০২. মানুষের উপকার করলে

মানুষের উপকার করলে কখনো-সখনো বড় কাজে লেগে যায়।

বকুলবাগানের এই ফ্ল্যাটখানা পাওয়ার পর ধ্রুবর একথাই মনে হয়েছিল। অথচ কারও উপকার করার কথা ও ভাবেনি।

প্রীতি আর অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। বিশেষ করে ধ্রুবর চাকরিতে একটা ছোটখাটো লিফট হওয়ার পর। ধ্রুব নিজেও আর অপেক্ষা করতে চায়নি।

হরিশ মুখার্জি রোডের যে ভাড়া বাড়িটায় ওরা থাকত, একখানা দোতলা, ছোট বাড়ি, সেখানে ঘরে সংখ্যা ছিল কম। ধ্রুবর বাবা মা এখনও সে বাড়িতেই। ওর দাদা-বৌদিরা সেখানেই। শুধু ধ্রুবকে সরে আসতে হয়েছে। ধ্রুব জানত, সরে আসতে হবে।

প্রীতি ওদের বাড়িতে নিতান্ত অপরিচিত ছিল না। কয়েকবারই গিয়েছে। নানা অজুহাতে।

ধ্রুবর মেজবৌদি রীতিমত বুদ্ধিমতী। দুদিনেই ধরে ফেলেছিল। হাসতে হাসতে বললে, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। যখন ঠিকই করে ফেলেছ ধ্রুবদা, বাবা-মাকে বলতে এত ভয় কিসের?

মেজবৌদি বয়সে ধ্রুবর চেয়ে সত্যি ছোট কি না বোঝা দায়। সেইজন্যেই হয়তো প্রথম থেকেই মেজবৌদি ওকে ধ্রুবদা বলত।

ধ্রুবর বোন সুমিতা ঠাট্টা করে বলেছিল, সে কি গো বৌদি, ঠাকুরপো বলতে পারো না? ধ্রুবদা আবার কি!

তখন মেজবৌদি তো নতুন বৌ, সদ্য বিয়ে হয়েছে। ধ্রুব হেসে বলেছিল, বুঝতে পারছিস না, বয়েস কমানোর তাল।

মেজবৌদি হেসে ফেলে বলেছিল, না ভাই, বিয়ে যখন হয়ে গেছে এখন আর বয়েস কমাব কোনও দুঃখে।

আসলে এ বাড়ির তুলনায় মেজবৌদি ছিল রীতিমত মডার্ন। ওর মুখে নাকি ঠাকুরপো, ঠাকুরঝি ধরনের কথা আসত না, বলতে গেলেই হেসে ফেলত। সেইজন্যেই ধ্রুবদা।

মেজবৌদির সঙ্গেই খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব হয়েছিল বলেই তার কাছে ধরাও পড়ে গিয়েছিল ধ্রুব।

বিয়ের পর সকলের সামনে সেই সব দিনের কথা ফাঁস করে দিয়ে বলেছিল, ধন্য বাবা তোমরা দুজন। কি নাটকই করলে। আমি ভাবতাম একসঙ্গে পড়ে, আজকাল তো সব বন্ধু বন্ধু, হয়তো তাই।

একঘর লোক, সবাই হাসছিল। সে-সব উচ্ছল আনন্দের দিন। ধ্রুবর মেজদাও ছিল। লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সুমিতা টিপ্পনি কেটেছিল, ছোটবৌদি কি ধূর্ত বাবা, কেউ টেরও পায়নি। মেজেবৌদি তখন খুশিতে হাসছে। তাই তো বলছি, দুজনে, টেবিলে ঝুঁকে পড়েছে বইয়ের ওপর, ফিসফিস করে কথা বলছে, দেখে আমি ভাবতাম, দুজনের কি পড়ায় মন। ভিতরে ভিতরে যে এত চলছে…

প্রতি অবশ্য প্রতিবাদ করেছে, এই না, সত্যি বলছি মেজবৌদি, তখন সত্যি পড়তাম।

—ছাই পড়তে। তারপর হেসে উঠে বলেছে, ওকে বই পড়া বলে না, প্রেমে পড়া বলে।

সকলে হো হো করে হেসে উঠেছে।

তবে ধ্রুব জানে, মেজবৌদি না থাকলে ব্যাপারটা এত সহজে হত না। বাবা মাকে বলতে সাহসই পেত না ও।

ও তো ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছে, বাবা-মা যাবতীয় ধ্যান-ধারণায় কত গোঁড়া। বাবার হাতে তো সব সময় পাঁজি ঘুরছে। কালবেলা বারবেলা না দেখে কারও কোথাও যাওয়া চলবে না। মা তার চেয়েও বেশি।

মেজদার বিয়ে তো প্রায় ভেঙে যায়। ঠিকুজিকুষ্ঠির মিল হচ্ছিল না। অথচ মেজবৌদিকে দেখে মেজদার দারুণ পছন্দ হয়ে গেছে।

শেষে নতুন একজন জ্যোতিষীকে শিখিয়ে পড়িয়ে ডেকে আনা হয়েছিল। ধ্রুবই সে-সব ব্যবস্থা করেছিল।

ধ্রুব তাই বলেছিল, তোমার একটু কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। আমি ব্যবস্থা করে কুষ্ঠি না মিলিয়ে দিলে তোমার বিয়ে হত না।

মেজবৌদি জবাব দিয়েছে, আজ্ঞে না। হয়তো আরো ভাল বিয়ে হত। কৃতজ্ঞ থাকতে হয় তো তোমার মেজদার। আমাকে দেখে তারই মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

ধ্রুব হেসে বলেছে, সে তোমরা দুজনে বুঝবে কার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু প্রীতিকে বিয়ে করতে চাই একথা বাবা-মাকে তোমাদেরই বলতে হবে। আমি বলতে গেলেই হয়তো পাঁজি ছুড়ে মারবেন।

মেজবৌদি হেসে ফেলেছে। তারপর হাসি থামিয়ে বলেছে, দেখি কি করা যায়। বাবাকে রীতিমত ভয় পেত ধ্রুব। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছে। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, ঠাকুরদেবতায় ভক্তি, সব সময় নীতিনিয়ম মেনে চলেন। বাড়িতে নিজেদের মধ্যে একটু হাসিহুল্লোড় হলে ধমক দিতেন।

ধ্রুব জানত, প্রীতিকে ও বিয়ে করতে চায় এ-খবর শুনলেই এ বাড়িতে একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। সেজন্যেই বলতে পারছিল না।

প্রীতি যেদিন ধ্রুবর খোঁজে প্রথম এসেছিল, হাতে একরাশ বই খাতা নিয়ে, সেইদিনই রাত্রে খেতে বসে বাবা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেছিলেন, মেয়েটি কে? আজ তোর খোঁজে এসেছিল?

তখন তো প্রীতি-সম্পর্কে কোনও দুর্বলতা ছিল না। দিব্যি বলতে পেরেছিল, আমাদের সঙ্গে পড়ে। অসুখ হয়ে পড়েছিল, তাই নোট নিতে পারেনি। খাতাটা নিতে এসেছিল।

–হুঁ।

ব্যস, আর কোনও কথা বলেননি।

ধ্রুবর পক্ষে ওইটুকুই যথেষ্ট। ও বেশ বুঝতে পেরেছিল, ওর এবাড়িতে আসা, ধ্রুবর খোঁজ নেওয়া, বাবার পছন্দ নয়। মনে মনে সেজন্যে বাবার ওপর রেগেও গিয়েছিল। এইসব পুরোনো দিনের লোেকদের নিয়ে মহা সমস্যা। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে দেখলেই এরা প্রেম ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। অথচ তখন তো প্রীতির সঙ্গে ভালবাসাবাসি শুরু হয়নি। একসঙ্গে পড়ত, কাছাকাছি থাকত বলেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এসে হাজির হত। অথচ ধ্রুব তাকে নিষেধও করতে পারত না। নিষেধ করলেই তো প্রীতি হেসে উঠত, বন্ধুবান্ধবদের কাছে গল্প করে বলত, আর সকলের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ত যে ধ্রুবরা ভীষণ ব্যাকডেটেড। প্রাচীনপন্থী। সে এক লজ্জা।

কিন্তু তারপর হঠাৎ কি ভাবে যেন মেজবৌদির সঙ্গে, সুমিতার সঙ্গে প্রীতির বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত কিন্তু ধরা পড়ে গেল মেজবৌদির কাছে। অথচ প্রীতি তখন খুব কমই আসত।

পরীক্ষাটরিক্ষা হয়ে গেল, দুজনেই পাশও করে গেল। আর ধ্রুব খুব সহজেই একটা চাকরি পেয়ে গেল। সামান্য চাকরি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে একটা লিষ্ট পেয়ে গেল বছর খানেকের মধ্যেই।

মেজবৌদি বললে, ঠিক আছে আমিই বলব। প্রতিদিন মেজবৌদি স্তোক দেয়, আজই বলব।

আব ধ্রুব অফিস থেকে ভয়ে-ভয়ে ফেরে, বেশ রাত করে। না জানি ফিরেই কি শুনতে হবে।

এসেই মেজবৌদিকে প্রশ্ন করে, বলেছিলে? কিংবা কোনওদিন প্রশ্নও করতে হয় না। ওর চোখের দৃষ্টিই বলে দেয় প্রশ্নটা কি।

মেজবৌদি ঠোঁট উল্টে ইশারায় জানিয়ে দেয়, না, বলতে পারিনি। আসলে মেজবৌদিও ভয় পাচ্ছিল।

তারপর একদিন মেজবৌদি ওর ঘরে এসে হাজির। মুখে উচ্ছল হাসি। উচ্চকিত স্বরে বলে উঠল, এই ধ্রুবদা, আমরা বাবাকে এতদিন একটুও বুঝতে পারিনি। একেবারে অন্য মানুষ, তোমরা কেউ ওঁকে চেনোই না।

ধ্রুবর মনে তখন উদ্বেগ আর কৌতূহল। ব্যাপারটা কি তাই বল।

–সে কথাই তো বলছি। বাবার গম্ভীর মুখটাই এতকাল দেখে এসেছ। ভিতরে কি আছে জানতে চাওনি।

ধ্রুব অধৈর্য হয়ে উঠল, আঃ, বলই না কি বললেন।

মেজবৌদিকে হেসে হেসে বললে, অনেক ধানাইপানাই করে তুললাম কথাটা। প্রীতিকে তোত আপনি দেখেছেন…। মেজবৌদি আবার হেসে উঠল।-বাবা সব শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর; আমার তো বুক ধড়ফড় করছে। হঠাৎ বাবা কি বললেন জানো, শুনলে অবাক হয়ে যাবে।

—কি বললেন?

মেজবৌদির মুখে এমন অঢেল হাসি দেখেই বুঝেছে সাঙ্ঘাতিক কিছু নয়। তবু উৎকণ্ঠা যায় না।

–বল না, কি বললেন।

মেজবৌদি হাসতে হাসতে বললে, সেই অকালকুষ্ম তোমাকে ঘটকালি করতে পাঠিয়েছে কেন? নিজে এসে বলতে পারে না? আমি বাঘ না ভালুক? আমি তো তার বাবা।

ধ্রুবর মুখেও তখন হাসি ফুটেছে। হাসতে হাসতেই বললে, অসম্ভব। আমি নিজে গিয়ে এখনও বলতে পারব না। কিন্তু রাজি হয়েছেন কি না বলবে তো?

মেজবৌদি বললে, তোমরা মনে কর তোমরাই বেশি চালাক। বাবা কি বললেন জানো? বললেন, ও আমি অনেকদিন থেকেই বুঝতে পেরেছি, শুধু ভাবছিলাম আহাম্মকটা কিছু বলছে না কেন! মেয়েটি শেষ পর্যন্ত রাজি হল না নাকি।

ধ্রুব হেসে ফেলল। বললে, আর মা?

–বাবার মত ছাড়া মার কি আর কোনও মত আছে নাকি? মাও খুশি। সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুবর বুক থেকে একটা ভার নেমে গেল। কিন্তু ওর তখন অবাক হবার পালা। সত্যি ভাবতে পারছিল না বাবা এত সহজ ভাবে নেবেন, এত সহজে মত দেবেন।

মেজবৌদি বললে, তার চেয়ে বড় কথা কি জানো? দিদি জিগ্যেস করেছিল, ঠিকুজিটা একবার মিলিয়ে নেবেন না? বাবা উত্তর দিলেন, নিজেরা বিয়ে করছে, সেখানে আবার ঠিকুজিকুষ্ঠি কি হবে? যেখানে আমরা ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছি, কেমন ভয়-ভয় করত।

অজানা অচেনা সব, তাই অত ভাবতে হয়। বলে হাসলেন।

ধ্রুব শুনে বললে, আমার কুড়িটা টাকা জলে গেল।

—কেন? মেজবৌদি হেসে তাকাল ধ্রুবর চোখের দিকে। আর ধ্রুব বললে, বাবা যদি রাজিও হন, ঠিকুজি চাইবেন ভেবে জ্যোতিষীকে দিয়ে এমন রাশিচক্র বানিয়ে নিয়েছি প্রীতির, একেবারে রাজযোটক।

মেজবৌদি হাত পেতে বললে, এবার ঘটক বিদেয় কি দেবে দাও। বাবা নিজেই বলেছেন, ঘটকালি করতে তোমাকে পাঠাল কেন।

ধ্রুব বললে, দেব দেব।

তারপর বেরিয়ে গেল। তখনই খবরটা প্রীতিকে দেবার জন্যে। ইচ্ছে করেই সেদিন অনেক রাত করে ফিরেছিল। রাত্তিরে বাবার সঙ্গে, বাবার সামনে যাতে খেতে বসতে না হয়। কি বলে বসবেন, কি জিগ্যেস করবেন সেই ভয়ে।

তারপর বিয়েটা হয়ে গেল। হরিশ মুখাজি রোডের সেই আগের বাড়িতেই। ওই বৌভাতের দিনেই রাখালবাবুকে ভাল করে দেখেছিল। দুএকটা কথাও বোধহয় বলেছিল। তবে তেমন একটা আদর আপ্যায়ন করেনি। কেন করবে। ছোট হলেও পুরো বাড়িটাই ওরা তখন ভাড়া নিয়ে আছে। বাবা সদ্য রিটায়ার করেছেন, কিন্তু তিন ছেলেই চাকরি করে। বেশ সচ্ছল।

আর রাখালবাবু থাকতেন ওদের সামনের বাড়ির একতলার একখানা কি দেড়খানা ঘর নিয়ে। স্ত্রী ও দুতিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। দেখে মনে হত বেশ দুঃস্থ।

হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িটার সামনেই রাস্তার ওপারে তখন ছিল টানা ব্যারাকের মতো দোতলা একটি বিধ্বস্ত বাড়ি। তার খোপে খোপে অনেকগুলি ভাড়াটে পরিবার। তারই একটিতে থাকত রাখালবাবুর সংসার। পলেস্তারা খসে খসে দেয়ালের ইট বেরিয়ে পড়েছে, জানালা দরজার কি রঙ ছিল বোঝাই যায় না, জানালা বন্ধ করার সময় সারা পাড়ার লোক শুনতে পেত। বাড়ির মালিক হেমন্তবাবু থাকতেন দোতলায়। বিরাট সংসার, এবং শেষের দিকে তাঁকে দেখেও বেশ দুঃস্থ মনে হত। ঘরে চল্লিশ পাওয়ারের টিমটিমে বা জ্বলতো, তাও দুখানি কি একখানি ঘরে।

কিন্তু হেমন্তবাবু মানুষটি ছিলেন খুব সজ্জন। যৌবনে তাঁর হয়তো একটু সৌন্দর্য পিপাসাও ছিল। বাড়ির এককোণে একটা পলাশ গাছ যখন লাল হয়ে কত, দেখতে ভালই লাগত ধ্রুবর। দেয়াল বেয়ে ওঠা বোগেনভেলিয়া বয়েসের বলিষ্ঠতায় আর লতা ছিল না, প্রায় কাণ্ড। ফুলে ছাওয়া। পিছনের দিকে খালি জমিতেও ঘাসঝোপের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা গাছ নিতান্ত অযত্নেও ফুল ফোটাত। সেটা তখন আর বাগান ছিল না, বেশির ভাগ সময়েই সেখানে নীচের ভাড়াটেরা কাপড় শুকোতে দিত। কাপড় শুকোনোর জায়গা নিয়ে, কিংবা কাপড় টাঙানোর দড়ি ছেড়া নিয়ে ভাড়াটেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিও শোনা যেত।

এই ভাড়াটেদেরই একজন রাখালবাবু। রাস্তায় যেতে আসতে কদাচিৎ দেখা হত। সুমিতা কিংবা বড়বৌদির কাছে খুব শুনেছিল ভদ্রলোক কিসের যেন ব্যবসা করেন। খুব ভেবেছিল, দোকানটোকান আছে হয়তো। ওঁর সম্পর্কে ধ্রুবর কোনও ঔৎসুক্যও ছিল না। বৌভাতের দিনে যা দুচারটে কথা।

তারপর হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা হতেই রাখালবাবু ডেকে বসলেন।–এই যে ধ্রুব, তোমার সঙ্গে একট কথা ছিল।

ধ্রুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখে হাসি আনল।

—তোমার বড়দার কাছেই আমি গেসলাম, বড়দা বললেন, বুঝলে কি না, তুমি ভাল ইংরিজি জানো, তুমিই ভাল পারবে।

ধ্রুব রাখালবাবুকে এড়িয়ে চলে আসার জন্যে তখন ব্যর্থ। সদ্য অফিস থেকে ফিরছে, এমনিতেই ক্লান্ত। তাছাড়া তখন তো বিয়ের পরের দিনগুলো, প্রীতির কাছে ফিরে আসার জন্যেও বেশ একটা ব্যগ্রতা ছিল।

রাখালবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমি মুখুসুখ মানুষ, সেজন্যেই তোমাদের কাছে ধনা দেওয়া। তোমরা না করে দিলে কার কাছে যাই বল?

ওঁর বলার ধরনে ধ্রুব একটু নরম হল। —কি বলুন?

—আমাদের গাঁয়ে একটা ইস্কুল আছে, বুঝলে কি না। সেখানে একজন উপমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বুঝলে কি না। তাঁর নামে ইংরিজিতে একটা অভিনন্দন লিখে দিতে হবে। সরকারি গ্র্যান্ট না বাড়ালে ইস্কুলটা উঠে যাবে।

ধ্রুবর একটুও ইচ্ছে ছিল না। সারা শরীর চিড়বিড় করে উঠেছে। রাগ গিয়ে পড়েছে দাদার ওপর। নিজে কাঁধ থেকে দায়িত্ব নামাবার জন্যে কি দরকার ছিল ধ্রুবর নাম করার। ধ্রুবই ভাল পারবে! কেন? তুমি নিজে করে দিতে পারতে না কিংবা বলতে পারতে না, অন্য কাউকে বলুন!

রাখালবাবু বললেন, এই শনিবারেই চাই কিন্তু ধ্রুব। বলে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করেছেন। সব লেখা আছে, দেখে নিও। ইস্কুলের নামটাম, উপমন্ত্রীকে কি বলতে হবে।

এ ধরনের কাজ কখনও করেনি ধ্রুব, জানেও না। তবু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে হয়েছে।

কাজের দায়িত্বটা নিয়েই রাখালবাবু লোকটির ওপরই ও রেগে গেছে, বিরক্ত হয়েছে।

বাড়িতে ফিরেই রাগ গিয়ে পড়েছে বড়বৌদির ওপর।—দাদার কি দরকার ছিল লোকটাকে আমার পিছনে লেলিয়ে দেওয়ার। অত যদি দয়ামায়া, নিজে করে দিলেই তো পারত।

সব শুনে বড়বৌদিও রেগে গেছে। বলেছে, ওসব কথা আমাকে বলছ কেন, নিজের দাদাটিকে বললেই তো পার।

কিন্তু যত রাগই হোক ধ্রুবকে কাজটা করে দিতে হয়েছিল। রাত জেগে, তিন দিন ধরে সেটা ঘষামাজা করে একটা গুরুগম্ভীর স্তবের মতো করে লিখে দিয়েছিল।

শেষ হতেই প্রীতিকে বলেছিল, উপমন্ত্রীকে তৈলদান কমপ্লিট।

প্রীতি আধখানা পড়েই হেসে লুটোপুটি।

কিন্তু রাখালবাবু অভিনন্দন পত্রখানা পেয়েই একবার ভাঁজ খুললেন, ভাঁজ করলেন। তারপর পকেটে রেখে দিলেন। মুখে তৃপ্তির হাসি। পড়ে দেখলেনও না।

ব্যস, এটুকুই পরিচয়, এটুকুই উপকার।

ওই ব্যারাকের মতো বাড়িটাকে ওরা উপেক্ষাই করত। এমনকি ওই বাড়ির মালিক হেমন্তবাবুকেও এড়িয়ে এড়িয়ে চলত, যদিও মানুষটি ছিলেন খুবই সজ্জন, বিনয়ী ভদ্রলোক। ওঁর বিনয় হয়তো বা খানিকটা হতাশা থেকে, দারিদ্র্য থেকে। অথচ সত্যি তো দরিদ্র ছিলেন না। একটা বাড়ির মালিক। দরিদ্র হবেন কেন।

ধ্রুবদের ভাড়া বাড়িটা ছিল রীতিমত ভাল, বলতে গেলে একেবারে ঝকঝকে নতুন। আর হেমন্তবাবুর নিজের বাড়িটা ধসে পড়া পুরনো বলেই মনে হত, একরাশ জঞ্জালের মতো। বোগেনভেলিয়া আর পলাশ গাছ থাকা সত্ত্বেও। সেজন্যেই হেমন্তবাবুদের বোধহয় ওরা উপেক্ষা করত।

একদিন মাঝরাত্তিরে লরির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ধ্রুবর। জিনিসপত্র যেন নামানো বা ওঠানো হচ্ছে। কুলিদের কথাবার্তা।

ধ্রুব বিছানা ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসছিল। এত রাত্রে কিসের শব্দ জানার আগ্রহে। ও ভেবেছিল, রাখালবাবুর ড্রাম এসেছে। না, তা নয়। এসে দেখল, আসবাবপত্র ওঠানো হচ্ছে লরিতে।

ভেবেছিল, সামনের বাড়ির নীচতলার ভাড়াটেরা কেউ উঠে যাচ্ছে। কিন্তু না, নীচতলার ভাড়াটেরাও কেউ জানতে পারেনি। বোধহয় ঘুম ভাঙেনি তাদের। শুধু ধ্রুবরা লক্ষ করল, পরপর কদিনই দোতলার কোনও ঘরেই আলো জ্বলল না। শেষে একদিন জানা গেল হেমন্তবাবু বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন। বাড়ি বিক্রি করার লজ্জায় রাত্রে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চলে গেছেন তিনি।

ধ্রুবর বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মানুষটির জন্যে। বেচারা বোধহয় ভাল দামও পায়নি। গোপনে গোপনে তো বিক্রি করেছেন।

কে যে বাড়িটা কিনল তা ধ্রুবরা জানত না। অনেকদিন পড়ে ছিল, কোনও নতুন মালিক এসে দোতলায় দরজা জানালা খোলেনি।

এখন আর ধ্রুবর স্পষ্ট মনেও পড়ে না, নীচের ভাড়াটে রাখালবাবুরা কবে উঠে গেলেন। অন্য ভাড়াটেরাও।

শুধু মনে আছে, একদিন কয়েকজন লোক এসে কি সব মাপজোক করল, আর পরের দিন থেকে বাড়িটা ভাঙতে শুরু করল।

ওঃ, সে যে কি বিড়ম্বনা। মাসখানেক ধরে চলল বাড়ি ভাঙার কাজ। ধ্রুবদের বাড়ি তখন ধুলোয় ধুলো, যতবার বোয়া মোছা হয়, দেখতে দেখতে ঘরগুলো আবার ধুলোয় ভরে ওঠে। কি বিরক্তিকর দিনই না গেছে।

নতুন বাড়ি উঠতে শুরু হল সেই জমিতে। একটা সাইনবোর্ডও ছিল তখন। শোনা গেল ওই জমিতে চারতলা বাড়ি উঠবে, আটখানা ফ্ল্যাট হবে। ফ্ল্যাট বিক্রি হবে।

প্রীতির তখন থেকেই খুব বাড়ি বাড়ি নেশা। ও বলেছিল, খোঁজখবর নাও না, একটা

ফ্ল্যাট কিনে রাখলে ভাল হত।

ফ্ল্যাট কেনার কথা ধ্রুব তখন কল্পনার মধ্যেই আনতে পারে না। টাকা কোথায়। তাছাড়া নিজেকে ও তখনও সংসার থেকে পৃথক করে ভাবতে শেখেনি।

তাই প্রীতির কাছে শোনা কথাটা গিয়ে বলেছিল বড়বৌদির কাছে। বলেছিল, বাবাকে একবার বলে দেখ।

বড়বৌদিরও বোধহয় কথাটা মনে ধরেছিল। ধ্রুব বড়বৌদিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বাবার কাছে। একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখলে হত। একেবারে পাড়ায়, বাড়ির সামনেই।

ধ্রুবর বাবা হাসলেন।এই বিরাট পরিবার, ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট কিনে কি হবে? তার চেয়ে কোথাও জমিটমি পাওয়া গেল বাড়ি করা যেত।

ব্যাস। ওখানেই সব স্বপ্ন থেমে গিয়েছিল। ওরা তখন সকলেই ব্যস্ত চাকরি নিয়ে। জমিটমি কে খুঁজবে। তাছাড়া বাবার কাছেও তেমন উৎসাহ পায়নি ধ্রুব। ইতিমধ্যে টিপু এসেছে। টিপু বড় হচ্ছে।

টিপু যতই বড় হচ্ছিল, ততই ঘরের অভাব দেখা দিচ্ছিল। ওদিকে একে একে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আসবাব বাড়ছিল ঘরের। পরিবারের লোকজন যতই বাড়ছে, বাড়িটা দিনেদিনে ততই যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দাদার দুদুটি ছেলে। স্কুলে পড়ে। মেজদার একটি মেয়ে, সেও স্কুলে। সবশেষে এই টিপু, এও বড় হবে। বড়বৌদির সবসময়ে অভিযোগ, ছেলেদের পড়ার জায়গা নেই। মেজবৌদির অভিযোগ মেয়ের শোবার জায়গা নেই। এর ওপর সুমিতার আরো নানান বায়না। আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়ারও বিরাম নেই। মেয়ে-জামাইও আসে মাঝে মাঝে।

একটা অশান্তি যেন দানা বাঁধছিল দিনে দিনে। আর চোখের সামনে ফ্ল্যাট বাড়িটা উঠছে। সেই পলাশ গাছটাও নেই, বোগেনভেলিয়াও সারা পাড়াটা এখন আর আলো কয়ে রাখে না। ওদিকে তাকালে মাঝেমাঝে হেমন্তবাবুর কথা মনে পড়ে। পুরনো হতশ্রী বাড়িটাকে শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। পারলেন না। শেষে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পালাতে হল।

সেইজন্যেই হেমন্তবাবুর জন্যে ধ্রুবর দুঃখ হয়। আচ্ছা, উনি কি আবার সেই ধ্রুবদের মতোই ভাড়াটে হয়ে গেলেন! নাকি যা কিছু টাকা পয়সা পেয়েছেন, অনেক দূরে, শহরের বাইরে গিয়ে নতুন একটা বাড়ি করেছেন। কেউ জানে না।

বারান্দা থেকেই প্রীতি একদিন ডাকল, এই শোনো শোনো, দেখে যাও।

ধ্রুব টিপুকে নিয়ে খেলা করছিল। একটা খেলনা মোটরগাড়ি কিনে দিয়েছে টিপুকে। টিপুর আব্দারে সেটায় বারবার চাবি ঘুরিয়ে দম দিতে হচ্ছিল ওকে।

প্রীতি আবার ডাকল, এসো না, দেখে যাও, কি সুন্দর রঙ করছে।

ধ্রুব উঠে গেল। বাড়িটা তখন শেষ হয়ে এসেছে। গিয়ে দেখল, বাইরের দেয়ালে রঙ শুরু হয়েছে।

ধ্রুব দেখে বললে, বাঃ দারুণ লাগছে। খুব সুন্দর রঙ।

প্রীতি বললে, ওই পরের বাড়ির প্রশংসা করেই জীবনটা কেটে যাবে, নিজেদের তত কিছু হবে না।

ধ্রুব দমে গেল। এই একটা কথা শুনলেই ওর নিজেকে বড় অক্ষম লাগে। অসহায় লাগে।

বাবার কাছ থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না। আন্দাজে আন্দাজে যেটুকু বোঝে ধ্রুব, যা আছে বাবার—ওই পেনসান, তাতে তাঁর নিজের জীবনটা কেটে গেলেই যথেষ্ট। এত বড় পরিবারের জন্যে একটা বাড়ি করা সম্ভবও নয়। দাদা মেজদারা প্রায়ই এবাড়ির অসুবিধের কথা বলে। হয়তো কোনওদিন নিজেরাই ফ্ল্যাট কিনবে।

এদিকে বাড়িওয়ালাও প্রায়ই উঠে যাওয়ার কথা বলছে।

প্রীতি একদিন বললে, দেখো ফ্ল্যাট কেনাটেনার কথা ভেবে লাভ নেই, বরং একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে চল।

আসলে ধ্রুব নিজেই তো আর মানিয়ে চলতে পারছিল না। প্রীতি পারবে কি করে।

ও সব সময় একটা হীনম্মন্যতায় ভুগত। এবাড়ির বড়বৌ, মেজবৌ দুজনেই বাপের বাড়ি থেকে যথেষ্ট দানসামগ্রী নিয়ে এসেছে। প্রচুর গয়নাগাঁটি। এ বাজারের দরদামে হিসেব করলে অনেক টাকা। সে তুলনায় প্রীতি প্রায় কিছুই আনেনি। ওর বাবা অবশ্য সাধ্যের তুলনায় যথেষ্ট দিয়েছেন, কিন্তু প্রীতি জানে ওদের তুলনায় তা কিছুই নয়।

ওরা যখন জড়োয়া গয়নায় সেজে বিয়েবাড়িতে যায়, প্রীতি সঙ্গে যেতে চায় না।

সেজন্যে ওর লজ্জা, সেজন্যে ওর রাগ। মনে মনে ভাবে, মেয়েরা কি কোনওদিনই বদলাবে না! আসলে ছেলেরা না বদলালে মেয়েরাই বা বদলাবে কি করে।

কিন্তু এইসব থেকে ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে বারুদ জমছিল। হঠাৎ একদিন বিস্ফোরণ ঘটল।

প্রীতি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে বসল, আমি আর এবাড়িতে এক দণ্ডও থাকব না।

ধ্রুবও তার কথায় সায় দিল।–না, এক দণ্ডও না।

দপদপ করে পা ফেলে গিয়ে দাঁড়াল বাবার কাছে। বাবা সব শুনেছেন। শুনলেও উনি আজকাল চুপচাপ থাকেন। কারও হয়ে কোনও কথা বলেন না। উনি জানেন, এখন আর ওঁর কথার কোনও দাম নেই। ছেলেদের ওপর ওঁর আর কোনও জোর নেই। কারণ ছেলেরা সবাই এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে গেছে বলেই উনি সংসারের কাছে ফালতু মানুষ হয়ে গেছেন।

অথচ এই ছেলেরাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে বলে বুকের ভিতরে একসময়ে কত গর্ব ছিল। গর্ব এখনও।

খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বুঝতে পারলেন ধ্রুব এসেছে; কিছু বলতে চায়। তবু চোখ তুললেন না।

-বাবা!

-বল।

ধ্রুবর গলার স্বরে তখনও ক্রোধ উপছে পড়ছে। বললে, এই অশান্তি নিয়ে এবাড়িতে আর থাকা যায় না।

ধ্রুবর মা বারান্দার এক চিলতে রোদ্দুরে বড়ি শুকোতে দিচ্ছিলেন। ভুরু কুঁচকে একবার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। বেশ রাগত স্বরে বললেন, অশান্তি তো তোরাই করছিস। সংসার তো এখন তোদের, শান্তি থাকলে তোদেরই, অশান্তি করলেও তোরাই।

—আমরা অশান্তি করছি? ধ্রুব আরো রেগে গেল।

মা বললেন, তোরা সবাই। সংসার যখন আমাদের ছিল, তখন তো এ-সব অশান্তি ছিল না।

ধ্রুবর বাবা এতক্ষণে কথা বললেন।—এসবের মধ্যে আমাদের আর টানছিস কেন! আমরা সাতেও নেই পাঁচেও নেই। দুবেলা দুটি খাই, আর কাজ তত নেই, পড়ে পড়ে ঘুমোই। বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা।

বাবার গলার স্বরে, বলার ধরনে, কি যেন ছিল। ধ্রুবর মন নরম হয়ে আসছিল। হয়তো রাগ পড়েও যেত।

তার আগেই প্রীতি এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি বলছেন, এই সব অন্যায় সহ্য করে চলতে হবে!

ধ্রুবর বাবা মুখ না তুলেই বললেন, আমি কিছুই বলছি না। রিটায়ার্ড ম্যান, আমার আর বলার এক্তিয়ার কোথায়?

প্রীতি বলল, বাবা, এভাবে অশান্তি বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। বলে ধ্রুবকে চোখের ইশারা করল। অর্থাৎ যা বলতে এসেছিল বল।

ধ্রুব আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। বললে, আমরা উঠে যাচ্ছি। আমরা উঠে গেলেই তো ওরা শান্তি পাবে।

প্রীতি বললে, হ্যাঁ বাবা, আমরা চলেই যাব।

বাবা চোখ তুলে অবাক হয়ে তাকালেন ছেলের মুখের দিকে।

–চলে যাবি?

মাথা নীচু করলেন। একটু থেমে বললেন, যেতে চাস, যা। কেউ যেতে চাইলে কি আর ধরে রাখা যায়।

হঠাৎ হেসে ফেললেন। হাসিটা কান্নার মতো। বললেন, আমাদেরও তো যাবার সময় হয়ে এল।

ধ্রুব আর প্রীতি চলে এল। বাবার সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না ধ্রুব।

ফিরে আসতেই বড়বৌদি বলে বসল, চলে যাবে সে তো ঠিক করেই রেখেছিলে, অজুহাত দেওয়ার দরকার কি ছিল।

ধ্রুব আরো রেগে গেল সে কথা শুনে। কোনও জবাব দিল না। কিন্তু চলে যাব বললেই তো চলে যাওয়া যায় না। কোথায় যাবে! তার আগে তো একটা ভাড়ার ফ্ল্যাট জোগাড় করতে হবে।

এই বাড়িটা যখন ভাড়া নিয়েছিল, তখন বাড়ির সামনে টু লেট ঝুলত। ভাড়াও কম। ভাড়া বাড়িয়ে বাড়িয়েও এখনও যথেষ্ট কম।

অফিসের বিনোদবাবু শুনে ধ্রুবকে বলেছিলেন, আপনি তো মশাই বিনা ভাড়ায় একটা গোটা বাড়ি নিয়ে আছেন। নতুন ভাড়াটেদের দুঃখ আপনি বুঝবেন না।

সত্যিই বুঝত না ধ্রুব। কোনওদিন তো খোঁজ করতে হয়নি। হয়তো দুচারজনের কাছে শুনেছে, কিন্তু মনে দাগ কাটেনি।

অথচ এখন আর উপায় নেই। বলে ফেলেছে, চলে যাব। আর মা এসে একটুও কান্নাকাটি করেননি। বাবাও বলেছেন, যেতে চাস, যা। এখন আর উপায় নেই। মানমর্যাদার প্রশ্ন।

মেজবৌদি একদিন বললে, চলে যাবার আগে আমাকে অন্তত জানিয়ো ধ্রুবদা, দুম করে চলে যেও না।

অর্থাৎ সকলেই ধরে নিয়েছে ওরা চলে যাবে।

তখন ধ্রুবর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান একটা ভাড়ার ফ্ল্যাট। যার সঙ্গেই দেখা হয়, কথায় কথায় জানিয়ে রাখে। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে চোখ বুলিয়ে যায়। দালাল ধরে।

প্রীতি বলেছিল, তিনখানা ঘর না হলে চলে না। একখানা শশাবার ঘর, একটা বসার : আর টিপু তো বড় হচ্ছে, ওর জন্যে একটা। ও তো বড় হচ্ছে, শশায়ার আর পড়ার জন্যে ওই একটা বাড়তি ঘর দরকার।

প্রীতি ওর দাদাকেও বললে একটু খোঁজ রাখতে।

সে সব শুনে বললে, তিনখানা ঘর? সে তো চার পাঁচশো টাকা ভাড়া হবে। তাছাড়া এদিকে কোথায় আর পাবি। অনেক দূরে যেতে হবে।

প্রীতি বললে, চার পাঁচশোই দেব।

–দিবি? তা হলেখাবি কি? পাঁচশো টাকা যদি ভাড়াতেই চলে যায়!

ধ্রুব সে-কথাও ভেবেছিল। একটু ভয় ভয় করত। যদি চালাতে না পারি!

তখন অবশ্য এমন বাজার ছিল না। আর চার পাঁচশো টাকাতেও ফ্ল্যাট পাওয়া যেত।

কিন্তু হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে ধ্রুব তখন হয়রান হয়ে গেছে। কোথাও আর মনের মতো ফ্ল্যাট মিলছে না। যদি বা পাওয়া যায় তাদের আবার ভাড়াটেকেই পছন্দ হয় না। বিনোদবাবুর কথাগুলো তখনই মনে পড়েছিল। পুরোনো ভাড়াটেদের ওপর কেন তাঁর এত রাগ বুঝতে পেরেছিল।

একদিন বলেছিলেন, আইনটাইন বদলানো উচিত। একশো দেড়শো টাকায় একটা পেল্লায় বাড়ি নিয়ে থাকবে কেন মশাই? আর আমি তো চারশো দিতে চাই, কোথাও পাচ্ছি না।

শুনে বিছুটির জ্বালা ধরত। যেন বিনোদবাবু ওদের হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িটা সম্পর্কেই বলছেন।

ভাড়ার ফ্ল্যাট খুঁজতে খুঁজতে ধ্রুবও তখন বিনোদবাবুর দলে। ক্রমশই যেন হতাশ হয়ে পড়ছিল।

বাড়িতেও তখন সবসময় থমথমে ভাব। কোথাও কোনও হাসিহল্লা নেই, রেডিও চলে, চললেও চাপা গলায়, রেকর্ডে গান শোনা যায় না। যেন বাড়িতে কোনও মুমূর্ষু রোগী আছে।

প্রতি হেসে বলেছিল, এরই নাম কোল্ডওয়ার।

ধ্রুবর তখন একটাই কাজ। সকালে উঠেই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখা। ঠিকানা থাকলে সটান সেখানেই চলে যাওয়া। বেশির ভাগই বক্স নম্বর। অতএব বসে বসে চিঠি লেখো। তারপর ব্রোকারের অফিসে তাগাদা দিতে যায়। রাস্তার মোড়ে কিংবা চায়ের দোকানের সামনে কোথাও কোথাও জনাকয়েক উটকো দালাল জটলা করে। তাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে, কিছু খবর পেলেন? বেশ তোষামোদের গলায় বলতে হয়। যেন তারা ইচ্ছে করলেই একটা ভাল ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিতে পারে। কামধেনুর মতো তারা তিনচারটে দারুণ ভাল ভাল ফ্ল্যাটের খবর বলে। ধ্রুব উৎসাহ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাড়ার অঙ্কটা শুনতে হয়। শুনেই থমকে যেতে হয়। কিংবা অন্য কোনও শর্ত।

কেউ কেউ ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যায়। বাড়িটায় ঢোকার আগেই ফ্ল্যাট অপছন্দ, তবু দালালকে খুশি রাখার জন্যে চারতলায় উঠতে হয়, জানলা দরজা খুলে ঘর দেখতে হয়।

তারপর অন্য কোনও কারণ দেখিয়ে বলতে হয় না এটা চলবে না।

দালাল হাত পাতে, হেসে বলে, ঘোরাঘুরি তো করছি, দেখি…

পাঁচ, দশ, বিশ টাকা দেয় ধ্রুব। জানে, এদের অনেকের এই টাকাটাই রোজগার।

কোথাও পাড়াটা খারাপ, কোথাও বাড়িটা পুরনো, জানালা দরজা ভাঙা। কোথাও বাথরুম কিংবা রান্নাঘরই সমস্যা। অথবা আলোবাতাস নেই।

ধ্রুব বেশ বুঝতে পারে, যে বাড়িটা ছেড়ে আসছে, ও সেই রকম একটা ফ্ল্যাট খুঁজছে। যে পাড়া ছেড়ে আসছে, সেই রকম পাড়া খুঁজছে।

দেখতে দেখতে দুটো মাস পার হয়ে গেল। প্রীতি অনুযোগেব স্বরে বললে, তোমার এখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই সেকথাটা ফ্র্যাঙ্কলি বললেই তো পার।

ধ্রুব অবাক হয়ে তাকাল প্রীতির মুখের দিকে। কোনও কথা বলল না। একটা অক্ষমতা, একটা অসহায়তার মধ্যেই ও তখন নিপীড়িত। প্রীতির কথায় ও লোধহয় রীতিমত ধাক্কা খেল।

বাড়ির পরিবেশও এদিকে অসহ্য হয়ে উঠেছে।

ঠিক সেই সময়েই একটা ঘটনা ঘটে গেল। অভাবিত।

ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার জন্যে প্রায়ই লেট হয়ে যেত অফিসে। কোনও কোনওদিন অবশ্য প্রীতি একাই চলে যেত। টিপুকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর এক সময় বিষণ্ণ মুখ নিয়ে ফিরে আসত।

সেদিনও বিকেলে একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা। টেলিফোনে আফসেই খবর পেল। তাই একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল।

ফিরেই দাদার মেয়ে সিমলির কাছে শুনল, ছোটকাকিমা বেরিয়ে গেছে।

—কোথায় গেছে বলে গেছে?

সিমলি ঠোঁট ওল্টালো।—কি জানি।

এটাই এখন এ বাড়ির রীতি। যেটুকু খবর বলেছে সেটুকুই যেন বাড়তি। বড় অভিমান হয়, বুকে লাগে। বিয়ের আগে দাদা বৌদিরা কত আপন ছিল। এই সিমলিকে ধ্রুব তত কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। অথচ এখন সিমলিও যেন কেমন পর-পর। হয়তো মা বাবার কথা শুনে শুনে দূরে সরে যাচ্ছে।

ঠোঁট উল্টে কি জানি। যেন জানার প্রয়োজনই নেই। দোষ শুধু সিমলির নয়। প্রীতিও ওদের কোনও কথা জানিয়ে যায় না। ধ্রুবকেও তখনই বেরোতে হবে, তা না হলে বাড়িওয়ালা থাকবে না। এদিকে সন্ধেও হয়ে আসছে। ও ভেবেছিল, প্রীতিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ভাবল, একাই চলে যাই।

বেরোতে যাচ্ছে, মেজবৌদি বললে, প্রীতি তো, সেই গুণ্ডামতো দালালটা এসেছিল একদিন, একটা হাত কাটা, তার সঙ্গে কি সব কথা বলছিল, হঠাৎ বেরিয়ে গেল তার সঙ্গে।

গুণ্ডামতো! কথাটা কানে বিস্বাদ লাগল ধ্রুবর। মনে হল যেন ইচ্ছে করেই বললে মেজবৌদি।

কিন্তু লোকটিকে চিনতে পারল। বেঁটেখাটো দারুণ ভাল স্বাস্থ্য লোকটির। কপালে একটা দাগ আছে, বাঁহাতের কনুই থেকে ফুল হাতা শার্টের হাতাটা ঝুলে থাকে। ওটুকুর জন্যেই লোকটিকে নিরাপদ মনে হয়। কিন্তু সব মিলিয়ে তাকে ধ্রুবরও অপছন্দ। কথাবার্তাতেও অশালীন।

ওই লোকটির সঙ্গে প্রীতি একা বেরিয়ে গেল? কোথায় কতদূরে নিয়ে যাবে কে জানে। এত তাড়াহুড়োর কি ছিল। ওকে তো সন্ধের পর কিংবা কাল সকালে আসতে বললেই হত।

বাড়িওয়ালা লোকগুলোকে এই দুমাসে হাড়ে হাড়ে চিনে নিয়েছে ধ্রুব। কথাবার্তার ধরনই অন্যরকম। এই আজ যেখানে যাবার কথা, দালাল ফোন করতেই ও বললে অফিস ছুটির পর যাবে। সে উত্তর দিলে, তা হলে উনি বেরিয়ে যাবেন, বলেছেন সাড়ে ছটার মধ্যে যেতে হবে। যেন ট্রেন ধরার ব্যাপার, ঘড়ি ধরে পৌছতে হবে। অবশ্য বলা যায় না, দালালটির নিজের ব্যগ্রতাও হতে পারে। একটা ফ্ল্যাট জুটিয়ে দিলেই তো একমাসের ভাড়া পাবে।

প্রীতির জন্যে খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়েই বেরিয়ে পড়ল ও।

বাস স্টপে পৌঁছতে দেখতে পেল ট্যাক্সি থেকে নামছে প্রীতি।

ধ্রুব কিছু প্রশ্ন করার আগেই প্রীতি হাসতে হাসতে বলে উঠল, দারুণ সুন্দর ফ্ল্যাট। এইমাত্র দেখে এলাম। কাছেই, বকুলবাগানে।

এমন স্বতঃস্ফূর্ত হাসি প্রীতির মুখে বহুদিন দেখেনি ও।

প্রীতি বললে, আজই, এখনই টাকা নিয়ে চলে যাও। তা না হলে, কাল সকালে একজন আসার কথা।

ধ্রুব বললে, কিন্তু দালাল লোকটা এল না কেন? কোথায় পাব ওকে?

প্রীতি ভুরু কুঁচকে বললে, কি যে বল, ওই গুণ্ডটাইপের লোকটাকে কি আমি ট্যাক্সিতে সঙ্গে নিয়ে আসব।

তারপরই বললে, ওর চেহারাটাই ওই রকম, লোকটা কিন্তু ভীষণ ভাল।

মেজবৌদি বলেছিল, গুণ্ডামত, তখন খুব খারাপ লেগেছিল। এখন প্রীতি বলছে। গুণ্ডাটাইপের। শুনতে অন্য কারণে খারাপ লাগল। একটা ভাল ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে, অন্তত পাওয়ার আশা। ওই লোকটাই জোগাড় করে দিচ্ছে, তাই এখন ওকে গুণ্ডাটাইপ বলতেও খারাপ লাগছে।

ধ্রুব জিগ্যেস করল, কোন তলায়? ভাড়া কত?

প্রীতি বললে, ওকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সিতে আসব না বলেই বুদ্ধি করে বললাম, আধ ঘণ্টা পরে আসতে।

ধ্রুব আগের প্রশ্নগুলো আবার করল।

প্রীতি বললে, দোতলায়, সাড়ে চারশো। শুধু এক মাসের অ্যাডভান্স।

সাড়ে চারশো। প্রীতির দাদার কথাটা মনে পড়ল। বাড়ি ভাড়াতেই অত বেরিয়ে গেলে খাবে কি? কথাটা সেদিন বুকে গিয়ে লেগেছিল, কিন্তু কথাটা তো সত্যি। তা হোক। ধ্রুব ভাবল, যেমন করে হোক চালিয়ে নেব। এই একটা দিক নিয়ে কারও কোনও ভাবনা নেই। না সরকারের, না কোম্পানিগুলোর। মাইনে দিয়েই দায়দায়িত্ব শেষ। তার অর্ধেক যে বাড়িওয়ালার গর্ভে চলে যাবে সে খেয়ালই নেই। অর্থাৎ কলকাতায় থাকার তোমার অধিকারই নেই, আহা, ডেলি প্যাসেঞ্জারি করো। সেখানেও ঘন ঘন ট্রেন লেট, মানে হাজরি-খাতায় লাল দাগ। বড় সাহেব, মেজ সাহেবের লাল চোখ।

ওদের তো কোনও চিন্তা নেই, অফিসের খরচায় ভাল-ভাল ফ্ল্যাট। গাড়ি। ব্যাটাবা পাংচুয়েলিটির বড়াই করে।

ওদের জন্যে কোম্পানিগুলো বেশি বেশি টাকা দিয়ে ভাল ফ্ল্যাটগুলো নিয়ে যাচ্ছে বলেই তো সাধারণ মানুষের এই হাল।

পকেটে টাকাটা নিয়ে ধ্রুব অপেক্ষা করল বাড়িতে ফিরে। দালাল লোকটা কখন আসে। আসবে তো!

—দক্ষিণ খোলা?

প্রীতি অবাক হয়ে তাকাল। বললে, তা তো জানি না। রান্নাঘরটা বেশ বড়। বাথরুম ছিমছাম, পরিষ্কার।

দক্ষিণ খোলা কি না তা দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি ও। তাই স্তোক দেবার মতো করে বললে, দক্ষিণে আর কতটুকু হাওয়া আসে।

–বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হল?

–না। বাড়িতে একটা ইয়া গোঁপওয়ালা দারোয়ান আছে, সেই দেখাল ফ্ল্যাটটা। দালালটা বললে, বাড়িওয়ালার সঙ্গে তোমাকে দেখা করতে হবে। কোন কোম্পানি, কত মাইনে, আরও কি সব জানতে চাইবে। এর আগে একজনকে দেয়নি। একজন মাদ্রাজি আজই দেখে গেছে, কাল আসবে সকালে।

ধ্রুব বললে, তা হলে আর গিয়ে লাভ কি, ইন্টারভিউয়ে ফেল করে যাব। একজন মাদ্রাজি ক্যান্ডিডেট যখন আছে..বাড়িওয়ালারা আজকাল খুব মাদ্রাজি পছন্দ করে।

প্রীতি হেসে বললে, না এখন আর তা নেই; এখন ওরা মাদ্রাজিদেরই বেশি ভয় পায়। বাঙালিকে ফ্রায়িংপ্যান ভাবত, এখন ফায়ার কি বস্তু বুঝতে পারছে। দালালটা অবশ্য সে-রকমই বললে।

দালালটা, দালালটা। ধ্রুবর শুনতে ভাল লাগছিল না। ব্রোকার বললেই তো হয়। কারণ, ওই একজন এতকাল পরে একটু আশার আলো দেখিয়েছে। ও তো হতাশ হয়ে পড়েছিল। হতাশ এবং ক্লান্ত।

লোকটা এল। পকেটে টাকা নিয়ে ধ্রুব বেরিয়ে গেল।

রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে লোকটা কেবলই বলছে, ওই তো আর একটু। বাড়িটা এত চমৎকার, ফাস্টক্লাশ ফ্ল্যাট, বৌদির খুব পছন্দ হয়েছে।

সামনেই একটা ঝকঝকে চমৎকার বাড়ি, দোতলায় ব্যালকনি আছে। একেবারে ছবির মতো সুন্দর। ধ্রুব ভাবলে, ওই বাড়িটাই। বাইরে থেকে দেখে ফ্ল্যাটটা ভারী ভাল লেগে গেল। ধ্রুব ভাবলে ওটাই হবে হয়তো। বেশ খুশি হয়ে উঠল।

কিন্তু না। ওটা নয়। লোকটা ও বাড়ি পার হয়ে এগিয়ে চলেছে। আরেকটা বেশ ভাল বাড়ি। ঝকঝকে নতুন। এটাই হয়তো, ধ্রুব ভাবলে।

না , ওটাও নয়।

শেষে আরেকটা বাঁক নিয়ে সরু গলিটার মধ্যে ঢুকল। গলিটা দেখেই ওর পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়িটা ভাল লেগে গেল। আগে যে দুটো চমৎকার বাড়ি ওর মন কেড়েছিল, সুন্দর লেগেছিল, তেমন ভাল নয় এটা। তবু মনকে বোঝাল, খারাপই বা কি!

বাইরে থেকে দেখল। তারপর বললে, ফ্ল্যাটটা আমি তো দেখিনি, একবার দেখলে হয়

না?

দারোয়ান বললে, চলিয়ে। লেকিন বাত্তি নেই।

সিঁড়িতে আলো ছিল। কিন্তু ফ্ল্যাটের ঘরগুলো একেবারে অন্ধকার। আগের ভাড়াটে ভদ্রলোক তাঁর বালবগুলো খুলে নিয়ে যেতে ভোলেনি।

দেশলাই জ্বেলে জ্বেলে যেটুকু দেখা যায় দেখল ধ্রুব। পছন্দ হল কি হল না নিজেও বুঝতে পারল না।

দালাল লোকটি বললে, বৌদির কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে।

লোকটার মুখে বারবার বৌদি কথাটা ভাল লাগছিল না।

আসলে ধ্রুবর চেয়েও দালালটির ব্যগ্রতা যেন বেশি।

ধ্রুব বললে, ঠিক আছে।

দরজায় তালাচাবি লাগল দারোয়ান।

গোঁপওয়ালা বিহারি দারোয়ানের পিছনে পিছনে ওরা নেমে এল।

দরজার বাইরে এসে দারোয়ান ওদের বললে, ঠহরিয়ে। অর্থাৎ অপেক্ষা করুন।

বলে আবার সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে গেল। যাবার আগে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেল।

লোকটা খুবই সাবধানি। বিশ্বাস করে দরজাটা খুলে রেখেও গেল না। সঙ্গে করে ওপরেও নিয়ে গেল না।

বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এভাবে অপেক্ষা করতে হলে বড় হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়। ধ্রুব সেজন্যে ভিতরে ভিতবে বিরক্তি বোধ করছিল। লেনদেনের ব্যাপার। তুমি ভাড়া দেবে, আমি ভাড়া নেব। দুজনেরই স্বার্থ। তুমি আমার উপকার করার জন্যে ভাড়া দিচ্ছ না। তুমি তিনতলার হাওয়া খেতে চাও, তাই নীচের তলা এবং দোতলা বানাতে হয়েছে। সুতরাং সেগুল খালি ফেলে রাখতে চাও না। হিসেব করে দেখেছ, ফেলে রাখলে লোকসান। তাই ভাড়া দিচ্ছ। দয়া করে নয়। অথচ ভাবটা এমন, যেন উনি জমিদার আর ধ্রুব প্রজা।

এভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে ধ্রুবর খুবই খারাপ লাগছিল। অথচ মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ! ওকে বাড়িওয়ালার পছন্দ হবে কি না, ভাড়া দিতে রাজি হবে কি না।

পছন্দ না হলে হয়তো এক কথায় বলে দেবেন, না মশাই দেব না। কিংবা ভদ্রতা করে বলবেন, আগে এলে না, একজনকে দিয়ে ফেলেছি।

দুমাস ধরে ঘুরে ঘুরে এদের চিনে ফেলেছে ধ্রুব।

কিছুক্ষণ পরেই গোঁপওয়ালা দারোয়ানটা ফিরে এল। বললে, চলিয়ে। ধ্রুব তার পিছনে পিছনে ওপরে উঠে গেল।

একটা দরজা দেখিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকতে বলল দারোয়ান।

ধ্রুব পা বাড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক গলায় বললে, আপনি!

ভদ্রলোকও চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। মুখে হাসি। বললেন, বসো, বসো।

ধ্রুব বসল। তাকিয়ে তাকিয়ে চারপাশ দেখে নিল। বেশ গোছানো বসার ঘর। দামি সোফা কৌচ, রবারের গদি। নীচে কার্পেট।

এ-সবে যত না অবাক তার চেয়ে বেশি ভদ্রলোকের পোশাক-আশাক দেখে।

সেই রাখালবাবু। ওদের বাড়ির সামনে হেমন্তবাবুর ধসে পড়া জরাজীর্ণ বাড়ির একতলার দেড়খানা ঘরে যিনি থাকতেন। তাঁকে তো লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বাজারে যেতে দেখে এসেছে, ধুতি পাঞ্জাবি পরে যখন কাজে বেরোতেন, কি কাজ কে জানে, ধুতিটা হাঁটু অবধি উঠে থাকত।

সেই রাখালবাবুর পরিধানে এখন ট্রাউজার্সের শোভা। অনভ্যস্ত বলে কেমন ঢিলেঢালা। গায়ে চকরবকর বুশশার্ট।

ধ্রুব হাসতে হাসতে বললে, আপনার বাড়ি! আমি ভাবতেই পারিনি।

রাখালবাবুও হাসলেন।–সবই লক্ষ্মীর কৃপা।

তারপর বললেন, তোমরা তাহলে এখনও ভাড়াবাড়ি খুঁজছ? কিছু একটা করলে না?

অর্থাৎ বাড়ি।

ধ্রুব বললে, কই আর হল। তবে ওঁদের জন্যে নয়, আমি খুঁজছি আমার নিজের জন্যে।

রাখালবাবু বললেন, সেই ভাল, ওই জয়েন্ট ফ্যামিলি শুধু শুনতেই ভাল, যত দূরে থাকবে তত শন্তি।

ধ্রুব শুধু হাসল। ভদ্রলোক তা হলে সবই বুঝে ফেলেছেন।

ও পকেট থেকে টাকাটা বের করলে। বললে, এই নিন সাড়ে চারশো।

রাখালবাবু যাতে দোমনা হবার সুযোগ না পান সেজন্যেই, নাকি তাঁর গলার স্বরেই বুঝে নিয়েছে ফ্ল্যাট ও পেয়ে গেছে, তাই বৃথা বাক্যব্যয় না করে ধ্রুব টাকাটা এগিয়ে দিল।

রাখালবাবু হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলেন। ধীরে সুস্থে বুকপকেটে রাখলেন, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মিল হয় না, বুঝলে কি না। তোমরা এখনও সেই ভাড়াটে।

বলে উঠে গিয়ে রসিদ বইটা নিয়ে এলেন। বললেন, তুমি আমার একটা উপকার করেছিলে একবার, আমি ভুলিনি।

রসিদটা লিখতে গিয়ে পকেট থেকে টাকাটা বের করলেন। গুনেগুনে পাঁচটা দশ টাকার নোট ফেরত দিয়ে বললেন, তুমি চারশোই দিয়ো, পাশের ফ্ল্যাটও তাই দেয়।

একমুখ হেসে ধ্রুবর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেবেছিলাম ভাড়া বাড়াব, পঞ্চাশ টাকা বেশি নেব। থাক, ওই চারশোই দিয়ে।

কড়কড়ে পাঁচখানা দশটাকার নোেট ফেরত পেয়ে খুব তখন খুশিতে ডগমগ। বারবার খোঁচা দিয়ে ভাড়াটে ভাড়াটে বলছিলেন বলে যেটুকু তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল মনের মধ্যে নিমেষে তা মিলিয়ে গেল। না, ইচ্ছে করে বলেননি। তা হলে কি উপকারের কথা তুলতেন।

ফেরার পথে ও যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলেছে।

আর তখনই মনে হয়েছে, মানুষের উপকার করলে কখনো-সখনো বড় কাজে লেগে যায়।

অথচ ও তো উপকার করতে চায়নি। বরং বিরক্ত হয়েছিল। নিতান্তই বাধ্য হয়ে, ভদ্রতার খাতিরে অভিনন্দনপত্র লিখে দিয়েছিল।

আশ্চর্য, রাখালবাবু কিন্তু সেকথা মনে রেখেছেন। মনে করে রেখেছেন বলেই বোধহয় পঞ্চাশ টাকা ভাড়া কমিয়ে দিলেন। ইচ্ছে করলেই তো নিতে পারতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *