মৎস্য শিকারের কোলাহল তখনও সমানে হয়ে চলেছে। সূর্য নেমেছে আরও নিচুতে। শ্যামাঙ্গ বারংবার তার মৃৎফলকগুলির কথা ভাবছিলো। জীবন্ত এবং উজ্জ্বল যে চিত্রমালা এখন চোখের সম্মুখে দেখছে–তাই তো সে ধরে রেখেছিলো তার মৃৎফলকগুলির মধ্যে। কিন্তু বসুদেব বুঝলেন না। এখন একটি দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার পর তার মনে হচ্ছে গুরু বসুদেবের ঐ আচরণ প্রকৃতই নাটকীয়। ঐ আচরণে কোনো মহত্ত্ব আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। চোখের সম্মুখে নতুন চিত্রমালার জীবন্ত বিষয়গুলি যতোই সে দেখছে, ততোই তার গুরুদেবের ওপর করুণা হচ্ছে। গুরু বসুদেব যদি প্রকৃতই শিল্পী হতেন, তাহলে তিনি সুধীমিত্রের নির্দেশ উপেক্ষা করতেন এবং যা তিনি শিষ্যদের বলেছেন তা–ই নিজের জীবনে পালন করতেন। তিনি সে চেষ্টা আদৌ কখনও করেছেন কি না তাই এখন সন্দেহের বিষয়। তিনি কি শিষ্যের পক্ষ নিয়ে সুধীমিত্রের বিরোধিতা করেছেন? করেননি। তাহলে তাঁর ঐ ক্ষিপ্ত উন্মাদ আচরণের কোনো তাৎপর্যই থাকে না। তুমি অন্তরে সৎ থাকবে, মহান থাকবে, কিন্তু বাইরে কিছুই বলবে না, এভাবে কি শিল্পী জীবনযাপন করতে পারে?
হঠাৎ সমস্বরে চিৎকার উঠতেই শ্যামাঙ্গ দৃষ্টি প্রসারিত করলো। দেখলো, একখানি চতুষ্কোণ জালে একটি মধ্যমাকার রোহিত মৎস্য লম্ফঝম্প করছে এবং দুতিনটি কিশোর ছুটে যাচ্ছে ঐ জালের দিকে। কিন্তু লাভ হলো না। করায়ত্ত হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রোহিতটি সজোর লম্ফ দিলো। এবং সবাইকে হতাশ করে নিমেষে পতিত হলো জলে।
দৃশ্যটি শ্যামাঙ্গ উপভোগ করলো, এবং অপেক্ষা করতে লাগলো, দেখা যাক, ঐ জালধারীর ভাগ্য পরবর্তী প্রচেষ্টায় কী এনে দেয়।
আর ঠিক ঐ সময় তার কানে এলো হাস্যমুখরা দুই রমণী কণ্ঠের আলাপ। একজন বলছে, চুপ চুপ দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা ভয় বলতে কি কিছুই নেই একেবারে?
কেন লো? আমি কি তোর মতো ভর্তাতাড়িতা যে আমার লজ্জা থাকবে?
বৃক্ষতলের বেদী যথেষ্ট উঁচু, সম্মুখের ভূমি নিম্নগামী এবং ঐ নিম্নভূমি থেকেই উঠে আসছিলো দুই সখী এবং তাদের আলাপ।
শ্যামাঙ্গ উঠে বসতেই মুখোমুখি হলো। দেখলো, দুটি শ্যামবর্ণা যুবতী পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। সম্মুখে হঠাৎ অপরিচিত যুবাপুরুষ দেখে ঈষৎ বা অপ্রতিভ।
লক্ষ্য করে শ্যামাঙ্গ, দুজনেই ঈষৎমেদা এবং শ্রোণীভারানতা। তবে আবার দুজনকেই ঈষৎ চঞ্চলও মনে হয়। হয়তো নবীন যৌবনের কারণে দুজনেরই কৃষ্ণ অক্ষিপক্ষ্মে কৌতুক ও কৌতূহল। শ্যামাঙ্গ মৃদু হাস্যে বললো, আমি ভিন্নদেশী পথিক, এই গ্রামের নাম কি, বলবেন?
তরুণী দুটি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে। তারপর ধীরপদে কাছে আসে। জানায়, গ্রামের নাম উজুবট, গ্রামপতি বিপ্রদাস–এবং ঐ যে দেখা যায়–হাত তুলে দেখায় একজন, ঐখানে আমাদের গ্রাম। শ্যামাঙ্গ দেখে, দূরে আম্রবীথি এবং তার ওপারে একটি মন্দিরের ধ্বজা দেখা যাচ্ছে। তরুণীটি জানায়, ঐ মন্দিরের কাছে গ্রামপতির গৃহ।
তরুণী দুটি তৎক্ষণাৎ চলে গেলো না–একটি সহজ, কৌতূহলী এবং আগ্রহী ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্যামাঙ্গের মনে হলো, এ অঞ্চলের নারীরা সম্ভবত অধিকতর শিথিলশাসনা। সে কারণেই অহেতুক লজ্জা বা সঙ্কোচ দেখছে না তরুণী দুটির আচরণে। বরং সহজেই তারা কৌতূহল প্রকাশ করছে। দুজনেই নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। যেমন, পথিক কি পূর্বে এদিকে আসেননি? আপনার নিবাস কোথায়? রজতপট গ্রাম শুনেছি অনেক দূর–আপনি কি পদব্রজে যাবেন? আচ্ছা, আত্রেয়ী নদী কি আরও প্রশস্তা?
প্রশ্নগুলির প্রত্যেকটিরই উত্তর দিতে হলো শ্যামাঙ্গকে। ইতোমধ্যে একটি বৃদ্ধা এসে উপস্থিত হয়েছে। সেও আলাপে যোগ দিলো। বৃদ্ধার রসনা প্রখর, তদুপরি সে সুরসিকা। ফলে তরুণী দুটির স্বভাবত সংকোচও আর থাকলো না। যখন বৃদ্ধা জানতে চাইলো, পথিক এই নবীন যৌবনে বিবাগী কেন–এই বয়স তো প্রব্রজ্যার নয়? তখন সকৌতুকে শ্যামাঙ্গের মুখপানে দৃষ্টি রাখলো তরুণী দুটি।
আর সে জন্যই বৃদ্ধার কথার উত্তর দেবার পূর্বে দুমুহূর্ত ভাবতে হলো শ্যামাঙ্গকে। সে বুঝলো, বৃদ্ধা তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে রসিকতা করতে চাইছে। বললো, আয়ি, আপনার মতো কেউ যদি থাকতো, তাহলে কি এই অধম দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়ায়?
বৃদ্ধা হাসিতে ভেঙে পড়ে। মেয়ে দুটিকে বলে, দেখ লো, পথিক কি চতুর–আমাকে সম্বোধন করলেও বক্তব্য কিন্তু তোদেরই শোনাচ্ছে। তোরা সাবধান হ।
বৃদ্ধার ঐ সরস কটাক্ষের উত্তরে, যে অধিকতর শ্যামা, সে বললো, আয়ি, আমাদের তো লোক আছে, তোমারই নেই–তুমি বরং ভেবে দেখতে পারো।
ঐ সময় নদীকূল থেকে একটি বালকের চিৎকার শোনা গেলো, তার মাছ কে একজন ছিনিয়ে নিচ্ছে। ঐ গোহারি শুনে বৃদ্ধা দাঁড়ালো না। যাবার সময় বলে গেলো, ওলো তোরা পথিককে ছাড়িস নে–আমি আসছি।
আয়ি সুরসিকা, শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে।
আমরাও দেখি, কি কি মাছ ধরা পড়লো।
শ্যামাঙ্গের মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে তরুণী দুটি নদীতীর অভিমুখে অগ্রসর হলো। শ্যামাঙ্গ পেছন থেকে ডেকে বললো, বৃহৎ রোহিত ধরা পড়লে নিমন্ত্রণ যেন পাই, দেখবেন।
শ্যামাঙ্গের ঐ কথায় দুজনই ঘুরে দাঁড়ায়। দুজনেরই অক্ষিতারকা নৃত্যপর হয়, পথিক কি ব্রাহ্মণ?
কে ব্রাহ্মণ? আমি? শ্যামাঙ্গ অবাক হয়।
নাহলে রোহিত ভোজনের জন্য এরূপ উদগ্র বাসনা কেন?
শ্যামাঙ্গ প্রায় মুগ্ধ হয়ে গেলো। শ্যামা তরুণীটি বড়ই বুদ্ধিমতী। সে সহজ স্বরে বললো, পথিকের আর দোষ কি বলুন, পুনর্ভবা তীরের রন্ধন নৈপুণ্যের খ্যাতি কে না জানে, তদুপরি নবাম্র আর সজিনাদণ্ডিকার ঋতু এখন–এ সময় ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ নির্বিশেষে সকল রসনারই উদগ্র হওয়ার কথা, আশা করি আপনাদের অজানা নয় সে কথা।
তা নয়, উজ্জ্বলতরা তরুণীটি জানায়, কিন্তু এও মনে রাখবেন, এতদঞ্চলে ঝালের ব্যবহার বেশি। ঝালতপ্ত ব্যঞ্জন ভোজনের অভ্যাস কি আছে পথিকের?
শ্যামাঙ্গ হাসে। মনে মনে বলে, ঝালের কেমন ব্যবহার তা বাপু বিলক্ষণ অনুভব করছি। প্রকাশ্যে বলে, এ অধম ব্রাহ্মণও নয়, শিশুও নয়, যে ননীছানাভুক হবো, আপনারা নিমন্ত্রণ করে দেখুন একবার।
আচ্ছা সে দেখা যাবে, বলে মেয়ে দুটি অতঃপর বিদায় নেয়।
শ্যামাঙ্গ এবার বেদী থেকে নেমে দাঁড়ায়। দেহের ক্লান্তি এবং অবসাদ সত্যিই এবার অনেকখানি দূর হয়েছে। সে দেখে, মৃত নদীর কর্দমাক্ত জলাশয় থেকে সিক্ত বস্ত্রে একে একে মৎস্য শিকারীরা উঠে আসছে। প্রত্যেকের কটিবন্ধনীতে মৎস্যমালা বিলগ্ন। বৃহদাকৃতির মৎস্য প্রায় কারও ভাগ্যেই জোটেনি।
তারা একে একে কৌতূহলভরে বৃক্ষতলে এসে দাঁড়ায়। কারও হাতে ক্ষুদ্রাকৃতি জালিকা। কারও হাতে লৌহাগ্র কোঞ্চ, কারও হাতে বংশখণ্ডিকা নির্মিত পলই। সকলেই শ্যামাঙ্গ সম্পর্কে জানতে চায়। ক্রমে তারা একযোগে ঘিরে দাঁড়ালো। আর তাতে অদ্ভুত একটি অনুভূতি হলো শ্যামাঙ্গের। জলের, মৃত্তিকার, আমিষের সম্মিলিত একটি গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে দিলো। একবার ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, সে যেন অন্য মানুষ। সমাগত লোকেরা নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। কেউ কেউ নাম পরিচয় জানতে চায়। সে আত্রেয়ী তীরের মানুষ জানতে পেরে কয়েকজনের আগ্রহ কিঞ্চিৎ অধিক হলো। অত দূরের মানুষ এ অঞ্চলে অহরহ আসে না। যাদের আত্মীয়স্বজন ঐ দূরদেশে থাকে, তারা নানাবিধ কুশলাদি জানার প্রত্যাশী। যেমন, মহাশয় কি নীলাঞ্জন গ্রামের দিবোনাথকে চেনেন? আপনার গ্রাম থেকে মালঞ্চি গ্রাম কত দূর? আত্রেয়ী তীরের কুম্ভকারেরা কি আর মৃৎপাত্র নির্মাণ করে না? এই প্রকার একের পর এক প্রশ্ন। শ্যামাঙ্গ কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, কোনোটির পারে না। ওরাই জানালো, আত্রেয়ী করতোয়া সংগম এখান থেকে বিশ ক্রোশাধিক পথ। এ গ্রামের হাটে কদাচিৎ আসে আত্রেয়ী তীরের মানুষ। আপনি বরং নবগ্রাম হাটে যান, একজন পরামর্শ দিলো, ওখানে প্রায় নিয়মিতই আত্রেয়ী তীরের বহু শকট আসে।
নবগ্রাম হাটের নাম শুনে শ্যামাঙ্গ আগ্রহী হয়। সুহৃদ নীলাম্বর নবগ্রাম হাটের কথা বারংবার বলে দিয়েছে। সে জানতে চাইলো, নবগ্রাম কি এ স্থান থেকে অধিক দূর?
না না, দূর কেন হবে? জলসিক্ত প্রৌঢ় লোকটি জানালো। বললো, এই ক্রোশ তিনেক পথ হবে।
ক্রোশ তিনেক। শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণে। তার অনুমান ছিলো, নবগ্রামে যদিবা সে নাও এসে থাকে তাহলে অন্তত পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামে এসেছে–উজুবট নবগ্রাম হাটেরই নিকটবর্তী কোনো স্থান হবে। কিন্তু এখন? সে পশ্চিমাকাশে চাইলো–সূর্যাস্তের আর দণ্ডাধিককাল দেরী–যদি যেতে হয়, তাহলে এখনই তার যাত্রারম্ভ করা উচিত। পথিমধ্যে হয়তো রাত্রি হবে–কিন্তু উপায় তো কিছু নেই, তিন ক্রোশ পথ সহজ ব্যাপার নয়।
সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। পাদুকা যুগল পরিধান করে, উত্তরীয় খানি স্কন্ধে রাখে এবং তার যথাসর্বস্ব পুটুলিটি হাতে তোলে।
তাকে ঐভাবে উদ্যোগী হতে দেখে প্রৌঢ়টি বললো, মহাশয় তিন ক্রোশ পথ কম নয়, আপনি অচেনা মানুষ, এই সন্ধ্যা সমাগমে যাত্রা না করলেই ভালো।
শ্যামাঙ্গ সম্মুখে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেয়—হ্যাঁ, সন্ধ্যার আর সত্যিই দেরি নেই। কৌতূহলী গ্রামবাসীরা কৌতূহল নিবৃত্ত করে চলে যাচ্ছে। প্রৌঢ় লোকটিও চলে গেলো। আশ্চর্য ব্যাপার! তাকে সন্ধ্যা সমাগমে যাত্রা করতে নিষেধ করলো প্রৌঢ় লোকটি, অথচ তার রাত্রিযাপনের কি ব্যবস্থা হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বললো না। তার অনুমান হয়, বোধ হয় তাকে আবার বিপদে পড়তে হবে।
ঐ সময় তার প্রৌঢ় পথিকের কথা মনে পড়ে। মনে মনে তুলনা করে, দণ্ড কয় আগে তার ভালো–মন্দ নিয়ে এক প্রৌঢ়ের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না–আর এখন অন্য এক প্রৌঢ় তার সমস্যার কথা জেনেও কিছু করার চেষ্টা করলো না। সে উঠে দাঁড়ায়, আপাতত যাত্রারম্ভ করাই বিধেয়। পথিমধ্যে যদি তেমন বোঝে, তাহলে পথিপার্শ্বেরই কোনো গ্রামে হয় আশ্রয় প্রার্থনা করবে।
কিন্তু প্রথম পদক্ষেপণের মুহূর্তেই তাকে থামতে হলো। শুনলো, পথিক মনে হচ্ছে যাত্রারম্ভ করলেন?
তরুণী দুটি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেনি। সে ঘুরে দাঁড়ালো। এবং মৃদু হাস্যে বললো, হ্যাঁ ভাবছি, নবগ্রাম পর্যন্ত চলে যাই।
তার কথায় দুজনের মুখেই ঈষৎ উদ্বেগের ছায়া দেখা গেলো। একজন বললো, নবগ্রাম তো অতি নিকটে, তাই না?
হ্যাঁ, এক প্রৌঢ় তো তাই বললেন, মাত্রই তিন ক্রোশ।
হ্যাঁ, মাত্র তিন ক্রোশ, উজ্জ্বলতরা তরুণীটির চোখে মুখে কপট কৌতুক দেখা গেলো ঐ সময়। বললো, এই তিন ক্রোশ পথ সূর্যাস্তের মধ্যে অতিক্রম করতে আপনার অসুবিধা হবে না তাই না?
না, তা নয়, শ্যামাঙ্গ স্বীকার করে, পথিমধ্যে রাত্রি অবশ্যই হবে।
তাহলে? দুজনের কণ্ঠ থেকে একসঙ্গে শব্দটি উচ্চারিত হয়।
তাহলে কী, শ্যামাঙ্গ জানতে চায়, পথ দুর্গম? পথিমধ্যে অরণ্য আছে? ব্যাঘ ভল্লুক আক্রমণ করে?
স্বল্প শ্যামা তরুণীটি জানায়, শুনুন মহাশয়, ও কাজও করবেন না। পথিমধ্যে অরণ্য আছে তা ঠিক এবং অরণ্যের ব্যাঘ্র ভল্লুকের আক্রমণের ভয়ও আছে। তবে সর্বাপেক্ষা ভয়ের কারণ অরণ্য সংলগ্ন গ্রামগুলি–ঐ গ্রামগুলিতে দস্যু তস্করের বাস। যাত্রা করতে চাইলে ভেবে–চিন্তে তবে যাত্রা করুন।
শ্যামাঙ্গকে এবার ভাবতে হয়। তার কটিদেশে গ্রন্থিবদ্ধ স্থলীতে যা আছে তার মূল্য খুব বেশি না হলেও একেবারে তুচ্ছ নয়। উপরন্তু প্রৌঢ় পথিক আবার কিছু মুদ্রা তাকে দান করেছেন। এ তো মহাবিপদ। সে মনে মনে কিছুটা আতঙ্ক বোধই করে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে হাসে, বলে, কিন্তু আমার যাত্রা করা ছাড়া আর কি উপায় আছে বলুন? এখানে আমাকে কে থাকতে দেবে?
ঐ কথায় দুই তরুণীই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। বোঝা যায় তারা দারুণ বিব্রত বোধ করছে। উত্তরে তারা কিছুই বলে না এবং এমন ভাব করে, যেন তাদের ব্যস্ততা আছে এবং অচিরাৎ তাদের গৃহে ফেরা প্রয়োজন।
আচ্ছা, এখানে কোনো মন্দির নেই? শ্যামাঙ্গ জানতে চায়।
হ্যাঁ আছে, কেন থাকবে না, একজন হাত তুলে দেখায়, ঐ যে দেখুন, মন্দিরের ধ্বজা উড়ছে।
শ্যামাঙ্গ সেদিকে লক্ষ্য করেনি তা নয়। সে পূর্বেই দেখেছে চক্রলাঞ্ছিত গৈরিক ধ্বজা চৈত্রের বাতাসে সতেজে উড্ডীন। সে বলে, কিন্তু ও তো বিষ্ণুমন্দির, সম্ভবত ব্রাহ্মণদের নিবাস ওখানে, নিকটে কোনো শিবমন্দির নেই?
পথিক কি শিবভক্ত? আবার কৌতুক ফোটে শ্যামাঙ্গী তরুণীটির স্বরে।
না, শ্যামাঙ্গ জানায়।
তাহলে কী?
এবার উজ্জ্বলবর্ণা মেয়েটির চোখে হাসি দেখা গেলো। বললো, ব্রাহ্মণ নয়, শিবভক্ত নয়, তাহলে কী?
কেন ব্রাহ্মণ ও শিবভক্ত ব্যতীত কি অন্য কিছু হওয়া যায় না?
যাবে না কেন? শ্যামাঙ্গী মেয়েটি উত্তর দিলো। বললো, শিবভক্ত না হয়ে যখন কোনো অপরিচিত আগন্তুক শিব মন্দিরের আশ্রয় সন্ধান করে, তখন তার পরিচয় জানতে চাওয়া গ্রামবাসীর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
শ্যামাঙ্গ ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে, এই তরুণীটির বুদ্ধি যেমন প্রখর বাকপটুতাও তেমনই অসাধারণ। তার বাক্যালাপ সে উপভোগ করতে লাগলো। বললো, জানা ছিলো না যে, পুরুষ নয়, নারীরাই পুনর্ভবা তীরে কোট্টপালের দায়িত্ব পালন করে।
তরুণীটি অপ্রতিভ হয় না। বলে, যদি তাই–ই হয়, তাহলে কি দোষ আছে কিছু?
না, না, দোষ কেন থাকবে? শ্যামাঙ্গ জানায়, আমার এখন মনে হচ্ছে, নবগ্রাম যাত্রা করাই বোধ হয় উত্তম ছিলো।
কেন? হঠাৎ একথা মনে হচ্ছে কেন? মেয়ে দুটি হতচকিত বোধ করে।
মনে হচ্ছে এজন্য যে শুনেছি, কামরূপ প্রভৃতি পূর্বদেশে রমণীরাই সমাজে সর্বেসর্বা। সেখানে পুরুষেরা কেউ বলীবর্দ, কেউ ছাগ, কেউবা কুক্কুর–এখন চিন্তা হচ্ছে, পুনর্ভবা তীরেও সেই রীতির প্রচলন হয়েছে কিনা, যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি এই দীন অভাজন পুনরায় গৃহের মুখ দেখতে পাবে?
শ্যামাঙ্গের ঐ কথায় দুই তরুণীই হেসে উঠলো।
ললিত প্রেক্ষণা রমণীর আননে সকৌতুক হাস্য পরিহাস যে বিচিত্র ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে তা শ্যামাঙ্গের অজানা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সম্মুখের তরুণী দুটির হাস্যাননে কোনো প্রকার ইন্দ্রজালই সে সৃষ্টি হতে দেখলো না। যা দেখলো তা নিতান্তই সহজ কৌতুক–এবং তাতে তার মন হয়ে উঠলো ভারমুক্ত। কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা বা মানসিক পীড়ন ঐ সময় তার অনুভূতিতে আর রইলো না।
শ্যামাঙ্গ নগরবাসী রাজপাদোপজীবী অথবা সামন্তপ্রভু গৃহের যুবকপুত্রদের মতো লীলারঙে কুশলী নয়। হলে সে এই কৌতুকহাস্যকে দীর্ঘায়ত করতে সচেষ্ট হতো। এবং হাস্যালাপের সূত্র ধরে প্রণয়াসক্তি প্রকাশের চেষ্টা করতো। তাই কৌতুকের ভাবটি সে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। কারণ ওদিকে দিবা অবসান প্রায়–এবং তরুণী দুটি ঈষৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তদুপরি তার নিজেরও একটি রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সে কখনও বামে কখনও দক্ষিণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। যদি কোনো বয়স্ক পুরুষ গোচরে আসে।
শ্যামাঙ্গনা তরুণীটি তা লক্ষ্য করে থাকবে। বললো, পথিক কি কাউকে সন্ধান করছেন?
হ্যাঁ, আপনাদের গ্রামে দেখছি পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই স্বল্প।
কেন, তাতে কি ভয় হচ্ছে? মেয়েটির স্বরে কৌতুক ঘোচে না। কপট আশ্বাস দেয় সে। বলে, আপনার ভয়ের কারণ নেই, বলীবর্দ, ছাগ অথবা কুক্কুর কোনোটারই আমাদের প্রয়োজন নেই।
আহা যদি হতো! শ্যামাঙ্গ যেন দীর্ঘশ্বাস মোচন করে।
হলে কি ভাল হতো? মেয়েটির চোখে ঈষৎ বিস্ময় ফোটে, এই না বললেন যে আপনার ভয় হচ্ছে–আবার এখনই হায়–হুতাশ কেন?
শ্যামাঙ্গ আক্ষেপ করে বলে, হায় যদি আপনাদের প্রয়োজন হতো, তাহলে বলীবর্দরূপে হোক, কি ছাগরূপে,–রাত্রিযাপনের একটা ভালো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আমার জন্য করতেন আপনারা।
তরুণী দুটি আবার বিব্রত বোধ করতে আরম্ভ করে। তাদের মুখ দেখে শ্যামাঙ্গ বোঝে, পথিককে তারা যে গৃহে আমন্ত্রণ জানাতে পারছে না, এই জন্যই তাদের মুখে ঐ বিব্ৰত ভাব। সে তখন জানতে চাইলো, আচ্ছা, আমি যদি ঐ মন্দিরে গিয়ে রাত্রিযাপনের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাহলে কেমন হয়?
না, স্বল্প–শ্যামা উত্তরে জানায়, আপনি বরং আমাদের গ্রামে যান–আমার পিতা শুকদেব, মাতুল দীনদাস। গ্রামে গিয়ে এঁদের সন্ধান করবেন এবং নিজ পরিচয় দিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।
ক্ষণেক চিন্তা করে হঠাৎ মেয়েটি জানতে চাইলো, আম্রপট্টলী গ্রাম কি চেনেন আপনি? আত্রেয়ী তীরের আম্রপট্টলী?
কেন, ঐ গ্রামে কে আছে আপনার? শ্যামাঙ্গ কৌতূহলী হয়। আম্রপট্টলী গ্রাম সে বিলক্ষণ চেনে–সেখানে তার মাতুলালয়। বললো, আমার গ্রাম রজতপট, আম্রপট্টলী থেকে দূরত্ব পাঁচ ক্রোশের মতো।
শ্যামাঙ্গের কথায় যেন উৎসাহ বোধ করে মেয়েটি। বললো, আম্রপট্টলীতে আমার ননদের শ্বশুরালয়। আমার পিতাকে বলবেন যে অনন্তদাসকে আপনি চেনেন। আমার ননদের নাম ব্রজতারা, মোহনদাস তার স্বামী, অনন্তদাসের পুত্র। আমার নাম মায়া, মায়াবতী–বলবেন যে আমার নাম আপনি জানেন।
ব্যাপারটি বেশ জটিল। মায়াবতীর ননদ ব্রজতারা, তার স্বামী মোহনদাস, মোহনদাসের পিতার নাম আবার অনন্তদাস–নিবাস আম্রপট্টলী গ্রাম–অতি দীর্ঘ একটি তালিকা। শুধু এইটুকুই নয়–একটি সম্পূর্ণ কাহিনী নির্মাণ করতে হবে তাকে এখন এবং সর্বক্ষণ সেটি মনে রাখতে হবে। তারপরও রয়েছে মায়াবতীর স্বামীর নাম, শ্বশুরের নাম, তাদের গ্রামের নাম–সম্পূর্ণ ব্যাপারটি আয়ত্তে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। মায়াবতীর পরামর্শ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না তার কাছে। বললো, আতিথ্য লাভের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে? এই কি নিয়ম নাকি এদেশে?
ঐ প্রশ্নে মায়াবতী গম্ভীর হয়ে উঠলো। বোধ হয় কিঞ্চিৎ আহত হলো সে। তার সঙ্গিনীও যে খুব প্রসন্ন হয়েছে এমন মনে হলো না। মায়াবতী সঙ্গিনীকে ডেকে বললো, আয় লীলা, আমরা যাই, বেলা গেলো।
তাহলে এ হলো মায়া, শুকদেবের কন্যা, আর ঐটি হলো লীলা, সম্ভবত লীলাময়ী অথবা লীলাবতী। শ্যামাঙ্গের নাম দুটি মধুর বোধ হলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, মায়াবতীদের গৃহেই সে আতিথ্য প্রার্থনা করবে।
অদূরে মেয়ে দুটি উচ্চ আলপথের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লীলাবতীর কেশভার বিপুল। নদীতীরের বাতাসে তার শিথিল কবরী বিস্রস্ত হওয়ায় বারবার তাকে দুহাত তুলে কবরী বন্ধন করতে হচ্ছিলো। আর ঐ সময়ই শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে লীলাবতীর দেহসৌষ্ঠব অনিন্দ্য। সে একটি অপরূপ যক্ষিণী মূর্তি দেখেছিলো সোমপুর মহাবিহারে। লীলাকে দেখে কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত পীবরস্তনী, বিপুলজঘনা, সুকেশী যক্ষিণী মূর্তিটি বারবার তার মানস চক্ষে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এবং নিজ বক্ষের অনেক গোপনে কোথায় যেন সে বারবার শিহরিত হতে লাগলো।
মায়াবতী পিত্রালয়ে থাকে এবং সে যে বিবাহিতা তা বোঝা গেলো। কিন্তু লীলাবতী? তার সংবাদ তো জানা গেলো না কিছুই, সে কি সত্যিই স্বামী পরিত্যক্তা?