দ্বিতীয় অধ্যায় – শিল্পের স্বরূপ বিশ্লেষণ
শিল্পী প্রকাশ করেন তাঁর অনুভূতি ও চেতনাকে। ছন্দে বা ভাষার সাহায্যে যা প্রকাশিত হয় তাকে আমরা বলি সাহিত্য; বর্ণের সাহায্যে যা রূপায়িত হয় তাকে বলি চিত্র; পাথরে যা মূর্ত হয়ে ওঠে তাকে বলি ভাস্কর্য। শিল্পীর বৃহত্তম উপাদান হল জীবন। জীবনকে তিনি যে কেন্দ্র থেকে উপলব্ধি করবেন তাকেই তিনি প্রকাশ করবেন বাইরে। শিল্পের এই কেন্দ্র সম্পর্কে, অর্থাৎ শিল্প—দর্শন সম্বন্ধে বিভিন্ন দার্শনিকের বিভিন্ন মত আছে। প্রতিনিধি হিসাবে আমরা কয়েকজনকে বেছে নিতে পারি, যেমন হেগেল, বেনেডেটো ক্রোচে ও কার্ল মার্কস।
হেগেল : হেগেল বলেন দর্শন (Philosophy) ও ধর্মের (Religion) মতো শিল্পও পরমব্রহ্মের (absolute) উপলব্ধি—প্রয়াসী। কিন্তু এই প্রয়াসের আশ্রয় (medium) প্রত্যেকটির বিভিন্ন। শিল্পের আশ্রয় হচ্ছে কাল্পনিক শক্তি (imaginative power) অথবা প্রতিফলনশক্তি; ধর্মের আশ্রয় হচ্ছে অনুভূতি (feeling) বা অন্তর্বেগ (emotion) শক্তি; দর্শনের আশ্রয় হচ্ছে পরমব্রহ্মের বোধশক্তি (cognition)। প্রত্যেক সৃষ্ট শিল্পকে তিনটি উপায়ে বিশ্লেষণ করা যায় : যে—ভাব (idea) উপলব্ধি করবার চেষ্টা হয় তাকে বলে শিল্পের আত্মা; প্রতিফলন (representation) বা প্রতীককে (symbol) বলা হয় শিল্পের অঙ্গ; আর প্রতীকের দ্বারা ভাবের প্রতিভাসন (reflection)। এই প্রতিভাত রূপ হচ্ছে সত্য, সামঞ্জস্য ও অভিব্যক্ত রূপ। যেখানে এই প্রতিভাসন অস্পষ্ট ও আবছা, যেখানে অসংলগ্ন প্রতিরূপ—সমষ্টিকে (images) সুনিয়ন্ত্রণের মতো ভাবের তেমন বহুলতা নেই; সেই শিল্পকে হেগেল বলেছেন আদিম শিল্প (Oriental Art)। শিল্পের এই আদিম যুগে হেগেল বলেন বস্তুর একটি মিথ্যা অমেয় (infinite) রূপ ছিল এবং এই অমেয়তার কারণ হচ্ছে তৎকালের অপ্রশস্ত সমাজ। শিল্পের উচ্চতর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর এই প্রাধান্য ও বৈসাদৃশ্য অন্তর্ধান করে এবং ভাবের সংস্পর্শে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। সাম্য ও সামঞ্জস্যের এই যে সুষমা, প্রত্যয় (conception) ও প্রতীকের এই যে সংগতি, গ্রিক ভাস্কর্য, গ্রিক নাটক প্রভৃতি ক্লাসিক্যাল শিল্পের (Classical Art) বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইগুলি। এই ক্ল্যাসিসিজম—এর পরবর্তী স্তর হচ্ছে রোমান্টিসিজম (Romanticism)। ক্লাসিসিজম—এর রূপ ও বস্তু, আত্মা ও প্রতীকের পারস্পরিক সংযোগের মধ্যে সাম্য থাকে; রোমান্টিসিজম—এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বস্তুকে ছাড়িয়ে রূপের, প্রতীককে ছাড়িয়ে আত্মার অতিক্রমণীয়তায়। অর্থাৎ ভাবকে প্রতিফলিত করবার বস্তুর যে—দীনতা সেখানেই রোমান্টিসিজম—এর চরম সার্থকতা। সংক্ষেপে এই হল দার্শনিক হেগেলের মত। হেগেলীয় শিল্প পারমার্থিক।
শিল্পের এই হেগেলীয় বিশ্লেষণের বহু ত্রুটি আছে। শিল্পের তিনটি গুণ আমরা পাই—ভাব, প্রতীক বা বস্তু (matter) ও প্রতিফলন। এর মধ্যে শেষোক্ত গুণটিই অনুধাবনীয়, কারণ এইটি হচ্ছে শিল্প বিচারের প্রকৃষ্ট প্রতিমান। ভাব বা গঠন—বস্তুর পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু বস্তুর দ্বারা ভাবের প্রতিফলন—রীতির বা এ—দুইয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধের যদি কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে শিল্পের শ্রেণি (type) ঠিকই থাকে। কবিতা ও চিত্র দু—রকমের শিল্প, বিষয়বস্তু দুটিরই বিভিন্ন, কিন্তু কবিতা ও চিত্র একই শ্রেণির শিল্প হতে পারে, যেমন ক্লাসিক্যাল বা রোমান্টিক। সাহিত্যেও এই বিচার প্রযোজ্য। মহাকাব্য, নাটক ও গীতিকবিতার মধ্যে ভাবগত ও বস্তুগত প্রভেদ থাকলেও তাদের সমশ্রেণির শিল্প বলা যেতে পারে। ঠিক সেইরকম আবার ভাবের পরিবর্তন হলেও শিল্পের শ্রেণির কোনো পরিবর্তন হয় না। পরমব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন শিল্পী কল্পনা করতে পারেন, কিন্তু যখন ভাবাপেক্ষা বস্তুর প্রাধান্য থাকে বেশি তখন সেই শিল্পের শ্রেণিকে বলা হয় ‘ওরিয়েন্টাল’; বস্তু ও ভাবের মধ্যে যখন সাম্য থাকে তখন বলা হয় ‘ক্লাসিক্যাল’; বস্তুকে ছাড়িয়ে ভাবের যখন উৎক্রান্তি হয় তখন বলা হয় ‘রোমান্টিক’। হেগেল বলেন যে রোমান্টিক শিল্প হচ্ছে শিল্পের চরম পর্যায় এবং শিল্পের ঐতিহাসিক ক্রমোন্নতির ফলে রোমান্টিক পর্যায়ে শিল্পের স্ফুরণ হয় ধর্ম ও দর্শনের সঙ্গে। শ্রেষ্ঠ শিল্প ও দর্শন অভিন্ন।
হেগেল শিল্পের ঐতিহাসিক স্তরের সঙ্গে শিল্পের শ্রেণিবিভেদকে একভাবে দেখেছেন। শিল্পের ঐতিহাসিক স্তর শিল্পাদর্শের ক্রমবিকাশের উপর নির্ভরশীল এবং শিল্পের শ্রেণিনির্ণীত হয় ভাব ও প্রতিফলন—রীতির পারস্পরিক সম্বন্ধের দ্বারা। শিল্প ও শিল্প চেতনার ক্রমবিকাশ ও ভাবের ঐতিহাসিক গতি অর্থাৎ জাতির সামাজিক চেতনার পরমব্রহ্মের ক্রমাভিব্যক্তি—এ—দুটিই সমান্তরাল। সুতরাং হেগেলীয় শিল্পের এই শ্রেণি—বিচার শিল্প—দর্শন নয়, কারণ শিল্প—দর্শনের জন্য প্রয়োজন হয় ইতিহাসের দার্শনিক ব্যাখ্যার এবং তার উপর শিল্প—দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার। তা ছাড়া শিল্পের এই হেগেলীয় যৌক্তিক (logical) বিমূর্ত (abstract) শ্রেণিবিভেদে শিল্পের মূর্ত স্তরের রূপগুলি ঠিক বিশ্লেষিত হয় না। শিল্পকে যুক্তির অচলায়তনে প্রাণহীন ও গতিহীন করে রাখা হয়। ইতিহাস গতিশীল। শিল্পের উপজীব্য জীবন ও চেতনারও ক্রমবিকাশ আছে। সুতরাং শিল্পের চরম পরিণতি বস্তুজগৎ থেকে ভাবজগতে অতিক্রমণে, ধর্মলোকে ও দর্শনলোকে উৎক্রান্তিতে—হেগেলের এই যুক্তিকে অলস কল্পনাবিলাস ভিন্ন কিছু আখ্যা দেওয়া যায় না। নিস্তরঙ্গ যৌক্তিক বোধের আঘাতে স্থিতি ও প্রতি—স্থিতির বিরোধ বিলীন হয়ে উচ্চতর সমন্বিত—স্থিতির সৃষ্টি হয় না। বাস্তবের মূর্ত (concrete) গতির ছন্দে, আবর্তে ও আঘাতে এই বিরোধ বিলুপ্ত হয়। শিল্প বিচারের পূর্বে হেগেল ও মার্কসের ডায়লেকটিকস—এর ব্যবধান সর্বপ্রথম বিবেচ্য।
মার্কসীয় শিল্পের আলোচনার পূর্বে শিল্প সম্বন্ধে আর—একটি সম্প্রদায়ের মতও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। শিল্পকে এঁরা বলেন বিশুদ্ধ কল্পনা মাত্র, পার্থিব ও অতিপার্থিব জগতের বাইরে একমাত্র মনোজগতেই শিল্পের আসন। শিল্পের স্বাধীনতা (Independence of Art) ও শিল্পের খাতিরে শিল্পের (Art for Art’s sake) একজন প্রধান অধিবক্তা হলেন বেনেভেটো ক্রোচে। ক্রোচে বলেন : “Art is independent both of science and of the useful and the moral”—নৈতিক জগৎ, ব্যাবহারিক জগৎ ও বৈজ্ঞানিক জগৎ থেকে শিল্প সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ক্রোচের মতে শিল্পের কোনো উদ্দেশ্য সন্ধান করা হাস্যকর। শিল্পের আধেয়কে (contents) কখনো নির্বাচন (select) করা সম্ভব নয়, কারণ সংবেদন বা প্রভাব নির্বাচনের অর্থই হচ্ছে যে সেগুলি অভিব্যক্ত। অভিব্যক্ত না হলে যা ক্রমিক ও অস্পষ্ট তার মধ্যে নির্বাচন কেমন করে সম্ভব হবে?—‘‘A selection among impressions and sensations implies that these are already expressions, otherwise how could a selection be made among the continuous and indistinct?” কোনো বিষয়কে নির্বাচন করা সম্ভব নয় যদি তার অভিব্যক্ত রূপ আমাদের সামনে না থাকে এবং সেইজন্য ক্রোচের কাছে নির্বাচনের প্রশ্ন অবান্তর। ক্রোচে বলেন যে সত্যকার রূপকার বিষয়বস্তুর মধ্যে নিজেকে আচ্ছন্ন দেবেন, কেমন করে তা নিজেই তিনি জানেন না। তিনি শুধু অনুভব করেন যে সৃষ্টির সময় এগিয়ে আসছে, তাঁর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর সৃষ্টি নির্ভর করে না। “The true artist, in fact, finds himself big with his theme, he knows not how, he feels the moment of birth drawing near, but he cannot will it or not will it.” সমালোচকদের উপর কটাক্ষ করে সেইজন্য ক্রোচে বলেছেন যে প্রশংসা বা নিন্দার বাক্যে শিল্পের বিষয়কে আক্রমণ করা যায় না। যখন কোনো শিল্পসমালোচক বলেন যে বিষয়ের নির্বাচন খারাপ হয়েছে তখন তিনি বিষয় নির্বাচনকে লক্ষ্য করে বলেন না, শিল্পের সেই বিষয়ের রূপায়ণের ত্রুটিকে, অর্থাৎ বিষয়বস্তুর বিরোধিতার দোষে দুষ্ট প্রকাশের ব্যর্থতাকে লক্ষ্য করে বলেন। এখানে বুঝতে হবে যে সে—শিল্পীর উপলব্ধি ও অভিব্যক্তি অভিন্ন। কিন্তু এই সমালোচকেরা যদি শিল্পীর বিষয়কে লক্ষ্য করে নিন্দা করেন এবং তার প্রকাশের পটুতাকে স্বীকার করেও সেই বিষয়ের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তাহলে অন্যায় হবে। অভিব্যক্তি যদি পরিপূর্ণ হয়, সমালোচকদের উচিত শিল্পীকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া, কারণ তাঁর আত্মাকে যা বিচলিত করবে, তিনি তা থেকেই অনুপ্রেরণা গ্রহণ করবেন। শিল্পীকে দোষ না দিয়ে সমালোচকদের উচিত পরিবেষ্টনকে ও সমাজকে পরিবর্তন করা। কুৎসিত কিছু যদি এ—পৃথিবীতে না থাকে তাহলে শিল্পীরও রুচির বিকৃতি ঘটবে না বা তিনি নিরাশ হবেন না, বরং সুন্দর, সরল ও সংযমী হয়েই সৃষ্টি করবেন।
…if these expressions really are perfect, there is nothing to be done but to advice the critics to leave the artists in peace, for they can only derive inspiration from what has moved their soul. They should rather direct their attention towards affecting changes in surrounding nature and society, that such impressions and states of soul should not recur. If ugliness were to vanish from the world, if universal virtue and felicity were established there, perhaps artists would no longer represent perverse or pessimistic, but calm, innocent and joyous feelings, Arcadians of real Arcady. (Æsthetic—Benedetto Croce)
কুৎসিত শিল্প বা সুন্দর শিল্প বলে কিছু নেই। শিল্পী যদি কুৎসিতই তাঁর আত্মায় উপলব্ধি করেন, তিনি তাকেই রূপ দেবেন, কিন্তু রূপায়িত যখন সে হল তখন আর কুৎসিত রইল না, তখন হল শিল্প। শিল্পী এ—পৃথিবীর মানুষ। তাঁর পরিবেষ্টন; সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সব মিলিয়ে তাঁর জগৎ। পরিবেষ্টনের পরিবর্তন হলে তাঁর বিষয়বস্তুরও পরিবর্তন হবে, কিন্তু পরিবেষ্টন ছাড়িয়ে তিনি অন্য কোনো বিষয় নির্বাচন করতে পারেন না। ক্রোচের এই কথাটি বিশেষভাবে বিবেচ্য, কারণ তিনি শিল্পকে আত্মাভিমুখী বললেও পরিবেষ্টনকে অস্বীকার করেননি। তবে লক্ষণীয় হচ্ছে যে সমাজ বা পরিবেষ্টন ও শিল্পী এ—দুয়ের মধ্যে তিনি শিল্পীর স্বাতন্ত্র্যের উপর বেশ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যার ফলে সমাজ বা প্রতিবেশ ম্লান হয়ে গিয়েছে এবং ঐতিহাসিক পটভূমিকায় ক্রোচে শিল্পের বিচার করেননি।
ভাষা ও ভাব ক্রোচের কাছে অভিন্ন। কোনো কবির রসোপলব্ধি হলে অনুরূপ ভাষার ভিতর দিয়ে তাঁর সেই উপলব্ধি হয়ে থাকে। তেমনি কোনো চিত্রকরের হয় অনুরূপ বর্ণবিন্যাসে এবং গায়কের হয় অনুরূপ স্বর—সংগতিতে। যখন কোনো বিষয় শিল্পী উপলব্ধি করেন তখন তার রূপ তাঁর কাছে ব্যক্ত রূপ, অন্তর বা বাহির বলে কিছু নেই। ভাষাকে সেইজন্য ক্রোচে বলেছেন ‘চিরন্তন সৃষ্টি’ (perpetual creation) এবং ‘আদর্শ ভাষা’—(model language) কিছু হতে পারে না। ভাষা বেগবান, প্রাণবান, তাকে সিলমোহর করে হাটের মাঝখানে পণ্যদ্রব্যের মতো যাচাই করা যায় না, সমালোচকদেরও উচিত নয় এই সিলমোহর করা ভাষা দিয়ে শিল্পীর ছন্দময়, প্রাণময় ভাষার বিচার করা।
প্রগতি শিল্প। সাধারণত শিল্পের প্রগতি বলতে আমরা শিল্পের সরল অগ্রগতি বুঝি। কিন্তু ক্রোচে বলেন শিল্পের প্রগতি সেভাবে হয় না। শিল্পের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় যে শিল্পের ‘প্রগতি চক্র’ (Progressive Cycles) আছে, প্রত্যেক চক্রের নিজস্ব সমস্যা আছে এবং সেই সমস্যার সঙ্গে সম্বন্ধের দিক থেকে প্রত্যেক চক্র প্রগতিপন্থী। কোনো একটি বিশিষ্ট যুগের একই সমস্যা বা বিষয়বস্তুকে রূপ দেবার জন্য বহু শিল্পী সচেতন, কিন্তু কেউ তাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে রূপায়িত করতে পারছেন না, যতক্ষণ এই অবস্থা থাকে ততক্ষণ বলা যায় যে সেই চক্রের প্রগতি আছে। যখনই কোনো নূতন শিল্পী সেই সমস্যাকে পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত করেন তখন আর প্রগতি থাকে না, সেই চক্রটি পূর্ণতা লাভ করে। আবার নূতন চক্র আরম্ভ হয় নূতন বিষয়যবস্তু, নূতন সমস্যা নিয়ে। ক্রোচে বলেন যে বিষয়বস্তু যদি এক না হয় তাহলে কোনো প্রগতিচক্র থাকতে পারে না। এ—কথা বলা যায় না যে শেক্সপিয়র (Shakespeare) দাঁতের (Dante) তুলনায় প্রগতিপন্থী, বা গয়েটে (Goethe) শেক্সপিয়রের তুলনায় প্রগতিপন্থী। বরং বলা যেতে পারে, সংকীর্ণ অর্থে, যে মধ্যযুগীয় শিল্পীর চাইতে দাঁতে প্রগতি নির্দেশ করেন এবং শেক্সপিয়র করেন এলিজাবেথীয় নাট্যকারদের থেকে। সেইজন্য যুক্তির দ্বারা বা কোনো অপরিবর্তনীয় মাপকাঠির দ্বারা শিল্পের প্রগতি নির্দেশ করা ভুল। ক্রোচে দৃষ্টান্তস্বরূপ বলেছেন যে অনেকে বলেন জ্যোত্যোর (Giotto) যুগ ইতালীয় শিল্পের শৈশব এবং র্যাফেল (Raphel) ও টিশিয়ান—এ (Titian) তার যৌবন। এই কথার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত হচ্ছে এই যে অনুরূপ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও জ্যোত্যোর শিল্প পূর্ণতা লাভ করেনি। অবশ্য কেউই অস্বীকার করবেন না যে জ্যোত্যো র্যাফেলের মতো মূর্তি আঁকতে পারতেন না, বা টিশিয়ান—এর বর্ণকুশলতাও তাঁর ছিল না। কিন্তু এ—কথাও অস্বীকার্য নয় যে জ্যোত্যোর মতো ছবি র্যাফেল বা টিশিয়ান কল্পনাও করতে পারেননি। জ্যোত্যোর অন্তর দৈহিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করেনি, রেনেসাঁস—এর যুগের শিল্পীরা দৈহিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাকে পটে ও পাথরে রূপায়িত করেছিলেন। সুতরাং কোন মাপকাঠির সাহায্যে এদের তুলনামূলক বিচার করা যেতে পারে? ক্রোচে সেইজন্য হেগেলীয় শিল্পবিভাগকে ভুল প্রতিপন্ন করেছেন।
The celebrated divisions of the history of art into an oriental period, representing a lack of equilibrium between idea and form, the latter dominating, a classical, representing a new lack of equilibrium between idea and form, the former dominating, suffer from the same defect. (Æsthetic—Benedetto Croce)
কার্ল মার্কস। হেগেল ও মার্কসের মধ্যে বিরোধ দু—জনের ইতিহাসের দার্শনিক ব্যাখ্যার ব্যবধানের মধ্যেই সুপরিস্ফুট। হেগেলের কাছে ইতিহাস হচ্ছে আত্মার জয়যাত্রা পূর্ণ মুক্তির উদ্দেশ্যে। এই মুক্তি আত্মচেতনায় লভ্য এবং পরম আত্মচেতনা হচ্ছে পরমেশ্বর, সুতরাং ইতিহাস হচ্ছে এই আত্মচেতনার ইতিহাস অর্থাৎ পরমেশ্বরের আত্মজীবনী। হেগেলীয় যুক্তির এই গণ্ডির মধ্যে সমগ্র বিশ্ব পর্যবসিত, এর বাইরে পরিত্রাণের পথ নেই। সাধারণে বলবেন এ—কথা মিথ্যা, এই কাঠামোর বাইরের জগতেই তো আমরা বাস করি, যেখানে দুঃখকষ্ট, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার সবই আছে, বিচার যেখানে পাশবিক শক্তিতে মূর্ত হয়ে ওঠে। হেগেল এ—কথার উত্তরে বলবেন যে আমাদেরই ভুল, এ আর কিছু নয়, “die List dervernunct”—the cunning of reason, যুক্তির শঠতা। ‘যুক্তি’ শুধু শক্তিমান নয়, শঠও বটে। যুক্তি শঠতা করে এইসব অন্যায়—অবিচারের প্রশ্রয় দেয়, স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহে বাধা দেয় না, কারণ সে জানে যে এ—সবের ধ্বংস অনিবার্য, বিপ্লবেই হোক আর প্রতিক্রিয়াতেই হোক। অর্থাৎ আরও প্রাঞ্জল ভাষায় হেগেলের এই যুক্তির শঠতার অর্থ হচ্ছে যে পরমেশ্বর যে সবসময় তাঁর বিচার সরলভাবে করবেন এমন নয়, মাঝেমধ্যে তিনি ধূর্তামিও করেন, মানুষকে প্রশ্রয় দেন। কিন্তু আসলে তাঁর উদ্দেশ্যই সার্থক হয়, মানুষের অভিপ্রায় ব্যর্থ হয়। হেগেলের এই ইতিহাসের দার্শনিক ব্যাখ্যাকে কার্ল মার্কস বলেছেন :
An esoteric, speculative history preceded the exoteric empirical history… the history of man is transformed into a history of abstraction… Instead of living in a real, objective world and conditioned by it, Hegel transforms man into an attribute of self-consciousness. He turns the world upside down.
আত্মচেতনাকে মানুষের আত্মচেতনা না ভেবে, মানুষকে এই পৃথিবীর মানুষ না ভেবে, বহির্জগতের অস্তিত্বকে এবং মানুষের চিন্তাধারা ও কর্মধারাকে এই জগৎসাপেক্ষ স্বীকার না করে, হেগেল মানুষকে আত্মচেতনার গুণবিশেষ বলেছেন এবং জগৎকে উলটিয়ে দেখেছেন। হেগেলের কাছে ভাব হচ্ছে এই বাস্তব জগতের স্রষ্টা, ভাবের প্রতিচ্ছবি জগৎ। মার্কস বলেন, এই জগৎই মানুষের মনে প্রতিফলিত হয়ে ভাবে রূপ পরিগ্রহ করে। হেগেলের কাছে সেইজন্য ইতিহাস হচ্ছে পরমেশ্বরের আত্মজীবনী, মার্কসের কাছে ইতিহাস মানুষের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও ক্রমবিকাশের ইতিকথা।
বস্তু ও ভাবের সম্বন্ধ বিচার করে মার্কস বলেছেন : Being determines consciousness… শিল্পীর সৃজনী—প্রতিভার উৎস বাস্তব জগৎ। কারণ সমস্ত কাল্পনিক সৃষ্টি শিল্পী যে—জগতে বাস করেন তার প্রতিভাসিত রূপ। সে—জগতের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্য, সে—জগতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, ঘৃণা, তা—ই তাঁর শিল্পের উপাদান। বুর্জোয়া সমালোচকরা বিদ্রুপ করে বলে থাকেন যে মার্কসের মতে শিল্প মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রয়োজনের প্রতিচ্ছবি। মার্কস কোনোদিন এমন অর্থহীন উক্তি করেননি। মার্কস তাঁর ‘Critique of Political Economy’—র ভূমিকাতে বলেছেন যে বাস্তব জীবনের উৎপাদন—প্রণালিই সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও প্রাজ্ঞিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের চেতনা মানুষের অস্তিত্বের বিধাতা নয়, মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই মানুষের চেতনার স্রষ্টা। ক্রমাবর্তনে সমাজ এমন একটি স্তরে পৌঁছোয় যখন উৎপাদনের বাস্তব শক্তিগুলির সঙ্গে, অর্থাৎ সামাজিক ক্রমোন্নতির জন্য যে—শক্তিগুলির সৃষ্টি হয়েছে তাদের সঙ্গে, সমাজের প্রচলিত উৎপাদন—প্রণালির সংঘর্ষ হয় এবং পরে সামাজিক বিপ্লব দ্বারা প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধূলিসাৎ হয়ে গিয়ে নূতন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। কিন্তু মার্কস বলেছেন :
In considering such revolutions the distinction should always be between the material revolution in the economic conditions of production which can be determined with the precision of natural science, and the juridical, political, religious, æsthetic or philosophic,—in short, ideological forms—in which, men become conscious of this conflict and fight it out.
মার্কসের এই উক্তিকে অনেক সময় বুর্জোয়া সমালোচকেরা উপেক্ষা করেন এবং তথাকথিত ‘নয়া সমাজতন্ত্রীরা’ কদর্থ করেন।
জেমস টি. ফ্যারেল (James T. Farrell) তাঁর ‘A Note on Literary Criticism’ নামক পুস্তকের মধ্যে মার্কসীয় সমালোচনার তিনটি প্রধান ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন—(১) Functionalism, (২) Impressionism ও (৩) Literary Eschatology. এই তিনটি ত্রুটিকে মার্কসীয় সমালোচনার ত্রুটি না বলে, বুর্জোয়া সমালোচকদের সাহিত্যের ও শিল্পের ভুল মার্কসীয় ব্যাখ্যা বলাই ঠিক। মার্কস বা এঙ্গেলসের কদর্থ করা হয় বলে মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল বলা মূর্খতা। Functionalism অর্থে ফ্যারেল বলেছেন কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধন বা প্রচারকার্যের দ্বারা সাহিত্যের উৎকর্ষ যাচাই করা। Impressionism অর্থে বলেছেন সাহিত্যের বা শিল্পের প্রভাব দ্বারা সাহিত্য বা শিল্প বিচার করা। আর দুশো বা তিনশো বছর পূর্বের শিল্পীদের বর্তমান সমাজের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করাকে ফ্যারেল Literary Eschatology বলেছেন।
ফ্যারেল যাকে Functionalism বলেছেন, মার্কস ও এঙ্গেলস কোনোদিন তা সমর্থন করেননি। আর্নল্ড রুজ (Arnold Ruge), বোর্ন (Borne), স্টাহর (Stahr) প্রমুখ ‘তরুণ হেগেলিয়ান’রা একসময় সমাজ ও রাষ্ট্র—বিমুখতার প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন এবং শিল্পীর এই জাতীয় মনোভাব দেখলে তাঁরা কটূক্তি করতে আদৌ কুণ্ঠিত হতেন না। তাঁরা বলতেন যে শিল্প ও রাজনীতির মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ থাকবে, রাজনীতিকে উপেক্ষা করলে জীবনকেও উপেক্ষা করা হয়। বিশিষ্ট ‘তরুণ হেগেলিয়ান’ স্টাহর বলেছিলেন :
The dogma has long enough prevailed among Germans that poetry and politics have nothing to do with one another, that political stuff can never serve as poetic material. But why? Have not the masterpieces of epic and dramatic poetry of all ages sprung from such soil?
জার্মানদের মধ্যে বহুদিনের সংস্কার রয়েছে যে কবিতা ও রাজনীতির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই এবং রাজনৈতিক বিষয় কখনো কবিতার উপকরণ হতে পারে না। কিন্তু কেন হতে পারে না? সমস্ত যুগের প্রসিদ্ধ মহাকাব্য ও নাট্যকবিতার উপাদান কি রাজনীতি ছিল না? এইভাবে তর্ক করে তাঁরা গয়েটেকে (Goethe) পর্যন্ত নির্মমভাবে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস এই সমালোচনার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম তীব্র প্রতিবাদ জানান। এঙ্গেলস ১৮৪৭ সালে গয়েটে সম্বন্ধে তথাকথিত ‘Real Socialist’—দের এই প্রলাপোক্তির নিন্দা করে বলেন যে এইসব ভাবপ্রবণ সমাজতন্ত্রীরা ‘Goethe, the phillistine’ এবং ‘Goethe, the poetic genius’—এর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তাকে ভুলে যান। লেনিন (Lenin) টলস্টয়কে (Tolstoy) বলতেন ‘the hysterical misery-mongering intellectual.’ কিন্তু তাঁকে শিল্পী হিসাবে ‘mirror of revolution’ বলতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। ‘Proletarii’ পত্রিকায় ১৯০৮ সালে টলস্টয় সম্বন্ধে লেনিন লিখেছিলেন।
Tolstoi reflected the accumulated hate, the ripened aspiration for a better life, the desire to throw off the past—and also the immaturity, the dreamy contemplativeness, the political inexperience, the revolutionary flabbiness of the village.
জার্মানিতে ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত যে সাহিত্য আন্দোলন হয়েছিল সে সম্বন্ধে ১৮৫১ সালে এঙ্গেলস : ‘New York Tribune’ পত্রিকায় লিখেছিলেন :
A crude constitutionalism, or a still cruder republicanism, were preached by almost all writers of the time. It became more and more the habit, particularly of the inferior sorts of literati, to make up for the want of cleverness in their productions, by political allusions which were sure to attract attention. Poetry, novels, reviews, the drama, every literary production teemed with what was called ‘tendency’, that is, with more or less timid exhibitions of and anti-Governmental spirit.
উদ্দেশ্যমূলক (tendentious) সাহিত্যকে এঙ্গেলস নিন্দা করেননি। এই প্রবন্ধ লেখার প্রায় চল্লিশ বছর পরে বালজাক (Balzac) সম্বন্ধে মিস হার্কনেসকে একখানি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন :
I think that tendency should arise of itself out of the situation and action, without being specially emphasised, and that an author is not obliged to give the reader a ready-made historical future solution of the conflicts he depicts… Therefore in my view the Socialist tendentious novel completely fulfils its mission in describing real relationships, in destroying relative illusions concerning them, in upsetting the optimism of the bourgeois world, in sowing doubt as to the eternal nature of the existing social order, even though the author did not thereby advance any definite solution and sometimes did not even come down on one side or other.
উদ্দেশ্যমূলক শিল্প ও সাহিত্য হতে পারে কিন্তু উদ্দেশ্যকে প্রচার করা শিল্পীর মুখ্য উদ্দেশ্য হবে না। উদ্দেশ্য স্বতঃই ফুটে উঠবে ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে এবং শিল্পীর সমস্যা সমাধানেরও কোনো দায়িত্ব নেই। সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য বা শিল্প হতে হলেই যে নায়ক—নায়িকার মুখ দিয়ে সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যা করতে হবে তারও কোনো বাধ্যতা নেই। সমাজের প্রত্যেকটি শ্রেণির পারস্পরিক সম্বন্ধ আলোচনা করা চলতে পারে, প্রত্যেক শ্রেণির ভুল ধারণাকে নির্দেশ করা যেতে পারে, বুর্জোয়া শ্রেণির স্বপ্নসৌধকে ভেঙে চুরমার করা যেতে পারে এবং বর্তমান সমাজব্যবস্থার অবিনশ্বরতা সম্বন্ধে শিল্পী একটি বিরাট প্রশ্ন করেও ছেড়ে দিতে পারেন, সমাধান যে দিতেই হবে এমন নয়। সুতরাং মার্কসীয় সমালোচনা সম্বন্ধে Functionalism—এর যে অপবাদ তা বুর্জোয়া সমালোচকদেরই আবিষ্কার এবং সমাজতন্ত্রীদের কুব্যাখ্যার ফল।
Literary Eschatology ও মার্কসীয় সমালোচনার ত্রুটি নয়, তার কদর্থ। বাস্তব জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে শিল্পীর, কিন্তু সে—যোগাযোগ প্রত্যক্ষভাবে বা যান্ত্রিকভাবে নেই। মার্কসকে এ—কথা বললে মার্কস নিশ্চয়ই বিদ্রুপ করতেন যে যেহেতু সামন্ততন্ত্রের (Feudalism) পরবর্তী পর্যায় ধনতন্ত্র (Capitalism), বা ধনতন্ত্রের পরবর্তী পর্যায় সমাজতন্ত্র (Socialism), সেই হেতু সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক শিল্প ধনতান্ত্রিক শিল্পে রূপধারণ করবে বা ধনতন্ত্রের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে ধনতান্ত্রিক শিল্প সমাজতান্ত্রিক শিল্পে রূপ গ্রহণ করবে। মার্কস এ—কথাও বলেননি যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন—প্রণালি সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন—প্রণালি অপেক্ষা উন্নততর বলে, ধনতান্ত্রিক শিল্পও সামন্ততান্ত্রিক—শিল্পের তুলনায় উন্নততর। শিল্পকে প্রত্যেক ঐতিহাসিক পর্যায়ের সঙ্গে, অর্থাৎ সমসাময়িক সমস্যা, সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক শক্তির সঙ্গে তুলনা করে বিচার করতে হবে। যুগ পরিবর্তনের সময় বা পরিবর্তনের পর শিল্পীরা সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিবর্তনকে উপলব্ধি করতে পারেন না। নূতন ও পুরাতনের দ্বন্দ্ব থাকেই এবং শিল্পী এই দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তার বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রাম করে তাকে জয় করেন।
হেগেল ও মার্কসের দৃষ্টিকেন্দ্র সম্পূর্ণ বিপরীত—শূন্য ও মর্ত। ক্রোচের সঙ্গেও মার্কসের বৈসাদৃশ্য আছে। ক্রোচে শিল্পের সরল প্রগতিকে স্বীকার না করে তার চাক্রিক প্রগতিকে স্বীকার করেছেন, মার্কস বলেছেন সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ও নূতনের ক্রমোপলব্ধি। একযুগের তুলনায় অন্য যুগের শিল্পকে উন্নততর বলা ভুল—এ—কথা ক্রোচে প্রতিপন্ন করেছেন, মার্কসও অস্বীকার করেননি। কিন্তু ব্যক্তিকে স্বীকার করেও মার্কসের কাছে সমাজ মুখ্য, ক্রোচের কাছে ব্যক্তিসর্বস্ব। ক্রোচের শিল্প—দর্শন ইতিহাস—শূন্য, মার্কসের শিল্প—দর্শন ইতিহাস—আশ্রয়ী। মার্কস বলেছেন যে মানুষের অনবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফলে সমাজের রূপান্তর ঘটে, আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় এবং শিল্পীর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, নূতন—পুরাতনের বিরোধ—বন্ধুর পথে ক্রমে সেই পরিবর্তনকে স্বীকার করেন। সামাজিক বিপ্লবের পর বা বিপ্লবের প্রস্তুতির সময় শিল্পীর মনেও বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং শিল্পী সে—সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তাকে জয় করবার চেষ্টা করেন। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক পরিবেষ্টনের মধ্যে মার্কস শিল্পকে সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণির অভিব্যক্তি আখ্যা দিয়েছেন এবং সেইজন্য শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিরোধ যেখানে বর্তমান সেখানে শ্রেণি—শিল্প (Class Art) ভিন্ন অন্য কিছু বিকশিত হতে পারে না। কারণ মার্কসীয় সংজ্ঞানুসারে শ্রেণি হচ্ছে একদল ব্যক্তি যাদের জীবন—অভিজ্ঞতার মূলত ঐক্য আছে, অর্থাৎ অন্য শ্রেণির জীবন—অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই শ্রেণির বহির্বিভেদ যত বেশি তার চাইতে অন্তর্বিভেদ অনেক কম। এই বিভেদের মূলে থাকে বাস্তব অর্থনৈতিক উৎপাদন—প্রণালি। সেইজন্য শিল্পীর দ্বারা নূতন অভিজ্ঞতার সাকল্য (integration) এবং যে—শ্রেণির সঙ্গে তাঁর জীবন—অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য আছে, সেই শ্রেণিরই চেতনা অভিব্যক্ত হয়ে থাকে। এই শ্রেণিই শিল্প অনুশীলন করে, কারণ সমাজের স্বাধীনতা ও সচেতনতার অধিকারী যারা তারা এই শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক যুগের শাসকশ্রেণি হচ্ছে এই শ্রেণি। শিল্পের গতি নির্ণয়ের এই হচ্ছে মার্কসীয় পন্থা।
দার্শনিক হেগেল যুক্তির অচলায়তনে ইতিহাসকে বন্দি করে বললেন, ঐশী চেতনার ক্রমবিকাশ হচ্ছে মানুষের ইতিহাস; এ—পৃথিবী সেই চেতনার প্রতিচ্ছায়া। আদিম যুগে বস্তুর প্রাধান্য থেকে, বস্তু ও ভাবের সাম্যাবস্থার ভিতর দিয়ে মানুষ ভাব দ্বারা বস্তুকে পরাজিত করে। এই বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিফলিত রূপ হচ্ছে শিল্প। ওরিয়েন্টাল ও ক্লাসিকাল স্তর অতিক্রম করে শিল্প যখন রোমান্টিক স্তরে উন্নীত হয় তখন শিল্প ও দর্শন অভেদাত্মা। বেনোডেটো ক্রোচে বলেন শিল্প স্বোৎসারিত, অহমসর্বস্ব, স্বোত্তর কোনো অতিপার্থিব জগতে শিল্পের উৎস বা পরিপূর্ণতা সন্ধান করা বৃথা। শিল্প উদ্দেশ্য—বর্জিত। শিল্পী সামাজিক শুভাশুভ চেতনার ঊর্ধ্বে। শিল্পের ইতর—বিশেষ নেই। কার্ল মার্কস বলেন শিল্প সমাজোদ্ভূত, শিল্পী সমাজসচেতন। বস্তুর জনিতা ভাব নয়, ভাবের জনিতা বস্তু। বস্তুজগৎই শিল্পের উৎস। কিন্তু শিল্পী আজ্ঞাবাহী নন, বা সমস্যার ক্রীতদাসও নন। সমাজের একাগ্রতাকে তিনি উপলব্ধি করে রূপায়িত করেন। সমাজের বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন রূপ ও ব্যবস্থার সঙ্গে শিল্পীর অন্তর ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং সামাজিক ক্রমবিকাশে যুগে যুগে শিল্পীরা তাঁদের অনুভূতি ও মানসিক বিরোধকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই অর্থে সমাজসংগ্রামে তাঁরাও সৈনিক। শিল্পী যদি তাঁর যুগ—সমস্যার প্রতি ও যুগাদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান হন, সত্যকার শিল্পীকে হতেই হবে, তাহলে তিনি সেই যুগে প্রগতিপন্থী। অস্তমান ধনতান্ত্রিক যুগে একজন হয়তো গাইবেন আসন্ন সমাজতন্ত্রের প্রভাতি, আর—একজন গাইবেন ধনতন্ত্রের পুরবি। কেউ হয়তো ক্ষয়িষ্ণু ধনতন্ত্রের বিরোধী সমস্যার আবর্তে দিগভ্রষ্ট হয়ে মনের বন্দর খুঁজে পাবেন না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করবেন, প্রলাপ বকবেন, বা নিজের একটি কাল্পনিক জগৎ সৃষ্টি করে সেখানে আশ্রয় নেবেন। প্রথম দু—জনের একজন আশাবাদী (optimist) এবং আর—একজন নৈরাশ্যবাদী (pessimist) হলেও, প্রগতি—পন্থী দুজনেই, কারণ দু—জনেই বর্তমান সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং তার মূর্ত শক্তিগুলির প্রতি নিষ্ঠাবান। একজন ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় উজ্জ্বল, তাই তাঁর মধ্যে ভবিষ্যতের ব্যঞ্জনা (suggestion) থাকে; আর—একজন বর্তমানের বীভৎসতায় জর্জরিত, তাই তাঁর মধ্যে বর্তমানের প্রতি বক্রোক্তি ও শ্লেষ থাকে। তৃতীয়জন হচ্ছেন পরিত্রাণকামী (Escapist), কিন্তু তাহলেও তিনি প্রতিভাবান শিল্পী হতে পারেন, যে—প্রতিভার সার্থকতা শুধু তাঁর নিজের কাছে।
সংক্ষেপে শিল্প ও সাহিত্যের এই হল মার্কসীয় বিশ্লেষণ।