সকালবেলা থেকেই ভারী মিষ্টি সানাই বাজছে। ভৈরবী রাগিণী যেন ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে বাতাসে। আষাঢ় মাস হলেও আজকের দিনটি বর্ষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন। কুঠিবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্র, সানাইয়ের সুরে তার বুকের মধ্যে যেন একটা কষ্টের অভিঘাত হচ্ছে। অনেক সময় অতি সুন্দরের মধ্যেই মিশে থাকে এই বোধ।
এ যাত্রায় রবীন্দ্রের সঙ্গী বা সঙ্গিনী কেউ নেই। কলকাতায় সম্প্রতি তাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়, গ্রাম সফরে এসে একাকিত্ব সে বেশ উপভোগ করে। এখানে যখন তখন কোনও অতিথি উপস্থিত হলৈ সে বিরক্তই হয়। দুদিন আগে পত্নী সহ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসেছিলেন, তাদের অ্যাপায়নে একটি বেলা বাজে খরচ হয়েছে। আবার এক এক সময় মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য মনটা লালায়িত হয়ে থাকে।
সাধারণ প্রজাদের জমিদারবাবুর কাছে আসতে দেওয়া হয় না, বরকন্দাজরা বাধা দেয়। অধিকাংশ প্রজাই অবশ্য ভয়ে কাছ ঘেঁষে না। আবার দু’চারজন এমনই সরল হয় যে নিয়মকানুন কিছুই বোঝে না। সোজা বজরায় উঠে আসে। রবীন্দ্র দেখতে পেলে বরকন্দাজদের নিবৃত্ত করে তাদের কাছে ডেকে নেয়। তারা অকপটে নিজেদের সুখদুঃখের কথা বলে। তারা যে ঠিক নালিশ জানাবার জন্য বা প্রতিকারের আশায় আসে, তাও নয়, সবই তারা নিয়তি বলে মেনে নেয়, শুধু এই দেবোপম দূরের মানুষটিকে নিজের কথা শুনিয়েই আনন্দ। কিছু কিছু বিচিত্র চরিত্রেরও দেখা পেয়েছে রবীন্দ্র। শিলাইদহতে একজন প্রায়ই আসে, সবাই তাকে বলে মৌলবি সাহেব। লোকটি পঞ্জাবি মুসলমান, আববি-ফারসি জানে। অতদুর থেকে এসে এই বাংলার এক গণ্ডগ্রামে কেন পড়ে আছে তা বোঝা দায়। লোকটি বেশ কথা বলে, কিছুক্ষণ ভাল লাগে, তার বকশকানি শেষ পর্যন্ত বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে যায়।
অছিমুদ্দি সরদার নামে আর একজনও বেশ গল্প জমায়। সে নাকি একজন কবিয়াল। কিন্তু তার কবিয়ালির চেয়ে উদ্ভট গল্পই বেশি উপভোগ্য। তারও একটা দোষ আছে, শেষের দিকে সে জমিদারির ম্যানেজার ও অন্যান্য আমলাদের সম্পর্কে নানান দোষের কথা সাতকাহন করে বলতে শুরু করে, তার ধারণা, এতে জমিদারবাবু খুশি হবেন।
রবীন্দ্র সবচেয়ে অবাক হয়েছিল শিলাইদহ পোস্ট অফিসের এক পিওনকে দেখে। চিঠির থলে পিঠে নিয়ে যাবার সময় সে আপন মনে গান করে। একদিন বজরার ছাদে বসে তার সেই গান শুনে রবীন্দ্র নিজেই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। লোকে বলে, ওর নাম গগন হরকরা, রবীন্দ্রের কাছে সে নিজে অবশ্য বলল, তার নাম গগনচন্দ্র দাম। সাধারণ এক অশিক্ষিত মানুষ, সে নিজে গান রচনা করে, নিজেই সুর দেয়। কী গভীর উপলব্ধির কথা সে সব গানের।
আমার মনের মানুষ যে রে, আমি কোথায় পাবো তারে
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশবিদেশে বেড়াই ঘুরে
কোথায় পাবো তারে…।
বাংলার গ্রামে-গঞ্জে এরকম কত সব মণি-মুক্তো ছড়িয়ে আছে। গগন হরকরার গান শুনতে শুনতে রবীন্দ্রর মনে হয়েছে, এই ধরনের সব লোকগীতি, মেয়েলি ছড়া, ব্রতকথা, মাঝিদের গান, এইসব সংগ্রহ করে রক্ষা করা দরকার। এই সবই তো আমাদের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।
সাজাদপুরে এসে এখনও তেমন কোনও আকর্ষণীয় মানুষের দেখা পাওয়া যায়নি। কদিন ঝড় বৃষ্টির জন্য বজরায় থাকা হয়নি। কুঠিবাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। নদীর ধার দিয়ে একা একা বেড়াবারও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে দুজন পাইক-লেঠেল যাবে পাহারা দিয়ে। রবীন্দ্র তা একেবারেই চায় না, কিন্তু ম্যানেজারমশাই জেদ ধরেছেন, জমিদারমশাইয়ের নিরাপত্তার জন্য এটা বিশেষ দরকার।
দুর, ওরকমভাবে বেড়িয়ে কোনও সুখ আছে নাকি?
আজ সকালে মনে হচ্ছে এবারে কলকাতা থেকে কারুকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভাল হত। শুধু বই পড়ে আর লেখালেখি করে ক্লান্ত লাগছে।
সিংহ দরজায় নহবত বসেছে, সানাই বাজছে সেখানে। কয়েকজন লোক গাঁদা ফুলের মালা গেঁথে টাঙাচ্ছে। মঙ্গলঘটের ওপর কচি কচি কলাগাছ কেটে এনে বসানো হচ্ছে সারি দিয়ে। ভেতরের বড় হল ঘরটিতে রঙিন কাগজের শিকলি। মেঝেতে পাতা হয়েছে বিভিন্ন রঙের সতরঞ্চি, মাদুর ও চট। মাঝখানে একটি কারুকার্যখচিত চেয়ার মখমল দিয়ে মোড়া। ঠিক যেন একটা সিংহাসন। আজ এখানে বিশেষ এক উৎসব, আজ পুণ্যাহ।
এর আগে শিলাইদহে বেশ কয়েকবার ঘুরে গেলেও সাজাদপুরে রবীন্দ্র এল এই প্রথম। কৈশোরে সে এসেছে জ্যোতিদাদার সঙ্গে, তখন ছিল খুবই ধুমধামের ব্যাপার। জ্যোতিদাদা অনেক লোক-লস্কর নিয়ে ঘুরতে ভালবাসতেন, যেমন সঙ্গে থাকত গানবাজনার দল, তেমনই ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জঙ্গলে শিকার করতে যেতেন। রবীন্দ্রের মনে আছে, একবার বাঘ শিকার করতে গিয়ে জ্যোতিদাদা তার হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছিলেন। ওঃ কী ভয় পেয়েছিল সে, ভাগ্যিস তার নিক্ষিপ্ত গুলি বাঘের চতুঃসীমানা দিয়েও যায়নি। নাঃ, শিকার-টিকার তার ধাতে পোয় না।
শিলাইদহ ও পাতিসরের জমিদারি দেবেন্দ্রনাথের নিজস্ব হলেও সাজাদপুর পড়েছে তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথের ভাগে। গিরীন্দ্রনাথের নাতি গগন, সমর, অবনরা নাবালক ছিল বলে দেবেন্দ্রনাথকেই দেখাশুনো করতে হত, এখন ওরা বড় হয়েছে, কিন্তু বড় অলস, বাড়িতে বসে ছবি আঁকে, বাইরে বেরুতেই চায় না। তাই রবীন্দ্রকেই ওদের বকলমে খাজনা আদায় করতে আসতে হয়েছে।
এক সময় ম্যানেজারমশাই এসে বললেন, হুজুর, এবার যে নীচে যেতে হয়। সকলে অপেক্ষা করে আছেন।
বেশ একখানা ঝলমলে পোশাক পরে নিতে হল রবীন্দ্রকে। চিনা সিল্কের কুতা-পাজামা। মাথায় পালক বসানো পাগড়ি, পায়ে নাগরা। এই বেশে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন জমিদারপ্রবর শ্রীল শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহিমার্ণব। রবীন্দ্রের মনে হতে লাগল, সে যেন একজন থিয়েটারের রাজা। রাজার ভূমিকায় অভিনয় করা তার অভ্যেস আছে।
বড় হলঘরটিতে সে প্রবেশ করার আগেই অনেকগুলি শাঁখ বেজে উঠল। শাঁখের আওয়াজে ঢেকে গেল সানাইয়ের সুর। প্রজারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে রইল। রবীন্দ্র এসে সেই নকল সিংহাসনে বসতেই সবাই ভূমিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম জানাল, কেউ কেউ সেই অবস্থা থেকে আর ওঠেই না।
অন্য জমিদারিতে এর পর পুরোহিত এসে বন্দনা করে, কিন্তু এই জমিদাররা ব্রাহ্ম, আগে পরম ব্রহ্মের অর্চনা, তারপর অন্য কিছু। একজন আচার্য এসে প্রার্থনা পরিচালনা করলেন কিছুক্ষণ, তারপর জমিদারবাবুকে পুষ্পমাল্য ও চন্দন দিয়ে অভিষিক্ত করলেন। এর পর ম্যানেজারবাবু শুরু করলেন জমিদারের গুণগান। অনেকদিন পর ঠাকুর বংশের কেউ এলেন সাজাদপুরে, এটা এখানকার প্রজাদের পক্ষে বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবতার মতন এই জমিদারের কৃপাধন দৃষ্টিপাতে প্রজাদের সমস্ত অমঙ্গল দূর হয়ে যাবে।
রবীন্দ্র মনে মনে ভাবছে, প্রজারা যাতে কোনও রাজা বা জমিদারকে তাদেরই মতন একজন সাধারণ মানুষ না মনে করে, সেইজন্য ভয় ও সম জাগাবার কিছু কিছু ব্যবস্থা চলে আসছে অনেক দিন ধরে। এই জন্যই রাজা-জমিদারদের নামগুলি খুব লম্বা লম্বা হয়, সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা। যতই গরম থাকুক, তবু জবরজং পোশাক পরতে হয় রাজাকে। তিনি উচ্চাসনে বসবেন। তিনি কথা বলবেন নীচের দিকে তাকিয়ে, প্রজাদের কথা বলতে হবে মুখ তুলে।
ম্যানেজার স্তুতি করে যাচ্ছে, রবীন্দ্র হাসছে ঠেটি টিপে। এরা কেউ জানে না। সে একজন নকল রাজা। ম্যানেজারবাবু তাকে দেবতা বানিয়ে দিয়েছে, আর রবীন্দ্র মনে মনে বলছে তার সদ্য রচিত কবিতার লাইন “খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে…” সে এখন খাঁচার পাখি!
বক্তৃতা শেষ করার পর ম্যানেজারবাবু রবীন্দ্রেব গলায় আর এক প্রস্থ মালা পরিয়ে প্রণাম করলেন ভূলুণ্ঠিত হয়ে। ম্যানেজারবাবুই এখানকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তিনিও যাঁকে এমনভাবে প্রণাম জানান, সেই জমিদার তা হলে কতখানি বড়।
এবার রবীন্দ্রকে প্রজাদের সম্বোধন করে ভাষণ দিতে হবে। যিনি স্বয়ং নাট্যকার ও অভিনেতা, তাঁর পক্ষে এই ভূমিকার্টি শক্ত কিছু নয়। সুললিত কণ্ঠে তিনি সমবেত প্রজ্ঞা ও আমলাবর্গকে আশীবাদ জানালেন।
এই উৎসবের দিনে প্রজাদের মধ্য থেকে বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে পুণ্যাহপাত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। জমিদার নিজের হাতে সেই পুণ্যাহপাত্র প্রজাকে প্রথম গলায় সোনার মালা পরিয়ে বরণ করবেন, তারপর তাকে নতুন কাপড়, এক হাঁড়ি দই, উত্তরীয়, একটি বড় মাছ, পান-তামাক ও ফলমূল ভর্তি একটি পাত্র—এইসব উপটৌকন দেবেন। জমিদার যে কতখানি প্রজানুরঞ্জক, তিনি যে শুধু গ্রহণ করেন না, প্রজাদেরও অনেক কিছু দেন, এ অনুষ্ঠান তারই প্রতীক।
এবারে যাকে পুণ্যাহপাত্র হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে, তিনি একজন মধ্যবয়স্ক মুসলমান। পোশাক-আশাক দেখে মনে হয় বেশ সম্রান্ত। ম্যানেজারের নির্দেশ মতন রবীন্দ্র তাঁকে চন্দনের ফোটা ও মালা পবাল, তারপর উপহার দ্রব্যগুলি তুলে দিল হাতে। সেসব মাথায় ঠেকিয়ে এক পাশে সরিয়ে রেখে প্রজাটি হঠাৎ শুয়ে পড়ে রবীন্দ্রের পা জড়িয়ে ধরলেন।
একজন বয়স্ক মানুষ পায়ে হাত দিচ্ছে বলে রবীন্দ্র স্বাভাবক সঙ্কোচেই পা সরিয়ে নিল। কিন্তু প্রজাটি তা মানরেন কেন। যুগ যুগ সঞ্চিত বিশ্বাসের এই প্রথা যে জমিদারের পা স্পর্শ করে প্রণাম জানাতে হয়। বুকে হেঁটে এগিয়ে এসে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন রবীন্দ্রের পায়ে। তারপর আচকানের জেল থেকে একটি মোহর ভর্তি পুঁটুলি রাখলেন সেখানে।
এরপর অন্য প্রজারা একে একে উঠে এসে নজরানা ও কর রেখে যেতে লাগল জমিদারের সামনে। রবীন্দ্র দেখল, বিভিন্ন জাতির প্রজাদের জন্য পৃথক বসার ব্যবস্থা। ব্রাহ্মণদের দেওয়া হয়েছে ধপধপে সাদা চাদর বেছানো মাদুর। হিন্দু আমলা ও মহাজনদের জন্য পাতা হয়েছে রঙিন সতরঞ্চি, আর সাধারণ প্রজা, যাদের অধিকাংশই মুসলমান, তাদের জন্য চট্ট। তাও হিন্দু ও মুসলমানদের দুদিকে।
একঘেয়েমি ও ক্লান্তি লাগলেও রবীন্দ্রের উঠে যাবার উপায় নেই। প্রজারা টাকা-পয়সা দিচ্ছে, এই জন্যই তো তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
সাজাদপুর থেকে আর দু দিন পরেই রবীন্দ্র ভেসে পড়ল শিলাইদহের দিকে। সেখানে অনেক কাজ বাকি আছে। সাজাদপুরে প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষের সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল, সেই জন্যই রবীন্দ্রকে তড়িঘড়ি করে এখানে আসতে হয়। কিন্তু সেরকম কোনও অসন্তোষের চিহ্নই দেখা গেল না। আপাতত সব কিছুই ঠিকঠাক, প্রজারাও শান্ত, ম্যানেজার ও আমলাবর্গও খুশি, যথেষ্ট কর আদায় হয়েছে বলে দেবেন্দ্রনাথও সন্তুষ্ট হবেন।
ফেরার পথে সে দু’খানা ছোট গল্প লিখে ফেলল। এখন গল্প বেশ এসে যাচ্ছে কলমের ডগায়। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য হিতবাদী’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করায় রবি সেখানে প্রতি সংখ্যায় একটি করে গল্প লিখতে শুরু করেছিল। ভালই লাগছিল তার গল্পগুলি লিখতে, হঠাৎ একদিন কৃষ্ণকমল বললেন, রবিবাবু আপনার গল্পগুলি কিছু গুরুপাক হয়ে যাচ্ছে, সাধারণ পাঠকরা ঠিক নিতে পারছে না। আপনার কাছ থেকে কিছু লঘু রকমের রচনা চাই। এ কথা শুনে রবীন্দ্রর রাগ ধরে গিয়েছিল। সম্পাদকের হুকুম মতন ফরমায়েশি লেখা লিখতে হবে নাকি? হিতবাদীতে লেখাই সে বন্ধ করে দিল।
কিছুদিন পরেই ঠাকুরবাড়ি থেকে আর একটি নতুন পত্রিকা বেরুতে শুরু করছে। সাধনা। নিজেদের একটা পত্রিকা না থাকলে চলে না। বড় দাদার দুই ছেলে সুধীন্দ্র ও নীতীন্দ্র নিয়েছে এই কাগজের ভার, কিন্তু রবীন্দ্রকেই সম্পাদনার ব্যাপারটা দেখে দিতে হয়, তার নিজের লেখাই থাকে সর্বাধিক। সাধনার জন্য আবার তার ছোট গল্প লেখা শুরু হয়েছে। রবীন্দ্রর বড় মেয়ে বেলী এখন বেশ টরটর করে কথা বলে, পৃথিবী সম্পর্কে তার হাজার রকম প্রশ্ন, তার কথা ভাবতে ভাবতে মাথায় এসে গেল ‘কাবুলিওয়ালা’ নামে একটা গল্প।
লেখার ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্র অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিছু কিছু প্রজার মুখ মনে পড়ে। সরল, পরিশ্রমী মানুষ, তারা ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলায়, কিন্তু তাদের দারিদ্র্য কোনও দিন ঘোচ না। কিন্তু মহাজন, আমলা, জমিদাররা তো দিব্যি আরামে থাকে। যাদের শ্রমে জমিতে ফসল ফলে, তাদের বঞ্চিত করে এই জমিদারির ব্যবসা কী করে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে? এই প্রশ্ন তার মনে বারবার জাগে, কিন্তু সমাধানের উত্তর খুঁজে পায় না। সে নিজে এখনও জমিদার নয়, পিতার এবং খুড়তুতো ভাইদের প্রতিনিধি মাত্র। কিন্তু সে যদি কোনও জমিদারির মালিক হত, তা হলে নিজের স্বত্ব ত্যাগ করলেও কি কোনও সুরাহা হত! অধিকাংশ গরিব প্রজারই নিজস্ব জমি ধরে রাখার ক্ষমতা নেই, তারা মহাজনের খপ্পরে পড়বে। ইংরেজ সরকারও প্রতিটি প্রজার কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে পারবে না, জমিদারদের কাছ থেকে থোক টাকা পেলেই তাদের সুবিধে, সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই ইংরেজ সরকার এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবে।
পদ্মা নদী ধরে এসে গোরাই নদীর মুখটায় ঢুকে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এই নামটির বেশ মজা ইতিহাস আছে। বিরাহিমপুর পরগনার এই গ্রামটির নাম এককালে ছিল খোরসেদপুর। খোরসেদ নামে এক ফকির এসে আস্তানা গেড়েছিলেন এখানে। তারপর সেই ফকিরের নাম মুছে গেল সাহেবি আমলে। দুই নদীর সঙ্গমস্থলে এককালে নীলকর সাহেবরা একটা কুঠি স্থাপন করেছিল। সেই নীলকরদের মধ্যে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাহেবের নাম ছিল শেলী, ওই নামে যে এক কোমল হৃদয়, স্বপ্নময় কবি ছিলেন তা এই সাহেবটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই। সেই অত্যাচারী নীলকরের নামে এই জায়গার নতুন নাম হল শেলীর দহ, তারপর লোকের জিভে একটু একটু করে বদলে গিয়ে এখন শিলাইদহ।
নীলকরদের সেই পরিত্যক্ত কুঠিবাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। রবীন্দ্রের মনে আছে, কৈশোর বয়েসে এখানে সদলবলে বেড়াতে এসে তারা সেই বিশাল কুঠিবাড়িটিতেই থেকেছে। বাড়িটি একেবারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল, সম্প্রতি সেটিকে একেবারে ভেঙে ফেলে তৈরি হয়েছে নতুন কুঠিবাড়ি। কয়া, জানিপুর ও কুমারখালি, কাছাকাছি এই তিনটি মহাল, আর একটু দূরে পাষ্টি মহাল, এই সব কটি মহালের জমিদারির কাজ পরিচালনা করা হয় শিলাইদহের কুঠিবাড়ি থেকে।
সাজাদপুরের থেকে অনেক বেশি আড়ম্বরের সঙ্গে এখানে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কুঠিবাড়িতে না উঠে রবীন্দ্র এখানে বজরাতেই রয়ে গেল। বজরাকে সে বলে শুধু বোট, বজরা শব্দটা কেমন যেন গেরেমভারি শোনায়। বোটটা রইল পদ্মার বুকে নোঙর করে। বর্ষায় পদ্মার যে ভুবনমোহন রূপ, তা ছেড়ে ইটকাঠের বাড়িতে থাকতে কার মন চায়। ইন্দিরাকে সে চিঠি লেখে, পদ্মকে আমি বড় ভালবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত, আমার তেমনি পদ্মা।
এখানে আর সানাই নয়, কয়েকটি বন্দুকের শব্দে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হল। তারপর হুলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনি। নদীর পাড় থেকে কুঠিবাড়ি পর্যন্ত স্থাপন করা হয়েছে কয়েকটি অস্থায়ী ফটক। চতুর্দিকে ফুলের ছড়াছড়ি। দু দিকে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কর্মচারীরা। নায়েবমশাই যখন রবীন্দ্রকে ডাকতে এল, তাকে অবাক করে সে বেরিয়ে এল শুধু শুভ্র ধুতি ও আচকান পরে, কাঁধের ওপর একটি মুগার চাদর। মাথায় পাগড়ি নেই, পায়ে নাগরার বদলে তালতলার চটি। আমলারা ভুরু তুলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল, এমন সাধারণ বেশে হুজুর যাবেন প্রজাদের সামনে?
সামান্যই পথ, তবু পালকি মজুত আছে। নায়েব রবীন্দ্রকে সেই পালকিতে ওঠার ইঙ্গিত করতেই রবীন্দ্র বলল যে সে হেঁটেই যাবে।
দরবার কক্ষের দ্বারের সামনে এসে সে থমকে দাঁড়াল।
ভেতরে বসার ব্যবস্থায় হিন্দু মুসলমানদের স্পষ্ট ভাগ রয়েছে। চাদব ঢাকা সতরঞ্চির ওপর হিন্দুরা, সামনের দিকে ব্রাহ্মণদের আসন। আর মুসলমানদের জন্য সতরঞ্চি থাকলেও তার ওপর চাদর পাতা নেই। নায়েব গোমস্তাদের জন্য বেশ কয়েকটি চেয়ার পাতা, মাঝখানে জমিদার হুজুরের সত্যিকারের সিংহাসন।
রবীন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মনে পড়ল, অছিমদ্দি সরদারের একটা কথা। সে একদিন বলেছিল, হুজুর, সাহাদের হাত থিকা শ্যাখদের বাঁচান। কথাটা প্রথমে বুঝতে পারেনি রবীন্দ্র। এখানে সব মুসলমানদের শেখ বলে। পরস্পর সম্বোধন করে ও ‘শ্যাখের পো’, এইভাবে। অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান বা শেখ। ইদানীং হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কটি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে এসেছে। সারা ভারতের অধিকাংশ মুসলমান নেতা এখন হিন্দুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসে যোগদানের বিরোধী। গ্রাম বাংলাতেও কি সেই প্রভাব ছড়িয়েছে?
অছিমদ্দি সরদার অবশ্য সেভাবে কথাটা বলেনি। মুসলমান অর্থাৎ শেখরা প্রায় সবাই গরিব। হিন্দুদের মধ্যেও গবিব আছে, তবে তাদের মধ্যে সাহা সম্প্রদায় মহাজনী করে, তারা ধনবান, গরিবদের ভমি-গয়নাপত্র-হাল-গরু বন্ধক রেখে তারা ফুলেফেঁপে ওঠে। জমিদারি কাচারির ম্যানেজার থেকে সমস্ত আমলাই হিন্দু, সুতরাং শোষক ও উৎপীড়ক বলতে কিছু হিন্দুর মুখই মনে পড়ে। এই অবস্থা কি যুগ যুগ ধরে চলতে পারে? হিন্দুদের মধ্যে যারা শিক্ষিত এবং শুভবোধসম্পন্ন, তাদেরও এই দিকটা চোখে পড়ে না?
সাজাদপুরে রবীন্দ্র যা মুখ ফুটে বলতে পারেনি, এখানে সে আর দ্বিধা করে না। এখানে তার কর্তৃত্ব অনেক বেশি।
রবীন্দ্র ম্যানেজাবকে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, প্রজাদের এ রকম ভিন্ন ভিন্ন বসার ব্যবস্থা কেন?
ম্যানেজার বলল, এই রকমই তো চলে আসছে হুজুর। কারা আগে প্রণামী দেবে, কারা পরে দেবে, সেইভাবে বসানো হয়েছে।
রবীন্দ্র বলল, মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক বেশি, তারা পরে দেবে কেন? তাদের বসার জায়গায় চাদর পাতা নেই কেন?
ম্যানেজার বলল, এটাই প্রথা হুজুর। সমাজে যার যে রকম স্থান। ব্রাহ্মণের স্থান সর্বাগ্রে, তারপর কায়স্থরা–
রবীন্দ্র বলল, প্রথা মাত্রই ভাল নয়, অনেক প্রথা যুগ অনুযায়ী বদলাতে হয়। এ সব তুলে ফেলুন। সবাই এক সঙ্গে মিলেমিশে বসবে।
ম্যানেজার হেসে বলল, তা কি হয় হুজুর! ওতে দুষ্ট প্রজারা লাই পেয়ে যাবে। আপনি চলুন হুজুর, সিংহাসনে গিয়ে বসন, শুভ মুহূর্ত পার হয়ে যাচ্ছে।
রবীন্দ্র বলল, আজ পুণ্যাহ, আজ প্রজাদের সঙ্গে মিলনের উৎসব। এমন বিভেদের ব্যবস্থা আমি মেনে নিতে পারি না। আমার ওই সিংহাসনও সরিয়ে নিন। আমি সবাইকার মাঝে গিয়ে বসব।
ম্যানেজার জিভ কেটে বলল, কী যে বলেন! তা আবার হয় নাকি? কর্তাদের আমল থেকে যা চলে আসছে, তা কখনও বদলানো যায়? শুধু শুধু দেরি হয়ে যাচ্ছে।
রবীন্দ্র ম্যানেজারের দিকে চেয়ে রইল। ম্যানেজার চোখ সরাল না। সে জানে যে কর্তার এই কনিষ্ঠ পুত্রটি কবিতা-টবিতা লেখে, যাত্রার দলের ছেলেদের মতন গান গায়। ঘোড়ায় চড়ে না, শিকার করতে যায় না, বাঈজী নাচায় না, এমনকী মদ পর্যন্ত খায় না। স্বভাবটা মেয়েলি ধরনের। এখন এর মাথায় একটা হুজুগ চেপেছে, তাকে কোনওমতেই প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। জমিদার চলে গেলে তারপর জমিদারি চালাবার সব দায়িত্ব নিতে হবে তো ম্যানেজারকেই।
প্রজারাও সবাই উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে। ম্যানেজারের সঙ্গে জমিদারতনয়ের নিচু গলায় কী আলোচনা হচ্ছে, তা তারা বুঝতেই পারছে না।
রবীন্দ্র গলা একটুও উঁচু না করে বলল, যতদিন ধরেই এ প্রথা চলে আসুক, আমার আদেশ, এটা বদল করতে হবে। জাতিভেদ আমি মানব না। সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে বসবে এ বছর থেকে।
ম্যানেজার এবার দৃঢ় গলায় বলল, জমিদারের ছকুম না পেলে কিছুই বদলাতে পারব না আমরা। এরকমই ব্যবস্থা চলবে।
রবীন্দ্র বলল, এখানে আমিই জমিদার। আমার আদেশই চুড়ান্ত। আপনি যদি মানতে না পারেন, তা হলে আপনাকেই সরে যেতে হবে।
ম্যানেজার বলল, শুধু আমি কেন, অন্য কর্মচারীরাও কেউ এ আদেশ মানতে পারবে না। তারা পদত্যাগ করবে।
রবীন্দ্র বলল, তা হলে আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, অন্য কর্মচারীরাও সরে যান এখান থেকে। কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে যে খাজাঞ্চি এসেছে, সে-ই হিসেবপত্র রাখবে।
রবীন্দ্র এবার এগিয়ে গিয়ে তার জন্য রক্ষিত ভারী সিংহাসনটা দু হাতে তুলে সরিয়ে দিল এক পাশে। তারপর প্রজাদের দিকে ফিরে বলল, এই পূণ্যাহ আমাদের সকলের শুভ মিলনের দিন। এই মিলন উৎসবে পরস্পরের মধ্যে কোনও ভেদ থাকতে পারে না। পৃথক আসন সব সরিয়ে দেওয়া হোক। আমিও অন্যদের সঙ্গে একাসনে বসব।
প্রজাদের মধ্যে বিভ্রান্তির কোলাহল শুরু হয়ে গেল। এই কথার তাৎপর্য প্রথমে বুঝতেই পারল না অনেকে। ব্রাহ্মণরা রাগারাগি শুরু করে দিল। অন্য দিকে মুসলমানরাও বলল, আমরা তো বেশ বসে আছি, অসুবিধা তো কিছু নাই।
প্রথা এমনই এক জিনিস যে তার ভাল-মন্দ বিচার করার ইচ্ছেটাই অনেকের মনে জাগে না। যে কোনও পরিবর্তনেই অনেকে ভয় পায়।
ছেলেছোকরারা বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠল। তারা চেয়ার ও সতরঞ্চি সব সরিয়ে ঢালাও ফরাস পেতে দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, যার যেখানে ইচ্ছে বসে পড়ো, হুজুর বলেছেন, তাঁর কাছে প্রজাদের কোনও জাত নেই। সবাই সমান।
সকলের স্থান সঙ্কুলান হবার পর রবীন্দ্রের নির্দেশে শুরু হল মাঙ্গলিক পাঠ। আচার-অনুষ্ঠান যেমন চলার চলতে লাগল। ম্যানেজার সমেত অনেক কর্মচারীই দূরে সরে দাঁড়িয়ে ছিল, এক সময় দু’তিনজন এসে বসে পড়ল পেছনের দিকে। রবীন্দ্র তাদের দিকে চেয়ে সম্মিতভাবে হেসে বলল, অন্যরাও যদি এখন আসতে চায় আমার আপত্তি নেই। ম্যানেজারবাবুকেও আমি পদত্যাগ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি।
এই কবি-কবি ধরনের ছোকরাটির যে এতখানি মনের জোর থাকবে তা ম্যানেজার কল্পনাও করেনি। সে হার স্বীকার করতে বাধা হল। সমস্ত অনুষ্ঠান চুকে গেল নির্বিঘ্নে।
এর পর রবীন্দ্র অনেক কিছুই সহজ করে দিল। সে এখন একলা বেড়াতে যায়, কোনও বরকন্দাজকে পাহারাদার হিসেবে সঙ্গে নেয় না। গ্রামের প্রজাদের নিজে কাছে ডেকে এনে কথা বলে। অনেকে অবশ্য ডাকলেও আসে না। একদিন সে দেখল, নদীর ধারে কতকগুলি বালক হা-ডু-ডু খেলছে। অনেকদিন সে এই খেলাটি দেখেনি, তার ভারি ভাল লাগল, ছেলেগুলির সঙ্গে ভাব করার জন্য সে হাতছানি দিয়ে ডাকল তাদের। ছেলেরা ভাবল, তাদের বুঝি কোনও অপরাধ হয়েছে, খেলা ভেঙে তারা ছুটে পালাল। সকলের ভয় ভাঙাতে অনেক সময় লাগবে।
রাত্তিরে অনেকক্ষণ জেগে থাকে রবীন্দ্র। মাল্লা-পাহারাদাররা ঘুমিয়ে পড়লেও লণ্ঠন জ্বেলে সে ইন্দিরাকে চিঠি লেখে। কখনও ছাদের ওপর উঠে বিশাল আকাশের নীচে দাঁড়ায়। বর্ষায় পদ্মা নদীর যৌবন যেন প্রতিদিনই বিকশিত হচ্ছে। রাত্রির নদী ফিসফিস করে কত কথা বলে। এই নদীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে যায় এক রহস্যময়ী রমণীর কথা, আজই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নদীর ধারে। সে একজন গেরুয়া পরা যুবতী। বেশ খাজা মাজা শরীর, কোথা থেকে সে এই গ্রামে এসেছ কেউ জানে না। বসাকদের একটা এঁদো পুকুরের ধারে একটা তমাল গাছের নীচে কুটির বেঁধে একলা একলা থাকে। তার কোঁচরে সব সময় বাঁধা থাকে অনেক ফুল। তার নাম সর্বখেপী, কেউ কেউ বলে সে নাকি জাদু জানে। নায়েবমশাইও রবীন্দ্রকে সাবধান করে দিয়েছে, বাবুমশাই, ওর চোখের দিকে তাকাবেন না। তা হলে আর কলকাতায় ফিরতে পারবেন না। সে কথা শুনে রবীন্দ্রর হাসি পেয়েছিল।
সকালবেলা নদীর ঘাটে সেই সর্বখেপীর সঙ্গে রবীন্দ্রের মুখোমুখি দেখা। থমকে দাঁড়িয়ে সর্বখেপী এমন একটা ভাব করল, যেন সে রবীন্দ্ৰকৈ বহুদিন চেনে। কোঁচড় থেকে এক মুঠো গন্ধরাজ ফুল তুলে রবীন্দ্রের হাতে দিতে দিতে বলল, গৌর, কেমন আছ গৌর। তারপর সে রবীন্দ্রের গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, গৌরসুন্দর আমার, পরাণের নিধি…। সেই কোমল হাতের স্পর্শে রবীন্দ্রের শরীর শিরশির করছিল, এ গ্রামের কেউ তাকে এমনভাবে ছুঁতে সাহস করবে না! সর্বখেপী একটা গানও গেয়েছিল।
মোরে
যে বোললা সে বোলো সখি
সে রূপ নিরখি নারি নিবারিতে
মজিল যুগল আঁখি
ও না তনুখানি কেবা সিরজিল
কি মধু মাখিয়া তায়…
গানটা কি সর্বখেপীর নিজের রচনা, না আগেকার কোনও পদকর্তার মিলিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু সুরটা অপূর্ব। আজ সারাদিন নিজের লেখার সময়ও রবীন্দ্র মাঝে মাঝে এই গানটা গুনগুন করেছে। সুরটা গেঁথে গেছে তার মনে।
অনেক বাতেও কিছু কিছু নৌকো যায়। দূরে দেখা যায় বিন্দু বিন্দু আলো। আকাশে চাঁদ ও মেঘেব লুকোচুরি চলেছে, স্নিগ্ধ বাতাস নিয়ে আসে রাত্রে ফোটা ফুলের সুগন্ধ, চলন্ত নৌকোয় শোনা যায় রাত জাগা মাঝিদের গান! একটা নৌকো এ দিকেই আসছে, রবীন্দ্র উৎকর্ণ হয়ে গানের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। পাশ দিয়ে যাবার সময় বোঝা গেল কিছুটা :
যোবতী
ক্যান বা কর মনভারি
পাবনা থেকে এনে দেবো
টাকা দামের মোটরি…
এ যে চিরকালের তৃষিত বিরহীর গান। কোন দুর গ্রামে রয়ে গেল স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা, সওদাগর কবে ফিরবে তার ঠিক নেই। সেই অভিমানিনীকে সান্ত্বনা দেবার জন্য প্রেমিকটি পাবনা থেকে এক টাকা দামের মোটরি কিনে আনবে। মোটরিটা কী বস্তু? কী সেই দুর্লভ জিনিস পাবনায় পাওয়া যায়, মাত্র এক টাকা দাম, যা পেলে প্রেমিকার মুখে হাসি ফুটবে?
রবীন্দ্র দ্রুত কামরায় ফিরে গিয়ে নিজের খাতায় গানটি লিখে রাখল। এমন সরল হৃদয় ভরা গান অনেক কবিই লিখতে পারবে না। এই গান কেন নির্জন রাত্রির নদীবক্ষে হারিয়ে যাবে? রবীন্দ্র ঠিক করল, গগন হরকরাকে ডেকে তার গানগুলিও সে লিখে নেবে।
জমিদারি পরিদর্শনে আসার প্রধান উদ্দেশ্য যতদূর সম্ভব কর আদায় করে তহবিল বোঝাই করা। এ বারে আদায়-পত্ৰ ভালই হয়েছে, দেবেন্দ্রনাথ খুশি হবেন। এ ছাড়াও, গ্রামবাংলার কত গান, কত মানুষের মুখ, জীবনের কত বিচিত্র বিকাশ, প্রকৃতি ও মানুষের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের অনুভব রবীন্দ্র যে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বোঝাই করে নিয়ে চলেছে, সেই সম্পদের পরিমাপ করবে কে?