০২. মা চলে গিয়েছেন

মা চলে গিয়েছেন এবং আর কোনোদিন ফিরে আসবে না— এটা আমরা খুব সহজেই বুঝে ফেললাম। শুধু সেতারা বুঝতে চাইল না। সে এমনিতেই কম কথা বলে। এখন কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। দিনরাত সে শুধু মাকে খুঁজত। মার শোবার ঘরের সামনে কতবার যে গিয়ে দাঁড়াত। ডাকাডাকি না কিছু না, শুধু দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। আমি একদিন দেখতে পেয়ে ডাকলাম, এই সেতারা।

উঁ।

এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

সেতারা মাথাটা অনেকখানি নিচু করে ফেলল যেন খুব-একটা অপরাধ করেছে।

কি করছিস তুই?

কিছু না।

আয় আমার সাথে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব, আসবি?

না।

আমি লক্ষ্য করি সে একা একা ঘুরে বেড়াতে চায়। কারো সঙ্গে থাকতে চায় না। সন্ধ্যাবেলা কেউ কিছু বলার আগেই সে আমার সাথী বই নিয়ে বসে একদম নিচু স্বরে পড়তে থাকে

‘কমলাফুলি কমলা ফুলি
কমলা লেবুর ফুল
কমলা ফুলির বিয়ে হবে
কানে মোতির দুল।’

যখনি সে পড়তে বসে এই একটি কবিতাই সে পড়ে। তখন যদি বাড়ির সামনে কোনো রিকশা। এসে থামে সে পড়া বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এক সময় বই বন্ধ করে অপরাধীর মত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে চলে যায় বারান্দায়। আবার ফিরে এসে পড়তে বসে–কমলাফুলি, কমলাফুলি কমলা লেবুর ফুল…।

একদিন নীলু বলল, সেতারা মা আমাদের কাউকে পছন্দ করেন না তো তাই চলে গেছেন। আর আসবেন না।

আচ্ছা।

যে আমাদের ভালবাসে না। আমরাও তাকে ভালবাসি না, ঠিক না?

হুঁ।

তুই আর মাকে খুঁজবি না–আচ্ছা?

সেতারা মৃদু স্বরে বলল, আমাদের পছন্দ করে না কেন?

আমরা সবাই তো মেয়ে এই জন্যে, ছেলে হলে পছন্দ হত। আমাদের তো কোন ভাই নেই। বুঝেছিস?

হুঁ।

সেতারা মায়ের আদর পায়নি বললেই হয়। তার জন্মের পর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেতারা বড় হতে থাকে আকবরের মার কোলে। মার অসুখ যখন সারল তখনো অবস্থার পরিবর্তন হল না। মা মাঝে মাঝেই বিরক্ত স্বরে বলতে লাগলেন, ঘর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে মেয়ে দিয়ে, ভাল লাগে না। সেতারা যখন হাঁটতে শিখল, টুকটুক করে হাটত। মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়াত সুযোগ পেলেই। মা গভীর গলায় ডাকতেন, আকবরের মা ওকে নিয়ে যাও তো, এখুনি ঘর নোংরা। করবে। তার দুবছর বয়স হতেই মা ওকে পাঠিয়ে দিলেন আমাদের ঘরে। রাতে ঘুমাবে নীলুর সঙ্গে। দুধ খাবার জন্যে কাঁদলে আকবরের মা উঠে দুধ বানিয়ে দেবে। সেতারা তখন কোনো ঝামেলা করেনি। এখনো করে না। নীলুর গলা জড়িয়ে ঘুমায়। নীলু বলে, গল্প শুনবি?

বল।

এক দেশে ছিল এক রাজা। তার দুই রানী দুয়ো ও সুয়ো…

এ পর্যন্ত আসতেই সেতারার চোখ বুজে আসে। কোনোদিন আর সে গল্প শেষ পর্যন্ত শোনা ट्र म्षी।

ইদানীং বাবা সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে চান। সেতারাও বেশ ভাল-মানুষের মত যায়।

কিন্তু মাঝরাতে একা একা চুলে আসে আমাদের ঘরে। রোজ এই কাণ্ড। একরাতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল, সেতারা সবাইকে ডাকতে লাগল, মা এসেছে রিকশা নিয়ে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসলাম, কোথায়?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম।

বলিস কি?

হৈচৈ শুনে বাবা উঠে এলেন। কোথায় কি, খা-খা করছে চারদিক! সেতারা দারুণ অবাক হল। বাবা বললেন, স্বপ্ন দেখেছি মা।

উঁহু, স্বপ্ন না। আমি দেখলাম।

সেতারা চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকাতে লাগল। সে ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবা সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। সে রাতে আমি এবং নীলু এক খাটে ঘুমাতে গেলাম। এবং অনেক রাত পর্যন্ত দুজনেই নিঃশব্দে কাদলাম। অথচ দু’জনই এমন ভাব করতে লাগলাম যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।

 

ধীরে ধীরে অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটল বাড়িতে। বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি পরিবর্তনগুলি করলেন খুব সাবধানে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি মার আলনায় কোনো কাপড় নেই। সব বাবা কোথায় সরিয়ে ফেলেন। তার দিন সাতেক পর বারান্দায় মার যে বড় বাধাই করা ছবিটি ছিল সেটিকে আর দেখা গেল না। বাবা-মার শোবার ঘরে তাদের বেশ কয়েকটি ছবি ছিল, সেগুলিও সরানো হল।

আমাদের ঘরে মা-বাবা এবং আমাদের তিন জনের যে ছবিটি ছিল সেটি শুধু বাবা সরালেন না। রান্নাবান্না করবার জন্যে রমজান নামের একজন বুড়ো মানুষ রাখা হল। এই লোকটি এসেই প্রচণ্ড ঝগড়া শুরু করল আকবরের মার সঙ্গে। দুজনেরই কি ঝাঁঝাল কথাবার্তা। কিন্তু রমজান লোকটি ভাল। সে সেতারাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভাত খাওয়াত। আমাদের ওপর তার খবরদারিরও সীমা ছিল না।

এই সইন্ধ্যা রাইতে বাগানো ঘুরাঘুরি করণ ঠিক না।

অত তেঁতুল খাওন বালা না, বুদ্ধি নষ্ট হয়।

ভাত খাওনের আগে বিসমিল্লা কইরা এট্টু লবণ মুখের মইধ্যে দেওন দরকার।

রাতের বেলায় খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সে গম্ভীর হয়ে একটা খবরের কাগজ নিয়ে আমাদের পড়ার ঘরে গিয়ে বসত। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এমন সব কথাবার্তা বলত যে নীলু হেসে উঠত খিলখিল করে।

হুঁ খুব সংকটময় অবস্থা। বুঝছি নীলু আপা, অবস্থা সংকটময়।

কেন?

নেপালে পাহাড়ি ঢল। হুঁ।

এই অবস্থায় ঝগড়া লেগে যেত আকবরের মার সঙ্গে, আকবরের মা কোমরে দুই হাত দিয়ে রণরঙ্গিনী মূর্তিতে এসে দাঁড়াত।

বিদ্যার জাহাজ যে বইছেন পাকঘরের বাসনডি কেডা ধুইব?

চুপ থাক। অশিক্ষিত মূর্খ মেয়ে মানুষ, এদের নিয়ে চলাফেরা মুশকিল।

রমজান ছাড়াও একজন ভয়ংকর রোগা দাঁত নেই ওস্তাদ রাখা হল। এই ওস্তাদটির নাম মুনশী সোভােহান। তিনি আমাদের তিন বোনকে সপ্তাহে তিন দিন গান শেখাবেন। আমরা তিন জনেই গান শিখতে শুরু করলাম। সকাললো হরমোনিয়াম নিয়ে বসে সারেগা রেগামা গামাপা। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। ওস্তাদ সোভােহান বেশিক্ষণ গান শেখাতে পারেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাঁপানির টান ওঠে। গান থামিয়ে বলেন, ঘরে কোনো টিফিন আছে কিনা দেখ তো খুকি। না থাকলে একটা মুরগির ডিম ভেজে দিতে বল। হাসের ডিম না। হাসের ডিম গন্ধ করে, খেতে পারি না।

গানের ওপর থেকে আমাদের মন উঠে গিয়েছিল, কাজেই আমাকে দিয়ে গান হল না। সেতারা এবং নীলু। শিখতে লাগল। কিছুদিন পর নীলুও কেটে পড়ল। রইল। শুধু সেতারা। মাস ছয়েকের মধ্যে দেখা গেল বেণী দুলিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেতারা গাইছে, নবীর দুলালী মেয়ে খেলে মদিনায়। ও ও ও খেলে মদিনায়।

ওস্তাদ সোভাহান ঘাড়-টান দুলিয়ে বলেছেন, মারহাবা মারহাবা কি টনটনে গলা। এইবার লক্ষ্মী ময়না গিয়ে দেখ তো কোনো টিফিন আছে কিনা। না থাকলে মধুর দোকান থেকে যেন একটা আমৃত্তি নিয়ে আসে। আর চা দিতে বল।

 

সে বছর শীতের সময় মা আমাদের তিন বোনকে সিরাজগঞ্জ থেকে আলাদা আলাদা চিঠি লিখলেন। বাবা একদিন সন্ধ্যায় পাংশুমুখে তিনটি খামে বন্ধ চিঠি নিয়ে আমাদের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। কাঁপা গলায় বললেন, তোমাদের মা চিঠি লিখেছেন। তোমরা কি সেই চিঠি পড়তে চাও?

বাবার গলা কাঁপছিল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বাবা চাচ্ছেন আমরা বলি, না। বাবা কপালের ঘাম মুছে নিচু স্বরে বললেন, আমরা সবাই তাকে ভুলতে চেষ্টা করছি। এখন আবার চিঠিপত্র শুরু করলে কষ্ট হবে। নতুন করে কষ্ট হবে।

বাবা থামতেই সেতারা বলল, আমার চিঠি দাও। খানিকক্ষণ চুপ থেকে নীলু বলল, আমার চিঠিটাও দাও। শুধু আমি কিছুই বললাম না। বাবা ধরা গলায় বললেন, মামণি রাত্রি, তোমারটা?

আমি চাই না।

কি লেখা ছিল নীলু এবং সেতারার চিঠিতে আমি জানি না। নীলু। সমস্ত কথাই আমাকে বলে। শুধু চিঠির ব্যাপারে কিছু বলল না। আর সেতারা তো তার খামই খুলল না। বন্ধ খাম হাতে নিয়েই ঘুরে বেড়াতে লাগল।

আমি বললাম, খুলে দেব?

না।

না খুললে পড়বি কি করে?

আমি পরে পড়ব।

যেন পড়লেই চিঠির মজা শেষ হয়ে যাবে। আমি সমস্ত দিন ভাবলাম কি লিখেছেন মা চিঠিতে? ক্লাসে আপারা কি পড়ালেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। অংক আপা দুবার ধমক দিলেন, এই বিলু তোমার পড়ায় আজকে মন নেই, কি ব্যাপার?

কিছু না আপা।

আমি কি বলছি তুমি তো কিছুই শুনিছ না।

শুনছি আপা।

না শুনিছ না। বল তো আমি কি বলছিলাম?

আমি বলতে পারলাম না। সব মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমার ক্লাসের মেয়েরা বিচিত্র কারণে আমাকে অপছন্দ করে। সব সময় আমার পেছনে লেগে থাকে। আমাদের বাথরুমের দেয়ালে আমাকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা লেখা। একটা নেংটা মেয়ে এবং একটা নেংটা ছেলের ছবি আঁকা আছে। মেয়েটার গায়ে লেখা বিলু ক্লাস নাইন খ শাখা। অথচ কোথাও নীলুর নামে কিছু লেখা নেই। আমি কখনো বাথরুমে যাই না। যদি যেতেই হয় তাহলে অনেকক্ষণ সেখানে বসে কাদি। ইরেজার দিয়ে লেখাগুলি তুলে ফেলতে চেষ্টা করি–কিছুতেই সেগুলি উঠানো যায় না।

বিলু মন দিয়ে পড়াশুনা করবে, বুঝলে। এরকম করলে তো হবে না।

ক্লাসের মেয়েগুলি আবার হৈচৈ করে হেসে উঠল। বাড়িতে ফিরে এসে অনেকক্ষণ একা একা বসে রইলাম। রাতে রমজান ভাইকে বলে দিলাম, ক্ষিধে নেই, কিছু খাব না। অনেক রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখি আমার-বালিশ্রের নিচে মায়ের পাঠানো খামটা রেখে দেয়া। নিশ্চয়ই বাবার কাণ্ড।

ঘরে কেউ নেই। নীলু এখনো পড়ছে। সেতারা রান্নাঘরে রমজান ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন করছে। আমি দরজা বন্ধ করে খাম খুলে ফেললাম। মা আমাকে বিলু নামে সম্বোধন করেননি, প্রথমবারের মত লিখেছেন রাত্রি।

মামণি রাত্রি,
আমি জানি রাগ করেছ তুমি। কিন্তু কি করব মা। উপায় ছিল না। তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। মানুষের মন খুব বিচিত্র জিনিস। একবার কোনো কিছুতে মন বসে গেলে তা ফেরানো যায় না। আমি বহু চেষ্টা করেছি। মানুষ হয়ে জন্মানোর মতো কষ্টের কিছু নেই। আমি তোমাদের ছেড়েছুড়ে এসেছি। তবু রাতদিন তোমাদের কথাই ভাবি। রাতদিন প্রার্থনা করি যে কষ্ট আমি পাচ্ছি। তা যেন কখনো আমার মামণিদের না হয়।
–তোমার মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *