রূপার সঙ্গে কি করে পরিচয় হল সেটা বলি।
আমার ছেলেবেলার বন্ধু সফিক। ভুল বললাম, বন্ধু বলে আমার কেউ নেই। যাদের আমি খানিকটা সহ্য করতে পারি তাদেরই বন্ধু বলার চেষ্টা করি। স্কুলে এবং কলেজে যাদের সঙ্গে আমি পড়েছি তাদের মধ্যে একমাত্র সফিককেই খানিকটা সহ্য করতে পারি। তাও সব সময় নয়, মাঝে মাঝে। সে গত বছর ডাক্তারি পাশ করেছে। এখনো বেকার। ডাক্তারও যে বেকার থাকে তা সফিকের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনোদিনও জানতাম না। তাকে ইদানীং দেখায় একজন লেখকের মতো। তার চুল লম্বা। গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে টায়ারের সোল লাগানো স্যাণ্ডেল। তাকে। সারাক্ষণই খুব উত্তেজিত দেখা যায়। এক জায়গায় বসে একটা দীর্ঘ বাক্য সে বলতে পারে না, লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। আবার বসে।
একদিন সফিক এসে বলল, চট করে শার্টটা গায়ে দে তো–কুইক।
আমি বললাম, কেন?
পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটিকে দেখবি। হেলেন অব ট্রয় এই মেয়ের কাছে মাতারি শ্ৰেণীর।
আমি চুপ করে রইলাম। হেলেন অব ট্রয় যে মেয়ের তুলনায় মাতরি তাকে দেখার ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করছে না।
দেরি করিস না। চট করে কাপড় পর।
না।
না মানে? আমি ঐ মেয়েকে দেখার জন্য সপ্তাহে একবার করে যেতে পারি, আর তুই একদিন যেতে পারবি না?
তুই প্রতি সপ্তাহে যাস?
অফকোর্স যাই। ইন্সপাইরেশনের জন্যে যাই। আমি লেখালেখির লাইন ধরব বলে ঠিক করেছি। উপন্যাসের ওয়ান ফোর্থ লিখেও ফেলেছি। রূপাকে পড়ে শোনালাম। রূপা বলল, ব্রিলিয়ান্ট!
রূপাটা কে? ঐ রূপবতী?
হুঁ। চল যাই। আজও খানিকটা পড়ব—তুই শুনতে পারবি।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, উপন্যাস পড়তে বা শুনতে আমার ভাল লাগে না।
না লাগলেও চল। একটা রিকোয়েস্ট রাখ। একা যেতে ইচ্ছা করছে না।
পুরানো ঢাকার যে বাড়ির সামনে নিয়ে সফিক আমাকে দাড়া করালো তার নিতান্তই ভগ্নদশা। রাজকন্যারা এ জাতীয় বাড়িতে থাকে না। দোতলা বাড়ি। একতলার সব কটা দরজা-জানালা বন্ধু। একতলাটা মনে হয় বসতবাড়ি না, দোকানপাট। একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে–নিউ হেকিমী দাওয়াখানা। রেলিংঘেরা উঠানে পিয়াজুর দোকান। পিয়াজু ভাজা হচ্ছে। দোতলায় উঠার সিঁড়ি লোহার। সেই সিঁড়ি যে এতদিনেও ভেঙ্গে পড়ে যায়নি কেন কে জানে। শুধু সিঁড়ি না, পুরো বাড়িটাই ছোটখাট ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষা করছে। সিঁড়ির গোড়ায় কলিং বেল আছে। সফিক অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল টেপাটিপি করতে লাগল। বেল বাজছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। আমি কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। সফিক হাসিমুখে বলল, অনেকক্ষণ ধরে বেল টেপাটিপি করতে হয়।
বেল বাজাতে বাজাতে সফিক যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন নদশ বছরের একটি ছেলে নামল। যাকে দেখেই মনে হল অসুস্থ। চোখ-মুখ ফোলা।
কারে চান?
রূপা আছে?
আমরা রূপার বন্ধু।
নাম কি? আমার নাম বললেই হবে। গিয়ে বল সফিক।
আমরা দোতলায় উঠলাম না। একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সফিক বলল, একতলায় রূপার নিজের একটা ড্রয়িং রুম আছে। খুব সুন্দর করে সাজানো। টেলিফোন আছে, টিভি, ভিসিআর সবই আছে। রূপার বাবা মেয়ের যা লাগে সব দিয়ে রেখেছেন।
এটা তাহলে রূপাদের বাড়ি না?
আরে না। এটা রূপার এক চাচার বাড়ি।
তাদের নিজেদের বাড়ি নেই?
আছে। সেই বাড়ি সারা বছর তালাবন্ধ থাকে। রূপার বাবা এক বছরে এগার মাস থাকে বাইরে। একটা মেয়ে তো আর একা একা থাকতে পারে না।
এগার মাস বাইরে কি করে?
ব্যবসা-ট্যাবসা করে বোধহয়। বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কও ভাল না। অবশ্যি আমার আন্দাজ। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
অন্য একটা ছেলে এসে একতলার একটা রুম খুলে দিল। সফিকের কথাই সত্যি। গা ছমছমানো ড্রয়িং রুম। সেখানের সাজসজ্জা এমন যে কিছুতেই পাঁচ দশ মিনিটের বেশি বসা সম্ভব না। পুরো দেয়ালজুড়ে অনেক পেইনটিং। সবই বিদেশি ল্যাণ্ডস্কেপ। চেরী গাছ, সামার হাউস, স্নো ফল….
সফিক বলল, ছবিগুলি দেখছিস?
হুঁ।
ভাল করে দেখে রাখ, পরে এই সম্পর্কে বলব। মনে করিয়ে দিস। আজকাল কিছু মনে থাকে না। প্রায়ই ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
আমরা বসে আছি। সফিক নিচু গলায় বলল–রূপা যদি সত্যি সত্যি নেমে আসে, তাহলে ট্যারা হয়ে যাবি। আই ডিফেক্ট হয়ে যাবে। এরকম মেয়ে চোখে দেখতে পাওয়াও বড় ধরনের অভিজ্ঞতা। তবে নেমে আসে কিনা সেটাও একটা কথা। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ থাকে। তখন দোতলা থেকে নামে না।
আমি বললাম, এতো বিরাট অপমানের ব্যাপার!
সফিক বলল, দূর দূর, অপমানের কিছু না। রূপার স্বভাবই এরকম। পরিচয় হলেই তুই বুঝবি।
যখন দেখা করে না, তখন কি করিস?
চা-টা খেয়ে চলে যাই। কি আর করব। রূপার একটা ভাল গুণ কি জানিস? কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেই চা দিতে বলে। দেখা করুক আর না করুক। চায়ের সঙ্গে সমুচা থাকে। অপূর্ব! রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। শেষ হয়েও শেষ হয় না, জিভে স্বাদ লেগে থাকে।
মেয়েটা দেখা করে না। তারপরেও তুই এখানে আসিস?
হুঁ। এত সুন্দর মেয়ে, খানিকক্ষণ কথা বললে মনটা ভাল হয়ে যায়। তাই আসি। এখানে এলে লেখার একটা ইন্সপিরেশন হয়। লেখকদের জন্যে ইন্সপিরিশন খুব দরকার। ইন্সপিরিশনের জন্যে একজন লেখক যা ইচ্ছা করতে পারে। হট হজ এ্যালাউড।
রূপা নামল না। তবে একজন কাজের ছেলে ট্রেতে করে চা এবং সমুচা নিয়ে এল। সফিক বলল, তোকে বলেছিলাম না চা চলে আসবে। অবশ্যি এটা খারাপ সাইন। তার মানে রূপা নামবে না। চা খা। চা খেয়ে চলে যাব। এই সমুচাগুলি এ বাড়ির স্পেশাল। ভেরি ভেরি গুড। খেয়ে দেখ।
চা শেষ করবার আগেই রূপা নেমে এল। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। জীবনে এত অবাক হইনি। মানুষ এত সুন্দর হয়! সফিক নিচু গলায় বলল, বলেছিলাম না ট্যারা হয়ে যাবি? এইভাবে তাকিয়ে থাকিস না, চোখে লাগছে। খুব ক্যাজুয়েলি তাকিয়ে থাক। যেন কিছুই না।
রূপা সফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো কাজে এসেছেন, না চা সমুচা। খাবার জন্যে এসেছেন?
কাজে এসেছি।
বলে ফেলুন। আমি খুব বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।
এ সফিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আমি আমার এই বন্ধুকে বলেছিলাম—এমন একজন মেয়ের কাছে তাকে নিয়ে যাব যাকে দেখলেই তার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।
রূপা আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, আপনার চোখ কি ট্যারা হয়েছে?
আমি কিছু বললাম না। তাকিয়ে রইলাম।
মেয়েটি সফিকের কথায় মোটেও বিব্রত বোধ করছে না। আমার দিকে তাকিয়ে আছে অসঙ্কোচে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, আচ্ছা আপনি কি কবি?
আমি বললাম, না।
বাঁচালেন। কবি হলে খানিকটা সমস্যা হত।
বলেই সে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আগ্রহের কারণ, সে অপেক্ষা করছে আমি জিজ্ঞেস করব—কি সমস্যা? আমি তা করলাম না। রূপা বলল, কি সমস্যা জানেন? কবি হলেই পরের দিন আপনি আবার আসতেন, পকেটে থাকত কবিতা। সেই কবিতা আমাকে নিয়ে লেখা। আমাকে শান্তমুখে সেই কবিতা শুনতে হত। এবং আবেগজর্জরিত কবিকে সমুচা খাওয়াতে হত। আপনি কি সমুচা খেয়েছেন?
হুঁ।
এ কেমন লাগল?
আমি জবাব দিলাম না। রূপা বলল, সফিক সাহেবের মতে সমুচাগুলি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো। আমি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়িনি, কাজেই বলতে পারছি না ব্যাপারটা কি? আপনি কি পড়েছেন?
একটা পড়েছি।
একটা পড়েছি।
শুধুই একটা?
শুধুই একটা?
হুঁ, হৈমন্তী।
পাঠ্য ছিল।
সফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মজার ব্যাপার কি জান? হৈমন্তী গল্পটা রঞ্জুর মুখস্থ। দাড়ি সেমিকোলনসহ।
সত্যি!
হ্যাঁ, সত্যি। তার যখন কিছু পছন্দ হয় সে মুখস্থ করে ফেলে। সে রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প পড়েছে, কিন্তু সেটা তার মুখস্থ।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না–সত্যি?
আমি জবাব দিলাম না। সফিককে বললাম, চল উঠি।
রূপা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, এখনই উঠবেন কি। বসুন। আরেক কাপ চা খান। হৈমন্তী গল্পটা মুখস্থ বলুন। প্লীজ। প্লীজ। বাসায় গল্পগুচ্ছ আছে, আমি বই। নিয়ে মিলিয়ে দেখব। যদি সত্যি সত্যি পারেন তাহলে…
তাহলে কি?
রূপা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে আপনার জন্য একটা প্রাইজ আছে।
সফিক বলল, ও পারবে, ওর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ভাল। আমার বরাবরই খারাপ ছিল। এখন আরো খারাপ হয়েছে। প্রায়ই ব্রেইন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
রূপা গল্পগুচ্ছ নিয়ে এল। হৈমন্তী গল্প বার করা হল। আমি রূপার মুখের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে বলে যেতে লাগলাম–কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে। কিন্তু পণের টাকার অপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো কিঞ্চিৎ উপরে। আছে, সেই জন্যেই তাড়া। …
রূপা বলল, থামুন। আপনি ভুল করেছেন–এখনো তাহার এই দুটা শব্দ বাদ পড়েছে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেই জন্যেই তাড়া।
আমি চুপ করে গেলাম। রূপা বলল, থামলেন কেন?
আমি বললাম, আজ আর ইচ্ছা করছে না। আরেকদিন।
রূপাদের বাড়ি থেকে বের হয়েই সফিক বলল, কি, আমার কথা ঠিক হয়েছে? দেখেছিস এমন রূপবতী মেয়ে?
আমি বললাম, না, দেখিনি।
মেয়েটার চোখ নীল, তা লক্ষ করেছিস?
হুঁ।
চোখ নীল কেন বল তো?
আমি কি করে বলব?
রূপার মা হচ্ছেন লেবানীজ মেয়ে। মেয়ে তার মার রূপ পেয়েছে। চোখ এই কারণেই নীল ড্রয়িং রুমে যে সব ছবি দেখেছিস, সবই ওর মার আঁকা।
রূপার সঙ্গে পরিচয়ের এই হচ্ছে শুরু। রূপার চাচার সঙ্গে কথা হয়েছে। ভদ্রলোক রোবট জাতীয়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কিছুক্ষণ পর খুব দ্রুত খানিকক্ষণ চোখ পিটপিট করেন, তারপর আবার তাকিয়ে থাকেন। কথাবার্তা বলেন, বললেও এক অক্ষরে সীমাবদ্ধ থাকে। রূপা যখন বলল, চাচা, ইনার নাম রঞ্জু।
রোবট চাচা বললেন, হুঁ।
উনি হলেন সফিক সাহেবের বন্ধু। সফিক সাহেবকে তো তুমি চেন, চেন না?
হুঁ।
ঠিক আছে চাচা, তুমি এখন যাও। এরা দুজন এসেছে ভি সি আরে একটা ছবি দেখতে–এ্যামেডিউস।
হুঁ।
আমি বললাম, এই যে আমরা প্রায়ই আসি আপনার চাচা বিরক্ত হন না?
অবশ্যই হন। তবে বিরক্ত হলেও কিছু বলেন না, কারণ আমাকে তার বাড়িতে রাখার জন্য তিনি মাসে দশ হাজার করে ঢাকা পান এবং বাবা তাকে বলে দিয়েছেন–আমাকে যেন আমার মত চলতে দেয়া হয়। চাচার ভয়ঙ্কর মানসিক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তিনি আমাকে আমার মত চলতে দিচ্ছেন।
মোট কবার গিয়েছি রূপাদের বাড়িতে? অনেকবার। তবে কখনো একা যাইনি। সব সময় সফিক সঙ্গে ছিল। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিবারই রূপা বলেছে–দেখি আপনার স্মৃতিশক্তি কেমন, হৈমন্তী গল্পটা আবার বলুন তো। আমি মিলিয়ে দেখি। একটা না একটা ভুল আপনি প্রতিবারই করেছেন। যেদিন কোনো ভুল করবেন না সেদিন আপনার জন্যে পুরস্কার আছে।
কি পুরস্কার?
তা বলব না। তবে খুব ভাল পুরস্কার। যা আপনি কখনো কল্পনাও করেন নি।
সফিককে বাদ দিয়ে একবার আমি গেলাম একা। আমাকে একা দেখে রূপা অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিল।
কি ব্যাপার, একা যে! বন্ধু কোথায়?
আমি বললাম, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এসেছি, কাজেই একা।
রূপা আগের চেয়েও বিস্মিত হয়ে বলল, কি প্রয়োজন?
হৈমন্তী গল্পটা ভুল ছাড়া আপনাকে শোনাব।
ও আচ্ছা। গল্পগুচ্ছ নিয়ে আসুন।
গল্পগুচ্ছ আনতে হবে না। আজ যে আপনি ভুল করবেন না তা আপনার চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আপনাকে একটা চমৎকার পুরস্কার দেব বলেছিলাম। তা দিতে আমি প্রস্তুত আছি। পুরস্কারটা কি আপনি কি আন্দাজ করতে পারেন?
না, আমি আন্দাজ করার চেষ্টাও করিনি। কারণ আপনি বলেছিলেন পুরস্কারটা কি তা আমি কল্পনাও করতে পারব না।
রূপা বলল, কিছু কল্পনাতো তারপরেও করেছেন। করেননি?
না।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
বসুন চা খাই আগে, তারপর কথা হবে। আমি যে একটা সিনেমা করছি তা কি আপনি জানেন?
জানি–সফিক বলেছে। সজনে ফুল।
আজ সেই ছবির কিছু কাজ হবে বুড়িগঙ্গা নদীতে। বিকেল তিনটা থেকে শিফট। আপনি কি যাবেন?
না।
না কেন?
অনেক লোকজন সেখানে থাকবে। এত লোকজন আমার ভাল লাগে না।
কি জন্যে লোকজনদের ভিড় আপনার ভাল লাগে না? লোকগুলিকে আপনার কি বোকা মনে হয়, না বেশি বুদ্ধিমান মনে হয়?
বোকা মনে হয়।
রূপা হেসে ফেলল। নিজেই চা নিয়ে এল। টী পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আপনাকে যেমন বলেছি–এমন সুন্দর একটা উপহার দেব যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সে রকম কথা আমি অন্য পুরুষ মানুষদেরও বলেছি। এটা বললে পুরুষদের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন দেখতে আমার ভাল লাগে।
কাউকে কি পুরস্কার দিয়েছেন?
না। বাজি এমন বিষয়ে ধরি যা পূরণ করা সম্ভব না। মুতালেব নামে আমার একজন বন্ধু আছে, তাকে একটা অঙ্কের ধাঁধা দিয়েছি। সে এক বছর ধরে সেই ধাঁধার জবাব বের করার চেষ্টা করছে–বিশেষ পুরস্কারের আশায়, যে পুরস্কারটা কি তা সে জানে না।
বের করতে পারেনি?
কোনদিন পারবেও না। এই ধাঁধাটার কোনো উত্তর নেই। তবে আপনি পারবেন। আপনার চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছে আপনি তৈরি হয়ে এসেছেন। তবে আজ হাতে একেবারেই সময় নেই। কোনো একদিন আপনাকে খবর দেব। বাসায় কি আপনার টেলিফোন আছে? থাকলে নাম্বারটা রেখে যান।
তারপর একদিন অদ্ভুত এক ব্যাপার হল। দুপুরে ঘুমিয়ে আছি–মুনিয়া এসে ডেকে তুলল, টেলিফোন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ঘুমুচ্ছি বলতে পারলি না?
দিনে তো তুই কখনো ঘুমাস না। কাজেই ভাবলাম বোধহয় মটকা মেরে পড়ে আছিস।
কে টেলিফোন করেছে?
নাম জিজ্ঞেস করিনি, তবে গলার স্বর অসম্ভব মিষ্টি। আমি এরকম মিষ্টি গলার স্বর এর আগে শুনিনি।
আমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রূপা বলল, আপনার কি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি আছে? শাদা পাঞ্জাবি?
কেন?
আছে কিনা বলুন।
আছে।
পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে চলে আসতে পারবেন?
পারব, কিন্তু ব্যাপারটা কি?
আপনাকে বিয়ে করতে হবে।
বিয়ে করতে হবে মানে?
অসহায় একজন তরুণীকে উদ্ধার করতে হবে। কিছু গুণ্ডাপাণ্ডা ধবনের ছেলে জোর করে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টায় আছে। তাদের একজন মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি বলছেন আপনি, এই যুগে এটা কি সম্ভব?
এই যুগেই সম্ভব। অন্য যুগ হলে সম্ভব ছিল না।
পুলিশে খবর দিতে বলুন।
পুলিশে খবর দেয়া হয়েছিল। পুলিশ ছেলের নাম শুনে পিছিয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, এখনো তো কিছু ঘটেনি। ঘটলে দেখা যাবে। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তো আমরা এ্যাকশন নিতে পারি না। এখন আপনি ভরসা।
আপনার কি করে ধারণা হল অমি অসহায় তরুণীদের উদ্ধারের ব্রত নিয়েছি?
তরুণীর নাম শুনলে আপনি খুব আগ্রহ করে এই ব্রত নেবেন বলে আমার ধারণা।
কি নাম?
তার নাম রূপা।
আমি প্রথমে ভাবলাম এটা নিশ্চয়ই রূপার কঠিন কোনো রসিকতার একটি। তারপর মনে হল রূপা তো কখনো রসিকতা করে না। অন্যের রসিকতায় খিলখিল করে হাসে–নিজে তো কখনো করে না। রূপা তরল গলায় বলল, মনে হচ্ছে কথা শুনে পাথর হয়ে গেছেন?
বুঝতে চেষ্টা করছি।
শুনুন, খুব মন দিয়ে শুনুন। আমার তালিকায় তিনটি নাম আছে। আপনি হচ্ছেন দুনম্বর। প্রথমজনকে টেলিফোনে পাইনি, ওদের টেলিফোন নেই। কাজেই আপনাকে টেলিফোন করলাম। আপনার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যে আপনাকে পেয়ে গেলাম। আপনি যদি রাজি না থাকেন, স্পষ্ট গলায় বলে দিন। আমি তৃতীয়জনকে টেলিফোন করবো।
ঠাট্টা করছেন?
না, ঠাট্টা করছি না।
প্রথমজনের নাম কি?
প্রথমজনকে আপনি চেনেন না। প্রথমজনের নাম জেনে কোনো লাভ নেই। তৃতীয়জনকে চেনেন, কিন্তু তার নামটা বলতে চাচ্ছি না। আপনাকে চিন্তা করার জন্য আধঘণ্টা সময় দিলাম। যদি রাজি থাকেন তাহলে আধঘণ্টা পর আমাদের বসায় চলে আসবেন।
বিয়ে কি আপনাদের বাসায় হবে?
তা কি করে হয়! আমাদের বাসার চারদিকে মস্তান ঘুরঘুর করছে। সন্দেহ হলেই ককটেল ফোটাবে। ব্রাস ফায়ার করবে।
সত্যি বলছেন?
এক রত্তি বানিয়ে বলিনি। আপনি যদি রাজি থাকেন চলে আসুন। আমি ইতিমধ্যে পুলিশকে টেলিফোন করছি। পুলিশের এক এআইজি আছেন বাবার বন্ধু। তাকে বলব–চাচা, আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন।
আপনার বাবা? উনি কোথায়?
বাবা ইংল্যাণ্ডে। তার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে।
উনি কি রাজি?
রূপা হাসতে হাসতে বলল, আমি তো তাঁর কোনো মতামত চাইনি। ঘটনা বলেছি–এখন বলুন আপনি কি রাজি?
আমি রাজি আছি।
এতো চট করে রাজি হবেন না। আধঘণ্টা সময় নিন। রাখি, কেমন?
পুলিশের উপস্থিতিতে বিয়ে হল রূপাদের চাচার বাসায়। বিয়ের পর পুলিশের জীপে করেই আমরা বেরুলাম।
রূপা বলল, এখন থেকে তোমাকে তুমি করে বলব। শোন, আমার কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে হবে, টুথব্রাশ, চিরুনি, ঘরে পরার শাড়ি। তোমার কাছে কি টাকা আছে?
না।
অসুবিধা নেই। আমার কাছে আছে। নতুন স্বামীরা স্ত্রীর টাকায় কিছু কিনতে চায় না বলেই জানতে চেয়েছি।
আমাকে নিয়ে তুমি সারাসরি তোমার বাসায় তুলবে?
হুঁ।
অসুবিধা হবে না তো? চিন্তা করে দেখ।
অসুবিধা হবে না।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে অসুবিধা হবে। তুমি বরং টেলিফোনে আগে কথা বলে নাও। ওরা খানিকটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাক।
টেলিফোন করার দরকার নেই।
রূপাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলাম রাত আটটার দিকে। রূপার বাবার বন্ধু এআইজি খালেকুর রহমান পুলিশের জীপে আমাদের নামিয়ে দিলেন।
রাত সাড়ে নটায় বাবার একটা মাইল্ড স্ট্রোক হল। আমার বাসর রাত কাটল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে।
আমি একা না, বাবুও সঙ্গে হাঁটছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে সে আমাকে খানিকটা সমীহ করত, সামনে সিগারেট খেত না। আজ সে সব কিছুই বোধহয় মনে নেই। তবে আমার ধারণা, বাবাকে নিয়ে সে যতটা না চিন্তিত তার চেয়েও বেশি চিন্তিত যে আজ রাতটা নষ্ট হল। রাতটা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু সে নিশ্চয়ই পড়ে ফেলত নন নিউটোনিয়ান ফ্লো না কি যেন বলে ঐ সব।
দাদা।
হুঁ।
বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল মনে হচ্ছে।
পড়াশোনার ক্ষতির কথা বলছিস?
সেই ঝামেলা তো আছেই। অসুখ-বিসুখ, হাসপাতাল-বাসা ছোটাছুটি। তার উপর তুমি আবার হুঁট করে বিয়ে করে ফেললে। ঐ নিয়ে বাড়িতেও নিশ্চয় টেনশন থাকবে।
তা কিছুটা থাকবে।
বাবু সিগারেট ধারতে ধরাতে বলল, তুমি এই ঝামেলাটা আমার পরীক্ষার পরে করলেও পারতে। মারাত্মক একটা ডিসটার্বেন্স হবে পড়াশোনায়। ভাবী নিশ্চয়ই ছাদে ঘুরঘুর করবে। মেয়েদের একটা টেনডেসিই থাকে ছাদে যাওয়া। কারণে-অকারণে ছাদে যাবে।
আমি নিষেধ করে দেব।
ইমমেডিয়েটলি কিছু বলার দরকার নেই। কয়েকটা দিন যাক। বাবার অবস্থা তোমার কি রকম মনে হচ্ছে?
এ যাত্রা টিকে যাবেন বলে মনে হয়।
বাবু শুকনো মুখে বলল, সব কটা ঝামেলা পরীক্ষার আগে শুরু হল। ধর ভালমন্দ কিছু যদি হয়, তাহলে এক মাস আর বই নিয়ে বসা যাবে না। আত্মীয়স্বজন… বিশ্রী অবস্থা হবে … আজকের পুরো রাতটা নষ্ট হল। কাল দিনটাও নষ্ট হবে।
কাল দিনটা নষ্ট হবে কেন?
রাত দুটা থেকে ভোর সাড়ে সাতটা–এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না ঘুমালে দিনে পড়তে পারি না। মাথা জাম হয়ে থাকে। এখন বাজে তিনটা। এক ঘণ্টা তো চলেই গেল। বিরাট সমস্যা।
সমস্যা তো বটেই।
আমরা এখন কি করব? বাকি রাত হাসপাতালের বারান্দাতেই হাঁটাহাঁটি করে কাটাব?
হুঁ।
বাবু বিরক্ত মুখে বলল, আমরা হাঁটাহাঁটি করে তো বাবাকে কোন ভাবে হেল্প করতে পারছি না। লাভটা কি হচ্ছে?
তুই কি চলে যেতে চাচ্ছিস?
আমি চলে গিয়েই বা করব কি? বাসায় ফিরতে ফিরতে ধর রাত সাড়ে তিনটা বেজে যাবে … তারপর কি আর রেস্ট নেবার সময় থাকবে?
আমি বললাম, চল চা খেয়ে আসি। হাসপাতালের আশেপাশে চায়ের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। বাবু বিরস মুখে বলল, চল।
চা খেতে খেতে বাবু বলল, মুনিয়া বলছিল, তুমি যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছ সে নাকি দারুণ রূপবতী।
তুই এখনো দেখিস নি?
না। ভাবীকে নিয়ে তুমি যখন এলে তখন আমি ফ্রী পার্টিকেল প্রবলেম সলভ করছিলাম–নিচে নামতে ইচ্ছা করল না।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার উপকারিতাটা কি তুই আমাকে বল তো দেখি।
বাবু বিস্মিত মুখে বলল, তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না। ঠিক কি জানতে চাচ্ছ বুঝিয়ে বল তো।
বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। কথার কথা। চল খোঁজ নিয়ে দেখি। বাবার কি অবস্থা?
বাবার অবস্থা ভালই। বাবা সামলে উঠেছেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, হার্টের কিছু না। হঠাৎ ব্লাড প্রেসার সুট করেছে, তাই এ অবস্থা।
বাবার কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ, তবু তিনি ক্ষীণ গলায় আমাকে বললেন, এই কাজটা তুই কি করে করলি? শাদা চামড়া দেখে সব ভুলে গেলি? কি আছে শাদা চামড়ায়? বল তুই, কি আছে?
কিছু নেই।
সুন্দর চেহারা? কি হয় সুন্দর চেহারায় তুই বল।
কিছুই হয় না।
তাহলে কি মনে করে তুই এই কাজটা করলি? কি জানিস তুই এই মেয়ে সম্পর্কে?
বিশেষ কিছু জানি না।
মেয়ের বাবা–উনি করেন কি?
বলতে পারছি না। ব্যবসা-ট্যাবসা করেন বোধহয়।
উনার নাম কি?
নাম জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করিনি। রূপাকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে বলব।
বাবা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।