০২. মুনার দেখা নেই

দশটা থেকে এগারটা এই এক ঘণ্টা মামুন মুনার অফিসে বসে রইল। মুনার দেখা নেই। অপরিচিত লোকজনদের মাঝে বসে থাকা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। সবাই যে অপরিচিত তা নয়, পাল বাবু তাকে চিনতে পেরেছেন এবং বাকি সবার সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন এই যে ইনি মামুন সাহেব। আমাদের মুনা ম্যাডামের সঙ্গে এনার সামনের মাসে বিয়ে হচ্ছে। কেউ কোনো উৎসাহ দেখায়নি। সম্ভবত মুনার সঙ্গে এদের সম্পর্ক ভাল নয়। পাল বাবু চা এনে দিয়েছেন এক কাপ। চায়ে ঘন সর। তার মধ্যে একটা বেশ তাজা কালো রঙের পিঁপড়া ভাসছে। মামুন আঙুল ডুবিয়ে পিঁপড়া সরাল। চায়ে চুমুক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু সময় কাটানোর জন্যে একটা কিছু করা দরকার। মামুন পিঁপড়াটার দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিল। চায়ে অন্য কোনো পোকা-মাকড় ডুবে থাকলে কেউ সে চা খায় না। কিন্তু পিঁপড়া ডুবে থাকলে কেউ আপত্তি করে না। এর কারণ কী? মামুন সিগারেট ধরাল। এক ঘণ্টার মধ্যে এটা হচ্ছে চতুর্থ সিগারেট। বা পাশের ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে তাকাচ্ছে। তিনি হয়ত সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারেন না। মামুন লক্ষ্য করেছে যে কবারই সে সিগারেট ধরিয়েছে এই লোকটি ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। একে নিৰ্ভয়ে সিগারেট অফার করে ভদ্রতা দেখানো যায়। সিগাটে নেবে না, ভদ্রতাও বজায় থাকবে। মামুন হাসিমুখে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়াল। মামুনকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক সিগারেট নিলেন এবং আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

এই অফিসে কাজকর্ম একটু বেশি হয় নাকি? সবাই ব্যস্ত। কোণার দিকে একটি মেয়ে একবারও মাথা না তুলে ক্রমাগত টাইপ করে যাচ্ছে। মুনা বলছিল এই অফিসের বিশ্বাস সাহেবের সঙ্গে মেয়েটির কী নাকি একটা বাজে ঝামেলা হয়েছে। বাজে ঝামেলাটা কী সেটা পরিষ্কার করে বলেনি। আগে মেয়েটি বিশ্বাস সাহেবের সঙ্গে বসন্ত, এখন অফিসের সবার সঙ্গে বসে। মামুন আড়াচোখে মেয়েটিকে কয়েকবার দেখল। বাজে ঝামেলাটা কোন পর্যায়ের হতে পারে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল। তেমন কোনো আকর্ষণীয় চেহারা নয়। মোটা ঠোঁট, চাপা নাক।

মামুন সাহেব!

মামুন তাকিয়ে দেখল পাল বাবু এক কপি দৈনিক বাংলা নিয়ে ঢুকেছেন।

বড় সাহেবের ঘর থেকে নিয়ে এলাম। বসে বসে পড়ুন। চা খাবেন নাকি আর এক কাপ?

জি না। ও বোধ হয় আজ আর আসবে না।

আসবে। আসবে। মেয়েরা ইন জেনারেল অফিস কামাই করে না। দেরি করে আসে। সাজতেগুজতে দেরি হয়।

পাল বাবু মামুনের পাশের চেয়ারটায় বসলেন। পানের কৌটা বের করলেন। হাসিমুখে বললেন পান খাবেন?

জি না।

খান একটা, ভাল জর্দা আছে।

মামুন পান নিল। বসে থাকার চেয়ে পান চিবানো ভাল। জর্দাটা কড়া। চট করে মাথায় ধরেছে। মুখ ভর্তি হয়ে গেছে পানের পিকে। ফেলার জায়গা নেই, গিলে ফেলতেও সাহস হচ্ছে না। পাল বাবু। তরল গলায় বললেন বাড়ি না, অফিসই মেয়েরা বেশি পছন্দ করে। বাড়িতে শতেক রকমের কাজ। ওই রান্না করবে, এই এক গ্লাস পানি দাওরে, এই চা বানাওরে। অফিসে এসব ঝামেলা নেই। মামুন কিছু বলল না, জর্দার রস ভর্তি পিক গিলে ফেলায় তার সত্যি সত্যি বমি বমি লাগছে। সে বলল, এগারটা বিশ বাজে। আজ আর বোধ হয় আসবে না।

যদি আসে কিছু বলতে হবে?

বলবেন ছুটির পর আমার মেসে যেতে। খুব দরকার।

বলব।

পাল বাবু তাকে অফিসের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই লোকটি সম্ভবত ফাঁকিবাজ, শুধু সময় নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এখন আবার এক আমসত্তওয়ালার সঙ্গে দীরদাম করা শুরু করেছে। দর দামের নমুনা দেখেই মনে হচ্ছে কিনবে না। সময় কাটানোর একটা ব্যাপার।

মামুন হাঁটছে ধীরপায়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে। তার মনে ক্ষীণ আশা, হঠাৎ দেখবে মুনা নামছে রিকশা থেকে। কিংবা মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে আসছে অফিসের দিকে। সে সিগারেট কেনার অজুহাতে পান বিড়ির দোকানটির সামনে মিনিট দশেক দাঁড়াল। মুনার দেখা পাওয়া গেল না।

আজকের দিনটাই মাটি হয়েছে। তিনদিনের ক্যাজুয়েল লিভের আজ হচ্ছে প্রথম দিন। কথা ছিল মুনা অফিসে এসে কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে সাড়ে এগারটার দিকে বেরুবে। তারপর দুজনে মিলে বাড়ি দেখতে যাবে কল্যাণপুরে। সেখানে নাকি নশ টাকায় চমৎকার একটা দুরুমের ফ্ল্যাট আছে। কথা দেয়া আছে একটার সময় বাড়িওয়ালা চাবি নিয়ে থাকবেন। হাতে এখনো সময় আছে। নিউ পল্টন থেকে মুনাকে উঠিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু মুনার কঠিন নিষেধ যেন কোনোদিন তার মামার বাড়িতে মামুন না যায়। নিষেধ সব সময় মানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু সে রেগে যাবে। একবার রেগে গেলে তার রাগ ভাঙান মুশকিল। দিনের পর দিন কথা না বলে থাকবে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা কথার জবাব দেবে। তাও এক অক্ষরের জবাব। হ্যাঁ কিংবা না।

মামুন গুলিস্তান থেকে মীরপুরের বাসে উঠল। জর্দা দিয়ে পান খাবার জন্যেই তার মাথাটা হালকা লাগছে। বমি বমি ভােব কাটেনি। কিন্তু সেই সঙ্গে বেশ ক্ষিধেও লেগেছে। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ব্যাপার এক সঙ্গে কিভাবে ঘটছে কে জানে। মামুন একটা সিনেমার কাগজ কিনে ফেলল। প্রথম পাতা জুড়ে তিন রঙা বিশালবীক্ষা মেয়ের ছবি। ভালই লাগে দেখতে।

বলা হয়েছিল মেইন রোডের পাশেই দোতলা বাড়ি। আসলে তা নয়, বেশ খানিকটা ভেতরে যেতে হল। বাড়ি দেখে যে কোনো আশাবাদী মানুষেরই আশাভঙ্গ হবে, মামুনেরও হল। অর্ধসমাপ্ত একটি বাড়ি। সামনে চুনসুড়কির পাহাড়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি এমন যে দু’জন মানুষও পাশাপাশি উঠতে পারে না। বাড়িওয়ালা হাজী সাহেবকেও খুব সুবিধার লোক মনে হল না। যেন বাড়ি দেখানোর তার কোনো গরজ নেই। দুপুর একটায় আসতে হওয়ায় তার যে কত বড় ক্ষতি হল সেই কথা তিনি চার-পাঁচ বার বললেন। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন। বলেছিলেন, আনলেন না কেন?

একটা কাজে আটকা পড়ে গেছে। পরে আসবে।

বাববার তো বাড়ি দেখানো যাবে না। নিতে যদি চান আজই বলবেন। নিতে না চাইলেও আজ বলবেন।

দোতলার বারান্দায় উঠেই মামুন বলল, বাড়ি পছন্দ হয়েছে, আমি নেব।

না দেখেই পছন্দ, ভাল করে দেখেন।

মামুন হৃষ্টচিত্তে ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখল। চমৎকার বাড়ি। দু’টি বিশাল ঘর। দু’টি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচিড বাথরুম। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা স্টোর রুম। চমৎকার একটা বারান্দা। উথালিপাথাল হাওযা খেলছে। হাজী সাহেব বললেন, আপনি আসবেন কবে?

সামনের মাসেব দশ-পনের তারিখেই আসব। কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে যাই আপনাকে?

অ্যাডভান্স দেয়ার দরকার নেই। আর আপনি যদি সামনের মাসের আগেই উঠতে চান বা জিনিসপত্র ব্যাখতে চান রাখবেন। তার জন্যে কোনো বাড়তি ভাড়া দিতে হবে না।

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

ধন্যবাদের দরকার নেই। বাড়িটার যত্ন করবেন, সাত তারিখের মধ্যে ভাড়া দিবেন ব্যস। দেশ কোথায় আপনার?

ময়মনসিংহ।

ময়মনসিংহের লোক খুব পাজি হয়। আমার বাড়িও ময়মনসিংহ। তবে আপনি প্রফেসর মানুষ। এটাই ভরসার কথা।

মেসে ফিরতে ফিরতে চারটা বেজে গেল। ঘরে ঢুকে দেখে মুনা তার চৌকির ওপর একা একা বসে আছে। তার গলায় নীল রঙের একটা মাফলার। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি করেছে। দেখেই বোঝা যায় গায়ে জুব। মুনা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, সেই কখন থেকে বসে আছি, কোথায় ছিলে? মামুন আজ সারাদিন ভেবেছে মুনার সঙ্গে দেখা হলেই খুব কথা শোনাবে। খুব রাগ করবে। কিন্তু রাগ করা গেল না। মুনার ওপর রাগ করা মুশকিল। মামুন গম্ভীর গলায় বলল, একটার সময় আমাদের এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল না?

যাব কিভাবে? অফিসেই গিয়েছি। দেড়টার সময। আমার জ্বর, গলা ব্যথা। টনসিল!

আবার টনসিল, বল কী?

বৃষ্টিতে ভিজালাম। আমি ভিজালাম, বকুল ভিজল, বাবু ভিজল। ওদের কারো কিছু হয়নি। আমার অবস্থাই কাহিল।

মুনা অসহায়ের মত মুখ করল। মামুন এগিয়ে এসে হাত রাখল। তার গলায়। মতলব ভাল নয়। মুনা বলল, কী অসভ্যতা করছ, হাত সরাও।

না সরাব না।

মামুনের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। কখন কে এসে পড়বে। বারান্দায় লোকজন চলাচল করছে। মামুন তার হাত সরিয়ে নিল না। তার হাসি হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রকম কোনো ইচ্ছাও তার নেই। মামুন নরম স্বরে বলল, কাল তোমার কী প্ল্যান?

কোনো প্ল্যান নেই, কেন?

চল কাল তোমাকে কল্যাণপুরের বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।

মুনা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মামুন বলল–দু’একটা ফার্নিচারও কিনব। তুমি সঙ্গে থাকলে ভাল হয়।

কী ফার্নিচার?

বড় দেখে একটা খাট!

এমন অসভ্যের মত কথা বলা কেন?

মামুন শব্দ করে হাসল। চোখ ছোট করে বলল, খাট কেনার মধ্যে অসভ্যতার কী দেখলে তুমি?

ভদ্র হয়ে বাস।

ঠিক আছে বসছি। ভদ্র হয়ে। কাল কখন আসবে বল।

কাল আসতে পারব না, অনেক কাজ আছে। ঘরে কাজের লোক নেই। মামির অসুখ।

কোনো কথা শুনব না। কাল আসতেই হবে। প্লিজ। মুনা। দুপুরে কোনো রেস্টটুরেন্টে বসে খাব। ফাইন হবে।

রেস্টুরেন্টে বসে খাবার মধ্যে ফাইন কী আছে?

আছে, তুমি বুঝবে না। মুনা, আসবে তো?

দেখি।

দেখাদেখি না। আসতেই হবে। সকাল নটার মধ্যে চলে আসবে, পজিটিভলি।

মুনা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। এখান থেকে সে যাবে মামির ভাইয়ের বাড়ি। আংটি দিয়ে আসবে। মামুন বলল … কী আশ্চর্য, এখনি উঠছ কেন?

কাজ আছে আমার।

এত কাজের মেয়ে হয়ে উঠলে কবে থেকে?

মুনা কিছু বলবার আগেই মামুন চট করে তার ঠোঁটে চুমু খেল। মুনা সরে গেল মুহূর্তেই। বিরক্ত স্বরে বলল, কেন সব সময় বিরক্ত কর? দরজা খোলা। লোকজন যাওয়া-আসা করছে।

মামুন হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি।

থাক। দরজা বন্ধ করতে হবে না।

তুমি আসছ তো?

দেখি।

কাল নটায়। পজিটিভলি।

 

মামির ভাই বাসায় ছিলেন না। তার স্ত্রী ছিলেন। ভদ্রমহিলা মুনাকে দেখেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন কাল তোমরা কেউ আসলে না যে, ব্যাপারটা কী?

মামির শরীরটা ভাল না।

তোমাদের শরীর তো ঠিক ছিল, না তোমাদের সবার একসঙ্গে শরীর খারাপ হল?

মুনা কিছু বলল না।

শদেড়েক লোক খেয়েছে। অথচ নিজের আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। বাস তুমি। চা-টা কিছু খাবে?

জি না।

এক বাটি গোসাত তুলে রেখেছিলাম তোমাদের জন্যে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেয়ো।

মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, গোসতের বাটি নিয়ে যাব কিভাবে?

বাটি নিয়ে যাবে কেন? টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দেব।

মুনাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হল। এ বাড়িতে অনেক লোকজন থাকে। এদের কাউকেই সে ভাল করে চেনে না। সে যে অনেকক্ষণ ধরে একা একা বাস আছে। এটা কেউ তেমন লক্ষ্যই করছে। না। পাশের কামরায় বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ভি সি আর দেখছে। একটি মেয়ে এসে এক ফাঁকে বলে গেল–অমিতাভের ছবি হচ্ছে, দেখবেন? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ছুটে চলে গেছে।

মুনা টিফিন বক্সের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কাজের ছেলেটি তার সামনে একটা পেপসির বোতল রেখে গেছে। বাড়ির কত্রী টেলিফোন ধরতে গিয়ে আর ফিরছেন না। মুনা ঘড়ি দেখল, সাড়ে ছটা বাজে। আজও বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *