০২. মিত্রপক্ষের গুলি : অনভিপ্রেত পরিণামের অর্থনীতি

০২. মিত্রপক্ষের গুলি : অনভিপ্রেত পরিণামের অর্থনীতি

১. ভূমিকা

সরকারের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে প্রখ্যাত রক্ষণশীল ব্রিটিশ দার্শনিক এডমুন্ড বার্ক লিখেছেন, ‘সরকার হচ্ছে মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষের প্রজ্ঞায় সৃষ্ট একটি উদ্ভাবন’ (a contrivance of human wisdom to provide for human wants)। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাছে চাহিদা মেটানোর দাবি করার অধিকার সব মানুষের রয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তাই অনুমান করা হয় যে সরকার নাগরিকদের কল্যাণের জন্য যত অর্থ ব্যয় করবে, যত ব্যবস্থা নেবে, যত দৌড়ঝাঁপ করবে, ততই মানুষের উপকার হবে। বাস্তবে দেখা যায় যে সরকার অনেক সময় ভালো কাজ করতে গিয়ে অনিষ্ট করে বসে। প্রাচীন চৈনিক দার্শনিক লাও জু বলতেন, মানুষের কল্যাণের জন্য সরকার যত আইন করবে, যত বিধিনিষেধ আরোপ করবে মানুষ ততই গরিব হবে। এই মতের প্রতিধ্বনি করে মার্কিন রসিক উইল রজার্স লিখেছেন, ‘We should not blame the government for not doing something. It is when they do something they become dangerous’ (সরকার কিছু না করলে তাকে দোষ দেবেন না। শুধু সরকার যখন কিছু করে তখনই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে)। সাম্প্রতিক কালে সব ডানপন্থী রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন, সরকারই হলো আসল সমস্যা, সরকার মোটেও কোনো সমাধান নয়। রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান লিখেছেন, ‘Many people want the government to protect the consumers. A much more urgent problem is to protect the consumer from the government’ (অনেকে চান যে সরকার ভোক্তাদের রক্ষা করুক। এর চেয়েও অনেক জরুরি সমস্যা হচ্ছে সরকারের খপ্পর থেকে ভোক্তাদের বাঁচিয়ে রাখা)।

সরকারের ক্রিয়াকাণ্ড নিয়ে বিতৃষ্ণা শুধু উগ্র ডানপন্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এ ধরনের ধারণা উদারনৈতিক ও আমূল পরিবর্তনের প্রবক্তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান স্মরণ করা যেতে পারে। সারা জীবন তিনি দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। তবু তাঁর সাম্প্রতিক রচনায় তিনি সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ২০০১ সালে ‘নেহরু বক্তৃতা’য় সেন (২০০৫) মিত্রপক্ষের গুলি বা friendly fire ধারণাটি (concept) অর্থনীতিতে প্রবর্তন করেন। এই লফজটি (term) তিনি ধার করেছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। সেনাবাহিনী সাধারণত শত্রুকে তাক করে গুলি চালায়। কিন্তু অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়; যুদ্ধের কুজ্ঝটিকায় শত্রু-মিত্র ঠাহর করা শক্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অনেক সৈন্য তাদের সপক্ষের যোদ্ধাদের তাক করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ ধরনের গুলিই হচ্ছে মিত্রপক্ষের গুলি। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন মিত্রপক্ষের ওপর হামলা ঘটে তেমনি সরকারের উদ্যোগে অনেক ব্যবস্থা গৃহীত হয়, যা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর উপকারের বদলে অপকার করে। এ ধরনের ব্যবস্থাকেই অধ্যাপক সেন মিত্রপক্ষের গুলি বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সাধারণত অর্থনীতিবিদেরা সরকারের ব্যর্থতাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে থাকেন : (১) কর্ম সম্পাদন না করার জন্য ব্যর্থতা (Errors of Omission), এবং (২) কর্ম সম্পাদনের ব্যর্থতা (Erors of Commission) (এন কুগার, ১৯৯০)। ধরুন, দেশের রাস্তাঘাট ঠিকমতো মেরামত করা হলো না। এটি হবে প্রথম ধরনের ব্যর্থতা। সরকার যদি ভুল মুদ্রানীতি অনুসরণ করে, এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি হবে দ্বিতীয় ধরনের ব্যর্থতা। কিন্তু মিত্রপক্ষের গুলি এ দুই ধরনের ব্যর্থতার কোনোটির মধ্যেই পড়ে না। মিত্রপক্ষের গুলির ক্ষেত্রে সরকার কাজটি ঠিকই করে। এখানে কর্ম। সম্পাদনে ব্যর্থতা নেই। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে যে কাজটি সম্পন্ন করা হয় তার পরিণাম হয় ক্ষতিকর ও ঋণাত্মক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সরকার দারিদ্র্য নিরসনের জন্য যেসব প্রকল্প গ্রহণ করে তা অনেক সময় দারিদ্র্যকে আরও ব্যাপক ও দুঃসহ করে তোলে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে বা সরকারি কর্মকাণ্ডে মিত্রপক্ষের গুলি কি সত্যি সত্যি ব্যাপক, না এমন ধরনের দুর্ঘটনা, যা কালেভদ্রে ঘটে? যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা নেহাত ফেলনা নয়। এখানে কয়েকটি সংখ্যা উল্লেখ করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ড ও স্টাফ কলেজের একজন বিশেষজ্ঞের হিসাব অনুসারে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর ২ থেকে ২০ শতাংশ সৈন্য মিত্রপক্ষের গুলিতে হতাহত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে ৭৫ হাজার ফরাসি সৈন্য মিত্রপক্ষের গুলির শিকার হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমপক্ষে ৬ হাজার মিত্রপক্ষের হামলার ঘটনা ঘটে। যদি প্রতিটি ঘটনায় গড়ে পাঁচজন করে সৈন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে কমপক্ষে ৩০ হাজার সৈন্য মিত্রপক্ষের আক্রমণের শিকার হয়। এই সংখ্যা বিবেচনা করলে সামরিক অভিযানে মিত্রপক্ষের হামলার গুরুত্ব অস্বীকার করার জো নেই। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডেও মিত্রপক্ষের হামলা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। অমর্ত্য সেন (২০০৫, ২১১) তাই বলছেন, ‘It is extremely important to study the issue of friendly fire’ (মিত্রপক্ষের হামলার বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি)।

এই নিবন্ধটির মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে মিত্রপক্ষের গুলির ব্যাপকতা, কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান বিশ্লেষণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় অসুবিধা হলো যে মিত্রপক্ষের গুলির ওপর যথেষ্ট উপাত্ত এখনো সংগৃহীত হয়নি। এই নিবন্ধে তাই প্রথমে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে তিনটি দেশের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে এর কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান বিশ্লেষণ করা হবে। নিবন্ধটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম খণ্ডে রয়েছে ভূমিকা। দ্বিতীয় খণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ভারতে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কতিপয় ঘটনা আলোচনা করা হবে। তৃতীয় খণ্ডে বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কয়েকটি উদাহরণ বর্ণনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে পূর্বে উল্লেখিত ঘটনা সমীক্ষাগুলির ভিত্তিতে মিত্রপক্ষের গুলির কারণ ও সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

২. বিভিন্ন দেশে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কতিপয় উদাহরণ

ক) প্রাচীন ইহুদিদের মধ্যে মিত্রপক্ষের গুলি

মিত্রপক্ষের গুলি নতুন ঘটনা নয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই অনেক বিধিবিধান করা হয়েছে, যা মানুষের উপকারের চেয়ে অনেক বেশি অপকার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইহুদিদের সপ্তবর্ষীয় বিরতি বা sabbatical সম্পর্কে বিধান স্মরণ করা যেতে পারে (ডুবনার ও লেভিট, ২০০৮)। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস এই যে বিধাতা ছয় দিন ধরে পৃথিবী সৃষ্টি করে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। ইহুদিরা আরও বিশ্বাস করে যে ফসলের জমিকেও অনুরূপভাবে সাত বছরে একবার বিশ্রাম দেওয়া উচিত। প্রাচীন ইহুদিরা প্রতি সপ্তম বছরে সব জমি অনাবাদি রাখত। যেসব ফসল চাষ ছাড়াই নিজে নিজে গজাত, গরিবেরা তা-ই দিয়ে উদরপূর্তির ব্যবস্থা করত। আর যারা সচ্ছল, তারা তাদের গোলায় সংরক্ষিত ফসল দিয়ে সংসার চালাত। এর পাশাপাশি আরেকটি নতুন নিয়ম চালু করা হয়। প্রতি সপ্তম বছরে যখন জমিতে চাষবাস হতো না, তখন সব অধমর্ণের ঋণ মাফ হয়ে যেত। এই নিয়মের উদ্দেশ্য ছিল মহাজনদের খপ্পর থেকে দেনাদারদের রক্ষা করা। প্রথম দিকে এ নিয়ম কাজ করেছিল । মহাজনেরা ধর্মীয় নির্দেশ মেনে খাতকদের ঋণ মাফ করে দিত। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে তারা বুঝতে পারে যে এভাবে চললে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। অথচ ধর্মের বিধিবিধান অগ্রাহ্য করার মতো সাহসও তাদের ছিল না। তাই তারা সপ্তম বর্ষের চক্র (cycle) পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোদমে ঋণ দিত। যারা যথানিয়মে ঋণ শোধ করত না, তাদের অথবা তাদের সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দেওয়া হতো। এ ব্যবসা পঞ্চম বছর পর্যন্ত চলত । এরপর নতুন ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হতো। তাই ষষ্ঠ ও সপ্তম বছরে ঋণের সংকট দেখা দিত। সপ্তম বছরে ঋণ মওকুফের নিয়মটি করা হয়েছিল গরিবদের উপকারের জন্য। দেখা গেল, যতই সপ্তম বছর এগিয়ে আসে, ততই বাজার থেকে ঋণ উধাও হয়ে যায়। ষষ্ঠ ও সপ্তম বছরে ঋণ না পাওয়াতে গরিবদের অনেকের পক্ষে বেঁচে থাকাই শক্ত হয়ে ওঠে। অবশেষে ইহুদিরা এই বিধান এড়ানোর জন্য একটি ব্যবস্থা বের করে। পাওনাদাররা সপ্তম বর্ষ শুরু হওয়ার আগে বকেয়া ঋণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতো। আদালতে মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে অনাদায়ী ঋণকে আদালতের পাওনা বলে গণ্য করা হতো। আদালতের পাওনা কখনো মাফ হয় না। তাই সপ্তম বছরে অধমর্ণদের ঋণ আর মাফ হতো না। আদালত ধীরেসুস্থে ঋণ আদায় করে উত্তমর্ণকে পরিশোধ করত। সপ্তম বছরে জমি চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞাও পাশ কাটানোর একটা ফন্দি বের করা হয়। সপ্তম বছরে চাষের জমি ইহুদি নয়, এমন কোনো ব্যক্তির কাছে এক বছরের জন্য বিক্রি করা হতো। বিধান দেওয়া হলো, ইহুদিদের জমি না হলে তা চাষে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ওই জমি এক বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে ইহুদিরাই চাষ করত । সপ্তম বছরের শেষে জমির মালিকানা আবার ইহুদি মালিকের কাছে ফিরে আসত। এমনি করে বিভিন্ন ফন্দিফিকির করে মিত্রপক্ষের গুলি থামানোর ব্যবস্থা করা হয়।

খ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ আইনে মিত্রপক্ষের গুলি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ আইনের অন্যতম লক্ষ্য হলো বিরল প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদগুলি যাতে নিশ্চিহ্ন না হয় তা নিশ্চিত করা। অন্তত দুটি বিপন্ন প্রজাতির পাখি রক্ষা করতে গিয়ে মার্কিন সরকার পাখিদের অস্তিত্বের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এ দুই প্রজাতির পাখি হলো : (১) লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা ও (২) কাঁটা ঝোঁপের মরচে রঙের পেঁচা।

লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা একটি বিপন্ন পাখি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এই প্রজাতির প্রায় ১২ হাজার পাখি জীবিত আছে। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিপন্ন প্রজাতি আইন বা Endangered Species Act পাস করা হয়। এই আইনের বিধান অনুযায়ী সরকার কোনো পাখিকে কোনো অঞ্চলে বিলুপ্ত প্রজাতি ঘোষণা করলে সেসব অঞ্চলে ওই প্রজাতির পাখিরা যে ধরনের গাছে বাসা বাঁধে তা কাটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা সাধারণত বড় আকারের পুরোনো পাইনগাছে বাসা বাঁধে। তাই বিলুপ্ত প্রজাতি আইন পাস হলে যারা পাইনগাছ চাষ করে তারা ঘাবড়ে যায় । তারা চিন্তা করে, যদি পাইনগাছ পুরোনো হয়, তবে লাল ঝুঁটিওয়ালা পাখিরা বাসা বাঁধতে পারে। তাই অনেক বনের মালিকেরা পাইনগাছ পুরোপুরি পরিপক্ক হওয়ার আগেই কম দামে বাজারে বিক্রি করে দেয়। পরিপক্ক হওয়ার জন্য তারা ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। একবার কোনো জমির পাইনগাছে লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা বাসা বাঁধলে সে জমির কোনো গাছ কাটা যাবে না। এর ফলে যারা পাইনের বাগান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করে, তারা ফতুর হয়ে যাবে। উত্তর ক্যারোলিনাতে পরিবেশ আইনের প্রভাব বিশ্লেষণ করে দুজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সরকারি বিধিনিষেধের ফলে লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরার প্রাকৃতিক বাসস্থান ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে এবং এ প্রজাতির পাখির বিলুপ্তির সম্ভাবনা বাড়ছে (লিউক, ডিন ও জেফরি এ. মাইকেল, ২০০৩)।

মার্কিন পরিবেশ আইনে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের তালিকা চূড়ান্ত নয়। যখনই সরকারের কাছে কোনো প্রজাতি বিপন্ন মনে হবে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে সরকার এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে। এ সময়ে কোনো অঞ্চলে যদি গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রশ্ন ওঠে, তবে জমির মালিকেরা নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই সব গাছ কেটে ফেলে। তাদের ভয় হলো, গাছ কাটার নিষেধাজ্ঞা জারি হলে এসব জমিতে আর গাছ পরিষ্কার করে বাড়িঘর নির্মাণ করার অনুমতি মিলবে না। ফলে এসব জমির দাম কমে যাবে। অ্যারিজোনাতে টুসন শহরের আশপাশে কাঁটাঝোঁপের মরচে রঙের খুদে পেঁচাঁদের নিয়ে এ ধরনের কাণ্ড ঘটে। যখন খুদে পেঁচাঁদের রক্ষার জন্য গাছ কাটা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব আলোচনায় আসে, তখনই শহরের আশপাশের অঞ্চলের জমির মালিকেরা সব গাছ কেটে ফেলে, যাতে সংরক্ষণের নিষেধাজ্ঞার ফলে সেসব অঞ্চলে বসত বাড়ি নির্মাণ বন্ধ না হয়ে যায়। এভাবে খুদে পেঁচাঁদের রক্ষা করতে গিয়ে তাদের আবাসস্থল সংকুচিত করে দীর্ঘ মেয়াদে তাদের ক্ষতি করা হয়।

গ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবন্ধীদের আইনে মিত্রপক্ষের গুলি

প্রতিবন্ধীদের সব অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি পবিত্র দায়িত্ব। তবে প্রশ্ন হলো, এসব অধিকার বাস্তবায়নের ব্যয় কে বহন করবে? সরকার চায় এ ব্যয় বেসরকারি খাতের ওপর চাপিয়ে দিতে। অন্যদিকে বেসরকারি খাত এসব ব্যয়বহুল দায়িত্ব এড়াতে চায়। এর ফলে দেখা দেয় মিত্রপক্ষের গুলি। অর্থাৎ সরকার প্রতিবন্ধীদের উপকার করতে গিয়ে তাদের অপকার করে।

মূক ও বধির প্রতিবন্ধীরা সাধারণ মানুষের মতো ডাক্তারদের প্রশ্নের জবাব। দিতে পারে না। তারা সংকেতের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করে থাকে। সাংকেতিক ভাষার কোনো দোভাষী (interpreter) ডাক্তারের অফিসে উপস্থিত থাকলে প্রতিবন্ধীদের বক্তব্য সঠিকভাবে ডাক্তারদের কাছে উপস্থাপন করা সহজ হয়। এতে চিকিৎসার মান উন্নত হবে। এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আইন করা হলো যে কথা বলতে অক্ষম রোগীদের পরীক্ষা করার সময় ডাক্তারের সঙ্গে সাংকেতিক ভাষার দোভাষী থাকতে হবে এবং এ দোভাষীর ব্যয় ডাক্তারদের দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ রোগীর ডাক্তারের বিল বিমা কোম্পানি দেয়। এ ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলি দোভাষীর বিল দিতে অস্বীকার করে। দোভাষীদের বিল ডাক্তারদের ফিয়ের চেয়ে বেশি। এ ধরনের রোগী দেখতে গেলে ডাক্তারদের নিজের পকেট থেকে সাংকেতিক দোভাষীদের বিল দিতে হয়। ফলে ডাক্তাররা এ ধরনের রোগী দেখতে অস্বীকার করে। দোভাষী-সংক্রান্ত আইন করার আগে ডাক্তাররা সাংকেতিক ভাষার ওপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধীদের দেখত। এতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসার অসুবিধা হতো। কিন্তু কোনোরকমে কাজ চলত। নতুন বিধির পর অনেক প্রতিবন্ধীর চিকিৎসাই বন্ধ হয়ে যায়।

শ্রমবাজারে যাতে প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না করা হয় তা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৯১ সালে Americans with Disabilities Act বা। প্রতিবন্ধী আমেরিকানদের জন্য আইন পাস করা হয়। এই আইনে চাকরিতে যাতে প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না করা হয়, তার জন্য বিধান রাখা হয়। কর্মস্থলে চাকাযুক্ত চেয়ার বা হুইলচেয়ারে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করার। নির্দেশ দেওয়া হয়। বলা হয়, প্রতিবন্ধীদের কাজ করার জন্য যদি বিশেষ যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হয়, তবে কারখানার মালিককে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সুস্থ শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন দেওয়া যাবে না এবং নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।

এ আইন পাস করার সময় আশা করা হয়েছিল যে এর ফলে প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে হলো এর উল্টোটি। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে গেল। অর্থাৎ মোট কর্মরত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা কমে গেল। এর একটি কারণ হলো, প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি সাহায্য বাড়ানোর ফলে কোনো কোনো প্রতিবন্ধী চাকরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এটি প্রতিবন্ধীদের চাকরি কমার প্রধান কারণ নয়। মূল কারণ হলো, প্রতিবন্ধীদের চাকরি দিতে হলে কর্মস্থলকে প্রতিবন্ধীদের উপযুক্ত করতে বাড়তি বিনিয়োগ লাগবে। উপরন্তু প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ করার পর তাদের শাস্তি দিলে বা বরখাস্ত করলে নতুন আইনে বৈষম্যের মামলা হতে পারে। এই আশঙ্কায় অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের চাকরি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য এ আইন বাধ্যতামূলক ছিল না। বড় উৎপাদকেরা প্রতিবন্ধী-বান্ধব সুনাম অর্জনের জন্য বাড়তি ব্যয়ে তত আপত্তি করেনি। মূল প্রতিরোধ আসে মধ্যম উৎপাদকদের কাছ থেকে। তাদের পক্ষে বৈষম্য হ্রাসের ব্যয় অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। তাই তারা প্রতিবন্ধীদের চাকরি দেওয়া যথাসাধ্য কমিয়ে দেয় (আচেমগলু ডেরন ও যশুয়া ডি আংগ্রিস্ট, ২০১১)। এই আইন তাই প্রতিবন্ধীদের জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

ঘ) ভারতে খাদ্যনীতিতে মিত্রপক্ষের গুলি

বিগত চার দশক ধরে ভারত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারত সরকারের খাদ্য মজুতের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। ২০০১ সালে ভারতে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৬.২ কোটি টন। এই মজুতের পরিমাণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমর্ত্য সেনের এক সহকর্মী জঁ ড্রেজ লিখেছেন, ৬.২ কোটি টন খাদ্যশস্যের বস্তা যদি একটির ওপরে একটি সাজানো যেত, তবে ১০ লাখ কিলোমিটার ওপরে ওঠা যেত (সেন, ২০০৫)। এতটুকু পথ ভ্রমণ করলে চাঁদে গিয়ে ফিরে আসা সম্ভব। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ভারতে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৫.৫৩ কোটি টন (যা ভারতের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ)। ভারত সরকারের হিসাব অনুসারে, ভারতের জন্য ২.৫ কোটি টনের আপৎকালীন মজুতই যথেষ্ট। অর্থাৎ ২০১২ সালে ভারতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি টন (যা বাংলাদেশের মোট খাদ্য উৎপাদনের কাছাকাছি)।

সরকারের গুদামে এত বিপুল পরিমাণ মজুত সত্ত্বেও ভারতে অপুষ্টির হার ভয়াবহ। অমর্ত্য সেন লিখেছেন যে উপসাহারা (Sub Sahara) অঞ্চলে মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও সেখানে ভারতের চেয়ে অপুষ্টির হার কম। ২০০৮ ০৯ সালে ভারতে পাঁচ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের ৪৩.৫ শতাংশ ছিল অপুষ্টির শিকার। উপসাহারা আফ্রিকাতে (সাহারার দক্ষিণে অবস্থিত আফ্রিকা মহাদেশ) এই হার মাত্র ২৪.৭ শতাংশ আর সব নিম্ন আয়ের দেশে গড়ে এই হার মাত্র ২৭.৭ শতাংশ। (বাংলাদেশে এই হার ৪১.৩ শতাংশ)।

ভারতে খাদ্যসামগ্রীর অভাব নেই। খাদ্যে ভর্তুকি দেওয়াতেও সরকারের কার্পণ্য নেই। ২০১১ সালে ভারত সরকার খাদ্যশস্য খাতে ভারতীয় মুদ্রায় ব্যয় করেছে ৬২ হাজার ৯২৯ কোটি রুপি (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরের মোট বাজেটের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি)। ভারত সরকারের খাদ্যে ভর্তুকি মূলত তিনটি কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, সরকার কৃষকদের উৎপাদন। বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করার জন্য কৃষিপণ্যের সংগ্রহ-মূল্য বাজারের চেয়ে কিছুটা বেশি রাখে। এই দাম সর্বনিম্ন সমর্থন-মূল্য হিসেবে পরিচিত। এই বাড়তি দামের সুবিধা পায় জমির মালিকেরা। অথচ সরকার চড়া দামে ফসল কিনলে খাদ্যশস্যের দাম গরিবদের নাগালের বাইরে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রেতারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য স্বল্পমূল্যে রেশনিং-ব্যবস্থায় খাদ্যশস্য বিক্রয়ের জন্য ভর্তুকি দিতে হয়। তবে স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য শুধু গরিবেরাই পায় না, এই সুবিধা বিত্তবানেরাও ভোগ করে। ফলে সরকারের ভর্তুকি-ব্যয় বেড়ে যায়। তৃতীয়ত, বিপুল পরিমাণ খাদ্য গুদামে রাখা ও পরিবহনের জন্যও ভর্তুকি দিতে হয়।

খাদ্য খাতে সরকারি ভর্তুকির একটি বড় অংশ গরিবেরা পায় না। সমর্থন মূল্যে খাদ্যশস্য কিনে সরকার গরিবদের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি করে সরকারের স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ নীতিমালা সে সমস্যার সমাধান করতে পারে না। অথচ ভারতের গুদামে যে ৩ কোটি টন উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য আছে তা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করলেই দেশটিতে কোনো অপুষ্টি থাকত না।

অমর্ত্য সেন (২০০৫, ২১৩) ভারতের খাদ্যনীতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘It looks more and more like insanity.’ (এই নীতি অনেকাংশে পাগলামি বলে মনে হয়)। সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারলেও গরিবদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারেনি। ক্রয়ক্ষমতা না বাড়াতে পারলে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দাম নির্ধারণের জন্য যে পরিমাণ ভর্তুকির প্রয়োজন তা দেওয়াও সম্ভব হয় না। সামগ্রিকভাবে এই ভ্রান্ত নীতি ভারতের গরিবদের জন্য মিত্রপক্ষের একটি প্রচণ্ড হামলায় পরিণত হয়েছে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও ভারতে ক্ষুধার ব্যাপকতা ও তীব্রতা বেড়ে গেছে।

ঙ) পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় মিত্রপক্ষের গুলি

একসময় পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ছিল অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। ধারণা করা হতো যে অপর্যাপ্ত বেতনের জন্য শিক্ষকেরা যথাযথ শিক্ষা দিতে পারছেন না। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সারা রাজ্যে দাবি ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শতাব্দীর শেষ দিকে ও বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। অমর্ত্য সেন জানাচ্ছেন যে পশ্চিমবঙ্গে ২০০০ সালের দিকে একজন প্রাথমিক শিক্ষক মাসে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার রুপি বেতন-ভাতা পেতেন এবং একজন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক পেতেন মাত্র ১ হাজার রুপি। তাই আশা করা হয়েছিল, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির ফলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার মান বাড়বে। অথচ প্রতীচী ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় দেখা গেল যে তার উল্টোটা ঘটেছে। প্রতীচী ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা থেকে নিম্নোক্ত তথ্য জানা গেছে :

• অনেক শিক্ষক ক্লাসে আদৌ আসেন না। বিদ্যালয়ে লেখাপড়া হয় না। লেখাপড়া শিখতে হলে গৃহশিক্ষক রাখতে হয়। যেসব ছাত্র গৃহশিক্ষক রাখতে পারে না, তাদের বেশির ভাগ নিজের নাম সই করতে পারে না।

• যেসব অঞ্চলে নিম্নবর্ণের মানুষের সংখ্যাধিক্য রয়েছে সেসব অঞ্চলের শিক্ষকেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। এসব অঞ্চলের ৭৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষক অনুপস্থিতির হার আশঙ্কাজনক।

বেতন বৃদ্ধিতে বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষার মানের এই অবনতিকে অমর্ত্য সেন ‘মিত্রপক্ষের গুলি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এর কারণ অবশ্য তিনি সরাসরি বিশ্লেষণ করেননি। তবে তার আলোচনায় পরোক্ষভাবে কিছু কারণ উল্লেখিত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বল্প বেতনই শিক্ষার মানের অবনতির একমাত্র কারণ নয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের তত্ত্বাবধান করার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। তারা সরকারি কর্মচারী, স্থানীয় অভিভাবকদের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। দ্বিতীয়ত, উচ্চবর্ণের শিক্ষকেরা নিম্নবর্ণের মানুষদের ঘৃণা করে। তাই নিম্নবর্ণের ছাত্রদের ফাঁকি দিতে তাঁদের বিবেকে মোটেও লাগে না। সবশেষে শিক্ষকদের রয়েছে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন। ফাঁকিবাজ ও অযোগ্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস রাজনৈতিক নেতাদের নেই। তত্ত্বাবধানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকলে, জাতপাত সম্পর্কে শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে এবং শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে শিক্ষার মানকে প্রাধান্য না দিলে বেতন বাড়িয়ে লাভ হবে না। একদিকে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ হবে, অন্যদিকে শিক্ষার মান নামতে থাকবে।

৩. বাংলাদেশে মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে কতিপয় উদাহরণ

৩.১. জাতীয় পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলির উদাহরণ

বাংলাদেশে মিত্রপক্ষের গুলির বিষয়টি দুটি পর্যায়ে দেখা যায় : (১) জাতীয় পর্যায়ে ও (২) তৃণমূল পর্যায়ে। জাতীয় পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি সরকারি উপাত্ত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ সম্ভব। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে প্রাথমিক উপাত্তের প্রয়োজন। এই নিবন্ধে বাংলাদেশের পাঁচটি মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনা বর্ণিত হবে। এর মধ্যে তিনটি পরোক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হবে। দুটি ঘটনা বর্ণিত হবে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।

ক) হস্তচালিত নলকূপ: ইতিহাসে জনগোষ্ঠীর ওপর বিষপ্রয়োগের সর্ববৃহৎ ঘটনা

অতি প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের অধিবাসীরা ভূ-উপরিস্থ জলাধার থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করেছে। কিন্তু পানীয় জল ছিল কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড .ও উদরাময়ের মতো জলবাহিত রোগের উৎস। বিশেষ করে, জলবাহিত এ ব্যামোগুলি ছিল শিশুমৃত্যু ও ব্যাধিগ্রস্ততার সবচেয়ে বড় কারণ। ১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশে নবজাতকের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল মাত্র ৪২ বছর।

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু (জরুরি) তহবিলের (UNICEF) সহায়তায় সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা নিরাপদ পানীয় জলের উৎস হিসেবে হস্তচালিত অগভীর নলকূপকে চিহ্নিত করে জনসাধারণকে নলকূপের জল পান করতে উৎসাহিত করে। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান সরকার সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে পানীয় জল সরবরাহের জন্য ১ লাখ ৬৪ হাজার হস্তচালিত নলকূপ বসায় (পাকিস্তান সরকার, ১৯৭০, ১৯২)। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার একই নীতি অনুসরণ করে। ১৯৮০ সালে গণখাতে হস্তচালিত নলকূপের সংখ্যা ৪.৬ লাখে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে মোট নলকূপের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখে দাঁড়ায়। এর অধিকাংশই ছিল বেসরকারি খাতে। একটি সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ৮৮ থেকে ৯৫.৭ শতাংশ। মানুষ হস্তচালিত নলকূপকে নিরাপদ পানীয় জলের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে (আসাদুল্লা, এমএন এবং নজমুল চৌধুরী, ২০০৮)। হস্তচালিত নলকূপের এই দ্রুত সম্প্রসারণের সুফলও পাওয়া যায়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ৬৪ বছরে উন্নীত হয়। একা ইউনিসেফ বাংলাদেশে ৯ লাখ হস্তচালিত নলকূপ স্থাপনের অর্থায়ন করে। তারা এই কর্মসূচিকে একটি অসাধারণ সফল কর্মসূচিরূপে বর্ণনা করে এবং দাবি করে যে এই কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশে ৯৭ শতাংশ লোক নিরাপদ পানি পান করছে।

তিন দশক ধরে নলকূপের গুণকীর্তনের পর হঠাৎ সুর পাল্টে গেল। এই উদ্যোগ একটি বিরাট বিপর্যয় বলে চিহ্নিত হলো। দেখা গেল, নলকূপের পানি অনেক ক্ষেত্রে আর্সেনিক বিষে দুষ্ট। তৃষ্ণার্তের মুখে যে জল তুলে দেওয়া হচ্ছে তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য বিষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করল, বাংলাদেশের হস্তচালিত নলকূপ কর্মসূচি হচ্ছে “The largest mass poisoning of a population in history (ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণবিষ প্রয়োগের ঘটনা)। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্সেনিক গবেষণা কর্মসূচির পরিচালক ড. এলান এইচ স্মিথ বাংলাদেশের আর্সেনিক-পরিস্থিতি বর্ণনা করে লিখেছেন ‘The highest environmental cancer risk ever found, a threat worse than Chernobyl and Bhopal’ (এ পর্যন্ত চিহ্নিত সর্বোচ্চ ক্যানসার ঝুঁকি, যা চেরনোবিল ও ভোপালের চেয়েও ভয়াবহ।) (রোড ও মানিক, ২০০৫)।

বাংলাদেশে মোট ৪৭ লাখ নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুসারে এর মধ্যে ১৪ লাখ হস্তচালিত নলকূপের জল। আর্সেনিক-সংক্রমিত। অর্থাৎ প্রতি পাঁচটি নলকূপের কমপক্ষে একটি আর্সেনিক বিষে দুষ্ট। এমন ৮ হাজার গ্রাম রয়েছে, যেখানে ৮০ শতাংশ নলকূপ আর্সেনিক ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে ২ কোটি লোক আর্সেনিক-সংক্রমিত পানি পান করছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর ২০ হাজার লোক মারা যাবে।

উন্নয়ন প্রকল্পের এই মর্মান্তিক ব্যর্থতা সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন বিশেষভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হলো যে যদিও ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার এই কর্মসূচিতে কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে, তবু তিন দশক ধরে নলকূপ দিয়ে উত্তোলিত পানির মান কেন আদৌ পরীক্ষা। করা হয়নি? অথচ এ ধরনের পরীক্ষার ব্যয় অতি নগণ্য। এতে প্রমাণিত হয়। যে তৃতীয় বিশ্বে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তার কারিগরি মানের ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয় না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো যে পানিতে আর্সেনিক বিষের যখন সন্ধান পাওয়া গেল, তার পরও কেন এ সমস্যা সমাধানের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের সমস্যা পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮২ সালে প্রথম দেখা দেয়। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তারা দুজন বাংলাদেশি রোগী পেয়েছে, যারা আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত (পিয়ার্স, ২০০১)। এতেও বাংলাদেশের টনক নড়েনি এবং নলকূপের পানির মান পরীক্ষার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৩ সময়কালে নলকূপের সঙ্গে জড়িত দাতা সংস্থারা ও বাংলাদেশ সরকার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক আছে জেনেও এ সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ১৯৯৩ সালে সরকারিভাবে আর্সেনিক দূষণসমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। তবে, জাতীয় পর্যায়ে দূষিত নলকূপ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। অথচ এই প্রক্রিয়া ১৯৮৫ সালে, যখন প্রথম আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়, শুরু হওয়া উচিত ছিল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৮ সময়কালে লাখ লাখ নাগরিক আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হয়। ত্বরিত ব্যবস্থা নিলে অনেকেই এ বিষের হাত থেকে বাঁচতে পারত। ১৩ বছর ধরে এই দণ্ডনীয় নিষ্ক্রিয়তার জবাবদিহি কে করবে? ইতোমধ্যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে ৪০ হাজার রোগীর শরীরে আর্সেনিকের বিষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার কোনো কার্যকর প্রতিষেধক নেই। আর্সেনিক-আক্রান্ত এলাকায় এখনো অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প নিরাপদ সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়নি। অর্থাৎ সরকার ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে নলকূপ প্রকল্প নিলেও তা একটি মিত্রপক্ষের গুলিতে পরিণত হয়।

খ) নদীর প্রতিশোধ : দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জলাভূমির বিয়োগান্তক নাটক

১৯৬০-এর দশকে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার মার্কিন সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় ৩৭টি পোল্ডার নির্মাণ করে। প্রতিটি পোল্ডারে একটি জলাভূমির চারদিকে বাঁধ দেওয়া হয়, যাতে বাইরের পানি ভেতরে ঢুকতে না পারে। সেই সঙ্গে ভেতরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে ২৮২টি জল নিষ্কাশনের দ্বার (sluice gate)-সহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধক্ষম ১ হাজার ৫৬৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এসব অবকাঠামোর মূল লক্ষ্য ছিল জমিতে সামুদ্রিক লোনা পানির প্রবেশ বন্ধ করা এবং নিচু জমিতে উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ধানের উৎপাদন। প্রকল্প সমাপ্তির পর ভৌত অবকাঠামোগুলি পরিকল্পনামাফিক কাজ করে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভৌত অবকাঠামোগুলি ব্যাপক পরিবেশগত সংকটের জন্ম দেয়। এসব অবকাঠামো নির্মাণের আগে সমুদ্রের পানির অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হতো। এতে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ডিঙিয়ে পানি ঢুকত ও পানির সঙ্গে পলি এসে জমিকে উঁচু করত। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পর পানিও আসে না এবং জমিতে নতুন পলিও জমে না। পলির অভাবে জলাভূমিগুলো নিচু থেকে যায়। অন্যদিকে জল নিষ্কাশনের দ্বারগুলি পলি জমে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ভেতরের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। চারদিকে বাঁধ দেওয়া পোল্ডারগুলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এভাবে উপকূলীয় বাঁধ অঞ্চলে ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে ফসল চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। লোনা ও মানুষের বর্জ্য মিলে উপদ্রুত অঞ্চলে বদ্ধ জলকে দূষিত করে তুলেছে। জলবাহিত রোগগুলি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সড়ক ও নৌপথ বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শিশুদের বিদ্যালয় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দূষিত জলে মাছ মরে যাচ্ছে। গাছ মরে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে। অনেক গ্রামবাসী উপকূলীয় বাঁধে ও বসতবাড়ির বাইরে উঁচু জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। এভাবে প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি হলো বিল ডাকাতিয়া ও ভবদহের জলাভূমি। ভবদহের উপদ্রুত অঞ্চলগুলি যশোর জেলার অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলায় অবস্থিত। বিল ডাকাতিয়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ নম্বর পোল্ডারে অবস্থিত। এখানে আটটি ইউনিয়নের ৩৬টি গ্রাম রয়েছে। এই অঞ্চলটি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও দৌলতপুর উপজেলায় অবস্থিত। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বিল ডাকাতিয়ার মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১.৬৫ লাখ। এর মধ্যে ১ লাখ একর এলাকার অধিবাসীরা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত (আতিউর রহমান, ১৯৯৫)।

সমস্যাটি মানুষের সৃষ্ট। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের জলাবদ্ধতার কোনো কাঠামোগত সমাধান খুঁজে পায়নি। এর ফলে জলাবদ্ধতার বিস্তৃতি ক্রমশ বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে বাঁধের ভেতরের জল নিষ্কাশনের জন্য বাঁধ কেটে দেয়। তবে এতেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফল পাওয়া যায়নি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাহায্য নিয়ে পর পর দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়। দুটি প্রকল্পই ব্যর্থ হয়েছে। অতি সম্প্রতি স্থানীয় প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে জোয়ার-ভাটা নদী ব্যবস্থাপনা (Tidal River Management) করে কিছু ফল পাওয়া গেছে। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো, কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়া জোয়ার-ভাটার পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। এর ফলে নদীতে পলি জমে নদীগর্ভকে উঁচু করে তোলে না। বরং নিচু জলাভূমিতে পলি জমে জমি উঁচু করে। এ ধরনের ব্যবস্থা বিল ডাকাতিয়াসহ কয়েকটি প্রকল্পে নেওয়া হয়েছে (ইসলাম ও কিবরিয়া, ২০০৬)। ক্ষতিগ্রস্তদের সংগঠন সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দাবি করছে : Several thousand houses on 80,000 hectares of land are under ankle to knee-deep water. In total, around two lakh hectares of land remain waterlogged and the number of affected people is around twelve lakh (http://www.sos-arsenic,net?english/development/destruction.html) এভাবে গরিব মানুষের উপকারের জন্য যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তা-ই তিন দশক ধরে গরিবদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ প্রকল্প থেকে আমরা দুটি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছি :

• পশ্চিমা প্রযুক্তি বাংলাদেশে সব সময় কার্যকর হয় না। নেদারল্যান্ডে যে ধরনের পানি-ব্যবস্থাপনা করা হয়ে থাকে তা সব ক্ষেত্রে নকল করা সম্ভব নয়।

• পানিসংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এসব প্রকল্পের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না।

গ) দরিদ্রদের জন্য ঋণ কর্মসূচি : বদান্যতার প্রহসন ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের বিঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে স্বল্প সুদে দরিদ্রদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা। সব সরকারই দাবি করে থাকে যে গরিব মানুষদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার উপলব্ধি করে না যে সুদের হার কমে গেলে মোট ঋণ সরবরাহ কমে যাবে। দরিদ্র মানুষ সুদের হার নিয়ে তত চিন্তিত নয়, যত উদ্বিগ্ন তারা ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে। চড়া সুদ দিতে হলেও তাদের ঋণ প্রয়োজন। যদি গরিব লোকেরা প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ না পায়, তাহলে তাদের মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে সরকারি ব্যাংকগুলির দেওয়া ঋণের পরিমাণ কৃষকদের চাহিদার তুলনায় নেহাতই অপ্রতুল। এখানে কিছু সংখ্যা স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের (২০১২, ৮২) ২০১০-১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের সব ব্যাংক মিলে ঐ অর্থবছরে মোট ৯২১০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১২ অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক ও দেশের প্রধান এনজিওগুলি মিলে একই সময়ে ২৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। অনুমান করা হয় যে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রধান এনজিওগুলি ৮০ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে। এই হিসাব অনুসারে ২০১০-১১ সালে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যদি অনুমান করি যে ক্ষুদ্রঋণের সমপরিমাণ ঋণ অনানুষ্ঠানিক (যথা : মহাজন, পরিচিত ব্যক্তি বা আত্মীয়স্বজন) সূত্র থেকে আসে, তবে গরিব মানুষের ঋণের মোট চাহিদা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৭৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সব ব্যাংক মিলে মোট চাহিদার প্রায় ১১.৫ শতাংশ মেটায়। তাই গরিবের উপকার করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঋণের প্রবাহ অনেক বাড়াতে হবে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে অনাদায়ী ঋণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি না দিলে গরিবদের জন্য ঋণের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে তাই সুদের হারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে ঋণের জোগান বাড়ানো। সুদের হার জোর করে কমিয়ে দিলে ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। অথচ এই সহজ বিষয়টি বাংলাদেশে কোনো সরকারই সম্যকভাবে উপলব্ধি করেনি।

অর্থনীতির জন্মের অনেক আগে থেকেই দার্শনিকেরা বারবার সতর্ক করছিলেন যে সরকারি হুকুমে সুদের হার কমালে মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল। বেশি হবে। এ ব্যাপারে সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক জন লকের (১৬৩২-১৭০৪) বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ সরকার সুদের হার ৬ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে হ্রাসের উদ্যোগ নেয়। জন লক এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন (নর্টন, ২০০৮)। এই বিতর্কে সুদের হার কমানোর বিপক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। তার যুক্তিগুলি ছিল নিম্নরূপ :

• মহাজনরা সুদের হারের অবাস্তব (নির্ধারিত) সর্বোচ্চ সীমা এড়ানোর ফন্দিফিকির করবে। এতে তাদের যে অতিরিক্ত ব্যয় হয় তা তারা খাতকদের কাছ থেকেই আদায় করবে। এর ফলে বাস্তবে সুদের হার কমাতে গেলে সুদের হার বেড়ে যেতে পারে।

• যদি সরকার সত্যি সত্যি সুদের হার কমাতে পারে, তাহলে ঋণের জোগান কমে যাবে। যাদের ঋণ দরকার তারা ঋণ পাবে না।

• বিধবা, এতিম ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ লগ্নি করে সংসার চালায়। সুদের হার কমে গেলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লক তাই মনে করেন, সুদের হার কমে গেলে এর অপ্রত্যাশিত বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যদি সুদের হার কমানোর আইনটি সঠিকভাবে কাজ করে, তবে ঋণের জোগান কমে যাবে। যদি ফাঁকি-ফক্কড়ির মাধ্যমে আইনটি এড়ানো সম্ভব হয়, তবে সুদের হার বেড়ে যাবে।

৩০০ বছর আগে লক বলেছেন যে সুদের হার বাজার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সুদের হার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই সমস্যা দেখা দেবে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সরকারই অর্থনীতির এ সাধারণ সূত্র মেনে নেয়নি। এর ফলে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচিতে স্বল্প সুদের হারে গরিব মানুষদের জন্য ঋণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তাতে লোকের উপকারের চেয়ে অপকারই। হয়েছে বেশি। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত তথ্যগুলি প্রাসঙ্গিক;

• বেশির ভাগ গরিব মানুষ স্বল্প সুদে ঋণ পায় না। স্বল্প সুদে ঋণের অর্থায়ন সরকারকে করতে হয়। বেসরকারি খাত লোকসান দিয়ে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে রাজি হয় না। তাই এ ধরনের ঋণের অর্থসংস্থান সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে করতে হয়। তাদের পক্ষে গরিবদের ঋণের জন্য যথেষ্ট অর্থ দেওয়া সম্ভব হয় না। এখন ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণ দেওয়া হয় তা গরিবদের প্রদত্ত প্রাতিষ্ঠানিক (ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওদের প্রদত্ত ক্ষুদ্রঋণ) ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে প্রদত্ত ঋণের ১২ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। অর্থাৎ চাহিদার কমপক্ষে ৮০ শতাংশ ঋণ সরকার দিতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা (ফেরারি, ২০০৮) থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (ক্ষুদ্রঋণের ফলে এ সংখ্যা অনেক কমার পরও) এবং ৪৩ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষককে মহাজনদের মতো অনানুষ্ঠানিক উৎস হতে ঋণ নিতে হয়। এদের জন্য সুদের হার বড় কথা নয়, এদের সবচেয়ে বড় দাবি হলো যখন দরকার তখন ঋণ দিতে হবে। সরকারি ঋণনীতির ফলে এরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

• যেহেতু স্বল্প সুদের ঋণের চাহিদার তুলনায় জোগান কম, সেহেতু এ ঋণের জন্য অশুভ প্রতিযোগিতা হয়। এ ধরনের ঋণ রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা পান। তারা একবার সরকারি ঋণ পেলে আর শোধ করেন না। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা যাদের নেই তাদের ঋণ পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (২০০৫) একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ ঋণ পাওয়ার জন্য ঘুষ দিয়েছে। পক্ষান্তরে বেসরকারি ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছে, তাদের মাত্র ১৫ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে। যারা ঘুষ দিয়ে ঋণ নেয় তারা একবার ঋণ পেলে ফেরত দিতে চায় না। ফলে স্বল্প সুদে যেসব ঋণ দেওয়া হয়, সেখানে খেলাপির হার আশঙ্কাজনক। সাধারণত আশা করা হয় যে স্বল্প সুদে ঋণ দিলে উপকৃত ব্যক্তিরা ঋণ ফেরত দেবে এবং যারা উচ্চ সুদের হারে ঋণ নেয় তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশে একটি ঋণ কর্মসূচিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে সুদের হার কম অথচ আদায়ের হার উঁচু সুদযুক্ত ঋণের চেয়ে বেশি।

• স্বল্প সুদে ঋণ দিতে গিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। ২০০৬ সালের একটি হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ১০০ থেকে ৬ হাজার ১০০ কোটি। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট লোকসান হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। উপরন্তু সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি কৃষিঋণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য শত শত কোটি টাকার ভর্তুকি সরকারের দিতে হচ্ছে। সমবায় দপ্তর ও সমবায় সংশ্লিষ্ট পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের বেতন দেওয়ার জন্যই সরকারের বছরে ১৩০ কোটি টাকার আবর্তক ব্যয় হয়। এইসব তৎপরতার পরও দেখা যাচ্ছে যে দেশের অধিকাংশ গরিব মানুষই বেশি সুদেও ঋণ পাচ্ছে না। স্বল্প সুদের হার চাপিয়ে দিলে ঋণের জোগান কমে যায়। তাতে গরিবদের দুঃখ লাঘব করতে গিয়ে তাদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

৩.২ বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি

জাতীয় পর্যায়ে মিত্রপক্ষের গুলি সব সময় ঠাহর করা যায় না। সরকারের ক্রিয়াকাণ্ডের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় তৃণমূল পর্যায়ে। তবে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য মাঠপর্যায়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণা সীমিত। এ নিবন্ধে লেখকের দুটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উদাহরণস্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশেও এ ধরনের অভিজ্ঞতার উদাহরণ রয়েছে। তাই এই অভিজ্ঞতাগুলিকে অনন্য মনে করার কারণ নেই।

ক) দুধে পানি মেশানো বন্ধ করার উদ্যোগের পরিণতি

১৯৫০-এর দশকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ভেজাল খাদ্য, বিশেষ করে দুধে পানি মেশানো নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক হইচই হয়। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রয় করা পাকিস্তান দণ্ডবিধির ২৭৩ ও ২৭৪ ধারা অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ। ভেজাল-সংক্রান্ত আইনের দুটি লক্ষণীয় বিশেষত্ব ছিল। প্রথমত, এই আইনে কোথাও ‘ভেজাল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। আক্ষরিক অর্থে একটি পদার্থের সঙ্গে ভিন্ন ধরনের পদার্থ মেশালেই তা ভেজাল হয়ে যায়। কিন্তু সব ভেজালই ক্ষতিকারক নয়। দুধের সঙ্গে বিশুদ্ধ জল মেশালে দুধের স্বাদ কমতে পারে; তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হওয়ার কারণ নেই। পাকিস্তান দণ্ডবিধিতে তাই স্পষ্ট করে বলা ছিল যে মিশ্রিত পদার্থটি ক্ষতিকর হতে হবে। ভেজাল নির্মল হলে দণ্ডবিধি অনুসারে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে না। তাই কেউ দুধে বিশুদ্ধ পানি মেশালে এ আইন অনুসারে তার কোনো দণ্ড হবে না। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান দণ্ডবিধিতে ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য কোনো সর্বনিম্ন সাজার বিধান ছিল না। সাজার মাত্রা বিচারক তার নিজের বিবেচনামতো নির্ধারণ করতেন। এর ফলে বিচারক লঘু ও গুরু অপরাধের মধ্যে তারতম্য করতে পারতেন। ইচ্ছা করলে বিচারক সিকি বা আধুলি জরিমানা করতেন, আবার ইচ্ছে করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড, ১ হাজার টাকা জরিমানা বা একসঙ্গে উভয় দণ্ড দিতেন।

১৯৫৮ সালে দেশে সেনাশাসন এল। কর্তাব্যক্তিরা হুকুম দিলেন, ভেজাল সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। তারা জনস্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা করতে বললেন, কেন তারা ভেজালের রমরমা কারবার বন্ধ করতে পারছেন না। জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা বললেন যে তাঁরা আসামিদের ঠিকই ধরছেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেটরা, ক্ষতিকর দ্রব্য মেশানো হয়নি, এই অজুহাতে অনেক আসামি ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে নামে মাত্র জরিমানা করছেন। যারা ভেজালের ব্যবসা করে তারা জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের আদৌ পরোয়া করে না। এই অবস্থাতে ভেজাল ঠেকাতে হলে ঔপনিবেশিক আমলের ভেজাল আইন সংশোধন করতে হবে।

ভেজাল রোধের লক্ষ্যে সামরিক শাসকেরা ১৯৫৯ সালে Pure Food Ordinance 1959 বা বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ জারি করলেন। এই আইনে দুটি বড় পরিবর্তন আনা হলো। প্রথমত, বলা হলো যে এই আইনে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে কমপক্ষে ১৫০ টাকা জরিমানা করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটরা তাঁদের মর্জিমতো নামমাত্র জরিমানা করতে পারবেন না। আশা করা হলো যে শাস্তির ভয়ে কেউ ভেজাল দেবে না।

দ্বিতীয়ত, সামরিক শাসকেরা বললেন যে এক জিনিসের সঙ্গে আরেক জিনিস মেশালেই ভেজাল বলে গণ্য হবে। মিশ্রিত দ্রব্যটি ক্ষতিকর না হলেও ভেজালের অপরাধে দণ্ড দেওয়া হবে। ফলে যদি দুধে বিশুদ্ধ পানিও মেশানো হয়, তবু তা ভেজাল হিসেবে দণ্ডনীয় হবে। দুধের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য আইনটি ছিল বদ্ধপরিকর। কী ধরনের দুধ বাজারে বেচা যাবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান রয়েছে ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের আট ধারায়। দুধের মান সম্পর্কে আইনের নির্দেশগুলি নিচে উদ্ধৃত হলো :

8. (a) the species of animal from which the milk is derived shall be specified by the seller in such manner as the local authority may direct by general and special order in this behalf,

(b) The article sold shall be normal, clear and fresh secretion obtained by the complete milking of the udder of a healthy animal of the species specified, not earlier than seven days after the calving and freeing the colstrums of such animal, and

(c) the article sold shall whether such secretion has been processed or not be an article from which no ingredient has been extracted and to which no water or other substance (including any preservative) has been added and which contains the normal constituents prescribed under Clause (a) of subsection (1) of Section 5.

ওপরের শর্তগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে ভেজাল দুধের সংজ্ঞা অনেক ব্যাপক করা হয়েছে। প্রথমত, সব গরুর দুধ বেচা যাবে না। যে দুধ কর্তৃপক্ষের শর্ত পূরণ করে, শুধু সে দুধই বাজারে বিক্রয় করা যাবে। দ্বিতীয়ত, বাছুর জন্মের কত দিন পর কীভাবে দুধ সংগ্রহ করলে বিক্রি করা যাবে, সে সম্পর্কেও এতে নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয়ত, দুধ থেকে কোনো উপাদান তোলা যাবে না বা তাতে কোনো কিছু মেশানো যাবে না। পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ জল মেশালেও তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

আশা করা হয়েছিল, এই নতুন আইন করার পর ভেজাল দুধ বিক্রয় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সে ধরনের কোনো প্রবণতা মোটেও দেখা যায়নি। বরং এ আইন পাস হওয়ার ১০ বছর পর মাঠপর্যায়ে এ আইনের অনভিপ্রেত প্রভাব দেখতে পাই।

১৯৬৯ সালে আমি তঙ্কালীন হবিগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ফৌজদারি আদালতের প্রধান বিচারক পদে নিয়োজিত ছিলাম। আমি লক্ষ করি যে দুধে পানি মেশানোর কয়েক শত মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। সরকার মামলা রুজু করেছে এবং দুধের নমুনা ঢাকায় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষাগারের প্রতিবেদন না পাওয়াতে মামলা নিষ্পন্ন করা যাচ্ছে না। আমি বারবার স্বাস্থ্যসচিবের কাছে নালিশ করলাম। অবশেষে আমার চেঁচামেচির ফল মিলল। প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক একসঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিল। আমিও মহানন্দে একই দিনে ৫০টি মামলার শুনানি ধার্য করলাম। প্রতিটি প্রতিবেদনেই লেখা ছিল যে দুধে পানি মেশানো হয়েছে। আমার ধারণা ছিল যে এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক আসামিকে দু-চার টাকা জরিমানা করলেই মামলা নিষ্পন্ন হবে। সরকারপক্ষ থেকে আমাকে বলা হলো যে এগুলি পাকিস্তান দণ্ডবিধির আওতায় দাখিল করা মামলা নয়, এ মামলাগুলি করা হয়েছে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের ভিত্তিতে। অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রত্যেককে কমপক্ষে ১৫০ টাকা জরিমানা করতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ৫০ জন দুধ বিক্রেতার প্রত্যেককে ১৫০ টাকা জরিমানা করি।

আমি আশা করেছিলাম যে এ ধরনের পাইকারি জরিমানার পর বাজারে দুধে পানি মেশানো কমে যাবে। হবিগঞ্জ শহরে আমার পূর্বপরিচিত একজন স্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। আমি তাঁকে দুধের বাজারে গিয়ে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আমাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করি। কয় দিন পর তিনি আমাকে যা জানালেন তাতে আমার আক্কেলগুড়ুম। জানা গেল, বাজারে দুধে পানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। মূল সমস্যা হলো প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট দুধ হয় না। খাঁটি দুধ কেনার সামর্থ্য অধিকাংশ ক্রেতার নেই। তাই কম দামে পানি মেশানো দুধ কিনতে ক্রেতাদের আপত্তি নেই। বিক্রেতাদেরও এতে সুবিধা। তাই বাজারে পানি মেশানোর বিপক্ষে কেউ নেই। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা উপদ্রব করে। যত দিন পর্যন্ত দায়ের করা মামলাগুলি অনিষ্পন্ন ছিল তত দিন স্যানিটরি ইন্সপেক্টরদের কেউ পাত্তা দিত না। এত লোকের একসাথে জরিমানা হওয়ার পর দুধ বিক্রেতারা বুঝতে পেরেছে, স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিশেষ করে, ইন্সপেক্টররা প্রচার করছে যে এক পাগলা হাকিম এসেছে যার কাছে দুধে পানি মেশানোর মামলা গেলেই অবধারিত ১৫০ টাকা জরিমানা হবে। চাই দুধ বিক্রেতারা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের ঘুষ দিচ্ছে এবং ঘুষের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দুধে আরও বেশি পরিমাণ পানি মেশাচ্ছে। কাজেই দুধে পানি মেশানো বন্ধের জন্য যে আইন করা হয়েছিল তা প্রয়োগ করতে গিয়ে দুধে পানি মেশানো বেড়ে গেল।

খ) সরকারের সাহায্যপ্রাপ্তির পর বিদ্যালয়ের লেখাপড়া বন্ধ

ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৯ সালে। একদিন অপরাহে একটি তহশিল অফিস পরিদর্শনে যাই। আমি যখন বিভিন্ন নথিপত্র পরীক্ষা করছিলাম তখন দেখতে পেলাম, অফিসের বাইরে লোকজন জমছে। আমি যখন কাজ শেষে বের হয়ে আসছি, স্থানীয় লোকজন আমাকে অনুরোধ জানাল যে আমি যেন তাদের গ্রামের স্কুলটি দেখে যাই। তাদের পীড়াপীড়িতে আমি স্কুলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই যে একটি দালানের ছাদ পড়ে গেছে।

গ্রামের লোকেরা পুরো ঘটনাটি খুলে বলল। ৫০ বছর ধরে গ্রামবাসী একটি টিনের ঘরে স্কুল চালাচ্ছিল। বছর দুয়েক আগে থানা শিক্ষা অফিসার এসে জানাল যে সরকার এখানে পাকা দালান নির্মাণের জন্য ১০ হাজার টাকা দেবে। এতে পুরো কাজ হবে না। তবে গ্রামবাসী যদি টিনের ঘরটি বেচে টাকাটা দালান নির্মাণের জন্য দিয়ে দেয়, তবে কাজটি সহজেই সুসম্পন্ন হবে। গ্রামের লোকজন এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে ঘরটি বেচে দিল। দালান নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হলো। দালানের ছাদ ঢালাই করা। হলো। সবাই আশা করল, শিগগিরই দালানে ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু ছাদ ঢালাই হতে না হতেই ছাদ ভেঙে পড়ল। ঠিকাদার ভেগে গেল। থানা শিক্ষা অফিসার বদলি হয়ে গেল। শিক্ষা বিভাগ দুর্নীতি মামলা শেষ হওয়ার আগে স্কুলটি পুনর্নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ দিতে অস্বীকার করল। সরকার সাহায্য দেওয়ার আগে এখানে টিনের ঘরে একটি স্কুল চলছিল। অথচ সরকার ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেল। সরকার চাইল প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি, বাস্তবে ঘটল অবনতি।

আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হতে পারে। তবে একটু অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনগুলির মান খুবই নিচু। এর নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তান ও চীনের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। যদি সব ধরনের বাড়ির মান একই পর্যায়ের হয়, তবে ভূমিকম্প হলে সব ধরনের ইমারত সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীন। ও পাকিস্তানে যখন ভূমিকম্প হয় তখন দেখা যায় যে অন্যান্য বাড়িঘরের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অনেক বেশি ক্ষতি হয়। ২০০৮ সালের ভূমিকম্পে সিচুয়ান প্রদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই ভূমিকম্পে সিচুয়ান প্রদেশের ৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় মাটিতে মিশে যায়। ভূমিকম্পের সময় অনেক বিদ্যালয়ে ক্লাস চলছিল। ভবন ধসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা ধ্বংসস্থূপের নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। চীনা সরকারের প্রতি পরিবারে ‘এক সন্তান নীতি’র পরিপ্রেক্ষিতে মৃত শিশুদের অনেকেই ছিল বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। ভূমিকম্পে বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় ভেঙে গেলেও আশপাশের বাড়িঘর অটুট ছিল। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি নির্মাণের মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের। চীনারা এখন ঠাট্টা করে বলে যে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি হচ্ছে টফু (tofu) বা নরম মাটির দলা দিয়ে তৈরি।

৪. উপসংহার

ওপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে সরকারের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনা ঘটে। এর অর্থ এই নয় যে সরকার যা করে তার সবই অকল্যাণকর। সরকার নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কাজও করে। তবে সমস্যা হলো সরকার সব সময় ভালো ও খারাপ কাজের মধ্যে তফাত করতে পারে না। আমলাতন্ত্র কখনো ভুল স্বীকার করতে চায় না। সরকারি কাগজপত্রে তাই মিত্রপক্ষের হামলার কোনো স্বীকৃতি দেখা যায় না।

সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় মিত্রপক্ষের গুলি হচ্ছে কোনো সরকারি কাজের অনভিপ্রেত পরিণতি। অনভিপ্রেত ফলাফল সব সময় ক্ষতিকর হয় না। কখনো কখনো ভালোও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত বৈধকরণের ঘটনাটিই স্মরণ করা যেতে পারে। এর সমর্থকেরা আশা করছিলেন যে গর্ভপাত বৈধ হলে মায়েরা অনভিপ্রেত সন্তানের দায় থেকে মুক্তি পাবে। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে, গর্ভপাত বৈধকরণ শুধু মায়েদের অধিকারই বাড়িয়ে দেয়নি; এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার অনেক কমে যায়, কেননা অধিকাংশ অনভিপ্রেত সন্তানই অপরাধ জগতে বিচরণ করত। এ ক্ষেত্রে অপরাধের হার হ্রাস একটি অপ্রত্যাশিত লাভ। অনেকটা ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে ধরনের ঘটনা।

বিশেষ উদ্দেশ্যে গৃহীত সামাজিক কর্মসূচির অপ্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে মার্টন (১৯৩৬)। সব অপ্রত্যাশিত ফলাফলই অনভিপ্রেত নয়। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ফলাফল বাঞ্ছনীয়ও হতে পারে। তবে সব অনভিপ্রেত ফলাফলই অপ্রত্যাশিত। যদি কেউ বিরূপ ফলাফল প্রত্যাশা করে থাকেন, তবে তার জন্য এ ফলাফল অনভিপ্রেত না-ও হতে পারে। মার্টন মনে করেন, নিম্নলিখিত পাঁচটি কারণে বিভিন্ন কর্মসূচির অপ্রত্যাশিত ফলাফল দেখা দিতে পারে :

• অজ্ঞতা : মানুষের জ্ঞান অসম্পূর্ণ। কাজেই কখনো সবকিছু জেনে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। সব সময় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। আমরা তাই ব্যক্তিগত মতামত ও বিভিন্ন অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করি। যত জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গৃহীত হবে ততই অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

• ত্রুটি : মার্টন বলছেন, চার পর্যায়ে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। প্রথমত, যে সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশ্লেষণ ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। তৃতীয়ত, করণীয় ব্যবস্থা নির্বাচনে ত্রুটি হতে পারে। চতুর্থত, করণীয় ব্যবস্থা সঠিকভাবে নির্বাচিত হলেও এর বাস্তবায়ন ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি বড় ভুল করা হয়। ধরে নেওয়া হয় যে অতীতে যা কাজ করেছে ভবিষ্যতেও তা কাজ করবে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে।

সারণি ২.১
কতিপয় মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ

ঘটনার নামদেশ ও সময়কালব্যর্থতার মূল কারণ
প্রতি সাত বছরে ঋণ মাফইসরায়েল, খ্রিষ্টপূর্বযাদের লাভ তারা বা সরকার কেউই লোকসানের দায়িত্ব নেয়নি, তা চাপিয়ে দেওয়া হয় অনিচ্ছুক মহাজনদের ওপর, যারা ফাঁকি দেয়।
বিরল পাখিদের আবাসস্থল সংরক্ষণমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭৩বাড়তি ব্যয় চিকিৎসক ও নিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং তারা ফাঁকি দেয়।
প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার ও চাকরির সুযোগমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯০লাভ সামাজিক অথচ ক্ষতি জমির মালিকদের এবং তারা ফাঁকি দেয়।
খাদ্যের সরকারি মজুত-ব্যবস্থাভারত, ২০০০-২০১০সরকারের ত্রুটি। সামাজিক ন্যায়বিচারের চেয়ে উৎপাদনের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ।
প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যর্থতাভারত, ২০০০ সালউপকারভোগীদের কাছে জবাবদিহির অনুপস্থিতি।
হস্তচালিত নলকূপবাংলাদেশ, ১৯৮৫-৯৮কারিগরি অজ্ঞতা ও জবাবদিহির অভাব।
জলাবদ্ধতার বিয়োগান্তক নাটকবাংলাদেশ, ১৯৮০-২০১২কারিগরি অজ্ঞতা ও উপকারভোগীদের কাছে জবাবদিহির অনুপস্থিতি।
দরিদ্রের জন্য ঋণবাংলাদেশ, ১৯৭০-২০১২সরকারের ব্যয় বহনে অনিচ্ছা ও ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর তা চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা।
দুধে ভেজালবাংলাদেশ, ১৯৬৯ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে। গ্রহণযোগ্য সমাধানের বদলে সরকারের নিজস্ব সমাধান।
প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণে দুর্নীতিবাংলাদেশ, ১৯৬৯উপকারভোগীদের কাছে। জবাবদিহির অনুপস্থিতি।

• তড়িঘড়ি কিছু করার বাধ্যবাধকতা (imperious immediacy of interest) : অনেক সময় এমন সমস্যা দেখা দেয়, যার সমাধান নিশ্চিতভাবে জানা নেই। অথচ সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চিত বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা জেনেও ব্যবস্থা নিতে হয়। যেমন ধরুন, কোনো একটি শহরে নদী অতি দ্রুত ভাঙছে। অথচ এর সঠিক সমাধান এই মুহূর্তে জানা নেই। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ চটজলদি সমাধান চায়। তাই জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ফলাফল দেখা দিতে পারে।

• মূল্যবোধে বৈপরীত্য : মার্টনের মতে, যারা মূল্যবোধের দ্বারা তাড়িত, তারা ফলাফলের দিকে তাকিয়ে কাজ করে না। তারা যান্ত্রিকভাবে ধর্মীয় নির্দেশ বা মূল্যবোধ মেনে চলে; এতে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না। প্রোটেস্টান্টিজম মানুষকে পরিশ্রম করতে ও কৃচ্ছুতাসাধনে উদ্বুদ্ধ করে। যারা এ অনুজ্ঞা অনুসরণ করে তারা বিত্তশালী হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কাজেই যান্ত্রিকভাবে কাজ করলে অপ্রত্যাশিত ফল দেখা দিতে পারে।

• যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তার উল্টোটি ঘটা (self-defeating prediction): এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ফলাফল অনেক সময় কল্যাণকর হতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে জনসংখ্যা যত বাড়বে খাদ্য উৎপাদন তত বাড়বে না। ফলে অনাহারে অনেক লোক মারা যাবে। এ ভবিষ্যদ্বাণী করার ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর এত জোর দেওয়া হলো যে ব্যাপক অনাহার-মৃত্যুর ঘটনাটি আদৌ ঘটল না।

বর্তমান নিবন্ধে যেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার কোনো কোনোটি মার্টনের তাত্ত্বিক কাঠামোতে বিশ্লেষণ করা গেলেও অনেকগুলির ক্ষেত্রে মার্টনের তত্ত্ব যথেষ্ট নয়। তার একটি বড় কারণ হলো, মার্টনের তত্ত্বে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ। তিনি যখন অপ্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধটি লেখেন তখন পর্যন্ত আধুনিক অর্থনীতির অনেক তত্ত্বই প্রকাশিত হয়নি। সারণি ২.১-এ এই প্রবন্ধে উল্লেখিত মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনাগুলির বিশ্লেষণ দেখা যাবে।

সারণি ২.১ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ১০টি মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনার মধ্যে একটি ক্ষেত্রে সরকারি ত্রুটি ও দুটি ক্ষেত্রে কারিগরি অজ্ঞতা মিত্রপক্ষের গুলির জন্য দায়ী। পাঁচটি ক্ষেত্রে কারণ অর্থনৈতিক। এসব ক্ষেত্রে বাজারের অস্তিত্ব অস্বীকার করে সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের ব্যয় বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেকটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। কিন্তু বুধোরা বাড়তি ব্যয় বহন করতে রাজি হয় না। তাই সরকার নামক উদোকে তার পিণ্ডি নিয়ে বেসামাল অবস্থায় পড়তে হয়। তিনটি ঘটনার বিশ্লেষণ হতে দেখা যাচ্ছে, মিত্রপক্ষের গুলির ঘটনার আশঙ্কা অনেক কমে যেত, যদি সরকারি উদ্যোগের স্থানীয় জনগণের কাছে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা থাকত। এ বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি সুপারিশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সামাজিক লাভের জন্য যদি সরকারের গৃহীত উদ্যোগে কারও ক্ষতি হয়, তবে তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্তরা সে উদ্যোগ ভন্ডুল করে দেবে। দ্বিতীয়ত, উপকারভোগীদের সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা না হলে সরকারি উদ্যোগে উপকারের চেয়ে অপকার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। তৃতীয়ত, মানুষের কারিগরি জ্ঞান সীমিত। তাই জটিল প্রকল্পের ক্ষেত্রে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। সবশেষে, সরকারকে তার গৃহীত ব্যবস্থার সম্ভাব্য ত্রুটি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। এ জন্য প্রতিনিয়ত সরকারি ক্রিয়াকাণ্ডের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রয়োজন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুটি মৌল সমস্যা রয়েছে। রাজনীতির মূল সমস্যা হলো, রাজনীতিবিদেরা স্বল্প মেয়াদের লাভ-লোকসানকে বড় করে দেখেন। এবং দীর্ঘ মেয়াদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াগুলি অগ্রাহ্য করেন। তাদের দৃষ্টি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনের বাইরে প্রসারিত হয় না। অথচ সমাজে অনেক জটিল সমস্যা রয়েছে, স্বল্প মেয়াদে যার সমাধান সম্ভব নয়। রাজনীতিবিদেরা জটিল সমস্যার স্বল্পমেয়াদি সহজ সমাধান চান। অনেক ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব হয় না। তাই যা অসম্ভব তাকে সম্ভব করার চেষ্টা করতে গিয়ে রাজনীতিবিদেরা সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলেন।

অর্থনীতির মৌল সমস্যাটি অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিক ব্যস্তিয়াত (১৯৯৫)। তিনি মনে করেন, কোনো অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ফলাফল তাৎক্ষণিক দেখা যায় না। কিছু ফলাফল সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়; কিছু ফলাফল পরবর্তী সময়ে আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই যেকোনো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে : (১) দৃশ্যমান ও (২) অদৃশ্য। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। দৃশ্যমান ফলাফল গ্রহণযোগ্য হলেও অদৃশ্য ফলাফল অবাঞ্ছিত হতে পারে। যারা ভালো অর্থনীতিবিদ, তাঁরা অদৃশ্য ফলাফল সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেন, অযোগ্য অর্থনীতিবিদেরা পারেন না। ব্যস্তিয়াত (১৯৯৫, ১) তাই লিখেছেন, There is only one difference between a bad economist and a good one: the bad economist confines himself to the visible effect; and the good economist takes into account both the effect that can be seen and those effects that must be foreseen. (সু ও কু অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একটিই তফাত আছে; খারাপ বা বাজে অর্থনীতিবিদ শুধু দৃশ্যমান প্রভাব দেখতে পান; ভালো অর্থনীতিবিদ একই সঙ্গে দৃশ্যমান প্রভাব ও অদৃশ্য প্রভাব সম্পর্কে সঠিক অনুমান বিবেচনায় নেন)। কাজেই মিত্রপক্ষের গুলি এড়ানোর জন্য চাই দক্ষ অর্থনীতিবিদ। আর তাদের শুধু অর্থনীতিতে দক্ষ হলেই চলবে না। অদূরদর্শী ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদেরও জয় করতে হবে তাদের।

.

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

আচেমঞ্জু, ডেরন ও যশুয়া ডি আংগ্রিস্ট (Acemoglu, Daron and Joshua D. Angrist) । ২০০১। ‘Consequences of Employment Protection? The Case of the Americans with Disabilities Act’. Journal of Political Economy. Vol. 109. No.5 l

আসাদুল্লাহ, মোহাম্মদ নিয়াজ ও নজমুল চৌধুরী (Asadullah, M. Niaz and Nazmul Chowdhury)। ২০০৮। Poisoning the Mind: Contamination and Cognative Achievement of Children’(Mimeo). Policy Research Working Paper. 4510. Washington DC: World Bank.

ইসলাম শহিদুল ও জাকির কিবরিয়া (Islam Shahidul and Zakir Kibria)। ২০০৬। Unravelling KJDRP. Dhaka: Uttaran. কুগার, এন ও. (Krueger, Anne 0.)। ১৯৯০। The Government Failure in Development’. The Journal of Economic Perspectives. Vol. IV. No. 2.

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB Bangladesh)। ২০০৫। Data Base on Corruption. Dhaka.

ডুবনার, স্টিফেন জে ও স্টিভেন ডি লেভিট (Dubner, Stephen J. and Steven D. Levitt) / Roob l ‘Unintended Consequences’. The New York Times. January 29, 2008.

নর্টন, রড (Norton Rod)। ২০০৮। Unintended Consequences. The Concise Encyclopedia of Economics. Indianapolis: Liberty Press.

পাকিস্তান সরকার (Government of Pakistan)। ১৯৭০। Fourth Five Year Plan. Islamabad: Planning Commission.

পিয়ার্স ফ্রেড (Pearce Fred) I food Bangladesh’s Arsenic Poisoning: Who is to blame? http://www. Unesco.org/courier/ 2001 01/uk?Planet. html.

ফেরারি, অরোরা (Ferari, Aurora)। ২০০৮। Increasing Access to Rural Finance in Bangladesh: The Forgotten Missing Middle. Washington DC: World Bank.

বাংলাদেশ ব্যাংক (Bangladesh Bank)। ২০১২। Annual Report. Dhaka.

ব্যস্তিয়াত, ফ্রেডরিক (Bastiat, Frederic)। ১৯৯৫। selected Essays. Translated by Seymour Cain. New York: Irvington on Hudson.

মার্টন, রবার্ট কে (Merton, Robert K)। ১৯৩৬। The Unanticipated Consequences of Purposive Social Action’. American Sociological Review. Vol. 1. No. 6, 894-904.

রোড, ডেভিড এবং জুকফিকার আলী মানিক (Rhode, David and Zulfikar Ali Manik) । 2005 ‘The lethal water wells of Bangladesh’ New York Times, july 17, 2005. Force,

লিউক, ডিন ও জেফরি এ. মাইকেল (Leuck, Dean and Jeffrey A. Michael)। ২০০৩। ‘Preemptive Habitat Destruction Under Endangered Sprcies Act’. Journal of Law and Economics. Vol XLVI.

সেন, অমর্ত্য (Sen, Amartya)। ২০০৫। The Argumentative Indian. New York: Farrar, Straus and Giroux.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *