০২. মিলেশীয় জনগোষ্ঠী
দর্শনের ইতিহাস; যা মূলত ছাত্রদের জন্য লেখা হয়, তার প্রতিটিতে প্রথমে উল্লেখ করা হয়, দর্শনশাস্ত্র শুরু করেছেন থালেস- তাঁর বক্তব্য ছিল, সবই জল দিয়ে গঠিত। নবীন বিদ্যার্থীদের এ তথ্য নিরুৎসাহিত করতে পারে, তারা হয়তো চেষ্টা করছেন দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে একটা সম্ভম বোধ করতে (সেটা বেশি কঠিনও নয়), পাঠক্রমও তাই আশা করে। থালেস সম্পর্কে সম্ভ্রম বোধ করার কিন্তু যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সে সম্ভ্রম আধুনিক অর্থে দার্শনিকের চাইতে বৈজ্ঞানিক হিসেবেই তাঁর প্রাপ্য।
থালেস ছিলেন এশিয়া মাইনরের একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র মিলেতস (Miletus) এর অধিবাসী, যেখানে বিরাট সংখ্যক ক্রীতদাস ছিল। অক্রীতদাস যে স্বাধীন জনসাধারণ- তাঁদের ভিতর ধনী-দরিদ্রের তিক্ত শ্রেণি সংগ্রাম চলত। মিলেতস-এ, প্রথমে জনসাধারণ জয়ী হয়ে অভিজাতদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে হত্যা করে, পরে অভিজাতরা জয়ী হন এবং তাঁদের প্রতিপক্ষদের জীবন্ত দগ্ধ করেন। নগরীর উন্মুক্ত স্থানগুলো তাঁরা জীবন্ত মশাল দিয়ে আলোকিত করেন।২৫ থালেস-এর সময় এশিয়া মাইনরে অধিকাংশ শহরের চেহারা প্রায় একইরকম ছিল।
সপ্তম এবং ষষ্ঠ শতাব্দীতে মিলেতসেও ইওনীয়-র অন্যান্য বাণিজ্যকেন্দ্রিক শহরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশ ঘটে। প্রথমদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল অভিজাত ভূস্বামীদের হাতে, তারপর ক্ষমতা ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র একটা বণিকগোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। এর পরে তাদের স্থান দখল করেন একজন স্বৈরাচারী তিনি ক্ষমতা দখল করেন গণতান্ত্রিক দলের সাহায্যে (সাধারণত এইরকম হতো) লুদিয়া (Lydia) রাজ্যের অবস্থান ছিল উপকূলবর্তী গ্রিক নগরগুলোর পূর্বে, তবুও নিনেভে (Nineveh), নগরীর পতনের পূর্ব পর্যন্ত (৬০৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) গ্রিক নগরগুলোর সঙ্গে লুদিয়ার সম্ভাব ছিল। কিন্ত পতনের ফলে লুদিয়া এবার পশ্চিম দিকে নজর দিতে চেষ্টা করল তবে মিলেতস তাদের সঙ্গে, বিশেষ করে শেষ লুদীয় রাজা ক্রয়েসস (Croesus)-এর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি ৫৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কুরুস (Cyrus) কর্তৃক বিজিত হন। মিশরের সঙ্গেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মিশরের রাজা ভাড়াটে গ্রিক সৈন্যদের উপর নির্ভর করতেন ও কয়েকটি নগরী গ্রিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মিশরে প্রথম গ্রিক বসতি ছিল মিলেশীয় সৈনিকদের (Milesian garrison) অধিকৃত একটি দুর্গ; কিন্তু ৬১০-৫৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত দাফনায়ে (Daphnae) ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে জেরেমিয়া (Jeremiah) এবং অন্যান্য অনেক ইহুদি শরণার্থী নেবুচাদরেজার (Nebuchardrezzar)-এর ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন (Jeremiah Xliii 5 ff)। যদিও গ্রিকরা নিঃসন্দেহে মিশরের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন কিন্তু ইহুদিদের দ্বারা হননি, তাছাড়া অনুমান করা অসম্ভব যে, এই সংশয়বাদী ইওনীয়দের জন্য জেরেমিয়ার প্রবল ভীতি ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি হওয়া সম্ভব ছিল।
পূর্বেই দেখা গেছে যে, থালেসের কাল সম্পর্কে শ্রেষ্ঠতম সাক্ষ্য হলো একটি বিশেষ গ্রহণ সম্পর্কে তার ভবিষ্যদ্বাণী এবং এর জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে এই গ্রহণটি ঘটেছিল ৫৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। অন্যান্য যে সমস্ত সাক্ষ্য পাওয়া যায় তা থেকে এই প্রতীতি জন্মায় যে, তাঁর কর্মজীবন এই সময়েই ছিল। গ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর অসাধারণ প্রতিভার কোনো সাক্ষ্য নয়। মিলেতস-এর সঙ্গে লুদিয়ার বন্ধুত্ব ছিল এবং লুদিয়ার সঙ্গে ব্যাবিলনিয়ার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল। ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন ১৯ বছরের চক্রে গ্রহণের পুনরাবৃত্তি ঘটে। চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী যথেষ্ট সফল হয়েছিল কিন্তু সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে অসুবিধা ছিল, কারণ, গ্রহণটা এক স্থানে দেখা যেত, অন্য স্থানে দেখা যেত না। ফলত তাঁরা এইমাত্র জানতেন যে, বিশেষ বিশেষ তারিখে গ্রহণের জন্য নজর রাখা উচিত, থালেসেরও জ্ঞানের সীমা বোধ হয় এই পর্যন্তই ছিল। তিনি কিংবা তাঁরা কেউই গ্রহণের এই কালচক্রের কারণ জানতেন না।
একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, থালেস মিশরে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে গ্রিকদের কাছে জ্যামিতিবিজ্ঞান বহন করে এনেছিলেন। মিশরীয়দের জ্যামিতির জ্ঞান ছিল প্রধানত অভিজ্ঞতালব্ধ এবং ব্যবহারিক (rules of thumb)। পরবর্তীকালের গ্রিক আবিষ্কার অবরোহী প্রমাণ (deductive proofs) পর্যন্ত থালেস পৌঁছেছিলেন- এ কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। স্থলে অবস্থিত দুটি বিন্দু থেকে পর্যবেক্ষণ করে কী উপায়ে সমুদ্রে একটি জাহাজের দূরত্ব নির্ণয় করতে হয় এবং ছায়ার দৈর্ঘ্য থেকে কি করে পিরামিডের উচ্চতা মাপতে হয়-মনে করা হয় সেটা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। অন্যান্য অনেক জ্যামিতিক উপপাদ্যের আবিষ্কর্তার গৌরব তার উপর আরোপ করা হয়। কিন্তু সম্ভবত সেটা ভুল।
গ্রিসের সাত বিজ্ঞ ব্যক্তির অন্যতম ছিলেন তিনি, এঁরা প্রত্যেকেই এক একটি জ্ঞানগর্ভ বাক্যের জন্য বিখ্যাত। জলই সর্বশ্রেষ্ঠ-থালেসের উপর আরোপিত এই ভক্তি সম্ভবত ঠিক নয়।
আরিস্ততেলেসের মতানুযায়ী থালেস ভেবেছিলেন জলই মূলবস্তু, তা থেকে অন্যান্য জিনিসের সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁর দৃঢ় বক্তব্য ছিল পৃথিবীর অবস্থান জলের উপর। আরিস্ততেলেস আরও বলেন, খালেসের মতে চুম্বকের আত্মা আছে, কারণ চুম্বক লোহাকে সঞ্চালন করতে পারে। তাছাড়া সকল বস্তুতেই দেবতা রয়েছেন।
সমস্ত বস্তুই জল থেকে উৎপন্ন- এই বক্তব্য একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য, কোনোক্রমেই এই বক্তব্যকে নির্বোধ উক্তি ভাবা উচিত নয়। কুড়ি বছর আগের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল- সব কিছুরই সৃষ্টি হাইড্রোজেন থেকে- যা জলের দুই-তৃতীয়াংশ। গ্রিকরা প্রকল্প বিষয়ে ছিলেন অবিমৃষ্যকারী, কিন্তু মিলেশীয় গোষ্ঠীরা অন্তত তাঁদের প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখতে প্রস্তুত ছিলেন। থালেস সম্পর্কে জ্ঞান এতই অল্প যে, সেই জ্ঞান থেকে সন্তোষজনকভাবে তাঁকে পুনর্নির্মাণ করা যায় না কিন্তু তাঁর মিলেশীয় উত্তরসূরিদের সম্পর্কে জ্ঞান অনেক বেশি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা যে থালেস থেকে আহরিত- এরকম অনুমান যুক্তিসঙ্গত। তার বিজ্ঞান এবং দর্শন-দুই-ই ছিল অমার্জিত কিন্তু সেগুলো চিন্তা এবং পর্যবেক্ষণকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাঁর সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে কিন্তু যে কটি তথ্য উল্লেখ করেছে তার চাইতে অধিকতর কিছু জানা আছে বলে মনে হয় না। কতগুলো গল্প বেশ মনোরঞ্জক, যেমন-আরিস্ততেলেসের রাজনীতি (Politics-১২৫৯৭) গ্রন্থে আছে? তিনি দারিদ্র্যের জন্য নিন্দিত ছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হতো যে, দর্শনশাস্ত্র কোনো কাজের নয়। কাহিনি অনুসারে তিনি তার তারকাপুঞ্জ সংক্রান্ত জ্ঞান থেকে শীতকালেই বুঝেছিলেন আগামী বছরে জলপাইয়ের ফসল খুব ভালো হবে। তাঁর সামান্য টাকা ছিল, সেই টাকা দিয়ে তিনি খিয়স (Chios) এবং মিলেতস (Miletus)-এর সমস্ত জলপাইয়ের ঘানি বায়না করে ফেললেন, বায়নাটা উনি সস্তায়ই করেছিলেন, কারণ তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ফসল সংগ্রহের সময় হঠাৎ একসঙ্গে সমস্ত ঘানির প্রয়োজন হলে তিনি তাঁর খুশিমতো দরে ঘানিগুলো ভাড়া দিলেন, ফলে তাঁর খানিকটা অর্থ লাভ হলো। এভাবেই তিনি পৃথিবীকে দেখিয়েছিলেন- মনস্থ করলে দার্শনিকরা সহজেই ধনী হতে পারেন, তবে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অন্যরকম।
মিলেশীয় গোষ্ঠীর দ্বিতীয় দার্শনিক আনাক্সিমাস (Anaximander) থালেসের চেয়ে অধিকতর আকর্ষণীয়। তাঁর জীবনকাল অনিশ্চিত তবে কথিত আছে ৫৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁর বয়স ছিল ৬৪ বছর। এ তথ্য যে সত্যের কাছাকাছি সেটা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে। তাঁর মত ছিল সকল বস্তুর উৎস একটি আদিম পদার্থ (primal substance) কিন্তু তা থালেসের জল নয়, কিংবা নয় আমাদের জানা কোনো বস্তু। যে পদার্থ অনাদি, অনন্ত ও কালাতীত এবং জগৎ সমষ্টিকে ঐ পদার্থ পরিবেষ্টন করে রয়েছে-তার ধারণা ছিল জগৎ বহু এবং আমাদের পৃথিবী তার একটি। আদিম পদার্থ আমাদের পরিচিত নানা বস্তুতে রূপান্তরিত হয় এবং তারা পরস্পর পরস্পরে পরিবর্তিত হয়। এ সম্পর্কে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন।
যা থেকে উদ্ভব হয় বস্তুগুলো তাতেই বিলীন হয়- নিয়তি এমনই। তার কারণ, তারা পরস্পর পরস্পরের অবিচারজনিত ক্ষতিপূরণ এবং সন্তোষসাধন করে- কালের বিন্যাস অনুসারে এ ঘটনা ঘটে।
মহাজাগতিক এবং মানবিক সুবিচার সম্পর্কে ধারণা গ্রিক দর্শন এবং ধর্মে এমন একটি ভূমিকা পালন করেছে যা আধুনিক মানুষের পক্ষে বোঝা খুব সহজ নয়। আসলে আমাদের ন্যায় justice) শব্দটা গ্রিসের বোধের সামান্যই প্রকাশ করে কিন্তু এর বিকল্প কোনো পছন্দসই শব্দ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মনে হয়, আনাক্সিমাস যে চিন্তাধারা প্রকাশ করেছেন সেটা সম্ভবত এই : বিশ্বের অগ্নি, ক্ষিতি (earth) এবং জল এগুলোর প্রত্যেকেরই একটি বিশেষ অনুপাত থাকা উচিত, কিন্তু প্রতিটি উপাদানই (এক একজন দেবতা বলে কল্পিত) নিজের সাম্রাজ্য বৃদ্ধির জন্য নিরন্তর সচেষ্ট। কিন্তু একটা প্রয়োজন কিংবা স্বাভাবিক বিধি আছে, যার সাহায্যে অবিরত ভারসাম্য পুনঃস্থাপিত হচ্ছে, যথা- আগুন থাকলেই ভস্ম থাকবে, ভস্মটা ক্ষিতির অংশ। ন্যায় সম্পর্কে এই কল্পন (conception) অর্থাৎ নির্দিষ্ট সীমা লঙ্ঘন না করা ছিল গ্রিকদের গভীরতম বিশ্বাসগুলোর মধ্যে একটি। মানুষ যতটা দেবতারাও ততটাই সুবিচারের অধীন ছিলেন কিন্তু এই সর্বোচ্চ শক্তি ব্যক্তিগত ছিল না এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছিলেন না।
আদিম পদার্থ যে জল হতে পারে না কিংবা পারে না কোনো জ্ঞাত মৌল পদার্থ হতে- এটা প্রমাণ করতে আনাক্সিমাসের একটি যুক্তি ছিল। যদি জ্ঞাত কোনো বস্তু আদিম বস্তু হয় তাহলে সে অন্য বস্তুকে জয় করবে। আরিস্ততেলেস অনুসারে, তিনি বলেছেন, এই জ্ঞাত মৌল উপাদানগুলো পরস্পরবিরোধী। বায়ু শীতল, জল সিক্ত এবং অগ্নি তপ্ত। সুতরাং এগুলোর কোনো একটি যদি অসীম হতো তাহলে এতদিনের অন্যগুলো লুপ্ত হয়ে যেত। তাই এই মহাজাগতিক দ্বন্দ্বে আদিম পদার্থকে নিরপেক্ষ হতেই হবে।
একটা চিরন্তন গতি ছিল- এই গতিপথে বিভিন্ন জগতের উৎপত্তি। ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টিয় ধর্মতত্ত্বের মতে পৃথিবী সৃষ্ট কিন্তু আনাক্সিমাসের মতে পৃথিবী বিবর্তিত। জীবজগতেও বিবর্তন ছিল। সিক্ত বস্তু সূর্যের উত্তাপে শুষ্ক হয়ে জীবন্ত বস্তুর উদ্ভব হয়। অন্যান্য সব পশুর মতো মানুষও মাছেদের বংশধর। মানুষ নিশ্চয়ই অন্য ধরনের পশুর বংশধর, কারণ মানুষের যেরকম দীর্ঘ শৈশব তাতে সে আদিতে বাঁচতে পারত না- যা এখন সে পারে।
আনাক্সিমান্দ্রস ছিলেন বৈজ্ঞানিক কৌতূহলে পরিপূর্ণ। বলা হয়, তিনিই প্রথম মানচিত্র এঁকেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল পৃথিবী বেলনাকার। সূর্যের আকার সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন সে সম্পর্কে নানা মত শোনা যায়, যেমন- সূর্য পৃথিবীর মতোই বড় কিংবা সূর্যটা পৃথিবীর চাইতে সাতাশ গুণ বড় কিংবা বড় আঠাশ গুণ।
নিজস্ব মৌলিক মত তিনি যা প্রকাশ করেছেন সেগুলো সবই বৈজ্ঞানিক এবং যৌক্তিক।
মিলেশীয় ত্রয়ীর শেষ দার্শনিক আনাক্সিমেনেস (Anaximenes) আনাক্সিমান্দ্রসের মতো তত আকর্ষণীয় নন, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি তিনি ঘটিয়েছিলেন তাঁর কাল অতি অনিশ্চিত। তিনি নিশ্চিতভাবে আনাক্সিমান্দ্রসের পরবর্তী ছিলেন এবং তাঁর কর্মজীবন ৪৯৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পূর্ববর্তী, কারণ, ইওনীয় বিদ্রোহ দমন করার সময় সে বছরই পারসিকরা মিলেস ধ্বংস করেন।
তিনি বলেছিলেন, মূলগত পদার্থ হলো বায়ু। আত্মা বায়ু, অগ্নি লঘুভূত বায়ু (rarefield air); বায়ু ঘনীভূত হলে প্রথমে জলে পরিণত হয় এবং আরও ঘনীভূত হলে ক্ষিতিতে এবং অন্তিমে প্রস্তরে রূপান্তিত হয়। এই তত্ত্বের গুণ হলো বিভিন্ন বস্তুর পার্থক্যকে সম্পূর্ণরূপে তাদের ঘনত্বের পরিমাণের উপরে নির্ভরশীল বলা হয়েছে।
তাঁরা চিন্তন ছিল পৃথিবীর আকার একটি গোলটেবিলের মতো এবং সকল বস্তু বায়ু দ্বারা বেষ্টিত : ঠিক যেমন আত্মা বায়ু হওয়ার দরুন আমাদের একত্রে ধারণ করে রাখে, তেমনই শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বায়ু সমগ্র পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে। মনে হয় যেন পৃথিবীও শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়।
প্রাচীনকালে আনাক্সিমাসের তুলনায় আনাক্সিমেনেস বেশি প্রশংসা পেয়েছেন, অথচ যে কোনো আধুনিক জগতের মূল্যায়ন হবে ঠিক বিপরীত। পুথাগরসের উপর প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং পরবর্তী বহু দূরকল্পনের উপরে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। পুথাগোরীয়রা আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবী গোলাকৃতি কিন্তু পরমাণুবাদীরা আনাক্সিমেনেসের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছেন। তাঁদের চিন্তায় পৃথিবীটা চাকতির মতো।
মিলেশীয় গোষ্ঠীর গুরুত্ব তাদের কৃতিত্বের জন্য নয়, গুরুত্ব তাঁদের প্রচেষ্টার জন্য। এ প্রচেষ্টার উৎস ছিল গ্রিক মানসের সঙ্গে মিশর এবং ব্যাবিলনিয়ার যোগাযোগ। মিলেতস একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক নগরী ছিল, সেখানে নানা জাতির মধ্যে যোগাযোগের ফলে কুসংস্কার এবং আদিম অন্ধ বিশ্বাসের প্রভাব অনেক হ্রাস পেয়েছিল। পঞ্চম শতাব্দীতে দারিয়স (Darius)-এর অধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইওনীয় ছিল সাংস্কৃতিক দিক থেকে হেলেনীয় জগতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দিওনিসিয়সীয় এবং অর্ফীয় ধর্ম আন্দোলন একে প্রায় স্পর্শই করেনি-এর ধর্ম ছিল অলিম্পীয়, কিন্তু সে ধর্মকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো না। থালেস, আনাক্সিমাস এবং আনাক্সিমেনেস-এর দূর কল্পনগুলোতে বৈজ্ঞানিক প্রকল্প বলেই ভাবা উচিত এবং তাতে নরত্বীয় (anthropomorphi) আকাক্ষা অথবা নৈতিক চিন্তার অনধিকার প্রবেশ ঘটেছে সামান্যই। যে প্রশ্ন তাঁরা উত্থাপন করেছিলেন- প্রশ্নগুলো উত্তম, সেই প্রশ্নের প্রাণশক্তি পরবর্তী অনুসন্ধানকারীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।
গ্রিক দর্শনের পরবর্তী পর্যায় দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত-এই দর্শন আরও ধর্মনির্ভর, বিশেষ করে অধিকতর অফীয়। কোনো কোনো ব্যাপারে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং প্রশংসনীয় কৃতিত্বের অধিকারী, কিন্তু এর মর্মবাণী ছিল মিলেশীয়দের তুলনায় অনেক কম বৈজ্ঞানিক।