আজকাল রাতের বেলা আমেনার ঘরে শোয় মকবুল। টুনি থাকে পাশের ঘরে। আগে, ফাতেমা আর ও দুজনে এক সঙ্গে থাকতো। মাসখানেক হলো ফাতেমা বাপের বাড়ি গেছে। এখন টুনি একা। রাতের বেলা ইচ্ছেমত যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ালেও ধরবার উপায় নেই। রাত জেগে মাছ ধরাটা ইদানীং একটা নেশা হয়ে গেছে ওদের। ঘুঘুটে অন্ধকার রাতে গ্রামের এ পুকুর থেকে অন্য পুকুরে জাল মেরে বেড়ায় ওরা। হাতে একটা টুকড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকে টুনি। জালে ওঠা মাছগুলো ওর মধ্যে ভরে রাখে।
পর পুকুরের মাছ ধরতে গিয়ে সমস্ত সময় সজাগ থাকতে হয় ওদের। চারপাশে দৃষ্টি রাখতে হয়। একদিন প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলো দুজনে। জমীর মুন্সির বড় পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলো সেদিন। আকাশে চাঁদ ছিলো কিন্তু চাদনী ছিলো না। কালো মেঘে ছেয়ে ছিলো পুরো আকাশটা।
এক হাঁটু পানিতে নেমে জালটাকে সন্তর্পণে ছুঁড়ে দিয়েছিলো সে। পুকুরের মাঝখানটাতে। শব্দ হয় নি মোটেও। কিন্তু পুকুর পাড় থেকে জোর গলায় আওয়াজ শোনা গেল, কে, কে জাল মারে পুকুরে?
এক হাঁটু পানি থেকে নীরবে এক গলা পানিতে নেমে গেলো মন্তু। টুনি ততক্ষণে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।
জমীর মুন্সির হাতের টর্চটা বিদ্যুদ্বেগে ছুটে গেল পুকুরের এপার থেকে ওপারে। মনে মনে বার বার খোদাকে ডাকছিলো মন্তু, খোদা তুমিই সব।
একটু পরে পাড়ের ওপর থেকে টুনির চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো, এই উইঠা আহ। মুন্সি চইলা গেছে। বলে খিল খিল করে হেসে উঠে সে। ওর হাসির শব্দে রাগে সমস্ত দেহটা জ্বালা করে উঠেছে মন্তুর। এমন সময়ে মানুষ হাসতে পারে?
তারপর থেকে আরো সাবধান হয়ে গেছে মন্তু। গনু মোল্লার কাছ থেকে তিন আনা পয়সা খরচ করে একটা জোরদার তাবিজ নিয়েছে সে। রাতে বিরাতে গাঁয়ের পুকুরে মাছ ধরে বেড়ানো, বিপদ আপদ কখন কি ঘটে কিছুতো বলা যায় না। আগে থেকে সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো। সগন শেখের পুকুর পাড়ে এসে, বাজুর ওপরে বাঁধা তাবিজটাকে আর একবার ভাল করে দেখে নিলো মন্তু। তারপর বুনো লতার ঝোপটাকে দুহাতে সরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলো সে। টুনি পেছন থেকে বললো, বারে, অত জোরে হাঁটলে আমি চলি কি কইরা? মন্তু জালটাকে গুছিয়ে নিতে নিতে বললো, আস্তে আহ, তাড়া কিসের? টুনি বলে বারে, আমার বুঝি ডর ভয় কিছুই নাই। যদি সাপে কামড়ায়? সাপের কথা বলতে না বলতেই হঠাৎ একটা অ্যাঁধি সাপ ফোঁস করে উঠে সরে যায় সামনে থেকে। অ্যাঁতকে উঠে দুহাত পিছিয়ে আসে মন্তু। ভয় কেটে গেলে থুতু করে বুকের মধ্যে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দেয় সে। পেছনে টুনির দিকে তাকিয়ে বলে, বুকে থুক দাও তাইলে কিছু অইবো না। কোন রকম বিতর্কে না এসে নীরবে ওর কথা মেনে নেয় টুনি। কপালটা আজ মন্দ ওদের। অনেক পুকুর ঘুরেও কিছু চিংড়ি গুঁড়ো ছাড়া আর কিছু জুটল না। মাছগুলো কেমন যেন সেয়ানা হয়ে গেছে। পুকুরের ধারে কাছে থাকে না। থাকে গিয়ে একেবারে মাঝখানটিতে, এতদূর জাল উড়িয়ে নেয়া যায় না। টুনি বলে থাক, আইজ থাউক, চলো বাড়ি ফিইরা যাই। জালটাকে ধুয়ে নিয়ে মন্তু আস্তে বলে, চলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুলো হাতটা কোলে নিয়ে বসে বসে আবুল আর হালিমার ঝগড়া দেখছিলো মকবুল।
অনেকক্ষণ কি একটা বিষয় নিয়ে তর্ক চলছে ওদের মধ্যে। দাওয়ায় বসে বসে যা মুখে আসছে ওকে বলে যাচ্ছে আবুল। হালিমাও একেবারে চুপ করে নেই। উঠানে একটা লাউয়ের মাচা বাধতে বাঁধতে দুএকটা জবাবও দিচ্ছে সে মাঝে মাঝে।
মকবুল হাতের ব্যথায় মৃদু কাতরাচ্ছিলো আর পিটপিট চোখে তাকাচ্ছিলো ওদের দিকে। হঠাৎ দাওয়া থেকে ছুটে এসে মূহুর্তে হালিমার চুলের গোছাটা চেপে ধরলো আবুল। তারপর কোন চিন্তা না করে সজোরে একটা লাখি বসিয়ে দিলো তলপেটে। উঃ মাগো, বলে পেটটা দুহাতে চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লো হালিমা। রাগে তখন ফোপাচ্ছে আবুল, আমার ঘরের ভাত ধ্বংস কইরা রাস্তার মানুষের লগে পিরীত। জানে খতম কইরা দিমু না তোরে। কাইটা রাস্তায় ভাসায় ডিমু না। বলে আবার ওর চুলের গোছাতে হাত দিতে যাচ্ছিলো আবুল, বুড়ো মকবুল চিৎকার করে উঠলো, খবরদার আবুইল্যা, তুই যদি বউ-এর গায়ে আরেকবার হাত তুলছস তাইলে ভালো অইবো না কিন্তুক।
আমার ঘরণীর গায়ে আমি হাত তুলি কি যা ইচ্ছা তাই করি, তুমি কইবার কে, অ্যাঁ? পরক্ষণে আবুল জবাব দিলো, তুমি যখন তোমার ঘরণীরে তুলা পেড়া কর তহন কি আমরা বাধা দেই?
অমন কোণঠাসা উত্তরের পর আর কিছু বলার থাকে না মকবুলের। শুধু জুলন্ত দৃষ্টিতে এক নজর ওর দিকে তাকালো মকবুল। আবুল তখন ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে চলেছে হালিমাকে। ভেতরে নিয়ে ঝাঁপি বন্ধ করে মনের সুখে মারবে। ওর ইচ্ছে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো হালিমা। তাই মাটি অ্যাঁকড়ে ধরে গোঙাতে লাগলো সে, ওগো তোমার পায়ে পড়ি। আর মাইরো না, মইরা যামু।
চুপ, চুপ, তীব্র গলায় ওকে শাসিয়ে ঝাঁপিটা বন্ধ করে দেয় আবুল। হেঁচকা টানে ওর পরনের হেঁড়া ময়লা শাড়িটা খুলে নিয়ে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। তালি দেয়া পুরান ব্লাউজটা অ্যাঁটসাঁট করে বাঁধা ছিলো টেনে সেটাও খুলে ফেলে আবুল। তারপর দু’পায়ে ওর নগ্ন দেহটাকে প্রচণ্ডভাবে মাড়াতে থাকে সে।
বেড়ার সঙ্গে পুরান একটা ছড়ি ঝোলান ছিলো। সেটা এনে হালিমার নরম তুলতুলে কপালে কয়েকটা অ্যাঁচড় টেনে দেয় আবুল। এইবার পিরীত কর। আরো পিরীত কর। রাস্তার মানুষের লগে।
আহারে। এর মাইয়াডারে মাইরা ফালাইস না। ওরে ও পাষাইন্যা, দরজা খোল মারিস আর মারিস না, জাহান্নামে যাইবি, মারিস না। বাইরে থেকে দু’হাতে ঝাঁপিটাকে ঠেলছে ফকিরের মা। অবুল একবার তাকালো সেদিকে কিন্তু ঝাঁপি খুললো না।
বউ মারায় একটা পৈচাশিক আনন্দ পায় আবুল। পান বিডির মত এও যেন একটা নেশা হয়ে গেছে ওর। মেরে মেরে এর আগে দু’দুটো বউকে প্রাণে শেষ করে দিয়েছে সে।
প্রথম বউটা ছিলো এ গাঁয়েরই মেয়ে। আয়েশা। একটু বেঁটে একটু মোটা আর রঙের দিক থেকে শ্যামলা। অপূর্ব সংযম ছিলো মেয়েটির। অপূর্ব শান্তি স্বভাব। কত মেরেছে ওকে আবুল। কোনদিন একটু শব্দও করে নি। পিঠটা বিছিয়ে দিয়ে উপুর হয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। কিল, চাপড়, ঘুষি ইচ্ছেমত মারতো আবুল।
একটা সামান্য প্রতিবাদ নেই।
প্রতিরোধ নেই।
শুধু আড়ালে নীরবে চোখের পানি ফেলতো মেয়েটা।
তারপর একদিন ভীষণভাবে রক্তবমি শুরু হলো ওর। জমাট বাঁধা কালো কালো রক্ত। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মারা গেলো আয়েশা।
আয়েশা টিকেছিলো বছর তিনেক। তার পরেরটা কিন্তু ওর চাইতেও কম। মাত্র দুবছর।
অবশ্য জমিলার মাত্র দুবছর টিকে থাকার পেছনে একটা কারণও আছে। ও মেয়েটা ছিলো একটা বাচাল গোছের আর একটু রুক্ষ মেজাজের। সহজে আবুলের কিল চাপড়গুলো গ্রহণ করতে রাজি হতো না সে। মারতে এলে কোমরে অ্যাঁচল বেঁধে রুখে দাঁড়াতো।
হাজার হোক মেয়েতো। পুরুষের সঙ্গে পারবে কেন? বাধা দিতে গিয়ে পরিণামে আরো বেশি মার খেতো জমিলা। ও যখন মারা গেল আর ওর মৃত দেহটা যখন গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করছিলো সবাই তখন ওর সাদা ধবধবে পিঠের ওপর সাপের মত অ্যাঁকাবাকা ফুলে ওঠা রেখাগুলো দেখে শিউরে উঠেছিলো অনেকে। ওরে পাষাইন্যারে এমন দুধের মত মাইয়াটারে শেষ করলি তুই।
আয়েশা মারা যাবার পর অবশ্য ভীষণ কেঁদেছিলো আবুল। গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছিলো সারা উঠোনে। পাড়াপড়শীদের বলেছিলে, আহা বড় ভালো বউ আছিলো আয়েশা। আমি পাষাইন্যা তার কদর বুঝলাম না। আহারে এমন বউ আর পামু না জীবনে।
আয়েশার শোকে তিনদিন এক ফোঁটা দানাপানিও মুখে পোরে নি আবুল। তিন রাত কাটিয়েছে ওর কবরের পাশে বসে আর শুয়ে। পাড়াপড়শীরা ভেবেছিলো ওর চরিত্রে বুঝি পরিবর্তন এলো এবার। এবার ভালো দেখে একটা বিয়ে শাদি করিয়ে দিলে সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার করবে আবুল।
কিন্তু জমিলার সঙ্গেও সেই একই ব্যবহার করেছে আবুল। একই পরিণাম ঘটেছে জমিলার জীবনেও।
দ্বিতীয় বউ-এর মৃত্যুতে আবুলের গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার কোন মূল্য দেয় নি পড়শীরা। মুখে বিরক্তি এনে বলেছে, আর অত ঢঙ করিস না আবুইল্যা। তোর ঢঙ দেইখলে গা জ্বালা করে।
আমার বউ-এর দুঃখে আমি কাঁদি, তোমাগো গো জ্বালা করে ক্যান? ওদের কথা শুনে ক্ষেপে উঠে আবুল। কপালে এক মুঠো ধুলো ছুঁইয়া সহসা একটা প্রতিজ্ঞা করে বসে সে, এই তৌবা করলাম বিয়া শাদি আর করমু না খোদা, আমারে আর বিয়ার মুখ দেখাইও না। খোদা, আমার শত্রুরা আরামে থাহুক। বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে আবুল।
পড়শীরা গালে হাত দিয়ে বলেছে, ইয়া আল্লা, এই কেমনতর কথা। বউ মারলি তুই, সেই কথা বইলা কি শতামি করলাম নাকি আমরা। সাচা কথা কইলেই তো মানুষ শত্রু হয়।
ঠিক কইছ বঁইচির মা, সাচা কথা কইলেই এমন হয়। তা, আমাগো কইবারও বা দরকার কি। ওর বউরে মারুক কি কাটুক কি নদীতে ভাসায়া দিক, আমাগো কি আছে তাতে।
সেদিন থেকে আবুলের সাতে পাঁচে আর কেউ নেই ওরা।
আজকাল হালিমাকে যখন প্রহর অন্তর একবার করে মারে আবুল তখন কেউ কিছু বলে। চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে বুড়ো মকবুল এক-আধটু বাধা দেবার চেষ্টা করে। আবুইল্যা তোর কি মানুষের পরান না, এমন কইরা যে মারছ বউডারে তোর মনে একটুও চোট লাগে না আবুইল্যা? বউদের অবশ্য মকবুলও মারে। তাই বলে আবুলের মত অত নির্দয় হওয়াটা মোটেই পছন্দ করে না সে। মারবি তো মার; একটুখানি সইয়া মার। অপরাধের গুরুত্ব দেইখা সেই পরিমাণ মার। এ হলো মকবুলের নিজস্ব অভিমত। অপরাধ, এমন কোন সাংঘাতিক করে নি হালিমা। পাশের বাড়ির নুরুর সঙ্গে কি একটা কথা বলতে গিয়ে হেসেছিলো জোরে। দূর থেকে সেটা দেখে গা জ্বালা করে উঠেছে আবুলের। একটা গভীর সন্দেহে ভরে উঠেছে মন।
এমন মন খোলা হাসিতো আবুলের সঙ্গে কোনদিন হাসে নি হালিমা।
বেহুঁশ হালিমাকে ভেতরে ফেলে রেখে আবুল যখন বাইরে বেরিয়ে এলো তখন সর্বাঙ্গে ঘামের স্রোত নেমেছে ওর। পরনের লুঙ্গি দিয়ে গায়ের ঘামটা মুছে নিয়ে দাওয়ার ওপর দম ধরে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিলো আবুল। মাটির কোটাকে নেড়েচেড়ে কি যেন দেখলো, তারপর কলকেটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
রশীদের বউ সালেহা উঠোনে বসে চাটাই বুনছিলো। আবুলকে এদিকে আসতে দেখে মুখ টিপে হেসে বললো, বউ-এর পিরীত বুঝি আর সইলো না মিয়ার।
আর সইব, বহুত সইছি। মুখ বিকৃত করে পুরনো কথাটাই আবার বলে গেলো আবুল, আমার ঘরের ভাত খাইয়া রাস্তার মানুষের সঙ্গে পিরীত। তুমি কও ভাবী, এইডা কি সহ্য করন যায়।
হ্যাঁ তাতো খাঁটি কথাই কইছ। সালেহা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ঘরনী যদি মনের মত না হয় তাইলে কি তারে নিয়ে আর সুখে ঘর করন যায়? আর ভাবী দুনিয়াদারী আর ভাল লাগে না। ইচ্ছা করে দুই চোখ যেই দিকে যায় চইল্যা যাই। বলে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে আবুল। তারপর সালেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, চুলায় আগুন আছে? একটু আগুন দাও।
এই দিই, বলে কলকেটা হাতে নিয়ে ঘরের ভিতরে চলে গেলো সালেহা। একটু পরেই আবার বেরিয়ে এলো সে। ও কাছে আসতে গলার স্বরটা একেবারে খাদে নামিয়ে এনে আবুল বললো, আইজ আর ছাড়ি নাই ভাবী। যতক্ষণ পারছি মারছি। তুমি একটু তেল গরম কইরা মালিশ কইরা দিও ওর গায়ে। হাড্ডি না দুই একখান ভাইঙ্গা গেছে কে জানে। তাইলে তো বড় বিপদ অইবো। কাম কাজ কত পইর্যা রইছে। সব কিছু বন্ধ অইয়া যাইবো।
সেই কথা আগে খেয়াল আছিলো না মিয়ার? সালেহা মুখ বাঁকালো। কাম কাজের যখন ক্ষতি অইবো জান, তহন না মারলেই পাইরতা। মালা ক্যান।
উহু, আবুল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, মারছি ঠিক করছি, না মারলে আস্কারা পাইয়া যাইতো।
আর আস্কারা কি এমনে কম পাইছে। চারদিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে চাপা স্বরে সালেহা বললো, নূরুর সঙ্গে কি আজকা কথা কইছে? ওতো রোজ রোজ কথা কয়।
কি? চোখ জোড়া আবার ধপ করে জ্বলে উঠলো আবুলের। আমারে এতদিন কও নাই ক্যান?
সালেহা বললো, কি দরকার বাপু আমাগো মিছামিছি শত্রু বইনা। কইম গেলে তো অনেক কথাই কইতে অয়। তাকি আর একদিনে শেষ করা যায়।
কি কথা কও ভাবী। খোদার কসম ঠিক কইরা কও। তামাক খাওয়াটা একবারে ভুলে গেলো আবুল।
সালেহা আস্তে করে বললো, যাই কও বাপু কারো বদনাম করার অভ্যাসই আমার নাই। কিন্তুক কই কি এই বউডা তোমার বড় ভালো হয় নাই। আমরা তো আয়শারেও দেখছি, জমিলারেও দেখছি। ওরাতো আমাগো হাতের ওপর দিয়েই গেছে। চরিত্রে ওগো তুলনা আছিলো না। কিন্তু হালিমার স্বভাব চরিত্র বাপু আমার বড় ভালো লাগে না। বলতে গিয়ে বার কয়েক কাশলো সালেহা। কাশটা গিলে নিয়ে আবার সে বললো, ইয়ে মানে, বাইরের মানুষের সঙ্গে হাসাহাসি আর ঢলাঢলি। একটুহানি লজ্জা শরমও তো থাকা চাই। কথা শেষে আবুলের রক্তলাল চোখ জোড়া দিকে দৃষ্টি পড়তে রীতিমত ভয় পেয়ে গেলো সাহেলা। একটু ধমকের সুরে বললো, দেইখো বাপু, তুমি মাইয়াডারে মারতা শুরু কইরো না। এমনিতেই বহুত মারছ। এতে যদি শিক্ষা না হয় তাইলে আর জন্মেও হইবো না। সালেহার কথাটা শেষ হবার আগেই সেখান থেলে চলে গেছে আবুল। কল্কেটা নিয়া যেতে ভুলে গেছে সে। একটু পরে আবার হালিমার কান্নার শব্দ শোনা গেলো ঘর থেকে। আবুল আবার মারছে তাকে।
এতক্ষণ ঘুম থেকে উঠলো টুনি।
এত শিঘ্রী উঠতো না সে, বুড়ো মকবুলের ধমক খেয়ে শুয়ে থাকাটা নিরাপদ মনে করলো না। মনে মনে বুড়োকে এক হাজার একশো অভিশাপ দিলো। চোখজোড়া জ্বালা করছে তার। মাথাটা ঘুরছে। সারা দেহে বিশ্রী এক অবসাদ। ছড়ানো শাড়িটা চাটাইয়ের ওপর থেকে গুটিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো টুনি। ঘরের পাশে ছাইয়ের গাদা থেকে একটা পোড়া কাঠের কয়লা তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরের দিকে চলে গেলো। একগলা পানিতে নেমে মন্তু গোছল করছে পুকুরে।
ঘোলাটে পানি আরো ভোলা হয়ে গেছে।
কতগুলো হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে সাঁতার কাটছে এপার থেকে ওপারে। আর মাঝে মাঝে মুখটা পানিতে ডুবিয়ে চ্যাপটা ঠোট দিয়ে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা।
কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো ঘাটের এককোণে এসে নীরবে বসলো টুনি। পা জোড়া পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে এ মলে দাঁতন করতে করতে হঠাৎ তার নজরে এলো মন্তর পিঠের ওপর একটা লম্বা কাটা দাগ। মনে হলো কিছুক্ষণ আগেই বুঝি কিছুর সঙ্গে লেগে চিরে গেছে পিটটা। ওমা, বলৈ মুখ থেকে হাত নামিয়ে নিলো টুনি, এই এই শোন। মন্তু ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, কি, কি হইছে?
এই দিকে আহ না, আহ না এই দিকে।
কাছে আসতে ওর পিঠটাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বললো, এইখানটা চিরলো কেমন কইরা, অ্যাঁ?
মন্তু হেসে দিয়ে বললো, গতকাল রাতে সগন শেখের পুকুর পাড়ে একটা বুনো লতার কাঁটা লাগছিলো পিঠে।
টুনির চোখ জোড়া মুহূর্তে করুণ হয়ে এলো। দরদ ভরা কণ্ঠে সে আস্তে করে বললো, চলো কচু পাতার ক্ষির লাগাইয়া বাইন্দা দি, নইলে পাইকা যাইবো, শেষে কষ্ট পাইবা।
মন্তু আবার একগলা পানিতে নেমে যেতে যেতে বললো, দূর কিছু অইবো না আমার।
টুনি কিছু বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ মকবুলের উঁচু গলার ডাকে ওর কথায় ছেদ পড়লো।
কই টুনি বিবি, বলি বিবিজানের মুখ ধোয়ন কি এহনো অইলো না নাকি? রান্না ঘর থেকে চিৎকার করছে বুড়ো মকবুল। কাল রাতে যে ধানগুলো ভানা হয় নি সেগুলো ভানতে হবে এখন। হাত ভেঙ্গে ফুলে গেলেও সহজে বসে থাকার পাত্র নয় মকবুল।
তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে বুড়োর মৃত্যু কামনা করতে করতে ঘাট থেকে উঠে গেলো টুনি।
মন্তুর কোন জমিজমা নেই।
পরের জমিতে খেটে রোজগার করে। লাঙ্গল চষে। ধান বোনে। আবার সে ধান পাকলে পরে কেটে এনে মালিকের গোল ভর্তি করে। তারপর ধানের মরশুম শেষ হয়ে গেলে কলাই, মুগ, তিল সরিষার ক্ষেতে কাজ করে মন্তু। মাঝে মাঝে এ বাড়ি ও বাড়ি লাকড়ি কাটার চুক্তি নেয়। পাঁচ মণ এক টাকা। কোন কোন দিন আট নয় মণ লাকড়িও কেটে ফেলে সে। মাঝে কিছুকাল মাঝি-বাড়ির নন্তু শেখের ছেলে করিম শেখের সঙ্গে নৌকা বেয়েছিলো মন্তু। নৌকায় পাল তুলে অনেক দূরের গঞ্জে চলে যেতো ওরা। ওখান থেকে যাত্রী কিংবা মাল নিয়ে ফিরতো। ক্ষেতের রোজগারের চেয়ে নৌকায় রোজগার অনেক বেশি।
মাচাঙের উপর থেকে আধ ময়লা ফতুয়াটা নামিয়ে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে মন্তু ভাবলো, আজ একবার করিম শেখের সঙ্গে দেখা করবে গিয়ে। তখন সন্ধ্যার কালো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে গ্রামের বুকে। মিয়া বাড়ির মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। মাথায় টুপিটা পরে নিয়ে ছবি হাতে নামাজ পড়তে চলেছেন গনু মোল্লা। মোগ হাঁসগুলো সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবার পর এখন উঠোনের এককোণে এসে জটলা বেঁধেছে। একটু পরে যার যার খোয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে ওরা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো মন্তু।
মাঝি-বাড়িটা বেশি দূরে নয়।
সগন শেখের পুকুরটাকে বাঁ দিকে রেখে ডান দিকে মিয়াদের খেজুর বাগানটা পেরিয়ে গেলে দুটো ক্ষেত পরে মাঝি-বাড়ি। বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে নন্তু শেখের গরু ঘরে পেছন থেকে একটা লোম ওঠা হাড় বের করা কালো কুকুর দৌড়ে এসে বিকট চিৎকার জুড়ে দিলো। হেই হেই করে কুকুরটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলো সে।
দেউড়ির সামনে বাঁশের উপরে ঝুলিয়ে রাখা সুপুরি পাতার ঝালরের আড়াল থেকে একটা গানের কলি গুন্গুন্ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলো আম্বিয়া।
আরে মন্তু ভাই দেহি। কি খবর?
মন্তু বললো, করিম আছে নাহি?
মাথার চুলগুলো খোঁপার মধ্যে গুটিয়ে নিতে নিতে আম্বিয়া বললো, আছে।
আইজ কয়দিন থাইকা জ্বর অইছে ভাইজানের।
কি জ্বর? কহন অইছে? মন্তুর চোখে উৎকণ্ঠা।
আম্বিয়া আস্তে করে বললে, পরশু রাইত থাইকা অইছে। কি জ্বর তা কইবার পারলাম না।
হুঁ। মন্তু কি যেন চিন্তা করলো। তারপর ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াতে আম্বিয়া পেছন থেকে ডাকলো, চইল্যা যাও ক্যান? দেখা কইরা যাইবা না? আম্বিয়ার পিছু পিছু হোগলার বেড়া দেয়া ঘরটায় এসে ঢুকলো মন্তু। কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে স্নান হেসে করিম বললো, মন্তু মিয়া যে, তোমারে তো আইজ-কাল দেখাই যায় না। বাঁইচা আছি না মইরা গেছি তাও তো খোঁজ-খবর নাও না মিয়া।
মন্তু প্রথমে ব্রিত বোধ করলো, তারপর বলো, দেখা না অইলে কি অইবো মিয়া খোঁজ-খবর ঠিকই নিই।
কল্কেতে তামাক সাজিয়ে এনে হুঁকোটা মন্তুর দিকে বাড়িয়ে দিলো আম্বিয়া। তারপর জিজ্ঞেস করলো, পান খাইবা? মন্তু হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা নিতে নিতে বললো, না থাউক। আপন মনে কিছুক্ষণ হুঁকো টানলো সে। তারপর আসল কথাটা আলোচনা করলো ওর সঙ্গে। করিম শেখের আবার কিছুদিনের জন্য নৌকায় কাজ করতে চায় মন্তু।
শুনে খুশি হলে করিম। বললো, নাওটারে একটু মেরামত করন লাগবে।
কাল পরশু একবার আইসো।
আবার আসবে বলে উঠতে যাচ্ছিলো মন্তু।
করিম সঙ্গে সঙ্গে বললো, আহা যাও কই, বহ না।
না। রাইত অইছে ই এইবার।
আম্বিয়া বললো, বহ মন্তু ভাই, চাইরডা ভাত খাইয়া যাও।
এর মধ্যে পাশের ঘরে গিয়ে ছেঁড়া ময়লা শাড়িটা পাল্টে একটা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরে এসেছে আম্বিয়া। মুখখানা গামছা দিয়ে মুছে এসেছে সে। কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু। অ্যাঁটসট দেহের ধাঁচে খাঁচে দুরন্ত যৌবন, আট হাত শাড়ির বাঁধন ভেঙ্গে ফেটে পড়তে চায়। ওকে অমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ব্রিত বোধ করলো আম্বিয়া, দাঁড়াইয়া রইলা ক্যান, বহ না।
মন্তু বললো, না আইজ না। আর এতদিন খামু। বলে বাইরে বেরিয়ে এলো মন্তু।
পিদিম হাতে দেউড়ি পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিয়ে গেলো আম্বিয়া। মন্তু শুধালো, তোমার আব্বা কই গেছে।
আম্বিয়া বললো, যেই কাজ কইরা বেড়ায় সেই কাজ করতে গেছে। যাইবো আবার কই।
ওর গলায় ক্ষোভ।
ওর মুখের দিকে এক নজর তাকালো মন্তু। ওর ক্ষোভের কারণটা সহজে বুঝতে পারলো। সাত গ্রামের মরা মানুষকে কবর দিয়ে বেড়ায় নন্তু শেখ। আশেপাশের গ্রামে গত ত্রিশ বছর ধরে যত লোক মরছে সবার কবর খুঁড়েছে ন্যু শেখ। এ তার পেশা নয়, নেশা।
আম্বিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় নেমে এলো মন্তু তখন সে অনুভব করলো বেশ রাত হয়েছে।
চারপাশে ঝি ঝি পোকার অবিশ্রান্ত ডাক। মাঝে মাঝে গাছের মাথায় দু-একটা পাখি হঠাৎ পাখা ঝাঁপটিয়ে আবার নীরব হয়ে যাচ্ছে। আকাশে ভরা চাঁদ হাসছে খলখলিয়ে।
বাড়ির কাছে এসে পৌঁছতেই সুরত আলীর সুর করে পুঁথি পড়ার শব্দটা কানে এলো মন্তুর।
কইন্যা দেইখা গাজী মিয়ার চমক ভাঙ্গিলো।
কইন্যার রূপেতে গাজী বেশ হইল।
উঠোনে বেশ বড় রকমের জটলা বেঁধেছে একটা। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে বসেছে সবাই। আর তার মাঝখানে পিদিমের আলোতে বসে পুঁথি পড়ছে সুরত। পুরুষরা তার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেও মেয়েরা বসেছে একটু দূরে। যাদের বয়স কম তারা বসেছে আরো দূরে। দাওয়ার ওপরে।
বুড়ো মকবুল গুড়ুম গুডুম হুঁকো টানছে আর বারবার প্রশংসা করছে সুরত আলীর পুঁথি পড়ার। বড় সুন্দর পুঁথি পড়ে সুরত আলী। এ গাঁয়ের সেরা পুঁথি পড়ুয়া সে।
অকাশে যখন জোছনার বান ডাকে। ভরা চাদ খলখলিয়ে হাসে। দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাস অতি ধীরে তার চিরুনি বুলিয়ে যায় গাছের পাতায় পাতায়। কাক ডাকে না। চড়ই আর শালিক কোন সাড়া দেয় না। গ্রামের সবাই সারা দিনের কর্মব্যস্ততার কথা ভুলে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেয়। নিঃশব্দ নিঝুম রাতে কুঁড়েঘরের ছায়াগুলো ধীরে ধীরে হেলে পড়ে উঠোনের মাঝখানে। তখন সুর করে পুঁথি পড়ে সুরত আলী। গাজী কালুর পুঁথি। ভেলুয়া সুন্দরীর পুঁথি।
শুন শুন বন্ধুগণরে, শুন দিয়া মন।
ভেলুয়ার কথা কিছু গুন সর্বজন।।
কি কহিব ভেলুয়ার রূপের বাখান।
দেখিতে সুন্দর অতিরে রসিকের পরাণ।।
আকাশের চন্দ্র যেনরে ভেলুয়া সুন্দরী।
দূরে থাকি লাগে যেন ইন্দ্রকূলের পরী।।
উৎকর্ণ হয়ে শোনে সবাই। সুরত আলী পড়ে। ঢুলে ঢুলে সুর করে পড়ে সে। পুরুষেরা গুড়ম গুড়ম তামাক টানে। মেয়েরা পান চিবোয়। মাঝে মাঝে কমলার পুঁথিটাও পড়ে শোনায় সুরত। কমলার কিচ্ছা বর্ণনা সবার কাছে। কিচ্ছা নয়, একেবারে সত্য ঘটনা। হিরণ্য নগরের মেয়ে ছিল কমলা। যেমন রূপ তেমনি গুণ। ভোজ উৎসব করে ঢাল-ঢোল পিটিয়ে একদিন বিয়ে হয়ে গেলো তার হিরণ্য নগরের রাজকুমারের সঙ্গে।
বড় সুখে দিন কাটছিলো ওদের।
এক বছর পরে একটা দুধের মত মেয়ে জন্ম নিলো ওদের।
আট বেহারার পালকি চড়ে একদিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে লাল পরী, নীল পরী আর সবুজ পরীর দীঘির পাড় দিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছিলো কমলা। দীঘি দেখে পালকি থেকে নামলো সে। চৈত্র মাসের খর রোদে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিলো ওর। দীঘির স্বচ্ছ পানি দেখে বড় লোভ হলো কমলার। পানিতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে অ্যাঁজল ভরে পানি খেলো সে। তারপর যখন উঠতে যাবে, দেখলো, চুলের মত সরু কি যেন একটা কড়ে আঙ্গুলের গোড়ায় আটকে রয়েছে। হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলো। পারলো না কমলা। যত টানে তত লম্বা হয় সে চুল। তার এক প্রান্ত পানির ভেতরে, অন্য প্রান্ত কড়ে আঙ্গুলের সঙ্গে গিট অ্যাঁটা। ছাড়াতে পারে না। কমলা, এগুতেও পারে না। এগুতে গেলে পানির ভেতর চুলে টান পড়ে। কে যেন টেনে ধরে রেখেছে ওটা। চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে গেলো। কত লোক এলো। কত লোক গেলো।
তারপর এক রাতে স্বপনে দেখলো সুন্দরী।
দীঘির পানিতে আছে এক রাজপুরী।
সেইখানে আছে এক রাজপুত্র সুন্দর।
আসেক হইয়াছে তার কমলার উপর।
কমলারে পাইতে চায় আপন করিয়া।
কমলার লাইগা তার কান্দিছে হিয়া।।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো কমলার। কাঁদলে সবাই। বাবা, মা। স্বামী সবাই। দীঘির পানি থেকে চুলে টান পড়লো এতদিনে। পাতা পানি থেকে হাঁটু পানিতে নেমে গেলো কমলা। হাঁটু থেকে বুক। তারপর গলা। ধীরে ধীরে দীঘির পানিতে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কমলা সুন্দরী।
চাঁদ হেলে পড়ে পুব থেকে পশ্চিমে।
ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
ঢুলে চুলে পুঁথি পড়া শেষ করলে সুরত আলী।
হীন মোয়াজ্জেম কহেরে ওন সর্বজন।
কমলা সুন্দরীর কিচ্ছা হইল সমাপন।
ভুল চুক হইলে মোরে লইবেন ক্ষেমিয়া।
দোয়া করিবেন মোরে অধীন জানিয়া।
পুঁথি পড়া শেষ হয়। কমলা সুন্দরী আর ভেলুয়া সুন্দরীর জন্যে অনেকে অনেক আফসোস করে মেয়ে বুড়োরা। অ্যাঁচল দিয়ে চোখের পানি মোছে আমেনা। টুনির চোখ জোড়াও পানিতে টলটল করে ওঠে। ফকিরের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সব খোদার ইচ্ছা, খোন্দা মাইরবার চাইলে কিনা করতা পারে। বুড়ো মকবুল কিছুক্ষণের জন্য কো টানতে ভুলে যায়। সে চুপ করে কি যেন ভাবে আর নীরব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
খড়ম জোড়া তুলে নিয়ে হাত পা ঘোয়ার জন্যে পুকুর ঘাটে চলে যায় মন্তু। অজু করে এসে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে আজ।
মাঝি বাড়ি থেকে ধপাস ধপাস ঢেঁকির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
রাত জেগে আজও ধান ভানছে আম্বিয়া। বড় মিহি কণ্ঠস্বর ওর, বড় সুন্দর গান গায় সে।
ভাটুইরে না দিয়ো শাড়ি,
ভাটুই যাব বাপের বাড়ি।
সর্ব লক্ষণ কাম চিক্কণ,
পঞ্চ রঙের ভাটুইরে।
পুকুর ঘাট থেকে ফেরার পথে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো মন্তু। ছোট পুকুরের পূর্ব পাড় থেকে কে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাড়ের দিকে। আবছা আলোতে সব কিছু স্পষ্ট না দেখলেও মেয়েটিকে চিনতে ভুল হলো না মন্তুর। আবুলের বউ হালিমা। এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছে সে। পশ্চিম পাড়ের লম্বা পেয়ারা গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা। চারপাশে বার কয়েক ফিরে তাকালো সে। তারপর ধীরে ধীরে পরনের ছেঁড়া কাপড়টা খুলে ফেললো সে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মন্তু। হাত-পাগুলো কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ওর।
পরনের কাপড় খুলে তার একটা প্রান্ত পেয়ারা গাছের মোটা ডালটার সঙ্গে বাঁধলো হালিমা। আরেকটা প্রান্ত নিজের গলার সঙ্গে পেঁচিয়ে কি যেন পরখ করলো সে।
মন্তুর আর বুঝতে বাকি রইলো না, গলায় ফাঁস দিয়ে মরতে চায় হালিমা।
এ দুনিয়াটা বোধ হয় অসহ্য হয়ে উঠেছে ওর কাছে। তাই আর বাঁচতে চায় না ও।
মন্তু এ মুহূর্তে কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।
হঠাৎ ওকে অবাক করে দিয়ে গলার ফাঁসটা খুলে ফেলে আপন মনে কেঁদে উঠলো হালিমা। পেয়ারা। গাছটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো সে।
হয়তো, বাবা-মার কথা মনে পড়েছে ওর। কিম্বা, দুনিয়াটা অতি নির্মম হলেও ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না হয়তো।
এর মধ্যে বার চারেক গলায় ফাঁস পরেছে আর খুলেছে হালিমা। ওর অবস্থা দেখে অতি দুঃখে হাসি পেলো মন্তুর। ধীরে ধীরে ওর খুব কাছে এগিয়ে গেলো সে। তারপর অকস্মাৎ ওর একখানা হাত চেপে ধরলো মন্তু।
একটা করুণ উক্তির সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো হালিমা। বড় বিষণ্ণ চাহনি ওর। অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলী না। বোবার মত দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। ঈষৎ চাদের আলোয় মন্তু দেখলো, হালিগ্রার নাক আর চোখ দুটো অসম্ভব রকম ফুলে গেছে। এত মার মেরেছে ওকে আবুল।
মন্তু শিউরে উঠলো। তারপর কি বলতে যাচ্ছিলো সে।
হঠাৎ এক ঝটকায় ওর মুঠো থেকে হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে একটা চাপা কান্নার সঙ্গে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেলো হালিমা। বোবা দৃষ্টি মেলে সেদিকে তাকিয়ে রইলো মন্তু।
পুকুর পাড় থেকে ফিরে এসে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো সে।
চেয়ে দেখে, ঘরের দাওয়ায় বসে পুঁথির কথাগুলো গুন্গুন্ করছে টুনি।
দাওয়া থেকে নেমে এসে টুনি শুধালো, কোথায় গিছলা মিয়া। তোমারে আমি খুঁইজা মরি।
শোবার ঘর থেকে মকবুল আর আমেনার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। রশীদ আর সালেহাও বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি নিয়ে যেন আলাপ করছে নিজেদের মধ্যে।
সুরত আলীর ঘরের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আবুল আর হালিমার ঘরেও কোন বাতি নেই।
মন্তু সহসা টুনির কথার কোন জবাব দিলো না।
টুনি আরো কাছে এগিয়ে এসে বললো, এহনি ঘুমাইবা বুঝি?
মন্তু বললো, হুঁ। শরীরটা আইজ ভালো নাই।
ক্যান, কি অইছে? টুনির কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা। জুর হয় নাই তো? মন্তু বললো, না এমনি খারাপ লাগতাছে।
মন্তু বললো, আজ থাক, কালকা যামু।
টুনি কি যেন ভাবলো। ভেবে বললো, পরশু দিনকা আমি বাপের বাড়ি চইলা যামু।
তাই নাহি?
হুঁ। বাপজানের অসুখ, তাই।
অসুখের কথা কার কাছ থাইকা শুনলা? ওর মুখের দিকে তাকালো মন্তু।
টুনি আস্তে করে বললো, বাপজান লোক পাঠাইছিলো।
অ। উঠোনের মাঝখানে দুজন কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। একটু পরে মন্তু নীরবতা ভাঙলো, পরশু থাইকা আমিও নাও বাইতে যাইতাছি।
কোনহানে যাইবা? টুনি সোৎসাহে তাকালো ওর দিকে।
মন্তু বললো, কোনহানে যাই ঠিক নাই। করিম শেখের নাও। সে যেই হানে নিয়া যায় সেই হানেই যামু। টুনি বললো, তোমার নায়ে আমারে বাপের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিবা? বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো টুনি।
সহসা কোন জবাব দিতে পারে না মন্তু। তারপর ইতস্তত করে বলে, অনেক রাত অইছে এইবার ঘুমাও গিয়া। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় মন্তু।
পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙলো মন্তুর।
বাইরের উঠোনে তখন কি একটা বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া বাঁধিয়েছে আমেনা আর সালেহা। অকথ্য ভাষায় পরস্পরকে গলাগলি দিচ্ছে ওরা। গনু মোল্লার ঘরের সামনে একটা বড় রকমের ভীড়।
গ্রামের অনেক ছেলে বুড়ো এসে জমায়েত হয়েছে সেখানে। ব্যাপারটা কি প্রথমে বুঝতে পারলো না মন্তু। পরে বুড়ো মকবুলের মেয়ে হিরনীর কাছ থেকে শুনলো সব।
মজু ব্যাপারীর মেয়েটাকে ভূতে পেয়েছে। ভূত তাড়াবার জন্য ওকে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে এসেছে সবাই। ব্যাপারীর ছোট ভাইকে সামনে পেয়ে মন্তু শুধালো, কি মিয়া ভূতে পাইল কহন অ্যাঁ?
ব্যাপারীর ভাই আদ্যন্ত জানালো সব।
কাল ভোর সকালে পরীর দীঘির পাড়ে শুকনো ডাল পাতা কুড়াতে গিয়েছিলো মেয়েটা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো মেয়ে আর ফিরে না। ওদিকে মেয়ের মা তো ভেবেই আকুল। বয়স্কা মেয়ে, কে জানে আবার কোন বিপদে পড়লো। প্রথমে ওকে দেখলো কাজী বাড়ির গুরথুরে বুড়িটা। লম্বা তেতুঁল গাছের মগডালে উঠে দুপা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে টেনে টেনে দিব্যি গান গাইছে মেয়েটা। বুড়ি তো অবাক, বলি লজ্জা শরমের কি মাথা খাইছ? দিন দুপুরে গাছে উইঠা পিরীতের গীত গাইবার লাগছ। ও মাইয়্যা, বলি লজ্জা শরম কি সব উইঠা গেছে নাহি দুনিয়ার উপর থাইক্যা?
বুড়ি যত চিৎকার করে মরে, মেয়ে তত শব্দ করে হাসে। সে এক অদ্ভুত হাসি। যেন ফুরোতেই চায় না।
খবর শুনে মঞ্জু ব্যাপারী নিজে ছুটে এলো দীঘির পাড়ে। নিচে থেকে মেয়েকে নাম ধরে বারবার ডাকলো সে। সখিনা, মা আমার নাক-কান কাটিছ না মা, নাইম্যা আয়।
বাবাকে দেখে ওর গায়ের ওপরে থুথু ছিটিয়ে দিলো সখিনা। তারপর খিলখিল শব্দে হেসে উঠে বললো, আর যামু না আমি। এইহানে থাকুম।
ওমা কয় কি। মাইয়্যা আমার এই কি কথা কয়? মেয়ের কথা শুনে চোখ উল্টে গেলো মজু ব্যাপারীর।
থুরথুরে বুড়ি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। সহসা বিজ্ঞের মত ঘাড় নাড়লো সে, লক্ষণ বড় ভালো না ব্যাপারী। মাইয়ারে তোমার ভূতে পাইছে।
খবরদার বুড়ি বাজে কথা কইস না। উপর থেকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো সখিনা।
বেশি বক বক করলে ঘাড় মটকাইয়া দিমু।
এ কথার পরে কারো সন্দেহের আর অবকাশ রইলো না।
বুড়ি বললো, এ বড় ভালো লক্ষণ নয়, জলদি কইরা লোকজন ডাহ।
লোকজন ডাকার কোন প্রয়োজন ছিলো না। কারণ হক-ডাক শুনে ততক্ষণে গ্রামের অনেক লোক এসে জড়ো হয়ে গেছে সেখানে। বুড়ো ছমির মিয়া বললো, দাঁড়ায়া তামাশা দেখতাছ ক্যান মিয়ারা, একজন উইঠা যাও না উপরে। কে উঠবে, কে উঠবে না তাই নিয়ে বসা হলো কিছুক্ষণ। কারণ যে কেউ তো আর উঠতে পারে না। এমন একজনকে উপরে উঠতে হবে, মেয়ের গায়ে হাত ছোঁয়াবার অধিকার আছে যার। অবশেষে ঠিক হলো তকু ব্যাপারীই উঠবে উপরে। মেয়ের আপন চাচা হয় সে। সুতরাং অধিকারের প্রশ্ন আসে না।
তকু ব্যাপারীকে উপরে উঠতে দেখে ক্ষেপে গেলো সখিনা। চিৎকার করে ওকে শাসাতে লাগলো সে, খবরদার, খবরদার ব্যাপারী, জানে খতম কইরা দিমু। বলে ছোট ছোট ডাল পাতা ছিড়ে ছিড়ে ওর ঘাড়ের ওপরে ছুঁড়ে মারতে লাগলো সে। তারপর অকস্মাৎ এক লাফে দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটা। অনেক কষ্টে দীঘির পানি থেকে পাড়ে তুলে আনা হলো তাকে।
কলসি কলসি পানি ঢালা হলো মাথার ওপর। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে এলো সখিনার তখন সে একেবারে চুপ হয়ে গেছে। তারপর থেকে একটা কথাও বলে নি সখিনা। একটা প্রশ্নের জবাব দেয়নি সে। তাই আজ সকালে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে এসেছে ওকে, যদি ভূতটাকে কোন মতে তাড়ানো যায়। নইলে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হবে। ব্যাপারীর ভাইয়ের কাছ থেকে সব কিছু শুনলো মন্তু। গনু মোল্লার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা সাদা কাপড়কে সরষের তেলের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে তার মধ্যে আগুন ধরিয়ে সেই কাপড়টাকে সখিনার নাকের ওপর গনু মোল্লা ধরেছে আর চিৎকার করে বলছে, কোনহানে থাইকা আইছ শীগগীর কইরা ক, নইলে কিন্তুক ছাড়মু না আমি। ক শীগগীর। সখিনা নীরব।
তার ঘাড়ের ওপর চেপে থাকা ভূতটা কোন কথাই বলছে না।
মন্তু আর দাঁড়ালো না সেখানে। ঘরের পিছন থেকে একটা নিমের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে দাঁতন করতে করতে পুকুর ঘাটে চলে গেলে সে। পুকুর পাড়ের পেয়ারা গাছের নিচে লাউ গাছগুলোর জন্য একটা মাচা বাঁধছে হালিমা। এখন দেখলে কে বলবে যে ওই মেয়েটা এই গতকাল রাতে ওই পেয়ারা গাছটার ডালে গলায় কাপড় বেধে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো। ওর দিকে চোখ পড়তেই, কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তারপর আবার মাচা বাঁধতে লাগল হালিমা।
নৌকাটা ঘাটে বেধে রেখে একগাদা কাদা ডিঙিয়ে পড়ে উঠে আসে ওরা। মন্তু আর করিম শেখ। হাটের এক কোণে মনোয়ার হাজীর চায়ের দোকানে বসে গরম দুকাপ চা খায়।
হাটের নাম শান্তির হাট। কিন্তু সারাদিন অশান্তিই লেগে থাকে এখানে। দূর দূর বহুদূর গ্রাম থেকে লোক আসে সওদা করতে। খুচরো জিনিসপত্রের চেয়ে পাইকারী জিনিসপত্রের বিক্রি অনেক বেশি। এখান থেকে মালপত্র কিনে নিয়ে গ্রামে গ্রামে আর ছোট ছোট হাট বাজারের দোকানীরা দোকান চালায়।
মাঝে মাঝে দুএকটা সার্কার্স পার্টিও আসে এখানে। তখন সমস্ত পরগণায় সাড়া পড়ে যায়। দলে দলে ছেলে বুড়ো মেয়ে এসে জড়ো হয় এখানে। দোকানীদেরও তখন খুশির অন্ত থাকে না। জোর বিক্রি চলে। নদীর পাড়ের ভরাট জায়গাটায় কয়েকটা দোচালা ঘর তুলে নিয়ে সেখানে হোটেল খোলে কেউ। ভিড় লেগেই থাকে। মানোর হাজীর সঙ্গে করিম শেখের অনেক দিনের খাতির। এ হাটে এলে একমাত্র হাজীর দোকানেই চা খায় করিম। হাজীও বাইরের কোথাও যেতে হলে করিম শেখের নাও ছাড়া অন্য কারো নৌকায় যায় না। চায়ের পয়সা দিতে এলে হাজী একমুখ হেসে শুধালো, কি মিয়া খবর সব ভাল তো?
করিম শেখ বিরক্তির সঙ্গে বললো, আর খবর, হাঁপানি হয়া মরছি।
আহা, ওইডা আবার কখন থাইকা হইলো? হাজার কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর। তা মিয়া হাঁপানি নিয়া না বাইরলেই পারতা।
কি আর করমু ভাই। পেট তো চলে না। করিম শেখ আস্তে করে বললো, পেট তো ঠাণ্ডা গরম কিছু মানে না।
মন্তুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে করিম।
কিছুক্ষণ হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে ওরা।
আকাশটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছে দুপাশের গ্রামগুলো। মাঝে মাঝে দুএকটা মিটমিটে বাতি দেখে বোঝা যায় গেরস্থদের বাড়ি গেলো একটা। কিম্বা হঠাৎ কোথাও একসার বাতি দুলতে দুলতে এগিয়ে যেতে দেখলে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় হাট থেকে ফিরছে ওরা হাটুরের দল।
মাঝে মাঝে দু একটা শিয়াল আর অনেকগুলো কুকুরের দলবাধা ডাক শোনা যায়। আর উজান নদীর একটানা কলকল শব্দ।
হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরে মন্তু।
আশা ছিলো মনে মনে প্রেম করিমু তোমার সনে।
তোমায় নিয়া ঘর বাঁধিমু গহিন বালুর চরে।
গানের সুর বহুদূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হয়। করিম শেখ হুঁকোটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে, নাও মিয়া তামুক খাও।
হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা নেয় মন্তু। গুডুম ডুম টান মারে হুঁকোতে।
তারপর আবার গান ধরে, আশা ছিল মনে মনে।
গান শুনে করিম শেখের মনটা উদাস হয়ে যায়। ও বলে, এইবার এক বিয়া শাদি করমু ঠিক করছি। একা একা আর ভালো লাগে না। মন্তু গান থামিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। অন্ধকারে ওর মুখখানা ভালো করে দেখতে পায় না সে!
করিম শেখ আবার বলে, কি মিয়া কিছু কও না যে?
মন্তু বলে, বিয়া করবা সেতো ভালো কথা।
করিম শেখ বলে, করবার তো ইচ্ছা হয়, করি কারে? ভাল দেইখ্যা একটা মাইয়া দেহায়া দাও না।
মন্তু হাসে, বলে, ভাল মাইয়া পাইলে কি আর নিজে এতদিন অবিয়াত থাকি মিয়া। বলে আবার গান ধরে সে।
আশা ছিল মনে মনে……..।