মুঘল সাম্রাজ্যের পতন
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস রচিত হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও পদুতার পরিপ্রেক্ষিতে। শতাব্দীর সুচনায় ঔরঙ্গজেবই দিল্লীর বাদশাহ ছিলেন। ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। এই পতন ত্বরান্বিত হয় ১৭১২ খ্ৰীস্টাব্দে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর। এই পতনের অন্তরালেই বাঙলায় নবাবী আমলের সুত্রপাত হয়। তারপর চলে ইংরেজের চক্রান্ত। ইংরেজই দেশের প্রভু হয়ে দাঁড়ায়। তারই পরিণামে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে গদিচ্যুত করে। ১৭০৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত এই ১৫০ বৎসর সময়কালের মধ্যে বারো জন মুঘল সম্রাট দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। যথাক্রমে তারা হচ্ছেন–
১) প্ৰথম বাহাদুর শাহ (ঔরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র)। শাসনকাল ১৭০৭ থেকে ১৭১২ পর্যন্ত।
২) জাহান্দার শাহ (প্ৰথম বাহাদুর শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র)। শাসনকাব্য ১৭১২ থেকে ১৭১৩ পর্যন্ত।
৩) ফারুকশিয়ার (প্ৰথম বাহাদুর শাহের দ্বিতীয় পুত্ৰ আজিম-উস-শানের পুত্ৰ)। শাসনকাল ১৭১৩ থেকে ১৭১৯৷
৪) রাফি-উদ-দৌলত (প্ৰথম বাহাদুর শাহের তৃতীয় পুত্র রাফি-উসশানের জ্যেষ্ঠ পুত্র)। শাসনকাল ১৭১৯।
৫) রাফি-উদ-দারজাত (প্ৰথম বাহাদুর শাহের তৃতীয় পুত্রের দ্বিতীয় পুত্র)। শাসনকাল ১৭১৯৷
৬) নিকুশিয়ার (ঔরঙ্গজেবের চতুর্থ পুত্ৰ আকবরের পুত্র)। শাসনকাল ১৭১৯।
৭) মহম্মদ শাহ (প্ৰথম বাহাদুর শাহের চতুর্থ পুত্ৰ জাহানশাহের পুত্ৰ)। শাসনকাল ১৭১৯-১৭৪৮
৮) আহমদ শাহ (মহম্মদ শাহের পুত্র)। শাসনকাল ১৭৪৮-১৭৫৪৷
৯) দ্বিতীয় আলমগীর (প্রথম বাহাদুর শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র জাহান্দর শাহের পুত্ৰ)। শাসনকাল ১৭৫৪-১৭৫৯।
১০) দ্বিতীয় শাহ আলম (দ্বিতীয় আলমগীরের পুত্র)। শাসনকাল ১৭৫৯-১৮০৬।
১১) দ্বিতীয় আকবর (দ্বিতীয় শাহ আলমের পুত্র)। শাসনকাল ১৮০৬-১৮৩৭।
১২)। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (দ্বিতীয় আকবরের পুত্র)। শাসনকাল ১৮৩৭-১৮৫৭। ইংরেজগণ কর্তৃক গদিচ্যুত।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ১৭০৭ থেকে ১৮৫৭ পৰ্যন্ত, এই ১৫০ বৎসরের মধ্যে যে বারো জন মুঘল সম্রাট দিল্লীর সিংহাসনের অধিকারী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দশজন অষ্টাদশ শতাব্দীতেই অধিরূঢ় ছিলেন। এই সময়কালটাই ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগ। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এটা বিশেষভাবে ত্বরান্বিত হয় বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে যে দ্বন্দ, সংঘর্ষ ও হত্যাকাও চলে, তা মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে রীতিমত দুর্বল করে দিয়েছিল। সেই সুযোগে মারাঠা ও শিখরা সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্ৰবল হয়ে ওঠে। তারপর ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে দিল্লী তছনছ করে দেয়। এটা ঘটে সম্রাট মহম্মদ শাহের শাসনকালে।
।।দুই।।
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্ৰ বাহাদুর শাহ সম্রাট হয়। বাহাদুর শাহের তখন বয়স ৬৯৷ পাঁচ বছর পরে (১৭১২ খ্ৰীস্টাব্দে) তার মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর মুঘল বংশের রীতি অনুযায়ী সিংহাসনে বসবার অধিকার নিয়ে বংশের সকলেই পরম্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বাহাদুর শাহের দ্বিতীয় পুত্র আজিমউমশান যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের পরিণামে জ্যেষ্ঠ জাহান্দার শাহ সম্রাট হয়। কিন্তু এগার মাস শাসনের পরে আমির-, ওমরাদের চক্রান্তের ফলে আগরার যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। নিজ মন্ত্রী জুলফিকার খান আঁকে হত্যা করে। তারপর আজিম-উশ-শানের পুত্র ফারুকশিয়ার ১৭১৩ খ্রীস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অত্যাচারী, অপদার্থ ও নির্লজ লম্পট ছিলেন। প্ৰকৃত ক্ষমতা আবদুল্লা ও হুসেন আলি বারহা সৈয়দ নামে দুই ভাইয়ের হাতে গিয়ে পড়ে। তারা ১৭১৯ খ্রীস্টাব্দে ফারুকশিয়ারকে হত্যা করে। তারপর সৈয়দ ভ্ৰাতৃদ্বয় কয়েকজন ‘ভূতুরে’ সম্রাটকে কয়েকদিনের জন্য করে সিংহাসনে বসায়। (আগে দেখুন)। তারা অন্তৰ্হিত হলে ১৭১৯ খ্রীস্টাব্দে মহম্মদ শাহ সম্রাট হন। ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দ পৰ্যন্ত তিনি সম্রাট ছিলেন। কিন্তু তার রাজত্বকালেই মুঘল সাম্রাজ্য খণ্ডিত হতে থাকে। ১৭২৪ খ্ৰীস্টাব্দে তার উজির আসাফ জাহ দাক্ষিণাত্যে গিয়ে স্বাধীন নিজাম বংশ স্থাপন করে। সেই বছরেই সাদৎ খান অযোধ্যার নবাব বংশ প্ৰতিষ্ঠা করেন। বাঙলায় আলিবর্দি খান প্ৰথম প্ৰথম সম্রাটকে রাজস্ব পাঠাতেন, কিন্তু পরে তা পাঠানো বন্ধ করে দেন এবং স্বাধীন শাসকের ন্যায় আচরণ করতে থাকেন। গঙ্গার উত্তরে রোহিলখণ্ডে রহিলা নামধারী এক আফঘান জাতি নিজ আধিপত্য বিস্তার করে। এ সবই ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ১৭ বছরের মধ্যে ঘটে যায়। মারাঠা ও শিখরাও আরও প্ৰবল হয়ে ওঠে। ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দে দ্বিতীয় পেশওয়া বাজীরাওয়ের আমলে মারাঠারা দিল্লীর উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত। হয়, কিন্তু আসাফ জাহ নিজাম দক্ষিণাত্যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্ৰস্তুত হচ্ছে শুনে, মারাঠারা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করে। তারপর মুঘল সাম্রাজ্যের ওপর চরম আঘাত হানে নাদির শাহ।
।।তিন।।
নাদির শাহকে পারস্যের সর্বযুগের শ্ৰেষ্ঠ যোদ্ধা বলে অভিহিত করা হয় (the greatest warrior Persia has ever produced)। ১৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে নাদির, শাহ পারস্যের সফবি বংশকে উচ্ছেদ করে পারস্যের সিংহাসন অধিকার করে। সিংহাসনে আরোহণ করবার পর নাদির শাহ সমৃদ্ধশালী ভারত আক্রমণ ও লুণ্ঠন করবার জন্য নানারকম আছিল খুঁজতে থাকে। ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে নাদির শাহ গাজনি, কাবুল ও লাহোর অতিক্রম করে। বিনা প্রতিরোধে দিল্লীর ৫০ ক্রোশের মধ্যে যমুনা পৰ্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানেই তাকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। পানিপথের নিকট কর্নালে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে দু’ঘণ্টা ধরে তার ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুঘল বাহিনী পরাজিত হয়। বিশ হাজার মুঘল সৈন্য নিহত হয়। নাদির শাহের লোকেরা প্রচুর ধনদৌলত লুণ্ঠন করে। সম্রাট মহম্মদ শাহ প্ৰতিকুল অবস্থা দেখে, নিজেই নাদির শাহের সঙ্গে তার শিবিরে দেখা করতে যান। তারপর দুই সম্রাট একসঙ্গে দিল্লীতে প্ৰবেশ করেন। কিছুদিন বেশ সদ্ভাবে কাটে। কিন্তু নাদির শাহের মৃত্যু ঘটেছে, এরকম একটা গুজব রটায়, দিল্লীর নাগরিকরা খড়্গহস্ত হয়ে নাদির শাহের কয়েক শত সৈনিককে নিহত করে। নাদির শাহ এর ভীষণ প্ৰতিহিংসা নেয়। দিল্লীর প্ৰধান রাজপথের ওপর অবস্থিত রশন-উদ-দৌলার সোনার মসজিদে বসে, তিনি দিল্লীর বাসিন্দাদের হত্যা করবার আদেশ দেন। নয় ঘণ্টা যাবৎ এই হত্যাকাণ্ড চলে, এবং অসংখ্য লোক নিহত হয়। তারপর মহম্মদ শাহের বিনীত প্রার্থনায়, এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়। এর পর দিল্লীর সন্ত্রান্ত ব্যক্তিদের গৃহ থেকে, তাদের তিনশত বৎসরের সঞ্চিত ধনদৌলত লুণ্ঠন করা হয়। ৫৮ দিন ভারতে অবস্থানের পর, নাদির শাহ স্বদেশে প্ৰত্যাবর্তন করে যাবার সময় শাহজাহানের বিখ্যাত ময়ুর সিংহাসনটি সঙ্গে নিয়ে যায়। ১৭৩৯ খ্ৰীস্টাব্দের ২৬ মে তারিখে এক সন্ধি হয়। সেই সন্ধির শর্ত অনুযায়ী সিন্ধু নদীর পশ্চিমের সমস্ত অঞ্চল নাদির শাহকে দিয়ে দিতে হয়। এই ভাবে মুঘল সাম্রাজ্য থেকে আফঘানিস্তান বিচ্যুত হয়।
নাদির শাহ মুঘল সাম্রাজ্যকে একেবারে নিঃস্ব ও ভূশায়িত করে দিয়ে যায়। সংহত কেন্দ্রীয় শক্তি বলে আর কিছুই থাকে না। দাক্ষিণাত্যে বিশৃঙ্খলতা প্ৰকাশ পায়। পশ্চিম ভারতে মারাঠারা আরও প্ৰবল হয়ে ওঠে। উত্তর ভারতে শিখরাও আরও শক্তিশালী হয়। ১৭৪২ খ্রীস্টাব্দের পর থেকে মারাঠা বৰ্গীরা — বাঙলায় গিয়েও হামলা শুরু করতে সাহস পায়।
Good
Hello