শনিবারের বৈকালিক বৈঠক সেদিন জমজমাট। খোশ গল্পের যাবতীয় ইন্ধন উপস্থিত, শুধু উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছি আমাদের এই আডর প্রধান গাল্পিক সেই কথা-সাহিত্যিক বন্ধুটির, যিনি শরৎচন্দ্র আর জলধরদার কাহিনী আমাদের শোনাবেন বলে সুড়সুড়ি দিয়ে রেখেছিলেন।
এমন সময় শাল পাতা মোড় একটা ঠোঙা হাতে তিনি এসে উপস্থিত। সবাই বিস্মিত, ঠোঙায় আবার কী এল!
বন্ধুবর বললেন–বড়বাজারের মোড়ে নেমেই দেখি ফুটপাতের ধারে অয়েল-কেক, একেবারে গরমাগরম। অডিডার গল্পের সঙ্গে ভাল জমবে ভেবেই এক ঠোঙা নিয়ে এলাম।
অয়েল-কেক? সে আবার কি।
ও, সাহেবী ভাষায় বললাম বলে বুঝি অবাক হচ্ছেন। আমাদের আদি ও অকৃত্রিম তেলে ভাজা। এবার বুঝলেন তো? রাস্তার ধারে তোলা উনুনে ভাজছিল। আর জানেন তো? যত ধুলো পড়বে ততই তার আস্বাদ আর ততই তার রঙের খোলতাই।
আড্ডার আর এক বন্ধু যিনি রম্য রচনায়, গল্প-উপন্যাসে, কাব্য-কবিতায় সব্যসাচী অর্থাৎ যিনি সাহিত্যের বাজারে জ্যাক অব অল ট্রেডস তিনি যেমন শীর্ণদেহ তেমনি পেটরোগ। কথাবার্তায় শ্লেষ তার থাকবেই, কিন্তু আড্ডায় রসের যোগান দিতে তিনি অদ্বিতীয়। তিনি বললেন—
আপনার আনা অয়েল-কে দেখেই বুঝতে পারছি যে আপনার লেখা গল্প কেন পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
তার মানে? অর্থ টা পরিষ্কার হোক। অপর একজন প্রশ্ন তুললেন।
অর্থ? অর্থ তো পরিষ্কার। অয়েল-কেক বলে যেমন তেলেভাজা আমাদের দেখালেন, তেমনি ইংরেজী সাহিত্যিকদের টেকনিক অবলম্বন করে দেশী মাল ছাড়তে ইনি ওস্তাদ। পাঠকরা ফলাফল বিবেচনা না করেই গরম-গরম খেল বটে, পরে বদহজম অথবা চোয়া ঢেকুরের জ্বালায় অস্থির। আপনারাও এখনই খেয়ে তার ফলভোগ করবেন।
গাল্পিক বন্ধুটিও ছাড়বার পাত্র নন। বললেন–ছেলেবেলায় তেলেভাজা কে না খেয়েছে। আমি আপনি সবাই খেয়েছি। আজ না হয় আপনাদের অরুচি। কিন্তু খাবার লোকের কি অভাব আছে? তাছাড়া আপনি তো একাধারে রসগোল্লা পান্তুয়া সন্দেশ সবই খাওয়াচ্ছেন। তাতে ছানা কোথায়? সবই তো সুজির ডেলা আর চালের গুঁড়ো। তাও আবার ভেজাল ঘিয়ে ভাজা আর ভেলি গুড়ে জাল দেওয়া।
কোথায় গল্প শুনব, তা নয়, গল্পের গরুকে শূলে চড়াবার উপক্রম। কী দরকার ছিল অর্থ জানবার! অর্থ ই যত অনর্থের মূল। দেখতে দেখতে আড্ডা একেবারে হাফ-আখড়াইয়ে পরিণত হল। নিরুপায় হয়ে একখানা তেলেভাজা ঠোঙা থেকে বার করে মুখে পুরে তারিফ করে তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে চলেছি, ততক্ষণে আমার দেখাদেখি অন্যরাও ঠোঙার শালপাতার সেলাই খুলে তেলেভাজায় তদতপ্রাণ হয়ে উঠেছেন। খেলেন না শুধু তারা দুজন, যিনি এনেছিলেন এবং যিনি তেলেভাজা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবহাওয়া থমথমে করে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই আবহাওয়াকে হালকা রসিকতায় সরগরম করে তুলতেও তার জুড়ি মেলে না। তিনি বললেন–
আপনি সেদিন সেই পান-খোর সম্পাদকের যে-ঘটনা বললেন তাতে বুঝতে পারছি আমাদের আজ্ঞার কবি বন্ধুটির কত বড় সর্বনাশ তিনি করেছেন।
–সর্বনাশ! কি করে?
–সর্বনাশ ছাড়া কি। গল্প লিখতে লিখতে উপন্যাস লেখা, তারপর পত্রিকায় একবার ছেপে দিতে পারলে প্রকাশক হাজির। সঙ্গে সঙ্গে দুটো পয়সার মুখদর্শন। কিন্তু তাঁকে কবি বানিয়ে দিয়ে তার ভবিষ্যৎটা তো দিলেন শেষ করে।
আমাদের এই আড্ডার আরেকজন গল্প-লেখক যিনি অবৈধ প্রেমের গল্প লিখে সম্প্রতি নাম করেছেন, তিনি একটু গম্ভীরভাবেই বললেন–
আমি কিন্তু ও ভুলটা সময়েই সংশোধন করে নিয়েছি। কবিতা লিখেই আমার সাহিত্যজীবনের প্রথম সূত্রপাত। দেখলাম ওতে নাম হয় না, ইনাম তো দুরের কথা।
এবারে আমাদের গাল্পিক বন্ধুটি মুখ খুললেন—কারণটা কি জানেন? আমাদের দেশে এমন একটিও তরুণ নেই যে প্রেমে পড়ে নি, কবিতা লেখে নি আর স্নানের ঘরে ঢুকে গান গায় নি। এই তিনটার কোন একটা যার জীবনে ঘটে নি সে বাঙালী নয়।
আমি বললাম-আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু অন্তত বলতে পারি যে, আজকের বাংলাদেশে কবিতার পাঠকের চেয়ে কবিতা লেখকের সংখ্যা তিন তিরিখ্খে নয় অর্থাৎ তিনগুণ বেশী। এই দপ্তরে প্রতিদিন কবিতা আসে তিরিশ কি চল্লিশটা। ছাপা হয় সপ্তাহে দুটো কি তিনটে। কিন্তু পাঠকদের মধ্যে তো কোন বিক্ষোভ দেখি না, তারা তো আওয়াজ তোলে না। কবিতা আরও ছাপতে হবে!
এদিকে আধুনিক কবিরা কিন্তু হিন্দী কবিদের মুশায়েরার অনুকরণে দিকে দিকে কবিতা-মেলা আয়োজন করছেন, চৌরঙ্গীর উপর ট্রামের গুমটির সামনে প্যাকিং বাক্সর উপর দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছেন, এমন কি শোভাযাত্রা করে ধ্বনি তুলছেন—কবিতা পড়ুন, আরও কবিতা পড়ন। কিন্তু কাকস্য…। ভবি ভোলবার নয়।
আড্ডার কবি-বন্ধু এতক্ষণ নীরবে আমাদের আলোচনা শুনছিলেন। এবারে তিনি প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন—গল্প-উপন্যাসের মত কবিতার পাঠক আমাদের দেশে অনেক কম এ-কথা মানি। কিন্তু পাঠক একেবারে নেই তা ঠিক নয়। রবীন্দ্র অনুসারী প্রবীণ কবিদের পাঠকদের কথা আমি অবশ্য বলতে পারি না। কারণ তারা রবীন্দ্রনাথকে ব্যর্থ অনুসরণ করে মানসী পর্যন্তই এগিয়েছিলেন। তারপর সেই যে থেমেছেন, সেইখানেই ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন উপগ্রহের মত, আর অগ্রসর হতে পারেন নি। সুতরাং তাদের পাঠক কে এবং তারা আজও বেঁচে আছেন কিনা জানি নে। কিন্তু আমি অন্তত এটুকু হলপ করে বলতে পারি আমার পাঠক আছে এবং তা আছে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ষষ্ঠবার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে। তারা নূতন মন নূতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আজকের দিনে এগিয়ে আসছে। তোক না তারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়, তবু তারাই আমার পাঠক।
কবি-বন্ধু থামলেন, থামবার আগে শেষের কথাটা একটু জোরের সঙ্গেই বলে থামলেন। সেদিনের আড্ডার সুর যেন কেটে গেল, গল্প বলা বা শোনার মেজাজ কানোরই যেন আর নেই। এদিকে শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, অফিসের যে অঞ্চলে আমাদের আড্ডা বসে তার আশে পাশের ঘরের লোকজন ছুটি হয়ে যাওয়ায় ঝাঁপি বন্ধ করে চলে গেছেন। গল্প আর জমবে না মনে করে সবাই কেমন যেন উঠি-উঠি ভাব, দু-একজন কাজের অছিলায় উঠেও গেলেন।
চায়ের দোকানের ছোকরাটা এসে হাজির টেবিলের উপর অনেকক্ষণ পড়ে-থাকা চায়ের কাপগুলি তুলে নিয়ে যাবার জন্য। কাপগুলির ভিতরে চায়ের তলানির সঙ্গে সিগরেটের ছাই আর টুকরোয় ভরতি। কাগজগুলি খুলে গিয়ে সিগারেটের তামাক চায়ের জলে ভিজে বজকে উঠে বিশ্রী দেখাচ্ছে। ছোকরাটা বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললে—টেবিলে দু-তিনটা ছাই ফেলার বাটি থাকতে কেন যে আপনারা চায়ের কাপে সিগরেটের টুকরো ফেলেন বুঝি না। দোকানের বাবু রাগারাগি করেন আমাদের উপর। বলেন–যা, গিয়ে বাবুদের বল গে যা, এ রকম করলে এবার থেকে সিগারেটের ছাইদানিতে করে চা পাঠাব আর সঙ্গে হাতল-ভাঙা কাপ দিয়ে দেব ছাই ফেলার জন্যে।
আমাদের আড্ডায় একজন সাত্ত্বিক সাহিত্যিক আছেন, যিনি যাবতীয় পানদোষ থেকে মুক্ত। সুযোগ পেয়ে বলে উঠলেন—নিন, এবার ঠ্যালা বুঝুন। পইপই করে আপনাদের বারণ করেছিলাম অত সিগরেট খাবেন না, গলায় ফুসফুসে ক্যানসার হবে, একেবারে দুরারোগ্য রোগ। তা নয়, কারখানার চিমনির মত অনবরত মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়া আর ঘর দোর মেঝে চায়ের কাপ সিগারেটের টুকরোয় তছনছ করা। ঠিক হয়েছে। ওহে ছোকরা, যাও তো পাঁচ ছাইদানি চা এনে দাও বাবুদের। পয়সা না হয় আমিই দেব।
আমরা তো সবাই অবাক। বলল কি না-পয়সা আমিই দেব। জীবনে আজ বোধ হয় প্রথম ওঁর মুখে এই কথা শুনলাম। এমন কি চায়ের ছোকরাটাও যেতে-যেতে কথাটা শুনে যেন হকচকিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ছোকরা দিনের পর দিন এ-ঘরে চা দিয়ে যায়, সুতরাং আড্ডাধারী প্রতিটি ব্যক্তিকে সে ভাল করেই চেনে জানে। পুজোর সময় বকশিশ দিতে হবে এই ভয়ে যে লেখক পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পর জন্য পত্রিকা বা টাকা নিতে আসে না, বলেডাকে পাঠিয়ে দিন, কাজের চাপে সময় করে উঠতে পারছি না, এ-হেন ব্যক্তি—তিনি এক সাহেব কোম্পানীতে মোটা চাকরি করেন, কলকাতায় তিনতলা যার বাড়ি তা সত্ত্বেও যার কাছে ওয়ান্ পাইস ফাদার-মাদার, সে দেবে চায়ের দাম?
আমাদের সব্যসাচী লেখক বললেন–ওঁর কথা আর বলবেন না। আরে মশাই সেদিন ওঁর এক প্রকাশকের অফিসে রয়ালটি বাবদ মোটা টাকার চেক আদায় করেছেন। ওঁর অনেকগুলো উপন্যাস ওখান থেকে বেরিয়েছে কিনা। কর্মচারীরা ওঁকে এসে ধরলেন কিছু মিষ্টি খাওয়াতে; ওখানে যে সব লেখকদের বইয়ের মোটামুটি ভাল বিক্রি তারা কর্মচারীদের পাঁচদশ টাকা দিয়ে থাকেন মিষ্টি খাবার জন্যে। কি বলব মশাই, বুক পকেট থেকে অতি কষ্টে একখানা দুটাকার নোট বার করে দিলেন, যেন নিজের কলজেটা উপড়ে দিচ্ছেন, এ রকম মুখের ভাব।
আপনি কি করে জানলেন? আপনি তো আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একটু রাগতস্বরে বললেন–সাত্ত্বিক সাহিত্যিক।
উপস্থিত থাকতে হবে কেন। প্রকাশকের সেই প্রুফ-রীডার, যে মাঝে মামা চোখের ইশারায় আমাকেও সারেণ্ডার করতে বললেন, আমিও বার করলাম। দাদামশায়ের তো দেখে চক্ষু স্থির।
আড্ডার গাল্পিক বন্ধুটি এতক্ষণে মুখ খুললেন। বললেন–বা-ব্বা! একখানা মামা বটে। তা আপনার দাদামশাই সত্যিই কিছু বললেন না?
বলবেন আর কি। পরের মাসেই মামাকে পাঠিয়ে দিলেন রাঁচী। রামকৃষ্ণ মিশনের একটা বিদ্যাপীঠ আছে, যেখানে প্রথমেই ছাত্রদের মাথা মুড়িয়ে দেয়,
সেইখানে।
যাক, মামার তো সর্বনাশ যা হবার হল। আপনার কি গতি হল?
দাদামশায় বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন পরীক্ষার পরই আমাকে যেন কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়েও গেলেন। শুধু কলকাতা থেকে নয়, একেবারে ভারতবর্ষের বাইরে আমাকে চলে যেতে হল।
আমাদের সেই সব্যসাচী রসিক বন্ধুটি টিপ্পনী কেটে বললেন—ভারতবর্ষের বাইরে গিয়েছিলেন, ভালই করেছিলেন। ফিরে এলেন কেন? সাহিত্যিকদের এই ভিড়ে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্তত কমত।