০২. যোধপর পার্কে জলের ট্যাঙ্কের কাছে

যোধপর পার্কে জলের ট্যাঙ্কের কাছে লাল রংয়ের ছোট্ট দোতলা বাড়িটার একতলার ঘরে ভোরবেলায় সোমনাথ যখন বিছানায় শুয়ে আছে তখনই ওকে ধরা যাক।

একটু আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু নীল স্ট্রাইপ দেওয়া পাজামা আর হাতকাটা জালি গেঞ্জি পরে সোমনাথ এখনও পাশবালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে।

সোমনাথের ঘরের বাইরেই এ-বাড়ির খাবার জায়গা। সেখানে চা তৈরির ব্যবস্থাও আছে। ওইখান থেকে চুড়ির ঠং ঠং আওয়াজ ভেসে আসছে। এই আওয়াজ শুনেই সোমনাথ বলে দিতে পারে, বড় বউদি অন্তত আধঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে সংসারের কাজকর্ম শুরু করেছেন। কমলা বউদি এই সময় মিলের আটপৌরে শাড়ি পরেন, তাঁর পায়ে থাকে বাটা কোম্পানির লাল রংয়ের শ্লিপার। চায়ের কাপ নামানোর আওয়াজ ভেসে আসছে—সুতরাং লিকুইড পেট্রলিয়াম গ্যাসের উননে বউদি নিশ্চয় চায়ের কেটলি চাপিয়ে দিয়েছেন।

ভোরবেলায় এই বাড়ির চা দু’বউ-এর একজনকে তৈরি করতে হবে। কারণ, দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি দিনের প্রথম চায়ের কাপটা ঝি-চাকরের হাত থেকে তুলে নেওয়াটা পছন্দ করেন না।

এ-বাড়ির অপর বউ দীপান্বিতা ওরফে বুলবুলের ওপরও মাঝে মাঝে চা তৈরির দায়িত্ব পড়ে। সোমনাথের ছোটদা একদিন বড় বউদিকে বলেছিল, তুমি রোজ-রোজ কেন ভোরবেলায় উঠবে? বুলবুলও মাঝে মাঝে কষ্ট করুক।

কমলা বউদি আপত্তি করেননি, কিন্তু মুখ টিপে হেসেছিলেন। হাসবার কারণটা সোমনাথের অজানা নয়। ছোটদার বউ বুলবুল বেজায় ঘুমকাতুরে। ঘড়ির মান-সম্মান বাঁচিয়ে ভোরবেলায় বিছানা থেকে উঠে চা তৈরি করা ওর পক্ষে বেশ শক্ত ব্যাপার।

আজ তো সোমবার? সুতরাং বুলবুলেরই চা তৈরি করার কথা। কিন্তু চুড়ির আওয়াজ তো বুলবুলের নয়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই, ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সোমনাথ। ছোটদার শোবার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেলো এবার। সেই সঙ্গে বুলবুলের হাতের চুড়ির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।

বুলবুলের গলার স্বর একটু চড়া। এবার তার কথা শুনতে পাওয়া গেলো। “কি লজ্জার ব্যাপার বলুন তো? ঘুম থেকে উঠতে পনেরো মিনিট দেরি করে ফেললাম।”

কমলা বউদির কথাও সোমনাথের কানে আসছে। তিনি বুলবুলকে বললেন, “লজ্জা করে লাভ নেই। বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে এসো।”

স্বামীর প্রসঙ্গ তুলে বুলবুল বললো, “ও আমাকে ডেকে না দিলে এখনও ঘুম ভাঙতো না বোধহয়।”

“ঠাকুরপো তোমাকে তাহলে বেশ শাসনে রেখেছে! ভোরবেলায় একটু ঘুমোবার সুখও দিচ্ছে না!” কমলা বউদির রসিকতা সোমনাথের বিছানা থেকেই শোনা যাচ্ছে। ছোট দেওর যে এই সময় জেগে থাকতে পারে তা ওরা দুজনে আন্দাজ করতে পারেনি।

বুলবুলের বেশিদিন বিয়ে হয়নি। এ-বাড়ির কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে একটা স্বাভাবিক লজ্জাবোধ এখনও আছে। কমলাকে সে বললো, “ভাগ্যে আপনি উঠে পড়েছেন। না হলে কি বিশ্রী ব্যাপার হতো! চায়ের অপেক্ষায় বাবা বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতেন।”

চায়ের কাপ সাজানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কমলা বউদি বললেন, “অনেকদিনের অভ্যেস তো—ঠিক পৌনে ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেলো। ছ’টা দশেও যখন কেটলি চড়ানোর আওয়াজ পেলাম না, তখন বুঝলাম তুমি বিছানা ছাড়েনি।”

বুলবুল বললো, “ভোরের দিকে আমার কী যে হয়! যত রাজ্যের ঘুম ওই সময় আমাকে ছে’কে ধরে।”

কমলা বউদি অল্প কথার মানুষ কিন্তু রসিকতা বোধ আছে পুরোপুরি। বললেন, ঘুমের আর দোষ কি? রাত দুপুর পর্যন্ত বরের সঙ্গে প্রেমালাপ করবে, ঘুমকে কাছে আসতে দেবে না। তাই বেচারাকে শেষ রাতে সুযোগ নিতে হয়।”

কমলা বউদির কথা শুনে সোমনাথেরও হাসি আসছে। বুলবুলের সলজ্জ ভাবটা নিজের চোখে দেখতে ইচ্ছে করছে। হাজার হোক কলেজে একসময় বুলবুল ওর সহপাঠিনী ছিল। বুলবুল বলছে, “বিশ্বাস করুন, দিদিভাই, কাল সাড়ে-দশটার মধ্যে দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন তো আর নবদম্পতি নই।”

কমলা বউদি ছাড়লেন না। “বলো কি? এখনও পুরো দ’বছর বিয়ে হয়নি, এরই মধ্যে বুড়ো-বুড়ি সাজতে চাও?”

“কী যে বলেন!” বুলবুল আরও কিছু মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কথা আর শোনা গেলো না। সোমনাথের কাছে বুলবুল যতই স্মার্ট হোক, গুরুজনদের কাছে সে বেশ নার্ভাস।

কমলা বউদি বললেন, “এ-নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বরের সঙ্গে মনের সুখে গল্প করবে এটা তোমার জন্মগত অধিকার। তাছাড়া, ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেও ঠাকুরপোর হয়তো তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। বরের রিলিজ অর্ডার না পেলে তুমি কী করবে?”

“দাদা নিশ্চয় আপনাকে সকালবেলায় ছাড়তে চান না।” বুলবুল এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো।

কমলা বউদি উত্তর দিতে একটু দেরি করছেন। বোধহয় চায়ের কাপগুলো শুকনো কাপড় দিয়ে মুছছেন—কিংবা লজ্জা পেয়েছেন। না, কমলা বউদি সামলে নিয়েছেন। অল্পবয়সী জা-কে ভয় দেখালেন, “বম্বেতে আজই প্রশ্ন করে পাঠাচ্ছি। লিখবো তোমার ভাদ্দর বউ জানতে চাইছিল!”

সোমনাথের চোখে আবার ঘুম নেমে আসছে। বাইরের কথাবার্তায় সে আর মনোযোগ দিতে পারছে না। কিন্তু কমলা ও বুলবুল তাদের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

দাদাকে চিঠি লেখার প্রসঙ্গে বুলবুল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো মুখভঙ্গি করে বুলবুল বললো, “লক্ষ্মীটি দিদিভাই। দাদা এসব শুনলে, আমি ওঁর সামনে লজ্জায় যেতে পারবো না। আপনার কাছে মাপ চাইছি, কাল থেকে সময়মতো উঠবোই…”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল বুলবুল। কিন্তু কমলা চাপা অথচ শান্ত গলায় জা-এর বক্তব্যের শূন্যস্থান পূরণ করলো, “তার জন্যে যদি রাত্রিবেলায় বরের সঙ্গে প্রেম বন্ধ রাখতে হয় তাও!”

এবার কেটলি নামিয়ে কমলা মেপে মেপে কয়েক চামচ চা চীনেমাটির পটে দিলো, আর একটা বাড়তি চামচ চা দিলো পটের জন্যে। কমলা তারপর বুলবুলকে বললো, “ছোটবেলা থেকে আমার সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সুতরাং তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। সকালে বাবাকে আমিই চা করে দেবো।”

বুলবুলের মুখে কৃতজ্ঞতার রেখা ফুটে উঠেছিল। তবু সে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। কিন্তু কমলা বললো, “বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে এসো। ঘুম ভেঙে বউ-এর চোখে পিঁচুটি দেখলে বর মোটেই খুশী হবে না।”

বুলবুল বাথরুমে চলে গেলো। কমলা চটপট এক কাপ চায়ে দুধ মেশালে। তারপর মাথায় ঘোমটা টেনে, শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিয়ে, একটা প্লেটে দু’খানা নোনতা বিস্কুট বার করে শ্বশুরমশায়ের উদ্দেশ্যে দোতলায় চললো।

 

দোতলায় মাত্র একখানা ঘর। সেই ঘরে একমাত্র দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি থাকেন। ভোরবেলায় কখন যে তিনি ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন কেউ জানে না।

সকালবেলায় প্রাত্যহিক হাঙ্গামা সেরে দক্ষিণের ব্যালকনিতে দ্বৈপায়ন শান্তভাবে বসে রয়েছেন। বাড়ির পুব দিকটা এখনও খোলা আছে। সেদিক থেকে ভোরবেলায় মিষ্টি রোদ সলজ্জভাবে উঁকি মারছে। বাবা সেইদিকে চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছেন। কমলার ধারণা, বাবা এই সময়ে মনে মনে ঈশ্বরের আরাধনা করেন।

চায়ের কাপ নামিয়ে সনম্র কমলা বাবাকে প্রণাম করলো। পায়ের ধূলো নিতে গেলে গোড়ার দিকে বাবা আপত্তি করতেন—এখন মেনে নিয়েছেন। বর্ধমাতাকে তিনি প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন।

কমলা বললো, “সকালবেলায় একটু বেড়ানো অভ্যেস করুন না।”

দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি বললেন, “করবো ভাবছি। কিন্তু শরীরে ঠিক জুত পাই না।”

শ্বশুরের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না কমলা। তাঁকে মনোবল দেবার জন্যে সে বললো, “আমার বাবাও প্রথমে বেরোতে চাইতেন না। এখন কিন্তু সকালে বেড়িয়ে খুব আরাম পাচ্ছেন। বাতের ব্যথা কমেছে। খিদে হচ্ছে।”

দ্বৈপায়ন বললেন, “দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো না বউমা।”

এক সময় শ্বশুরমশায় গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কারুর সঙ্গে বড় একটা কথা বলতেন না। কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর কী যে হলো—বেশ পাল্টে গেলেন। এখন বড় বউমার সঙ্গে অনেক কথা বলেন প্রায় আড্ডা জমিয়ে ফেলেন মাঝে মাঝে।

আট বছর আগেও এই বাড়ির সর্বময়ী কত্রী ছিলেন প্রতিভা দেবী। কাজে কর্মে ও প্রাণোচ্ছল কথাবার্তায় তিনি একাই ব্যানার্জি পরিবারের সমস্ত কিছু পরিপূর্ণ রেখেছিলেন। দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি নিজেই কমলাকে বলেছিলেন, “তোমার শাশুড়ী যে বলতেন এ-বাড়িতে তিনিই ভাগ্যলক্ষ্মীকে এনেছেন তা মোটেই মিথ্যে নয়।”

এর পরেই শ্বশুরমশায় ড়ুবে যেতেন পুরানো দিনের গল্পে। কমলাকে বলতেন, কেমন করে ওঁদের বিয়ে হলো—ছোটবেলায় প্রতিভা কী রকম একগয়ে ছিলেন—দ্বৈপায়নের সঙ্গে ঝগড়া হলে শাশুড়ীর কাছে কীভাবে স্বামীর নামে লাগাতেন।

আজও বাবা বোধহয় বউমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। আর এই ভোরবেলাটাই ওঁর যত কথা বলার সময়। চায়ে চুমুক দিয়ে দ্বৈপায়নের খেয়াল হলো বউমার নিজের মুতে চায়ের পেয়ালা নেই। ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন, “ওহো, তোমাদের চা বোধহয় নিচের টেবিলে ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমার মনে থাকে না যে প্রথমে আমার জন্যে বিনা চিনিতে চা তৈরি করো। তারপর অন্যদের চা-এ চিনি মেশানো হয়। তুমি বরং চায়ের হাঙ্গামা শেষ করে এসো বউমা। ইচ্ছে করলে নিজের কাপটা এনে এখানে বসতে পারো।”

কমলা বললো, “না-হয় একটু দেরি হবে। এখনও তো কেউ ওঠেনি।”

বাবা রাজী হলেন না। বললেন, “না, মেজ বউমা কি চয় তোমার জন্যে বসে আছে। তোমার শাশুড়ী এই জন্যে আমাকে বকাবকি করতেন। বলতেন, সংসারটা কেমনভাবে চলছে তুমি মোটেই খোঁজ রাখো না। তুমি নিজের খেয়ালেই বদ হয়ে থাকো।”

শ্বশুরের কথা অমান্য করতে পারলো না কমলা। বাবাকে যে কমলা খুব ভালোবাসে তা ওর ভাবভঙ্গি দেখুলেই বোঝা যায়। বাড়ির সবার সঙ্গেই দ্বৈপায়নের একটু দূরত্ব আছে–যে একজন কেবল খুব কাছাকাছি চলে আসতে পারে সে কমলা।

আরামকেদারায় অর্ধশায়িত অবস্থায় দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি অপসরমান কমলার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে রইলেন। শুধু নামে নয়, আসল কমলাকেই একদিন প্রতিভা পছন্দ করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। প্রতিভা বোধহয় জানতেন তিনি এখানে চিরদিন থাকবেন না।

 

যোধপর পার্কের পূব-পশ্চিমমুখো রাস্তাটা এই বারান্দা থেকে পুরো দেখা যায়। দু-একজন পথচারী গভরমেন্টের দুধের বোতল হাতে এই পথ দিয়ে যেতে-যেতে ব্যালকনির আরামকেদারায় সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বৈপায়নকে লক্ষ্য করছে। এই বাড়ির মালিককে তারা বোধহয় হিংসে করছে। বাড়িটা ছোট হলেও ছিমছাম—সর্বত্র রুচির পরিচয় ছড়িয়ে আছে। সে-কৃতিত্ব অবশ্য দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির নয়—প্রতিভা এবং বড় ছেলে সুব্রতর। আই-আই-টিতে এক মাস্টারমশায়কে দিয়ে সব্রত নকশা আঁকিয়েছিল। দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি ভেবেছিলেন বিলেতফেরত আর্কিটেক্টের ওই নকশা অনুযায়ী বাড়ি করতে অনেক খরচ লাগবে রাজ্য সরকারের সাধারণ চাকরি করে এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি?

প্রতিভা কিন্তু দ্বৈপায়নের কোনো আপত্তি শোনেননি। নির্দ্ধিধায় স্বামীকে মুখ-ঝামটা দিয়েছিলেন। ওঁরা তখন থাকতেন টালিগঞ্জের একটা সরকারী রিকুইজিশনকরা ফ্ল্যাটবাড়িতে। প্লান দেখে দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি বলেছিলেন, “ভোম্বল, এসব বাড়ি বিলেত আমেরিকায় চলে। কলকাতা শহরে জমিই কিনতে পারতাম না-নেহাত সরকারী কো-অপারেটিভ থেকে জলের দামে আড়াই কাঠা দিলো তাই। সে দামটাও তো শোধ করেছি মাসে মাসে মাইনে থেকে।

প্রতিভা বলেছিল, “তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন? আমি আর ভোম্বল যা পারি করবো। ভোম্বল তো তোমার মতো আনাড়ি নয়—ভালোভাবে আই-আই-টি থেকে পাস করেছে।’

কমলার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে। তখন থেকেই সে একটু বশরের দিকে ঝকে কথা বলে। সে বলেছিলো, “টাকাটা তো বাবাকেই বার করতে হবে।” শাশুড়ীকে বলেছিল, “বাবার কত অভিজ্ঞতা। কত আদালতে কত লোককে দেখেছেন।”

বউমার সঙ্গে প্রতিভা একমত হতে পারেনি। জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, “শুধু বস্তা বস্তা রায় লিখেছে কোর্টে বসে—কিন্তু কোনো কাণ্ডজ্ঞান হয়নি। সারাজন্ম আমাকেই চালিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে তোমার শ্বশুরমশাইকে। যোধপর পার্কের এই জমিটুকুও কেনা হতো না—যদি-না পলিন রায়ের কাছে খবর পেয়ে আমি রাইটার্স বিল্ডিংস-এ ওঁকে পাঠাতাম। উনি সব ব্যাপারেই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। জীবনে করবার মধ্যে একটা কাজ করেছিলেন, রিপন কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়ে বি সি এস পরীক্ষায় বসেছিলেন।”

দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির মনে আছে স্ত্রীর কথা শুনে প্রথমে তিনি মিটমিট করে হেসেছিলেন। তারপর বউমার সামনেই স্ত্রীকে জেরা করেছিলেন, “প্রতিভা, আর কোনো কাজের কাজ, করিনি?”

গৃহিণী সস্নেহে কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, “পরীক্ষায় পাস-দেওয়া ছাড়া সারাজীবনে তুমি আর কিছুই করোনি।”

আড়চোখে নববিবাহিতা পত্রবধুর দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে দ্বৈপায়ন বলেছিলেন, “বউমাকে আমি সালিশী মানছি।”

তারপর আস্তে-আস্তে অর্ধাঙ্গিনীকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “চাকরির জন্যে পরীক্ষায় পাস করা ছাড়াও আর একটা কাজ করেছিলাম তোমাকে এ-বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।”

কমলা আন্দাজ করেছিল, বাবার এই সগর্ব ঘোষণায় মা খুব খুশী হবেন। হয়তো পত্রবধুর সামনে লজ্জা পাবেন। কমলা তাই কোনো একটা ছুতোয় সেখান থেকে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ী কেউ যেতে দিলেন না। তাঁদের মেয়ে নেই—তাই কমলার ওপর স্নেহ একটু বেশি।

চোখে-মুখে আনন্দের ভাবটা ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে প্রতিভা দেবী ঝগড়ার মেজাজে বলেছিলেন, “একেবারে বাজে কথা।” তারপর কমলার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “এর কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না বউমা। তুমি শুনে রাখো, যদি কারুর জন্যে এ-বাড়িতে বউ হয়ে থাকতে পারি, সে আমার পুঁটে মামার জন্যে। দেড় বছর মামা ওঁর পিছনে লেগেছিলেন, আর উনি নানান ছুতোয় মামাকে অন্তত দুশোবার ঘুরিয়েছেন। পুঁটে মামার অসীম ধৈর্য না থাকলে আমার বিয়েই হতো না। আমি তখনই ঠিক করেছিলাম, আমার ছেলের বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে একেবারেই ঘোরাবো না।”

“করেছেনও তো তাই,”, কমলা এবার শাশুড়ীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। এ-বাড়িতে বধূ, হিসাবে মেয়েকে পাঠাতে তার বাবা-মাকে মোটেই কষ্ট করতে হয়নি। সামান্য এক সপ্তাহের মধ্যে সব কথাবার্তা পাকাপাকি হয়েছিল।

প্রতিভা দেবী বলেছিলেন, “তোমার বিয়ের ব্যাপারে উনি অবশ্য কথার অবাধ্য হননি। ভোম্বল একবার আপত্তি তুলতে গিয়েছিল, একটু সময় দাও, ভেবে দেখি। কিন্তু এমন বকুনি লাগিয়েছিলাম যে আর কথা বাড়াতে সাহস পায়নি। কলেজে অমন শক্ত শক্ত সব পরীক্ষায় উত্তর লিখতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় দেয় না—আর সামান্য একটা বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানাতে হাজার দিন সময় চাই কেন?”

“বিয়েটা সামান্য নয়, প্রতিভা,” দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি পুত্রবধূর সামনেই গৃহিণীর সঙ্গে রসিকতা করেছিলেন।

প্রতিভা এরপর অরিজিন্যাল বিষয়ে ফিরে এসেছিলেন। বলেছিলেন, “বিয়ের তিরিশ বছর পরে রহস্যটা বুঝে তো লাভ নেই, এখন বাড়ি সম্বন্ধে যা বলছি শোনো। তোমাকে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার ব্যাঙ্কের পাশ বই আমার কাছেই আছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইনসিওর থেকে কত টাকা পাবে তাও আমি পলিনকে দিয়ে হিসেব করিয়েছি। ভোম্মলের নকশা অনুযায়ীই বাড়ি হবে। ছোট বাড়ি হোক, লোক যেন দেখলে খুশী হয়। বউমাকে তুমি যতই নিজের দলে টানো, আমি আর ভোম্বল যা করবো তাই হবে। তোমার কোনো কথায় কখনও কান দিইনি, এখনও দেবো না।”

দ্বৈপায়ন হেসে বলেছিলেন, “ঠিক আছে। বাড়িতে যখন আমার কোনো কথাই চলবে না, তখন বাড়ির বারান্দায় বসে যাতে নিজের কথা ভাবতে পারি এমন ব্যবস্থা যেন থাকে।”

রিটায়ার করে তুমি যাতে নিজের খেয়াল মতো বসে থাকতে পারো তার ব্যবস্থা তো রাখা হয়েছে—বারান্দা নয়, দোতলায় রীতিমতো ব্যালকনি তৈরি হবে তোমার জন্যে।” প্রতিভার কথাগুলো এখনও কানে বাজছে দ্বৈপায়নের। সেই বাড়ি উঠলো, সেই ব্যালকনি রয়েছে—শুধু প্রতিভা নেই। দ্বৈপায়নের রীতিমতো সন্দেহ হয়, এমন যে হবে প্রতিভা জানতো। তাই আগে থেকে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

ব্যালকনি থেকে দ্বৈপায়ন আবার যোধপর পার্কের রাস্তার দিকে তাকালেন। পথচারীরা ওঁর দিকে নজর দিয়ে হয়তো কত কী ভাবছে। আন্দাজ করছে, বদ্ধ ভদ্রলোক সব দিকে সফল হয়ে এখন কেমন নিশ্চিত মনে স্বোপার্জিত অবসরসখ ভোগ করছেন।

এ-রকম ভুল বুঝবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বিশেষ করে বাড়ির সামনে সুদৃশ্য বোর্ডে নামের তালিকা দেখলে। নেমপ্লেটে প্রথমেই দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম লেখা—সকলেই জানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস থেকে অবসরপ্রাপ্ত। তারপরেই সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, খড়্গপুরের এম-ই। তারপর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। এখন তো চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টদেরই যুগ। হিসাবেই তো শিব! অভিজিতের পরে সোমনাথের নামটাও ওখানে লেখা আছে।

ছোটছেলে সোমনাথের কথা মনে আসতেই দ্বৈপায়ন কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। যোধপর পার্কের এই ছবির মতো সুখের সংসারে ছোট ছেলেটাই ছন্দপতন ঘটিয়েছে। সুব্রত ও অভিজিৎ দুজনেই স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল। সুব্রত তো অঙ্কে লেটার পেয়েছিল। অভিজিৎ ছোকরার নাম যে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় স্কলারশিপ-লিস্টে উঠবে তা দ্বৈপায়ন বা প্রতিভা দেবী কেউ কল্পনা করতে পারেননি। অথচ অভিজিৎ সম্বন্ধে প্রতিভার বেশি চিন্তা ছিল-ছোকরা মাত্রাতিরিক্ত আড্ডা দিতে, সময়মতো পড়াশোনায় বসতো না, বুঁদ হয়ে রেডিও সিলোনে হিন্দী সিনেমার গান শুনতো।

অভিজিৎকে প্রতিভা বলতেন, “তোর কপালে অনন্ত দুর্গতি আছে। গেরস্ত বাঙালীর ঘরে পড়াশোনার জোরটাই একমাত্র জোর—আর কিছুই নেই তোদের! তুই এখন লেখাপড়া করছিস না, পরে বুঝবি।”

অভিজিৎ, ওরফে কাজল ফিকফিক করে হাসতো। কোনো কথাই শুনতো না। পরীক্ষার রেজাল্ট যখন বেরল তখন প্রতিভা বিশ্বাসই করতে পারেন না, কাজল স্কলারশিপ পেয়েছে। ছেলেটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুরানো কায়দায় ঠোঁট টিপে হাসছিল।

প্রতিভা বলেছিলেন, “দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় কাছে আয়।” তারপর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়েছিলেন। লজ্জা পেয়ে কাজল তখন মায়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। প্রতিভা বলেছিলেন, “শুধু শুধু আমাকে এতোদিন ভাবিয়ে কষ্ট দিলি।”

সেই সব দিনের কথা ভেবে দ্বৈপায়নের মনে হাসি আসছিল। প্রতিভার খুব বিশ্বাস ছিল ছোটছেলের ওপরে। সোমনাথ মায়ের কথা শুনতো। ছোট বয়স থেকেই সোমনাথ খুব শান্ত। পড়ায় বসাবার জন্যে মাকে কখনও বকাবকি করতে হতো না। সন্ধ্যা হওয়ামাত্র হাতপা ধুয়ে পড়ার টেবিলে চলে যেতে খোকন। নিজের মনে পড়ে যেতো, মা ডাকলে তবে উঠে এসে ঢায়ের পেয়ালা নিতে। রাত্রে খাবার তৈরি হলে প্রতিভা ডাকতেন, বই-পত্তর গুছিয়ে রেখে খোকন খেতে বসতো। প্রতিভা বলতেন, “খোকনকে নিয়ে আমাকে একটুও ভাবতে হবে না।”

হাসলেন দ্বৈপায়ন। এখন যত ভাবনা সেই খোকনকে নিয়েই। তবে প্রতিভা একদিকে ঠিকই বলেছিলেন। সোমনাথের ভাবনা প্রতিভাকে একটও ভাবতে হচ্ছে না। সমস্ত দায়দায়িত্ব দ্বৈপায়নের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তিনি অসময়ে বিদায় নিয়েছেন।

 

ওপরের ব্যালকনিতে চায়ের কাপে দ্বৈপায়ন যখন চুমুক দিলেন তখন সোমনাথ একতলায় নিজের বিছানায় আর একবার পাশ ফিরে শুলো।

সোমনাথেরও এই মুহূর্তে মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মা সত্যিই আদরের ছোটছেলের ওপর অগাধ আস্থা রেখেছিলেন। মায়ের ভরসা ছিল, ছোটছেলে বাড়ির সেরা হবে। তাই সেবার যখন সেই দাড়িওয়ালা শিখ গণক্তার টালিগঞ্জের বাড়িতে যা-তা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলো তখন মা ভীষণ চটে গেলেন। সেই তারিখটা সোমনাথ বলে দিতে পারে কারণ সেদিন ছিল সোমনাথের জন্মদিন। হাতে কিছু কাগজপত্তর নিয়ে শিখ গণৎকার তাদের দরজায় এসে কলিং বেল টিপেছিল।

বাড়িতে তখন মা এবং সোমনাথ ছাড়া আর কেউ ছিল না। দাদারা কলেজ বেরিয়েছে, বাবা অফিসে। সোমনাথ শুধু স্কুলে যায়নি জন্মদিনে মায়ের কাছে আবদার করেছিল, “আজ তোমার কাছে থাকবো মা।” মা এমনিতে বেজায় কড়া কিন্তু ছোটছেলের জন্মদিনে নরম হয়েছিলেন। বেল বাজানো শুনে মা নিজেই দরজা খুলতে এসে গণৎকারের দেখা পেলেন।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গণৎকার চটপট বললো, “তুই গণনায় বিশ্বাস করিস না। কিন্তু তোর মুখ দেখে বলছি আজ তোর খুব আনন্দের দিন।”

সেই কথা শুনেই মায়ের খানিকটা বিশ্বাস হলো। গণকঠাকুরকে বাইরের ঘরে বসতে দিলেন। বললেন, “আমার হাত দেখাবো না। আমার ছেলের ভাগ্যটা পরীক্ষা করিয়ে নেবো।”

এই বলে মা সোমনাথকে ডাকলেন।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, বিড়বিড় করে কী সব হিসেব-পত্তর সেরে শিখ বললো, “বেটী তোর তিনটে ঘড়া আছে।” ঘড়া বলতে গণকঠাকুর যে ছেলেদের কথা বলছেন তা মায়ের বুঝতে দেরী হলো না। গণনা মিলে যাচ্ছে বলে একটু আনন্দও হলো। কিন্তু এবার গণৎকার চরম বোকামি করে বসলো। বললো, “তোর প্রথম দুটো ঘড়া সোনার—আর ছোটটা মাটির।”

শোনা মাত্রই মায়ের মেজাজ বিগড়ে গেলো। ইতিমধ্যে সোমনাথ সেখানে এসে পড়েছে। কিন্তু মা তখন গণকঠাকুরকে বিদায় করছেন, বলছেন, “ঠিক আছে, আপনাকে আর হাত দেখতে হবে না।”

গণকের কথা মা বিশ্বাসই করতে চাননি। তাঁর ধারণা, তাঁর তিনটে ঘড়াই সোনার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হলো?

সোমনাথ আর একবার পাশ ফিরলো। একটা মশা পায়ের কাছে জ্বালাতন করছে। অনেকগুলো দুশ্চিন্তা মাথার ভিতর জট পাকাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে মশার মতো পোঁ-পোঁ আওয়াজ করছে। চাকরির বাজারে কী যে হলো—এতো চেষ্টা করেও সামান্য একটা কাজ জোটানো গেলো না।।

সোমনাথ হয়তো বড়দা এবং ছোটদার মতো ব্রিলিয়ান্ট নয়, হয়তো সে স্কুল ফাইনালে ওদের মতো ফার্স্ট ডিভিসন পায়নি। কিন্তু যেসব ছেলে সেকেন্ড কিংবা থার্ড ডিভিসনে পাস করেছে তাদের কি এদেশে বাঁচবার অধিকার নেই? তারা কি গঙ্গার জলে ভেসে যাবে?

গত আড়াই বছরে অন্তত কয়েক হাজার চাকরির অ্যাপ্লিকেশন লিখেছে সোমনাথ কিন্তু ওই আবেদন-নিবেদনই সার হয়েছে। আজকাল, সত্যি বলতে কি চাকরির ব্যাপারটা আর ভাবতেই ইচ্ছে করে না সোমনাথের। কোনো লাভ হয় না, মাঝখান থেকে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।

আবার একটু ঘুমের ঘোর আসছে সোমনাথের।

সোমনাথের মনে হচ্ছে চাকরির উমেদারী এবার শেষ হলো। ধবধবে সাদা শার্ট-প্যান্ট এবং নীল রংয়ের একটা টাই পরে সেমিনাথ প্রখ্যাত এক বিলিতী কোম্পানির মিটিং রুমে বসে আছে। দিশী সায়েবরা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। তাঁরা একের পর এক প্রশ্নবাণ ছাড়ছেন, আর সোমনাথ অবলীলাক্রমে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। একজন অফিসার তারই মধ্যে বললেন, “মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি রিটন পেপারে ফরেন ক্যাপিটাল সম্পর্কে খুব সুন্দর উত্তর লিখেছেন। এ-বিষয়ে আরও দু-একটা কথা আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।” ভদ্রলোকের প্রস্তাবে সোমনাথ একটও ভয় পাচ্ছে না। কারণ ফরেন ক্যাপিটাল সম্পর্কে সব রকম সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর সোমনাথের মখস্থ আছে।

ইন্টারভিউ শেষ করে সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ জানিয়ে সোমনাথ বেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সুন্দরী এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সেক্রেটারী মিটিং রুমের বাইরে ওর পথ আটকালো। বললো, “মিঃ ব্যানার্জি, আপনি চলে যাবেন না-রিসেপশন হল-এ একটু অপেক্ষা করুন।”

মিনিট পনেরো পরে সোমনাথের আবার ডাক হলো। পার্সোনেল অফিসার অভিনন্দন জানালেন এবং করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “বুঝতেই পারছেন, আমরা আপনাকেই সিলেক্ট করেছি। দু-একদিনের মধ্যেই জেনারেল ম্যানেজারের সই করা চিঠি পাবেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়া মাত্রই আমাদের জানিয়ে দেবেন, কবে কাজে যোগ দিতে পারবেন।”

সেই চিঠিটার জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সোমনাথ। কখন কমলা বউদি ঘরে টোকা দেবেন, হাসি মুখে বলবেন, “নাও তোমার চিঠি এইমাত্র পিওন দিয়ে গেলো।”

সত্যিই দরজায় টোকা পড়ছে। সোমনাথের ঘুম ভেঙে গেলো। চুড়ির আওয়াজেই সোমনাথ বুঝতে পারছে কে ধাক্কা দিচ্ছে। তাহলে এই ইন্টারভিউ-এর ব্যাপারটাই মিথ্যা—ভোরবেলায় সোমনাথ এতোক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিল।

সোমনাথ দরজা খুলে দিলো। মেজদার বউ বুলবুল দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুলবুলের সঙ্গে সোমনাথের একটু রসিকতার সম্পর্ক। ওঁরা একসঙ্গে চার বছর কলেজে পড়েছে। বুলবুল বললে, গুড মর্ণিং। পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল। আর কতক্ষণ ঘুমবে?”

মুখ গম্ভীর করে সোমনাথ শুয়ে রইলো। মনে মনে বললে, “বেকার মানুষ সকালসকাল উঠেই বা কী করবো?”

বুলবুল বললে, “দিদির হুকুম, সোমকে তুলে দাও।”

“বউদি কোথায়?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।

“বউদি এখন নিজের কাজে ব্যস্ত।”

সোমনাথ একমত হলো না। “বউদির একমাত্র ছেলে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল রয়েছে। বউদির কর্তাটি বেশ কিছুদিন অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে। সুতরাং বউদি এখন নিজের কাজে কি করে ব্যস্ত থাকবেন?”

বুলবুল ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, “দাঁড়াও, দিদিকে রিপোর্ট করছি। কর্তা ছাড়া আমাদের বুঝি কোনো কাজকর্ম নেই।”

সোমনাথ অধৈর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আঃ! বলো না বউদি কোথায়?”

বুলবুল হেসে বললো, “আমিও তো তোমার বউদি।”

সোমনাথ বললো, “তোমাকে তো আমি এখনও বউদি বলে রেকগনাইজ করি নি। দাদার বউ হলেই বউদি হওয়া যায় না বুঝলে?”

“তবে কী হওয়া যায়?” সহাস্যে বুলবুল চোখ দুটো বড় বড় করে জানতে চাইলো।

“সে সব তোমাকে বোঝাতে অনেক সময় লাগবে,” সোমনাথ উত্তর দিলো। “সময় মতো বলা যাবে। এখন বলো বউদি কোথায়?”

বুলবুল বললো, “দিদি দোতলার ব্যালকনিতে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। মাথায় অনেক দায়িত্ব, হাজার হোক বাড়ির বড় গিন্নি তো।”

সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কর্তা ঘুম থেকে উঠেছে?”

“কোন, সকালে উঠে পড়েছে। অফিসে কী সব জরুরী মিটিং আছে, এখনই গাড়ি আসবে। তাই বাথরুমে ঢুকেছে।”

বুলবুল আরও জানালো, “ওর অফিসে কী যে হয়েছে! শুধু কাজ আর কাজ। লোকটাকে খাটিয়ে খাটিয়ে মারছে।” সোমনাথের জন্যে বুলবুল এবার চা আনতে গেলো।

অফিসে এই খাটিয়ে মেরে ফেলার প্রসঙ্গটা সোমনাথের ভালো লাগলো না। চাকরি পেলে অফিসে খুব খাটতে হাজার হাজার বেকারের মোটেই আপত্তি নেই। চাকরিওয়ালা লোকগুলো বেশ আছে। চাকরি করছো এই না যথেষ্ট—তবু মন ওঠে না, কাজেও আপত্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *