শিবানীর সঙ্গে পরামর্শ করেই ভারতী ঠিক করেছিলেন, আরো কিছুদিন না গেলে স্বামী বা ছেলেকে কিছু জানাবেন না। ওরা যাতে কোনকিছু জানতে না পারে, সেজন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছিল শিবানীর বাড়িতে।
তবে হ্যাঁ, ভারতী নিশ্চয়ই দুর্বাকে নিজের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবেন।
দুই বন্ধু আলাপ-আলোচনা করেই ঠিক করেছিলেন, বাবাই বা ওর বাবা বাড়ি ফেরার আগেই ওরা দুর্বাকে নিয়ে রওনা হয়ে যাবেন।
সেদিন শিবানী ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হতেই দুর্বা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বলল, মাসীমা, আমি রেডি চটি বদলেই আসছি।
সুনন্দাও বেরিয়ে এলেন। বলেন, একি, তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
না, ভাই সুনন্দা, এখন আর বসব না।
তাই বলে, একেবারে দরজা থেকেই চলে যাবে?
ঠিক সেই সময় দুর্বা বেরিয়ে এসে বলল, মা, আসছি।
শিবানী একটু হেসে বলেন, সুনন্দা, চিন্তা করো না। তোমার মেয়েকে ঠিক সময়েই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।
তোমাদের ওখানে যাচ্ছে, চিন্তা করব কেন?
শিবানী আর দুর্বা ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই সুনন্দা হাসতে হাসতে বলেন, শিবানী, ঘটকালি করার ব্যাপারটা ভুলে যেও না।
উনিও হাসতে হাসতে বলেন, মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। সে দায়িত্ব তো আমি স্বেচ্ছায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছি।
বাইপাস দিয়ে ট্যাক্সি ছুটছে। কিছু কুন্তল রাশি উড়ে পড়ছে দুর্বার মুখে কিন্তু সেদিকে ওর হৃক্ষেপ নেই। খোলা জানলা দিয়ে দুরের আকাশ দেখতে দেখতেই ও একটু হেসে বলে, জানেন মাসীমা, আমার খুব ইচ্ছে করে গাড়ি নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে আর প্রাণভরে প্রকৃতি দেখতে।
ও সঙ্গে সঙ্গে একটু চাপা গলায় গেয়ে ওঠে–
আকাশে আজ কোন্ চরণের
আসা-যাওয়া
বাতাসে আজ কোন্ পরশের
লাগে হাওয়া…।
শিবানী অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলেন, শিল্পী, তোমাকে যত দেখছি, তত বেশি ভাল লাগছে।
দুর্বা চাপা হাসি হেসে বলে, আপনি কি সত্যি সত্যিই আমার নাম রাখলেন শিল্পী?
তোমাকে তো আর লেন নামে ডাকা যায় না।
.
ট্যাক্সি থামার আওয়াজ শুনেই ভারতী ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন। দুর্বা ট্যাক্সি থেকে নামতেই উনি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার মুখোনা দেখার জন্য কখন থেকে হা করে জানলার ধারে বসে আছি।
শিবানী, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়েই ওদের দুজনের হাতে ধরে বলেন, এখন ভিতরে চলল তো।
ড্রইং রুমে পা দিয়েই সামনের ছবিটা দেখে দুর্বা বলে, মাসীমা,এই ভদ্রলোকের ছবিতে মালা দেওয়া কেন? আজ কী ওনার জন্মদিন?
শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, না, শিল্পী, আজ ওনার জন্মদিন না। আমি রোজই এই ছবিতে মালা দিই।
কেন?
দুর্বা যেন জিভ ফসকে প্রশ্ন করে।
ভারতীও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দুর্বা, আমার এই দেওর বহুঁকাল আগেই আমাদের সবাইকে ফেলে চলে গেছে।
ছবি দেখে তো মনে হচ্ছে, উনি নেহাতই ইয়ং ম্যান। উনি কবে মারা গিয়েছেন?
ভারতীই ওর প্রশ্নের জবাব দেন, ঠাকুরপো মারা যাবার ঠিক দশ দিন আগে এই ছবিটা তোলা হয়।
ও মাই গড! এত অল্প বয়সে…
শিবানী ওর একটা হাত ধরে বলেন, এখন ভিতরে চলল। পরে সবই জানতে পারবে।
হঠাৎ যেন সুর কেটে যায়, ছন্দ পতন হয়। হাসি উবে যায় তিনজনেরই মুখ থেকে।
দুর্বা যেন নড়তে পারে না। অপলক দৃষ্টিতে আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর খুব আস্তে গেয়ে ওঠে–
তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে
কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে
কেউ তা মানে না।
ফিরি আমি উদাস প্রাণে,
তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার
মতন এমন টানে
কেউ তো টানে না।
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে…
গান হঠাৎ থামিয়ে দুর্বাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন, ভিতরে যাই।
যাইহোক তিনজনে মিলে ব্রেকফাস্ট খাবার পর শিবানীর শোবার ঘরে বিছানার উপরে বসার পর পরই দুর্বা প্রশ্ন করে, মেলোমশাই কত বছর বয়সে চারা যান?
শিবানী বলেন, ও তখন ঠিক একত্রিশ বছরের।
মাত্র একত্রিশ?
হ্যাঁ, মা।
তখন আপনার বয়স কত?
সাতাশ।
ইস। হোয়াট এ স্যাড স্টোরি!
ভারতী বলেন, দুর্বা, তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে, এই সর্বনাশের সময় শিবানী প্রেগন্যান্ট ছিল। মাত্র এক মাস পরই তাতাইয়ের জন্ম হয়।
চমৎকার! ঈশ্বর যে মাঝে মাঝে কি পাগলামীই করেন, তা ভেবে পাই না।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে শিবানীর একটা হাত দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, মাসীমা, বলুন তো কী করে কাটিয়ে দিলেন এতগুলো বছর।
শিবানী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, মা, মানুষের সুখ-দুঃখের জন্য কি সময় দাঁড়িয়ে থাকে? সময় ঠিকই এগিয়ে যায় কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি যেন চিরকালের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে থাকে চোখের সামনে।
দু এক মিনিট কেউই কোন কথা বলেন না। সবাই চুপ।
আচ্ছা মাসীমা, মেলোমশায়ের কি হার্ট অ্যাটাক করেছিল?
শিবানী উত্তর দেন না, উত্তর দিতে পারেন না। সেই সর্বনাশের কথা বলতে গেলেই যেন কেউ গলা টিপে ধরে। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারেন না।
ভারতী বলেন, মা, এত বছর পরেও সেদিনের অঘটনের কথা বলতে গেলে আমরা নিজেদের সামলাতে পারি না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সেদিন সন্ধে সাতটা নাগাদ উডল্যাণ্ডস্ থেকে ঠাকুরপোর কাছে ফোন এলো–
ডক্টর ব্যানার্জী।
কি ব্যাপার ডক্টর চ্যাটার্জী এখন আবার টেলিফোন করছেন কেন?
আর, এম. ও. ডক্টর চ্যাটার্জী বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন, বার্ন স্টল্ডার্ডের ওয়ার্কস ম্যানেজার ফ্যাক্টরীতে সিরিয়াসলি ইনজিয়োর্ড হয়েছেন। আপনি এক্ষুনি চলে আসুন।
ইয়েস আয়াম কামিং।
কাম স্ট্রেট টু ও-টি টু।
ঠিক আছে।
.
ঠাকুরপো, সারাদিনই প্যান্ট-সার্ট পরে থাকতো; চেঞ্জ করতে রাত্রে শোবার আগে চান করার পর। যাইহোক এ টেলিফোন আসার দু’মিনিটের মধ্যেই ঠাকুরপো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মেলোমশাই কি সার্জেন ছিলেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, ঠাকুরপো অসাধারণ সার্জেন ছিল। এম. বি. বি. এস’ এর ফাঁইনালে সার্জারীতে গোল্ড মেডলিস্ট তারপর শুধু এম. এস. না, ও দ্বিতীয়বার গভর্নরের গোল্ড মেডেল পায়।
ও মাই গড!
দুর্বা মুহূর্তের জন্যে থেমে বলে, যাইহোক সেদিন কী হলো, তাই বলুন।
শিবানী ঠিক রাত বারোটায় ফোন করলো উডল্যান্ড-এ; ওখান থেকে ওরা বলল, ডক্টর ব্যানার্জী অপারেশন শুরু করেছেন ঠিক আটটায়। এখনও অপারেশন চলছে। এখনই বলতে পারছি না, কখন শেষ হবে।
বাবা! তার মানে, খুবই মেজর অপারশেন চলছিল।
হ্যাঁ, খুবই মেজর অপারেশন ছিল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর ভারতী পাঁজর কঁপানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কি আর বলব মা। উডল্যান্ড থেকে বাড়ি ফেরার পথে হেড লাইট ছাড়া একটা লরীর সঙ্গে ঠাকুরপোর গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কায়…
না, উনি কথাটা শেষ করতে পারেন না।
দুর্বা আঁতকে ওঠে, কি সর্বনাশ!
ও তাকিয়ে দেখে দুই মাসীমার চোখেই জল।
দুর্বা আঁচল দিয়ে ওদের দু’জনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, এত বছর ধরেই তো আপনারা চোখের জল ফেলছেন। আজ আর চোখের জল ফেলবেন না। আমি কারুর চোখের জল দেখলে নিজেকে সামলাতে পারি না।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গেই একটু কষ্ট করেই হেসে বলেন, না, শিল্পী, আজ আর আমরা চোখের জল ফেলব না। তোমাকে কি আমরা কষ্ট দিতে পারি?
দুর্বা দু’হাত দিয়ে ওদের দুজনের দুটো হাত ধরে বলে, তাহলে শুনুন…
হ্যাঁ, ও গেয়ে ওঠে–
দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার
ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষে দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর
আগুনটারে
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তারে পালাস না রে,
ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে ছুটে
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর।
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে,
তারপরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।
দুঃখ যদি না পাবে তো…
শিবানী দুর্বার গাল টিপে আদর করে একটু হেসে বলেন, রোজ যদি তোমার কাছে একটা গানও শুনতে পারতাম, তাহলে আর কোনদিন চোখের জল ফেলতাম না।
মাসীমা, রোজ হয়তো পারব না কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, মাঝে মাঝেই আমি আপনাকে গান শোনাব। প্লীজ, আপনি আর চোখের জল ফেলবেন না।
ভারতী ঠিক সেই সময় গলা চড়িয়ে বলেন, সারদা, আমাদের তিন কাপ কফি দেবে?
রান্নাঘর থেকেই সারদা জবাব দেয়, হ্যাঁ, বড়মা, দিচ্ছি।
একটু পরেই সারদা কফি দিয়ে যায়।
কফি খেতে খেতেই দুর্বা শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনারা দু’জনে কী আপন বোন? নাকি…
শিবানী ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চাপা হাসি হেসে বলেন, এই ভারতী, তুই শিল্পীকে বল আমরা কি রকম বোন।
ভারতীও চাপা হাসি হেসে বলেন, আমরা আপন বোনও না, জ্যাঠতুতো খুড়তুতো বোনও না।
দুর্বা যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবাক হয়ে বলে,তবে?
ভারতী বলে যান, আমি বেথুন কলেজে চাকরি পাবার ঠিক পাঁচ বছর পর শিবানী ওখানে জয়েন করে। কি করে যে বছর খানেকের মধ্যেই আমাদের দু’জনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল, তা বলতে পারব না।
দুর্বা হাসে; বলে, তারপর?
রোজ কলেজ ছুটির পর আমরা ঘণ্টাখানেক আড্ডা না দিয়ে বাড়ি যাই না।
রোজ?
হ্যাঁ, রোজ।
কি এত কথা বলতেন?
দুজনে দুজনের মনের কথা, সংসারের কথা ছাড়াও কত কি বিষয়ে আমাদের কথা। এইভাবে বছর খানেক কাটার পরই আমাদের দুজনের বাড়ি নিয়ে সমস্যা শুরু হলো।
বাড়ি নিয়ে সমস্যা মানে?
তখন আমরা দুজনেই ভাড়া বাড়িতে থাকি। দুজনেই বাড়িওয়ালার জন্য নিত্য অশাস্তি ভোগ করি।
অশান্তি কেন?
শিবানীদের বাড়িওয়ালার বাতিক ছিল, উনি নিজে সদর দরজা বন্ধ না করে কিছুতেই শুতে যাবেন না। অথচ ঠাকুরপো তখন সবে এস. এস. পাশ করে কর্মজীবন শুরু করেছে।
ভারতী একটু থেমে বলেন, ৩খন ঠাকুরপো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছোট-বড় সব ধরনের অপারেশন করার জন্য অনেকগুলো নাসিং হোমে যায়। ওর ফিরতে রোজ রাত হতো। আর তাই নিয়েই বাড়িওয়ালা শুরু করতেন। অশান্তি।
আচ্ছা লোক তো।
ভাড়া বাড়িতে থাকার যে কি জ্বালা, তা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
আপনাদের বাড়িওয়ালা কি নিয়ে অশান্তি করতেন?
আমাদের বাড়ির মালিক ছিলেন দুই ভাই। ওদের দুজনের জাতাকলে পড়ে আমাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
কেন?
এক ভাই নিয়মিত টাকা অ্যাডভান্স নিতেন আর অন্য ভাই আমাদের তাড়াবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন।
আচ্ছা মজার ব্যাপার।
শিবানী বলেন, হারে ভারতী, সব ডিটেল-এ বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।
না, না, ডিটেলস্-এ বলব না।
ভারতী একটু থেমেই আবার শুরু করেন, আমরা এর মধ্যে এর-ওর বাড়ি যাতায়াত শুরু করেছি। দুটো পরিবারের মধ্যে বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যাইহোক আমরা দুজনে ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক আমাদের নিজেদের বাড়ি করতে হবে। বাড়িওয়ালাদের জ্বালাতন-খামখেয়ালীপনা আর সহ্য করব না।
আচ্ছা।
হ্যাঁ, আমরা দু’জনে মন্ত্রী আর কয়েকজন অফিসারদের কাছে যাতায়াত করতে করতে শেষ পর্যন্ত সল্টলেকের এই দুটো জমি পেলাম।
দুই মেলোমশাই নিশ্চয়ই খুব খুশি হলেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, তুমি শুনলে অবাক হবে জমির কথা ওদের আমরা কিছু জানাইনি।
শিবানী বলেন, আমরা দু’জনে তো সংসারে টাকা দিতাম না। সুতরাং ব্যাঙ্কে বেশ টাকা ছিল। ভারতী নিজের টাকাতেই জমি কিনতে পারলেও আমার টাকা কম পড়লো। কিছু টাকা ভারতী দিল আর কিছু টাকা কলেজ থেকে অ্যাডভান্স নিলাম।
ভেরি ইন্টারেস্টিং।
তারপর ঠাকুরপো আর আমার কর্তাকে রাজি করিয়ে সবাই মিলে পুরী গেলাম। ওখানে গিয়ে ওদের দুজনকে আমাদের জমির দলিল দেখাতেই ওরা চমকে গেল।
তারপর আপনারা বাড়ি বানালেন?
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত অনেক কাণ্ড করে আমাদের দুটো বাড়ি হলো।
শিবানী বলেন, তবে বাড়ি তৈরি হয়েছে শুধু দাদার জন্য। সব ঝক্কি-ঝামেলা উনি একলা হাতে সামলেছেন।
ভারতী এক ঝলক বন্ধুকে দেখে নিয়েই চাপা হাসি হেসে দুর্বাকে বলেন, এবার একটা মজার কথা বলব?
হ্যাঁ, বলুন।
নিজেদের নতুন বাড়িতে আসার আনন্দে এক বছরের মধ্যেই শিবানীর পেটে তাতাই এলো।
দুর্বা হো হো করে হেসে ওঠে।
শিবানী কোন মতে হাসি চেপে বলেন, আচ্ছা ভারতী, তোর কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই?
এইসব হাসি-ঠাট্টা থামার পর শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, জানো শিল্পী, দাদা আর ভারতী আমার পাশে না থাকলে এই মহা সর্বনাশের পর আমি ঠিক আত্মহত্যা করতাম। দাদা যে আমাকে কি স্নেহ করেন, তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
ভারতী একটু হেসে বলেন, আমার স্বামীকে আমি একটা কথা হাজার বার বললেও উনি কানে তোলেন না। সব ব্যাপারেই উনি নির্বিকার ভোলানাথ কিন্তু বৌমা যদি একটা কথা একবার বলে, তাহলে ভোলানাথ সে কাজ না করে শান্তি পান না।
তুই সব সময় দাদাকে ভোলানাথ ভোলানাথ বলবি না তো! দাদার মত মানুষ দশ-বিশ লাখে একটা হয় না, তা জানিস?
শিবানী একটু অভিমান করেই বলেন।
ভারতী হঠাৎ বেশ গম্ভীর হয়ে বলেন, আচ্ছা বাবা, তোর দাদাকে আর ভোলানাথ বলব না। হয়েছে তো?
দুর্বা শুধু হাসে।
খেতে বসার আগে শিবানী বলেন, শিল্পী, চল, তোমাকে আমার বাড়ি দেখাই।
হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন।
প্রথম ঘরটায় ঢুকতে না ঢুকতেই ভারতী বলেন, দুর্বা, এটা ছিল ঠাকুরপোর ঘর।
দুর্বা চারদিকে তাকিয়ে দেখে। যাঁকে আর কোনদিন কেউ কাছে পাবে না, সব দেয়ালে শুধু তারই ছবি। শুধু একটা ছবির নচে লেখা আছে–ডাঃ তপোব্রত বন্দোপাধ্যায়। তার নীচে দুটি সন-তারিখ-জন্মদিন আর মৃত্যুদিন।
দুর্বা দু’চোখ ভরে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলে, কি সুন্দর দেখতে ছিলেন মেসোমশাই।
দুর্বা, ঠাকুরপো শুধু দেখতে সুন্দর ছিল না, অসাধারণ ভাল সার্জেন ছাড়াও ওর স্বভাব-চরিত্রের কোন তুলনা ছিল না।
ভারতী মুহূর্তের জন্য থেমেই একটু হেসে বলেন, কিছুদিন পর তাতাই এই ঘরে বসবে।
হঠাৎ দুর্বা মুখ ঘুরিয়ে ভারতীর দিকে তাকিয়ে বলে, তাতাই এই মাসীমার ছেলে?
হ্যাঁ।
আর বাবাই কে?
শিবানী এক গাল হেসে বলেন,আমাদের দুজনের পেটে একটা করে ছেলে হলেও আমরা দুজনেই দুটো ছেলের মা।
শুনে দুর্বা খুশির হাসি হাসে। তারপর বলে, আপনাদের দুটো ছেলে কী করছেন? পড়াশুনা নাকি…
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শিবানী চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, বাবাইসোনা দারুণ ছেলে। কানপুর আই-আই-টি থেকে অসাধারণ ভাল রেজাল্ট করে এম. ট্রেক পাশ করে…।
ও বাবা! তার মানে খুবই ভাল ছেলে।
হ্যাঁ, শিল্পী, ও সত্যি খুব ভাল ছেলে।
শিবানী মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, ছেলেটা এখন এত ভাল চাকরি করছে, থলি ভর্তি টাকা আয় করছে কিন্তু কোন চালিয়াতিও নেই, কোন উচ্ছাসও নেই।
ভারতী একটু হেসে বলেন, আমার স্বামীর মত বাবাইও আরেক ভোলানাথ হয়েছে।
মাসীমা, ওকথা বলবেন না। আজকাল বহু ছেলেমেয়েই লেখাপড়ায় ভাল রেজাল্ট করে খুব ভাল চাকরি করছে কিন্তু তাদের অনেকেরই স্বভাব-চরিত্র দেখে অবাক হতে হয়।
ও প্রায় না থেমেই বলে, আপনারা ভাবতে পারবেন না, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই অনেক ছেলেমেয়ে শুধু ড্রিঙ্ক করে না, আরো অনেক কিছু করে।
ভারতী বলেন, হ্যাঁ, সেইরকমই তো শুনতে পাই।
শিবানী বলেন, আমাদের ভাগ্য ভাল,আমাদের ছেলে দুটো সেরকম হয় নি।
আচ্ছা মাসীমা, আপনাদের তাতাইসোনা কি করছেন?
ভারতীর দুটো চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, বাবাই সোনা ঠিক ঠাকুরপোর মতই অসাধারণ সার্জেন হতে চলেছে।
ও আচ্ছা!
ও এত ভাল ছেলে যে একই সঙ্গে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ আর দিল্লির এ-আই-আই-এম-এস এ এম. বি. বি. এসএ চান্স পায়। তাতাই সোনা কলকাতায় না পড়ে দিল্লী চলে যায়। ওখানে এম. বি. বি. এস পড়ে এখন এম. এস. করছে।
দুর্বা একটু হেসে বলে, তার মানে উনিও সার্জারীতে খুব ভাল?
ভারতী বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, তাতাই সোনা বিখ্যাত সার্জেন হতে বাধ্য।
দুই ছেলের জন্যই আপনারা গর্ব করতে পারেন।
শিবানী বলেন, ছেলেদের জন্য ঠিক গর্ব করি না কিন্তু আমাদের নিশ্চয়ই ভাল লাগে।
ভারতী বলেন, তাতাই সোনার মত প্রাণবন্ত ছেলে হয় না। ও যখন এখানে আসে, ও যে আমাদের সবাইকে নিয়ে কি পাগলামী করে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তাই নাকি?
আমাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, ও আমার বুড়ো ভোলানাথকে নিয়ে যে কখন কোথায় যাবে, তার ঠিক ঠিকানা নেই।
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, তাতাই গতবার ছুটিতে এসে কি কাণ্ড করেছিল, তা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
উনি কি করেছিলেন?
ও দাদাকে নিয়ে বেরুবার সময় বলল, মা, আমি জেঠুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি। আবার হাওড়া স্টেশন থেকে ফোন করে বলল, মা, আমরা পুরী যাচ্ছি; কদিন পর ফিরব।
দুর্বা হাসতে হাসতে বলে, আচ্ছা ছেলে তো!
অন্য একটা ঘরে পা দিয়েই শিবানী বলেন, এটা ছেলের ঘর।
মাসীমা, তা আর বলে দিতে হবে না। দেয়ালের পোস্টারগুলো দেখেই বুঝতে পারছি।
ভারতী বুক শেলফ-এর উপর থেকে একটা ছবি তুলে দুর্বার হাতে দিতে বলেন, এই দেখো, আমাদের ছেলেদের ছবি।
আপনাদের দুটো ছেলেই তো বেশ দেখতে।
হ্যাঁ, তা বেশ দেখতে।
শিবানী আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, এই হচ্ছে বাবাই সোনা আর এই হচ্ছে…
ওনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দুর্বা একটু হেসে বলে, তাতাই সোনা, তাইতো?
হ্যাঁ, মা।
চোখ দুটো দেখলেই মনে হয়, আপনাদের তাতাই সোনা বেশ দুষ্ট আছে।
ভারতী আর শিবানী প্রায় একই সঙ্গে বলেন, ঠিক ধরেছ।
ভারতী হাসতে হাসতেই বলেন, ছেলেটা দেখতে দেখতে কত বড় হলো, এম. এস. পড়ছে কিন্তু এখনও বাচ্চাদের মত দুষ্টমি করতে ওর-জুড়ি নেই।
খেতে বসেও কত কথা, কত গল্প হয়। খাওয়া দাওয়ার পরও কত কথা হয় ওদের।
একবার দুর্বা ভারতীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মেলোমশাই কি করেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, উনি একটু বড় ধরনের মিস্ত্রিগিরি…
ওনাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই শিবানী বলে, চুপ কর ভারতী। দাদা মিস্ত্রিগিরি করেন, তাই না?
এবার উনি দুর্বার দিকে তাকিয়ে বলেন, দাদা গেস্টকিন-উইলিয়ামস্-এর চীফ ম্যানেজার-প্ল্যানিং।
তার মানে মেলোমশাই ইজ এ বিগ বস!
শিবানী সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, শিল্পী, তোমার বাবা কি করেন?
বাবা মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। এখন চীফ জেনারেল ম্যানেজর-ওয়ার্কস।
তাইতো বাবাকে হরদম দিল্লী আর হায়দ্রাবাদ ছুটতে হয়।
তার মানে তোমার বাবা বেশ কৃতি পুরুষ।
কৃর্তি পুরুষ কিনা জানি না কিন্তু হি ইজ রিয়লী এ ভেরি গুড ম্যান, এ চামিং হাসব্যান্ড অ্যান্ড লাভলি অ্যাফেকশনেট ফাদার।
বেলা গড়িয়ে যায়; সূর্য ঢলে পড়ে। কফি খেতে খেতে ভারতী বলেন, শিবানী, চল, আমরা দু’জনে গিয়ে দুর্বাকে পৌঁছে দিই।
দুর্বা কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও দেয় না; বলে, না, না, আপনাদের কাউকে যেতে হবে না। আমি একলাই যেতে পারব।
নিশ্চয়ই তুমি একলা যেতে পারে কিন্তু আমরাই তোমাকে পৌঁছে দেব।
দুর্বা আবার আপত্তি করে না কিন্তু শিবানী বলেন, আমাদের যদি যেতে ইচ্ছে করে, তুমি আপত্তি করবে কেন?
ও একটু হেসে বলে, আপনারা সব সময় আমাকে হারিয়ে দিচ্ছেন।
এর পর তুমি আমাদের বার বার হারিয়ে দিও।
রওনা হবার আগে ভারতী বলেন, চলো দুর্বা, আমার বাড়িটা দেখবে।
হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন।
বাড়িটা দেখে বেরুতে বেরুতেই দুর্বা বলে, আপনাদের দুটো বাড়িতেই কোন বাহুল্য নেই। আজকাল অনেক বাড়িতেই এমন দামী দামী আর চকমকে-ঝকঝকে ফার্নিচার রাখে যে মনে হয়, কোন হোটেলে এসেছি।
মা, আমরা আবার কি বাহুল্য করব?
মাসীমা, আজকাল বহু বাড়িতেই লক্ষ্মী-সরস্বতী বিরাজ করেন কিন্তু সেই সব বাড়িতে রুচির পরিচয় বিশেষ পাওয়া যায় না।
হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
ট্যাক্সি ধরার জন্য ওরা তিনজনে মোড়ের মাথার দিকে এগিয়ে চলেন।
শিবানী বলেন, শিল্পী, এই দুই বুড়ীর সঙ্গে সারাটা দিন কাটিয়ে কেমন লাগলো, তা তো বললে না।
মাসীমা, বিশ্বাস করুন, খুব ভাল লেগেছে, খুব আনন্দ পেয়েছি।
দুর্বা না থেমেই হাসতে হাসতে বলে, দেখবেন, এবার থেকে যখন-তখন আপনাদের কাছে এসে যাবে।
শিবানীর সঙ্গে পরামর্শ করেই ভারতী ঠিক করেছিলেন, আরো কিছুদিন না গেলে স্বামী বা ছেলেকে কিছু জানাবেন না। ওরা যাতে কোনকিছু জানতে না পারে, সেজন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছিল শিবানীর বাড়িতে।
তবে হ্যাঁ, ভারতী নিশ্চয়ই দুর্বাকে নিজের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবেন।
দুই বন্ধু আলাপ-আলোচনা করেই ঠিক করেছিলেন, বাবাই বা ওর বাবা বাড়ি ফেরার আগেই ওরা দুর্বাকে নিয়ে রওনা হয়ে যাবেন।
সেদিন শিবানী ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হতেই দুর্বা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বলল, মাসীমা, আমি রেডি চটি বদলেই আসছি।
সুনন্দাও বেরিয়ে এলেন। বলেন, একি, তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
না, ভাই সুনন্দা, এখন আর বসব না।
তাই বলে, একেবারে দরজা থেকেই চলে যাবে?
ঠিক সেই সময় দুর্বা বেরিয়ে এসে বলল, মা, আসছি।
শিবানী একটু হেসে বলেন, সুনন্দা, চিন্তা করো না। তোমার মেয়েকে ঠিক সময়েই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।
তোমাদের ওখানে যাচ্ছে, চিন্তা করব কেন?
শিবানী আর দুর্বা ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই সুনন্দা হাসতে হাসতে বলেন, শিবানী, ঘটকালি করার ব্যাপারটা ভুলে যেও না।
উনিও হাসতে হাসতে বলেন, মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। সে দায়িত্ব তো আমি স্বেচ্ছায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছি।
বাইপাস দিয়ে ট্যাক্সি ছুটছে। কিছু কুন্তল রাশি উড়ে পড়ছে দুর্বার মুখে কিন্তু সেদিকে ওর হৃক্ষেপ নেই। খোলা জানলা দিয়ে দুরের আকাশ দেখতে দেখতেই ও একটু হেসে বলে, জানেন মাসীমা, আমার খুব ইচ্ছে করে গাড়ি নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে আর প্রাণভরে প্রকৃতি দেখতে।
ও সঙ্গে সঙ্গে একটু চাপা গলায় গেয়ে ওঠে–
আকাশে আজ কোন্ চরণের
আসা-যাওয়া
বাতাসে আজ কোন্ পরশের
লাগে হাওয়া…।
শিবানী অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলেন, শিল্পী, তোমাকে যত দেখছি, তত বেশি ভাল লাগছে।
দুর্বা চাপা হাসি হেসে বলে, আপনি কি সত্যি সত্যিই আমার নাম রাখলেন শিল্পী?
তোমাকে তো আর লেন নামে ডাকা যায় না।
.
ট্যাক্সি থামার আওয়াজ শুনেই ভারতী ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন। দুর্বা ট্যাক্সি থেকে নামতেই উনি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার মুখোনা দেখার জন্য কখন থেকে হা করে জানলার ধারে বসে আছি।
শিবানী, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়েই ওদের দুজনের হাতে ধরে বলেন, এখন ভিতরে চলল তো।
ড্রইং রুমে পা দিয়েই সামনের ছবিটা দেখে দুর্বা বলে, মাসীমা,এই ভদ্রলোকের ছবিতে মালা দেওয়া কেন? আজ কী ওনার জন্মদিন?
শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, না, শিল্পী, আজ ওনার জন্মদিন না। আমি রোজই এই ছবিতে মালা দিই।
কেন?
দুর্বা যেন জিভ ফসকে প্রশ্ন করে।
ভারতীও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দুর্বা, আমার এই দেওর বহুঁকাল আগেই আমাদের সবাইকে ফেলে চলে গেছে।
ছবি দেখে তো মনে হচ্ছে, উনি নেহাতই ইয়ং ম্যান। উনি কবে মারা গিয়েছেন?
ভারতীই ওর প্রশ্নের জবাব দেন, ঠাকুরপো মারা যাবার ঠিক দশ দিন আগে এই ছবিটা তোলা হয়।
ও মাই গড! এত অল্প বয়সে…
শিবানী ওর একটা হাত ধরে বলেন, এখন ভিতরে চলল। পরে সবই জানতে পারবে।
হঠাৎ যেন সুর কেটে যায়, ছন্দ পতন হয়। হাসি উবে যায় তিনজনেরই মুখ থেকে।
দুর্বা যেন নড়তে পারে না। অপলক দৃষ্টিতে আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর খুব আস্তে গেয়ে ওঠে–
তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে
কেউ তা জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে
কেউ তা মানে না।
ফিরি আমি উদাস প্রাণে,
তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার
মতন এমন টানে
কেউ তো টানে না।
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে…
গান হঠাৎ থামিয়ে দুর্বাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন, ভিতরে যাই।
যাইহোক তিনজনে মিলে ব্রেকফাস্ট খাবার পর শিবানীর শোবার ঘরে বিছানার উপরে বসার পর পরই দুর্বা প্রশ্ন করে, মেলোমশাই কত বছর বয়সে চারা যান?
শিবানী বলেন, ও তখন ঠিক একত্রিশ বছরের।
মাত্র একত্রিশ?
হ্যাঁ, মা।
তখন আপনার বয়স কত?
সাতাশ।
ইস। হোয়াট এ স্যাড স্টোরি!
ভারতী বলেন, দুর্বা, তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে, এই সর্বনাশের সময় শিবানী প্রেগন্যান্ট ছিল। মাত্র এক মাস পরই তাতাইয়ের জন্ম হয়।
চমৎকার! ঈশ্বর যে মাঝে মাঝে কি পাগলামীই করেন, তা ভেবে পাই না।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে শিবানীর একটা হাত দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, মাসীমা, বলুন তো কী করে কাটিয়ে দিলেন এতগুলো বছর।
শিবানী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, মা, মানুষের সুখ-দুঃখের জন্য কি সময় দাঁড়িয়ে থাকে? সময় ঠিকই এগিয়ে যায় কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি যেন চিরকালের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে থাকে চোখের সামনে।
দু এক মিনিট কেউই কোন কথা বলেন না। সবাই চুপ।
আচ্ছা মাসীমা, মেলোমশায়ের কি হার্ট অ্যাটাক করেছিল?
শিবানী উত্তর দেন না, উত্তর দিতে পারেন না। সেই সর্বনাশের কথা বলতে গেলেই যেন কেউ গলা টিপে ধরে। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারেন না।
ভারতী বলেন, মা, এত বছর পরেও সেদিনের অঘটনের কথা বলতে গেলে আমরা নিজেদের সামলাতে পারি না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সেদিন সন্ধে সাতটা নাগাদ উডল্যাণ্ডস্ থেকে ঠাকুরপোর কাছে ফোন এলো–
ডক্টর ব্যানার্জী।
কি ব্যাপার ডক্টর চ্যাটার্জী এখন আবার টেলিফোন করছেন কেন?
আর, এম. ও. ডক্টর চ্যাটার্জী বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন, বার্ন স্টল্ডার্ডের ওয়ার্কস ম্যানেজার ফ্যাক্টরীতে সিরিয়াসলি ইনজিয়োর্ড হয়েছেন। আপনি এক্ষুনি চলে আসুন।
ইয়েস আয়াম কামিং।
কাম স্ট্রেট টু ও-টি টু।
ঠিক আছে।
.
ঠাকুরপো, সারাদিনই প্যান্ট-সার্ট পরে থাকতো; চেঞ্জ করতে রাত্রে শোবার আগে চান করার পর। যাইহোক এ টেলিফোন আসার দু’মিনিটের মধ্যেই ঠাকুরপো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মেলোমশাই কি সার্জেন ছিলেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, ঠাকুরপো অসাধারণ সার্জেন ছিল। এম. বি. বি. এস’ এর ফাঁইনালে সার্জারীতে গোল্ড মেডলিস্ট তারপর শুধু এম. এস. না, ও দ্বিতীয়বার গভর্নরের গোল্ড মেডেল পায়।
ও মাই গড!
দুর্বা মুহূর্তের জন্যে থেমে বলে, যাইহোক সেদিন কী হলো, তাই বলুন।
শিবানী ঠিক রাত বারোটায় ফোন করলো উডল্যান্ড-এ; ওখান থেকে ওরা বলল, ডক্টর ব্যানার্জী অপারেশন শুরু করেছেন ঠিক আটটায়। এখনও অপারেশন চলছে। এখনই বলতে পারছি না, কখন শেষ হবে।
বাবা! তার মানে, খুবই মেজর অপারশেন চলছিল।
হ্যাঁ, খুবই মেজর অপারেশন ছিল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর ভারতী পাঁজর কঁপানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কি আর বলব মা। উডল্যান্ড থেকে বাড়ি ফেরার পথে হেড লাইট ছাড়া একটা লরীর সঙ্গে ঠাকুরপোর গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কায়…
না, উনি কথাটা শেষ করতে পারেন না।
দুর্বা আঁতকে ওঠে, কি সর্বনাশ!
ও তাকিয়ে দেখে দুই মাসীমার চোখেই জল।
দুর্বা আঁচল দিয়ে ওদের দু’জনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, এত বছর ধরেই তো আপনারা চোখের জল ফেলছেন। আজ আর চোখের জল ফেলবেন না। আমি কারুর চোখের জল দেখলে নিজেকে সামলাতে পারি না।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গেই একটু কষ্ট করেই হেসে বলেন, না, শিল্পী, আজ আর আমরা চোখের জল ফেলব না। তোমাকে কি আমরা কষ্ট দিতে পারি?
দুর্বা দু’হাত দিয়ে ওদের দুজনের দুটো হাত ধরে বলে, তাহলে শুনুন…
হ্যাঁ, ও গেয়ে ওঠে–
দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার
ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষে দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর
আগুনটারে
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তারে পালাস না রে,
ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে ছুটে
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর।
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে,
তারপরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।
দুঃখ যদি না পাবে তো…
শিবানী দুর্বার গাল টিপে আদর করে একটু হেসে বলেন, রোজ যদি তোমার কাছে একটা গানও শুনতে পারতাম, তাহলে আর কোনদিন চোখের জল ফেলতাম না।
মাসীমা, রোজ হয়তো পারব না কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, মাঝে মাঝেই আমি আপনাকে গান শোনাব। প্লীজ, আপনি আর চোখের জল ফেলবেন না।
ভারতী ঠিক সেই সময় গলা চড়িয়ে বলেন, সারদা, আমাদের তিন কাপ কফি দেবে?
রান্নাঘর থেকেই সারদা জবাব দেয়, হ্যাঁ, বড়মা, দিচ্ছি।
একটু পরেই সারদা কফি দিয়ে যায়।
কফি খেতে খেতেই দুর্বা শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনারা দু’জনে কী আপন বোন? নাকি…
শিবানী ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চাপা হাসি হেসে বলেন, এই ভারতী, তুই শিল্পীকে বল আমরা কি রকম বোন।
ভারতীও চাপা হাসি হেসে বলেন, আমরা আপন বোনও না, জ্যাঠতুতো খুড়তুতো বোনও না।
দুর্বা যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবাক হয়ে বলে,তবে?
ভারতী বলে যান, আমি বেথুন কলেজে চাকরি পাবার ঠিক পাঁচ বছর পর শিবানী ওখানে জয়েন করে। কি করে যে বছর খানেকের মধ্যেই আমাদের দু’জনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল, তা বলতে পারব না।
দুর্বা হাসে; বলে, তারপর?
রোজ কলেজ ছুটির পর আমরা ঘণ্টাখানেক আড্ডা না দিয়ে বাড়ি যাই না।
রোজ?
হ্যাঁ, রোজ।
কি এত কথা বলতেন?
দুজনে দুজনের মনের কথা, সংসারের কথা ছাড়াও কত কি বিষয়ে আমাদের কথা। এইভাবে বছর খানেক কাটার পরই আমাদের দুজনের বাড়ি নিয়ে সমস্যা শুরু হলো।
বাড়ি নিয়ে সমস্যা মানে?
তখন আমরা দুজনেই ভাড়া বাড়িতে থাকি। দুজনেই বাড়িওয়ালার জন্য নিত্য অশাস্তি ভোগ করি।
অশান্তি কেন?
শিবানীদের বাড়িওয়ালার বাতিক ছিল, উনি নিজে সদর দরজা বন্ধ না করে কিছুতেই শুতে যাবেন না। অথচ ঠাকুরপো তখন সবে এস. এস. পাশ করে কর্মজীবন শুরু করেছে।
ভারতী একটু থেমে বলেন, ৩খন ঠাকুরপো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছোট-বড় সব ধরনের অপারেশন করার জন্য অনেকগুলো নাসিং হোমে যায়। ওর ফিরতে রোজ রাত হতো। আর তাই নিয়েই বাড়িওয়ালা শুরু করতেন। অশান্তি।
আচ্ছা লোক তো।
ভাড়া বাড়িতে থাকার যে কি জ্বালা, তা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
আপনাদের বাড়িওয়ালা কি নিয়ে অশান্তি করতেন?
আমাদের বাড়ির মালিক ছিলেন দুই ভাই। ওদের দুজনের জাতাকলে পড়ে আমাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
কেন?
এক ভাই নিয়মিত টাকা অ্যাডভান্স নিতেন আর অন্য ভাই আমাদের তাড়াবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন।
আচ্ছা মজার ব্যাপার।
শিবানী বলেন, হারে ভারতী, সব ডিটেল-এ বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।
না, না, ডিটেলস্-এ বলব না।
ভারতী একটু থেমেই আবার শুরু করেন, আমরা এর মধ্যে এর-ওর বাড়ি যাতায়াত শুরু করেছি। দুটো পরিবারের মধ্যে বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যাইহোক আমরা দুজনে ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক আমাদের নিজেদের বাড়ি করতে হবে। বাড়িওয়ালাদের জ্বালাতন-খামখেয়ালীপনা আর সহ্য করব না।
আচ্ছা।
হ্যাঁ, আমরা দু’জনে মন্ত্রী আর কয়েকজন অফিসারদের কাছে যাতায়াত করতে করতে শেষ পর্যন্ত সল্টলেকের এই দুটো জমি পেলাম।
দুই মেলোমশাই নিশ্চয়ই খুব খুশি হলেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, তুমি শুনলে অবাক হবে জমির কথা ওদের আমরা কিছু জানাইনি।
শিবানী বলেন, আমরা দু’জনে তো সংসারে টাকা দিতাম না। সুতরাং ব্যাঙ্কে বেশ টাকা ছিল। ভারতী নিজের টাকাতেই জমি কিনতে পারলেও আমার টাকা কম পড়লো। কিছু টাকা ভারতী দিল আর কিছু টাকা কলেজ থেকে অ্যাডভান্স নিলাম।
ভেরি ইন্টারেস্টিং।
তারপর ঠাকুরপো আর আমার কর্তাকে রাজি করিয়ে সবাই মিলে পুরী গেলাম। ওখানে গিয়ে ওদের দুজনকে আমাদের জমির দলিল দেখাতেই ওরা চমকে গেল।
তারপর আপনারা বাড়ি বানালেন?
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত অনেক কাণ্ড করে আমাদের দুটো বাড়ি হলো।
শিবানী বলেন, তবে বাড়ি তৈরি হয়েছে শুধু দাদার জন্য। সব ঝক্কি-ঝামেলা উনি একলা হাতে সামলেছেন।
ভারতী এক ঝলক বন্ধুকে দেখে নিয়েই চাপা হাসি হেসে দুর্বাকে বলেন, এবার একটা মজার কথা বলব?
হ্যাঁ, বলুন।
নিজেদের নতুন বাড়িতে আসার আনন্দে এক বছরের মধ্যেই শিবানীর পেটে তাতাই এলো।
দুর্বা হো হো করে হেসে ওঠে।
শিবানী কোন মতে হাসি চেপে বলেন, আচ্ছা ভারতী, তোর কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই?
এইসব হাসি-ঠাট্টা থামার পর শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, জানো শিল্পী, দাদা আর ভারতী আমার পাশে না থাকলে এই মহা সর্বনাশের পর আমি ঠিক আত্মহত্যা করতাম। দাদা যে আমাকে কি স্নেহ করেন, তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
ভারতী একটু হেসে বলেন, আমার স্বামীকে আমি একটা কথা হাজার বার বললেও উনি কানে তোলেন না। সব ব্যাপারেই উনি নির্বিকার ভোলানাথ কিন্তু বৌমা যদি একটা কথা একবার বলে, তাহলে ভোলানাথ সে কাজ না করে শান্তি পান না।
তুই সব সময় দাদাকে ভোলানাথ ভোলানাথ বলবি না তো! দাদার মত মানুষ দশ-বিশ লাখে একটা হয় না, তা জানিস?
শিবানী একটু অভিমান করেই বলেন।
ভারতী হঠাৎ বেশ গম্ভীর হয়ে বলেন, আচ্ছা বাবা, তোর দাদাকে আর ভোলানাথ বলব না। হয়েছে তো?
দুর্বা শুধু হাসে।
খেতে বসার আগে শিবানী বলেন, শিল্পী, চল, তোমাকে আমার বাড়ি দেখাই।
হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন।
প্রথম ঘরটায় ঢুকতে না ঢুকতেই ভারতী বলেন, দুর্বা, এটা ছিল ঠাকুরপোর ঘর।
দুর্বা চারদিকে তাকিয়ে দেখে। যাঁকে আর কোনদিন কেউ কাছে পাবে না, সব দেয়ালে শুধু তারই ছবি। শুধু একটা ছবির নচে লেখা আছে–ডাঃ তপোব্রত বন্দোপাধ্যায়। তার নীচে দুটি সন-তারিখ-জন্মদিন আর মৃত্যুদিন।
দুর্বা দু’চোখ ভরে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলে, কি সুন্দর দেখতে ছিলেন মেসোমশাই।
দুর্বা, ঠাকুরপো শুধু দেখতে সুন্দর ছিল না, অসাধারণ ভাল সার্জেন ছাড়াও ওর স্বভাব-চরিত্রের কোন তুলনা ছিল না।
ভারতী মুহূর্তের জন্য থেমেই একটু হেসে বলেন, কিছুদিন পর তাতাই এই ঘরে বসবে।
হঠাৎ দুর্বা মুখ ঘুরিয়ে ভারতীর দিকে তাকিয়ে বলে, তাতাই এই মাসীমার ছেলে?
হ্যাঁ।
আর বাবাই কে?
শিবানী এক গাল হেসে বলেন,আমাদের দুজনের পেটে একটা করে ছেলে হলেও আমরা দুজনেই দুটো ছেলের মা।
শুনে দুর্বা খুশির হাসি হাসে। তারপর বলে, আপনাদের দুটো ছেলে কী করছেন? পড়াশুনা নাকি…
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শিবানী চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, বাবাইসোনা দারুণ ছেলে। কানপুর আই-আই-টি থেকে অসাধারণ ভাল রেজাল্ট করে এম. ট্রেক পাশ করে…।
ও বাবা! তার মানে খুবই ভাল ছেলে।
হ্যাঁ, শিল্পী, ও সত্যি খুব ভাল ছেলে।
শিবানী মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, ছেলেটা এখন এত ভাল চাকরি করছে, থলি ভর্তি টাকা আয় করছে কিন্তু কোন চালিয়াতিও নেই, কোন উচ্ছাসও নেই।
ভারতী একটু হেসে বলেন, আমার স্বামীর মত বাবাইও আরেক ভোলানাথ হয়েছে।
মাসীমা, ওকথা বলবেন না। আজকাল বহু ছেলেমেয়েই লেখাপড়ায় ভাল রেজাল্ট করে খুব ভাল চাকরি করছে কিন্তু তাদের অনেকেরই স্বভাব-চরিত্র দেখে অবাক হতে হয়।
ও প্রায় না থেমেই বলে, আপনারা ভাবতে পারবেন না, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই অনেক ছেলেমেয়ে শুধু ড্রিঙ্ক করে না, আরো অনেক কিছু করে।
ভারতী বলেন, হ্যাঁ, সেইরকমই তো শুনতে পাই।
শিবানী বলেন, আমাদের ভাগ্য ভাল,আমাদের ছেলে দুটো সেরকম হয় নি।
আচ্ছা মাসীমা, আপনাদের তাতাইসোনা কি করছেন?
ভারতীর দুটো চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, বাবাই সোনা ঠিক ঠাকুরপোর মতই অসাধারণ সার্জেন হতে চলেছে।
ও আচ্ছা!
ও এত ভাল ছেলে যে একই সঙ্গে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ আর দিল্লির এ-আই-আই-এম-এস এ এম. বি. বি. এসএ চান্স পায়। তাতাই সোনা কলকাতায় না পড়ে দিল্লী চলে যায়। ওখানে এম. বি. বি. এস পড়ে এখন এম. এস. করছে।
দুর্বা একটু হেসে বলে, তার মানে উনিও সার্জারীতে খুব ভাল?
ভারতী বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, তাতাই সোনা বিখ্যাত সার্জেন হতে বাধ্য।
দুই ছেলের জন্যই আপনারা গর্ব করতে পারেন।
শিবানী বলেন, ছেলেদের জন্য ঠিক গর্ব করি না কিন্তু আমাদের নিশ্চয়ই ভাল লাগে।
ভারতী বলেন, তাতাই সোনার মত প্রাণবন্ত ছেলে হয় না। ও যখন এখানে আসে, ও যে আমাদের সবাইকে নিয়ে কি পাগলামী করে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তাই নাকি?
আমাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, ও আমার বুড়ো ভোলানাথকে নিয়ে যে কখন কোথায় যাবে, তার ঠিক ঠিকানা নেই।
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, তাতাই গতবার ছুটিতে এসে কি কাণ্ড করেছিল, তা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
উনি কি করেছিলেন?
ও দাদাকে নিয়ে বেরুবার সময় বলল, মা, আমি জেঠুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি। আবার হাওড়া স্টেশন থেকে ফোন করে বলল, মা, আমরা পুরী যাচ্ছি; কদিন পর ফিরব।
দুর্বা হাসতে হাসতে বলে, আচ্ছা ছেলে তো!
অন্য একটা ঘরে পা দিয়েই শিবানী বলেন, এটা ছেলের ঘর।
মাসীমা, তা আর বলে দিতে হবে না। দেয়ালের পোস্টারগুলো দেখেই বুঝতে পারছি।
ভারতী বুক শেলফ-এর উপর থেকে একটা ছবি তুলে দুর্বার হাতে দিতে বলেন, এই দেখো, আমাদের ছেলেদের ছবি।
আপনাদের দুটো ছেলেই তো বেশ দেখতে।
হ্যাঁ, তা বেশ দেখতে।
শিবানী আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, এই হচ্ছে বাবাই সোনা আর এই হচ্ছে…
ওনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দুর্বা একটু হেসে বলে, তাতাই সোনা, তাইতো?
হ্যাঁ, মা।
চোখ দুটো দেখলেই মনে হয়, আপনাদের তাতাই সোনা বেশ দুষ্ট আছে।
ভারতী আর শিবানী প্রায় একই সঙ্গে বলেন, ঠিক ধরেছ।
ভারতী হাসতে হাসতেই বলেন, ছেলেটা দেখতে দেখতে কত বড় হলো, এম. এস. পড়ছে কিন্তু এখনও বাচ্চাদের মত দুষ্টমি করতে ওর-জুড়ি নেই।
খেতে বসেও কত কথা, কত গল্প হয়। খাওয়া দাওয়ার পরও কত কথা হয় ওদের।
একবার দুর্বা ভারতীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মেলোমশাই কি করেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, উনি একটু বড় ধরনের মিস্ত্রিগিরি…
ওনাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই শিবানী বলে, চুপ কর ভারতী। দাদা মিস্ত্রিগিরি করেন, তাই না?
এবার উনি দুর্বার দিকে তাকিয়ে বলেন, দাদা গেস্টকিন-উইলিয়ামস্-এর চীফ ম্যানেজার-প্ল্যানিং।
তার মানে মেলোমশাই ইজ এ বিগ বস!
শিবানী সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, শিল্পী, তোমার বাবা কি করেন?
বাবা মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। এখন চীফ জেনারেল ম্যানেজর-ওয়ার্কস।
তাইতো বাবাকে হরদম দিল্লী আর হায়দ্রাবাদ ছুটতে হয়।
তার মানে তোমার বাবা বেশ কৃতি পুরুষ।
কৃর্তি পুরুষ কিনা জানি না কিন্তু হি ইজ রিয়লী এ ভেরি গুড ম্যান, এ চামিং হাসব্যান্ড অ্যান্ড লাভলি অ্যাফেকশনেট ফাদার।
বেলা গড়িয়ে যায়; সূর্য ঢলে পড়ে। কফি খেতে খেতে ভারতী বলেন, শিবানী, চল, আমরা দু’জনে গিয়ে দুর্বাকে পৌঁছে দিই।
দুর্বা কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও দেয় না; বলে, না, না, আপনাদের কাউকে যেতে হবে না। আমি একলাই যেতে পারব।
নিশ্চয়ই তুমি একলা যেতে পারে কিন্তু আমরাই তোমাকে পৌঁছে দেব।
দুর্বা আবার আপত্তি করে না কিন্তু শিবানী বলেন, আমাদের যদি যেতে ইচ্ছে করে, তুমি আপত্তি করবে কেন?
ও একটু হেসে বলে, আপনারা সব সময় আমাকে হারিয়ে দিচ্ছেন।
এর পর তুমি আমাদের বার বার হারিয়ে দিও।
রওনা হবার আগে ভারতী বলেন, চলো দুর্বা, আমার বাড়িটা দেখবে।
হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন।
বাড়িটা দেখে বেরুতে বেরুতেই দুর্বা বলে, আপনাদের দুটো বাড়িতেই কোন বাহুল্য নেই। আজকাল অনেক বাড়িতেই এমন দামী দামী আর চকমকে-ঝকঝকে ফার্নিচার রাখে যে মনে হয়, কোন হোটেলে এসেছি।
মা, আমরা আবার কি বাহুল্য করব?
মাসীমা, আজকাল বহু বাড়িতেই লক্ষ্মী-সরস্বতী বিরাজ করেন কিন্তু সেই সব বাড়িতে রুচির পরিচয় বিশেষ পাওয়া যায় না।
হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
ট্যাক্সি ধরার জন্য ওরা তিনজনে মোড়ের মাথার দিকে এগিয়ে চলেন।
শিবানী বলেন, শিল্পী, এই দুই বুড়ীর সঙ্গে সারাটা দিন কাটিয়ে কেমন লাগলো, তা তো বললে না।
মাসীমা, বিশ্বাস করুন, খুব ভাল লেগেছে, খুব আনন্দ পেয়েছি।
দুর্বা না থেমেই হাসতে হাসতে বলে, দেখবেন, এবার থেকে যখন-তখন আপনাদের কাছে এসে যাবে।
ওরা দুজনেই এক সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, মা, এসো খুব খুশি হব।
ওরা দুজনেই এক সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, মা, এসো খুব খুশি হব।