দ্বিতীয় অধ্যায় — শিক্ষার লক্ষ্য
কিভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তাহা আলোচনা করিবার পূর্বে বরং শিক্ষা হইতে কিরূপ ফল আশা করি সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। ডক্টর আর্নল্ড চাহিয়াছিলেন মনের নম্রতা; অ্যারিস্টটলের মহানুভব মানবের [Mag nanimous man] মধ্যে কিন্তু এ গুণ দেখা যায় না। নিসের আদর্শ আর খ্রিস্টধর্মের আদর্শ এক নয়; ক্যান্টের আদর্শের সঙ্গেও ইহার মিল নাই; খ্রিস্টধর্মের প্রেমধর্মের উপর জোর দিয়াছেন; ক্যান্ট বলেন, যে কাজের মূল উৎস প্রেম তাহা কখনও সাধু কাজ হইতে পারে না। ভালো চরিত্রগঠনে কি কী উপাদান প্রয়োজন সে বিষয়ে একমত হইলেও কোন উপাদান কি পরিমাণে থাকা দরকার সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। একজন হয়তো সাহসকে প্রাধান্য দিবেন, অন্য একজন জ্ঞানার্জনের উপর জোর দিবেন; অপর কেহ দয়া এবং কেহ বা সত্যবাদিতাকেই প্রধান মনে করিবেন। প্রথম ব্রুটাসের মত কেহ হয়তো পারিবারিক স্নেহ-প্রীতি অপেক্ষা দেশের প্রতি কর্তব্যকেই সর্বপ্রধান কাম্য বলিয়া মনে করিবেন; আবার কেহ হয়তো কনফুসিয়াসের [Confucius] মতো পরিবারের প্রতি স্নেহপ্রীতিকেই সকলের উপর স্থান দিবেন। এই সব পার্থক্যের দরুন শিক্ষার মধ্যেও পার্থক্য ঘটিবে। কোন ধরনের শিক্ষা সর্বোৎকৃষ্ট তাহা স্থির করিবার পূর্বে শিক্ষাদীক্ষা দিয়া আমরা কি রকম মানুষ প্রস্তুত করিতে চাই সে সম্বন্ধে আমাদের ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক।
অবশ্য শিক্ষাবি যেরূপ লোক প্রস্তুত করিতে ইচ্ছা করেন সব সময়েই যে সেরূপ পারেন তাহা নয়। কখনও বা হয়তো আদর্শের বিপরীত লোক প্রস্তুত হয়; যেমন চ্যারিটি স্কুলে [Charity School] বিনয় শিক্ষার ফলে Uriah Heep-এর মতো লোক তৈয়ারি হইয়াছিল। কিন্তু মোটের উপর সক্ষম শিক্ষাবিদগণ তাঁহাদের উদ্দেশ্য সাধনে বহুল পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছে; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চীনের শিক্ষাবিদগণ, আধুনিক জাপানের শিক্ষাব্রতীবৃন্দ, জেসুইটগণ, ডক্টর আর্নল্ড এবং মার্কিন শিক্ষার পরিচালকগণ। ইহারা সকলেই ইঁহাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ইহাদের কাম্য লক্ষ্য অপরের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল, তবু ফললাভ করিয়াছেন সকলেই। শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য কি হওয়া উচিত তাহা স্থির করিবার পূর্বে এই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রণালী আলোচনা করিলে আমরা লাভবান হইবে পারিব।
চীনের চিরাচরিত শিক্ষাপদ্ধতি কোনো কোনো বিষয়ে এথেন্সের গৌরবময় যুগের শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ অনুরূপ। এথেন্সবাসী বালকদিগকে হোমারের কবিতা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করিতে হইত। চীনা বালকদিগকে দেবদেবিকে শ্রদ্ধা করিতে শিখিত। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন কতকগুলি আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিত, তাহাদের বুদ্ধিমূলক উচ্চ-চিন্তায় কোনো প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিত না। ঠিক এমনিভাবে চীনারা তাহাদের পূর্বপুরুষের পূজা [Ancestor-worship] সংক্রান্ত কতকগুলি রীতিনীতি শিক্ষা করিত; কিন্তু শিক্ষিত বয়স্ক যে ইহা বিশ্বাস করিবে এরূপ আশা করা হইত না : যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করা চলিতে পারে কিন্তু কোনো স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হীন কাজ বলিয়াই বিবেচনা করা হইত। অভিমত বা মতবাদ এমন হওয়া চাই যেন তাহা লইয়া ভোজের আসরে মনোজ্ঞ আলোচনা করা চলে, যেরূপ মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ যুদ্ধ করতে কুণ্ঠিত হয় না সেরূপ হওয়ার দরকার নাই। কার্লাইল [Carlyle] প্লেটোকে বলিয়াছেন তিনি জিয়নে আরামে বিরামে আসীন একজন সম্ভ্রান্ত এথেনীয়ন ভদ্রলোক। এই আরাম এবং বিলাসের মধ্যে আসীন থাকার বৈশিষ্ট্য চীন ঋষিদের মধ্যেও বিদ্যমান কিন্তু খ্রিস্টান জ্ঞানীদের মধ্যে এই ভাব দেখা যায় না। অবশ্য গেটের মতো গ্রিক সভ্যতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত লোকদের মধ্যে ইহার ব্যতিক্রম হইয়াছে। এথেন্সবাসী এবং চীনাদেশবাসী উভয়েই জীবনকে উপভোগ করিতে চাহিয়াছিল; তাহাদের জীবনে উপভোগের ধারণা শোভন সৌন্দর্যবোধ দ্বারা মণ্ডিত হইয়াছিল।
এই দুইটি সভ্যতার মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। তাহার প্রধান কারণ-গ্রিকরা উদ্যমশীল এবং সকল কাজে উৎসাহী আর চীনারা অলস। গ্রিকরা তাহাদের শক্তি, শিল্প, বিজ্ঞান এবং আত্মধ্বংসী কলহে নিয়োজিত করিয়াছিল। এ সকল ক্ষেত্রেই তাহারা অপূর্ব সাফল্য লাভ করিয়াছিল। রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম অবলম্বন করিয়া গ্রিকদের শৌর্য আত্মপ্রকাশ করিত : স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইলে রাজনৈতিক নেতারা নির্বাসিত লোকদের লইয়া দল গঠন করিয়া নিজেদের দেশ আক্রমণ করিত। চীনা কর্মচারী কর্মচ্যুত হইলে পাহাড় অঞ্চলে নির্জনবাস করিতে যাইত এবং পল্লীর সুখসৌন্দর্য সম্বন্ধে কবিতা লিখিত। এইভাবে গ্রিক সভ্যতা আত্মঘাতী হইয়াছিল, কিন্তু চীনা সভ্যতা কেবল বাহিরের শত্রু কর্তৃকই ধ্বংস হইতে পারে। অবশ্য এই পার্থক্যের জন্য, কেবল শিক্ষাকেই দায়ী করা চলে না; কেননা কনফুসিয়াসের মতবাদ জাপানে প্রবর্তিত হইলেও সেখানে শুধু কিয়াটোদের অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া অন্যদের মধ্যে চীনাদের মতো শিক্ষিত, সভ্য এবং অলস তার্কিকদল সৃষ্টি করে নাই।
চীনা শিক্ষার ফল হইয়াছে পরিবর্তনবিমুখতা [Stadility] এবং শিল্পের প্রসার। ইহা প্রগতি কিংবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুফল প্রদান করে নাই। অলস তার্কিকতা যেখানে প্রাধান্য লাভ করে সেখানে ফলাফল বোধহয় এইরূপই হইয়া থাকে। দৃঢ় জীবন্ত বিশ্বাস উন্নতির পথে লইয়া যায়, আর না হয় বিপদ টানিয়া আনে, অচলায়তনের মধ্যে জাতিকে বদ্ধ রাখে না। মানুষের বিশ্বাস যেখানে শিথিল সেখানে বিজ্ঞান প্রসার লাভ করিতে পারে না, কারণ বিজ্ঞান প্রচলিত কুসংস্কারের মূলে আঘাত করে বটে কিন্তু ইহার উপরও তো দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রাখা চাই! আধুনিক বিজ্ঞান পৃথিবীর দেশগুলিকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনিয়াছে; যুদ্ধসঙ্কুল বিশ্বের জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শক্তি ও শৌর্যের প্রয়োজন আছে; এবং বিজ্ঞান ছাড়া গণতন্ত্র অসম্ভব। চীন সভ্যতা অল্পসংখ্যক শিক্ষিত লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; গ্রিক সভ্যতা দাস প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এইজন্য, চীনদেশের চিরাচরিত শিক্ষা বর্তমান যুগের উপযোগী নয় বলিয়া চীনগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াছে। এই একই কারণে অষ্টাদশ শতাব্দীর চীনা সংস্কৃতিবান অভিজাতগণও অপ্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছেন।
বিশ্বের সকল বৃহৎ শক্তির মধ্যে যে-ভাবের প্রাধান্য দেখা যায় আধুনিক জাপানে তাহার সুস্পষ্ট উদাহরণ মিলিবে। এভাবে হইল জাতীয় উন্নতিকে শিক্ষার সর্বপ্রধান লক্ষ্য বলিয়া গ্রহণ করা। জাপানি শিক্ষার উদ্দেশ্য হইল অধিবাসীদের প্রবৃত্তিগুলিকে যথাযথভাবে ট্রেনিং দিয়া রাষ্ট্রের প্রতি অনুরক্ত নাগরিক তৈয়ার করা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে লাগে এমন জ্ঞান দান করা। যেরূপ কৌশলে এই দুইটি উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা হইয়াছে তাহার প্রশংসা করিয়া শেষ করা যায় না। কমোডোর পেরি যখন যুদ্ধজাহাজ লইয়া জাপানের উপকূলে উপনীত হইয়াছিলেন তখন হইতে জাপানে আত্মরক্ষার সমস্যাটি বড় এবং কঠিন হইয়া রহিয়াছে। এ বিষয়ে জাপানিদের সাফল্য তাহাদের শিক্ষাব্যবস্থারই সাফল্য প্রমাণ করে; নতুবা আত্মরক্ষাকে অপরাধ বলিয়া গণ্য করিতে হয়। জাতি যেখানে আসন্ন বিপদের সম্মুখিন, সেখানেই কেবল এইরূপ শিক্ষাব্যবস্থা সমর্থন করা যায়, অন্যত্র ইহা অচল। শিন্টো ধর্ম এমনভাবে রক্ষিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পর্যন্ত ইহার সমালোচনা করার বা প্রশ্ন করার অধিকার নাই; ইহার ইতিহাস বাইবেলের জেনেসিস [Genesis] অধ্যায়ের মতোই সংশয়জনক। জাপানে ধর্মের নামে যে অত্যাচার হইয়াছে তাহার পাশে ডেটন [Day ton]-এর বিচার ম্লান হইয়া পড়ে। সেখানে নীতিগত অত্যাচারও চলিয়াছে অনুরূপভাবে। জাতীয়তা, সন্তানবাৎসল্য, মিকোডো পূজা প্রভৃতি সম্বন্ধে কাহারও কোনোরূপ বিরূপ সমালোচনা করার উপায় নাই। কাজেই নানা বিষয়ে উন্নতির পথও রুদ্ধ। এইরূপ লৌহঘঁচে-ঢালা ব্যবস্থার বিপদ এই যে উন্নতির পন্থা হিসাবে ইহা বিপ্লব জাগাইয়া তোলে। ইহাই সত্যিকারের বিপদ এবং দ্রত না হইলেও শিক্ষাব্যবস্থাই ইহা ঘটায়।
এইভাবে দেখা যাইতেছে যে, প্রাচীন চীনে যে ত্রুটি ছিল আধুনিক জাপানে ঠিক তাহার বিপরীত ত্রুটি রহিয়াছে। চীনের শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিরা ছিলেন অবিশ্বাসী এবং অলস; শিক্ষিত জাপানিরা নিজেদের অভিমতকে একেবারে অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করে, কাজেও তাহাদের আদম্য উৎসাহে। সব কিছু সম্বন্ধেই অবিশ্বাসের ভাব পোষণ করা কিংবা সব কিছুতেই নিজের মত অভ্রান্ত বলিয়া মনে করা–ইহার কোনোটিই প্রকৃত শিক্ষার ফল হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শিক্ষাকে এইরূপ বিশ্বাস উৎপাদন করিতে হইবে যে, কষ্টকর হইলেই কিছু পরিমাণ জ্ঞান অর্জন সম্ভবপর; এক সময় যাহা জ্ঞান বলিয়া মনে করা হয় অন্য সময় তাহা হয়তো কিছুটা ভুল হইতে পারে, কিন্তু ওই ভুল যত্ন ও পরিশ্রম দ্বারা সংশোধন করা যায়। যেখানে সামান্য একটু ভুলের ফলে বিপদ ঘটিতে পারে সেখানে। বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়াই আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে। মনের এইরূপ অবস্থাপ্রাপ্তি কঠিন ব্যাপার; ইহার জন্য চাই ভাবাবেগ এবং উচ্চস্তরের বুদ্ধি প্রয়োগ! কঠিন হইলেও ইহা অসম্ভব নয়; কার্যত ইহাই বৈজ্ঞানিক স্বভাব বা মেজাজ। অন্যান্য ভালো জিনিসের মতোই জ্ঞানলাভ কঠিন; কিন্তু অসম্ভব নয়। অভ্রান্তবাদীরা ইহা মোটেই কঠিন মনে করে না, অবিশ্বাসীরা ইহার, সম্ভাব্যতাই বিশ্বাস করে না। এই দুই পক্ষই ভ্রান্ত; ইহাদের ভুল ব্যাপক হইলেই শুরু হয় সামাজিক বিপদাপদ।
আধুনিক জাপানিদের মতো জেসুইটগণও শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের জন্য নিয়োজিত করিয়া ভুল করিয়াছিলেন। তাঁহাদের এই প্রতিষ্ঠান ছিল ক্যাথলিক ধর্মসংঘ। তাহারা কোনো ছাত্রের ব্যক্তিগত কল্যাণ কামনা করিতেন না; ধর্মসংঘের প্রয়োজনে লাগে এমনভাবে তাহাকে গড়িয়া তোলাই ছিল তাঁহাদের উদ্দেশ্য। আমরা যদি তাঁহাদের মতবাদ গ্রহণ করি তবে তাহাদিগকে দোষ দিতে পারি না। তাহাদের ধর্মনীতি হইল–নরক হইতে একটি আত্মাকে উদ্ধার করা যে কোনো জাগতিক কাজ হতে শ্রেষ্ঠ এবং এই কাজ কেবল ক্যাথলিক ধর্মসংঘই করিতে পারে। যাহারা জেসুইটদের এই মতবাদ মানেন না, তাহারা ফলাফল দেখিয়া জেসুইট শিক্ষার বিচার করিবেন। এই শিক্ষার ফলে অনেক সময় Uriah Heep-এর মতো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তৈয়ারি হইয়াছে। ভল্টেয়ারও জেসুইট শিক্ষার ফলস্বরূপ। মোটের উপর অনেক কাল ধরিয়া জেসুইট শিক্ষার ফল পাওয়া গিয়াছিল। বিরুদ্ধ সংস্কার আন্দোলন (Counter Reformation] এবং ফ্রান্সে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের বিলোপ জেসুইটদের শিক্ষার ফলেই সম্ভব হইয়াছিল। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁহারা শিল্পকে করিয়াছিলেন ভাবপ্রবণ, চিন্তাধারাকে করিয়াছিলেন ভাসা ভাসা, অগভীর এবং নীতিবোধকে করিয়াছিলেন শিথিল। অবশেষে তাঁহাদের এই কুফলের আবর্জনা ভাসাইয়া লইবার জন্য ফরাসিবিপ্লবের প্রয়োজন হইয়াছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে তাহাদের অপরাধ ছিল এই যে, ছাত্রের প্রতি ভালোবাসা দ্বারা নয়, নিজেদের স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাঁহারা পরিচালিত হইতেন।
ডক্টর আর্নল্ডের শিক্ষাপ্রণালী অদ্যাবধি ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলসমূহে প্রচলিত রহিয়াছে; ইহার একটি দোষ হইল যে ইহা আভিজাত্য গর্বে গর্বিত। এ শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল, কি স্বদেশের, কি সুদূর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক অংশে যাহারা উচ্চপদ ও ক্ষমতায় অধিকারী হইবেন এমন লোক তৈয়ার করা। অভিজাত সম্প্রদায়কে টিকিয়া থাকিতে হইলে কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটাইতে হয়; এইগুলি স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হইত। ফলে গড়িয়া উঠিল উদ্যমশীল, দৈহিক এবং নৈতিক শক্তিতে শক্তিমান, ধৈর্যশীল এবং অভিজাত সম্প্রদায়। তাহাদের মনে এমন এক ধারণা বদ্ধমূল হইল যে, তাহারা যাহা জানে তাহাই সত্য, তাহার কোনো পরিবর্তণ হইতে পারে না এবং তাহারা বিশ্বে কোনো মহৎ কার্য সম্পাদন করিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে! বিস্ময়করভাবে এই ফল ফলিয়াছিল। ইহার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে বিসর্জন দিতে হইয়াছিল, কেননা বুদ্ধি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি করিতে পারে; তথাকথিত নিকৃষ্ট শ্রেণির বা জাতির লোকদের উপর শাসন করিতে গেলে সহানুভূতি প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করিতে পারে। কাজেই সহানুভূতি বিসর্জন দেওয়া হইল, দ্র আচরণের পরিবর্তে দৃঢ়তার উপর জোর দেওয়া হইল। ইহাই হইল এ অভিজাত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য। জগৎ যদি পরিবর্তনশীল হইত তবে ব্রিটিশ অভিজাত সম্প্রদায়ে স্পাটার্নদের দোষগুণের অধিকারী হইয়া স্থায়িত্ব লাভ করিত। কিন্তু আভিজাত্যের দিন চলিয়া গিয়াছে, কোনো শাসিত জাতিই বিজ্ঞ এবং গুণশালী শাসককেও আর মানিতে চাহিবে না। ইহার ফলে শাসকগণ অত্যাচারী হইয়া ওঠেন; অত্যাচার বিদ্রোহের পথই সুগম করিয়া দেয়। বর্তমান বিশ্বের জটিল সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য ক্রমেই বেশি পরিমাণে বুদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু ডক্টর আর্নল্ড বুদ্ধিবৃত্তি বিসর্জন দিয়া তাহার ছাত্রদের মধ্যে কতকগুলি গুণের বিকাশ ঘটাইয়াছিলেন। ইটনের খেলার মাঠে যুদ্ধ জয় সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হারানোর সূচনাও হইয়াছিল ওইখানেই। বর্তমানে জগৎ অন্য ধরনের লোক চায়; এখন দরকার উদার কল্পনা ও সহানুভূতি, দরকার বুদ্ধিশক্তির নমনীয়তা; বুলডগের মতো একগুঁয়ে সাহসের পরিবর্তে যন্ত্র বিজ্ঞানের উপর বেশি আস্থার প্রয়োজন। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপরিচালককে স্বাধীন নাগরিকের সেবক হইতে হইবে, প্রশংসমান প্রজাবৃন্দের শাসক হইলে চলিবে না। ব্রিটিশ উচ্চশিক্ষার মধ্যে যে আভিজাত্যের ধারা বদ্ধমূল রহিয়াছে তাহাই হইয়াছে ইহার ধ্বংসের কারণ। হয়তো এই ঐতিহ্য ক্রমে ক্রমে দূর করা সম্ভব; হয়তো বা প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানের প্রয়োজনের সঙ্গে নিজদিগকে খাপ খাওয়াইতে পারিবে না। এ সম্বন্ধে আমি কোনো অভিমত দিতে চাই না।
আমেরিকার পাবলিক স্কুল সাফল্যের সঙ্গে যে কাজ সম্পন্ন করিয়াছে তাহা পূর্বে কোথাও বিরাট আকারে করার চেষ্টা করা হয় নাই। ইহা বিভিন্ন জাতির কতক মানবগোষ্ঠীকে এক মহান জাতিতে পরিণত করা। আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপের নানা জাতির লোক এখানে উপনিবেশ স্থাপন করিতে আসে। নানা ভাষা, নানা জাতি, নানারূপ জাতীয় বৈশিষ্ট্য; ইহা সত্ত্বেও এই সকল লোকগোষ্ঠীকে এমন সুষ্ঠুভাবে এক জাতিতে পরিণত করা হইয়াছে যে, যাহারা ইহা করিয়াছেন তাহাদের কৃতিত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিতে হয়। কিন্তু জাপানের মতো আমেরিকার অবস্থাও স্বতন্ত্র, কাজেই অস্বাভাবিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করার ফলে কোনো নীতি কার্যকরি হইয়াছে বলিয়াই তাহা যে সর্বত্র সুফলপ্রদ এবং উপযোগী হইবে এমন কোনো কথা নাই। আমেরিকার কতকগুলি সুবিধা আছে, অসুবিধাও আছে। সুবিধাগুলি হইল ও অর্থের প্রাচুর্য, যুদ্ধে পরাজয় আশঙ্কা না থাকা, মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের হাত হইতে অব্যাহতি। বিভিন্ন দেশ হইতে উপনিবেশ স্থাপন করিতে যাহারা আসিয়াছিল তাহারা মার্কিন মুল্লুক জনসাধারণের মধ্যে গণতন্ত্রে অনুকূল মনোভাব এবং যান্ত্রিক সভ্যতার অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থা দেখিতে পায়, এই দুইটিই মনে হয় প্রধান কারণ যে জন্য প্রায় সকলেই নিজেদের জন্মভূমি অপেক্ষা আমেরিকার প্রশংসায় মুখর হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু নবাগত স্বদেশপ্রেম হইয়াছিল দ্বিমুখি: ইউরোপে যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে তাহারা ডিনজেদের আসল জন্মভূমির সমর্থক হইয়া পড়িত। পক্ষান্তরে তাহাদের সন্তানসন্ততির তাহাদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমির প্রতি কোনো দরদ নাই, তাহারা আমেরিকার অধিবাসীরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহাদের পিতামাতার যে মনোভাব তাহা মার্কিন মুলুকের সাধারণ গুণের ফলেই সম্ভব হইয়াছে; সন্তানসন্ততিবর্গের মনোভাব গড়িয়া তুলিয়াছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার ফলে কি হইয়াছে তাহাই আমাদের বিবেচনার বিষয়।
মার্কিন দেশের যে সব গুণ আছে তাহা শিক্ষার ভিতর দিয়া নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে। এক্ষেত্রে স্বদেশ ও প্রেমকে কোনো ভ্রান্ত আদর্শের সঙ্গে জড়িত করিয়া শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু যেখানে প্রাচীন মহাদেশ ইউরোপ নূতন মহাদেশ আমেরিকা হইতে শ্রেষ্ঠ, সেখানে প্রকৃত ভালো জিনিসের প্রতিও অবজ্ঞার ভাব ছাত্রদের মনে গড়িয়া তোলা হয়। পশ্চিম ইউরোপে জ্ঞান ও শিক্ষার মান এবং পূর্ব ইউরোপের শিল্পের মান মোটের উপর আমেরিকার মান অপেক্ষা উচ্চ। স্পেন ও পর্তুগাল ছাড়া সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে ধর্ম সম্বন্ধীয় কুসংস্কার মার্কিন দেশ অপেক্ষা অনেক কম। ইউরোপের প্রায় সকল দেশেই ব্যক্তির উপর গোষ্ঠীর প্রভাব যেমন, মার্কিন দেশে তেমন বেশি নয়; এমনকি যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কম সেখানেও তাহার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা অনেক বেশি। এই বিষয়ে মার্কিন পাবলিক স্কুলগুলি বিশেষ ক্ষতিসাধন করে। অন্য সব কিছু বাদ দিয়া কেবল মার্কিনি স্বদেশপ্রেম শিক্ষা দেওয়াতেই ইহার উদ্ভব। জাপানি এবং জেসুইটদের মতোই এই অপকারের আসল কারণ হইল ছাত্রদের মঙ্গলের জন্যই তাহাদের শিক্ষা না দিয়া কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায়স্বরূপ তাহাদিগকে গড়িয়া তোলা। শিক্ষক তাঁহার রাষ্ট্র কিংবা ধর্মপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে ছাত্রকে বেশি ভালোবাসিবেন; তাহা না হইলে তিনি আদর্শ শিক্ষকই নহেন।
আমরা যদি বলি ছাত্র অর্থাৎ ছাত্রের কল্যাণই শিক্ষার চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত, ছাত্রকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায়রূপে ব্যবহার শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় তবে কেহ প্রত্যুত্তরে বলিতে পারেন কোনো উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই প্রত্যেকের প্রয়োজন, নতুবা তাহার সার্থকতা কি? একজন মানুষই যদি লক্ষ্য হয়, তবে তাহার মৃত্যুর সঙ্গেই সব লোপ পাইল কিন্তু উপায়স্বরূপ হইয়া সে যাহা কিছু উৎপন্ন করে তাহা তো টিকিয়া থাকে। এ তর্ক আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসাবে একজন মানুষ ভালো কাজে বা মন্দ কাজে লাগিতে পারে। মানুষের কাজের বহুদূরপ্রসারী শেষফল এত অনিশ্চিত যে, বিজ্ঞ লোকমাত্রই তাহা লইয়া মাথা ঘামাইতে চাহিবেন না। মোটামুটি বলিতে গেলে ভালো লোকের কাজ ভাল, খারাপ লোকের কাজ খারাপ, তবে ইহাও অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম নহে। একজন খারাপ লোক একজন অত্যাচারীকে হত্যা করিতে পারে; কারণ সে হয়তো এমন অপরাধ করিয়াছে যেজন্য অত্যাচারী শাসক তাহাকে শাস্তি দিতে চায়। যদিও সে নিজে এবং তাহার কাজ ভাল নয় তথাপি তাহার কাজের ফল ভালো হইতেও পারে। কিন্তু সাধারণ নিয়মে ইহাই দেখা যায় যে, যেখানে জনসাধারণ অজ্ঞ এবং অপকারী সেখানকার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট নরনারী সমন্বয়ে গঠিত মানব-সমাজে সুফল বেশি। ইহা ছাড়া কাহারা ছাত্রদের মঙ্গল কামনা করে, কাহারাই বা তাহাদিগকে কোনো উদ্দেশ্যসাধনের উপায় বা কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে তাহা শিশু, কিশোর ও যুবকগণ সহজেই বুঝিতে পারে। শিক্ষক যদি ছাত্রের প্রতি মমতাহীন হন, তবে ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তি বা চরিত্র কোনোটিই সম্যক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে পারে না; একমাত্র শিশুর মঙ্গল কামনার মধ্যেই এরূপ মমতা নিহিত থাকে। আমাদের সকলেরই নিজের সম্বন্ধে এরূপ মমতা আছে; আমরা নিজের জন্য ভালো জিনিস কামনা করি কিন্তু ইহার দ্বারা যে কোন মহৎ কাজ সম্পন্ন হইবে এরূপ কোনো প্রমাণও আগে দেখিতে চাই না। প্রত্যেক স্নেহশীল জনক বা জননী তাহার সন্তানের জন্য এরূপই ভাবেন। তাহারা নিজেরা যেমন নিজেদের মঙ্গল কামনা করেন, তেমনি চান তাহাদের সন্তান সবল এবং স্বাস্থ্যবান হইয়া গড়িয়া উঠুক, স্কুলে পড়াশুনায়। ভালো করুক ইত্যাদি; কাম্য অবস্থা বা জিনিস শেষ পর্যন্ত ভালো কি মন্দ ফল দিবে, ইহার দ্বারা ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষিত হইবে কিনা কেহ এসব চুলচেরা বিচার করিয়া দেখে না। জনক-জননীর হৃদয়ে যে সন্তানের জন্য স্বাভাবিক মঙ্গল কামনা রহিয়াছে তাহা সর্বদা কেবল নিজের সন্তানের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিশুদের শিক্ষক যিনি হইবেন তাঁহার অন্তরে এই কামনা থাকা চাই। শিশুদের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহা কতকটা শিথিল হইয়া আসে। কিন্তু যাহারা শিশুদের প্রতি মমতা এবং তাদের কল্যাণচিন্তা পোষণ করেন কেবল তাহারাই শিক্ষাপ্রণালী রচনার অধিকারী হইতে পারেন। যাহারা মনে করেন যুদ্ধ করিতে এবং যুদ্ধে প্রাণ দিতে ইচ্ছুক ও সক্ষম পুরুষ তৈয়ার করাই বালকদের শিক্ষার উদ্দেশ্য তাঁহাদের মনে পিতৃহৃদয়ের মমতা নাই; তথাপি এইরূপ লোকই ডেনমার্ক এবং চীনদেশ ছাড়া সর্বত্র শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন।
শিক্ষাবিদগণ যে ছাত্রকে ভালোবাসিবেন ইহাই যথেষ্ট নয়; কি কি গুণে ভূষিত হইলে মানুষের উৎকর্ষতা বাড়ে সে সম্বন্ধেও তাহাদের সঠিক ধারণা থাকা চাই। বিড়াল তাহার ছানার সঙ্গে খেলা করে এবং ইঁদুর ধরা শিখায়, যুদ্ধবাদীগণ [Mil itarists] অনুরূপভাবে মানব শিশুকে শিক্ষা দেন। বিড়াল তাহার নিজের ছানাকে ভালবাসে কিন্তু ইঁদুর ছানাকে ভালোবাসে না, যুদ্ধবাদী সন্তানদিগকে ভালোবাসে না। যাহারা সমগ্র মানবজাতিকে ভালোবাসেন তাহারাও উৎকৃষ্ট জীবনের উপাদান কী সে সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষণ করার ফলে ভুল পথে চলিতে পারেন। কাজেই কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া কিংবা কোনো গুণ অধিগত করা (ইহা আদৌ) সম্ভবপর কিনা তাহা চিন্তা না করিয়া, মানবজীবনে চরম উৎকর্ষলাভের জন্য কিসের প্রয়োজন তাহাই প্রথমে আলোচনা করিব। পরে, যখন আমরা শিক্ষার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব, তখন ইহা কাজে লাগিবে; তখন বুঝিতে পারিব কোন্ লক্ষ্য অভিমুখে আমরা চলিতে চাই।
আমরা প্রথমেই একটা পার্থক্যের কথা স্বীকার করিয়া লই :–এমন কিছু গুণ আছে যাহা সকলের মধ্যে না হোক কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়, আবার কতকগুলি গুণ সর্বজনীন হওয়া উচিত। আমরা শিল্পী চাই কিন্তু বৈজ্ঞানিকও আমরা চাই। আমরা রাষ্ট্র পরিচালক ও শাসক চাই, আবার কৃষক, মজুর, ব্যবসায়ীও তো চাই। যে গুণাবলি একজন লোকের জীবনে বিরাট প্রতিভারূপে প্রকাশ পায় তাহাই সর্বসাধারণের মধ্যে বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। শেলি একজন কবির দিনের কাজের বর্ণনা দিয়াছেন এইরূপ :
প্রভাত সময় হতে প্রদোষ অবধি।
দেখিবে সে হ্রদতীরে বসি
রৌদ্রকরে উল্লসিত মৌমাছির মেলা
ফুলে ফুলে। বস্তুপুঞ্জে নাহি আকর্ষণ,
নিমগ্ন সুন্দরের ধ্যানে।
কবির পক্ষে এই অভ্যাস প্রশংসনীয় কিন্তু ডাকপিওনের পক্ষে নয়। কাজেই সকলের মধ্যেই স্বভাব বা মনোভাব গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্যে আমরা কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে পারি না। কিন্তু কতকগুলি গুণ সকলের মধ্যেই বিকশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়; কেবল এইগুলিই এখানে বিবেচনা করিব।
এই গুণসমূহের কোনগুলি পুরুষের পক্ষে প্রযোজ্য, কোন্গুলি স্ত্রীলোকের পক্ষে প্রযোজ্য সে সম্বন্ধে কোনো পার্থক্য করিতে চাই না। যে সকল স্ত্রীলোককে শিশুর যত্ন পরিচর্যা করিতে হয় তাঁহাদের জন্য পেশামূলক কিছু শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা উচিত, একজন কৃষক ও একজন মিলচালক বা মজুরের মধ্যে শিক্ষার যা পার্থক্য এ ক্ষেত্রেও পার্থক্য প্রায় সেইরূপ। এ পার্থক্য মূলনীতিগত নয় এবং ইহা লইয়া এ পর্যায়ে আলোচনারও প্রয়োজন নাই।
যে চারিটি বৈশিষ্ট্য একত্র মিলিত হইয়া আদর্শ চরিত্র গঠন করিতে পারে প্রথমে তাহারই উল্লেখ করা হইতেছে : উৎসাহ-উদ্দীপনা (উদ্যম), সাহস, অনুভূতিশীলতা এবং বুদ্ধি। মানব চরিত্রে গুণাবলির পক্ষে এই তালিকাই যে সম্পূর্ণ, তাহা বলি না কিন্তু ইহার মধ্যে অনেকগুলি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। অধিকন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে যথোপযুক্তভাবে দেহমনের যত্ন লইলে এইগুলি প্রায় সকলের মধ্যেই বিকশিত করা যায়। একে একে ইহাদের আলোচনা করা যাক।
.
উদ্যম : উদ্যমকে মানসিক বৈশিষ্ট্য না বলিয়া বরং দৈহিক বৈশিষ্ট্য বলা যায়। যেখানেই ভালো স্বাস্থ্য সেখানেই উদ্যম বিদ্যমান; বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইহা কমিতে থাকে এবং বার্ধক্যে শেষ হইয়া যায়। স্বাস্থ্যবান শিশুদের বেলায় তাহাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগেই ইহা পূর্ণমাত্রায় বিকাশ লাভ করে, শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে ক্রমে কমিতে থাকে। দেহের সবল, সুস্থভাবে বাঁচিয়া থাকার আনন্দ বাড়াইয়া দেয়, কষ্টবোধ হ্রাস করে। উদ্যমশীল শিশু যাহা দেখে সবকিছুতে কৌতূহল বোধ করে এবং নানা জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হয়। বহির্জগতে নানা বিষয়ের সংস্পর্শে আসিয়াই শিশু তাহার বিচারবুদ্ধির পরিচয় দেয়। মানুষ তাহার চতুর্দিকে যাহা কিছু দেখে বা শেখে তাহাতে যদি কোনো প্রকার আনন্দ না পায়, তবে স্বভাবতই সে (নিজের ভিতরেই ইহার সন্ধানে ডুবিয়া যায়) আত্মস্থ হইয়া পড়ে। ইহা দুভার্গের কারণ হইয়া পড়ে কেননা বহির্জগতের আনন্দ উপভোগে অসমর্থ, নিরানন্দ লোকের জীবনে প্রথমে আসে অবসাদ; ইহাই ক্রমে বিষণ্ণতা ও মানসিক রোগে পরিণত হয়। অতি অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মানসিক বিষণ্ণতা জীবনকে অকেজো করিয়া ফেলে। উদ্যম বহির্জগতের প্রতি মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে; ইহা কাজের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। উদ্যম মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে; ইহা ঈষার বড় প্রতিষেধক। মানুষের মনঃকষ্টের একটি বড় কারণ পরশ্রীকারতা। এই পরশ্রীকাতরতা উদ্যমশীল লোকের আনন্দময় জীবনে ঘেঁসিতে পারে না। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেহের উদ্যমের সঙ্গে অনেক দোষ যুক্ত থাকিতে পারে; উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি সরল সুস্থ বাঘের কথা। আবার উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের অভাব থাকিলেও লোকের অনেক গুণ থাকিতে পারে। উদাহরণ দেওয়া যায়–নিউটন [Newton] এবং লক [Locke] উভয়েরই স্বাস্থ্য ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। এ দুজনেই ছিল খিটখিটে মেজাজসম্পন্ন এবং ঈর্ষাপরায়ণ। ইহারা স্বাস্থ্যবান হইলে হয়তো দোষ হইতে মুক্ত থাকিতে পারিতেন। নিউটন যদি স্বাস্থ্যবান হইতেন এবং জীবনের সাধারণ সুখ উপভোগ করিতে পারিতেন তবে হয়তো লিবিনিজের [Leibiniz] সঙ্গে তাহার যে বাকবিতণ্ডার ফলে ইংল্যাণ্ডের গণিতবিদ্যা একশত বৎসরের জন্য ধ্বংস হইয়াছিল তাহা সংগঠিতই হইত না। দৈহিক পূর্ণস্বাস্থ্যের কিছু কিছু দোষ থাকা সত্ত্বেও উদ্যমকে আমি মানুষের পক্ষে একান্ত কাম্য গুণ বলিয়া মনে করি।
.
সাহস : সাহসের কয়েকটি প্রকার আছে এবং সব কয়টিই জটিল। ভয়শূন্যতা এক জিনিস এবং ভয় দমন করিবার ক্ষমতা অন্য জিনিস। বাস্তব এবং যুক্তিসঙ্গত ভয় হইতে মুক্ত থাকা এক কথা, অবাস্তব বা অযৌক্তিক ভয় হইতে মুক্ত থাকা অন্য কথা। অবাস্তব ভয় না থাকা খুবই ভালো; ভয়কে দমন করার শক্তিও প্রশংসনীয়। কিন্তু ভয় যেখানে যুক্তিসঙ্গত সেখানেও যদি ভয়শূন্যতা থাকে তবে তাহা কিসের দ্যোতক, তাহার ফলাফলই বা কি হইতে পারে সে সম্বন্ধে তর্ক চলিতে পারে। যাহা হউক, আপাতত: এ তর্ক স্থগিত রাখিয়া সাহসের অন্য স্বরূপ সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক।
বেশিরভাগ লোকের ভাব-জীবনে [Emotional life] অবাস্তব ভীতি একটি প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে। অকারণ উৎপীড়নের আশঙ্কা, বিনা কারণে অমূলক উৎকৃষ্ঠা বোধ করা প্রভৃতি উৎকট মানসিক রোগের প্রকৃতি নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য উন্মুদ রোগীর চিকিৎসকের প্রয়োজন। এগুলি যাহাদের মধ্যে তীব্র আকারে প্রকাশ পায় তাহারা উন্মাদের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু মৃদু আকারে এরূপ ভাব অনেক সুস্থ ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যায়। কাহারও এরূপ বোধ হইতে পারে যে, তাহার চারিদিকে বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে; হঠাৎ কোনো কিছু ঘটিতে পারে; ইহাকেই বলা চলে উৎকণ্ঠা, কাহারও বা হয়তো কোনো কিছু ভয়ের ভাব বদ্ধমূল হইয়াছে, অথচ প্রকৃতই তাহাতে ভয়ের কিছু নাই, যেমন ইঁদুর বা মাকড়সা দেখিয়া ভয় পাওয়া। আগে মনে করা হইত যে, ভয় মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি অর্থাৎ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কতকগুলি প্রবৃত্তির মতো ভয়ও সে লাভ করে কিন্তু বর্তমান গবেষকগণের অধিকাংশই এখন ইহা মানেন না। বাহ্যত জন্মগত কয়েকটি ভয় আছে, যেমন উচ্চ শব্দ শুনিয়া ভয়; কিন্তু বেশিরভাগ ভয়ের উৎপত্তি হয় অভিজ্ঞতা হইতে আর না হয় অন্যের সংস্পর্শ হইতে। অন্ধকার দেখিয়া ভীত হওয়া সম্পূর্ণরূপে অন্যের কাছে পাওয়া। এরূপ মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, মেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্বভাব শত্রু সম্বন্ধে তাহাদের কোনো ভীতিবোধ থাকে না; ইহা তাহারা তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে লাভ করে। মানুষ যখন ইহাদিগকে হাতে করিয়া লালন-পালন করে তখন ইহাদের গোষ্ঠীর অন্যান্যদের মধ্যে যে ভয় স্বাভাবিক তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইহা অত্যন্ত সংক্রামক। শিশুরা তাহাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট হইতে ইহা পায়, এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠরা হয়তো জানিতেই পারিলেন না কখন কিভাবে তাহারা ভীতির ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। জননী বা ধাত্রীর ভীরুতা শিশু অতি শীঘ্র অনুকরণ করে। এতদিন পুরুষেরা মনে করিয়াছেন যে অবাস্তব ভয়ে ভীত থাকিলে স্ত্রীলোকের আকর্ষণ বাড়ে কেননা ইহার ফলে তাহারা প্রকৃত কোনো বিপদের সম্মুখিন না হইয়াও বিপন্ন মহিলাদের রক্ষক সাজিবার সুযোগ পাইতেন, কিন্তু ইহাদের পুত্রগণ তাহাদের জননীর নিকট হইতে ভয় অর্জন করিয়াছে। অথচ পুরুষগণ যদি স্ত্রীলোকদিগকে এভাবে অশ্রদ্ধা না করিত তবে তাহাদের সন্তানগণ ভীত হইয়া পড়িয়া উঠিত না। [শিক্ষার ভিতর দিয়া তাহাদের ভয় দূর করিয়া সাহসী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে হয়। স্ত্রীলোকদিগকে অধীন করিয়া রাখা অপরিসীম ক্ষতির কারণ হইয়াছে; সন্তানের মনে ভয়সঞ্চার ইহার কেবল একটি উদাহরণ মাত্র।
কি উপায়ে ভয় এবং উৎকণ্ঠা কামানো যায় এখন তাহার আলোচনা করিতেছি; পরে এ বিষয়ে আলোচনা হইবে। এখন একটি প্রশ্ন উঠে: ভয় চাপিয়া রাখিয়াই কি আমরা সন্তুষ্ট থাকিব, না ইহার কারণেই মূলোচ্ছেদ করিতে হইবে? ঐতিহ্য এইভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে যে, অভিজাত সম্প্রদায় কোনো প্রকার ভয় ভীত হইবে না; পরাধীন জাতির লোকজন, সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ এবং স্ত্রীলোকদিগের ভীরু হইয়া থাকিতে উৎসাহিত করা হইয়াছে। বাহিরের আচরণ দ্বারা এর সাহসের প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে–সাহসী ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পালাইবে না; পুরুষোচিত খেলাধুলায় সে পারদর্শী হইবে; অগ্নিকাণ্ড, জাহাজডুবি, ভূমিকম্প প্রভৃতির সময় সে আত্মসংযম হারাইয়া ফেলিবে না। সাহসের পরিচয় দিতে গিয়া যখন যাহা করা দরকার সে শুধু তাহাই করিবে না, ভয়ের কোনোরূপ চিহ্ন যেন যাহাতে তাহার আচরণে বা দেহে প্রকাশ না পায় যেমন বিবর্ণ হইয়া যাওয়া, কাপিতে থাকা, ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলা প্রভৃতি–তাহাই করিতে হইবে। এ সমস্ত খুবই প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান; পৃথিবীর সকল জাতির, সকল শ্রেণির পুরুষ ও নারী সকলের মধ্যেই সাহসের উদ্বোধন ঘটুক ইহাই আমি দেখিতে চাই। কিন্তু যখন ভয় দমন করিয়া বা চাপিয়া রাখিয়া সাহসের ভাব দেখানো হয় তখন দমন করার দরুন কুফলের হাত এড়ানো যায় না। লজ্জা ও অপমান সর্বদা সাহস উৎপাদনের প্রধান উপায় আছে; কার্যত কিন্তু ইহা দুইটি ভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব মাত্র–ভয় এবং ভয়ে ভীত হইলে অন্যের নিকট হইতে লজ্জা পাওয়ার ভয়; এই দুই ভয়ের দ্বন্দ্বে সাধারণের নিকট অপমানিত হওয়ার ভয়ই প্রবল হয়। এবং অপমানের হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে সাহস প্রদর্শন করে। বাল্যকালে আমাকে শিখানো হইত যখন তোমাকে কোনো কিছু ভয় দেখায় তখন ছাড়া অন্য সব সময় সত্য কথা বলিবে। সময় সময় যে সত্যকথার ব্যতিক্রম করা উচিত তাহা মানি না! ভয়কে জয় করিতে হইবে, শুধু কাজে নয়, চিন্তাতেও। কেবল সজ্ঞান চিন্তাতে নয়, নিজ্ঞান [Unconscious] চিন্তাতেও। [ভয়ের সম্মুখিন হইয়াও অনেক সময় মানুষ লোকলজ্জার ভয়ে সাহসের পরিচয় দেয়। এক্ষেত্রে লোকভয় তাহার প্রাথমিক ভয়কে জয় করিয়াছে; সাহসীর মতো আচরণের মধ্যে এই জয়ের অভিব্যক্তি দেখা দেয়। অভিজাতের রীতি অনুযায়ী ভয়কে বাহ্যত জয় করা হইল বটে, কিন্তু আসল ভাবটির মনের গহনে প্রবেশ এমন নূতন আকারে আত্মপ্রকাশ করে যে, সেটি যে ভয় হইতেই সঞ্জাত তাহা বুঝিবার উপায় থাকে না। কামানের গোলার ভীতির কথা বলিতেছি না; সেক্ষেত্রে ভয় সুস্পষ্ট। প্রতিপত্তিশালী জাতিসমূহ যে অত্যাচার এবং নিষ্ঠুরতার সাহায্যে তাহাদের প্রাধান্য বজায় রাখে–আমি তাহার কথাই চিন্তা করিতেছি। কিছুদিন আগে একজন ব্রিটিশ কর্মচারী সাংহাইতে একদল নিরস্ত্র চীনা ছাত্রকে সতর্ক করিয়া না দিয়া পিঠের দিক হইতে গুলি করিয়া মারিবার নির্দেশ দিয়াছিল। যেরূপ ভীত হইলে একজন সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করে, তখন সেই কর্মচারীটিও নিশ্চয়ই ঠিক তেমনি ভীত হইয়াছিল। কিন্তু যোদ্ধার অভিজাত সম্প্রদায়ের এতখানি বুদ্ধি নাই যে, এইরূপ ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক কারণ নির্ণয় করিতে পারে; তাহারা বরং ইহাকে দৃঢ় এবং উপযুক্ত মনোভাব প্রদর্শন বলিয়াই মনে করে।
মনস্তত্ত্ব ও শারীরবিজ্ঞানের দিক দিয়া ভয় এবং ক্রোধ একই জাতীয় প্রক্ষোভ [Emotion]; ক্রুদ্ধ ব্যক্তি উন্নত ধরনের সাহস প্রদর্শন করিতে পারে না। নিগ্রো বিদ্রোহ দমনে, কমিউনিস্ট বিপ্লব দমনে এবং আভিজাত্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল রকম আন্দোলন দমন করিতে যে নিষ্ঠুরতা দেখানো হইয়াছে তাহা কাপুরুষতা হইতেই উৎপন্ন। কাপুরুষতা স্কুল প্রকাশ যেরূপ ঘৃণার যোগ্য, এ আচরণ তেমনি নিন্দনীয়। আমি বিশ্বাস করি যে, সাধারণ স্ত্রী পুরুষকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া যায় যাহাতে তাহারা ভয়শূন্য হইয়া জীবনযাপন করিতে পারে। এ পর্যন্ত কেবল বড় বড় ঋষিরাই এরূপ জীবনযাপন করিয়াছেন; কিন্তু উপায় দেখাইয়া দিলে সাধারণ লোকেও নির্ভীকতা লাভ করিতে পারে।
যে সাহসের অর্থ কেবল দমন করা নয়, সেরূপ প্রকৃত সাহস অর্জন করিতে হইলে কতকগুলি বিষয় দরকার। প্রথমেই বলা যায় স্বাস্থ্য এবং উদ্যম। এ-দুইটি সম্পূর্ণ অপরিহার্য না হইলেও বিশেষ সহায়ক। বিপদজ্জনক অবস্থা হইতে উদ্ধার হওয়ার অভ্যাস এবং কৌশলও বিশেষ বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা যখন কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রদর্শিত সাহস নয়, সাধারণ সাহসের কথা বিবেচনা করি তখন আরও মৌলিক [fundamental] কতকগুলি গুণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ইহা সকল আত্মসম্মান এবং জীবনের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক [impersonal] দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ। প্রথমে আত্মসম্মানের কথা আলোচনা করি :–কতক লোক নিজেদের অন্তরের মধ্যে বাস করেন এবং নিজেদের বিচার বুদ্ধি এবং বিবেক দ্বারা পরিচালিত হন, আর কতক লোক তাহাদের প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবের দর্পণস্বরূপ, অপরের অনুভূতি এবং অভিমত দ্বারা পরিচালিত হন। এরূপ লোকের সত্যকারের সাহস থাকিতে পারে না। ইহারা প্রশংসার কাঙাল, প্রশংসা নষ্ট হইবে এই ভয়ে ইহারা ভীত। বিনয়, নম্রতা, শিক্ষা এক সময় বাঞ্চনীয় মনে করা হইত; ইহার কুফল ফলিয়াছে। নম্রতা অর্জন করিতে ইচ্ছুক লোকদিগকে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হইয়াছে কিন্তু তাহারা অপরের নিকট হইতে শ্রদ্ধা পাইবার বাসনা ত্যাগ করে নাই। ম হওয়া, আত্মসম্মান বিকাইয়া দেওয়া ইহারা লোকের বাহবা পাওয়ার উপায় বলিয়া মনে করিয়াছে। এইভাবে মিথ্যাচার এবং ভণ্ডামি প্রশ্রয় পাইয়াছে। শিশুদিগকে যুক্তি দিয়া বুঝাইয়াই আদেশ মানিয়া লইতে শিখানো হইত না; তাহাদের বয়স বেশি হইলে তাহারাও অন্যের নিকট হইতে এইরূপ নতি স্বীকার দাবি করিত; বলা হইত যে, যাহারা আদেশ মান্য করিতে জানে, কেবল তাহারাই আদেশ করিতেও জানি। আমি বলি কি আদেশ মান্য করার শিক্ষার প্রয়োজন নাই, কাহাকেও আদেশ দান করারও প্রয়োজন নাই। অবশ্য আমি একথা বলি না যে, সহযোগিতামূলক সমবায় পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত কোনো কাজে কোনো নেতা থাকিবে না; ফুটবল-দলের অধিনায়কের নির্দেশ যেমন সকলে স্বেচ্ছায় মানিয়া চলে, তেমনি একই উদ্দেশ্যসাধনের ব্যাপারে সফর নেতার আদেশ সানন্দে এবং স্বেচ্ছায় মানিয়া চলিবে। এই উদ্দেশ্য যেন আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য হয়, বাহির হইতে কেহ যেন আমাদের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দিয়া তাহা সাধন করিতে হুকুম না করে। কাহারও আদেশ করার দরকার নাই, কাহারও আদেশ পালন করারও প্রয়োজন নাই একথা বলিতে আমি ইহাই বুঝাইতে চাই।
সর্বশ্রেষ্ঠ সাহস প্রদর্শনের জন্য আরও একটি জিনিসের কথা বলা হইয়াছে; তাহা হইল জীবনের প্রতি নৈর্ব্যত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। যে ব্যক্তি অতিমাত্রায় আত্মসর্বস্ব, যাহার আশা, ভয় সমস্ত কিছুই কেবল নিজেকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হয়, সে প্রশান্তচিত্তে মৃত্যুবরণ করিতে পারে না; কেননা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাহার ভাব ও আশা-আকাঙ্ক্ষা জগতের পরিসমাপ্তি ঘটে। এখানেও আমরা আত্মদমনের একটা সহজ পন্থা প্রচলিত দেখি; সাধুব্যক্তিকে আত্মবর্জন করিতে হইবে, দেহের কষ্ট বরণ করিতে হইবে, স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত আনন্দ উপভোগ পরিত্যাগ করিতে হইবে। এইরূপ করা যায়, কিন্তু ইহার ফল হয় খারাপ। নিজের সুখ বর্জন করিয়া ত্যাগী সন্ন্যাসী ব্যক্তি অপরের পক্ষেও ইহা বর্জনীয় মনে করে। এইরূপ মনে করা সহজ। আত্মনিপীড়নকারী ব্যক্তি বুঝিতে পারে না কিন্তু সংসারের ভোগীদের প্রতি ঈষা তাহার মনের গভীরে ফল্পর স্রোতের মতো বহিত থাকে; তিনি মনে করেন শারীরিক দুঃখকষ্ট সহ্য করা সহনীয় কাজ, কাজেই ন্যায়সঙ্গতভাবেই ইহা অন্যের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া যায়। এইভাবে জীবনের মূল্য সম্বন্ধেই, এক সম্পূর্ণ ভুল এবং বিপরীত ধারণার সৃষ্টি হয়। যাহা ভালো তাহাকে মনে হয় মন্দ এবং যাহা মন্দ তাহাকেই মনে হয় ভালো। এইসব ক্ষতির মূল কারণ হইল স্বাভাবিক বাসনা ও প্রবৃত্তিগুলির বৃদ্ধি এবং বিকাশ না ঘটাইয়া নীতিমূলক আদর্শের সাহায্যে মহৎ জীবন গঠনের চেষ্টা। মানুষের স্বভাবে এমন কতকগুলি জিনিস আছে যাহা বিনা চেষ্টাতেই আমাদিগকে আমাদের সত্তার উর্ধ্বে লইয়া যাইতে পারে। ইহাদের প্রধান হইল প্রীতি, বিশেষ করিয়া জনক-জননীর বাৎসল্য। কোনো কোনো লোকের মধ্যে এই প্রীতি এমন ব্যাপক যে সমগ্র মানবজাতিকে তাঁহারা প্রীতি-পাশে আবদ্ধ করিতে পারেন। অন্য বিষয়টি হইল জ্ঞান। গ্যালিলিও যে বিশ্বের কল্যাণকামী ঋষি-প্রকৃতির লোক ছিলেন এমন অনুমান করিবার কোনো কারণ নাই, তথাপি জ্ঞানের সাধনায় তিনি যাহা সত্য বলিয়া স্থির বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাহার নজ্য জীবন দিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নাই। অপর বিষয় হইল শিল্প। প্রকৃতপক্ষে মানুষে নিজের দেহ ছাড়া বাহিরের জিনিসের দিকে যে পরিমাণ আকৃষ্ট হইবে ততই তাহার জীবনের প্রতি নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিও সেই পরিমাণে বাড়িবে। এইজন্য, শুনিতে স্বয়ং বিরোধী মনে হইলেও, ইহা সত্য যে, যে-ব্যক্তি বহির্জগতের নানা বিষয়ে দীপ্ত উৎসাহ দেখাইয়া থাকে সে যত সহজে জীবনের মায়া কাটাইতে পারে। একজন হতভাগ্য, সর্বদা অমূলক রোগের ভয়ে শঙ্কিত, মনোবিকারগ্রস্ত রোগী তত সহজে প্রাণের মায়া কাটাইতে পারে না। এমন মানুষের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়, যিনি নিজের সত্তাকে বিশ্বের একটি অংশ বলিয়া অনুভব করন–নিজেকে হেয় করিয়া নয়, নিজের জীবন ছাড়া অন্য কোনো জিনিসকে জীবনের চেয়ে মহত্তর বলিয়া মনে করিয়া।
প্রকৃতি মুক্ত এবং বুদ্ধি সক্রিয় না থাকিলে এরূপ ঘটিতে পারে না। এই দুইটির মিলনের ফলে দৃষ্টিভঙ্গির এমন উদারতা এবং ব্যাপকতা জন্মে যে, তাহা ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং সংযমী ঋষি উভয়েরই কাছে অজ্ঞাত; এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির নিকট ব্যক্তিগত মৃত্যু অকিঞ্চিৎকর বলিয়া মনে হয়। এই সাহস অস্থি-মূলক [positive] এবং প্রবৃত্তি সজ্ঞাত, নেতিমূলক [Negative] ও দমনমূলক নয়।
.
অনুভূতিশীলতা : এক হিসাবে অনুভূতিশীলতাকে সাহসের সংশোধন বলা যায়। যে-ব্যক্তি বিপদ সম্বন্ধে ধারণা বা অনুভব করিতে পারে না তাহার পক্ষে সাহসীর ন্যায় আচরণ করা সহজ; এইরূপ সাহস প্রায় মূর্খতার শামিল। অজ্ঞতা বা বিস্মৃতির ফলে যে কাজ অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে কখনোই সন্তোষজনক বলা যায় না। কোনো কাজের মূলে যথাসম্ভব সম্পূর্ণ জ্ঞান এবং তাহার সম্বন্ধে ধারণা বিদ্যমান থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিতে গেলে বুদ্ধির কথা ওঠে; আমি এখানে অনুভূতিশীলতাকে মনের ভাব বা প্রক্ষোভের পর্যায়ে ফেলিয়াছি। ইহার সহজ ব্যাখ্যা এইভাবে করা যায় : যখন অনেকগুলি ঘটনা কোনো ব্যক্তির মনে নানা প্রক্ষোভের [Emotions] সৃষ্টি করিয়া নানা ভাব জাগাইয়া তোলে তখন বলা যায় যে, সে অনুভূতিশীল হইয়া উঠিয়াছে; ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করিলে এই মানসিক অবস্থা কল্যাণকর না-ও হইতে পারে! ভালো হইতে হইলে মনের উপর এই অনুভূতির প্রতিক্রিয়া যথাযথ হওয়া দরকার; শুধু প্রতিক্রিয়ার তীব্রতার প্রয়োজন নাই। বাহিরের সুখদুঃখ আনন্দ-বেদনাময় ঘটনায় মনে অনুরূপ অনুভূতি জাগরিত হউক ইহাই আমার কাম্য। আনন্দময় ঘটনা মনে আনন্দের অনুভূতি জাগাইবে, দুঃখময় ঘটনা মনে বেদনার অনুভূতি জাগাইবে ইহাকেই বলা চলে যথাযথ প্রতিক্রিয়া।
যথার্থ বিষয় কি তাহাই বুঝাইতে চেষ্টা করিব। শিশুর বয়স যখন পাঁচ মাসের মতো তখন খাদ্য এবং কোমল উষ্ণতায় সে যে আনন্দ অনুভব করে তাহা ছাড়াইয়া আরও একটি নূতন অনুভূতি। এই অনুভূতি খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রত্যেক শিশুই প্রশংসা ভালোবাসে, দোষারোপ অপছন্দ করে। সাধারণত লোকে ভাল বলুক এই ইচ্ছা মানুষের সারা জীবন ধরিয়া প্রবল থাকে। অপরের প্রশংসা লাভ করার বাসনা মানুষকে মনোজ্ঞ আচরণ করিতে উৎসাহিত করে। তাহার লোভের প্রবৃত্তি দমন রাখিতে সাহায্য করে। কোন্ কোন্ গুণ প্রকৃতই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য সে সম্বন্ধে আমরা যদি কিছু বিচক্ষণতার পরিচয় দিতাম, তবে ফল অনেক ভালো হইত। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের হত্যাকারীকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বলিয়া প্রশংসা করা হইবে, ততদিন শিশুর প্রশংসালাভের বাসনাকেই ভালো জীবন গঠনের একমাত্র উপাদান হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে না। দিগ্বিজয়ী বীরের প্রশংসা শুনিয়া বালক নিজেও প্রশংসিত ব্যক্তির গুণাবলি অনুকরণ করিতে চেষ্টা করে; যাহাকে সে বীর বলিয়া অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাহার গুণগুলি তাহার কাছে সহনীয় মনে হয়। এইভাবে প্রকারান্তরে সে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার নিষ্ঠুরতাকে গুণ বলিয়া বরণ করিয়া নেয় এবং নিজের জীবনেও অনুকরণ করে।
অনুভূতিশীলতা বিকাশের দ্বিতীয় সোপান হইল সমবেদনা। এক রকম সমবেদনা আছে যাহা দৈহিক–যেমন ছোট শিশু তাহার ভাই বা বোনকে কাঁদিতে দেখিলে নিজেও কাঁদিতে শুরু করে। এই সূত্র অবলম্বন করিয়া সমবেদনা বিকাশের সুযোগ কাজে লাগানো যায়। স্বাভাবিক সহানুভূতি বোধকে দুইদিকে বাড়ানো দরকার প্রথম, বিপন্ন ব্যক্তি বিশেষ স্নেহের পাত্র না হইলেও তাহার দুঃখে সহানুভূতি বোধ করা; দ্বিতীয়, যখন বিপন্ন ব্যক্তি চোখের সামনে নেই, তখন তাহাদের দুঃখদুর্দশার কথা শুনিয়াই সমবেদনা বোধ করা। এই দ্বিতীয় উপায়ে সমবেদনা বোধ করা প্রধানত বুদ্ধির উপর নির্ভর করে। ভালো উপন্যাসে দুঃখ-দুর্দশার জীবন্ত বর্ণনা পাঠ করিয়া পাঠক সমবেদনা বোধ করিতে পারে; আবার ইহা (বুদ্ধি) এমন উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে যাহার ফলে পরিসংখ্যান [Statistics] দেখিয়াই কেহ সহানুভূতিতে বিগলিত হইতে পারেন। নিজের প্রিয়জনের কর্কটরোগ [Cancer] হইলে প্রায় সকলেই সমবেদনায় উদ্বেল হইয়া ওঠেন। বেশিরভাগ লোক হাসপাতালে অপরিচিত রোগীর যন্ত্রণা দেখিয়া বিচলিত হয়। অথচ যখন তাহারা পড়ে যে, কর্কটরোগে মৃত্যুর হার বাড়িয়াছে তখন তাহারা তাহাদের নিজেদের ওই রোগ হইতে পারে; কিংবা তাহাদের প্রিয়জনের হইতে পারে এই আশংকায় সাময়িকভাবে বিচলিত হয় মাত্র। যুদ্ধ সম্বন্ধে এ কথা খাটে। যাহাদের ছেলে বা ভাই যুদ্ধে বিকলাঙ্গ হয় তাহারা যুদ্ধকে ভয়ঙ্কর মনে করে; আরও লক্ষ লোক যে বিকলাঙ্গ হইতে পারে তাহা ভাবিয়া তাহারা যুদ্ধকে লক্ষ গুণ ভয়ঙ্কর মনে করে না। যিনি ব্যক্তিগত আচরণে সহৃদয়তার পরিচয় দেন তিনিও যুদ্ধে উত্তেজনা দান ব্যাপার হইতে কিংবা অনুন্নত দেশে শিশুদের উপর অত্যাচার চালনা হইতে অর্থোপার্জন করেন। এই সকল পরিচিত ঘটনার কারণ হইল এই যে, বস্তু-নিরপেক্ষ [Abstract] কোনো তথ্য বেশিরভাগ লোকের মনে সহানুভূতি জাগাইতে পারে না। জাগাইতে পারিলে বর্তমান জগতের অনেক অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব হইত। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদিগকে দূরবর্তী দেশের মানবগোষ্ঠীর উপরও প্রভাব বিস্তার করিতে সক্ষম করিয়াছে কিন্তু তাহাদের জন্য সহানুভূতি বোধ বৃদ্ধি করে নাই। মনে করুন, আপনি সাংহাইতে তুলা উৎপাদন ব্যবসাতে লিপ্ত কোনো কোম্পানির অংশীদার। আপনি হয়তো কর্মব্যস্ত লোক; ব্যবসায়ী উপদেষ্টার পরামর্শক্রমেই আপনি টাকা খাটাইতেছেন; সাংহাই বা তুলা ব্যবসা কোনওটি সম্বন্ধেই আপনার কৌতূহল নাই, আপনি কেবল চান লাভের টাকা। তবু নিরীহ লোকেদের হত্যার ব্যাপারে আপনি অংশ গ্রহণ করিতেছেন এবং ছোট ছোট বালক-বালিকাকে অস্বাভাবিক ও বিপজ্জনক কাজে না খাটাইলে আপনার লাভের অঙ্কে শূন্য পড়িবে। আপনার মনে কোনও ভাবান্তর হয় না, কেননা আপনি সেখানকার বালক-বালিকাদিগকে দেখেন নাই এবং শুধু তথ্য আপনাকে বিচলিত করিতে পারে না। বৃহদাকারের যন্ত্রশিল্প যে এত নির্মম কেন এবং পরাধীন জাতির অধিবাসীদের উপর অত্যাচার যে বিজয়ী জাতির লোকে সহ্য করে কেন তাহার মূল কারণ ইহাই। যদি এমন শিক্ষা দেওয়া যায় যাহার সাহয্যে বস্তু নিরপেক্ষ তথ্য দ্বারাও অনুভূতি জাগানো সম্ভব, তাহা হইলে সেই শিক্ষাই এরূপ অবিচার ও অত্যাচারের বিলোপ ঘটাইবে।
জ্ঞানোত্থিত অনুভূতি অর্থাৎ জ্ঞান হইতে যে অনুভূতি উদ্ভত হয় সেরূপ ভাবাবেগও প্রয়োজন। ইহাকে অন্য কথায় পর্যবেক্ষণের অভ্যাসও বলা যায়। বুদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে ইহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। সৌন্দর্যবোধের সাথে কতকগুলি সমস্যা জড়িত আছে; সেগুলি বর্তমানে আলোচনা করিতে চাই না। কাজেই উন্নত চরিত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি সম্বন্ধে আলোচনা করিব।
.
বুদ্ধি : প্রচলিত নীতি-জ্ঞানের একটি দোষ এই যে ইহা বুদ্ধির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে নাই। গ্রিকগণ ভুল করেন নাই কিন্তু খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ লোকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করিয়া দিয়াছেন যে, কতকগুলি গুণ ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের মূল্য নাই। গুণ বলিতে কি বোঝায়? কতকগুলি কাজকে তাহারা নিজেদের খেয়াল খুশিতো পাপ আখ্যা দিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। এ কাজগুলি হইতে বিরত থাকাই তাহাদের গুণের পরিচায়ক, যতদিন এই ধারণা প্রচলিত থাকিবে ততদিন এই তথাকথিত গুণ অপেক্ষা যে বুদ্ধি অনেক বেশি কাজে লাগে তাহা লোককে বুঝানো যাইবে না। বুদ্ধি বলিতে অর্জিত জ্ঞান এবং জ্ঞান গ্রহণের ক্ষমতা এ দুইটিই বুঝাইতেছি। বস্তুত এই দুইটি পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। মূর্খ বয়স্ক ব্যক্তিগণ জ্ঞান গ্রহণ করিতে অক্ষম; উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্বাস্থ্যনীতি বা খাদ্য সম্বন্ধে বিজ্ঞান যাহা বলে তাহা তাহারা কিছুতেই বিশ্বাস করিবে না। একজন লোক যত বেশি জানে, তাহাকে তত বেশি শিখানো সহজ, অবশ্য সে যদি কোনো প্রকার কুশিক্ষার ফলে মানসিক সংকীর্ণতা বা গোড়ামিতে অভ্যস্ত না হইয়া উঠিয়া থাকে। অজ্ঞ লোকেরা এমন অপরিবর্তনশীল, আড়ষ্ট মানসিক অভ্যাস গঠন করিয়া থাকে যে, তাহারা কিছুতেই তাহা বদলাইতে পারে না। যেখানে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ না করিয়া সহজে কিছু বিশ্বাস করা উচিত নয়, সেখানে অজ্ঞ ব্যক্তিরা অতি সহজেই বিশ্বাস করে; শুধু তাহাই নয়, যেখানে জ্ঞান গ্রহণ করা উচিত সেখানে তাহারা হয় অবিশ্বাসী। বুদ্ধি কথাটির যথাযথ অর্থ হইল অর্জিত জ্ঞান নয়, জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা বা মানসিক শক্তি। পিয়ানোবাদক বা দৈহিক কসরত প্রদর্শনকারী যেমন পুনঃ পুনঃ অনুশীলনের ফলে কৌশল আয়ত্ত করেন, জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা বা শক্তিও তেমনি চেষ্টা করিয়া আয়ত্ত করিতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন না করিয়াই অবশ্য শিক্ষাদান করা সম্ভবপর; শুধু সম্ভবপর নয়, এরূপ করা সহজ এবং প্রায়শই করা হইয়া থাকে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে, জ্ঞান দান ব্যতিরেকে বুদ্ধির অনুশীলন সম্ভব। বুদ্ধি ব্যতীত আমাদের বর্তমান জটিল জগৎ চলিতে পারে না, উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া তো অসম্ভব। এজন্য বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশকে আমি শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলিয়া মনে করি। মনে হইতে পারে, ইহা তো অতি সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা সেরূপ নয়। সত্য বিশ্বাস বলিয়া যাহা প্রচলিত সেগুলি ছাত্রদের মনে। অনুপ্রবিষ্ট করাইয়া দিতে গিয়া শিক্ষাবিদগণ অনেক সময় বুদ্ধির সম্যক শিক্ষণের প্রতি উদাসীন হইয়া পড়েন। এই বিষয়টি স্পষ্ট করিয়া বুঝাইতে গেলে বুদ্ধি কথাটি ভালভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার, কেননা ইহা দ্বারাই জানা যাইবে বুদ্ধির অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য কি কি মানসিক অভ্যাসের প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে অর্জিত জ্ঞানের কথা বাদ দিয়া জ্ঞান অর্জনের শক্তি সম্বন্ধেই আলোচনা করিব।
বুদ্ধিময় [Intellectual] জীবনের ভিত্তি হইল কৌতূহল প্রবৃত্তি। ইহা ইতর প্রাণীর মধ্যে প্রাথমিক আকারে দেখা যায়। বুদ্ধির জন্য চাই সদা-জাগ্রত কৌতূহল। কিন্তু ইহাও কোনো বিশেষ ধরনের হওয়া দরকার। পাড়াগাঁয়ে প্রতিবেশিরা সন্ধ্যার অন্ধকারে, পরদার আড়ালে উঁকিঝুঁকি মারে যে কৌতূহলের বশে, তাহার বিশেষ কোনো মূল্য নাই; খোশগল্প করার যে উৎসাহ, তাহাও জ্ঞানার্জনের বাসনা হইতে নয়; ইহা ঈর্ষা হইতে সঞ্জাত; কেহ অপরের গোপন গুণগুলির আলোচনা করিয়া খোশগল্পের আসর জমায় না, অপরের গুপ্ত দোষ সম্বন্ধে সরস রসালাপই হইল উপভোগের বিষয়। কাজেই অধিকাংশ খোশগল্পের মূলেই সত্য নাই, কিন্তু এগুলি সত্য কি না তাহা যাচাই করিয়া দেখার চেষ্টা হয় না। ধর্মের সান্ত্বনার মতো আমাদের প্রতিবেশির দোষগুলি আমাদের কাছে এত মুখরোচক যে, সে সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখার কোনো প্রয়োজন অনুভব করি না। পক্ষান্তরে প্রকৃত কৌতূহল জ্ঞানলাভের বাসনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। একটি বিড়াল নূতন অপরিচিত কোনো কক্ষে ছাড়িয়া দিলে ইহার আচরণে কৌতূহলের প্রকাশ দেখা যাইবে; ইহা তখন কক্ষের প্রতি কোনো এবং প্রতিটি আসবাব শুকিয়া দেখিবে। শিশুদের মধ্যেও ইহা দেখা যাইবে; কোনো বদ্ধ ড্রয়ার বা কাবার্ড তাহাদিগকে দেখাইবার জন্য খুলিলে তাহারা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত দেখিতে ঝুঁকিয়া পড়িবে। জীবজন্তুর, কলকবজা, বজ্রবিদ্যুৎ, বিভিন্ন রকমের হাতের কাজ শিশুদের কৌতূহল জাগ্রত করে। নূতন জিনিস জানিবার আগ্রহ তাহাদের এত বেশি যে, অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তিকেই লজ্জায় পড়িতে হয়। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃত্তি ক্রমে কমিয়া আসে; অবশেষে এমন হয় যে, অজ্ঞাত বা অপরিচিত কোনো জিনিস মাত্রই বিরক্তি উৎপাদন করে। এই অবস্থায় পৌঁছিলে লোকে বলে, দেশটা জাহান্নামে যাইতেছে, আর বলে আমাদের ছোট বয়সে যেমন ছিল দিনকাল আর এখন তেমন নেই। সে জিনিসটি অতীতে যাহা ছিল, এখন তাহা নাই, তাহা হইল বক্তার কৌতূহল। কৌতূহলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, আমরা ধরিয়া লইতে পারি যে, সক্রিয় বুদ্ধিরও মৃত্যু ঘটিয়াছে।
বাল্যকালের পর কৌতূহলের তীব্রতা ও পরিমাণ কমিয়া আসে বটে কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত ইহার উৎকর্ষ বাড়িতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে কৌতূহল অপেক্ষা সাধারণ বিষয় সম্বন্ধে কৌতূহল উচ্চতরস্তরে বুদ্ধির পরিচয় দেয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, কৌতূহল উদ্রেককারী বিষয়বস্তু যত বেশি ব্যাপক হইবে ততই তাহা হইবে উচ্চতর বুদ্ধির পরিচায়ক। (তবে সকল ক্ষেত্রে এই সূত্রটিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করিয়া বুদ্ধির স্তর নির্ণয় করা হইবে না;) যাহার সঙ্গে বক্তিগত সুবিধা, যেমন খাবার সংগ্রহ করা, জড়িত নাই এমন বিষয়ের প্রতি কৌতূহল এই প্রবৃত্তিটির উত্তর্ষের নিদর্শন। যে-বিড়ালটি নূতন কক্ষের কোণে কোণে ঘ্রাণ লইয়া বেড়ায় তাহাকে নিছক বৈজ্ঞানিক গবেষক মনে করিলে চলিবে না; সে হয়তো দুরের সন্ধান পাওয়া যাইবে কি না তাহারই খোঁজ করিতেছে, স্বার্থসম্বন্ধবিহীন হইলেই যে কৌতূহল সর্বশ্রেষ্ঠ হইল তাহা বলা ঠিক হইবে না, বরং যখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ সাক্ষাৎ বা সুস্পষ্ট নয় কিন্তু বুদ্ধিপ্রয়োগ করায় অধিকার করা যায় তখন সে কৌতূহলকে অতি উচ্চস্তরের বলা যায়। যাহা হউক, এ বিষয়ে নির্ধারণ করা এখন আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
কৌতূহল ফলপ্রদ হইতে হইলে জ্ঞান অর্জনের কতকগুলি কৌশল ইহার সহিত সংযুক্ত হওয়া উচিত। পর্যবেক্ষণের অভ্যাস, জ্ঞানের সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে বিশ্বাস, ধৈর্য এবং পরিশ্রম একান্ত আবশ্যক। যদি আসল জিনিস অর্থাৎ কৌতূহল থাকে এবং তাহার সঙ্গে থাকে উপযুক্ত জ্ঞানাত্মক শিক্ষা তবে এ অভ্যাসগুলি আপনা আপনি বিকাশলাভ করিবে। কিন্তু সারা দিনমান আমরা যে কাজকর্মে লিপ্ত থাকি জ্ঞানাত্মক কাজ তাহার একটি অংশ মাত্র এবং নানা প্রবৃত্তির সঙ্গে কৌতূহলের অবিরত সংঘর্ষ হইতেছে; সেজন্য বুদ্ধিকে সজাগ রাখিয়া ঠিক পথে চালিত করার জন্য কতকগুলি জ্ঞানমূলক গুণের প্রয়োজন, যেমন ভোলা-মন সবকিছুকেই নিরপেক্ষভাবে যুক্তি দ্বারা যাচাই করিয়া দেখিবার অভ্যাস। আমাদের অভ্যাস এবং মনোবাসনা নূতন সত্যকে গ্রহণ করিতে স্বভাবতই নারাজ হয়। যাহা অনেক বছর ধরিয়া আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছি যাহা আমাদের আত্মসম্মান বা অন্য প্রধান প্রবৃত্তিগুলির পরিতৃপ্তি সাধন করিয়া আসিতেছে তাহা অবিশ্বাস করা কঠিন সন্দেহ নাই। কাজেই খোলা সতেজ মন গঠন করা শিক্ষার একটি কাম্য গুণ হওয়া উচিত।
বুদ্ধির সততা এবং দৈহিক শৌর্য প্রদর্শনের জন্য সাহসের একান্ত প্রয়োজন। এই বাস্তব জগতের যতখানি আমরা জানি বলিয়া মনে করি প্রকৃতপক্ষে জানি তাহার চেয়ে অনেক কম, জীবনের প্রথম দিন হইতে আমরা নানারূপ বাস্তব অবাস্তব সিদ্ধান্ত এবং অনুমান প্রয়োগ করিতে থাকি এবং প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে আমাদের মানসিক অভ্যাসগুলিকে তাল পাকাইয়া ফেলি। নানারকম বুদ্ধি পরিচালিত প্রতিষ্ঠান, যেমন খ্রিষ্টধর্ম, সাম্যবাদ, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি অনাথ আশ্রমের মতো সকলকে দাসত্বের বিনিময়ে নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। কোনো নীতিকে আশ্রয় করিলে জীবন নিরাপদ এবং আরামদায়ক হইতে পারে; কিন্তু স্বাধীনমনা ব্যক্তি যিনি দলে বা গোষ্ঠীতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মিশাইয়া দেন নাই, এরূপ আরামের জীবন লাভ করিতে পারেন না; বাহিরে যখন শীতের প্রবল ঝটিকা গর্জন করিয়া ফেলে কোনো একটি নীতিই কেবল মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দান করিতে পারে।
এই প্রসঙ্গে একটি কঠিন প্রশ্ন ওঠে; ভালো জীবনকে এইরূপে নীতি বা দল হইতে কতখানি মুক্ত করা উচিত আমি দলপ্রবৃত্তি বা যূথপ্রবৃত্তি [Hard instinct] কথাটি প্রয়োগ করিতে ইতস্তত করিতেছি; কেননা ইহার সত্যতা সম্বন্ধে বিরুদ্ধে অভিমত আসে কিন্তু যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হউক, এই প্রবৃত্তির স্বরূপ যাহা বর্ণনা করা হইয়াছে তাহার সহিত সকলেই পরিচিত। যে দলের সহিত আমরা সহযোগিতা করিতে চাই, তাহার সঙ্গে মিলিত হইতে আমরা পছন্দ করি–যেমন আমাদের পরিবার-পরিজন, আমাদের প্রতিবেশি, আমাদের সহকর্মী, আমাদের রাজনৈতিক দল কিংবা আমাদের জাতি। এরূপ মিলনের বাসনা স্বাভাবিক, কেননা সহযাগিতা ভিন্ন আমরা জীবনের কোনো আনন্দই উপভোগ করিতে পারি না। অধিকন্তু প্রক্ষোভ [Emotion] বা মানসিক ভাবাবেগ ছোঁয়াচে, বিশেষ করিয়া অনেক লোক একত্র হইয়া যখন ইহা অনুভব করে। একটি উত্তেজনাপূর্ণ জনসভায় উপস্থিত থাকিয়া খুব কম লোকই উত্তেজিত না হইয়া থাকিতে পারে। তাহারা যদি বিরুদ্ধ দলীয় হয়, তাহাদের বিরোধের ভাব প্রবল হইয়া ওঠে।
বেশিরভাগ লোকের পক্ষে এরূপ বিরোধিতা কেবল তখনই সম্ভবপর যখন তাহারা বুঝিতে পারে যে, অন্যত্র ভিন্ন জনতার মধ্যেও তাহারা তাহাদের কাজের জন্য প্রশংসা লাভ করিবে। এই জন্যই ঋষিদের মিলন [Communion of Saints] অত্যাচারিতদের মনে সান্ত্বনা দিতে পারিয়াছে। আমরা কি জনতার সঙ্গে সহযোগিতার বাসনা মানিয়া লইব, না আমাদের শিক্ষা ইহা শিথিল করিতে চেষ্টা করিবে? ইহার দুই পক্ষেই যুক্তি আছে; কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে অভিমত না দিয়া ইহার যথার্থ উত্তর হইবে দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ নির্ণয়ে, কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ অনুকূলে যে অভিমত তাহার মধ্যে নয়।
আমার নিজের মনে হয় সকলেরই অন্যকে খুশি করার ও অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করার বাসনা প্রবল এবং স্বাভাবিক কিন্তু এমন হওয়া চাই যেন কোনো বিশেষ জরুরি ক্ষেত্রে অন্য বাসনা দ্বারা ইহাকে জয় করা যায়। অনুভূতিশীলতা আলোচনার সময় আমরা অন্যকে খুশি করার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। ইহা না থাকিতে দিলে আমরা সকলেই হইতাম অসভ্য, বর্বর এবং পরিবার হইতে উপরের দিকে কোনো সামাজিক দল গঠনই সম্ভবপর হইত না। শিশুরা যদি তাহাদের পিতামাতার প্রশংসা কামনা না করিত তবে তাহাদিগকে শিক্ষাদান করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হইত। প্রক্ষোভ যে একজন হইতে অন্য জনের মধ্যে সংক্রামিত হয় তাহারও উপকারিতা আছে, বিশেষ করিয়া ইহা যখন বিজ্ঞ লোক হইতে অজ্ঞ লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু ভয় বা রাগ যদি ব্যাপকভাবে বহু লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তাহার ফল হয় ঠিক বিপরীত। কাজেই দেখা যায় প্রক্ষোভ সংক্রামণের অর্থাৎ এক ব্যক্তি হইতে অন্যের মধ্যে প্রক্ষোভ বা ভাব সঞ্চারের প্রশ্নটি কোনমতেই সহজ নয়। যেখানে শুধু বুদ্ধিগত ব্যাপার সেখানেও বিষয়টি সুস্পষ্ট নহে। বড় বড় আবিষ্কারকদিগকে তাঁহাদের মননশক্তি ও বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইয়াছিল। (উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কলম্বাসের কথা; স্থির বুদ্ধি ও দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে তিনি নূতন মহাদেশের সন্ধানে বাহির হইয়াছিলেন কিন্তু তাহার সঙ্গীদের নিজেদের বুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসের উপর বিশেষ আস্থা ছিল না। নিজেদের প্রাণের ভয়ে তাহারা কলম্বাসের অভিযানে বাধা সৃষ্টি করিতে উদ্যত হইয়াছিল।
সাধারণ মানুষ যদি অন্যের মতামত গ্রহণ না করিয়া সর্বদা কেবল নিজের অভিমতই প্রকাশ করিত তবে তাহার দরুন সে অজ্ঞতার পরিচয় দিত; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্তত তাহারা যে বৈজ্ঞানিকদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাহা কল্যাণকর হইয়াছে।
আমার মনে হয়, অতি অসাধারণ লোকের কথা বাদ দিলে সাধারণ মানুষের জীবনের দুইটি ক্ষেত্র আছে; একটি বড় ক্ষেত্র, সেখানে যূথপ্রবৃত্তি বা দলের সঙ্গে মিশিয়া, সহযোগিতা করিয়া দলের ভার গ্রহণ করিয়া চলিবার বাসনা প্রবল; অন্যটি ছোট ক্ষেত্র, যেখানে যূথপ্রবৃত্তি প্রবেশ করে না। এই ছোট ক্ষেত্রটি তাহার নিজের বিচারবুদ্ধির স্থান। যে ব্যক্তি আর অন্যান্য সকলে প্রশংসা না করা পর্যন্ত কোনো স্ত্রীলোককে প্রশংসা করিতে পারে না তাহার ব্যক্তিগত অভিমত সম্বন্ধে কেহই উচ্চ ধারণা পোষণ করে না। আমরা মনে করি পত্নী নির্বাচনের ব্যাপারে যে-কোনো লোকের পক্ষে সমাজের আর সকলে কি বলিবে সে চিন্তা না করিয়া নিজের স্বাধীন অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা চালিত হওয়া উচিত। তাহার প্রতিবেশিদের অভিমতের সঙ্গে তাহার মতের মিল হইবে কি না সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়; সে যদি কোনো মেয়েকে ভালোবাসে তবে তাহার পক্ষে নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও ভালোবাসার অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হওয়াই উচিত।
ইহার বিপরীত দিকেও অনুরূপ কথা বলা চলে। চাষি যে জমি চাষ করে তাহার গুণাগুণ ও উৎপাদন ক্ষমতা সম্বন্ধে সে নিজের অভিমত অনুযায়ী কাজ করিবে যদিও চাষ-আবাদের বৈজ্ঞানিক প্রণালী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ার পরেই সে নিজের অভিমত গঠন করিতে পারিবে। অর্থনীতিক প্রচলিত মুদ্রা সংক্রান্ত প্রশ্নে নিজের স্বাধীন অভিমত গঠন করিবেন, কিন্তু সাধারণ লোকের পক্ষে ওইরূপ জটিল ব্যাপারের মধ্যে মাথা না ঘামাইয়া বিশেষজ্ঞের অভিমত মানিয়া চলাই কর্তব্য। যেখানেই বিশেষজ্ঞান, গবেষণা ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োজিত হয় সেখানেই অভিমতের স্বাধীনতা মানিয়া চলা উচিত। কিন্তু তাই বলিয়া বিশেষজ্ঞগণ অত্যুগ্র মতের কন্টকে নিজেদের আবৃত রাখিযা জনসাধারণকে দূরে সরাইয়া রাখিলে বিশেষ কোনো উপায় হইবে না। আমাদের বেশিরভাগ কাজই সহযোগিতামূলক হওয়া উচিত এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করিয়াই সহযোগিতা গড়িয়া তোলা। কর্তব্য। তবু যে-সব বিষয় আমাদের ভালো রকম আছে সে সম্বন্ধে নিজেদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতা থাকা চাই এবং প্রয়োজন হইলে অন্যের পক্ষে। অপ্রিয় হইলেও স্বাধীন অভিমত প্রকাশ করিবার সৎসাহস থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে এই সাধারণ নীতি প্রয়োগ করিতে হয়তো অসুবিধা হইতে পারে। কিন্তু আমরা যে-সব গুণের কথা আলোচনা করিতেছি তাহা যখন বেশিরভাগ লোকের মধ্যে দেখা যাইবে তখন ইহা প্রয়োগ করিতে এত বেশি কঠিন হইবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, এই রকম জগতে সাধু ব্যক্তির উপর অত্যাচার চলিবে না; প্রকৃত সৎলোকে আত্মাভিমানে গর্বিত হইয়া বিশ্বজন হইতে পৃথক থাকিবেন না; ভাবের আবেগ দ্বারা চালিত সৎস্বভাব সুখের কারণ হইয়া উঠিবে। তাঁহার প্রতিবেশিরা তাঁহাকে ঘৃণা করিবে না কারণ তাহারা তাহাকে ভয় করিবে না। অগ্রগামী ব্যক্তিগণ [Pioneers] অপরের ভয় উৎপাদন করেন বলিয়াই তাহাদের ঘৃণার পাত্র হইয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা সাহসী হইতে শিখিয়াছে তাহাদের মধ্যে এরূপ ভয় থাকিবে না। ভয়ে অভিভূত হইয়া লোকে কু ক্লাক্স ক্লান [Ku Klux Klan] কিংবা ফ্যাসিস্তি [Faseisti] দলে যোগদান করে। সাহসী লোকপূর্ণ জগতে এরূপ অত্যাচারী সংঘের অস্তিত্বই থাকিবে না, এবং সে যুগের সৎলোকেরা প্রবৃত্তিগুলিকে এ যুগের মতো এমনভাবে বাধাও দিব না। কেবল নির্ভীক লোকেরাই এরূপ সুখের জগৎ সৃষ্টি করিতে এবং চালু রাখিতে পারে; তবে যতই তাহারা এ কাজে সফল হইবে ততই তাহাদের সাহস প্রয়োগের প্রয়োজন কমিয়া আসিবে।
শিক্ষার ফলে যদি উদ্যম, সাহস, অনুভূতিশীলতা এবং বুদ্ধি নরনারীর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয় তবে এমন এক সমাজ গড়িয়া উঠিবে যেরূপ মানবগোষ্ঠী কোনোকালে ছিল না। খুব কম লোকই তখন অসুখি হইবে। বর্তমানে সুখি না হইবার প্রধান কারণ হইল : স্বাস্থ্যহীনতা, দারিদ্র্য এবং অসন্তোষজনক যৌনজীবন। এ সকলই তখন হইবে অত্যন্ত বিরল। প্রায় সকলেই তখন পূর্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী হইবে। এমনকি বার্ধক্যও বিলম্বের আসিবে। শিল্প-বিপ্লবের পর হইতেই দারিদ্রের একমাত্র কারণ হইয়াছে বহু লোকের সমবেত মূর্খতা। অনুভূতিশীল লোকের মধ্যে ইহা বিলোপ করার বাসনা জাগাইয়া তুলিবে, বুদ্ধি দেখাইবে কি উপায়ে ইহা সম্ভব এবং সাহস সে উপায় গ্রহণ করিতে উৎসাহিত করিবে। ভীরু ব্যক্তি অস্বাভাবিক কিছু করার পরিবর্তে বরং দুঃখদুর্দশার মধ্যেই থাকিতে পছন্দ করিবে। বর্তমানে অধিকাংশ লোকের যৌনজীবন কমবেশি রকমের অসন্তোষজনক। ইহার জন্য অংশত দায়ী কুশিক্ষা, অংশত দায়ী ভাব্যতার বাঁধাধরা সংস্কার এবং কর্তৃপক্ষের অত্যাচার। অবাস্তব যৌনভীতি হইতে মুক্ত এক প্রজাতি [Generation] স্ত্রীলোক এই অবস্থার অবসান ঘটাইবে। ভয় স্ত্রীলোকের পক্ষে গুণ বলিয়া ধরা হইয়াছে এবং চেষ্টা করিয়া তাহাদিগকে দেহে মনে ভীরু করিয়া গড়িয়া তোলা হইয়াছে। যে-সব স্ত্রীলোকের প্রেম স্বাভাবিকভাবে আত্মপ্রকাশের পথ পায় না, তাহারা তাহাদের স্বামীদের নিষ্ঠুরতা ও ভণ্ডামিতে উৎসাহ দেয় এবং তাহাদের সন্তান-সন্ততির প্রবৃত্তিগুলি বিকৃত করিয়া তোলে। একজনই নির্ভীক স্ত্রীলোক নির্ভীক, সরল, উদার স্নেহশীল এবং স্বাধীন সন্তানের জন্ম দিয়া বিশ্বের রূপই বদলাইয়া দিতে পারে। আমরা অলস, ভীরু, হৃদয়হীন এবং মূর্খ বলিয়া যে-সব নিষ্ঠুরতা এবং দুঃখ সহ্য করি, তাহাদের অন্তরের অনুরাগ ও উদ্যম সেগুলি নির্মূল করিয়া দূর করিয়া দিবে। শিক্ষা হইতে আমরা এই দোষগুলি পাই, আবার একমাত্র শিক্ষাই ইহার বিপরীত গুণগুলির বিকাশ ঘটাইতে পারে। শিক্ষাই নূতন জগতের চাবিকাঠি।
সাধারণ নীতির আলোচনা ছাড়িয়া দিয়া যে উপায়ে আমাদের আদর্শগুলি বাস্তব রূপ গ্রহণ করিতে পারে তাহার বস্তুনিষ্ঠ এবং বিস্তারিত আলোচনা আরম্ভ করা যাক।