শিল্পকলায়, চলায়, বলায় সবকিছুতেই ছন্দ
আমরা বলেছি যে, কবিতায় মিল থাক আর না-ই থাক, ছন্দ সর্বদা চাই। আগেও চাই, পরেও চাই। এখন কথা হচ্ছে, ছন্দবস্তুটা কী। ওটা আর কিছুই নয়, কবিতার শরীরে দোল লাগাবার কায়দা। তা নানান দোলায় কবিতার শরীরকে দোলানো যায়। ছন্দ তাই নানা রকমের।
কিন্তু ‘কবিতার ছন্দ’ নিয়ে আলোচনার আগে বরং মোটামুটিভাবে ছন্দ জিনিসটা নিয়েই কিছু বলা যাক।
ছন্দ বস্তুটা কী? আমরা যখন বলি, কমলের চেহারায় না আছে ছিরি না আছে ছাঁদ, তখন তার দ্বারা আমরা কী বোঝাতে চাই? এইটেই তো বোঝাতে চাই যে, কমলের চেহারা একে বিচ্ছিরি তায় বেঢপ। তাই না? (ছাঁদ কথাটা ছন্দ থেকেই এসেছে।) তাহলেই দেখা যাচ্ছে, যেমন কবিতার চেহারায়, তেমনি মানুষের চেহারাতে ও ছন্দ থাকা চাই।
মজা এই যে, ছন্দ না-থাকাটাও এক রকমের ছন্দ। কবিতায় না হােক, অন্য সব ব্যাপারে।
বড়ো রাস্তা দিয়ে ভীমবেগে এইমাত্র একটা লরি চলে গেল। তার ওই ভীমবেগে যাবার একটা ছন্দ আছে। লরি আসছে দেখবামাত্র দুটি লোক রাস্তা থেকে লম্ফ দিয়ে ফুটপাতে উঠে পড়লেন। তাদের ওই লম্ফ দিয়ে ফুটপাতে উঠবারও একটা ছন্দ আছে। ফুটপাথে উঠে তাদের এক জন, যেন কিছুই হয়নি এইভাবে, একটা বিড়ি ধরালেন। তার একটা ছন্দ আছে। অন্যজন, তখনও তার ভয় কাটেনি, ঝাড়া তিন মিনিট চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারও একটা ছন্দ আছে।
ছন্দ আছে সবকিছুতেই। নাতিবিখ্যাত কিন্তু অতিশক্তিমান এক বাঙালি প্রাবন্ধিকের লেখায় দুই ভদ্রলোকের প্রাতঃকালীন ভ্রমণের বর্ণনা দেখেছি। একজন মোটা, অন্যজন রোগা। একজন ঘোঁতঘোঁত করে হাঁটেন, অন্যজন পন্পন্ করে হাঁটেন। এই দুই রকমের হাঁটারই ছন্দ আছে।
আলোচনাকে এবারে কিছুটা উচ্চস্তরে উঠিয়ে আনি। রবীন্দ্ৰকাব্যের নায়িকা মাকে জিজ্ঞেস করছেন, “কী ছাদে কবরী বাঁধি লব আজ”। কেউ জানে না, শেষ পর্যন্ত তিনি কোন কায়দায় খোঁপা বেঁধেছিলেন। কিন্তু যে-কায়দাতেই বঁধুন, তাতে ছন্দ নিশ্চয়ই ছিল। ছন্দ যেমন টান-খোপাতে আছে, তেমনি এলো-খোপাতেও আছে। চুড়ো-খোঁপাতেও আছে, আবার লতানে খোঁপাতেও আছে।
ছন্দ আছে সর্বত্র। কুঁড়েঘরেও আছে, আবার আকাশ-ছোঁয়া অট্টালিকাতেও আছে। গৃহিণীর চাঁদপানা মুখেও আছে, আবার পাওনাদারের হাঁড়িপনা মুখেও আছে। চেয়ারে বসে ফাইল সই করাতেও আছে, আবার ঘাম ঝরিয়ে মোট বওয়াতেও আছে। আজ সকাল থেকে এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। এর একটা ছন্দ আছে। আবার হাওয়া যখন মরে যাবে, এবং গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়বে না, তখন তারও একটা ছন্দ থাকবে। চোখের সামনে আমরা যা-কিছু দেখি, যা-কিছু শুনি, তার সবকিছুতেই- সমস্ত চলায়, সমস্ত বলায়, সব রকমের কাজে কিংবা অকাজে- ছন্দ রয়েছে। ছন্দ মানে এখানে ঢং কিংবা ডৌল কিংবা রীতি। সেটা কোথায় নেই?
এ-বাড়ির গিন্নি বলেন, ও-বাড়ির নতুন বউয়ের চলনে নেই। কিন্তু সেটা রাগের কথা। আসলে ও-বাড়ির নতুন বউয়ের চলনেও একটা ছন্দ আছে ঠিকই, তবে কিনা। এ-বাড়ির গিনির সেটা ভালো ঠেকছে না।
যা বলছিলুম। গাড়ি, বাড়ি, চলা, বলা, মাঠ, নদী, মেঘ, পাহাড়– সবকিছুরই একটা-না-একটা ছন্দ আছে। আছে কবিতারও। কিন্তু কবিতার ছন্দ বলতে যেকোনও রকমের একটা ছাদ বোঝায় না। সে-ও এক রকমের ছাদই, তবে কিনা তার নিজস্ব কতকগুলি নিয়মকানুন থাকে। মুখে আমরা যেসব কথা বলি, তাকে যদি সেই নিয়মকানুনের মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারতুম, মুখের কথাও তাহলে কবিতা হয়ে উঠত।
বেঁধে ফেলার প্রস্তাব শূনেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ছন্দ এক রকমের বন্ধন। কথাকে যা কিনা নিয়মের মধ্যে বঁধে। কিন্তু আর-এক দিক থেকে দেখতে গেলে, ঠিক বন্ধনও এটা নয়। রবীন্দ্রনাথ একে সেই দিক থেকেই দেখেছেন। তিনি বলেছেন, “এ কেবল বাইরে বাঁধন, অন্তরে মুক্তি। কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই ছন্দ।”
শুনে অনেকের ধাঁধা লাগতে পারে। বন্ধন কীভাবে মুক্তির পথ খুলে দেয়, সেই জটিল তত্ত্বটাকে সহজে বুঝিয়ে বলবার জন্যে রবীন্দ্রনাথ তাই সেতারের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। সুরকে ভালোভাবে মুক্তি দেবার জন্যেই তো সেতারের তারগুলিকে টান করে বেঁধে নিতে হয়। এ-ও সেই ব্যাপার। কথাকে। যদি না ছন্দে বাঁধি, তার অন্তরের সুর তাহলে ভালো করে মুক্তি পায় না।
ছন্দ আসলে কথার মধ্যে গতির তাড়া জাগিয়ে দেয়। আর এই গতির তাড়া জেগে উঠলেই আমরা দেখতে পাব যে, এমনিতে যাকে হয়তো খুব সহজ কথা কথাগুলিও তখন আশ্চর্য এক রহস্যের ছোঁয়ায় কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে।
একটা দৃষ্টান্ত দিই।
ধরা যাক, আমাদের বলবার কথাটা এই যে, সারাটা দিন যা হােক কোনওক্ৰমে কেটে গেছে, কিন্তু বিকেলটা আর কাটতে চাইছে না। এমন কথা তো আমরা ; কতদিনই বলি। বলবার সঙ্গে-সঙ্গেই তা ফুরিয়েও যায়। কিন্ত এই কথাটাকেই রবীন্দ্রনাথ যখন ছন্দে বেঁধে বলেছেন, তখন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে, বলবার পরেও তার রেশ ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সামান্য ওই কয়েকটি কথার মধ্যেই উদাস একটি বেদনার গতি এমন আশ্চর্যভাবে সঞারিত হয়ে গিয়েছে যে, শব্দগুলিকে সেই গতিই যেন ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। শ্রোতার অন্তরে বারবার গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে একটি শব্দমালা :
“সকল বেলা কাটিয়া গোল
বিকাল নাহি যায়।”
রবীন্দ্রনাথ, বলাই বাহুল্য, গদ্যেও এই কথাগুলিকে খুবই মর্মগ্রাহী করে বলতে পারতেন। কিন্তু ছন্দের বাঁধনে এইভাবে না বঁধলে, কথাগুলির মধ্যে একটি বেদনার গতিকে হয়তো এতটাই মোক্ষমভাবে জাগিয়ে তোলা যেত না। এ যেন কথার নেপথ্য থেকে একটি দীর্ঘশ্বাসও বেশ স্পষ্ট করে শুনতে পাওয়া গেল।
শুধু বেদনার কথা কেন, ফুর্তির কথাকেও ছন্দে বেঁধে চঞলি করে তোলা যায়। শুনে, শ্রোতার মনও হঠাৎ কেমন চনমান করে ওঠে।
কথা এই যে, ছন্দ এক রকমের নয়। আবার একই ছন্দের মূল কাঠামোর মধ্যে নানান রকমের বৈচিত্র্যের খেলা দেখানো যেতে পারে। সেটা অবশ্য পরের কথা। তার আগে মূল ছন্দগুলির পরিচয় জানা চাই।