দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ লুণ্ঠন
শিব-মন্দির প্রায় নিকটবর্তী হইয়াছে, এমন সময় চতুর্দিকে “রি-রি-রি-মার-মার” শব্দ উত্থিত হইল। সর্দার ও রক্ষীগণ প্রস্তুত হইবার পূর্বেই ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় পর্তুগীজ ও বাঙ্গালী দস্যুগণ তাহাদের উপর লাঠি ও সড়কি বর্ষণ করিতে লাগিল। বেহারারা পাল্কী ফেলিয়া, রক্ষীরা অস্ত্র ফেলিয়া, সেই ভীষণ অন্ধকারে দিগ্বিদিকে বক-তাড়িত শৃগালের ন্যায় ছুটিয়া পলাইল। অন্ধকারে আছাড় পড়িয়া, হোঁচট খাইয়া গাছের বাড়ি খাইয়া যাহারা পলাইল তাহাদেরও অনেকে সাংঘাতিকরূপে আহত হইল। পাঁচজন প্রহরী, দস্যুদের বিষম প্রহারে প্রাণত্যাগ করিল।
একজন মশালধারী মালী আক্রান্ত হইয়া, জ্বলন্ত মশালের আগুনে আততায়ীকে দগ্ধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে একজন পর্তুগীজ দস্যু তাহাকে তরবারির ভীষণ আঘাতে কুষ্মাণ্ডের ন্যায় দ্বিখণ্ড করিয়া করিয়া ফেলিল। কয়েকজন সাংঘাতিকরূপে জখম হইল! দূরে অশ্বারোহী যুবকের কণ্ঠ হইতে একবার আর্ত চীৎকার শ্রুত হইতেছিল। কিন্তু এই ভীষণ দুর্যোগ ও পবনের মাতামাতির হুঙ্কারে সেই আর্ত চিৎকার গ্রামবাসী কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। বৃষ্টিও যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া মুষলধারে পড়িতে লাগিল। যেমন সূচিভেদ্য অন্ধকার, তেমনি মেঘের ঘন ভীষণ গর্জন এবং তুমুল বর্ষণ। মাঝে মাঝে চঞ্চলা দামিনীলতা ক্ষণকালের জন্য রূপের লহরী দেখাইয়া করাল ভ্রূভঙ্গীতে এই দুর্যোগের কেবল ভীষণতাই বৃদ্ধি করিতেছিল। দস্যুরাও সেই ভীষণ দুর্যোগে ত্রস্ত হইয়া পড়িল। তাহারা পাল্কীখানা তুলিয়া লইয়া নিকটবর্তী শিব-মন্দিরের বারান্দায় যাইয়া দাঁড়াইল। কিন্তু সেখানেও বৃষ্টির ঝাপ্টা তাহাদিগকে সিক্ত ও বিপর্যস্ত করিয়া তুলিল। তাহারা সেই অন্ধকারের মধ্যেই প্রস্তুরের আঘাতে রুদ্ধ দ্বারের তালা ভাঙ্গিয়া মন্দিরে প্রবেশ করিল। তারপর চকমকি ঠুকিয়া আগুণ জ্বালাইয়া মন্দিরের প্রদীপ জ্বালাইল। প্রদীপের আলোকে সমস্ত মন্দির উদ্ভাসিত হইল। মন্দিরটি নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। ভিতরের চূণকাম ধব্ধব্ করিতেছে। একটি কাল প্রস্তরের বেদীর উপরে এক হস্ত অপেক্ষা দীর্ঘ সিন্দুরচর্চিত বিল্বপত্র ও পুস্প-পরিবেষ্টিত শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। পার্শ্বে একটি কুলঙ্গীর মধ্যে পঞ্চপ্রদীপ, কোষাকোষি, কতকগুলি সলিতা প্রভূতি পূজার উপকরণ রহিয়াছে। দস্যুদের মধ্যে পনের জন শিবলিঙ্গ দেখিয়া “জয় শিব শঙ্কর বোম ভোলানাথ” বলিয়া একেবারে মাটিতে লুটাইয়া শিবলিঙ্গকে প্রণাম করিল। তারপর একজন বলিয়া উঠিল,-“বাবা ভোলানাথ! আজ তোমার আর্শীবাদেই আমরা সিদ্ধিলাভ করিয়াছি। এ দারুণ দুর্যোগে তুমি আমাদিগকে আশ্রয় দিয়াছ।” অবশিষ্ঠ পাঁচজন পর্তুগীজ দস্যু, তাহারা প্রস্তরের এই বীভৎস লিঙ্গকে ভক্তি করিতে দেখিয়া অবাক হইয়া গেল! তাহারা আরও বিবিধ প্রকারের সুন্দর ও ভীষণ মূর্তির সম্মুখে হিন্দুদিগকে গড় করিতে দেখিয়াছে বটে, কিন্তু এমন উদ্দগুলিঙ্গও যে উপাস্য দেবতা হইতে পারে, ইহা কখনও তাহাদের ধারণা ছিল না। একজন কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,-“তোমাদের এ লিঙ্গ পূজার মট্লব কি আছে?” তখন সেই বাঙ্গালী দস্যুদের মধ্য হইতে একজন হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠকায় উজ্জ্বল-চক্ষু যুবক বলিল,-“গডফ্রে! তুমি ক্রেস্তান, তুমি কি তাহা বুঝিতে পারিবে? লিঙ্গই যে পরম বস্তু, লিঙ্গই ত স্রষ্টা, লিঙ্গ হইতেই ত আমরা জন্মিয়াছি। তাই লিঙ্গ পূজা করিতে হয়।”
গডফ্রেঃ হাঃ ! হাঃ ! হাঃ ! লিঙ্গ হইটে জন্ম, বেশ কটা আছে। কিন্তু আমি মনে করি, লিঙ্গ পূজা টোমাডের··· পক্ষে ভাল হয়। টোমরা পুরুষ মানুষ আছ···· টোমরা শিবের লিঙ্গটা পূজা করিটে যাইবে কেন? হাঃ ! হাঃ ! হাঃ ! লিঙ্গ পূজা!!
এমন সময় পাল্কীর মধ্যে ফিঁকরিয়ে ফিঁকরিয়ে কাঁদিবার শব্দ শোনা গেল। সেই বলিষ্ঠকায় যুবকটির তখন পাল্কীর দরজা খুলিয়া প্রদীপটা লইয়া সম্মুখে ধরিয়া বলিল, “ঠাকুরাণি! ক্রন্দন করবেন না। ভয়ের কোনও কার নাই। আমরা আপনার কোন অনিষ্ট করবো না। আমরা যশোহরের অধীশ্বর প্রবল-প্রতাপ মহারাজ প্রতাপাদিত্যের লোক। মহারাজ আপনাকে বিবাহ করবার জন্য আপনার পিতা রাজা কেদার রায়ের নিকট পুনঃ পুনঃ প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু আপনার পিতা বহু সপত্নীর ভয়ে আপনাকে প্রতাপাদিত্যের করে সমর্পণ কোর্তে রাজী হন নি; আপনি অবশ্য তাহা অবগত আছেন। তাই আপনাকে আমরা লুঠে নেওয়ার জন্য এক বৎসর পর্যন্ত সুযোগ অনুসন্ধান করছিলাম। আপনার কোনও ভয় নাই। আপনি আমাদের মহারাজের সর্বাপেক্ষা পেয়ারের রাণী হবেন। চল্লিশ রাণীর উপরে আপনি আধিপত্য কোর্বেন। আর এরূপ লুঠে নেওয়ায় আপনার পিতার পক্ষে কোন কলঙ্কের কথা নাই। স্বয়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের ভগ্নী সুভদ্রা দেবীকে মহাপুরুষ অর্জুন হরণ করেছিলেন। তাহাতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে বরং অনুরাগীই হ’য়েছিলেন।” এমন সময় দরজায় যুগপৎ ভীষণ পদাঘাত ও বীর কণ্ঠে “কোন্ হ্যায়! দরওয়াজা খোল” শ্রুত হইল। ভীষণ পদাঘাতে দ্বারের ভিতর দিকের হুড়কা ভাঙ্গিয়া দ্বার খুলিয়া গেল। সহসা কম্পিত শিখা-প্রদীপের ক্ষীণালোক সেই আগন্তকের মুখের উপর পড়ায় দস্যুরা কম্পিত হৃদয়ে দেখিল,-এক তেজঃপুঞ্জ-বীরমূর্তি, উলঙ্গ-কৃপাণ-পাণি উষ্ণীষ-শীর্ষ মুসলমান যুবক, রোষ-কষায়িত-লোচনে মন্দির-প্রবেশে উদ্যত। যুবকের প্রশস্ত ও উজ্জ্বল চক্ষু হইতে কালানলজ্বালা নির্গত হইতেছে,-“কে তুমি? তুমি এখানে কেন? পলায়ন কর, এ শিব-মন্দির, এখানে মুসলমানের আশ্রয় নাই।” দস্যুদের কথা শেষ হইবার পূর্বেই যুবকের ভীষণ তরবারি-আঘাতে একজন দস্যুর বাহুর ছিন্ন এবং অপরের স্কন্ধ ভীষণরূপে কাটিয়া গেল। তখন দস্যুগণ প্রমাদ গণিয়া সকলে ভীষণ তেজে এক সঙ্গে তাঁহার উপর বজ্রের ন্যায় নিপতিত হইবার উপক্রম করিল। যুবক কৌশলে দ্বারের বাহিরে আসিয়া একপার্শ্বে তরবারি তুলিয়া দন্ডায়মান হইলেন। আক্রমণোদ্যত-দস্যু-মন্তক দ্বারের ভিতর আসিবামাত্রই তাঁহার শাণিত কৃপাণের বজ্র প্রহারে ছিন্ন হইতে লাগিল। লাঠি ও বল্লমের দণ্ডগুলি তরবারির আঘাতে খন্ড খন্ড হইয়া ছুটিয়া পড়িল। অল্প সময়ের মধ্যেই পাঁচজন নিহত এবং সাতজন ভীষণরূপে জখম হইল। রক্তধারা আসিয়া বাহিরের বৃষ্টিধারার সঙ্গে মিশিতে লাগিল। যুবকের বীর বিক্রম এবং অস্ত্র সঞ্চালনের অমোঘতা দর্শনে অবশিষ্ট পর্তুগীজ ও হিন্দু দস্যুগণ ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। সকলে বীর যুবকের পদে নিরীহ মেষের ন্যায় আত্মসমর্পণ করিবার জন্য আকুল হইয়া উঠিল। কিন্তু গড়ফ্রে তাহার বজ্রকণ্ঠ নিনাদিত করিয়া কহিল, “কভি নেহি, আভি হাম ফটে করে গা।” সে এই বলিয়া যুবককে লক্ষ্য করিয়া পিস্তল ছুঁড়িল। যুবক চকিতে মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। পিস্তলের গুলী মাথার উপর দিয়া বোঁ করিয়া চলিয়া গেল। যুবক পর মুহুর্তে চকিতে লস্ফ প্রদান করিয়া প্রসারিত করে তরবারি আস্ফালন করিলেন। তরবারি নামিবার সঙ্গে সঙ্গেই মহাকায় গডফ্রের মস্তকটি গ্রীবাচ্যুত হইয়া পক্ক তালের মত সশব্দে ভূপতিত হইল। অবশিষ্ঠ দস্যুগণ ভয়ে আড়ষ্টপ্রায় হইয়া মন্দিরের মধ্যে কাঁপিতে লাগিল। শিব-মন্দিরে মাত্র একটি দ্বার, সুতরাং দস্যুদিগের পলায়ন করিবার উপায় ছিল না। এক সঙ্গে সকলে সকলে মিলিয়া আক্রমণ করিবারও সুবিধা ছিল না। যুবক দ্বার অবরোধ করিয়া দন্ডায়মান। দুইজনের বেশি একসঙ্গে দ্বারের ভিতরে পাশাপাশি দাঁড়ান যাইতে পারে না।
যে দ্বারের নিকটবর্তী হইতেছিল, তাহারই মস্তক যুবকের অসি-প্রহারে ভূ-চুম্বন করিতেছিল। দস্যুগণ প্রাণ-ভয়ে আতঙ্কিত হইয়া প্রদীপ নির্বাপিত হওয়ায় সমস্তই ভীষণ অন্ধকারে ডুবিয়া গেল। চতুর্দিকে কেবল অন্ধকার-আর অন্ধকার! নিজের শরীর পর্যন্তও দেখা যাইতেছে না। দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া যুবক অবিরত বারিধারায় সিক্ত হইতেছিলেন। গাছের মাথা দোলাইয়া পাতা উড়াইয়া প্রবাহিত হইতেছিল। যুবক অন্ধকারে দাঁড়াইয়া ভাবিলেন, “দ্বার উন্মুক্ত রহিয়াছে, সুতরাং অন্ধকারের মধ্যে অলক্ষ্যে আসিয়া দস্যুগণ সহসা আক্রমণ করিতে পারে।” এজন্য দরজা টানিয়া বাহির হইতে বন্ধ করায় দস্যুরা আরও ভীত হইয়া পড়িল। রাত্রি প্রভাত হইবা মাত্র অথবা বৃষ্টি ও দুর্যোগ থামিয়া গেলে আরও লোকজন আসিয়া পড়িতে পারে। তাহারা বন্দী হইলে কেদার রায় যে জীবন্ত প্রোথিত করিবেন, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তখন দস্যুরা মন্দিরের ভিতর হইতে অতীব করুণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “হুজুর! আমাদিগকে আল্লার ওয়াস্তে মাফ করুন। আমরা নরাধম প্রতাপাদিত্যের প্ররোচনায় বড়ই অন্যায় কার্যে হস্তক্ষেপ ক’রেছিলাম। আমাদের সুমচিত শিক্ষা ও দণ্ড হয়েছে। দোহাই আপনার, আমাদিগকে রক্ষা করুন। আমরা মা কালীর নামে শপথ করছি, জীবনে কদাপি আর এমন কার্যে লিপ্ত হ’ব না।”
দস্যুদের কাতরোক্তি শুনিয়া বীর যুবক হুঙ্কার করিয়া উঠিলেন। তাঁহার হুঙ্কারে ঝটিকা যেন ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া গেল। যুবক বলিলেন, “রে নরাধম পাষন্ডগণ, তোদের মত কাপুরুষগণকে বধ ক’রে কোন মুসলমান কখনও তাঁর তরবারিকে কলঙ্কিত করেন না। কিন্তু সাবধান! আর কখনও পরস্ত্রী বা কন্যা হরণ-রূপ জঘন্য কার্যে লিপ্ত হস্ না। এখন তোরা মন্দিরের প্রদীপ জ্বেলে অস্ত্রশস্ত্র রেখে আমর সম্মুখে দিয়ে একে একে বের হয়ে চলে যা। আমি তোদের অভয় দিচ্ছি। খোদা তোদের সুমতি দিন। খোদা সর্বদা জেগে আছেন, ইহা বিশ্বাস করিস। আমি খিজিরপুরের ঈসা খাঁ। বিশেষ কোনও প্রয়োজনে মুরাদপুরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পরমেশ্বরের কি অপূর্ব কৌশল! তিনি আমাকে পথ ভুলিয়ে এদিকে নিয়ে এসেছেন। তাই আজ কেদার রায়ের কন্যা রক্ষা পেল এবং তোরা সমুচিত শিক্ষা লাভ ও শাস্তি ভোগ করলি!”
দস্যুরা বারভূঁইয়ার অধিপতি প্রবলপ্রতাপ নবাব ঈসা খাঁ মসনদ-ই-আলীর নাম শুনিয়া আরও বিস্মিত, চমৎকৃত এবং ভীত হইয়া পড়িল। করুণ কণ্ঠে কাঁপিতে কাঁপিড়ে কহিল, “হুজুর! আমাদের বেআদবী মাফ করুন! হুজুরকে আমরা চিনতে পারি না। হুজুরকে চিনতে পারলে, আমরা তখনই হুজুরের পায় আত্মসমর্পণ করতেম। তা আমাদের মত ছোটলোক হুজুরকে চিনবে কি ক’রে হুজুর! আমরা এ কাজে প্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলাম না। মহাপাতক মনে করে ভীত হয়েছিনু। কিন্তু আমাদের দেশের রাজসভায় সেই বড় বামুন ঠাকুর আমাদের সামনে তার লম্বা টিকি নেড়ে তালপাতার কি এক সংহিতা না পুঁথি খুলে বল্লে যে, ‘কন্যা চুরি ক’রে বিবাহের ব্যবস্থা শাস্ত্রে আছে। এতে কোন পাতক নেই।’ তাই আমরা রাজী হয়ে এক বৎসরকাল দাঁও খুঁজে বেড়াচ্ছিনু। আজ সুযোগ পেয়েছিনু! কিন্তু খুব শিক্ষা হল।”
ঈসা খাঁ স্বাভাবিক মিষ্ট তেজের সহিত বলিলেন, “সে বামুন ঠাকুর হয়ত শাস্ত্রের কিছু জানে না। শাস্ত্রে এমন পাপ-কথা লেখা থাকে না। যদি থাকে তবে তা শাস্ত্র নয়।”
দস্যুঃ আজ্ঞে, আমাদের শাস্ত্রে নাকি সেরূপ বিধি আছে। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ রুক্সিণীকে হরণ করেছিলেন। অর্জুনে আবার ভগবানের ভগ্নী সুভদ্রাকে নাকি হরণ করে বিয়ে ক’রেছিলেন।
ঈসা খাঁ:আরে, সে গর্ভস্রাব ব্রাহ্মণ তোদের ফাঁকি দিয়েছে। সে বেটা দেখছি তোদের শাস্ত্রের মর্ম বোঝে নাই। অথবা টাকার লোভে কুটার্থ করেছে। বর ও ক’নে যদি উভয়ে উভয়কে নিজ ইচ্ছায় স্বামী-স্ত্রীরূপে বরণ করে থাকে, আর কনের পিতামাতা যদি ক’নের সেই বিবাহের প্রতিবাদী হয়, তবে সেই কন্যাকে হরণ করে নিলে পাপ হয় না। কিন্তু সে যে প্রাচীন কালের ব্যবস্থা।
দস্যুঃ “আজ্ঞে এতক্ষণে বুঝনু। হুজুর ঠিক বলেছেন। হুজুর দেখছি সেই বামুন ঠাকুরের চেয়ে আমাদের শাস্ত্র ভাল বুঝেন। হুজুর! আমরা আর এমন পাপকর্ম কখনই করবো না।” দস্যুরা এই বলিয়া প্রদীপ জ্বালাইল এবং অস্ত্রশস্ত্র রাখিয়া কম্পিত পদে বাহির হইল। ঈসা খাঁ প্রদীপের আলোকে দেখিলেন, পাঁচজন আহত তখনও জীবিত আছে। দরদর ধারায় তাহাদের রক্তস্রাব হইতেছে। তাহাদের শোচনীয় অবস্থায় প্রাণে বড়ই ক্লেশ বোধ করিলেন। দুঃখে বলিলেন, “হা হতভাগারা! এমন কার্য কেন কোর্তে এসেছিলি!” তৎপরে নিজের বহুমূল্য উষ্ণীষ ছিঁড়িয়া স্বহস্তে তাহাদের আহত স্থানে পটী বাঁধিয়া দিলেন। দস্যুরা ঈসা খাঁর মহত্ত্ব দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া পড়িল। একজন রাজার যে এতখানি বীরত্বের সহিত এতখানি দয়া থাকিতে পারে, তাহা প্রতাপাদিত্যের মত পাষণ্ড দস্যু-ব্যবসায়ী রাজার রাজ্যবাসী লোকের পক্ষে ধারণা করিবারও শক্তি ছিল না। ঈসা খাঁ পটী বাঁধিয়া দিয়া বলিলেন, “যা, এখন তোরা শীঘ্র শীঘ্র পালা। রাত্রি প্রভাত হলে কেদার রায়ের এলাকায় থাকা নিরাপদ নহে।”
দস্যুরা দ্রুতপদে বর্ষাপ্লাবন-তাড়িত শৃগালের ন্যায় যারপর নাই শোচনীয় অবস্থায় দ্রুতপদে সেই দুর্যোগের মধ্যে প্রস্থান করিল।
ঈসা খাঁ অতঃপর মন্দিরের মধ্যে সেই জলসিক্ত অবস্থায় প্রবেশ করিলেন। প্রদীপের আলোতে দেখিলেন পাঁচজন পর্তুগীজ দস্যু এবং দুইজন হিন্দু দস্যু নিহত হইয়া বীভৎস অবস্থায় সেই মন্দিরের তলে পড়িয়া রহিয়াছে। সমস্ত মন্দির রক্তে ভাসিতেছে। ঈসা খাঁ সেই সাতটি দেহ লইয়া বাহিরে দূরে রাস্তার পার্শ্বে একটা গর্তে ফেলিয়া দিলেন। তারপর বাহির হইতে অঞ্জলি করিয়া জল সেঁচিয়া মন্দিরের ভিতর যথাসম্ভব ধুইয়া ফেলিলেন। স্বর্ণময়ী পাল্কীর ভিতর হইতে বাহির হইয়া ঈসা খাঁর পদস্পর্শ করিল। তাহার পর হাস্যমুখে বলিল, “ভাগ্যে আপনি এসে পড়েছিলেন।”
ঈসা খাঁ বলিলেন, “সেজন্য পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দাও। সমস্তই তাঁর কৃপা।”
স্বর্ণঃ তা কি আর বলতে আছে। তাঁর কুদরতের সীমা নাই। আমি যে আজ উদ্ধার পাব, তা স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমি আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে আত্মহত্যার সঙ্কল্প এঁটে বসেছিলাম; সমস্ত শরীর ঘৃণা, ক্রোধ ও ভয়ে কাঁপিতেছিল, হয়ত এতক্ষণ আমি মৃতুদেহে পরিণত হ’তেম। ধন্য খোদাতালা! কবি সত্যই বলেছেন-
‘কাদেরা কুদরত তু দারি হরছে খাহি আঁকুনী,
মোরদারা তু জানে বখ্শি জেন্দারা বে-জাঁকুনী।
হে মহিমাময়! ধন্য তোমার মহিমার অদ্ভুত কৌশল। তুমি মুহুর্তে জীবিতকে মৃত ও মৃতকে জীবিত কর।”
ঈসা খাঁ:আচ্ছা, তোমাদের এত রাত হল কেন? সঙ্গে কত লোক ছিল?
স্বর্ণঃ প্রথমতঃ মাথাভাঙ্গা নদীর ঘাট পার হতে অনেক বিলম্ব হয়। খেয়া নৌকাখানি ভাঙ্গা ছিল। তারপর হরিশপুরের চটির কাছে এসে গরমের জন্য সকলেই বিশ্রাম করতে থাকে। সঙ্গে আট জন বেহারা, বার জন রক্ষী, তিন জন ভারী, দুই জন মশালচী এবং দাদা ছিলেন।
ঈসা খাঁ:তোমার দাদাও ছিলেন? তিনি কোথায়? তিনি কি ঘোড়ায় ছিলেন?
স্বর্ণঃ হাঁ, তিনি ঘোড়ায় চড়ে আগে আগে যেতে ছিলেন।
ঈসা খাঁ:তাঁকে ত দস্যুরা আত্রুমন করে নাই?
স্বর্ণঃ কেমন করে বলব? কয়েকবার তাঁর উচ্চ চিৎকার শুনেছিলা। সম্ভবতঃ তিনি ঘোড়া হাঁকিয়ে দূরে চলে গিয়েছেন।
ঈসা খাঁ:তোমাদের এতগুলি লোক থাকতে, বিশেষতঃ বার জন রক্ষী, তাহাতে দস্যুরা আক্রমণ করিল কোন সাহসে?
স্বর্ণঃ আমাদের সকলেই অপ্রস্তুত ও গাফেল ছিল। দস্যু আক্রমণ করবে এ কখনও ভাবি না। সর্দার সঙ্গে আনা, কেবল ভড়ঙ্গের জন্য। রক্ষীদের মধ্যে সকলেই চাঁড়াল, পর্তুগীজ ও বাগদী। ওরা যতই লস্ফঝম্ফ করুণ না, হঠাৎ বিপদে পড়লে ওরা একবারেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ওদের পাঁচ জনের কাছে বন্দুক ছিল। কিন্তু বন্দুকের নলে উপর লাঠি পড়াবামাত্রই বন্দুক ফেলে পালিয়েছে। যা হউক, আপনি আর ভিজে কাপড়ে থাকবেন না, অসুখ কোর্তে পারে। আপনি বড়ই শ্রান্ত হয়েছেন। কাপড় বদলান। পাল্কীর ভিতরে আমার কয়েকখানি শাড়ী আছে।
স্বর্ণময়ী এই বলিয়া তাড়াতাড়ি পাল্কীর ভিতর হইতে কাপড় বাহির করিয়া দিল। ঈসা খাঁর সমস্ত বস্ত্রই গিয়াছিল। তিনি তাহা পরিত্যাগ করিয়া স্বর্ণময়ীর প্রদত্ত শাড়ী দুই ভাঁজ করিয়া তহবন্দের মত পরিলেন এবং আর একখানি লইয়া গায়ে দিলেন। স্বর্ণময়ী তাঁহার সিক্ত ইজার, পাগড়ী, চাপকান, কোমর-বন্ধ প্রভূতি নিংড়াইয়া দেওয়ালের গায়ে শুকাইতে দিল এবং পাল্কীতে যে গালিচাখানা বিছানো ছিল, তাহাই বাহির করিয়া মন্দির-তলে বিছাইয়া দিল। ঈসা খাঁ গালিচায় ফরাগৎ মত বসিয়া একটু আরাম বোধ করিলেন। স্বর্ণময়ী পাল্কী হইতে পানদানী বাহির করিয়া ঈসা খাঁকে দুইটি পান দিল। ঈসা খাঁ আনমনে পান চিবাইতে লাগিলেন। স্বর্ণময়ী গালিচার এক প্রান্তে বসিয়া ঈসা খাঁর তেজোজ্জ্বল সুন্দর বদনমন্ডল পিপাসার্ত নয়নে পুনঃ পুনঃ দেখিতে লাগিল।
বাল্য ও কৈশোরের সেই সুপরিচিত মুখখানায় আজ যেন কি এক মদিরাময় সৌন্দর্য দেখিতে পাইল তাহার শরীরের প্রত্যেক অণু-পরমাণুর নিকট ঈসা খাঁ আজ যে কি প্রিয়তম, মিষ্টতম এবং সুন্দরতম বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তাহার হৃদয় ঘন ঘন স্পন্দিত হইতে লাগিল। লজ্জায় তাহার মুখমন্ডল আরক্রিম হইল। প্রাণের ভিতরে ঈসা খাঁর জন্য কি এক তীব্র চৌম্বক আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিল। স্বর্ণময়ী হৃদয়ে অনেকের কথা আলোচনা করিল, অনেকের মূর্তি মানসপটে অঙ্কন করিল, কিন্তু ঈসা খাঁর কাছে সকলেই মলিন হইয়া গেল। ঈসা খাঁর ন্যায় হৃদয়বান সুন্দর বীরপুরুষ, যুবতী আর কাহাকেও পৃথিবী অনুসন্ধান করিয়াও দেখিতে পাইল না। ঈসা খাঁ বাল্যকাল হইতেই তাহাকে আনন্দ দিয়া আসিয়াছে। কিন্তু আজ যেন সে আনন্দ শতগুনে উথলিয়া উঠিয়াছে। স্বর্ণময়ী ঈসা খাঁ খাঁর সম্বন্ধে অনেক চিন্তা করিল। কত উজ্জল স্মৃতি তাহার মনে পড়িল। সেই পাঁচ বৎসর হইল, একদিন স্বর্ণময়ী শ্রীপরের কৃষদীঘিতে গিয়া মাঝখানে ডুবিয়া মরিতেছিল। শত শত লোক পাড়ে দাঁড়াইয়া আর্তকণ্ঠে চীৎকার করিতেছিল। ঈখা খাঁ তাহাদের বাটীতে পুণ্যাহ উপলক্ষে নিমন্ত্রিত হইয়া উপস্থিত ছিলেন। তিনি মুহূর্ত মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। কতদিন রাজবাড়ীর ওস্তাদ মৌলানা ফখরউদ্দীনের নিকট নিজামীর সেকান্দর নামা, জামীর জেলেখা এবং ফেরদৌসীর শাহনামার যে সমস্ত অংশ ভাল করিয়া বুঝিতে পারে নাই, ঈসা খাঁ তাহাকে তাহা কত সুন্দররূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। সেই একবার রাজবাড়ীর নিকটবতী জঙ্গলে একটি ভীষণ বাঘ আসিয়া কত লোককে খুন জখম করিতেছিল। বড় বড় শিকারীরাও হাতীতে চড়িয়া শিকার করিতে সাহস পাইতেছিল না। তারপর ঈসা খাঁ আসিয়া সকলের নিষেধ ও ভীতি অগ্রাহ্য কতরঃ একদিন প্রাতঃকালে তরবারি-হস্তে যাইয়া বিনা হাতীতে সেই বাঘ একাকী মারিয়া আনিয়া সকলের বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিল। ইত্যাকার বহু সুখ ও আনন্দময় স্মৃতি একে একে তাহার মনে পড়িতে লাগিল এবং ঈসা খাঁকে তাহার হৃদয়ের সম্মুখে এক অপূর্ব সৌন্দর্য ও ক্ষমতাশালী হৃদয়বান পুরুষরূপে প্রতিভাত করিল। ঊষার আলোক যেমন তাহার অপূর্ব যাদুকরী তুলিকায় অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর চক্ষুর সম্মুখে নীলাকাশের নীরদমালাকে বিবিধ বিচিত্র মনঃপ্রাণ-বিহোহনরূপে সাজাইয়া দেয়, তেমনি অতীতের স্মৃতি বর্তমান ঘটনার তুলিকায় বিচিত্র উজ্জ্বল রং ফলাইয়া যুবতীর মানস-চক্ষে ঈসা খাঁকে তাহার হৃদয়ের প্রিয়তম, সুন্দরতম এবং শেষে আকাঙ্খিতজনরূপে অঙ্কিত করিল! যুবতী শিহরিয়া উঠিল। তাহার আপাদমস্তকে কি এক বিদ্যুতের তরঙ্গ প্রবাহিত হইল। যুবতী এতক্ষণ পর্যন্ত ঈসা খাঁর অনিন্দ্যসুন্দর তেজোদ্দীপ্ত বদনমন্ডল এবং সুদীর্ঘ কৃষ্ণতারা সমুজ্জ্বল ভাসা ভাসা চক্ষুর সৌন্দর্য-সুধা পান করিতেছিল। কিন্তু আর পারিল না, লজ্জা আসিয়া তাহার অনিচ্ছা সত্ত্বেও চক্ষুকে নত করিয়া দিল।
যুবতীর হৃদয়ের উপর দিয়া কত কি চিন্তার তুফান ও ভাবের তরঙ্গ প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে, কিন্তু ঈসা খাঁ আনমনে চিবাইতেছেন। পান চিবান শেষ হইলে-ছিবড়া ফেলিয়া যুবক একবার নেত্র ফিরাইয়া যুবতীর দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “স্বর্ণ! এখন কি করা যায়! বৃষ্টি ও তুফান এখনও ত সমানভাবে চলছে। তুমি পাল্কীর ভিতরে শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে। অসুখ করতে পারে। বৃষ্টি থামলে যা হয় একটা বন্দোবস্ত করবো।”
যুবকের আহবানে পুনরায় কি যেন একটা তড়িৎ স্রোত যুবতীর হৃদয়ে প্রবাহিত হইল। যুবতী গলাধরা-স্বরে বলিল “আমার ঘুম আসছে না। আপনি অনেক হয়রান হয়েছেন, আপনি বরং ঘুমান।” তারপর একটু থামিয়া যুবতী আবার বলিল, “আচ্ছা, আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন এখানে এ সময় কেমন করে এলেন?”
যুবকঃ কেন? সে কথা তুমি এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করছ যে?
যুবতীঃ আপনাকে পরিশ্রান্ত ভেবেই প্রথমে কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই। তবে আপনি যে মুরাদপুরে যাচ্ছিলেন, তখন তা দস্যুদিগকে বলেছিলেন।
যুবকঃ হাঁ, মুরাদপুরেই যাচ্ছিলেম। সেখানে একটা গ্রামের সীমা নিয়ে, আমার অধীন দুইজন জমিদারের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। সেখানে পূর্বেই লোক পাঠিয়েছি। আরো লোক সঙ্গে ছিল। ঝড় উঠে এলে, আমি ভট্রাচার্যদের বাড়ীতে আশ্রয় নেবার জন্য দ্রুতগতিতে অশ্ব চালনা করায় তা’রা পিছনে পড়েছে। অন্ধকারে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই রাস্তায় এসে পড়ি। মন্দিরের নিকটবর্তী হলে, বহু লোকের কোলাহল শব্দ শুনে ও গবাক্ষের ভিতর দিয়ে গৃহের আলো দেখে এখানে নেব মনে করে ঘোড়া হতে নামি। এটা যে শিবমন্দির তা অন্ধকারে কিছু টের পাইনি। আমি বৈঠকখানা মনে করেছিলাম। মন্দিরের দ্বারের সম্মুখবর্তী হইবামাত্রই প্রতাপাদিত্যের লোকেরা তোমাকে লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে, তা তাদের কথা থেকে বেশ বুঝতে পেলাম। ব্যাপার গুরুতর মনে করে আমি ঘোড়টাকে তাড়াতাড়ি এই সম্মুখের গাছের নীচে রেখে বিদ্যুতালোকে মন্দিরটি একবার বেশ ভাল করে দেখে নিলাম। দেখলাম যে, একটি ব্যতীত মন্দিরের দ্বিতীয় দ্বার নাই। দস্যুদের পালাবার কোন উপায় নাই। তখন দ্বারে পদাঘাত করি।
যুবতীঃ ধন্য আপনার হৃদয়! ধন্য আপনার সাহস ও বীরত্ব! আপনি একাই অতগুলি দস্যুকে আক্রমণ করে জয়লাভ করলেন। ভগবান্ আপনার দীর্ঘজীবন ও মঙ্গল করুন।
যুবকঃ এ আর বেশী সাহসের বা বীরত্বের কথা কি, স্বর্ণ! দস্যুরা বলশালী হলেও, অন্তরে তারা অত্যন্ত ভীরু। যারা পাপকার্য করে, তারা মানসিক বলশূন্য। বাহিরে তারা যতই আস্ফালন করুক না কেন, ভিতরে অত্যন্ত ভীত ও কম্পিত। আর তোমাকে বিপদগ্রস্থ দেখে, তোমাকে উদ্ধার করবার জন্য আমার এখন উত্তেজনা এসে পড়েছিল যে আমি তখন আমার নিজের কোনও বিপদের বা দস্যুদের সংখ্যার বিষয় আদৌ খেয়াল করি নাই।
যুবতীঃ আপনি আমাকে দু’বার রক্ষা ক’রলেন।
যুবকঃ আমি কে, যে রক্ষা করব? খোদা রক্ষা করেছেন। আর দু’বার কোথায়?
যুবতীঃ খোদাই রক্ষা করেন সত্য, কিন্তু আপনি ত উপলক্ষ বটেন। দু’বার নয় কেন? এই একবার, আর সেই যে কৃষ্ণদীঘি থেকে; ভুলে গেছেন নাকি?
যুবকঃ না, ভুলে যাইনি। কিন্তু সেবার আরো লোক ত তোমাকে জন্য জলে ঝেঁপে পড়েছিল।
যুবতীঃ পড়েছিল বটে, কিন্তু সে অনেক পরে, আপনি তখন আমাকে তুলে নিয়ে দীঘির প্রায় কেনারায় এসেছিলেন। আপনি না তুললে সেদিন আর একটুতেই ডুবে যেতাম।
যুবকঃ তুমি যাতে ডুবে না যাও, সেই জন্যই খোদা আমাকে তখন ওখানে রেখেছিলেন। কেন? সে কথা এখন তুললে যে!
যুবতীঃ না, এমনি মনে প’ল। তবে আমি যখনি বিপদে পড়ি, তখনই যে খোদা আপনাকে আমার উদ্ধারকর্তা করে পাঠান এ এক চমৎকার রহস্য।
ইহা বলিয়া যুবতী মন্দিরস্থ শিবলিঙ্গের দিকে আনমনে একবার দৃষ্টি করিল এবং মনে মনে কি যেন ভাবিয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।
যুবকঃ তাঁর সবই রহস্য। তাঁর কোন কার্যে রহস্য নাই? তাঁর সবই বিচিত্র। ভাবলে অবাক হতে হয়।
যুবতীঃ যা হ’ক আপনি না এলে, উঃ! কি একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার সংঘটিত হ’ত! আপনাকে দেখে আমার বড়ই সুখ ও আনন্দ হচ্ছে। আপনার কথা আমরা সর্বদাই স্মরণ করি। এবার পুণ্যাহে কত বিনয় ক’রে আপনাকে নিমন্ত্রণ করা হল; তথাপি এলেন না। আপনি না আসায় পুণ্যাহের আমোদও তেমন হয় নাই; আপনি আসবেন বলেই মালাকরেরা কত ভাল ভাল বাজি তৈয়ার ক’রেছিল। বাবা আপনার জন্য কত দুঃখ প্রকাশ ক’রলেন।
যুবকঃ কি ক’রবো স্বর্ণ। তোমাদের ওখানে আসতে আমারও খুব আনন্দ ও ইচ্ছা হয়, কিন্তু কেবলা সাহেবের মৃত্যুর পর হ’তে বিষয়কর্ম নিয়ে এমনি ফ্যাসাদে পড়েছি যে, একটু ফরাগৎ মত দম ফেলবারও আমার অবসর নাই। সর্বদাই মহালে বিদ্রোহ হচ্ছে। সীমা নিয়ে জমিদারের সঙ্গে প্রায়ই লড়াই চলছে। দায়ুদ খাঁর পতনের পরে বাঙ্গালা দেশ কেমন অরাজক হয়ে পড়েছে। এদিকে আকবর শাহ্ সমস্ত বাঙ্গালা এখনও করতে পারেন নি।
যুবতীঃ যাক, সে সব কথা। আপনার বিবাহের কি হচ্ছে?
যুবকঃ এখনও বিবাহের কিছু হয়নি। কিছু হলে তোমরা ত জেয়াফতই পেতে। মা মাঝে মাঝে বিবাহের কথা বলেন। তবে আমি এখনও বিবাহ সম্বন্ধে বড় একটা কিছু ভাবি নাই।
যুবতীঃ এত বয়স হয়েছে। এখনও বিয়ে করবেন না?
যুবকঃ তা আর বেশী কি? এই ত সবে পঁচিশে পড়েছি। আমাদের মধ্যে ৩০ বৎসর বয়সের পূর্বে প্রায় বিয়ে হয় না। হিন্দুদের মত আমাদের মধ্যে বাল্য-বিবাহ নাই।
যুবতীঃ বাল্য-বিবাহটা বড়ই খারাপ।
যুবকঃ নিশ্চয়ই। তাতে দম্পতির স্বাস্থ্যই যে কেবল নষ্ট হয়, তা নয়। তাদের সন্তানেরাই অত্যন্ত দুর্বল, ক্ষীণজীবী এবং রোগপ্রবল হয়। যে সব দোষের জন্য তোমাদের হিন্দুরা মুসলমানের অপেক্ষা দুর্বল, সাহসহীন ও ভীরু, তাহার মধ্যে এও একটি প্রধান কারণ।
যুবতীঃ কিন্তু আপনার এখন বিবাহ করা উচিত।
যুবকঃ তা দেখা যাবে।
যুবতীঃ খুব সুন্দরী ও প্রেমিকা দেখে বিয়ে করবেন।
যুবকঃ সুন্দরী ও প্রেমিকা ও চাইই বটে। কিন্তু বিয়ে করলে বলিষ্ঠা ও সাহসিনী দেখেও করা চাই।
যুবতীঃ কেন?
যুবকঃ তা’হলে সন্তানাদিও বলিষ্ঠ ও বীরভাবাপন্ন হবে।
যুবতীঃ আপনার ছেলে এমনি বীরপুরুষ হবে। আপনার সাহস ও বীরত্বের চার ভাগের একভাগ পেলেই সে ছেলে বাঘ আছড়িয়ে মারবে।
যুবকঃ কেবল পিতা বীরপুরুষ হ’লেই হয় না, মাতাও বীর্যবতী ও সাহসিনী হওয়া চাই।
যুবতীঃ তা’হলে স্ত্রীলোকদিগেরও শারীরিক নানা প্রকার ব্যায়াম এবং অস্ত্রচালনা কৌশল শিক্ষা করা চাই।
যুবকঃ নিশ্চয়ই।
যুবতীঃ তা’হলে আপনাদের মধ্যে স্ত্রীলোকেরাও ব্যায়াম-চর্চা করে?
যুবকঃ হাঁ, সম্ভ্রান্ত বংশের সকল স্ত্রীলোককেই যুদ্ধ শিখ্তে হয়। আগে এ প্রথা আরও বেশী ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা দেশে এসে মুসলমানেরাও কেমন বিলাসী, অলস ও দুর্বল হ’য়ে পড়ছে।
যুবতীঃ আমি ত একটু তীর ও তরবারি চালনার অভ্যাস ক’রেছি। কিন্তু বাবা ব্যতীত আর সকলেই তার জন্য আমাকে ঠাট্রা বিদ্রূপ করে-বলে যে, “মর্দামী শিখছে।”
যুবকঃ তবে ত আজ দস্যুরা বড় বেঁচে গেছে!
যুবতীঃ আপনি বিদ্রূপ কচ্ছেন, কিন্তু আমার হাতে অস্ত্র থাকলে আমি দস্যুদিগের সঙ্গে নিশ্চয়ই যুদ্ধ করতেম।
যুবকঃ বেশ কথা। আমি শুনে খুসী হ’লেম। এইবার একটা বীরপুরুষ দেখে বিয়ে দিতে হবে। দেখো কোনো কাপুরুষকে শাদী না কর।
যুবকের কথা শুনে যুবতীর গোলাপী গণ্ড লজ্জার আক্রমণে পক্ক বিম্ববৎ রক্তিম হইয়া উঠিল। যুবতীর গষ্ডে ও চক্ষে লজ্জার আবির্ভাব হইলেও, মনটা কেমন যেন একটা আনন্দ-রসে সিক্ত হইয়া গেল।
এদিকে বৃষ্টি সরিয়া যাওয়ায়, ঈসা খাঁ যুবতীকে বলিলেন, “স্বর্ণ! তুমি এখন শোও! আমি বাইরে যেয়ে আকাশের অবস্থাটা দেখে আসি।”
যুবক এই বলিয়া দ্বার খুলিয়া বাহিরে গেলেন। দেখিলেন মেঘ-বিমুক্ত আকাশ নির্মল নীলিমা ফুটাইয়া তারকা-হারে সজ্জিত হইয়া হাস্য করিতেছে। পূর্বদিকে দশমীর চন্দ্র ক্ষুদ্র এক কৃষ্ণ জলদের শিরে চড়িয়া বৃষ্টিস্নাতা পৃথিবী সুন্দরীর পানে চাহিয়া হাসিয়া উঠিয়াছে। নব বধূ অতি প্রত্যুষে গোপন স্নানান্তে ঘাট হইতে বাটী ফিরিবার পথে নন্দার সহিত দেখা হইলে যেমন লজ্জায় ও হৃদয়-চাপা-আনন্দে ইষৎ আরক্ত ও প্রফুল্ল হইয়া উঠে, সদ্যস্নাতা ধরণীসুন্দরীও তেমনি চন্দ্র দর্শনে আনন্দে স্ফীত-বা ও প্রফুল্লমুখী হইয়া উঠিয়াছে।
বৃষ্টি-বিধৌত বৃরে নির্মল শ্যামল পত্রগুলি বায়ুভরে দুলিয়া দুলিয়া চাঁদের কিরণে চিক্চিক্ করিয়া জ্বলিতেছে। জোনাকীগুলি বৃষ্টি বন্ধ হইয়াছে দেখিয়া, চারিদিকের ছোট ছোট গাছপালা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝোপের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে উড়িয়া উড়িয়া বাহার দিয়া ফিরিতেছে। মাঝে মাঝে বাতাস আসিয়া গাছপালার পত্রস্থ জল ঝাড়িয়া মাথা মুছাইয়া দিতেছে। যুবকের শাদা ঘোড়াটি গাছের নীচে দাঁড়াইয়া গা ঝাড়িতেছে। ঈসা খাঁ মন্দিরে ঢুকিয়া নিজের ভেজা ইজার লইয়া ঘোড়াটার গা মুছিয়া দিলেন। পরে তরবারি হস্তে লইয়া যুবতীকে বলিলেন, “তুমি পাল্কীর ভিতরে ঘুমাও, আর কোন ভয়ের কারণ নাই। আমি একবার ভট্রাচার্য-বাড়ীতে আমার লোকজনের এবং তোমার দাদার অনুসন্ধান করে আসি।”
ঈসা খাঁ তরবারি হস্তে মন্দির হইতে রাস্তায় বাহির পড়িলেন। কিঞ্চিৎ দূরে অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, দূরে কে একজন অশ্বারোহণে ইতস্ততঃ ফিরিতেছে। যুবক অগ্রসর হইলেন। অশ্বারোহী ঈসা খাঁকে তরবারি-পাণি দেখিয়া ভীত কণ্ঠে বলিল, “কে ও ?” ঈসা খাঁ কণ্ঠস্বরেই বুঝিতে পারিলেন যে, অশ্বারোহী কেদার রায়ের পুত্র বিনোদ।
ঈসা খাঁ আনন্দে বলিলেন, “বিনোদ! এস, ভয় নাই, আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। স্বর্ণ ভাল আছে।” সহসা বিশ্বস্ত ও আত্মীয়তার প্রীতিমাথা কণ্ঠস্বর শ্রবণে বিনোদ বিস্মিত-অন্তরে ঘোড়া ছুটাইয়া নিকেট আসিল। ঘোড়া হইতে নামিয়া ঈসা খাঁর পদধূলি গ্রহণ করিল। ঈসা খাঁ তাহাকে আনন্দে আলিঙ্গন করিলেন। বিনোদ বলিল “দাদা সাহেব! আপনি এ দুর্যোগে কোথা থেকে” ঈসা খাঁ তাহাকে সমস্ত ঘটনা খুলিয়া মন্দির দেখাইয়া ভট্রাচার্য-বাড়ীর দিকে অগ্রসর হইলেন।
ঈসা খাঁ ভট্রাচার্য-বাড়ী উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তাঁহার সমস্ত লোকজন ভট্রাচার্য বাড়ীতে বসিয়া আছে। বাড়ী কর্তা রজনী ভট্রাচার্য ঈসা খাঁকে সপরিবারে, পরম সৌভাগ্য জ্ঞানে দেবতার ন্যায় সম্মান ও সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। রজনী ভট্রাচার্যের আগ্রহে, ভদ্রতা ও খাতিরে, ভক্তি ও শ্রদ্ধায় ঈসা খাঁ তথায় আহার করেন ও রাত্রি যাপনে সম্মত হইলেন। লোক পাঠাইয়া বিনোদ ও রায় নন্দিনীকে মন্দির হইতে আনিলেন। স্বর্ণময়ী অন্তঃপুরে পরমাদরে রমণীদের দ্বারা অভ্যর্থিতা হইল। রজনী ভট্রাচার্য একজন জমিদার। তিনি রাজার ন্যায় যত্নে ও আড়ম্বরে ঈসা খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীয় পঞ্চান্ন জন লোককে ভোজন করাইলেন।
রজনী প্রভাতে ঈসা খাঁ বেহারা ঠিক করিয়া স্বর্ণময়ীকে সাদুল্লাপুরে পাঠাইয়া দিলেন। তৎপর রজনী ভট্রাচার্যের ছেলে ও মেয়েকে ডাকিয়া প্রত্যেকের হস্তে জলপান খাইবার জন্য ১০টি করিয়া মোহর প্রদান করিয়া অশ্বারোহণে মুরাদপুরের দিকে দ্রুত ধাবিত হইলেন। স্বর্ণময়ী পাল্কীর দরজার ফাঁকের মধ্য দিয়ে যতদূর দৃষ্টি চলিল, ততদূর পর্যন্ত তাহার প্রাণের আরাধ্য মনোমোহন-দেবতার ভুবনোজ্জ্বল অশ্বারূঢ় মূর্তি অনিমেষ দৃষ্টিতে সমস্ত প্রাণের পিপাসার সহিত দেখিতে লাগিল। স্বর্ণ দেখিল, যেন কোন অপূর্ব সুন্দর স্বর্গীয় দেবতা তাহার হৃদয়-মন চুরি করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছেন। তাঁহার গমন-পথের উপরিস্থ আকাশ, নিম্নস্থ ধরণী এবং দুই পার্শ্বের শ্যালল-তরুলতা যেন আনন্দে পুলকিত হইয়া উঠিতেছে। চারিদিকে যেন আলোকের তরঙ্গ উঠিতেছে। স্বর্ণময়ী দেখিল সত্য সত্যই তাহার প্রিয়তম-সুন্দরতম এবং জগদ্বিমোহন। তারপর যখন ঈসা খাঁ দূর পল্লীর তরুবল্লী-রেখার অন্তরালে মিশাইয়া গেলেন, তখন সুন্দরী বুকভাঙ্গা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া দৃষ্টি প্রত্যাহার করিল। হৃদয় উচ্ছ্বসিত নদীর ন্যায় ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে দুই বিন্দু অশ্রু অজ্ঞাতসারে বরে কাঁচলীতে পতিত হইল। যুবতী তাড়াতাড়ি পাল্কীর দরজা বন্ধ করিয়া পাল্কীর ভিতরে শুইয়া পড়িল। বাহিরের দৃশ্য দেখিবার আর ইচ্ছা হইল না। বেহারারা পাল্কী লইয়া দুই দিকের বিস্তৃত শ্যামায়মান ধান্যক্ষেত্রর মধ্যবতী রাস্তা দিয়া সাদুল্লাপুরের দিকে ছুটিয়া চলিল।