হিমু,
তুই রাতে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলি কেন? তুই নিজেকে কী ভাবিস? যা মনে আসে করে বেড়াবি? তোকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।? বাংলাদেশের সব মানুষের মাথা কি তুই কিনে নিয়েছিস?
ঐ রাতে কী ঘটেছিল আমার কাছে শোন। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল। আমি বাতি বন্ধ করে শুয়েছিলাম। এতে মাথা ধরা আরো বাড়ল। তুই বোধহয় জানিস না শুয়ে থাকলে আমার মাথা ধরা বাড়ে। আমার সবই উল্টা। যাই হোক মাথা ধরা যখন খুব বাড়ল তখন মাথা ধরার টেবলেটের খোঁজে গেলাম তোর খালুর কাছে। দেখি সে একা মুখ আমসি করে বসে। আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হিমু কোথায়? তোর খালু বলল, জানি না। কোথায়। আমি বললাম, সে চলে গেছে না কি? তোর খালু বলল, জানি না। যেতেও পারে, খবর না দিয়ে যে আসে সে খবর না দিয়ে চলে যায়। তখন আমি গোলাম জহিরের ঘরে। সেখানেও তুই নেই। কাজের মেয়েরাও কেউ কিছু বলতে পারে না। গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম। সেও বলল, গেট দিয়ে কাউকে যেতে দেখে নি। তোর খালু বলল, চলে গেছে— গেছে। এত হৈচৈ করছ, কেন? টেবিলে খাবার দিতে বলে।
হিমু, কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা ঠিক না। আমি রাগ করেছি এবং মনে কষ্ট পেয়েছি। আমি যাদেরকে বেশি স্নেহ করি। তারাই আমাকে কষ্ট দেয়। জহিরের কথাই মনে করে দেখ।
ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারে জহিরের সব কথাবার্তা এই নিয়ে পাঁচবার শুনলাম। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এইসব কী ধরনের কথাবার্তা? আমার তো মনে হয় ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। তার ডাক্তারি চিকিৎসা দরকার। কোনো সুস্থ মাথার ছেলে এ ধরনের কথা বলতে পারে না। ভূমিকম্পের রাতে সে তার বাবার সঙ্গে যে কথাবার্তা বলেছে সেটা শুনলেই যে কেউ বলবে, ছেলেকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দাও। ঐটাই তার জন্যে উপযুক্ত জায়গা। ঘটনা। কী হয়েছে শোন। বাপ-ছেলে খেতে বসেছে। আমি বসি নি। প্রথমত, আমার মাথার যন্ত্রণা; দ্বিতীয়ত, তোর জন্য রান্না-বান্না করিয়েছি। আর তুই না বলে পালিয়ে গেছিস; যাই হোক মূল ঘটনা শোন। জহিরের বাবা বলল, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
জহির বলল, ভালোই হচ্ছিল। তবে এখন হচ্ছে না।
জহিরের বাবা বলল, হচ্ছে না কেন?
জহির বলল, ফিজিক্স পড়ে কোনো লাভ নেই বাবা।
লাভ নেই কেন?
প্রকৃতিকে বোঝার জন্যেই ফিজিক্স পড়া। আমি চিন্তা করে দেখেছি। এখন পর্যন্ত ফিজিক্সের যে উন্নতি হয়েছে তা দিয়ে প্রকৃতিকে কিছুতেই বোঝা যাবে না। বরং উল্টো হবে। ফিজিক্সের জ্ঞান আমাদের চিন্তাকে আরো ধোঁয়াটে করে ফেলবে।
জহিরের বাবা তখন শান্ত গলায় বলল, আমি ফিজিক্স জানি না। আমি ইতিহাসের ছাত্র। তুই কী বলছিস বুঝিয়ে বল।
জহির বলল, সব কিছু বোঝাতে পারব না। একটা শুধু বলি, ফিজিক্স বলছে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। বিগ ব্যাং থেকে। প্রচণ্ড শব্দে কসমিক ডিম ফেটে মহাবিশ্ব তৈরি হলো। যে মুহুর্তে কসমিক ডিম ফাটল সেই মুহূর্ত থেকে সময়ের শুরু। কসমিক আগে কী ছিল কিছুই বলতে পারছে না।
ডিম ফাটার আগে কী ছিল ফিজিক্স তা বলতে পারছে না বলে তুই ফিজিক্স পড়বি না?
না। আমার কাছে ফিজিক্স পড়া অর্থহীন মনে হচ্ছে।
কী করবি বলে ঠিক করেছিস?
বাবা, আমি একটা কফিশপ চালাব।
বুঝতে পারছি না। কী বলছিস। কী চালাবি?
কফিশপ। ছোট্ট ঘরোয়া ধরনের কফিশপ। দোকান সারাদিন বন্ধ থাকবে। খুলবে সন্ধ্যার পর। কাটায় কাটায় বারটার সময় কফিশপ বন্ধ হবে।
রসিকতা করছিস নাকি?
না, রসিকতা কেন করব? কফিশপের নাম ঠিক হয়ে গেছে— শুধুই কফিতা।
নাম শুধুই কফিতা?
হ্যাঁ, আমার কফিশপের নাম কফিতা। এখন কী করছি জানো বাবা? যে মাগে করে কফি দেয়া হবে সেই মগের ডিজাইন করছি।
মগের ডিজাইন করছিস?
হ্যাঁ। কোন রঙের মাগে কফির গেরুয়া রঙ ভালো ফুটে সেটা দেখা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে গাঢ় সবুজ রঙের মাগে কফির রঙ ভালো ফুটে। কাজেই আমাদের মগের রঙ হলো গাঢ় সবুজ। এই মগ হবে গ্রাসের মতো। মাগে চায়ের কাপের মতো কোনো বোটা থাকবে না।
বোটা থাকবে না?
জ্বি না। কেন থাকবে না শুনতে চাও?
শুনি কেন থাকবে না।
পানির গ্রাস আমরা হাত দিয়ে ধরি। ঠাণ্ডা পানির গ্রাস হাত দিয়ে ধরেই পানির শীতলতা আমরা টের পাই। আমাদের ভালো লাগে। গরম কফির উষ্ণতাও ঠিক একইভাবে আমরা কফির মগ হাত দিয়ে ধরা মাত্র টের পাব।
আমাদের ভালো লাগবে।
তুই তাহলে কফির দোকান দিচ্ছিস?
জ্বি।
তোর নেক্সট পরীক্ষা যেন কবে?
নয় তারিখ–সাত দিন আছে। পরীক্ষা তো দিচ্ছি না!
পরীক্ষা দিচ্ছিস না?
না। কফিশপের আইডিয়া মাথায় আসামাত্র পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি।
জহিরের বাবা এরপরেও বেশ সহজভাবে খাওয়া শেষ করল। বেসিনে হাত ধুয়ে এসে আবার খাবার টেবিলে বসল। জহিরের খাওয়া তখনো শেষ হয় নি। জহিরের বাবা শান্তমুখে ছেলের খাওয়া দেখতে লাগল। খাওয়া শেষ হবার পর জহিরের বাবা বলল, নয় তারিখে তুই পরীক্ষা দিতে যাবি। যদি না যাস তাহলে ঐ দিনই এক বিস্ত্ৰে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি। কথা চালাচালি আমার পছন্দ না। আমি আমার কথা বলে শেষ করলাম। এই বিষয়ে নয়। তারিখ পর্যন্ত আর কোনো কথা বলব না।
জহির বলল, আচ্ছা।
হিমু, এই হলো ঘটনা। জহিরের বাবাকে আমি মোটেই দোষ দিচ্ছি। না। সে তো তাও ধৈর্য ধরে ছেলের কথা শুনেছে। আমার ইচ্ছা করছিল–খাবার টেবিলেই ঠাস করে ছেলের গালে এক চড় মারি। যাতে এক চড়ে মাথার সব আইডিয়া নাকের ফুটো দিয়ে বের হয়ে যায়।
ঐ ঘটনার পর আমি তোর খালুকে ফুলফুলিয়া মেয়েটার কথা বলেছি। আমি চিন্তা করে দেখলাম, ছেলে যেভাবে বিগড়াচ্ছে ফুলফুলিয়ার ব্যাপারটা আর গোপন রাখা ঠিক হবে না। ক্যাসেট করা কথাবার্তাও তোর খালুকে শুনিয়েছি। বেচারা যে কী পরিমাণে শকড হয়েছে তুই বিশ্বাস করবি না। তিনদিনের একটা কনফারেন্সে তার সুইডেনে যাবার কথা ছিল। এটা সে বাতিল করেছে। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল, আবার সিগারেট ধরেছে। ভোস ভোস করে দিনরাত সিগারেট টানছে। আমি কিছু বলছি না। সিগারেট টেনে যদি টেনশন কিছু কমে তাহলে কমুক। গতকাল রাতে ঢাকা ক্লাবে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরেছে। মদ খেয়ে। সিগারেটের সঙ্গে মদ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে। আবারো মদ ধরবে। চিন্তা করে। দেখ আমি কী বিপদে পড়েছি। তোর খালুকে আমি এখন কিছুই বলব না। নয় তারিখ পার হোক। তারপর দেখা যাক পানি কোন দিকে গড়ায়।
হিমুরে, আমি মহাবিপদে আছি। তোকে যে বাড়িতে আসতে বলব, তোর সঙ্গে পরামর্শ করব সেই উপায় নেই।
জহিরের বাবা তোর এ বাড়িতে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। দারোয়ানকে ডেকেও বলে দেয়া হয়েছে তুই যেন এ বাড়িতে ঢুকতে না পারিস। জহিরের বাবার ধারণা তার ছেলের এই সমস্যার মূলে আছিস তুই। তুই নাকি মানুষের মাথায় হালকা বাতাস দিয়ে আইডিয়া ঢুকিয়ে সটকে পড়িস। আমি তাকে বলেছি–এটা ঠিক না। হিমু আমাদের দলে। জহিরের কথাবার্তা খুব কায়দা করে হিমুই রেকর্ড করে এনেছে। তোর খালু। বলেছে–হিমু সব দলেই আছে। জহির যদি ফুলফুলিয়াকে বিয়ে করে তাহলে দেখা যাবে উকিল বাবাহিমু। তোর খালুর কথাও আমি ফেলতে পারছি না। বল তো আমি কী করি?
এদিকে ফুলফুলিয়া মেয়েটার বিষয়ে তোর খালুও কিছু খোঁজখবর বের করেছে। মেয়েটা কী করে শুনলে তুই মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। সে একটা ক্লিনিকে আয়ার কাজ করে। রোগীদের গু মুত পরিষ্কার করে। অবস্থাটা চিন্তা করে দেখ।
আমি মানত করেছি। সমস্যা সমাধান হলেই আজমীর শরিফে চলে যাব। খাজা বাবার দরবারে শুকরানা নামাজ পড়ব। সেখানকার এতিম মিসকিনদের একবেলা খাওয়াব। আমার যে কী রকম অস্থির লাগছে তোকে বলে বুঝাতে পারব না।
মানসিক যে অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমি চাই না সেটা আরো খারাপ হোক। তবে তুই দূর থেকে আমার একটা উপকার করতে পারিস। ফুলফুলিয়া মেয়েটার ঠিকানা দিচ্ছি। তার সঙ্গে দেখা করে এই মেয়েটার বিষয়ে আমাকে একটা রিপোর্ট দে। ভয় দেখিয়ে কিংবা লোভ দেখিয়ে জহিরের কাছ থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। এর জন্যে টাকা পয়সা যা লাগে আমি খরচ করব। কেয়ারটেকারের কাছে ঠিকানা আছে। তুই তার কাছ থেকে ঠিকানাটা নে। ওর কাছে দশ হাজার টাকাও দিয়ে দিয়েছি। প্রয়োজনে গুণ্ডা লাগিয়ে মেয়েটাকে হুমকি ধমকি দিয়ে অন্য কোথাও সরিয়ে দে। এই উপকারটা তুই আমার করা।
ইতি
তোর মাজেদা খালা
পুনশ্চ : হিমু আমার মাথাটা আসলেই খারাপ হয়ে গেছে। যে ঘটনাটা তোকে জানাবার জন্যে চিঠি লিখেছিলাম। সেই ঘটনাই জানানো হয় নি। অথচ চিঠি শেষ করে বসে আছি। আসলে আমি আর টেনশন নিতে পারছি না বলে। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেদিন মাথা ধরার ট্যাবলেট ভেবে তোর খালুর দুটা প্রেসারের ওষুধ খেয়ে ফেলেছি। তারপর দেখি ধুম করে প্রেসার নেমে যাচ্ছে। মাথায় পানি ঢালাঢালি–ডাক্তার ডাকাডাকি।
যাই হোক, মূল ঘটনাটা মন দিয়ে শোন। এখন পর্যন্ত ঘটনাটা নিয়ে কারো সঙ্গেই আলাপ করি নি। শুধু আমার কাজের মেয়ে তিনটিকে বলেছি। কাজটা ভুল হয়েছে। তিনটা মেয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। তোর খালুকে ঘটনাটা বলতে গিয়েও বলি নি। তাকে যা বলব— সে গম্ভীর হয়ে বলবে, এটা কিছু না। তুমি স্বপ্ন দেখেছি। চোখের সামনে দেখা জলজ্যান্ত জিনিসকে কেউ যদি বলে স্বপ্ন তাহলে কেমন রাগ লাগে তুইই বল?
ঘটনাটা ঘটেছে ভূমিকম্পের রাতে। তখন ঘটনাটা আমি নিজেও বুঝতে পারি নি। ভূমিকম্পের ভয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কী দেখছি বাঁ কী দেখছি না বুঝতেই পারি নি। যতই দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা ততই পরিষ্কার হচ্ছে–আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
ভূমিকম্পের রাতের কথা তোর নিশ্চয়ই মনে আছে। দরজা ভেতর থেকে লক করা। আমি দরজা খুলতে পারছি না। চাবি পাচ্ছি না। ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার উলট-পালট করছি। তোর খালু পাগলের মতো বিড়বিড় করছে। এক সময় ছুটে গেলাম জহিরের ঘরে। তখন তুই বললি বালিশের নিচে খুঁজে দেখতে। আমি গেলাম শোবার ঘরে। আমি মশারি খাটিয়ে ঘুমাই। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয়ার পর থেকে এই ব্যবস্থা। রাত আটটা বাজতেই কাজের মেয়ে মশারি খাটিয়ে দেয়। আমি গোলাম অবাক হলাম— দেখি বাড়ির চাবি। চাবি হাতে নিতে গিয়ে আরেকটা জিনিস দেখলাম— দেখি বুড়ো একজন মানুষ কুজো হয়ে মশারির ভেতর বসে আছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তখন আমার মাথাতেই নেই যে এটা একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমার মশারির ভেতর কোনো বুড়ো মানুষ বসে থাকতে পারে না। ভূমিকম্পের ভয়ে আমি এতই অস্থির যে বুড়ো মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা আমার মাথায় ঢুকাল না। আমি চাবি নিয়ে দরজা খুলে দৌড়ে নিচে চলে গেলাম।
হিমু, ব্যাপারটা কী বল তো? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আমার কি কথা বলা উচিত?
সাক্ষাতে এটা নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলব। আপাতত তুই ফুলফুলিয়ার ব্যাপারটা দেখ। প্রয়োজনে কেয়ারটেকারকে সাথে নিয়ে যা। এই ধরনের মেয়েরা হিংস্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের হাতে পোষা গুণ্ডাপাণ্ডাও থাকে। তোকে একা পেয়ে কিছু করে বসতে পারে। দুজন থাকলে কিছুটা রক্ষা। ভালো থাকিস।
ফুলফুলিয়া যার নাম তার স্বভাব-চরিত্র যাই হোক সে দেখতে খুব সুন্দর হবে। এরকম ধারণা হবেই। আমি ধরেই নিলাম মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকব। মনে মনে বলব, বাহ।
মেয়েটির বাসা ঝিকাতলায়। ঠিকানা লেখা কাগজ হাতে নিয়ে তার বাসা খুঁজছি। আর কল্পনা করছি মেয়েটা দেখতে কেমন হবে। গায়ের রঙ গৌর বর্ণ। মাথা ভর্তি চুল। কুচকুচে কালো চুল না। সামান্য পিঙ্গল ভাব আছে। অতিরিক্ত ফর্স মেয়েরা সাধারণত পিঙ্গলকেশী হয়। রোগা, গোলগাল মুখ। খুবই ছটফট স্বভাবের মেয়ে। স্থির হয়ে এক জায়গায় বসেও থাকতে পারে না। অকারণে হেসে ফেলার বাতিকও আছে। সিরিয়াস ধরনের কথাতেও মুখ আড়াল করে হাসছে।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর যে মেয়েটি দরজা খুলে দিল সে-ই যে ফুলফুলিয়া এতে আমার মনে সন্দেহের তিল মাত্ৰও নেই। অথচ কল্পনার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। শান্ত চেহারার শ্যামলা মেয়ে। রোগাটা ঠিক আছে, তবে মুখ গোলাকার না, লম্বাটে। মনে হয় রুটি বানাচ্ছিল। হাতে ময়দা লেগে আছে। ফুলফুলিয়া অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমাকে দেখে এত বিস্মিত হচ্ছে কেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমার চেহারা বিস্মিত হবার মতো না। আমি সহজ গলায় বললাম, ফুলফুলিয়া কেমন আছ?
মেয়েটা খানিকটা ভীত গলায় বলল, ভালো আছি।
রুটি বানাচ্ছিলে নাকি?
মেয়েটার গলা থেকে বিস্ময় ভাবটা চলে গেল। সেখানে চলে এলো আনন্দ। সে বলল, আপনি হিমু ভাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ। চিনেছ কীভাবে? জহির নিশ্চয়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার চেহারার বর্ণনা তোমার কাছে করেছে।
উনি কিছুই বলেন নি। উনি শুধু বলেছেন হিমু ভাইজান যদি তোমার কাছে আসেন তাহলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলবে। তিনি দেখতে কেমন, এইসব কিছু বলার দরকার নেই।
আমি যে হলুদ পাঞ্জাবি পরি এটা নিশ্চয়ই বলেছে।
না, হলুদ পাঞ্জাবির কথাও বলেন নি। বাসা অন্ধকার কেন?
বারান্দার বাতিটা চুরি হয়ে গেছে। এই জন্যে অন্ধকার। ভেতরে আসুন, ভেতরে
আলো আছে।
তুমি ছাড়া বাসায় আর কে আছে?
রহমতের মা বলে একজন মহিলা আছেন। উনি আমার পাহারাদার। উনি ছাড়া আর কেউ নেই।
তোমার বাবা কোথায়?
ফুলফুলিয়া মিষ্টি করে হেসে বলল, বাবা আমার উপর রাগ করে দুপুরবেলা চলে গেছেন। বলে গেছেন। আর ফিরবেন না।
প্রায়ই কি এরকম রাগ করে চলে যান?
জ্বি।
রাগ ভেঙে গেলে দিনে দিনেই কি ফেরেন?
না, সব দিন ফেরেন না। এমনও হয়েছে চার পাঁচদিন পরে ফিরেছেন।
আমি ফুলফুলিয়ার সঙ্গে একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরে সস্তার একটা খাট পাতা আছে। টেবিল চেয়ার আছে। আলনা আছে। আলনার কাপড়-চোপড় দেখে মনে হচ্ছে এই ঘরে ফুলির বাবা ঘুমান।
হিমু ভাইজান, দুধ ছাড়া এককাপ চা খাবেন?
খাব।
ঘরে খুব ভালো ঘি আছে। গরম রুটিতে ঘি মাখিয়ে চিনি দিয়ে দেই?
দাও।
ফুলফুলিয়া খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, উনি বলছিলেন। আপনি নাকি একজন মহাপুরুষ। আপনি যে-কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারেন। এটা কি সত্যি?
না, এটা সত্যি না।
আপনি কি মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?
তাও পারি না।
তাহলে উনি কেন এত বড় গলায় আপনার কথা বললেন? আপনি কী পারেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি সুখে এবং দুঃখে মানুষের পাশে থাকতে পারি।
সে তো সবাই পারে। আপনার বিশেষত্ব কী?
আমার বিশেষত্ব হচ্ছে। আমি সব সময় একটা হলুদ পাঞ্জাবি পারি। সবাই হলুদ পাঞ্জাবি পরে না।
সব সময় হলুদ পাঞ্জাবি কেন পরেন?
হলুদ পাঞ্জাবি পরার প্রধান কারণ হচ্ছে–হলুদ রঙের কাপড় সহজে ময়লা হয় না। একবার ধুয়ে অনেক দিন পরা যায়।
এটাকে বললেন প্ৰধান কারণ। অপ্রধান কারণ কী?
অপ্রধান কারণ আমার বাবা। তিনি মহাপুরুষ বানাবার একটা স্কুল খুলেছিলেন। আমি ছিলাম স্কুলের একমাত্র ছাত্র। হলুদ পাঞ্জাবি হলো স্কুল ড্রেস। বাবার ধারণা হয়েছিল গেরুয়া বৈরাগ্যের রঙ। গেরুয়া রঙের কাপড় পরলে মনে বৈরাগ্য আসে। মহাপুরুষদের বৈরাগ্য থাকতে হয়।
ফুলফুলিয়া কথা শুনে মজা পাচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ফুলফুলিয়ার পাহারাদারও একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল। মৈনাক পর্বতের মতো শরীর। সাধারণভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিন্তু ফোস ফোঁস শব্দ হচ্ছে। এ রকম পাহারাদার থাকলে আর চিন্তা নেই। ফুলফুলিয়া বলল, আপনার বাবা কি সত্যি সত্যি আপনাকে মহাপুরুষ বানাবার চেষ্টা করেছিলেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বাবা রীতিমতো স্কুল খুলে বসেছিলেন!। স্কুলের তিনিই প্রিন্সিপাল, তিনিই শিক্ষকমণ্ডলি, তিনিই ড্রিল স্যার। এত করেও শেষ রক্ষা হয় নি। স্কুল থেকে পাশ করে বের হবার আগেই বাবার মৃত্যু। বাবার মৃত্যু মানেই প্রিন্সিপাল স্যারের মৃত্যু, শিক্ষকমণ্ডলির মৃত্যু এবং ড্রিল স্যারের মৃত্যু।
নিজের বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা এত সহজভাবে বলছেন?
মহাপুরুষ স্কুলের ট্রেনিং-এর কারণে বলতে পারলাম। ট্রেনিং না থাকলে বাবার মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে যেত। চোখ ভেজা ভেজা হয়ে যেত। তুমি তাড়াতাড়ি রুটি বানিয়ে নিয়ে এসো। খাওয়া-দাওয়ার পর ইন্টারভ্যু পর্ব।
কীসের ইন্টারভ্যু?
মাজেদা খালাকে তোমার সম্পর্কে একটা রিপোর্ট দিতে হবে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
কিছু বুঝতে না পারা খুবই ভালো কথা। যত কম বুঝবে তত ভালো। কাগজ-কলম আছে না? কাগজ কলম দাও–আমি পয়েন্টগুলো লিখে নেই। কী কী প্রশ্ন করব ঠিক করি।
ফুলফুলিয়া আনন্দিত গলায় বলল, আমার এখন রুটি বানাতে ইচ্ছে করছে না। আপনার প্রশ্নগুলো শুনতে ইচ্ছে করছে।
ঠিক আছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব আগে শেষ হোক।
ফুলফুলিয়া কাগজ-কলম। এনে দিল। খাটের উপর বসল। আনন্দ ও উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করছে। আমি বললাম, তোমার নাম কী?
ফুলফুলিয়া।
ফুলফুলিয়া কোনো নাম না, ভালো নাম বলো।
আক্তারী জাহান।
বয়স?
একুশ।
উচ্চতা?
বলতে পারছি না। উচ্চতা কখনো মাপি নি।
ওজন নিয়েছ? ওজন কত?
ওজনও নেই নি।
যাই হোক অনুমান করে লিখে নিচ্ছি— উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ। ওজন পঞ্চাশ কেজি। পড়াশোনা কি?
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছি।
কোন ডিভিশন?
ফাস্ট ডিভিশন।
বর্তমানে কী করছ?
আমাদের এখানে একটা ক্লিনিক আছে। ক্লিনিকে শমসের আলি বলে একজন ডাক্তার আছেন। আমি তার রোগীদের সিরিয়েল দেই।
ক্লিনিকে আয়ার কাজ কখনো করেছ?
জ্বি করেছি। শুরুতে তাই করতাম। ডাক্তার চাচা সেখান থেকে আমাকে নিয়ে রোগী দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন।
কী খেতে পছন্দ? আলাদা করে আইটেম বলবে। মাছের মধ্যে কোন মাছ?
ইলিশ মাছ।
ভর্তার মধ্যে কোন ভর্তা?
শুকনা মরিচের ভর্তা।
পোলাও, ভাত, খিচুড়ি –এই তিনটের মধ্যে কোনটা পছন্দ?
খিচুড়ি।
শুকনা খিচুড়ি না ঢলঢালা খিচুড়ি?
শুকনা।
পছন্দের ফুল?
যুঁই ফুল।
একজন খুব পছন্দের মানুষের নাম বলো।
ফুলফুলিয়া হেসে ফেলল।
আমি বললাম, হাসছ কেন?
ফুলফুলিয়া বলল, হাসছি কারণ আমি যখনই আমার খুব পছন্দের মানুষের নাম বলব। আপনি বিশ্বাস করবেন না। কারণ আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ হচ্ছেন আপনি অথচ আপনার সঙ্গে মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমার দেখা হয়েছে।
তোমার খুব অপছন্দের একজন মানুষের নাম বলো।
আমার বাবা।
জহির তোমার খুব পছন্দের তালিকায় নেই?
না। তিনি মোটামুটি পছন্দের একজন।
মোটামুটি পছন্দের একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছ?
ফুলফুলিয়া চমকে উঠে বলল, তাকে আমি কেন বিয়ে করব?
বিয়ের কোনো কথা তার সঙ্গে তোমার হয় নি?
না।
জহির তো বিয়ে করার জন্যে খুবই ভালো ছেলে। জহির যে কত ভালো ছেলে সেই সার্টিফিকেট কিন্তু আমি তোমাকে দিতে পারি।
সার্টিফিকেট দিতে হবে না। মানুষের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মানুষটা ভালো না মন্দ।
তাই না কি?
হ্যাঁ তাই। পুরুষ মানুষের পক্ষে হয়তো এটা বোঝা সম্ভব না। কিন্তু সব মেয়ের এই ক্ষমতা আছে।
জহির তো পরিকল্পনা করে রেখেছে তোমাকে কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে করবে। বিয়েতে আমি একজন সাক্ষী। তোমার তরফ থেকে যদি কোনো সাক্ষী না পাওয়া যায় দ্বিতীয় সাক্ষীও আমিই জোগাড় করব।
কী সর্বনাশ! এইসব আপনি কী কথা বলছেন!! আমার তো বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী নাইক্ষ্যংছড়ি পোস্টাপিসের পোস্টমাষ্টার। ঐ এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালিতে ঝামেলা হচ্ছে এই ভয়ে সে আমাকে নিতে চায় না।
আমি বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, পবিত্ৰ গাভী।
ফুলফুলিয়া বলল, পবিত্ৰ গাভী মানে কী?
হলি কাউ। ঐটাই বাংলা করে বললাম— পবিত্ৰ গাভী।
ফুলফুলিয়া বলল, পবিত্ৰ গাভী তো আপনার আগে আমার বলা উচিত।
বলো। ফুলফুলিয়া খুব গম্ভীর গলায় বলল, পবিত্ৰ গাভী। বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল।
আমি বললাম, যাও রুটি বানিয়ে নিয়ে এসো। বেশি রাত করা যাবে না। মাজেদা খালার কেয়ারটকার অপেক্ষা করছে। তোমার উপর প্রতিবেদনটা হাতে হাতে নিতে যাবে।
মাজেদা খালাটা কে?
মাজেদা খালা হচ্ছেন তোমার হলেও হতে পারত শাশুড়ি। খুবই ইন্টারেস্টিং মহিলা। লোকজন গাছের ওপর ভূত বসে থাকতে দেখে। উনি একমাত্র মহিলা যিনি তাঁর শোবার ঘরের মশারির ভেতর ভূত বসে থাকতে দেখেন। বৃদ্ধ ভূত। old man and the sea-এর মতোই Old man and the mosquito net.
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কথা বোঝার দরকার নেই। তুমি তোমার কাজ কর। আমি এখানে বসেই প্রতিবেদনটা লিখে ফেলি। দীর্ঘ প্রতিবেদনের দরকার নেই। ঘটনা যা দাঁড়িয়েছে সংক্ষিপ্ত চিঠি দিয়েই কাজ। সারা যায়। মাজেদা খালাকে সংক্ষেপ করে আমি লিখলাম প্রিয় মাখালা। অন্যরকম একটা অর্থ দাঁড়িয়ে গেল। চিঠির শুরুই হলো রহস্যময়।
প্রিয় মা-খালা,
ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই মুহুর্তে আমি ফুলফুলিয়ার বাবার শোবার ঘরে বসে আছি। ফুলফুলিয়া রুটি সেঁকতে গিয়েছে। চা-রুটি খেয়ে চলে আসব। ফুলফুলিয়া মেয়েটার বায়োডাটা আলাদা একটা কাগজে লিখে দিলাম। ওজন এবং উচ্চতা অনুমানে লিখলাম। এই দুটি তথ্যে কিছু ভুল থাকতে পারে।
মেয়েটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত না হবার একশটি কারণ আছে। আমি শুধু একটা কারণ উল্লেখ করব। কারণটা হলো— বারুদ ভেজা।। মনে হচ্ছে তুমি কিছু বুঝতে পারছি না? আমি ব্যাখ্যা করে বলি। একবার যুদ্ধের সময় এক গোলন্দাজ সেনাপতির দায়িত্ব ছিল পাহাড়ের ওপর অবস্থান নেওয়া। সেখান থেকে যখন সে দেখবে শক্ৰ আসছে তখন সে গোলাবর্ষণ করবে।
শক্ৰ এলো ঠিকই কিন্তু গোলন্দাজ সেনাপতি গোলাবর্ষণ করল না। তাকে কোর্টমার্শাল করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে বলা হলো গোলাবর্ষণ না করার পেছনে তোমার কি কোনো বক্তব্য আছে?
সেনাপতি বলল, গোলাবর্ষণ না করার পেছনে আমার একশ দুটা যুক্তি আছে। তার প্রথমটা হলো–আগের রাতে প্ৰচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। সব বারুদ গেছে ভিজে।
বিচারপতি বললেন, বাকি একশ একটা যুক্তি বলতে হবে না। বারুদ ভেজা এই একটাই যথেষ্ট। যাও তুমি খালাস।
ফুলফুলিয়ার ব্যাপারে বারুদ ভেজার অর্থ হলো— মেয়েটা বিবাহিতা। তার স্বামী নাইক্ষ্যংছড়িতে আছে। পোস্টমাস্টার। পাহাড়ি-বাঙালি সমস্যার কারণে স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারছে না ঠিকই কিন্তু পোস্টমাস্টার হবার সুবাদে প্রতিদিনই একটা করে চিঠি লিখে পাঠাচ্ছে।
আশা করি ফুলফুলিয়ার ব্যাপারে তোমার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে। এখন বলো তোমার বৃদ্ধ ভূতের খবর কী? তাকে কি আবারো দেখেছি? আগেরবার সে বিছানায় বসে ছিল। এখনো কি বসা অবস্থায় পেয়েছ? বসতে পেলেই শুতে চায় এই প্রবচন ভুতদের বেলাতেও যদি খাটে তাহলে এর পরের বার শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখার কথা। তুমি ভালো থেকো।