০৩. পীথাগোরাস

৩. পীথাগোরাস

আমার এই অধ্যায়ের মূল বক্তব্য হলো প্রাচীন এবং আধুনিক যুগে পীথাগোরাসের প্রভাব। বৌদ্ধিক দিক থেকে তিনি মানব সমাজের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণদের একজন। জ্ঞানীর মতো এবং জ্ঞানহীনের মতো আচরণের কালে- উভয় অস্থায়ই এ কথা সমান প্রযোজ্য। প্রদর্শনীয় অবরোহী যুক্তি হিসেবে (deductive argument) গণিতের শুরু পুথাগর থেকে এবং তাঁর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে এক অদ্ভুত অলৌকিকবাদ। অংশত তাঁরই জন্য দর্শনের উপরে গণিতের প্রভাব এবং এই প্রভাব তাঁর সময় থেকেই সুগভীর এবং দুর্ভাগ্যজনক।

যতটুকু জানা আছে তাই দিয়েই তার জীবন সম্পর্কে শুরু করা যাক। তাঁর আদি নিবাস ছিল সামস (Samos) দ্বীপে এবং তাঁর জীবনকাল ৫৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি। অনেকে বলেন, তিনি সোস (Mnesarchos) নামে একজন ধনী নাগরিকের সন্তান, আবার অনেকের মতে তিনি এ্যাপোলো দেবের সন্তান-পাঠকদের স্বাধীনতা রইল দুটি মতের ভিতরে যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার। তাঁর সময়ে সামসের শাসনকর্তা ছিলেন স্বৈরতন্ত্রী পলিক্রাতেস (Polycrates), এই বৃদ্ধ দুবৃত্তটি বিরাট ধনী হয়েছিলেন এবং এক বিশাল নৌবাহিনীর অধিপতি ছিলেন।

মিলেতসের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সামস, সেখানকার বণিকরা, এমনকি সুদূর স্পেনের তাতেসুস (Tartessus) পর্যন্ত যেতেন, যা ছিল খনির জন্য খ্যাত। পলিক্রাতেস ৫৩৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সামসের স্বৈরাচারী রাজা হন এবং ৫১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। নীতিবোধের কোনো বালাই তাঁর ছিল না। তার দুই ভাই স্বৈরাচারের প্রথম দিকে তাঁর সহযোগী ছিলেন, পরবর্তী দুজনকেই তিনি হত্যা করেন। তাঁর নৌবাহিনী প্রধানত জলদস্যুবৃত্তিতেই ব্যবহৃত হতো। সেই সময় মিলেতসের পারস্যের অধীন হওয়ার ঘটনা থেকে তিনি ফায়দা লোটেন। পারসিকদের পশ্চিমদিকে আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য তিনি মিশরের রাজা অ্যামাসিস (Amasis)-এর পক্ষ অবলম্বন করেন, কিন্তু যখন পারস্যের রাজা কামবুসেস (Cambyses) মিশর অধিকার করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। তখন তাঁর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বুঝে পলিক্রাতেস পক্ষ পরিবর্তন করেন। তিনি মিশরকে আক্রমণ করার জন্য তাঁর রাজনৈতিক শত্রুদের দ্বারা গঠিত একটি নৌবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু নাবিকরা বিদ্রোহ করেন এবং তাঁকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে সামস-এ ফিরে আসেন। তাদের বিরুদ্ধে পলিক্রাতেস জয়ী হতে সমর্থ হলেও অবশেষে নিজের বিশ্বাসঘাতক লোভের জন্য তার পতন হয়। পারস্যের প্রাদেশিক শাসক সার্দেস (Sardes) জানিয়েছিলেন তিনি মহান সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চান এবং পলিক্রাতেস সাহায্য করলে তাঁকে বহু অর্থ দেবেন। পলিক্রাতেস দেখা করার জন্য মূল ভূখণ্ডে গেলে তাঁকে বন্দী করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়।

পলিক্রাতেস শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বহু হিতকর এবং চমকপ্রদ কর্ম দিয়ে সামস-এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর সভাকবি ছিলেন আনাক্রেয়ন (Anacreon)। তাঁর সরকারকে অপছন্দ হওয়ার পীথাগোরাস সামস পরিত্যাগ করেন। কথিত আছে এবং হয়তো অসম্ভব নয় যে, পীথাগোরাস মিশরে গিয়েছিলেন ও তার প্রজ্ঞান অনেকটাই তিনি মিশর থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ ইতালির ক্রোটন (Croton)-এ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

সামস এবং মিলেতসের মতোই ধনী এবং সমৃদ্ধ ছিল দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরগুলো, তাছাড়া তারা পারসিক ভয় থেকে মুক্ত ছিল। বৃহত্তম দুটি নগরী ছিল সুবারিস (Sybaris) এবং ক্রোটন। সুবারিস বিলাসবাহুল্যের জন্য প্রবাদ হয়ে আছে। দিওদরস (Diodorus) বলেছেন, সুবারিসের শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোতে তার জনসংখ্যা ছিল তিন লক্ষ (৩,০০,০০০)। সন্দেহ নেই এটা অত্যুক্তি। আয়তনে ক্রোটন ছিল সুবারিসের সমান। ইওনীয়দের তৈজসপত্র ইতালিতে আমদানি করাই ছিল এই দুটি নগরীর জীবিকা। এই তৈজসপত্রের খানিকটা ইতালিতেই ব্যবহার হতো, আবার খানিকটা পশ্চিম উপকূল থেকে গল এবং স্পেনে পুনরপ্তানি হতো। ইতালির গ্রিক নগরগুলো পরস্পরের সঙ্গে ভয়ংকর যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। পুথাগরস যখন ক্রোটনে পা দিয়েছেন তখন সেই নগর সদ্য লখ্রি (Locri)-র কাছে পরাজিত হয়েছেন। তাঁর আগমনের অনতিকাল পরেই কিন্তু সুবারিসের সঙ্গে যুদ্ধে ক্রোটন সম্পূর্ণ জয়লাভ করে এবং ৫১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সুবারিস সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মিলেতসের সঙ্গে সুবারিসের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ক্রোটন ওষুধের জন্য বিখ্যাত ছিল। ক্রোটনের জনৈক ডেমোসিডিস (Democedes) পলিক্রোতেসের চিকিৎসক হন এবং পরে হন দারিয়সের চিকিৎসক।

ক্রোটন-এ পুথাগরস একটি শিষ্যসমাজ স্থাপন করেন, ঐ শহরে কিছুকাল এই সমাজের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাগরিকরা তাঁর বিরুদ্ধে যান এবং তিনি মেতাপন্তিয়ন (Metapontion) এ চলে যান (এই নগরীও ছিল দক্ষিণ ইতালিতে), এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। শীঘ্রই তিনি পরিণত হন এবং প্রবাদ পুরুষ-এ (mythical figure), নানা অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম এবং জাদুবিদ্যার কৃতিত্ব তাঁকে অর্পণ করা হয়। তবে তিনি একটি গাণিতিক গোষ্ঠীরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সুতরাং তাঁর স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত রয়েছে দুটি বিপরীত ঐতিহ্যের দ্বন্দ্ব এবং জট ছাড়িয়ে সত্যকে খুঁজে বার করা শক্ত।

পুথাগরস ইতিহাসে সর্বাধিক আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের একজন এবং এক বিরাট ধাঁধা। তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত ঐতিহ্য শুধুমাত্র সত্য এবং মিথ্যার জটিল মিশ্রণই নয়, তাঁর সম্পর্কে এমনকি স্বল্পতম এবং তর্কাতীত তথ্যে এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব দেখতে পাই। সংক্ষেপে তাঁকে আইনস্টাইন এবং শ্রীমতি এডি (Mrs. Eddy)-র সমন্বয় বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। তিনি যে ধর্মসম্প্রদায় স্থাপন করেন তার মূলনীতি ছিল আত্মার পুনর্জন্ম এবং শিম (bean) ভক্ষণজনিত পাপ। তার ধর্ম একটি ধর্মসম্প্রদায়ে পরিণত হয়, সে সম্প্রদায় এখানে সেখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দখল করে এবং ঋষিদের শাসন স্থাপন করে। কিন্তু অধঃপতিতরা শিম খাওয়ার জন্য ছোঁক ছোঁক করতে থাকে এবং আগে হোক পরে হোক-তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

পুথাগোরীয় সম্প্রদায়ের কয়েকটি নিয়মঃ

১। শিম অভক্ষ্য।

২। পতিত বস্তা না ভোলা।

৩। সাদা মোরগ অস্পৃশ্য।

৪। রুটি না ভাঙা।  

৫। দুটি দণ্ডের উপরে আড়াআড়িভাবে যদি একটি দণ্ড থাকে তাহলে সেটি ডিঙিয়ে না যাওয়া।

 ৬। লোহা দিয়ে আগুন উস্কে না দেওয়া।

৭। গোটা পাউরুটি থেকে না খাওয়া।

৮। মালা থেকে ফুল চয়ন না করা।

 ৯। কোয়ার্ট (quarter-দুই পাঁইট, প্রায় দশ ছটাক) মাপার পাত্রের উপরে না বসা।

১০। হৃদপিণ্ড অভক্ষ্য।

১১। রাজপথ দিয়ে না হাঁটা।

১২। সোয়ালোর (swallow-বসন্তের একরকম পাখি) সঙ্গে একই ছাদের তলায় থাকা।

 ১৩। আগুন থেকে পাত্র তুলে তাপ ছাপ ছাইয়ের উপরে না রাখা এবং সেজন্য ছাইটাকে নেড়ে সমান করে দেওয়া।

১৪। আলোর পাশে আয়নার ভেতর না দেখা।

১৫। শয্যা ত্যাগ করে শয্যা গুটিয়ে রাখা এবং দেহের চিহ্নকে সমান করে দেওয়া।

এই সমস্ত নৈতিক শিক্ষা আদিম-নিষিদ্ধকরণ (tabu-conceptions) ধ্যান-ধারণার অংশ।

কর্ণফোর্ড (ধর্ম থেকে দর্শন গ্রন্থে) বলেন, তাঁর মতে, পুথাগরস গোষ্ঠী অতীন্দ্রিয় ঐতিহ্যের মূল ধারার প্রতিনিধি, এই ধারাকে আমরা বিজ্ঞান প্রবণতার সম্পূর্ণ বিপরীতে স্থাপন করেছি। তাঁর মতে, পার্মেনিদেস (Parmenides), যাকে তিনি তর্কবিদ্যার আবিষ্কর্তা মনে করেন, পুথাগরসবাদের একটি শাখা এবং প্লাতন (Plato) নিজে তাঁর প্রধান প্রেরণা পেয়েছিলেন ইতালির দর্শন থেকে। তিনি বলেন, পুথাগরসবাদ ছিল অফীয় মতবাদের একটি সংস্কার আন্দোলন, অফীয় মতবাদ আবার ছিল দিওনিসিয়স পূজার সংস্কার আন্দোলন। ইতিহাসে সর্বত্রই যুক্তিবাদ এবং অতীন্দ্রিয়বাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। গ্রিকদের ভিতর এটা প্রথম দেখা দেয় অলিম্পীয় দেবতা এবং অন্যান্য স্বল্প সভ্য দেবতাদের দ্বন্দ্বে নৃতত্ত্ববিদরা এই স্বল্প সভ্য দেবতাদের সঙ্গে আদিম বিশ্বাসগুলোর নিকটতম সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই বিভাজনে পুথাগরস ছিলেন অতীন্দ্রয়বাদীদের পক্ষে কিন্তু তার অতীন্দ্রিয়বাদের একটা অদ্ভুত বৌদ্ধিক রূপ ছিল। তিনি নিজের উপরে আংশিক দেবত্ব আরোপ করতেন, শোনা যায় তিনি বলেছেন : মানুষ আছে, দেবতাও আছেন, এবং পুথাগরসের মতো জীবও রয়েছেন। যে সমস্ত তন্ত্র তাঁর কাছে প্রেরণা পেয়েছিল কর্ণফোর্ডের মতে তার সবগুলোরই ঝোঁক অতিজাগতিক সমস্ত মূল্যই তিনি আরোপ করেছেন ঈশ্বরের অদৃশ্য ঐক্যে এবং দৃশ্যমান বিশ্বজগৎকে মিথ্যা এবং মায়াময় বলে নিন্দা করেছেন। বলেছেন, জগতটা একটা অস্বচ্ছ মাধ্যম-তার ভিতর স্বর্গীয় আলোকরশ্মি ভেঙে যায় এবং অস্পষ্ট হয়ে যায় কুয়াশা ও অন্ধকারের আড়ালে।

দিকেআর্খস্ (Dikaiarchos) বলেন, পুথাগরসের শিক্ষা প্রথমত আত্মা অমর এবং তা অন্য প্রকারের জীবে রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও অস্তিত্বশীল সকল প্রাণের কোনো চক্রে পুনর্জন্ম হয় তাই কোনো কিছুই সম্পূর্ণ নতুন নয় এবং প্রাণ নিয়ে যাদের জন্ম তাদের আত্মীয় মনে করতে হবে। কথিত আছে, সাধু ফ্রান্সিসের মতো পুথাগরস পশুদের ধর্মোপদেশ দিতেন।

তার স্থাপিত সমাজে স্ত্রী ও পুরুষকে একই শর্তে গ্রহণ করা হতো সম্পত্তির মালিকানা সর্বসাধারণের ছিল এবং জীবনযাপনের ধরনও ছিল এক প্রকার। এমনকি, বৈজ্ঞানিক এবং গাণিতিক আবিষ্কারগুলোও যৌথ বলে বিবেচিত হতো এবং অতীন্দ্রিয় অর্থে পুথাগরসকেই সেগুলোর কারণ ভাবা হতো, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও। নিয়মভঙ্গকারী হিপ্পাসস (Hippasos)-যিনি মেতাপন্তিয়ন (Metapontion)- এর লোক ছিলেন-তার জাহাজডুবি হয়েছিল এই নিয়মভঙ্গের জন্য, দৈব ক্রোধ তার কারণ।

কিন্তু এসবের সঙ্গে গণিতের কী যোগ? সে যোগ এক নীতির সূত্রে-সে নীতি মননশীল জীবনের জয়গান করে। বার্পেট এই নীতির সংক্ষিপ্তসার করেছেনঃ

‘এ পৃথিবীতে আমরা আগন্তুক এবং শরীর হল আত্মার সমাধিমন্দির কিন্তু আত্মহনন করে পলায়নের প্রচেষ্টা অনুচিত; আমরা ঈশ্বরের অস্থাবর সম্পত্তি, তিনি আমাদের দলপতি। তাঁর আদেশ ব্যতীত পলায়নে আমরা অনধিকারী। অলিম্পিক ক্রীড়ায় যেমন তিন প্রকারের মানুষ আসেন তেমনই এই জীবনে তিন প্রকারের মানুষ দেখা যায়। সর্বনিম্ন শ্রেণি ক্রয়-বিক্রয়কারী, তার ঊর্ধ্বে যাঁরা, তাঁরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁরা, যাঁরা শুধুমাত্র দর্শক। তাই সর্বোচ্চ বিশুদ্ধি হলো নিষ্কাম বিজ্ঞান। যে নিজেকে এই কার্যে সমর্পণ করে সেই যথার্থ দার্শনিক, সে নিজেকে কার্যকরভাবে জন্মচক্র থেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে।’

 শব্দার্থের পরিবর্তন অনেক সময়ই খুব শিক্ষামূলক। আগে উন্মাদনা (orgy) শব্দ সম্পর্কে বলেছি, এখন তত্ত্ব (theory) শব্দ সম্পর্কে বলব। মূলত এটা অফীয় শব্দ, কর্ণফোর্ড এর অর্থ করেছেন সআবেগ সমব্যথী চিন্তন। তিনি বলেন, এই অবস্থায় দর্শক যন্ত্রণাদগ্ধ ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়, তাঁর মৃত্যুতে মৃত হয় এবং নবজন্মে তার পুনরুত্থান হয়। পীথাগোরাসের এই সআবেগ সমব্যথী চিন্তন ছিল বৌদ্ধিক এবং তা প্রকাশিত হয়েছিল গাণিতিক বৈদগ্ধে। এইভাবে পীথাগোরাসবাদের মাধ্যমে তত্ত্ব শব্দটি তার আধুনিক অর্থ পরিগ্রহ করে কিন্তু পীথাগোরাস যাঁদের প্রেরণা তাঁদের কাছে এটিতে একটি হর্ষোচ্ছসিত দৈব সত্য প্রকাশের উপাদান অবশিষ্ট ছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যারা স্কুলে সামান্য গণিত শিখেছেন তাঁদের কাছে অদ্ভুত মনে হলেও, যারা সময়ে গণিতের সহসা উপলব্ধির মাতাল করা আনন্দ উপভোগ করেছেন এবং গণিত শাস্ত্রের অনুরাগী তাঁদের কাছে পুথাগোরীয় দৃষ্টিভঙ্গি অসত্য হলেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মনে হবে। পরীক্ষামূলক দার্শনিককে তাঁর জড় উপাদানের ক্রীতদাস মনে হতে পারে কিন্তু সংগীত শিল্পীর মতোই বিশুদ্ধ গণিতজ্ঞ তাঁর সুবিন্যস্ত সৌন্দর্যের জগতের স্বাধীন স্রষ্টা।

বার্ণেটের বিবরণ অনুসারে পীথাগোরীয় নীতির সঙ্গে আধুনিক মূল্যবোধের বিরোধিতা খুব কৌতূহলোদ্দীপক। আধুনিক চিন্তায় একটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় শুধুমাত্র দর্শকদের তুলনায় খেলোয়াড়রা বেশি চমৎকার। তেমনই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও আধুনিক মনন শুধুমাত্র দর্শকদের তুলনায় রাজনীতির খেলায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিকদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে। মূল্যবোধের এই পরিবর্তন সামাজিক রীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্তযোদ্ধা, অভিজাত, অর্থবান এবং একনায়ক-প্রত্যেকেরই শ্রেয় এবং সত্যের নিজস্ব মান আছে। অভিজাতদের দার্শনিক তত্ত্বের ইনিংস দীর্ঘ, কারণ তাঁরা গ্রিক প্রতিভার সঙ্গে জড়িত। কারণ, মননের মূল্য ধর্মতত্ত্বের অনুমোদন পেয়েছিল এবং নিষ্কাম সত্যের আদর্শ শিক্ষার জীবনকে গৌরবান্বিত করেছিল। অভিজাতের সংজ্ঞা হলো যিনি এমন এক সমাজের সদস্য যেখানে সকলেই সমান এবং যাঁর জীবন ও জীবিকা দাসশ্রমের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল কিংবা কিছু এমন মানুষের উপর নির্ভরশীল যাদের হীনতা প্রশ্নাতীত। মনে রাখতে হবে সন্ন্যাসী এবং ঋষিও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত, কারণ, এঁদের জীবনও চিন্তানির্ভর-কৰ্মনির্ভর নয়।

সত্যের আধুনিক সংজ্ঞা, যেমন যেগুলো প্রয়োেগশীলতার এবং যান্ত্রিকতাবাদের, সেগুলো যতনা মননশীল তার চেয়ে বেশি হাতে-কলমে সত্য। এই সত্যগুলো শ্রমশীলতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ- অভিজাত জীবনের দ্বারা নয়।

ক্রীতদাসপ্রথাকে সহ্য করে যে সমাজ তার সম্পর্কে যাই মনে করা হোক না কেন, উপরোক্ত অভিজাতশ্রেণির কাছেই আমরা বিশুদ্ধ গণিতের জন্য ঋণী। এই মননশীলতার আদর্শ বিশুদ্ধ গণিতের জন্মদাতা হওয়ার জন্যই সুফলপ্রদ কাজের উৎস এবং কার্যকরী হওয়াতেই এর সম্মান বেড়েছে ও ধর্মতত্ত্বে; নীতিশাস্ত্রে এবং দর্শনশাস্ত্রে সফল হয়েছে, না হলে এই সম্মান হয়তো তার ভাগ্যে জুটত না।

পীথাগোরাসের দুটি ভিন্ন দিকের ব্যাখ্যা এই পর্যন্তই: একদিকে ধর্মগুরু, অন্যদিকে শুদ্ধ গণিতবিদ। উভয় দিক দিয়েই তার প্রভাব অপরিমেয় এবং আধুনিক মানসে এদের যতই দূরবর্তী মনে হোক, আদিতে তা ছিল না।

প্রায় প্রতিটি বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রথমদিকে কোনো না কোনো ধরনের মিথ্যা বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত ছিল, তার ফলে সেগুলোর কিছু কাল্পনিক মূল্য ছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞান জড়িত ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে, রসায়নশাস্ত্র জড়িত ছিল অপরসায়নের (alchemy) সঙ্গে। গণিতের সঙ্গে জড়িত ছিল আরও একটু সূক্ষ্ম ভুল। গণিতের জ্ঞানকে মনে হয়েছিল সুনির্দিষ্ট, নিশ্চিত, নির্ভুল এবং বাস্তব জগতে প্রযোজ্য; তাছাড়া বিশুদ্ধ চিন্তার সাহায্যে সে জ্ঞান আহরণ করে যেত, কোনো পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হতো না। সুতরাং মনে করা হতো গণিতের কাছে পাওয়া গেছে একটি আদর্শ, সে আদর্শ থেকে দৈনন্দিন কর্মভিত্তিক জ্ঞান অনেক ন্যূন। গণিতের ভিত্তিতে মনে করা হতো চিন্তাশক্তি ইন্দ্রিয়ানুভূতির চাইতে উন্নততর, স্বজ্ঞা (intuition) উন্নততর পর্যবেক্ষণের চাইতে। ইন্দ্রিয়ানুভূতির জগৎ যদি গণিতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে দোষটা তাহলে ইন্দ্রিয়ানুভূতির। গণিতবিদের আদর্শের নিকটতম হওয়ার পদ্ধতি নানাভাবে খোঁজা হয়েছিল এবং এর ফল যে সমস্ত অভিভাব (suggestions), সেগুলো জ্ঞানতত্ত্ব এবং অধিবিদ্যার বহু ভুলের উৎস। পুথাগরস থেকে এই ধরনের দর্শনের শুরু।

এটা সর্বজনবিদিত যে, পীথাগোরাস বলেছেন, সব বস্তুই সংখ্যা। আধুনিক ভাষ্যে এই বিবৃতি যুক্তিগতভাবে অর্থহীন কিন্তু তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা ঠিক অর্থহীন নয়। তিনি সংগীতে সংখ্যার গুরুত্ব আবিষ্কার করেছিলেন এবং সংগীত ও পাটীগণিতের ভিতর যে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন সে সম্পর্ক এখন স্বরাত্মক মধ্যক (harmonic mean) এবং সংগীতের সুরের ক্রমান্বয়িক উত্থান ও পতন (harmonic progression) শব্দগুলোর ভিতর বেঁচে আছে। তার চিন্তনে সংখ্যাগুলোর আকৃতি ছিল-যেমন দেখা যায় পাশার খুঁটি কিংবা খেলার তাসে। আজও আমরা সংখ্যার বর্গ (square) এবং ঘনফলের (cube) কথা বলি, এই শব্দগুলোর জন্য আমরা তার কাছে ঋণী। তিনি আয়ত (দৈর্ঘ্য > প্রস্থ) সংখ্যা, ক্রিকোণ সংখ্যা, পিরামিডাকৃতি সংখ্যা (ত্ৰিপার্শ্ব শঙ্কু) ইত্যাদির কথা বলেছেন। এগুলোর ছিল আলোচ্য আকার তৈরি করতে প্রয়োজনীয় নুড়ির সংখ্যা (কিংবা, আরও স্বাভাবিকভাবে বলা যায় ছররা-shot)। বোধ হয় তিনি ভাবতেন পৃথিবীটা আণবিক এবং বিভিন্ন বস্তুপিণ্ড অণু দিয়ে গঠিত, অণুগুলো গঠিত পরমাণুগুলোকে নানা আকারে সাজিয়ে। এভাবেই তাঁর আশা ছিল পদার্থবিদ্যায় এবং নন্দনতত্ত্বে গণিতকে মূলগত পাঠ্য করা।

পীথাগোরাস কিংবা তার প্রত্যক্ষ শিষ্যদের বৃহত্তম আবিষ্কার ছিল সমকোণী ত্রিভুজ সম্পর্কে উপপাদ্য অর্থাৎ সমকোণের পার্শ্ববর্তী দুটি বাহুর বর্গের যোগফল অতিভুজের (hypotenuse) বর্গের সমান। যে ত্রিভুজের বাহুগুলো ৩, ৪ এবং ৫, তার ভিতরে একটি সমকোণ রয়েছে-এ তথ্য মিশরীয়রা জানতেন কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ৩^২+৪^২=৫^২ এটা গ্রিকরা প্রথম জেনেছিলেন। এই অভিভাবের সাহায্যে তারা সাধারণ উপপাদ্যটির প্রমাণ আবিষ্কার করেছিলেন।

পুথাগরসের দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর উপপাদ্য তৎক্ষণাৎ অমেয় (incommensurables) আবিষ্কারের পথিকৃৎ হলো, তার ফলে গোটা দর্শনই অপ্রমাণিত হলো। একটি সমকোণী সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ অন্য যে কোনো বাহুর বর্গের দ্বিগুণ। অনুমান করা যাক, প্রতিটি বাহু এক ইঞ্চি লম্বা-তাহলে অতিভুজ কত লম্বা? অনুমান করা যাক, এর দৈর্ঘ্য m/n ইঞ্চি। তাহলে m^২/n^২ =২; m এবং n-এর সাধারণ গুণক থাকলে ভাগ করে ফেলুন, তাহলে m অথবা n বিজোড় সংখ্যা হবে। m^২=২ n^২, সুতরাং m^২ জোড় সংখ্যা; তাহলে m জোড় সংখ্যা, সুতরাং n বিজোড় সংখ্যা। অনুমাণ করা যাক, m =2p। তাহলে 8p^২=2n^২, সুতরাং n^২=2p^২ এবং n জোড় সংখ্যা। এটা প্রকল্পের বিরোধী (Contra hyp)। সুতরাং m/n এর কোনো ভগ্নাংশই অতিভুজকে মাপতে পারবে না। এই প্রমাণ প্রকৃতপক্ষে এউক্লিদের দশম খণ্ডে রয়েছে।

এই যুক্তি প্রমাণ করে যে, আমরা দৈর্ঘ্যের যে এককই গ্রহণ করি না কেন, এমন কতগুলো দৈর্ঘ্য থাকে যার ঐ এককের সঙ্গে কোনো সাংখ্যিক সম্পর্ক থাকবে না অর্থাৎ m এবং n এরকম কোনো পূর্ণ সংখ্যা নেই যেখানে আলোচ্য দৈর্ঘ্যের m গুণ, এককের n গুণ। এর ফলে গ্রিক গণিতবিদরা স্থির নিশ্চয় হলেন যে, জ্যামিতিকে পাটিগণিত সাপেক্ষে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্লাতনের কথোপকথনের কতগুলো বক্তব্য থেকে প্রমাণ হয় তার সময় জ্যামিতির স্বাধীন বিকাশ অনেকটাই অগ্রসর হয়েছিল, জ্যামিতিকে নিখুঁত করেছিলেন এউক্লিদ। এউক্লিদ তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডে জ্যামিতির সাহায্যে এমন অনেক জিনিস প্রমাণ করেছেন, প্রমাণগুলো স্বভাবতই বীজগণিতের সাহায্যে আমাদের করা উচিত, যেমন-(a+b)^২=a^২+২ab+b^২। অমেয়গুলোর ত্রুটির জন্য তিনি এই পদ্ধতিকে প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর পুস্তকের পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডের অনুপাতগুলো নিয়ে আলোচনা সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। এই তন্ত্রের সম্পূর্ণটাই যৌক্তিকভাবে আনন্দদায়ক এবং এ তন্ত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর গণিতজ্ঞদের শ্রমশীলতা পূর্বাহ্নেই অনুমান করেছিল। যতদিন অমেয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত পাটীগণিত তত্ত্ব ছিল না, ততদিন এউক্লিদের পদ্ধতি শ্ৰেষ্ঠ ছিল- যে শ্রেষ্ঠত্ব জ্যামিতির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। দেকার্তে স্থানাঙ্ক জ্যামিতি উপস্থাপন করে পাটীগণিতকে আবার সর্বোচ্চ স্থান দিলেন; তিনি অমেয় সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অসময়ে এরকম কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং দর্শনশাস্ত্রের উপরে জ্যামিতির প্রভাব সুগভীর। গ্রিকরা যে জ্যামিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার শুরুতে কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ দিয়ে, সেগুলো স্বপ্রকাশ (অথবা সেইরকমই মনে করা হয়) এবং তারপর অবরোহী যুক্তির সাহায্যে এমন সমস্ত উপপাদ্যে পৌঁছায় যেগুলো মোটেই স্বপ্রকাশ নয়। মনে করা হয় স্বতঃসিদ্ধ এবং উপপাদ্যগুলো বাস্তব স্থান সাপেক্ষ সত্য, এই বাস্তব স্থান অভিজ্ঞতাপ্রসূত। মনে হয়েছিল যা স্বপ্রকাশ তাকে জেনে এবং অবরোহী যুক্তির সাহায্যে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে আবিষ্কার করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্লাতন, কান্ট এবং মধ্যবর্তী অধিকাংশ দার্শনিককে। প্রভাবিত করেছে। স্বাধীনতা ঘোষণায় যখন বলা হয় এই সকল সত্যকে আমরা স্বপ্ৰকাশ মনে করি, তখন সেটা এউক্লিদীয় আদর্শের অনুকরণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর সহজাত অধিকার বিষয়ক মতবাদ আসলে রাজনীতিতে এউক্লিদীয় স্বতঃসিদ্ধের সন্ধান। পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও নিউটনের প্রিন্সিপিয়া-র গঠন সম্পূর্ণরূপে এউক্লিদ দ্বারা প্রভাবিত। পাণ্ডিত্যপূর্ণ ধর্মতত্ত্বের রচনাশৈলীর একই উৎস। ব্যক্তিগত ধর্ম আহরণ করা হয় উন্মাদনা থেকে, ধর্মতত্ত্ব আহরণ করা হয় গণিত থেকে এবং পীথাগরসে এ দুটোই পাওয়া যায়।

আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি, গণিত হলো অতি-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (Super-sensible) বোধগম্য জগতে আস্থার প্রধান উৎস এবং চিরন্তন ও নির্ভুল সত্যে আস্থা। জ্যামিতির বিচার নির্ভুল বৃত্ত নিয়ে কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো বৃত্ত নির্ভুল বৃত্ত নয়। যত যত্ন নিয়েই আমরা কম্পাস ব্যবহার করি না কেন, কিছু খুঁত আর অনিয়ম থেকেই যাবে। এটা ইঙ্গিত করে যে, আদর্শ বস্তুসমূহ অথবা চিন্তাসমূহের ক্ষেত্রে নির্ভুল যুক্তি প্রযোজ্য-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর ক্ষেত্রে নয়। স্বাভাবিকভাবে আরও এগিয়ে গিয়ে যুক্তি উপস্থিত করা যেতে পারে-চিন্তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার চেয়ে মহত্তর এবং চিন্তার বিষয়বস্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়বস্তুর চাইতে বেশি বাস্তব। কালের সঙ্গে নিত্যকার সম্পর্ক বিষয়ক অতীন্দ্রিয় মতবাদগুলো শুদ্ধ গণিতের সাহায্যে দৃঢ়তর হয়, কারণ, গাণিতিক বস্তু যেমন-সংখ্যা যদি বাস্তব হয় তাহলে তারা চিরন্তন, তাদের অবস্থান কালে নয়। এই চিরন্তন বস্তুগুলোকে ঐশ্বরিক চিরন্তন বলে ভাবা যেতে পারে, সেইজন্য প্লাতনের মতে ঈশ্বর জ্যামিতি বিশারদ এবং স্যার জেমস্ জীনস্ (Sir James Jeans) এর বিশ্বাস পাটীগণিতে ঈশ্বরের নেশা আছে। যুক্তিবাদী ধর্মের বিপরীতে বিদ্যাপ্রকাশভিত্তিক ধর্ম পীথাগোরাসের পর থেকে এবং বিশেষ করে প্লাতনের পর থেকে গণিত এবং গাণিতিক পদ্ধতির দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত। পীথাগোরাস থেকে গণিত এবং ধর্মতত্ত্বের যে সমন্বয় শুরু হয় সে সমন্বয় গ্রিসের মধ্যযুগের ধর্মীয় দর্শনের এবং কান্ট পর্যন্ত আধুনিক যুগের ধর্মীয় দর্শনের বিশেষত্ব। পীথাগোরাসের পূর্ববর্তী অফীয় মতবাদ এশীয় অতীন্দ্রিয়বাদী ধর্মের অনুরূপ ছিল। কিন্তু প্লাতন, সেন্ট অগস্তিন, টমাস অ্যাকুইন্যাস, দেকার্তে, স্পিনোজা এবং লিবনিজ-এ ধর্ম এবং যুক্তির একটা ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ঘটেছে, সমন্বয় ঘটেছে কালাতীত সম্পর্কে শ্রদ্ধা এবং নৈতিক আকাক্ষার, এগুলো এসেছে পীথাগরাসের কাছ থেকে। সহজ সরল এশীয় অতীন্দ্রিয়বাদ এবং ইউরোপীয় যৌক্তিক ধর্মতত্ত্বের ভিতরে এটাই পার্থক্য। পীথাগোরাসের কোথায় ভুল ছিল সেটা স্পষ্ট হয়েছে মাত্র অতি সম্প্রতিককালে। চিন্তাজগতে তাঁর মতো প্রভাবশালী অন্য কোনো ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই-আমার এ কথা বলার কারণ, যাকে আমরা প্লাতনবাদ বলি সেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আসলে সেটা পীথাগোরাসবাদ। একটি শাশ্বত জগৎ যা বুদ্ধিগ্রাহ্য কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় সে কল্পনের সম্পূর্ণটাই তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত। তিনি না থাকলে খ্রিষ্টিয়রা খ্রিষ্টকে শব্দ বলে ভাবতে পারত না, তিনি না থাকলে ধর্মতত্ত্ববিদরা ঈশ্বর এবং অমরত্বের যৌক্তিক প্রমাণ খুঁজতেন না। কিন্তু তার ভিতরে এটা ছিল অব্যক্ত (implicit)। করে সেটা ব্যক্ত হলো তা আমাদের অগ্রগতির সঙ্গে ক্রমশ প্রকাশ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *