॥ ২ ॥
মহীতোষবাবু যে এত ফরসা সেটা ছবি দেখে বোঝা যায়নি। লম্বায় ফেলুদার কাছাকাছি, যতটা রোগা ভেবেছিলাম ততটা না, মাথার চুল ছবির চেয়ে অনেক বেশি পাকা, আর বয়সের তুলনায় বেশ ঘন। শিকারিরা জঙ্গলে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকে বলে শুনেছি। ইনিও হয়তো তাই করেন, কিন্তু বাড়িতে কথা বলার সময় গলা থেকে যে গুরুগম্ভীর তেজীয়ান আওয়াজ বেরোয়, সেটা শুনলে হয়তো বাঘেরও চিন্তা হবে।
ভদ্রলোক আমাদের খাতির-টাতির করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা প্রকাণ্ড বৈঠকখানায় বসানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা ওঁর লেখার প্রশংসা করে বলল, ‘আমি শুধু ঘটনার কথা বলছি না— সেগুলো তো খুবই অদ্ভুত— আমার মনে হয় সাহিত্যের দিক দিয়েও আপনার লেখার আশ্চর্য মূল্য আছে।’
বেয়ারা আমের শরবত এনে আমাদের সামনে শ্বেতপাথরের নিচু টেবিলের উপর রেখেছিল, মহীতোষবাবু ‘আসুন’ বলে সেগুলোর দিকে দেখিয়ে দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বললেন, ‘অথচ জানেন, আমি সবে এই বছর চারেক হল কলম ধরেছি। আসলে লেখাটা বোধহয় রক্তে ছিল। আমার বাপ-ঠাকুরদা দুজনেই সাহিত্যচর্চা করেছেন। অবিশ্যি তার আগে বিশেষ কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। আমরা রাজপুতানার লোক, জানেন তো? ক্ষত্রিয়। এক কালে মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। পরে মানুষ ছেড়ে জানোয়ার ধরেছি। এখন অবিশ্যি বন্দুক ছেড়ে একরকম বাধ্য হয়েই কলম ধরেছি।’
‘উনি কি আপনার ঠাকুরদা?’
আমাদের বাঁদিকের দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিং-এর দিকে দেখিয়ে ফেলুদা প্রশ্নটা করল।
‘হ্যাঁ, উনিই আদিত্যনারায়ণ সিংহরায়।’
একখানা চেহারা বটে। জ্বলজ্বলে চোখ, পঞ্চম জর্জের মতো দাড়ি আর গোঁফ, বাঁ হাতে বন্দুক ধরে ডান হাতটা আলতো করে একটা টেবিলের উপর রেখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে সোজা চেয়ে আছেন আমাদের দিকে।
‘ঠাকুরদার সঙ্গে বঙ্কিমের চিঠি লেখালেখি ছিল, জানেন? ঠাকুরদা তখন কলেজে পড়েন। ‘বঙ্গদর্শন’ বেরোচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন ‘দেবী চৌধুরানী’। আর সেই সূত্রেই ঠাকুরদা চিঠি দিলেন বঙ্কিমকে।’
‘দেবী চৌধুরানী তো এই অঞ্চলেরই গল্প— তাই না?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘তা তো বটেই’, মহীতোষবাবু বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘এই যে তিস্তা নদী পেরিয়ে এলেন, এই তিস্তাই হল গল্পের ত্রিস্রোতা নদী— যাতে দেবীর বজরা ঘোরাফেরা করত। অবিশ্যি বৈকুণ্ঠপুরের সে জঙ্গল আর নেই; সব চা-বাগান হয়ে গেছে। গল্পে যে রংপুর জেলার কথা বলা হয়েছে, একশো বছর আগে আমাদের এই জলপাইগুড়ি সেই রংপুরের ভেতরেই পড়ত। পরে যখন পশ্চিম ডুয়ার্স বলে নতুন জেলা তৈরি হল, তখন জলপাইগুড়ি পড়ল তার মধ্যে, আর রংপুর হয়ে গেল আলাদা।’
‘আপনারা শিকার আরম্ভ করলেন কবে?’
প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু। মহীতোষবাবু হেসে বললেন, ‘সে এক গল্প। আমার ঠাকুরদার খুব কুকুরের শখ ছিল, জানেন। ভাল কুকুরের খবর পেলেই গিয়ে কিনে আনতেন। এইভাবে জমতে জমতে পঞ্চাশটার উপর কুকুর হয়ে গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে। দিশি বিলিতি ছোট বড় মাঝারি হিংস্র নিরীহ কোনওরকম কুকুর বাদ ছিল না। তার মধ্যে ঠাকুরদার যেটি সবচেয়ে প্রিয় ছিল সেটি একটি ভুটিয়া কুকুর। আমাদের এদিকে জল্পেশ্বরের শিবমন্দির আছে জানেন তো? এককালে সেই মন্দিরকে ঘিরে শিবরাত্রির খুব বড় মেলা বসত। সেই মেলায় বিক্রির জন্য ভুটিয়ারা তাদের দেশ থেকে কুকুর আনত। ইয়া গাব্দা গাব্দা লোমশ কুকুর। ঠাকুরদা সেই কুকুর একটা কিনে পোষেন। সাড়ে তিন বছর বয়সে সেই কুকুর চিতাবাঘের কবলে পড়ে প্রাণ হারায়। ঠাকুরদার তখন জোয়ান বয়স। রোখ চাপল বাঘের বংশ ধ্বংস করে শোধ তুলবেন। বন্দুক এল। বন্দুক ছোঁড়া শেখা হল। ব্যস…দেড়শোর উপর শুধু বড় বাঘই মেরেছেন ঠাকুরদা তাঁর বাইশ বছরের শিকারি জীবনে। তা ছাড়া আরও অন্য কত কী যে মেরেছেন তার হিসেব নেই।’
‘আর আপনি?’
এ প্রশ্নটাও করলেন লালমোহনবাবু।
‘আমি?’ মহীতোষবাবু হেসে ঘাড় কাত করে ডানদিকে চেয়ে বললেন, ‘বলো না হে শশাঙ্ক।’
একটি ভদ্রলোক কখন যে ঘরে ঢুকে এক পাশে চেয়ারে এসে বসেছেন। তা টেরই পাইনি।
‘টাইগার?’ মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন নতুন ভদ্রলকটি, ‘তুমি লিখছ তোমার শিকার কাহিনী, তুমিই বলো না!’
মহীতোষবাবু এবার আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘থ্রি ফিগারসে পৌঁছতে পারিনি সেটা ঠিকই, তবে তার খুব কমও নয়। বাঘ মেরেছি একাত্তরটা, আর লেপার্ড পঞ্চাশের উপর।’
মহীতোষবাবু নতুন ভদ্রলোকটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।
‘ইনি হচ্ছেন শশাঙ্ক সান্যাল। আমার বাল্যবন্ধু। আমার কাঠের কারবারটা ইনিই দেখাশোনা করেন।’
বন্ধু হলে কী হবে, চেহারায় আর হাবভাবে আশ্চর্য বেমিল। শশাঙ্কবাবু লালমোহনবাবুর মতো বেঁটে না হলেও, পাঁচ ফুট সাত-আট ইঞ্চির বেশি নন, গায়ের রং মাঝারি, কথাবার্তা বলেন নিচু গলায়, দেখলেই মনে হয় চুপচাপ শান্ত স্বভাবের মানুষ। কোথাও নিশ্চয়ই দুজনের মধ্যে মিল আছে, যেটা এখনও টের পাওয়া যাচ্ছে না। নইলে বন্ধুত্ব হবে কী করে?
‘তড়িৎবাবুর কাছে একটা ম্যান-ইটারের কথা শুনছিলাম, সেটার আর কোনও খবর আছে কি?’ জিজ্ঞেস করলে ফেলুদা।
মহীতোষবাবু একটু নড়চড়ে বসলেন।
‘ম্যান-ইটার বললেই তো আর ম্যান-ইটার হয় না। আমি থাকলে দেখে ঠিক বুঝতে পারতাম। তবে যে জানোয়ারেই খেয়ে থাক, সে আর দ্বিতীয়বার নরমাংসের প্রতি লোভ প্রকাশ করেনি।’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘যদি সত্যিই ম্যান-ইটার বেরোত, তা হলে আপনি অন্তত সাময়িকভাবে নিশ্চয়ই কলম ছেড়ে বন্দুক ধরতেন।’
‘তা ধরতাম বৈকি। আমারই এলাকায় যদি নরখাদক বাঘ উৎপাত আরম্ভ করে তবে তাকে শায়েস্তা করাটা তো আমার ডিউটি!’
আমাদের শরবত খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মহীতোষবাবু বললেন, ‘আপনারা ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিচ্ছে, আপনারা স্নান খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে নিন। বিকেলের দিকে আমার জিপে করে আপনাদের একটু ঘুরিয়ে আনবে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা আছে, হরিণ-টরিণ চোখে পড়তে পারে, এমনকী হাতিও! তড়িৎ, যাও তো, এঁদের ট্রোফি রুমটা একবার দেখিয়ে সোজা নিয়ে যাও এঁদের ঘরে।’
ট্রোফি রুম মানে বাঘ ভাল্লুক বাইসন হরিণ কুমীরের চামড়া আর মাথায় ভরা একটা বিশাল ঘর। ঘরের মেঝে আর দেওয়ালে তিল ধরার জায়গা নেই। এতগুলো জানোয়ারের জোড়া জোড়া পাথরের চোখ চারিদিক থেকে আমাদের দিকে চেয়ে আছে দেখলেই গা-টা ছমছম করে। শুধু জানোয়ার নয়; যেসব অস্ত্র দিয়ে এই জানোয়ার মারা হয়েছে সেগুলোও ঘরের এক পাশে একটা খাঁজকাটা র্যাকের উপর রাখা রয়েছে। দোনলা একনলা পাখি-মারা বাঘ-মারা হাতি-মারা কতরকম যে বন্দুক তার ঠিক নেই।
এই সব দেখতে দেখতে ফেলুদা তড়িৎবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনিও শিকার করেছেন নাকি?’
তড়িৎবাবু একটু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, ‘একেবারেই না। আপনি গোয়েন্দা, আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারছেন না?’
ফেলুদা বলল, ‘শিকারি হলেই যে ষণ্ডা লোক হতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই। আসলে তা নার্ভের ব্যাপার। আপনাকে দেখে ও জিনিসটার অভাব আছে বলে মনে করার তো কোনও কারণ দেখছি না।’
‘তা হয়তো নেই, তবে শিকারে প্রবৃত্তি নেই। আমি কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। শিকার-টিকারের কথা কোনওদিন ভাবতেই পারিনি।’
ট্রোফি রুম থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দা দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে ফেলুদা বলল, ‘শহরের ছেলে জঙ্গলের দেশে এলেন যে বড়?’
তড়িৎবাবু বললেন, ‘পেটের দায়ে। বি এ পাস করে বসেছিলাম। কাগজে সেক্রেটারির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন মহীতোষবাবু। অ্যাপ্লাই করি, ইন্টারভিউয়ে ডাক পড়ে, আসি, চাকরিটা হয়ে যায়।’
‘কদ্দিন আছেন?’
‘পাঁচ বছর।’
‘শিকার না করলেও জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেন বোধহয়?’
‘মানে?’ তড়িৎবাবু একটু অবাক হয়েই ফেলুদার দিকে চাইলেন।
‘আপনার ডান হাতে তিনটে আঁচড়ের দাগ দেখছি। মনে হল কাঁটাগাছ থেকে হতে পারে।’
তড়িৎবাবুর গম্ভীর মুখে হাসি দেখা দিল। বললেন, ‘আপনার দৃষ্টিশক্তির পরিচয় পাওয়া গেল। কালই লেগেছে আঁচড়। জঙ্গলে ঘোরা একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘হাতিয়ার ছাড়াই?’ অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফেলুদা প্রশ্ন করল।
তড়িৎবাবু শান্তভাবে জবাব দিলেন, ‘ভয়ের তো কিছু নেই। এক সাপ আর পাগলা হাতির জন্য দৃষ্টিটা একটু সজাগ রেখে চললে জঙ্গলে কোনও ভয় নেই।’
‘কিন্তু ম্যান-ইটার?’ চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
‘সেটার অস্তিত্ব প্রমাণ হলে জঙ্গলে যাওয়া ছাড়তে হবে বৈকি।’
সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে একটা দরজা পেরোতেই একটা প্রকাণ্ড লম্বা বারান্দায় এসে পড়লাম। বাঁদিকে রেলিং, ডানদিকে সারি সারি ঘর। প্রথম ঘরটাই নাকি মহীতোষবাবুর কাজের ঘর, তড়িৎবাবুকেও দিনের বেলা এখানেই বসতে হয়। কিছু দূর গিয়ে বারান্দাটা বাঁদিকে ঘুরে গেছে। এটা হল পশ্চিমদিক। এটারও ডানদিকে ঘরের সারি, আর তারই মধ্যে একটা ঘর হল আমাদের ঘর। ফেলুদা বলল, ‘এত ঘরে কারা থাকে মশাই?’
তড়িৎবাবু বললেন, ‘বেশির ভাগই ব্যবহার হয় না, বন্ধ থাকে। পুবের বারান্দায় একটা ঘরে মহীতোষবাবু থাকেন, আর একটায় ওঁর দাদা দেবতোষবাবু। শশাঙ্কবাবুর ঘর দক্ষিণে। আমারও তাই। আরও দুটো ঘর মহীতোষবাবুর দুই ছেলের জন্য রয়েছে। দুজনেই কলকাতায় চাকরি করে, মাঝে-মধ্যে আসে।’
এবার চোখে পড়ল আমাদের উল্টোদিকে পুবের বারান্দায় বেগুনি ড্রেসিং গাউন পরা একজন লোক রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে আমাদের দিকে দেখছে। ফেলুদা বলল, ‘উনিই কি মহীতোষবাবুর দাদা?’
তড়িৎবাবু কিছু বলার আগেই গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন শোনা গেল— ‘তোমরা রাজুকে দেখেছ, রাজু?’
দেবতোষবাবু আমাদেরই উদ্দেশে প্রশ্নটা করেছেন। ভদ্রলোক এর মধ্যেই পুব থেকে উত্তরের বারান্দায় চলে এসেছেন, তাঁর লক্ষ্য আমাদেরই দিকে। এখন বুঝতে পারছি ভদ্রলোকের চেহারায় মহীতোষবাবুর সঙ্গে বেশ মিল আছে, বিশেষ করে চোয়ালের কাছটায়। তড়িৎবাবু আমাদের হয়ে জবাব দিয়ে দিলেন, ‘না, এঁরা দেখেননি।’
‘দেখেনি? আর হোসেন? হোসেনকে দেখেছে?’
ভদ্রলোক ক্রমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। এবার বুঝতে পারছি। ওঁর চোখ দুটো কেমন যেন ঘোলাটে। মাথার সব চুল পাকা, আর মহীতোষবাবুর মতো ঘন নয়। লম্বায় হয়তো ভাইয়ের কাছাকাছি, কিন্তু কুঁজো হয়ে পড়াতে অতটা মনে হয় না।
তড়িৎবাবু, ‘না, হোসেনকেও দেখেননি বলে আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে ইশারা করলেন।
‘দেখেনি?’ দেবতোষবাবুর গলায় যেন একটা হতাশার সুর।
‘না’, তড়িৎবাবু বললেন, ‘এঁরা নতুন এসেছেন, কিছু জানেন না।’
‘রাজু আর হোসেন কারা মশাই?’ ঘরে ঢুকে ফেলুদা প্রশ্ন করল।
তড়িৎবাবু হেসে বললেন, ‘রাজু হল কালাপাহাড়ের আরেক নাম। আর হোসেন হল হোসেন খাঁ। গৌড়ের সুলতান ছিল। দুজনেই বাংলাদেশের অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছে। জল্পেশ্বরের মন্দিরের মাথা হোসেন খাঁ-ই ভাঙে।’
‘আপনি কি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘না। সাহিত্য। মহীতোষবাবু জলপাইগুড়ির ইতিহাস লিখছেন, তাই সেক্রেটারি হিসেবে আমাকেও কিছুটা জেনে ফেলতে হচ্ছে।’
তড়িৎবাবু চলে যাবার পর আমরা তিনজন প্রথম হাঁপ ছাড়ার সুযোগ পেলাম। ঘরটি দিব্যি ভাল। এ ঘরেও দুটো দরজার উপর দুটো হরিণের মাথা রয়েছে। অন্য ঘরে জায়গা হয়নি বলেই বোধহয় মেঝেতেও একটা মাথা সমেত চিতাবাঘের ছাল দুটো খাটের মাঝখানে হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দুটো খাট আর একটা খাটিয়া গোছের জিনিস, সেটা বোধহয় আগে ছিল না, আমরা তিনজন লোক বলে এনে রাখা হয়েছে। ফেলুদা খাটিয়াটা দেখে বলল, ‘দেখে মনে হয় এটাকে শিকারের মাচা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, দড়ি বাঁধার দাগ রয়েছে এখনও। তোপসে, তুই ওটাতে শুবি।’
তিনটে খাটের উপরে মশারি খাটানো রয়েছে, আর রয়েছে প্রায় আট ইঞ্চি পুরু গদি, দুটো করে নকশা করা ওয়াড় লাগানো বালিশ, আর একটা করে পাশ বালিশ। লালমোহনবাবু সব দেখেটেখে বললেন, ‘তিনটে দিন দিব্যি আরামে কাটবে বলে মনে হচ্ছে মশাই। তবে আশা করি, দাদাটি আর রাজু-টাজুর খবর নিতে বেশি আসবেন না এদিকটায়। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, পাগলের সান্নিধ্যটা আমার কাছে রীতিমতো অস্বস্তিকর।’
এ কথাটা আমারও যে মনে হয়নি তা নয়। তবে ফেলুদা ও নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত বলে মনে হল না। বাক্স খুলে জিনিস বার করতে করতে একবার খালি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘মহীতোষবাবু আমার কাছে কী ধরনের উপকার আশা করছেন সেটা এখনও বোঝা গেল না।’