২. মুসলিম: রক্ষণশীল চেতনা (১৪৯২-১৭৯৯)
১৪৯২ সালে পশ্চিমে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হতে চলা নতুন ব্যবস্থার অন্যতম শিকার ছিল ইহুদিরা। ওই গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোর অন্য শিকার ছিল স্পেনের মুসলিমরা, ইউরোপে ঘাঁটি হারিয়েছিল তারা। কিন্তু ইসলাম কোনও দিক থেকেই পরাস্ত শক্তি ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে তখনও তা বিশ্ব পরাশক্তি ছিল। যদিও সুঙ রাজবংশ (৯৬০-১২৬০) চীনকে সামাজিক জটিলতা ও শক্তির দিক থেকে ইসলামি জগতের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরে নিয়ে গিয়েছিল ও ইতালিয় রেনেসাঁ এক সাংস্কৃতিক আলোকনের সূচনা ঘটিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যকে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম করে তুলবে, তবু মুসলিমরা প্রথম দিকে অনায়াসে এইসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পেরেছে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। মুসলিমরা গোটা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু তারা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকায় এমন বিস্তৃত ও কৌশলগতভাবে ছড়িয়ে ছিল যে এই সময় ইসলামী জগৎকে আধুনিককালের গোড়ার দিকের সভ্য জগতের অধিকাংশ এলাকার ধ্যানধারণা তুলে ধরা বিশ্ব ইতিহাসের একটি মাইক্রোকোসম হিসাবে দেখা যেতে পারে। মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক উত্তেজনাকর ও উদ্ভাবনী কাল: ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি নতুন ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল: এশিয়া মাইনর, আনাতোলিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ও উত্তর আফ্রিকায় অটোমান সাম্রাজ্য; ইরানে সাফাভিয় সাম্রাজ্য; ও ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য। প্রতিটি সাম্রাজ্য ইসলামি আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন ভিন্ন চেহারা তুলে ধরেছিল। মুঘল সাম্রাজ্য ফালসাফাহ নামে পরিচিত সহিষ্ণু বিশ্বজনীন দার্শনিক যুক্তিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে; সাফাভিয় শাহগণ এপর্যন্ত অভিজাত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস শিয়া ধর্মমতকে রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করেছিলেন; এবং সুন্নী ইসলামের প্রতি ভীষণভাবে অনুগত রয়ে যাওয়া অটোমান তুর্কিরা পবিত্র মুসলিম বিধান শরীয়াহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
এই তিনটি সাম্রাজ্য ছিল এক বিচ্যুতি। তিনটিই প্রাথমিক আধুনিক প্রতিষ্ঠান ছিল, পদ্ধতিগতভাবে আমলাতান্ত্রিক ও যৌক্তিক নির্ভুলতার সাথে এগুলো পরিচালিত হত। গোড়ার দিকের বছরগুলোতে অটোমান রাষ্ট্র ইউরোপের অন্য যেকোনও রাজ্যেও চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী ছিল। সুলতান দ্য ম্যাগনিফিশেন্টের (১৫২০- ৬৬) শাসনামলে তা শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়। গ্রিস, বালকান্স ও হাঙেরি হয়ে পশ্চিমে রাজ্য বিস্তৃত করেন সুলাইমান। ইউরোপের অভ্যন্তরে তাঁর অগ্রযাত্রা কেবল ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অধিকারে ব্যর্থতার কারণেই প্রতিহত হয়েছিল। সাফাভিয় ইরানে শাহগণ অনেক সড়ক ও কারাভানসরাই নির্মাণ করেন ও অর্থনীতিকে সংহত রূপ দেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশকে সামনের কাতারে নিয়ে আসেন তাঁরা। সবগুলো সাম্রাজ্যই ইতালিয় রেনেসাঁর সমমানের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ উপভোগ করেছে। অটোমান স্থাপত্যকলা, সাফাভিয় শিল্পকলা ও তাজমহলের জন্যে এক মহান সময় ছিল ষোড়শ শতাব্দী।
কিন্তু তাসত্ত্বেও এসবই ছিল আধুনিকায়নের পথে চলা সমাজ, এরা কোনও রেডিক্যাল পরিবর্তন বাস্তবায়ন করেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া বিপ্লবী রীতিনীতির অংশীদার ছিল না তারা। বরং এই সাম্রাজ্যগুলো যা প্রকাশ করেছে তাকে আমেরিকান পণ্ডিত মার্শাল জি.এস. হজসন বলেছেন ইউরোপসহ সকল প্রাক আধুনিক সমাজেরই বৈশিষ্ট্য ‘রক্ষণশীল চেতনা’। প্রকৃতপক্ষেই এই সাম্রাজ্যগুলো ছিল রক্ষণশীল মানসিকতার শেষ রাজনৈতিক প্রকাশ; প্রাক আধুনিক কালের সবচেয়ে অগ্রসর রাষ্ট্র ছিল বলে বলা যেতে পারে এগুলো তার সমগ্রকে তুলে ধরেছে। আজ রক্ষণশীল সমাজ বিপদে রয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য রীতি কার্যকরভাবে অধিকার করে নিয়েছে তাকে কিংবা রক্ষণশীল থেকে আধুনিক চেতনায় উত্তরণের কঠিন পথে অগ্রসর হচ্ছে। অধিকাংশ মৌলবাদই এই বেদনাদায়ক উত্তরণের প্রতি সাড়া। সুতরাং, এই মুসলিম সাম্রাজ্যের তুঙ্গ অবস্থায় রক্ষণশীল চেতনাকে পরখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা এর আবেদন ও শক্তি এবং সেই সাথে সহজাত সীমাবদ্ধতাগুলোও উপলব্ধি করতে পারি।
পাশ্চাত্য (পুঁজি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে) সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সভ্যতা নিয়ে আসার আগে, উনবিংশ শতাব্দীর আগে যার অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়নি, সকল সংস্কৃতিই অর্থনৈতিকভাবে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল। এর মানে, যেকোনও কৃষি নির্ভর সমাজের বিস্তার ও সাফল্যের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল, কেননা শেষ পর্যন্ত তার সম্পদ ও দায়িত্ব ফুরিয়ে ফেলবে। বিনিয়োগের জন্যে প্রাপ্য পুঁজির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিরাট পুঁজির প্রয়োজন হতে পারে এমন যেকোনও উদ্ভাবনকে নাকচ করে দেওয়া হত, কারণ লোকের সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলে, কর্মচারীদের বহাল রেখে আবার নতুন করে শুরু করার কোনও উপায় ছিল না। পশ্চিমে আজ যাকে আমরা নিশ্চিত ধরে নিই, আমাদের সংস্কৃতির আগের কোনও সংস্কৃতিই অব্যাহত উদ্ভাবনকে সামাল দিতে পারেনি। এখন আমরা আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্ম থেকে বেশি জানবার প্রত্যাশা করি, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, আমাদের প্রজন্ম ক্রমেই আরও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর হয়ে উঠবে। আমরা ভবিষ্যৎমুখী, আমাদের সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আগামীর দিকে তাকাতে হয় ও আগামী প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে এমন বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এটা স্পষ্ট হবে যে, আমাদের এই সমাজ স্থিতিশীল একরোখা যুক্তিবাদী ভাবনার ফল। এটা লোগোসের সন্তান, যা সবসময়ই সামনে তাকায়, আরও জানতে চায় ও আমাদের ক্ষমতার সীমানা বাড়াতে চায়। কিন্তু কোনও যৌক্তিক ভাবনাই একটি আধুনিক অর্থনীতি ব্যতীত এই আগ্রাসীভাবে উদ্ভাবনী সমাজ গড়ে তুলতে পারত না। নতুন নতুন আবিষ্কার সম্ভব করে তোলার জন্যে পাশ্চাত্য সমাজগুলোর পক্ষে অবকাঠামো বদলে ফেলা অসম্ভব নয়, কেননা পুঁজির অবিরাম পুনর্বিনিয়োগের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের মৌল সম্পদ বাড়িয়ে তুলতে পারি যাতে তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে তাল মেলাতে পারে। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে এটা সম্ভব ছিল না, এখানে লোকে ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকেই টিকিয়ে রাখতে শক্তি ব্যয় করত। একারণে প্রাক আধুনিক কালের ‘রক্ষণশীল’ প্রবণতা কোনও মৌল ভীরুতা থেকে উৎপন্ন হয়নি, বরং এই ধরনের সংস্কৃতির বাস্তবসম্মত মূল্যায়নই তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা মূলত পালাক্রমিক জানার ব্যাপার ছিল, এখানে কোনওরকম মৌলিকত্বকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সমাজ সাধারণভাবে ধারণ করতে পারত না বলে ছাত্রদের কোনও রেডিক্যাল নতুন ধারণা ভাবতে উৎসাহিত করা হত না; সুতরাং, এই ধরনের ভাবনা সামাজিকভাবে বিধ্বংসী হয়ে গোটা সম্প্রদায়কে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারত। রক্ষণশীল সমাজে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাক স্বাধীনতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।
আধুনিকদের মতো ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর বদলে প্রাক আধুনিক সমাজগুলো অনুপ্রেরণার জন্যে অতীতের দিকে মুখ ফেরাত। অবিরাম উন্নয়নের প্রত্যাশার বদলে ধরে নেওয়া হত যে পরবর্তী প্রজন্ম অনায়াসে অতীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। সাফল্যের নতুন চূড়ায় আরোহণের বদলে সমাজগুলো আদিম নিখুঁত অবস্থা থেকে অবনত হয়েছে বলে মনে করা হত। এই কল্পিত সোনালি যুগকে সরকার ও ব্যক্তি বিশেষের জন্যে আদর্শ মনে করা হত। অতীতের এই আদর্শের কাছাকাছি যাওয়ার ভেতর দিয়েই কেবল কোনও সমাজ তার সম্ভাবনাকে পূর্ণ করতে পারত। সভ্যতাকে সহজাতভাবে নাজুক মনে করা হত। সবাই জানত, পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপের মতো যেকোনও দেশই বর্বর কালে পতিত হতে পারে। ইসলামি বিশ্বে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে ত্রয়োদশ শতকের মঙ্গোল আগ্রাসনের স্মৃতি তখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। গণহত্যা, আগুয়ান দস্যু দলের হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের পলায়ন, ব্যাপক দেশান্তর, একের পর এক মহান ইসলামি শহরের ধ্বংসলীলা তখনও সত্রাসে স্মরণ করা হচ্ছিল। লাইব্রেরি ও শিক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।
সেই সাথে শত শত বছরের কষ্টে সংগৃহীত জ্ঞানও হারিয়ে গিয়েছিল। মুসলিমরা সামলে নিয়েছিল; সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীরা এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেন, যা লুরিয় কাব্বালাহর মতোই উপশমকারী বলে প্রমণিত হয়েছে; তিনটি নতুন সাম্রাজ্য ছিল সেই পুনরুজ্জীবনেরই নিদর্শন। অটোমান ও সাফাভিয় রাজবংশগুলোর মূল নিহিত ছিল মঙ্গোল যুগের ব্যাপক স্থানচ্যুতির ভেতর, দুটোই জন্ম নিয়েছে উগ্র গাযু রাষ্ট্রে, এগুলো সর্দার যোদ্ধার হাতে পরিচলিত হত ও প্রায়শঃই কোনও সুফি ত্বরিকার সাথে সম্পর্কিত ছিল। প্রলয়ঙ্করী ঘটনার সময় যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সাম্রাজ্যগুলোর শক্তি ও সৌন্দর্য ছিল ইসলামি মূল্যবোধের পুনরুত্থান ও মুসলিম ইতিহাসের আবার সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের গর্বিত উচ্চারণ। কিন্তু এমন মাত্রার বিপর্যয়ের পর প্রাক আধুনিক সমাজের স্বাভাবিক রক্ষণশীলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। লোকে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে বরং যা কিছু হারিয়ে গেছে তাকেই আবার ধীরে ধীরে কষ্টের সাথে ফিরে পাবার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ,
সুন্নি ইসলামে-ধর্মের অধিকাংশ মুসলিমের অনুসৃত ভাষ্য, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-এই মর্মে ঐকমত্য স্থাপিত হয় যে ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ (‘স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগ’) রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম জুরিস্টদের কোরান বা কোনও প্রতিষ্ঠিত ট্র্যাডিশনে স্পষ্ট জবাব দেওয়া হয়নি এমনসব আদর্শ ও বিধিবিধান সংক্রান্ত উত্থাপিত প্রশ্নের সমাধান বের করার লক্ষ্যে নিজস্ব বিচার বিবেচনা প্রয়োগের অনুমতি ছিল। কিন্তু আধুনিক কালের গোড়ার দিকে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে সুন্নি মুসলিমরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে স্বাধীন ভাবনার আর প্রয়োজন নেই। সমস্ত উত্তর তৈরি রয়েছে, শরীয়াহই সমাজের স্থায়ী নীল নকশা; ইজতিহাদের প্রয়োজনও নেই, তা কাঙ্ক্ষিতও নয়। মুসলিমদের বরং অবশ্যম্ভাবীভাবে অতীতের অনুসরণ (তাকলিদ) করতে হবে। নতুন সমাধান সন্ধানের পরিবর্তে তাদের উচিত হবে প্রতিষ্ঠিত আইনি সারগ্রন্থে প্রাপ্য বিধির প্রতি নতি স্বীকার করা। আইন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন (বিদাহ)-কে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে সুন্নি ইসলামি জগতে ক্রিশ্চান পাশ্চাত্যের মতবাদগত বিষয়ে ধর্মদ্রোহের মতোই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বিপজ্জনক মনে করা হত।
প্রবল রকম প্রতিমাবিরোধী আধুনিক পাশ্চাত্যের সাথে এরচেয়ে বেশি বেমানান প্রবণতা কল্পনা করা কঠিন। আমাদের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার উপর ইচ্ছাকৃত বাধা আরোপ এখন ঘৃণিত। পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, লোকে কেবল এই ধরনের বাধা ছুঁড়ে ফেলতে প্রস্তুত হলেই আধুনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা লোগোসের ফল হয়ে থাকলে মিথোস কীভাবে প্রাক আধুনিক বিশ্বের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল চেতনার সহায়ক ছিল সেটা বোঝা সহজ। পৌরাণিক ধ্যানধারণা অতীতমুখী, সামনে তাকায় না। পবিত্র সূচনা, আদিম ঘটনা, কিংবা মানুষের জীবনের ভিত্তির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে মিথ অটল কোনও কিছুর দিকে দৃষ্টি দেয়। আমাদের জন্যে এটা কোনও ‘সংবাদ’ বয়ে আনে না, বরং সবসময় কী ছিল সেই কথা বলে; গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কিছুই চিন্তা করা হয়ে গেছে, অর্জিত হয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কথার উপর, বিশেষ করে পবিত্র টেক্সটের উপর ভিত্তি করে আমরা বেঁচে থাকি, আমাদের যা কিছু জানার তার সবই তা জানিয়ে দিয়েছে। এটাই ছিল রক্ষণশীল কালের চেতনা। কাল্ট, আচরিক অনুশীলন ও পৌরাণিক বিবরণ ব্যক্তিকে কেবল তার গভীরতর অবচেতনে অনুরণন তোলা অর্থই যোগাত না, বরং কৃষি নির্ভর সমাজে টিকে থাকার জন্যে জরুরি প্রবণতা ও এর সহজাত সীমাবদ্ধতাকে শক্তিশালী করে তুলত। শাব্বেতাই যেভি কেলেঙ্কারী যেমন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মিথের বাস্তব পরিবর্তন ঘটানোর কথা নয়। এটা মনের একটা অবস্থা তৈরি করে যা চলমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয় ও সমরূপতা অর্জন করে। অনিরুদ্ধ উদ্ভাবনকে স্থান দিতে অপারগ সমাজে এটা আবশ্যক ছিল।
পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানকারী পাশ্চাত্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে যেমন মিথোলজির ভূমিকা বোঝা কঠিন-এমনকি অসম্ভব; তেমনি গভীর ও জোরালভাবে রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতায় গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষেও আধুনিক সংস্কৃতির অগ্রসর গতিশীলতা গ্রহণ করা দারুণভাবে কঠিন—এমনকি অসম্ভবও। আবার, এখনও প্রথাগত পৌরাণিক মূল্যবোধে লালিত জাতিকে বোঝাও আধুনিকতাবাদীর পক্ষে যারপরনাই কঠিন। আমরা যেমন দেখব, বর্তমান ইসলামি বিশ্বে কোনও কোনও মুসলিম দুটো বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। প্রথমত, তারা পাশ্চাত্য সমাজের ধর্মকে রাজনীতি থেকে, চার্চকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নকারী সেক্যুলারিজমকে ঘৃণা করে; দ্বিতীয়ত, অনেক মুসলিমই তাদের সমাজ ইসলামের পবিত্র আইন শরীয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া দেখতে চায়। এটা আধুনিক চেতনায় গড়ে ওঠা মানুষের চোখে দারুণভাবে বিভ্রান্তিকর; তারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই ভেবে ভীত যে একটা যাজকীয় প্রতিষ্ঠান তাদের চোখে স্বাস্থ্যকর সমাজের জন্যে আবিশ্যিক অবিরাম প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। এরা চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নকরণের সুবিধা ভোগ করেছে, তাই ইনকুইজিশনের মতো কোনও প্রতিষ্ঠান ‘ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছে’ ভেবে শিউরে ওঠে। একই ভাবে প্রত্যাদেশ মারফত পাওয়া স্বর্গীয় বিধানের ধারণাও আধুনিক রীতিনীতির সাথে বেমানান। আধুনিক সেক্যুলারিস্টরা কোনও অতিমানবীয় সত্তা কর্তৃক মানবজাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরিবর্তনীয় আইনের ধারণা বিতৃষ্ণার উদ্রেককারী মনে করে। তারা মনে করে, আইন মিথোস থেকে নয়, বরং লোগোস থেকে উদ্ভুত। এটা যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক, চলমান অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যে একে সময়ে সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হতে হবে। সুতরাং, এইসব মূল ইস্যুই আধুনিকতাবাদীদের মুসলিম মৌলবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
অবশ্য তুঙ্গ অবস্থায় শরীয়া আইনের ধারণা দারুণভাবে সন্তোষজনক ছিল। এটা ছিল ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য থেকে বৈধতা লাভ করা অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য। সুলতানকে শরীয়াহ আইনের রক্ষক হিসাবে শ্রদ্ধা করা হত। এমনকি সুলতান ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নিজ দিওয়ান-খাস মহল-যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হত—থাকলেও শরীয়াহ আদালতের (অটোমানরাই প্রথম একে পদ্ধতিগতভাবে সংগঠিত করেছিল) সভাপতিত্বকারী কাজিরাই বিচারকের সীলমোহর হিসাবে বিবেচিত হতেন। কাজি, তাদের পরামর্শক মুফতি ও মাদ্রাসায় ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের শিক্ষাদানকারী পণ্ডিতগণ (ফিকহ) সবাই ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। তাঁরা সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতোই সরকারের পক্ষে আবশ্যক ছিলেন। সুলতানের কর্তৃত্ব ধর্মীয় পণ্ডিত উলেমাদের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হত বলে বিভিন্ন আরব প্রদেশের বাসিন্দারা তুর্কিদের আধিপত্য মিনে নিতে পেরেছিল, এদের পেছনে ইসলামি আইনের পবিত্র কর্তৃত্ব ছিল। সুতরাং সেই হিসাবে ইস্তাম্বুল ও বিভিন্ন প্রদেশের ভেতর উলেমাগণ সুলতান ও প্রজাদের ভেতর সম্পর্কের একটা উপায় ছিলেন। তাঁরা ক্ষোভের কথা সুলতানের কানে তুলতে পারতেন ও এমনকি ইসলামি বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলে তাঁকেও ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারতেন। সুতরাং, উলেমারা অটোমান রাষ্ট্রকে নিজেদের রাষ্ট্র মনে করতে পারতেন; আর সুলতানগণ অংশীদারি তাঁদের ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল বলে তাঁদের উপর যাজকদের আরোপিত বাধা মেনে নিতেন। অটোমান সাম্রাজ্যের মতো আর কখনওই শরীয়া আইন রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে এভাবে প্রধান ভুমিকা রাখতে পারেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য দেখিয়েছে যে, ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য সত্যিই তাঁদের সঠিক পথে নিয়ে এসেছিল। অস্তিত্বের মৌল নীতিমালার সাথে একই ছন্দে অবস্থান করছিলেন তাঁরা।
সকল রক্ষণশীল সমাজ (যেমন ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে) এক সোনালি যুগের মুখাপেক্ষী থাকে; অটোমান সাম্রাজ্যের সুন্নি মুসলিমদের জন্যে সেটা ছিল পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) (c. ৫৭০-৬৩২সিই) ও তাঁর অব্যবহিত পরের প্রথম চার রাশিদুন (‘সঠিকপথে পরিচালিত’) খলিফা। তাঁরা ইসলামি আইন অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করেছিলেন। ধর্ম ও রাষ্ট্রের কোনও বিচ্ছিন্নতা ছিল না। মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক প্রধান। সপ্তম শতাব্দীর আরবাসীদের জন্যে তাঁর নিয়ে আসা প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থ কোরান জোর দিয়েছে যে, একজন মুসলিমের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ গঠন করা যেখানে দরিদ্র ও দুস্থ জনগণের প্রতি সম্মানের সাথে আচরণ করা হবে। এর জন্যে প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে জিহাদের (একটি শব্দ ‘পবিত্র যুদ্ধে’র পরিবর্তে-যেমনটা পাশ্চাত্যবাসীরা প্রায়ই ধরে নেয়-যার অনুবাদ হওয়া উচিত ‘প্রয়াস’ বা ‘সংগ্ৰাম’।): আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক। আল্লাহকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ গঠনের মাধ্যমে ও মানবজাতির জন্যে তাঁর পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে মুসলিমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংহতি অর্জন করবে যা তাদের আল্লাহর একত্বের বোধ জাগাবে। জীবনের কোনও একটি দিককে ঝেড়ে ফেলে তাকে এই ধর্মীয় ‘প্রয়াসে’র আওতার বাইরে ঘোষণা করা হবে প্রধান ইসলামি গুণ এই একীভূতকরণের (তাওহিদ) নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন। এটা স্বয়ং আল্লাহকেই অস্বীকার করার শামিল হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, ধর্মপ্রাণ কোনও মুসলিমের পক্ষে রাজনীতি হচ্ছে ক্রিশ্চানরা যাকে বলবে অপসুদীক্ষা। এটা এমন এক কর্মকাণ্ড যাকে পবিত্রায়িত করতেই হবে যাতে তা আল্লাহকে পাওয়ার একটি উপায়ে পরিণত হয়।
মুসলিম সম্প্রদায় অর্থাৎ উম্মাহর বিভিন্ন উদ্বেগ শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে বাধ্যতামূলক ইসলামের পাঁচটি আবশ্যকীয় অনুশীলন স্তম্ভে’ (রুকন) স্পষ্ট করা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা যেখানে অর্থডক্সিকে সঠিক বিশ্বাস মনে করে, মুসলিমদের সেখানে ইহুদিদের মতো অর্থপ্র্যাক্সির, ধর্মীয় অনুশীলনের সর্বজনীনতা এবং বিশ্বাসকে গৌণ বিষয় হিসাবে দেখা প্রয়োজন। পাঁচটি স্তম্ভ অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমকে শাহাদাহ (আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাস ও মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্বের পক্ষে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি) উচ্চারণ করতে হয়, দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনা করা, সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করার জন্যে কর প্রদান (যাকাত) করা, দরিদ্রদের উপবাসে থাকার কষ্টের স্মরণে রমযান মাসে উপবাস পালন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে মক্কায় হাজ্জ তীর্থযাত্রা পালন। উম্মাহর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য স্পষ্টত যাকাত ও রমযানের উপবাসের মূখ্য বিষয়। কিন্তু আবিশ্যিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ঘটনা হাজ্জে এটা জোরালভাবে উপস্থিত, এই সময় উম্মাহর ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যে ও ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য মুছে ফেলার জন্যে তীর্থযাত্রী সর্বজনীন শাদা পোশাক পরে।
আরবীয় হিজাজের কেন্দ্রে মক্কায় অবস্থিত চৌকো আকৃতির উপাসনাগৃহ কাবাহ হাজ্জের মুল মনোযোগের বিষয়। কাবাহ এমনকি মুহাম্মদের (স) আমলেও বহু প্রাচীন ছিল, সম্ভবত আদিতে আরবীয় প্যাগান দেবনিচয়ের পরম ঈশ্বর আল্লাহ’র প্রতি নিবেদিত ছিল। মুহাম্মদ (স) কাবাহয় বার্ষিক তীর্থযাত্রার আনুষ্ঠানিকতাকে ইসলামিকরণ করেছেন, একেশ্বরবাদী তাৎপর্য দান করেছেন। এখন পর্যন্ত হাজ্জ মুসলিম সমাজের এক জোরাল অভিজ্ঞতা দান করে। কাবাহর কাঠামো মনস্তাত্ত্বিক জি.সি. জাঙ (১৮৭৫-১৯৫১) কর্তৃক আবিষ্কৃত আর্কিটাইপাল তাৎপর্যমণ্ডিত জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাথে খাপ খায়। অধিকাংশ প্রাচীন শহরের কেন্দ্ৰে উপাসনালয় পবিত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে, তাদের অস্তিত্বের পক্ষে যাকে আবশ্যক মনে করা হত। এটা মরণশীল নারী-পুরুষের নাজুক ও অরক্ষিত শহুরে সমাজে অধিকতর সক্ষম আদিম বাস্তবতাকে বয়ে আনত। পুতার্ক, ওভিদ, দিওনিসাস অভ হেলিকারনাসাসের মতো ধ্রুপদি লেখকগণ বৃত্তাকার বা চৌকো হিসাবে উপাসনাগৃহের বর্ণনা দিয়েছেন, এটা মহাবিশ্বের অত্যাবশ্যক কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলে বলে বিশ্বাস করা হত। এটা সেই প্যারাডাইম যা তুমুল বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে এবং একে টেকসই করে বাস্তবতা দান করেছে। জাঙ বিশ্বাস করতেন যে, চৌকো বা বৃত্তের ভেতর যেকোনও একটিকে বেছে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, বাস্তবতার ভিত্তি মহাজাগতিক শৃঙ্খলাকে তুলে ধরা জ্যামিতিক চিত্র, তিনি বিশ্বাস করতেন, বৃত্তের ভেতর প্রবেশ করানো একটা চতুর্ভুজ। উপাসনাগৃহে পালিত আচারগুলো উপাসককে মহাবিশ্বের মৌল নীতিমালা ও আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে ও একে বিভ্রান্তি বা কুহকের ফাঁদে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সহজাত বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ভরা জগতে স্বর্গীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। মক্কার কাবাহ ঠিক আর্কিওটাইপের সাথে মিলে যায়। গ্রানিটের চৌকো কাঠামো ঘিরে তীর্থযাত্রীরা সাতবার আচরিক প্রদক্ষিণে দৌড়ে বেড়ায়। এর চারটে কোণ পৃথিবীর কোণের প্রতিনিধিত্ব করে, পৃথিবীকে ঘিরে সূর্যের ঘূর্ণনের ধরনকে অনুসরণ করে তারা। নারী বা পুরুষ তার সম্পূর্ণ সত্তার জীবনের মৌল ভিত্তির কাছে কেবল অস্তিত্বগত আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই (ইসলাম) একজন মুসলিম (যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন) সমাজে প্রকৃত মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে।
তীর্থযাত্রায় গেছে এমন একজন মুসলিমের কাছে এখনও সর্বোচ্চ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হজ্জ এভাবে গভীরভাবে রক্ষণশীল চেতনায় পরিপূর্ণ। সকল প্রকৃত মিথোই-এর মতো পৌরাণিক আদর্শজগতের অবচেতন বিশ্বে প্রোথিত হাজ্জ মুসলিমদের সেই মৌল উপাদানের কথা মনে করিয়ে দেয় যা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কারও পক্ষে এর বাইরে যাওয়া অসম্ভব। এটা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের চেয়ে গভীরে যেতে, বস্তুনিচয়ের আবিশ্যিকভাবে স্বাভাবিক ধর্মে আত্মসমর্পণ ও নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে অগ্রসর না হতে সাহায্য করে। সম্প্রদায়ের সমস্ত যৌক্তিক কর্মকাণ্ড-রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য বা সামাজিক সম্পর্ক-পৌরাণিক প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত ও পরে মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে অবস্থিত কাবাহ এইসব যৌক্তিক কর্মকাণ্ডকে অর্থ ও পরিপ্রেক্ষিত দান করেছে। কোরানও এই রক্ষণশীল মনোভাব তুলে ধরেছে। এটা বারবার জোরের সাথে বলেছে যে, মানুষের কাছে এটা কোনও নতুন সত্যি বয়ে আনছে না, বরং মানবজীবনের অত্যাবশ্যক বিধিবিধানকেই প্রকাশ করছে। এটা এরই মধ্যে জানা সত্যিরই ‘স্মারক’। মুহাম্মদ (স) মনে করেননি যে তিনি একটি নতুন ধর্ম তৈরি করছেন, বরং বিশ্বাস করেছেন যে, এই আরবীয় গোত্রের কাছে মানবজাতির আদিমতম ধর্মকেই নিয়ে আসছেন; এর আগে কখনও এদের কাছে কোনও পয়গম্বর প্রেরণ করা হয়নি, তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনও ঐশীগ্রন্থও ছিল না। কোরানের দৃষ্টিতে প্রথম পয়গম্বর আদমের কাল থেকেই কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে তার শিক্ষা দিতে আল্লাহ পৃথিবীর বুকে প্রত্যেক জাতির কাছে বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন।’ সহজাতভাবে স্বর্গীয় বিধির কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম পশু-পাখি, মাছ বা গাছের বিপরীতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে, ইচ্ছে করলে সে এই বিধানকে অমান্য করতে পারে।” তারা যখন এইসব মৌল বিধানকে অমান্য করে দরিদ্রের উপর নির্যাতনকারী সুষ্ঠুভাবে সম্পদ বণ্টনে অস্বীকারকারী স্বেচ্ছাচারী সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই তারা তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। কোরান আমাদের জানাচ্ছে অতীতের মহান সব পয়গম্বর-আদম, নোয়াহ, মোজেস, জেসাস এবং আরও অনেকে—কীভাবে আল্লাহ’র সেই একই বাণী উচ্চারণ করেছেন। এখন কোরান আরবদের কাছে সেই একই স্বর্গীয় বাণী এনে দিয়েছে, তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার চর্চা করার নির্দেশ দিচ্ছে যা তাদের অস্তিত্বের মৌল বিধির সাথে সমন্বিত করবে। মুসলিমরা যখন আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলে, সবকিছু যেমন হওয়া উচিত ছিল সেইভাবে বস্তুনিচয়ের ধারার সাথে চলার বোধ জাগে তাদের ভেতর। আল্লাহ’র বিধান অমান্য করাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিবেচনা করা হয়েছে: এ যেন কোনও মাছ জমিনে বাস করার প্রয়াস পাচ্ছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানদের বিস্ময়কর সাফল্যকে নিশ্চয়ই তাদের প্রজাদের চোখে তারা যে এই মৌল নীতিমালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে ফুটে উঠেছিল। একারণেই তাদের সমাজ এমন দর্শনীয়ভাবে কাজ করেছে। অটোমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরীয়াহ আইনকে দেওয়া নজীরবিহীন প্রাধ্যান্যকেও এই রক্ষণশীল চেতনায় দেখা হয়েছিল। আধুনিকতার সূচনায় মুসলিমরা স্বর্গীয় আইনকে তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্নকারী বিষয় মনে করেনি, এটা ছিল পৌরাণিক আদর্শজগতের আচরিক ও কাল্টিক বাস্তবায়ন, যা তাদের পবিত্রের সংস্পর্শে নিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করেছে। মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের পরবর্তী শতাব্দীগুলোয় ধীরে ধীরে মুসলিম আইনের বিকাশ ঘটেছে। কোরানে খুব কমই বিধানের অস্তিত্ব রয়েছে আর পয়গম্বরের পরলোকগমনের এক শো বছরের ভেতর মুসলিমরা হিমালয় থেকে পিরেনীজ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করছিল বলে অন্য যেকোনও সমাজের মতোই এর জটিল আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন থাকায় এটা ছিল একটা সৃজনশীল উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের চারটি ধারা গড়ে ওঠে। সবগুলোই প্রায় একই ধরনের, এদের সমানভাবে বৈধ মনে করা হয়। পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে এই বিধানব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ গ্রহণের সময় ইসলামের নিখুঁত ভঙ্গিমা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নবম শতাব্দীতে খুব সতর্কতার সাথে পয়গম্বরের শিক্ষা ও আচরণ সংক্রান্ত প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন (হাদিস) সংগ্রহ করা হয়, মুসলিমরা তাঁর বাণী ও ধর্মীয় অনুশীলনের (সুন্নাহ) একটা নির্ভুল রেকর্ড লাভ করে সেটা নিশ্চিত করতে যত্নের সাথে বাছাই করা হয়েছে। আইনি মতবাদগুলো মুহাম্মদীয় এই প্যারাডাইমগুলোকে তাদের আইনি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে যাতে সারা বিশ্বের মুসলিমরা পয়গম্বর যেভাবে কথা বলতেন, খেতেন, হাতমুখ ধুতেন, ভালোবাসতেন ও প্রার্থনা করতেন তার অনুকরণ করতে পারে। এইসব বাহ্যিক বিষয়ে পয়গম্বরের অনুকরণের ভেতর দিয়ে তারা আল্লাহর কাছে তাঁর অন্তস্থঃ আত্মসমর্পণের নাগাল পাবার আশা করেছিল।” প্রকৃত রক্ষণশীল চেতনায় মুসলিমরা অতীতের এক নিখুঁত বিষয়ের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিল।
মুসলিম বিধানের অনুশীলন ঐতিহাসিক চরিত্র মুহাম্মদকে (স) মিথে পরিণত করে তাঁকে তিনি যে কালে বেঁচেছিলেন সেই কাল থেকে মুক্ত করে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের ব্যক্তি জীবনে তুলে এনেছে। একইভাবে এই কাল্টিক পুনারাবৃত্তি মুসলিম সমাজকে আল্লাহর কাছে নিখুঁত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একজন মানুষের কেমন হওয়া উচিত তার নজীরে পরিণত হওয়া ব্যক্তি মুহাম্মদের (স) নৈকট্য লাভের ভেতর দিয়ে প্রকৃত ইসলামি করে তুলেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আগ্রাসনের সময় নাগাদ শরীয়াহ আধ্যাত্মিকতা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সারা মুসলিম বিশ্বে শেকড় বিস্তার করেছিল, সেটা খলিফা ও উলেমাগণ এটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নয়, বরং এটা নারী-পুরুষকে নুমিনাসের অনুভূতি দিয়েছিল ও তাদের জীবনকে অর্থ দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল বলে। অতীতের প্রতি এই কাল্টিক উল্লেখ অবশ্য সপ্তম শতাব্দীর জীবনধারার প্রতি প্রাচীন আনুগত্যের কাছে বন্দি করেনি। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্য তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র ছিল। সময়ের হিসাবে এটা অসাধারণ দক্ষ ছিল, এক নতুন ধরনের আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে ও প্রাণবন্ত জীবনধারাকে উৎসাহিত করেছে। অটোমানরা অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি উদার ছিল। পাশ্চাত্য নৌচলাচল বিজ্ঞান তাদের সত্যিই উত্তেজিত করে তুলেছিল, অভিযাত্রীদের বিভিন্ন আবিষ্কারে রীতিমতো আলোড়িত হয়েছে; এবং গানপাউডার ও আগ্নেয়াস্ত্রের মতো পাশ্চাত্য সামরিক আবিষ্কার আয়ত্ত করতে তারা উদগ্রীব ছিল।” উলেমাদের দায়িত্ব ছিল এইসব উদ্ভাবনকে মুসলিম আইনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইমের অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতির অনুসন্ধান করা। জুরিপ্রুডেন্সের গবেষণা (ফিকহ) মানে কেবল প্রাচীন টেক্সট পাঠের ব্যাপার ছিল না, বরং এর চ্যালেঞ্জিং একটা মাত্রা ছিল। এবং এই সময় পর্যন্ত ইসলাম ও পশ্চিমের ভেতর কোনও পার্থক্য ছিল না। ইউরোপও রক্ষণশীল চেতনায় ডুবে ছিল। রেনেসাঁ মানবতাবাদীরা আদ ফন্তেসে, উৎসে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, সাধারণ মরণশীলের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ধর্ম থেকে বের হয়ে আসা কার্যত অসম্ভব। নতুন নতুন আবিষ্কার সত্ত্বেও ইউরোপিয়রা অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রক্ষণশীল রীতিনীতিতেই শাসিত হয়েছে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা ভবিষ্যৎমুখী যুক্তিবাদ দিয়ে জীবনের পশ্চাদমুখী পৌরাণিক ধারাকে প্রতিস্থাপিত করার পরেই কেবল কোনও কোনও মুসলিম ইউরোপকে অচেনা ভাবতে শুরু করবে।
এছাড়া, রক্ষণশীল সমাজকে সম্পূর্ণ স্থবির কল্পনা করে নেওয়াটা ভ্রান্তি হবে। গোটা মুসলিম ইতিহাস জুড়ে ইসলা (‘সংস্কার’) ও তাজদিদ (‘নবায়ন’)-এর আন্দোলন চলেছে, প্রায়শঃই এগুলো ছিল সম্পূর্ণই বিপ্লবী। উদাহরণ স্বরূপ, দামাস্কাসের আহমাদ ইবন তাঈমিয়াহর (১২৬৩-১৩২৮) মতো একজন সংস্কারক ‘ইজতিহাদের দুয়ার রুদ্ধ করার’ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মঙ্গোল আগ্রাসনের আগে ও পরে জীবন যাপন করেছেন তিনি, মুসলিমরা এই সময় প্রবল আচ্ছন্ন দশা থেকে মুক্ত হয়ে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছিল। সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কালে বা ব্যাপক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অব্যবহিত পরপর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়ে থাকে। এমন সময়ে পুরোনো সমাধান আর কাজে আসে না, সুতরাং সংস্কারকগণ ইজতিহাদের যৌক্তিক ক্ষমতা ব্যবহার করে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন। ইবন তাঈমিয়াহ শরীয়াকে হালনাগাদ করতে চেয়েছিলেন যাতে করে তা এই খোলনলচে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে মুসলিমদের সত্যিকারের প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি আবিশ্যিকভাবে রক্ষণশীল রূপ ধারণ করেছিল। ইবন তাঈমিয়া বিশ্বাস করতেন যে, সঙ্কট উত্তরণের জন্যে মুসলিমদের অবশ্যই উৎসে, অর্থাৎ কোরান ও পয়গম্বরের সুন্নাহ্য় ফিরে যেতে হবে। পরবর্তীকালের সকল ধর্মীয় সংযোজন বাতিল করে মূলে ফিরে যেতে চেয়েছেন তিনি। অর্থাৎ, আদিম মুসলিম আদর্শরূপে ফিরে যেতে পবিত্র বিবেচিত হতে শুরু করা অনেক মধ্যযুগীয় জুরিপ্রুডেন্স (ফিকহ) ও দর্শন বাতিল করে দিয়েছিলেন। এই প্রতিমাবিরোধিতা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং ইবন তাঈমিয়া বাকি জীবন কারাগারে কাটান। বলা হয়ে থাকে যে, আটককারী তাঁকে কলম ও কাগজ না দেওয়ায় ভগ্ন হৃদয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল, তাঁর আইনি সংস্কার ছিল উদার ও রেডিক্যাল, তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের স্বার্থই তিনি মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন।২ তাঁর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় স্বীকৃতির প্রদর্শনীতে পরিণত হয়। ইসলামি ইতিহাসে এমন আরও অনেক সংস্কারক রয়েছেন। আমরা আমাদের বর্তমান কালের কোনও কোনও মুসলিম মৌলবাদীকে ইসলাহ ও তাজদিদের এই ঐতিহ্যে কাজ করতে দেখব।
অন্য মুসলিমরা নিগূঢ় আন্দোলনের মাঝে নতুন ধর্মীয় ধারণা ও অনুশীলনের সন্ধান করতে পেরেছিল। এসব সাধারণ জনগণের কাছে গোপন রেখেছিল তারা, কেননা তাদের ধারণা ছিল এসবকে ভুল বোঝা হতে পারে। অবশ্য, তারা ধর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণার কোনও পার্থক্য দেখতে পায়নি। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের আন্দোলনসমূহ কোরানের শিক্ষার সম্পূরক ছিল এবং সেগুলোকে নতুন প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছে। ইসলামের তিনটি প্রধান নিগূঢ় ধরন হচ্ছে, সুফিবাদের অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন, ফালসাফাহর যুক্তিবাদ ও শিয়া ধর্মমতের কিছুটা রাজনৈতিক ধার্মিকতা। এই অধ্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত অনুসন্ধান করব। কিন্তু ইসলামের এই নিগূঢ় ধরনগুলোকে যত উদ্ভাবনীমূলক বা মূলধারার শরীয়া ধার্মিকতা থেকে যতই বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, মরমীরা বিশ্বাস করত যে তারা আদ ফন্তেসে ফিরে যাচ্ছে। কোরানের ধর্মে গ্রিক যুক্তিবাদের নীতিমালা প্রয়োগের প্রয়াস লাভকারী ফালসাফাহর প্রচারকরা সময়হীন সত্যির আদিম সর্বজনীন ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে, তাদের ধারণা ছিল ওই ধর্ম বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধর্মের আগেও বিরাজ করত। সুফিরা বিশ্বাস করেছে যে, অতীন্দ্রিয় পরমানন্দ পয়গম্বর কোরান গ্রহণ করার সময় যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তারাও মুহাম্মদের (স) আদি আদর্শের সাথে একাত্ম হচ্ছে। শিয়াদের দাবি, কেবল তারাই কোরানে উল্লিখিত সামাজিক ন্যায়বিচারের আবেগের চর্চা করে, কিন্তু দুর্নীতিবাজ মুসলিম শাসকগণ তাকে উপেক্ষা করে গেছেন। নিগূঢ়বাদীদের কেউই আমাদের ধারণা অনুযায়ী ‘মৌলিক’ হতে চায়নি, সবাইই মূলে ফিরে যাওয়ার রক্ষণশীল দিক থেকে মৌলিক, কেবল সেটাই মানুষকে পূর্ণাঙ্গতা ও পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশ্বাস করা হত।[১৩]
এই গ্রন্থে আমরা যেসব দেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব তাদের ভেতর একটি মিশর। ১৫১৭ সালে এই দেশটি অটোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। প্রথম সেলিম সেই সময় সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সময় দেশটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। সুতরাং শরীয়া ধার্মিকতা মিশরে প্রধান ছিল। কায়রোর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহার সুন্নি বিশ্বে ফিকহ গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু অটোমান শাসনের শতাব্দীগুলোয় ইস্তাম্বুলের পেছনে পড়ে যায় মিশর, আপেক্ষিকভাবে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব। আধুনিক কালের সূচনা লগ্নে এই দেশটির অবস্থা সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। ১২৫০ সাল থেকে এই অঞ্চল মামলুকদের শাসনাধীন ছিল—এরা ছিল কিশোর বয়সে বন্দি করে ইসলামে ধর্মান্তরিত কর্সিকান দাসদের নিয়ে সংগঠিত একটা ক্র্যাক সামরিক বাহিনী। একই ধরনের দাস-বাহিনী জানেসারিরা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক মেরুদণ্ড। তুঙ্গ সময়ে মামলুকরা মিশর ও সিরিয়ায় এক প্রাণবন্ত সমাজে নেতৃত্ব দিয়েছে। মিশর ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলুক সাম্রাজ্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতার সহজাত সীমাবদ্ধতার কাছে নতি স্বীকার করে নেয়, এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এর পতন শুরু হয়। মামলুকরা অবশ্য মিশরে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়নি। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বে’র সাথে জোট বেঁধে দেশটি দখল করে নেন। এই রফার অধীনে খায়ের বে-কে অটোমান বাহিনী প্রত্যাহৃত হওয়ার পর ভাইসরয় নিয়োগ করা হয়েছিল।
গোড়ার দিকে অটোমানরা মামলুকদের সামাল দিতে পেরেছিল, দুটি মামলুক বিদ্রোহকে দমন করেছিল তারা।[১৪] তবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে অটোমানরা তাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফেলতে যাচ্ছিল। ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি প্রশাসনে পতন ডেকে আনে এবং ক্রমশঃ বেশ কয়েকটা বিদ্রোহের পর মামলুক অধিনায়করা (বে) মিশরের আসল শাসক হিসাবে আবির্ভূত হন, যদিও সরকারীভাবে ইস্তাম্বুলের অধীন ছিলেন তাঁরা। বে-গণ উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন সামরিক ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন, এই বাহিনী তুর্কি গভর্নরের বিরুদ্ধে অটোমান সেনাবাহিনীতে মামলুক বাহিনীর একটা বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় ও তার জায়গায় নিজেদের একজনকে ক্ষমতায় বসায়। সুলতান এই নিয়োগের বৈধতা দান করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে সংক্ষিপ্ত একটা পর্যায় বাদে মামলুকরা দেশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছিল। ওই সময় জানেসারিদের একজন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। তবে মামলুক শাসন ছিল অস্থিতিশীল। বে-তন্ত্ৰ দুটো উপদলে বিভক্ত ছিল, ফলে সারাক্ষণ অস্থিরতা ও অন্তর্দলীয় কোন্দল লেগেই থাকত।[১৫] এই গোটা উত্তাল সময় জুড়ে প্রধান শিকার ছিল মিশরের সাধারণ জনগণ। বিদ্রোহ ও উপদলীয় সহিংসতার সময় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, করের ভারে পঙ্গু হয়ে গেছে তারা। তুর্কি বা সারকাসিয়ান, যাই হোক না কেন, শাসকদের সাথে তারা কোনওরকম ঐক্য বোধ করতে পারেনি, এরা ছিল বিদেশী ও জনগণের কল্যাণে কোনও আগ্রহ ছিল না তাদের। জনগণ ক্রমবর্ধমানহারে উলেমাদের শরনাপন্ন হচ্ছিল: মিশরিয় ছিলেন তাঁরা, শরীয়ার পবিত্র শৃঙ্খলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁরাই মিশরিয় জনগণের প্রকৃত নেতায় পরিণত হন। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে বে-দের ভেতরকার বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করলে মামলুক নেতৃবৃন্দ আবিষ্কার করেন যে, জনগণকে তাদের শাসন মেনে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে উলেমাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই।১৬
উলেমারা ছিলেন মিশরিয় সমাজের শিক্ষক, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী। প্রতিটি শহরে এক থেকে সাতটি মাদ্রাসা (ইসলামি আইন ও ধর্মতত্ত্ব পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল, এগুলোই ছিল দেশের শিক্ষকের যোগানদার। বুদ্ধিবৃত্তির মান খুব উন্নত ছিল না। প্রথম সেলিম মিশর দখল করে নেওয়ার পর প্রচুর মূল্যবান পাণ্ডুলিপিসহ বহু নেতৃস্থানীয় উলেমাকে সাথে করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অটোমান সাম্রাজ্যের একটা পশ্চাদপদ প্রদেশে পরিণত হয়েছিল মিশর। অটোমানরা আরব পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। মিশরিয়দের বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। মামলুক শাসনের সময় সমৃদ্ধি লাভ করা মিশরিয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ওষুধবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল।১৭
কিন্তু শাসক ও সাধারণ জনগণের ভেতর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম থাকায় উলেমাগণ যাপরনাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। এদের বেশিরভাগই এসেছিলেন ফেলাহীন কৃষক শ্রেণী থেকে, তাই পল্লী অঞ্চলে তাদের প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। কোরান স্কুল ও মাদ্রাসায় গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা; শরীয়া আদালতসমূহ বিচার ব্যবস্থার মুল কেন্দ্র থাকায় উলেমাগণ আইনি ব্যবস্থায়ও একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। এছাড়া, দিওয়ানে” গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদের অধিকারী ছিলেন তাঁরা এবং শরীয়াহর অভিভাবক হিসাবে সরকারের বিরুদ্ধে মূল বিরোধিতারও নেতৃত্ব দিতে পারতেন। বিখ্যাত মাদ্রাসা আল-আযহারের অবস্থান ছিল বাজারের পাশে, উলেমাদের সাথে বণিক শ্রেণীর শক্তিশালী সম্পর্ক ছিল। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলে তারা আযহারের মিনার থেকে বাজানো ঢাকের আওয়াজেই বাজার বন্ধ করে দিতে পারত ও লোকজনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে পারত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৭৯৪ সালে আযহারের রেক্টর শেখ আল-শারকাভি এক নতুন করারোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একে নির্যাতনমূলক ও অনৈসলামিক ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তিন দিন পরে বে-গণ কর প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৯ কিন্তু সরকার উৎখাত করে উলেমাদের সরকার গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থান পরিচালনার কোনও বাস্তব হুমকি ছিল না। বে-গণ সাধারণত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। মব ভায়োলেন্স প্রায়শঃই মামলুক সেনাবাহিনীর পক্ষে তেমন কোনও চলমান চ্যালেঞ্জ ছিল না। তা সত্ত্বেও উলেমাদের প্রাধান্য মিশরিয় সমাজকে একটা লক্ষযোগ্য ধর্মীয় চরিত্র দান করেছিল, ইসলামই মিশরের জনগণকে একমাত্র নিরাপত্তার যোগান দিয়েছিল।২১
অষ্টম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ছিল যারপরনাই মূল্যবান। এই সময় নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্য মারাত্মক অবনতির শিকারে পরিণত হয়। এর ষোড়শ শতকীয় সরকারের অসাধারণ দক্ষতা বিশেষ করে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় অযোগ্যতার জন্ম দেয়। বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল পাশ্চাত্য জগৎ। অটোমানরা আবিষ্কার করে যে তারা এখন আর আগের মতো ইউরোপের সাথে সমান তালে লড়তে পারছে না। পাশ্চাত্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল, সেটা রাজনৈতিক দুর্বলতার কালে ঘটছিল বলে নয়, বরং ইউরোপে গড়ে উঠতে থাকা এক নতুন সমাজের কোনও পূর্ব নজীর না থাকায়।২২ সুলতানগণ মানিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের প্রয়াস ছিল বাহ্যিক। উদাহরণ স্বরূপ, সুলতান তৃতীয় সেলিম (১৭৮৯-১৮০৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন) পাশ্চাত্য হুমকিকে কেবল সামরিক ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন। ১৭৩০-এর দশকে ইউরোপিয় ধাঁচে সেনাবাহিনীকে গড়ো তোলার ব্যর্থ প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৭৮৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করার পর সেলিম ফরাসী নির্দেশকসহ বেশ কয়েকটি সামরিক স্কুল খোলেন: ছাত্ররা এখানে ইউরোপিয় ভাষা ও গণিত, নৌচলাচল, ভূগোল ও ইতিহাসের বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে।২৩ অল্প কিছু সামরিক কৌশল শিক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞানের ভাসা ভাসা জ্ঞান অবশ্য পাশ্চাত্য হুমকিকে সামাল দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। কারণ ইউরোপিয়রা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জীবন ও চিন্তা ধারার বিকাশ ঘটিয়েছিল; ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেতায় কাজ করছিল তারা। তাদের নিজস্ব কৌশলে তাদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে অটোমানদের প্রয়োজন ছিল সমাজের ইসলামি কাঠামো ভেঙে একেবারে নতুন ধরনের যৌক্তিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো ও অতীতের সাথে সমস্ত পবিত্র সম্পর্ক ছেদ করতে প্রস্তুত থাকা। অভিজাত গোষ্ঠীর অল্প কিছু মানুষের পক্ষে হয়তো এই পরিবর্তন অর্জন করা সম্ভব ছিল, ইউরোপিয়দের যার জন্যে প্রায় তিনশো বছর লেগেছিল; কিন্তু সাধারণ জনগণকে কীভাবে তাঁরা এমন রেডিক্যাল পরিবর্তন মেনে নিতে ও উপলব্ধি করতে সম্মত করাতেন, যাদের মনমানসিকতা রক্ষণশীল রীতিনীতিতে পরিপূর্ণ?
ইউরোপের সীমান্তে যেসব জায়গায় অটোমান পতন অনেক বেশি প্রকট ছিল, সেখানকার জনগণ বরাবরের মতোই পরিবর্তন ও অস্থিরতার প্রতি সাড়া দিয়েছিল-ধর্মীয় কায়দায়। আরবীয় পেনিনসুলায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল- ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ইস্তাম্বুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মধ্য আরব ও পারসিয়ান গাল্ফ এলাকায় নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হন। আব্দ আল-ওয়াহহাব ছিলেন টিপিক্যাল ইসলামি সংস্কারক। মধ্যযুগীয় জুরেসপ্রুডেন্স, অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শন প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করে কোরান ও সুন্নাহয় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবিলার প্রয়াস পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে এসব যেহেতু আদি ইসলাম থেকে বিচ্যুতি, তাই আল-ওয়াহহাব অটোমান সুলতানদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিশ্বাসীদের আনুগত্য লাভের অযোগ্য ও মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের শরীয়া রাষ্ট্র সঠিক নয়। তার বদলে আল-ওয়াহহাব সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে খাঁটি ধর্মের একটা ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটা ছিল আক্রমণাত্মক আন্দোলন, বাহুবলে জনগণের উপর চেপে বসেছিল। এইসব সহিংস ও প্রত্যাখ্যানমূলক ওয়াহহাবীয় শিক্ষা আরও ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্থিরতার কাল বিংশ শতাব্দীর দিকে কিছু সংখ্যক মৌলবাদী ইসলামি সংস্কারকদের হাতে ব্যবহৃত হবে।২8
মরোক্কোর সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবন ইদ্রিসের (১৭৮০-১৮৩৬) সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আমাদের কালেও যার অনুসারী রয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে তাঁর সমাধান ছিল সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা ও তাদের ভালো মুসলিমে পরিণত করা। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে প্রচুর সফর করেছেন তিনি, সাধারণ জনগণের উদ্দেশে তাদের নিজস্ব ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন, সমবেত প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন ও অনৈতিক অনুশীলন থেকে তাদের বের করে আনতে চেয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন ছিল এটা। ওয়াহহাবী পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার অবকাশ ছিল না ইবন ইদ্রিসের। তাঁর চোখে শক্তি নয়, শিক্ষাই ছিল মূল চাবকাঠি। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা অবশ্যই ভ্রান্তি। অন্য সংস্কারকগণ একই পথে কাজ করেছেন। আলজেরিয়ায় আহমাদ আল-তিগরানি (মৃ. ১৮২৪), মদিনায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল-করিম শামীম (মৃ. ১৭৭৫) এবং লিবিয়ায় মুহাম্মদ ইবন আলি আল-সানুসি (মৃ. ১৮৩২)-এদের প্রত্যেকে উলেমাদের পাশ কাটিয়ে ধর্মকে সরাসরি মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। এটা ছিল জনমুখী সংস্কার, তাঁরা তাঁদের চোখে অভিজাতপন্থী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছেন; আব্দ আল-ওয়াহহাবের বিপরীতে মতবাদগত পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না তাঁরা। জনগণকে মূল কাল্টে ফিরিয়ে নিয়ে ও তাদের নৈতিকভাবে জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করে জটিল ফিকহের চেয়ে অনেক কার্যকরভাবে সমাজের অসুস্থতাকে দূর করা যাবে।
শত শত বছর ধরে সুফিগণ শিষ্যদের তাদের নিজস্ব জীবনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইম নতুন করে সৃষ্টি করার শিক্ষা দিয়ে এসেছেন; তারাও জোর দিয়ে বলেছেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথই হচ্ছে সৃজনশীল ও অতীন্দ্ৰিয় কল্পনা: মানুষের সুফিবাদের ধ্যানমূলক অনুশীলনের সাহায্যে অবশ্যই নিজের মতো থিওফ্যানি সৃষ্টি করার দায়িত্ব রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষে ও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এইসব সংস্কারকগণ-পণ্ডিতরা যাদের ‘নিও-সুফি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন—আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করার শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের আর পণ্ডিত ও বিদ্বান যাজকের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। ইবন ইদ্রিস এমনকি যত মহানই হোন না কেন, পয়গম্বর বাদে সকল মুসলিম সাধুর কর্তৃত্ব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করার মতো পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের যা কিছু নতুন তাকে মূল্য দিতে ও শ্রদ্ধার আলখেল্লাহ ঝেড়ে ফেলার উৎসাহ দিয়েছেন। অতীন্দ্রিয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া নয়, বরং পয়গম্বরের মানবীয় চরিত্রের সাথে গভীরভাবে একীভূত হওয়া-যিনি আল্লাহর কাছে নিজেকে এমনি নিখুঁতভাবে উন্মুক্ত করে তুলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এগুলো আধুনিক প্রবণতা ছিল। নিও-সুফিগণ পয়গম্বরের আদিআদর্শ ব্যক্তিত্বের মুখাপেক্ষী থাকলেও তারা যেন দুর্ভেয়মুখী নয় বরং মানবমুখী ধর্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটাচ্ছিলেন এবং শিষ্যদের যা কিছু নতুন ও উদ্ভাবনী শক্তির তাকে প্রাচীনের মতোই মূল্য দিতে শেখাচ্ছিলেন। পশ্চিমের সাথে ইবন ইদ্রিসের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তিনি কখনওই তাঁর লেখায় ইউরোপের কথা উল্লেখ করেননি, পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান বা তার প্রতি কোনও আগ্রহেরও প্রকাশ ঘটাননি। কিন্তু সুন্নি ইসলামের পৌরাণিক অনুশীলন তাঁকে ইউরোপিয় আলোকনের কিছু কিছু নীতিমালাকে আলিঙ্গন করতে চালিত করেছে।২৫
ইরানের ক্ষেত্রেও একই রকম ছিল ব্যাপারটা। এই দেশের এই সময়ের ইতিহাস মিশরের তুলনায় ভালোভাবে লিখিত আছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাফাভিয়রা ইরান জয় করে শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রের সরকারী ধর্মে পরিণত করে। এর আগে পর্যন্ত শিয়া মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অতীন্দ্রিয় নিগূঢ় অভিজাত আন্দোলন ছিল; নীতিগতভাবে শিয়ারা রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল। ইরানে সব সময়ই কিছু প্রধান শিয়া কেন্দ্র ছিল, তবে বেশির ভাগ শিয়াই ছিল আরব, পারসি নয়। সুতরাং, ইরানে সাফাভিয় পরীক্ষা ছিল এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। সুন্নি ও শিয়াদের ভেতর কোনও মতবাদগত বিরোধ নেই, পার্থক্যটা স্পষ্টতই আবেগজাত। সুন্নিরা মূলত মুসলিম ইতিহাসের বেলায় আশাবাদী, অন্যদিকে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি ট্র্যাজিক: পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) বংশধরদের পরিণতি শুভ ও অশুভ, ন্যায়বিচার ও স্বৈরাচারের মাঝে মহাজাগতিক যুদ্ধের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যেখানে দুষ্টই যেন সব সময় জয় লাভ করছে বলে মনে হয়। সুন্নিরা যেখানে মুহাম্মদের (স) জীবনকে মিথে পরিণত করেছে, শিয়ারা তাঁর বংশধরদের জীবনকে পুরাণে পরিণত করেছে। শিয়া বিশ্বাস উপলব্ধির জন্যে-যা না হলে ১৯৭৮-৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের মতো ঘটনাবলী বোধের অতীত-আমাদের অবশ্যই সংক্ষেপে শিয়া বিশ্বাসের বিকাশ বিবেচনা করতে হবে।
৬৩২ সালে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) পরলোকগমন করার সময় উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্যে কোনও ব্যবস্থা রেখে যাননি। তাঁর বন্ধু আবু বকর উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাধ্যমে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হন। অবশ্য কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে, মুহাম্মদ (স) হয়তো তাঁর নিকটতম পুরুষ আত্মীয় আলি ইবন আবি তালিবই তাঁর উত্তরাধিকারী হোক, এটাই চাইতেন, তিনি ছিলেন তাঁর পোষ্য, চাচাত ভাই ও মেয়ে জামাই। কিন্তু ৬৩৬ সালে চতুর্থ খলিফা হওয়ার আগ পর্যন্ত আলিকে বিভিন্ন নির্বাচনে ক্রমাগত বাদ দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শিয়ারা অবশ্য প্রথম তিন খলিফার শাসনকে স্বীকার করে না। আলিকেই তারা প্রথম ইমাম (‘নেতা’) আখ্যায়িত করে থাকে। আলির ধার্মিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি তাঁর অফিসারদের উদ্দেশে ন্যায়বিচার ভিত্তিক বিচারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে চিঠি লিখেছেন। অবশ্য ৬৩৬ সালে দুঃখজনকভাবে এক মুসলিম চরমপন্থীর হাতে নিহত হন তিনি। শিয়া- সুন্নি নির্বিশেষে এই ঘটনা শোকের সাথে স্মরণ করে থাকে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুয়াবিয়াহ খেলাফতের সিংহাসন দখল করে নেন এবং দামাস্কাস ভিত্তিক অধিকতর ইহজাগতিক উমাঈয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। আলির বড় ছেলে হাসান, শিয়ারা যাঁকে দ্বিতীয় ইমাম বলে থাকে, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ৬৬৯ সালে মদিনায় পরলোকগমন করেন। কিন্তু ৬৮০ সালে খলিফা মুয়াবিয়াহ মারা গেলে ইরাকের কুফায় আলির দ্বিতীয় ছেলে হুসেইনের পক্ষে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উমাঈয়াদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ এড়াতে হুসেইন মক্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেন, কিন্তু নতুন উমাঈয়া খলিফা ইয়াযিদ তাঁকে হত্যা করাতে মক্কার পবিত্রতা লঙ্ঘন করে পবিত্র নগরে দূত পাঠায়। তৃতীয় শিয়া ইমাম হুসেইন এই অন্যায় ও অপবিত্র শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দায়িত্ব মনে করেন। স্ত্রী ও সন্তানসহ পঞ্চাশ জনের একটা দল নিয়ে কুফার পথে রওয়ানা হন তিনি, ভেবেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারীদের এই করুণ মিছিলের দৃশ্য উম্মাহকে আবার ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু আরব দশম মাস মুহররমের আশুরার পবিত্র উপবাসের দিনে উমাঈয়া বাহিনী কুফার বাইরে কারবালার প্রান্তরে হুসেইনের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে। সবার শেষে নিহত হন হুসেইন, তখন তাঁর কোলে ছিল তাঁর শিশু পুত্র।২৬
কারবালা ট্র্যাজিডি নিজস্ব কাল্ট গড়ে তুলবে এবং প্রত্যেক শিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের এক সময়হীন ঘটনা, মিথে পরিণত হবে। ইয়াযিদ পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার ও অন্যায়ের মূর্ত প্রতীকে। দশম শতাব্দী নাগাদ সাধারণভাবে শিয়ারা আশুরার উপবাসের দিন হুসেইনের শাহাদাৎ বরণের বার্ষিকী পালন করে থাকে, তারা কাঁদে, নিজেদের শরীরে আঘাত করে মুসলিম রাজনৈতিক জীবনের দূষণের চিরন্তন বিরোধিতা ঘোষণা করে। কবিগণ শহীদ আলি ও হুসেইনের সম্মানে মহাকাব্যিক শোকগীতি আবৃত্তি করে থাকেন। এভাবে শিয়ারা কারবালার মিথোসের উপর ভিত্তি করে প্রতিবাদের ধার্মিকতা গড়ে তুলেছে। এই কাল্ট শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির মূল বিষয় সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগঘন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রেখেছে। আশুরা আচারের সময় শিয়ারা যখন ভাবগম্ভীর মিছিলে হেঁটে যায়, তখন তারা হুসেইনকে অনুসরণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এমনকি মৃত্যু বরণ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা দেয়। ২৭
এই মিথ ও কাল্ট গড়ে উঠতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। কারবালার পরের প্রথম কয়েক বছর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া হুসেইনের ছেলে আলি এবং তাঁর ছেলে মুহাম্মদ (যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম ইমাম নামে পরিচিত) মদিনায় চলে যান, তাঁরা কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রথম ইমাম আলি উমাঈয়া শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠা অনেকের কাছেই ন্যায়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। আব্বাসিয় উপদল যখন শেষ পর্যন্ত ৭৫০ সালে উমাঈয়া খেলাফত উৎখাত করে তাদের নিজেদের রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে (৭৫০-১২৬০), প্রথমে নিজেদের তারা শিয়া-ই আলি (আলির দল) বলে দাবি করেছিল। শিয়ারা আবার কিছু অদ্ভূত আঁচঅনুমানের সাথেও সম্পর্কিত ছিল, বেশির ভাগ মুসলিমই যাকে ‘চরম’ (গুলুউ) মনে করে। ইরাকে মুসলিমরা এক প্রাচীন ও আরও জটিল ধর্মীয় জগতের সংস্পর্শে এসেছিল এবং কেউ কেউ ক্রিশ্চান, ইহুদি বা যোরোস্ত্রিয় মিথলজিতে আকৃষ্ট হয়। কোনও কোনও শিয়া বলয়ে আলিকে জেসাসের মতো ঈশ্বরের অবতার হিসাবে দেখা হত; শিয়া বিদ্রোহীরা মনে করত তাদের নেতারা মারা যাননি বরং আত্মগোপনে (বা ‘অকাল্টেশন’) আছেন; একদিন তাঁরা ফিরে আসবেন, অনুসারীদের বিজয়ের পথে নিয়ে যাবেন। অন্যরা স্বর্গীয় আত্মার মানুষের সত্তায় অবতরণ ও তাকে স্বর্গীয় জ্ঞান দেওয়ার ধারণায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।২৮ এইসব মিথ এক পরিবর্তিত রূপে শিয়া নিগূঢ় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
হুসেইনের সম্মানে সৃষ্ট কাল্ট এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজিডিকে শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা মিথে পরিণত করেছে। এটা মানুষের খোদ অস্তিত্বে অব্যাহত কিন্তু অদৃশ্য শুভ ও অশুভের ভেতরকার সংগ্রামের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে; আচার অনুষ্ঠান হুসেইনকে তাঁর সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে তাঁকে এক জীবিত সত্তায় পরিণত করে; তিনি পরিণত হন গভীর সত্যের প্রতীকে। কিন্তু শিয়াবাদের পুরাণকে বাস্তব বিশ্বে বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। এমনকি আব্বাসিয় শাসকদের মতো শিয়ারা ক্ষমতা দখল করতে পারলেও রাজনৈতিক জীবনের কর্কশ বাস্তবতা বোঝায় যে তারা ওইসব উচ্চমার্গীয় আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে পারছিলেন না। আব্বাসিয় খলিফাগণ ইহজাগতিক দিক থেকে অত্যন্ত সফল ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর অল্প সময়ের ভেতরই শিয়া রেডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দিয়ে সাধারণ সুন্নিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁদের শাসন উমাঈয়াদের তুলনায় খুব বেশি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়নি; কিন্তু প্রকৃত শিয়াদের পক্ষে বিদ্রোহ করা ছিল অর্থহীন, কারণ প্রয়োজনের খাতিরেই যেকোনও বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হত। প্রকৃতপক্ষেই হুসেইনের মিথ যেন বোঝাতে চেয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের বিরোধিতা করার যেকোনও প্রয়াসই ব্যর্থ হতে বাধ্য, সেটা ন্যায়বিচারের পক্ষে যত ধার্মিক ও উৎসাহী হোক না কেন।
ষষ্ঠ শিয়া ইমাম জাফর আস-সাদিক (মৃ. ৭৬৫) এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী হিসাবে তিনিই উম্মাহর একমাত্র বৈধ নেতা (ইমাম) হলেও কোনও অর্থহীন বিরোধে জড়ানো সত্যিকারের কাজ নয়, বরং ঐশীগ্রন্থের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় শিয়াদের পথ নির্দেশ করাই তাঁর দায়িত্ব। আলির বংশের প্রত্যেক ইমাম, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর প্রজন্মের আধ্যাত্মিক নেতা। ইমামদের প্রত্যেকে তাঁর পূবসুরী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি তাঁকে স্বর্গীয় সত্যের গোপন জ্ঞান (‘ইলম) দিয়ে গেছেন। সুতরাং একজন ইমাম ভ্রান্তির অতীত আধ্যাত্মিক নির্দেশক ও নিখুঁত বিচারক। এভাবে শিয়ারা রাজনীতি ছেড়ে কোরানের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকানো গোপন (বাতিন) প্রজ্ঞা অনুভব করতে ধ্যানের কৌশল চর্চা করার মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদে সন্তুষ্ট ছিল না, নতুন দর্শনের ভিত্তি হিসাবে টেক্সটকে কাজে লাগাত তারা। তাদের ঐশী অনুপ্রাণিত ইমামের প্রতীকীবাদ পবিত্র সত্তার শিয়া অনুভূতি তুলে ধরে যা একজন অতীন্দ্রিয়বাদী এই উত্তাল বিপজ্জনক বিশ্বে সর্বব্যাপী ও সুগম হিসাবে আবিষ্কার করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপযোগী মতবাদ ছিল না এটা, একে তারা আনাড়ীভাবে ব্যাখ্যা করে বসতে পারত; তো শিয়াদের অবশ্যই তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিজের কাছে রাখতে হবে। জাফর আস-সাদিক কর্তৃক বিকশিত ইমামতির মিথলজি ছিল একটি কল্পনানির্ভর দর্শন যা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ও বাস্তব ভিত্তিক অর্থের অতীতে অনুসন্ধান ও ইতিহাসকে অদৃশ্যের (আল-গায়েব ) অটল, আদিম বাস্তবতা হিসাবে দেখে। দীক্ষা হীন যেখানে কেবল একজন মানুষকে দেখেছে, ধ্যানী শিয়া জাফর আস-সাদিকের মাঝে স্বর্গীয় আভাস দেখতে পেয়েছে।২৯
ইমামত দৈনন্দিন জীবনের সখুঁত ও ট্র্যাজিক পরিস্থিতিতে আল্লাহ’র ইচ্ছা বাস্তাবায়নের চরম অসুবিধাও প্রতীকায়িত করেছে। জাফর আস-সাদিক কার্যকরভাবে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, ধর্মবিশ্বাসকে ব্যক্তি পর্যায়ে এনে একে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বলয়ে সীমিত করেছেন। এটা তিনি করেছেন ধর্মকে বাঁচাতে ও এমন বিশ্বে একে বেঁচে থাকতে সক্ষম করে তুলতে যাকে আবিশ্যিকভাবেই এর প্রতি বৈরী মনে হয়। এক গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকেই এই সেক্যুলারাইজেশন নীতির উদ্ভব ঘটেছিল। শিয়ারা জানত ধর্মের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এক শতাব্দী পরে এটা করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৮৩৬ সালে আব্বাসিয় খলিফাগণ বাগদাদের আনুমানিক ষাট মাইল দক্ষিণে সামারায় রাজধানী সরিয়ে নেন। ততদিনে আব্বাসিয়দের শক্তি ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল, খলিফা গোটা মুসলিম বিশ্বের নামমাত্র শাসক থাকলেও সাম্রাজ্য জুড়ে মূল কর্তৃত্ব ছিল স্থানীয় আমির ও সর্দারদের হাতে। খলিফাগণ মনে করলেন এমন একটা অস্থির সময়ে তাঁদের পক্ষে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী ইমামদের এভাবে মুক্ত থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। ৮৪৮ সালে খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল দশম ইমাম আলি আল-হাদিকে মদিনা থেকে সামারায় তলব করেন। এখানে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। তিনি ও তাঁর ছেলে একাদশ ইমাম হাসান আল- আশারি শিয়াদের সাথে কেবল প্রতিনিধি (ওয়াকিল)-র মারফত যোগাযোগ রাখতে পারছিলেন। বাগদাদের বাণিজ্য এলাকা আল-কার্খ-এ থেকে আব্বাসিয় কর্তৃপক্ষের মনোযোগ এড়াতে ব্যবসা করত তারা।
৮৭৪ সালে একাদশ ইমাম পরলোকগমন করেন, সম্ভবত খলিফার ইঙ্গিতে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তাঁকে। তাঁকে এমন ভীষণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে শিয়ারা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। তাঁর কি কোনও ছেলে ছিল? যদি না থাকে তো কে তাঁর উত্তরাধিকারী হবে? তাঁর বংশধারা কি শেষ হয়ে গেছে? যদি তাই হয়, তার মানে কি তবে শিয়ারা অতিন্দ্রীয় নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে? প্রবল হয়ে উঠেছিল আঁচঅনুমান, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ জোরের সাথে জানাল যে, হাসান আল-আশারির সত্যিই একজন ছেলে ছিল, আবু আল কাসিম মুহাম্মদ, দ্বাদশ ইমাম; জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন তিনি। আকর্ষণীয় সমাধান ছিল এটা, কারণ এখানে বোঝানো হয়েছে যে কিছুই বদলায়নি। শেষ দুজন ইমাম কার্যত অগম্য ছিলেন। এখন গোপন ইমাম তাঁর ওয়াকিল উসমান আল-আমরির মারফত জনগণের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারবেন। এই ওয়াকিল আধ্যাত্মিক পরামর্শ দিতে পারবেন, যাকাতের দান সংগ্রহ করবেন, ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যা করবেন ও আইনি সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু এই সমাধানের আয়ু ছিল সীমিত। দ্বাদশ ইমামের জীবিত থাকার সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ামাত্র শিয়ারা আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করল। তারপর ৯৩৪ সালে বর্তমান প্রতিনিধি আলি ইবন মুহাম্মদ আস-সামাররি গোপন ইমামের কাছ থেকে শিয়াদের জন্যে এক বার্তা নিয়ে এলেন। তিনি পরলোকগমন করেননি। বরং আল্লাহ অলৌকিকভাবে তাঁকে আড়াল করেছেন; শেষ বিচারের আগে আগে ন্যায়বিচারের যুগের সুচনা ঘটাতে আবার ফিরে আসবেন তিনি। এখনও তিনি শিয়াদের ভুলের অতীত নির্দেশক ও উম্মাহর একমাত্র বৈধ শাসক রয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাসীদের সাথে তিনি আর প্রতিনিধি মারফত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবেন না। শিয়াদের তাঁর দ্রুত প্রত্যাবর্তন আশা করা ঠিক হবে না। তারা তাঁকে কেবল ‘দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাবার পর ও পৃথিবী স্বৈরাচারে পরিপূর্ণ হলেই আবার দেখতে পাবে।’৩১
গোপন ইমামের ‘অকাল্টেশনে’র মিথ যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেবল অতীন্দ্রিয়বাদ ও আচরিক অনুশীলনের প্রেক্ষাপটেই এটা অর্থ প্রকাশ করে। আমরা যদি গল্পটি লোগোস হিসাবে বুঝে থাকি, বাস্তব ঘটনার মামুলি বিবরণ হিসাবে যদি আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সবরকম প্রশ্ন উঠে আসে। ইমাম গেছেন কোথায়? তিনি পৃথিবীতেই আছেন নাকি কোনও ধরনের মধ্যবর্তী বলয়ে? সেখানে তাঁর জীবন কেমন হতে পারে? তিনি কি ক্রমেই বুড়িয়ে যাচ্ছেন? বিশ্বাসীরা তাঁকে দেখতে বা তাঁর কথা শুনতে না পেলে কেমন করে তিনি তাদের পথ দেখাবেন? যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মনের অধিকতর স্বজ্ঞামূলক শক্তির উপর নির্ভরশীল বাতিন বা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থের সুশৃঙ্খল অনুশীলনে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও শিয়ার কাছে এইসব প্রশ্ন ভোঁতা মনে হবে। শিয়ারা তাদের ঐশীগ্রন্থ ও মতবাদ আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করেনি। তাদের সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা অদৃশ্যের (আল-গায়েব) প্রতীকী অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল যা বাইরের যাহির) ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে থাকে। শিয়ারা এক অদৃশ্য, দুর্বোধ্য আল্লাহর উপাসনা করে থাকে, কোরানের গুপ্ত অর্থের সন্ধান করে, এক গোপন ইমামের আকাঙ্ক্ষায় ছিল তারা, ন্যায় বিচারের জন্যে অন্তহীন কিন্তু অদৃশ্য লড়াইতে অংশ নিয়েছে এবং ইসলামের এক নিগূঢ় ভাষ্য চর্চ্চা করেছে যাকে পার্থিব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে।২ এই ব্যাপক ধ্যানমুখী জীবনই ছিল অকাল্টেশনের মানে তুলে ধরা পটভূমি। গোপন ইমাম মিথে পরিণত হয়েছিলেন, স্বাভাবিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে সময় ও কালের সীমা থেকে মুক্ত করা হয়েছে; প্যারাডক্সিকালি তিনি ও অন্যান্য ইমাম মদিনা বা সামারায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সময় যতখানি ছিলেন তারচেয়ে ঢের বেশি উজ্জ্বল সত্তায় পরিণত হয়েছিলেন। অকাল্টেশন এমন এক মিথ যা আমাদের পবিত্রের বোধকে অধরা ও হতবুদ্ধিকরভাবে অনুপস্থিত রূপে তুলে ধরে। জগতে উপস্থিত থাকলেও এটা এর অংশ নয়; স্বর্গীয় প্রজ্ঞা মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য (কারণ মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কেবল ঈশ্বরসহ কোনও কিছু সম্পর্কে ধারণা করতে পারি), কিন্তু আমাদের তা সাধারণ নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে নিয়ে যায়। অন্য যেকোনও মিথের মতো অগোছাল যুক্তি দিয়ে অকাল্টেশন বোঝা যাবে না, যেন বা তা স্বয়ংপ্রকাশিত সত্যি বা যৌক্তিক প্রদর্শনীর উপযুক্ত। বরং তা মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় একটি মিথকে তুলে ধরে।
যেকোনও নিগূঢ় আধ্যাত্মিকতার মতো শিয়া মতবাদ এই পর্যায় পর্যন্ত কেবল অভিজাত গোষ্ঠীর ব্যাপার ছিল। অতীন্দ্রিয় ধ্যনের মেধা ও চাহিদা সম্পন্ন অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুঃসাহসী মুসলিমরাই এতে আকৃষ্ট হচ্ছিল বেশি। কিন্তু শিয়াদের অন্য মুসলিমদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সুন্নি ইসলামের আচার ও অনুশীলন যেখানে সুন্নি মুসলিমদের জীবন যেমন সেভাবেই মেনে নিয়ে আদর্শ জগতের রীতিনীতি মোতাবেক চলতে সাহায্য করেছে সেখানে শিয়া অতীন্দ্রিয়বাদ স্বর্গীয় অসন্তোষ তুলে ধরেছে। অকাল্টেশনের মতবাদ প্রচারিত হওয়ার অল্প পরেই বিকাশ লাভ করা প্রথম দিকের ট্র্যাডিশনসমূহ দশম শতাব্দীতে বহু শিয়ার অনুভূত হতাশা ও অক্ষমতা তুলে ধরেছে। একে বলা হত “শিয়া শতাব্দী’, কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের বহু অধিনায়ক যারা কোনও এক বিশেষ এলাকায় কার্যকর ক্ষমতা ভোগ করতেন তাদের প্রায় সবারই শিয়া মতবাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু সেকারণে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। কোরানের পরিষ্কার শিক্ষা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে জীবন তখনও ছিল অন্যায় ও সমতাহীন। প্রকৃতপক্ষেই, সকল ইমামই শিয়াদের চোখে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ট্র্যাডিশন আছে যে, উমাঈয়া ও আব্বাসিয় খলিফারা হুসেইনের পরের প্রত্যেক ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন। আরও ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও উদার সামাজিক ব্যবস্থার পক্ষে তাদের আকাঙ্ক্ষা থেকে শিয়ারা শেষ যুগে গোপন ইমামের চূড়ান্ত আবির্ভাব (যুহুর)-এর উপর ভিত্তি করে পরকালতত্ত্বের বিকাশ ঘটায়, যখন তিনি ফিরে এসে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন ও চূড়ান্ত বিচারের আগে ন্যায়বিচার ও শান্তির এক সোনালি যুগের প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু সমাপ্তির জন্যে এই আকাঙ্ক্ষার মানে শিয়ারা রক্ষণশীল রীতি ত্যাগ করে ভবিষ্যৎমুখী হয়ে গেছে, এমন ছিল না। তারা আদি আদর্শ জগতের প্রতি এত প্রবলভাবে সজাগ ছিল, পরিস্থিতির যেমনটা হওয়া উচিত ছিল, তাদের চোখে সাধারণ রাজনৈতিক জীবন অসহনীয় ঠেকেছে। গোপন ইমাম এই বিশ্বে নতুন কিছু নিয়ে আসবেন না, তিনি স্রেফ মানুষের ইতিহাসকে পরিশুদ্ধ করবেন যাতে মানুষের কর্মকাণ্ড অস্তিত্বের মৌলিক নীতিমালার অনুগামী হয়। একইভাবে ইমামদের ‘আবির্ভাব’ গভীরতর অর্থে সব সময় অস্তিত্ব ছিল এমন কিছুকে প্রকাশ করবে মাত্র, কারণ গোপন ইমাম শিয়ার জীবনে এক ধ্রুব অস্তিত্ব, তিনি আল্লাহর অধরা আলোকে এক অন্ধকার স্বৈরাচারী পৃথিবীতে তুলে ধরেন এবং তিনিই আশার একমাত্র উৎস।
ষষ্ঠ ইমাম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিসর্জন দিয়ে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সূচিত অকাল্টেশন শিয়া ইতিহাসের পুরাণে রূপান্তরের কাজটি শেষ করেছিল। মিথ বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে কোনও নীল নকশার যোগান দেয় না, বরং বিশ্বাসীকে তার সমাজের দিকে চোখ ফেরাতে ও অন্তস্থঃ জীবনকে বিকাশ করতে শেখায়। অকাল্টেশনের মিথ শিয়াদের চিরকালের মতো বিরাজনীতি করে দিয়েছিল। জাগতিক শাসকদের শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অর্থহীন ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই শিয়াদের। যাকে আত্মগোপনে যেতে হয়, চলমান বিশ্বে বাস করতে অক্ষম ন্যায়বিচারক একজন ইমামের ইমেজ শিয়াদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাই তুলে ধরে। যুগের প্রকৃত প্রভু গোপন ইমামের কর্তৃত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে বলে এই নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনও সরকারকেই অবৈধ বিবেচনা করতে হয়েছে। সুতরাং, পার্থিব শাসকদের কাছ থেকে কিছুই আশা করার ছিল না, যদিও বেঁচে থাকার স্বার্থে শিয়াদের অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করবে তারা, কেবল ‘দীর্ঘ সময় শেষে’ শেষ যুগেই পৃথিবীতে আসন্ন এক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা করবে। তারা কেবল ইমামদের সাবেক ‘প্রতিনিধি’দের স্থান গ্রহণকারী শিয়া উলেমাদের একক কর্তৃত্বই মেনে নেবে। শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা ও স্বর্গীয় আইনে দক্ষতার কারণে উলেমাগণ গোপন ইমামের সহকারীতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাঁর নামে বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু সকল সরকারই অবৈধ থাকায় উলেমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।৩৪
এভাবে শিয়ারা নীরবে রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলারাজেইশন সমর্থন দিয়েছিল যাকে তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি নীতির লঙ্ঘন মনে হতে পারে, যেখানে রাষ্ট্র ও ধর্মের এজাতীয় বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এক ধর্মীয় দর্শন থেকে এই বিচ্ছিন্নতার মিথলজির উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সকলেই গুপ্তহত্যার শিকার, কারাবন্দি, দেশান্তরী এবং সবশেষে খলিফাদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন এমন ইমামদের কিংবদন্তী রাজনীতি ও ধর্মের মৌল সমন্বয়হীনতা তুলে ধরে। রাজনৈতিক জীবন লোগোসের এখতিয়ার, একে অবশ্যই ভবিষ্যৎমুখী, বাস্তবভিত্তিক হতে হবে, একে আপোস করতে জানতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, যৌক্তিক ভিত্তিতে সমাজকে সংগঠিত করতে হবে। একে ধর্মের চরম চাহিদা ও জমিনে জীবনের গম্ভীর বাস্তবতার ভেতর ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। প্রাক আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ একটি মৌলিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল, এটা কৃষকদের শ্রমের উপর নির্ভর করত যারা সভ্যতার ফল ভোগ করতে পারত না। অ্যাক্সিয়াল যুগের (c. ৭০০-২০০ বিসিই) মহান কনফেশনাল ধর্মগুলোর সবকটাই এই টানাপোড়েনে ব্যস্ত ছিল, একে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। সম্পদের পরিমাণ যেখানে অপ্রতুল আর যেখানে প্রযুক্তি ও যোগাযোগের অভাব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কঠিন করে তোলে, সেখানে রাজনীতি অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও আগ্রাসীভাবে বাস্তবভিত্তিক হয়ে ওঠে। সুতরাং, যেকোনও সরকারের পক্ষে ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা বা এর ঘাটতিসমূহ দুঃখজনকভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া স্বর্গীয় প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক ইমামদের অস্তিত্ব সহ্য করা ছিল অসম্ভব। ধর্মীয় নেতারা যাচ্ছেতাই অপচয়ের বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনা বা প্রতিবাদ জানাতে পারতেন, কিন্তু এক ধরনের করুণ অর্থে পবিত্রকে হয় প্রান্তিকায়িত বা সীমার ভেতর রাখতে হয়েছে, যেমন করে খলিফাগণ সামারার আসকারী দুর্গে ইমামদের আটক করে রেখেছিলেন। কিন্তু এক আদর্শের প্রতি শিয়া ভক্তিতে মাহাত্ম্য ছিল যাকে অবশ্যই টিকিয়ে রাখার দরকার ছিল, যদিও গোপন ইমামের মতো সেটা ছিল সুপ্ত এবং বর্তমানে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিশ্বে কাজ করতে অক্ষম।
শিয়া মতবাদ পৌরাণিক ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হলেও তার মানে তা অযৌক্তিক ছিল না। আসলে শিয়াবাদ সুন্নাহর চেয়ে ইসলামের অধিকতর যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিয়ারা আবিষ্কার করেছিল যে, তারা মুতাযিলি নামে পরিচিত সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিকদের সাথে সহমত পোষণ করে। কোরানের বিভিন্ন মতবাদকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এরা। অন্যদিকে মুতাযিলিরাও শিয়া মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। প্যারাডক্সিকালি অকাল্টেশনের অযৌক্তিক মতবাদ শিয়া উলেমাদের সুন্নি উলেমাদের চেয়ে কর্মকাণ্ডের বাস্তব জগতে তাদের অনেক বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের স্বাধীনতা দিয়েছিল। গোপন ইমাম আর নাগালের মধ্যে না থাকায় বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হত তাদের। সুতরাং, শিয়া মতবাদে সুন্নাহর মতো ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ কোনওদিনই রুদ্ধ হয়নি।৩৫ এটা ঠিক, শিয়ারা প্রথমে ইমাম অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ একজন বিশিষ্ট ও জ্ঞানী শিয়া যাজক ঠিক মুজতাহিদ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, ইজতিহাদের যৌক্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতাশালী বলে মনে করা হত তাঁকে।
অবশ্য শিয়া যুক্তিবাদ আমাদের বর্তমান পাশ্চাত্যের সেক্যুলারাইজড যুক্তিবাদ হতে ভিন্ন ছিল। শিয়ারা প্রায়শঃই সমালোচনামুলক চিন্তাবিদ ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, একাদশ শতাব্দীর পণ্ডিত মুহাম্মদ আল-মুইদ ও মুহাম্মদ আল-তুসি পয়গম্বর ও তাঁর কয়েকজন সহচরের হাদিস প্রতিবেদনের সঠিকতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁদের মতবাদের সমর্থনে এইসব অবিশ্বস্ত ট্র্যাডিশন উদ্ধৃত করা যথেষ্ট হবে না, বরং তার বদলে যাজকদের উচিত হবে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা; কিন্তু তারপরেও তাঁদের তুলে ধরা যৌক্তিক বক্তব্য আধুনিক সংশয়বাদীকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ, তুসি ইমামতের মতবাদ ‘প্রমাণ’ করতে গিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যেহেতু আল্লাহ শুভ ও তিনি আমাদের মুক্তি চান, তো এটা বিশ্বাস করাই যুক্তিসঙ্গত যে তিনিই আমাদের অনির্বচনীয় পথ-নির্দেশ যোগাবেন। নারী-পুরুষ সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু স্বর্গীয় বিধি এই বিষয়টিকে আরও জরুরি করে তোলে। এমনকি তুসিও অকাল্টেশনের পক্ষে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে দিশাহারা বোধ করেছেন।৩৬ কিন্তু শিয়াদের কাছে এটা অস্বস্তিকর ছিল না। মিথোস ও লোগোস, যুক্তি ও প্রত্যাদেশ, পরস্পর বিরোধী ছিল না, বরং স্রেফ একটি অপরটি থেকে ভিন্ন এবং সম্পূরক। আধুনিক পশ্চিমে আমরা যেখানে সত্যির উৎস হিসাবে মিথোলজি ও অতীন্দ্রিয়বাদকে নাকচ করে কেবল যুক্তির উপর নির্ভর করে থাকি; তুসির মতো একজন চিন্তাবিদ চিন্তার উভয় পথকেই বৈধ ও প্রয়োজনীয় হিসাবে দেখেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, অতীন্দ্রিয় ধ্যানে মগ্ন থাকার সময় নিখুঁত অর্থ প্রকাশকারী মতবাদসমূহ ইসলামি প্রেক্ষিতেও যুক্তিসঙ্গত। ধ্যানের অন্তর্মুখী কৌশলসমূহ এমন অন্তর্দৃষ্টির যোগান দেয় যেগুলো তাদের নিজস্ব বলয়ে সঠিক, কিন্তু সেগুলোকে লোগোসের সৃষ্টি কোনও গাণিতিক সমীকরণের মতো যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রমাণ করা যাবে না।
পঞ্চদশ শতকের শেষ নাগাদ, আমরা যেমন দেখেছি, বেশিরভাগ শিয়াই আরব ছিল এবং শিয়াবাদ বিশেষত ইরাকে দুটি উপাসনালয়ের শহর যথাক্রমে ইমাম আলি ও ইমাম হুসেইনের প্রতি নিবেদিত নাজাফ ও কারবালায় শক্তিশালী ছিল। বেশিরভাগ ইরানিই ছিল সুন্নি, যদিও ইরানি শহর কুম সব সময়ই শিয়াদের কেন্দ্র ছিল। রাঈ, কাশা ও খোরাশানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়ার বাস ছিল। তো সুফিবাদের সাফাভিয় ধরনের নেতা উনিশ বছর বয়স্ক শাহ ইসমাইলকে স্বাগত জানানোর মতো ইরানি ছিল। ১৫০১ সালে তাব্রিয দখল করেন তিনি ও পরের এক দশকের মধ্যেই ইরানের বাকি অংশ অধিকার করে নেন। তিনি ঘোষণা করেন, শিয়া মতবাদই নতুন সাফাভিয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র ধর্ম হবে। নিজেকে সপ্তম ইমামের বংশধর দাবি করেছিলেন ইসমাইল, যা তাঁকে অন্য মুসলিম শাসকদের যা ছিল না সেই বৈধতা দিয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ৩৭
কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই শিয়া ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি ছিল। ‘দ্বাদশবাদী’ (দ্বাদশ ইমামের প্রতি তাদের শ্রদ্ধার কারণে) অধিকাংশ শিয়া বিশ্বাস করত যে, গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকারই বৈধ হতে পারে না।৩৮ তাহলে কেমন করে ‘রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদ’ থাকতে পারে? এতে অবশ্য ইসমাইলের কোনও সমস্যা হয়নি। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিল না তাঁর। মঙ্গোল আগ্রাসনের অব্যবহতি পরে প্রতিষ্ঠিত অতীন্দ্রিয় ভ্রাতৃসংঘ সাফাভিয় গোষ্ঠী মূলত সুফি সংস্থা ছিল কিন্তু প্রাচীন শিয়া মতবাদের বহু ‘চরম’ (গুলুউ) ধারণা গ্রহণ করেছিল। ইসমাইল বিশ্বাস করতেন যে, ইমাম আলি স্বর্গীয় ছিলেন, এবং স্বর্ণযুগের উদ্বোধন ঘটাতে অচিরেই ফিরে আসবেন শিয়া মেসায়াহ। তিনি হয়তো শিষ্যদের এও বলে থাকতে পারেন যে, তিনিই সেই গোপন ইমাম, অড়াল ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন। সাফাভিয় ব্যবস্থা ছিল প্রান্তিক, জনপ্রিয়তামুখী বিপ্লবী দল, শিয়া বিশেষ নিগূঢ় ধারা থেকে অনেক ভিন্ন।৩৯ শিয়া রষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসমাইলের কোনও রকম দ্বিধা ছিল না, জাফর আস-সাদিকের আমল থেকেই শিয়ারা যেমন করে আসছিল, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে একটা সভ্য মোদাস ভিভেন্দি’র খোঁজ করার বদলে ধর্মান্ধভাবে সুন্নি বিরোধী ছিলেন তিনি। অটোমান ও সাফাভিয় সাম্রাজ্যে এক নতুন উপদলীয় অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছিল; একই সময়ে ইউরোপে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের ভেতর দেখা দেওয়া বিবাদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না সেটা। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমানরা তাদের এলাকায় শিয়াদের প্রান্তিকায়িত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। ইসমাইল যখন ইরানে আবির্ভূত হন, তিনিও সমানভাবে সেখানকার সুন্নাহকে নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
অবশ্য সাফাভিয়দের এটা আবিষ্কার করতে বেশি সময় লাগেনি যে, বিরোধী অবস্থানে থাকার সময় মেসিয়ানিক ‘চরমপন্থী’ আদর্শ কাজে এলেও এখন ক্ষমতায় আসার পর সেটা জুৎসই ঠেকছে না। প্রাচীন গুলুউ ধর্মতত্ত্ব মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শাহ প্রথম আব্বাস (১৫৮৮-১৬২০) আমলাতন্ত্র থেকে চরমপন্থীদের বরখাস্ত করেন। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি প্রচারের জন্যে আরব থেকে শিয়া উলেমাদের আমদানি করেন তিনি। নতুন রাজধানী ইস্পাহান ও হিল্লায় তাঁদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, তাঁদের পক্ষে সম্পত্তি অর্পণ করেন (ওয়াকফ) ও উদার হাতে তাঁদের উপহার দেন। গোড়ার দিকে এই পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন ছিল, কারণ নতুন অভিবাসী হিসাবে উলেমারা শাহর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু অনিবার্যভাবে শিয়া মতবাদের প্রকৃতি পাল্টে দিয়েছিলেন। শিয়ারা সব সময়ই সংখ্যালঘু দল ছিল। তাদের নিজস্ব মাদ্রাসা ছিল না, সব সময়ই একে অন্যের বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন, বিতর্ক করেছেন। এখন শিয়ারা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছিল। ইস্পাহান শিয়া মতবাদের সরকারী বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়।৪১ শিয়ারা সব সময়ই এর আগে সরকার থেকে দূরে অবস্থান করেছে, কিন্তু এখন উলেমাগণ ইরানের শিক্ষা ও আইনি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং আরও নির্দিষ্টভাবে সরকারের ধর্মীয় দায়িত্বও হাতে তুলে নিয়েছিলেন। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ছিল ইরানিদের সমন্বয়ে গঠিত, তখনও সুন্নাহর প্রতি অনুগত ছিল তারা, সুতরাং, তাদের আরও বেশি সেক্যুলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইরানি সরকারে সেক্যুলার ও ধর্মীয় বলয়ে একটা চলমান বিভাজন দেখা দিয়েছিল।৪২
উলেমগণ অবশ্য সাফাভিয় রাষ্ট্র সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তখনও তাঁরা সরকারী পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, নিজেদের প্রজা হিসাবে দেখতেই পছন্দ করতেন। সুতরাং, তাদের অবস্থান ছিল অটোমান উলেমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু সহজাতভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। শাহদের উদারতা ও পৃষ্ঠপোষকতা উলেমাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে দিয়েছিল। অটোমান ও তাদের উত্তরাধিকারীরা যেখানে সব সময়ই ভর্তুকী প্রত্যাহার বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে উলেমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, সেখানে শিয়া উলেমাদের এভাবে ভয় দেখানোর উপায় ছিল না। ইরানি জনগণের মাঝে শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তাঁরা এই বাস্তবতা থেকে লাভবান হচ্ছিলেন যে শাহগণ নন, বরং তাঁরাই গোপন ইমামের একমাত্র প্রকৃত মুখপাত্র। অবশ্য গোড়ার দিকের সাফাভিয়রা উলেমাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরানের জনগণ পুরোপুরি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার আগে যাজকগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিজেদের মতো হয়ে উঠতে পারেনি।
কিন্তু ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে। উলেমাগণ সাফাভিয় সাম্রাজ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ ও এমনকি গোঁড়া হয়ে উঠতে লাগলেন। শিয়া মতবাদের কিছু অধিকতর আকর্ষণীয় গুণাবলী চাপা পড়ে যায়। এই নতুন কঠোর পন্থা মূর্ত করে তোলেন সর্বকালের অন্যতম ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী উলেমা মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃ. ১৭০০)। শত শত বছর ধরে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের এক ধরনের উদ্ভাবনী প্রকৃতির কৌশল অনুসরণ করে এসেছে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় ও দার্শনিক আঁচঅনুমানের প্রবল বিরোধী ছিলেন মজলিসি। দুটোই ছিল প্রাচীন নিগূঢ়বাদী শিয়া মতবাদের মূলধারা। তিনি ইরানে অবশিষ্ট সুফিদের উপর নিরলসভাবে নির্যাতনের সূচনা করেন ও ফালসাফাহ নামে পরিচিত দার্শনিক যুক্তিবাদ ও ইস্ফাহানে অতীন্দ্রিয় দর্শন দমন করার প্রয়াস পান। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের প্রতি এক গভীর অবিশ্বাসের সূচনা করেছিলেন তিনি এখনও যা বর্তমান ইরানে টিকে আছে। কোরানের নিগূঢ় পাঠে মগ্ন হওয়ার বদলে শিয়া পণ্ডিতদের ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্স ফিকহর প্রতি মনোনিবেশে উৎসাহিত করা হয়েছে।
হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত আচরিক মিছিলের অর্থও পাল্টে দিয়েছিলেন মজলিসি।” আরও বিস্তৃত হয়ে উঠেছিল এসব: এখন সবুজ কাপড়ে ঢাকা উটের পিঠে ইমামের পরিবারের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রন্দনরত নারী ও শিশুরা বসে থাকে, সৈনিকরা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গভর্নর, গণ্যমান্য লোকজন ও মানুষের জটলা ইমাম ও তাঁর শাহাদৎ বরণকারী সহচরদের প্রতীক কফিন অনুসরণ করে, এরা ছুরি দিয়ে নিজেদের আঘাত হেনে আহত করে।৫ কারবালা কাহিনীর দারুণ আবেগঘন বর্ণনা-রাওদা-খানি (‘রাওদাতের আবৃত্তি’) নামে পরিচিত বিশেষ অনুষ্ঠানে ইরাকি শিয়া ওয়াইজ কাশিফট (মৃ. ১৫০৪) রচিত রাওদাহ আশ-শাহাদা রাওদা-খানি জমায়েতে আবৃত্তি করা হত, জনতা জোরে চিৎকার করে বিলাপ করত, কাঁদত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে লড়াই করার জনগণের ইচ্ছা তুলে ধরায় এইসব আচারের সবসময়ই এক ধরনের বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল। এখন অবশ্য, জনগণকে হুসেইনকে একটা নজীর হিসাবে দেখার জন্যে উৎসাহিত করার পরিবর্তে মজলিসি ও তাঁর যাজকগোষ্ঠী শিক্ষা দিতে লাগলেন যেন তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিবেচনা করা হয় যিনি তাঁর মৃত্যুর জন্যে শোক প্রকাশ করার মাধ্যমে ভক্তি দেখাতে পারলে তাদের বেহেশতে গমন নিশ্চিত করতে পারবেন। এবার স্থিতাবস্থার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে আচার অনুষ্ঠানগুলো জনগণকে শক্তিমানের পক্ষে আনুকূল্য দেখিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখার শিক্ষা দিয়েছে। ৬ এটা ছিল পুরোনো শিয়া আদর্শের নপুংসকীকরণ ও অবমূল্যায়ন; এটা রক্ষণশীল রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। জনগণকে অস্তিত্বের মৌল বিধিবিধান ও ছন্দের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার বদলে কাল্টকে কেবল বিপুল জনগোষ্ঠীকে সামাল দিয়ে রাখার কাজে লাগানো হয়েছে। এটা এমন এক পরিবর্তন ছিল যা সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে দেখায় যে, বিধ্বংসী রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর্মের কী ক্ষতি করতে পারে।
মজলিসির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ইস্ফাহানে মির দামাদ (মৃ. ১৬৩১) ও শিষ্য মোল্লাহ সম্রা (মৃ. ১৬৪০) হাতে বিকশিত অতীন্দ্রিয় দর্শন। সদ্রা এমন একজন চিন্তাবিদ ছিলেন ভবিষ্যৎ ইরানি প্রজন্মের উপর যার গভীর প্রভাব সৃষ্টি হবে।৪৭ মির দামাদ ও মোল্লাহ সদ্রা উলেমাদের কারও কারও নতুন অনমনীয় মনোভাবের দারুণ বিরোধী ছিলেন। একে তাঁরা শিয়া মতবাদ, এমনকি প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মের সামগ্রিক বিকৃতি বলে বিবেচনা করেছেন। প্রাচীন কালে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থ সন্ধানের সময় নীরবে মেনে নিয়েছিল যে স্বর্গীয় সত্যি সীমানাহীন, নতুন নতুন ধারণা সব সময়ই সম্ভব; কোরানের কোনও একক ব্যাখ্যা যথেষ্ট হতে পারে না। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রার চোখে সত্যিকারের জ্ঞান কোনওদিনই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার ব্যাপার ছিল না। কোনও সাধু বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই, তিনি যত মহান বা বিশিষ্টই হোন না কেন, সত্যির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবি করতে পারেন না।
তাঁরা স্পষ্টভাবে রক্ষণশীল বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন যে মিথোলজি ও যুক্তি উভয়ই মানব জীবনের পক্ষে আবশ্যক, একটি দিয়ে সম্পূরক না হলে অপরটি হারিয়ে যায়। মির দামাদ ছিলেন স্বভাব বিজ্ঞানী এবং ধর্মতাত্ত্বিকও। মোল্লা সদ্রা উলেমাদের পৌরাণিক স্বজ্ঞার দর্শনকে খাট করার জন্যে ও যৌক্তিক চিন্তার গুরুত্বকে বিসর্জন দিতে সুফিদের সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত দার্শনিককে অ্যারিস্টটলের মতো যুক্তিবাদী হতে হবে, কিন্তু তারপরই তাঁকে নিজেকে অতিক্রম করে সত্যের এক নিগূঢ় কল্পনা নির্ভর উপলব্ধিতে পৌঁছুতে হবে। উভয় চিন্তকই অবচেতনের ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, একে তাঁরা এমন এক পর্যায় হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা ইন্দ্রিয়জ ধারণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিমূর্ততায় অস্তিত্ববান। অতীতে সুফি দার্শনিকগণ এই মনস্তাত্ত্বিক অঞ্চলকে আলম আল-মিথাল বা খাঁটি ইমেজের জগৎ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টির বলয় এটা, আমরা যাকে অবচেতন বলব সেখান থেকে আগত, স্বপ্ন ও সম্মোহনী ইমেজারিতে যা মনের চেতন স্তরে উঠে আসে, কিন্তু অতীন্দ্রিয়দের কোনও কোনও অনুশীলন ও স্বজ্ঞামূলক চর্চার মাধ্যমেও যার নাগাল পাওয়া সম্ভব। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রা দুজনই জোর দিয়ে বলেছেন যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেও এইসব দিব্য দর্শন কেবল ধারণাগত কল্পনা নয়, বরং এসবের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা রয়েছে। এগুলোকে ‘কাল্পনিক’ বলে অবাস্তব হিসাবে বাতিল করার বদলে-একজন আধুনিক যুক্তিবাদী যেমনটা করতে পারে-আমাদের উচিত হবে আমাদের অস্তিত্বের এই পার্থক্যের দিকে নজর দেওয়া। সচেতন নির্মাণের পক্ষে এর অবস্থান অনেক গভীরে, কিন্তু আমাদের আচরণ ও ধারণার উপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। আমাদের স্বপ্ন বাস্তব, এগুলো আমাদের একটা কিছু বলে; স্বপ্নে আমরা কাল্পনিক কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি। মিথোলজি ছিল অবচেতনের অভিজ্ঞতাকে ইমেজারিতে সংগঠিত করার প্রয়াস, নারী-পুরুষকে যা এইসব মৌলিক অঞ্চলকে তাদের নিজস্ব সত্তার সাথে সম্পর্কিত করতে সফল করে তুলত। বর্তমানে লোকে অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ধরনের ধারণা পেতে সাইকোঅ্যানালিস্টের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। দামাদ ও মোল্লা সদ্রা জোরের সাথে বলেছেন যে, কেবল যৌক্তিকভাবে, প্রকাশ্যে ও আইনসম্মভাবে ধারণা করা কিছুই একমাত্র সত্যি নয়। এর একটা অন্তস্থঃ মাত্রা রয়েছে যা আমাদের স্বাভাবিক চেতন মনের কর্মকাণ্ড দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
এটা অনিবার্যভাবে কোনও কোনও উলেমাকে কট্টরপন্থী শিয়াদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে দিয়েছিল। মোল্লা সদ্রাকে ইস্ফাহান থেকে বিতাড়িত করে তারা। দশ বছর কুমের কাছে এক ছোট গ্রামে বাস করতে বাধ্য হন তিনি। এই নির্জনবাসের সময় বুঝতে পারেন যে, অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি ভক্তি সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বড় বেশি বৃদ্ধিবৃত্তিক রয়ে গেছে। জুরিসপ্রুডেন্স (ফিকহ) বা বাহ্যিক ধর্মতত্ত্বের পাঠ কেবল ধর্ম সম্পর্কে আমাদের তথ্য যোগাতে পারে, এটা ধর্মীয় অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য আলোকন বা ব্যক্তিগত পরিবর্তন এনে দিতে পারে না। কেবল মনোসংযোগের অতীন্দ্রিয় অনুশীলন গুরুত্বের সাথে চর্চা শুরু ও আপন সত্তার মাঝে গভীরভাবে আলম আল-মিথালে অবতরণের পরই তাঁর হৃদয়ে ‘আগুন জ্বলে উঠেছিল’ এবং ‘স্বর্গীয় জগতের আলোক আমার সামনে জ্বলে ওঠে…আমি আগে বুঝতে পারিনি এমন সব রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়ে উঠি,’ তাঁর মহৎ সৃষ্টি আল-আসফার আল-আরবা’হ-তে (দ্য ফোর জার্নিজ অভ সোউল) পরে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
সদ্রার অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা মানুষের পক্ষে এই জগতেই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করা সম্ভব বলে নিশ্চিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু রক্ষণশীল চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত হওয়ায় তিনি যে সম্পূর্ণতার কথা কল্পনা করেছিলেন সেটা নতুন ও উচ্চতর এক পর্যায়ে উত্তরণ নয় বরং আব্রাহাম ও অন্যান্য পয়গম্বরের আদি খাঁটি দর্শনে প্রত্যাবর্তন ছিল। সকল অস্তিত্বের উৎস আল্লাহয়ও প্রত্যাবর্তন ছিল এটা। কিন্তু তাঁর মানে এই ছিল না যে অতীন্দ্রিয়বাদী এই জগৎকে ত্যাগ করেছেন। দ্য ফোর জার্নিজ অভ দ্য সোউল-এ এক ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতার অতীন্দ্রিয় অভিযাত্রার বর্ণনা করেছেন তিনি। প্রথমে তাঁকে অবশ্যই মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ’র উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। এরপর স্বর্গীয় বলয়ে ভ্রমণ করবেন তিনি যতক্ষণ না আল্লাহ’র বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে ধ্যান করে সেগুলোর অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের ব্যাপারে সহজাত চেতনায় পৌঁছেন। এভাবে আল্লাহ’র মুখাবয়বের দিকে চোখ রেখে তিনি বদলে যান ও একশ্বরবাদের আসল অর্থ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইমামদের অনুভূত বোধের অনুরূপ এক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন। তৃতীয় যাত্রায় নেতা আবার মানব জাতির কাছে ফিরে এসে আবিষ্কার করেন যে, এখন তিনি জগৎকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁর চতুর্থ ও চূড়ান্ত অন্বেষণ হচ্ছে এই জগতে আল্লাহ’র বাণী প্রচার করা, স্বৰ্গীয় আইন প্রতিষ্ঠার নতুন পথ বের করা ও আল্লাহ’র ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজকে নতুন করে নির্মাণ করা।৫° এটা এমন এক দর্শন যা সমাজের পূর্ণতাকে যুগপৎ আধ্যাত্মিক উন্নতির সাথে সম্পর্কিত করে। অতীন্দ্রিয় ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়া এই মর্ত্য জগতে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। ইহজগতে সমাজকে পরিবর্তিত করতে অত্যাবশ্যক যৌক্তিক প্রয়াস একে অর্থ প্রদানকারী পৌরাণিক ও অতীন্দ্রিয় পরিপ্রেক্ষিত হতে অবিচ্ছেদ্য আবিষ্কার করে দ্বাদশবাদী শিয়ামতবাদে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ ঘটিয়েছে মোল্লা সদ্রার দর্শন। মোল্লাহ সদ্রা এভাবে শিয়া নেতৃত্বের এক নতুন আদর্শের প্রস্তাব রেখেছিলেন আমাদের কালেও ইরানের রাজনীতিতে যার গভীর প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
মোল্লা সদ্রার দর্শনের অতীন্দ্রিয় রাজনৈতিক নেতার ঐশী অন্তর্দৃষ্টি থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে তিনি শক্তি দিয়ে নিজের মত ও ধর্মীয় অনুশীলন অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন। তেমন কিছু করলে সদ্রার দৃষ্টিতে তিনি ধর্মের সত্যির মুল সত্তাকে অস্বীকার করেছেন। উলেমাদের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছেন সদ্রা। সপ্তম শতাব্দীতে ইরানে ক্রমশ শেকড় ছড়াতে থাকা এক নতুন ধারণার কারণে বিশেষভাবে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তিনি। কিছু কিছু উলেমা এই সময় বিশ্বাস করেছিলেন যে, উলেমারাই গোপন ইমামদের একমাত্র আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র হওয়ায় বেশির ভাগ মুসলিমই নিজে থেকে বিশ্বাসের মৌল বিষয়সমূহ (উসুল) ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, সাধারণ জনগণকে তাই এমন একজন মুজতাহিদ নির্বাচন করতে হবে যিনি ইজতিহাদের (‘স্বাধীন যুক্তিপ্রয়োগ’) চর্চা করার ক্ষমতা রাখেন বলে প্রতীয়মান এবং তাঁর আইনি শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই নিজেদের আচরণকে গড়ে তোলা উচিত। উসুলিদের-এই মতবাদের অনুসারীদের এই নামেই ডাকা হত—এইসব দাবি শুনে ভীত হয়ে উঠেছিলেন সদ্রা। ১ তাঁর দৃষ্টিতে এমন দাসত্বমূলক অনুকরণের (তাকলিদ) উপর নির্ভরকারী যেকোনও ধর্ম সহজাতভাবে ‘দূষিত’৷৫২ সকল শিয়াই পয়গম্বর ও ইমামদের ট্র্যাডিশন (আকবার) বোঝার ক্ষমতা রাখে এবং প্রার্থনা ও আচারআচরণের ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিজেরাই সমাধান বের করার উপযুক্ত।
সপ্তদশ শতাব্দী গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে উসুলি ও তাদের বিরোধীদের সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সাফাভিয় শক্তির তখন পতন শুরু হয়েছে, সমাজ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপযুক্ত শক্তি উলেমাদের মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল, কিন্তু আপন ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে নিজেদের ভেতরই বিরোধে লিপ্ত ছিলেন তাঁরা। এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইরানি উসুলিদের বিরোধিতা করেছে, অতীতের ঐতিহ্যের উপর নির্ভরকারী তথাকথিত আকবারিদের অনুসরণ করেছে। আকবারিরা ইজতিহাদের প্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে কোরান ও সুন্নাহর সংকীর্ণ আক্ষরিক অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা করত। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, সকল আইনি সিদ্ধান্তকে অবশ্যই কোরান, পয়গম্বর বা ইমামদের সুস্পষ্ট বিবৃতি ভিত্তিক হতে হবে। এমন কোনও ঘটনা যদি ঘটে যার বেলায় কোনও স্পষ্ট বিধি নেই, মুসলিম জুরিস্ট অবশ্যই নিজের বিচার বিবেচনার উপর নির্ভর না করে বরং বিষয়টি সেক্যুলার আদালতে পাঠাবেন।৫৩ উসুলিরা অধিকতর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে চেয়েছিল। ইসলামি ট্র্যাডিশনের অনুসৃত নীতিমালার ভিত্তিতে জুরিস্টগণ নিজস্ব যুক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বৈধ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারতেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে আকবারিরা এমনভাবে অতীতে জড়িয়ে পড়বে যে ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স আর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, কোনও জুরিস্টই শেষকথা বলতে পারবেন না, আর কোনও পূর্ব নজীরই বাধ্যতামূলক হবে না। প্রকৃতপক্ষেই, তাঁরা এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, অতীতের সম্মানিত কর্তৃত্বকে অনুসরণ করার বদলে বিশ্বাসীদের সব সময়ই কোনও একজন জীবিত মুজতাহিদের বিধান মেনে চলা উচিত। উভয় পক্ষই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা সময়ে রক্ষণশীল চেতনায় স্থির থাকার প্রয়াস পাচ্ছিল এবং উভয়ই প্রধানত স্বর্গীয় বাণী নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। আকবারি বা উসুলিদের কেউই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার উপর জোর দেয়নি; এটা ছিল স্রেফ আচরণ বা ধর্মীয় অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসীকে কার কাছে নতি স্বীকার করতে হবে, ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থের কাছে নাকি কোনও মুজতাহিদের কাছে সেই প্রশ্ন। তবু দুই পক্ষই একটা কিছু হারিয়েছিল। আকবারিরা আইনে মূৰ্ত আদিম স্বর্গীয় আজ্ঞাকে অতীতের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে, পরিণত হয়েছে অক্ষরবাদীতে; আবিশ্যিকভাবে প্রাচীন শিয়া মতবাদের প্রতীকী ধর্মের সাথে তাদের সম্পর্ক হারিয়ে গিয়েছিল। তাদের চোখে বিশ্বাস পরিণত হয়েছিল বাহ্যিক কিছু নির্দেশনার ধারায়। মানুষের যুক্তির উপর অনেক বেশি আস্থা ছিল উসুলিদের, তাদের ধর্মের মিথোসে এখনও তা প্রোথিত আছে। কিন্তু বিশ্বাসীকে তাদের রায় মেনে নিতে হবে বলে জোর দিয়ে তারা মোল্লা সদ্রার ব্যক্তির পবিত্র স্বাধীনতায় বিশ্বাস খুইয়েছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাষ্ট্রের দুর্বলতা পুষিয়ে দিতে পারবে এমন একটা আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল, নেমে আসছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং পরবর্তীকালের শাহদের অযোগ্যতা রাষ্ট্রকে নাজুক করে তুলেছিল। ১৭২২ সালে আফগান গোত্রগুলো ইস্ফাহানে হামলা চালায়, নেহাত অসম্মানের সাথে আত্মসমর্পণ করে শহরটি। এক গোলযোগের যুগে প্রবেশ করে ইরান। কিছুদিনের জন্যে এমনও মনে হয়েছিল যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে এর অস্তিত্বও বুঝি থাকবে না। উত্তর দিক থেকে আগ্রাসন চালায় রাশানরা, পশ্চিম থেকে অটোমানরা। সুলতান হুসেইন শাহর তৃতীয় ছেলে দ্বিতীয় তাহমাস্প অবশ্য ইস্ফাহানের অবরোধ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ইরানি আফসার গোত্রের সর্দার নাদির খানের সহায়তায় আগ্রাসীদের বিতাড়নে সফল হন তিনি। ১৭৩৬ সালে নাদির খান তাহমাস্পকে উৎখাত করে নিজেকেই সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৭৪৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু প্রায়শঃই দক্ষতার সাথে দেশটি শাসন করেছেন তিনি। তুর্কমান কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ খান নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এক অন্ধকার অরাজক অন্তবর্তীকালীন সময় উপস্থিত হয়েছিল। ১৭৯৪ সালে শাসন সংহত করতে সক্ষম হন তিনি।৪ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ক্ষমতায় অবস্থান করে নতুন কাজার রাজবংশ।
এই বিষণ্ন বছরগুলোয় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটে। নাদির খান ইরানে আবার সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, ফলে নেতৃস্থানীয় উলেমারা ইস্ফাহান ছেড়ে ইরাকে অটোমান সাম্রাজ্যের মাজার শহর নাজাফ ও কারবালায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। একে প্রথমে বিপর্যয় মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা উলেমাদের পক্ষে উপহার প্রমাণিত হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে আরও বড় ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাঁরা রাজনৈতিক শাহদের নাগালের বাইরে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ছিলেন। ক্রমে দরবারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অনন্য অবস্থানে পৌঁছে বিকল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। এই সময়ের দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তন ছিল বিশিষ্ট পণ্ডিত ওয়াহিদ বিহবেহানি (১৭০৫-৯২)-এর কিছুটা সহিংস পদ্ধতিতে অর্জিত উসুলিদের বিজয়। ইজতিহাদের ভূমিকা অনেক স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তিনি, জুরিস্টদের পক্ষে এর প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন। উসুলি অবস্থান মেনে নিতে অস্বীকারকারী যেকোনও শিয়াকে বিধর্মী হিসাবে নিষিদ্ধ করা হত, বিরোধিতাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘাতে কিছু সংখ্যক আকবারি প্রাণ হারায়। ইস্ফাহানের অতীন্দ্রিয় দর্শনও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সুফিবাদকে এমন বর্বরভাবে দমন করা হয়েছিল যে, বিহবেহানির ছেলে আলি সুফি-ঘাতক নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু, আমরা যেমন দেখেছি, ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি সাধারণত উল্টো ফল দেয়, অতীন্দ্রিয়বাদ আত্মগোপনে চলে যায় এবং স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী ও বুদ্ধিজীবীদের ধ্যানধারণাকে আকার দিতে থাকে। বিহবেহানির বিজয় ইরানি উলেমাদের পক্ষে রাজনৈতিক বিজয় ছিল। অরাজকতার উত্তাল সময়ে উসুলি অবস্থান জনপ্রিয় ছিল, কেননা এটা কিছু পরিমাণ শৃঙ্খলা নিয়ে আসার ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্বের যোগান দিয়েছিল তাদের। মুজতাহিদগণ রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন, জনগণের মাঝে কখনওই ক্ষমতা হারাননি। কিন্তু ইমামদের আচরণ ও আদর্শ থেকে দূরবর্তী হওয়ায় স্বৈরাচারী উপায়ে অর্জিত বিহবেহানির বিজয় এক ধরনের ধর্মীয় পরাজয় ছিল।৫৬
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অটোমান ও ইরানি সাম্রাজ্য উভয়ই বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। কৃষি নির্ভর সভ্যতার সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার অনিবার্য নিয়তি বরণ করে নিচ্ছিল এরা। অ্যাক্সিয়াল যুগের সময় থেকেই রক্ষণশীল চেতনা নারী-পুরুষকে গভীর স্তরে এই ধরনের সভ্যতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সাহায্য করে এসেছে। এর মানে এই ছিল না যে, রক্ষণশীল সমাজগুলো স্থবির ও অদৃষ্টবাদী ছিল। এই আধ্যাত্মিকতা ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য বয়ে এনেছিল। কিন্তু এই রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক প্রয়াস এক ধরনের পৌরাণিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত হয়েছিল, যা ইউরোপে বিকাশ লাভ করতে থাকা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ম্যল্যবোধের কাছে অচেনা হয়ে দাঁড়াবে। আধুনিক ইউরোপের বহু আদর্শ মুসলিমদের পক্ষে অনুকূল হবে। আমরা দেখেছি, তাদের ধর্মবিশ্বাস এমন প্রবণতার বিকাশ ঘটাতে উৎসাহিত করেছিল যা আধুনিক পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী প্রবণতার অনুরূপ: সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্যবাদ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, মানবীয় ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতা, সেক্যুলার রাজনীতি, ব্যক্তিমুখী বিশ্বাস ও যৌক্তিক ধারণার চর্চা। কিন্তু নব্য ইউরোপের অন্যান্য বৈশিষ্টগুলো রক্ষণশীল রেওয়াজে গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইউরোপিয়দের পেছনে পড়ে গিয়েছিল, এই সময় ইসলামি সাম্রাজ্যগুলো ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেগুলো ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে নাজুক হয়ে দাঁড়ায়; এসব রাষ্ট্র বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রয়াস চালানোর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ভারতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে ব্রিটিশরা; এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল ফ্রান্স। ১৯শে মে, ১৭৯৮, নেপোলিয়ন বোনাপার্তে প্রাচ্যে ব্রিটিশ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে তুলন থেকে ৩৮,০০০ লোক ও ৪০০ জাহাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করল ফরাসী নৌবহর। ১লা জুলাই আলেকজান্দ্রিয়ার সৈকতে ৪,৩০০ সেনা অবতরণ করালেন নেপোলিয়ন, পরদিন ভোরের অল্প পরেই দখল করে নিলেন গোটা শহর।৫৭ এভাবে মিশরে একটা ঘাঁটি পেয়ে যান তিনি। সাথে করে পণ্ডিত, আধুনিক ইউরোপিয় সাহিত্যের একটা লাইব্রেরি, একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও আরবী হরফঅলা একটা ছাপাখানা নিয়ে এসেছিলেন নেপোলিয়ন। পশ্চিমের নতুন বৈজ্ঞানিক, সেক্যুলারিস্ট সংস্কৃতি আক্রমণ হানল মুসলিম বিশ্বে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।
২. মুসলিম: রক্ষণশীল চেতনা (১৪৯২-১৭৯৯)
১৪৯২ সালে পশ্চিমে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হতে চলা নতুন ব্যবস্থার অন্যতম শিকার ছিল ইহুদিরা। ওই গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোর অন্য শিকার ছিল স্পেনের মুসলিমরা, ইউরোপে ঘাঁটি হারিয়েছিল তারা। কিন্তু ইসলাম কোনও দিক থেকেই পরাস্ত শক্তি ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে তখনও তা বিশ্ব পরাশক্তি ছিল। যদিও সুঙ রাজবংশ (৯৬০-১২৬০) চীনকে সামাজিক জটিলতা ও শক্তির দিক থেকে ইসলামি জগতের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরে নিয়ে গিয়েছিল ও ইতালিয় রেনেসাঁ এক সাংস্কৃতিক আলোকনের সূচনা ঘটিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যকে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম করে তুলবে, তবু মুসলিমরা প্রথম দিকে অনায়াসে এইসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পেরেছে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। মুসলিমরা গোটা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু তারা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকায় এমন বিস্তৃত ও কৌশলগতভাবে ছড়িয়ে ছিল যে এই সময় ইসলামী জগৎকে আধুনিককালের গোড়ার দিকের সভ্য জগতের অধিকাংশ এলাকার ধ্যানধারণা তুলে ধরা বিশ্ব ইতিহাসের একটি মাইক্রোকোসম হিসাবে দেখা যেতে পারে। মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক উত্তেজনাকর ও উদ্ভাবনী কাল: ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি নতুন ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল: এশিয়া মাইনর, আনাতোলিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ও উত্তর আফ্রিকায় অটোমান সাম্রাজ্য; ইরানে সাফাভিয় সাম্রাজ্য; ও ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য। প্রতিটি সাম্রাজ্য ইসলামি আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন ভিন্ন চেহারা তুলে ধরেছিল। মুঘল সাম্রাজ্য ফালসাফাহ নামে পরিচিত সহিষ্ণু বিশ্বজনীন দার্শনিক যুক্তিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে; সাফাভিয় শাহগণ এপর্যন্ত অভিজাত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস শিয়া ধর্মমতকে রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করেছিলেন; এবং সুন্নী ইসলামের প্রতি ভীষণভাবে অনুগত রয়ে যাওয়া অটোমান তুর্কিরা পবিত্র মুসলিম বিধান শরীয়াহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
এই তিনটি সাম্রাজ্য ছিল এক বিচ্যুতি। তিনটিই প্রাথমিক আধুনিক প্রতিষ্ঠান ছিল, পদ্ধতিগতভাবে আমলাতান্ত্রিক ও যৌক্তিক নির্ভুলতার সাথে এগুলো পরিচালিত হত। গোড়ার দিকের বছরগুলোতে অটোমান রাষ্ট্র ইউরোপের অন্য যেকোনও রাজ্যেও চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী ছিল। সুলতান দ্য ম্যাগনিফিশেন্টের (১৫২০- ৬৬) শাসনামলে তা শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়। গ্রিস, বালকান্স ও হাঙেরি হয়ে পশ্চিমে রাজ্য বিস্তৃত করেন সুলাইমান। ইউরোপের অভ্যন্তরে তাঁর অগ্রযাত্রা কেবল ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অধিকারে ব্যর্থতার কারণেই প্রতিহত হয়েছিল। সাফাভিয় ইরানে শাহগণ অনেক সড়ক ও কারাভানসরাই নির্মাণ করেন ও অর্থনীতিকে সংহত রূপ দেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশকে সামনের কাতারে নিয়ে আসেন তাঁরা। সবগুলো সাম্রাজ্যই ইতালিয় রেনেসাঁর সমমানের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ উপভোগ করেছে। অটোমান স্থাপত্যকলা, সাফাভিয় শিল্পকলা ও তাজমহলের জন্যে এক মহান সময় ছিল ষোড়শ শতাব্দী।
কিন্তু তাসত্ত্বেও এসবই ছিল আধুনিকায়নের পথে চলা সমাজ, এরা কোনও রেডিক্যাল পরিবর্তন বাস্তবায়ন করেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া বিপ্লবী রীতিনীতির অংশীদার ছিল না তারা। বরং এই সাম্রাজ্যগুলো যা প্রকাশ করেছে তাকে আমেরিকান পণ্ডিত মার্শাল জি.এস. হজসন বলেছেন ইউরোপসহ সকল প্রাক আধুনিক সমাজেরই বৈশিষ্ট্য ‘রক্ষণশীল চেতনা’। প্রকৃতপক্ষেই এই সাম্রাজ্যগুলো ছিল রক্ষণশীল মানসিকতার শেষ রাজনৈতিক প্রকাশ; প্রাক আধুনিক কালের সবচেয়ে অগ্রসর রাষ্ট্র ছিল বলে বলা যেতে পারে এগুলো তার সমগ্রকে তুলে ধরেছে। আজ রক্ষণশীল সমাজ বিপদে রয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য রীতি কার্যকরভাবে অধিকার করে নিয়েছে তাকে কিংবা রক্ষণশীল থেকে আধুনিক চেতনায় উত্তরণের কঠিন পথে অগ্রসর হচ্ছে। অধিকাংশ মৌলবাদই এই বেদনাদায়ক উত্তরণের প্রতি সাড়া। সুতরাং, এই মুসলিম সাম্রাজ্যের তুঙ্গ অবস্থায় রক্ষণশীল চেতনাকে পরখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা এর আবেদন ও শক্তি এবং সেই সাথে সহজাত সীমাবদ্ধতাগুলোও উপলব্ধি করতে পারি।
পাশ্চাত্য (পুঁজি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে) সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সভ্যতা নিয়ে আসার আগে, উনবিংশ শতাব্দীর আগে যার অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়নি, সকল সংস্কৃতিই অর্থনৈতিকভাবে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল। এর মানে, যেকোনও কৃষি নির্ভর সমাজের বিস্তার ও সাফল্যের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল, কেননা শেষ পর্যন্ত তার সম্পদ ও দায়িত্ব ফুরিয়ে ফেলবে। বিনিয়োগের জন্যে প্রাপ্য পুঁজির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিরাট পুঁজির প্রয়োজন হতে পারে এমন যেকোনও উদ্ভাবনকে নাকচ করে দেওয়া হত, কারণ লোকের সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলে, কর্মচারীদের বহাল রেখে আবার নতুন করে শুরু করার কোনও উপায় ছিল না। পশ্চিমে আজ যাকে আমরা নিশ্চিত ধরে নিই, আমাদের সংস্কৃতির আগের কোনও সংস্কৃতিই অব্যাহত উদ্ভাবনকে সামাল দিতে পারেনি। এখন আমরা আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্ম থেকে বেশি জানবার প্রত্যাশা করি, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, আমাদের প্রজন্ম ক্রমেই আরও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর হয়ে উঠবে। আমরা ভবিষ্যৎমুখী, আমাদের সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আগামীর দিকে তাকাতে হয় ও আগামী প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে এমন বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এটা স্পষ্ট হবে যে, আমাদের এই সমাজ স্থিতিশীল একরোখা যুক্তিবাদী ভাবনার ফল। এটা লোগোসের সন্তান, যা সবসময়ই সামনে তাকায়, আরও জানতে চায় ও আমাদের ক্ষমতার সীমানা বাড়াতে চায়। কিন্তু কোনও যৌক্তিক ভাবনাই একটি আধুনিক অর্থনীতি ব্যতীত এই আগ্রাসীভাবে উদ্ভাবনী সমাজ গড়ে তুলতে পারত না। নতুন নতুন আবিষ্কার সম্ভব করে তোলার জন্যে পাশ্চাত্য সমাজগুলোর পক্ষে অবকাঠামো বদলে ফেলা অসম্ভব নয়, কেননা পুঁজির অবিরাম পুনর্বিনিয়োগের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের মৌল সম্পদ বাড়িয়ে তুলতে পারি যাতে তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে তাল মেলাতে পারে। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে এটা সম্ভব ছিল না, এখানে লোকে ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকেই টিকিয়ে রাখতে শক্তি ব্যয় করত। একারণে প্রাক আধুনিক কালের ‘রক্ষণশীল’ প্রবণতা কোনও মৌল ভীরুতা থেকে উৎপন্ন হয়নি, বরং এই ধরনের সংস্কৃতির বাস্তবসম্মত মূল্যায়নই তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা মূলত পালাক্রমিক জানার ব্যাপার ছিল, এখানে কোনওরকম মৌলিকত্বকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সমাজ সাধারণভাবে ধারণ করতে পারত না বলে ছাত্রদের কোনও রেডিক্যাল নতুন ধারণা ভাবতে উৎসাহিত করা হত না; সুতরাং, এই ধরনের ভাবনা সামাজিকভাবে বিধ্বংসী হয়ে গোটা সম্প্রদায়কে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারত। রক্ষণশীল সমাজে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাক স্বাধীনতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।
আধুনিকদের মতো ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর বদলে প্রাক আধুনিক সমাজগুলো অনুপ্রেরণার জন্যে অতীতের দিকে মুখ ফেরাত। অবিরাম উন্নয়নের প্রত্যাশার বদলে ধরে নেওয়া হত যে পরবর্তী প্রজন্ম অনায়াসে অতীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। সাফল্যের নতুন চূড়ায় আরোহণের বদলে সমাজগুলো আদিম নিখুঁত অবস্থা থেকে অবনত হয়েছে বলে মনে করা হত। এই কল্পিত সোনালি যুগকে সরকার ও ব্যক্তি বিশেষের জন্যে আদর্শ মনে করা হত। অতীতের এই আদর্শের কাছাকাছি যাওয়ার ভেতর দিয়েই কেবল কোনও সমাজ তার সম্ভাবনাকে পূর্ণ করতে পারত। সভ্যতাকে সহজাতভাবে নাজুক মনে করা হত। সবাই জানত, পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপের মতো যেকোনও দেশই বর্বর কালে পতিত হতে পারে। ইসলামি বিশ্বে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে ত্রয়োদশ শতকের মঙ্গোল আগ্রাসনের স্মৃতি তখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। গণহত্যা, আগুয়ান দস্যু দলের হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের পলায়ন, ব্যাপক দেশান্তর, একের পর এক মহান ইসলামি শহরের ধ্বংসলীলা তখনও সত্রাসে স্মরণ করা হচ্ছিল। লাইব্রেরি ও শিক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।
সেই সাথে শত শত বছরের কষ্টে সংগৃহীত জ্ঞানও হারিয়ে গিয়েছিল। মুসলিমরা সামলে নিয়েছিল; সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীরা এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেন, যা লুরিয় কাব্বালাহর মতোই উপশমকারী বলে প্রমণিত হয়েছে; তিনটি নতুন সাম্রাজ্য ছিল সেই পুনরুজ্জীবনেরই নিদর্শন। অটোমান ও সাফাভিয় রাজবংশগুলোর মূল নিহিত ছিল মঙ্গোল যুগের ব্যাপক স্থানচ্যুতির ভেতর, দুটোই জন্ম নিয়েছে উগ্র গাযু রাষ্ট্রে, এগুলো সর্দার যোদ্ধার হাতে পরিচলিত হত ও প্রায়শঃই কোনও সুফি ত্বরিকার সাথে সম্পর্কিত ছিল। প্রলয়ঙ্করী ঘটনার সময় যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সাম্রাজ্যগুলোর শক্তি ও সৌন্দর্য ছিল ইসলামি মূল্যবোধের পুনরুত্থান ও মুসলিম ইতিহাসের আবার সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের গর্বিত উচ্চারণ। কিন্তু এমন মাত্রার বিপর্যয়ের পর প্রাক আধুনিক সমাজের স্বাভাবিক রক্ষণশীলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। লোকে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে বরং যা কিছু হারিয়ে গেছে তাকেই আবার ধীরে ধীরে কষ্টের সাথে ফিরে পাবার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ,
সুন্নি ইসলামে-ধর্মের অধিকাংশ মুসলিমের অনুসৃত ভাষ্য, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-এই মর্মে ঐকমত্য স্থাপিত হয় যে ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ (‘স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগ’) রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম জুরিস্টদের কোরান বা কোনও প্রতিষ্ঠিত ট্র্যাডিশনে স্পষ্ট জবাব দেওয়া হয়নি এমনসব আদর্শ ও বিধিবিধান সংক্রান্ত উত্থাপিত প্রশ্নের সমাধান বের করার লক্ষ্যে নিজস্ব বিচার বিবেচনা প্রয়োগের অনুমতি ছিল। কিন্তু আধুনিক কালের গোড়ার দিকে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে সুন্নি মুসলিমরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে স্বাধীন ভাবনার আর প্রয়োজন নেই। সমস্ত উত্তর তৈরি রয়েছে, শরীয়াহই সমাজের স্থায়ী নীল নকশা; ইজতিহাদের প্রয়োজনও নেই, তা কাঙ্ক্ষিতও নয়। মুসলিমদের বরং অবশ্যম্ভাবীভাবে অতীতের অনুসরণ (তাকলিদ) করতে হবে। নতুন সমাধান সন্ধানের পরিবর্তে তাদের উচিত হবে প্রতিষ্ঠিত আইনি সারগ্রন্থে প্রাপ্য বিধির প্রতি নতি স্বীকার করা। আইন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন (বিদাহ)-কে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে সুন্নি ইসলামি জগতে ক্রিশ্চান পাশ্চাত্যের মতবাদগত বিষয়ে ধর্মদ্রোহের মতোই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বিপজ্জনক মনে করা হত।
প্রবল রকম প্রতিমাবিরোধী আধুনিক পাশ্চাত্যের সাথে এরচেয়ে বেশি বেমানান প্রবণতা কল্পনা করা কঠিন। আমাদের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার উপর ইচ্ছাকৃত বাধা আরোপ এখন ঘৃণিত। পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, লোকে কেবল এই ধরনের বাধা ছুঁড়ে ফেলতে প্রস্তুত হলেই আধুনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা লোগোসের ফল হয়ে থাকলে মিথোস কীভাবে প্রাক আধুনিক বিশ্বের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল চেতনার সহায়ক ছিল সেটা বোঝা সহজ। পৌরাণিক ধ্যানধারণা অতীতমুখী, সামনে তাকায় না। পবিত্র সূচনা, আদিম ঘটনা, কিংবা মানুষের জীবনের ভিত্তির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে মিথ অটল কোনও কিছুর দিকে দৃষ্টি দেয়। আমাদের জন্যে এটা কোনও ‘সংবাদ’ বয়ে আনে না, বরং সবসময় কী ছিল সেই কথা বলে; গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কিছুই চিন্তা করা হয়ে গেছে, অর্জিত হয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কথার উপর, বিশেষ করে পবিত্র টেক্সটের উপর ভিত্তি করে আমরা বেঁচে থাকি, আমাদের যা কিছু জানার তার সবই তা জানিয়ে দিয়েছে। এটাই ছিল রক্ষণশীল কালের চেতনা। কাল্ট, আচরিক অনুশীলন ও পৌরাণিক বিবরণ ব্যক্তিকে কেবল তার গভীরতর অবচেতনে অনুরণন তোলা অর্থই যোগাত না, বরং কৃষি নির্ভর সমাজে টিকে থাকার জন্যে জরুরি প্রবণতা ও এর সহজাত সীমাবদ্ধতাকে শক্তিশালী করে তুলত। শাব্বেতাই যেভি কেলেঙ্কারী যেমন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মিথের বাস্তব পরিবর্তন ঘটানোর কথা নয়। এটা মনের একটা অবস্থা তৈরি করে যা চলমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয় ও সমরূপতা অর্জন করে। অনিরুদ্ধ উদ্ভাবনকে স্থান দিতে অপারগ সমাজে এটা আবশ্যক ছিল।
পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানকারী পাশ্চাত্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে যেমন মিথোলজির ভূমিকা বোঝা কঠিন-এমনকি অসম্ভব; তেমনি গভীর ও জোরালভাবে রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতায় গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষেও আধুনিক সংস্কৃতির অগ্রসর গতিশীলতা গ্রহণ করা দারুণভাবে কঠিন—এমনকি অসম্ভবও। আবার, এখনও প্রথাগত পৌরাণিক মূল্যবোধে লালিত জাতিকে বোঝাও আধুনিকতাবাদীর পক্ষে যারপরনাই কঠিন। আমরা যেমন দেখব, বর্তমান ইসলামি বিশ্বে কোনও কোনও মুসলিম দুটো বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। প্রথমত, তারা পাশ্চাত্য সমাজের ধর্মকে রাজনীতি থেকে, চার্চকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নকারী সেক্যুলারিজমকে ঘৃণা করে; দ্বিতীয়ত, অনেক মুসলিমই তাদের সমাজ ইসলামের পবিত্র আইন শরীয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া দেখতে চায়। এটা আধুনিক চেতনায় গড়ে ওঠা মানুষের চোখে দারুণভাবে বিভ্রান্তিকর; তারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই ভেবে ভীত যে একটা যাজকীয় প্রতিষ্ঠান তাদের চোখে স্বাস্থ্যকর সমাজের জন্যে আবিশ্যিক অবিরাম প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। এরা চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নকরণের সুবিধা ভোগ করেছে, তাই ইনকুইজিশনের মতো কোনও প্রতিষ্ঠান ‘ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছে’ ভেবে শিউরে ওঠে। একই ভাবে প্রত্যাদেশ মারফত পাওয়া স্বর্গীয় বিধানের ধারণাও আধুনিক রীতিনীতির সাথে বেমানান। আধুনিক সেক্যুলারিস্টরা কোনও অতিমানবীয় সত্তা কর্তৃক মানবজাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরিবর্তনীয় আইনের ধারণা বিতৃষ্ণার উদ্রেককারী মনে করে। তারা মনে করে, আইন মিথোস থেকে নয়, বরং লোগোস থেকে উদ্ভুত। এটা যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক, চলমান অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যে একে সময়ে সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হতে হবে। সুতরাং, এইসব মূল ইস্যুই আধুনিকতাবাদীদের মুসলিম মৌলবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
অবশ্য তুঙ্গ অবস্থায় শরীয়া আইনের ধারণা দারুণভাবে সন্তোষজনক ছিল। এটা ছিল ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য থেকে বৈধতা লাভ করা অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য। সুলতানকে শরীয়াহ আইনের রক্ষক হিসাবে শ্রদ্ধা করা হত। এমনকি সুলতান ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নিজ দিওয়ান-খাস মহল-যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হত—থাকলেও শরীয়াহ আদালতের (অটোমানরাই প্রথম একে পদ্ধতিগতভাবে সংগঠিত করেছিল) সভাপতিত্বকারী কাজিরাই বিচারকের সীলমোহর হিসাবে বিবেচিত হতেন। কাজি, তাদের পরামর্শক মুফতি ও মাদ্রাসায় ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের শিক্ষাদানকারী পণ্ডিতগণ (ফিকহ) সবাই ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। তাঁরা সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতোই সরকারের পক্ষে আবশ্যক ছিলেন। সুলতানের কর্তৃত্ব ধর্মীয় পণ্ডিত উলেমাদের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হত বলে বিভিন্ন আরব প্রদেশের বাসিন্দারা তুর্কিদের আধিপত্য মিনে নিতে পেরেছিল, এদের পেছনে ইসলামি আইনের পবিত্র কর্তৃত্ব ছিল। সুতরাং সেই হিসাবে ইস্তাম্বুল ও বিভিন্ন প্রদেশের ভেতর উলেমাগণ সুলতান ও প্রজাদের ভেতর সম্পর্কের একটা উপায় ছিলেন। তাঁরা ক্ষোভের কথা সুলতানের কানে তুলতে পারতেন ও এমনকি ইসলামি বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলে তাঁকেও ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারতেন। সুতরাং, উলেমারা অটোমান রাষ্ট্রকে নিজেদের রাষ্ট্র মনে করতে পারতেন; আর সুলতানগণ অংশীদারি তাঁদের ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল বলে তাঁদের উপর যাজকদের আরোপিত বাধা মেনে নিতেন। অটোমান সাম্রাজ্যের মতো আর কখনওই শরীয়া আইন রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে এভাবে প্রধান ভুমিকা রাখতে পারেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য দেখিয়েছে যে, ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য সত্যিই তাঁদের সঠিক পথে নিয়ে এসেছিল। অস্তিত্বের মৌল নীতিমালার সাথে একই ছন্দে অবস্থান করছিলেন তাঁরা।
সকল রক্ষণশীল সমাজ (যেমন ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে) এক সোনালি যুগের মুখাপেক্ষী থাকে; অটোমান সাম্রাজ্যের সুন্নি মুসলিমদের জন্যে সেটা ছিল পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) (c. ৫৭০-৬৩২সিই) ও তাঁর অব্যবহিত পরের প্রথম চার রাশিদুন (‘সঠিকপথে পরিচালিত’) খলিফা। তাঁরা ইসলামি আইন অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করেছিলেন। ধর্ম ও রাষ্ট্রের কোনও বিচ্ছিন্নতা ছিল না। মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক প্রধান। সপ্তম শতাব্দীর আরবাসীদের জন্যে তাঁর নিয়ে আসা প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থ কোরান জোর দিয়েছে যে, একজন মুসলিমের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ গঠন করা যেখানে দরিদ্র ও দুস্থ জনগণের প্রতি সম্মানের সাথে আচরণ করা হবে। এর জন্যে প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে জিহাদের (একটি শব্দ ‘পবিত্র যুদ্ধে’র পরিবর্তে-যেমনটা পাশ্চাত্যবাসীরা প্রায়ই ধরে নেয়-যার অনুবাদ হওয়া উচিত ‘প্রয়াস’ বা ‘সংগ্ৰাম’।): আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক। আল্লাহকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ গঠনের মাধ্যমে ও মানবজাতির জন্যে তাঁর পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে মুসলিমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংহতি অর্জন করবে যা তাদের আল্লাহর একত্বের বোধ জাগাবে। জীবনের কোনও একটি দিককে ঝেড়ে ফেলে তাকে এই ধর্মীয় ‘প্রয়াসে’র আওতার বাইরে ঘোষণা করা হবে প্রধান ইসলামি গুণ এই একীভূতকরণের (তাওহিদ) নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন। এটা স্বয়ং আল্লাহকেই অস্বীকার করার শামিল হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, ধর্মপ্রাণ কোনও মুসলিমের পক্ষে রাজনীতি হচ্ছে ক্রিশ্চানরা যাকে বলবে অপসুদীক্ষা। এটা এমন এক কর্মকাণ্ড যাকে পবিত্রায়িত করতেই হবে যাতে তা আল্লাহকে পাওয়ার একটি উপায়ে পরিণত হয়।
মুসলিম সম্প্রদায় অর্থাৎ উম্মাহর বিভিন্ন উদ্বেগ শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে বাধ্যতামূলক ইসলামের পাঁচটি আবশ্যকীয় অনুশীলন স্তম্ভে’ (রুকন) স্পষ্ট করা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা যেখানে অর্থডক্সিকে সঠিক বিশ্বাস মনে করে, মুসলিমদের সেখানে ইহুদিদের মতো অর্থপ্র্যাক্সির, ধর্মীয় অনুশীলনের সর্বজনীনতা এবং বিশ্বাসকে গৌণ বিষয় হিসাবে দেখা প্রয়োজন। পাঁচটি স্তম্ভ অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমকে শাহাদাহ (আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাস ও মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্বের পক্ষে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি) উচ্চারণ করতে হয়, দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনা করা, সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করার জন্যে কর প্রদান (যাকাত) করা, দরিদ্রদের উপবাসে থাকার কষ্টের স্মরণে রমযান মাসে উপবাস পালন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে মক্কায় হাজ্জ তীর্থযাত্রা পালন। উম্মাহর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য স্পষ্টত যাকাত ও রমযানের উপবাসের মূখ্য বিষয়। কিন্তু আবিশ্যিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ঘটনা হাজ্জে এটা জোরালভাবে উপস্থিত, এই সময় উম্মাহর ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যে ও ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য মুছে ফেলার জন্যে তীর্থযাত্রী সর্বজনীন শাদা পোশাক পরে।
আরবীয় হিজাজের কেন্দ্রে মক্কায় অবস্থিত চৌকো আকৃতির উপাসনাগৃহ কাবাহ হাজ্জের মুল মনোযোগের বিষয়। কাবাহ এমনকি মুহাম্মদের (স) আমলেও বহু প্রাচীন ছিল, সম্ভবত আদিতে আরবীয় প্যাগান দেবনিচয়ের পরম ঈশ্বর আল্লাহ’র প্রতি নিবেদিত ছিল। মুহাম্মদ (স) কাবাহয় বার্ষিক তীর্থযাত্রার আনুষ্ঠানিকতাকে ইসলামিকরণ করেছেন, একেশ্বরবাদী তাৎপর্য দান করেছেন। এখন পর্যন্ত হাজ্জ মুসলিম সমাজের এক জোরাল অভিজ্ঞতা দান করে। কাবাহর কাঠামো মনস্তাত্ত্বিক জি.সি. জাঙ (১৮৭৫-১৯৫১) কর্তৃক আবিষ্কৃত আর্কিটাইপাল তাৎপর্যমণ্ডিত জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাথে খাপ খায়। অধিকাংশ প্রাচীন শহরের কেন্দ্ৰে উপাসনালয় পবিত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে, তাদের অস্তিত্বের পক্ষে যাকে আবশ্যক মনে করা হত। এটা মরণশীল নারী-পুরুষের নাজুক ও অরক্ষিত শহুরে সমাজে অধিকতর সক্ষম আদিম বাস্তবতাকে বয়ে আনত। পুতার্ক, ওভিদ, দিওনিসাস অভ হেলিকারনাসাসের মতো ধ্রুপদি লেখকগণ বৃত্তাকার বা চৌকো হিসাবে উপাসনাগৃহের বর্ণনা দিয়েছেন, এটা মহাবিশ্বের অত্যাবশ্যক কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলে বলে বিশ্বাস করা হত। এটা সেই প্যারাডাইম যা তুমুল বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে এবং একে টেকসই করে বাস্তবতা দান করেছে। জাঙ বিশ্বাস করতেন যে, চৌকো বা বৃত্তের ভেতর যেকোনও একটিকে বেছে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, বাস্তবতার ভিত্তি মহাজাগতিক শৃঙ্খলাকে তুলে ধরা জ্যামিতিক চিত্র, তিনি বিশ্বাস করতেন, বৃত্তের ভেতর প্রবেশ করানো একটা চতুর্ভুজ। উপাসনাগৃহে পালিত আচারগুলো উপাসককে মহাবিশ্বের মৌল নীতিমালা ও আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে ও একে বিভ্রান্তি বা কুহকের ফাঁদে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সহজাত বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ভরা জগতে স্বর্গীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। মক্কার কাবাহ ঠিক আর্কিওটাইপের সাথে মিলে যায়। গ্রানিটের চৌকো কাঠামো ঘিরে তীর্থযাত্রীরা সাতবার আচরিক প্রদক্ষিণে দৌড়ে বেড়ায়। এর চারটে কোণ পৃথিবীর কোণের প্রতিনিধিত্ব করে, পৃথিবীকে ঘিরে সূর্যের ঘূর্ণনের ধরনকে অনুসরণ করে তারা। নারী বা পুরুষ তার সম্পূর্ণ সত্তার জীবনের মৌল ভিত্তির কাছে কেবল অস্তিত্বগত আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই (ইসলাম) একজন মুসলিম (যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন) সমাজে প্রকৃত মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে।
তীর্থযাত্রায় গেছে এমন একজন মুসলিমের কাছে এখনও সর্বোচ্চ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হজ্জ এভাবে গভীরভাবে রক্ষণশীল চেতনায় পরিপূর্ণ। সকল প্রকৃত মিথোই-এর মতো পৌরাণিক আদর্শজগতের অবচেতন বিশ্বে প্রোথিত হাজ্জ মুসলিমদের সেই মৌল উপাদানের কথা মনে করিয়ে দেয় যা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কারও পক্ষে এর বাইরে যাওয়া অসম্ভব। এটা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের চেয়ে গভীরে যেতে, বস্তুনিচয়ের আবিশ্যিকভাবে স্বাভাবিক ধর্মে আত্মসমর্পণ ও নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে অগ্রসর না হতে সাহায্য করে। সম্প্রদায়ের সমস্ত যৌক্তিক কর্মকাণ্ড-রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য বা সামাজিক সম্পর্ক-পৌরাণিক প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত ও পরে মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে অবস্থিত কাবাহ এইসব যৌক্তিক কর্মকাণ্ডকে অর্থ ও পরিপ্রেক্ষিত দান করেছে। কোরানও এই রক্ষণশীল মনোভাব তুলে ধরেছে। এটা বারবার জোরের সাথে বলেছে যে, মানুষের কাছে এটা কোনও নতুন সত্যি বয়ে আনছে না, বরং মানবজীবনের অত্যাবশ্যক বিধিবিধানকেই প্রকাশ করছে। এটা এরই মধ্যে জানা সত্যিরই ‘স্মারক’। মুহাম্মদ (স) মনে করেননি যে তিনি একটি নতুন ধর্ম তৈরি করছেন, বরং বিশ্বাস করেছেন যে, এই আরবীয় গোত্রের কাছে মানবজাতির আদিমতম ধর্মকেই নিয়ে আসছেন; এর আগে কখনও এদের কাছে কোনও পয়গম্বর প্রেরণ করা হয়নি, তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনও ঐশীগ্রন্থও ছিল না। কোরানের দৃষ্টিতে প্রথম পয়গম্বর আদমের কাল থেকেই কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে তার শিক্ষা দিতে আল্লাহ পৃথিবীর বুকে প্রত্যেক জাতির কাছে বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন।’ সহজাতভাবে স্বর্গীয় বিধির কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম পশু-পাখি, মাছ বা গাছের বিপরীতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে, ইচ্ছে করলে সে এই বিধানকে অমান্য করতে পারে।” তারা যখন এইসব মৌল বিধানকে অমান্য করে দরিদ্রের উপর নির্যাতনকারী সুষ্ঠুভাবে সম্পদ বণ্টনে অস্বীকারকারী স্বেচ্ছাচারী সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই তারা তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। কোরান আমাদের জানাচ্ছে অতীতের মহান সব পয়গম্বর-আদম, নোয়াহ, মোজেস, জেসাস এবং আরও অনেকে—কীভাবে আল্লাহ’র সেই একই বাণী উচ্চারণ করেছেন। এখন কোরান আরবদের কাছে সেই একই স্বর্গীয় বাণী এনে দিয়েছে, তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার চর্চা করার নির্দেশ দিচ্ছে যা তাদের অস্তিত্বের মৌল বিধির সাথে সমন্বিত করবে। মুসলিমরা যখন আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলে, সবকিছু যেমন হওয়া উচিত ছিল সেইভাবে বস্তুনিচয়ের ধারার সাথে চলার বোধ জাগে তাদের ভেতর। আল্লাহ’র বিধান অমান্য করাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিবেচনা করা হয়েছে: এ যেন কোনও মাছ জমিনে বাস করার প্রয়াস পাচ্ছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানদের বিস্ময়কর সাফল্যকে নিশ্চয়ই তাদের প্রজাদের চোখে তারা যে এই মৌল নীতিমালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে ফুটে উঠেছিল। একারণেই তাদের সমাজ এমন দর্শনীয়ভাবে কাজ করেছে। অটোমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরীয়াহ আইনকে দেওয়া নজীরবিহীন প্রাধ্যান্যকেও এই রক্ষণশীল চেতনায় দেখা হয়েছিল। আধুনিকতার সূচনায় মুসলিমরা স্বর্গীয় আইনকে তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্নকারী বিষয় মনে করেনি, এটা ছিল পৌরাণিক আদর্শজগতের আচরিক ও কাল্টিক বাস্তবায়ন, যা তাদের পবিত্রের সংস্পর্শে নিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করেছে। মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের পরবর্তী শতাব্দীগুলোয় ধীরে ধীরে মুসলিম আইনের বিকাশ ঘটেছে। কোরানে খুব কমই বিধানের অস্তিত্ব রয়েছে আর পয়গম্বরের পরলোকগমনের এক শো বছরের ভেতর মুসলিমরা হিমালয় থেকে পিরেনীজ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করছিল বলে অন্য যেকোনও সমাজের মতোই এর জটিল আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন থাকায় এটা ছিল একটা সৃজনশীল উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের চারটি ধারা গড়ে ওঠে। সবগুলোই প্রায় একই ধরনের, এদের সমানভাবে বৈধ মনে করা হয়। পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে এই বিধানব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ গ্রহণের সময় ইসলামের নিখুঁত ভঙ্গিমা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নবম শতাব্দীতে খুব সতর্কতার সাথে পয়গম্বরের শিক্ষা ও আচরণ সংক্রান্ত প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন (হাদিস) সংগ্রহ করা হয়, মুসলিমরা তাঁর বাণী ও ধর্মীয় অনুশীলনের (সুন্নাহ) একটা নির্ভুল রেকর্ড লাভ করে সেটা নিশ্চিত করতে যত্নের সাথে বাছাই করা হয়েছে। আইনি মতবাদগুলো মুহাম্মদীয় এই প্যারাডাইমগুলোকে তাদের আইনি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে যাতে সারা বিশ্বের মুসলিমরা পয়গম্বর যেভাবে কথা বলতেন, খেতেন, হাতমুখ ধুতেন, ভালোবাসতেন ও প্রার্থনা করতেন তার অনুকরণ করতে পারে। এইসব বাহ্যিক বিষয়ে পয়গম্বরের অনুকরণের ভেতর দিয়ে তারা আল্লাহর কাছে তাঁর অন্তস্থঃ আত্মসমর্পণের নাগাল পাবার আশা করেছিল।” প্রকৃত রক্ষণশীল চেতনায় মুসলিমরা অতীতের এক নিখুঁত বিষয়ের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিল।
মুসলিম বিধানের অনুশীলন ঐতিহাসিক চরিত্র মুহাম্মদকে (স) মিথে পরিণত করে তাঁকে তিনি যে কালে বেঁচেছিলেন সেই কাল থেকে মুক্ত করে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের ব্যক্তি জীবনে তুলে এনেছে। একইভাবে এই কাল্টিক পুনারাবৃত্তি মুসলিম সমাজকে আল্লাহর কাছে নিখুঁত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একজন মানুষের কেমন হওয়া উচিত তার নজীরে পরিণত হওয়া ব্যক্তি মুহাম্মদের (স) নৈকট্য লাভের ভেতর দিয়ে প্রকৃত ইসলামি করে তুলেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আগ্রাসনের সময় নাগাদ শরীয়াহ আধ্যাত্মিকতা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সারা মুসলিম বিশ্বে শেকড় বিস্তার করেছিল, সেটা খলিফা ও উলেমাগণ এটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নয়, বরং এটা নারী-পুরুষকে নুমিনাসের অনুভূতি দিয়েছিল ও তাদের জীবনকে অর্থ দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল বলে। অতীতের প্রতি এই কাল্টিক উল্লেখ অবশ্য সপ্তম শতাব্দীর জীবনধারার প্রতি প্রাচীন আনুগত্যের কাছে বন্দি করেনি। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্য তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র ছিল। সময়ের হিসাবে এটা অসাধারণ দক্ষ ছিল, এক নতুন ধরনের আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে ও প্রাণবন্ত জীবনধারাকে উৎসাহিত করেছে। অটোমানরা অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি উদার ছিল। পাশ্চাত্য নৌচলাচল বিজ্ঞান তাদের সত্যিই উত্তেজিত করে তুলেছিল, অভিযাত্রীদের বিভিন্ন আবিষ্কারে রীতিমতো আলোড়িত হয়েছে; এবং গানপাউডার ও আগ্নেয়াস্ত্রের মতো পাশ্চাত্য সামরিক আবিষ্কার আয়ত্ত করতে তারা উদগ্রীব ছিল।” উলেমাদের দায়িত্ব ছিল এইসব উদ্ভাবনকে মুসলিম আইনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইমের অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতির অনুসন্ধান করা। জুরিপ্রুডেন্সের গবেষণা (ফিকহ) মানে কেবল প্রাচীন টেক্সট পাঠের ব্যাপার ছিল না, বরং এর চ্যালেঞ্জিং একটা মাত্রা ছিল। এবং এই সময় পর্যন্ত ইসলাম ও পশ্চিমের ভেতর কোনও পার্থক্য ছিল না। ইউরোপও রক্ষণশীল চেতনায় ডুবে ছিল। রেনেসাঁ মানবতাবাদীরা আদ ফন্তেসে, উৎসে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, সাধারণ মরণশীলের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ধর্ম থেকে বের হয়ে আসা কার্যত অসম্ভব। নতুন নতুন আবিষ্কার সত্ত্বেও ইউরোপিয়রা অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রক্ষণশীল রীতিনীতিতেই শাসিত হয়েছে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা ভবিষ্যৎমুখী যুক্তিবাদ দিয়ে জীবনের পশ্চাদমুখী পৌরাণিক ধারাকে প্রতিস্থাপিত করার পরেই কেবল কোনও কোনও মুসলিম ইউরোপকে অচেনা ভাবতে শুরু করবে।
এছাড়া, রক্ষণশীল সমাজকে সম্পূর্ণ স্থবির কল্পনা করে নেওয়াটা ভ্রান্তি হবে। গোটা মুসলিম ইতিহাস জুড়ে ইসলা (‘সংস্কার’) ও তাজদিদ (‘নবায়ন’)-এর আন্দোলন চলেছে, প্রায়শঃই এগুলো ছিল সম্পূর্ণই বিপ্লবী। উদাহরণ স্বরূপ, দামাস্কাসের আহমাদ ইবন তাঈমিয়াহর (১২৬৩-১৩২৮) মতো একজন সংস্কারক ‘ইজতিহাদের দুয়ার রুদ্ধ করার’ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মঙ্গোল আগ্রাসনের আগে ও পরে জীবন যাপন করেছেন তিনি, মুসলিমরা এই সময় প্রবল আচ্ছন্ন দশা থেকে মুক্ত হয়ে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছিল। সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কালে বা ব্যাপক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অব্যবহিত পরপর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়ে থাকে। এমন সময়ে পুরোনো সমাধান আর কাজে আসে না, সুতরাং সংস্কারকগণ ইজতিহাদের যৌক্তিক ক্ষমতা ব্যবহার করে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন। ইবন তাঈমিয়াহ শরীয়াকে হালনাগাদ করতে চেয়েছিলেন যাতে করে তা এই খোলনলচে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে মুসলিমদের সত্যিকারের প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি আবিশ্যিকভাবে রক্ষণশীল রূপ ধারণ করেছিল। ইবন তাঈমিয়া বিশ্বাস করতেন যে, সঙ্কট উত্তরণের জন্যে মুসলিমদের অবশ্যই উৎসে, অর্থাৎ কোরান ও পয়গম্বরের সুন্নাহ্য় ফিরে যেতে হবে। পরবর্তীকালের সকল ধর্মীয় সংযোজন বাতিল করে মূলে ফিরে যেতে চেয়েছেন তিনি। অর্থাৎ, আদিম মুসলিম আদর্শরূপে ফিরে যেতে পবিত্র বিবেচিত হতে শুরু করা অনেক মধ্যযুগীয় জুরিপ্রুডেন্স (ফিকহ) ও দর্শন বাতিল করে দিয়েছিলেন। এই প্রতিমাবিরোধিতা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং ইবন তাঈমিয়া বাকি জীবন কারাগারে কাটান। বলা হয়ে থাকে যে, আটককারী তাঁকে কলম ও কাগজ না দেওয়ায় ভগ্ন হৃদয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল, তাঁর আইনি সংস্কার ছিল উদার ও রেডিক্যাল, তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের স্বার্থই তিনি মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন।২ তাঁর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় স্বীকৃতির প্রদর্শনীতে পরিণত হয়। ইসলামি ইতিহাসে এমন আরও অনেক সংস্কারক রয়েছেন। আমরা আমাদের বর্তমান কালের কোনও কোনও মুসলিম মৌলবাদীকে ইসলাহ ও তাজদিদের এই ঐতিহ্যে কাজ করতে দেখব।
অন্য মুসলিমরা নিগূঢ় আন্দোলনের মাঝে নতুন ধর্মীয় ধারণা ও অনুশীলনের সন্ধান করতে পেরেছিল। এসব সাধারণ জনগণের কাছে গোপন রেখেছিল তারা, কেননা তাদের ধারণা ছিল এসবকে ভুল বোঝা হতে পারে। অবশ্য, তারা ধর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণার কোনও পার্থক্য দেখতে পায়নি। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের আন্দোলনসমূহ কোরানের শিক্ষার সম্পূরক ছিল এবং সেগুলোকে নতুন প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছে। ইসলামের তিনটি প্রধান নিগূঢ় ধরন হচ্ছে, সুফিবাদের অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন, ফালসাফাহর যুক্তিবাদ ও শিয়া ধর্মমতের কিছুটা রাজনৈতিক ধার্মিকতা। এই অধ্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত অনুসন্ধান করব। কিন্তু ইসলামের এই নিগূঢ় ধরনগুলোকে যত উদ্ভাবনীমূলক বা মূলধারার শরীয়া ধার্মিকতা থেকে যতই বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, মরমীরা বিশ্বাস করত যে তারা আদ ফন্তেসে ফিরে যাচ্ছে। কোরানের ধর্মে গ্রিক যুক্তিবাদের নীতিমালা প্রয়োগের প্রয়াস লাভকারী ফালসাফাহর প্রচারকরা সময়হীন সত্যির আদিম সর্বজনীন ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে, তাদের ধারণা ছিল ওই ধর্ম বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধর্মের আগেও বিরাজ করত। সুফিরা বিশ্বাস করেছে যে, অতীন্দ্রিয় পরমানন্দ পয়গম্বর কোরান গ্রহণ করার সময় যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তারাও মুহাম্মদের (স) আদি আদর্শের সাথে একাত্ম হচ্ছে। শিয়াদের দাবি, কেবল তারাই কোরানে উল্লিখিত সামাজিক ন্যায়বিচারের আবেগের চর্চা করে, কিন্তু দুর্নীতিবাজ মুসলিম শাসকগণ তাকে উপেক্ষা করে গেছেন। নিগূঢ়বাদীদের কেউই আমাদের ধারণা অনুযায়ী ‘মৌলিক’ হতে চায়নি, সবাইই মূলে ফিরে যাওয়ার রক্ষণশীল দিক থেকে মৌলিক, কেবল সেটাই মানুষকে পূর্ণাঙ্গতা ও পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশ্বাস করা হত।[১৩]
এই গ্রন্থে আমরা যেসব দেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব তাদের ভেতর একটি মিশর। ১৫১৭ সালে এই দেশটি অটোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। প্রথম সেলিম সেই সময় সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সময় দেশটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। সুতরাং শরীয়া ধার্মিকতা মিশরে প্রধান ছিল। কায়রোর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহার সুন্নি বিশ্বে ফিকহ গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু অটোমান শাসনের শতাব্দীগুলোয় ইস্তাম্বুলের পেছনে পড়ে যায় মিশর, আপেক্ষিকভাবে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব। আধুনিক কালের সূচনা লগ্নে এই দেশটির অবস্থা সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। ১২৫০ সাল থেকে এই অঞ্চল মামলুকদের শাসনাধীন ছিল—এরা ছিল কিশোর বয়সে বন্দি করে ইসলামে ধর্মান্তরিত কর্সিকান দাসদের নিয়ে সংগঠিত একটা ক্র্যাক সামরিক বাহিনী। একই ধরনের দাস-বাহিনী জানেসারিরা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক মেরুদণ্ড। তুঙ্গ সময়ে মামলুকরা মিশর ও সিরিয়ায় এক প্রাণবন্ত সমাজে নেতৃত্ব দিয়েছে। মিশর ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলুক সাম্রাজ্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতার সহজাত সীমাবদ্ধতার কাছে নতি স্বীকার করে নেয়, এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এর পতন শুরু হয়। মামলুকরা অবশ্য মিশরে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়নি। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বে’র সাথে জোট বেঁধে দেশটি দখল করে নেন। এই রফার অধীনে খায়ের বে-কে অটোমান বাহিনী প্রত্যাহৃত হওয়ার পর ভাইসরয় নিয়োগ করা হয়েছিল।
গোড়ার দিকে অটোমানরা মামলুকদের সামাল দিতে পেরেছিল, দুটি মামলুক বিদ্রোহকে দমন করেছিল তারা।[১৪] তবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে অটোমানরা তাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফেলতে যাচ্ছিল। ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি প্রশাসনে পতন ডেকে আনে এবং ক্রমশঃ বেশ কয়েকটা বিদ্রোহের পর মামলুক অধিনায়করা (বে) মিশরের আসল শাসক হিসাবে আবির্ভূত হন, যদিও সরকারীভাবে ইস্তাম্বুলের অধীন ছিলেন তাঁরা। বে-গণ উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন সামরিক ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন, এই বাহিনী তুর্কি গভর্নরের বিরুদ্ধে অটোমান সেনাবাহিনীতে মামলুক বাহিনীর একটা বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় ও তার জায়গায় নিজেদের একজনকে ক্ষমতায় বসায়। সুলতান এই নিয়োগের বৈধতা দান করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে সংক্ষিপ্ত একটা পর্যায় বাদে মামলুকরা দেশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছিল। ওই সময় জানেসারিদের একজন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। তবে মামলুক শাসন ছিল অস্থিতিশীল। বে-তন্ত্ৰ দুটো উপদলে বিভক্ত ছিল, ফলে সারাক্ষণ অস্থিরতা ও অন্তর্দলীয় কোন্দল লেগেই থাকত।[১৫] এই গোটা উত্তাল সময় জুড়ে প্রধান শিকার ছিল মিশরের সাধারণ জনগণ। বিদ্রোহ ও উপদলীয় সহিংসতার সময় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, করের ভারে পঙ্গু হয়ে গেছে তারা। তুর্কি বা সারকাসিয়ান, যাই হোক না কেন, শাসকদের সাথে তারা কোনওরকম ঐক্য বোধ করতে পারেনি, এরা ছিল বিদেশী ও জনগণের কল্যাণে কোনও আগ্রহ ছিল না তাদের। জনগণ ক্রমবর্ধমানহারে উলেমাদের শরনাপন্ন হচ্ছিল: মিশরিয় ছিলেন তাঁরা, শরীয়ার পবিত্র শৃঙ্খলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁরাই মিশরিয় জনগণের প্রকৃত নেতায় পরিণত হন। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে বে-দের ভেতরকার বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করলে মামলুক নেতৃবৃন্দ আবিষ্কার করেন যে, জনগণকে তাদের শাসন মেনে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে উলেমাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই।১৬
উলেমারা ছিলেন মিশরিয় সমাজের শিক্ষক, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী। প্রতিটি শহরে এক থেকে সাতটি মাদ্রাসা (ইসলামি আইন ও ধর্মতত্ত্ব পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল, এগুলোই ছিল দেশের শিক্ষকের যোগানদার। বুদ্ধিবৃত্তির মান খুব উন্নত ছিল না। প্রথম সেলিম মিশর দখল করে নেওয়ার পর প্রচুর মূল্যবান পাণ্ডুলিপিসহ বহু নেতৃস্থানীয় উলেমাকে সাথে করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অটোমান সাম্রাজ্যের একটা পশ্চাদপদ প্রদেশে পরিণত হয়েছিল মিশর। অটোমানরা আরব পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। মিশরিয়দের বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। মামলুক শাসনের সময় সমৃদ্ধি লাভ করা মিশরিয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ওষুধবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল।১৭
কিন্তু শাসক ও সাধারণ জনগণের ভেতর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম থাকায় উলেমাগণ যাপরনাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। এদের বেশিরভাগই এসেছিলেন ফেলাহীন কৃষক শ্রেণী থেকে, তাই পল্লী অঞ্চলে তাদের প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। কোরান স্কুল ও মাদ্রাসায় গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা; শরীয়া আদালতসমূহ বিচার ব্যবস্থার মুল কেন্দ্র থাকায় উলেমাগণ আইনি ব্যবস্থায়ও একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। এছাড়া, দিওয়ানে” গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদের অধিকারী ছিলেন তাঁরা এবং শরীয়াহর অভিভাবক হিসাবে সরকারের বিরুদ্ধে মূল বিরোধিতারও নেতৃত্ব দিতে পারতেন। বিখ্যাত মাদ্রাসা আল-আযহারের অবস্থান ছিল বাজারের পাশে, উলেমাদের সাথে বণিক শ্রেণীর শক্তিশালী সম্পর্ক ছিল। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলে তারা আযহারের মিনার থেকে বাজানো ঢাকের আওয়াজেই বাজার বন্ধ করে দিতে পারত ও লোকজনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে পারত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৭৯৪ সালে আযহারের রেক্টর শেখ আল-শারকাভি এক নতুন করারোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একে নির্যাতনমূলক ও অনৈসলামিক ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তিন দিন পরে বে-গণ কর প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৯ কিন্তু সরকার উৎখাত করে উলেমাদের সরকার গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থান পরিচালনার কোনও বাস্তব হুমকি ছিল না। বে-গণ সাধারণত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। মব ভায়োলেন্স প্রায়শঃই মামলুক সেনাবাহিনীর পক্ষে তেমন কোনও চলমান চ্যালেঞ্জ ছিল না। তা সত্ত্বেও উলেমাদের প্রাধান্য মিশরিয় সমাজকে একটা লক্ষযোগ্য ধর্মীয় চরিত্র দান করেছিল, ইসলামই মিশরের জনগণকে একমাত্র নিরাপত্তার যোগান দিয়েছিল।২১
অষ্টম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ছিল যারপরনাই মূল্যবান। এই সময় নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্য মারাত্মক অবনতির শিকারে পরিণত হয়। এর ষোড়শ শতকীয় সরকারের অসাধারণ দক্ষতা বিশেষ করে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় অযোগ্যতার জন্ম দেয়। বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল পাশ্চাত্য জগৎ। অটোমানরা আবিষ্কার করে যে তারা এখন আর আগের মতো ইউরোপের সাথে সমান তালে লড়তে পারছে না। পাশ্চাত্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল, সেটা রাজনৈতিক দুর্বলতার কালে ঘটছিল বলে নয়, বরং ইউরোপে গড়ে উঠতে থাকা এক নতুন সমাজের কোনও পূর্ব নজীর না থাকায়।২২ সুলতানগণ মানিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের প্রয়াস ছিল বাহ্যিক। উদাহরণ স্বরূপ, সুলতান তৃতীয় সেলিম (১৭৮৯-১৮০৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন) পাশ্চাত্য হুমকিকে কেবল সামরিক ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন। ১৭৩০-এর দশকে ইউরোপিয় ধাঁচে সেনাবাহিনীকে গড়ো তোলার ব্যর্থ প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৭৮৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করার পর সেলিম ফরাসী নির্দেশকসহ বেশ কয়েকটি সামরিক স্কুল খোলেন: ছাত্ররা এখানে ইউরোপিয় ভাষা ও গণিত, নৌচলাচল, ভূগোল ও ইতিহাসের বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে।২৩ অল্প কিছু সামরিক কৌশল শিক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞানের ভাসা ভাসা জ্ঞান অবশ্য পাশ্চাত্য হুমকিকে সামাল দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। কারণ ইউরোপিয়রা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জীবন ও চিন্তা ধারার বিকাশ ঘটিয়েছিল; ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেতায় কাজ করছিল তারা। তাদের নিজস্ব কৌশলে তাদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে অটোমানদের প্রয়োজন ছিল সমাজের ইসলামি কাঠামো ভেঙে একেবারে নতুন ধরনের যৌক্তিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো ও অতীতের সাথে সমস্ত পবিত্র সম্পর্ক ছেদ করতে প্রস্তুত থাকা। অভিজাত গোষ্ঠীর অল্প কিছু মানুষের পক্ষে হয়তো এই পরিবর্তন অর্জন করা সম্ভব ছিল, ইউরোপিয়দের যার জন্যে প্রায় তিনশো বছর লেগেছিল; কিন্তু সাধারণ জনগণকে কীভাবে তাঁরা এমন রেডিক্যাল পরিবর্তন মেনে নিতে ও উপলব্ধি করতে সম্মত করাতেন, যাদের মনমানসিকতা রক্ষণশীল রীতিনীতিতে পরিপূর্ণ?
ইউরোপের সীমান্তে যেসব জায়গায় অটোমান পতন অনেক বেশি প্রকট ছিল, সেখানকার জনগণ বরাবরের মতোই পরিবর্তন ও অস্থিরতার প্রতি সাড়া দিয়েছিল-ধর্মীয় কায়দায়। আরবীয় পেনিনসুলায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল- ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ইস্তাম্বুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মধ্য আরব ও পারসিয়ান গাল্ফ এলাকায় নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হন। আব্দ আল-ওয়াহহাব ছিলেন টিপিক্যাল ইসলামি সংস্কারক। মধ্যযুগীয় জুরেসপ্রুডেন্স, অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শন প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করে কোরান ও সুন্নাহয় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবিলার প্রয়াস পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে এসব যেহেতু আদি ইসলাম থেকে বিচ্যুতি, তাই আল-ওয়াহহাব অটোমান সুলতানদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিশ্বাসীদের আনুগত্য লাভের অযোগ্য ও মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের শরীয়া রাষ্ট্র সঠিক নয়। তার বদলে আল-ওয়াহহাব সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে খাঁটি ধর্মের একটা ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটা ছিল আক্রমণাত্মক আন্দোলন, বাহুবলে জনগণের উপর চেপে বসেছিল। এইসব সহিংস ও প্রত্যাখ্যানমূলক ওয়াহহাবীয় শিক্ষা আরও ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্থিরতার কাল বিংশ শতাব্দীর দিকে কিছু সংখ্যক মৌলবাদী ইসলামি সংস্কারকদের হাতে ব্যবহৃত হবে।২8
মরোক্কোর সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবন ইদ্রিসের (১৭৮০-১৮৩৬) সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আমাদের কালেও যার অনুসারী রয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে তাঁর সমাধান ছিল সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা ও তাদের ভালো মুসলিমে পরিণত করা। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে প্রচুর সফর করেছেন তিনি, সাধারণ জনগণের উদ্দেশে তাদের নিজস্ব ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন, সমবেত প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন ও অনৈতিক অনুশীলন থেকে তাদের বের করে আনতে চেয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন ছিল এটা। ওয়াহহাবী পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার অবকাশ ছিল না ইবন ইদ্রিসের। তাঁর চোখে শক্তি নয়, শিক্ষাই ছিল মূল চাবকাঠি। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা অবশ্যই ভ্রান্তি। অন্য সংস্কারকগণ একই পথে কাজ করেছেন। আলজেরিয়ায় আহমাদ আল-তিগরানি (মৃ. ১৮২৪), মদিনায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল-করিম শামীম (মৃ. ১৭৭৫) এবং লিবিয়ায় মুহাম্মদ ইবন আলি আল-সানুসি (মৃ. ১৮৩২)-এদের প্রত্যেকে উলেমাদের পাশ কাটিয়ে ধর্মকে সরাসরি মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। এটা ছিল জনমুখী সংস্কার, তাঁরা তাঁদের চোখে অভিজাতপন্থী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছেন; আব্দ আল-ওয়াহহাবের বিপরীতে মতবাদগত পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না তাঁরা। জনগণকে মূল কাল্টে ফিরিয়ে নিয়ে ও তাদের নৈতিকভাবে জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করে জটিল ফিকহের চেয়ে অনেক কার্যকরভাবে সমাজের অসুস্থতাকে দূর করা যাবে।
শত শত বছর ধরে সুফিগণ শিষ্যদের তাদের নিজস্ব জীবনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইম নতুন করে সৃষ্টি করার শিক্ষা দিয়ে এসেছেন; তারাও জোর দিয়ে বলেছেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথই হচ্ছে সৃজনশীল ও অতীন্দ্ৰিয় কল্পনা: মানুষের সুফিবাদের ধ্যানমূলক অনুশীলনের সাহায্যে অবশ্যই নিজের মতো থিওফ্যানি সৃষ্টি করার দায়িত্ব রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষে ও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এইসব সংস্কারকগণ-পণ্ডিতরা যাদের ‘নিও-সুফি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন—আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করার শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের আর পণ্ডিত ও বিদ্বান যাজকের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। ইবন ইদ্রিস এমনকি যত মহানই হোন না কেন, পয়গম্বর বাদে সকল মুসলিম সাধুর কর্তৃত্ব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করার মতো পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের যা কিছু নতুন তাকে মূল্য দিতে ও শ্রদ্ধার আলখেল্লাহ ঝেড়ে ফেলার উৎসাহ দিয়েছেন। অতীন্দ্রিয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া নয়, বরং পয়গম্বরের মানবীয় চরিত্রের সাথে গভীরভাবে একীভূত হওয়া-যিনি আল্লাহর কাছে নিজেকে এমনি নিখুঁতভাবে উন্মুক্ত করে তুলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এগুলো আধুনিক প্রবণতা ছিল। নিও-সুফিগণ পয়গম্বরের আদিআদর্শ ব্যক্তিত্বের মুখাপেক্ষী থাকলেও তারা যেন দুর্ভেয়মুখী নয় বরং মানবমুখী ধর্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটাচ্ছিলেন এবং শিষ্যদের যা কিছু নতুন ও উদ্ভাবনী শক্তির তাকে প্রাচীনের মতোই মূল্য দিতে শেখাচ্ছিলেন। পশ্চিমের সাথে ইবন ইদ্রিসের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তিনি কখনওই তাঁর লেখায় ইউরোপের কথা উল্লেখ করেননি, পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান বা তার প্রতি কোনও আগ্রহেরও প্রকাশ ঘটাননি। কিন্তু সুন্নি ইসলামের পৌরাণিক অনুশীলন তাঁকে ইউরোপিয় আলোকনের কিছু কিছু নীতিমালাকে আলিঙ্গন করতে চালিত করেছে।২৫
ইরানের ক্ষেত্রেও একই রকম ছিল ব্যাপারটা। এই দেশের এই সময়ের ইতিহাস মিশরের তুলনায় ভালোভাবে লিখিত আছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাফাভিয়রা ইরান জয় করে শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রের সরকারী ধর্মে পরিণত করে। এর আগে পর্যন্ত শিয়া মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অতীন্দ্রিয় নিগূঢ় অভিজাত আন্দোলন ছিল; নীতিগতভাবে শিয়ারা রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল। ইরানে সব সময়ই কিছু প্রধান শিয়া কেন্দ্র ছিল, তবে বেশির ভাগ শিয়াই ছিল আরব, পারসি নয়। সুতরাং, ইরানে সাফাভিয় পরীক্ষা ছিল এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। সুন্নি ও শিয়াদের ভেতর কোনও মতবাদগত বিরোধ নেই, পার্থক্যটা স্পষ্টতই আবেগজাত। সুন্নিরা মূলত মুসলিম ইতিহাসের বেলায় আশাবাদী, অন্যদিকে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি ট্র্যাজিক: পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) বংশধরদের পরিণতি শুভ ও অশুভ, ন্যায়বিচার ও স্বৈরাচারের মাঝে মহাজাগতিক যুদ্ধের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যেখানে দুষ্টই যেন সব সময় জয় লাভ করছে বলে মনে হয়। সুন্নিরা যেখানে মুহাম্মদের (স) জীবনকে মিথে পরিণত করেছে, শিয়ারা তাঁর বংশধরদের জীবনকে পুরাণে পরিণত করেছে। শিয়া বিশ্বাস উপলব্ধির জন্যে-যা না হলে ১৯৭৮-৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের মতো ঘটনাবলী বোধের অতীত-আমাদের অবশ্যই সংক্ষেপে শিয়া বিশ্বাসের বিকাশ বিবেচনা করতে হবে।
৬৩২ সালে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) পরলোকগমন করার সময় উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্যে কোনও ব্যবস্থা রেখে যাননি। তাঁর বন্ধু আবু বকর উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাধ্যমে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হন। অবশ্য কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে, মুহাম্মদ (স) হয়তো তাঁর নিকটতম পুরুষ আত্মীয় আলি ইবন আবি তালিবই তাঁর উত্তরাধিকারী হোক, এটাই চাইতেন, তিনি ছিলেন তাঁর পোষ্য, চাচাত ভাই ও মেয়ে জামাই। কিন্তু ৬৩৬ সালে চতুর্থ খলিফা হওয়ার আগ পর্যন্ত আলিকে বিভিন্ন নির্বাচনে ক্রমাগত বাদ দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শিয়ারা অবশ্য প্রথম তিন খলিফার শাসনকে স্বীকার করে না। আলিকেই তারা প্রথম ইমাম (‘নেতা’) আখ্যায়িত করে থাকে। আলির ধার্মিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি তাঁর অফিসারদের উদ্দেশে ন্যায়বিচার ভিত্তিক বিচারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে চিঠি লিখেছেন। অবশ্য ৬৩৬ সালে দুঃখজনকভাবে এক মুসলিম চরমপন্থীর হাতে নিহত হন তিনি। শিয়া- সুন্নি নির্বিশেষে এই ঘটনা শোকের সাথে স্মরণ করে থাকে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুয়াবিয়াহ খেলাফতের সিংহাসন দখল করে নেন এবং দামাস্কাস ভিত্তিক অধিকতর ইহজাগতিক উমাঈয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। আলির বড় ছেলে হাসান, শিয়ারা যাঁকে দ্বিতীয় ইমাম বলে থাকে, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ৬৬৯ সালে মদিনায় পরলোকগমন করেন। কিন্তু ৬৮০ সালে খলিফা মুয়াবিয়াহ মারা গেলে ইরাকের কুফায় আলির দ্বিতীয় ছেলে হুসেইনের পক্ষে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উমাঈয়াদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ এড়াতে হুসেইন মক্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেন, কিন্তু নতুন উমাঈয়া খলিফা ইয়াযিদ তাঁকে হত্যা করাতে মক্কার পবিত্রতা লঙ্ঘন করে পবিত্র নগরে দূত পাঠায়। তৃতীয় শিয়া ইমাম হুসেইন এই অন্যায় ও অপবিত্র শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দায়িত্ব মনে করেন। স্ত্রী ও সন্তানসহ পঞ্চাশ জনের একটা দল নিয়ে কুফার পথে রওয়ানা হন তিনি, ভেবেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারীদের এই করুণ মিছিলের দৃশ্য উম্মাহকে আবার ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু আরব দশম মাস মুহররমের আশুরার পবিত্র উপবাসের দিনে উমাঈয়া বাহিনী কুফার বাইরে কারবালার প্রান্তরে হুসেইনের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে। সবার শেষে নিহত হন হুসেইন, তখন তাঁর কোলে ছিল তাঁর শিশু পুত্র।২৬
কারবালা ট্র্যাজিডি নিজস্ব কাল্ট গড়ে তুলবে এবং প্রত্যেক শিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের এক সময়হীন ঘটনা, মিথে পরিণত হবে। ইয়াযিদ পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার ও অন্যায়ের মূর্ত প্রতীকে। দশম শতাব্দী নাগাদ সাধারণভাবে শিয়ারা আশুরার উপবাসের দিন হুসেইনের শাহাদাৎ বরণের বার্ষিকী পালন করে থাকে, তারা কাঁদে, নিজেদের শরীরে আঘাত করে মুসলিম রাজনৈতিক জীবনের দূষণের চিরন্তন বিরোধিতা ঘোষণা করে। কবিগণ শহীদ আলি ও হুসেইনের সম্মানে মহাকাব্যিক শোকগীতি আবৃত্তি করে থাকেন। এভাবে শিয়ারা কারবালার মিথোসের উপর ভিত্তি করে প্রতিবাদের ধার্মিকতা গড়ে তুলেছে। এই কাল্ট শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির মূল বিষয় সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগঘন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রেখেছে। আশুরা আচারের সময় শিয়ারা যখন ভাবগম্ভীর মিছিলে হেঁটে যায়, তখন তারা হুসেইনকে অনুসরণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এমনকি মৃত্যু বরণ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা দেয়। ২৭
এই মিথ ও কাল্ট গড়ে উঠতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। কারবালার পরের প্রথম কয়েক বছর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া হুসেইনের ছেলে আলি এবং তাঁর ছেলে মুহাম্মদ (যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম ইমাম নামে পরিচিত) মদিনায় চলে যান, তাঁরা কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রথম ইমাম আলি উমাঈয়া শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠা অনেকের কাছেই ন্যায়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। আব্বাসিয় উপদল যখন শেষ পর্যন্ত ৭৫০ সালে উমাঈয়া খেলাফত উৎখাত করে তাদের নিজেদের রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে (৭৫০-১২৬০), প্রথমে নিজেদের তারা শিয়া-ই আলি (আলির দল) বলে দাবি করেছিল। শিয়ারা আবার কিছু অদ্ভূত আঁচঅনুমানের সাথেও সম্পর্কিত ছিল, বেশির ভাগ মুসলিমই যাকে ‘চরম’ (গুলুউ) মনে করে। ইরাকে মুসলিমরা এক প্রাচীন ও আরও জটিল ধর্মীয় জগতের সংস্পর্শে এসেছিল এবং কেউ কেউ ক্রিশ্চান, ইহুদি বা যোরোস্ত্রিয় মিথলজিতে আকৃষ্ট হয়। কোনও কোনও শিয়া বলয়ে আলিকে জেসাসের মতো ঈশ্বরের অবতার হিসাবে দেখা হত; শিয়া বিদ্রোহীরা মনে করত তাদের নেতারা মারা যাননি বরং আত্মগোপনে (বা ‘অকাল্টেশন’) আছেন; একদিন তাঁরা ফিরে আসবেন, অনুসারীদের বিজয়ের পথে নিয়ে যাবেন। অন্যরা স্বর্গীয় আত্মার মানুষের সত্তায় অবতরণ ও তাকে স্বর্গীয় জ্ঞান দেওয়ার ধারণায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।২৮ এইসব মিথ এক পরিবর্তিত রূপে শিয়া নিগূঢ় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
হুসেইনের সম্মানে সৃষ্ট কাল্ট এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজিডিকে শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা মিথে পরিণত করেছে। এটা মানুষের খোদ অস্তিত্বে অব্যাহত কিন্তু অদৃশ্য শুভ ও অশুভের ভেতরকার সংগ্রামের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে; আচার অনুষ্ঠান হুসেইনকে তাঁর সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে তাঁকে এক জীবিত সত্তায় পরিণত করে; তিনি পরিণত হন গভীর সত্যের প্রতীকে। কিন্তু শিয়াবাদের পুরাণকে বাস্তব বিশ্বে বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। এমনকি আব্বাসিয় শাসকদের মতো শিয়ারা ক্ষমতা দখল করতে পারলেও রাজনৈতিক জীবনের কর্কশ বাস্তবতা বোঝায় যে তারা ওইসব উচ্চমার্গীয় আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে পারছিলেন না। আব্বাসিয় খলিফাগণ ইহজাগতিক দিক থেকে অত্যন্ত সফল ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর অল্প সময়ের ভেতরই শিয়া রেডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দিয়ে সাধারণ সুন্নিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁদের শাসন উমাঈয়াদের তুলনায় খুব বেশি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়নি; কিন্তু প্রকৃত শিয়াদের পক্ষে বিদ্রোহ করা ছিল অর্থহীন, কারণ প্রয়োজনের খাতিরেই যেকোনও বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হত। প্রকৃতপক্ষেই হুসেইনের মিথ যেন বোঝাতে চেয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের বিরোধিতা করার যেকোনও প্রয়াসই ব্যর্থ হতে বাধ্য, সেটা ন্যায়বিচারের পক্ষে যত ধার্মিক ও উৎসাহী হোক না কেন।
ষষ্ঠ শিয়া ইমাম জাফর আস-সাদিক (মৃ. ৭৬৫) এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী হিসাবে তিনিই উম্মাহর একমাত্র বৈধ নেতা (ইমাম) হলেও কোনও অর্থহীন বিরোধে জড়ানো সত্যিকারের কাজ নয়, বরং ঐশীগ্রন্থের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় শিয়াদের পথ নির্দেশ করাই তাঁর দায়িত্ব। আলির বংশের প্রত্যেক ইমাম, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর প্রজন্মের আধ্যাত্মিক নেতা। ইমামদের প্রত্যেকে তাঁর পূবসুরী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি তাঁকে স্বর্গীয় সত্যের গোপন জ্ঞান (‘ইলম) দিয়ে গেছেন। সুতরাং একজন ইমাম ভ্রান্তির অতীত আধ্যাত্মিক নির্দেশক ও নিখুঁত বিচারক। এভাবে শিয়ারা রাজনীতি ছেড়ে কোরানের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকানো গোপন (বাতিন) প্রজ্ঞা অনুভব করতে ধ্যানের কৌশল চর্চা করার মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদে সন্তুষ্ট ছিল না, নতুন দর্শনের ভিত্তি হিসাবে টেক্সটকে কাজে লাগাত তারা। তাদের ঐশী অনুপ্রাণিত ইমামের প্রতীকীবাদ পবিত্র সত্তার শিয়া অনুভূতি তুলে ধরে যা একজন অতীন্দ্রিয়বাদী এই উত্তাল বিপজ্জনক বিশ্বে সর্বব্যাপী ও সুগম হিসাবে আবিষ্কার করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপযোগী মতবাদ ছিল না এটা, একে তারা আনাড়ীভাবে ব্যাখ্যা করে বসতে পারত; তো শিয়াদের অবশ্যই তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিজের কাছে রাখতে হবে। জাফর আস-সাদিক কর্তৃক বিকশিত ইমামতির মিথলজি ছিল একটি কল্পনানির্ভর দর্শন যা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ও বাস্তব ভিত্তিক অর্থের অতীতে অনুসন্ধান ও ইতিহাসকে অদৃশ্যের (আল-গায়েব ) অটল, আদিম বাস্তবতা হিসাবে দেখে। দীক্ষা হীন যেখানে কেবল একজন মানুষকে দেখেছে, ধ্যানী শিয়া জাফর আস-সাদিকের মাঝে স্বর্গীয় আভাস দেখতে পেয়েছে।২৯
ইমামত দৈনন্দিন জীবনের সখুঁত ও ট্র্যাজিক পরিস্থিতিতে আল্লাহ’র ইচ্ছা বাস্তাবায়নের চরম অসুবিধাও প্রতীকায়িত করেছে। জাফর আস-সাদিক কার্যকরভাবে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, ধর্মবিশ্বাসকে ব্যক্তি পর্যায়ে এনে একে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বলয়ে সীমিত করেছেন। এটা তিনি করেছেন ধর্মকে বাঁচাতে ও এমন বিশ্বে একে বেঁচে থাকতে সক্ষম করে তুলতে যাকে আবিশ্যিকভাবেই এর প্রতি বৈরী মনে হয়। এক গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকেই এই সেক্যুলারাইজেশন নীতির উদ্ভব ঘটেছিল। শিয়ারা জানত ধর্মের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এক শতাব্দী পরে এটা করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৮৩৬ সালে আব্বাসিয় খলিফাগণ বাগদাদের আনুমানিক ষাট মাইল দক্ষিণে সামারায় রাজধানী সরিয়ে নেন। ততদিনে আব্বাসিয়দের শক্তি ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল, খলিফা গোটা মুসলিম বিশ্বের নামমাত্র শাসক থাকলেও সাম্রাজ্য জুড়ে মূল কর্তৃত্ব ছিল স্থানীয় আমির ও সর্দারদের হাতে। খলিফাগণ মনে করলেন এমন একটা অস্থির সময়ে তাঁদের পক্ষে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী ইমামদের এভাবে মুক্ত থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। ৮৪৮ সালে খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল দশম ইমাম আলি আল-হাদিকে মদিনা থেকে সামারায় তলব করেন। এখানে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। তিনি ও তাঁর ছেলে একাদশ ইমাম হাসান আল- আশারি শিয়াদের সাথে কেবল প্রতিনিধি (ওয়াকিল)-র মারফত যোগাযোগ রাখতে পারছিলেন। বাগদাদের বাণিজ্য এলাকা আল-কার্খ-এ থেকে আব্বাসিয় কর্তৃপক্ষের মনোযোগ এড়াতে ব্যবসা করত তারা।
৮৭৪ সালে একাদশ ইমাম পরলোকগমন করেন, সম্ভবত খলিফার ইঙ্গিতে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তাঁকে। তাঁকে এমন ভীষণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে শিয়ারা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। তাঁর কি কোনও ছেলে ছিল? যদি না থাকে তো কে তাঁর উত্তরাধিকারী হবে? তাঁর বংশধারা কি শেষ হয়ে গেছে? যদি তাই হয়, তার মানে কি তবে শিয়ারা অতিন্দ্রীয় নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে? প্রবল হয়ে উঠেছিল আঁচঅনুমান, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ জোরের সাথে জানাল যে, হাসান আল-আশারির সত্যিই একজন ছেলে ছিল, আবু আল কাসিম মুহাম্মদ, দ্বাদশ ইমাম; জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন তিনি। আকর্ষণীয় সমাধান ছিল এটা, কারণ এখানে বোঝানো হয়েছে যে কিছুই বদলায়নি। শেষ দুজন ইমাম কার্যত অগম্য ছিলেন। এখন গোপন ইমাম তাঁর ওয়াকিল উসমান আল-আমরির মারফত জনগণের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারবেন। এই ওয়াকিল আধ্যাত্মিক পরামর্শ দিতে পারবেন, যাকাতের দান সংগ্রহ করবেন, ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যা করবেন ও আইনি সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু এই সমাধানের আয়ু ছিল সীমিত। দ্বাদশ ইমামের জীবিত থাকার সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ামাত্র শিয়ারা আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করল। তারপর ৯৩৪ সালে বর্তমান প্রতিনিধি আলি ইবন মুহাম্মদ আস-সামাররি গোপন ইমামের কাছ থেকে শিয়াদের জন্যে এক বার্তা নিয়ে এলেন। তিনি পরলোকগমন করেননি। বরং আল্লাহ অলৌকিকভাবে তাঁকে আড়াল করেছেন; শেষ বিচারের আগে আগে ন্যায়বিচারের যুগের সুচনা ঘটাতে আবার ফিরে আসবেন তিনি। এখনও তিনি শিয়াদের ভুলের অতীত নির্দেশক ও উম্মাহর একমাত্র বৈধ শাসক রয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাসীদের সাথে তিনি আর প্রতিনিধি মারফত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবেন না। শিয়াদের তাঁর দ্রুত প্রত্যাবর্তন আশা করা ঠিক হবে না। তারা তাঁকে কেবল ‘দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাবার পর ও পৃথিবী স্বৈরাচারে পরিপূর্ণ হলেই আবার দেখতে পাবে।’৩১
গোপন ইমামের ‘অকাল্টেশনে’র মিথ যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেবল অতীন্দ্রিয়বাদ ও আচরিক অনুশীলনের প্রেক্ষাপটেই এটা অর্থ প্রকাশ করে। আমরা যদি গল্পটি লোগোস হিসাবে বুঝে থাকি, বাস্তব ঘটনার মামুলি বিবরণ হিসাবে যদি আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সবরকম প্রশ্ন উঠে আসে। ইমাম গেছেন কোথায়? তিনি পৃথিবীতেই আছেন নাকি কোনও ধরনের মধ্যবর্তী বলয়ে? সেখানে তাঁর জীবন কেমন হতে পারে? তিনি কি ক্রমেই বুড়িয়ে যাচ্ছেন? বিশ্বাসীরা তাঁকে দেখতে বা তাঁর কথা শুনতে না পেলে কেমন করে তিনি তাদের পথ দেখাবেন? যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মনের অধিকতর স্বজ্ঞামূলক শক্তির উপর নির্ভরশীল বাতিন বা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থের সুশৃঙ্খল অনুশীলনে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও শিয়ার কাছে এইসব প্রশ্ন ভোঁতা মনে হবে। শিয়ারা তাদের ঐশীগ্রন্থ ও মতবাদ আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করেনি। তাদের সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা অদৃশ্যের (আল-গায়েব) প্রতীকী অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল যা বাইরের যাহির) ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে থাকে। শিয়ারা এক অদৃশ্য, দুর্বোধ্য আল্লাহর উপাসনা করে থাকে, কোরানের গুপ্ত অর্থের সন্ধান করে, এক গোপন ইমামের আকাঙ্ক্ষায় ছিল তারা, ন্যায় বিচারের জন্যে অন্তহীন কিন্তু অদৃশ্য লড়াইতে অংশ নিয়েছে এবং ইসলামের এক নিগূঢ় ভাষ্য চর্চ্চা করেছে যাকে পার্থিব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে।২ এই ব্যাপক ধ্যানমুখী জীবনই ছিল অকাল্টেশনের মানে তুলে ধরা পটভূমি। গোপন ইমাম মিথে পরিণত হয়েছিলেন, স্বাভাবিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে সময় ও কালের সীমা থেকে মুক্ত করা হয়েছে; প্যারাডক্সিকালি তিনি ও অন্যান্য ইমাম মদিনা বা সামারায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সময় যতখানি ছিলেন তারচেয়ে ঢের বেশি উজ্জ্বল সত্তায় পরিণত হয়েছিলেন। অকাল্টেশন এমন এক মিথ যা আমাদের পবিত্রের বোধকে অধরা ও হতবুদ্ধিকরভাবে অনুপস্থিত রূপে তুলে ধরে। জগতে উপস্থিত থাকলেও এটা এর অংশ নয়; স্বর্গীয় প্রজ্ঞা মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য (কারণ মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কেবল ঈশ্বরসহ কোনও কিছু সম্পর্কে ধারণা করতে পারি), কিন্তু আমাদের তা সাধারণ নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে নিয়ে যায়। অন্য যেকোনও মিথের মতো অগোছাল যুক্তি দিয়ে অকাল্টেশন বোঝা যাবে না, যেন বা তা স্বয়ংপ্রকাশিত সত্যি বা যৌক্তিক প্রদর্শনীর উপযুক্ত। বরং তা মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় একটি মিথকে তুলে ধরে।
যেকোনও নিগূঢ় আধ্যাত্মিকতার মতো শিয়া মতবাদ এই পর্যায় পর্যন্ত কেবল অভিজাত গোষ্ঠীর ব্যাপার ছিল। অতীন্দ্রিয় ধ্যনের মেধা ও চাহিদা সম্পন্ন অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুঃসাহসী মুসলিমরাই এতে আকৃষ্ট হচ্ছিল বেশি। কিন্তু শিয়াদের অন্য মুসলিমদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সুন্নি ইসলামের আচার ও অনুশীলন যেখানে সুন্নি মুসলিমদের জীবন যেমন সেভাবেই মেনে নিয়ে আদর্শ জগতের রীতিনীতি মোতাবেক চলতে সাহায্য করেছে সেখানে শিয়া অতীন্দ্রিয়বাদ স্বর্গীয় অসন্তোষ তুলে ধরেছে। অকাল্টেশনের মতবাদ প্রচারিত হওয়ার অল্প পরেই বিকাশ লাভ করা প্রথম দিকের ট্র্যাডিশনসমূহ দশম শতাব্দীতে বহু শিয়ার অনুভূত হতাশা ও অক্ষমতা তুলে ধরেছে। একে বলা হত “শিয়া শতাব্দী’, কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের বহু অধিনায়ক যারা কোনও এক বিশেষ এলাকায় কার্যকর ক্ষমতা ভোগ করতেন তাদের প্রায় সবারই শিয়া মতবাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু সেকারণে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। কোরানের পরিষ্কার শিক্ষা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে জীবন তখনও ছিল অন্যায় ও সমতাহীন। প্রকৃতপক্ষেই, সকল ইমামই শিয়াদের চোখে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ট্র্যাডিশন আছে যে, উমাঈয়া ও আব্বাসিয় খলিফারা হুসেইনের পরের প্রত্যেক ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন। আরও ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও উদার সামাজিক ব্যবস্থার পক্ষে তাদের আকাঙ্ক্ষা থেকে শিয়ারা শেষ যুগে গোপন ইমামের চূড়ান্ত আবির্ভাব (যুহুর)-এর উপর ভিত্তি করে পরকালতত্ত্বের বিকাশ ঘটায়, যখন তিনি ফিরে এসে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন ও চূড়ান্ত বিচারের আগে ন্যায়বিচার ও শান্তির এক সোনালি যুগের প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু সমাপ্তির জন্যে এই আকাঙ্ক্ষার মানে শিয়ারা রক্ষণশীল রীতি ত্যাগ করে ভবিষ্যৎমুখী হয়ে গেছে, এমন ছিল না। তারা আদি আদর্শ জগতের প্রতি এত প্রবলভাবে সজাগ ছিল, পরিস্থিতির যেমনটা হওয়া উচিত ছিল, তাদের চোখে সাধারণ রাজনৈতিক জীবন অসহনীয় ঠেকেছে। গোপন ইমাম এই বিশ্বে নতুন কিছু নিয়ে আসবেন না, তিনি স্রেফ মানুষের ইতিহাসকে পরিশুদ্ধ করবেন যাতে মানুষের কর্মকাণ্ড অস্তিত্বের মৌলিক নীতিমালার অনুগামী হয়। একইভাবে ইমামদের ‘আবির্ভাব’ গভীরতর অর্থে সব সময় অস্তিত্ব ছিল এমন কিছুকে প্রকাশ করবে মাত্র, কারণ গোপন ইমাম শিয়ার জীবনে এক ধ্রুব অস্তিত্ব, তিনি আল্লাহর অধরা আলোকে এক অন্ধকার স্বৈরাচারী পৃথিবীতে তুলে ধরেন এবং তিনিই আশার একমাত্র উৎস।
ষষ্ঠ ইমাম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিসর্জন দিয়ে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সূচিত অকাল্টেশন শিয়া ইতিহাসের পুরাণে রূপান্তরের কাজটি শেষ করেছিল। মিথ বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে কোনও নীল নকশার যোগান দেয় না, বরং বিশ্বাসীকে তার সমাজের দিকে চোখ ফেরাতে ও অন্তস্থঃ জীবনকে বিকাশ করতে শেখায়। অকাল্টেশনের মিথ শিয়াদের চিরকালের মতো বিরাজনীতি করে দিয়েছিল। জাগতিক শাসকদের শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অর্থহীন ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই শিয়াদের। যাকে আত্মগোপনে যেতে হয়, চলমান বিশ্বে বাস করতে অক্ষম ন্যায়বিচারক একজন ইমামের ইমেজ শিয়াদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাই তুলে ধরে। যুগের প্রকৃত প্রভু গোপন ইমামের কর্তৃত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে বলে এই নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনও সরকারকেই অবৈধ বিবেচনা করতে হয়েছে। সুতরাং, পার্থিব শাসকদের কাছ থেকে কিছুই আশা করার ছিল না, যদিও বেঁচে থাকার স্বার্থে শিয়াদের অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করবে তারা, কেবল ‘দীর্ঘ সময় শেষে’ শেষ যুগেই পৃথিবীতে আসন্ন এক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা করবে। তারা কেবল ইমামদের সাবেক ‘প্রতিনিধি’দের স্থান গ্রহণকারী শিয়া উলেমাদের একক কর্তৃত্বই মেনে নেবে। শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা ও স্বর্গীয় আইনে দক্ষতার কারণে উলেমাগণ গোপন ইমামের সহকারীতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাঁর নামে বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু সকল সরকারই অবৈধ থাকায় উলেমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।৩৪
এভাবে শিয়ারা নীরবে রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলারাজেইশন সমর্থন দিয়েছিল যাকে তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি নীতির লঙ্ঘন মনে হতে পারে, যেখানে রাষ্ট্র ও ধর্মের এজাতীয় বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এক ধর্মীয় দর্শন থেকে এই বিচ্ছিন্নতার মিথলজির উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সকলেই গুপ্তহত্যার শিকার, কারাবন্দি, দেশান্তরী এবং সবশেষে খলিফাদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন এমন ইমামদের কিংবদন্তী রাজনীতি ও ধর্মের মৌল সমন্বয়হীনতা তুলে ধরে। রাজনৈতিক জীবন লোগোসের এখতিয়ার, একে অবশ্যই ভবিষ্যৎমুখী, বাস্তবভিত্তিক হতে হবে, একে আপোস করতে জানতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, যৌক্তিক ভিত্তিতে সমাজকে সংগঠিত করতে হবে। একে ধর্মের চরম চাহিদা ও জমিনে জীবনের গম্ভীর বাস্তবতার ভেতর ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। প্রাক আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ একটি মৌলিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল, এটা কৃষকদের শ্রমের উপর নির্ভর করত যারা সভ্যতার ফল ভোগ করতে পারত না। অ্যাক্সিয়াল যুগের (c. ৭০০-২০০ বিসিই) মহান কনফেশনাল ধর্মগুলোর সবকটাই এই টানাপোড়েনে ব্যস্ত ছিল, একে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। সম্পদের পরিমাণ যেখানে অপ্রতুল আর যেখানে প্রযুক্তি ও যোগাযোগের অভাব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কঠিন করে তোলে, সেখানে রাজনীতি অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও আগ্রাসীভাবে বাস্তবভিত্তিক হয়ে ওঠে। সুতরাং, যেকোনও সরকারের পক্ষে ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা বা এর ঘাটতিসমূহ দুঃখজনকভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া স্বর্গীয় প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক ইমামদের অস্তিত্ব সহ্য করা ছিল অসম্ভব। ধর্মীয় নেতারা যাচ্ছেতাই অপচয়ের বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনা বা প্রতিবাদ জানাতে পারতেন, কিন্তু এক ধরনের করুণ অর্থে পবিত্রকে হয় প্রান্তিকায়িত বা সীমার ভেতর রাখতে হয়েছে, যেমন করে খলিফাগণ সামারার আসকারী দুর্গে ইমামদের আটক করে রেখেছিলেন। কিন্তু এক আদর্শের প্রতি শিয়া ভক্তিতে মাহাত্ম্য ছিল যাকে অবশ্যই টিকিয়ে রাখার দরকার ছিল, যদিও গোপন ইমামের মতো সেটা ছিল সুপ্ত এবং বর্তমানে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিশ্বে কাজ করতে অক্ষম।
শিয়া মতবাদ পৌরাণিক ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হলেও তার মানে তা অযৌক্তিক ছিল না। আসলে শিয়াবাদ সুন্নাহর চেয়ে ইসলামের অধিকতর যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিয়ারা আবিষ্কার করেছিল যে, তারা মুতাযিলি নামে পরিচিত সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিকদের সাথে সহমত পোষণ করে। কোরানের বিভিন্ন মতবাদকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এরা। অন্যদিকে মুতাযিলিরাও শিয়া মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। প্যারাডক্সিকালি অকাল্টেশনের অযৌক্তিক মতবাদ শিয়া উলেমাদের সুন্নি উলেমাদের চেয়ে কর্মকাণ্ডের বাস্তব জগতে তাদের অনেক বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের স্বাধীনতা দিয়েছিল। গোপন ইমাম আর নাগালের মধ্যে না থাকায় বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হত তাদের। সুতরাং, শিয়া মতবাদে সুন্নাহর মতো ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ কোনওদিনই রুদ্ধ হয়নি।৩৫ এটা ঠিক, শিয়ারা প্রথমে ইমাম অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ একজন বিশিষ্ট ও জ্ঞানী শিয়া যাজক ঠিক মুজতাহিদ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, ইজতিহাদের যৌক্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতাশালী বলে মনে করা হত তাঁকে।
অবশ্য শিয়া যুক্তিবাদ আমাদের বর্তমান পাশ্চাত্যের সেক্যুলারাইজড যুক্তিবাদ হতে ভিন্ন ছিল। শিয়ারা প্রায়শঃই সমালোচনামুলক চিন্তাবিদ ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, একাদশ শতাব্দীর পণ্ডিত মুহাম্মদ আল-মুইদ ও মুহাম্মদ আল-তুসি পয়গম্বর ও তাঁর কয়েকজন সহচরের হাদিস প্রতিবেদনের সঠিকতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁদের মতবাদের সমর্থনে এইসব অবিশ্বস্ত ট্র্যাডিশন উদ্ধৃত করা যথেষ্ট হবে না, বরং তার বদলে যাজকদের উচিত হবে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা; কিন্তু তারপরেও তাঁদের তুলে ধরা যৌক্তিক বক্তব্য আধুনিক সংশয়বাদীকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ, তুসি ইমামতের মতবাদ ‘প্রমাণ’ করতে গিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যেহেতু আল্লাহ শুভ ও তিনি আমাদের মুক্তি চান, তো এটা বিশ্বাস করাই যুক্তিসঙ্গত যে তিনিই আমাদের অনির্বচনীয় পথ-নির্দেশ যোগাবেন। নারী-পুরুষ সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু স্বর্গীয় বিধি এই বিষয়টিকে আরও জরুরি করে তোলে। এমনকি তুসিও অকাল্টেশনের পক্ষে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে দিশাহারা বোধ করেছেন।৩৬ কিন্তু শিয়াদের কাছে এটা অস্বস্তিকর ছিল না। মিথোস ও লোগোস, যুক্তি ও প্রত্যাদেশ, পরস্পর বিরোধী ছিল না, বরং স্রেফ একটি অপরটি থেকে ভিন্ন এবং সম্পূরক। আধুনিক পশ্চিমে আমরা যেখানে সত্যির উৎস হিসাবে মিথোলজি ও অতীন্দ্রিয়বাদকে নাকচ করে কেবল যুক্তির উপর নির্ভর করে থাকি; তুসির মতো একজন চিন্তাবিদ চিন্তার উভয় পথকেই বৈধ ও প্রয়োজনীয় হিসাবে দেখেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, অতীন্দ্রিয় ধ্যানে মগ্ন থাকার সময় নিখুঁত অর্থ প্রকাশকারী মতবাদসমূহ ইসলামি প্রেক্ষিতেও যুক্তিসঙ্গত। ধ্যানের অন্তর্মুখী কৌশলসমূহ এমন অন্তর্দৃষ্টির যোগান দেয় যেগুলো তাদের নিজস্ব বলয়ে সঠিক, কিন্তু সেগুলোকে লোগোসের সৃষ্টি কোনও গাণিতিক সমীকরণের মতো যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রমাণ করা যাবে না।
পঞ্চদশ শতকের শেষ নাগাদ, আমরা যেমন দেখেছি, বেশিরভাগ শিয়াই আরব ছিল এবং শিয়াবাদ বিশেষত ইরাকে দুটি উপাসনালয়ের শহর যথাক্রমে ইমাম আলি ও ইমাম হুসেইনের প্রতি নিবেদিত নাজাফ ও কারবালায় শক্তিশালী ছিল। বেশিরভাগ ইরানিই ছিল সুন্নি, যদিও ইরানি শহর কুম সব সময়ই শিয়াদের কেন্দ্র ছিল। রাঈ, কাশা ও খোরাশানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়ার বাস ছিল। তো সুফিবাদের সাফাভিয় ধরনের নেতা উনিশ বছর বয়স্ক শাহ ইসমাইলকে স্বাগত জানানোর মতো ইরানি ছিল। ১৫০১ সালে তাব্রিয দখল করেন তিনি ও পরের এক দশকের মধ্যেই ইরানের বাকি অংশ অধিকার করে নেন। তিনি ঘোষণা করেন, শিয়া মতবাদই নতুন সাফাভিয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র ধর্ম হবে। নিজেকে সপ্তম ইমামের বংশধর দাবি করেছিলেন ইসমাইল, যা তাঁকে অন্য মুসলিম শাসকদের যা ছিল না সেই বৈধতা দিয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ৩৭
কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই শিয়া ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি ছিল। ‘দ্বাদশবাদী’ (দ্বাদশ ইমামের প্রতি তাদের শ্রদ্ধার কারণে) অধিকাংশ শিয়া বিশ্বাস করত যে, গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকারই বৈধ হতে পারে না।৩৮ তাহলে কেমন করে ‘রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদ’ থাকতে পারে? এতে অবশ্য ইসমাইলের কোনও সমস্যা হয়নি। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিল না তাঁর। মঙ্গোল আগ্রাসনের অব্যবহতি পরে প্রতিষ্ঠিত অতীন্দ্রিয় ভ্রাতৃসংঘ সাফাভিয় গোষ্ঠী মূলত সুফি সংস্থা ছিল কিন্তু প্রাচীন শিয়া মতবাদের বহু ‘চরম’ (গুলুউ) ধারণা গ্রহণ করেছিল। ইসমাইল বিশ্বাস করতেন যে, ইমাম আলি স্বর্গীয় ছিলেন, এবং স্বর্ণযুগের উদ্বোধন ঘটাতে অচিরেই ফিরে আসবেন শিয়া মেসায়াহ। তিনি হয়তো শিষ্যদের এও বলে থাকতে পারেন যে, তিনিই সেই গোপন ইমাম, অড়াল ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন। সাফাভিয় ব্যবস্থা ছিল প্রান্তিক, জনপ্রিয়তামুখী বিপ্লবী দল, শিয়া বিশেষ নিগূঢ় ধারা থেকে অনেক ভিন্ন।৩৯ শিয়া রষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসমাইলের কোনও রকম দ্বিধা ছিল না, জাফর আস-সাদিকের আমল থেকেই শিয়ারা যেমন করে আসছিল, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে একটা সভ্য মোদাস ভিভেন্দি’র খোঁজ করার বদলে ধর্মান্ধভাবে সুন্নি বিরোধী ছিলেন তিনি। অটোমান ও সাফাভিয় সাম্রাজ্যে এক নতুন উপদলীয় অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছিল; একই সময়ে ইউরোপে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের ভেতর দেখা দেওয়া বিবাদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না সেটা। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমানরা তাদের এলাকায় শিয়াদের প্রান্তিকায়িত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। ইসমাইল যখন ইরানে আবির্ভূত হন, তিনিও সমানভাবে সেখানকার সুন্নাহকে নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
অবশ্য সাফাভিয়দের এটা আবিষ্কার করতে বেশি সময় লাগেনি যে, বিরোধী অবস্থানে থাকার সময় মেসিয়ানিক ‘চরমপন্থী’ আদর্শ কাজে এলেও এখন ক্ষমতায় আসার পর সেটা জুৎসই ঠেকছে না। প্রাচীন গুলুউ ধর্মতত্ত্ব মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শাহ প্রথম আব্বাস (১৫৮৮-১৬২০) আমলাতন্ত্র থেকে চরমপন্থীদের বরখাস্ত করেন। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি প্রচারের জন্যে আরব থেকে শিয়া উলেমাদের আমদানি করেন তিনি। নতুন রাজধানী ইস্পাহান ও হিল্লায় তাঁদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, তাঁদের পক্ষে সম্পত্তি অর্পণ করেন (ওয়াকফ) ও উদার হাতে তাঁদের উপহার দেন। গোড়ার দিকে এই পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন ছিল, কারণ নতুন অভিবাসী হিসাবে উলেমারা শাহর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু অনিবার্যভাবে শিয়া মতবাদের প্রকৃতি পাল্টে দিয়েছিলেন। শিয়ারা সব সময়ই সংখ্যালঘু দল ছিল। তাদের নিজস্ব মাদ্রাসা ছিল না, সব সময়ই একে অন্যের বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন, বিতর্ক করেছেন। এখন শিয়ারা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছিল। ইস্পাহান শিয়া মতবাদের সরকারী বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়।৪১ শিয়ারা সব সময়ই এর আগে সরকার থেকে দূরে অবস্থান করেছে, কিন্তু এখন উলেমাগণ ইরানের শিক্ষা ও আইনি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং আরও নির্দিষ্টভাবে সরকারের ধর্মীয় দায়িত্বও হাতে তুলে নিয়েছিলেন। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ছিল ইরানিদের সমন্বয়ে গঠিত, তখনও সুন্নাহর প্রতি অনুগত ছিল তারা, সুতরাং, তাদের আরও বেশি সেক্যুলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইরানি সরকারে সেক্যুলার ও ধর্মীয় বলয়ে একটা চলমান বিভাজন দেখা দিয়েছিল।৪২
উলেমগণ অবশ্য সাফাভিয় রাষ্ট্র সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তখনও তাঁরা সরকারী পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, নিজেদের প্রজা হিসাবে দেখতেই পছন্দ করতেন। সুতরাং, তাদের অবস্থান ছিল অটোমান উলেমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু সহজাতভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। শাহদের উদারতা ও পৃষ্ঠপোষকতা উলেমাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে দিয়েছিল। অটোমান ও তাদের উত্তরাধিকারীরা যেখানে সব সময়ই ভর্তুকী প্রত্যাহার বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে উলেমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, সেখানে শিয়া উলেমাদের এভাবে ভয় দেখানোর উপায় ছিল না। ইরানি জনগণের মাঝে শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তাঁরা এই বাস্তবতা থেকে লাভবান হচ্ছিলেন যে শাহগণ নন, বরং তাঁরাই গোপন ইমামের একমাত্র প্রকৃত মুখপাত্র। অবশ্য গোড়ার দিকের সাফাভিয়রা উলেমাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরানের জনগণ পুরোপুরি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার আগে যাজকগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিজেদের মতো হয়ে উঠতে পারেনি।
কিন্তু ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে। উলেমাগণ সাফাভিয় সাম্রাজ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ ও এমনকি গোঁড়া হয়ে উঠতে লাগলেন। শিয়া মতবাদের কিছু অধিকতর আকর্ষণীয় গুণাবলী চাপা পড়ে যায়। এই নতুন কঠোর পন্থা মূর্ত করে তোলেন সর্বকালের অন্যতম ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী উলেমা মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃ. ১৭০০)। শত শত বছর ধরে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের এক ধরনের উদ্ভাবনী প্রকৃতির কৌশল অনুসরণ করে এসেছে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় ও দার্শনিক আঁচঅনুমানের প্রবল বিরোধী ছিলেন মজলিসি। দুটোই ছিল প্রাচীন নিগূঢ়বাদী শিয়া মতবাদের মূলধারা। তিনি ইরানে অবশিষ্ট সুফিদের উপর নিরলসভাবে নির্যাতনের সূচনা করেন ও ফালসাফাহ নামে পরিচিত দার্শনিক যুক্তিবাদ ও ইস্ফাহানে অতীন্দ্রিয় দর্শন দমন করার প্রয়াস পান। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের প্রতি এক গভীর অবিশ্বাসের সূচনা করেছিলেন তিনি এখনও যা বর্তমান ইরানে টিকে আছে। কোরানের নিগূঢ় পাঠে মগ্ন হওয়ার বদলে শিয়া পণ্ডিতদের ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্স ফিকহর প্রতি মনোনিবেশে উৎসাহিত করা হয়েছে।
হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত আচরিক মিছিলের অর্থও পাল্টে দিয়েছিলেন মজলিসি।” আরও বিস্তৃত হয়ে উঠেছিল এসব: এখন সবুজ কাপড়ে ঢাকা উটের পিঠে ইমামের পরিবারের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রন্দনরত নারী ও শিশুরা বসে থাকে, সৈনিকরা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গভর্নর, গণ্যমান্য লোকজন ও মানুষের জটলা ইমাম ও তাঁর শাহাদৎ বরণকারী সহচরদের প্রতীক কফিন অনুসরণ করে, এরা ছুরি দিয়ে নিজেদের আঘাত হেনে আহত করে।৫ কারবালা কাহিনীর দারুণ আবেগঘন বর্ণনা-রাওদা-খানি (‘রাওদাতের আবৃত্তি’) নামে পরিচিত বিশেষ অনুষ্ঠানে ইরাকি শিয়া ওয়াইজ কাশিফট (মৃ. ১৫০৪) রচিত রাওদাহ আশ-শাহাদা রাওদা-খানি জমায়েতে আবৃত্তি করা হত, জনতা জোরে চিৎকার করে বিলাপ করত, কাঁদত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে লড়াই করার জনগণের ইচ্ছা তুলে ধরায় এইসব আচারের সবসময়ই এক ধরনের বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল। এখন অবশ্য, জনগণকে হুসেইনকে একটা নজীর হিসাবে দেখার জন্যে উৎসাহিত করার পরিবর্তে মজলিসি ও তাঁর যাজকগোষ্ঠী শিক্ষা দিতে লাগলেন যেন তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিবেচনা করা হয় যিনি তাঁর মৃত্যুর জন্যে শোক প্রকাশ করার মাধ্যমে ভক্তি দেখাতে পারলে তাদের বেহেশতে গমন নিশ্চিত করতে পারবেন। এবার স্থিতাবস্থার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে আচার অনুষ্ঠানগুলো জনগণকে শক্তিমানের পক্ষে আনুকূল্য দেখিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখার শিক্ষা দিয়েছে। ৬ এটা ছিল পুরোনো শিয়া আদর্শের নপুংসকীকরণ ও অবমূল্যায়ন; এটা রক্ষণশীল রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। জনগণকে অস্তিত্বের মৌল বিধিবিধান ও ছন্দের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার বদলে কাল্টকে কেবল বিপুল জনগোষ্ঠীকে সামাল দিয়ে রাখার কাজে লাগানো হয়েছে। এটা এমন এক পরিবর্তন ছিল যা সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে দেখায় যে, বিধ্বংসী রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর্মের কী ক্ষতি করতে পারে।
মজলিসির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ইস্ফাহানে মির দামাদ (মৃ. ১৬৩১) ও শিষ্য মোল্লাহ সম্রা (মৃ. ১৬৪০) হাতে বিকশিত অতীন্দ্রিয় দর্শন। সদ্রা এমন একজন চিন্তাবিদ ছিলেন ভবিষ্যৎ ইরানি প্রজন্মের উপর যার গভীর প্রভাব সৃষ্টি হবে।৪৭ মির দামাদ ও মোল্লাহ সদ্রা উলেমাদের কারও কারও নতুন অনমনীয় মনোভাবের দারুণ বিরোধী ছিলেন। একে তাঁরা শিয়া মতবাদ, এমনকি প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মের সামগ্রিক বিকৃতি বলে বিবেচনা করেছেন। প্রাচীন কালে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থ সন্ধানের সময় নীরবে মেনে নিয়েছিল যে স্বর্গীয় সত্যি সীমানাহীন, নতুন নতুন ধারণা সব সময়ই সম্ভব; কোরানের কোনও একক ব্যাখ্যা যথেষ্ট হতে পারে না। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রার চোখে সত্যিকারের জ্ঞান কোনওদিনই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার ব্যাপার ছিল না। কোনও সাধু বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই, তিনি যত মহান বা বিশিষ্টই হোন না কেন, সত্যির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবি করতে পারেন না।
তাঁরা স্পষ্টভাবে রক্ষণশীল বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন যে মিথোলজি ও যুক্তি উভয়ই মানব জীবনের পক্ষে আবশ্যক, একটি দিয়ে সম্পূরক না হলে অপরটি হারিয়ে যায়। মির দামাদ ছিলেন স্বভাব বিজ্ঞানী এবং ধর্মতাত্ত্বিকও। মোল্লা সদ্রা উলেমাদের পৌরাণিক স্বজ্ঞার দর্শনকে খাট করার জন্যে ও যৌক্তিক চিন্তার গুরুত্বকে বিসর্জন দিতে সুফিদের সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত দার্শনিককে অ্যারিস্টটলের মতো যুক্তিবাদী হতে হবে, কিন্তু তারপরই তাঁকে নিজেকে অতিক্রম করে সত্যের এক নিগূঢ় কল্পনা নির্ভর উপলব্ধিতে পৌঁছুতে হবে। উভয় চিন্তকই অবচেতনের ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, একে তাঁরা এমন এক পর্যায় হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা ইন্দ্রিয়জ ধারণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিমূর্ততায় অস্তিত্ববান। অতীতে সুফি দার্শনিকগণ এই মনস্তাত্ত্বিক অঞ্চলকে আলম আল-মিথাল বা খাঁটি ইমেজের জগৎ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টির বলয় এটা, আমরা যাকে অবচেতন বলব সেখান থেকে আগত, স্বপ্ন ও সম্মোহনী ইমেজারিতে যা মনের চেতন স্তরে উঠে আসে, কিন্তু অতীন্দ্রিয়দের কোনও কোনও অনুশীলন ও স্বজ্ঞামূলক চর্চার মাধ্যমেও যার নাগাল পাওয়া সম্ভব। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রা দুজনই জোর দিয়ে বলেছেন যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেও এইসব দিব্য দর্শন কেবল ধারণাগত কল্পনা নয়, বরং এসবের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা রয়েছে। এগুলোকে ‘কাল্পনিক’ বলে অবাস্তব হিসাবে বাতিল করার বদলে-একজন আধুনিক যুক্তিবাদী যেমনটা করতে পারে-আমাদের উচিত হবে আমাদের অস্তিত্বের এই পার্থক্যের দিকে নজর দেওয়া। সচেতন নির্মাণের পক্ষে এর অবস্থান অনেক গভীরে, কিন্তু আমাদের আচরণ ও ধারণার উপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। আমাদের স্বপ্ন বাস্তব, এগুলো আমাদের একটা কিছু বলে; স্বপ্নে আমরা কাল্পনিক কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি। মিথোলজি ছিল অবচেতনের অভিজ্ঞতাকে ইমেজারিতে সংগঠিত করার প্রয়াস, নারী-পুরুষকে যা এইসব মৌলিক অঞ্চলকে তাদের নিজস্ব সত্তার সাথে সম্পর্কিত করতে সফল করে তুলত। বর্তমানে লোকে অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ধরনের ধারণা পেতে সাইকোঅ্যানালিস্টের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। দামাদ ও মোল্লা সদ্রা জোরের সাথে বলেছেন যে, কেবল যৌক্তিকভাবে, প্রকাশ্যে ও আইনসম্মভাবে ধারণা করা কিছুই একমাত্র সত্যি নয়। এর একটা অন্তস্থঃ মাত্রা রয়েছে যা আমাদের স্বাভাবিক চেতন মনের কর্মকাণ্ড দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
এটা অনিবার্যভাবে কোনও কোনও উলেমাকে কট্টরপন্থী শিয়াদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে দিয়েছিল। মোল্লা সদ্রাকে ইস্ফাহান থেকে বিতাড়িত করে তারা। দশ বছর কুমের কাছে এক ছোট গ্রামে বাস করতে বাধ্য হন তিনি। এই নির্জনবাসের সময় বুঝতে পারেন যে, অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি ভক্তি সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বড় বেশি বৃদ্ধিবৃত্তিক রয়ে গেছে। জুরিসপ্রুডেন্স (ফিকহ) বা বাহ্যিক ধর্মতত্ত্বের পাঠ কেবল ধর্ম সম্পর্কে আমাদের তথ্য যোগাতে পারে, এটা ধর্মীয় অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য আলোকন বা ব্যক্তিগত পরিবর্তন এনে দিতে পারে না। কেবল মনোসংযোগের অতীন্দ্রিয় অনুশীলন গুরুত্বের সাথে চর্চা শুরু ও আপন সত্তার মাঝে গভীরভাবে আলম আল-মিথালে অবতরণের পরই তাঁর হৃদয়ে ‘আগুন জ্বলে উঠেছিল’ এবং ‘স্বর্গীয় জগতের আলোক আমার সামনে জ্বলে ওঠে…আমি আগে বুঝতে পারিনি এমন সব রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়ে উঠি,’ তাঁর মহৎ সৃষ্টি আল-আসফার আল-আরবা’হ-তে (দ্য ফোর জার্নিজ অভ সোউল) পরে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
সদ্রার অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা মানুষের পক্ষে এই জগতেই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করা সম্ভব বলে নিশ্চিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু রক্ষণশীল চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত হওয়ায় তিনি যে সম্পূর্ণতার কথা কল্পনা করেছিলেন সেটা নতুন ও উচ্চতর এক পর্যায়ে উত্তরণ নয় বরং আব্রাহাম ও অন্যান্য পয়গম্বরের আদি খাঁটি দর্শনে প্রত্যাবর্তন ছিল। সকল অস্তিত্বের উৎস আল্লাহয়ও প্রত্যাবর্তন ছিল এটা। কিন্তু তাঁর মানে এই ছিল না যে অতীন্দ্রিয়বাদী এই জগৎকে ত্যাগ করেছেন। দ্য ফোর জার্নিজ অভ দ্য সোউল-এ এক ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতার অতীন্দ্রিয় অভিযাত্রার বর্ণনা করেছেন তিনি। প্রথমে তাঁকে অবশ্যই মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ’র উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। এরপর স্বর্গীয় বলয়ে ভ্রমণ করবেন তিনি যতক্ষণ না আল্লাহ’র বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে ধ্যান করে সেগুলোর অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের ব্যাপারে সহজাত চেতনায় পৌঁছেন। এভাবে আল্লাহ’র মুখাবয়বের দিকে চোখ রেখে তিনি বদলে যান ও একশ্বরবাদের আসল অর্থ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইমামদের অনুভূত বোধের অনুরূপ এক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন। তৃতীয় যাত্রায় নেতা আবার মানব জাতির কাছে ফিরে এসে আবিষ্কার করেন যে, এখন তিনি জগৎকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁর চতুর্থ ও চূড়ান্ত অন্বেষণ হচ্ছে এই জগতে আল্লাহ’র বাণী প্রচার করা, স্বৰ্গীয় আইন প্রতিষ্ঠার নতুন পথ বের করা ও আল্লাহ’র ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজকে নতুন করে নির্মাণ করা।৫° এটা এমন এক দর্শন যা সমাজের পূর্ণতাকে যুগপৎ আধ্যাত্মিক উন্নতির সাথে সম্পর্কিত করে। অতীন্দ্রিয় ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়া এই মর্ত্য জগতে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। ইহজগতে সমাজকে পরিবর্তিত করতে অত্যাবশ্যক যৌক্তিক প্রয়াস একে অর্থ প্রদানকারী পৌরাণিক ও অতীন্দ্রিয় পরিপ্রেক্ষিত হতে অবিচ্ছেদ্য আবিষ্কার করে দ্বাদশবাদী শিয়ামতবাদে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ ঘটিয়েছে মোল্লা সদ্রার দর্শন। মোল্লাহ সদ্রা এভাবে শিয়া নেতৃত্বের এক নতুন আদর্শের প্রস্তাব রেখেছিলেন আমাদের কালেও ইরানের রাজনীতিতে যার গভীর প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
মোল্লা সদ্রার দর্শনের অতীন্দ্রিয় রাজনৈতিক নেতার ঐশী অন্তর্দৃষ্টি থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে তিনি শক্তি দিয়ে নিজের মত ও ধর্মীয় অনুশীলন অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন। তেমন কিছু করলে সদ্রার দৃষ্টিতে তিনি ধর্মের সত্যির মুল সত্তাকে অস্বীকার করেছেন। উলেমাদের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছেন সদ্রা। সপ্তম শতাব্দীতে ইরানে ক্রমশ শেকড় ছড়াতে থাকা এক নতুন ধারণার কারণে বিশেষভাবে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তিনি। কিছু কিছু উলেমা এই সময় বিশ্বাস করেছিলেন যে, উলেমারাই গোপন ইমামদের একমাত্র আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র হওয়ায় বেশির ভাগ মুসলিমই নিজে থেকে বিশ্বাসের মৌল বিষয়সমূহ (উসুল) ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, সাধারণ জনগণকে তাই এমন একজন মুজতাহিদ নির্বাচন করতে হবে যিনি ইজতিহাদের (‘স্বাধীন যুক্তিপ্রয়োগ’) চর্চা করার ক্ষমতা রাখেন বলে প্রতীয়মান এবং তাঁর আইনি শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই নিজেদের আচরণকে গড়ে তোলা উচিত। উসুলিদের-এই মতবাদের অনুসারীদের এই নামেই ডাকা হত—এইসব দাবি শুনে ভীত হয়ে উঠেছিলেন সদ্রা। ১ তাঁর দৃষ্টিতে এমন দাসত্বমূলক অনুকরণের (তাকলিদ) উপর নির্ভরকারী যেকোনও ধর্ম সহজাতভাবে ‘দূষিত’৷৫২ সকল শিয়াই পয়গম্বর ও ইমামদের ট্র্যাডিশন (আকবার) বোঝার ক্ষমতা রাখে এবং প্রার্থনা ও আচারআচরণের ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিজেরাই সমাধান বের করার উপযুক্ত।
সপ্তদশ শতাব্দী গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে উসুলি ও তাদের বিরোধীদের সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সাফাভিয় শক্তির তখন পতন শুরু হয়েছে, সমাজ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপযুক্ত শক্তি উলেমাদের মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল, কিন্তু আপন ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে নিজেদের ভেতরই বিরোধে লিপ্ত ছিলেন তাঁরা। এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইরানি উসুলিদের বিরোধিতা করেছে, অতীতের ঐতিহ্যের উপর নির্ভরকারী তথাকথিত আকবারিদের অনুসরণ করেছে। আকবারিরা ইজতিহাদের প্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে কোরান ও সুন্নাহর সংকীর্ণ আক্ষরিক অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা করত। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, সকল আইনি সিদ্ধান্তকে অবশ্যই কোরান, পয়গম্বর বা ইমামদের সুস্পষ্ট বিবৃতি ভিত্তিক হতে হবে। এমন কোনও ঘটনা যদি ঘটে যার বেলায় কোনও স্পষ্ট বিধি নেই, মুসলিম জুরিস্ট অবশ্যই নিজের বিচার বিবেচনার উপর নির্ভর না করে বরং বিষয়টি সেক্যুলার আদালতে পাঠাবেন।৫৩ উসুলিরা অধিকতর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে চেয়েছিল। ইসলামি ট্র্যাডিশনের অনুসৃত নীতিমালার ভিত্তিতে জুরিস্টগণ নিজস্ব যুক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বৈধ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারতেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে আকবারিরা এমনভাবে অতীতে জড়িয়ে পড়বে যে ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স আর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, কোনও জুরিস্টই শেষকথা বলতে পারবেন না, আর কোনও পূর্ব নজীরই বাধ্যতামূলক হবে না। প্রকৃতপক্ষেই, তাঁরা এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, অতীতের সম্মানিত কর্তৃত্বকে অনুসরণ করার বদলে বিশ্বাসীদের সব সময়ই কোনও একজন জীবিত মুজতাহিদের বিধান মেনে চলা উচিত। উভয় পক্ষই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা সময়ে রক্ষণশীল চেতনায় স্থির থাকার প্রয়াস পাচ্ছিল এবং উভয়ই প্রধানত স্বর্গীয় বাণী নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। আকবারি বা উসুলিদের কেউই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার উপর জোর দেয়নি; এটা ছিল স্রেফ আচরণ বা ধর্মীয় অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসীকে কার কাছে নতি স্বীকার করতে হবে, ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থের কাছে নাকি কোনও মুজতাহিদের কাছে সেই প্রশ্ন। তবু দুই পক্ষই একটা কিছু হারিয়েছিল। আকবারিরা আইনে মূৰ্ত আদিম স্বর্গীয় আজ্ঞাকে অতীতের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে, পরিণত হয়েছে অক্ষরবাদীতে; আবিশ্যিকভাবে প্রাচীন শিয়া মতবাদের প্রতীকী ধর্মের সাথে তাদের সম্পর্ক হারিয়ে গিয়েছিল। তাদের চোখে বিশ্বাস পরিণত হয়েছিল বাহ্যিক কিছু নির্দেশনার ধারায়। মানুষের যুক্তির উপর অনেক বেশি আস্থা ছিল উসুলিদের, তাদের ধর্মের মিথোসে এখনও তা প্রোথিত আছে। কিন্তু বিশ্বাসীকে তাদের রায় মেনে নিতে হবে বলে জোর দিয়ে তারা মোল্লা সদ্রার ব্যক্তির পবিত্র স্বাধীনতায় বিশ্বাস খুইয়েছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাষ্ট্রের দুর্বলতা পুষিয়ে দিতে পারবে এমন একটা আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল, নেমে আসছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং পরবর্তীকালের শাহদের অযোগ্যতা রাষ্ট্রকে নাজুক করে তুলেছিল। ১৭২২ সালে আফগান গোত্রগুলো ইস্ফাহানে হামলা চালায়, নেহাত অসম্মানের সাথে আত্মসমর্পণ করে শহরটি। এক গোলযোগের যুগে প্রবেশ করে ইরান। কিছুদিনের জন্যে এমনও মনে হয়েছিল যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে এর অস্তিত্বও বুঝি থাকবে না। উত্তর দিক থেকে আগ্রাসন চালায় রাশানরা, পশ্চিম থেকে অটোমানরা। সুলতান হুসেইন শাহর তৃতীয় ছেলে দ্বিতীয় তাহমাস্প অবশ্য ইস্ফাহানের অবরোধ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ইরানি আফসার গোত্রের সর্দার নাদির খানের সহায়তায় আগ্রাসীদের বিতাড়নে সফল হন তিনি। ১৭৩৬ সালে নাদির খান তাহমাস্পকে উৎখাত করে নিজেকেই সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৭৪৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু প্রায়শঃই দক্ষতার সাথে দেশটি শাসন করেছেন তিনি। তুর্কমান কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ খান নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এক অন্ধকার অরাজক অন্তবর্তীকালীন সময় উপস্থিত হয়েছিল। ১৭৯৪ সালে শাসন সংহত করতে সক্ষম হন তিনি।৪ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ক্ষমতায় অবস্থান করে নতুন কাজার রাজবংশ।
এই বিষণ্ন বছরগুলোয় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটে। নাদির খান ইরানে আবার সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, ফলে নেতৃস্থানীয় উলেমারা ইস্ফাহান ছেড়ে ইরাকে অটোমান সাম্রাজ্যের মাজার শহর নাজাফ ও কারবালায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। একে প্রথমে বিপর্যয় মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা উলেমাদের পক্ষে উপহার প্রমাণিত হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে আরও বড় ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাঁরা রাজনৈতিক শাহদের নাগালের বাইরে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ছিলেন। ক্রমে দরবারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অনন্য অবস্থানে পৌঁছে বিকল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। এই সময়ের দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তন ছিল বিশিষ্ট পণ্ডিত ওয়াহিদ বিহবেহানি (১৭০৫-৯২)-এর কিছুটা সহিংস পদ্ধতিতে অর্জিত উসুলিদের বিজয়। ইজতিহাদের ভূমিকা অনেক স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তিনি, জুরিস্টদের পক্ষে এর প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন। উসুলি অবস্থান মেনে নিতে অস্বীকারকারী যেকোনও শিয়াকে বিধর্মী হিসাবে নিষিদ্ধ করা হত, বিরোধিতাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘাতে কিছু সংখ্যক আকবারি প্রাণ হারায়। ইস্ফাহানের অতীন্দ্রিয় দর্শনও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সুফিবাদকে এমন বর্বরভাবে দমন করা হয়েছিল যে, বিহবেহানির ছেলে আলি সুফি-ঘাতক নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু, আমরা যেমন দেখেছি, ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি সাধারণত উল্টো ফল দেয়, অতীন্দ্রিয়বাদ আত্মগোপনে চলে যায় এবং স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী ও বুদ্ধিজীবীদের ধ্যানধারণাকে আকার দিতে থাকে। বিহবেহানির বিজয় ইরানি উলেমাদের পক্ষে রাজনৈতিক বিজয় ছিল। অরাজকতার উত্তাল সময়ে উসুলি অবস্থান জনপ্রিয় ছিল, কেননা এটা কিছু পরিমাণ শৃঙ্খলা নিয়ে আসার ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্বের যোগান দিয়েছিল তাদের। মুজতাহিদগণ রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন, জনগণের মাঝে কখনওই ক্ষমতা হারাননি। কিন্তু ইমামদের আচরণ ও আদর্শ থেকে দূরবর্তী হওয়ায় স্বৈরাচারী উপায়ে অর্জিত বিহবেহানির বিজয় এক ধরনের ধর্মীয় পরাজয় ছিল।৫৬
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অটোমান ও ইরানি সাম্রাজ্য উভয়ই বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। কৃষি নির্ভর সভ্যতার সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার অনিবার্য নিয়তি বরণ করে নিচ্ছিল এরা। অ্যাক্সিয়াল যুগের সময় থেকেই রক্ষণশীল চেতনা নারী-পুরুষকে গভীর স্তরে এই ধরনের সভ্যতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সাহায্য করে এসেছে। এর মানে এই ছিল না যে, রক্ষণশীল সমাজগুলো স্থবির ও অদৃষ্টবাদী ছিল। এই আধ্যাত্মিকতা ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য বয়ে এনেছিল। কিন্তু এই রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক প্রয়াস এক ধরনের পৌরাণিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত হয়েছিল, যা ইউরোপে বিকাশ লাভ করতে থাকা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ম্যল্যবোধের কাছে অচেনা হয়ে দাঁড়াবে। আধুনিক ইউরোপের বহু আদর্শ মুসলিমদের পক্ষে অনুকূল হবে। আমরা দেখেছি, তাদের ধর্মবিশ্বাস এমন প্রবণতার বিকাশ ঘটাতে উৎসাহিত করেছিল যা আধুনিক পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী প্রবণতার অনুরূপ: সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্যবাদ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, মানবীয় ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতা, সেক্যুলার রাজনীতি, ব্যক্তিমুখী বিশ্বাস ও যৌক্তিক ধারণার চর্চা। কিন্তু নব্য ইউরোপের অন্যান্য বৈশিষ্টগুলো রক্ষণশীল রেওয়াজে গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইউরোপিয়দের পেছনে পড়ে গিয়েছিল, এই সময় ইসলামি সাম্রাজ্যগুলো ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেগুলো ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে নাজুক হয়ে দাঁড়ায়; এসব রাষ্ট্র বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রয়াস চালানোর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ভারতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে ব্রিটিশরা; এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল ফ্রান্স। ১৯শে মে, ১৭৯৮, নেপোলিয়ন বোনাপার্তে প্রাচ্যে ব্রিটিশ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে তুলন থেকে ৩৮,০০০ লোক ও ৪০০ জাহাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করল ফরাসী নৌবহর। ১লা জুলাই আলেকজান্দ্রিয়ার সৈকতে ৪,৩০০ সেনা অবতরণ করালেন নেপোলিয়ন, পরদিন ভোরের অল্প পরেই দখল করে নিলেন গোটা শহর।৫৭ এভাবে মিশরে একটা ঘাঁটি পেয়ে যান তিনি। সাথে করে পণ্ডিত, আধুনিক ইউরোপিয় সাহিত্যের একটা লাইব্রেরি, একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও আরবী হরফঅলা একটা ছাপাখানা নিয়ে এসেছিলেন নেপোলিয়ন। পশ্চিমের নতুন বৈজ্ঞানিক, সেক্যুলারিস্ট সংস্কৃতি আক্রমণ হানল মুসলিম বিশ্বে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।