শুরুটা ভালো ছিল, কিন্তু আমার কাছে শেষটাই বরং দামি। নৌকায় তুলতে ও খাড়ি পেরনোর পর নৌকা থেকে গাড়িতে উঠিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হলো বটে; তবু পাওনার তুলনায় সেটুকুন কিছুই নয়।
বন্ধুরা অভিসারী, আর আমি কামরার ভেতর বালিশে হেলান দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে কাত হয়ে আছি। জানালা খোলা। দেখা যাচ্ছে নগরীর লাল নীল সবুজ আলোকমালা। হঠাৎ গুপ্তধন পেয়ে যাওয়ার পর কৃপণের মতো আমি শিহরিত, সতর্ক তাই বাইরের ঠিকরানো হাতছানি চোখে পড়লেও ভেতরে কোনো সাড়া তুলছে না। বরং আমি ক্রমে নিজের ভাবনার রেশমি জালের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছি।
জীবন বারবার নিজেকে আমার কাছে অনাবৃত করে ধরেছে এটাই আশ্চর্য। আচমকা একেকবার পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে অঙুলি-সঙ্কেত করেছে ভেতরের দিকে, এই রঙ্গমঞ্চ। তার পাশেই সাজঘর। সেখানে আসলরূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিনেতা অভিনেত্রী, কোনো প্রসাধন নেই আবরণ নেই। বাইরে যাদের চেনা যায় না সেখানে তারাই নিজ নিজ বেশে প্রতিষ্ঠিত। দেখতে ভয় লাগে কিন্তু একবার দেখতে শিখলে তার ভয়ঙ্কর নেশাই পেয়ে বসে।
হয়তো কিছু চাওয়ার আছে আমার কাছে, জীবনের, নইলে ধরা দেবার জন্য কেন এত আগ্রহ?
অনেকদিন রাত্রে একলা বিছানায় শুয়ে আমি ভেবেছি কেন এমন হলোর হঠাৎ কানে বেজেছে কার কণ্ঠস্বর। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে জহু যেন বলছে জাহেদ আমার ছবিটা শেষ করবি না?
চমকে উঠে একদৌড়ে ওখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই, হাস্নাহেনার ঝাড়গুলো শুধু হাওয়ায় কাঁপছে।
জহুর ছবি আর শেষ করতে পারিনি, মনের কোণায় স্কেচটুকু শুধু জমা আছে; যেদিন শেষ করতে পারব সেদিন বুঝব শিল্পী হয়েছি। আরও কত কাহিনি! কিছু স্বাভাবিক, কিন্তু বেশির ভাগই আকস্মিক।
আজও তাই হলো। জোবেদা খালার স্বামী যে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন এবং বহুকাল পর ফিরে এসে নিজের ভাঙা ভিটেটার ওপর পড়ে গত বছর মরেছেন তা আমি বলিনি, তবু সে কি প্রতিক্রিয়া! একদম অবিশ্বাস্য। প্রথম যৌবনের সেই একজন সত্যইকি ছিল তার প্রেমপাত্র? যদি ছিল তবে কেন বেছে নিলেন অন্যপথ?
নিজের উর্ধ্বে উঠতে পারাটাই শিল্পী ব্যক্তিত্বের সর্বপ্রথম অঙ্গীকার এবং সে আমারও লক্ষ্য। এখন শেষ দুঃখ শেষ সুখের সামনে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ি না এতেই আমি সন্তুষ্ট।
বসুন্ধরা ছবিটা প্রথম প্রদর্শনেই সমালোচক ও সমঝদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এতে আমি সুখী। প্রতিষ্ঠা ও যশ শিল্পী মাত্রেরই কাম্য এবং আমিও সেটা চাই। কিন্তু তবু বলতে পারি, ছবিটা হলঘরের এক কোণায় অনাদরে পড়ে থাকলেও খুব দুঃখিত হতাম না। কারণ আমার যা আসল পাওনা, তা পেয়ে গেছি অনেক আগেই। সে হলো। আনন্দ, সৃষ্টির আনন্দ। সে আনন্দ, আনন্দের চেয়ে তীব্র বেদনার চেয়ে গভীর মৃত্যুর চেয়ে অনন্ত এবং তখন আমিই তো নায়ক ছিলাম না? হ্যাঁ তাই, আমি ছিলাম না তখন। আমি ছিলাম ইজেলে সাঁটানো ক্যানভাসের সামনে, রং সাজিয়ে তুলি হাতে, নিঘুম সারারাত; কিন্তু রচনা করেছিল সে আর একজন। বর্ষণ, বৃষ্টি বিদ্যুৎ, ঝটিকার মেঘে আকাশটা ঝিম ধরে ছিল, যখন ভেঙে পড়ল পরিচিত আমিকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। অন্যজন হলো সৃষ্টির সারথি। আমার দেহের অভ্যন্তরেই জেগেছিল সে বিধাতার মতো, অচেনা রহস্যময় আমার হাত দিয়ে ক্যানভাসের ওপর কাজ করে চলে গেছে। তাকে চিনি না, কিন্তু তবু মনে হয় সে-ই তো জেগেছিল রাফেল দা ভিঞ্চি মাইকেল এঞ্জেলার মাঝে, গগাঁ রেনোয়া পিকাসোর আত্মায়?
এজন্যই বুঝি রাতটা অপরূপ হয়ে এসেছিল। আমাদের ছোট ঘরটার জানালার পাশে একটি নারকেল গাছ চিরল-চিরল পাতায় ছাওয়া, শেষ রাত্রে তার ফাঁকে এসে পড়ল হলুদ চাঁদের আলো। দূরে কোথায় যেন গান হচ্ছিল। এমপ্লিফায়ারের সেই সুর তরঙ্গ দমকা হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছিল। সে যেন এক সুরলোকের অশ্রুতপূর্ব মধুর রাগিণী।
হঠাৎ কেন জানি তুলিটা হাতে নিয়েই একবার উঠলাম। মাঝের কপাটটা ঠেলে চুপি চুপি শোবার কামরায় ঢুকি। হা ছবি ঘুমোচ্ছে তার কোলের কাছে টুলটুল। হাওয়া আর চাঁদ যেন মিতালি পাতিয়েছে। একজন জানালার পর্দা উঠিয়ে ধরে অন্যজন বুলিয়ে যায় মায়াবী হাতের ছোঁয়া আশ্চর্য সুন্দর। মা ও শিশু এই তো বসুন্ধরা, দুঃখে দুর্ভিক্ষে দারিদ্রে ছিন্নভিন্ন কিন্তু তবু মরে না; তার স্নিগ্ধ শান্ত চোখের চাওয়ায় যুদ্ধের শিবির ভেঙে পড়ে। তার খুশির হাতছানিতে দোলে ধান গম ভুট্টার ক্ষেত-সোনালি খামার নদীর তরঙ্গধারা।
আমি তন্ময় হয়ে দেখছি, এত পবিত্র এই দৃশ্য ওর কপালে একটু চুমু খেতেও সাহস হলো না।
প্রশংসিত হয়েছে এবং বাজার অনুযায়ী দামও কম পায়নি, যদিও কাজের দাম বলতে আমি বুঝি অন্য কিছু। কিন্তু তবু কথা থাকে। সমালোচকরা দেখেছেন কমপোজিশন রং আয়তন মাত্রা বিভাগ, বক্তব্য চোখে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস লাগিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এবং তারা ভুল করেন নি। কিন্তু একটি কথা তারা কখনো জানতে পারবেন না, সে হলো এই ছবির জন্মকাহিনি। নিজের উর্ধ্বে যখন উঠি তখন বরং বলি জীবনই নিজেকে প্রকাশ করেছে, আমি নিমিত্ত মাত্র।
লুভ্যর ন্যাশনাল গ্যালারি, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট কোনদিন যেখানেই এই ছবি যাক না কোনদিন এও কেউ জানতে পারবে না যে আমার ছবিই এই ছবির জন্মদাত্রী। কারণ চতুষ্কোণ কাম্বিসের স্থানটুকুর মধ্যে একজন মানবীর মূর্তি প্রকাশ পেয়েছে, মূর্তি হিসেবে সে বিশেষ কিছু নয় এবং অনাগতকালে আমিও থাকব না, ছবিও থাকবে না থাকবে না টুলটুলও। হয়তো থাকবে শুধু এই ছবি যার নাম মাদার আর্থ, বসুন্ধরা, ক্যাটালগে তালিকাবদ্ধ তেইশ নম্বর তৈলচিত্র।
অন্তত এই ছবিটির বেলায় সামান্য সময়ের জন্য হলেও জীবন আমাকে শিল্পী করেছিল। আর ছবিই সেই জীবন।
অথচ যেদিন প্রথম দেখা হলো তখন বুঝতেও পারিনি এই হাবা মেয়েটিই আমাকে নিয়ে যাবে ঝরনার উৎসবের কাছে।
দোকানে রঙের টিউবগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। একজন লোক প্রবেশ করলেন হঠাৎ। ছেঁড়া শার্ট ময়লা পায়জামা, পায়ে টায়ারের স্যাণ্ডেল। গাল আর চোখজোড়া গর্তে ঢুকে গেছে। আ-ছাঁটা চুল ও খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফে বিপর্যস্ত চেহারা।
একটা কাজ পেয়ে গেছি, দুটো রং দিতেই হবে হোসেন সাব, ব্লু আর রেড। বিকেলের মধ্যে কাজটা সেরে সন্ধ্যায় টাকা নিয়ে রাত দশটার আগেই রঙের দামটা দিয়ে যাব। হঠাৎ আমার দিকে নজর পড়তেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও ছবি আঁক নাকি হে?
জানা নেই শোনা নেই একেবারে তুমি সম্বোধন! বয়সে না-হয় একটু ছোটই হবো কিন্তু ভদ্রতা বলে একটা জিনিশ তো আছে? তবু ঝগড়া করা বৃথা। বললাম, এই কিছু কিছু।
খাসা জবাব। কিন্তু জানো হোড়াই হোক বেশিই হোক সেই একই ব্যাপার! বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজা! চুরিচামারিরও একটা দাম আছে, কিন্তু ছবি আঁকার নয়।
নাম বলতেই শো-কেসের ওপর থেকে আমার হাতটা টেনে নিয়ে করমর্দন করলেন। লোকটা খ্যাপা নাকি?
জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে চেনেন আপনি?
কিছুটা! স্কুলের গত একজিবিশনে ছাত্রদের মধ্যে তোমার কাজই আমার সবচে ভালো লেগেছে, তোমার কম্পোজিশন আর ডাইমেনশন জ্ঞান চমৎকার, ড্রয়িং ভালো রং এখনো বোঝনি তবে আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। একটানা কথাগুলো বলার পর দোকানির চোখের সামনেই দুটো টিউব তুলে নিয়ে বললেন, চল একটু তোমার সঙ্গে কথা আছে!
ছবির দাদা জামিলের সঙ্গে এই ভাবেই পরিচয়। প্রথম দিনেই গলির ভিতরে তার ভাঙাচোরা বাসার অন্দরে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুকামরার বাড়ি ইট সুরকি ভেঙে পড়েছে
কেমন স্যাঁতসেঁতে, একটি ঘর কিছু বড় আরেকটি ছোট। সেটার মধ্যে তার স্টুডিও তার একধারে ছোট্ট একটা চৌকি! রাত্রে হয়তো থাকে কেউ।
স্টুডিওটা মূর্তিমান জঙ্গল। ফ্রেম রং কালি তুলি কাগজ বিড়ির টুকরো বিজ্ঞাপনের ছবি গাদাগাদি ছড়াছড়ি। ঘরটা বছরেও একবার গুছানো হয় কিনা সন্দেহ। গুছিয়ে দেয়ার কেউ নেই এমন নয় তবে পরে জানতে পেরেছিলাম। জামিলই তা করতে দেন না। পরিপাটি দেখলেই নাকি প্রায় পাগল হয়ে যান এবং হাতের কাছে যা পান তাই নিয়ে মারতে আসেন।
ছবি! ছবি! স্টুডিও ঘরে ঢুকেই জামিল ডাক দিলেন, একটা প্যালেট টেনে নিয়ে আমাকে বললেন, একটু ধরো।
তখন হালকা সবুজ রঙের সস্তা শাড়ি পড়া আলুথালু বেশ একটি মেয়ে চৌকাঠে পা দিচ্ছিল কিন্তু আমাকে দেখতে পেয়েই আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
লজ্জা পাচ্ছিস কেন রে! এদিকে আয় পরিচয় করিয়ে দিই, জাহেদুল ইসলাম, আর্ট স্কুলের ফাইনাল ইয়ারের ফার্স্ট বয়, খুব ভালো ছেলে!
কিন্তু ছবি আড়াল ছেড়ে এলো না। আমি ওর মনটা যেন বুঝতে পারলাম, বললাম, ঠিক আছে আস্তে আস্তে পরিচয় হবে।
জামিল এটা সেটা নাড়াচাড়া নিয়ে ব্যস্ত, কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ছবি! চুলায় আগুন আছে রে?
না! মিষ্টি গলার ছোট্ট একটা শব্দ।
আগুন জ্বালাতে অসুবিধে হবে?
না।
তাহলে আমাদের দুকাপ চা দে না! জামিলের কথা বলার ভঙ্গিটা লক্ষ্য করার মতো, যেন দীন হীনের কাতর প্রার্থনা। ছবি দরজার কাছে থেকে চলে গেলে আমাকে বললেন, কিছু মনে করো না ভাই জাহেদ, আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। দুটো বিজ্ঞাপন একটি ডিজাইন তুমি করে দাও। ডিজাইন দুটো ঠিক সময়ে দিয়ে কিছু টাকা না নিতে পারলে সত্যিই বিপদ।
উত্তম পরিচয়! এ না হলে কি আর শিল্পী! জীবনকে ইতিমধ্যেই কিছু দেখেছি কাজেই অবাক হলাম না। একটু ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু আমি যে কমার্শিয়াল আর্ট করি না।
করো না? খুব ভালো কথা। জামিল বললেন, হ্যাঁ কমার্শিয়াল ঢুকে গেলে আর্টকে ভুলে যেতে হয় অনেক সময়। কিন্তু এদেশে শুধু আর্ট নিয়ে থাকতে পারবে কি না সন্দেহ। পাস করে বেরোও সব দেখতে পাবে। তোমাকে আজ এ-কাজটা করতেই হবে। এরকম তো আর করতে যাচ্ছ না তুমি? একটা ড্রয়িং শুধু কপি করে দেওয়া।
ঠিক আছে বলে দরজার দিকে চাইতেই দেখি ছবি, এবারে সে ওর মুখের অর্ধেকটা ও একটি চোখ আড়াল থেকে নিয়ে এসেছে এবং আমি চাইলেও তা সরিয়ে নিল না। তেল না দেওয়া অবিন্যস্ত চুল কেমন করুণ চেহারাটি যেন নীরব অশ্রুজলে মলিন হয়ে যাওয়া। আমার দিকে সে চাইল, একেবারে শূন্য, ভাবলেশহীন দৃষ্টি। পরে আস্তে করে ডাকল, দাদা!
জামিল প্যালেটে রঙ তৈরি করছিলেন, আমি ধাক্কা দিয়ে বললাম, আপনাকে ডাকছে।
কে? বলে মুখ তোলার সঙ্গেই বললেন, ছবি? কি ব্যাপার?
জামিল উঠে যেতে ছবি তাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল।
একটু পর ফিরে এসে চৌকাঠের কাছে থাকতেই সশব্দে হেসে উঠলেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার! হাসছেন কেন?
কারণ ঘটেছে তাই। আমাদের সম্বন্ধে কি ভাববে তুমি, তাই ভেবে আমার হাসি পেল। এই প্রথম দেখ, অথচ কি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!
না, না, সে কিছু নয়! আমি বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে বরং আমার লাভই হলো। অনেক কিছু শিখতে পারব। কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র আপনি, বড় বড় গুণীর সঙ্গে কাজ করেছেন।
হ্যাঁ তা বটে। তা বলতে পারো! জামিলের কণ্ঠস্বর হঠাৎ ভারি হয়ে এলো, বললেন, টিচাররা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আমি কাজও করতাম মন্দ নয়। যাগগে, ওসব কথা। বলছিলাম কি প্রথম পরিচয়, তোমাকে ডেকে এনে কাজে লাগালাম তারপর দ্যাখ চা খাওয়াতে বললাম, ছবি বলে চায়ের পাতা নেই- কেনার পয়সাও যে নেই। তাই হাসছিলাম, পরিচয় যখন হয়েছে দেখে যাও আমাদের অবস্থা।
অজান্তেই আমার মুখটা লজ্জায় ছেয়ে গেল না। বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমার কাছে পয়সা আছে। চা কিনে নিয়ে আসি।
না তুমি যাবে কেন, আমার কাছে দাও।
না-না আমিই যাই। কোনো অসুবিধে হবে না। আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দারিদ্রকে ঘৃণা করি কিন্তু অন্যের দারিদ্র মোচনের ক্ষমতাও নেই। এক পয়সা দু’পয়সা সাহায্য দিয়ে সে অসম্ভবও বটে। সমাজের কাঠামোটাকেই পাল্টে দিয়ে দারিদ্র্যের অবসান ঘটানোই আমার সংকল্প। সেজন্য ভিক্ষে কখনো দিইনে। ভিক্ষুককে কিছু দেয়ার মানে ভিক্ষাবৃত্তিরই পোষণ এবং ভিক্ষুকের জাতি দুনিয়ার বুকে টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু এখানে সে ব্যাপার নয়। অবস্থাটা এত স্পষ্ট ছলনার প্রয়াসটুকু পর্যন্ত অনুপস্থিত। কেউ হয়তো বলবেন এ অন্য ধরনের প্রতারণা। ভদ্রতার আবরণে না ঢেকে খোলাখুলি হয়ে যাওয়ার মধ্যে একই উদ্দেশ্য সিদ্ধির অধিকতর জোরালো ভঙ্গিটাই বর্তমান। কিন্তু আমি বলি ঘরে যে কিছু নেই এটা তো আর ছলনা নয়? জামিল যে ক্ষুধার্ত এটাও ছলনা নয়? ছবির মুখটা গভীর করুণ এখানে কোথায় ছলনার চিহ্ন?
হ্যাঁ, ঘরে কিছু নেই, চা, চিনি কিনতে গিয়ে আমার মনে হলো ঘরে চাল-ডাল কিচ্ছুই হয়তো নেই।
পকেটে পাঁচটি টাকার একটি নোট ছিল। রং কেনবার পয়সা। সবটা খরচ করে ফিরে এলাম।
বড় কামরার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় ডাক দিলাম, ছবি! ছবি!
ছবি প্রথম বুঝতে পারেনি, বারান্দায় পা দিয়েই হকচকিয়ে উঠল। কিন্তু আমাকে দেখতে পেয়ে সরে গেল না। আমি দ্রুতপদে কাছে গিয়ে চটের থলেটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এই নাও। ছবি থলেটা হাতে নিয়ে বলল, এসব কেন। দাদা জানতে পারলে খুব রাগ করবেন।
সে জন্যই তোমাকে দিচ্ছি। ওকে জানিও না, আর কিছু মনে করো না তুমি লক্ষ্মীটি!
ছবির চোখের মণি আমার দিকে হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে উঠল; কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্য। মাথাটি নিচু করে চলে এলাম। আমি তো সজ্ঞানে এই কথাটি উচ্চারণ করতে চাইনি? তবে কেন এমন হলো? ও নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছে, নইলে প্রতিবাদ করত।
এরপর বিজ্ঞাপনের ডিজাইন আঁকতে আর বলতে হলো না-জামিল কাজ করছিলেন; আমিও তুমি টেনে নিয়ে বসে যাই। আশ্চর্য, এটি হয়ে গেল। আমি তো চাইনি এমন কিছু? আমি জানতে পারিনি অতি সাধারণ শাড়িপরা দুঃখের দুলালী এই নিরাভরণ মেয়েটি কখন আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে। অল্পক্ষণের পরিচয়, তাতেই যে বেদনার সরোবর টলমল করে উঠল, আমার ছোট্ট সম্বোধনটি হয়তো তার থেকে জন্ম নেওয়া লাল পদ্ম!
স্বপ্নচ্ছন্নের মতো একমনে কাজ করে চলেছি, সারাক্ষণ মনের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন আলোড়ন!
ছবি চা নিয়ে এলে আমি আর চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। একটা চুমুক দিয়ে জামিল বললেন, প্রথম দিনেই আমাকে ঋণী করে ফেললে জাহেদ। এ আমি সাধারণত স্বীকার করি না। কিন্তু তোমার প্রতি একটা দুর্বলতা জাগল, ভালোমতো বাধা দিতে পারিনি।
আমি বললাম, আপনি বড় বেশি ভাবেন, নইলে বুঝতেন এ ব্যাপারটাকে ঋণ বলা যায় না কিছুতেই।
এরপর নীরবতা। হিমানী কেশতৈলের লেবেল, চৌকোণা ঘরে স্বদেশী চিত্রতারকার ছবি থাকবে, অবশ্যি চেহারার একেবারে কপি নয়, অনেকটা মিল শুধু। ফটোগ্রাফ থেকে হুবহু মেরে দিলে আইনের আওতায় পড়তে পারে, অথচ ক্রেতাদের আকর্ষণ করবার জন্য দেওয়াও প্রয়োজন। তাই দুইয়ের মধ্যে একটা সমঝোতা। এটা আমিই করছি। আর উনি করছেন একটা সিনেমার বিজ্ঞাপন।
ছবির ডাকে মাঝখানে একবার উঠে গেলেন জামিল, খানিকক্ষণ পরে হাসিমুখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমাকে আজকে এখানে খেতে হবে। অবশ্যি দাওয়াতটা। আমার নয় ছবির। কাজেই বুঝতে পারছ না বলার কোনো মানে নেই!
আমি বললাম, ভোজন জিনিসটা সর্বদাই আমার কাছে লোভনীয়, কাজেই সে আশঙ্কা বৃথা!
জামিল হেসে বললেন, আমার সঙ্গে তোমার বেশ মিল দেখছি! খাদ্যবস্তুর প্রতি আমারও ভয়ানক দুর্বলতা। একদিন ছিল
হঠাৎ থেমে গেলেন। কেন জানি মুখে বিষণ্ণতার ছায়া নেমে এসেছে। আমি তাকে লক্ষ্য করে বললাম, থামলেন কেন, শেষ করুন।
না ভাই! আজ নয়। সব জিনিস, আস্তে ধীরে জানাই ভালো। তাতে অন্তত কৌতূহলটা বজায় থাকে এবং তার দাম কম নয়।
এভাবেই ভাইবোনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল খানিকটা অস্বাভাবিক কিন্তু অসাধারণ কিছু ছিল না। খেতে বসে জামিল বলেছিলেন, জানো জাহেদ, ছবি সত্যিই ভালো মেয়ে। ও না থাকলে আমি রাস্তায় পড়ে মরতাম। তোমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই, দুদিন বাজার করতে পারিনি কিন্তু তবু ঠিক সময়ে খাবার পেয়েছি। কোত্থেকে যে সে জোগাড় যন্ত্র করে আনে আমি বুঝি না।
ছবি এতক্ষণ কপাটের কাছে দাঁড়িয়ে তদারক করছিল, নিজের সম্বন্ধে কথা শুনতে পেয়ে আড়ালে চলে গেল।
ও কোথাও চলে গেলে আমার কি অবস্থা হবে মাঝে মাঝে তাই ভাবি।
এতক্ষণ কথা বলতে পারছিলাম না, এবার সুযোগ পেয়ে বললাম– চলে যাবে কেন?
জামিল সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, তুমি দেখছি সত্যি ছেলেমানুষ। চলে যাবে কেন! আছে যে এটাই বিচিত্র। মেয়েদের বিশ্বাস নেই রে ভাই!
উনি যখন কথা বলছিলেন সামনের দেয়ালে টাঙানো ফটোটার দিকে চেয়ে ছিলাম। নিঃসন্দেহে জামিল এবং তার বৌ। বিয়ের পোশাকে তোলা ছবি। মেয়েটার কপালে টিপ। বেনারসি শাড়ির ঘোমটা টানা সলজ্জ মধুর মুখোনি। কাটা সুন্দর চেহারা। জামিলের গায়ে পাঞ্জাবি, মাথার চুল বড়-বড় ঘাড় অবধি নেমেছে। প্রশস্ত কপালের নিচে চোখজোড়া উজ্জ্বল। গাল তোবড়াননা নয়। ছবিটা নষ্ট হয়নি। খুব জীবন্ত মনে হচ্ছে।
কোনদিন প্রকাশ না করলেও আমার জানতে দেরি হয়নি। কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র জামিল চৌধুরী সহপাঠিনী মীরা দাশগুপ্তার প্রেমে পড়েছিলেন। অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে আউটডোর স্কেচ আর পিকনিকের আড়ালে চলত তাদের মন দেওয়া-নেওয়া। সুযোগ মতো লম্বা লম্বা-চিঠির আদান-প্রদান। আগুন কখনো ছাই চাপা থাকে না। এ ব্যাপার নিয়ে সে কি কানাঘুষা হৈ চৈ! জামিলের প্রাণই বিপন্ন হয়েছিল। কিন্তু একমাত্র মীরার গুণে শেষ পর্যন্ত আদালতে দুজনের বিয়ে হতে পারল। দিনটা ছিল সতেরোই আগস্ট উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সন; লোকের প্রবাহের সঙ্গে সেদিন বিকেলের ট্রেনে ওরা চলে এসেছিলেন ঢাকায়।
অথচ এখন দু বছর ধরে ছাড়াছাড়ি! ছবি হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, বৌদির একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মে গেছে। তার ফলেই এই কাণ্ড। দুটি ছেলেমেয়ে আছে। দাদার সঙ্গে থাকলে নাকি ওরা মানুষ হতে পারবে না!
তাই নাকি? আমি বিস্মিত স্বরে জিগগেস করলাম।
ছবি বলল, হ্যাঁ তাই। সেজন্যই তো আলাদা থাকেন। বৌদি মেয়েদের স্কুলে ড্রয়িং টিচার।
কোনদিন এখানে আসেন না উনি?
দাদা না থাকলে মাঝে মাঝে আসেন। বিছানাপত্র গুছিয়ে দিয়ে যান।
ছবি একটু থেমে বলল, কিন্তু সেটা আরো বিশ্রী। দাদা বুঝতে পারেন তো? একদম লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে তোলেন।
সেদিন দুর্বল মুহূর্তেই যেন ছবি কথা বলতে শুরু করেছিল, হঠাৎ সচেতন হয়ে একদম চুপ হয়ে গেল।