মিনিট পাঁচেক চুপচাপ কাটল, তারপর বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “সাড়ে দশটা বাজল।”
চঞ্চল এতক্ষণে একটা কথা বললে, “আমার মনে হয়, ওঁর ফিরতে দেরি হবে। হয়তো কোথাও গেছেন টেছেন। আমি তাহলে…”
বিজয়কৃষ্ণ তাড়াতাড়ি বললেন, “না, না, আপনি এক্ষুণি যাবেন না। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না!”
বিজয়বাবুর এই চিন্তিতভাব দেখে চঞ্চলের একটু হাসিই পেল। যেন এত বড় একটা পুরুষমানুষ কলকাতার শহর থেকে হারিয়ে যাবে। চঞ্চল রাত্তিরে যে কোনো সময়ে কলকাতার যে কোনো রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় – তার মনে কোনো ভয়ের ভাব আসে না। তাই সে বেশ শন্তভাবে বললে, “আপনি বরং শুয়ে পড়ুন গিয়ে।”
“শুয়ে পড়ব!” বিজয়কৃষ্ণ উত্তেজিতভাবে বললেন। তারপর, নিজের উত্তেজনা প্রকাশ পাওয়ার জন্যে একটু যেন লজ্জিতভাবেই তক্ষুণি আবার বললেন, “আপনার ঘুম পাচ্ছে বুঝি?”
“না, আমার রাত-জাগা অভ্যেস আছে। আপনাকে একটু আগে মনে হচ্ছিল যেন আর ব্সে থাকতে পারছেন না।”
বিজয়বাবু একটু ম্লান হেসে বললেন, “হ্যাঁ, আমার সকাল সকাল শোয়ারই অভ্যেস।”
কথাবার্তা বিশেষ এগুলো না, এগরোটা বাজল। তখন বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “নিশ্চয়ই দাদার কোনো বিপদ ঘটেছে – এত রাত অবধি কখনও তিনি বাইরে থাকেন না।”
চঞ্চল একটুও বিচলিত বোধ করল না। কী আর বিপদ হতে পরে? গরমের দিনে এগারোটা আসলে এমন কিছু রাতও নয়!
বিজয়বাবু উঠে দাঁড়ালেন, “নাঃ, আর বসে থাকা যায় না। আমি বেরুচ্ছি দাদার খোঁজে। আপনি চলুন না আমার সঙ্গে?”
চঞ্চল বুঝতে পারল, এত রাত্তিরে গাড়িতেও এক বেরোতে প্রসিদ্ধ দাদার অর্থে ও যত্নে প্রতিপালিত এই মোটাসোটা নধর ভদ্রলোকটির সাহস হচ্ছে না। সে হাসিমুখে বললে, “বেশ তো, চলুন। তার আগে মহিমবাবুকে একবার ফোন করতে চাই।”
“ আসুন, সিঁড়ির নীচেই ফোন রয়েছে। আমি ততক্ষণ জামাটা বদলে আসছি। কাঞ্চা, গাড়ি বের কর।”
ফোনে মহিমবাবুকে পাওয়া গেল। তিনি রাত জেগে কাজ করেন, তাছাড়া হঠাৎ যদি “হরকরা”র কোনো দরকার হয়, সেজন্য তাঁর শোবার ঘরেও ফোনের এক্সটেনশন আছে।
“ আমি চঞ্চল। পরীক্ষিৎবাবু বাড়ি নেই।”
“সে কী! বাড়ি নেই?”
“সন্ধেবেলা বেরিয়েছেন, এখনও ফেরেননি।”
“এখনও ফেরেননি?” মহিমবাবুর গল একটু কেঁপে গেল।
“বিজয়বাবু খুব ব্যস্ত হযে পড়েছেন – গাড়ি নিযে খুঁজতে বেরুচ্ছেন, আমাকেও যেতে বলছেন সঙ্গে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ব্যস্ত হবার তো কথাই,” মহিমবাবুর কণ্ঠস্বর রীতিমতো উত্তেজিত শোনাল, “তুমি যাবে বইকি বিজয়ের সঙ্গে, নিশ্চয়ই যাবে! শোনো – বিজয়কে বাড়ি পৌঁছিযে দিযে তুমি সোজা আমার এখানে চলে আসবে – যত রাত্তিরই হোক। বাস টাস না পেলে, ট্যাক্সি নিও। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জেগে থাকব। ভারি দুশ্চিন্তায় রইলাম, বুঝলে?”
মহিমবাবুর কথা শুনে এতক্ষণে চঞ্চলের ধারণা হল যে, এতে সত্যিই হয়তো দুশ্চিন্তার কিছু আছে? সত্যিই তো, পরীক্ষিৎবাবু হঠাৎ আজকে নিয়ম ভাঙবেন কেন? তাঁর যা বয়স আর খ্যাতি, তাতে যখন তখন যেখানে সেখানে ইচ্ছে থাকলেও তিনি যেতে পারেন না। আর তাঁর কোনো এংেজমেন্ট নেই, এদিকে শরের ভালো না, জয়ন্তী সেরেই আবু পাহাড়ে যাবার কথা। তাই তো?
একগাল গান মুখে পুরে ডিবেটি পকেটে পুরতে পুরতে তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিযে নামতে নামতে বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “চলুন, চলুন, আর এক মিনিটও দেরি না!”
দুজনে গড়িতে উঠে বসল। কাঞ্চা জিগ্যেস করল, “কোথায় যাব?”
“আগে প্রিন্সেপ ঘাট।”“
চঞ্চল বললে, “ আমরা তো যাচ্ছি, এর মধ্যে উনি যদি ফিরে আসেন?”
“এলে তো ভালোই। বিজয়বাবুর কথা শুনে মনে হল, সে আশা তাঁর মনে অতি ক্ষীণ।
খনিকক্ষণ কাটল চুপচাপ। তারপর, বিজযবাবু হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, “ উপেন ধরকে দেখেছেন কখনও?”
“কোন উপেন ধর? শ্রী ইন্সিওরেন্স কোম্পানির -”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই।”
“দেখেছি দু-একবার। তার কথা হঠাৎ আপনার মনে হল কেন?”
“কিছুদিন ধরে দাদাকে সে ভারি বিরক্ত করছে। তার কোম্পানিতে পঞ্চাশ হাজার টাকার শেযার কিনে একজন ডিরেক্টর হতে হবে। দাদা নেহাৎ ভালোমানুষ – মুখের উপর কাউকে “না” বলতে পারেন না – ভেবে দেখি, আচ্ছা কাল এস – এইভাবে কিনা কাটছে। কাল সকালে তার আসবার কথা – কাল দাদাকে একেবারে রাজি করিয়ে পরশু, অর্থাৎ জয়ন্তীর দিন সকালে দাদার ছবি দিয়ে সব কাগজে বড় বিজ্ঞাপন দেবে, এইরকম তার মতলব। হাতে পায়ে ধরতে বাকি রেখেছে, অথচ, এসব ব্যাপারের মধ্যে যাবার ইচ্ছে দাদার একেবারেই নেই, লোকটা এমন নাছোড়বান্দা যে, কী বলব।”
এই ঘটনার সঙ্গে পরীক্ষিৎবাবুর বাড়ি না ফেরার কী সম্বন্ধ, চঞ্চল তাই ভাবছে, এমন সময়ে বিজয়কৃষ্ণ হঠাৎ বললেন, “ উপেন ধর লোকটা বেশ লম্বা।”
কথাটা শুনে চঞ্চল হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বললে, “ আপনার কি মনে হয়, উপেন ধর আপনার দাদাকে কোনোরকমে …”
“অসম্ভব নয়, কিছুই অসম্ভব নয়।”
চঞ্চল মনে মনে খুব একচোট হেসে নিল, মুখে কিছু বললে না।
প্রিন্সেপ ঘাটে এসে কিছুই হদিশ মিলল না। মস্ত মস্ত জাহাজগুলো আলো নিবিয়ে চুপ, নৌকোগুলোর গায়ে ধাক্কা লেগে জলের ছলছল শব্দ – এ ছাড়া আর কিছুই নেই। পরীক্ষিৎবাবু যেখানে বসে ছিলেন, অন্য লোকটি যেখানে বসে ছিল, সে সব জায়গা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল – বিজয়কৃষ্ণ একটি টর্চ সঙ্গে আনতে ভোলেন নি। বিজয়বাবুর এই বাড়াবাড়িতে চঞ্চলের মনে মনে একটু রাগই হচ্ছিল, এমন সময়ে হঠাৎ ছোট্ট সাদা চকচকে একটা জিনিস তার চোখে পড়ল। সেটা খুড়িয়ে নিতেই পাশ থেকে বিজয়বাবু বলে উঠলেন, “কী, কী ওটা? দেখি।”
চঞ্চল উল্টিয়ে দেখল, বিশেষ কিছু নয়, একটা ভিজিটিং কার্ড। তাতে ইংরেজিতে লেখা –
বৃন্দাবন গুপ্ত
চঞ্চল নিঃশব্দে কার্ডটি বিজয়বাবুর হাতে দিলে। সেটার দিকে একবার তাকিয়েই বিজনয়বাবুর মুখ ফ্যাকাশে হযে গেল, কাঁপা গলায় বললেন, “ অ্যাঁ, এ কী! বৃন্দাবন গুপ্ত!”
চঞ্চল শান্তভাবে বললে, “তাতে কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে? তুমি বলছ কী হে ছোকরা! বৃন্ধাবন গুপ্ত কে, জান তো?”
হঠাৎ এই “তুমি” সম্বোধনে কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে চঞ্চল বললে, “তা জানি।”
“দাদার এত বড় সাহিত্যিক শত্রু বাংলাদেশে আর কেউ নেই, জান তো? দাদা প্রথম যখন লিখতে আরম্ভ করেন, তখন থেকে আজ পর্যন্ত, এই তিরিশ বছর ধরে দাদাকে ও কী অশ্রাব্য গালাগালই না করে আসছে। ক্ষতি করবার চেষ্টাও কম করেনি, কিছু করেওছে! এই জয়ন্তীর ব্যাপার নিয়ে, ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপে’ এই কুৎসিত প্রবন্ধগুলো কে লিখছে? এই বৃন্দাবন। নিজের কাগজ ছিল ‘শার্দূল’ – সবাই বলত ‘লাঙ্গুল’ – সে সব চুকিয়ে দিয়ে একহন ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপে’র কাঁধে ভর করেছে। ছাপার কালি ছিটিয়ে ওর রাগ কমেনি – এখন দেখলে তো কাণ্ডটা!”
চঞ্চল বললে, “বোঝা যাচ্ছে না।”
“বোঝা যাচ্ছে না মনে? নিশ্চযই ও দাদাকে কিডন্যাপ করেছে – জযন্তী ভণ্ডুল করে দেবে। উঃ, কত বড় শয়তান! কিছু অসম্ভব নয় ওর পক্ষে – খুন করেও ফেলতে পারে! উঃ!” বিজয়কৃষ্ণ হতাশভাবে দু-হাতে মুখ ঢেকে ঘাটের সিঁড়ির উপর বসে পড়লেন।
চঞ্চল সান্ত্বনার সুরে বললে, “আহা – আপনি এত অধৈর্য হচ্ছেন কেন? একটা ভিজিতিং কার্ড থেকে কিচুই প্রমাণ হয় না। হয়তো বৃন্দাবনবাবুও এখানে বেড়াতে এসেছিলেন – তাঁর পকেট থেকে দৈবাৎ ওটা পড়ে গেছে।”
“দেখছ না – কার্ডটা একেবারে নতুন। আজই পড়েছে এখানে।”
“হয়তো আজই এসেছিলেন।”
“তুমি কি বলতে চাও, বৃন্দাবন মিছিমিছি এসেছিল? তুমি কি বলতে চাও, এখানে থাকলেও দাদার সঙ্গে তার দেখা হয় নি?”
চঞ্চল কোনো জবাব করলে না। হতে অবশ্য তাও পরে, কিন্তু ঘটনার পারম্পর্য এমনভাবে মিলে যাচ্ছে যে, সন্দেহ হওয়া অন্যায় নয়! একটু পরে সে বললে, “প্রথমে কিন্তু আপনি উপেন ধরকে সন্দেহ করছিলেন। তাছাড়া, ড্রাইভার যে লোকটাকে দেখেছিল, সে লম্বা। আর বৃন্দাবনবাবু তো ছোটোখাটো ডিস্পেপটিক মানুষ।”
“তুমি দেখেছ বৃন্দাবনকে?”
“আমায় যে কাজ করতে হয়, তাতে সকলকেই একটু আধটু চিনতে হয়।”
“তুমি ওকে চেন?” বিজয়কৃষ্ণ এমনভাবে চঞ্চলের দিকে তাকালেন যে, এ ব্যাপারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে বলে যেন তিনি তাকেই সন্দেহ করেছেন।
“না, এমন কিছু চিনি না। তবে চেহারা চিনি।”
“তুমিও যেমন! ও নিজে আসবে নাকি এ কাজ করতে? ওর ভাড়াটে সব গুণ্ডা আছে না? সাহিত্যিক গুণ্ডামিই তো ওর পেশা।”
“তাহলে, গুণ্ডার পকেট কি ওঁর কার্ড ছিল? আর ভুল করেও এ রকম একটা প্রমাণ রেখে যাবে, এমন কাঁচা ছেলেই কি বৃন্দাবন গুপ্ত?”
কিন্তু এ সব যুক্তির কোনো জবাব না দিয়ে বিজয়কৃষ্ণ শুধু বলতে লাগলেন, “উঃ, কী ভয়ানক! কী ভয়ানক! এখন কী করি?”
চঞ্চল বললে, “আপাতত চলুন গাড়িতে গিযে উঠি – তারপর ভেবে চিন্তে যা হয় একটা ঠিক করা যাবে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজয়কৃষ্ণ উঠে দাঁড়ালেন। দু জনে রাস্তার দিকে দু পা এগিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ এক শব্দ হল। চমকে তাকিয়ে দেখলে, তাদের সমনে দিয়ে একজন দীর্ঘকায় লোক দৌড়িয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। বিজয়কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চলের হাত আঁকড়ে ধরে কেমন অদ্ভুত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, “উপেন ধর! ধর ওকে, ধর!”
বিজয়বাবুর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিযে চঞ্চল প্রাণপণে ছুটল, কিন্তু অন্ধকারে কোথায় যে মিলিয়ে গেল লোকটা, তার পাত্তাই নেই।
মোটা শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চঞ্চলের কাছে এসে বিজয়বাবু বললেন, “কোথায়?”
“কী যেন! লোকটা যেন হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেল~ আপনি ঠিক দেখেছিলেন?”
দুজনে স্তব্ধ হযে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পরে চঞ্চল বললে, “উপেনবাবুকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না! এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও আর লাভ নেই।”
একটু দূরে গাছের তলায় আলো নিবিয়ে দিয়ে কালো রঙের গাড়িটা অন্ধকারে প্রায় মিশে ছিল, দু জনে গিয়ে উঠে বসতেই কাঞ্চা স্টার্ট দিলে। “কোনদিকে যাব?”
চঞ্চল বললে, “চল তো বলছি।” সে স্বপ্নেও ভাবে নি, পরীক্ষিৎবাবুর বাড়ি না ফেরার মধ্যে এত কিছু থাকতে পরে। কার্ডটা না হয় যা হোক করে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু এত রাত্রে উপেন ধর মশাই এখানে কী করছিলেন? তাঁর অমন করে পালানোরই বা অর্থ কী? আর, কোথায় বা পালালেন?
বৃন্দাবন বাবুর সঙ্গে উপেন ধররের কি কোনো যোগাযোগ আছে? সব মিলিয়ে একটা দুর্বোধ্য রহস্য চঞ্চলের মনের মধ্যে রচিত হতে লাগল, তার মাথাটা যেন ঝিমঝিম করছে!