শিখার সাধনা
এক – মহারাণী ইন্দিরা দেবী
কাঞ্চনগড়ের মহারাণী ইন্দিরা দেবীর জন্মতিথি উৎসব। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও পরিচিত যে যেখানে আছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই নিমন্ত্রণ করেছেন মহারাণী।
শিখার কাছেও এসেছিল একখানা নিমন্ত্রণপত্র। শিখার সঙ্গে মহারাণীর পরিচয় খুবই অল্পদিনের। লাটপ্রাসাদে একটা উৎসব উপলক্ষে শিখা গিয়েছিল নিমন্ত্রিত হয়ে—ওখানেই মহারাণীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
মহারাণীকে শিখার খুবই ভাল লেগেছিল, তাই তাঁর নিমন্ত্রণ সে উপেক্ষা করতে পারলো না। নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো সে।
উপহার দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথের দু’খানা কবিতার বইও কিনে নিলো সে—সঞ্চয়িতা আর গীতাঞ্জলি।
আলিপুর রোডের উপরেই কাঞ্চনগড় প্রাসাদ। প্রাসাদের ফটকের সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে বইয়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো শিখা।
প্রাসাদের সামনের চমৎকার ‘লন’টা তখন নিমন্ত্রিতদের মোটর গাড়ীতে ভর্ত্তি হয়ে গেছে। বুইক, পনটিয়াক, হাম্বার, ডি—সোটো, ষ্টুডিবেকার এবং আরও অনেক রকম গাড়ীর বিচিত্র সমাবেশ। বড়লোকদের সম্পদ দেখাবার প্রাথমিক পর্যায়ই হচ্ছে মোটরগাড়ী। মোটরহীন মানুষ মানুষই নয়, বড়লোকদের কাছে। মোটর গাড়ীগুলো দেখে শিখা যেন কিছুটা সঙ্কুচিতা হয়ে পড়ে। গাড়ীর বহর দেখেই সে বুঝতে পারে সমাগত অতিথিদের কাঞ্চনকৌলীন্য।
শিখার মনে হয়, এঁরা সবাই দামী দামী উপহার নিয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই। এঁদের সেইসব দামী উপহারের পাশে তার দেওয়া দুখানা বই…উপহারটা খুবই নগণ্য। কি জানি, সবাই যদি হেসে ওঠে। সবাই যদি করুণার দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে! নাঃ! না এলেই দেখছি ভাল ছিল। কিন্তু এখন তো আর ফিরে যাওয়া চলে না।
প্রাসাদের দরজার সামনে উর্দীপরা নেপালী দরোয়ান সসম্ভ্রমে অভিবাদন করে শিখাকে। সঙ্কুচিতপদে হল—ঘরে প্রবেশ করে সে।
শিখাকে দেখেই মহারাণীর সেক্রেটারী মিস্ চোপরা এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানায়।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সুসজ্জিত হলঘরটা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় উদ্ভাসিত। সমাগত মহিলাদের মিহি—কণ্ঠের হাসির টুকরোগুলির সঙ্গে পুরুষদের কলগুঞ্জনধ্বনি মিশে এক অপূর্ব্ব আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল।
একটু পরেই মহারাণী এসে গেলেন। তাঁর পরণে বহুমূল্য শাড়ী আর সোনার তারের কাজ করা ব্রোকেডের ব্লাউজ। অলঙ্কারের বাহুল্য না থাকলেও যে দু—একখানা অলঙ্কার তিনি পরেছিলেন তার হীরে—জহরতের ঔজ্জ্বল্য দেখে সবাই বুঝতে পারলেন যে এগুলির দাম অনেক।
মহারাণীর অলঙ্কারগুলোর মধ্যে তাঁর হাতের ব্রেসলেট জোড়াই ছিল সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয়। ব্রেসলেটের হীরেগুলো যেন আকাশের তারার মতই ঝিকমিক করছিল।
শোনা গেল সম্প্রতি মহারাজা বোম্বের কোন বিখ্যাত জুয়েলারী ফার্ম থেকে মহারাণীকে তাঁর জন্মদিনে উপহার দেবার জন্য কিনে এনেছেন ঐ ব্রেসলেট জোড়া।
শ্যামনগরের মহারাণী ব্রেসলেট জোড়া দেখে তো রীতিমত আশ্চর্য্যই হয়ে গেলেন। তিনি বললেন যে ঠিক এমনিই একজোড়া ব্রেসলেট নাকি বোম্বের একটা জুয়েলারী দোকানে দেখে এসেছিলেন। ব্রেসলেট জোড়া নাকি খুবই পছন্দ হয়েছিল তাঁর, তাই বাড়ীতে ফিরেই তিনি দেওয়ানজীকে পাঠিয়েছিলেন বোম্বেতে ঐ ব্রেসলেট জোড়া কিনতে। কিন্তু দেওয়ানজী এসে খবর দেন যে ব্রেসলেট জোড়া পাওয়া গেল না। দোকান থেকে ব্রেসলেট জোড়া নাকি চুরি গিয়েছিল।
ব্রেসলেট সম্বন্ধে অতিথিদের এইরকম আলোচনা ভাল লাগলো না মহারাণীর। তিনি ওখান থেকে অন্যদিকে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়াতেই শিখাকে দেখতে পেলেন। শিখাকে দেখেই তিনি তাড়াতাড়ি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন—এই যে মিস্ রায়! আপনি এসেছেন তাহলে? আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আসবেন না।
—কেন বলুন তো? আমি আসবো না এরকম মনে হওয়ার কারণ?
—কারণ এমন কিছু নেই অবশ্য। ভেবেছিলাম যে আপনি যে রকম ব্যস্ত থাকেন, তাতে হয়তো সময়ই করে উঠতে পারবেন না। যাই হোক, যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা না করে যাবেন না কিন্তু!
শিখা মৃদু হেসে সম্মতি জানিয়ে তার উপহারের প্যাকেটটা মহারাণীর হাতে তুলে দিয়ে বললো—আপনার জন্মদিনে আমার এই সামান্য উপহার গ্রহণ করুন মহারাণী!
শিখার দেওয়া বইয়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে তিনি বললেন—সামান্য নয় মিস্ রায়, আপনার উপহার আমার কাছে অসামান্য।
রাত ঠিক আটটার সময় ডিনার আরম্ভ হ’ল। খেতে খেতে গল্পগুজব চলতে থাকে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে। দেশের অবস্থা থেকে আরম্ভ করে যুদ্ধ, জাপান, জার্ম্মানী, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্ল্যাক—মার্কেট প্রভৃতি নানা বিষয়ের অবতারণা হতে থাকে ডিনার টেবিলের আলোচনায়।
ডিনার শেষে বিদায় নেবার সময় শিখার হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে মহারাণী তাকে দেখা করে যেতে বলেছিলেন।
শিখা তখন মিস্ চোপরাকে জিজ্ঞাসা করে—মহারাণী কোথায় মিস্ চোপরা?
শিখার এই প্রশ্নে মিস্ চোপরা সবিনয়ে জানায় যে মহারাণী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে শুয়ে পড়েছেন।
—কিন্তু আমাকে যে তিনি যাবার আগে একবার দেখা করে যেতে বলেছিলেন।
—আমি খুব দুঃখিত মিস্ রায়। মহারাণী আমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে আজ আর কারো সঙ্গেই দেখা করতে পারবেন না তিনি।
এই কথা শুনবার পর আর ওখানে দেরী করা উচিত নয় বিবেচনা করে শিখা বেরিয়ে যায় হলঘর থেকে। মিস্ চোপরা দরজা পর্য্যন্ত এগিয়ে দেয় তাকে।
পথে খানিকদূর হেঁটে গেল শিখা, বাস দাঁড়াবার জায়গা পর্য্যন্ত।
বাসের অপেক্ষায় যেখানে শিখা দাঁড়ালো, সেখানে একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকও দাঁড়িয়েছিলেন।
পথের আলো তাঁর উপর পড়েছিল। দীর্ঘ সুগঠিত বলশালী দেহ, মাথায় পাগড়ী, পরণে পাঞ্জাবী, ঢিলা পোষাক—বয়স বড় জোর ত্রিশবত্রিশ হবে।
শিখার মনে হয় পাঞ্জাবী ভদ্রলোক তার পানেই তাকিয়ে আছেন। মনে মনে সে অস্বস্তি অনুভব করে। বাসখানা তাড়াতাড়ি আসেও না, মিনিট পনের সে অপেক্ষা করছে। হাতের ঘড়ির পানে সে একবার তাকায়—দশটা বাজে।
শান্ত কণ্ঠে ভদ্রলোক ডাকলেন, ”শুনুন, এ পথে বাস আসবে না শুনলুম, রাস্তায় হঠাৎ গোলমাল বেধেছে। একখানা বাস নাকি পুড়িয়ে দেবার চেষ্টাও করেছে গুণ্ডার দল। সঙ্গে সঙ্গে বাস বন্ধ হয়ে গেছে। আপনি বরং ট্যাক্সি করে চলে যান, অনর্থক বাসের প্রত্যাশায় থাকবেন না। রাস্তাতেও যখন গোলমাল রয়েছে—”
বিস্মিতা শিখা তাঁর পানে এতক্ষণে ভালো করে তাকায়।
সে মৃদুকণ্ঠে ধন্যবাদ জানায়।
ভদ্রলোক ট্যাক্সির জন্য এদিক ওদিক খোঁজ করতে লাগলেন।
শিখা শান্ত কণ্ঠে বললে, ”থাক, আপনাকে ট্যাক্সির জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না, আমি নিজেই ট্যাক্সি ডেকে নেব’খন।”
কিন্তু ভদ্রলোক সে কথা শোনেন না। চলন্ত একখানা ট্যাক্সিকে তিনি ডাকেন—
”উঠে পড়ুন মিস্ রায়, রাত হয়ে গেছে, দেরী করবেন না—।”
ধন্যবাদ জানিয়ে শিখা বললে, ”আপনার এই অযাচিত উপকারের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?”
একটু হেসে ভদ্রলোক বললেন, ”আপনি আমাকে না চিনলেও, আমি আপনাকে চিনি। হয়ত একদিন আপনাকে আমার দরকার হবে। আপনার পরিচয় আমি আগেই পেয়েছি।”
”আপনার নাম ঠিকানাটা পেলে অত্যন্ত আনন্দিত হতুম।”
পাঞ্জাবী যুবক একটু হাসলেন, ধীরকণ্ঠে বললেন, ”আমার নাম পার্থ সিং, পৃথিবীতে আমি একা—আর কলকাতায় নবাগত, আমার দেশ পাঞ্জাবে। এখানে আমি এক বিশেষ কাজে এসেছি, সম্ভবতঃ শীঘ্রই আবার ফিরতে হবে, সে জন্যে আজ আমার বর্ত্তমান ঠিকানা আপনাকে দিয়ে কোন লাভ নেই। আশা করি সে জন্যে আমায় মাপ করবেন। আচ্ছা নমস্তে—”
”নমস্তে—”
ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করে।
চলন্ত ট্যাক্সি হতে মুখ বাড়িয়ে শিখা দেখতে পায় পার্থ সিং তখনও দাঁড়িয়ে আছেন, হয়ত কি ভাবে তিনি ফিরবেন তাই চিন্তা করছেন।
ট্যাক্সি দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করে—পার্থসিংকে আর দেখা যায় না।
দুই – জুয়েলারী দোকানে চুরি
শিখা যে অবশেষে এই ডিটেকটিভ লাইনটাই বেছে নেবে তা কেউই ভাবতে পারেনি। তার ভূতপূর্ব্ব সহপাঠিনীরা সবাই আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ এমন কথাও বলতো, ”শেষকালটায় এই বিপদের লাইনটাই জীবনে বেছে নিলে শিখা। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে তুমি শেষপর্য্যন্ত ডিটেকটিভ হবে। এরকম বিপদের লাইন…”
শিখার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে বান্ধবীদের কথায়। সে বলে, ”ছেলেবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চারটা আমার ভাল লাগে। একটা বড় অ্যাডভেঞ্চারে নাম কিনে ফেললুম। পুলিসের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্ট প্রচুর উৎসাহ দিচ্ছে। একটা বড় চাকুরীরও অফার পেয়েছি। তবে আমি মনে করছি যে মাইনের চাকরি আমি নেবো না। হুকুম দিয়ে আমায় কেউ কোনদিন কাজ করাতে পারবে না, আমি যা করব তা আমার খুশীমতই করব। নিত্য—নূতন উত্তেজনার পেছনে ছুটতে কি যে আনন্দ তা যদি জানতে—”
বন্ধুরা চুপ করে যায়।
আসল কথা—শিখার বরাবরই ঝোঁক ছিল এই রকম উত্তেজনামূলক কাজের দিকে—তাই আজ কেউ তাকে বাধা দিলেও সে তা শুনবে না।
শিখার কাকা পত্র লেখেন—”এসব কি শুনতে পাচ্ছি শিখা, তুমি নাকি ডিটেকটিভের কাজ করবার ইচ্ছা করেছো? খবরের কাগজে পড়লাম, সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয়েছে—”ধন্য বাঙ্গালী মেয়ে”—এ টিটকারী তুমি সইতে পারছো কি করে? শেষ পর্য্যন্ত বংশের নাম ডোবাবে নাকি?”
সংবাদপত্রের মন্তব্যটা শিখা আগেই দেখেছে। তাতে তার সুখ্যাতিই করেছিল। মন্তব্যটা ছিল এইরকম :—
”কুমারী অগ্নিশিখা রায় চট্টগ্রামের মেয়ে এবং সায়ান্স কলেজের ছাত্রী। তাঁর তীক্ষ্ন বুদ্ধির পরিচয় আমরা পূর্ব্বেই পেয়েছি। তাঁর খুল্লতাত মেজর অতুলকৃষ্ণ রায়ের নাম বাঙ্গালীমাত্রেই জানেন। কুমারী অগ্নিশিখা স্বেচ্ছায় ডিটেকটিভের কাজ নির্ব্বাচন করে নিয়েছেন তাঁর জীবনে, সেজন্য তাঁকে আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। কুমারী রায় বাঙ্গালী মেয়েদের সামনে আদর্শস্থানীয়া হয়ে থাকুন, এবং দীর্ঘজীবন লাভ করে পরের হিতব্রত পালন করে যান এই কামনা আমরা সর্ব্বান্তঃকরণে করছি।”
শিখা লেখাটা পড়ে হেসেছিল সেদিন। খবরের কাগজওয়ালারা একটা কিছু পেলেই হয়—
* * *
চা পান করে শিখা একবার বের হওয়ার উদ্যোগ করছিল এমন সময় রতন এসে খবর দিলে—কাঞ্চনগড় রাজবাড়ী থেকে জরুরী খবর নিয়ে লোক এসেছে, এখনই দেখা করতে চায়।
বিরক্ত হয় শিখা।
সকাল আটটায় সে বউবাজারে যাবে বিশেষ দরকারে। কাল সন্ধ্যায় ওখানকার থানার ও. সি. যতীনবাবু এসেছিলেন একটা দুঃসাহসিক চুরির তদন্তের জন্য তার সাহায্য চাইতে। চুরিটা নাকি কোন এক তরুণীর দ্বারা ঘটেছে এবং সেই কারণেই শিখাকে তাঁর দরকার। শিখারও উৎসাহ বড় কম নয়। সেইখানেই চলেছে সে চুরির বিবরণ যা সে শুনেছিল তা এই রকম :—
”অপূর্ব্ব সুন্দরী এক তরুণী দুজন সঙ্গী নিয়ে প্রায়ই আসতেন বউবাজারের এক জুয়েলারী দোকানে। দামী মোটরগাড়ী করে তিনি আসতেন এবং যখনই আসতেন কিছু না কিছু গহনা কিনতেন। সেদিনও মোটরেই এসেছিলেন তিনি। কাউণ্টারে দাঁড়িয়ে অনেক রকম জড়োয়ার নেকলেস ঘেঁটে অবশেষে একগাছা সাধারণ হার কিনে নিয়ে চলে যান। চুরিটা ধরা পড়ে তিনি চলে যাবার পরেই।
বহুমূল্য হীরকখচিত একটি নেকলেস বার বার দেখছিলেন তিনি। কর্ম্মচারীরা মনে করেছিল ঐ নেকলেসটিই তিনি পছন্দ করেছেন। কর্ম্মচারীরা তাঁকে মোটেই সন্দেহ করেনি। ওদের সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কখন যে ঠিক সেই রকমই নকল হীরাখচিত কেমিকেল সোনার তৈরী একটা নেকলেস আসল নেকলেসের বাক্সে রেখে আসলটা সরিয়ে নিয়েছেন কেউ তা বুঝতে পারেনি। মেয়েটির সঙ্গে আরও একটি তরুণী ছিল সেদিন।
যতক্ষণ তাঁদের কেনা—কাটা, দাম চুকানো শেষ হয়নি, ততক্ষণ সেই নেকলেসের বাক্সটা তাঁদের কাছেই ছিল, সুতরাং কোন ফাঁকে যে ওটা বদলে ফেলেছিলেন কে জানে?
নেকলেসটার দাম কয়েক হাজার টাকা।
দোকানের বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী হুজুরীমলও সন্দেহ করতে পারেননি, কখন আসল নেকলেস সরে গিয়ে নকল এসে সেই স্থান দখল করেছে। শুধু তিনি কেন, আশপাশে যে সব কর্ম্মচারী ছিল তারাও কেউ বুঝতে পারেনি, কি ভাবে এই সাংঘাতিক ঘটনাটা ঘটে গেল।
পুলিসে খবর যেতে যতীন্দ্রনাথ নিজেই আসেন তদন্ত করতে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে মেয়েটি যে ঠিকানা ও নাম দিয়ে গেছেন তা একেবারেই বাজে।
অনেক খুঁজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তিনি শিখার কাছে গিয়েছিলেন।
শিখা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছে, সে যতটুকু পারে চেষ্টা করবে, তবে কৃতকার্য্য হওয়া ভগবানের হাত।
আটটার সময় শিখার বউবাজারে যতীন্দ্রনাথের কাজে যাওয়ার কথা। তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দিলালের দোকানে যাবেন, এমন সময় একি বাধা উপস্থিত হ’ল!
বিরক্ত হয়ে শিখা বললে, ”হাঁকিয়ে দাও! ওকে বল গিয়ে, দিদিমণি এখন ঘুমোচ্ছেন, দেখা হবে না।”
রতন মাথা চুলকায়। বলে, ”কিন্তু বিশেষ জরুরী দরকার দিদিমণি, লোকটা একেবারে হাঁপাচ্ছে। এখনই তোমায় যেতে হবে, এ কথা বার বার করে বলছে।”
শিখা হাতের ঘড়ি দেখে—সাড়ে সাতটা বাজে। বললো, ”বল গিয়ে, আমি আসছি।”
রতন চলে গেল।
তিন – মহারাণীর বিনয়
মহারাণী ইন্দিরা চিঠি পাঠিয়েছেন। প্রেরিত লোকের মুখের কথা যদি শিখা বিশ্বাস না করে তাই ইংরাজীতে নিজেই লিখে দিয়েছেন—বিশেষ দরকার, শিখার এখনই আসা চাই।
শিখার মুখখানা শক্ত হয়ে ওঠে।—
সে কথা বলে নেয়—বেশীক্ষণ সে থাকতে পারবে না, আধঘণ্টার মধ্যে তাকে বউবাজার থানার সামনে নামিয়ে দিতে হবে।
ভাবলেশহীন মুখে ড্রাইভার কেবল মাথা নাড়ে।
লোকটাকে দেখে খুশী হতে পারে না শিখা। বিরাট—দেহ সেই পাঞ্জাবী ড্রাইভারটিকে দেখে ভাল লোক বলে মনে হয় না শিখার। এমন একটা চোয়াড়ে লোককে ড্রাইভারের কাজ কেন দিয়েছেন মহারাণী, এই কথাই তার মনে হয়।
আধঘন্টার মধ্যেই কাঞ্চনগড় প্যালেসে পৌঁছে যায় ওরা।
মহারাণীর সেক্রেটারী মিস্ চোপরা তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করে দোতলায় নিয়ে যায় মহারাণীর কাছে।
একখানা সোফায় মহারাণী ইন্দিরা বসে ছিলেন। মুখখানা তাঁর খুবই বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
শিখাকে দেখেই তিনি ব্যগ্রকণ্ঠে বলেন, ”আসুন—মিস্ রায়; আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।”
শিখা ঘরে প্রবেশ করে বিনীতভাবে অভিবাদন করে।
প্রত্যভিবাদন করে মহারাণী বললেন, ”বসুন মিস্ রায়, বিশেষ দরকারে, অর্থাৎ ভীষণ বিপদে প’ড়েই আপনাকে এমন জরুরী কল দিতে হয়েছে।”
শিখা সোফার ধারে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললো, ”কিন্তু আমি তো খুব বেশীক্ষণ থাকতে পারব না মহারাণী, আধঘণ্টা সময় মাত্র আপনাকে দিতে পারব—আপনি তার মধ্যে—”
শশব্যস্তে মহারাণী বললেন, ”না না, বেশীক্ষণ আপনাকে আমি আটক করে রাখব না মিস্ রায়, আধঘণ্টার মধ্যেই সব জানতে পারবেন।”
মিস্ চোপরাকে তিনি আদেশ করলেন, ”তুমি বাইরে অপেক্ষা করো, ঘণ্টা দিলে এসো। আমি ততক্ষণে মিস্ রায়ের সঙ্গে জরুরী কথাগুলো শেষ করে নিই।”
মিস্ চোপরা ঘর থেকে চলে যেতেই মহারাণী শিখার পাশে সরে বসলেন। বললেন, ”আপনি বোধহয় জানেন আমরা পাঞ্জাবের অধিবাসী, আমার স্বামী ওদিককার মস্ত বড় জমিদার এবং গভর্ণমেণ্ট তাঁকে মহারাজা উপাধি দিয়েছেন?”
শিখা উত্তর দিলো, ”জানি মহারাণী। আর এও আমি জানি যে আপনি মাত্র বছরখানেক এসেছেন এবং এরই মধ্যে আপনি কলকাতার অভিজাত সমাজে যে খ্যাতি অর্জ্জন করেছেন সে রকম খ্যাতি অনেকের অদৃষ্টেই জোটে না।”
মহারাণী বিষণ্ণ মুখে বললেন, ”ওই খ্যাতিটাই তো আমার সর্ব্বনাশ করেছে মিস্ রায়। আপনি হয়তো জানেন আমার জন্মদিনে মহারাজা আমায় বহুমূল্য একজোড়া ব্রেসলেট উপহার দিয়েছিলেন; সেই ব্রেসলেট জোড়া খোয়া গেছে।”
”খোয়া গেছে—মানে?”
শিখা যেন আকাশ থেকে পড়ে। সেই ব্রেসলেট জোড়া সেদিন সে দেখেছিল, আর এটাও সে বুঝতে পেরেছিল যে ব্রেসলেট জোড়ার দাম অনেক—মহামূল্য বললেই হয়।
মহারাণী বলে যান—”পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে এবং তদন্ত চলছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি মিস্ রায়, পুলিশের উপর আমার মোটেই আস্থা নেই। ওরা কেবল সহজ ব্যাপারকে ঘোলাটে করতেই পারে। ‘ট্যাকটফুলি’ তদন্ত করে চোরাই মাল খুঁজে বের করা ওদের দ্বারা সম্ভব নয়।”
এই বলে একটু চুপ করে থেকে মহারাণী আবার বললেন—”ব্রেসলেট জোড়া যে অত্যন্ত মূল্যবান তা বোধ হয় আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না?”
—”না। যে ব্রেসলেট জোড়া সেদিন আপনাকে পরে থাকতে দেখেছিলাম, তার সঠিক দাম জানা না থাকলেও, ওর দাম যে অনেক তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, আমাকে কি করতে বলছেন ও ব্যাপারে?”
—”আপনাকেই আমি এই ব্রেসলেট চুরির তদন্ত ভার দিতে চাই মিস্ রায়। খবরের কাগজে আপনার সম্বন্ধে যে সব সুখ্যাতি পড়েছি, তাতে আমার মনে হয় আপনি ছাড়া আর কেউ এ চুরির কিনারা করতে পারবে না।”
শিখা বললো, ”মহারাজা কোথায়? তাঁর সঙ্গে আমি দু—একটা কথা বলতে চাই।”
বিষণ্ণ হাসি হেসে মহারাণী বললেন—”ওঁর সঙ্গে দেখা করে কি করবেন মিস্ রায়। মহারাজা কি আর মানুষ আছেন?”
—”তার মানে?”
—”মানে, তাঁকে মানুষ না বলে জড় পদার্থ বললেই হয়। আপনি হয়তো জানেন না যে তিনি ভালভাবে কথা বলতেই পারেন না। তিনি যদি মানুষের মত মানুষ হতেন, তাহলে তো সব কিছু তিনি নিজেই করতে পারতেন, আমাকে আর কিছু দেখাশুনা করতে হতো না। আর এইজন্যই তো আমার পেছনে শত্রু ঘুরছে।”
শিখা আশ্চর্য্য হয়ে যায়।
দুই মাস আগে মহারাণীর জন্মদিনে সেই ব্রেসলেট জোড়া মহারাজা বোম্বে থেকে কিনে এনে দিয়েছেন, এই কথাই সে শুনেছিল। মহারাজাকে সেদিন সে দেখতে পায়নি, আজও পেলো না।
শিখা বললো—”কিন্তু সেদিন আপনার জন্মদিনের উৎসবে শুনেছিলাম মহারাজা নিজে বোম্বে থেকে ব্রেসলেট জোড়া পছন্দ করে কিনে এনে আপনাকে উপহার দিয়েছেন—অথচ আপনি বলছেন—”
বাধা দিয়ে মহারাণী বললেন, ”হা আমার কপাল। মহারাজা কি নিজে বোম্বে থেকে কিনে এনেছেন? এনেছেন মহারাজের এক বন্ধু। আমার পছন্দ হতেই তিনি দাম দিয়ে দিলেন। সময় সময় মাথাটা তাঁর একটু ভাল থাকে, কিন্তু এত কম সময়ের জন্য যে সেটা ধর্ত্তব্যের মধ্যেই নয়। টাকা পয়সা ধন দৌলতের অভাব নেই বটে, কিন্তু যে জ্বালা অহরহ আমি ভোগ করছি সেটা মুখ ফুটে কারুর কাছে বলতে পারি না। আপনিও তো মেয়েমানুষ, এ জ্বালার কথা আপনাকে আর খুলে কি বলব—দ্বিচারিণী তো হতে পারি না।”
বিষাদের হাসি হাসলেন মহারাণী।
শিখা জিজ্ঞাসা করলো, ”নিশ্চয়ই তাঁর চিকিৎসা করাচ্ছেন। কে চিকিৎসা করছেন?”
মহারাণী বললেন, ”আমার কথা শুনে দুঃখ করবেন না মিস্ রায়। এখানে এরকম ডাক্তার হয়তো আছেন যারা উন্মাদের চিকিৎসা করেন, কিন্তু আমি তাঁদের বিশ্বাস করতে পারিনি। বোম্বে থাকতে বিখ্যাত ডাক্তার রবিশঙ্কর মহারাজার চিকিৎসা করতেন; এখন এই এক বৎসর বাংলাতে এলেও তিনিই চিকিৎসা করছেন। বিখ্যাত ডাক্তার রবিশঙ্করের নাম আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন। তিনিই আমাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান।”
শিখা স্মিতমুখে বললে, ”আমার দুর্ভাগ্য, আমি এই প্রথম আপনার কাছে তাঁর নাম শুনছি। বোম্বে আমি কোনদিন যাইনি বলেই হয়তো তাঁর পরিচয় পাইনি। তা, ডাক্তার রবিশঙ্করের চিকিৎসায় মহারাজা নিশ্চয়ই উন্নতির দিকে যাচ্ছেন?”
মহারাণী বললেন—”তা কিছুটা যাচ্ছেন বৈকি! আমাদের এ স্টেটের নিজস্ব প্লেন আছে; পনেরো দিন অন্তর তিনি আসেন, একদিন বা দুদিন এখানে থেকে রোগীর অবস্থা দেখেন। কিন্তু ওসব কথা এখন থাক মিস্ রায়, আপনি বলুন আমার কেসটা আপনি নেবেন কি না? অবশ্য এর জন্যে উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিশ্চয়ই আপনি পাবেন। পুলিশকে আমি বিশ্বাস করি না বলেই আপনাকে জোর করে ধরছি, আমার কেসটা আপনি নিন।”
শিখা হেসে বললে, ”কিন্তু আর একটা কেস আমি আগেই নিয়ে ফেলেছি মহারাণী—বউবাজার থানার ও.সি.—র বিশেষ অনুরোধ এড়াতে না পেরে আনন্দিলালের কেসটা আমায় নিতে হয়েছে।”
মহারাণীর মুখখানা যেন বিষণ্ণ হয়ে যায় এই কথা শুনে।—একটু থেমে তিনি বলেন, ”আমি যদি আনন্দিলালের চাইতে ডবল পারিশ্রমিক দিই আপনাকে?”
শিখা ঘাড় নাড়ে। বলে, ”টাকাটাই সব নয় মহারাণী। আমি সেখানে কথা দিয়েছি।”
মহারাণী তবুও ছাড়বার পাত্রী নন। গলাটা একটু কেসে পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন, ”দূর হোক গে ব্রেসলেট। আমার পেছনে যে শত্রুদল ঘুরছে, সেই দলটাকে খুঁজে বের করবার ভার আপনি নিন।”
শিখা উঠে দাঁড়ায়। বলে, ”সময় পেলে নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করব মহারাণী, আচ্ছা আজ তাহলে চলি, নমস্কার।”
এই বলেই শিখা চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
শিখার প্রত্যাখ্যানে দুঃখিত হন মহারাণী। রাগও হয় তাঁর মনে মনে। নিশ্চল পাথরের মুর্ত্তির মত তাকিয়ে থাকেন তিনি শিখার চলার পথের দিকে।
শিখা তখন ঘর থেকে চলে গেছে।
চার – দস্যুর চ্যালেঞ্জ
যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিখা আনন্দিলালের বউবাজারের দোকানে উপস্থিত হ’ল।
আনন্দিলাল সসম্ভ্রমে তাঁদের অভিবাদন করলেন।
শিখার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,—”যেমন করেই হোক, আপনাকে এ কেসটার সুরাহা করতেই হবে মিস্ রায়। সে মেয়েকে আমি দেখিনি, আমার কর্ম্মচারীরা দেখেছে, হয়তো তারা দেখলেই চিনতে পারবে। নূতন ঝকঝকে ক্যাডিলাক গাড়ীতে তারা এসেছিল।”
শিখা বললো—”কিন্তু তারা এমন কোন কিছু রেখে যায়নি শুনলাম, যা থেকে সূত্র পাওয়া যায়। যতীনবাবুর কাছে শুনলাম ঠিকানা যা দিয়ে গেছে—সেখানে কোন বাড়ী নেই, একটা বস্তী আছে মাত্র। যাই হোক, আপনি সেই নকল হারটা নিয়ে আসুন।”
নকল হারটা দেখলো শিখা। চমৎকার গড়ন, দেখলে মুগ্ধ হতে হয়।
লকেটের এককোণে কি যেন লেখা আছে মনে হ’ল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিখা বার বার লেখাটা দেখতে লাগলো।
হারটা একদিনের জন্যে চেয়ে নেয় শিখা, উদ্দেশ্য বাড়ীতে গিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাশ দিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবে লেখাটা পড়তে পারা যায় কি না?
হারটা দিতে আনন্দিলাল আপত্তি করলেন না।
মোটরে উঠতে উঠতে উৎসুককণ্ঠে যতীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ”কি ব্যাপার? কোন সূত্র পেলেন নাকি?”
সংক্ষেপে শিখা বললো—”এখনও পাইনি, তবে শীগগিরই পাব আশা করছি, আর সেই জন্যেই বাড়ী নিয়ে যাচ্ছি হারটা। যদি রহস্য উদ্ধার করতে পারি, আপনাকে জানাব।”
যতীন্দ্রনাথ শিখাকে তার বাড়ীতে পৌঁছে দেন।
মোটর থেকে নামবার সময় শিখা থমকে দাঁড়ায়। দরজার পাশে বসে একটা অন্ধ ভিখারী ভিক্ষা চাইছে—”একটা পয়সা দাও বাবা, কাল থেকে কিছু খেতে পাইনি।”
শিখা ব্যাগ খুলে একটা সিকি বের করে ভিখারীটার হাতে দিয়ে যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে।
অসন্তুষ্ট ভাবে যতীন্দ্রনাথ বলেন, ”আপনি ওই লোকটিকে ভিক্ষা দিলেন কেন? ওতে কুড়েমির প্রশ্রয় দেওয়া হয় মাত্র—”
—”সকলেই যে কুড়ে হবে তার কি মানে আছে? কাজের অভাবেও অনেকে কুড়ে বনে যায়।” বলতে বলতে শিখা থমকে দাঁড়ায়—”রতনটার কি কাণ্ড বলুন তো? দরজাটা একেবারে হাট করে খুলে রেখে দিয়েছে!”
যতীন্দ্রনাথ শিখাকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন। শিখা বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করে দুখানা চিঠি দেখতে পায়। একখানা ডাকে এসেছে। লিখেছেন তার কাকা, মেজর অতুল রায়। তিনি জানাচ্ছেন—উপস্থিত তিনি বার্মা ফ্রণ্ট থেকে পত্র দিচ্ছেন; এ জায়গা পর্য্যন্ত ইংরেজের দখলে এসেছে। তিনি আরও লিখেছেন যে শিখার মা ও কাকীমা আর যশোরে থাকতে চাচ্ছেন না, হয়তো তারা দু’ একদিনের মধ্যে কলকাতায় এসে পড়বেন।
অপর চিঠিখানা সম্ভবতঃ কেউ হাতে দিয়ে গেছে। কভারটা ছিঁড়তেই শিখার দুই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। চিঠির কাগজের মাথায় আঁকা একটি নর—কঙ্কালের ছবি। কি বীভৎস মূর্ত্তিটি! কঙ্কালটা যেন হাত বাড়িয়ে ধরতে আসছে তাকে।
শিখা ইংরাজিতে লেখা সেই চিঠিখানা পড়ে।
”কুমারী রায়—
অনর্থক এ সব ব্যাপারে আপনি আসবেন না। আপনি স্ত্রীলোক বলেই আপনাকে সতর্ক করছি, নইলে অনেক আগেই আপনার ব্যবস্থা করা হ’ত। আমাদের দলের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন করবার উদ্দেশ্যে আপনার শয়ন কক্ষে একটুখানি নিদর্শন রেখে গেলাম। ভয় পাবেন না। রতনকে হত্যা করা হয়নি। আমরা যে যখন খুশী আপনার মত একটি মেয়েকে সায়েস্তা করবার ক্ষমতা রাখি সেই কথাটা বুঝাতেই আপনার চাকর বেচারাকে ঘন্টাকয়েকের জন্য অচেতন করে রাখতে বাধ্য হলাম। এরপর আশা করি আমাদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করবার ইচ্ছাটা পরিত্যাগ করবেন। কিন্তু এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও যদি আপনি আমাদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি না ছাড়েন, তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবেন। ইতি…
কঙ্কাল।”
চিঠিখানা পড়েই শিখা তাড়াতাড়ি সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে লাগলো।
রতন আহত হয়েছে। আহা বেচারা। না জানি কি অবস্থা হয়েছে তার?
দোতলায় উঠেই রিভলভারটা বের করে হাতে নেয় শিখা।
রিভলভার বের করবার উদ্দেশ্য—কেউ যদি তখনও ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তাহলে শুধু হাতে তার সঙ্গে এঁটে নাও উঠতে পারে সে।
রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে সে এগিয়ে যায় তার শয়নকক্ষের দিকে। পা দিয়ে ভেজানো দরজাটায় ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলে। ঘরের ভিতর প্রবেশ করে সে। ঘরে ঢুকেই তার নজর পড়ে মেঝের দিকে। মেঝের উপরে নির্জীবের মত উপুড় হয়ে পড়ে আছে রতন।
ঘরের চারিদিকে ভাল করে লক্ষ্য করে শিখা দেখতে পায় যে তার বাক্স সুটকেশ আর টেবিলের ড্রয়ারগুলো সব খোলা।
কিন্তু সেদিকে নজর দেবার মত মনের অবস্থা তখন তার ছিল না। সে তাড়াতাড়ি রতনের পাশে হাঁটুগেড়ে বসে কোথায় তার আঘাত লেগেছে দেখতে চেষ্টা করে।
রতনকে ভাল করে পরীক্ষা করবার পর শিখা বুঝতে পারে যে আঘাতটা গুরুতর হলেও প্রাণের আশঙ্কা নেই তার।
রতনের মাথার ঠিক মাঝখানে একটা আঘাতের চিহ্ন। আঘাতের জায়গাটা দেখে শিখার মনে হ’ল যে আঘাতটা কোন রকম ভোঁতা জিনিস দিয়ে করা হয়েছিল।
শিখা তখন আর এক মুহূর্ত্ত সময়ও নষ্ট না করে রতনের শুশ্রুষায় আত্মনিয়োগ করলো। ঘরের এক কোণে কুঁজোয় ভর্ত্তি জল ছিল। কুঁজো থেকে একটা গ্লাসে করে খানিকটা জল ঢেলে নিয়ে সে রতনের চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলো।
বার কয়েক জলের ঝাপটা দিতেই চোখ মেলে চাইলো রতন। রতনকে তাকাতে দেখে শিখা বললো—”খুব লেগেছে, না রতন?”
রতন ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দিল—হ্যাঁ দিদিমণি। ওরা একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছিল আমার মাথায়।” এই কথা বলেই উঠে বসতে চেষ্টা করে রতন। রতনকে উঠতে দেখে শিখা বললো, ”এখনই উঠতে চেষ্টা করো না তুমি। আমি তোমার জন্য এক কাপ দুধ গরম করে নিয়ে আসছি, ততক্ষণ তুমি শুয়েই থাকো।”
রতন কিন্তু শিখার নিষেধ না শুনে উঠে বসলো। সে বললো—”আপনি ব্যস্ত হবেন না দিদিমণি। আমার খুব বেশী লাগেনি।”
শিখা বললো—”বেশ তাহলে চলো তোমাকে তোমার বিছানাতে শুইয়ে দিই। ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেওয়া তোমার খুবই দরকার।”
শিখা তখন রতনকে ধরে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দুধ গরম করে আনতে চলে গেল।
দুধ গরম করতে যাওয়ার পথে সে তার বসবার ঘরে গিয়ে যতীন্দ্রনাথকে টেলিফোন করলো।
শিখার টেলিফোন পেয়ে যতীন্দ্রনাথ আশ্চর্য্য হয়ে বললেন—”কি ব্যাপার মিস্ রায়? হঠাৎ টেলিফোন করছেন যে?
শিখা বললো—”আপনি এক্ষুণি একবার চলে আসুন এখানে, বিশেষ দরকার।”
”কি ব্যাপার?” প্রশ্ন করলেন যতীনবাবু।
শিখা তখন সংক্ষেপে সেই চিঠির কথা এবং রতনের আহত হবার কথা তাঁকে জানিয়ে দিয়ে বললো—”আপনি আর দেরী করবেন না যতীনবাবু, দয়া করে এক্ষুণি চলে আসুন।”
যতীন্দ্রনাথ বললেন—”বেশ, আমি আধঘণ্টার মধ্যেই যাচ্ছি।”
যতীনবাবু আসছেন শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে শিখা রতনের জন্য দুধ গরম করতে বাড়ীর ভিতরে চলে গেল।
পাঁচ – আবার পার্থ সিং
পরের দিন সংবাদপত্রে বেশ ফলাও করে খবরটি প্রকাশিত হ’ল। সর্ব্বশেষে মন্তব্য করেছেন সম্পাদক, ”আশা করছি কুমারী রায় এবং পুলিশ ইনসপেক্টার যতীন বসু শীঘ্রই সকল রহস্য ভেদ করতে পারবেন।”
শিখা খবরটা পড়ে যতীনবাবুকে দেয় কাগজখানা। রতন মুরুব্বীর মত মাথা দুলিয়ে বললে, ”ঠিক লিখেছে দিদিমণি। তুমিই পারবে ডাকাতগুলোকে ধরতে। তার ওপরে যতীনবাবু রয়েছেন।”
শিখা তাকে এক ধমক দেয়। বলে, ”তুই চুপ কর তো রতন।”
যতীনবাবু কাগজখানা মুড়ে রেখে বলেন,—
”সেদিন দরজার সামনে যে ভিখারীটা অন্ধের ভান করে অপেক্ষা করছিল, সে ওদের দলের লোক ছাড়া আর কেউ নয়। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। যাই হোক, কোন বিপদ আপদ ঘটেনি যে সেই রক্ষে!”
যতীনবাবু সেদিন খুব সকালেই এসেছিলেন শিখার বাড়ীতে। কে বা কাহারা শিখার বাড়ীতে বেআইনীভাবে প্রবেশ করে রতনকে জখম করেছে এবং শিখাকে চিঠি লিখে ভয় দেখিয়ে গেছে, সেই বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন যতীনবাবু, কিন্তু চিন্তা করেও এর কোন কূল—কিনারা বের করতে তিনি পারেন না।
বিষয়টা নিয়ে শিখাও কম চিন্তা করেনি।
কে এই দলের নেতা?
নরকঙ্কালের প্রতীক চিহ্নই বা ব্যবহার করে কেন তারা? আনন্দিলালের দোকানে চুরির সঙ্গে যে এই দলের সম্পর্ক আছে তা তো স্পষ্টই বুঝতে পারা যাচ্ছে।
শিখাকে অন্যমনস্ক দেখে যতীনবাবু বললেন—”কি ভাবছেন বলুন তো?”
—”ভাবছি এই দলের কথাটাই। তাছাড়া আরও একটা কথা ভাবছি আমি।”
—”কি?”
—”আমি ভাবছি যে বাড়ীতে একজন দরোয়ান রাখা দরকার। আছে আপনার খোঁজে কোন ভাল দরোয়ান?”
যতীনবাবু বললেন—”ঠিকই বলেছেন মিস্ রায়, আপনার বাড়ীতে একজন দরোয়ান থাকা খুবই দরকার। আমার হাতে একজন ভাল লোকও আছে।”
—”কি করে লোকটা?”
—”করে না, করতো। লোকটা পুলিশেই চাকরী করতো কিন্তু হুজুগে পড়ে ধর্ম্মঘট করতে গিয়ে চাকরীটা গেছে বেচারার।”
যতীনবাবুর কথায় শিখা হেসে বললো—”বেশ লোক দিতে চাচ্ছেন আমাকে! না, যতীনবাবু, আপনার ঐ ধর্ম্মঘটী লোক নিয়ে আমার চলবে না।”
যতীনবাবু বললেন—”না না, যা ভাবছেন তা নয়। লোকটা সত্যিই ভাল। তাছাড়া ডি. ডি. তে অনেকদিন চাকরী করায় কলকাতার অপরাধীদের প্রায় সবাইকেই সে চেনে। বন্দুক চালাতে বা রিভলভার ছুঁড়তেও ভালই জানে লোকটা। এখন বেকার হয়ে চাকরী খুঁজছে। আমার মনে হয় ওকে রাখলে ভালই হবে।”
শিখা বললো—”বেশ, তাহলে আজই পাঠিয়ে দেবেন তাকে। সে কোথায় আছে এখন?”
—”থানার কাছাকাছি কোথাও আছে হয়তো। সিপাইদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবো। তবে আজই তাকে পাঠাতে পারবো কি না বলতে পারিনে।”
শিখা বললো—”বেশ, যত শীগগির সম্ভব পাঠিয়ে দেবেন। বন্দুকটারও একটা গতি হবে তাহলে।”
—”তার মানে?”
—”মানে শেষ অবধি বন্দুকটা বাক্সেই রয়ে গেছে। দরোয়ান পাওয়া গেলে তাকেই ব্যবহার করতে দেবো ওটাকে।”
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্ত্তা বলে যতীনবাবু বিদায় নিলেন শিখার কাছ থেকে।
যতীনবাবু চলে যাবার আধঘণ্টা খানেক বাদেই একজন লোক শিখার বাড়ীর সদর দরজায় কড়া নাড়লে।
শিখা দরজা খুলে সামনে একজন অবাঙালী যুবককে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো—”কাকে চাই আপনার?”
—”আপনাকেই!”
—”আমাকেই! কি ব্যাপার বলুন তো?” যুবকটি বললো—”বাইরে দাঁড়িয়ে বলবো, না ভিতরে যাবার অনুমতি পাবো?”
শিখা লজ্জিত হ’ল একটু। বললো—”বেশ, আসুন।”
ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে শিখা তাকে একখানা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলো—”বসুন।”
যুবকটি বসলে শিখা তার সামনের চেয়ারখানায় বসে জিজ্ঞাসা করলে—”হ্যাঁ, এইবার বলুন তো, কি দরকার আপনার?”
যুবকটি মৃদু হেসে উত্তর দিল—”আমাকে আপনি চিনতে পারলেন না মিস্ রায়? আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারবেন।”
যুবকটির কথা শুনে শিখা তাকালো তাঁর মুখের দিকে। কিন্তু কোথায় যে দেখেছে তাঁকে, তা সে মনে করতে পারলো না।
সে বললো—”ক্ষমা করবেন। আমি ঠিক স্মরণ করতে পারছি না কোথায় দেখেছি আপনাকে।”
যুবকটি বললো—”সেদিন, ‘আইমিন’ কাঞ্চনগড় প্যালেসে মহারাণী ইন্দিরা দেবীর জন্মতিথি উৎসবের দিন বাস স্ট্যাণ্ডে দেখা হয়েছিল আমার সঙ্গে।”
এতক্ষণে চিনতে পারলো শিখা।
সে বললো—”কিন্তু সেদিন আপনার পরণে পাঞ্জাবী পোষাক ছিল, তাই না?”
যুবকটি বললো—”হ্যাঁ, পাঞ্জাবী পোষাকই পরেছিলাম আমি সেদিন।”
শিখা বললো—”কি নাম বলেছিলেন যেন আপনার?… পার্থ সিং না?”
যুবকটি বললো—”হ্যাঁ।”
এই বলে একটু থেমে সে আবার বললো—”আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী মিস্ রায়।”
—”কিন্তু কি ব্যাপার খুলে না বললে আমি তো আপনাকে কোন জবাবই দিতে পারবো না মিঃ সিং। কি ব্যাপারে আপনি আমার সাহায্য চান বলুন?”
—”সব কথা বলবার জন্যই আজ আপনার কাছে এসেছি মিস্ রায়। এমন কতকগুলো কথা আমি আপনাকে বলতে চাই যা আর কেউ জানে না—অবশ্য কাঞ্চনগড়ের দু’চারজন ছাড়া।”
শিখা বুঝতে পারে না পার্থ সিং কি বলতে চান। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকায়।
পার্থ সিং বললেন, ”আমাকে ভয় বা সন্দেহ করবেন না। আমাকে আপনার বন্ধু মনে করুন,—জানবেন কাঞ্চনগড়ের ব্যাপারে যদি কেউ প্রকৃত সূত্র দিতে পারে সে আমি। আমি ছাড়া আর কেউ নেই যে সে সব কথা জানে। আপনি যদি আমায় সাহায্য করবেন আশ্বাস দেন, আমি আপনাকে সব কথা খুলে বলতে পারি।”
সন্দিগ্ধভাবে শিখা বলে, ”আপনাকে কি বিষয়ে সাহায্য করতে হবে বুঝলুম না, যাই হোক, বলুন আপনার কি বক্তব্য।”
পার্থ সিং মাথা নাড়লেন। বললেন, ”এখানে সেসব কথা বলা সম্ভব নয় মিস্ রায়। আপনি ভাবছেন আপনার বাড়ী সুরক্ষিত, কিন্তু আমি বলব, আপনার বাড়ীর দেয়ালে শতছিদ্র। আপনার ঘরের দুয়ার সর্ব্বদাই মুক্ত। আপনি নিজেকে নিরাপদ মনে করবেন না মিস্ রায়। যে কোন মুহূর্ত্তে আপনি বিপন্ন হতে পারেন। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে—তারা আপনাকে আর আমাকে লক্ষ্য করছে। আমি বলি কি, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমার সঙ্গে চলুন। বাইরে আমার ট্যাক্সি আছে। ট্যাক্সি করে কোন নির্জ্জন জায়গায় গিয়ে আমি যা জানি সব কিছু খবর আপনাকে জানাব।”
শিখার একবার মনে হ’ল সে যাবে না। কিন্তু লোকটা কি বলতে চায় তা জানবার কৌতূহলও হ’ল তার।
সে বললে—”বেশ চলুন।”
ছয় – রাখে হরি মারে কে?
রাত্রে শিখার চোখে ঘুম আসে না।
অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত সে জেগেছিল। পার্থ সিং আজ তাকে যে সব কথা বলেছেন, সেই সব কথাগুলি নিয়েই চিন্তা করছিল সে। পার্থ সিং বলেছেন, রতনকে যারা আহত করে তার ঘর থেকে কতকগুলো দরকারী কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে, তিনি সেই অপরাধীদের সন্ধান জানেন। শিখা তাঁকে সাহায্য করলে তিনি নাকি ওদের সবাইকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু আসল কথা তাঁর মুখ থেকে বেরুলো না, অর্থাৎ কাঞ্চনগড়ের রাজবাড়ীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কি তা জানা গেল না?
কাঞ্চনগড় সম্বন্ধে অনেক কথাই বলেছেন পার্থ সিং। কিন্তু অন্ধ—বিশ্বাসে সেগুলো মেনে নেবার কোন কারণ খুঁজে পায় না শিখা।
মহারাণীর সম্বন্ধে অবিশ্বাস্য কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন তার চোখে ঘুম নেমে এসেছিল। অকস্মাৎ শিখার ঘুম ভেঙ্গে যায়, ঘরের মধ্যে একটা শব্দ শুনতে পায় যেন সে। তার মনে হয় যেন কার পা লেগে ঘরের ভিতরের একখানা চেয়ার খানিকটা সরে গেল। শব্দটা শুনেই জেগে ওঠে শিখা। পার্থ সিং—এর কথা মনে পড়ে যায়। ”আপনার জীবন নিরাপদ নয়।”—বলেছিলেন তিনি।
পথের দিকের জানালাটা খোলা। পথের আলো দেখা যাচ্ছে।
শোবার আগে নিজের হাতে জানালাটা বন্ধ করে দিয়েছে মনে আছে। জানালায় গরাদে ছিল না, সেই জন্য এ বাড়ী নেবার সময় সে মোটা এক্সপাণ্ডেড মেটাল দিয়ে জানালাটা আবৃত করেছিল, যাতে জানালাপথে কেউ ঘরে না আসতে পারে।
ঘুম—চোখে জানালায় জাল আছে কিনা তা বুঝতে পারে না শিখা। সে উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চেষ্টা করে—কেউ যদি জানালাপথে প্রবেশ করে থাকে তার পদশব্দ বা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায় কিনা—।
হালকা অন্ধকারের মধ্যে আবছা ছায়ার মত একটি মূর্ত্তিকে যেন দেখা যায়।
শিখা বালিশের তলা অন্বেষণ করে।—নাঃ, রিভলভারটাও আজ সে কাছে নিতে ভুলে গেছে। রিভলভারটা অন্যমনস্কভাবে হয়তো টেবিলের উপরই ফেলে রেখেছে।
তবু ধৈর্য্যহারা না হয়ে সে আত্মরক্ষার উপায় ঠিক করে নেয়।
মশারীটা তুলে সে অতি সন্তর্পণে খাট থেকে নেমে পড়ে। নামবার আগে পাশবালিশটাকে গায়ের চাদর দিয়ে ঢেকে বিছানার ঠিক মাঝখানে লম্বালম্বি ভাবে রেখে দেয়। তারপর নিঃশব্দে দেওয়ালের দিক দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে।
লোকটি আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়ে আসে, তারপর শিখার খাটের পাশে এসে দাঁড়ায়।
শিখার সমস্ত দেহ কন্টকিত হয়ে ওঠে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে খাটের নিচে অপেক্ষা করে।
লোকটি মশারী তোলে—
একটু পরেই লোকটা তীরবেগে জানালার দিকে ছুটে যায় এবং মুহূর্ত্ত—মধ্যে খোলা জানালাপথে অদৃশ্য হয়ে যায়।
সে কি করতে এসেছিল এবং কি করে গেল, শিখা সেটা আন্দাজ করে নেয়। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে খাটের তলায় শুয়ে থাকে সে।
কিন্তু না, লোকটা আর ফিরলো না। যে কাজ করতে সে এসেছিল, সে কাজ শেষ করে ফিরে গেছে। লোকটাকে দেখে শিখার আর একজন লোকের কথা মনের মধ্যে উকি মারে, সে রাণী ইন্দিরার ড্রাইভার। লোকটার আকৃতি অনেকটা তারই মত।
খাটের তলা হতে বাইরে আসে শিখা।
প্রথমেই সে ক্ষিপ্রহস্তে জানালাটা বন্ধ করে দেয়। সে আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করে যে জানলার ছিটকানী ভাঙা এবং মজবুত এক্সপাণ্ডেড মেটাল পরিপাটিভাবে কাটা।
ফিরে এসে আলো জ্বালে সে—
মশারী তুলতে দেখা যায়—সে যা ভেবেছে তাই ঠিক। পাশ—বালিশটার মাঝখানে একখানা ছোরা আমূল বিদ্ধ হয়ে রয়েছে।
হাসিও আসে, দুঃখও হয়।
আততায়ী যেই হোক, সে মনে মনে সান্ত্বনা লাভ করেছে এই ভেবে যে শিখাকে সে জগৎ থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
ছোরা বিদ্ধ হওয়ার সময় সে যে একটুও নড়েনি বা এতটুকু শব্দ পর্য্যন্ত করেনি, শত্রু সেদিকে দৃষ্টিপাত করেনি। কাজ হাসিল হয়েছে মনে করে তাড়াতাড়ি সে পলায়ন করেছে। শিখার আহ্বানে রতনের ঘুম ভেঙে যায়। পাশের ঘর হতে সে ছুটে আসে।
ছোরাবিদ্ধ বালিশ দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে বলে—”একি দিদিমণি, এ কাণ্ড কে করলে?”
সকৌতুকে শিখা বললে,—”আর কি,—তোমার দিদিমণি ছোরাবিদ্ধ হয়েছে, ধরে নাও সে মারা গিয়েছে—অন্ততঃপক্ষে আততায়ী তাই মনে করেছে।”
রতন জানালাটা পরীক্ষা করে। জানালার নীচে দুই বাড়ীর মাঝখানে অপ্রশস্ত একটা গলি। আবর্জ্জনাপূর্ণ এই গলিতে লোকজন বড় একটা যাতায়াত করে না। এই গলিপথটা দিয়ে শত্রু উপরে উঠে জাল কেটেছে এবং ছিটকিনী ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেছে, এটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
রতন চিন্তিত মুখে বললে, ”এ তো ভয়ানক ব্যাপার দিদিমণি! অবশেষে লোকগুলো তোমাকে খুন পর্য্যন্ত করবার মতলব করলে? নাঃ, তুমি এ সব কাজ ছেড়ে দাও, সাহেব তোমায় আবার পড়াশুনা করতে বলেছেন, তাই কর। এখান হতে এখন সরে পড়াই ভালো।”
রতনের কথা শুনে শিখা হাসে।
বললে, ”দেখা যাবে, ভেবে চিন্তে যা হয় একটা কিছু করব। আজ রাত্রের মত মোটের উপর নিশ্চিন্ত, শত্রু—পক্ষ জেনে গেছে আমি নিহত হয়েছি, কাজেই আজ আর কেউ এদিকে আসছে না। কাল সকালে নিশ্চয়ই তারা প্রত্যেক কাগজে দেখবে আমার মৃত্যু—সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিনা—”
রতন ব্যগ্রকণ্ঠে বললে, ”তুমি কি আজ এই ঘরেই থাকবে ভেবেছো নাকি দিদিমণি। আরও তো ঘর আছে, আমি বিছানা করে দিচ্ছি—”
শিখা তাকে অভয় দেয়, ”বললাম যে—আজ আর কেউ আসবে না, কালকের কথা কাল দেখা যাবে।”
নিশ্চিন্ত ভাবে আবার সে শয়ন করে।
সে বেশ জানে, আজ আর কেউ এদিকে আসবে না। তবে আক্রমণ যখন সুরু হয়েছে সহজে থামবে না বলে মনে হয় তার।
বিছানায় শুয়ে তার মনে হয় পার্থ সিংয়ের কথা। পার্থ সিং মিথ্যা কথা বলেননি বলে তার মনে হয়।
শয়তানদের পার্থ সিং সত্যিই চেনেন মনে হচ্ছে, তাছাড়া তাদের ওপর পার্থ সিংয়ের রাগও কম নয়। পার্থ সিং নিজে পাঞ্জাবী। শয়তানদের দলটাও যদি পাঞ্জাবী হয়, তা হলে কাঞ্চনগড় প্যালেসটাই কি এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রস্থল। অন্ততঃ পার্থ সিং ত তাই বলতে চান।
কিন্তু পার্থ সিংয়ের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো মহারাণী ইন্দিরা একটি সাংঘাতিক মেয়ে!
তার ফুলের মত সুন্দর মুখখানা, তার হাব—ভাব, চাল—চলন, অভিজাত সমাজে তার মেলামেশা, কিন্তু এ সবের অন্তরালে কী ভয়ানক সাপের মত খল সে!
শিখা মনে মনে ঠিক করে যে কালই সে যাবে কাঞ্চনগড় প্যালেসে। মহারাণী ইন্দিরার সঙ্গে আর একবার দেখা করতেই হবে তাকে।
সাত – পার্থ মহারাজের কে?
পরদিন বিকালেই কাঞ্চনগড় প্যালেসে যায় শিখা।
গেটে গুর্খা দরোয়ান মাথা নোয়ায়—জিজ্ঞাসা করে, ”আপনি রাণীমার সঙ্গে দেখা করতে চান নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনি তো এখানে নেই; —আজ দুদিন হল কাঞ্চনগড়ে গেছেন।”
সেদিনও যখন শিখা এসেছিল, রাণী ইন্দিরার কাঞ্চনগড়ে যাওয়ার কথা শোনেনি।
রাণী ইন্দিরা এখানে নেই শুনে শিখা জিজ্ঞাসা করে, ”তাঁর সেক্রেটারী কোথায়?”
দরোয়ান আবার সেলাম দিয়ে বলে—”তিনিও মহারাণীর সঙ্গে গেছেন। এখানে এখন রাণীমার এক আত্মীয়া লছমী দেবী ছাড়া আর কেউ নেই।”
শিখা জানায়, সে লছমী দেবীর সঙ্গেই দেখা করবে, জরুরী দরকার আছে।
দরোয়ান বাধা দেয় না। শিখা ভিতরে প্রবেশ করে।
বৃদ্ধা লছমী দেবীর যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। শোনা গেল তিনি ইন্দিরা দেবীর আদেশে এখানে আছেন। কাঞ্চনগড় হতে মহারাণীর আদেশ পেলে তিনিও চলে যাবেন।
শিখা অত্যন্ত হৃদ্যতার সঙ্গে বলে, ”কিন্তু আপনাকে রেখে যাওয়া মহারাণীর উচিত হয়নি। আপনার বলতে কেউ নেই, অপরিচিত দেশ, এখানে আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক থাকা দরকার।”
সখেদে লছমী দেবী বললেন, ”সেই কি যেতো মা—গেল কেবল ওই হতভাগার জন্যে। কোথায় ছিল—এখানে এসে হাজির হয়েছে। আমরা সবাই জানতাম বিলেত হতে ফিরবার সময় সে মারা গেছে,—ইন্দিরাও তাই নিশ্চিন্ত ছিল। হঠাৎ তার জন্মদিনে—সেই যে গো, যেদিন তোমরা এসেছিলে, সেই দিনই এই বাড়ীতে এসে হাজির হয়ে বলল, সে পার্থ সিং। ছয় সাত বছর সে নিখোঁজ হয়েছিল। তারপর যখন খবর পাওয়া গেল বিলেত হতে আসবার সময় পার্থ হঠাৎ কি করে জাহাজ হতে জলে পড়ে গেছে—আর তাকে কেউ দেখতে পায়নি, তখন হতেই মহারাজার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেল।”
আর্শ্চয্যভাবে শিখা বললে, ”কিন্তু পার্থ মারা গেলে মহারাজা উন্মাদ হয়ে যাবেন কেন? পার্থ মহারাজার কে?”
লছমী দেবী গালে হাত দিয়ে পরম বিস্ময়ে বললেন, ”শোন কথা একবার! পার্থ যে মহারাজার একমাত্র ছেলে—রাজ্যের ভবিষ্যৎ মালিক। তার মরণের কথা শুনে আমরাই চোখের জল ফেলেছি—হাজারে একটি হয় না অমন ছেলে। জানো বাছা, তখন আমাদের দুবেলা খাওয়া—দাওয়া জুটতো না—ওই অতটুকু ছেলের কত উদার মন, প্রতিদিন রানীমার কাছ হতে যা কিছু পেতো, সব এনে দিয়ে যেত। তখন ওই ছেলে তার মাকে—মানে বড়—মহারাণীকে পর্য্যন্ত আমাদের কুঁড়েঘরে টেনে নিয়ে এসেছে—।”
”পার্থ সিং মহারাজার ছেলে।”
শিখা যেন আকাশ থেকে পড়ে; এখন বুঝতে পারে কেন পার্থ সিং তার সাহায্য চাইছেন? তিনি অনেক কথাই বলেছেন—দেননি কেবল আত্ম—পরিচয়।
এই সঙ্গে মনে পড়ে যায়, রাণীর কর্ম্মচারী হিম্মত সিং যে একজন চোরা কারবারী এ কথা পার্থ সিং বলেছেন। অনেক কিছুর চোরা কারবারই নাকি তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। মহারাণী ইন্দিরা রয়েছেন তাঁর পেছনে। তাঁর আছে অসাধারণ বুদ্ধি, সৌন্দর্য্য—হাতে আছে অগাধ অর্থ, আছে কাঞ্চনগড়ের সুনাম যার জন্য সরকার সন্দেহ করতে পারেন না।
ব্রেসলেট চুরির ব্যাপারটাকে পার্থ সিং মিথ্যা প্রচার বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন।
বৃদ্ধা লছমী দেবী শিখার চিন্তার অবকাশে ঢুলছিলেন—হয়তো আফিং খান, এই সাময়িক তন্দ্রাটা তারই ফল।
”শুনছেন—?”
আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে শিখা—”মহারাজ এখানে ছিলেন, তিনিও কি কাঞ্চনগড়ে গেছেন রাণীর সঙ্গে—”
লছমী দেবী একটা হাই তোলেন, তারপর বলেন, ”হ্যাঁ, ওই পাগল মানুষটাকে নিয়ে যেতে জ্বালা বড় কম কিনা! এখানে রইলেন মহারাজ আর ডাক্তার রবিশঙ্কর। ডাক্তারও কাল নাগাদ আর একটা ইনজেকশান দিয়ে চলে যাবেন—ওদিকে রোগী এই দুইদিনেই কি কষ্ট যে পাচ্ছে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। অথচ সেখানেও রয়েছে ডাক্তার রবিশঙ্করের হাতের রোগী, তাতেই তো তিনি তাড়াতাড়ি ফিরতে চাচ্ছেন।”
ডাক্তার রবিশঙ্করকে দেখতে পায় শিখা—তখন তিনি বের হয়ে যাচ্ছিলেন; এ দেখাটা তার সৌভাগ্যই বলতে হবে।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে তিনি দরোয়ানকে তিরস্কার করছিলেন—তাঁর কাছাকাছি এসে শিখা থমকে দাঁড়ায়। তারপর স্মিতমুখে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে, ”নমস্তে,—আমি নিশ্চয়ই ডক্টর রবিশঙ্করের সঙ্গে কথা বলছি।”
পলকের দৃষ্টিপাতে সে দেখতে পায় লোকটির মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল,—কিন্তু তা মুহূর্ত্তের জন্য মাত্র। শান্ত হাসি হেসে ডাক্তার বলেলন, ”আপনার উপস্থিতি আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছে, কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কি করে মিস্ রায়? আপনি তো কোনদিনই আমায় দেখেননি!”
শিখা তাঁর পা হতে মাথা পর্য্যন্ত পলকের দৃষ্টিতে দেখে নেয়। তারপর বললে, ”আপনাকে চেনা কিছু কষ্টসাধ্য নয় ডক্টর শঙ্কর, আপনি নিজের নামেই খ্যাত। আপনার যে কয়টি ফটো আমার কাছে ছিল তা থেকেই আপনাকে চিনতে পেরেছি।”
”আমার ফটো!”
বিবর্ণমুখে ডাক্তার তাকান শিখার দিকে।
দৃঢ়কণ্ঠে শিখা বললে, ”হ্যাঁ, আপনার ফটো, ডক্টর শঙ্কর; আপনাকে দেখাতে পারতাম যদি আমার সেই অ্যালবামটা চুরি না যেতো। আমি আপনার কাছে অপরিচিত হলেও আপনি আমার কাছে অপরিচিত নন।”
তীক্ষ্ন—দৃষ্টিতে শিখা ডাক্তারের মুখের ভাবের পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করে।
কিন্তু অতিশয় ধূর্ত্ত এই লোকটা। কোন রকম দ্বিধা না করে ডাক্তার এবার হো হো করে হেসে ওঠেন। বললেন, ”ভুল দেখেছেন মিস্ রায়, আপনার অ্যালবামে যে ফটো সংগ্রহ করে রেখেছেন সে আমি নই। ডক্টর রবিশঙ্করের ফটো লোকে এনলার্জ করে বৈঠকখানায় সাজিয়ে রাখে, বোম্বেতে একবার দয়া করে পদার্পণ করলেই সেটা বুঝতে পারবেন। আচ্ছা, নমস্কার।—”
সদম্ভে তিনি ভিতরের দিকে চলে যান।
গুর্খা দরোয়ান বাহাদুরের পানে তাকিয়ে শিখা বললে, ”আমি তোমার কথা শুনেও চলে যাইনি,—তুমি আমায় ভিতরে প্রবেশ করতে দিয়েছো, সেজন্যে ডাক্তার সাহেব তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইছিলেন। কিন্তু তাতে তুমি ভয় পেয়ো না। যদি জবাব দেন, এই নাও আমার নাম ঠিকানার কার্ড, তুমি আমার কাছে যেয়ো, আমি তোমায় কাজ দেব।”
দরোয়ান কৃতজ্ঞচিত্তে অভিবাদন করে কার্ড নিয়ে পকেটে রাখে। ভিতরের ঘরের জানালা হতে যে একজন এই দৃশ্যটা দেখছিল তা কিন্তু সে জানতে পারল না।
শিখা গেটের বাইরে আসে।
মহারাণীর জন্মদিনে বহুলোক এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ডাক্তার রবিশঙ্করকে সে দেখেনি, আজই প্রথম সে তাঁকে দেখল।
দীর্ঘাকৃতি প্রৌঢ়বয়স্ক রবিশঙ্কর—যে কেউ তাঁর মুখের পানে তাকালেই বুঝবে তিনি অত্যন্ত ধূর্ত্ত। শুধু ধূর্ত্তই নন, দেহে মনে অসীম শক্তিশালী। আজ প্রথম তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে শিখা বুঝেছিল, পৃথিবীতে যে কোন শক্ত কাজই থাক—এ লোক তা করতে পারে।—
ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, শিখা বাস স্ট্যান্ডের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়।
আট – রহস্য ঘোরাল হল
রাত্রি গভীর হয়ে আসে, শিখা তখনও বাড়ীতে ফেরেনি।
সন্ধ্যার ট্রেনে শিখার মা যোগমায়া দেবী ও কাকিমা অপর্ণা দেবী যশোর থেকে এসেছেন। শিখা আজ সকালেই পত্রে সে কথা জেনেছে। আজ তার কোথাও না যাওয়াই উচিত ছিল।
রতন আপন মনেই গজর গজর করে—আজ আসুন দিদিমণি, বেশ দু’চার কথা শুনিয়ে দেবে সে। করুন না ডিটেকটিভের কাজ, তবু নিজের দিকটাও দেখতে হয় তো। এই তো কুমার দেব আছেন, যতীন্দ্রনাথ আছেন, তাঁরা তো নিজের সংসারের কথা ভুলে এমন ভাবে পরের কাজ নিয়ে হৈ হৈ করে বেড়ান না।
মা কাকিমাকে নিজেই সে পরিচর্যা করে, তাঁদের খাওয়া—দাওয়ার ব্যবস্থা করে, বিছানা পেতে শুতে দেয়। পরিশ্রান্ত তাঁরা—শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লেন। রতন নিচের বৈঠকখানা ঘরে জেগে বসে রইলো। কি জানি কখন দিদিমণি আসবেন, বাইরের দরজায় ডেকে যদি তার সাড়া না পান।
দেয়ালের ঘড়িতে একে একে বাজতে লাগলো এগারোটা, বারোটা—ক্রমে একটা—
অস্থির হয়ে ওঠে রতন—
নিশ্চয়ই কোন বিপদ ঘটেছে। এত রাত পর্য্যন্ত দিদিমণি তো কোথাও থাকেন না। যেখানেই যান রাত আটটার মধ্যেই ফিরে আসেন। আজ রাত ক্রমে বেড়ে চললো—দিদিমণি ফিরলেন না কেন?
এত রাতে কি—ই বা করবে সে। কাকে ডাকবে, কাকে খবর দেবে, সকাল না হলে কিছুই সে করতে পারবে না, কাউকে খবরও দিতে পারবে না।
সারারাত দারুণ উৎকণ্ঠায় কাটে, রতন দুই চোখের পাতা এক করতে পারল না।
ভোর বেলা দরজার সামনেই দেখতে পায় সে যোগমায়া দেবীকে। উদ্বিগ্নভাবে তিনি অপেক্ষা করছেন তার জন্য। জিজ্ঞাসা করেন, ”শিখা তো রাত্রে ফেরেনি রতন, কোথায় গেছে একবার খোঁজ নিলে হতো না?”
রতন উত্তর দিলে, ”আমি এখনই যাচ্ছি বড় মা, আমার যদি ফিরতে একটু দেরী হয়—ভাববেন না। ঘরে কোথায় কি আছে আপনারা দেখে শুনে ঠিক করে নেবেন।”
রতন বার হ’ল। পিছন দিক হতে কাকিমার কথা কাণে আসে—”মেয়েছেলে নাকি ডিটেকটিভের কাজ করবে—যত সব গাঁজাখুরী কথা। বলে—যার যা কাজ তারেই সাজে। পুরুষের যা কাজ তা পুরুষেই করুক, মেয়েদের ও সব কাজে হাত দেওয়ার দরকার কি বাপু? তুই যেমন লেখাপড়া করছিলি তাই কর, লেখাপড়া ছেড়ে হৈ হৈ করে বেড়ানো কি উচিত হচ্ছে, না ভালো হচ্ছে? মেয়েছেলের পথে ঘাটে কত বিপদ! তার ওপর গুণ্ডা বদমায়েসদের সঙ্গে পাল্লা দিতে আরম্ভ করেছে—”
রতন কথায় কাণ দেয় না, সে হন হন করে ছোটে বাসের দিকে।
বাস স্ট্যাণ্ডে দাঁড়ায় সে, পকেটে হাত দিয়ে দেখে একটি পয়সাও পকেটে নাই।
মুহূর্ত্ত মাত্র দাঁড়ায় সে, তারপর পায়ে হেঁটেই যতীন্দ্রনাথের সন্ধানে বউবাজার থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়।
জিপখানা পথের পাশে রেখে যতীনবাবু একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, এই সময় রতন এসে নমস্কার করে দাঁড়াল। দ্রুত হেঁটে আসবার জন্য সে তখন হাঁফাচ্ছিল।
যতীন্দ্রনাথ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ”এত সকালে কি খবর রতন?”
আর্দ্র কণ্ঠে রতন বলে যায়—”কাল রাত্রে দিদিমণি বাড়ী”—
বলতে গিয়ে হঠাৎ সে থেমে যায়।
মনে হয় এখানে কেবল যতীন্দ্রনাথই নন, অপরিচিত আর একজন লোক রয়েছেন, হয়তো তাঁর সামনে এ কথা বলা সমীচীন হবে না। তার মুখ দেখে যতীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন বিশেষ কিছু ঘটেছে; তিনি বললেন, ”আচ্ছা থাক, তুমি বরং আমার জিপে উঠে বসো, তোমার কথা পরে শুনব। এখন এঁর কথাটা আগে শেষ হোক।”
রতন জিপে উঠে বসে—
অপরিচিত ভদ্রলোক ও যতীন্দ্রনাথের কথাবার্ত্তার দুই একটা কথা তার কাণে আসে—নোট জাল—জালিয়াতের উপদ্রব ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের কথা হচ্ছিল। ভদ্রলোক নিজের মনিব্যাগ খুলে কয়েক খানা নোট যতীন্দ্রনাথের হাতে দিলেন তাও সে লক্ষ্য করলো। দু’চার মিনিট পরে যতীন্দ্রনাথ তাঁকে বিদায় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ”কি হয়েছে রতন, তুমি কি বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলে কেন? এত সকালে শিখা দেবী পাঠিয়েছেন কেন?”
”তিনি পাঠাননি দাদাবাবু, আমি নিজেই এসেছি। কাল রাত্রে দিদিমণি বাড়ী ফেরেননি—”
—”সে কি!”
যতীন্দ্রনাথ প্রায় চেঁচিয়ে ওঠেন—
রতন ততক্ষণ ফুলে ফুলে কাঁদছে।
যতীন্দ্রনাথ তার কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকি দেন, রূঢ়স্বরে বললেন, ”এখন কান্না রাখ রতন—কি হয়েছে শীঘ্র আমায় বল, বললে হয়তো এখনই একটা কোন ব্যবস্থা করতে পারব।”
রতন চোখ মুছে আর্দ্রকণ্ঠে বললে, ”কোথায় বাইরে যাবেন বলে দিদিমণি বার হয়েছিলেন। যেখানেই তিনি যান আটটার মধ্যে বাড়ী ফেরেন—বিশেষ কাল সন্ধ্যায় তাঁর মা—কাকিমার আসবার কথা—তিনি যত তাড়াতাড়ি পারবেন ফিরে আসবেন বলে গিয়েছিলেন। তার পর সারারাত গেল, তিনি ফেরেননি,—নিশ্চয়ই কোন বিপদ ঘটেছে, আমার মনে হচ্ছে।”
যতীন্দ্রনাথ নিস্তব্ধ হয়ে যান, স্তম্ভিত হয়ে খানিক পরে বললেন, ”কিন্তু আমার এখানে তো আসেননি, তবে গেলেন কোথায়? তাঁর কোন বন্ধু—বান্ধব, আত্মীয়—স্বজন—কারুর বাড়ী গিয়ে আটকে পড়ে যাননি তো?”
রতন বললে, ”সে রকম কেউ নেই দাদাবাবু, তাছাড়া বন্ধু—বান্ধব থাকলেও তিনি কারও বাড়ীতে রাত্রে থাকেন না। কাজকর্ম্ম পড়াশুনা এই সব নিয়েই থাকেন, এই তো সামনের বছর পরীক্ষা দেবেন, সেদিন বললেন—পরীক্ষাটা দিয়েই ফেলি, ওতে আমার—”
”আঃ,—”
যতীন্দ্রনাথের গর্জ্জনে অকস্মাৎ বাধা পেয়ে থেমে যায় রতন।
যতীন্দ্রনাথ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, ”ধান ভানতে শিবের গীতের দরকার নেই রতন। আমি যা জিজ্ঞাসা করি সেই উত্তর দাও। তিনি কখন বের হয়েছিলেন, সঙ্গে কিছু নিয়েছিলেন কিনা—সেই জরুরী খবরক’টা দাও দেখি।”
রতন বললে, ”তখন বোধ হয় সাড়ে পাঁচটা হবে যখন তিনি বের হয়েছিলেন, হাতে শুধু তাঁর ব্যাগটা ছিল।”
যতীন্দ্রনাথ চিন্তিত মুখে কেবলমাত্র বললেন, ”বুঝেছি।”
তাঁর মুখের পানে তাকিয়ে রতন আর কোন কথা বলবার ভরসা পায় না।
নয় – কোথায় শিখা?
অকস্মাৎ মোটরখানা এসে যে পিছন হতে থাক্কা দেবে তার জন্য শিখা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ধাক্কা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ে যায়।
চারিদিক হতে লোকজন ছুটে আসবার আগেই মোটর হতে দুজন ভদ্রলোক নেমে পড়েন, এবং সেই মুহূর্ত্তেই আহত শিখাকে ধরাধরি করে মোটরে তুলে ফেলেন।
পথের লোক মোটর ঘিরে ফেলল। কিন্তু মোটরের আরোহীরা বুঝিয়ে বললেন, আগে হাসপাতালে যাওয়ার দরকার। মোটরের নম্বর রয়েছে—দোষ তাঁরা অস্বীকার করছেন না।
সত্যিই তো, জীবনটা তো আগে বাঁচাতে হবে। তারা মোটর ছেড়ে দেয়। তীরবেগে মোটর চলতে আরম্ভ করে।
কতক্ষণ পরে শিখা নিজেকে সামলে নেয়। অকস্মাৎ ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার ফলে তার মাথায় আঘাত লেগে সে যেন মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। এরা কি করছে তাও সে বুঝতে পারেনি।
”এ কি, আপনারা কে? আমায় নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?” শিখা চেঁচিয়ে ওঠে।
সামনের সিটে উপবিষ্ট ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে, মিষ্ট কণ্ঠে বললেন, ”আপনার কোন ভয় নেই। আমার ড্রাইভারের দোষে আপনি আহত হয়েছেন, আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য আমাদের নেই।”
তাঁর কণ্ঠস্বর এবং কথা শুনে শিখা কতকটা আশ্বস্ত হয়।
সে মনে করেছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা এবং মোটরে তুলে নেওয়া শত্রুদের দলেরই কাজ। উৎকণ্ঠিত সে যথেষ্ট হয়ে উঠেছিল, এখন ভদ্রলোকের কথা শুনে সে অনেকটা ভরসা পায়।
সোজা হয়ে বসে সে। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে উপবিষ্ট ভদ্রলোকের পানে তাকায়।
তাঁকে দেখে বিহারী বলে মনে হয়। কথাবার্ত্তাও হিন্দীতেই বলছিলেন তিনি। তাঁর আকৃতিতে, পোষাকে—পরিচ্ছদে তিনি যে সম্ভ্রান্তবংশীয় তা বেশ বুঝতে পারা যায়।
শিখার পাশে—সিটের এককোণে আর একটি লোক বসে ছিল। অন্ধকারে তার মুখ ভাল দেখা যায় না।
শিখা জিজ্ঞাসা করলো, ”আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি? আমার বাড়ীতে পৌঁছে দিন, তাহলে সত্যিই অত্যন্ত খুসি হব!”
সামনের ভদ্রলোক হেসে বললেন, ”হ্যাঁ, তাতে পুলিশ কেসটা জমবে ভালো কুমারীজি। আপনি বাড়ীতে গিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে আমাকে যে ফ্যাসাদে ফেলবেন না, সে বিশ্বাস আমি কি করে করবো বলুন? তার চেয়ে আপনাকে আমি আমার বাড়ীতে নিয়ে যাচ্ছি, ওখানে আপনাকে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করে একটু সুস্থ হলে তারপর আমি নিজে দিয়ে আসব আপনার বাড়ীতে।”
”তবে যে বললেন হাসপাতালে যাবেন—আপনাদের উদ্দেশ্য কি?”
”কিছুই না—শুধু পুলিশ কেসটা বাঁচানো।” ড্রাইভারের পাশ থেকে উত্তর আসে।
মোটরটা এই সময় একটা বাঁকের মুখে গতি হ্রাস করে। একখানা পুলিশ—কার উজ্জ্বল আলো ফেলতে ফেলতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
ভদ্রলোক বললেন, ”আপনার চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ নেই কুমারীজি, আমি কথা দিচ্ছি, বাড়ীতে পৌঁছেই আপনার বাড়ীতে ফোন করে জানাব—কিন্তু আপনার বাড়ীতেই বা কে আছে? শুনেছি একটা চাকর ছাড়া কেউ নেই—”
বলতে বলতে হঠাৎ তিনি চুপ করে যান। কথাটা হয়তো বেফাঁসে বেরিয়ে পড়েছিল তাঁর মুখ থেকে, তাই সেটাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি হঠাৎ ড্রাইভারকে ভর্ৎসনা করেন—”এ কি, এ পথ ধরলে কেন, এখনই যে ঐ গাছটায় লেগে অ্যাকসিডেণ্ট হতো।”
কিন্তু শিখার বিস্মিতভাব তাতে কমে না।
অপরিচিত বিহারী ভদ্রলোক কি করে জানলেন তার বাড়ীতে চাকর ছাড়া আর কেউ নাই? তবে কি ইনি শত্রুদলের লোক? যে দল তাদের বিরুদ্ধে না লাগতে তাকে চিঠি লিখে সতর্ক করেছে, তারপর খুন করবার জন্যও চেষ্টা করেছে।
এই সব কথা মনে হতেই শিখা জিজ্ঞাসা করলো, ”আপনি কি করে জানলেন আমার বাড়ীতে চাকর ছাড়া আর কেউ নেই?”
ভদ্রলোক নিজেকে অত্যন্ত বিব্রত মনে করেন শিখার এই প্রশ্নে, কিন্তু তবু এক মুখ হাসবার চেষ্টা করে বলেন, ”কি যে বলেন আপনি কুমারীজি। আমার মোটরে আপনি ধাক্কা খেয়েছেন তাই আপনার জন্যে যতটা না হোক—আমার নিজের জন্যেই আমি আপনাকে গাড়ীতে তুলে নিয়েছি। আসল কথা—পুলিশকে আমার বড় ভয়। লোকে যেমন বলে—বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, তেমনই পুলিশে ছুঁলে আঠারো বার কোর্ট ঘর করতে হয়; তাতে যারা কাজকর্ম্ম করে, চাকরী—ব্যবসা, লেখাপড়া করে—তাদের কতখানি ক্ষতি হয় একবার মনে করুন। এই সব ভেবেই আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি আমার বাড়ীতে, আর তাতে আপনার আপত্তির কারণই বা কি থাকতে পারে বলুন? আপনার বাড়ীতে যেই থাক, ফোন নিশ্চয়ই আছে—না থাকে তাও বলুন—আমি আমার সেক্রেটারী মথুরাকে নামিয়ে দেই। ঠিকানাটা দিন,—সে গিয়ে এখনই খবর দিতে পারবে।”
শিখা উৎকন্ঠিত হয়েছিল বড় কম নয়। আজই সন্ধ্যায় মা—কাকিমা এসে পৌঁচেছেন, তাঁরা বড় কম ভাবনায় পড়েননি।
সে বললে, ”আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি পুলিশে আমি কোন খবর দেব না, তাতে বিশ্বাস করুন মিঃ—মিঃ, হ্যাঁ—আপনার নামটা জানতে পারি কি?”
মিনতিভরা কণ্ঠে ভদ্রলোক হাতজোড় করে জানান—”দুনিচাঁদ আগরওয়ালা কুমারীজি—। থাকুন না আজকের রাতটা গরীবের বাড়ীতে, আমি মথুরাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার ঠিকানাটা আমায় দিন।”
মোটরখানা ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে যেতেই শিখার পাশের লোকটি নেমে গেল এবং আগরওয়ালা নেমে এসে তার পরিত্যক্ত স্থান দখল করলেন।
শিখা নিজের নাম—ঠিকানা লেখা কার্ডখানা তাঁর হাতে দিয়ে বললো, ”মোটের উপর যত তাড়াতাড়ি পারেন আমায় পৌঁছে দেবেন—নেহাৎ না ছাড়তে চান। আর আপনার সেক্রেটারীকে বলে দিন—এখনই যেন আমার বাড়ীতে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসেন।” এ ছাড়া আর বলবেই বা কি সে। যদিই বা শত্রুর হাতে পড়ে, সে তো নিরস্ত্র। চুপ করে যাওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। দেখাই যাক না এর শেষ কোথায়?
আগরওয়ালা হেসে বললেন, ”সে জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না কুমারীজি, মথুরা খুবই কাজের লোক। ওকে যে কাজের ভার দেই তখনই সে কাজ করে ফেলে।”
মথুরাকে ট্যাক্সি ভাড়া করে যেতে আদেশ করে তিনি মোটর চালাতে নির্দ্দেশ দেন।
শিখা জিজ্ঞাসা করে, ”কিন্তু আমায় নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?”
আবার বিনীত হাসি হেসে করজোড়ে দুনিচাঁদ আগরওয়ালা বলেন, ”গরীবের বাড়ীখানা সহর থেকে একটু দূরে, তাই একটু দেরী হচ্ছে কুমারীজি; কিন্তু আর দেরী নেই, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে যাব।”
সত্যিই মিনিট পাঁচ—সাতের মধ্যে মোটর থামলো একটি বৃহৎ অট্টালিকার গেটের সামনে।
ড্রাইভারের আহ্বানে দরোয়ান এসে সসম্ভ্রমে গেট খুলে দিয়ে অভিবাদন করে সরে দাঁড়ায়। মোটর গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
বেচারা শিখা—
দুর্নিবার চক্রান্তের জালে সে জড়িয়ে পড়লো। মনে তার নানা সন্দেহের উদয় হলেও সে নিরুপায়।
দশ – যতীন্দ্রনাথের পালা
পুলিশ কমিশনারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ।
কমিশনার মিঃ এডওয়ার্ড বেলি খুব কড়া প্রকৃতির লোক। অধীনস্থ কর্ম্মচারীরা এই নূতন কমিশনারকে রীতিমত ভয় করতেন। সসঙ্কোচে এড়িয়ে চলতেন তাঁকে।
মিঃ এডওয়ার্ড কতকগুলো কাগজপত্র দেখছিলেন, মুখ তুলে তাকালেন।
শক্ত মুখে গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, ”তোমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এসেছে মিঃ বোস, একে একে আমি সব বলছি শোন।
প্রথমতঃ দেখ, বউবাজারে বিখ্যাত ধনী জুয়েলার্স আনন্দিলালের দোকানে প্রকাশ্য দিনের বেলায় একটা বহুমূল্য নেকলেস চুরি হয়ে গেল, তুমি কিছুই করতে পারলে না। দ্বিতীয়তঃ একজন পাঞ্জাবী লোক—নাম পার্থ সিং—বিখ্যাত দস্যুদলের অধিনায়ক, সে কেমন স্বচ্ছন্দভাবে কলকাতার বুকে চলাফেরা করছে, তুমি বা তোমার পুলিশ জানা সত্ত্বেও আজও পর্য্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে না। তৃতীয়তঃ মিস্ রায়ের আকস্মিক উধাও হয়ে যাওয়া;—হ্যাঁ, উধাও হওয়াই বলবো—আমার ধারণা, এই মেয়েটিকে এই দস্যুদলই সরিয়েছে, পাছে তিনি এদের পেছনে তদন্ত সুরু করে দেন—”
শুষ্ক কণ্ঠে যতীন্দ্রনাথ বললেন, ”আমি তাঁর অনুসন্ধান করছি স্যার, আমি জানি তিনি যেদিন আপনার সঙ্গে দেখা করেছেন, সেইদিনই তিনি প্যালেস কাঞ্চনগড়ে সন্ধ্যার আগে গিয়েছিলেন। প্যালেসের দারোয়ান জং বাহাদুর আমাকে জানিয়েছে যে তিনি ওখানে আধঘণ্টার বেশী ছিলেন না। এর ফলে আমি খানিকটা এগিয়ে যেতে পারছি স্যার—শিখা দেবীকে আমি শীঘ্রই পাব আশা করছি। তা ছাড়া তিনি যে রকম মেয়ে—তাতে তিনি নিজেই দু’ একদিনের মধ্যে এসে উপস্থিত হবেন এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আর পার্থ সিং সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। আমার যতদূর মনে হয় লোকটা বদমায়েস নয়। তবে বদমায়েসদের চেনে।”
কমিশনার বললেন, ”কিন্তু ওদের গ্রেপ্তার করবার কি ব্যবস্থা করছো তুমি?”
যতীন্দ্রনাথ বললেন, ”আমি নিশ্চেষ্ট নই স্যার, ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে পাহারা রেখেছি। যতদূর মনে হয়—কলকাতার কাছাকাছি কোন জায়গাতেই এদের আড্ডাখানা। আমি শুনেছি এদের মধ্যে কেবল পুরুষই নেই, অনেক মেয়েও অছে। সে সব মেয়েরা বেশ বড় ঘরের এবং তাদেরই মধ্যে একজন আনন্দিলালের দোকান হতে নেকলেস অপহরণ করেছে।”
কমিশনার চিন্তিত মুখে বললেন, ”কিন্তু এত বড় লজ্জার কথা। বাংলা দেশের—বিশেষ করে কলকাতার পুলিশ এতদিনেও একটা তদন্তের কিনারা করতে পারলো না। আমি তোমাকে একমাস সময় দিচ্ছি মিঃ বোস, যদি এই সময়ের মধ্যে অন্ততঃ একটারও কিনারা না হয়, তোমাদের সকলকেই ডিগ্রেড করবো!”
অপমানে যতীন্দ্রনাথের মুখখানা লাল হয়ে যায়। নিঃশব্দে তিনি ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীকে অভিবাদন—করে বাইরে চলে আসেন।
অপমানিত যতীন্দ্রনাথকে বড় সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে অন্য এক থানার ও. সি. জিজ্ঞাসা করলেন—”কি হল হে বোস! সাহেব কি বললে?”
ঐ ভদ্রলোককেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন কমিশনার।
যতীন্দ্রনাথ তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। পুলিশ অফিসের ভিতরে কোনো দিকেও তিনি না তাকিয়ে বাইরে যেখানে তাঁর জিপ দাঁড়িয়ে ছিল, সেইদিকে অগ্রসর হলেন।
”নমস্তে দারোগা সাহেব,” বলে একটি কিশোর অভিবাদন করে পকেট হতে একখানা লম্বা খামে বদ্ধ পত্র বার করে যতীন্দ্রনাথের সামনে ধরে। বলে, ”দেখুন তো চিঠিখানা কাকে দিতে হবে।”
”আমার চিঠি! কে দিলে এ চিঠি তোমাকে?”
মৃদু হেসে ছেলেটি বললে, ”যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি আপনার বন্ধু। খুব জরুরী চিঠি শুধু এই কথা বলে দিয়েছেন।”
চিঠিখানা যতীন্দ্রনাথের হাতে দিয়েই সে একটুও দাঁড়ায় না।
কভারটা ছিঁড়তেই বের হয়ে পড়ে চিঠিখানা, নীচে নাম সই ”পার্থ সিং”।
যতীন্দ্রনাথ চিঠিখানা পড়বার উপক্রম করছেন এমন সময় হঠাৎ রিভলভারের শব্দ হল,
”গুড়ুম—গুড়ুম—”
কি ব্যাপার!
কোথা হ’তে দুবার রিভলভারের গুলি ছুটে আসে—
একটা যতীন্দ্রনাথের গা ঘেঁসে চলে যায়, আর একটা তাঁর পিঠে এসে বেঁধে—
”ওঃ—”
সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যান যতীন্দ্রনাথ।
লালবাজার পুলিস অফিসের সামনে—পুলিস ইনস্পেক্টরকে গুলি। প্রায় অসম্ভব ব্যাপার বৈ কি!
লোকজন ছুটে আসবার আগেই পুলিশ কনষ্টেবলরা জায়গাটা ঘিরে ফেলে।
গেটে কয়জন প্রহরী ছিল, তাদের মধ্যে একজন আগেই তাঁকে ধরে ফেলেছিল,—পরে আর সকলে ছুটে এলো।
মুহূর্ত্তে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল।
অ্যাম্বুলেন্স এলো, ষ্ট্রেচারে করে মূর্চ্ছিত যতীন্দ্রনাথকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে পাঠানো হল হাসপাতালে, সঙ্গে গেলেন দু’জন বড় অফিসার।
এগারো – পলায়নের চিন্তা
রাত্রে কোথায় এসেছে কিছুই শিখা বুঝতে পারেনি। দোতলার সুসজ্জিত একটি ঘরে তাকে সে রাত্রে থাকতে দেওয়া হয়েছিল,—সে ঘরে সে ছিল একা।
রাত্রিটা কোন রকমে কেটে গেল।
সমস্ত রাত্রি জেগে ভোরের দিকে শিখা ঘুমিয়ে পড়েছিল, অনেক বেলাতে তার ঘুম ভাঙ্গলো—তখন চারিদিক রৌদ্রে ভরে গেছে।
দেওয়ালের একটা ঘড়িতে এমনই সময় ঠন ঠন করে ন’টা বেজে যায়।
শিখা অস্থির হয়ে ওঠে—ইস, বেলা ন’টা বেজে গেল,—কম বেলা তো হয়নি। এতক্ষণে সে ঘরখানা দেখবার অবকাশ পায়—একখানা মূল্যবান পালঙ্কে সে শুয়ে ছিল; একপাশে টেবিল, চেয়ার, বইয়ের কয়েকটা আলমারী, পাশে একটা দরজার ওদিকে বাথরুম; এক কথায় সবই আছে।
কোন দিকে মেসিন চলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে—ভারি বিরক্তিকর মনে হয়।
ঘরের দুই দিকে দু’টি জানালা, কিন্তু সে জানালাপথে বাইরের কিছু দেখা যায় না—মস্ত বড় দেয়ালে প্রতিহত হয়ে দৃষ্টি ফিরে আসে।
বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখে জল দেয় শিখা, সমস্ত দেহে দারুণ ব্যথা, পিছনটাতে ভীষণ ব্যথা—অনেকখানি স্ফীত হয়ে উঠেছে, শিখা হাত বুলিয়ে দেখে।
দরজা ভিতর হতে সে বন্ধ করে দিয়েছিল।
দ্রুতহস্তে শিখা দরজার আগল খুলে ফেলে দরজা খুলতে যায়—
কিন্তু হায়! দরজা বাইরের দিক হতে বন্ধ।
হয়তো কপাট এঁটে গেছে ভেবে শিখা টানাটানি করে, খোলে না।
চীৎকার করে শিখা—”দরজা খুলুন—কে দরজা বন্ধ করেছেন—খুলে দিন—”
কোনই সাড়া—শব্দ পাওয়া যায় না। বৃথাই শিখা দরজাটা টানাটানি করে ঘর্ম্মাক্ত হয়ে ওঠে, বৃথাই দরজায় পদাঘাত করে পায়ে ব্যথা করে ফেলে।
পরিশ্রান্ত শিখা বিছানায় এসে বসলো। এতক্ষণে তার আর কোন সন্দেহই থাকে না। সে বুঝতে পারে নিজেই সে বোকামীর পরিচয় দিয়েছে, বুদ্ধিহীনতার ফলে সে আজ শত্রুদের হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়েছে, সে বন্দিনী হয়েছে।
অধর দংশন করে শিখা—
কিন্তু উপায় নেই। দুর্দ্দান্ত দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার লাভ করবার ব্যবস্থা একটা তাকে করতেই হবে। বেশী কিছু ভাবতে পারে না শিখা। আজ সে বড়ই শ্রান্ত, মাথাটাও ভার হয়ে রয়েছে। চিন্তাগুলো যেন তার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হাত—পা এলিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলো শিখা।
কিছুক্ষণ পরে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে। কিন্তু ঠিক ঘুম তাকে বলা যায় না। একটা তন্দ্রার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রইলো সে।
হঠাৎ দরজায় খুট করে একটা শব্দ হলো। সেইটুকু শব্দেই শিখার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো শিখা। তার মনে হলো বাইরে থেকে কে দরজার তালা খোলবার চেষ্টা করছে।
দু—একটা খুটখাট শব্দ হবার পরই দরজা খুলে গেল। বাইরের আলো খানিকটা এসে পড়ল ঘরের ভিতরে। তা থেকে শিখা অনুমান করে নিলো বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে।
মনে মনে হাসল শিখা। বন্দীর আবার দিন—রাত্রি। শুধু শুয়ে বসে থাকা ছাড়া কাজকর্ম্ম যখন আর কিছুই নেই তখন বেলা বাড়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটাই বা কি!
অতি সন্তর্পণে ঘরে এসে যে ঢুকল তাকে দেখেই অবাক হয়ে যায় শিখা। প্রথম দর্শনেই চিনতে পারে তাকে—সে লছমী বাঈ।
লছমী বাঈও শিখাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
”আরে তুমি বেটী এখানে?” দরজাটা আবার বেশ করে করে ভেজিয়ে বন্ধ করে দেয় লছমী বাঈ।
”আরে লছমী বাঈ যে—তা তুমিও শেষ পর্য্যন্ত এখানে এসে হাজির হলে?”
”আর বলিসনি বেটী—আমি কি জানি কাঞ্চনগড়ে না গিয়ে সকলে এখানে এসে জুটেছে? তা তোমার কাছে থাকবার জন্যই কি ওরা আমাকে এখানে নিয়ে এল? তা বেটী ভালই হয়েছে।”
এক ডেলা আফিম নিয়ে গালে ফেলে একটা ঢোক গিলে থপ করে বসে পড়ল লছমী বাঈ।
ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় শিখা। ভালই হল। এই আফিমখোর বুড়ীটা যদি তার পাহারাদার হয় তা হলে একটা সুবিধে সে নিশ্চয়ই এক সময় করে নিতে পারবে।
কিন্তু—এত বড় একটা দুর্ভেদ্য কেল্লার মত বাড়ী থেকে সে বেরিয়ে যাবে কি করে? অচেনা জায়গা—কে জানে শত্রুর জাল কতদূর পর্য্যন্ত ছড়ানো আছে।
ক্ষুধা—তৃষ্ণা ভুলে গেল শিখা! বুড়ীর সঙ্গে আলাপ জমাতে বসল সে।
দু—একটা কথা বলবার পরই শিখার বুকটা আনন্দে নেচে উঠল। শিখা একটা কথা বললে বুড়ী বড় বড় করে তার মাতৃভাষায় হাজার কথা বলে। কিন্তু মাঝে মাঝে একেবারে চুপ করে গিয়ে ঝিমুতে থাকে। খানিকক্ষণ পরে শিখা আবার একটা কথা বলে—আবার সে বক বক সুরু করে দেয়।
একটুও সময় নষ্ট করে না শিখা। কাঞ্চনগড়ের রাজবাটীর পারিবারিক কথার খেই ধরিয়ে দেয়। লছমী বাঈ আপন মনে বকে চলে। তার কথার মর্ম্মোদ্ধার করতে শিখার একটুও দেরী হয় না।
যদি সে একবার কোনরকমে এখান থেকে বেরুতে পারে তা হলে এদের ব্যবস্থা করতে তার একটুও দেরী হবে না।
অদ্ভুত এদের কৌশল, অদ্ভুত এদের কাজ। আত্মপরিচয় গোপন করে পার্থ সিং যে কথাগুলো বলেছিলেন এখন সেগুলো জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায় শিখার কাছে। রাজকুমার আজ চক্রান্তে বিপন্ন। এই রাজকুমার আর কেউ নয়, পার্থ সিং নিজে। বিমাতার ষড়যন্ত্রে তাঁর মা নিহত হয়েছেন, এ খবর তিনি পেয়েছিলেন ইংলণ্ডে থাকতেই। মহারাজার অনেক কিছু আশা—ভরসা ছিল এই পুত্রের উপর, তাই উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পুত্রকে তিনি ইংলণ্ডে পাঠিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ছলনাময়ী ইন্দিরা সেক্রেটারী রূপে এসে মহারাজার দুর্ব্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বিয়ে করে মহারাণীর আসন দখল করে নেয়।
এই রহস্যময়ী সেক্রেটারীর রূপের আগুনে নিজেকে একেবারেই পুড়িয়ে ফেললেন মহারাজ। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগল এবং মহারাজের বিকৃত মস্তিষ্কের সুযোগে মহারাণী ইন্দিরাই হয়ে উঠলেন কাঞ্চনগড়ের এষ্টেটের সর্ব্বময়ী কর্ত্রী।
ইংলণ্ডে পার্থ সিং অকস্মাৎ শুনতে পেলেন তাঁর মা হার্টফেল করে মারা গেছেন। পার্থ এ কথা বিশ্বাস করেননি। তাঁর মনে হয় যে তাঁর মাকে স্লো—পয়জন করে হত্যা করা হয়েছিল। বুঝতে পেরে তিনি ইংলণ্ড হতে অষ্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই ভূমধ্যসাগরে একখানা জাহাজডুবি হয়। পার্থ সিং কৌশল করে রটিয়ে দিলেন তিনিও সেই জাহাজের আরোহী ছিলেন আর বন্ধু—বান্ধবদের সাহায্যে নিখোঁজ লোকেদের তালিকার মধ্যে নিজের নামটাও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন পার্থ। আত্মরক্ষা করবার জন্য এর চেয়ে সহজ উপায় আর কিছু খুঁজে পাননি তিনি তখন।
যেদিন মৃতের তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশ পেয়েছিল, শোনা যায় সেদিন রাজপ্রাসাদে বিরাট ভোজের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
হতভাগ্য মহারাজ!
পিতার কথা বলতে গিয়ে শক্তিশালী যুবক পার্থ সিংয়ের চোখে জল এসে পড়েছিল; অতি কষ্টে তিনি আত্মসংযম করেছিলেন।
সরোষে বলেছিলেন, ”জানেন মিস্ রায়, মহারাজকে হাতের অস্ত্র রূপে এরা জিইয়ে রেখেছে। তাঁকে হত্যা করলে এদের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাবে—মহারাণী ইন্দিরার মুখোস খুলে যাবে, সেই জন্যেই মহারাজকে এরা উন্মাদ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে শুনেছি তাঁর জ্ঞান হয়, সেই মুহূর্ত্তে এরা কি ইনজেকশান দেয়, ঔষধ খাওয়ায়, তিনি আবার তাঁর স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।”
তাঁর মুখেই শিখা শুনতে পেয়েছে একজন ডাক্তার এই বিরাট দলের নেতা। ডাক্তার নাকি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। দরিদ্রের সুন্দরী মেয়ে ইন্দিরাকে তিনিই খুঁজে বের করেছিলেন। বৃদ্ধ মহারাজের চোখের সামনে এনে—নিজের ভাগিনেয়ী পরিচয় দিয়ে নির্জ্জনে মহারাজের সঙ্গে মেলামেশা করবার সুযোগ দিয়ে ছিলেন। মায়াবিনী ইন্দিরার পক্ষে মহারাজকে খেলিয়ে তুলতে একটুও দেরী হয়নি। নির্ম্মল চরিত্র মহারাজ তাঁকে বিয়ে করবেন বলে শীঘ্রই ঘোষণা করে দিলেন। সেই ইন্দিরাই আজ কাঞ্চনগড়ের মহারাণী বলে পরিচিত।
শিখা সে সব কথা এখন বিশ্বাস করেছে। এখন আনন্দিলালের দোকানে হীরকখচিত নেকলেস সরানোর ব্যাপারেও সে আজ সরাসরি ইন্দিরাকেই সন্দেহ করে।
খবর পাওয়া যাচ্ছে, বছর তিনেক আগে বোম্বের এক জুয়েলারী ফার্ম্মে ভীষণ ডাকাতি হয়ে গেছে। ঐ দোকান থেকে যে সব অলঙ্কারপত্র খোয়া যায়, তার মধ্যে ছিল একজোড়া বহুমূল্য ব্রেসলেট।
শিখা একটি বড় রহস্যের জট ছাড়াতে চেষ্টা করে। বোম্বের চুরি যাওয়া সেই ব্রেসলেট জোড়াটা হয়তো মহারাণীর হাতেই শোভা পাচ্ছিল তাঁর জন্মদিনে। স্ত্রীলোক সে। গহনা পরবার সাধ কোন দিনই তার মেটে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই যখন নিজের ভুল সে বুঝতে পারে তখনই উৎসবের হল ছেড়ে সে চলে যায়। তারপর ভেবেচিন্তে প্রচার করে তার সেই ব্রেসলেট চুরি গেছে। শ্যামনগরের মহারাণী এই জোড়াটাই বোম্বের জুয়েলারী ফার্ম্মে দেখেছিলেন। তাঁর কথাতেই ইন্দিরার চৈতন্য হয় যে মস্তবড় ভুল করে ফেলেছে সে, ঐটুকু সময়ের জন্য ওটা হাতে দিয়ে।
শিখা এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়—ইন্দিরা কাঞ্চনগড়ে যায়নি। পার্থ সিং কলকাতায় আছে। তাকে এখন দস্তুরমত ভয় করে ওরা। তাকেই পৃথিবী থেকে সরাবার চেষ্টা চলছে। কিন্তু পার্থও পাঞ্জাবী—বাচ্ছা। আর আসল রাজরক্ত তার শিরায় বইছে। সেও সহজে ছাড়বার পাত্র নয়।
কিন্তু এ রহস্যের মর্ম্মোদ্ধার করবে কে? শিখা যে নিজেই বন্দিনী। পার্থকে অবিশ্বাস করবার কিছু নেই। সে শিখার সাহায্য চেয়েছিল। এখন যদি কোন রকমে একবার পার্থর সঙ্গে দেখা হয় তার! এই শত্রুপুরীতে সে আসবেই বা কেন? যদি সে একবার কোন রকমে এখান থেকে বেরুতে পারে তাহলে এদের ব্যবস্থা করতে তার একটুও দেরী হবে না।
বার -মহারাজার শাস্তি
লছমী বাঈ কিছুক্ষণ পরেই চলে যায়। তার কথাগুলো আর পার্থ সিংয়ের কথাগুলো এক সঙ্গে ছোড়াতাড়া দিয়ে সাজাতে থাকে শিখা। কি ভীষণ এক দল প্রকাশ্য দিবালোকে সহরের বুকের ওপর কতই না কাণ্ড করে চলেছে। ওদের কর্ম্মতৎপরতা একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। শুধু যে ওরা চুরি—ডাকাতিই করে তাই নয়; নোট জাল, নরহত্যা কোন কিছুতেই এরা পিছপা নয়। অন্যদিকে আবার সমাজে প্রচুর মান—সম্ভ্রম নিয়ে কেমন অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বেপরোয়া—ভাবে মেলামেশা করছে। গভর্ণমেন্ট—হাউস থেকে আরম্ভ করে এদের গতিবিধি সর্ব্বত্র। এ রহস্য ফাঁস করে দিতে পারে এক সে নিজে আর একজন পারে সে পার্থ সিং। কিন্তু সে নিজে আজ বন্দী—আর পার্থ সিংও বেশী দিন বন্দী না হয়ে থাকতে পারবে না। এত দিনে বন্দী হয়েছে কিনা তাই বা কে জানে? লছমী বাঈয়ের সঙ্গে কথা বলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবই জানা গেল। কিন্তু তাকে দিয়ে ত উদ্ধারের কোন কিনারাই হবে না। আফিমখোর বুড়ী—বরং তাকে বেশী ঘাঁটালে কার কাছে কি বলে ফেলবে। তাতে বরং তার বিপদের সম্ভাবনাই বাড়বে। রাগে সর্ব্বাঙ্গ জ্বলে উঠে শিখার। এমনই সময়ে আর একটি বৃদ্ধা আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, তার হাতে শিখার আহার্য্য।
শিখা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায়—দরজার দিকে তাকায়।
রুক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে—”দুনিচাঁদ আগরওয়ালা কোথায়? তোমাকে এই খাবার দিয়ে পাঠালে কে?—আমার কথার উত্তর দাও—নইলে—”
থেমে যায় সে। বৃদ্ধা তার কথার কর্ণপাতও করে না। মেঝেয় থালা বাটি নামিয়ে শিখার পানে তাকায়—ইঙ্গিতে খাওয়ার নির্দ্দেশ করে।
শিখা একবার মনে করে লাথি মেরে সব ফেলে দিয়ে বৃদ্ধার গলা টিপে ধরে এক আছড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়—। চোখ দুটো তার জ্বলতে থাকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে শিখা।
হাতখানা তুলতেই বাইরে কে গর্জ্জন করে—”খবরদার।”
শিখা পেছিয়ে এসে বাইরের দিকে তাকায়।
একটি কিশোর—উদ্যত রিভলভার তার হাতে।
তরুণ ছেলেটি তারপর বৃদ্ধার হাত ধরে বার হয়ে যায়। একবার চেঁচিয়ে ডাকে শিখা তাদের। কিন্তু কেউ তার কথায় উত্তর দেয় না,—নিরুপায় শিখা অধর দংশন করে।
উপায় নাই—ক্ষুধার তাগিদে আহার করতে হয়। সারাদিনের মধ্যে আর কারও দেখা নাই।
ঘরের মধ্যে পিঞ্জরাবদ্ধ বাঘিনীর মতই রাগে ফুলতে থাকে শিখা।
পালাবার কোন উপায় নেই। জানালা দুটিতে মোটা লোহার গরাদে, অনেক চেষ্টা করে তা নড়াতে পারে না শিখা।
আলমারী খুলে শেষ পর্য্যন্ত কয়েকখানা বই বের করে নেয় সে। সময় তো কাটাতে হবে যে কোন রকমে।
পড়তে পড়তে ঘুম এসে যায়। সে তখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।
হঠাৎ কার বুকফাটা আর্ত্তনাদে শিখার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অন্ধকার ঘরে সে উঠে পড়ে, দেয়ালের গায়ে সুইচ টিপে দিতেই ঘর আলো হয়ে যায়।
শিখা শুনতে পায়, কে যেন যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে চীৎকার করে বলছে—”আর আমি সইতে পারছিনে, এর চেয়ে তোমরা আমায় হত্যা কর। এমন করে বেঁধে রেখে আমায় তিল তিল করে মেরো না ইন্দিরা—তোমাদের পায়ে পড়ি—”
নারী কণ্ঠে কে ধমক দেয়—”চুপ কর, ফের যদি এই রাত্রে এমন করে চীৎকার কর, তাহলে এখনি ডাক্তারকে ডাকব—”
”না—না—না, ওই পিশাচটাকে ডেকো না। ওকে দেখলে আমার ভয় হয়। আমার বড় ভয় করছে। ও আমার রুক্মিণীকে হত্যা করেছে। আমার একমাত্র পুত্র—পার্থকে সে জলে ডুবিয়ে মেরেছে, আর—আমাকে?—ও! হো হো হো—”
আবার সেই তীব্র আর্ত্তনাদ—
শিখা একেবারে পাথর হয়ে যায়। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে—না, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করেছে, কতকটা নিশ্চিন্ত হ’ল সে।
কি সাংঘাতিক কাণ্ড—চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা—বাংলা জুড়ে ব্ল্যাক—মার্কেট, জাল নোটের ছড়াছড়ি; তার প্রধান আড্ডাস্থল এইখানে? ইন্দিরা আলিপুরের প্রাসাদ ত্যাগ করে আত্মগোপন করেছে এইখানে। মহারাজাকেও এখানে রাখা হয়েছে, আলিপুরে রাখার সাহস এদের নেই। হয়তো আগে রেখেছিল—রাণীর জন্মদিনে পার্থ সিংয়ের হঠাৎ আবির্ভাবের পর, রাণীর অকস্মাৎ ভাবান্তর—এ সবারই মূলে রয়েছে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র।
একবার যদি কোন রকমে মুক্তি পায় শিখা! যদি এই শয়তানের দলকে গ্রেপ্তার করতে পারে সে—তবেই বুঝবে তার যোগ্যতা, কিন্তু সেদিন কি আসবে?
কিন্তু এ কোন স্থান—নাম কি এখানকার? এখানে যে এত কাণ্ড হচ্ছে, কেউ কি সে সন্ধান রাখে না?
সেই বুড়ীটার বোধ হয় অসুখ করেছে—আহার্য্য নিয়ে আসে সেই কিশোর। এক হাতে খাবারের থালা আর এক হাতে তার রিভলভার। শিখা রোজই হেসে হেসে কথা বলে তার সঙ্গে। যদি ভাল কথায় এর কাছ থেকে কিছু কথা বেরোয়—
একদিন শিখা বলে, ”ডাক্তার শঙ্কর কি এখানে থাকেন?”
ডাক্তার শঙ্করের নাম করতে তার মুখখানা বিকৃত হয়ে ওঠে। শিখা বুঝতে পারে সে শঙ্করকে ঘৃণা করে। চুপ করে থাকে ছেলেটি।
শিখা জিজ্ঞাসা করে, ”প্রায় রাত্রে এখানে আমার ওপাশের ঘরে কান্নাকাটি চীৎকার শোনা যায়, ওদিকে কে থাকেন জানো?”
”তিনি মহারাজা, তাঁর রাণীও যে এখানে আছেন।”
বলেই সে পেছনে ফেরে। আর কোন কথা বলতে পারবে না সে। এই রকম একটা ভাব নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল সে।
শিখা তাকে আর একবার ডাকে। সে থমকে দাঁড়ায়। বলে, ”কথা বলবার হুকুম নেই। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। তাতে আমাদের দুজনেরই বিপদ হবে।”
”না—বলছি তুমি এতটুকু ছেলে, রিভলভার ছুড়তে জানো?”
”আমরা সকলেই জানি।”
”দেখি না তোমার রিভলভারটা একবার—”
অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ছেলেটি শিখার দিকে। বলে, ”বলেন কি? রিভলভারটি পেলেই কি আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন মনে করেছেন?”
”বয়সের চেয়েও বুদ্ধি তোমার অনেক বেশী দেখছি। আচ্ছা, বলতে পারো ওরা কেন আমায় আটকে রেখেছে?”
ছেলেটি কি ভাবল। বলল, ”আর—একদিন—বলব।” আর এক মুহূর্ত্তও দাঁড়াল না ছেলেটি।
তের – শয়তানের মুখোস
সময় আর কাটে না—
দিনের পর দিন আসে—চলে যায়, শিখার মুক্তির কোন উপায় হয় না।
তবু এর মধ্যেই সে জানালা দুটি বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করেছে, কোন রকমে জানালা ভেঙ্গে পলায়ন সম্ভব হয় কিনা।
কিন্তু না, হতাশ হয়ে পড়ে শিখা,—
জানালার পাশে কিছু নাই, নিচে মাটি পর্য্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছায় না, মনে হয়—তাকে দ্বিতলে রাখা হয়নি, একেবারে ত্রিতলে রাখা হয়েছে।
ছেলেটি আজ কয়দিন আসে নাই। তার সঙ্গে ভাব করে একটা পলায়নের উপায় যে করবে, সে আশাও মনে সুদূরপরাহত হয় শিখার।
কিন্তু তাই কি—?
মুক্তি একদিন মিলবেই, অগ্নিশিখা চিরদিনই যা কিছু স্পর্শ করে—দহন করে। এরা তা জানে না, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে মনে করেছে অগ্নিশিখাকে। জানে না এই অগ্নিশিখাই একদিন সমস্ত পুড়িয়ে ভস্মে পরিণত করবে।
আর একজন লোক শিখার আহার্য্য আনে। খর্ব্বাকৃতি লোকটি, কোন দিন কোন কথা বলে না, কোন কথা কানেও তোলে না। দেখে মনে হয় লোকটি মাদ্রাজী,—কালা ও বোবা হওয়াই সম্ভব, অথবা ছলনা করে তাই বা কে জানে?
শিখা তার সঙ্গে প্রথমদিকটায় কথা বলবার চেষ্টা করেছিল, তারপর আর তাকিয়েও দেখে না। আলমারীতে আছে প্রচুর বই,—অগত্যা সময় কাটাবার জন্য সে বই নিয়ে বসে।
সেদিন সন্ধ্যার পর—
নিতান্ত অনিয়মিত সময়ে দরজার চাবি খুলবার শব্দ পেয়ে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে শিখা, বইখানা বন্ধ করে।
দরজা খুলবার সঙ্গে সঙ্গে খোলা দরজাটার উপর যে লোকটি দাঁড়ালো, তার মুখের পানে তাকিয়ে শিখা একেবারে পাথর হয়ে যায়—ডাক্তার রবিশঙ্কর তার পানে তাকিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললো, ”নমস্তে, ভালো আছেন মিস্ রায়? শরীর সুস্থ তো?”
দারুণ ঘৃণায় শিখার পা হতে মাথা পর্য্যন্ত শির শির করে ওঠে। মনে ভাবে লোকটার কথার উত্তর দেবে না, কিন্তু না দিলেই বা এ লোকটার কি আসে যায়?
সে বিকৃত কণ্ঠে বললে—”হ্যাঁ, যেমন ভাবে রেখেছো তেমনই সুস্থ আছি শঙ্কর রাও—অত্যন্ত চমৎকার ভাবে আমায় রেখেছো, তোমায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
ডাক্তার শঙ্কর রাও বক্রদৃষ্টিতে শিখার পানে তাকালো; বললো, ”বাঃ চিনতে যে পেরেছ তা জানতে পেরে ভারি খুশী হয়েছি মিস্ রায়। একদিন বলেছিলে বটে—সেদিনই বুঝেছিলাম তুমি অন্ততঃপক্ষে আমায় চিনবার চেষ্টা করছো। যাক, আমি যা বলতে এসেছি—তোমাকে কাল এখান হতে আমাদের সঙ্গে একজায়গায় যেতে হবে—জানিয়ে যাচ্ছি আর তোমার খবরটাও নিচ্ছি।”
শঙ্কর রাওয়ের স্পর্দ্ধায় শিখা স্তম্ভিত হয়ে যায়।
বললো, ”আমায় তো সরাবে,—মহারাজাকেও নিশ্চয় সরানো হবে, আর তোমার সহকারিণী সেই মেয়েটি—যাকে মহারাণী নামে সমাজে পরিচিত করা হয়েছে—তাকেও তো নিয়ে যেতে হবে? আচ্ছা—আমরা যাব কিসে?—ট্রেনে নিশ্চয়ই নয়, যেতে গেলে প্লেনে যাওয়াই নিরাপদ, নয় কি? আশা করছি প্লেনের ব্যবস্থাই হচ্ছে—কি বল?”
বিস্মিত চোখে শঙ্কর রাও শিখার পানে তাকায়। মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে সে তার সাহস দেখে তারিফ করে—চমৎকার সাহসী মেয়ে—ঘাবড়ায় না।
শান্ত কণ্ঠে বললেন, ”হ্যাঁ, প্লেনেই যেতে হবে বই কি—সে ব্যবস্থা আমার ঠিক আছে।”
শিখা সংযত কণ্ঠে বললে, ”খুব ভালো করেছ শঙ্কর রাও, কিন্তু মহারাজাকে নিয়ে যেতে পারবে তো? দিন তিন চার তাঁর আর চেঁচানি শুনিনি, তার আগে যা চীৎকার শুনেছি—তাতে এ ঘরে থাকাই আমার মুস্কিল হতো, সারারাত জেগে থাকতে হতো, কিন্তু এ কয়দিন তাঁর কোনো সাড়া শব্দ পাইনি, তাঁকে আগেই সরানো হয়ে গেছে নাকি?”
শঙ্কর রাও মাথা নাড়ে, ”না, তিনি নিজের কামরায় দিনরাত নেশাখোরের মত পড়ে আছেন। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলেন, খেতে চান, ছেলেকে খোঁজেন, ডাকেন—পাছে আবার নূতন উপদ্রব করেন, তাই আজ আর একটা ষ্ট্রং ইনজেকশান দিয়ে যাচ্ছি যাতে উনি ঘুমিয়ে থাকবেন, কোন উৎপাত করবেন না।”
মনে মনে শিখা ভাবে, মরফিণ দিয়ে পিশাচটা মহারাজের এই দুর্দ্দশা করেছে।
পিশাচ—হ্যাঁ, পিশাচই বটে,—মানুষের মধ্যে এমন পিশাচ লোকও থাকে—?
দাঁতের উপর দাঁত রাখে শিখা—
জিজ্ঞাসা করে—”শুনলাম মহারাণী নাকি আপনার ভাগ্নী—তাই কি?”
শঙ্কর রাওয়ের মনটা আজ বেশ ভালোই আছে, বিশেষ এই বাঙ্গালী মেয়েটির সাহস ও বুদ্ধি দেখে সে খুবই খুশী হয়েছে মনে হয়।
তাই সে বলে, ”হ্যাঁ, আমাকে মামাই বলে সে। আগে ছিল ভাগ্নী এখন মহারাণী, আর পার্থ সিংয়ের একটা ব্যবস্থা হলে অনেক কিছুই আশা করে মামা ভাগ্নী দুজনেই—”
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শিখা জিজ্ঞাসা করলে, ”পার্থ সিং? তিনি বেঁচে আছেন তো—?”
অট্টহাসি হেসে শঙ্কর রাও বললো, ”আছে, বেঁচে আছে বৈ কি? লালবাজারে চিঠি পাঠিয়েছিল তোমার সন্ধান দিয়ে। কাল সেও তোমাদের সঙ্গে যাবে। তবে সে যে তোমাকে চিনতে পারবে না এ কথা ঠিক। আচ্ছা, আজ বিদায় মিস্ রায়। আমাকে আবার আলিপুর ফিরতে হবে কিনা। তা কাল তো আবার দেখা হচ্ছেই, নমস্কার—”
শঙ্কর রাও নমস্কার করে চলে যায় ওখান থেকে।
চৌদ্দ – পলায়নের পথ
প্রস্তুত হয় শিখা—
যেমন করেই হোক—তাকে আজ রাত্রেই পালাতে হবে, নইলে এদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা যাবে না।
কিন্তু কি করে পালানো যায়। একখানি ছোট ছুরিও যদি তার কাছে থাকতো—তাহলেও হয়তো দরজার কব্জাটা আলগা করার চেষ্টা করতে পারতো সে।
শেষ চেষ্টা করবে আজ শিখা।
বোবা কালা লোকটা এখন সন্ধ্যার পর আহার্য্য নিয়ে আসে। কর্ত্তব্য স্থির করে ফেলে সে।
রোজকার মত সেদিনও ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছিল শিখা। রাত প্রায় ন’টার সময় বাইরে থেকে দরজায় করাঘাত করতে শিখা দরজা খুলে দিয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে।
খর্ব্বাকৃতি লোকটা একখানি থালায় করে রুটি তরকারি নিয়ে এসেছিল। থালাখানা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমে প্রবেশ করে সে।
ঠিক এই সুযোগটিরই প্রতীক্ষায় ছিল শিখা।
লোকটা বাথরুমে প্রবেশ করবামাত্র শিখা ছুটে গিয়ে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। বোবা কালা লোকটা তখন বিকট শব্দ করে দরজায় আঘাত করতে থাকে। শিখা ততক্ষণ বাইরে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। চাবিশুদ্ধ তালাটা বাইরের কড়ার সঙ্গেই ঝুলছিল।
বাইরে হয় তো প্রহরী আছে।
থাক, তবু যতটুকু ক্ষমতা মুক্তির চেষ্টা করা যাক। ধরা পড়ে—পড়বে, আর যদি বা ধরা পড়ে,—ভগবান ছাড়া গতি কি?
শিখা ত্রস্ত হস্তে শাড়িখানাকে এঁটে সেঁটে পরে নেয়। তারপর ভগবানের নাম স্মরণ করে চলতে থাকে সে।
না, কেউ নাই—। পাহারা হয়তো প্রথম প্রথম দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, পনের কুড়ি দিন একই ভাবে অবস্থান করায় আর কেউ সন্দেহ করে না; সেজন্য পাহারা দেওয়ার দরকার হয় না। তা ছাড়া তিনতলার ঘর সিঁড়ি দিয়ে নামতে দোতলায় ও একতলায় যথেষ্ট লোক আছে, ধরা পড়তেই হবে জানা কথা।
বুদ্ধিমতী শিখা সিঁড়ির পথ ধরে না, ইতস্ততঃ তাকিয়ে সে বারান্দার দক্ষিণ দিকে চলে যায়।
না, ভগবান আছেন—।
বোধ হয় সম্প্রতি মিস্ত্রী এ বাড়ীতে কাজ করছে, এখনও বাঁশের ভারা বাঁধা আছে।
ভগবানের নাম স্মরণ করে রেলিংয়ের ওধারে বাঁশের ভারা ধরে শিখা।
অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠেছে—। এ দিকটা সম্ভবতঃ বাড়ীর পিছন দিক। এদিকে পাহারার ব্যবস্থা ছিল না।
সর সর করে নেমে পড়ে শিখা। মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়ায়।
সামনেই মাঠ! সেই মাঠ দিয়ে ছুটতে থাকে সে। মনে হয় এ সব মাঠে ধান ছিল, কাটা হয়ে গেছে অনেক দিন, তার গোড়াগুলি উঁচু হয়ে আছে। শিখার পা দু’খানা ক্ষত—বিক্ষত হয়ে গেল।
কিন্তু ধরা পড়বার ভয় তাঁর অত্যন্ত বেশী,—একবার ধরা পড়লে তার আর মুক্তি নেই—এই আশঙ্কা নিয়েই শিখা দৌড়ায়।
বহুদুর ছুটে এসে হাঁপিয়ে পড়ে সে। তার মনে হয় গ্রামের সীমানায় এসে পৌঁচেছে সে; গাছপালা—ঘেরা বাড়ীগুলিতে আলো জ্বলছে দেখা যায়।
একটা গাছতলায় সে বসে পড়ে, আর হাঁটবার ক্ষমতা তার ছিল না।
হঠাৎ তার মনে হয়, ঘরের দরজাটা বোধ হয় খোলা রেখে এসেছে সে। যদি খোলা থাকে এখনই তার সন্ধান হবে, এবং এই রাত্রেই ওদের দলবল তাকে পাকড়াও করবার চেষ্টা করবে বা নিজেরা সাবধান হয়ে যাবে।
না, মনে হচ্ছে দরজা সে দিয়ে এসেছে। দরজার শিকলে চাবি লাগানো তালা ঝুলছিল, সে শিকল তুলে দিয়ে তালা আটকেছে, চাবিটা তার শাড়ীর আঁচলে বাঁধা রয়েছে—হাত দিয়ে সে দেখে নেয়।
”কে ওখানে—”
প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো এসে পড়ে।
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে যায় শিখা—পারে না, পা দুখানা যেন অবশ হয়ে গেছে।
প্রশ্নকারী এগিয়ে আসেন। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করেন, ”কে তুমি? এখানে এমনভাবে অন্ধকারে বসে আছ কেন?”
শিখা আশ্বস্ত হয়—না, তারা নয়। গ্রামের কোন লোক হয়তো। ক্লান্ত কণ্ঠে সে বলে, ”এখানে কি কোন থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি আছে?”
”থানা।”
আগন্তুক টর্চের আলো ফেলে শিখার মুখে। বলে—”তোমার দরকার থানায়? আমি ওখানেই যাচ্ছি, তুমি আসতে পারো আমার সঙ্গে।”
বহুকষ্টে গাছের গুঁড়িটাকে ধরে উঠে দাঁড়ায় শিখা—।
গ্রামের নাম কালিকাপুর—
কালিকাপুরের নাম শিখা জানে।
চলতে চলতে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, ”তুমি কোথা থেকে আসছো জানতে পারি কি?”
শিখা কোন উত্তর দেয় না।
ভদ্রলোক বললো, ”আমাকে ভয় করবার কোন কারণ নেই। আমিই এই থানার ও. সি.। বিশ্বাস না হয় চল—দেখতে পাবে।
আমার মনে হয় তুমি আমাদের সন্দেহজনক বাড়ীটা থেকে পালিয়ে এসেছো।”
বিশ্বাস করে না বলেই শিখা উত্তর দেয় না।
থানায় পৌঁছে তার ভুল ভাঙ্গে—সত্যই সে ও. সি. গোবিন্দবাবুর সঙ্গে এসেছে।
শিখা তখন যথাসম্ভব সংক্ষেপে গোবিন্দবাবুকে বলে ঐ বাড়ীটার কাহিনী। সব শুনে তিনি চিন্তিত মুখে বললেন, ”ওই বাড়ীটা সম্বন্ধে আমি অনেক রিপোর্ট পেয়েছি। নিজেও তিনচার দিন গিয়েছি। ম্যানেজার কি যেন আগরওয়ালা আমায় তাদের চালের কল, আটার কল দেখিয়েছে। ওখানে নূতন করে একটি গেঞ্জির কল বসানো হয়েছে শুনেছি। কিন্তু জাল নোট তৈরী হচ্ছে ওখানে এ সন্দেহ কোনদিনই করিনি। তাছাড়া আমার এখানে বেশী কনষ্টেবলও নাই যে ও বাড়ী ঘেরাও করবো, অথচ আপনার কথা শুনে বুঝছি ওরা যদি কোনরকমে জানতে পারে আপনি পালিয়েছেন তাহলে আজ রাত্রেই পালাবে।”
শিখা বললো, ”আপনার এখানে কোথাও যদি ফোন থাকে তাহলে আপনি এখনই লালবাজার পুলিশ অফিসে ফোন করে দিন—যেন এখনই কমিশনারের আদেশ নিয়ে কেউ সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে আসেন। বলে দিন—এই রাত্রেই যেন আলিপুর রোডের কাঞ্চনগড় প্যালেসটা ঘেরাও করা হয়, সেখানে দস্যুদলের নেতা শঙ্কর রাও ডাক্তার রবিশঙ্কর নাম নিয়ে আছে—তাকে আগেই যেন গ্রেপ্তার করা হয়। আরও বলবেন যে আনন্দিলালের দোকানের সেই চোর মেয়েটি আর তার সঙ্গীরা সবাই এখানে আছে। একটুও দেরী না করে যেন এখনই চলে আসেন। আপনি বলে দেবেন, শিখা নামে এক তরুণী মেয়ে রিপোর্ট দিচ্ছে।”
”আপনিই কি মেয়ে ডিটেকটিভ শিখা দেবী? কাগজে যে শিখা দেবীর কথা বেরিয়েছিল?” অবাক হয়ে তাকান তিনি শিখার দিকে।
”হ্যাঁ, আমারই নাম শিখা, কিন্তু আর এখন বেশী কথা বলবার সময় নেই। যা বললাম তাই করুন।”
* * * *
একই সময়ে হানা দেয় পুলিশ—
আলিপুরস্থ প্যালেস কাঞ্চনগড়ের জনপ্রাণীও সরতে পারেনি। শঙ্কর রাও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
এদিকে রাত্রি আড়াইটার সময় কালিকাপুরের এই গুপ্ত ঘাঁটিটাও ঘেরাও করে পুলিশ। এখানকার সকলকেই গ্রেপ্তার করা হয়—রাণী ইন্দিরাও বাদ যায় না।
জাল নোট আবিষ্কার হয় প্রায় কোটি টাকার মত। নোট জাল করবার যন্ত্রপাতিও হস্তগত করে পুলিশ।
শিখাকে পুলিশ দলের সঙ্গে দেখে দুনিচাঁদ আগরওয়ালা আকাশ থেকে পড়ে। ইন্দিরার মুখখানাও কালো হয়ে ওঠে।
অচৈতন্য—প্রায় জীর্ণ শীর্ণ দেহ বৃদ্ধ রাজাকেও উদ্ধার করা হয় একখানা ঘর থেকে। শিখা যে বোবাকালা লোকটাকে বন্দী করেছিল তাকে মুক্তি দিলে সে বেচারা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
সেই রাত্রেই লরী—ভর্ত্তি অপরাধীদল সহ পুলিশদল চললো কলকাতার দিকে।
শিখা নিজের বাড়ীতে ফিরলো।
মা অজস্র চোখের জল ফেললেন তাকে ফিরে পেয়ে। কাকিমা বললেন, ”মেয়েদের এমন সাহস ভালো নয় বাপু, যা রয় সয় তাই ভালো। কি দরকার তোমার এ সব কাজ করবার? কি এমন অভাব পড়েছে তোমার শুনি? দশটা নয় পাঁচটা নয়—আমাদের একটা মাত্র মেয়ে,—কোন দিন এতটুকু দুঃখ—কষ্ট পেতে দেইনি,—সেই মেয়ে কিনা ইচ্ছে করে এই রকম দুঃখ—কষ্ট…”
তাঁর চোখে জল এসে পড়ে।
রতনও গোপনে চোখের জল মোছে। মনের খুশীতে সেদিন সে ঠাকুরের নামে মেনে—রাখা পাঁচসিকের হরিরলুট দিয়ে ফেললো।
কাঞ্চনগড় প্যালেসের নীচের তলার একটা অন্ধকার বন্ধ ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে পার্থ সিংকে। এই কয়দিনেই তিনি শীর্ণ হয়ে পড়েছেন। উপযুক্ত চিকিৎসায় মহারাজা অনেকটা প্রকৃতিস্থ হয়েছেন। পুত্র বেঁচে আছে সে কথাটা তিনি শুনেছেন, সেই পুত্রকে যখন তিনি সামনে দেখলেন তখন তাঁর মনের যে অবস্থা হ’ল তা বর্ণনাতীত।
শিখার চেষ্টায় রাজসাক্ষী রূপে গ্রহণ করা হ’ল সেই কিশোর ছেলেটিকে।
ডক্টর শঙ্কর রাও উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু সে তার শিক্ষা ও জ্ঞান সৎপথে চালিত করেনি। মানুষের অপকারই সে করে এসেছে এতদিন। পুনায় থাকতে তার নাম জাল করবার অভিযোগ আসে। সে তখন বোম্বেতে আত্মগোপন করে। তারপর যায় কাঞ্চনগড়ে। সুন্দরী তরুণী ইন্দিরাকে দিয়ে সে অনেক কাজ করায়—ধনী দুনিচাঁদ আগরওয়ালা ছিল তার সব রকম পাপ কাজের সহায়। তার দলের লোক সারা ভারতময় ছড়িয়ে আছে। বর্ত্তমানে সে বাংলায় তার কর্ম্মকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। পার্থ সিং ফিরে না এলে তার ষড়যন্ত্রের কথা বিন্দুমাত্রও প্রকাশ হতে পারতো না।
খুনি, চুরি—ডাকাতি, চোরা—কারবার, কাঞ্চনগড়ের মহারাজার উপর অমানুষিক অত্যাচার—এ সব তারই কীর্ত্তি।
বিচারে শঙ্কর রাওয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়, অন্যান্য আসামীরাও যথাযোগ্য দণ্ডে দণ্ডিত হয়।
হীরার নেকলেস উদ্ধার করা ও চোরকে গ্রেপ্তার করার পুরস্কার স্বরূপ পাঁচ হাজার টাকা আনন্দিলাল শিখাকে দিলেন। গভর্ণমেণ্টও শিখাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করলেন। পুলিশ কমিশনারের আগ্রহে এই উপলক্ষে একটা উৎসবও হ’ল।
যতীন্দ্রনাথ আরোগ্যলাভ করেছিলেন। সেই উৎসবে সস্ত্রীক তিনিও যোগদান করেছিলেন। আর শিখা।…
হেসে হেসে সকলের সঙ্গেই সে নমস্কার বিনিময় করেছিল সেদিন।