০২. মুহিবের বাবা শামসুদ্দিন সাহেব

মুহিবের বাবা শামসুদ্দিন সাহেব পল্লবীতে থাকেন। দুই কামরার ঘর, পেছনে বারান্দা আছে। টিনের ছাপড়া দিয়ে বারান্দা ঢাকা। সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা। গ্যাসের কারবার নেই, রাধতে হয় কেরোসিনের চুলায়। সেটা শামসুদ্দিন সাহেবের জন্যে কোনো ব্যাপার না। তিনি একা মানুষ বিশাল বাড়ি দিয়ে তিনি কী করবেন! তার দরকার ঘুমাবার জন্যে একটা জায়গা। মাথার উপর ফ্যান। (তিনি গরম একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। শীতের সময়ও ফ্যান ছেড়ে রাখতে হয়।)

তাঁর জন্যে সবচে সুবিধা হতো যদি এক কামরার একটা ঘর হতো। ঘরের এক কোনায় রান্নার ব্যবস্থা থাকবে। টুক করে পানি গরম করে এক কাপ চা খেয়ে ফেলা। এক মুঠ চাল এক মুঠ ডাল দিয়ে খিচুড়ি। রান্নার শেষ পর্যায়ে চায়ের চামচে এক চামচ ঘি। ব্যস ফুরিয়ে গেল।

এক কামরার একটা ঘরই তার জন্যে যথেষ্ট ছিল। এখন যে বাড়িতে আছেন সেটাও খারাপ না। ফ্ল্যাট বাড়ি না। আলাদা বাড়ি। মাথার উপর টিনের ছাদ। রাতে টিনের চালে যখন বৃষ্টি হয় অদ্ভুত ভালো লাগে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাড়িতে থাকতে পারলে খারাপ হতো না। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। খুপড়ি খুপড়ি টিনের বাড়ি সব উঠে যাচ্ছে। বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হবে। লিফট থাকবে। আলাদা জেনারেটর থাকবে। সব ভাড়াটেদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে। বাড়ি ছাড়ার শেষ সময়ও পার হয়ে গেছে। বেশির ভাগই চলে গেছে। শামসুদ্দিন সাহেব যেতে পারেন নি। তিনি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। বৃদ্ধদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। বাড়িওয়ালা চোখ বড় বড় করে বলে, একা থাকবেন? আপনার ফ্যামিলি মেম্বাররা কোথায়?

তারা ঢাকায়। তাদের সাথে আমার ঠিক অ্যাডজাস্টমেন্ট হয় না বলে আমি আলাদা থাকি।

অ্যাডজাস্টমেন্ট হয় না কেন?

শামসুদ্দিন সাহেব ধাঁধায় পড়ে যান। কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না। অ্যাডজাস্টমেন্ট কেন হয় না— এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলাপ করার কিছু নেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি ব্যাখ্যা না করলে বাড়ি পাওয়াও যাবে না। বাড়িওয়ালাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।

আপনি করেন কী? মানে আপনার সোর্স অব ইনকাম কী?

কোচিং সেন্টারে পড়াই।

কী পড়ান?

ইংরেজি পড়াই। আমি একটা বেসরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক ছিলাম। রিটায়ার করেছি।

আপনি যে একা থাকবেন অসুখ-বিসুখ হলে আপনাকে দেখবে কে?

মেজাজ খারাপ হবার মতো প্রশ্ন। আমাকে কে দেখবে সেটা আমার ব্যাপার। তোমার মাসে মাসে ভাড়া পেলেই তো হলো।

বাড়িওয়ালাকে এই ধরনের কথা বলা যায় না। বাড়ি ভাড়া নেবার আগে বাড়িওয়ালার মন জুগিয়ে কথা বলতে হয়। স্রোতের পাংগাশ হতে হয়। স্রোত যেদিকে পাংগাশ মাছ সেদিকে। বাড়িওয়ালা স্রোত, ভাড়াটে পাংগাশ।

শামসুদ্দিন সাহেব যথেষ্টই ঝামেলায় পড়েছেন। কেউ তাকে বাড়ি ভাড়া দেবে— এরকম মনে হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত হয়তো সস্তা ধরনের কোনো হোটেলে মাসকাবারি বন্দোবস্তে যেতে হবে। এটাও খারাপ না। হোটেলে থাকা মানেই লোকজনের মধ্যে থাকা। বয়-বাবুর্চির আনাগোনার মধ্যে থাকা। কোথাও টেলিফোনের দরকার পড়ল— ম্যানেজারের অফিস থেকে টেলিফোন। শরীরও এখন ভালো যাচ্ছে না। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে রাতদুপুরে একশ দুই একশ তিন জ্বর। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বয়কে খবর দিলে মাথায় এসে পানি ঢালবে। পাঁচ-দশ টাকা বকশিশ ধরিয়ে দিলেই হলো।

তিনি হোটেল খোজা এখনো শুরু করেন নি। রোজই ভাবেন আগামীকাল থেকে শুরু হবে। ইত্তেফাঁক পত্রিকায় ছয়শ টাকা খরচ করে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। তাতে কিছু হয় কি-না সেটা দেখে জোরেসোরে হোটেলে ঘর খোজা শুরু করবেন। ইত্তেফাঁকের বিজ্ঞাপনটা এরকম–

লজিং চাই
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে লজিং চাই।

এখনো কোনো জবাব আসে নি। ঢাকা শহরের লোকজন ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী, তবে ঘরে টিচার রাখতে আগ্রহী না। ঘরে লজিং রাখার ব্যাপার মনে হয় ঢাকা শহরের লোকজন ভুলে গেছে। লজিং শব্দটা এসেছে Lodge থেকে।

তাড়াতাড়ি কোনো একটা লজিং-এর ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। কারণ কোচিং সেন্টারে কিছু সমস্যা হয়েছে। কোচিং সেন্টারের মালিক চেংড়া এক ছেলে মাসখানেক আগে তাকে ডেকে নিয়ে মুখ-চোখ কুঁচকে বলল— শামসুদ্দিন সাহেব, আপনি দাড়ি রেখেছেন কেন? এখন তো আপনাকে দেখে মনে হয় মাদ্রাসার শিক্ষক। ছাত্রদের পড়াবেন ইংরেজি, গেটাপে স্মার্টনেস থাকবে। মুখভর্তি যদি মওলানার মতো দাড়ি থাকে তাহলে চলবে কীভাবে? আজ দাড়ি রেখেছেন, পড়শু থেকে ধরবেন লম্বা আচকান। তারপর চোখে দেবেন সুরমা। কয়েক দিন পরে মাথায় বেতের গোলটুপি। ভাই, আমরা তো ব্যবসা করতে এসেছি। আমাদের শো-শা থাকতে হবে। থাকতে হবে না?

শামসুদ্দিন বললেন, জি থাকতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আপনি যত ইচ্ছা ধর্মকর্ম করেন। আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি নিজে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। দুবছর আগে ওমরা হজ করে এসেছি। বুঝতে পারছেন কী বলার চেষ্টা করছি?

কিছু না বুঝেই শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, জি বুঝতে পারছি।

আপনার বয়সও হয়েছে। আপনি লোডও ঠিকমতো নিতে পারছেন না। আমার দরকার অ্যানার্জেটিক লোক। বুঝতে পারছেন?

জি বুঝতে পারছি।

আপনার টিচিং অ্যাবিলিটি নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেইন নেই। আমি শুনেছি আপনি ভালো শিক্ষক। কিন্তু বয়সের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে রাখতে হবে।

শামসুদ্দিন সাহেব বেশ কয়েকবার মাথা নেড়ে বলেছেন, জি জি।

এইসব লক্ষণ ভালো লক্ষণ না। তার ধারণা তিনি যে-কোনো একদিন শুনবেন— তার চাকরি শেষ। তখন ভালো ঝামেলায় পড়ে যেতে হবে। কী ঝামেলা সে সব নিয়ে আগে-ভাগে চিন্তা করতে ভালো লাগে না। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি খুব চেষ্টা করেন সমস্যা নিয়ে চিন্তা না করতে। খুবই আশ্চর্যের কথা তিনি এ ব্যাপারে সফল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি জেগে থাকেন। মাথায় কোনো চিন্তা নেই। ফাঁকা মাথা। যখন বৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টির শব্দ শুনছেন। Oxford ডিকশনারিতে Lodge শব্দ সম্পর্কে বলা হয়েছে— A small house in a country where people stay when they want to take part in some types of out door sport.

গত রাতে শামসুদ্দিন সাহেবের ঘুম ভালো হয় নি। শরীর খুব খারাপ লাগছিল বলে নটা বাজার আগেই শুয়ে পড়েছিলেন। রাত এগারোটার দিকে ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসে না। মাথায় যন্ত্রণা। বমি বমি ভাব। শরীরে ব্যথা। বিছানায় শুয়ে আরাম পাচ্ছেন না। কাত হয়ে শুলে মনে হয় চিৎ হয়ে থাকলে ভালো লাগত। চিৎ হয়ে থাকলে মনে হয় আগে যেভাবে শুয়েছিলেন সেটাই ভালো ছিল। কপালে হাত দিয়ে কোনো জ্বর টের পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও কৌতূহলবশত থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখলেন। একশ দুই-এর সামান্য বেশি। শিশু এবং বৃদ্ধদের জন্যে একশ দুই খুব বেশি জ্বর না। একশ তিনের উপর উঠলে মাথায় পানি ঢালার চিন্তা করতে হয়। তার জ্বর যদি আরো বাড়ে তাহলে বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে বসে থাকলেই হবে।

মানুষের সকল অবস্থার জন্যে তৈরি থাকতে হয়। এই ধরনের উচ্চ শ্রেণীর ভাব চিন্তা করে তিনি সময় কাটাতে লাগলেন। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তখন মনে হচ্ছে তিনি মহিষের গাড়িতে শুয়ে আছেন। গাড়ি একবার এদিক হেলে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিক হেলছে। মহিষের গায়ের বোটকা গন্ধও তখন নাকে লাগছে।

শেষ রাতে জ্বর আরো বাড়ল। থার্মোমিটারে পারদ তিনের ঘর ছাড়িয়েও কিছু দূর উঠে গেল। তিনি বুঝতে পারছেন তার উচিত বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দেয়া। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো শারীরিক জোরও তিনি পাচ্ছেন না। তিনি জেগে আছেন। জাগ্রত অবস্থাতেই তাঁর মনে হচ্ছে, মহিষের গাড়িতে শুকনা খড়ের বিছানায় তিনি শুয়ে আছেন। খানাখন্দে পড়ে গাড়িও আঁকাচ্ছে। তিনি সারা শরীরে সেই ঝাঁকুনি অনুভব করছেন।

 

সকাল এগারোটার দিকে মুহিব তার বাবাকে দেখতে এলো। বাড়ির চারপাশে পানি থইথই করছে। আরেকটু পানি বাড়লেই ঘরে পানি ঢুকে যাবে। পানি ভেঙে ঘরে ঢুকতে গিয়ে প্যান্ট-জুতা কাদায় মাখামাখি।

শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, বাথরুমে ঢুকে সাবান ডলা দিয়ে পা ধুয়ে ফেল। তাকের উপর সাবান আছে। ভেজা প্যান্ট খুলে একটা লুঙ্গি পরে নে। আমার ধোয়া লুঙ্গি আছে।

মুহিব বলল, বাবা তোমার শরীর খারাপ?

রাতে সামান্য জ্বরের মতো এসেছিল— এখন শরীর ফিট। হালকা ফুরফুরে লাগছে।

কিছুক্ষণ আগেই তার খুবই খারাপ লাগছিল। বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছিল না। ছেলেকে দেখার পর থেকে সত্যি সত্যি ভালো লাগছে। মাথায় চাপ দিয়ে যে যন্ত্রণাটা বসে ছিল সেটাও নেই। শরীরে এখন সত্যি সত্যি ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। ছেলের সঙ্গে মুখোমুখি বসে গল্প করবেন ভাবতেই ভালো লাগছে। ভালো লাগাটা এত তীব্র যে বুকে সামান্য ব্যথা বোধও করছেন। তাঁর এই ছেলেটা মাঝে-মধ্যে তাকে দেখতে আসে। সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলে। ছেলেটা যখন আসে তখন তার মনে হয় বেঁচে থাকা যথেষ্টই আনন্দের ব্যাপার। এবং তার নিজের জীবনে কোনোই সমস্যা নেই। কোনো একটা কাজে সংসারের বাইরে বাস করছেন। কাজ শেষ হলেই সংসারে ফিরবেন।

মুহিব, নাশতা খেয়ে এসেছিস?

মুহিব বাথরুম থেকে বলল, হুঁ।

চা খাবি? চা বানাব?

হুঁ।

বাড়ির খবর সব ভালো তো?

হুঁ।

শামসুদ্দিন সাহেব হেসে ফেললেন। হু হু করে কথা বলা মুহিবের শৈশবের অভ্যাস। এক দেড় বছর বয়সে বাচ্চারা কথা বলা শেখে। একবার বলা শুরু করলে অতি দ্রুত লম্বা লম্বা বাক্য তৈরি শুরু হয়। মুহিবের বেলায় উল্টাটা হয়েছিল। দেড় বছর বয়স পর্যন্ত সে শুধু হু বলত। আর কিছু না, শুধুই ই।

কেমন আছ গো বাবা?

হুঁ।

পানি খাবে?

হুঁ।

নাম কী তোমার বাবা?

হুঁ।

ওরে সোনা, হুঁ ছাড়া তুমি আর কিছু বলতে পার না?

হুঁ।

শামসুদ্দিন তার ছোট ছেলের নাম দিয়েছিলেন বাবা। শৈশবের অনেক অভ্যাসের মতো হুঁ বলা অভ্যাস মুহিবের বেলা স্থায়ী হয় নি। তবে শামসুদ্দিন লক্ষ করেছেন, মুহিব যখন অন্যমনস্ক থাকে তখন তার হুঁ বলা অভ্যাস ফিরে আসে। তখন যে প্রশ্নই করেন মুহিব জবাব দেয় হুঁ দিয়ে।

মুহিব তোর চাকরি-বাকরির কিছু হয়েছে?

মুহিব জবাব দিল না। শামসুদ্দিন বাথরুম থেকে পানি ঢালার শব্দ পেলেন। তাঁর মন সামান্য খারাপ হলো। ছেলেকে এই প্রশ্ন করা ঠিক হয় নি। চাকরি পেলে সে নিজেই এসে হাসি মুখে বলত। বেচারার সমস্যার সমাধান কিছু হচ্ছে না। এই সময়ে সমস্যার কথা মনে করিয়ে দেয়া অন্যায় একটা কাজ। তিনি সব সময় ভাবেন– এই কাজ কখনো করবেন না। চাকরির কথা জিজ্ঞেস করে ছেলেকে লক্ষ্মী দেবেন না। অথচ প্রতিবারই প্রশ্নটা করেন।

মুহিব বাথরুম থেকে বের হয়েছে। সে যে শুধু হাত-পা ধুয়েছে তা না, মাথায়ও পানি দিয়েছে। চুল বেয়ে পানি পড়ছে। শামসুদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশিখুশি গলায় বললেন, কাছে আয় মাথা মুছিয়ে দেই। মুহিব আপত্তি করল না। এবার কাছে এগিয়ে গেল। শামসুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, চাকরি হচ্ছে কি হচ্ছে না— এই নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবি না। যখন হবার হবে। ভাগ্যে যা থাকার তাই হয়।

মহিব বলল, তুমি কি নতুন বাড়ি খুঁজে পেয়েছ? এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে বলেছিলে।

শামসুদ্দিন সাহেবের আবার খানিকটা মন খারাপ হলো। ছেলে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ। বেচারার নিজের ঝামেলারই কোনো পারাপার নেই, তাকে ভাবতে হচ্ছে অন্যের ঝামেলা নিয়ে।

শামসুদ্দিন সাহেব মিথ্যা করে বললেন, এখনো খোঁজা শুরু করি নাই। তাছাড়া লোকজনদের বলা আছে। খুঁজতেও হবে না। তাছাড়া আমি একা মানুষ, আমার কিছু লাগবে না। একা মানুষের জন্যে কিছু লাগে না। কথায় আছে—

ভোজনং যত্রতত্র
শয়নং হট্ট মসজিদ।

মুহিব বুলি, কথাটা হবে হট্ট মন্দির। তুমি মসজিদ বলছ কেন?

এখানে মন্দির পাব কোথায়। আর যদি পাইও ওরা কি মন্দিরে আমাকে ঘুমাতে দিবে?

তুমি কি আজকাল ধর্ম-কর্ম করছ?

দাড়ি দেখে বলছিস? ফজর আর মাগরেবের নামাজটা পড়ার চেষ্টা করি।

মুহিব হঠাৎ বলে বসল, বাবা, তুমি কি খুব কষ্টে আছ?

কথাটা মুহিব খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কিন্তু শামসুদ্দিনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। গলা ভারী হয়ে গেল। তিনি অবহেলার একটা ভাব চোখেমুখে এনে বললেন, কষ্টে আছি তোকে কে বলল? সুখে আছি বুঝলি। সংসারের টেনশন মাথায় নাই। রাতে যখন ইচ্ছা শুয়ে পড়লাম, আবার ইচ্ছা করল সারা রাত বসে রইলাম। কারো কিছু বলার নেই। Freedom-এর আনন্দের কাছে সব আনন্দ তুচ্ছ। এই বিষয়ে কোলরিজের একটা বিখ্যাত বাক্য আছে। মনে পড়লেই তোকে বলব। আজকাল স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে।

মুহিব ফট করে বলে বসল, বাবা, যমুনা মেয়েটা কোথায়? যার জন্যে তুমি আমাদের সবাইকে ফেলে রেখে চলে এলে। যে মেয়ের জন্যে তুমি এতটা করলে সে তোমাকে এই অবস্থায় রেখে চলে গেল কেন?

শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বোধ করছেন। ছোটবেলায় মুহিবের অভ্যাস ছিল বাবার বুকের উপর শুয়ে ঘুমানো। সেই ছেলে এমন কঠিন প্রশ্ন করছে!

মুহিব বলল, তোমার জবাব দিতে ইচ্ছা না হলে জবাব দিও না। চা বানাও চা খাই।

শামসুদ্দিন চা বানালেন। ঘরে দুধ নেই, লিকার চা। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, আদা-চা বানিয়ে দিলাম। খেয়ে দেখ, শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। কোরান শরীফে আদার রেফারেন্স আছে এটা জানিস?

না।

আল্লাহপাক বলেছেন, বেহেশতে তোমাকে দেয়া হবে আদা মিশ্রিত পানীয়। আল্লাহপাক আদা-চায়ের কথাই বলেছেন কি-না কে জানে।

বাবা, তোমার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ করেছে। চোখ ফুলে গেছে। হাতপা ফুলে গেছে। শরীরে মনে হয় পানি এসেছে।

বুড়ো বয়সে শরীরে পানি তো আসবেই। আমার তো তাও কম এসেছে। অনেকের এমন পানি আসে যে শরীরেই জোয়ার-ভাটা হয়। হা হা হা হা।

মুহিব তাকিয়ে আছে। শামসুদ্দিন সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তোর বন্ধু-বান্ধবরা কেমন আছে?

কোন বন্ধুরা?

ঐ যে কিছু বেকার বন্ধুরা ক্লাবের মতো কী যেন করেছিস।

ক্লাব-টাব কিছু না। মাঝে মাঝে এক সঙ্গে বসা হয়।

ওরা আছে কেমন?

ভালো।

একজনকে নিয়ে এসেছিলি, সফিক নাম।

জি।

সফিক ভালো আছে?

জি, ভালো আছে।

অসাধারণ ছেলে। এমন ভালো ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নি।

কোন অর্থে ভালো ছেলে?

সব অর্থে। তাকে একবার কথায় কথায় বলেছিলাম, ঢাকা শহরে ভালো ঘি পাওয়া যায় না। সবই ভেজাল। সে বলল, চাচাজি, আমি শেরপুর থেকে আসল সরে ভাজা ঘি এনে দেব। এই ধরনের কথার কথা তো সবাই বলে। কয়জন আর মনে রাখে! সফিক কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছে। এক কেজি ঘি এনে দিয়েছে যেমন ঘ্রাণ, খেতেও তেমন সুস্বাদু। এখনো আছে। এক চামচ খাবি?

শুধু শুধু ঘি খাব কেন?

শুধু শুধু খাওয়া যায়। মাঝে মাঝে শরীর ভালো থাকে না। রান্নাবান্না করতে ইচ্ছা করে না। আমি করি কী, দুই চামচ ঘি আর দুই গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি। দেব তোকে এক চামচ? লবণের ছিটা দিয়ে খেয়ে দেখ। অবশ্যই ভালো লাগবে। দেব?

মুহিব বলল, দাও।

 

মুহিব ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে ঘর থেকে বের হলো।

শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে এগিয়ে দিতে গেলেন। নিজেই রিকশা ঠিক করলেন। দরদাম করে ভাড়া কমিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলেন। রিকশা যখন চলতে শুরু করল তখন হঠাৎ বললেন, মুহিব দাঁড়া। তোর সঙ্গে রিকশায় করে কিছু দূর যাই। এ জার্নি বাই রিকশা। আমার খারাপ লাগে না। হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া। শহরের বিষাক্ত হাওয়া— এইটাই যা সমস্যা।

রিকশা চলছে। শামসুদ্দিন ছেলের পাশে বসে আছেন। এক সময় ইতস্তত করে বললেন, তোর কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে?

মুহিব বলল, না।

শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, যদি অভ্যাস থাকে তাহলে আমাকে লজ্জা করিস। একটা বয়সের পর পুত্র হলো মিত্র বদাচারে অর্থাৎ মিত্র। তোর বন্ধুরা তোর কাছে যেমন, আমিও সে-রকম। বুঝতে পারছিস?

হুঁ।

তোর বন্ধু সফিকের সঙ্গে তোর কি আজ দেখা হবে?

হুঁ।

দেখা হলে অবশ্যই বলবি তার দেয়া ঘি আমি খুব আরাম করে খেয়েছি। বলতে পারবি না?

হুঁ।

সফিকের মতো ছেলে বন্ধু হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের কথা।

হুঁ।

আসলে বন্ধু পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার। বন্ধুত্বের বিষয়ে কবি ইয়েটস-এর কিছু লাইন আছে অসাধারণ–

Think where mans glory most begins and ends
And say, my glory was I had such friends.

লাইন দুটা সুন্দর না?

হুঁ।

মুখস্থ করে ফেল। মুখস্থ করে ফেললে সময়ে অসময়ে বলতে পারবি। আরেকবার বলি?

Think where mans glory most begins and ends
And say, my glory was I had such friends.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *