০২. মহিম শিল্পী

মহিম শিল্পী।

মহিমের বাবা দশরথের অবস্থা ভালই ছিল। যৌবনে অমানুষিক পরিশ্রম করে সে তার অবস্থাকে দাঁড় করিয়েছিল স্বচ্ছল। কারণ ছিল অবশ্য এর পিছনে।

যে সামাজিক আবহাওয়ার মধ্যে দশরথ মানুষ হয়েছে, সেখানকার দীনতা-নীচতা কাটিয়ে মাঠের মানুষ দশরথের মনে একদিন যে আলোড়ন উঠেছিল—সেই আলোড়নেরই সাক্ষী তার অতীতকৃত বর্তমানের স্মৃতিগুলোতে। তার ভিটাতে সেই চিহ্নই বর্তমান।

স্বার্থপর ছিল দশরথ নিঃসন্দেহেই। তা নইলে অর্থকে পরমার্থ বলে চিনেছিল কী করে। কিন্তু স্বার্থপর হলেও চাষী—আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল তার প্রবল। সকলেরই সেই আত্মসম্মান জ্ঞান আছে—ছিল সব চাষীরই। কেউ-ই তার নিজের অবস্থাতে সুখী নয়। কিন্তু দশরথের মনে তা যেন ভিন্ন ভাবে দেখা দিয়েছিল।

ক্ষুব্ধ দশরথ দেখেছিল কী প্রচণ্ড ঘৃণায়-দীনতায়-হীনতায় মিশে তাদের জীবন। জাতি হিসাবে বর্ণহিন্দুদের প্রবল প্রতাপ, ছোট জাতকে অপমান করবার মহান অধিকার নিয়েই জন্মেছে যেন এই বর্ণহিন্দুরা। প্রতিটি সামান্য কারণে তাই দশরথ চিরকাল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এই সমাজের বিরুদ্ধে, প্রতিটি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য—তাদের প্রতি বর্ণহিন্দুদের ফিরিয়ে দিয়েছে সে অত্যন্ত রূঢ় প্রতিবাদ করে, যে জন্য তার জাতি-ভায়েরা পর্যন্ত সংকোচ আর ভয়ের সঙ্গে প্রায় ত্যাগ করতে বসেছিল তাকে।

কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঘৃণায় সেদিন দশরথেরও গা-টা ঘুলিয়ে উঠেছিল। চরম দারিদ্র্যই যে এর কারণ এ কথা জানতে পেরে। সেই থেকে তার মনে কী বদ্ধমূল আশা জুড়ে বসলবর্ণহিন্দু না হোক, ভদ্দরলোক হতে তার আপত্তি কোথায়?

পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে লাভ নেই। তবে এই পর্যন্ত, দশরথ লড়েছিল দারিদ্রের বিরুদ্ধে। তার সেই একক প্রচেষ্টা কার্যকরীও হয়েছিল। একজন কেউকেটা গোছেরই হয়েছিল সে, অবিকল ভদ্রলোকদেরই মতো অমায়িক মিষ্টি ব্যবহার। বর্ণহিন্দুদের অনুকরণে গড়ে তুলেছিল সে নিজের পারিবারিক জীবন। মূল্যও পেয়েছিল বই কী! বর্ণহিন্দুরা খাতির করেছে তাকে, দেখেছে সমান নজরে। আপনি আজ্ঞে না করলেও তার অন্যান্য জ্ঞাতি-গোষ্ঠির মতো তুই-তোকারিও করেনি।

ফলে যে দশরথ চাষী মাঠে লাঙল বয়েছিল এককালে, তার ছেলেদের সে কোনওকালের তরে পাঠায়নি মাঠে। খুব বড় আশা ছিল তার লেখাপড়া শিখবে তার ছেলেরা।

কিন্তু ভরত সেদিক থেকে তাকে প্রচণ্ড ভাবেই নিরাশ করেছিল সে জীবিত থাকতেই। মহিমের শিক্ষার অঙ্কুরোগম দেখে গেছে সে। মৃত্যু সময় শিশু-মহিম তাকে কোনও আশাই দিতে পারেনি তখন।

যদি বেঁচে থাকত তা হলে দেখে যেতে পারত, তার এই ছেলেটি শুধু পড়াশুনোর ব্যাপারে নয়, অনেক খেয়ালে, বিচিত্র মানসিকতার গুণে কী অপূর্ব। আর দেখে যেতে পারত, তার এই ছেলেটি সেই ছোটকালটি থেকে—কেমন করে মনের রূপকে মাটিতে রূপ দেয়।

তখন মহিম শিশু। দুগা পুজা এগিয়ে আসছে। কুমোরেরা মূর্তি গড়ছে মাটির, সমস্ত দেবদেবীদের। স্কুল পালিয়ে মহিম তখন শুধু কুমোরবাড়ির আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করেছে। শিশুর সেই বিস্ময়ান্বিত চোখের সেদিন পলক পড়তে চাইছিল না মাটির পুতুলগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, নেই লেখাপড়া, একমাত্র কাজ মাটির পুতুল বানাবার কারিগরি দেখা। প্রয়োজন মতো ব্যস্ত কারিগরদের ফাইফরমাস খাটা থেকে শুরু করে ইস্তক তামাক ভরে দেওয়া পর্যন্ত। কিছুই বাদ যায়নি। প্রতিদানে শুধু তাকে ভাগিয়ে না দিয়ে চুপচাপ করে বসে সেই মূর্তি গড়া দেখতে দেওয়া। কুমোর তুলি টেনেছে, মহিম অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত চিত্তে তাকিয়ে থেকেছে তুলির ডগাটিতে। এই বুঝি সরস্বতী মায়ের চোখের একটা মণি একটু বড় হয়ে গেল। গেছেও এমন কত সময়। অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠেছে মহিম। এ কী করলে? হা, বিরক্ত হয়েছে অনেক সময় কুমোরকারিগরের দল। ছোঁড়াটার অনেক কথাই তাদের অতি ক্লান্ত মেজাজে এনে দিয়েছে রাগ, রুক্ষতা, রূঢ়তা। তার পরম গুরু অর্জুন পালও এক এক সময় বিরক্ত হয়ে দিয়েছে লাগিয়ে থাই থাপড়, দিয়েছে হটিয়ে সেখান থেকে। তবে হ্যাঁ, অর্জুন পাল ভালবেসেছিল মহিমকে। বুঝেছিল, ছেলেটার চোখে যেন থেকে থেকে স্বয়ং বিশ্বকর্মা ভর করে।

মহিম ফিরে এসেছে ঘরে। তারপর বয়ে বয়ে এনেছে তাল তাল মাটি। মূর্তি গড়েছে ভেঙেছে, কেঁদেছে, রেগেছে, থেকেছে উপোস। মার খেয়েছে ভরতের, ধমকানি খেয়েছে অহল্যার, কিন্তু শিশুর বুকে দমভারী এক রুদ্ধ বেদনায় মূক করে দিয়েছে তাকে। মনের চেহারা, হাতের মাটিতে দেয় না ধরা। আ! সে কী অসহ্য কষ্ট আর অশান্তি। যা চাই, তা কেন পাই না? আবার গেছে ছুটে ছুটে, দেখেছে কারিগরদের কাজ। আবার তৈরি করেছে মূর্তি।

পেয়েছে, অনেক কষ্টে তারপর পেয়েছে। আর কিছু নয়, হাতখানেক লম্বা দশভূজার মূর্তি একখানি। পাগল, ছেলেমানুষ। চাষা দশরথের ছেলে আবার সেই মূর্তির পূজোও করেছে। গাদা ছেলেমেয়ের দল এসেছে আবার সেই ঠাকুর দেখতে। মহিমের হাতে গড়া ঠাকুর। ওমা! এ যে সত্যি সত্যি দুগগা পিতিমের মতোই হয়েছে গো। শুধু মহিমের সঙ্গী সাথীরা নয়, ওই ভরত অহল্যার মতো অনেক ভারী বয়সের মেয়ে পুরুষের মুখ থেকেই সেদিন ওই কথাগুলো ঘন ঘন বেরিয়ে গৌরবান্বিত করেছে শিশুশিল্পীকে।

সেই আরম্ভ হল। কয়েক বছর কাটল—শুধু ঠাকুরের মূর্তি গড়ে। এদিকে লেখাপড়া যদিও চলল, কিন্তু তার দৌড়টা এল ঝিমিয়ে। ছেলে মূর্তি গড়তে লাগল। তার প্রতিভাকে অভিনন্দন জানাল সবাই। তাই তাকে আরও পাগল করে তুলল। বহু কাগজের বহু ছবি ঘেটে দেখল ভাস্কর্যের নতুন পুরনো মহিমময় কীর্তিগুলো। এত মহান, এত বিরাট, এত সুন্দর এই কাজ!

এক বিচিত্র স্বপ্ন বাসা বাঁধল কিশোরের বুকে। শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন।

ঠিক সময়ে এসে জুটল বামুনপাড়ার লেখাপড়া জানা পাগলটা—গৌরাঙ্গসুন্দর। মহিমের চেয়ে সে বড়, কিন্তু বন্ধুত্বে আটকাল না একটুও। সে তার স্বপ্নকে দৃঢ় করল, শোনল দেশি-বিদেশি শিল্পীদের বিচিত্র সব জীবনের কাহিনী।

শুনতে শুনতে স্বপ্ন ছেয়ে আসত মহিমের চোখে।

আর সেই এক মাথা চুল, স্বপ্নালু চোখ দুটের দিকে তাকিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলা গৌরাঙ্গ বলত—হবে, তোমার দ্বারা হবে।

তারপর পাগলা গৌরাঙ্গ মহিমকে নিয়ে একদিন পাড়ি জমাল কলকাতার দিকে, তার চোখের সামনে খুলে দিতে একটা জগৎকে।

সে কী অসহ্য উত্তেজনা মহিমের। রাজধানীর মিউজিয়ম চিত্রশালা, আর্টস্কুল, কিছু বাদ পড়ল না অজস্র কৌতূহল আর বিস্ময়ে ভরা চোখ দুটোতে। উঃ, কী বিরাট আর কী বিচিত্র। কৃষ্ণনগর ঘুরে প্রেরণা পেল মহিম আরও বেশি। দেশি কারিগরির সেটা যেন সোনার খনি। বাবার থানের মতো লুকিয়ে সে প্রণাম করেছে কৃষ্ণনগরের মাটিকে।

পাগলা গৌরাঙ্গ বলল, থেকে যাও কলকাতায় আমার সঙ্গে। পৃথিবীর সেরা শিল্পী করে ছেড়ে দেব তোমাকে।

কিন্তু এত বিস্ময়, এত কৌতূহল, এত আগ্রহ, তবু প্রাণ যে হাঁফিয়ে উঠেছে মহিমের। কলকাতার কথা কত শুনেছে, কিন্তু এ তো তার সেই মনে গড়া কলকাতা নয়! এ যে অপরিচিত দেশ, অপরিচিত পরিবেশ, অচেনা সব লোক। প্রাণ যে কাঁদছে সেই নির্জন খালপাড় গ্রামটির জন্য, সেই গ্রামের মানুষগুলোর জন্য। প্রাণ যে উড়ছে সেই উড়ো অস্থায়ী মেঘে ঢাকা অসীম আকাশের বুকে, পড়ে আছে দিগন্তবিসারী মাঠের মাঝে!

সমস্ত শিল্পের খনি একলকাতা। কিন্তু এখনির গর্ভে থাকতে গিয়ে নিশ্বাস আটকে আসবে মহিমের। এখানে সে পারবে না থাকতে।

পাগলা গৌরাঙ্গ তো—পাগলাই। সে মহিমকে যেতে দিল না। ফিরে গেল এককালে সে যে মেসে থেকে পড়াশুনা করেছে, সেই মেসে। সেখানে একখানা ঘর নিয়ে মহিমকে আটকে রাখল সে। বনের পাখি মানুষের মতো কথা বলবার উদ্যোগ করতে, মানুষের খাঁচায় বাঁধা পড়ার মতো হল মহিমের অবস্থা। মুখে রইল শান্ত, কিন্তু ভিতরে ঝড়। অনুরাগ কমল না শিল্পের প্রতি, কিন্তু প্রাণটা যেন জগদ্দল পাথরের চাপে পিষ্ট হচ্ছে।

পাগলা গৌরাঙ্গ টের পেল সবই। টের পেল যে তার কিশোর শিল্পী কয়েকমাসের মধ্যেই অসম্ভব রকম রোগা হয়েছে গেছে। প্রাণ খুলে হাসতে পারে না, হাসতে পারে না, কথা বলতে পারে না। সেই স্বপ্নালু চোখ দুটোতে স্বাস্থ্যহীনতার লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

কিন্তু মুখে সে কিছু বলল না। ভাবল, শিল্পচর্চা আর একটু জমে উঠলেই আবার স্বাস্থ্য ফিরে আসবে, মুখের দুশ্চিন্তার রেখাগুলো পড়ে যাবে ঢাকা। ওর আজকের এই গ্রাম-ছাড়া, পরিজন-ছাড়া শুকনো বিষাদ মুখে ধ্বনিত হয়ে উঠবে ধন্যবাদের উচ্ছ্বসিত শব্দ ভবিষ্যতে কোনও একদিন পাগলা গৌরাঙ্গের প্রতি। আর সেদিনও বেশি দূরে নয়।

এদিকে গাঁয়ে-ঘরে, বিশেষ করে, মহিমদের পাড়াটাতে এই নিয়ে কথা হল বহুরকম। রাগ করল কেউ, ভয় পেল কেউ, দোষ দিল অনেকে ভরত আর অহল্যাকে পাগলের সঙ্গে ছেলেকে একদম ছেড়ে দেওয়ায়। কৈফিয়ত চাইল অনেকে পাগলা গৌরাঙ্গের বাপের কাছে। বামুন বলে খাতির নাই, ছেলে কোথায় বার করো।

মুখে খুব চোটপাট করলেও শঙ্কিত হল পাগলা গৌরাঙ্গের বাপও। ভাল ফ্যাসাদ করেছে তার ছেলে। কলকাতায় পুরনো মেসের ঠিকানায় চিঠি দিয়ে সব খবর নিয়ে তবে সে ঠাণ্ডা করল ভরতকে। আর তার প্রতিবেশীদের।

শেষটায় মেয়ে-পুরুষেরা মুখ টিপে হাসাহাসি করল। চোখ টিপল এমনভাবে, যেন গাঁয়ের কোনও মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে কেউ কলকাতায়।

কিন্তু কান্না বাঁধ মানল না অহল্যার। সে ছাড়ল খাওয়া পরা, কথা বলা। ইস্তক, ভরতের ভরা যৌবনের মধুময় রাতগুলোকে পর্যন্ত কান্নায় ঝগড়ায় এক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করল। যেন ভরত তার কেউ নয়, প্রাণপতিই তার হয়েছে দেশান্তরি। ভাল জ্বালায় পড়ল ভরত। স্নেহ মানে না, আদর মানে না, মানে না রাগ পীড়ন। এ এক হয়েছে অদ্ভুত দেবর-সোহাগী।

প্রায় তিনবছর কাটতে চলল।

শেষটায় একদিন আচমকাই মনে পড়ল ভরতের। তাই তো, ঘরে একটা ছেলেপুলে নাই, নাই কথা বলবার লোক, মেয়েমানুষ একটা থাকে কেমন করে ঘরে?

সে পাগলা গৌরাঙ্গের বাপের কাছ থেকে কলকাতার ঠিকানা নিয়ে কলকাতা যাওয়ার আয়োজন করল। হারামজাদা ছোঁড়াকে ধরে নিয়ে আসা ছাড়া গত্যন্তর নাই। সৎ ভাই কি না। নইলে ভাই-ভায়ের বউকে ভুলে থাকে কী করে এমন দূরে বিদেশে?

ভরত যাবে তো, অহল্যা বলে—আমিও যাব। সামান্য কান্নাকাটিতেই ভরতের মন থেকে বাধাটুকু ঝরিয়ে ফেলল সে। দুদিনের ঝামেলা বই তো কিছু নয়। ভরত আপত্তি করবে কেন?

ইদানীং অবশ্য সে অহল্যার কোনও আবদারেই আপত্তি করা ছেড়ে দিয়েছিল, কারণ আর যাই হোক, বাল্যবিবাহের রসও তো তার উঠছিল পেকে। সময়টাই যে পড়েছিল তখন আত্মসমর্পণের। অহল্যার কাছে ভরতের আত্মসমর্পণ।

কলকাতায় পাগলা গৌরাঙ্গের মেসে এসে উঠল ভরত আর অহল্যা, দূর বাংলার এক চাষী দম্পতি—যা তাদের চোখে মুখে পোশাকে স্পষ্টই প্রতীয়মান।

প্রায় তিনবছর পর দেখা। অহল্যা ছুটে গেল মহিমকে দেখতে পেয়ে। ছোটার বেগটা মহিমেরও কম নয়। সে-ই আগে ঝাঁপিয়ে পড়ল অহল্যার বুকে। তারপর হাসিতে চোখের জলে একাকার কাণ্ড। ভরত খানিকটা লজ্জিত দর্শক ছাড়া আর কিছু নয়। পাগলা গৌরাঙ্গ ভ্রূ কুঁচকে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট মুখে এ-দৃশ্য দেখল। যেন বাধা পড়েছে তার একাগ্র সাধনায়।

কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।

এবার ফুরসত হল অহল্যা আর ভরতের ঘরটার চারদিক দেখবার ঘরটা নিতান্তই তাদের দেশি কুমোরের ঘরের মতো না হলেও তারই এক গম্ভীর ও পরিচ্ছন্ন সংস্করণ। মূর্তিগুলোরও কোনও মিল নেই তাদের কুমোরের গড়া পুতুলের সঙ্গে, আগে মহিমও যে ছাঁদে গড়ত প্রতিমা।

সবচেয়ে বেশি উতলা হল অহল্যা। ঘরের চারদিক ঘোরে আর তার পেঁয়ো বিস্মিত চোখ দিয়ে কী এক অদ্ভুত বস্তু যেন নিরীক্ষণ করতে থাকে।

এ সবই তুমি গড়েছ? সে তার পাড়াগেঁয়ে কৌতূহলে যেন ফেটে পড়বার উপক্রম করল।

হ্যাঁ। মহিমের বুকে উচ্ছ্বসিত আলোড়নের খেলা চলছে। এই কথা, এই বিস্ময়-সবই তো তার গুণমূল্য! মুখখানি তার লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল।

এটা আবার কোন্ দেবতা?

বুদ্ধদেব।

কে বুদ্ধদেব অহল্যা তা জানে না। তবু হাত তুলে প্রণাম করল সে। কী টানা টানা বিশাল ধ্যানস্থ চোখ, কী সুন্দর নাক, ঠোঁট, কী বাহার চুলের আর গলার মালাটির।

আর এটা?

হর-পার্বতী।

হর-পাবর্তী। লজ্জা পেল অহল্যা, কৃত্রিম কোপে মুখটি তার অদ্ভুত হয়ে উঠল। এ কেমন হর-পার্বতী! এক বিরাট পুরুষ, আর তার পাশে পাবর্তী, খালি যৌনাঙ্গটুকু কয়েকটি মণিমাণিক্যে ঢাকা, আর সবই উলঙ্গ। বিশেষ বলিষ্ঠ স্তনযুগলই আরও লজ্জা দিয়েছে অহল্যাকে।

ছোঁড়ার মাথাটা দেখছি খেয়েছে পাগলা গৌরাঙ্গ। এমনি উলঙ্গ নারী মূর্তি অনেক কটাই রয়েছে। এসব কি পাথর, না মাটির?

মহিম হেসে উঠল বউদির কথায়। পাথর কোথায় গো! সবই মাটির। তবে যে-সে মাটি নয়, কিনে আনতে হয় পয়সা দিয়ে এ-মাটি! ঘরে বসে এর মশলা তৈরি করতে হয়।

মাত্র দু-তিন বছরের অবর্তমানে যেন বহু অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে মহিম। আর সেই খালধারের নয়নপুরের চাষী দশরথের ছেলে, অহল্যার বাধ্য দেবরটি বুঝি নেই। কেমন যেন শঙ্কিত হয়ে উঠল অহল্যা। মহিম কি দূরে সরে গেছে, হয়ে গেছে অন্য মানুষ! যার নাগাল কোনও রকমেই অহল্যারা পাবে না? এমনি পর পর, মার্জিত বাবু-ভদ্দরলোকের ছেলেদের মতো, যাদের সঙ্গে অহল্যাদের কোনও সামঞ্জস্যই নেই তাদের মতোই হয়ে গেছে মহিম! মহিমের কথাবার্তাও সন্দেহ জাগায়, সে যেন বড়সড় হয়ে উঠেছে অনেক। মাত্র তিনটে বছররের ব্যবধান, এর মধ্যেই কত বড় আর মানুষ হতে পারে। কিন্তু মহিম যেন স্বাভাবিক বাড়কে ছাড়িয়ে উঠেছে। কেমন যেন উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল অহল্যা। যেন সে চায় না, কোনও দিনই মহিম বড় হবে। থাকবে চিরকালের সেই নরম ছোট্টটি, ছেলেমানুষ, যার উপর অহল্যার আধিপত্য থাকবে আগেরই মতো পুরো পরিমাণে।

হ্যাঁ, এতদিন পরে মহিমেরও তো আছে কিছু দ্রষ্টব্য, যা দিয়ে সে এই চিরকালের পাড়াগেঁয়ে দাদাবউদিকে খানিকটা চমকে দেয়। তার উৎসাহ তো সেইখানেই বেশি, যেখানে সে যত বিস্ময়ের সৃষ্টি করতে পারবে। তার প্রাপ্য এই চমকানি, এ বিস্ময়। সে তার কথায় কাজে সব দিয়ে সবখানি মূল্য চায় ফিরিয়ে নিতে।

কিন্তু অহল্যার এ ভয় কেন?

তা তো অহল্যা জানে না। সে শুধু জানে, যে সংশয় যে সন্দেহ তার মনে এসেছে, তাই যদি হয় কার্যকরী, তবে বুঝি বাঁচবে না। তাই যাচাই করে নেওয়ার জন্যই সে দৃঢ় গলায় গভীর হয়ে বলল : মোরা কিন্তু তোমারে নিতে আসছি। ঘরে ফিরে যেতে হবে এবার তোমার।

মহিমের চোখে ফুটল যেন বহুদিন পরে মায়ের সঙ্গ পাওয়া সন্তানের ব্যাকুল আনন্দ, আমিই বুঝি তোমাদের আর একলা একলা নয়নপুরে ফিরে যেতে দিচ্ছি?

মহিম বেঁকে বসলে ভরত কী বলত.বলা যায় না। এখন সে হঠাৎ খিঁচিয়ে উঠল, কেন, থাক না আরও কিছুদিন বিদেশে হতচ্ছাড়া কোথাকার! চল লয়নপুরে, গোবেড়ন লাগাব তোমাকে।

মহিম ভয় পেল না। আর কিছু না হোক, এটা সে বুঝেছে, দুশো মাইল তফাত থেকে যারা ছুটে আসে—তারা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া মাত্র গোেবেড়ন দেওয়ার পাত্র নয়।

অহল্যা বলে, হয়েছে, থাক্। তারপর এক টানে সে তার জামাটা খুলে ফেলল।

এদিকে সারারাত্রি পাগলা গৌরাঙ্গের পাত্তা নেই। শঙ্কিত হল অহল্যা আর ভরত। মহিম নিশ্চিন্ত মনে বলল, ভাববার কিছু নেই, উনি ওরকম করে থাকেন।

পরদিন রুক্ষ্মবেশে ফিরে এলেন পাগলা গৌরাঙ্গ। মহিমরা তখন কলকাতার গল্পে মত্ত। বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়েই পাগলা গৌরাঙ্গ ডাকল মহিমকে। মহিম অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে কাছে এসে দাঁড়াল।

তুই নয়নপুরে ফিরে যাবি ওদের সঙ্গে? ভীষণ গভীর শোনাল তার গলা।

মহিম প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। তারপর এক কথায় বলল, হ্যাঁ।

হ্যাঁ? হঠাৎ ভীষণ খেপে গিয়ে পাগলা গৌরাঙ্গ প্রচণ্ড বেগে একটা ধমক দিয়ে কিল চড় মেরে মহিমকে শুইয়ে ফেলল তার পায়ের কাছে। যেন মহিমের প্রতি কী প্রচণ্ড আক্রোশ তার।

অতবড় ষণ্ডা মানুষ ভরতও যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল ব্যাপার দেখে। একমাত্র অহল্যারই বুকটা দারুণ রোষে ওঠা-নামা করতে লাগল। ফুলে উঠল নাকের পাটা দুটো। বাঘিনীর মতো ছিনিয়ে নিয়ে গেল সে মহিমকে। কেন মারছ ছোঁড়াকে এমন করে, জিজ্ঞেস করি? মগের মুলক পেয়েছ?

সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে পাগলা গৌরাঙ্গ হিসিয়ে উঠল; মহিমের দিকে চেয়ে, যা, চলে যা। তারপর ঘরে ঢুকে মহিমের জামাকাপড় সব ছুড়ে ফেলে দিল বারান্দায়।

একমাত্র অহল্যাই বিহ্বল হল না। সে সব বেঁধেছেদে নিতে লাগল। ভীষণ অপমানে জ্বলে যাচ্ছে সে। যাওয়ার ব্যবস্থা যখন তৈরি হয়ে গেল, তখন বহু দ্বিধা কাটিয়ে মহিম একবার ঘরে ঢুকল।

পাগলা গৌরাঙ্গ তখন বুদ্ধ মূর্তিটার মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, এ ঘরের কিছু তুই পাবি না। যা, চলে যা। বলে আঙুল দেখিয়ে দিল সে দরজার দিকে।

মহিম দেখল পাগলা গৌরাঙ্গের চোখের কোণে দু ফোঁটা জল।

মহিম ফিরে ফিরে দেখল সারা ঘরটা। কয়েকদিন মাত্র সে শুরু করেছিল পাগলা গৌরাঙ্গের আকণ্ঠ প্রতিমূর্তি, তা মাঝপথেই থেমে গেল।

ফিরে যাওয়ার পথে ট্রেনে উঠে মহিম কেঁদে ফেলল অহল্যার কাছে। পাগলা ঠাকুর কষ্ট পাবে বউদি।

অহল্যা মনে মনে বাঁকা ঠোঁটে হাসল। যার যেমন কর্ম তেমন ফল। কষ্ট অহল্যাও কম পায়নি।

এই হল মহিমের শিল্পচর্চা আরম্ভের প্রথমদিককার কথা। তারপর সে পাগলা গৌরাঙ্গের মূর্তি তৈরি করে রেখে দিয়েছে নিজের ঘরটিতে।

কয়েক বছর পরে পাগলা গৌরাঙ্গ ফিরে এসেছিল নয়নপুরে, কিন্তু কোনও দিনও মহিমের সঙ্গে দেখা হয়নি। দেখা করতে গেলে ফিরিয়ে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *