০২. শহরতলীর সর্পিল পথ

শহরতলীর সর্পিল পথ ধরিয়া চলিয়াছে বিনায়ক। মন তাহার বিষাদখিন্ন। তার একমাত্র অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু তপনের অন্তরে বিষাক্ত কন্টক বিদ্ধ হইয়াছে। সে কাঁটা তুলিয়া ফেলার উপায় বাহির করা সহজ নহে, কারণ তুলিতে গেলে তপনের হৃদপিণ্ডটিকে জখম করিতে হয়। বিনায়ক ভাবিতেছে আর চলিতেছে। দিকে দিকে বাসন্তী শ্ৰী ফুটিয়া উঠিতেছে; মাঘ মাসের শেষ হইয়া আসিল। সরস্বতী পূজা, কিন্তু পূজার শ্রেষ্ঠ পুরোহিত তপন আসিবে না। বিনায়কের মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিল তপনের বিরুদ্ধে। কেন সে না দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ করিতে গেল? মিঃ চ্যাটার্জির বিষয়-সম্পত্তির প্রতি তো তপনের লোভ নাই। লোভ তাহার কিছুতেই নাই। আজ দ্বাদশ বৎসর বিনায়ক তপনকে দেখিয়া আসিতেছে। অথচ সেই তপন কিনা এক কথায় মিঃ চ্যাটার্জির মেয়েকে বিবাহ করিয়া বসিল? যেমন কর্ম তেমনি ফল হইয়াছে। নইলে সারা বাংলা দেশে তপনের মতো ছেলের বধূ যোগাড় করা কিছুই কঠিন ছিল না।

বিনায়ক গভীর দুঃখের মধ্যে আত্মবঞ্চনার শান্তি লাভ করিতেছে, তাহার হাসি পাইল নিজের বোকামির জন্য। তপন কোনদিন বিনা কারণে কিছুই করে না। তপনের হৃদয়, আকাশের তপনের মতই জ্বলন্ত, জাগ্রত, জ্যোর্তিময়।

কারখানায় আসিয়া পড়িল বিনায়ক। খেলনা তৈয়ারীর ছোট কারখানা। তপনের মস্তিষ্কউদ্ভূত নানাপ্রকার খেলনা তৈরী হয় শিশুমনের উৎকর্ষতর উপযোগী করিয়া। তপনই ইহার জনক এবং বিনায়ক তাহার মালিক ও পরিচালক। তপন নিজের খাওয়া পরার যৎসামান্য খরচ ছাড়া কিছুই গ্রহণ করে না। কারণ সে একা, তাহার খরচ খুবই কম, আর বিনায়কের মা-ভাই-বোন আছে, বাড়ী ভাড়া করিয়া থাকিতে হয় এবং বাজার করিয়া খাইতে হয়।

বিনায়ককে একা আসিতে দেখিয়া শ্রমিকবর্গ উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল, ছোটা কই বড়দাদাবাবু?

শ্রান্তকণ্ঠে বিনায়ক উত্তর দিল—অসুস্থ। তোমাদের জন্য মার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে দুলাইন কবিতা পাঠিয়েছে—

দীর্ণ জীর্ণ জীবনে তোমার বাসন্তী বিভা ছড়ায়ে দিও,
—দুঃখ-আর্ত বঞ্চিত প্রাণে নব যৌবনে আশ্বাসিও।

এইবার এসো ভাই সব, পূজায় বসি।

সকলেই ক্ষুব্ধ হইল, উদ্বিগ্ন হইল কিন্তু পূজার সময় হইয়াছে। বিনায়ক পূজায় বসিল। করজোড়ে কর্মীগণ উপবিষ্ট রহিল।

পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণ করিয়া বিনায়ক বলিল—তোমাদের ছোটদা দুচারদিন আসতে পারবে না ভাই সব, অসুখের জন্য নয়, অন্য কারণ আছে। ভেবো না তোমরা।

–তিনি ভালো আছেন তো?

—হ্যাঁ, সামান্য সর্দি মতো হয়েছে। বিনায়ক একাকী ফিরিয়া চলিল। দুই পাশে কচুরীপানার জঙ্গল শুকাইয়া উঠিয়াছে। দূরে দূরে দুই একটা গাছে লাল ফুল ফুটিতেছে। বাসন্তীর আগমনে সবই যেন লাল হইয়া যায়, এমন কি তপনের হৃদয়টাও আজ রক্তে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। বিনায়ক নিশ্বাস ফেলিল একটা।

তপন, তাহার বাল্যবন্ধু তপন—জীবনে যে কোনদিন কোনরূপ অসৎ কার্য করে নাই, কাহারও মনে বেদনা দেয় নাই, জীবন-পণ করিয়া যে পরোপকারবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে, সেই তপনের জীবনে এমন দুর্বিপাক কেন ঘটিল? তপন না থাকিলে মাতা-ভ্রাতা-ভগিণীকে লইয়া বিনায়ক আজ ভাসিয়া যাইত। এম-এ পাশ করিয়াও যখন চল্লিশ টাকার চাকুরী জুটিল না তখন একদিন নিরাশনয়নে গড়ের মাঠে বিনায়ক বসিয়া ভাবিতেছিল, আত্মহত্যাই তাহাকে করিতে হইবে। ঠিক সেই সময় তপন রাস্তার উপর দাঁড়ানো মোটরগাড়ীর আরোহীগণকে বিক্রয় করিতেছিল তাহার স্বহস্তের প্রস্তুত খেলনা। বিনায়ককে ক্লান্ত অবসাদখি দেখিয়া সেই তো এই কারখানার পত্তন করে নিজের হাতের আংটি বেচিয়া। সেদিন ছিল তিন টাকা ভাড়ার একটি চালাঘর এবং দুইজন শ্রমিক বিনায়ক আর তপন। সে আজ আট বৎসর পুর্বের ঘটনা। আজ এই কারখানায় পঞ্চাশ জন শ্রমিক কাজ করে। প্রস্তুত খেলনা বিদেশী খেলনার সহিত প্রতিযোগিতা করে। নীট আয় মাসিক দুই শত টাকার কম নয়।

কিন্তু তপন ইহার কতটুকু অংশ গ্রহণ করিয়াছে। মাসে পনের টাকাও সে গ্রহণ করে নাই, বিনায়কের সংসার পালনের জন্য দান করিয়াছে। এই অসাধারণ বন্ধুবৎসল তপন আজ ভাগ্যের ফেরে ক্ষতচিহ্ন, আর্তহৃদয়-অথচ বিনায়ক তাহার কোন উপকার করিতে পারে না! হয়ত পারে! বিনায়ক দ্রুত পা চালাইয়া নিকটবর্তী একটি দোকানে আসিয়া কয়েক আনা পয়সা দিয়া ফোন করিল।

অসুস্থ তপন আসিয়া ফোনে বলিল—কি বলছিস বিনু?

–তুই আত্মপরিচয় কেন দিবিনে তপু–তাহলে সে তোকে ভালোবাসবে।

-না, তার দরকার নাই। যে আমায়, কুৎসিত দেখে ভালোবাসলে না, সে আমায় সুন্দর দেখে ভালবাসতে পারে না, যে আমায় মূর্খ ভেবে গ্রহণ করলে না, আমাকে পণ্ডিত দেখে গ্রহণ করবার তার আর অধিকার নেই। যদি সে অনা কাউকে চায় তবে তারই হাতে ওকে তুলে দেবো।

–কিন্তু তাহলে…।

—থাক বিনু—এসব ফোনে হয় না। তপন ফোন ছাড়িয়া দিয়াছে। বিনায়ক গভীর শ্রান্তিতে এলাইয়া পড়িল। বাড়ী আসিয়া যখন সে পৌঁছিল তখন একটা বাজিয়া গিয়াছে এবং স্নেহময়ী জননী তাহার আহার্য লইয়া বসিয়া ঢুলিতেছেন।

বিনায়ক খাইতে বসিল।

 

তপতী চ্যাটার্জি সাবানঘষা একরাশ চুলে লাল ফিতা বাঁধিয়া বাসন্তী রং-এর কাপড় পরিয়া সেতার কোলে চলিয়াছে কলেজ-হোস্টেলে সরস্বতী পূজা করিবার জন্য। সেখানে সে গাহিবে, নাচিবে এবং রূপের বিদ্যুতে সকলকে চমকিত করিয়া দিবে।

মা বলিলেন—খুকী, তপন ওঘরে সরস্বতী পূজা করছে যা প্রণাম করে আয়।

নাক বাঁকাইয়া তপতী কহিল,—তুমি যাও, আমার প্রণাম করিবার ঢের জায়গা আছে।

তপতী গিয়া গাড়ীতে উঠিল। তপতীর দুই একজন বন্ধু, যাহরা তাহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল, তাহারা কিন্তু তপনকে একবার দেখিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। তপনের কক্ষদ্বারে গিয়া দেখিল, ক্ষৌম বস্তু-পরিহিত, উত্তরীয়-আবৃত দেহ তপন পিছন ফিরিয়া পূজা করিতেছে। তাহার মুণ্ডিত মস্তকের উপর লাউয়ের বোঁটার মতো টিকিতে একটা গাঁদা ফুল। তরুণীর দল আর স্থির থাকিতে পারিল না। একটা ছোট কঁচি আনিয়া টিকিটি আমূল ছটিয়া দিল। হাসির উচ্ছল শব্দে মুখ ফিরাইয়া তপন দেখিল, ঘরে চাঁদের হাট। সে পুনরায় মুখ ফিরাইয়া পূজা করিতে লাগিল। তাহার চন্দনচর্চিত মুণ্ডিত মুখশ্রী আধুনিক আলোক-প্রাপ্তদের মোটেই ভালো লাগিল না। তাহার উপর তপন কয়েকদিনের অসুস্থতার জন্য দাড়ি কামায় নাই, ইহা তাহার দ্বিতীয় অপরাধ। সর্বোপরি সে যে পুস্তকখানির উপর পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করিতেছিল, সকলে সবিস্ময়ে দেখিল, লালচে রং-এর কাগজের মলাটে তাহার নাম লেখা হারু ঠাকুরের পাঁচালী।

ঐ বটতলার নিদারুণ অশ্লীল বই তপন পড়ে এবং সরস্বতী পূজার জন্য উহারই উপর পুস্পাঞ্জলী অর্পণ করে, ইহা অপেক্ষা কদর্যতার পরিচয় আর কি হইতে পারে। উহার আর কোন বই নাই, আর কিছু পড়িবার যোগ্যতা নাই! কি হইবে উহার সহিত রসিকতা করিয়া। তরুণী দল বাহিরে আসিল মুখ টেপাটেপির হাসিতে। তগতীর অদৃষ্ট সম্বন্ধে যাহারা এতাবৎ ঈর্ষাপরায়ণা ছিল, তাহারা বেশ একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করিল, তপনের অর্বাচীনতাটা তাহারা আজ আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে।

গাড়িতে বসিয়া তপতী বিরক্তিতে তিক্ত হইয়া উঠিতেছিল। ঝঙ্কার দিয়া কহিল—এরকম দেরী করলে যাবো না আমি। রেবা মৃদু হাসিয়া বলিল—দেখে এলাম তোর বর-পাঁচালী পড়ছে। এবার সচিত্র প্রেম পত্তর আউড়ে চিঠি দেবে তোকে—যাও পাখী বলো তারে—।

সকলে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একজন তপনের কর্তিত টিকিটি আনিয়াছিল, তপতীর অঞ্চল-বিদ্ধ ব্রোচটিতে সেই টিকিটি আটকাইয়া দিয়া কহিল–তোর বরের মাথার ধ্বজারা বুকে খুঁজে!

আবার হাসি! রাগে তপতীর যেন বাকরুদ্ধ হইয়া গিয়াছে; রোষকষায়িত নয়নে সে ড্রাইভারকে ধমক দিল—জলদি চালাও-জলদি! বান্ধবীদের মধ্যে একজন সহানুভূতি দেখাইয়া কহিল,—তপু, কি করে জীবনটা কাটাবী তুই?

অন্যজন বলিল,–রিয়েলি, উই আর সো স্যরি।

তৃতীয়া বলিল,–মন্দই বা কি ভাই! বেশ হুকুম মতো চলবে, গা-হাত পা টিপে দেবে, মাঝে মাঝে পাঁচালী পড়ে শোনাবে, দরকার হলে রান্না-বান্নাটাও

হো হোকরিয়া হাসিতে হাসিতে আর একজন বলিল,–চেহারাটাও ঠিকরাঁধুনি বামুনের মতন।

তপতীর আপাদমস্তক জ্বলিতেছে, কিন্তু উপায় নাই। ইহারা যাহাকে দেখিয়া আসিয়াছে, সে ঐরকমই নিশ্চয়, বিরুদ্ধে তপতী কিছুই বলিতে পারে না। তাহার যত রাগ গিয়া পড়িল তাহার বাবার উপর। বাবা তাহার একি করিলেন? একটা নিতান্ত অশিক্ষিত, সভ্য সমাজে অপাংক্তেয় ছেলের সহিত তপতীর বিবাহ দিলেন। আশ্চর্য! ইহাই যদি বাবার মনে ছিল তবে তপতীকে তিনি এত লেখাপড়া শিখাইলেন কেন? তপতী তো ঠাকুরদার কাছে যতটুকু লেখাপড়া শিখিয়াছিল তাহাতেই বেশ চলিত। ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর তপতীকে কলিকাতায় আনিয়া তিনি কলেজে ভর্তি করিয়াছেন। তাহার জন্য গানের মাষ্টার রাখিয়াছেন,নাচের মাষ্টার রাখিয়াছেন। পাঁচটা সাতটা ক্লাবে তাহাকে ভর্তি করিয়া দিয়াছেন, এক কথায় সম্পূর্ণ আধুনিক ছাঁদে তপতীকে গড়িয়া তুলিয়াছেন তাহা কি ঐ পাঁচালী পাঠকারী টিকিওয়ালা গণ্ডমূর্খের জন্যই! বেশ—তপতী ইহার শোধ তুলিয়া তবে ছাড়িবে।

 

তপতীর ব্যবহার কয়েকদিন মিসেস্ চ্যাটার্জি লক্ষ্য করিতেছিলেন। আজ তাহার মুখে বিদ্রোহের বাণী শুনিয়া তিনি শঙ্কিত হইয়াই অপেক্ষা করিতেছিলেন। গভীর রাত্রে বাড়ী ফিরিয়া তপতী সীমাহীন তিক্ততার সহিত জানাইল, আমার বন্ধুরা তোমার জামাইয়ের কাছে যেন না যায়, বুঝেছে-তা হলে আমায় বাড়ীছাড়া হতে হবে।

—কেন? মা স্নিগ্ধকণ্ঠেই প্রশ্ন করিলেন।

-কেন! তপতীর কণ্ঠে অগ্নদগার হইল-কেন, তা জানো না! একটা হতভাগ্য মুখ লোককে ধরে এনেছো—টিকি রাখে, পাঁচালী পড়ে—আবার কেন! লজ্জা করলো না জিজ্ঞাসা করতে?

মা নিঃসহায় বোধ করিতে লাগিলেন। মুহূর্তে সামলাইয়া কহিলেন,—গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এসেছে, তাই টিকি রয়েছে, ওটা তুই হেঁটে দিস।

—তুমি ছাঁটো গিয়ে, ধুয়ে ধুয়ে জল খাবে—আর পাঁচালী শুনবে–।

—পাঁচালী পড়তে আমি বারণ করে দেবো, খুকী।

–কিছু তোমার করতে হবে না, শুধু এইটি করো যেন আমার কোন বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা না হয়, তাহলেই বাধিত থাকবে।

তপতী রোষভরে শয়নকক্ষে চলিয়া গেল। মা একবার তপনের কক্ষে আসিয়া উঁকি দিয়া দেখিয়া গেলেন, ক্লান্ত অসুস্থ তপন একক শয্যায় ঘুমাইতেছে। কক্ষের মৃদু আলোক তাহার প্রশস্ত ললাটে আসিয়া পড়িয়াছে—যেন রূপকথার রাজপুত্র, সোনার কাঠির ছোঁয়ায় এমনি জাগিয়া উঠিবে। মিসেস্ চ্যাটার্জি একটা নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলেন, এমন সুন্দর ছেলে, লেখাপড়া কেন যে শেখে নাই। পর মুহূর্তেই মনে পড়িল তপনের দারুণ অবস্থা-বিপর্যয়ের কথা। পিতার মৃত্যুর পর পিতৃহীন হইয়া তপনকে পাঠ্য পুস্তক বেচিয়া বাড়ী ফিরিতে হয়। কিন্তু কি-ই বা উহার বয়স? এখনো তে পড়াশুনা করিতে পারে।

মিসে চ্যাটার্জি স্বামীর কক্ষে আসিলেন। মিঃ চ্যাটার্জি এখনও তাহার অপেক্ষায় জাগিয়া ছিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন,–খুকী ফিরেছে?

-হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরলো।

মিঃ চ্যাটার্জি নিদ্রার আয়োজন করিতেছেন। মিসেস চ্যাটার্জি কয়েক মিনিট থামিয়া বলিলেন,–খুকী কিন্তু তপনকে মোটেই পছন্দ করছে না।

বিস্ময়ের সুরে মিঃ চ্যাটার্জি কহিলেন,—কেন! অপছন্দের কি কারণ?

ছেলেটাকে আমার তো খুব ভাল লাগছে গো, তবে লেখাপড়া ভালো জানেনা, পাঁচালী, ছড়া, এইসব নাকি পড়ে। খুকী তো এই কদিনে একবারও তার কাছে যায়নি। কতবার বললাম, জ্বর হয়েছে, একবার যা, কাছে গিয়ে বোস, তা কথাই কানে তুললো না। আজ আবার এসে বললো, তার বন্ধুরাও যেন ওর কাছে না যায়। আমি বাবু বেশ ভালো মনে করছি না, অতবড় মেয়ে!

পত্নীর এতগুলি কথার উত্তরে মিঃ চ্যাটার্জি হাসিয়া উঠিলেন, পরে বলিলেন,–খুকীর পরীক্ষাটা হয়ে যাক—তারপর দেখে নিও। ও ছেলেকে আমি ছেলেবেলা থেকে জানি, আর জানতাম ওর বাবাকে। সেই বাপের শতাংশের এক অংশও যদি পেয়ে থাকে, তা হলে ও হবে অসাধারণ।

—কিন্তু খুকী ওর সঙ্গে মিশছেই না–বলে, মূর্খ, পাড়াগেঁয়ে।

–মূর্খ তো নয়ই, পাড়াগেঁয়েও নয়। আমি দুচারটা কথা কয়েই বুঝেছি। কিছু ভেবো তুমি, আমি ওকে পরশু থেকেই আমার ব্যবসায়ে লাগাব, আর তোমার খুকী ইতিমধ্যে পরীক্ষাটা দিয়ে নিক। তারপর দুজনকে শিলং-এ নতুন বাড়ীটাতে দেব পাঠিয়ে—সব ঠিক হয়ে যাবে।

–আচ্ছা, পাঁচালী, ছড়া এসব পড়ে কেন? ইংরাজী না জানুক বাংলা ভালো বই, মাসিকপত্র, এসব তো পড়তে পরে?

তুমি বোলো সেকথা। আর ইংরাজী যে একেবারে জানে না, তা তো নয়, যা জানে তাতে আমার অফিসের কাজ চলে যাবে। আর তোমার ঐ আধুনিক সমাজের ধরণাধারণ শিখতে মাসখানেকের বেশী লাগে না। আমি ওকে আপ-টু-ডেট করে দিচ্ছি। ভেবো না তুমি।ক

মিসেস্ চ্যাটার্জি কতকটা আশ্বস্ত হইয়া শয়ন করিলেন।

পরদিন মিসে চ্যাটার্জি তপনকে চা খাওয়াইতে বসাইয়া বলিলেন,–তুমি পাঁচালী কেন পড় বাবা? খুকীর বিস্তর মাসিক পত্রিকা আছে—সেইগুলো পড়ো। ভাল বাংলা বই পড়ো, বুঝলে।

উত্তরে তপন স্মিত হাস্যে কহিল,–পাঁচালী বাংলার আদি সাহিত্য মা, ওর ওপর এত রাগ কেন আপনাদের।

-না বাবা, আজকাল ওগুলো আর চলে না কিনা, তাই বলছি আধুনিক সমাজে ওর কদর নেই।

—কিন্তু আমি আধুনিক নই মা, অত্যন্ত প্রাচীন, আপনার শ্বশুরের মতন প্রাচীন। আর ঐ পাঁচালীখানা আপনার শ্বশুরমশায়ের—আপনারই বাড়িতে পেয়েছি কাল।

স্নিগ্ধ মধুর হাসিয়া মিসেস্ চ্যাটার্জি বলিলেন,—ওঃ তাই বলে বাবা তুমি শশুর—আবার ফিরে এলে বুঝি?

তপন মৃদু হাসিয়া বলিল,–হ্যাঁ মা, এবার ছেলে হয়ে এলাম।

মিসেস চ্যাটার্জি যেসমাজে বাস করেন সেসমাজে এরূপকথার চলন বিশেষনাই,সেখানে কথাবার্তার স্রোত আন্তরিকতাহীন কৃত্রিমতারমধ্যে বহিয়া যায়। কিন্তু সেসব হেঁদোকথা এমন করিয়া তো মনকে আকর্ষণ করে না, এ যেন নিমেষে আপন করিয়া লয়। তপন যেন ক্রমশ তাহার পুত্রহীনতার স্থানটিকে জুড়াইয়া দিতেছে। এমন সুন্দর ছেলেকে তাহার খুকী গ্রহণ করিবে না। নিশ্চয় করিবে। খুকীর পরীক্ষাটা হইয়া যাক—তারপর মিসেস চ্যাটার্জি খুকীর উপর চাপ দিবেন। তপন তত বাড়ীতেই রহিল। ব্যস্ত হইবার কিছু কারণ নাই।

পরদিন সাহেব কোম্পানীর দোকানের কোট-প্যান্টালুন পরাইয়া মিঃ চ্যাটার্জি তপনকে নিজের অফিসে লইয়া গেলেন। তপন এখন হইতে তাহাকে কাজ কর্মে সাহায্য করিবে।

 

অতি প্রত্যুষে উঠিয়া আপনার টু-সীটার খানায় খানিকটা বেড়াইয়া আসিয়া তপতী স্নান করে এবং বাপের সহিত চা খাইয়া পড়িতে বসে। তপন সে সময় আপনার ঘরে স্নান করিয়া পূজা করিতে থাকে। যখন খাইতে আসে তখন একমাত্র মিসেস, চ্যাটার্জি ছাড়া আর কেহই থাকে না।

খাইয়াই তপন বাহির হইয়া যায়, বহুস্থানেই তাহাদের কোম্পানীর কন্ট্রাক্টে বাড়ী নির্মিত হইতেছে, তাহাই দেখিতে। ফিরিয়া যখন আসে তখন তপতী খাইয়া বিশ্রাম করিতেছে আপনার ঘরে। তপন মধ্যাহ্নে ভোজন সারিয়া আবার বাহির হয় অফিসে। বিকাল সাড়ে পাঁচছটায় ফিরিয়া আসে জল খাইবার জন্য। তপতী তখন কোনদিন বন্ধুদের লইয়া বাহিরে বেড়াইতে গিয়াছে, কোনদিন বালনে টেনিস খেলিতেছে, কোনদিন হয়ত বন্ধুবান্ধবদের সহিত সঙ্গীতের আসর জমাইয়া তুলিয়াছে।তপনের সহিত তাহার সাক্ষাতের অবরনাই,ইচ্ছে তো নাই-ই। দৈবাৎ উহা ঘটিলেও ঘটিতে পারিত, কিন্তু তপতী যতখানি এড়াইয়া চলে, তপন এড়াইতে চায় ততোধিক। বৈকালিক জলযোগ সারিয়া তপন পুনরায় বাহিরে চলিয়া যায় এবং ফিরিয়া আসে রাত্রি সাড়ে দশটার আগে নয়।

মিষ্টার বা মিসেস চ্যাটার্জি তাহাকে এতখানি পরিশ্রম করিতে দিতে চান না, কিন্তু তপন মৃদু হাসিয়া বলে,—গরীবের ছেলে মা আমি খেটে খেতেই তো জন্মেছি। মিসেস চ্যাটার্জি ক্ষুব্ধস্বরে বলেন,—সে যখন ছিলে বাবা, এখন তো তোমার কিছু অভাব নাই, এত খাটুনি কমাও তুমি। তপন আরও মধুর করিয়া উত্তর দেয় বাবাকে একটু সাহায্য করার জন্য আমি চেষ্টা করছি মা,আমার বিদ্যে-সাধ্যি অল্প, তাই খুব সাবধানে কাজ করি, যাতে ভুল কিছু না হয়। খাটুনি আমার কিছু লাগে না মা।

মিসেস চ্যাটার্জির আর কিছু কথা যোগায় না। অনেকক্ষণ পরে তিনি বলিলেন,–তোমার জন্য একটা গাড়ী কিনে দিই বাবা।

-–কি দরকার মা? ট্রামে তো দিব্যি যাচ্ছি-আসছি।

কিন্তু পরদিন মিঃ চ্যাটার্জি তপনের জন্য একখানা গাড়ী কিনিয়া আনিলেন। তপন পরদিন নূতন গাড়ী চড়িয়া অফিসে গেল। বিকেলে ফিরিয়া গাড়ীখানা গাড়ীবারান্দায় রাখিয়া সে জল খাইতে বসিয়াছে, তপতী দেখিল, নূতন গাড়ীখানা দেখিতে খুবই সুন্দর সে অন্য সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া গাড়ীটাকে লইয়া বেড়াইতে চলিয়া গেল। তপন নীচে আসিয়া দারোয়ানের মুখে দিদিমণির কীর্তি শুনিয়া মৃদু হাসিল এবং ট্রামের পাশখানা পকেটে ঠিক আছে দেখিয়া লইয়া হাঁটিয়া গিয়া ট্রামে উঠিল।

রাত্রে ফিরতেই মিসেস চ্যাটার্জি বলিলেন,–খুকীটা বড্ড দুই বাবা, তোমার গাড়ী নিয়ে বেড়াতে চলে গিয়েছিল। আবার বকতে গেলুম, তো হাসে।

—নিক না মা; ছেলেমানুষ, ঐ গাড়ীটা যদি ওর ভাল লাগে তো নিক—আমি ট্রামে বেশ যাতায়াত করতে পারি।

বাবা, তুমি এমন কিছু বুড়ো মানুষ নও। আর খুকীর ত গাড়ী রয়েছে। তুমি দিওনা ওকে তোমার গাড়ী।

উত্তরে তপন মৃদু হাসিল, কিছুই বলিল না। খাইতে খাইতে সে ভাবিতে লাগিল, তপতীর ইহা নিছক ছেলেমানুষি, নাকি ইহার অন্তরালে আরো কিছু আছে? এই দীর্ঘ পনেরদিন একটিবারও তপনের সহিত তাহার দেখা হয়নাই। দুজনেই দুজনকে এড়াইয়া চলিয়াছে; হঠাৎ তাহার জন্য ক্ৰীত গাড়ীখানা লইয়া তপতীর বেড়াইতে যাইবার উদ্দেশ্য কি? সে কি চায় যে তপন তাহার সহিত মিশুক, তাহার সহিত বেড়াইতে যাক—কিম্বা তাহার বিপরীত। তপন কিছুই স্থির করিতে পারিল না। খাওয়া শেষ করিয়া আপনার কক্ষে গিয়া শয়ন করিল।

কিন্তু ঘুম কি আসিতে চায়। তপতী তাহার পঞ্চবিংশতি বর্ষের জীবনে জ্বালাইয়া দিয়াছে। তপন এই কয়দিন লক্ষ্য করিয়াছে, যাহাদের সহিত তপতী বেড়াইতে যায়, গানকরে, টেনিস খেলে, তাহারা সকলেই আধুনিক সমাজেরতরুণ-তরুণী।সুশ্রী, সভ্য এবংসর্বতোভাবে তপতীর যোগ্য। এত লোককেছাড়িয়া কেন মিঃ চ্যাটার্জি তপনেরসহিতকন্যার বিবাহ দিলেন, তপন তাহা ভাবিয়া পায় না, তাহার পিতার সহিত নাকি মিঃ চ্যাটার্জির বন্ধুত্ব ছিল। তপন যখন নিতান্ত ছোট তখনই নাকি মিঃ চ্যাটার্জির কন্যার সঙ্গে তপনের বিবাহের কথা হয়। কিন্তু মিঃ চ্যাটার্জি সেকথা ভুলিয়াইবারহিলেন কেন, আর আজ এতকালপরে সেইঅঘটনটা ঘটাইয়াই বা দিলেন কেন। কিন্তু ভাবনা, নিল। যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে।

সকালে উঠিয়া স্নান পূজা যথারীতি সারিয়া সে বাহিরে যাইবার জন্য আজো তাহার গাড়িখানি লইতে আসিয়া দেখিল, তাহারই গাড়ী লইয়া তপতী প্রাতঃভ্রমণে বাহির হইয়া গিয়াছে, এখনো ফিরে নাই। তপতীর গাড়ীটা অবশ্য গ্যারেজেই রহিয়াছে, কিন্তু তপনের উহা লইতে সঙ্কোচ বোধ হইল। শুধু সঙ্কোচ বলিলে যথেষ্ট হয় না, হয়তো একটু ঘৃণার ভাবও মনে আসিল তাহার। কতদিন তপন দেখিয়াছে, ঐ গাড়ীখানার চালকের স্থানে তপতী এবং পাশে মিঃ ব্যানার্জী না হয় মিঃ অধিকারী কিম্বা চৌধুরী-কোনদিন বা তিনজনই। ও গাড়ী না লওয়াই ভালো। তপন ট্রাম ধরিবার জন্য বাহির হইয়া গেল।

তপতী বাড়ী ফিরিয়া দেখিল, তাহার টু-সীটার গ্যারেজে রহিয়াছে। চাকরকে জিজ্ঞাসা করিল,জামাইবাবু গাড়ী নেহী লিয়া?

নেহী হুজুর—ট্রামমে চলা গিয়া।

তপতী উপরে চলিয়া আসিল এবং নিঃশব্দে আপন ঘরে ঢুকিয়া পড়িতে বসিল; মা কিন্তু সমস্তই জানিয়াছেন;কন্যার ঘরে আসিয়া একটু উত্তপ্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন করিলেন,–খুকী, আজও তুই ওর গাড়ী নিয়েছিলি?

—নিলুম তো কি হলো মা? ও আমার গাড়ীটায় চড়লো না কেন? বলে দিও ঐটা নিতে। এ গাড়ীটা বেশ দেখতে, তাই নিয়েছিলুম। এই গাড়ীটাই আমি নেবো এবার থেকে।

মা বিস্ময়ের সহিত বলিলেন,–কেন, তোর গাড়ী মন্দ?

-মন্দ কেন—এটা নতুন, বেশ রংটা আর দৌড়ায় খুব। কিন্তু আমার গাড়ীটাও খারাপ নয়-চড়ে দেখতে বললা একদিন।

তপতীমধুর হাসিল। মা ভাবিলেন, খুকীতাহার জামাতার সঙ্গে ভাব করিতে চায়। বয়স্কা মেয়ে, লজ্জায় সব কথা খুলিয়া বলে না, আর এ-যুগের মেয়েদের চিনিবার উপায় নাই। হয়ত খুকী তপনের সঙ্গে কথাবার্তা কিছু কহিয়াছে,হয়ত ইহা ভালোরই লক্ষণ। মা খানিকটা স্বস্তির হাসি হাসিয়া বলিলেন,–বেশ তো, দুজনে বলাবলি করিস।

-হ্যাঁ, তুমি বলে দিও সে কথা!

তপতী পাঠে মন দিল। মা চলিয়া আসিলেন। দুপুরে তপন খাইতে আসিলে মা বলিলেন,–তুমি খুকীর গাড়ীটাই নাও বাবা, তোমার গাড়ীর সবুজ রং ওর বড় পছন্দ হয়েছে, তাই তোমারটাই নিতে চাইছে।

—বেশ তো মা, ও নিক—গাড়ীর আমার কী-ই বা দরকার? তখনও যেমন চলছিলাম, এখনও তেমনি চলবো ট্রামে।

—না বাবা-মা। মা ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। তাহলে আমি খুকীর কাছ থেকে গাড়ীটা কেড়ে নেব।

ছিঃ মা, ওর এখন পড়ার সময়, মনে আঘাত পাবে। আমি কিছু মনে করছি না মা, দুটো গাড়ীই থাকলো, যখন যেটাতে খুসি ও চড়বে।

-তুমি তাহলে কি ট্রামেই চড়বে বাবা? মাতার স্বরে আতঙ্কের আভাস স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিল।

হাসিয়া তপন বলিল—আচ্ছা মা, আমি একটা মোটর বাইক কিনে নেবো।

–বড্ড বিপদজনক গাড়ী বাবা–ভয় করে।

—কিছু ভয় নেই মা, আমার জীবনে কোন অকল্যাণ স্পর্শ করে না।

মা খানিকটা আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন,—মেয়েটার কি যে কাণ্ড।

–আপনার খুকীর গাড়ী না হলে একদিনও চলে না, আর আমার পা-গাড়ীতে আমি পঁচিশ বছর চলে এলুম। আমার জন্য অত ভাবছেন কেন মা! তাছাড়া মোটর বাইকে চড়তে আমি ভালোবাসি।

–বেশ বাবা, তাই করো তাহলে আজই কিনে নাও একখানা মোটর বাইক। খাওয়ার শেষে আপন কক্ষে আসিয়া তপনের হাসি পাইতে লাগিল। প্রাচুর্যের মধ্যে যাহাদের বাস তাহারা অর্থ সম্পদ দিয়াই মানুষকে বশ করিতে চায়। কিন্তু মানুষ যে অর্থের অপেক্ষা অন্য একটা জিনিসের বেশী আকাঙ্ক্ষা করে, তাহা ইহারা কিরূপে জানিবে? যাক, মোটর বাইক একখানা কিনিতেই হইবে নতুবা মা ভাবিবেন, খুকীর উপর তপন রাগ করিয়াছে।

পরদিন তপন একটা মোটর বাইকে চড়িয়া বাড়ী ফিরিল।

পরীক্ষার জন্য তপতী কিছুদিন যাবৎ অত্যন্ত ব্যস্ত তাই তাহার সঠিক স্বরূপ তপন দেখিতে পাইতেছে না। তথাপি সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছে, তপতীর নিকট তপনের কোন আশা নাই। তপতী তাহার বন্ধুদের মধ্যে কাহাকেও নিশ্চয় ভালোবাসে, কিম্বা এমনও হইতে পারে, তপতী আজো কাহাকেও ভালবাসিবার সুযোগ পায় নাই, তবে তপনকে যে

সে কোন দিন গ্রহণ করিবে না, ইহা নানা ভাবে বুঝাইয়া দিতে চায়।

আজও তপন বাহির হইবার পূর্বে তাহার মোটর বাইকখানা লইয়া সেই যে তপতী লনের চক্রাকার পথে ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে; নামিবার নামটি নাই। তপন নীরবে গেটের নিকট মিনিটখানেক দাঁড়াইল,—ভাবটা,—তাহাকে দেখিয়া যদি তপতী বাইক খানা ছাড়িয়া দেয়। তপন পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে, তপতী বাইকের বিকট শব্দ করিয়া বাহির হইয়া গেল একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে। অর্থাৎ এবাড়ীর সব জিনিসেই তপতীর অধিকার, তপনের কিছুমাত্র অধিকার নাই। তপন হাঁটিয়া গিয়া ট্রামে উঠিল। তারপর সে সনাতন ট্রামেই যাতায়াত আরম্ভ করিয়া দিল।

মা কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা জানিতে পারিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে মেয়েকে বলিলেন,—এসব তোর কি কাণ্ড খুকী!

উচ্ছল হাসিতে ঘর ভরাইয়া তুলিয়া খুকী জবাব দিল,–জানো মা মোটর গাড়ী সব মেয়েই চালায়, কিন্তু মোটর বাইক চালাতে বেশী মেয়ে জানে না—আমি তাদের হারিয়ে দিলাম।

মা খুশী না হইয়া বিরক্তির সঙ্গে বলিলেন,—তোর বাবাকে বল, তোর জন্যে একখানা কিনে দিক; ওরটা কেন নিলি?

—নিলুম, তাতে তোমার জামাই ধন্য হয়ে যাবে বুঝেছো! তপতী হাসিয়া আপন কক্ষে চলিয়া গেল একটা ইংরেজী গানের এক লাইন গাহিতে গাহিতে।

খুকীর মন তপনের প্রতি অনুকূল না প্রতিকুল! আপনার গর্ভজাত কন্যার অন্তররহস্য মা আজ কিছুমাত্র অনুধাবন করিতে পারিতেছেন না। তাহাদের সময়ে এসব ছিল না। ধনী শ্বশুবের আদরিণী পুত্রবধূ হইয়া তিনি আসিয়াছিলেন প্রথম দর্শনের দিনটি হইতেই স্বামীকে আপনার বলিয়া চিনিয়াছিলেন, স্বামীও তাঁহাকে আপনার করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু এযুগের আবহাওয়া কখন কোন দিক দিয়া প্রবাহিত হয় তাহা বুঝিবার সাধ্য স্বয়ং মহাকালের

আছে কিনা সন্দেহ। উহা লতপন বাড়ী ফিরিলে তিনি উৎকণ্ঠিত ভাবেই প্রশ্ন করিলেন, ট্রামেই তো এলে বাবা–

-হ্যাঁ মা। কিন্তু আপনি এত ভাবছেন কেন! ট্রামে বিস্তর বড়লোকের ছেলে চড়ে। ট্রাম কিছু খারাপ নয় মা।

মা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। দরিদ্র এই ছেলেটি নিজেকে দরিদ্র বলিয়া প্রচার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। এখনি হয়ত বলিয়া বসিবে, আমি ফুটপাতের মানুষ মা, আপনার আবুহোসেনি রাজত্বে এসে নাই বা চড়লাম মোটরে। রাজত্ব তো রয়েছে! আর ইহাকে দেওয়া জিনিস যখন তাহারই মেয়ে কাড়িয়া লইয়াছে তখন বেশী কিছুবলিতে যাওয়া উচিত নয়। হয়ত মনে করিবে, নিজের মেয়েকে বলিতে পারেন না, যত কথা তাহাকেই বলা হয়। উহার ভালোমানুষির সুযোগ লইয়া খুকী কিন্তু বড়ই অন্যায় করিতেছে। একটু ভাবিয়া বলিলেন—খুকীর গাড়ীটাই বা কেন তুমি নাও না বাবা?

–গাড়ীর দরকার নেই মা, অনর্থক কেন ভাবছেন আপনি! আর দরকার যখন হবে তখন নেবো, ও নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না। আমরা বুঝব সে সব!

মা ভাবিলেন, হয়তো তাহাই ঠিক,–খুকীর সহিত তপনের কোনরূপ কথাবার্তা হইয়া থাকিবে। তিনি আর উচ্চবাচ্য করিলেন না।

আহারান্তে তপন চলিয়া যাইতেছিল, মা বলিলেন,–খুকীর জন্মদিন বাবা, আজ একটু সকাল সকাল ফিরো!

–চেষ্টা করবো মা। বলিয়া তপন চলিয়া গেল।

 

সন্ধ্যায় বাড়ীতে মহাসমারোহ! আধুনিক সমাজে বিবাহের পূর্বেই অবশ্য মেয়ের জন্মদিনউৎসব ধূমধামে হইয়া থাকে, বিবাহের পর উহার প্রয়োজন ফুরাইয়া যায়! কারণ, জন্মদিনউৎসবটা ছেলেদের ও মেয়েদের পরস্পর পছন্দ করিয়া বিবাহ বন্ধনের জন্য প্রস্তুত হইবার দিন! কিন্তু তপতী ইহাদের একমাত্র কন্যা, তাই জন্মদিনটা এবারও হইতেছে।

তপতীর বন্ধুর দল তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। গান গাহিতেছে একটি মেয়ে! বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তপতীকে আশীর্বাদ করিয়া গেলেন। অনেকে মিসেস চ্যাটার্জিকে জামাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। মিসেস চ্যাটার্জি প্রত্যেককে জানাইলেন, সে জরুরী কাজে গিয়াছে, এখনি আসিবে।

মিসেস চ্যাটার্জির কথায় মিঃ অধিকারী কহিলেন—সেই বামুন ঠাকুরটি কোথায় গেলেন? ভয়ে পালিয়েছেন নাকি?

মিঃ ব্যানার্জি উত্তর দিলেনভয় নয় ভাবনায়, আমরা তার বোকামী ধরে ফেলবো বলে!

মিঃ চৌধুরী বলিলেন—রেবা দেবী সেদিন তার টিকি কেটে দিয়েছেন। রেবা দেবী কহিলেন,—মাথাটা মুড়ানো আছে, তুই ঘোল ঢেলে দিস তপতী।

-না না না মিস চ্যাটার্জি, ঘোল নয়, ওর মাথায় কডলিভার অয়েল দেবেন, চুলগুলো একটু ভিটামিন খেয়ে বাঁচবে।

সকলেই হাসিয়া উঠিল। মিস চ্যাটার্জি আখ্যাতা তপতী কহিল,–চুপ করুন, মা শুনতে পেলে বকবেন এখুনি।

–বকবেন কি? এর জন্য দায়ী তো আপনার মা আর বাবা! আপনার মতো সর্বগুণান্বিতা মেয়েকে একটি বানরের গলায় দিতে ওঁদের বাধলো না?

তপতী চুপ করিয়া রহিল। ক্ষণ পরে কহিল—মিঃ ব্যানার্জি তত আমায় দুল দিয়েছেন, মিঃ চৌড্রী দিলেন ব্রোচ, মিঃ অধিকারীর কথা ছিল যা দেবার তা না দিয়ে অন্য একটা বাজে জিনিস দিলেন, ওঁর শাস্তি হওয়া দরকার।

সকলেই একসঙ্গে বলিয়া উঠিল,–সার্টেনলি।

মিঃ অধিকারী কহিলেন,—সে জিনিস আপনি নিলে আমি কৃতার্থ হয়ে যাবো।

—নিশ্চয়ই নেবো, দিন!

—জিনিসটা কি মিঃ অধিকারী!—প্রশ্ন করিলেন মিঃ ব্যানার্জি।

–একটা ডায়মন্ড রিং। উত্তর দিল তপতী স্বয়ং।

সকলে একটু বিচলিত হইল। বিবাহিতা মেয়েকে আংটি দেওয়া চলে কি? কিন্তু তপতী নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়া দিতে চায়, সে আজো বিবাহিতনহে এবং এ জন্যই মিস চ্যাটার্জি নামে অভিহিত হইতে আপত্তি করে না। মিঃ অধিকারী ধনীর সন্তান। তিনি তপতীর জন্য আংটি কিনিয়া আনিয়াছিলেন। তৎক্ষণাৎ তাহা বাহির করিয়া তপতীর দিকে অগ্রসর হইলেন। তপতী তাহা পরাইয়া দিবার জন্য বাঁ হাতখানি বাড়াইয়া দিল।

মিঃ অধিকারীর আংটি পরানো তখনো শেষ হয় নাই, মার সঙ্গে তপন আসিয়া ঢুকিল, হাতে তাহার একগুচ্ছ ফুল। মা তপতীর কাণ্ড দেখিয়া মুহূর্তে থহইয়া গেলেন, কিন্তু তপনের

সামনে কোনরূপ উচ্চবাচ্য করিয়া কহিলেন, প্রণাম কর খুকী…

তপতী উঠিল না, যেমন ছিল তেমনি বসিয়া রহিল। তপন একমুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া বলিল,–থাক মা, আমি এমনি আশীর্বাদ করছি। বলিয়া সে অশোক গুচ্ছটি তপতীর হাতে দিতে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ করিল,–তোমার জীবনে পবিত্র হোমশিখা জ্বলে উঠুক…

তপতী পুষ্পগুচ্ছটা টানিয়া ঘুড়িয়া দিয়া সরোষে বলিল,–যাত্রা দলে প্লে করে নাকি? আশীর্বাদের ছটা দেখো!

বন্ধুদল হাসিয়া উঠিল, কিন্তু মা অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। তিনি কিছু বলিবার পূর্বেই তপন মাকে কহিল—বলুকগে মা, আমি কিছু মনে করিনি।

তপন আপন কক্ষে চলিয়া গেল। মাও অত্যন্ত বিরক্ত এবং বিব্রত হইয়া চলিয়া গেলেন। বন্ধুর দল হাসি থামাইয়া বলিল,–সত্যি একটা ওরাংওটাং।

 

পরদিন সকালে আসিল শিখা, তপতীর বন্ধুদের মধ্যে নিকটতমা। আসিয়াই বলিল–কাল সবে এসেছি ভাই, তোর বর কোথায় বল—-আলাপ করব।

—আলাপ করতে হবে না, সে একটা যাচ্ছেতাই।

—ওমা, সেকি? কেন?

—যা কপালে ছিল ঘটেছে আর কি। হুঁ, ঠাকুরদা নাকি গণনা করে বলেছিলেন, আমার বর হবে অদ্ভুত, তাই অদ্ভুত হয়েছে, যাত্রাদলের ভড় একটা।

শিখা বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়া প্রশ্ন করিল—কেন তপু ব্যাপার কিরে?

ব্যাপার তোর মাথা! যা, দেখে আয়, ওঘরে রয়েছে!

শিখা আর কোন কথা না বলিরা তপনের কক্ষদ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। তপন তখন পূজা শেষ করিয়া প্রণাম করিয়া উঠিতেছে। পিছন ফিরিতেই শিখার সহিত চোখ মিলিল। তাহার চন্দনচর্চিত পূত দেহকান্তি, উন্নত প্রশস্ত ললাটে ত্রিপুণ্ডক রেখা, গলায় শুভ্র উপবীত শিখাকে মুহূর্তে যেন অভিভূত করিয়া দিল। শিখা ভুলিয়া গেল, সে দেখা করিতে আসিয়াছে তাহার বন্ধুর বরের সঙ্গে। ভুলিয়া গেল উহার সহিত শিখার সম্বন্ধ কি! যুক্তকর ললাটে ঠেকাইয়া নমস্কার করিতে গিয়া শিখা আভূমি লুষ্ঠিত হইয়া তপনকে প্রণাম করিয়া বসিল।

মৃদু হাসিয়া তপন কহিল,—তুমি কে ভাই দিদি? এ সমাজে তোমাকে দেখবার আশা তো করিনি?

পাঁচ সাত সেকেণ্ড করোধ হইয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে সে কহিল—আমি আপনার ছোট বোন আর তপতীর বন্ধু আর জাষ্টিশ মুখার্জির মেয়ে।

-ওঃ! তুমিই শিখা। কিন্তু একটা কথা আছে।

বলুন!

—এখানে আমাকে তুমি কেমন দেখলে, কিছুই বলবে না তোমার বন্ধুর কাছে কারো কাছে। আজ বিকেলে আমি তোমাদের বাড়ী গিয়ে যা-কিছু বলবার বলবো-অনেক কথা আছে। তুমি এখন বাড়ী চলে যাও ভাই শিখা।

–যাচ্ছি। কিন্তু আমার নাম জানলেন কি করে?

–মার কাছে শুনেছি। আচ্ছা, এখন আর কথা নয়।

শিখা বাহিরে আসিয়া আপনার গাড়ীতে উঠিয়া প্রস্থান করিল, তপতীর সহিত আর দেখাও করিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *