মায়ের মন আতঙ্কে শিউরে উঠলো।
এখানেও জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই।
প্রশস্ত পথ জুড়ে ভাঙ্গা কাচের টুকরো। ইটের টুকরো।
আর মৃতদেহ।
কুকুরের।
বিড়ালের।
পাখির।
আর মানুষের।
চারপাশে একবার তাকালো তপু।
ধ্বনির পশুরা তাড়া করছে ওকে।
ডানে। বাঁয়ে। সামনে। পেছনে।
চারপাশে থাকে।
তপু ছুটছে। পালাচ্ছে সে প্রাণপণে।
সহসা সামনে একটা খোলা দরজা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। ওটা একটা সিঁড়িঘর। ঘোরান সিঁড়ির উৎস মুখে লুকিয়ে থাকার মতো এক টুকরো অন্ধকার। ভেতরে এসে তার আত্মগোপন করলো তপু।
শব্দের রাক্ষসগুলো তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে নীরবে বসে বসে নিজের হৃৎপিণ্ডের দ্রুত ধাবমান গতিটাকে আয়ত্বের অধীন আনার চেষ্টা করতে লাগলো সে। ভাঙ্গার শব্দ শুনলো।
কাছে কোথায় যেন সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছে ওরা।
একটা আর্তনাদ শোনা গেলো। না। না।
তপু এবার যে ঘরে এসে আশ্রয় নিলো তার কোন কিছুই অক্ষত নেই।
বিছানা। আসবাব। বই। কাপড়। কাচ। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে।
তপুর মনে হলো ওর হাত পা সব ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে।
দাঁড়াবার শক্তি হারিয়ে ফেলছে সে। ধীরে ধীরে চারপাশে তাকালো।
কাকে যেন খুঁজলো। অস্পষ্ট স্বরে ডাকলো সে। ইভা।
কোন সাড়া নেই।
পাশের বাথরুমে খোলা কল থেকে একটানা পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বেসিন উপচে পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। বাথটবে কয়েকটা মৃতদেহ। রক্ত আর পানির মধ্যে ডুবে আছে।
ইভার মা।
বাবা।
ছোট ভাই।
মরিয়া হয়ে ইভাকে খুঁজতে লাগলো তপু।
কয়েকটা কাচের টুকরো ছিটকে গেলো মেঝের ওপর।
ইভা। ইভা।
আবার সেই পশুদের চিৎকার।
কবাটের আড়ালে আত্মগোপন করতে গিয়ে পিঠের সঙ্গে নরোম কি যেন ঠেকলো তার। সভয়ে পিছিয়ে আসতে ইভার চেতনাহীন দেহটা মেঝের ওপরে গড়িয়ে পড়লো।
ইভা! তপু চমকে উঠলো।
ইভার ধমনি দেখলো সে।
বুকে মাথা রেখে তার হৃদপিণ্ডের শব্দ শোনার চেষ্টা করলো। বেঁচে আছে।
দুহাত ভরে বেসিন থেকে পানি এনে ওর মুখের ওপর ছিটিয়ে দিলো সে।
ইভা চোখ মেলে তাকিয়ে চিৎকার করে আবার চোখ বন্ধ করলো। না। না। দোহাই তোমাদের আমাকে মেরো না। আমাকে মেরো না।
তপু ডাকলো। শোন ইভা, আমি তপু। চেয়ে দেখো, আমি তপু। জবার মতো লাল চোখ জোড়া আবার খুললো মেয়েটি। যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। সহসা শিশুর মতো কেঁদে উঠে তপুর বুকে মুখ লুকালো মেয়েটি।
আকাশ কালো করা জমাট মেঘগুলো বৃষ্টির রূপ নিয়ে অফুরন্ত ধারায় ঝরে পড়ছে। মাটিতে। আর অসংখ্য অগণিত লোক সেই বর্ষণের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে এক হাঁটু পানি আর কাদা ডিঙ্গিয়ে হেঁটে চলেছে।
নানা বর্ণের।
নানা বয়সের।
কেউ দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত।
কেউ জরাগ্রস্থ।
কেউ আবার হিংস্র দানবের নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত।
ওরা পালাচ্ছে।
আমরা এখন কোথায়? একজন আর একজনকে প্রশ্ন করলো। আমরা এখন কোথায়?
ইন্দোনেশিয়ায়। না ভিয়েতনামে। না সাইপ্রাসে।
কোথায় আমরা।
জানি না।
আমার বাড়িঘরগুলো ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। জমি দখল করে নিয়েছে। আলু ওদের ক্ষমা করবে ভেবেছো। কোন দিনও না।
ঘর। বাড়ি। মাটি ছেড়ে আসা মানুষগুলো এক হাঁটু পানি আর কাদা ডিঙ্গিয়ে হেঁটে চলেছে। আর তাদের মাঝখানে বুড়ি মা ঘুরে ঘুরে সবার কাছে যাচ্ছেন। সকলকে দেখছেন। সবার চেহারার দিকে খুঁটিয়ে তাকাচ্ছেন তিনি। তাঁর সন্তানকে খুঁজছেন। আপনারা কেউ দেখেছেন কি তাকে? আসার পথে কোথাও দেখেছেন কি? মাথায় ঝাক ঝাঁকড়া চুল। শ্যামলা রঙ। দেখতে বেশ লম্বা। আপনারা কেউ দেখেছেন কি? সবার কাছে একটি প্রশ্নই করেছেন বুড়ি মা। হা হা। ওর কপালের বাঁ পাশে একটা কাটা দাগ আছে। ছোট বেলায় বিছানা থেকে পড়ে কেটে গিয়েছিলো। আপনার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিলো কি?
সবার কাছে ওই একটি প্রশ্ন করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন মা। কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিতে পাচ্ছে না।
সবাই নিজের ভাবনা আর চিন্তায় মগ্ন। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের কথা নিয়ে দু’দণ্ড আলাপ করার অবকাশ নেই।
আপনি দেখেছেন কি? ওর নাম তপু। হ্যাঁ, আমার ছেলের নাম। ও নামে কাউকে দেখেছেন কি?
তপু, তাই না? হ্যাঁ মনে হচ্ছে দেখা হয়েছিলো। মানে ঠিক কোথায় দেখা হয়েছিলো স্মরণ করতে পাচ্ছি না। অত কি আর মনে থাকে মা। গ্রামকে গ্রাম ওরা পুড়িয়ে ছাই করে দিলো। কত মেরেছে জিজ্ঞেস করছো? তার কি কোন হিসেব আছে। এক বছর নদীতে কোন স্রোত ছিল না। মরা মানুষের গাদাগাদিতে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শকুনরা ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে দু’বছর ধরে। এখনো খাচ্ছে।
মা আতঙ্কে শিউরে উঠলেন।
নিজের সন্তানের নির্মম মৃত্যুর কথা ভেবে অবিরাম বৃষ্টি ধারার মাঝখানে নীরবে দাঁড়িয়ে
দু’চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু, বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে, দু’গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নিচে।
তুমি কাঁদছো কেন গো। কেঁদে কি হবে। আমার দিকে চেয়ে দেখো। আমি তো কাঁদি না। অফুরন্ত মিছিলের একজন বললো। ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে হিরোশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমর রাস্তায়। আমার বোনটা এক সাদা কুত্তার বাড়িতে বাঁদী ছিলো। তার প্রভু তাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে হত্যা করেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই, তাকে ফাঁসে ঝুলিয়ে মেরেছে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালবাসতো।
কিন্তু আমি তো কাঁদি না। তুমি কাঁদছ কেন?
বিষণ্ণ বুড়ি মা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেই লোকটার দিকে। লোকটা থামলো না। এক হাঁটু পানি আর কাদা ডিঙ্গিয়ে সে এগিয়ে গেলো সামনে। সহস্র শরণার্থীর অবিরাম মিছিলে।
পাগলা কুকুরের হলা বেড়েই চলেছে।
মরিয়া হয়ে ওরা তাড়া করছে তপুকে। ইভাকে।
ওরা দুজনের ছুটছে। প্রাণপণে।
টুকরো টুকরো ইটে ভরা শহুরে রাস্তাগুলোতে আলো ঝলমল করছে। আর ওরা অন্ধকার খুঁজছে।
একটুখানি অন্ধকার পেলে তার ভেতরে দু’জনে আত্মগোপন করবে ওরা। সহসা তপু একটা ইটের টুকরো তুলে নিলো হাতে। রাস্তার পাশে জ্বলা বাতি লক্ষ্য করে ইটটা ছুঁড়ে মারলো সে।
বাতি নিভে গেলো।
কাচের টুকরোগুলো ছিটকে গেলো নিচে।
আরেকটা বাত্তি নিভে গেলো।
এক নতুন খেলায় মেতেছে ওরা।
ইভা আর তপু।
ইট সগ্রহ করে এগিয়ে দিচ্ছে ইভা।
আর একটার পর একটা বাতি ভেঙ্গে চলেছে তপু।
ঝলমলে আলো সরে গিয়ে অন্ধকার নেমে এলো পথে। আর সেই অন্ধকারের এককোণে নীরবে লুকালো ওরা দুজনে।
পাগলা কুকুরগুলো হন্যে হয়ে খুঁজেছে ওদের।
শূকরছানাগুলো চিৎকার জুড়েছে সারা পথ জুড়ে।
তপুর সারা দেহ গড়িয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছে।
ইভার বুকটা ওঠানামা করছে দ্রুত তালে।
ইভা। তপু ডাকলো।
কি। ওর দিকে চোখ তুলে তাকালো ইভা।
ভয় লাগছে।
না। তুমি পাশে থাকলে আমি ভয় পাই না।
আচ্ছা ইভা। তপু আবার বললো, তুমি আমাকে ভালবাসতে গেলে কেন বল তো?
জানি না। ইভা মিষ্টি করে হাসলো। ভালো লেগেছে। ভালো লাগে। তাই ভালোবাসি।
গির্জার ঘণ্টাগুলো মৃদু শব্দে বেজে উঠলো।
বুড়ো পাদ্রি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।
দোরগোড়ায় কারা যেন করাঘাত করছে।
বুড়ো পাদ্রি মুহূর্তের জন্যে কি যেন ভাবলেন।
তারপর এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিলেন তিনি।
ইভা আর তপু বাইরে দাঁড়িয়ে।
ওদের বিপর্যস্ত চেহারা আর বসনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন বুড়ো পাদ্রি।
আমরা আপনার এখানে একটু আশ্রয় পেতে পারি কি? শুধু একটা রাতের জন্যে?
ওদের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বুড়ো পাদ্রি।
দূরে শূকর শূকরীর হল্লা শুনলেন।
ইঙ্গিতে ওদের ভেতরে আসতে বললেন তিনি।
দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিলেন।
গির্জার ভেতরে এক প্রশান্ত নীরবতা।
শুধু ওদের পায়ে চলার শব্দগুলো উঁচু দেয়ালের গায়ে লেগে করুণ এক প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করছে।
একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে এনে ওদের আশ্রয় দিলেন বুড়ো পাদ্রি।
এখানে কেউ তোমাদের খোঁজ পাবে না। নিশ্চিত থাকতে পারো।
বুড়ো পাদ্রি শুধোলেন, তোমরা কি ক্ষুধার্ত কিছু খাবে?
ওরা ঘাড় নেড়ে যায় দিলো।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বুড়ো পাদ্রি ফিরে যাচ্ছিলেন, হয়তো খাবারের খোজে। সহসা নিচে প্রার্থনালয় থেকে অসংখ্য কষ্ঠের চিৎকার ধ্বনি শুনলেন।
বিস্মিত হলেন তিনি।
সামনে এসে দেখলেন।
প্রার্থনালয় ভরে গেছে সাদা ধবধবে মানুষের ভিড়ে।
বুড়ো পাদ্রিকে দেখে চিকার করে উঠলো ওরা।
ওই নিগ্রোগুলোকে ওখান থেকে বের করে দাও। আমাদের হাতে ছেড়ে দাও।
না, না, ওরা তো নিগ্রো নয়। বুড়ো পাদ্রি বিড়বিড় করে বললেন। তোমরা ভুল করছে। ওরা নিগ্রো নয়।
মিথ্যে কথা। সাদা ধবধবে মানুষগুলো আবার চিৎকার জুড়ে দিলো। আমরা দেখেছি, একটা নিগ্রো ছেলে আর মেয়েকে তুমি গির্জার মধ্যে আশ্রয় দিয়েছে। বের করে দাও ওদের।
বুড়ো পাদ্রি ব্রিত বোধ করলেন।
ফিরে এসে ভেজানো দরজাটা খুলে ইভা আর তপুকে দেখলেন তিনি।
দেখলেন। একটি নিগ্রো ছেলে আর একটি উয়ে ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
মুহূর্তের জন্যে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন বুড়ো পাদ্রি।
বিশ্বাস হলো না।
আবার দেখলেন।
আবার তাকালেন।
না। নিগ্রো ছেলে আর মেয়ে তো নয়। ইভা আর তপু বসে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখছে তাঁকে। এতক্ষণে শ্বাস নিলেন তিনি প্রাণ ভরে।
প্রার্থনালয়ের কাছে সেই সাদা ধবধবে মানুষগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াবার অভিলাষে ফিরে এসে বুড়ো পাদ্রি দেখলেন, প্রার্থনালয় শূন্য। শূন্য চেয়ারগুলোতে একটি মানুষের অস্তিত্বও নেই। বার কয়েক মাথা নাড়লেন তিনি।
অস্বস্তিতে।
তারপর পকেট থেকে ক্ষুদ্র বাইবেলটা বের করে জোরে জোরে আবৃত্তি করতে লাগলেন বুড়ো পাদ্রি।
বদ্ধঘরের মধ্যে নীরবে বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে বুড়ো পাদ্রির বাইবেল পাঠ শুনলো ইভা আর তপু।
সহসা তপু শুধালো, কি ভাবছে ইভা।
ইভা বললো, যদি পৌঁছতে না পারি?
নিশ্চয়ই পারবো। তবু সাহস দিলো তাকে।
ইভা আবার বললো, কিন্তু সেখানেও যদি কথাটা শেষ করলো না সে। শুধু মুখ তুলে তাকালো তপর দিকে।
ওখানে ভয়ের কিছু নেই ইভা। তবু ধীরে ধীরে জবাব দিলো।
ওখানে আমার মা আছেন। বাবা আছেন। আমার তিনটে ভাই আছে আর একটি বোন। ওরা সবাই তোমাকে পেলে খুব খুশি হবে ইভা। তুমি দেখে নিও। ওরা ভীষণ ভালবাসবে তোমায়।
আমি শুধু তোমার ভালবাসা চাই। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো ইভা। সারাটা জীবন শুধু তোমাকে ভালবাসতে চাই। আমি তোমার সন্তানের মা হতে চাই তপু। আমি একটা সুন্দর ঘর বাঁধতে চাই। আমি সুখ চাই। শান্তি চাই। বলতে বলতে দুচোখ ভরে অশ্রু জমে এলো তার।
তপু ধীরে ধীরে ইভার মুখখানা কাছে টেনে নিলো। চোখের কোণে জমে থাকা অর্শ বিন্দুগুলো আঙ্গুলের স্পর্শে আদর করে মুছে দিয়ে বললো, কেঁদো না ইভা। কাঁদছো কেন? ইভা আস্তে করে বললো, বাবা মার কথা ভীষণ মনে পড়ছে তাই।
বাক্সঘরের মধ্যে আশ্রিত ঊনিশ জন মানুষ।
বাচ্চা। বুড়ো। পুরুষ। মেয়ে। যুবক। যুবতী।
আর আসন্ন সন্তান-সম্ভবা মহিলাটি।
খোয়াড়ের মধ্যে হাঁস মোরগগুলো যেমন গাদাগাদি হয়ে থাকে তেমনি। তেমনি আছে ওরা। কতগুলো মানুষ।
জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে। সাধারণ এক আতঙ্কের দ্বন্দে ক্ষতবিক্ষত। একটু নড়াচড়া করার পরিসর নেই। মাথা সোজা কঝে বর্সবে সে সুযোগ নেই। কারণ বুকের কাছ থেকে মাথাটা তুলতে গেলেই ছাদের সঙ্গে লাগে।
মই বেয়ে উঠে বাক্সঘরের দরজা খুললেন বুড়ি মা।
এক টুকরো আলো এসে ছড়িয়ে পড়লে ওদের চোখেমুখে। কয়েক ঢেউ বাতাসে পোকা-মাকড়ের মতো মানুষগুলো নড়েচড়ে উঠলো। বুড়ি মা খাবার নিয়ে এসেছেন।
ঊনিশ জোড়া ক্ষুধার্ত চোখ ঝাঁপিয়ে পড়লো খাবারের থালার উপরে। খাবারগুলো গোগ্রাসে গিলতে লাগলো ওরা।
বুড়ি মা স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, বাইরে এখন গোলমাল কিছুটা কমেছে। আপনারা নিচে নেমে এসে কিছুক্ষণ চলাফেরা করুন।
হাত পাগুলো ছড়িয়ে বসুন।
ঊনিশ জোড়া চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো।
ওদের নিচে নামার জন্যে মইটা ধরে দাঁড়ালেন বুড়ি মা।
কিন্তু বাক্স থেকে বেরুতে গিয়ে ওরা অনুভব করলো হাত পাগুলো আর সোজা করতে পারছে না। বুকের কাছ থেকে মাথাটা তুলতে গিয়ে দেখলো মেরুদণ্ডে টান পড়ছে। ব্যথা লাগছে।
দীর্ঘদিন একটা বাক্সের মধ্যে হাত পা গুটিয়ে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে ওরা ধীরে ধীরে দ্বিপদ থেকে চতুষ্পদু হয়ে গেছে।
তবু হাত পাগুলো সোজা করে দাঁড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো ওরা।
চতুষ্পদ মানুষগুলো।
সহসা বাইরে আবার সেই হিংস্রতার ধ্বনি শোনা গেল।
সচকিত হলো ঊনিশটি প্রাণ।
বিকলাঙ্গ মানুষগুলো পাখির মতো কিচমিচ শব্দ তুলে মইটার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তালাটা বন্ধ করে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন মা।
বুড়ো বাবা বিছনায় বসে বসে তছবি গুনছেন।
তিন সন্তান উৎকর্ণ হয়ে বন্য ধ্বনি শুনছে।
চৌদ্দ বছরের মেয়েটি হঠাৎ বললো, বাবা, কারা যেন কড়া নাড়ছে। বুড়ো বাবা অস্বস্তিতে ছবি নামিয়ে রাখলেন। তিনি সন্তানের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, বাতিগুলো সব নিভিয়ে দাও। বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো তার।
মা চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে কাছে টেনে নিলেন। কানে কানে বললেন, ওঘরে গিয়ে ওদের একেবারে চুপ থাকতে বলে এসো। যেন কোন রকম শব্দ না করে, যাও। বলে স্বামীর দিকে তাকলেন তিনি। দরজায় করাঘাতের মাত্রা উচ্ছ্বল হয়ে পড়ছে। বুড়ো বাবা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। দরজা খুলে দেবেন তিনি।
বুড়ি মা।
তাঁর তিন সন্তান।
আর চৌদ্দ বছরের মেয়েটি।
সবাই গভীর উৎকণ্ঠা বুকে নিয়ে সিঁড়ির মাথায় নীরবে দাঁড়িয়ে। বুড়ো বাবা দরজা খুললেন। বাইরে থেকে বন্য হিংস্রতা চিৎকার করে উঠলো। বাড়ির ভেতর থেকে ওদের বের করে দাও।
এখানে কেউ নেই। বিশ্বাস করে। এখানে কেউ নেই। বুড়ো বাবা এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন।
মিথ্যে কথা।
মিথ্যে কথা।
মিথ্যে কথা।
এক সঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ চিত্তার জুড়লো তোমরা কাদের আশ্রয় দিয়েছে আমরা জানি। নিজেদের ভালো চাও তো ওদের আমাদের হাতে দিয়ে দাও।
তোমরা ভুল করছে। আমাদের এখানে কেউ নেই।
কিন্তু ওরা বিশ্বাস করতো না। বুড়ো বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ভেতরে এসে ঢুকলো ওরা। তারপর পুরো বাড়িটা তচনচ করে ফেলতে লাগলো।
বাক্সঘরে তখন কবরের নীরবতা।
মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়ে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো ওরা।
ভয়ে।
আতঙ্কে।
আর সেই মুহূর্তে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটির প্রসব বেদনা উঠেছে। একটি সন্তানের জন্ম দিচ্ছে সে। ঊনিশ জন মৃতপ্রায় মানুষ চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে শিশুটির জন্য প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
না। না। এখন নয়।
এখন নয়।
মুমূর্ষু মহিলাটি যন্ত্রণার অস্থিরতায় বারবার নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছে আর ঘর্মাক্ত দেহটাকে আয়ত্তে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
সেও চায় না এ মুহূর্তে শিশুটির জন্ম হোক।
কিন্তু! সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ঊনিশ জন মানুষের অভিসম্পাত কুড়োতে কুড়োতে শিশুটি ভূমিষ্ট হলো।
আর সঙ্গে সঙ্গে, দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে, ঊনিশ জনের একজন সেই বাচ্চাটির গলা টিপে ধরলো।
নিচে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওরা এখন এ ঘরে এসে আশ্রিত মানুষগুলোকে খুঁজছে। প্রসূতির চোখ জোড়া হয়তো পৃথিবীর প্রতি ঘৃণায় একবার কুঞ্চিত হলো। তারপর বিবর্ণ মণিতে প্রাণের চিহ্ন রইলো না। আর বাচ্চাটার সঙ্গে সঙ্গে তার মা-ও মারা গেলো।
মৃত মহিলার স্বামী হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আকিয়ে রইলো সেদিকে। সহসা কান্নার আবেগে ভেঙ্গে পড়তে গিয়ে নিজেই মুখখানা দুহাতে চেপে ধরলো।
না। না। এখন নয়।
এখন কান্নাও নয়।
এখন শুধু নীরবে দুটি মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করো আর নিজেদের আসন্ন মরণ সম্ভাবনার কথা ভেবে ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকে।
মৃত্যুর বন্যতার শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না।
ওরা কান পাতলো।
ভাল করে শোনার চেষ্টা করলো।
শুনলো। বুড়ি মা নিচে থেকে বলছেন। আর ভয়ের কিছু নেই, ওরা চলে গেছে।
বুড়ি মার কণ্ঠস্বর শুনে মৃত মহিলার স্বামী পরক্ষণে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
তার মৃত স্ত্রীর জন্যে। তার মৃত নবজাতকটির জন্যে।