০২. মেমোরিয়ামে
হ্যারির রক্ত ঝড়ছে। ডান হাত দিয়ে সে বাঁ হাত চেপে ধরেছে। তার মুখের নিচের অংশটি ঘামছে। সে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তার বেডরুমের দরোজাটি খুলল। ঘরটিতে চীনা মাটির ভাঙা টুকরাটাকরি। তার পা পড়ল ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চাসহ চায়ের কাপের উপর। বেডরুমের ঠিক বাইরে মেঝের ওপর কাপটি রাখা ছিল।
কী কারণ
সে চারদিকে তাকাল। প্রাইভেট ড্রাইভ, চার নম্বর ল্যান্ডিং ফ্লোর পুরোটা দেখল। কিন্তু কেউ নেই। হয়তো এই চায়ের কাপ রেখে তামাশা করার ধারণাটি ডাডলির মাথা থেকে এসেছে। যে হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে তা সে উপরের দিকে তুলে ধরে আছে। হ্যারি অন্য হাতটি দিয়ে কাপের ভাঙা টুকরোগুলো জড়ো করল এবং ঘরের মধ্যে রাখা দুমড়ানো ময়লা ফেলার বিনটিতে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাথরুমে গেল হাতের আঙুলগুলোকে পানির ট্যাপের নিচে রাখার জন্য।
কী রকম স্টুপিড,অর্থহীন,বিরক্তিকর বিষয় যা বিশ্বাস করা যায় না, আজ ঢার দিন হয় সে যাদু ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু সে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিল যে তার নখের আগায় কাটার কারণটাই তাকে ভোগাচ্ছে। সে কখনো এটা শিখতে পারেনি কী করে ক্ষত সারাতে হয়। এবং এখন সে ভাবতে থাকল, বিশেষ করে তার পরিকল্পনার কথা চিন্তা করে, তার যাদু শিক্ষায় এই বিষয়টিতে ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। বিষয়টি কী করে হলো তা হারমিয়নের কাছে জানতে হবে, ওর পেছনে দরোজাটি বন্ধ করার আগে এই চিন্তা করে সে বেশ খানিকটা টয়লেট পেপার নিয়ে যতটা পারল মেঝের ওপর থেকে চায়ের দাগ মুছল।
হ্যারি ওর সকালটা ব্যয় করল স্কুল ট্রাঙ্কটা পুরো খালি করতে। ছয় বছর আগে গোছানো ট্রাঙ্কটা এই প্রথম সম্পূর্ণ খালি করল। এতদিন স্কুলের শুরুর বছরগুলোতে সে ট্রাঙ্কের উপরের দিকে থাকা তিন চতুর্থাংশ জিনিস পরিবর্তন অথবা ঠিকঠাক করেছে। নিচের দিকে পড়ে আছে কিছু সাধারণ অকেজো আবর্জনা–পুরাতন ফুলের পাপড়ি, শুকিয়ে যাওয়া পোকার চোখ, জোড়ার একটি মোজা যা এখন পায়ে লাগবে না। কয়েকমিনিট আগে হ্যারি এসব জিনিসের মধ্যে হাত ঢুকিয়েছিল এবং ডান হাতের আঙুলের তর্জনীর অগ্রভাগে কেটে যাওয়ায় ব্যথা অনুভব করেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে এনে দেখল প্রচুর রক্ত পড়তে শুরু করেছে।
এবার সে একটু সতর্কভাবে এগুলো। ট্রাঙ্কের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। সে হাত ঢুকিয়ে ট্রাঙ্কের ভেতরে নিচের দিকের জিনিসগুলো অনুভব করতে চেষ্টা করল। সে একটি পুরানো ব্যাজ পেল, সাপোর্ট সেডরিক ডিগরি এবং পটার স্টিংকস, অদৃশ্যমান কোনো কিছু দেখার একটি পুরনো ও ভাঙা স্নিকস্কোপ, একটি লকেট যার ভেতরে লেখা আছে আর.এ.বি, সবশেষে পেল একটি ধারালো যা দিয়ে ওর আঙ্গুল কেটেছিল। সে তখনি চিনতে পারল, যাদু আয়নার দু ইঞ্চি লম্বা একটি অংশ ভাঙা আয়নাটি ওর গডফাদার সিরিয়স ওকে দিয়েছিল। সে হাতড়িয়ে দেখল, আর কোনো খণ্ড পাওয়া যায় কি-না, না সব গুড়ো হয়ে গেছে। ট্রাঙ্কের তলায় চকচক করছে।
হ্যারি আয়নার যে টুকরোতে ওর হাত কেটেছিল সেটির দিকে তাকাল, নিজের সবুজাভ উজ্জ্বল দুচোখ ছাড়া অন্য কিছু দেখা গেল না। সেদিনকার ডেইলি প্রফেট বিছানার ওপর, এখনো পড়া হয়নি, ওর উপর কাঁচের গুড়োগুলো রাখল। আয়না হারানোর বেদনা ভুলে থাকার জন্য ট্রাঙ্কে রাখা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করায় মনোযোগ দিল।
একঘন্টা লাগল খালি করতে, ফেলে দিল কিছু, আর কিছু স্থূপ করে রাখল পরে ভাববার জন্য রাখার প্রয়োজন আছে কি না। তার স্কুল ও খেলার ড্রেস, কলড্রন, হাতে তৈরি কাগজ, পাখার কলম এবং ক্লাসের অধিকাংশ বই এক কোণে ঝুপ করল ফেলে যাওয়ার জন্য। এগুলো দেখে তার আন্ট ও আন্টি কি ভাববে চিন্তা করে মজা পেল হ্যারি। নিশ্চই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জিনিস মনে করে গভীর রাতে পুড়িয়ে ফেলবে। তার মাগল জামাকাপড়, অদৃশ্য হওয়ার আলখেল্লা, পোসন বানাবার উপকরণ ও যন্ত্রপাতি, কয়েকটি বই, হ্যাগ্রিডের দেওয়া ফটো এলবাম, এক বান্ডিল চিঠি এবং তার যাদুদণ্ড একটি পুরনো ব্যাগে রাখল। ব্যাগের সামনের পকেটে রাখল মারুদার যাদু ম্যাপ এবং ভেতরে আর.এ.বি নোট লেখা লকেট।
লকেটটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে নয় যে এটা অনেক দামি
বা অনেক কাজে আসবে… কারণ এই যে এটা অর্জন করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে।
এখানে ডেস্কের উপর অনেকগুলো সংবাদপত্র তূপ হয়ে আছে। তার পাশে বসে আছে সাদা পেঁচা হেডউইগ। গ্রীষ্মের সময় হ্যারি প্রাইভেট ড্রাইভে থাকতে প্রতিদিন একটি করে পত্রিকা আসত।
সে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল। আড়মোড়া ভেঙে ডেস্কের অন্যদিকে গেল। সে সংবাদপত্রগুলোকে একটা একটা করে ছুঁড়ে পাশের আবর্জনার স্তূপের উপর ফেলতে শুরু করল। হেডউইগ একটুও নড়াচড়া করছে না। সে ঘুমিয়ে বা ঘুমের ভান করে আছে। হ্যারির ওপর রাগ করে থাকার কারণ আছে তার, তাকে এখন খুব অল্প সময়ের জন্য খাচা থেকে বের করা হয়েছিল।
পত্রিকা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন হ্যারি একটু মন্থর গতিতে একটি বিশেষ সংখ্যা খুঁজতে থাকল। কারণ সে জানে, গ্রীষ্মে সে প্রাইভেট ড্রাইভে ফিরে আসার প্রায় পরপরই সংখ্যাটি এসেছিল। তার খুব ভালো করে মনে আছে হগগায়ার্ট স্কুলে মাগল বিষয়ের শিক্ষক চ্যারিটি বার্বেজের পদত্যাগ নিয়ে কিছু উল্লেখ করা ছিল। অবশেষে সে ওই পত্রিকাটি খুঁজে পেল। সে ডেস্কের চেয়ারে বসল এবং ১০ নাম্বার পাতায় নিবন্ধটি আবারো পড়তে থাকল।
অ্যালবাস ডাম্বলডোরকে স্মরণ
এলফিয়াস ডোগ
অ্যালবাস ডাম্বলডোরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১১ বছর বয়সে হগোয়ার্ট স্কুলে আমাদের প্রথম দিনে। একটিমাত্র কারণে আমাদের দুজনের দুজন প্রতি আকৃষ্ট
হয়েছিলাম। তা হলো আমরা দুজনই নিজেদেরকে বহিরাগত
অনুভব করেছিলাম। স্কুলে
প্রবেশের কিছুদিন স আগে আমার গুটি বসন্ত হয়েছিল। যদিও আমার সে। রোগের
জীবাণু আর নেই, কিন্তু
বসন্তের ওই ফোটগুলোর সবুজ
দাগ তখন ছিল। যার ফলে অনেকেই আমার কাছে ভিড়তে
চাইত না। আর অ্যালবাসের
বিষয়টি হলো, সে এসেছিল
ঘাড়ে এক দুর্নামের বোঝা
নিয়ে। প্রায় এক বছর আগে ওর বাবা পার্সিবল ভয়ানক অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত
হন। তিনি তিনজন নিরাপরাধ মাগলের ওপর আক্রমণ করেছিলেন।
অ্যালবাম কখনো অস্বীকার করতে চেষ্টা করেনি ওর বাবার (যিনি আজকাবানে
মারা যান) অপরাধের কথা। আবার অন্যদিকে আমি যখন হঠাৎ সাহস করে জিজ্ঞেস করেছি, সে আমাকে জানিয়েছে যে তার বাবা
অধী সেটা সে জানে। এ ছাড়া ডাম্বলডোর এই দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে কথা
বলতে চাইত না, যদিও অনেকেই
চেষ্টা করত তাকে দিয়ে বলাতে। কেউ কেউ ত্য ওর বাবার অপরাধের দায়
ওকে চাপিয়ে দিত এবং ধারণা করত যে অ্যালবাসও মাগল বিরোধী। এরচেয়ে বেশি ভুল ধারণা তাদের ব্যাপারে
আর কিছু নেই; অ্যালবাসকে
চেনে এমন যে কেউ স্বাক্ষ্য দেবে যে তার মধ্যে মাগল বিরোধীর সামান্য প্রবণতাও নেই। সত্যিই
তাই, মাগলদের
সমর্থন করতে গিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে
তার অনেক শক্রর জন্ম হয়েছে।
যা হোক, অল্প কয়েক মাসের মধ্যে তার বাবার ঘটনা ছাপিয়ে অ্যালবাসের নিজের খ্যাতি
ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম বছরের
শিক্ষা শেষে সে আর মাগল বিরোধী
লোকের সন্তান হিসাবে পরিচিত
রইল না। বরং স্কুলের এ
যাবৎ কালের অন্যতম সেরা মেধাবী ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হলো। আমরা যারা তার বন্ধু হওয়া সুযোগ পেয়েছিলাম তার বিভিন্ন গুণাবলি
থেকে উপকৃত হয়েছি। তার
কাছ থেকে সাহায্য বা অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা তো বলার অপেক্ষা
রাখেনা। সে পরবর্তী জীবনে
আমার কাছে স্বীকার করেছে যে সে শুরু থেকেই জানত শিক্ষকতার মধ্যে রয়েছে তার আনন্দ।
সে যে শুধু স্কুলের দেয়া সব পুরস্কার পেয়েছে তাই
নয়, সে সময়ের বিখ্যাত ও প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সাথে তার পত্র যোগাযোগ হতো। তার মধ্যে ছিল বিখ্যাত আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বাথিন্ডা ব্যাগসট এবং যাদু
তাত্বিক অ্যালবার্ট ওয়াফফিং প্রমুখ। তার বেশ কয়েকটি লেখা
ট্রান্সফিগারেশন টুডে,
চ্যালেঞ্জিং ইন চার্মিং এবং দ্য প্র্যাকটিক্যাল পাইওনিয়ারের মতো প্রকাশনায় জায়গা করে নেয়। ডাম্বলডোরের পরবর্তী জীবন ছিল শনৈঃ
শনৈঃ উন্নতির। শুধু একটি
প্রশ্ন বাকি ছিল, কবে সে
যাদু মন্ত্রী হবে। পরবর্তী
বছরগুলোতে মনে হয়েছে যে
সে মন্ত্রী হয় হয় প্রায়,
কিন্তু মন্ত্রীত্ব গ্রহণের আগ্রহ
কখনোই তার ছিল না।
হগোয়ার্টে কাজ শুরুর তিন বছর পর অ্যালবাসের ভাই অ্যাবারফোর্থ স্কুলে আসে। তারা দুজন মোটেই
এক রকম নয়। আবারফোর্থ কখনোই বইয়ের পোকা ছিল না এবং অ্যালবাসের মতো সে যুক্তিতর্কে বিচার বিশ্লেষণের ধার ধারত না। কিন্তু এ কথা বলা যাবে না যে দুই ভাইয়ের মধ্যে
সুসম্পর্ক ছিল না। যদিও
কেউ কেউ তেমনটিই মনে করে।
পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা যতটা সম্ভব প্রস্পরকে মানিয়ে চলত। আবার ফোর্থের ওপর সুবিবেচনা
করলে একথা বলতে হবে যে অ্যালবাসের ছত্রচ্ছায়ায়
বাস সব সময় খুব একটা সুখকর ছিল না। (বন্ধুত্বের জায়গায় অব্যাহতভাবে এক জনের নাম ছাপিয়ে
যাওয়া পেশাগত ক্ষেত্রে একটি বিড়ম্বনা, এটা এক জন ভাইয়ের জন্য খুব সুখকর নয়।) আবারফোর্থের
ওপর সুবিবেচনা করলে একথা বলতেই হবে যে অ্যালবাসের মতো পেষাগত উৎকর্ষ ও খ্যাতিমান ব্যক্তির ছায়ার তলে
বাস সব সময় খুব একটা সুখকর হওয়ার কথা নয়।
অ্যালবাস এবং আমি যখন হগোয়ার্ট স্কুল ছাড়লাম, তখন
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাদের ক্যারিয়ারে যাওয়ার আগে আমরা একসঙ্গে একটি চিরাচরিত
বিশ্বভ্রমণে বের হব। বিদেশি যাদুকরদের স্থানগুলোতে যাব এবং তাদের সম্পর্কে জান : কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা আমাদের
বাধাগ্রস্ত করল। আমাদের
যাত্রা শুরু মুখে অ্যালবাসের মা কেন্দ্র! মারা গেলেন ওর ওপর সংসারের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনের ব্যক্তি হতে হলো অ্যালবাসকে : আমি আমার যাত্রা
বাতিল করলাম কেন্দ্রার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের প্রতি সম্মান জানিয়ে। তারপর আমাকে এক যাত্রা শুরু
করতে হলো। ছোট ভাই ও বোনের দেখাশোনা এবং মাত্র অল্প কিছু স্বর্ণ
থাকায় অ্যালবাসের আমার সঙ্গে যাওয়ার আর প্রশ্নই উঠল না।
এই সময়টাতে অ্যালবাস এবং আমার যোগাযোগ খুবই কমে গেল। গ্রিসের চিমাক্রাসে অল্পের
জন্য বেঁচে যাওয়া থেকে শুরু করে মিশরের আলকেমিস্টদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে অ্যালবাসকে
চিঠি লিখতাম। তার চিঠিগুলোতে প্রতিদিনের জীবনের খবর খুব একটা থাকত না! আমি ধারণা করলাম এ রকম একজন মেধাবী যাদুকরের চিঠিগুলো হতাশাজনকভাবে স্কুল। নিজের অভিজ্ঞতাগুলোর ভেতর ডুবে থেকে কয়েক বছর ভ্রমণ শেষে আমি ভয়ানক খবরটি শুনতে পেলাম। জানলাম যে ডাম্বলডোর আরো একটি হৃদয় বিদারক আঘাত পেয়েছে। তার বোন অরিয়ানা মারা গেছে।
যদিও অনেকদিন ধরেই অরিয়ানা অসুস্থ ছিল, কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর পর অরিয়ানার মৃত্যু দুই ভাইয়ের ওপর গভীর
প্রভাব ফেলে। যারা অ্যালবাসের
কাছের মানুষ, আমি নিজেকেও
ওর কাছের মানুষ বলে মনে করি—আমরা সবাই বিশ্বাস করি যে অরিয়ানার মৃত্যু এবং সেই
মৃত্যুতে অ্যালবাসের দায়িত্ব সম্পর্কে তার অনুভূতি তার জীবনে বড় রেখাপাত করে গেছে। (যদিও এ ব্যাপারে অবশ্যই তার কিছু করার ছিল না!)
আমি ফিরে এসে একজন অল্প বয়সের মানুষ খুঁজতে শুরু
করলাম যে কি অনেক বেশি
বয়সের একজন মানুষের যন্ত্রণাগুলো
অনুভব করেছে। অ্যালবাম
আগের চেয়ে অনেক রিজার্ভ হয়ে গেছে। আগের মতো আর প্রাণ চঞ্চলতা নেই। তার বোন অরিয়ানকে হারানোর পর অ্যালবাস এবং আবারফোর্থের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তো বাড়েনি, বরং ব্যবধান
তৈরি হয়েছে। এই সময়ে এর অবসান হতে পারত —অবশ্য
পরবর্তী বছরগুলোতে তাদের
মধ্যে ঘনিষ্ঠতা না
হলেও আন্তরিকতা দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু সে সময় থেকেই সে খুব একটা তার মা-বাবা অধবা অরিয়ানা সম্পর্কে কথা বলত না। এবং তার বন্ধুরাও জানত সেটা, তাই তারাও এ সম্পর্কে কিছু
উত্থাপন করত না।
আর কোনো পালকের কলম পরবর্তী
বছরগুলোতে অন্য চমক লাগানো সফলতার ঘটনাগুলো বর্ণনা করবে। যাদু বিদ্যার ভাণ্ডারে ডাম্বলডোরের অসংখ্য অবদানের বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ড্রাগন ব্লাডের
১২টি ব্যাবহারের আবিষ্কার।
এসব পরবর্তী প্রজন্মের কাজে আসবে। এছাড়া সে ওয়াইজেনগামোটের চিফ ওয়ারলক (প্রধান যাদুবিদ)
থাকতে বহু বিচারের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার
পরিচয় রেখেছে। লোকে এখনো বলে যে ১৯৪৫ সালে ডাম্বলডোর এবং গ্রিনডেনভান্ডের মধ্যে
যে দ্বন্দ্ব ছিল সে রকম আজও দেখা যায় না। এই দুজন অসাধারণ যাদুকরের ভয়াবহ যুদ্ধ যারা দেখেছে, সে কাহিনী তাদের চিরদিন স্মরণ
থাকবে। তারা নিজেরা কতটা
ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিল তা তাদের লেখায় ফুটে এসেছে। যাদু জগতে ডাম্বলডোরের কৌশল এবং তার পরিণতিকে
যাদুর ইতিহাসের নতুন দিক বলে মনে করা হয়, বিশেষ করে গোপনীয় আন্তর্জাতিক যাদুর নিয়মের বেলায় এবং হি ই মাস্ট নট
বি নেইমড এর পতন।
অ্যালবাস ডাম্বলডোর কখনোই গর্বিত বা অহঙ্কারি ছিল না। সে যে কারো বিষয়কেই অথবা যত গুরুত্বহীন
বিষয়ই তোক তাকে মূল্য দিত। এবং আমি বিশ্বাস
করি যে তার অতীতের হারানোর
বেদনা তাকে মানবতা ও সমবেদনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি তার বন্ধুত্বকে এতটা মিস
করবো যে তা ভাষায় প্রকাশ
করা যাব না। কিন্তু আমার
সে ব্যাক্তিগত ক্ষতিকে যাদু দুনিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। সে ছিল সবচেয়ে প্রেরণাদায়ক
এবং সে ছিল হগোয়ার্ট স্কুলের হেডমাস্টারদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় যার কোনো তুলনাই চলে না। তার মৃত্যুও হয়েছে এক মহান
কাজ করতে গিয়ে। সে মারা
যাওয়ার সময়ও ছিল জীবিত সময়ের মতোই। যে মহান কাজে নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখত। তার শেষ
সময়গুলোতে ছিল সেই ড্রাগন
পক্সের দাগের বালকটির মতোই যার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
হ্যারি পড়া শেষ করে শোক সংবাদের ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকল। ডাম্বলডোর ওর বহুপরিচিত পোশাক পড়ে আছে, মুখে বিনীত হাসি। কিন্তু সে যখন ভালো করে তাকাল, দেখল অর্ধচন্দ্রাকার চশমাটির ওপর দিয়ে এমনকি পত্রিকার পাতার ছবিতেও বোঝা যাচ্ছে তার মনেরভাব। হ্যারির ওপর একটা রঞ্জনরশ্মির ছাপ। যার দুঃখের সঙ্গে মিশে আছে, ঘৃণাও।
হ্যারি ভেবেছিল সে ডাম্বলডোরকে ভালোভাবে চেনে। কিন্তু এই মৃত্যু সংবাদটি পরার পর তার কাছে মনে হলো সে তাকে খুব কমই চিনত। সে কখনোই ডাম্বলডোরের শৈশব বা কৈশর নিয়ে চিন্তা করেনি। হ্যারি তাকে ঠিক যেভাবে দেখেছে সেভাবেই তাকে চিনত। সে জানত ডাম্বলডোর একজন অভিজ্ঞ যাদুকর ও শিক্ষক এবং রুপালি চুলের সুদর্শন একজন বৃদ্ধ! একজন টিনেজ ডাম্বেলডোরের ধারণা করাটা একটা বেমানান কাজ। যেমন যায় না একটি বোঁকা টাইপ হার মিয়নকে কল্পনা করা বা ফ্রেন্ডলি ব্লাস্ট এন্ডেড স্ক্রিট।
সে ডাম্বেলডোরের অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার কথা কখনো চিন্তা করেনি। কোনো সন্দেহ নেই যে প্রশ্নটা হতো অদ্ভুত, অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এটা সবার জানা যে ডাম্বেলডোর গ্রিন্ডেলবান্ডের সঙ্গে সেই বিখ্যাত দ্বন্দ্বে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু হ্যারি কখনো ডাম্বলডোরকে সে ব্যাপারে অথবা অন্য কৃতিত্বগুলোর ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করার কথা ভাবেনি। না, তারা সব সময় হ্যারিকে নিয়েই আলোচনা করেছে। হ্যারির অতীত, হ্যারির ভবিষ্যত, হ্যারির পরিকল্পনা…এখন হ্যারির কাছে মনে হয়, যদিও তার ভবিষ্যত ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল এবং অনিশ্চিত, সে ডাম্বেলডোর সম্পর্কে না জিজ্ঞেস করে বিরাট সুযোগ নষ্ট করেছে। যদিও সে একটি মাত্র ব্যক্তিগত প্রশ্ন ডাম্বলডোরকে করেছিল এবং তার সন্দেহ যে ডাম্বলডোর তাকে সঠিকভাবে উত্তরটি দেয়নি।
তুমি যখন আয়নার দিকে তাকাও তখন আয়নায় কি দেখ?
আমি? আমি দেখি একজোড়া মোটা উলের মোজা হাতে ধরে আছি।
কয়েক মিনিট চিন্তার পর হ্যারি দি প্রফেট পত্রিকা থেকে মৃত্যু সংবাদটি ছিঁড়ল এবং যত্ন সহকারে ভাঁজ করে প্র্যাকটিক্যাল ডিফেনসিভ ম্যাজিক এন্ড ইটস ইউজ এগেইস্ট দি ডার্ক আর্টসের প্রথম ভলিউমে গুঁজে রাখল। এরপর সে সংবাদপত্রের বাকী অংশ আবর্জনার স্তূপে ছুঁড়ে ফেলল এবং রুমের দিকে ফিরল। রুমটি তখন অনেকটা স্বস্তিদায়ক। একটিমাত্র জিনিসই নির্দিষ্ট জায়গায় নেই। তাহলে আজকের ডেইলি প্রফেট। সেটি বিছানার ওপর পড়ে আছে। তার ওপর একটি ভাঙা আয়না।
হ্যারি হেঁটে সেখানে গেল। ডেইলি প্রফেট থেকে সেটি সরিয়ে পত্রিকাটি ভাঁজ খুলল। সকালে যখন পত্রিকাটি ডেলিভারি পেঁচা দিয়ে গিয়েছিল তখন সে শুধু ভাঁজ করা পত্রিকার শিরোনামগুলোর দিকে চোখ বুলিয়েছিল। পত্রিকায় ভোল্ডেমর্ট সম্পর্কে কিছু লেখেনি দেখে ছুঁড়ে পাশে রেখে দিয়েছিল। হ্যারি নিশ্চিত ছিল যে মন্ত্রণালয় প্রফেট পত্রিকার ওপর চাপ দিয়েছে ভোল্টেমর্টের সংবাদের ব্যাপারে। এখন সে দেখতে পেল যে আসল খবর তার চোখ এড়িয়ে গেছে। পত্রিকার প্রথম পাতার নিচের অংশে ডাম্বলডোরের ছবির ওপর ছোট শিরোনাম দেয়া। ছবিটিতে ডাম্বলডোর দ্রুত হাঁটছে। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে:
ডাম্বলডোর –শেষ পর্যন্ত সত্যি?
অনেকেই, তার প্রজন্মের মহান যাদুকর বলে যে মানুষটিকে মনে
করে, তার চরিত্রের বিপরীত
বিষয় নিয়ে মাত্র সামনের সপ্তাহেই বই প্রকাশ হবে। তার শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, রূপালি দাড়ির জ্ঞান-গাম্ভীৰ্য্য
অনেকটা ধুলিসাৎ হবে এ বই প্রকাশ হওয়ার পর। রিটা স্কিটার তার বইতে লিখেছেন তার অসুস্থ বাল্যকাল
বিশৃঙ্খল যৌবন, সারা জীবনের
দ্বন্দ্ব এবং অজানা কালো
অধ্যায়ের কথা–যে সব নিয়েই ডাম্বলডোরকে কবরে যেতে হয়েছে। তার বইতে তাঁর অনেক অজানা বিষয় ও প্রশ্নসহ তার
কারণ ব্যাখ্যা আছে–যে মানুষটি ম্যাজিক জগতের মন্ত্রী হওয়ার কথা তিনি
কেনো সারাজীবন হেডমাস্টারই
থেকে গেছেন? গোপন সংস্থা অর্ডার অব দ্য ফিনিক্সের কাজ কি ছিল? আর ডাম্বলডোর তার শেষ পরিণতির দিকে কীভাবে
গেলেন, সে সব বিস্ফোরণকর
অজানা কাহিনী।
এসবসহ, আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই জীবনী গ্রন্থে। দ্য লাইফ এন্ড লাইস অব অ্যালবাস ডাম্বলডোর, লিখেছেন রিটা স্কিটার। আর লেখক রিটা স্কিটারের একান্ত সাক্ষাতকার নিয়েছেন
বেটি। ব্রেইথওয়েইট, ডিতরে, ১৩নং পৃষ্ঠায়।
হ্যারি পত্রিকার ভাঁজ খুলে ১৩ নাম্বর পৃষ্ঠায় চোখ রাখল। প্রতিবেদনের উপরে একটি ছবি। ছবিতে আরো একটি পরিচিত মুখ, একজন মহিলা অলঙ্কারপূর্ণ রঙিন চশমা পরে আছে। মাথায় বিস্তৃত কোঁকড়ানো সোনালি চুল। দাঁত বের করা মুখে পরিষ্কার বিজয়ের হাসি বোঝা যায়। তার দিকে আঙুল তুলে নাড়ছে। পেটের ভেতর মোচড় দেয় ছবিটি দেখলে। হ্যারি এই ছবির দিকে না তাকিয়ে পড়তে থাকল।
পালকের কলমে আক্রমণাত্মক লেখায় যেমন
তাকে মনে হয়, মানুষ হিসাবে
রিটা স্কিটার ঠিক তার বিপরীত,
তিনি অনেক উষ্ণ এবং নরম হৃদয়ের মানুষ। আমাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে তার বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমাকে নিয়ে সোজা তার রান্নাঘরে ঢুকলেন এক
কাপ চা এবং এক স্লাইজ কেকের জন্য এবং কোনো ভূমিকা ছাড়াই অত্যন্ত উষ্ণ ধুমায়িত চায়ের সাথে আমাদের। আলাপচারিতাও শুরু হল।
স্কিটার বললেন, এটা ঠিক ডাম্বলডোর হলেন যে কোনো জীবনীকারের স্বপ্ন। এমন পরিপূর্ণ
ও দীর্ঘ জীবন খুব কমই আছে।
আমি নিশ্চিত যে অনেক অনেক বইয়ের
মধ্যে আমারটাই প্রথম প্রকাশিত হবে।
স্কিটার অবশ্যই লেখার কাজটি করেছেন
অসম্ভব দ্রুত গতিতে। জুন
মাসে ডাম্বলডোরের রহস্যজনক
মৃত্যুর পর নয়শ পাতার বইটি শেষ করতে তার সময় লেগেছে মাত্র চার সপ্তাহ। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই
অসম্ভব দ্রুত গতিতে তিনি কীভাবে কাজটি করলেন?
আপনি যখন দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা করবেন, দেখবেন সময়ের ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয়। আমি জানি যে তার পুরো কাহিনী জানার জন্য যাদুর জগৎ রীতিমতো হৈচৈ পরে গেছে।
আর আমি সকলের আগেই তাদেরকে সেই কাহিনী জানাতে চেয়েছি। ওয়াইজেনোমোটের বিশেষ উপদেষ্টা এবং ডাম্বলডোরের দীর্ঘকালের বন্ধু এলফিয়াস
ডোগের সম্প্রতি বহুল প্রচারিত
লেখাটির কথা বললাম তাকে, সেখানে বলা হয়েছে যে, স্কিটারের বইতে চকলেট ফ্রগ কার্ড থেকেও কম কথা সন্নিবেশিত থাকবে।
স্কিটার হাসতে হাসতে তার মাথাটা
পেছনের দিকে টানলেন।
ডার্লিং ডোজি! আমার মনে আছে কয়েক বছর আগে অর্ধমানবদের নিয়ে আমি
তার একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম।
তার মঙ্গল হোক। তাকে পুরোপুরি বার্ধক্যে পেয়েছে, আমার মনে হয়েছিল আমরা উইয়োর লেকের ধারে বসে আছি এবং তিনি আমাকে মাছগুলো দেখতে বলছেন।
তথাপি এলফিয়াস ডোগের ওই অভিযোগ নিয়ে চারদিকে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্কিটার কি সত্যিই মনে করেন যে মাত্র চার সপ্তাহে ডাম্বলডোরের দীর্ঘ ও এক অসাধারণ জীবনের
বর্ণনা করা যায়?
ওহ্ মাই ডিয়ার, স্কিটার সোহাগের সঙ্গে আঙুলগুলো দিয়ে আমাকে সমান্তরালভাবে
ধরল, আমার মতো তুমিও জানো যে
কি পরিমাণ তথ্য গ্যালোনের
ভাণ্ডার থেকে পাওয়া যেতে পারে।………..
জনগণ ডাম্বলডোরের অজানা
কাহিনী শুনতে উদগ্রীব।
আপনি নিশ্চই জানেন যে অনেকেই মনে করে যে
তিনি একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন,
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ নেননি
যা তার নেওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু বৃদ্ধ ডোজি ডোগে হিপোফিকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে পারেন,
কিন্তু আমি পেয়েছিলাম এমন একটি সূত্র
অধিকাংশ সাংবাদিকই যা পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে খবরের জন্য। এমন একজন আছেন যিনি এর আগে কোনো কিছু জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি, তিনি ডাম্বলডোরের যৌবনকালের বিশৃঙ্খল এবং অস্বাভাবাকি সময়ে তাকে দেখেছেন
অনেক কাছ থেকে।
স্কিটারের জীবনীটির আগাম প্রচারপত্রটি তাদেরকে বেশ আঘাত করবে যারা মনে করে যে ডাম্বলডোরের জীবন একেবারে কালিমাহীন
ছিল। এর মধ্যে তিনি কোন বিষয়টি সবচেয়ে বড় বিস্ময় হিসেবে আবিষ্কার
করেছেন তা আমি জানতে চাইলাম।
এখন বাদ দাও বেটি, বই
পড়ার আগে পাঠকের সামনে আমি সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাই না। তিনি উচ্চস্বরে হাসলেন! কিন্তু
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি,
যারা এখনো মনে করে যে ভাম্বলভোর ছিলেন তার দাড়ির মতোই শুভ্র
তারা ভুল চিন্তা করছে!
শুধু এটুকু বলি যে কেউ তাকে প্রচণ্ড রাগতে
কখনো শুনেনি। তুমি জানো তিনি যৌবনে স্বপ্ন দেখতেন
নিজেকে ডার্ক আর্টের মধ্যে নিমগ্ন রাখতে! অথচ তিনিই আবার এমন একজন যাদুকর যিনি পরবর্তী বছরগুলোতে সহিষ্ণুতা ও শান্তির জন্য
কাজ করেছেন। তার যখন অল্প
বয়স তখন তিনি অত বড় মনের ছিলেন না। হ্যাঁ,
অ্যালবাস ডাম্বলডোরের অতীত জীবন ছিল চরম অপরিচ্ছন্ন, তিনি তার পরিবারের সন্দেহজনক
ও কলঙ্কিত বিষয়াদি লুকিয়ে রাখতে কঠিনভাবে
চেষ্টা করেছেন।
আমি জানতে চাইলাম স্কিটার কি ডাম্বলডোরের ভাই আবারফোর্থের কথা বলতে
চাইছেন কি না, যে ১৫ বছর
আগে যাদুর অপব্যবহারের দায়ে ওয়াইজেনামোটের দ্বারা অভিযুক্ত হয়ে কিছুটা
কলঙ্কিত হয়েছিল।
ওহ, আবারফোর্থ তো একটা গোবরের
গাদি, স্কিটার হাসল। না না, সেটা ছোটখাটো প্রতারণা করা ভাইয়ের চেয়ে খারাপ বিষয়ে, এমনকি মাগলদের নির্যাতন করা বাবার চেয়েও খারাপ। ডাম্বলডোর পর্যন্ত তাদের দুজনের কাউকে
এসব কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি,
সে বিষয়েও না, তারা দুজনই
যে ওয়াইজেনগামোট দ্বারা
অভিযুক্তও হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে
আমাকে উৎসুক করেছে তার মা এবং বোন। তাদের বিষয়ে একটু নাড়াচাড়া
করতেই অনেক নোংরা কাহিনীর
সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু
আমি সব কথা এখন বলব না,
সবটুকু জানতে হলে আপনাকে আমার বইয়ের নবম থেকে দ্বাদশ অধ্যায় পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে
হবে। এখন আমি যতটুকু আপনাকে
বলতে পারি তা হলো, ডাম্বলডোর তার নাকটা কীভাবে ভেঙেছে
কেন তা কখনো বলেনি, সেটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় ছিল না।
পরিবারের ঐতিহ্য না থাকা সত্বেও ডাম্বলডোর তার মেধা দিয়ে অনেক যাদুর
আবিষ্কার করেছেন একথা কি স্কিটার অস্বীকার করেন?
তার মেধা ছিল, তিনি স্বীকার করলেন। যদিও এখন অনেক লোক প্রশ্ন করে যে তার সে সব অর্জনের জন্য তিনি পুরো কৃতিত্ব একা পেতে পারেন কি
না। আমি সে কথা ১৬ অধ্যায়ে বলেছি, ইডর ডিলন দাবি করেছেন যে তিনি আগেই
ড্রাগনের রক্তের আট ধরণের ব্যবহার আবিষ্কার করেছিলেন এবং ডাম্বলডোর তার সে সব কাগজপত্র ধার নিয়েছিলেন।
কিন্তু ডাম্বলডোরের কিছু অর্জনের গুরুত্ব নিশ্চয়ই
অস্বীকার করা যাবে না।
তার বিখ্যাত ঘটনা গ্রিনডেলবাল্ডকে হারানোর পেছনে কি কাজ করেছে?
ওহ, এখন আমি বেশ খুশি হয়েছি যে আপনি গ্রিনডেলবান্ডের
কথা উল্লেখ করেছেন। ছোট করে হাসি দিয়ে স্কিটার বললেন। আমার ভয় হয় যারা আর্দ্র চোখে ডালডোরের দর্শনীয় বিজয়কে দেখেন তারা শীঘ্রই একটি বিস্ফোরণের
মধ্যে পড়বেন বা হয়তো গোবর বোমায়। বিষয়টি খুবই নোংরা। আমি
এ পর্যন্ত এখন বলব, এতটা নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে সেটি সত্যিই একটি
দর্শনীয় সংঘাত ছিল। আমার বই পাঠের পর জনগণ বুঝে নেবে
যে গ্রিনডেলবাল্ড তার যাদুদণ্ডটির প্রান্ত থেকে নেহায়েত একটি সাদা মাল যাদু করে বের
করেছিলেন এবং নিরবে এসেছিলেন।
স্কিটার এই বিষয়ে আর কোনো কিছু বলতে চাইলেন না। এরপর
আমরা কথা ঘুরালাম একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিষয়ে যা তার পাঠককে অন্য যে কোনো বিষয়ের চাইতে অধিক আকর্ষণ
করবে।
ওহ, হ্যাঁ,
স্কিটার মৃদু মাথা দোলালেন,
আমি পুরো এক অধ্যায় ডাম্বলডোর-পটার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। বিষয়টিকে বলা যায় অস্বস্তি কর, এমনকি দুর্ভাগ্যজনক। আবার, আপনার পাঠকরা আমার বইটি কিনবে
পুরো কাহিনীর জন্য। এ ব্যাপারে যে সব কথাবার্তা
শোনা যায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে ডাম্বলডোর পটারের প্রতি অস্বাভাবিক
আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন। ছেলেটির
জন্য এই সম্পর্ক কতখানি প্রয়োজন ছিল —আচ্ছা, সেটা আমরা পরে দেখতে পাব। তবে এটা অনেকের কাছেই গোপন
নেই যে পটারের কৈশর অনেক ঝামেলাপূর্ণ ছিল।
আমি জানতে চাইলাম স্কিটারের এখনো পটারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি-না। পটারের একটি
বিখ্যাত সাক্ষাতকার গত বছর তিনি নিয়েছিলেন। সেটি ছিল একটি সারা জাগানো সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকারে পটার। পরিষ্কারভাবে তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা বলেছে যে ইউ–নো-হুঁ ফিরে এসেছে।
ওহ! হ্যাঁ,
আমরা একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম, স্কিটার বললেন, বেচারা পটারের প্রকৃত বন্ধুর
সংখ্যা ছিল খুব কম। এবং
আমাদের সাক্ষাত হয়েছিল তার জীবনের একটি চরম পরীক্ষার সময়। সেটি হলো ট্রাই উইজার্ড টুর্নামেন্টের সময়। আমি সম্ভবত তাদের মধ্যে একমাত্র
ব্যক্তি বেঁচে আছি যে বলতে পারে–সে প্রকৃত হ্যারি পটারকে জানে।
ডাম্বলডোরের মৃত্যুর কোন বিষয়টি জানার এখনো আমাদের আগ্রহী করে? স্কিটার কি মনে করেন যে ডাম্বলডোরের মৃত্যুর সময় পটার সেখানে
উপস্থিত ছিল?
বুঝলাম, এ নিয়ে আমি অত কথা বলব না। এসব ব্যাপারে বইতে সব লেখা
আছে। কিন্তু হগোয়ার্ট প্রাসাদের
ভেতরে প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছিল ডাম্বলডোর পড়ে যাওয়ার,
লাফ দেওয়ার বা তাকে ধাক্কা দেওয়ার সেই মুহূর্তগুলোর পরপরই পটার সেখান থেকে দৌড়ে সড়ে যাচ্ছে। পটার পরে সেভেরাস স্লেইপের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে তার আগের থেকেই
প্রচণ্ড রাগ ছিল! যা দেখা
গেছে, যা জানা গেছে সব
কিছু কি তেমন? এর বাইরে
কি কিছু নেই? এ বিষয়ে যাদু কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে যখন তারা আমার
বইটি পড়বে।
আমি চলে আসার সময় এই একটি কাহিনী আমি নোট করলাম। এ ব্যাপারে
কোনো সন্দেহ নেই যে স্কিটারের
লেখা বই ডাম্বলডোরের ভক্তদের
মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে বেস্ট সেলারে পরিণত হবে। এদিকে তাদের হিরো সম্পর্কে যা বেরিয়ে আসবে তা
হয়তো তাদেরকে
প্রচণ্ড ঝাঁকি দেবে।
হ্যারি লেখাটি পড়া শেষ হওয়ার পরও পত্রিকার পৃষ্ঠাটির দিকে কিছুক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে থাকল। তার ভেতরে ক্রোধ ও ঘৃণা এমনভাবে নাড়া দিল যে ভেতর থেকে বমিভাব উঠে এলো। সে পত্রিকাটি বলের মতো গোল করে মোচরালো এবং গায়ের শক্তি দিয়ে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেটি কাগজ ফেলার বিনের কাছে অন্য কাগজগুলোর সঙ্গে গিয়ে জড়ো হলো। বিনে ইতিমধ্যেই কাগজে ভরে গেছে।
সে সারা ঘরে অন্ধের মতো পায়চারি করতে থাকল। একবার গিয়ে ড্রয়ার খুলছে, একবার বই হাতে তুলে নিচ্ছে আবার একই ভূপের ওপর রেখে দিচ্ছে। কি করছে সে ব্যাপারে তার বিশেষ হুঁশ-জ্ঞান নেই। তার মাথার মধ্যে রিটার আর্টিকেলের বিশেষ বিশেষ অংশগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে; পুরো অধ্যায় পটার ডাম্বলডোর সম্পর্ক নিয়ে… বিষয়টিকে বলা যায় অস্বস্তিকর এবং ক্ষতিকর… নিজেকে সে কালো আর্টের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছিল যৌবনে… আমার ছিল তথ্য পাওয়ার বিশেষ সূত্র, অধিকাংশ সাংবাদিক সেই সূত্র পেলে তাদের দণ্ডটি সে দিকে তাক করত..
মিথ্যা? হ্যারি চিৎকার করে উঠল। জানালা দিয়ে দেখল ঠিক পাশের প্রতিবেশীকে। তিনি লন মাওয়ারটি (ঘাস কাটা মেশিন) চালু করতে সময় নিলেন এবং উদ্বেগ নিয়ে ওর দিকে তাকালেন।
হ্যারি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। বিছানার ওপর থাকা ভাঙা আয়নার টুকরো লাফিয়ে একটু দূরে গিয়ে পড়ল। হ্যারি সেটি কুড়িয়ে নিলো আঙুলের মধ্যে উল্টাতে পাল্টাতে লাগল আর চিন্তা করতে থাকল, ডাম্বলডোরের বিষয় নিয়ে। কীভাবে রিটা স্কিটার তার ও ডাম্বলডোরের ব্যাপারে বদনাম ছড়িয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ উজ্জল নীল আলোর ঝলক দেখা গেল। হ্যারি স্থির হয়ে গেল। তার কাটা আঙুল পিছলে আয়নার চোখা প্রান্তে গিয়ে লাগল। সে বিষয়টি নিশ্চয়ই কল্পনা করছে। সে কাঁধের উপর দিয়ে ঘুরে তাকাল। কিন্তু দেয়ালটি হলুদ-কমলার বিরক্তিকর রঙ, আয়নায় প্রতিফলন হতে পারে এমন কোনো নীল রঙের চিহ্নই নেই। সে আবার ভাঙা আয়নার টুকরোটির দিকে তাকাল। আয়নার টুকরোটিতে নিজের সবুজ চোখ দুটো ছাড়া আর অন্য কিছু দেখতে পেল না।
সে নিশ্চয়ই ব্যাপারটি কল্পনা করছে। এছাড়া তার কাছে আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। সে কল্পনা করেছে, কারণ সে তার মৃত প্রধান শিক্ষককে নিয়ে চিন্তা করছিল। যদি রিটা স্কিটারের লেখার বিষয়টি সত্যি হতো, তাহল অ্যালঝস ডাম্বলডোরের গভীর নীল চোখ তাকে কখনো তীব্র চাহনি দিয়ে বিদ্ধ করত না।