২. মিলেসীয় ধারা
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে লেখা দর্শনের প্রত্যেকটি বইতে প্রথমেই যে কথাটি উল্লেখ করা হয় তা হলো : দর্শনের শুরু থেলিস থেকে, যিনি বলেছিলেন সবকিছুই পানি থেকে সৃষ্ট। যে নবিস ছেলে বা মেয়েটি দর্শনের প্রতি তার পাঠ্যসূচির প্রত্যাশিত অনুরাগ নিজের মধ্যে সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করছে-প্রাণপণে না হলেও, চেষ্টা করছে-তার কাছে এটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কিন্তু তবুও থেলিসের জন্য শ্রদ্ধাবোধ করার প্রচুর কারণ রয়েছে, যদিও তা আধুনিক অর্থে দার্শনিক হিসেবে নয়, বরং একজন বিজ্ঞানী হিসেবে।
এশিয়া মাইনরের মিলেটাস নামক এক বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক নগরীর অধিবাসী ছিলেন থেলিস। সেখানে ছিল এক বিশাল দাস জনগোষ্ঠী, আর স্বাধীন জনগণের মধ্যে ছিল ধনী আর গরিবে এক তিক্ত শ্রেণিসংগ্রাম। মিলেটাস প্রথমে সাধারণ মানুষ জয়ী হয়। এবং তাদের প্রতিপক্ষদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, এমনভাবেই পুড়িয়ে মারে যে জ্বলন্ত মানবদেহের আলোয় পুরো শহর আলোকিত হয়। থেলিসের যুগে এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ নগরীতেই এ ধরনের সংঘাতময় অবস্থা ছিল।
আয়োনিয়ার অন্যান্য বাণিজ্যিক নগরীগুলোর মতো মিলেটাসেও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ ঘটে। প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল ভূস্বামী অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে, তবে তা ক্রমশ চলে যায় ধনী বণিকগোষ্ঠীর হাতে। পরে এই ক্ষমতা চলে যায় এক স্বৈরশাসকের হাতে, যে কি না তা লাভ করে সাধারণ জনতার সহযোগিতায় (যেমনটি সেকালে সচরাচর ঘটত)। লিডিয়া রাজ্যের অবস্থান ছিল গ্রিক উপকূলীয় নগরীগুলোর পুব দিকে, কিন্তু নিনেভাহ্ (খ্রি.পূ. ৬০৬)-এর পতনের আগ পর্যন্ত গ্রিক নগরীগুলোর সঙ্গে লিডিয়ার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। এর ফলে লিডিয়া তার পশ্চিম দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করার ফুরসত পায়। কিন্তু মিলেটাস বরাবর লিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়, বিশেষ করে শেষ লিডীয় রাজা ক্রোয়েসাসের সঙ্গে, যাকে খ্রি.পূ. ৫৪৬ সালে সাইরুস পরাজিত করেন। মিলেটাসের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল মিসরের সঙ্গেও, সেখানকার রাজা গ্রিক বণিকদের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতিপয় নগরী উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মিসরে প্রথম গ্রিক বসতি ছিল একটি দুর্গ, সেটি দখল করে নিয়েছিল এক মিলেসীয় বাহিনী। তবে ৬১০-৫৬০ খ্রি.পূ. সময়কালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডাফনি। সেখানে জেরোমিয়াহ্ ও অন্যান্য ইহুদি ফেরারীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু মিসর যেহেতু সন্দেহাতীতভাবে গ্রিকদের প্রভাবিত করেছিল, সেহেতু আমরা মনে করতে পারি না যে সন্দেহপরায়ণ আয়োনীয়দের প্রতি গ্রিকদের বা জেরোমিয়াহর ভয় ছাড়া অন্য কোনো ভালো অনুভূতি ছিল।
থেলিসের জীবনকাল সম্পর্কে সর্বোত্তম সাক্ষ্য হচ্ছে, যেমনটি আমরা জানি, তিনি এক চন্দ্র/সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। জ্যোতির্বিদদের মতে সেই গ্রহণ ঘটেছিল খ্রি.পূ. ৫৮৫ সালে। এ রকম আরেকটি সাক্ষ্য থেকেও তাকে এর কাছাকাছি সময়কালের মানুষ রূপেই পাওয়া যায়। থেলিসের পক্ষে একটি চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়া কোনো অসাধারণ প্রতিভার বিষয় ছিল না। মিলেটাসের মৈত্রী ছিল লিডিয়ার সঙ্গে, আর লিডিয়ার ছিল ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আর ব্যাবিলনিয়ার জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেছিল যে প্রায় ১৯ বছরের এক চক্রে চন্দ্রগ্রহণ ঘুরে ঘুরে আসে। চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস তারা দিতে পারত বেশ সাফল্যের সঙ্গেই, তবে সূর্যগ্রহণের ব্যাপারে তাদের সমস্যা ছিল এই যে, সূর্যগ্রহণ কোনো একটি জায়গা থেকে দৃশ্যমান হতে পারে আবার অন্য আরেক জায়গা থেকে না-ও হতে পারে। ফলে তারা শুধু জানতে পারত যে সম্ভাব্য অমুক অমুক তারিখে সূর্যগ্রহণের প্রত্যাশায় আকাশে তাকানো যেতে পারে। থেলিস সম্ভবত এ সবকিছুই জানতেন। থেলিস নিজে বা তারা কেউই জানতেন না সঠিক কী মেয়াদে সূর্যগ্রহণের চক্রটা ঘুরে ঘুরে আসে।
বলা হয়ে থাকে, থেলিস মিসর ভ্রমণ করেছিলেন আর সেখান থেকেই গ্রিকদের কাছে এনেছিলেন জ্যামিতির বিজ্ঞান। মিসরীয়রা জ্যামিতিশাস্ত্রের যা জানত তা ছিল অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন দ্বারা স্থিরীকৃত কিছু পরিমাপ-পদ্ধতি (rules of thumb)। তাই এ কথাও মনে করার কোনো কারণ নেই যে থেলিসের জ্যামিতিক জ্ঞান অবরোহমূলক প্রমাণ অবধি পৌঁছেছিল। সেটা ছিল পরবর্তী কালের গ্রিকদের আবিষ্কার। ধারণা করা হয়, তিনি সমুদ্রতীরে দুটি বিন্দু থেকে পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্রবক্ষের কোনো জাহাজের দূরত্ব কীভাবে পরিমাপ করতে হয় এবং একটি পিরামিডের ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে ওই পিরামিডের উচ্চতা কীভাবে মাপতে হয় তা আবিষ্কার করেন। আরো অনেক জ্যামিতিক উপপাদ্য থেলিসের আবিষ্কার বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু সম্ভবত তা ঠিক নয়।
গ্রিসে যে সাতজন মনীষীর প্রত্যেকে একটি করে প্রজ্ঞাময় উক্তি করার জন্য বিশেষভাবে খ্যাতিমান ছিলেন, থেলিস তাদের একজন। থেলিসের উক্তিটি একটি ভ্রান্তি, তিনি মনে করতেন পানিই সর্বোত্তম। অ্যারিস্টটলের মতে : থেলিস মনে করতেন পানি হচ্ছে আদিমৌলিক সারবস্তু, যা থেকে অবশিষ্ট সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করতেন, পৃথিবী পানির ওপর ভাসছে। অ্যারিস্টটল আরো বলেন, থেলিস বলেছিলেন, চুম্বকের মধ্যে একটি আত্মা থাকে, কারণ তা লোহাকে নড়ায়। তিনি আরো বলেছিলেন, সব বস্তুর মধ্যে দেবতারা আছে।
সবকিছুর উৎপত্তি পানি থেকে-এই বক্তব্যকে বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর এটি কোনোভাবেই নির্বোধ উক্তি নয়। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে গৃহীত মত ছিল যে সবকিছু হাইড্রোজেন থেকে সৃষ্ট, যে-হাইড্রোজেন কিনা আবার পানির দুই-তৃতীয়াংশ। গ্রিকরা নিজেদের অনুমানের ব্যাপারে ছিল হঠকারী, কিন্তু মিলেসীয় ধারাটি অন্তত নিজেদের অনুমানগুলো অভিজ্ঞতা দ্বারা পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল। আমরা থেলিস সম্বন্ধে এত অল্প জানি যে, তার সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা সন্তোষজক দিকে পালটানোর সুযোগ তেমন নেই। কিন্তু মিলেটাসে তার উত্তরসূরিদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেছে, আর এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে, তাদের বিশ্ববীক্ষার কিছু কিছু এসেছিল থেলিস থেকেই। থেলিসের বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ই কাঁচা, কিন্তু সেগুলো চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ উদ্দীপ্ত করার পক্ষে সহায়ক ছিল।
থেলিস সম্পর্কে অনেক কাহিনি-উপকথা চালু আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমার উল্লিখিত তথ্যাগুলোর চেয়ে বেশি আর কিছু তার সম্পর্কে জানা যায়নি। তার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনিগুলোর কিছু কিছু শুনতে বেশ প্রীতিকর। যেমন-একটি বলেছেন অ্যারিস্টটল, তার পলিটিক্স গ্রন্থে : লোকেরা তাকে (থেলিসকে) তার দারিদ্র্যের জন্য গালমন্দ করত, যা থেকে মনে করা হতো যে, দার্শনিকরা কোনো কাজের নয়। কাহিনিটি অনুসারে, গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে দক্ষ ধারণা থেকে থেলিস এক শীতকালে টের পেলেন, পরবর্তী বছর জলপাইয়ের ফলন খুব ভালো হবে। তার যে সামান্য অর্থ ছিল তা দিয়ে তিনি কিওস ও মিলেটাসের সব জলপাইয়ের ঘানি ভাড়া করার জন্য অগ্রিম বায়না করে রাখলেন, তা তিনি করতে পারলেন খুব সস্তায়, কারণ সেসব নেওয়ার জন্য ওই মুহূর্তে তার কোনো প্রতিযোগী ছিল না। তারপর যখন ফসল তোলার মৌসুম এলো এবং প্রচুর লোক জলপাইয়ের ঘানির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল, তখন তিনি সেগুলো ছেড়ে দিলেন নিজের ইচ্ছেমতো দরে এবং এ থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেন। এভাবে তিনি জগৎকে দেখিয়ে দিলেন যে, দার্শনিকরা ইচ্ছে করলে অর্থ উপার্জন করে ধনী হতে পারে। কিন্তু তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো ভিন্ন প্রকৃতির।
মিলেসীয় ধারার দ্বিতীয় দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার। তিনি থেলিসের চেয়ে বেশি আগ্রহোদ্দীপক এক চরিত্র। তার সময়কাল অনিশ্চিত, তবে বলা হয়, তিনি ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কাছাকাছি সময়েই যে তা ঘটেছিল এ ধারণার পেছনে যুক্তি আছে। অ্যানাক্সিমেন্ডার মনে করতেন সব বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে একটিমাত্র আদিবস্তু থেকে, কিন্তু তা থেলিসের দাবিকৃত পানি বা আমাদের পরিচিত কোনো পদার্থই নয়। তা অসীম, শাশ্বত, সময়নিরপেক্ষ এবং তা সব বিশ্বকে বেষ্টন বা আবৃত করে রয়েছে-তিনি মনে করতেন আমাদের জগৎ অনেক জগতের একটি মাত্র। সেই আদিবস্তু আমাদের কাছে পরিচিত বিভিন্ন পদার্থে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেগুলো। আবার একটি থেকে আরেকটাতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ সম্বন্ধে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও লক্ষণীয় মন্তব্য করেছেন :
যে-রূপ থেকে বস্তুগুলোর উদ্ভব ঘটে নিয়তিনির্ধারিতভাবে তারা আবার সেই রূপের মধ্য দিয়ে যায়, কারণ কালের বিন্যাস অনুসারে তারা তাদের পরস্পরের অন্যায্যতার ক্ষতিপূরণ ও সন্তোষ বিধান করে।
মহাজাগতিক এবং মানবিক-উভয় অর্থে ন্যায্যতার ধারণা গ্রিক ধর্ম ও দর্শনে এমন এক ভূমিকা পালন করেছে যা আধুনিক মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে বোঝা সহজ নয়। ন্যায্যতার নিহিতার্থ যা ছিল, আমাদের ব্যবহৃত ন্যায়বিচার বা ন্যায্য আচরণ তা প্রকাশ করে না বললেই চলে। কিন্তু এর চেয়ে জুতসই আর কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অ্যানাক্সিমেন্ডার যে চিন্তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা বোধ করি এই : বিশ্বে আগুন, পানি ও মাটির একটি নির্দিষ্ট অনুপাত আছে। কিন্তু এই তিনটি উপাদানের প্রত্যেকটি (মনে করা হচ্ছে যে তারা প্রত্যেকেই একজন করে দেবতা) অবিরামভাবে তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু একটি অনিবার্যতা বা প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে যা অবিরামভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। যেমন-যেখানে আগুন আছে, সেখানে আছে ছাই। আর ছাই হলো মাটি। ন্যায্যতার অর্থ শাশ্বতভাবে নির্ধারিত সীমাগুলো অতিক্রম না করা। এই ধারণা ছিল গ্রিক বিশ্বাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গভীর ধারণাগুলোর একটি। দেবতারাও ঠিক মানুষের মতোই এই ন্যায্যতার অধীন ছিল। তবে খোদ চূড়ান্ত শক্তিটি নিজে ছিল নৈর্ব্যক্তিক, তা কোনো সর্বময় ঈশ্বর ছিল না।
পানি বা অন্য কোনো পরিচিত পদার্থ যে আদিবস্তু নয় তা প্রমাণ করার জন্য অ্যানাক্সিমেন্ডার এক তর্ক জুড়েছিলেন। সেটা ছিল এ রকম : উপাদানগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি যদি হয় আদি বা প্রাথমিক, তাহলে তা অন্যগুলোকে আত্মসাৎ করে নিত। অ্যারিস্টটল জানাচ্ছেন অ্যানাক্সিমেন্ডার বলেছিলেন, আমাদের পরিচিত বা জ্ঞাত পদার্থগুলো পরস্পর বিপরীতধর্মী। বায়ু শীতল, পানি আর্দ্র, আগুন গরম। অতএব, এদের যেকোনো একটি যদি অসীম হতো তাহলে এত দিনে অন্যগুলোর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যেত। সুতরাং এই মহাজাগতিক দ্বন্দ্বে আদি বস্তু অবশ্যই নিরপেক্ষ।
শাশ্বত এক গতি ছিল, জগৎগুলোর সূচনা ঘটেছে তারই ধারায়। জগৎগুলো সৃষ্টি হয়নি-খ্রিস্টীয় বা ইহুদি ধর্মতত্ত্বে যেমনটি বলা হয়েছে-বরং বিকশিত হতে হতে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। প্রাণিজগতে একটি বিকাশ প্রক্রিয়া ছিল। আর্দ্র উপাদান যখন সূর্যকিরণে বাষ্পীভূত হয়েছিল তখন তা থেকে প্রাণীগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। অন্য সব প্রাণীর মতো মানুষও সম্ভূত হয়েছে মাছ থেকে। নিশ্চয়ই ভিন্ন প্রকৃতির জীব থেকে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে, কারণ এখন তার শৈশবকাল এত দীর্ঘ যে, আদিতে এ রকম থাকলে সে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারত না।
অ্যানাক্সিমেন্ডারের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ছিল প্রভূত পরিমাণে। বলা হয়, তিনিই সর্বপ্রথম একটি মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন পৃথিবীর আকৃতি একটি চোঙের মতো। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয় যে তিনি মনে করতেন সূর্য পৃথিবীর সমান বা পৃথিবীর চেয়ে ২৭ বা ২৮ গুণ বড়। তার মৌলিকত্ব ছিল তার বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদিতা।
অ্যানাক্সিমেনিস ছিলেন মিলেসীয় ধারার শেষ দার্শনিক। অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতো তিনি আগ্রহব্যঞ্জক না হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। তার জন্ম মৃত্যুর সাল-তারিখ খুবই অনিশ্চিত, তবে এটা নিশ্চিত যে তিনি ছিলেন অ্যানাক্সিমেন্ডারের পরবর্তীকালের। আর যেহেতু ৪৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আয়োনীয়দের বিদ্রোহ দমনের একপর্যায়ে পারসিকদের দ্বারা মিলেটাস বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেহেতু অ্যানাক্সিমেনিস নিশ্চিতভাবেই ওই সময়ের পূর্ববর্তী ছিলেন।
অ্যানাক্সিমেনিস বলেছিলেন মূল পদার্থ হচ্ছে বায়ু। আত্মা বায়ু, আগুন তরলীকৃত বায়ু। ঘনীভূত করা হলে বায়ু প্রথমে হয় পানি, তারপর আরো ঘনীভূত করা হলে হয় মাটি, এভাবে শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় পাথরে। এই তত্ত্বের মধ্যে যে কৃতিত্বটা আছে তা হচ্ছে শুধু বিভিন্ন পদার্থের ঘনীভবনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে তাদের মধ্যকার সব পার্থক্যকে পরিমাণগত রূপ দেওয়ার ক্ষমতা। তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর আকৃতি একটি গোলাকার টেবিলের মতো, আর সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে বায়ু। আত্মা যেমন করে আমাদেরকে সংহত করে, একত্রে ধরে রাখে, তেমনি করে নিঃশ্বাস আর বায়ু পুরো বিশ্বকে ধরে রাখে। যেনবা পৃথিবী দম নিচ্ছে, দম ফেলছে।
প্রাচীন যুগে অ্যানাক্সিমেন্ডারের চেয়ে অ্যানাক্সিমেনিস বেশি সমাদৃত ছিলেন। অবশ্য আধুনিক দুনিয়ার যেকোনো মানুষ এখন এর ঠিক উলটো মূল্যায়নটাই করবে। পিথাগোরাস এবং তার পরবর্তী কালের অনেক চিন্তায় অ্যানাক্সিমেনিসের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। পিথাগোরাসবাদীরা আবিষ্কার করে পৃথিবী গোলাকার। কিন্তু পরমাণুবাদীরা ছিলেন অ্যানাক্সিমেনিসের মতের কাছাকাছি-অর্থাৎ পৃথিবী একটি চাকতির মতো।
মিলেসীয় দার্শনিক ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ তার অর্জনের কারণে নয়, বরং তার উদ্যম ও প্রয়াসের জন্য। মিলেসীয় ধারার উৎপত্তি ঘটেছিল ব্যাবিলনিয়া ও মিসরের সঙ্গে গ্রিক মননের সংযোগের ফলে। মিলেটাস ছিল একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক নগরী, যেখানে আদিম ধারণা ও কুসংস্কারগুলো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নমনীয় রূপ লাভ করেছিল। পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে দারিয়ুস কর্তৃক অধিকৃত হবার পূর্ব পর্যন্ত হেলেনিক জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আয়োনিয়া। ডায়োনিসাস এবং অর্ফিয়ুসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধর্মীয় আন্দোলনের স্পর্শ থেকে আয়োনিয়া প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ছিল। আয়োনিয়ার ধর্ম ছিল অলিম্পীয়, তবে হয়তো ততটা কঠিন অর্থে নয়। থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার এবং অ্যানাক্সিমেনিসের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে বিবেচনা করতে হবে বৈজ্ঞানিক অনুমান হিসেবে; সেগুলোতে প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে মনুষ্যত্ব আরোপের আকাক্ষা, বা নৈতিক কোনো ধারণার অন্যায় অনুপ্রবেশ ছিল না। তাদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো ছিল উত্তম প্রশ্ন, আর তাদের প্রাণশক্তি অনুপ্রাণিত করেছিল পরবর্তীকালের অনুসন্ধিৎসুদের।
গ্রিক দর্শনের পরবর্তী ধাপ, যা দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা অধিকতর ধর্মীয় এবং বিশেষ করে, অধিকতর অর্ফিক। কিছু দিক থেকে তা বেশি আগ্রহব্যঞ্জক, অর্জনের দিক থেকে প্রশংসনীয়, কিন্তু মিলেটাসের দার্শনিক ধারার চেয়ে চেতনার দিক থেকে কম বিজ্ঞানভিত্তিক।