মধ্যযুগীয় কাব্য-কাহিনী বনাম সুসমাচার কাহিনী
প্রকৃতপক্ষে, মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বিভিন্ন গাথা বা কাব্য-কাহিনী যেভাবে গড়ে উঠেছিল, সুসমাচার-রচনার কাহিনী অনায়াসেই সেসবের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এরমধ্যে সর্বাধিকভাবে তুলনীয় হতে পারে ‘সঙ অভ রোল্যান্ড’ নামক সর্বজনপরিচিত কাহিনী-কাব্যটি। এই কাহিনী-কাব্যে একটি সত্য ঘটনাকে রূপকথার মত সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ঘটনাটি ছিল এইরূপ :
শার্লিমেনের সেনাবাহিনীর একটি অংশের দলপতি ছিলেন রোল্যান্ড। তিনি যখন তাঁর বাহিনীকে নিয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন রনসভকস এর নিকট তাদের উপর হামলা চলে। ইতিহাসে দেখা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল ৭৭৮ সালের ১৫ই আগস্ট। (এগিনহার্ড) মূলতঃ এ ঘটনাটি সাংঘাতিক এক যুদ্ধের কাহিনী হিসেবে প্রচার লাভ করে। শুধু তাই নয়, শেষপর্যন্ত এই যুদ্ধের ঘটনাটি ধর্মযুদ্ধের কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। উল্লেখ্য যে, শার্লিমেনকে তার সীমান্তরক্ষার জন্য প্রায়ই প্রতিবেশি শক্তির অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে হত। অথচ, রূপকথার রচয়িতাবৃন্দ এই কাহিনীকে কেন্দ্র করে তাদের কল্পনাশক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ছেড়েছেন।
অন্যদিকে, গাথা বা মহাকাব্যের মত যত রঙই ছড়ানো হোক, বর্ণিত কাহিনীর মধ্যেও একটি সত্য ঘটনা যে লুকানো রয়েছে, তা স্বীকার করতে হয়।
অনুরূপভাবে, মথি তার সুসমাচারে যতই আদি-ভৌতিক কাহিনীর অবতারণা করুন, সুসমাচারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈপরিত্য যতই মারাত্মক হয়ে ধরা পড়ক, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের তুলনায় সেসব রচনার বর্ণনা যতই অবাস্তব ও অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হোক এবং পরবর্তী পর্যায়ে এসব কাহিনীকে যতই ঝুটলানো হয়ে থাক-না-কেন ওইসব সুসমাচারের রচনার মধ্যেও সেই একই ধরনের সত্য ঘটনা লুকানো রয়েছে।
বলা অনাবশ্যক, সুসমাচার রচনার ক্ষেত্রে এই ধরনের সত্য ঘটনাকে ভিত্তি ধরে নিয়েই তার সাথে মেশানো হয়েছে মানবীয় কল্পনার নানারূপ, নানারঙ, নানাবর্ণ, নানাগন্ধ ইত্যাদি। কল্পনার এতসব রূপ ও রঙ সত্ত্বেও কিন্তু যীশুখ্রিস্টের মিশন তথা তার কার্যকলাপ ও বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে, প্রচলিত বাইবেল তথা ইঞ্জিলে যীশুর সেই মিশনকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, শুধু সেই বর্ণনার ক্ষেত্রেই দেখা দেয় যত সন্দেহ ও সংশয়।
এখানে এই গ্রন্থকার সেই সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার মতো কিছু কারণ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস ইতোমধ্যে চালিয়েছেন। অনেকেই সম্ভবত মত প্রকাশ করবেন, ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কোরআন বিজ্ঞান’ রচিত গ্রন্থে যেহেতু এ-সকল বক্তব্য তথা মন্তব্য তিনি তুলে ধরেননি, এখানে কেন তা আসবে? এই গ্রন্থকার বিনয়ের সাথে সে-সকল পাঠকদের উদ্দেশে বলছেন :
‘আমি মূলত ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থকে অবলম্বন করে পরোক্ষ এবং কখনো কখনো প্রত্যক্ষভাবে তাঁর গ্রন্থটিকে পাঠকদের নিকট বর্ণনা করতে চাচ্ছি, আর তাই তার অর্থাৎ ড. মরিস বুকাইলি রচিত গ্রন্থে উল্লিখিত মন্তব্য, বক্তব্য ও উক্তিকে আরও দৃষ্টান্ত-সমৃদ্ধকরণে প্রয়াসী এবং এ কারণেই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে প্রসঙ্গ : ‘ড. মরিস বুকাইলির বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান শুধু বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ নয়। তবে, আমি সম্মানিত সে-সকল বোদ্ধা পাঠকগণকে এই বলে আশ্বস্ত করছি, ড. মরিস বুকাইলি রচিত বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান অবলম্বিত আমার এই গ্রন্থে তাঁর অর্থাৎ ড. মরিস বুকাইলি রচিত ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থে পরিবেশিত সকল তথ্য ভিন্নরূপ উপস্থাপনায় পরিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন বিষয়কে ভিন্নআঙ্গিকে উপস্থাপন করে সহজে পাঠকমনে বোধগম্য করার প্রয়াস রয়েছে, যেমনি কিছুটা বেশি তথ্য পরিবেশনের দায় গ্রহণ করা হয়েছে।
মূলত, এ বইটি গ্রন্থিত হয়ে প্রকাশিত হলো ড. মরিস বুকাইলি রচিত, ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে বলেই, কিন্তু তথ্য-জ্ঞানের এই প্রতিযোগিতার যুগে অবিরত নতুন নতুন তথ্য আমাদের হাতে আসছে, আর তাই এই গ্রন্থে কিছুটা প্রাসঙ্গিকতার কারণে বেশি তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এবং মূল বইয়ের বক্তব্যকে পরোক্ষভাবে অবিকৃত রেখে, যে-কারণে ঔদ্ধত্যপনা হয়ে গেলেও এই গ্রন্থকার বোন্ধাপাঠকদের উদ্দেশে বলতে বাধ্য হচ্ছেন এই গ্রন্থে মূলগ্রন্থের চেয়ে বেশি তথ্য সন্নিবেশিত হওয়ায় অন্যান্য গ্রন্থকারের গ্রন্থ থেকেও তথ্য নেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থপাঠে পাঠকবর্গ উপকৃত হবেন বৈ অপকৃত হবেন না, এখন পাঠকদের বক্তব্য-সমালোচনা শোনা ও জানার দায় নিয়ে ক্ষমাসুন্দরদৃষ্টি কামনা করে এবং এই গ্রন্থ প্রকাশে যে-সকল গ্রন্থকারের গ্রন্থ থেকে তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে সম্মানিত সে সকল গ্রন্থকার, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছিঃ
সুসমাচার লেখক ‘লূক’-এর বিভ্রান্তি
সুসমাচার লেখক লুক তার সুসমাচারে যীশুখ্রিস্টের জন্মকাল সম্পর্কে লিখেছেন,
“তখনকার অগস্ত কৈর (Augustus Caesar)-এর এক রাজা বের হলো যে, সাম্রাজ্যের সমুদয় লোককে নাম লেখাতে হবে। সুরিয়ার (Syria) দেশাধ্যক্ষ (Governor) কুরীশীয়ের সময় এই প্রথম নাম লেখানো হয়। সবাই নাম লিখে দেয়ার জন্য নিজ নিজ নগরে গিয়েছিল। আর যোসেফও গালীলের নাসরত নগর থেকে যিহুদিয়ার বেথেলহেম আখ্যাত দায়দের নগরে গেলেন, কারণ, তিনি দায়দের কুর ও বংশজাত ছিলেন; তিনি তাঁর বাগদত্তা স্ত্রী মরিয়মের সাথে নাম লিখে দিতে গেলেন। মরিয়ম তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন; তারা যখন সেখানে ছিলেন, তখন তার সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত হলো, আর তিনি তার প্রধমজাত পুত্রকে প্রসব করলেন …” (২ : ১-৭)।
অর্থাৎ, লুকের এই বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, সিরিয়ার গভর্নর কুরীশীয়ের সময় রোম সাম্রাজ্যে প্রথম লোক গণনা করা হয় এবং এই লোক গণনায় নাম লিখে দিতে আসন্ন সন্তানপ্রসবা মরিয়ম তার বাগদত্তা স্বামী যোসেফের সাথে গালীলের নাসরত নগর থেকে ৭০ মাইল দূরবর্তী বেথেলহেম নগরে গিয়েছিলেন এবং তখনই তিনি তাঁর প্রথমজাত সন্তান যীশুকে প্রসব করেন। কিন্তু লুক বর্ণিত এই ঘটনা ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত নয়। কারণ, যীশুর জন্মকালে রোম সাম্রাজ্যে লোক গণনার এবং সিরিয়া দেশে কুরীশীয় নামে দেশাধ্যক্ষ থাকার প্রমাণ খ্রিস্টান পণ্ডিতদের কাছে নেই। বরং, ইহুদী ইতিহাসবিদদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ফ্লেবিয়াস যোসেফাসের লেখা অনুযায়ী যীশুর জন্মের সাতবছর পরে রোম সাম্রাজ্যে প্রথম লোক গণনা করা হয় এবং যীশুর জন্মের দশবছর আগে থেকে হেরোদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত সিরিয়ায় যথাক্রমে স্টিপলাস ওয়ারদাছ (Stiplus Wardus), সেনটিরিস (Sentiris) এবং তীথনিস (Titnis) দেশাধ্যক্ষ ছিলেন বলে Ency. Bitanica, Under “Chronicle”-এ নিশ্চিত করা হয়েছে।
সুতরাং, লুক বর্ণিত আলোচ্য তথ্যটি অবিশ্বাস্য হলেও প্রশ্ন জাগে : এমন ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণাদির প্রতিকূলে লুক কি উদ্দেশ্যে লোকসংখ্যা গণনার মত একটি ইতিহাস যীশুর জন্মকালে হয়েছিল বলে আবিষ্কার করলেন? এই আবিষ্কারের পিছনে বাধ্যবাধকতামূলক কোনো নেপথ্যকারণ (background) নিশ্চয় তাঁর ছিল। মনে হয়, যোসেফ মরিয়মকে নিয়ে তার গর্ভাবস্থাকালীন সময় শারীরিক দুর্বলতার চরমসীমায় বেথেলহেমের মত সুদূরবর্তী স্থানে এক দুঃসাধ্য ভ্রমণের ঝুঁকি কেন গ্রহণ করেছিলেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই লুক এহেন নৈরাশ্যজনক অনুসন্ধান চালান এবং পরিণামে লোকসংখ্যা গণনার প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে হোঁচট খান, যা তার আরোপিত তারিখের সাত বছর পরে সংগঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, জনসংখ্যা গণনা ও যীশুর জন্ম একইসময় ঘটেছিল এমন প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে তিনি ইচ্ছে করেই জনসংখ্যা গণনার তারিখ সাত বছর এগিয়ে দেন, যা প্রকৃত ঘটনার প্রায় সত্তর-আশি বছর পর ইতিহাস লিখতে গিয়ে সম্ভবত তিনি মনে করেন যে, দীর্ঘকাল পরে এ ধরনের ঐতিহাসিক ভ্রমণকাল নিরূপণের বিষয়টি কেউ আর বুঝবে না। এভাবে সাতবছর পরে সংঘটিত জনসংখ্যা গণনাকে যীশুর জন্মবর্ষে আরোপ করে লুক নিজে নিজে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন যে, যোসেফ কেন তার রুগ্ন স্ত্রীকে পূর্ণ গর্ভাবস্থায় ৭০ মাইল দূরবর্তী বেথেলহেম ভ্রমণের কষ্ট দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবে লুক নিজের কাছে। ব্যাখ্যাদানে কৃতকার্য হয়েছেন।
কিন্তু তবুও একটি দুর্বোধ্য ব্যাপার থেকে যায়, যীশুর জন্মকালে যদি লোকসংখ্যা গণনার মতো প্রচলিত ইতিহাস থেকেই থাকে তবে লুক কেন বেথেলহেম ভ্রমণের মতো ইতিহাস আবিষ্কারে এত সচেষ্ট হলেন? কেনই-বা তিনি যোসেফকে নিয়ে মরিয়মের ওই কষ্টকর ভ্রমণে বাধ্য করালেন? মূলতঃ লুকের এই আবিষ্কার তার নিজের জন্যই অন্তরায় ছিল। কারণ, মরিয়মের পবিত্র আত্মায় গর্ভধারণের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বড় বড় আশ্চর্যজনক অলৌকিক ক্রিয়াসমূহ শুরু হয় এবং যীশুর জন্মপর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটতে থাকে। তিনি আশংকা করেন যে, যোসেফ ও মরিয়মের এই ভ্রমণের উপযুক্ত কারণ যদি প্রমাণ করা না হয়, তাহলে জনসাধারণের কাছে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবেই দুর্বল বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত হবেন এবং জনসাধারণ স্বভাবতঃই বলবে যে, উক্ত গর্ভধারণের সময় এত অলৌকিক ক্রিয়াসমূহ প্রত্যক্ষ করার পরও যোসেফ লোকজনের সমালোচনা ও কুৎসা রচনার ব্যাপারে তখনও ভীত ছিলেন এবং উক্ত গর্ভধারণের ঘটনা ও পরবর্তী জন্মবৃত্তান্ত গোপন করার উদ্দেশ্যেই তারা নাসরত নগর ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু রূঢ় বাস্তব বিষয় ছিল, তারা অতি দূরবর্তী স্থানে বেথেলহেমের ভ্রমণ পরিগ্রহণ করেছিলেন বাস্তব ন্যায়সঙ্গত কারণে। লুক সম্ভবতঃ ভেবেছিলেন যে, জনসাধারণ বলতে পারে যে, উক্ত গর্ভধারণের অব্যাবহিত পরেই অলৌকিক কার্যকলাপ ও স্বর্গীয় চিহ্নাদি যদি সত্যিই সংঘটিত হয়ে থাকে তবে মরিয়মের গর্ভধারণ ও পরবর্তীতে যীশুর জন্মবৃত্তান্ত গোপন করার জন্য যোসেফ মরিয়মকে তার কায়িক দুর্বলাবস্থায় এই কঠিন ও ক্লান্তিময় ভ্রমণে বাধ্য করেছিলেন?
এ সকল কারণই যীশুর গর্ভে থাকাবস্থায় বড় বড় অলৌকিক ক্রিয়াসমূহ। আবিষ্কারের বিষয়টিই লুককে লোকসংখ্যা গণনা ও লোকসংখ্যা গণনাকালীন সময়ে মরিয়মকে বেথেলহেম যাওয়ার গল্প তৈরি করতে বাধ্য করে।
যদিও যীশুর জন্মসময়ে লোকসংখ্যা গণনা করা হয়েছিল এহেন তথ্য আবিষ্কার করা লুকের অপ্রয়োজন ছিল, সহজেই তিনি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, মরিয়ম মন্দিরে থাকাকালীন যোসেফের সাথে বিয়ে হয়, যেহেতু যোসেফ নিজেও মরিয়মের সতীত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন এবং এ মর্মে তিনি পূর্বেই এক স্বপ্ন দেখেছিলেন (মথি, ১: ২০-২১) কিন্তু তিনি যেহেতু আশংকা করছিলেন, তাই তিনি অন্য লোকদেরকে এ ঘটনা বিশ্বাস করাতে সমর্থ হবেন না এবং লোকজনের তরফ থেকে কুৎসা রটনার ভীতিও পোষণ করতেন, তাই তিনি মরিয়মের গর্ভধারণের পূর্ণতৃপ্রাপ্তি লোক-সমাজে প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই তাকে সুদূরবর্তী স্থানে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু লুক তা করেননি। কারণ, সেক্ষেত্রে মরিয়মের গর্ভধারণের সময় বড় বড় অলৌকিক ক্রিয়া-সংঘটনের সকল গল্প চুরমার হয়ে যেতো। এভাবেই সমস্ত জটিলতার উদ্ভব হয়েছে এবং একটি আবিষ্কার আরেকটি আবিষ্কারকে সৃষ্টি করেছে।
যীশুর জন্মসন নিয়ে মতভেদ :
যীশুর জীবনী লেখক পৃথিবীখ্যাত বেঁনা বলেছেন, অগাস্টাস সিজারের রাজত্বকালে ৭৫০ রোমান অব্দে এবং খুব সম্ভবতঃ বর্তমান সভ্যজগতের সাল গণনার প্রথমবর্ষের কয়েক বছর আগে যীশু জন্মগ্রহণ করেন। অন্য বর্ণনায় আছে, রোম সম্রাট অকটোভিয়াস (সরকারি নাম অগাস্টস সিজার)-এর সময় সাঁইত্রিশ বছরকাল রাজত্ব করে ইহুদীদের রাজা হেরোদ সত্ত্বর বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যুর আগের বছর অথবা সেই বছরই উত্তর প্যালেস্টাইনের গালিলী প্রদেশের নাজারেথ শহরে যীশুর জন্ম হয়। তার জন্মের চার কি পাঁচ বছর পর থেকে তাঁর জন্মানোকেই উপলক্ষ্য করে প্রচলিত খ্রিস্টাব্দের গণনা আরম্ভ হয়েছে। আর সাধু লুকের বিবৃতি থেকে জানা যায়, বছর মাথাপিছু পোল ট্যাক্স বা জিজিয়া কর আদায়ের অভিপ্রায়ে লোকসংখ্যা গণনা করা হয় সেই বছরই যীশু জন্মগ্রহণ করেন। এই লোকসংখ্যা গণনার কাজ শুরু হয় ছয় খ্রিস্টাব্দে আর শেষ হয় সাত খ্রিস্টাব্দে। এই হিসেবে তখন যীশুর বয়স দশ কি এগারো বছর দাঁড়ায়। সুসমাচার রচয়িতা মথি ওই ঘটনাকেই দশ বছর এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। গোলমাল হয় দেখে, অনেকে আবার যীশুর জন্মসালকে দশবছর পিছিয়েও দেন। কিন্তু তাহলে সুসমাচারে বর্ণিত কালক্রমের প্রায় সবটাই ওলোট-পালোট হয়ে যায়।
যাহোক, প্রচলিত রয়েছে, যীশুর জন্ম হয়েছিল ‘আগস্ট-সেপ্টেম্বর’-এর কোন একসময়। সেক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের ভ্রান্তির পরিমাণ সম্ভবতঃ তিন-চার মাসের। কিন্তু দিন-মাস নিয়ে মতান্তর নয়, প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে গবেষকদের গুরুতর মতপার্থক্য রয়েছে সংশ্লিষ্ট বছর সম্পর্কে। পণ্ডিতদের মতে, যীশুর জন্ম চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে একাদশ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোন একসময়ে। পণ্ডিতরা এর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে একটি তারার কথা এবং তিনজন পূর্বদেশীয় পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করেছেন। এই পণ্ডিত তিনজন ‘মর্মজ্ঞ মহাত্মা’ (Magi), সম্ভবতঃ ইহুদী। লক্ষণ গণনা করে তাঁরা নবজাতক যীশুর দর্শন পান তারকা চিহ্নিত পথ ধরে এসে। যে তারকাটি লক্ষ্য করে তাঁরা পথ চলছিলেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে, দক্ষিণে বেথেলহেমে এসে তা একটি পান্থশালায় থামে। তখন যে উজ্জ্বল তারাটির কথা বলা হয়েছে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে তাকে হ্যালির ধূমকেতু বা ওইরকম কোন ধুমকেতুকেই বলা হয়েছে।
মথি লিখিত সুসমাচারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, যীশুর জন্মের পরে পূর্বদেশ থেকে একদল দৈবজ্ঞ গুণী জেরুজালেমে এসে দেখা দিলেন। তারা সেখানে এসে খোঁজ করতে লাগলেন, ইহুদীদের যিনি রাজা হবেন তিনি কোথায় জন্মেছেন? পূর্বাকাশে তারা তার জন্ম-তারা উঠতে দেখেছেন, তাই তারা তাকে অর্ঘ্য নিবেদন করতে এসেছেন। কথাটা পরম্পরাগতভাবে যখন জুডিয়ার রাজা হেরোদের কানে উঠল তখন তিনি বেশ খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হলেন এবং তিনি সকল প্রধান পুরোহিত ও ধর্মগুরুদের সম্মিলিত করে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতি ত্রাণকর্তা (খ্রিস্ট) কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন?
তাঁরা পুঁথিপত্র ঘেঁটে জানালেন, শাস্ত্রে আছে তিনি জুডিয়ার বেথেলহেমে জন্মাবেন (২: ৩-৫)। তখন রাজা হেরোদ পূর্বদেশ থেকে আগত সেই দৈবজ্ঞ গুণীদের নিজের কাছে ডেকে এনে গোপনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নিলেন, সর্বপ্রথম কবে তারা পূর্বাকাশে সেই তারা উঠতে দেখেছেন। তারপর তাদের বেথেলহেম শহরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, আপনারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখুন। খোঁজ পেলেই আমায় এসে জানাবেন। তাহলে আমিও সেখানে গিয়ে তাকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসবো।
রাজার আদেশ শুনে গ্রহাচার্যেরা বেথেলহেমের দিকে পা বাড়ালেন। আশ্চর্য, যে তারাটি তারা পূর্বাকাশে দেখেন, সেই তারাই এখন তাদের যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। অবশেষে, যীশু যে জায়গায় জন্মেছিলেন সেই জায়গার ঠিক মাথার উপর তা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দৈব মর্মজ্ঞরা বুঝলেন, তারা ঠিক জায়গায় পৌঁছেছেন। খুশি হয়ে তারা ঘরের ভেতর ঢুকতেই নবজাতক শিশুকে তার মায়ের কোলে দেখতে পেলেন, পিতা যোসেফ কাছেই দাঁড়িয়ে। তাদের সবাইকে প্রণিপাত করে তাঁরা গাটরি-পাটরা খুলে নানারকমের দামী দামী উপহার সামগ্রী বের করে শিশু-যীশুকে নিবেদন করলেন।
তারপর সেইরাতেই তাঁরা স্বপ্নে প্রত্যাদেশ পেলেন, তারা যেন আর হেরোদের কাছে ফিরে না যান। আদেশ শুনে তারা আর দেরি না করে অন্য পথ ধরে স্বদেশে ফিরে গেলেন। ওদিকে রাজা হেরোদ যখন বুঝতে পারলেন দৈবজ্ঞরা তাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে, তখন রাগে তিনি একেবারে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সেই পণ্ডিতদের নিকট বিশেষ করে যে সময় জেনে নিয়েছিলেন সে অনুসারে দু’বছর ও তকম বয়সের যত বালক বেথেলহেম ও তৎসীমার মধ্যে ছিল, লোক পাঠিয়ে সেসব শিশু বালকদের নির্বিচারে হত্যা করল (২: ১৬)।
ফলে, অনেক নিঃস্পাপ শিশুর মৃত্য হল। কিন্তু জল্লাদদের হত্যাকাণ্ড শুরুর পূর্বেই মরিয়মের বাগদত্ত স্বামী যোসেফ স্বপ্নে প্রত্যাদেশ পান, কালবিলম্ব না করে সে যেন শিশুটিকে আর তার মাকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যান এবং যতদিন না তাদেরকে ফিরতে বলা হয়, ততদিন যেন সেখানেই থাকেন। এভাবে, শিশু যীশু যোসেফ কর্তৃক তার মাকে নিয়ে মিসরে পালিয়ে যাওয়ায় ওই নির্বিচার হত্যার হাত থেকে রক্ষা পান।
কিন্তু, ইতিহাসের বিবরণ মানতে গেলে, পৃথিবীর সর্বত্রই ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নিয়ে এমন অনেক কথা কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে, যা মূলত ইতিহাস নয়। রাজা হেরোদের নির্বিচারে শিশু হত্যার বিষয়টিও একই। কারণ, রাজা হেরোদের অনেকরকম হত্যাকাণ্ডের কথা, তার বহু অপকীর্তির কাহিনী ঐতিহাসিকরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, কিন্তু ওরকম একটি বিনাবাছবিচারে পাইকারী হারে নিষ্পাপ শিশুহত্যার কথা কোন বইয়ের পাতায় কিংবা কোন দলিল-দস্তাবেজে কখনো দেখা যায় না। তবে, হেরোদ যে চরিত্রের লোক ছিলেন তাতে তার পক্ষে ওরকম একটি হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করানো কেমন কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয় বলেই বোধহয় মথির কাহিনীতে জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে, জুডিয়ার সিংহাসনে বসার আগের সবকথা বাদ দিলেও, ঐতিহাসিক উক্তি অনুসারে ইহুদীদের রাজা হয়ে বসার পর হেরোদের এমন একটি দিন যায়নি, যেদিন কেউ-না-কেউ তার হাতে খুন না হয়েছেন। তার ওই আসুরিক কাণ্ড থেকে তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউই বাদ যায়নি। এক শ্যালক, দুই ভগ্নিপতি, এক স্ত্রী, সেই স্ত্রীর গর্ভজাত দুই পুত্র, এক শ্বাশুড়ি, দুই দাদা শ্বশুড় সবাই তার হাতে একে একে নিহত হন। এমনকি মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগেও তার দশ রানীর এক রানীকে ও আরেক রানীর গর্ভজাত পুত্রকে তিনি হত্যা করার আদেশ দেন।
ঐতিহাসিকেরা তেমন মিথ্যা টিপ্পনি কাটেননি যে হেরোদকে দেখে মনে হত, যেন কোন হিংস্র পশু বন থেকে বেরিয়ে এসে জুডিয়ার সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছে।
যাহোক, ঐতিহাসিকগণ পেয়েছেন, শিশু-হস্তা হেরোদ যে বছর মারা যান সেইবছর ইহুদীদের নিস্তার-পর্ব (passover) নামের বিশেষ উৎসবের অব্যবহিত পরেই একটি চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ইহুদী ক্যালেণ্ডার সম্পর্কিত জ্ঞান এবং গ্রহণ সংক্রান্ত সূত্র প্রয়োগ করে জানান, তা ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব চার অব্দে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা (১৯৮৬) সংস্করণ, পঞ্চদশ খণ্ড) বলে, Jesus was born a few years before the end of his (Herod) reign, w, where Jesus birth and early lot are set in the time of Herod I and the change of regime (4 BC). সুতরাং, বিষয়টি নানাদিক থেকে বিচারবিশ্লেষণ করে গবেষকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, যীশুর জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ছয় অব্দে –তার আগেও হয়তোবা হতে পারে।
ড. এস. পিক জে, স্টুয়ার্ট হোয়েন ‘ডিড আওয়ার লর্ড অ্যাকচোয়্যালি লিভ?’ গ্রন্থে বলেন, পুস্তকে এঙ্গোরা মন্দিরগাত্রে রক্ষিত শিলালিপি এবং প্রাচীন চীনা ক্লাসিকে উদ্ধৃত সুদূর চীনে ২৫-২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত সুসমাচারে বর্ণিত কাহিনীর বর্ণনা থেকে যুক্তির মাধ্যমে যীশুর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব আট অব্দে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর বলে নির্ধারণ করেছেন।
লুক লিখিত সুসমাচার থেকে জানা যায়, তাইবেরিয়াস সিজারের শাসনকালের পঞ্চদশ বছরে যখন পান্তিয়াস পীলাত ইহুদীদের দেশাধ্যক্ষ, হেরোদ গালীলের রাজা, তার ভ্রাতা ফিলিপ যিতূরিয়া ও ত্রাখোনীতিয়া প্রদেশের রাজা এবং লূষাণিয়া অবলিনী (Abilane)-এর রাজা তখন হানন (Annas) ও কায়াফা (Caiaphas)-এর মহাযাজত্বকালে সরিয়ের পুত্র যোহন (হযরত জাকারিয়ার পুত্র হযরত ইয়াহইয়া) প্রথম ঐশীবাণী (নবুয়ত) লাভ করেন (৩: ১-২)। উদ্ধৃত তিবিরিয়া কৈসরের শাসনকালের পঞ্চদশ বছরকে ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ ২৮/২৯ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছে। সর্বদীসম্মত মত এই যে, যীশু ও যোহন সমবয়সী (ছয় মাসের ছোট-বড়) ছিলেন (লুক, ১ : ২৪-২৬) এবং যোহনের অব্যবহিত পরেই যীশু নবুয়ত লাভ করেন।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ তায়ালা কাউকেই চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে নবুয়ত প্রদান করেননি এবং পবিত্র কোরআনেও নবুয়ত লাভের বয়স ৪০ বছর বলে উল্লিখিত হয়েছে (সূরা আরাফ, সূরা আল আহকাফ)। এই মতানুসারে যীশুর জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব (৪০-২৮ =)১১/১২ অব্দে। আর এ বিষয়টি মথি বর্ণিত একটি আকাশীয় লক্ষণ থেকেও জানা যায়।
মথি লিখিত সুসমাচারে বর্ণিত রয়েছে, যীশুর জন্ম হওয়ার পরে পূর্বদেশ (খুব সম্ভবতঃ ভারত) থেকে ক’জন জ্ঞানী পণ্ডিত জেরুজালেমে এসে বলেন, ইহুদীদের যে রাজা জন্মেছেন তিনি কোথায়? কারণ, তার জন্মের লক্ষণস্বরূপ যে তারাটি উদিত হওয়ার কথা, তারাটি তারা পূর্বদেশে দেখেছেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করতে এসেছেন (২: ১-২)–এখানে সকল গবেষক-পণ্ডিতই প্রশ্ন তুলেছেন : যীশুর জন্মকালে পূর্বদেশের ক’জন (স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও, মনে হয় তিনজন) জ্ঞানী পণ্ডিত আকাশে কি দেখেছিলেন, যা লোকমুখে আজও Star of Bethlehem বা বেথেলহেমের তারা বলে অভিহিত হয়ে আসছে?–এ সম্বন্ধে Ment Students Encyclopeadia (Vol, 4, P-469) বলে :
‘জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বাইবেলে (মথি, ২:২,৯) উল্লিখিত তারাটি নির্ণয়ের চেষ্টা করেন, যার অনুসরণ করে জ্ঞানী ব্যক্তিরা বেথেলহেমে এসেছিলেন। সম্ভাব্য তারাটি প্রথমত, এগারো খ্রিস্টপূর্বাব্দে বেথেলহেমের উপরে হ্যালীর ধূমকেতু দেখা দিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ খ্রিস্টপূর্ব সাত বা আট অব্দে বৃহস্পতি, শনি ও মঙ্গলের কক্ষপথগুলো এমনভাবে একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছিল যে পৃথিবী থেকে দেখলে মনে হতো, ওইসব গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত আলো এক বিন্দু থেকেই আসছে। সবশেষে, বেথেলহেমের তারাটি হয়তো বা একটি নোভা অর্থাৎ, এমন একটি তারা, যা হঠাৎ করেই অধিক উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে এবং কিছুসময় পরেই আবার আঁধারে মিলিয়ে যায়। যাহোক, খ্রিস্টের জন্ম তারিখ যখন নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি, তখন এসব সূত্রের কোনটিকেই সত্য বলে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।”
তবে, পণ্ডিতদের অধিকাংশই উল্লিখিত তারাটিকে ধূমকেতু বলে বিশ্বাস করেন। আবার কেউ কেউ তা অশুভ ঘটনার প্রতীক বলে নাকচ করে দিয়েছেন। কিন্তু, বিষয়টি একেবারে অসম্ভব নয়। কারণ, পরবর্তীকালে ধূমকেতু অমঙ্গলের প্রতীকে পরিণত হলেও প্রাচীনকালে ধূমকেতু সর্বক্ষেত্রে অবিমিশ্র মন্দ বলে বিবেচিত ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ষষ্ঠ শতাব্দীর ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির এর কথা বলা যায়, তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘বৃহৎ সংহিতায় প্রধানতঃ পূর্বসূরীদের মতামতের সারকথা একত্রে পরিবেশন করে রায় দেন আকার, আকৃতি, স্থায়ীত্ব ইত্যাদির তারতম্য অনুযায়ী ধূমকেতু শুভ বা অশুভ–দুয়েরই ইঙ্গিত বহন করতে পারে। শুধু তাই নয়, দুর্নামের পাশাপাশি কিছু সুনামও যে ধূমকেতুরা বেশ প্রাচীনকাল থেকেই অর্জন করে তাও তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।
আর এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে, বাইবেলোক্ত প্রাজ্ঞ-ব্যক্তিরা যান পূর্বদেশ থেকে এবং খুব সম্ভবতঃ তারা ধর্মবেত্তা পণ্ডিত ও জ্যোতিষী ছিলেন বলেই তারা আকাশে পরিলক্ষিত ঘটনার পার্থিব অর্থ করেছিলেন।
শুধু পূর্বদেশেই নয়, প্রতীচ্যেও ধূমকেতুকে মঙ্গলজনক ঘটনার সাথে যুক্ত করার অন্ততঃ একটি পুরোনো নজির রয়েছে, তাও খ্রিস্টের জন্ম প্রসঙ্গেই।
১৩০১ সালে হ্যালীর ধূমকেতু পৃথিবীর আকাশে দেখা দিয়েছিল এক মনোহররূপে এবং সে ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কিছুদিন পরেই ইতালীর সুধীশিল্পী জিয়োত্তো (Giotto) পাদুয়া (Padua) ভজনালয়ের জন্য একটি চিত্র অংকন করেন ‘অ্যাডোরেশন অব মেইজ মেজাই’ নামে।
প্রসিদ্ধ ওই চিত্রে তিনি জ্ঞানীব্যক্তিদের মাতার উপরে আকাশে একটি ধূমকেতুকেই স্থাপন করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টপূর্ব বারো অব্দের, ছাব্বিশে অক্টোবর পর্যন্ত আকাশে হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিয়েছিল।
এভাবে, সম্প্রতি খ্রিস্টধর্মের গোড়ার ইতিহাস গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত খ্রিস্টাব্দের গণনা ভুল এবং যীশু ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেননি, জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রচলিত খ্রিস্টীয় সনের এগারো বছর পূর্বে যখন বেথেলহেমের আকাশে হ্যালীর ধূমকেতু দেখা দিয়েছিল এবং সেখানকার খেজুর গাছে টাটকা-পাকা খেজুর ছিল, আর তখন মেষপালকরা রাত্রে তাদের মেষপালগুলো মাঠে চরাতে পারত।
ডিসেম্বর নিয়ে ভাবনা : এটি ক্রীষ্টমাস না কৃষ্ণমাস
খ্রিস্টান জাতি প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসকে ক্ৰীষ্টমাস হিসেবে যীশুখ্রিস্টের জন্মতিথি হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু এই মাসটি দু’হাজার বছর বা তারও বেশিসময় ধরে জড়িয়ে আছে আরেকটি নামের সঙ্গে। খ্রিস্টানদের পূর্বে, আরও বহু জাতি এই মাসে তাদের আনন্দোৎসব পালন করতো। রোমকরা পালন করতো ‘Saturnalia’ আনন্দোৎসব। টিউটনরা (Teuton) পালন করতে ‘ইয়ূল’ উৎসব (Yule Festival)। আর ইহুদীদের বিখ্যাত ‘হানুখাহ্’ (Hanukhah) বা Festivial of lights উৎসবটিও অনুষ্ঠিত হয় তাদের কিসলেভ (Kislev) মাসের ২৫ তারিখে, যা সাধারণতঃ ডিসেম্বর মাসেই পড়ে। আর এই উপমহাদেশে ভারতের হিন্দুরা খ্রিস্টজন্মের বহুবছর পূর্ব থেকেই পালন করে আসছে ‘গীতা-জয়ন্তী’ উৎসব এবং এই মাসকে তারা অভিহিত করে আসছে কৃষ্ণমাস নামে। কারণ, এই মাসে নাকি মহাভারতের যুগের হিন্দু অবতার কৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে গীতা উপদেশ দিয়েছিলেন। তাই হিন্দুরা কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বলে এই মাসকে ‘কৃষ্ণমাস’ নামে অভিহিত করে আসছে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, খ্রিস্টানদের ‘ক্রিষ্টমাস’ এবং হিন্দুদের ‘কৃষ্ণমাস’ উৎসব নিয়ে আধুনিক বক্তব্য বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।
পণ্ডিতগণ বলেন, কৃষ্ণমাস নামটি থেকেই মূলতঃ ক্রিষ্টমাস নামটি এসেছে। কারণ, কৃষ্ণের গীতা উপদেশের বহুপরে এমনকি রোম সভ্যতারও পতনের বহু পরে, মাত্র চতুর্থ শতাব্দীতে এসে ২৫শে ডিসেম্বর যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাই আমাদের বক্তব্য ক্রিষ্টমাস এবং ডিসেম্বর মাসের পার্থক্য নিয়ে।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর দ্বাদশ মাস বা শেষ মাস হলো ডিসেম্বর। প্রাচীন রোমক পঞ্জিকার দশম মাস। ‘ডিসেম্বর’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। ‘Decem’ শব্দের অর্থ হলো দশ। আবার ‘দশম’ শব্দটির ল্যাটিন রূপ হলো ‘Decem’। ‘দশম অম্বর’ বা ‘দশ-অম্বর হলো অম্বর বা আকাশের দশম অংশ। আকাশকে মোট বারোটি ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকটি ভাগকে একটি নির্দিষ্ট রাশির জন্য পৃথক করেন প্রাচীন ভারতীয়রা, যারা এই বারোটি রাশিচক্র অনুসারে বারো মাসের ভাগ ঠিক করেন। তাদের বছর আরম্ভ হতো মার্চ মাসের সময় থেকে। সে অনুসারে এই মাস দশম মাস। সূর্য তখন এই মাসে দশম রাশিচক্র অতিক্রম করতো। ভারতীয়দের এই অতিপ্রাচীন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক মাস বিভাগ পরবর্তীকালে প্রাচীন রোমকরা গ্রহণ করে। প্রথমে গ্রীকরা নিয়েছিল এই বিভাজন। তারপর নেয় রোমকরা। ফলে, এই মাস গ্রীক বা রোমকদের বছরের দশম মাস হিসেবেই নির্দিষ্ট ছিল। তাই মাসের নাম ‘Decem-mber’ বা ‘December’, যা সংস্কৃত ‘দশম-অম্বর’ বা দশ-অম্বর’-এর ল্যাটিন এবং পরবর্তীকালে শুধু রোমীয় রূপান্তর। সুতরাং, ‘December’ নামকরণটি এসেছে সংস্কৃত নামকরণ থেকে। তাই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীতে এই মাস দ্বাদশ মাস হলেও, প্রাচীন দশম মাসের নামটি এখনও ধরে রেখেছে এবং এই কথাই প্রমাণ করেছে যে গ্রীক ও রোমক সভ্যতা ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার কাছে বহুকাল থেকেই সম্যকভাবে ঋণী।
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে ভুল করেন যে, ক্রিস্টমাস হচ্ছে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। কিন্তু সংস্কৃত মাস’ শব্দটি থেকে বুঝা যায় যে, ক্রিষ্টমাস’ শব্দটির একটি পুরো মাস বোঝানোর সংস্কৃত ব্যঞ্জনা আছে। অনেকে এটাকে ‘X-mas’ ও বলেন। খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী ‘X-mas’-মানে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। এখানেও সেই একই ভুল। ‘x’ এই প্রতীকটি রোমানলিপিতে “১০” বুঝায়।’X mas’-অর্থ দশম মাস। আবার ল্যাটিন ‘Decem’ শব্দের অর্থও দশম। সুতরাং, ক্রিষ্টমাস বা ‘X-mas’-সম্পূর্ণ একটি মাসকেই বুঝাচ্ছে, কোন বিশেষ সপ্তাহ নয়। তাছাড়া, ‘mas’ (মাস) বলতে সম্পূর্ণ মাসটিই বোঝায়, কোন সপ্তাহ বা দিন নয়। ‘X-mas’-মানে দশম মাস, ‘December’ অর্থও দশম মাস এবং ‘Chirstmas’ অর্থ কৃষ্ণের নামে উৎসর্গীকৃত পুরো মাসটিই, বা কৃষ্ণমাস। এছাড়া, ‘Christmas Day’ বা ‘x-mas Day’ কথাটিও অর্থহীন। কারণ, এখানে মাসকে ‘Day’ বা দিনের সমার্থক ভাবা হচ্ছে। যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন বোঝাতে মাসটিকে ‘Christmas’ না বলে দিনটিকে বলা যেতো ‘Christ Day’। প্রাচীনকাল থেকে তা কিন্তু বলা হয়নি। তাই বলতে হচ্ছে : খ্রিস্টমাস কথাটি দু’হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে জড়িয়ে আছে এই মাসের আরেকটি নামের সঙ্গে।
ত্রিত্ববাদ ও যীশু
ত্রিত্ববাদ (Trinity) খ্রিস্টধর্মের বৈশিষ্ট্য। খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের মতে, খোদার তিন রূপ–পিতা খোদা (God the Father), পুত্র খোদা (God the Son) এবং পবিত্র আত্মা খোদা (God the Holy Spirit)। সাধু পৌল প্রচারিত এবং ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রাচীন খ্রিস্টান দুনিয়ার দ্বিতীয় সার্বভৌম ক্যাথলিক ধর্মসভার আহ্বায়ক সম্রাট থিয়োডোসিউস কর্তৃক ঘোষিত মতবাদ একের ভিতরে তিন (The Doctrine of the Trinity) অনুসারে খ্রিস্টানগণ বলেন পিতা, খোদা স্রষ্টা, সকল কিছুর আদি উৎস; পুত্র হিসেবে তিনি যীশুর মধ্যে মূর্ত এবং পবিত্র আত্মা হিসেবে তিনি সকল সৃষ্টির মধ্যে এবং আমাদের আত্মার মধ্যে বিরাজমান। এককথায়, খ্রিস্টানগণ বিশ্বাস করেন, একই খোদার সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমশক্তিসম্পন্ন তিনটি রূপের মধ্যদিয়ে প্রকাশ ঘটে–পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার। অর্থাৎ, খ্রিস্টানরা এক খোদয় বিশ্বাস করেও এক ঐক্যের মধ্যে তিনের বিভেদের কথা বলে থাকেন। তাদের মতে, পিতা খোদা, পুত্র খোদা এবং পবিত্র আত্মা খোদা–এই তিন খোদার প্রত্যেকটি হচ্ছেন পূর্ণ ও স্বতন্ত্র খোদা। আবার এই তিন খোদা মিলে হচ্ছে এক পূর্ণ খোদা। কিন্তু এই মতবাদ্ধ যে অবিশ্বাস্য এবং ব্যবহারিক জীবনে অচল তার প্রমাণ মেলে ভারতীয় একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ডক্টর মুফতি মুহম্মদ সাদেক-এর একটি উপমা থেকে।
‘১৯২০ সালে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে মুফতি মুহম্মদ সাদেক যান ভারত থেকে আমেরিকায়। সেখানে তিনি চিকাগোর ওয়াবাস (Wabash) এভিনিউতে একদিন এক বইয়ের দোকান-মালিককে খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদের (ত্রিত্ববাদের) অসারতা বুঝাতে গিয়ে একটি বই পছন্দ করেন। ঐ দোকানের সকল বইয়ের মূল্যই তিন সেন্ট ছিল। ফলে, দোকান-মালিক বইটির মূল্য তিন সেন্ট চাইলে ডক্টর সাহেব তাকে পকেট থেকে শুধু একটি সেন্ট বের করে দেন। এতে দোকান-মালিক তাঁকে জানালেন যে তিনি ভুল করছেন, তাকে আরও দু’সেন্ট দিতে হবে। এতে ডক্টর সাহেব তাঁকে বললেন, “সে কি কথা! আমি তো ঠিকই দিয়েছি; আপনি কি বিশ্বাস করেন না তিনে এক, একে তিন?” এতে দোকান-মালিক লজ্জিত হয়ে বললেন, “ওটা তো ধর্মের কথা, ব্যবসায়তে ওটা চলে না।” অথচ তিন খোদা এক এবং এক খোদা তিন এই জাজ্বল্যমান মিথ্যে মতবাদ প্রচার করে খ্রিস্টানরা বিশ্বকে বিভ্রান্ত করছে। পাশ্চাত্য জাতি সূক্ষাতিসূক্ষ্ম হিসেবে পারদর্শী হয়েও এক যে তিন হয় না এবং তিন যে এক হয় না, ধর্মের ব্যাপারে এই সহজ সত্য কথা তারা বুঝে না, তারা এমনি অন্ধ।’
যাহোক, ‘তিন খোদা এবং এক খোদা তিন’–এই অভিনবত্ব বাইবেলের নতুন নিয়মের সৃষ্টি, পুরাতন নিয়মে এমন নয়। সেখানে খোদা এক ও অদ্বিতীয়রূপেই ব্যাখ্যাত হয়েছে, যেমন–
১. “তোমরা যেন জানতে ও আমাকে বিশ্বাস করতে পারো এবং বুঝতে পারো যে, আমিই তিনি, আমার পূর্বে কোন খোদা নির্মিত হয়নি, এবং আমার পরেও হবে না। আমি, আমিই সদাপ্রভু আমি ভিন্ন আর ত্রাণকর্তা নেই” (যিশাইয়র, ৪৩ : ১০-১১)।
২. সদাপ্রভু এই কথা বলেন, আমিই আদি, আমিই অন্ত, আমি ভিন্ন আর কোন খোদা নেই” (যিশাইয়, ৪৪ : ৬)।
৩. “তথাপি আমিই মিশর দেশ অবধি তোমার খোদা সদাপ্রভু আমাকে ব্যতিরেকে আর কোন খোদাকে তুমি জানবে না এবং আমি ভিন্ন ত্রাণকর্তা আর কেউ নেই” (হোশেয়, ১৩ : ৪)।
৪. “সদাপ্রভু এই কথা বলেন, আমি সদাপ্রভু সর্ববস্তু নির্মাতা, আমি একাকী আকাশমণ্ডল বিস্তার করেছি, আমি ভূতল বিছিয়েছি, আমার সঙ্গী কে?” (যিশাইয়, ৪৪ : ২৪)।
৫. “এখন দেখ, আমি, আমিই তিনি, আমি ব্যতীত কোন খোদা নেই” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৩২: ৩৯)।
৬. “তবে তোমরা কার সাথে খোদার তুলনা দিবে? তাঁর সদৃশ বলে কি প্রকার মূর্তি উপস্থিত করবে? …. তুমি কি জ্ঞাত হওনি? তুমি কি শুননি? অনাদি অনন্ত খোদা, সদাপ্রভু, পৃথিবীর প্রান্তসমূহের সৃষ্টিকর্তা ক্লান্ত হন না, শ্রান্ত হন না; তার বুদ্ধির অনুসন্ধান করা যায় না” (যিশাইয়, ৪০: ১৮, ২৮)।
৭. “আকাশমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা সদাপ্রভু, স্বয়ং খোদা, যিনি পৃথিবীকে সংগঠন করে নির্মাণ করেছেন, তা স্থাপন করেছেন ও অনর্থক সৃষ্টি না করে বাসস্থানার্থে নির্মাণ করেছেন, তিনি এই কথা বলেন, আমি সদাপ্রভু, আর কেউ নয়” (যিশাইয়, ৪৫ : ১৮)।
৮. “হে প্রভু, দেবতাদের মধ্যে তোমার তুল্য কেউ নেই ….. কারণ, তুমি মহান এবং আশ্চর্য-কার্যকরী; তুমিই একমাত্র খোদা” (গীত সংহিতা, ৮৬: ৮, ১০)।
৯. “আর তারা জানুক যে, তুমি যার নাম সদাপ্রভু, একা তুমিই সমস্ত পৃথিবীর উপরে পরাৎপর” (গীত সংহিতা, ৮৩ : ১৮)।
১০. “পুরাকাল পর্যন্ত তুমি ভিন্ন আর কোন খোদা আছেন বলে লোকে শুনেনি, কর্ণে অনুভব করেনি, চক্ষুতে দেখেনি” (যিশাইয়, ৬৪ : ৪)।
১১. “আমাদের খোদা সদা প্রভুর তুল্য কেউ নেই” (যাত্রা পুস্তক, ৮:১০)।
১২. “সদাপ্রভুই খোদা, তিনি ব্যতীত আর কেউ নেই” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৪: ৩৫)।
১৩. “হে সদাপ্রভু, তোমার তুল্য কেউ নেই, ও তুমি ব্যতীত কোন খোদা নেই” (১ বংশাবলী ১৭ : ২০)।
১৪. “হে ইস্রায়ীল, শুন : আমাদের খোদা সদাপ্রভু একই সদাপ্রভু” (দ্বিতীয় বিবরণ; ৬: ৪)।
১৫. মনে রাখ যে, উপরিস্থ স্বর্গে ও নীচস্থ পৃথিবীতে সদাপ্রভুই খোদা, অন্য কেউ নেই” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৪: ৩৯)।
১৬. তোমরা আপনাদের খোদা সদাপ্রভুরই অনুগামী হও, তাঁকেই ভয় কর, তাঁরই আজ্ঞা পালন কর, তাঁরই রবে অনুধাবন কর, তারই সেবা কর ও তাতেই আসক্ত থাক” (দ্বিতীয় বিবরণ, ১৩ : ৪)।
১৭. “অতএব, হে সদাপ্রভু খোদা, তুমি মহান; কারণ তোমার তুল্য কেউই নেই, ও তুমি ব্যতীত কোন খোদা নেই, আমরা স্বকর্ণে যা যা শুনেছি, তদনুসারে ইহা জানি” (২ শমূয়েল, ৭: ২২)।
বাইবেলের নতুন নিয়ম পাঠ করলেও জানা যায়, যীশু কখনও তিন খোদার কথা প্রচার করেননি, বরং এক খোদা ও একত্ববাদই প্রচার করতেন, যেমন–
১. “হে ইস্রায়ীল! শুন, আমাদের খোদা প্রভু একই প্রভু; আর তুমি তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ, তোমার সমস্ত মন ও তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার খোদা প্রভুকে প্রেম করবে” (মার্ক, ১২ : ২৯-৩০; দ্বিতীয় বিবরণ, ৬ : ৪-৫)।
২. “সকলের খোদা ও পিতা এক, তিনি সবার উপরে, সবার নিকটে ও সবার অন্তরে আছেন” (ইফিষীয়, ৪ : ৬)।
৩. “এবং খোদা এক ছাড়া দ্বিতীয় নেই; … দেবতা নামে খ্যাত কিছু যদি স্বর্গে, অথবা পৃথিবীতে থাকে …. তথাপি আমাদের একমাত্র খোদা আছেন, তিনি পিতা, তার থেকে সকলই হয়েছে ও আমরা তারই জন্য” (করিন্থিয়, ৮: ৪-৬)
৪. “আমি আলফা এবং ওমিগা, আদি এবং অন্ত–ইহা প্রভু খোদা বলেন। যিনি আছেন ও যিনি ছিলেন ও যিনি বিরাজ করছেন, যিনি সর্বশক্তিমান” (প্রকাশিত বাক্য-১: ৮)।
যীশুকে ‘খোদার পুত্র খোদা’ বলার কল্পকাহিনী:
এখন খ্রিস্টানবিশ্ব যীশুখ্রিস্টকে খোদার পুত্র বলে জানে এবং বলে থাকে তিনি খোদার জীবন্ত প্রতিরূপ (Incarnation of God)। এই বিশ্বাসটি তাদের মতো আরও অনেক পৌত্তলিক জাতির মধ্যেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু যীশুর এই পুত্রত্বের সাথে খ্রিস্টান জগত আরও যেসব বিশ্বাস ও সংস্কারের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর নেই।
খ্রিস্টানদের মতে সাবেক সদাপ্রভু বা পিতা খোদাকে পূর্বে কেউ দেখেনি। অর্থাৎ “একজাত পুত্র, যিনি পিতার ক্রোড়ে থাকেন, তিনিই তাঁকে প্রকাশ করেছেন” (ব্যাপ্টিষ্ট মিশন, ১৯২৮-পরিবর্তনসহ)।
Begotten Son অর্থ ঔরসজাত পুত্র। সুতরাং, প্রথম পদের অর্থ হবে “একমাত্র ঔরসজাত পুত্র”। একজাত শব্দের দ্বারা Only begotten পদের যথার্থ তাৎপর্য জানা যায় না। তাছাড়া, বাইবেলে বলা হয়েছে যে, যীশুর আবির্ভাবের পূর্বপর্যন্ত যে খোদা কুদরতের কারখানা যথানিয়মে চালিয়ে আসছিলেন, সম্ভবতঃ নিরাকার বলে, কেউ তাঁকে দর্শন করতে পারেনি। কিন্তু যীশুখ্রিস্ট নিজেকে প্রকাশ করে, তাকেই জড় দেহের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছেন। সুতরাং, যীশুকে খোদার পুত্র করে দেয়ার জন্য খ্রিস্টান জগৎ পৌত্তলিকতার কোন অন্ত স্থলে গিয়ে উপনীত হয়েছে, এসব সংস্কার থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। অথচ, এটা কখনোই যীশুর শিক্ষা ছিল না। প্রাথমিক যুগের ধর্মপরায়ণ সাধু ব্যক্তিদের সাথেও এর কোন সম্বন্ধ সংস্রব ছিল না (দেখুন, Encyclopeadia of Biblica, “Son of God”)। এ সম্বন্ধে ভলতেয়ারের উক্তিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভলতেয়ার বলেন, খ্রিস্টের ঈশ্বরত্ব নিয়ে যে বিরাট প্রশ্নটি খ্রিস্টান ধর্মমণ্ডলীর হৃদয় আলোড়িত করেছিল, খ্রিস্টের পর ৩২৪ অব্দে রোম সম্রাট কনস্টেনটাইন কর্তৃক আহূত নিসিয়া সম্মেলনে তা মীমাংসিত হয়। এই সভায় অন্যূন আঠারোজন বিশপ এবং দু’হাজার সাধারণ পাদ্রী যীশুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করেন এবং তা নিয়ে বিরুদ্ধ-তর্ক করেন। কিন্তু অনেক ক্রদ্ধ বাদানুবাদ ও বিরুদ্ধ তর্কবিতর্কের পর যীশুকে ‘পিতা পরমেশ্বর কর্তৃকজাত তার একমাত্র পুত্র বলে ঘোষণা করা হয়। বিরুদ্ধবাদী আঠারোজন বিশপের অন্যতম এরিয়াস একত্ববাদী অর্থাৎ খ্রিস্টের ঈশ্বরত্বে আস্থাহীন ব্যক্তিদেরকে পরিচালিত করেন এবং এই কাজের জন্য তিনি ধর্মদ্রোহী বিবেচিত হওয়ায় নির্বাসিত হন। কিন্তু অবিলম্বেই কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) পুনরাহূত হয়ে নিজের ধর্মমতকে প্রবল করতে সমর্থ হন। ত্রিত্ববাদীদের নেতা। তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিরশত্রু এথানাসিয়াসের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার ধর্মমতসমূহ সমগ্র রোম জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।”
‘খ্রিস্টান পুরোহিতদের দ্বিতীয় সম্মেলন কনষ্টানটিনোপলে ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে বসেছিল। নিসিয়া সম্মেলনে ‘পবিত্র-আত্মা সম্বন্ধে যা অসীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল, এই সভায় তা পরিষ্কার করে নেয়া হয় এবং এই সম্মেলনে সিদ্ধান্তহয় যে, প্রভু পবিত্ৰাত্মাই মূলতঃ পিতা থেকে সমুৎপন্ন এবং পিতা ও পুত্রের সাথে একত্রে সম্মিলিত এবং একই সাথে গৌরবান্বিত হন। পবিত্র আত্মা পিতা এবং পুত্র থেকে জাত হয়েছেন। এই ধর্মমত নবম শতাব্দীর পর থেকে ক্রমশঃ লাতিন ধর্ম সম্প্রদায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে ইফিসাসে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সাধারণ সম্মেলনে ইহা নির্ধারিত হয় যে, মেরী প্রকৃতই ঈশ্বরের জননী। সুতরাং, যীশুর দুটি স্বভাব এবং একটি দেহ। এ নিয়ে নবম শতাব্দীতে লাতিন ও গ্রীক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষম মতভেদের সৃষ্টি হয়, এরপর পোপের পদ নিয়ে মতভেদের জন্য রোম শহরে অন্যূন ঊনত্রিশটি মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।” (Voltair Quoted, 6th Essay, P-23-24)।
যাহোক, এখন কিছু নজির উপস্থাপন করে দেখার প্রয়াস পাব যে যীশু খোদা অথবা খোদার পুত্র কোনটিই ছিলেন না; এরূপ দাবী তিনি কখনও করেননি; বরং, তিনি ছিলেন খোদার প্রেরিত একজন নবী–ভাববাদী।
বিনাপিতায় জন্ম খোদাত্বের প্রমাণ নয়:
জগতের দু’টি জাতি, খ্রিস্টান ও মুসলমান একমত পোষণ করে যে যীশুর জন্ম সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত হয়েছে। তবে খ্রিস্টান জাতি একে অতিপ্রাকৃতিক (Supernatural) বা অলৌকিক বলে এবং ইহুদীরা একে অবৈধ (illegitimate) বলে মনে করে (Jew. Ency.)। এছাড়া পারিবারিক জন্ম-তালিকাতেও যীশুর জন্ম এরূপেই লিপিবদ্ধ রয়েছে (Tulmud)। শুধু এই বাস্তব ঘটনাটিই গ্রহণযোগ্য প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করে যে, যীশুর জন্ম অসাধারণ ছিল। উল্লেখ্য, মথি লিখিত সুসমাচার অনুযায়ী মরিয়মের স্বামী যীশুর জন্মের পূর্বপর্যন্ত দাম্পত্য জীবনের কোন সম্পর্ক স্থাপন করেননি (১: ২৫)
প্রকৃতপক্ষে, খ্রিস্টান ও ইহুদী জাতি যীশুর জন্মকে অতিপ্রাকৃতিক ও অবৈধ বলে মনে করে, কিন্তু তাঁর জন্ম অতিপ্রাকৃতিকও ছিল না, অবৈধও ছিল না। অথচ, খ্রিস্টান জাতি যীশুর পিতৃহীন জন্ম’কে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে বলে থাকে যে, তিনি মানব-সৃষ্টির সাধারণ নিয়মের বিপরীত বিনাপিতায় জন্ম গ্রহণ করেছেন (মুসলমানরাও এ কথা স্বীকার করেন)। সুতরাং, এই অলৌকিক জন্মের জন্যই তাকে খোদা বলে মানতে হবে। কিন্তু জননীর জরায়ুতেই যে তার প্রথম সঞ্চার ঘটেছিল এবং অন্যান্য জরায়ুজ জীবের ন্যায়ই ভ্রুণ-জীবের বিভিন্ন রূপ, স্তর ও আকারের মধ্যদিয়েই যে তাঁকে ক্রমশঃ পুষ্ট ও বর্ধিত হতে হয়েছিল, তাতে কোন মতভেদ নেই। ণতত্ত্ব (Embryology) সম্বন্ধে যার সামান্য কিছু জানা আছে, তাঁকে স্বীকার করতে হবে যে, জরায়ুতে ভ্রুণের সঞ্চার হতে ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত বাইরের একটি শক্তি বা নিয়মের অধীন হয়েই তাকে নানারূপে পরিবর্তিত হতে হয়। এ নিয়মের অধীন হয়ে যাকে আত্মপ্রকাশ করতে হয় খোদা সে নয়। বরং, সেই নিয়মের নিয়ামক যিনি তিনিই খোদা।
খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের যুক্তি হল, যেহেতু বিনাপিতায় শুধু যীশুই জন্মগ্রহণ করেছেন সেহেতু তিনিই খোদার পুত্র। তাই, বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ করলে কেউ খোদার পুত্র হয় কিনা এবং এ ধরনের জন্য প্রকৃতিসম্মত কিনা তা আমরা প্রাচীন গ্রন্থ ও বিজ্ঞানের আলোকে আলোচনা করতে বা দেখতে পারি।
“কথিত আছে যে, লুম্বিনী উদ্যানে এক বিশেষ দর্শনলাভের পর রাণী মায়াদেবী গর্ভধারণ করেন এবং এমনিভাবে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। রাজা শুদ্ধোদন মহাত্মা বুদ্ধের প্রকৃত পিতা ছিলেন না। যোসেফের সাথে যীশুর যে সম্পর্ক শুদ্ধোদনের সাথেও গৌতমের সেইরূপ সম্পর্ক। মূলত, গৌতমের জন্য বিনাপিতায়ই হয়েছিল (Budhism in Christianity, By Arther lillie)
হিন্দুধর্মগ্রন্থ, মহাভারতে রয়েছে, যীশুখ্রিস্ট যেভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কর্ণও সেইভাবে বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বর্ণিত আছে, মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণের পিতামহ নূর তার প্রথমজাত সন্তানকে মানত করেন। এই মানতের পর এক কন্যা-সন্তান ‘পৃথা’ জন্মগ্রহণ করেন। পৃথাকে কুন্তিভোজের তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণ সেবায় রাখা হয়েছিল বলে ঐ কন্যা কুন্তি’ নামে আখ্যাত হন। কথিত আছে যে, কুন্তি দেবী কুমারীবস্থায় সূর্যের দ্বারা (প্রাকৃতিক নিয়ম) গর্ভবর্তী হন এবং কর্ণকে প্রসব করেন (আদি পর্ব, ১১১ অধ্যায়)।”
পূর্বোক্ত বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের দুটো নজির ছাড়াও প্রাচীন পারস্যবাসীদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস থেকে জানা যায়, খোদা ও মানুষের মধ্যে প্রধান মাধ্যম ‘মিথরা’র জন্ম হয়েছিল বিনাপিতায় একজন কুমারীর গর্ভে। আর এই বিশ্বাস খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দেও প্রচলিত থাকার প্রমাণ রয়েছে (দ্রষ্টব্য : Religions Of The World)।
অতএব, শুধু যীশুই যে বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ করেননি, তা বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং পারস্যে প্রচলিত একটি নজির থেকেও জানা গেল। প্রকৃতপক্ষে, বিনাপিতায় জন্মগ্রহণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। বিজ্ঞানের গবেষণায়ও বিষয়টি এখন সমর্থিত। কারণ, মাতৃগর্ভে (জরায়ুতে) উৎপন্ন ডিম্বাণুর দ্বারা সন্তান উৎপাদনের জন্য পিতৃপুরুষের সংমিশ্রণ যে একান্তই জরুরি, তা নয়। পুরুষ-বীর্যের সহায়তা ছাড়াই স্ত্রী ডিম্বাণুর স্ফুটন ঘটতে পারে, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘বিনা নরে জন্ম’ বা ‘পার্থেনোজেনেসিস’ (Parthenogenesis) বলা হয়। এ সম্বন্ধে The World Book of Dictionary বলে, কোন পুরুষ সংসর্গের প্রভাব ছাড়াই প্রজনন, যেমন কোন কোন কীট-পতঙ্গের মাঝে বিপরীত লিঙ্গের সংসর্গ ছাড়াই কুমারী স্ত্রী-ডিম্বকোষের উর্বরতা ঘটে থাকে, পার্থেনোজেনেসিস বা বিনা নরে জন্ম কীট পতঙ্গের মাঝে অতি সাধারণ হলেও বড় জাতের প্রাণীদের মাঝে তা কখনো কখনো ঘটে।
Macmillan Family Encyclopaedia (Vol. 15. P-100) বলে, নারীদের ক্ষেত্রে একটি ডিম্বকোষের মাঝে যখন প্রাথমিক বিভাজন ঘটে তখন দুটি কোষের উৎপত্তি হয়। কোষ দুটির প্রত্যেকটিতে নির্দিষ্ট (ডিপ্লয়েড) সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে। এদের একটি কোষ উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে ক্ষয়গ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় একে প্রাথমিক পোলার বডি বলা হয় এবং এটি অপর কোষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। ডিম্বকোষের প্রবৃদ্ধির এই স্তরে এসেই যৌন সংসর্গবিহীন বা বিনা-নরে জন্মদানের রতিক্রিয়ার উদ্দীপনা জোটে। এ ধরনের রতিক্রিয়াকালে ডিম্বকোষের দ্বিতীয় বিভাজন ঘটে। দু’ভাবে এটি ঘটতে পারে: হয় যুক্ত ক্রোমোজোম পৃথক হয়ে যাবে এবং প্রতিটি সদৃশ ক্রোমোজোম এলোমেলো কিছু পরিপূরক ক্রোমোজোমকে ফেলে দ্বিতীয় অবর্তী দেহ নিয়ে বাইরে বিক্ষিপ্ত হবে; না হয় দ্বিতীয় পোলার বডি সৃষ্টি হবে না। এ কারণে ডিম্বকোষের মাঝে নির্দিষ্ট (ডিপ্লয়েড) সংখ্যক ক্রোমোজোম রয়ে যাবে। যৌন সংসর্গবিহীন জন্ম কখনো কখনো এই দ্বিতীয় প্রকারের ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যেই ঘটে থাকে। উল্লেখ্য, রুশ বিজ্ঞানী Dr. Igor Golman বিনাপিতায় জন্ম লাভ সম্বন্ধে অনেক তথ্য প্রকাশ করেছেন এবং এরকম জন্মের সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন (Daily Express, Jesselton, 14 October, 1966)। তাছাড়া, Sunday Pictorial, November, 1955 সংখ্যায় প্রকাশিত হয় যে, বিজ্ঞানীদের মতে কোন কোন নারী দেহে একপ্রকার টিউমার হয়ে থাকে, এতে পুরুষের ন্যায় শুক্রকীটের উদ্ভব হয়। কখনো কখনো এই টিউমার থেকে শুক্রকীট বের হয়ে ডিম্বকোষে প্রবেশ করে এবং এতে কখনো কখনো গর্ভের সঞ্চার করে, যদিও তা খুবই বিরল। পত্রিকাটিতে কয়েকজন কুমারী মাতার নামও প্রকাশ করা হয়েছে। বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী Lancet-এ বলা হয়েছে যে, চিকিৎসা বিজ্ঞান তথা জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতির বিশেষ ব্যবস্থাধীনে যৌন-সংসর্গ ব্যতীত সন্তান জন্ম বা পুরুষের স্পর্শ ব্যতিরেকে নারীর সন্তান উৎপাদনের সম্ভাব্যতাকে অসম্ভব বলা যায় না। চিকিৎসাবিদগণ নারীর শ্রোণীতে বা নিাঙ্গের মধ্যে কখনো কখনো প্রাপ্ত ‘আরহেনোব্লাস্টোমা’ নামক একপ্রকার বিশেষ টিউমারের কারণে এই সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এসব টিউমার পুরুষ শুক্রাণু এবং পুং-জনন কোষ উৎপাদন করতে সক্ষম। যদি এই আরহেনোক্লাস্টোমা দ্বারা কোন নারীদেহে স্বক্রিয় বা জীবিত পুং-জনন কোষ সৃষ্টি হয় তবে সেই নারী কুমারী হলেও তার গর্ভধারণ করার সম্ভাব্যতা অস্বীকার করা যায় না। সেই নারীর দেহ এমনভাবে ক্রিয়াশীল হবে যেন কোন পুরুষ-দেহ থেকে শুক্রাণু সাধারণ প্রক্রিয়া দ্বারা অথবা কোন চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর সাহায্যে তার দেহে স্থানান্তরিত হয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপের স্ত্রীরোগ বিশারদগণ সন্তান-প্রসবের দৃষ্টান্ত প্রমাণ করতে এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন যেখানে প্রসূতি-মাতার কোন সম্পর্ক বা সংযোগ কোন পুরুষের সঙ্গেই ছিল না। Lancet-এর এই বিষয়টির বিস্তারিত তথ্য-বিবরণ লন্ডন থেকে W. B. Saunders & Co. কর্তৃক প্রকাশিত Anomalies and Curiosities of Medicine নামক পুস্তকে George M. Gould, A.M. M.D. এবং Walter L. Payle, A.M., M.D. কর্তৃক আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে :
“চিকিৎসাবিদগণ প্রাকৃতিক ‘পারথেনোজেনেসিস’ বা কোন পুরুষ সংসর্গ ছাড়াই শুধু নারীর দ্বারা সন্তান উৎপাদনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ধরনের উক্তিকে দ্বিধাহীনচিত্তে হাস্যম্পদ মনে হলেও জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে কতগুলো শর্তসাপেক্ষে এহেন সম্ভাবনাকে স্বীকার করতে হয়। ডক্টর টিমি এমন সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেন, ‘আরহেনোব্লাস্টোমা” নামে পরিচিত (পুরুষ এবং বীর্যর জন্য গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভূত) একপ্রকার টিউমার নারীর নিজের মধ্যে কখনো কখনো উৎসৃষ্ট হয়, যার ফলে এমন ঘটে। এ টিউমারগুলো পুরুষ শুক্রাণু বা পুং-জননকোষ উৎপাদন করতে সক্ষম। স্বভাবতঃই যদি এই পুরুষ শুক্রকোষগুলো জীবন্ত ও তৎপর হয়ে নারীর ডিম্বকোষে অথবা ডিম্বের সংস্পর্শে আসে, তবেই গর্ভসঞ্চার হতে পারে। এমন ঘটনার প্রক্রিয়ায় যৌক্তিকতা রয়েছে … … ডক্টর টিমি বলেন, ইউরোপে এমন বিশটি প্রাথমিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া গেছে, যাতে ‘আরহেনোব্লাস্টোমাই’ পুরুষ জননকোষ সৃষ্টি করেছে। আরহেনোরাস্টোমা এক ধরনের টিউমার, যাতে রাস্টোডারমিক কোষ থাকে। … এই কোষগুলোর গঠন-প্রক্রিয়া সৃজনশীল এবং যেকোন সময় বর্ধিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কাজেই আরহেনোরাস্টোমা’য় অবস্থিত এই অপরিপক্ক কোষগুলো যে অণ্ডকোষ-উপাদান সৃষ্টি করতে পারে এবং পুরুষ জীবকোষও সৃষ্টি করতে পারে বৈজ্ঞানিক মতে, তা সম্ভব। … যদি ‘আরহেনোব্লাস্টোমা’ প্রক্রিয়ায় নারীদেহে জীবন্ত পুরুষ শুক্রকোষ সৃষ্ট হয়, তাহলে নারীদেহে এমনকি কুমারী গর্ভে সন্তান উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং, এহেনবস্থায় নারীর নিজ দেহে একই অবস্থার সৃষ্টি হবে, যে অবস্থার সৃষ্টি হবে পুরুষ দেহ থেকে যদি জীবকোষ স্বাভাবিকভাবে অথবা চিকিৎসকের সাহায্যে নারীদেহে স্থানান্তরিত হয়।” –(আমেরিকান মেডিকেল জার্নাল)।
পত্রিকাটিতে পিতৃবিহীন সন্তান-জন্মের কয়েকটি ঘটনাও উল্লিখিত আছে :
“উত্তম নৈতিক চরিত্রের এক যুবতী গর্ভধারণ করেছিল অথচ এই উৎস সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্রও জ্ঞান ছিল না। …. পুরুষের সংস্পর্শবিহীন এক অবিবাহিতার গর্ভধারণের এমন এক ঘটনা রয়েছে যে, তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার সকল প্রকারের প্রচেষ্টাকে সে যুক্তি প্রমাণ দ্বারা কৃতিত্বের সাথে ব্যর্থ করে দিয়েছে। সে বিনাপিতায় গর্ভবতী হয় এবং সুগঠিত সুদর্শন এক কন্যা-সন্তান প্রসব করে।”
সুতরাং, মরিয়ম কিভাবে যীশুকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, উপরোকৃত তথ্যাদি থেকে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্তা’য়ালার কার্যকলাপ দুর্বোধ্য এবং তার শক্তিসমূহ অপরিসীম, যিনি সমগ্র বিশ্ব একটি ‘কুন’ (হও) শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। তিনি পদার্থে এমন পরিবর্তন ঘটাতে পারেন, যার ফলে যা বাহ্যতঃ দুর্বোধ্য বলে মনে হলেও তার সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
যাহোক, যীশুর বিনাপিতায় জন্মলাভের মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই, আর এজন্য তিনি খোদার পুত্র হতে পারেন না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, “সেইত তিনি, যিনি তোমাদের জরায়ুতে যেমন ইচ্ছা আকার দান করেন; তিনি ব্যতীত খোদা আর কেউ নেই–প্রবল প্রজ্ঞাময় তিনি” (৩ : ৫)। যীশু সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “ইন্না মাছালা ঈসা ইন্নাল্লাহি কামাছালি আদামা খালাকাহু মিন তুরাব (৩ : ৬০) অর্থাৎ আল্লাহর কাছে যীশুর জন্ম অস্বাভাবিক কিছু নয়–বরং আদামা বা অন্যান্য মানুষের জন্মের মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি যীশুসহ সকল মানুষকেই মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন। এখানে খ্রিস্টান প্রচারকরা যদি আদামা অর্থে শুধু একজন আদি মানব হযরত আদম (আঃ)-কে বুঝাতে চান, তাহলেও এ থেকে তাদের কুসংস্কারের প্রতিবাদ হয়ে যায়। কারণ, ধর্মীয় কারণে তারা বিশ্বাস করেন যে, হযরত আদম (আঃ) বিনাপিতামাতায় সৃষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং, যীশু ‘বিনাপিতায় পয়দা’ বলে যদি খোদার পুত্র খোদা হওয়ার অধিকারী হন তবে শুধু পিতা নয় মাতারও সংস্রব ছাড়া জন্ম যে হযরত আদমের, তিনি তো তার অপেক্ষা বৃহত্তর খোদা হওয়ার অধিকারী নন কি?
‘Son of God’ প্রসঙ্গঃ
খ্রিস্টানধর্ম প্রচারকগণ যীশুর খোদাত্বের প্রমাণস্বরূপ নতুন নিয়মে যীশুর জন্য ব্যবহৃত Son of God বা ‘খোদার পুত্র’। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, যীশুকে যেহেতু খোদার পুত্র, বলা হয়েছে, সেহেতু তারা খোদার পুত্রকেও খোদারূপে মান্য করেন। শাস্ত্রজ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই খ্রিস্টানরা এই ভ্রমে পতিত। যদি তারা ভালভাবে শাস্ত্রপাঠান্তে চিন্তা করতেন, তবে দেখতে পেতেন, বাইবেলের নতুন ও পুরাতন উভয় নিয়মেই খোদাপ্রাপ্ত অসংখ্য পবিত্র ব্যক্তিকে রূপকভাবে ‘খোদা বা খোদার পুত্র’ আখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু এজন্য তারা কেউই প্রকৃত খোদা বা খোদার পুত্র হয়ে যাননি। যেমন–ইহুদীরা যখন যীশুকে পাথর মারতে উদ্যত হয় তখন যীশু বললেন, “কেন আমাকে পাথর মার? ইহুদীরা তাকে উত্তর দিল, কারণ, তুমি মানুষ, অথচ নিজেকে খোদা করে তুলছ, এজন্য। যীশু তাদেরকে উত্তর দিলেন, তোমাদের ব্যবস্থায় কি লেখা নেই, ‘আমি বললাম, তোমরা খোদা’? যাদের নিকট খোদার বাক্য উপস্থিত হয়েছিল, তিনি যদি তাদেরকে খোদা বললেন–আর শাস্ত্রের খণ্ডন ত হতেই পারে না–তবে যাঁকে পিতা পবিত্র করলেন ও জগতে প্রেরণ করলেন, তোমরা কি তাকে বল যে, তুমি খোদা নিন্দা করছ। কারণ, আমি বললাম যে, আমি খোদার পুত্র?” (যোহন, ১০: ৩২-৩৬)। এখানে ইহুদীদের মিথ্যা অপবাদ খণ্ডন করে যীশু বলছেন যে, ইহুদী-শাস্ত্ৰ গীত সংহিতার ৮২: ৬ পদে যেরূপ রূপকভাবে খোদার বাক্য লাভকারী ব্যক্তিদেরকে খোদা বলা হয়েছে তেমনই তিনিও রূপকভাবে খোদার পুত্র। অন্যত্র যীশু বলেন, “ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা খোদার পুত্র বলে আখ্যায়িত হবে।” (মথি, ৫: ৯)। এরূপ বাইবেলে আরও বহু লোককে রূপকভাবে খোদার পুত্র বলা হয়েছে। যেমন–“সদাপ্রভু এই কথা বলেন, ইস্রায়ীল আমার পুত্র, আমার প্রথম জাত” (যাত্রা পুস্তক, ৪ : ২২)। “তুমি আমার পুত্র” (গীত সংহিতা, ২ : ৭)। “শলোমন খোদার পুত্র” (১ বংশাবলী, ২২ : ১০; ২৮ : ৬)। “যত লোক খোদার হুকুম দ্বারা চালিত হয়, তারাই খোদার পুত্র” (রোমীয়, ৮: ১৪)। “আমরা খোদার সন্তান” (রোমীয়, ৮ : ১৬)। “তোমরা আপনাদের খোদা সদাপ্রভুর সন্তান” (দ্বিতীয় বিবরণ, ১৪ : ১)। “আমাদের একমাত্র পিতা আছেন, তিনি খোদা” (যোহন, ৮: ৪১) “খোদা আপন পবিত্র বাসস্থানে পিতৃহীনদের পিতা” (গীত সংহিতা, ৬৮ : ৫)। “পৃথিবীতে কাউকে ‘পিতা’ বলে সম্বোধন করো না, কারণ তোমাদের পিতা একজন, তিনি সেই স্বর্গীয়” (মথি, ২৩ : ৯) অতএব, যীশু খোদা অথবা খোদার পুত্র নন, তিনি খোদার বাক্য লাভকারী এক পবিত্র ভাববাদী, নবী। বাইবেলে অন্যান্য লোককে যেমন খোদার পুত্র বলা হয়েছে, তেমনই যীশুকেও খোদার পুত্র বলা হয়েছে রূপকভাবে।
যীশুকে বাইবেলে খোদার পুত্র কেন বলা হয়েছে সে বিষয়ে একটি উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক ও হিব্রুতে ‘খোদার পুত্র’ স্থলে ‘বেনে এলোহীম’ বলা হয়েছে, এর অর্থ অত্যন্ত প্রিয়, রাজা, স্বর্গীয় দূত, ‘খোদার সেবক’ (দেখুন Gesenius কৃত Hebrew And English Lexican, English Translation–J. W. Gibbs, page-34)। এছাড়া, খোদার পুত্র বা ঈশ্বরপুত্র শব্দটি একটি সম্মানসূচক রাজকীয় পদবী। রোমান সম্রাট এই উপাধিটি (ডিভি/ফিলিউস) ধারণ করতেন। কিন্তু, যীশু এসবে খুবই বিরক্ত হতেন এবং বারবার লোকদেরকে এ বিষয়ে সাবধান করতেন যদিও নিবৃত্ত করতে পারতেন না।
বার্ণাবার উত্তর:
বার্ণাবা, যিনি পৌলের সহপ্রচারক ও বন্দী জীবনের সঙ্গী তিনি তাঁর সুসমাচারে যীশুর একত্ববাদ প্রচারের কথা উল্লেখ করে লিখেন, “যারা যীশুকে খোদার পুত্ররূপে পূজা করে তাদের উপর মহাত্মা যীশু অভিসম্পাত বর্ষণ করেছেন। যেমন, ‘Crused be every One who shall insert into my Saying that I am the Son of the God’ (Chapter-53)। বার্ণাবা তাঁর সুসমাচারের শেষ–২২২ অধ্যায়ে লিখেন, Certain evil men, …. preached, and yet preach, that Jesus is the Son of God, among whom is Paul decived, অর্থাৎ কয়েকজন অপবিত্র লোক … প্রচার করে থাকে যে, যীশু খোদার পুত্র, আর এসব প্রচারকদের মধ্যে প্রতারিত পৌলও একজন।
যীশুর অলৌকিক কীর্তিকলাপ খোদাত্বের প্রমাণ?
খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা যীশুর খোদাত্বের প্রমাণস্বরূপ বলে থাকেন যে, যীশু নানাপ্রকার অলৌকিক কাজ করেছেন, যা খোদা ব্যতীত অন্য কারও দ্বারা অসম্ভব। যেমন : মৃতকে জীবিত করা, অন্ধকে দৃষ্টিদান করা কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্যদান প্রভৃতি। এর স্বপক্ষে তারা পবিত্র কোরআনের ৩: ৫০ আয়াতের উল্লেখ করে বলে থাকেন যে, কোরআনেও যীশুর খোদাত্ব স্বীকার করা হয়েছে এবং কোরআনের কোন কোন তাফসীরকারও যীশু কর্তৃক “মৃত্তিকার দ্বারা পাখির আকৃতি গঠনপূর্বক ফুস্কার প্রদান করে তাকে জীবিত পাখিতে পরিণত করা, মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধকে দৃষ্টিশক্তি প্রদান করা এবং কুষ্ঠ-রোগীকে স্পর্শমাত্র আরোগ্য করা …. এতদ্ভিন্ন সমবেত লোকদের খাদ্য-পানীয় এবং সংগৃহীত দ্রব্যাদি সম্বন্ধেও নানারূপ বিস্ময়কর সংবাদ” দেয়া সম্বন্ধে বিশ্বাস ও সংস্কারের পূর্ণ সমর্থন করেছেন।
মাওলানা মোহাম্মদ আলী হাসান বলেন, “বাইবেলে হযরত ঈসা কর্তৃক জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান, কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য এবং মৃতকে জীবিত করার প্রথা লিপিবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু মৃন্ময় পক্ষীকে সজীব করার কথা উল্লিখিত হয়নি। ইহুদীরা ঐসব কথায় সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী। খ্রিস্টানরাও বাইবেলে যা লিখিত আছে, তদ্ব্যতীত অন্যকথার প্রতি অবিশ্বাসী। আধুনিক কোন কোন তাফসীরকার হযরত ঈসার অলৌকিক নিদর্শন সম্বন্ধে পবিত্র কোরআন ও বাইবেলে যে-সব উক্তি আছে, তার সবগুলোকেই রূপক বর্ণনা বলে অভিহিত করছেন তাঁরা বলেন, “আল্লাহ ব্যতীত অপরের পক্ষে মৃতকে জীবন দান করা, কোন নতুন জীব সৃষ্টি করা কিংবা প্রাকৃতিক শক্তিকে স্বীয় আজ্ঞাধীন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব”। তাদের মতে, মৃন্ময় পক্ষী-মূর্তিকে সজীব করার অর্থ তুচ্ছ মাটির মানুষকে আধ্যাত্মিক জীবন্ত-শক্তি প্রদান করা, মৃতকে জীবিত করার অর্থ অবনত ও পতিত জাতিকে উন্নত ও শক্তিশালী করা এবং অন্ধকে দৃষ্টিদান, খঞ্জকে চলৎশক্তি, রোগীকে আরোগ্য ও বধিরকে শ্রবণশক্তি দান করা (নতুন নিয়ম) প্রভৃতির অর্থ ধর্মহীনকে ধর্ম শিক্ষাদান, পথভ্রান্তকে পথ-প্রদর্শন, অজ্ঞানান্ধকে জ্ঞানের আলোক বিতরণ এবং নির্বোধ মুখদেরকে ধর্মজ্ঞান ও উপদেশ প্রদান প্রভৃতি। তঃ কবির, বয়জবী ও বাঃ কোঃ মঃ আঃ প্রভৃতি তুলিতব্য।” (তরজমা ও তাফসীর, ১ম খণ্ড, ১৭১-৭২ পৃষ্ঠা, ওসমানিয়া লাইব্রেরি, কলকাতা)।
পবিত্র কোরআনের ৩ : ৫০ আয়াতে বলা হয়েছে, ফেরেশতা কর্তৃক যীশু তাঁর স্বজাতীয়দের কাছে কি বলবেন, কি করবেন সেই ভাবী বিষয়গুলো যীশুর বিশেষ নিজস্ব ভাষায় মরিয়মের নিকট অভিব্যক্ত হয়েছে। যীশু বনী ইস্রায়ীলের নিকট রসূলরূপে প্রেরিত হয়ে বলেছিলেন :
“… আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্য কাদা থেকে পাখির আকার সদৃশ সৃষ্টি করব; অতঃপর তাতে আমি ফুঙ্কার করব, ফলে তা আল্লাহর আদেশে উড্ডয়নশীল হবে এবং আমি আল্লাহর আদেশে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করব এবং মৃতদেরকে জীবনদান করব এবং তোমরা কি খাবে এবং তোমাদের ঘরে কি সঞ্চয় করবে সে বিষয়ে তোমাদেরকে আমি অবহিত করব। নিশ্চয় এর মধ্যে তোমাদের জন্য এক নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা মোমেন হও।”
এখানে আয়াতের বিভিন্ন অর্থবাচক শব্দগুলোকে সাধারণ অর্থে গ্রহণ করলে স্বীকৃত হয়, সৃষ্টি করার, মাটি দিয়ে পাখি তৈরি করার এবং মৃতদেরকে জীবিত করার শক্তি যীশুর ছিল এবং সে শক্তি নিশ্চয় তিনি প্রয়োগও করেছেন। কিন্তু কোরআনের নৈতিক শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন তাৎপর্য গ্রহণ করা মোটেই সঙ্গত হবে না। কেননা, পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে:
“এবং তারা তাঁর পরিবর্তে এমন মা’বুদ গ্রহণ করেছে যারা কোন কিছু সৃষ্টি করে না বরং নিজেরাই সৃষ্ট, বস্তুতঃ তারা নিজেদের জন্যও না কোন উপকার এবং না কোন অপকার করার ক্ষমতা রাখে এবং না জীবন না মরণ এবং না পুনরুথানেরই তারা কোন ক্ষমতা রাখে।” (২৫ : ৪)।
“হে মানবমণ্ডলী! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর নিশ্চয় তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকছ, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্র হলেও। এবং মাছি যদি তাদের নিকট থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা তাও তার নিকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে অন্বেষক ও অস্পেষিত উভয়ই কত দুর্বল” (২২ : ৭৪)।
এই আয়াত দুটো থেকে জানা যায় যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তার আসনে বসানো হয়েছে (১) সৃষ্টির অধিকার তাদের নেই (২) কারও মৃত্যু ঘটানোর অধিকার তাদের নেই। (৩) কাউকে জীবনদানের অধিকার তাদের নেই। (৪) কোন মৃতকে জীবিত করার শক্তি তাদের নেই।
সুতরাং, ভ্রষ্ট মানব-সমাজ এ পর্যন্ত যাদেরকে আল্লাহর অংশীদাররূপে গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম যীশুখ্রিস্ট যে ঐ গুণ চতুষ্টয়ের অধিকারী ছিলেন না, তা স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, মানুষ একবার মরে যাবার পর কিয়ামত পর্যন্ত তার পুনর্জীবিত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন–পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন :
“এবং প্রত্যেক জনপদের জন্য, যাকে আমরা ধ্বংস করেছি তার সম্পর্কে হারাম (অলঙ্ঘনীয় বিধান) করা হয়েছে যে, তার অধিবাসীবৃন্দ পুনরায় কখনও ফিরে আসবে না” (২১ : ৯৬)।
হাদিসে আছে, আল্লাহতায়ালা শহীদদেরকে তাদের প্রার্থনা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করছেন : “হে আমার বান্দা, আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে তা দান করব।’ শহীদরা তখন বলে : আমাদের কোনই অভাব নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার ঐরকম প্রশ্ন হওয়ার এবং তাদের পক্ষ থেকে ঐধরনের উত্তর দেয়ার পরও যখন আল্লাহ ঐরূপ জিজ্ঞেস করেন, শহীদরা তখন বলেন, হে প্রভু, আমাদের একমাত্র আকাঙ্গ আপনি আবার আমাদেরকে জীবিত করে দুনিয়ায় পাঠান, আবার আমরা আপনার নামে জেহাদ করি এবং শহীদরূপে নিহত হই। তখন আল্লাহ বলেন : ‘আমার অল্য নির্দেশ : মৃতেরা আর দুনিয়ায় ফিরবে না।’ (মুসলিম শরীফ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ প্রভৃতি)।
প্রকৃতপক্ষে, যীর মূল শিক্ষা থেকে খ্রিস্টান সমাজ কতদূর ঋলিত হয়েছে, নাজরান ডেপুটেশনকে তা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যই যীশুর নিজমুখের উক্তি ৩: ৫০ আয়াতে তারই ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। এরমধ্যে যে গূঢ় তত্ত্ব নিহিত আছে, তা জানতে যীশুর জীবনচরিতের আশ্রয় নিতে হবে। তাঁর জীবনেতিহাস রচয়িতারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, যেকোন কারণেই হোক, যীশু জনসাধারণের মধ্যে তার ধর্মমত প্রচার করতেন রূপকভাবে (Allegorical) উপমা উদাহরণের মাধ্যমে।
মথি বলেছেন :
“তখন তিনি উপমাদ্বারা তাদের নিকট অনেক কথা বললেন (১৩ : ৩) পরে শিষ্যেরা তাঁর কাছে এসে তাঁকে বললেন, আপনি কি কারণে উপমাঘারা এদের নিকট কথা বলছেন? তিনি উত্তরে তাঁদের বললেন, স্বর্গরাজ্যের নিগূঢ় তত্ত্বগুলো তোমাদের জানতে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের দেয়া হয়নি। কারণ, যার আছে, তাকে দেয়া হবে, আর তার উপচে পড়বে; কিন্তু যার নেই, তার যা আছে তাও তার কাছ থেকে নেয়া হবে। এজন্য, আমি উপমা দ্বারা তাদের নিকট কথা বলি, কারণ তারা দেখেও-দেখে-না আর শুনেও-শুনে-না এবং বুঝেও-বুঝে-না” (১৩ : ১০-১৩)।
মার্ক বলছেন :
“তিনি উপমা দ্বারা তাদের অনেক বিষয় শিক্ষা দিলেন (৪ : ৩) পরে যখন তিনি একাকী ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গীরা সেই বারোজন শিষ্যকে নিয়ে তাঁকে উপমা কয়টির বিষয় জিজ্ঞেস করলেন। তিনি তাঁদের বললেন, খোদার রাজ্যের নিগঢ়-তত্ত তোমাদের জানতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যারা বাইরে রয়েছে, তাদের জন্য সমস্ত কিছুই উপমা দিয়ে বলা হয়”। যেন তারা যদিও দেখে তবুও প্রত্যক্ষ না করে, যদিও শুনে তথাপি না বুঝে, পাছে তারা ফিরে আসে ও তাদের ক্ষমা করা হয়।‘ পরে তিনি তাদের বললেন, তোমরা এই উপমাটি যখন বুঝতে পারলে না, তখন অন্যান্যগুলোর অর্থ কি করে বুঝবে?” (৪:১০ : ১৩)।
পূর্বোক্ত বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, যীশু জনসাধারণের মধ্যে রূপক ভাষায় উপমা উদাহরণের মধ্যদিয়ে ধর্মকথা প্রচার করতেন, যার মর্ম তারা কিছুই বুঝতে পারত না। এমনকি, তার অন্তরঙ্গ শিষ্য-সহচরদের পক্ষেও অনেক সময় সে সবের মর্ম গ্রহণ করা ছিল অসম্ভব। এজন্য, বাড়ি গিয়ে তিনি তার মর্ম শিষ্যদেরকে বুঝিয়ে দিতেন।
অতএব, যীশু কি বলেছেন, না বলেছেন তার প্রকৃত মর্ম যখন তৎকালীন জনসাধারণ এমন কি শিষ্য-সহচররা পর্যন্ত বুঝতে পারতেন না, বর্তমান খ্রিস্টানদের তো বুঝার প্রশ্নই ওঠে না; অধিকন্তু যীশুর কাছে জিজ্ঞেস করার কোন সুযোগ-সুবিধা যখন এখন নেই তখন ৩ : ৫০ আয়াতের অবোধ্য উক্তি নিয়ে যীশুখ্রিস্টের অতিমানুষী বা খোদায়ী-সরূপের ভিত্তি খোঁজা খ্রিস্টান প্রচারকদের সঙ্গত নয়।
যুক্তরাজ্য থেকে ১৯৮৮ সালে Islam International Publications Limited কর্তৃক প্রকাশিত The Holy Quran, Vol. 2, p-401-404-এ আলোচ্য আয়াতের টীকায় বলা হয়েছে :
“বাইবেলের কোথাও উল্লেখ নেই যে, ঈসা (আঃ) মোজেযা প্রদর্শন করার জন্য পাখি সৃষ্টি করে আকাশে উড়িয়েছেন। সত্যি সত্যি যদি ঈসা (আঃ) পাখি বানিয়ে উড়িয়ে থাকতেন, তবে বাইবেলে তা কিভাবে ও কেন অনুল্লিখিত থাকল? আল্লাহর কোন নবী পূর্বে এ ধরনের ঐশী নিদর্শন দেখাননি। অথচ, বাইবেল এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। বাইবেলে এই মহা-নিদর্শনের উল্লেখ থাকলে, সকল নবীর উপর ঈসা (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হত এবং পরবর্তীকালের খ্রিস্টানরা ঈসার প্রতি যে ঈশ্বরত্ব আরোপ করেছে, তাও কিছুটা সমর্থন লাভ করত। খালক’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়–মাপ বা ওজন করা, পরিমাপ ঠিক করা, নক্সা তৈরি করা, আকৃতি দেয়া, পোশাক তৈরি করা, সৃষ্টি করা ইত্যাদি। সৃষ্টি করা অর্থে ‘পালক’ শব্দটি কোরআনের কোথাও আল্লাহর কাজ ছাড়া অন্য কারও কাজ বলে স্বীকৃতি পায়নি; আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও প্রতি এই গুণটি কোরআনের কোথাও আরোপিত হয়নি (১৩ : ১৭; ১৬ : ২১; ২২: ৭৪; ২৫ : ৪; ৩১:১১-১২, ৩৫ : ৪১ এবং ৪৬ : ৫)।
পূর্বোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে এবং কাদা-মাটির রূপক অর্থ সম্মুখে রেখে ‘তোমাদের জন্য কাদা-মাটি থেকে আমি পাখির অবস্থার অনুরূপ সৃষ্টি করব, অতঃপর তার মধ্যে আমি নবজীবন) ফুৎকার করব, ফলে তা আল্লাহর আদেশে উড্ডয়নশীল হয়ে যাবে ইত্যাদি কথার মর্ম বুঝার চেষ্টা করলে, তার তাৎপর্য দাঁড়াবে এই যে, সাধারণ অনভিজাত লোক, যাদেরমধ্যে উন্নতি ও জাগরণের শক্তি রয়েছে, তারা যদি ঈসা (আঃ)-এর সংস্পর্শে আসে ও তার বাণী গ্রহণ করে জীবনযাপন করে তবে তাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসে যাবে। ধূলি ধূসরিত, সংসারাসক্ত, বস্তু-কেন্দ্রিক জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে, তারা অধ্যাত্মিক আকাশের উচ্চমার্গে পাখির মত বিচরণ করতে সমর্থ হবে এবং প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটেছিল। ঘৃণিত, অবহেলিত গালিলীর জেলেরা, তাদের প্রভু ও গুরুর উপদেশ ও উদাহরণ অনুসরণের মাধ্যমে, পাখিরই মত উচ্চমার্গে আরোহণ করে, বণী ইস্রায়ীল জাতির মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচারের তৌফিক লাভ করেছিল। অন্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিদের রোগমুক্তির বা উপশমদানের সম্বন্ধে বলা যায়, এ ধরনের রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে বণী-ইস্রায়ীল জাতি অপবিত্র ও নোংরা জানে, এদেরকে সমাজের সংশ্রব থেকে দূরে রাখত; সমাজে ঘেঁষতে দিত না। … … ‘আমি মুক্ত করে দিব কথাটির তাৎপর্য এই যে, এসব রোগাক্রান্ত লোকেরা আইনগত ও সমাজগতভাবে, অবহেলিতবস্থায় বহু বঞ্চনা ও অসুবিধার মধ্যে ঘৃণিত পরিবেশে বাস করত। ঈসা (আঃ) এসে তাদেরকে সেবা-যত্ন করার তাগিদ দিয়ে, সমাজে তাদেরকে স্থান দান করে, তাদেরকে দুর্বিসহ জীবন থেকে মুক্ত করেছিলেন। এও হতে পারে যে, ঈসা (আঃ) এসব রোগীকে সুস্থ করতেন। … … আল্লাহর নবীগণ আধ্যাত্মিক চিকিৎসকবিশেষ; তারা আধ্যাত্মিক অন্ধদেরকে চক্ষুদান করেন, বধিরকে শ্রবণশক্তি দান করেন, আধ্যাত্মিক মৃতদেরকে জীবনদান করেন (মথি, ১৩ : ১৫)।…… আমি মৃতের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করব’ বাক্যটির অর্থ এটা নয় যে, ঈসা (আঃ) মৃত ব্যক্তিকে সত্যিই জীবিত করেছিলেন। যারা প্রকৃতই মরে যায়, তারা পৃথিবীর বুকে কখনও পুনরুজ্জীবিত হয় না। এ ধরনের বিশ্বাস কোরআনের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত (২ : ২৯; ২৩:১০০-১০১; ২১ : ৯৬; ৩৯ : ৫১-৬০; ৪০ : ১২; ৪৫ : ২৭)।… … প্রকৃতপক্ষে, আধ্যাত্মিক পরিভাষা মতে, নবীগণ তাঁদের অনুসারীদের জীবনে যে বৈপ্লবিক ও অসাধারণ মহাপরিবর্তন আনেন, তাকেই বলা হয় মৃতকে জীবিত করা।… … এবং তোমরা কি খাবে এবং তোমাদের ঘরে কি সঞ্চয় করবে বাক্যাংশটির সামগ্রিক অর্থ দাঁড়ায় : ঈসা (আঃ) তাঁর শিষ্যদেরকে শিক্ষা দিবেন, দিনযাপনের জন্য তারা কি পরিমাণ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খরচ করবে এবং কি পরিমাণ তারা বাঁচাবে অর্থাৎ, পরকালে পাবার জন্য খরচ করবে। অন্যকথায়, ঈসা (আঃ) তাদেরকে বললেন, তারা ন্যায়ভাবে যা উপার্জন করবে, তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে, এবং অবশিষ্ট অর্থ আল্লাহর পথে খরচ করবে। আর আগামীদিনের কথা আল্লাহ্’র উপর ছেড়ে দিবে (তুলিতব্য, মথি, ৬ : ২৫- ২৬)।”
মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সাহেব আলোচ্য আয়াতের বিস্তারিত আলোচনার পর আয়াতের ভাবার্থে বলেন,
“হযরত ঈসা (আঃ) যা যীশুখ্রিস্ট আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হয়ে প্রথমেই ঘোষণা করেছিলেন যে, হে ইস্রায়ীলকুল, তোমাদেরকে প্রকৃতিগত মূল উপাদান (তীন) হতে আবার তোমাদেরকে পূর্বের ন্যায় একটি মহাজাতিরূপে গঠনের চেষ্টা করব, এজন্য প্রথমে গঠন করব–জাতির কাবুদ মাত্রকে। তারপর সে কালবুদের মধ্যে স্বর্গীয় প্রেরণা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে জানা সমাজকে দিব্য দৃষ্টিদানে–নানা জঘন্য ব্যভিচার ব্যধি-কলুষিত জাতিকে আল্লাহর অনুমতিক্রমে এক মুক্ত জীবন্ত ও উধ্বগতি উন্নতমুখী জাতিতে পরিণত করে দেব। এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে–মূর্খতা ও পাপাচারে যাদের জ্ঞান ও বিবেক মরে গেছে, যাদের হৃদয় সত্যের অনুভূতি শক্তি থেকে বঞ্চিত ও অসাড় হয়ে পড়েছে, তাদের মধ্যে মুক্ত জ্ঞানের ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার স্বর্গীয় প্রেরণা জাগ্রত করে আবার তাদেরকে ধর্মের হিসেবে জীবন্ত করে তুলব। আর পার্থিব জীবনের ভোগ ও পারলৌকিক জীবনের সঞ্চয় কি হবে তাও তোমাদের জ্ঞাত করব। এই মিশন ও এই সাধনা নিয়েই আমি তোমাদের প্রভুর সন্নিধান থেকে তোমাদের সমীপে প্রেরিত হয়েছি।”
অবশেষে, খ্রিস্টান প্রচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় যে, যীশু যেসব জুরা, মৃত্যু এবং ব্যধিগ্রস্ত লোককে আরোগ্য দান করেছিলেন, তারা কেউই প্রকৃতপক্ষে দৈহিকভাবে রোগাক্রান্ত বা মৃত ছিল না; বরং পাপের ফলে আত্মিক দিকদিয়ে মৃত বা ব্যধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল বলে খোদ বাইবেলেই প্রমাণ রয়েছে, যেমন যীশু এক পক্ষাঘাতকে আরোগ্য দান করে বললেন, “তোমার পাপ ক্ষমা হলো।” (মথি, ৯ : ২)। এখানে পাপমুক্ত হওয়ায় যে রোগ আরোগ্য হয়ে গেল তা আত্মিক ব্যাধি ছাড়া অন্য কিছু নয়। অন্য এক রোগীকে সুস্থ করে বললেন, “দেখ তুমি সুস্থ হলে, আর পাপ করো না।” (যোহন, ৫: ১৪)। অর্থাৎ, পুনরায় পাপ করলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। এস্থলেও আত্মিক দিকদিয়ে সুস্থ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। আত্মিক মৃত সম্বন্ধে শিষ্যদের মধ্যে আর একজন তাঁকে বললেন,
“প্রভু, প্রথমে আমার পিতাকে কবর দিয়ে আসতে অনুমতি দিন। কিন্তু যীশু তাঁকে বললেন, আমার অনুসরণ কর; মৃতেরাই নিজেদের মৃতদের কবর দিক” (মথি, ৮: ২১-২২)।
প্রকৃত মৃতদের দ্বারা অন্য মৃত ব্যক্তিদের কবর দেয়া কখনও সম্ভব নয়। কেবল আত্মিক মৃতদের দ্বারাই তা সম্ভব। এমন আত্মিক মৃতকে প্রত্যেক নবীই জীবিত করতে পারতেন। যেমন–পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে,
“হে বিশ্বাসীরা! আল্লাহ এবং রসুলের আহবানে সাড়া দাও, যখন তিনি আহবান করেন তোমাদেরকে জীবিত করার জন্যে। (৮: ২৫)।
প্রকৃতকথা হলো, যীশুসহ আরও অনেকেই এসব কাজ করতে সক্ষম ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও সক্ষম হবেন বলে খোদ বাইবেলেই বলা হয়েছে, যেমন–এলিয় এক মহিলার মৃত পুত্রকে জীবিত করে তুলেছিলেন (১ রাজাবলী, ১৭ : ২১-২২)। ইলীশায় নামান নামীয় কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্যদান করেছিলেন (২ রাজাবলী, ৫: ১-১৪)। অন্যেরাও ভূত ছাড়াতে সক্ষম (মার্ক, ১৬ : ১৭) যীশুর ন্যায় অদ্ভুত কাজ আরও অনেকেই করতে পারে (মথি, ২১ : ২১) এমনকি যীশু থেকেও বড় কাজ অন্যেরা করতে পারে (যোহন, ১৪ : ২১)।
যীশুর খোদাত্বের আরও কিছু অসারতা
খ্রিস্টধর্ম প্রচারকেরা যীশুর খোদাত্বের প্রমাণস্বরূপ আরও যেসব দলিল পেশ করেন, সেগুলোর অসারতা বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা হল :
পাপমোচন করার ক্ষমতা খোদাত্বের প্রমাণ নয়, অন্যেরাও পাপ মোচন করতে পারে (যোহন, ২০ : ২৩)। যীশু পিতায় এবং পিতা যীশুতে থাকা খোদাত্বের প্রমাণ নয়, কারণ অন্য লোকেরাও যীশুর ন্যায় খোদাতে থাকতে পারেন (যোহন, ১৭ : ২১)। যীশু ও খোদা এক, এ বাক্যও খোদাত্বের প্রমাণ নয়। অন্যের জন্যও এ বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। (যোহন, ১৭:১১; আদি, ১: ২৭)। এছাড়া, যীশু সর্বদাই খোদাত্বের কথা অস্বীকার করেছেন, বরং তিনি নিজেকে খোদার দাস, প্রেরিত, ভাববাদী, মনুষ্য-পুত্র এবং পবিত্র ব্যক্তি বলে পরিচয় দিয়েছেন। এ সম্বন্ধে নিতে কয়েকটি প্রমাণ উপস্থাপন করা হল :
যীশু মানুষ (মথি, ৯ : ৮)। যীশু মনুষ্য-পুত্র (মথি, ১২: ৮; ১৩ : ৩৭)। যীশু খোদার প্রেরিত (মথি, ১০ : ৪০; যোহন, ৭ : ১৬ ১৭ : ৩)। যীশু ভাববাদী (মথি, ১৩ : ৫৭; ২১:১১)। যীশু পবিত্র ব্যক্তি (যোহন, ৬ : ৬৯)। যীশু খোদার দাস (প্রেরিত, ৩ : ১৩; ৪ : ২৭)। যীশু মানুষ ছিলেন, এজন্য খোদার নিকট প্রার্থনা করতেন (মথি, ২৭ : ৪৬)। যীশু দুর্বল মানুষ ছিলেন, এজন্য মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন (মার্ক, ১৪ : ৩৬)। যীশু খোদা নন, এ জন্য তিনি মানুষের পাপের বিচার করতে পারেন না (যোহন, ১২ : ৪৭-৫০)। যীশু নিজেকে খোদা থেকে পৃথক দেখিয়েছেন; যেমন–তিনি বলেন, “খোদাতে বিশ্বাস কর, আমাতেও বিশ্বাস কর” (যোহন, ১৪:১)।
ত্রিত্ববাদ ও খোদার পুত্রত্বের ইতিহাস
খ্রিস্টের দু’হাজার বছর পূর্বে ব্যবিলন অঞ্চলে ‘মরদুক’ বলে এক দেবতার কাহিনী পাওয়া যায়। ‘মরদুক’ ছিলেন ব্যবিলনবাসী সর্বেশ্বরবাদীদের সূর্য দেবতা। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৫০ অব্দে ব্যবিলনের রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের পর মরদুক প্রাচ্যের প্রধানতম সেমাইটদের দেবতার মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়। খালদীন ও ব্যবিলনবাসীরা মরদুককে খোদার প্রিয় পুত্র মনে করত। তারা এই দেবতার প্রতি যেসকল গুণাবলী আরোপ করেছিল, যীশুর প্রতিও খ্রিস্টানরা সেই সমস্ত গুণাবলী আরোপ করেছিল বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। আরব, ইরান, সিরিয়া এবং মিশরের মুশরেকরা বৌদ্ধমত ও সূর্য পূজার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল এবং তারাই যীশুর প্রতিও ঐ সকল গুণাবলী আরোপ করেছিল। এদিক থেকেও খ্রিস্টানরা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। যীশু নিজেকে একজন ‘মানুষ’-এর অতিরিক্ত করে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হননি। পৌত্তলিকরা এবং অগ্নি-পূজকরাই তাঁকে খোদার পুত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। ফলে, মুসা (আঃ) এবং বনি ইস্রায়ীল পয়গম্বরদের দ্বারা প্রবর্তিত ধর্মের শিক্ষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাকে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার অব্যবহিত পরেই তার দেয়া শিক্ষাও জটিল হয়ে ওঠে, যারফলে জন্ম নেয় খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ। যা অজস্র রক্তপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যীশুর উপরে এ ধরনের মিথ্যা কল্পনারোপের ব্যাপারে ‘মিথরা’ মতবাদই খ্রিস্টানদেরকে সর্বাপেক্ষা বেশি বিপথগামী করেছে বলে মনে হয়। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ’ অব্দে পারস্যে এই মতবাদ প্রচলিত ছিল। মিথরার জন্ম হয় একটি পর্বতগুহায়। জন্মের তারিখটি ২৫শে ডিসেম্বর বলে মনে করা হয়। একজন কুমারীই তাঁকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তাঁর বারোজন সাগরেদ ছিলেন। তিনি বহু দেশদর্শী ছিলেন। মানবতার সেবায় তার জীবন উৎসর্গীত হয়েছিল, তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কবরস্থ হয়েছিলন, আবার বেঁচেও উঠেছিলেন। তাঁর পুনরুত্থানকে বিপুলভাবে অভিনন্দিতও করা হয়েছিল। এ সকল কথাই মিথরা সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস এবং তা যীশু সম্পর্কে তৈরি খ্রিস্টানদের কাহিনীর সাথে হুবহু মিলে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সাধু পৌল মহাশয়ই নাকি এ-সকল ক্রিয়াকাণ্ডের মূলনায়ক। তার অপব্যাখ্যাই যীশুখ্রিস্টকে এত বিকৃতরূপে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত করেছে। পক্ষান্তরে, সাধু পিতর, যিনি যীশুখ্রিস্টের একান্ত শিষ্য ছিলেন, তার দ্বারা এসবকিছুই হয়নি।
মূলত, খ্রিস্টান ব্যাখ্যাকাররা পৌত্তলিকদের প্রীত করতে একদিকে যেমন হযরত যীশুর প্রচারিত তৌহিদীবাদকে এবং তার প্রতি অবতীর্ণ হওয়া আল্লাহর কেতাব ইঞ্জিলকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিয়ে বসলেন, অপরদিকে পৌল নামক ধুরন্ধরের খপ্পরে পড়ে তার আনীত গ্রীক ও পার্সীক দর্শনের সংমিশ্রণে এক অভিনব উদ্ভট ধর্মকে খ্রিস্টানধর্মের নামানুকরণে চালিয়ে দেন। ফলে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জুলুম করা হয়েছে হযরত যীশুর নবী-জীবনের মহিমার উপর। ইঞ্জিলগুলোতে নানাপ্রকার ভিত্তিহীন গল্প-গুজবের সমাবেশ ঘটিয়ে তা করা হয়েছে।
যীশুকে খোদা বলে প্রতিপন্ন করার জন্য সাধু পৌলের যুগ থেকেই খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান প্রবর্তকেরা আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করেন এবং অন্যান্যপ্রকারে ধর্মশান্ত্রের বিকার ঘটাচ্ছেন। এ শ্রেণীর জাল ও প্রবঞ্চনা তাঁদের পরিভাষায় “Pious fraud” বা সাধু প্রবঞ্চনা বলে কথিত হয়ে থাকে। প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান সাধুরা এ জাল জুয়াচুরির কথা সগৌরবে স্বীকার করে গেছেন। সাধু পৌল বলেছেন, “কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি খোদার সত্যনিষ্ঠতা তাঁর মহিমার উদ্দেশ্যে উৎকর্ষ লাভ করে, তবে পাপী বলে আমার বিচার হয় কেন?” (রোমীয়, ৩ : ৭)। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খ্রিস্টান পাদ্রী পুরোহিতদের এ স্বেচ্ছা প্রণোদিত অনাচারও যে কিরূপ নিষ্ঠুরভাবে প্রচলিত হয়ে এসেছে, পাশ্চাত্য জগতের বহু খ্রিস্টান লেখকের লেখায় এর বিস্তারিত বিবরণ এখন দুনিয়াময় প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু এখন থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে পবিত্র কোরআন তাদের এই জাল-জুয়াচুরির কথা স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করে দিয়েছে।
এ শ্রেণীর জাল-জুয়াচুরি এবং শাব্দিক ও আর্থিক বিকার সাধন করার পর তারা দুনিয়াকে বুঝাচ্ছে, যীশুকে খোদা বলে বিশ্বাস করতে হবে, স্বয়ং যীশুই এ আদেশ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনের ৩ : ৭৮ আয়াতে মানুষের সাধারণ জ্ঞান-বিবেকের দিকথেকে এ দাবীর প্রতিবাদ করে বলা হয়েছে, যীশু মানুষ ছিলেন, তাঁর খোদাত্ব তোমাদের মিথ্যা রচনা। একজন মানুষকে আল্লাহ্ নিজের “বাণী” প্রদান করলেন, সেই বাণীকে সম্পূর্ণভাবে প্রাণগত করার উপযোগী প্রজ্ঞাও তাঁকে দিলেন, আর সাথে সাথে নবুয়তের দায়িত্ব অর্পণ করে তাঁকে আদেশ করলেন সেই বাণীকে ইস্রায়ীল-কুলের কাছে পৌঁছাতে। এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার পরও কোন মানুষ নিজের প্রজ্ঞা ও আল্লাহর বাণীর বিপরীত এ ধরনের কথা কখনোই বলতে পারেন না যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ তার পূজা করবে। এমনকথা বলা তার পক্ষে অসঙ্গত এবং শোভনীয় নয়। ফলতঃ হযরত ঈসা (আঃ) বা যীশুর পক্ষে ঐ ধরনের কথা বলা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। প্রচলিত বাইবেলে তোমাদের উক্তির অনুকূল কিছু থাকলে তা তোমাদের নিষ্ঠুর ধার্মিক জালিয়াতি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
একটি ভ্রান্তির অপনোদন প্রয়োজন:
ইজ কালাতিল মালাঈকাতু ইয়া মারইয়ামু ইল্লাল্লাহা উ বাশিরুকী বি কালিমাতিম মিনহু– ইসমুহুল মাসীহু ঈসা ইবনু মারইয়ামা অর্থাৎ অন্য ফেরেশতারা যখন বলেছিল : হে মরিয়ম! আল্লাহ্ তোমাকে নিজ সন্নিধানের একটি কলেমা সম্বন্ধে সংবাদ দিচ্ছেন : তাঁর নাম আল্ মসীহ্ ইসা ইবনু মরিয়ম।
খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরা পবিত্র কোরআনের উপরোদ্ধৃত (৩ : ৪৫) আয়াতের কলেমা শব্দ দ্বারা মুসলমানদের বুঝাতে চান যে, কোরআনও যীশুর অনাদিস্বরূপ ও খোদাত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু কলেমা’ শব্দের অর্থ বাক্য। এটা আরবি ভাষার একটি ইডিয়ম, অর্থ-সংবাদ বা সন্দেশ। ইমাম রাগিব বলেছেন, ফরমান বা decree মাত্রকেই কলেমা বলা হয়–তা সে বাক্যতঃ হোক আর কার্যত হোক। হযরত ঈসার জন্ম সম্বন্ধে আল্লাহর যে ফরমান, ফয়সালা, নির্দেশ বা decree পূর্ব থেকে নির্ধারিত ছিল ৩ : ৪৫ আয়াতে সাধ্বী মরিয়মকে সেই ফরমানের সংবাদ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু, খ্রিস্টান পণ্ডিত-পুরোহিতরা নানাবিকার ও বিপ্লবের পর পবিত্র কোরআনের ৩ : ৪৫ আয়াতের কলেমা’ শব্দকে যীশুর ‘অনাদিস্বরূপ’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কলেমার প্রতিশব্দরূপে বাইবেলের গ্রীক অনুবাদে Logos শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বাইবেল সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ও নিরপেক্ষ পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও স্বীকার করেছেন যে, গ্রীক দার্শনিক Heraclituse ও Philo প্রভৃতির অনুকরণ করে যীশুর পরবর্তী খ্রিস্টানরা, বিশেষতঃ যোহন খ্রিস্টানধর্মে এ মতবাদটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ একে Chistinising of the Logos conception বলে উল্লেখ করতেও কুণ্ঠিত হননি। এ Logos সম্বন্ধে Encyclopaedia Biblica’-এর লেখক J.G, Adolf D. D. ‘Art. Logos-এ বলেন:
চতুর্থ সুসমাচারের প্রস্তাবনা অংশ ছাড়া বাইবেলে উল্লিখিত আচার আচরণের কোন বৈচিত্র্য নেই; এ থেকে কেবল কোন বাক্য বা কোন ধারণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দের জটিলতাকেই বুঝায়। ‘the logos of God’ পূর্ণাঙ্গ সুসমাচারকেই বলা যায়, অথবা আরও সহজ করে বললে বলতে হয় “বিমূর্ত স্বর” (The logos)।
প্রবন্ধের উপসংহারে লেখক আরও বলেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ দ্বিতীয় শতাব্দীর মত সুদূর অতীতেও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা ঐশ্বরিক সুসমাচারের ঐতিহাসিক বর্ণনার প্রসঙ্গের চেয়ে তার দার্শনিক উপাদানের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। আর বর্তমান লেখক বিমূর্ত বাণীর বিষয়টিকে এভাবে প্রকাশ করার সুযোগ গ্রহণ করায় বিষয়টি খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিপদের উত্স হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
খ্রিস্টান পণ্ডিতরা এভাবে কলেমা বা বাক্য শব্দের যে বিকৃত অনুবাদ করেছেন এবং গ্রীক দার্শনিকদের অনুকরণ করে যোহন এ অনুবাদে যেমন অন্যায়ভাবে যীশুকে ঈশ্বররূপে প্রবেশ করিয়েছেন, পূর্বোক্ত উদ্ধৃতাংশ থেকে তার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, এসব জানা সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ আলোচ্য কলেমা শব্দকে অবলম্বন করে বলতে চান যে, কোরআনও যীশুর অনাদি ও ঈশ্বরত্ব বা খোদাত্ব হওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তাই প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে দেয়ার জন্য এ অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হল। মূলতঃ পবিত্র কোরআনের ৩: ৪৫ আয়াতে কলেমা’ শব্দ ব্যবহার করে যোহন প্রভৃতির প্রবর্তিত বিকারের মূল ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং দৃঢ় ও সুস্পষ্ট ভাষায় তার প্রতিবাদ জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যীশু শাশ্বত ও স্বয়প্রকাশ নন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্’র নির্দেশ অনুসারে, অন্যান্য মানুষের মত তাকেও জন্মগ্রহণ করতে হয়েছে।
পরিশেষ : “ত্রিত্ববাদ’ এবং যীশুখ্রিস্টকে খোদার পুত্র খোদা বলার খ্রিস্টানদের কল্প-কাহিনী সম্বন্ধে ত্রিত্ববাদ ও যীশু’ আখ্যায় এই অধ্যায়ে যা আলোচিত হয়েছে, তা পবিত্র কোরআনের সেইসব আয়াতের ব্যাখ্যাস্বরূপ, বলা হয়েছে :
“তারা নিশ্চয় (যীশুর শিক্ষায়) অবিশ্বাসী, যারা বলে, আল্লাহ হলেন তিনের মধ্যে তৃতীয়, অথচ আর কোন খোদাই নেই একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া।”–৫: ৭৪)
“নিশ্চয় তারা (প্রকৃত খোদায়) অবিশ্বাসী, যারা বলে মরিয়ম-পুত্র মসীহই খোদা; অথচ মসীহ্ বলেছিলেন, হে বনি-ইস্রায়ীল! উপাসনা কর আল্লাহর যিনি আমার ও তোমাদের প্রভু।–৫ : ৭৩)
“এবং তারা বলে আল্লাহ্ পুত্র গ্রহণ করেছেন, অথচ পবিত্র তিনি এথেকে।”–(২ : ১১৭)।
“নিশ্চয় যীশুর দৃষ্টান্ত আল্লাহ্র নিকট আদমের দৃষ্টান্তস্বরূপ।” (৩: ৬০)
যীশু কি আদৌ ক্রুশে নিহত হয়েছিলেন:
রক্ষণশীল খ্রিস্টান চার্চগুলো অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে সাধু পৌলের যুগ থেকে প্রচার করে আসছে যে, যীশুখ্রিস্ট ক্রুশে নিহত হয়েছিলেন। কেননা, ক্রুশে নিহত করতে না পারলে তার দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত পাপীর প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার চমকপ্রদ তত্ত্বটি অর্থাৎ সাধু প্রতারণাটা একেবারে পণ্ড হয়ে যায়; অন্যদিকে, ইহুদীদের দায়ুদের সিংহাসন অধিকারের রাজনৈতিক প্রলোভনটিও মাঠে মারা যায়। সেক্ষেত্রে, যীশুর ক্রুশে নিহত হওয়ার কাহিনীটি শুধু খ্রিস্টানদের কাছেই নয়, ইহুদীদের কাছেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
এছাড়া, বিষয়টি এখন মুসলমানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, ইহুদীরা দাবী করে, যীশুকে তারা ক্রুশে নিহত করে মিথ্যেবাদী ও অভিশপ্ত প্রমাণ করেছে।
পক্ষান্তরে, খ্রিস্টানরা এ বিষয়ে একমত হয়েও এক বিশেষ মতভেদ রাখে যে, যীশু তাঁর অনুসারীদের যাবতীয় পাপের বোঝা নিজের দায়িত্বে গ্রহণ করে তার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ ক্রুশে আত্মোৎসর্গ করেছেন। কিন্তু মুসলমানদের পবিত্র কোরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছে :
“এবং তাদের এ কথা বলার কারণে, আমরা আল্লাহর রসূল মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, কুশে বিদ্ধ করেও নিহত করেনি; কিন্তু তাদের নিকট দ্রুপ সদৃশই করা হয়েছিল; আর নিশ্চয় যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করে তারা সন্দেহে অভিভূত, এ সম্বন্ধে তাদের কোন নিশ্চিত জ্ঞান নেই, আছে শুধু অনুমানের অনুসরণ এবং তারা তাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে পারেনি। বরং, আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে উন্নীত করেছেন; বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, পরম প্রজ্ঞাময়। এবং আহলে কিতাব (ইহুদী ও খ্রিস্টান)-দের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যে নিজ মৃত্যুর পূর্বে তাতে বিশাস না রাখে, অথচ কিয়ামতের দিনে সে (ঈসা) তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন।” (সূরা নিসা, ১৫৭-১৫৯ আয়াত)।
প্রকৃতপক্ষে, ইহুদী ও খ্রিস্টান জাতির সমবেত দাবির বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন দৃঢ় ও স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করছে,
“ইহুদী ও খ্রিস্টান জাতি যীশুর অভিশপ্ত মৃত্যু এবং প্রায়শ্চিত্তবাদ সম্বন্ধে যে-সব কল্পকাহিনী প্রচার করে আসছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যে, যীশুকে তারা কুশে দিয়ে অথবা অন্য কোনপ্রকারেও হত্যা করতে পারেনি। বরং, আল্লাহ্ তাকে স্বীয় পরাক্রম দ্বারা অভিশপ্ত মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং নবীসুলভ সম্মানজনক ঊর্ধ্বগতি দান করেছেন। কিন্তু, আহলে কিতাবধারী ইহুদী ও খ্রিস্টানরা যীশুকে তার মৃত্যুর পূর্বেই ক্রুশে নিহত কল্পনা করে যে মতভেদ করেছে, তার ভুল কিয়ামতের দিনে তারা বুঝতে পারবে। যেসব ইহুদী যীশুকে অভিশপ্ত কল্পনা করে ইহজগত ত্যাগ করবে তারা নিজে অভিশপ্ত হওয়ার স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে নিজ ভুল বুঝবে এবং যেসব খ্রিস্টান যীশুকে ত্রাণকর্তা মেনে অবাধে সকল পাপ করে গেছে বা করবে তারা নিজ নিজ কর্মের জবাবদিহি ও ফলভভাগের মধ্যে নিজ ভূল উপলব্ধি করবে। এভাবে উভয় জাতির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন যীশু সাক্ষী হবেন।
যীশুখ্রিস্টের আগমনের কারণ : হযরত ইব্রাহিম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত যত নবী-রসূল আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ায় প্রেরিত হন, তাঁদের প্রত্যেকেরই নবুয়তের মিশন ও বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সমসাময়িক পরিস্থিতি অনুসারে এক একটি ভৌগোলিক সীমারেখাও নির্ধারিত হয়েছিল।
এভাবে হযরত মুসা (আঃ) এসেছিলেন ইহুদী জাতিকে মিসর-রাজ ফেরাউনের শোচনীয় দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে উদ্ধার করে তাদের পুরানো আবাসভূমিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিতে। কিন্তু হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর সহকারী হযরত হারুন (আঃ) এবং ইস্রায়ীলবংশীয় অন্যান্য নবীদের সাধনা নানাকারণে পূর্ণসিদ্ধিলাভে ব্যর্থ হয়।
এ অবস্থায়, অজ্ঞাতকারণে এবং নিতান্ত অজ্ঞাত স্থানে হযরত মুসা (আঃ) এর মৃত্যু হয়। কালক্রমে ইহুদী জাতির নিজ কর্মফলে তাদের জাতীয় জীবন বিভিন্ন পাপে-তাপে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তাঁদের পবিত্র ধর্মস্থান জেরুজালেম পর্যন্ত পরজাতির দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে; পুনঃপুনঃ তাদের ধর্মশাস্ত্রগুলো ভস্মীভূত করা হয়। যে কারণে বনি-ইস্রায়ীল জাতি আবার যে গোলামের জাতি, সেই গোলামের জাতিতেই পরিণত হয়ে পড়ে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, হযরত ইয়াকুব (আঃ) বা ইস্রায়ীল (আঃ)-এর বারোজন পুত্র-সন্তান ছিল। এই বারোজন পুত্রের সন্তানেরা বারোটি গোত্রে বিভক্ত হয়ে পরবর্তীকালে ইস্ৰায়ীলের দ্বাদশ গোত্র’ নামে পরিচিত হয়। এরা ব্যাবিল-রাজ নাবুক নাসর (Nebuched-nezzer) কর্তৃক বারবার আক্রান্ত হয়ে অবশেষে খ্রিঃ পূঃ ৫৮৬ সালে বন্দী ও বিতাড়িত হয়ে ব্যাবিলনে আনীত হয় এবং সেখানে তারা নাবুক নাসর ও তার বংশধরদের দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় (২১ বংশাবলী, ৩৬ : ২০)। তারপর সাইরাস (Cyrus) রাজ ব্যাবিলন দখল করলে তার অনুমতিক্রমে তাঁদের দুটি গোত্র, ফিলিস্তিনে গিয়ে পুনরায় বসবাস শুরু করে এবং পরে পারস্য-রাজ দারিয়ুস (Darius) ব্যাবিলন দখল করলে এবং তাঁর রাজ্য ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হলে বনি-ইস্রায়ীলের অপরাপর দশটি গোত্র নাসিবিনের পথধরে পারস্যের উপর দিয়ে আফগানিস্তান, লাদাখ, তিব্বত, কাশ্মীর ও মধ্যভারতে চলে আসে এবং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। Apocrypha থেকে জানা যায়, তারা কখনো তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করেনি (2 Esdres, 13: 29-36)। আল্লাহতায়ালা বনি-ইস্রায়ীলের এই হারানো গোত্রগুলোকে একত্র এবং পুনরায় সংহত করার জন্যে এবং তৌরাতের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ করার প্রধান উদ্দেশ্যে হযরত ঈসা (আঃ) বা যীশুকে প্রেরণ করেন। ফিলিস্তিনে বনি-ইস্রায়ীলের মাত্র দুটো গোত্রের মধ্যে। তাই যীশু বলতেন,
“আমার আরও মেষ আছে, সে সকল এ খোয়াড়ের নয়, তাদেরকে আমার আনতে হবে এবং তারা আমার কথা শুনবে, তাতে এক পাল ও এক পালক হবে (যোহন, ১০ : ১৬)।
তিনি আরও বলতেন, “আমাকে অন্যান্য নগরেও ঈশ্বর-রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করতে হবে, কারণ সে জন্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি।” (লুক, ৪ : ৪৩)।
বাইবেল পাঠান্তে জানা যায়, যীশু কোন নতুন ধর্মমত আনেননি, মোশির বিধি-ব্যবস্থার কোনপ্রকার পরিবর্তন ঘটাতেও তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। কেননা, তিনি বলতেন,
“মনে করো না যে, আমি বিধি-ব্যবস্থা অথবা নবীদের আনীত গ্রন্থ বিলুপ্ত করতে এসেছি। আমি তাকে লোপ করতে আসিনি, বরং তাকে পরিপূর্ণ করতে এসেছি।” (মথি, ৫:১৭)
যীশু যে বনি-ইস্রায়ীল ছাড়া অন্য কোন জাতির নিকট প্রেরিত হননি, সে সম্বন্ধে বাইবেল বলে–
“আর সে স্থান ছেড়ে যীশু সোর ও সীদোন অঞ্চলে চলে গেলেন। আর সেই অঞ্চলের একজন কেনানীয় মহিলা এসে চিৎকার করে তাঁকে বলল, ‘প্রভু, দায়ুদ-সন্তান, আমার প্রতি দয়া করুন, আমার কন্যাটি নিদারুণভাবে মন্দ-আত্মা-বিষ্ট হয়েছে।”
কিন্তু, তিনি তাকে কোনও উত্তর দিলেন না। তাঁর শিষ্যেরা নিকটে এসে তাঁকে অনুরোধ করে বলেন, মহিলাটিকে বিদায় করুন, কারণ সে চিৎকার করতে করতে আমাদের পিছু পিছু এসেছে। তিনি উত্তরে বললেন, ইস্রায়ীল-কুলের হারানো মেষ ছাড়া আর কারও নিকট আমি প্রেরিত হইনি’। মহিলাটি কিন্তু এসে, তাঁকে প্রাণিপাত করে বলল, ‘প্রভু, আমায় সাহায্য করুন’। তিনি উত্তরে বললেন, ‘সন্তানদের খাদ্য নিয়ে কুকুরের কাছে ফেলে দেয়া সঙ্গত নয়।” (মথি ১৫ : ২১-২৬)।
অন্য এক কারণে যীশু শিষ্যদেরকে সাবধান করে বললেন,
“পবিত্র বস্তু কুকুরকে দিয়ো না; তোমাদের মুক্তা কুরের সামনে ছড়িয়ো না …।” (মথি, ৭: ৬)।
বাইবেলের এসব সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, মোশির বা অন্যান্য ভাববাদীদের প্রবর্তিত বিধি-ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন কিংবা ইহুদী ব্যতীত অন্য কোন লোক সমাজের কাছে ধর্ম প্রচার করার কোন সংকল্প যীশুর ছিল না। ইস্রায়ীল-বংশের হারানো পোত্র দশটি উদ্ধার করাই ছিল তাঁর নবী-জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
যিশুর বিরুদ্ধে ইহুদীদের আন্দোলন:
ইহুদীরা যখন তাওরাতের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রতিশ্রুত একজন ত্রাণকর্তা, ‘মসীহ’র অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই যীশু আবির্ভূত হয়ে ঘোষণা করলেন, বনি-ইস্রায়ীলের হারানো গোত্রগুলোকে একত্রিত ও পুনঃসংহত করার প্রধান উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালা তাকে মনোনীত করেছেন। কিন্তু, এই ঘোষণায় স্থানীয় ইহুদীদের কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ তাঁকে বিশ্বাস করলো না; বরং তার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। কারণ, তারা বিশ্বাস করতো যে, মালাকী নবী (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রতিশ্রুত মসীহ’র আবির্ভাব হবে ইলিয়াস (ইদ্রিস) নবী (আঃ)-এর আগমনের পরে (মালাকী ৪:৫) তাওরাতের বর্ণনানুযায়ী ইলিয়াস নবী (আঃ) রথযোগে জীবিতাবস্থায় আকাশে উড়ে গেছেন (২ রাজাবালী, ২: ১১)। সুতরাং, আকাশ থেকে যখন তাঁর পুনরাগমন হয়নি, তখন প্রতিশ্রুত মসীহও আসতে পারেন না। কিন্তু, যীশু তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, আকাশ থেকে নবী নেমে আসা অসম্ভব, এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং তোমরা যদি গ্রহণ করতে সম্মত হও তবে জানবে যে যোহন বা ইয়াহইয়া নবীই ‘এলিয়’ (মথি, ১১ : ১৪) কারণ, ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, “তিনি এলিয়’র আধ্যাত্মিকতা ও শক্তি নিয়ে মসীহ্’র পূর্বে আগমন করবেন” (লুক, ১ : ১৭) কিন্তু ইহুদীরা যীশুর এ ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেনি। তাদের ধারণায় ‘এলিয়’ স্বয়ং আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবেন, অন্যকোন ব্যক্তি এলিয়ের রূপ ধরে বা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আসবে না। সুতরাং, মরিয়ম পুত্র একজন প্রতারক এবং ভ্রান্তপথ প্রদর্শনকারী।
পক্ষান্তরে, যীশু ঐ ব্যাখ্যার সাথে এই বাণীও প্রচার করতে থাকেন যে, স্বর্গ রাজ্য (Kingdom Of God) প্রতিষ্ঠার জন্যেই তিনি প্রেরিত হন। সেই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের অধিকার সবারই রয়েছে। ফলে ক্রমশঃ অধিকসংখ্যক লোক যীশুর অনুগামী হতে থাকে। আর বিপথগামী বকধর্মীয় দল যীশুর বাণীর অপব্যাখ্যায় মেতে উঠে। পরিশেষে, যীশুর সাথে তর্কে পেরে না উঠে তারা নিজেদের মধ্যে যীশু-বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তারা প্রচার করতে থাকে যে, যীশু ইহুদীদের ধর্মশাস্ত্রগুলোর নিন্দে করেন, জেরুজালেমের ধর্ম-মন্দির ভেঙ্গে তিনদিনে তা পুনঃনির্মাণ করে দিতে পারেন; এরূপ উক্তি তিনি করে থাকেন। খোদার পুত্র এবং ইহুদীদের রাজা হওয়ার দাবীও তিনি করে থাকেন, ইত্যাদি।
ইহুদী আলেমরা কিছুকাল ধরে নিজেদের মধ্যে এ আন্দোলন চালানোর পরে প্রথমত নিজেরাই যীশুকে হত্যা করার চেষ্টা করে (যোহন, ৫: ১৮)। কিন্তু যীশুর সমর্থক ও আইনের ভয়ে যখন তারা তাকে হত্যা করতে অসমর্থ হয় (মথি, ২১ : ৪৬) তখন তারা বিভিন্ন ফেরকার আলেমদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে (মথি, ২৭:১) তারপর আঞ্চলিক শাসনকর্তা পীলাতের কাছে এ ধরনের অভিযোগ পেশ করতে থাকে যে
(১) যীশু রাজদ্রোহী, নিজেকে তিনি ইহুদীদের রাজা বলে ঘোষণা করেন, রাজকর দিতে লোকদের নিষেধ করেন;
(২) ধর্ম হিসেবে তিনি একজন ফাছক (Corruptor), ইহুদীদের পবিত্র ধর্ম মন্দির সম্বন্ধে অবৈধ আক্রমণ করতে এবং নিজেকে খোদার পুত্র বলে ঘোষণা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হন না, ইত্যাদি। এসব অপরাধের জন্য তাঁকে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে নিহত করা হোক। কিন্তু পীলাত যীশুকে গ্রেফতার করার আদেশ না দেয়ায়, একদিন ইহুদী প্রধানরাই অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যীর বাসস্থান আক্রমণপূর্বক তাকে ধরে নিয়ে পীলাতের আদালতে উপস্থিত করে, যাতে রাজ দরবারের বিচারে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে নিহত করা যায়।
কিন্তু ‘যীশু ক্ৰশে নিহত হয়েছিলেন’–রক্ষণশীল খ্রিস্টানচার্চগুলোর এই বুনিয়াদি প্রচারণাটি যে উদ্দেশ্যমূলক এবং কল্পিত উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয় পরবর্তী আলোচনাক্রমে তা জানা যাবে।
বাইবেলের সাক্ষ্য অনুযায়ী যীশু ক্রুশে প্রাণত্যাগ করেননি:
যারা বাইবেল পাঠ করেছেন তারা অবগত আছেন যে, সুসমাচার রচয়িতারা যীশুর জীবনেতিহাস সংকলনের সময় তাঁর কার্যকলাপের সমর্থনের জন্য মোশির ব্যবস্থা বা পুরাতন নিয়মের অনেক উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এই পুরাতন নিয়মে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে:
“এবং যদি কোন ব্যক্তি প্রাণদণ্ডের যোগ্য পাপ করে আর তার প্রাণদণ্ড হয়, আর তুমি তাকে গাছে (ক্রুশে) টাঙ্গিয়ে দেও, তবে তার শব রাতে গাছের (ভুশের) উপর থাকতে দেবে না, পরন্তু সেদিনই তুমি তাকে কবর দেবে, কেননা যে ব্যক্তিকে (কাষ্ঠে) টাঙ্গানো হয় সে ঈশ্বরের শাপগ্রস্ত; তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু যে ভূমিকে তোমার উত্তরাধিকার সূত্রে দান করেছেন; তুমি তাকে অশুচি করবে না।” (দ্বিতীয় বিবরণ, ২১ : ২২-২৩)।
উদ্ধৃত পদ দুটোর অনুবাদে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বেশ কিছুটা কারচুপি করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। তাই প্রকৃত তাৎপর্যটি বুঝিয়ে দেবার জন্য বন্ধনীর মধ্যে “ক্রুশ” এবং “কাষ্ঠে” শব্দ দুটো বাড়িয়ে দেয়া হল।
কারণ, আরবি বাইবেলে এ শব্দ দুটো রয়েছে। আরবি অনুবাদে ‘খাছীবুহু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যার আভিধানিক অর্থ, কাষ্ঠনির্মিত কোন পদার্থ। ইস্রায়ীলীদের ধর্মীয় পরিভাষায় এর অর্থ ‘ছালীব’ বা ক্রুশ-কাষ্ঠ। একজন বিখ্যাত খ্রিস্টান অভিধানকার বলেছেন,
“যে মহিমান্বিত কাঠের উপর প্রভু যীশুখ্রিস্টকে ক্রুশে দেয়া হয়, তাকে (আরবিতে) ছালীব বলা হয়, কিন্তু আমাদের পরিভাষায় মাছব বলতে প্রভু ঈসা মসীহকে বুঝিয়ে থাকে।” (আকরাবুল-মাওয়ারিদ)।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, ক্রুশ-কাষ্ঠের উপর যাদের মৃত্যু হয়, তাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্তরূপে পরিগণিত হয়। এমনকি তার মৃতদেহকে এমন অশুচি বলে গণ্য করা হয় যে, তার সংশ্রবে বনি-ইস্রায়ীলের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পবিত্র ভূমিগুলো পর্যন্ত কলুষিত হয়ে যায়। অথচ, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা সমবেতকণ্ঠে ঘোষণা করে আসছেন যে, যীশুখ্রিস্টকে ক্রুশে দিয়ে নিহত করা হয়েছিল। কারণ, তা না হলে খ্রিস্টধর্মের মূল ভিত্তিটিই স্বতঃসিদ্ধরূপে ও সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু এ রকম তথ্যের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের হয় স্বীকার করতে হবে যে, কুশে মৃত্যু হওয়ায় যীশু আল্লাহর নির্দেশমতে অভিশপ্ত ও অশুচি হয়েছেন; না হয় বলতে হবে যে, যীশু ক্রুশের উপর মৃত্যুবরণ করেননি। প্রথমাবস্থায় তাদের বর্ণিত যীশুর সমস্ত বৈশিষ্ট্য একেবারে নস্যাৎ হয়ে যায়, দ্বিতীয়াবস্থায় বাইবেলের সামগ্রিক বর্ণনাগুলোই মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন হয়।
এখন, যীশু যে আদৌ ক্রুশে প্রাণত্যাগ করেননি, তার কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে–
১। ধর্মগুরু ও ফরীশীরা যখন যীশুকে তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ কোন একটি মোজেযার দাবী করেছিল, তখন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তার ক্ষেত্রে যোনা ভাববাদীর নিদর্শন দেখানো হবে। যেমন, ক’জন ধর্মগুরু ও ফরীশী তাকে বললেন, শুরু আমরা আপনার প্রদর্শিত একটি লক্ষণ দেখতে চাই। তিনি উত্তরে তাদের বললেন, “এ যুগের দুষ্ট ও ভ্রষ্টচারী লোকেরা লক্ষণের অন্বেষণ করে, কিন্তু ভাববাদী যোনার লক্ষণ ছাড়া আর কোন লক্ষণ এদের নিকট প্রদর্শিত হবে না। কারণ, যোনা যেমন তিনদিন-তিনরাত্রি তিমি মাছের উদরে ছিলেন, মনুষ্যপুত্রও তেমনি তিনদিন-তিনরাত্রি পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকবেন।” (মথি, ১২ : ৩৮-৪০)।
লুক লিখিত সুসমাচারেও অনুরূপই বর্ণিত রয়েছে, উপরন্তু সেখানে বলা হয়েছে, “এ যুগের লোকেরা দুষ্ট, এরা লক্ষণের অন্বেষণ করে, কিন্তু যোনার লক্ষণ ছাড়া দৃশ্য কোন লক্ষণই এদের দেয়া যাবে না। কারণ, যোনা যেমন নীনবাসীদের নিকট লক্ষণস্বরূপ হয়েছিলেন, মনুষ্য-পুত্রও এ যুগের লোকদের নিকট সেরূপ হবেন।” (১১: ২৯-৩০)।
মথি ও লুক লিখিত সুসমাচার এবং বাইবেলে সন্নিবেশিত “যোনা ভাববাদীর পুস্তক” নামে আর একখানি স্বতন্ত্র পুস্তক থেকে জানা যায় যে,
(১) যোনা ভাববাদী বা ইউনুস (আঃ) নবী তিনদিন-তিনরাত্রি একটি তিমি মাছের উদরে অবস্থান করেছিলেন।
(২) মাছটি তাঁকে তার জীবিতাবস্থায় গ্রাস করেছিল এবং তিনদিন তিনরাত্রি জীবন্ত ও সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় তাকে তার উদরে রেখেছিল।
(৩) মাছের উদরে অবস্থানকালে যোনা ভাববাদী নিজের মুক্তির জন্য সদাপ্রভুর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন এবং সদাপ্রভু তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন।
(৪) অবশেষে মাছটি তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্ববলাবস্থায় সমুদ্রের কিনারায় উগড়ে দিয়েছিল। অতঃপর তিনি নিজের নবুওয়াতের মিশন সম্পূর্ণ করার জন্য নিনিবা অঞ্চলে যান এবং তাঁর দীর্ঘকালের সাধনা ও প্রার্থনার ফলে ঐ জনপদটি ও তার অধিবাসীরা আত বিনাশের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং তাদের মধ্যে সত্যিকারের ধর্মীয় জীবন ফিরে আসে।
তাই বলা যায়, যোনা ভাববাদী যেমন তার পরীক্ষাকালে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং কখনও প্রাণত্যাগ করেননি, তেমনি যীশুও তার পরীক্ষাকালে বেঁচেছিলেন এবং একমুহূর্তের জন্যও প্রাণত্যাগ করেননি। তাছাড়া, যোনা ভাববাদীকে যেরূপ চিহ্ন দেয়া হয়েছিল, মনুষ্য-পুত্র যীশুকে সেরূপ চিহ্ন দেয়া হবে। এছাড়া, আর কোন চিহ্নই দেয়া হবে না বলে যীশু নিজেই দৃঢ়তার সাথে ধর্মগুরু ও ফরীশীদের কাছে প্রকাশ্যভাবেই ঘোষণা করেন। সুতরাং, বাইবেলে বর্ণিত যীশুর ঘোষণানুসারে তাঁর ক্রুশে নিহত হওয়ার বিবরণটি মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে।
২। বাইবেলের বর্ণনানুসারে জানা যায়, ইহুদী প্রধানরা যীশুর বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছিল এবং তার প্রাণবধ করাই ছিল এই ষড়যন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই ষড়যন্ত্র ক্রমশ সফলতার দিকে এগিয়ে চলছে দেখে যীশু অত্যন্ত বিচলিত হতে থাকেন। যীশুর এই চঞ্চলতাকে অনেকেই তার স্বাভাবিক মানবীয় দুর্বলতা বলে বর্ণনা করেছেন। মনুষ্য-পুত্রের’র মধ্যে সাধারণত অনেকসময় মানবীয় দুর্বলতা সঞ্চারিত হওয়া আদৌ অসম্ভব নয়। যদিও আল্লাহর নবীদের কথা আলাদা। যীশু বিচলিত হয়ে পড়ে বাইবেলের সাক্ষ্যানুসারে এটা সত্য কথা।
কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াতের ভারপ্রাপ্ত রসূলের মনে এমন বিব্রতকর অবস্থায় অথবা অন্যকোন মহৎ কারণেও এ ধরনের একটি হতাশার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যীশু দেখছিলেন:
(১) অচিরেই তাঁর পার্থিব জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে, অথচ তার নবুওয়াতের মিশন এখনও সম্পূর্ণভাবে অসমাপ্ত রয়ে গেছে; ইস্রায়ীলের হারিয়ে যাওয়া বাকী গোত্রগুলো সম্পর্কে কোনপ্রকার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা তখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি; কারণ, তার আগমনের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বনি-ইস্রায়ীলের হারিয়ে যাওয়া গোত্রগুলোকে খুঁজে বের করা; অথচ,
(২) ক্রুশে নিহত করে ইহুদীরা তাঁকে অভিশপ্ত বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছে। মনে হয়, এ দুটো কারণেই যীশুর মনে এই চাঞ্চল্যের উদ্রেক হয়েছিল।
যাহোক, চরম বিপদের সম্মুখীন হয়ে যোনা ভাববাদী যেমনই কাতরকণ্ঠে সদাপ্রভুকে উদ্ধারের জন্য ডেকেছিলেন, যীশুও তেমনি বিপদ-মুক্তির জন্য সদা প্রভুকে আকুলকণ্ঠে ডাকলেন–তাঁর হুজুরে প্রার্থনা জানালেন:
“প্রার্থনা কর, তোমাদের দেয়া হবে; অন্বেষণ কর, পাবে, দ্বারে করাঘাত কর, তোমাদের জন্য খুলে দেয়া হবে। কারণ, যে কেউ প্রার্থনা করে সে গ্রহণ করে; যে অন্বেষণ করে সে পায়; যে দ্বারে করাঘাত করে তার জন্য দ্বার খুলে যায়।” (মথি, ৭: ৭-৮)।
পরে কিছুদূর এগিয়ে তিনি ভূমিতে পড়ে প্রার্থনা করলেন : যদি সম্ভব হয়, তবে যেন সেই মুহূর্ত তার নিকট থেকে দূরে চলে যায়। তিনি বললেন, আব্বা, পিতঃ, তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। এ পান পাত্র আমার নিকট থেকে দূর কর, কিন্তু আমার ইচ্ছানুসারে নয়, তোমার ইচ্ছানুসারে হোক।” (মার্ক, ১৪ : ৩৫-৩৬)।
“তিনি আবার দ্বিতীয়বার গিয়ে প্রার্থনা করলেন, পিতা আমার, আমি পান না করলে যদি ইহা দূর না হতে পারে, তবে তোমার যা ইচ্ছা তাই হোক।” (মথি, ২৬ : ৪২)।
যেকোন কারণেই হোক, নিজের প্রাণরক্ষার জন্য যীশু বারবার আল্লাহ’র দরবারে কাতরকতে আবেদন জানাতে থাকেন। “তখন স্বর্গ থেকে এক দূত দেখা দিয়ে তাকে সবল করলেন। মর্মান্তিক যন্ত্রণায়, তিনি আরও একান্তভাবে প্রার্থনা করলেন তাঁর ঘাম রক্তের ফোঁটার মত হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল।” (লুক, ২২ : ৪৩-৪৪)।
সুসমাচার রচয়িতার বর্ণনানুসারে, যীশুর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায় যে, “তার ঘাম রক্তের ফোঁটার মত মাটিতে ঝরতে লাগল।” যীশুর মৃত্যুভয় ও তাঁর অতিমাত্রার চাঞ্চল্য সম্বন্ধে সুসমাচার রচয়িতাদের কিছু অতিরঞ্জন থাকুক বা-না-থাকুক, তাদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আল্লাহর নেক বান্দাদের মত যীশুও এক সর্বশক্তিমান ও সর্বমঙ্গলময় সদাপ্রভু-পরোয়ারদিগারে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি যে তার সকল প্রার্থনা গ্রহণ করেন এ বিশ্বাস তিনি দৃঢ়তার সাথে পোষণ করতেন, আর শিষ্যদের কাছেও তিনি তা প্রকাশ করতেন। একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি সদাপ্রভুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছেন :
পিতা, তুমি আমার কথা শুনেছ বলে আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি; তুমি সর্বদা আমার কথা শুনে থাক, এটা আমি জানতে পেরেছি।” (যোহন, ১১: ৪১-৪২)।
পূর্বোক্ত ঘটনাক্রম থেকে জানা যাচ্ছে যে, যীশু ক্রুশের লাঞ্ছিত মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য সদাপ্রভুর নিকট কাতর হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন এবং বাইবেল বলে তার সেই প্রার্থনা সদাপ্রভু ঈশ্বর গ্রহণ করেছিলেন (হিব্রু ৫: ৭)।
এমতাবস্থায়, যদি স্বীকার করা হয় যে, ক্রুশ-ঘটনার সাথে সাথে যীশুর জীবনের অবসান ঘটেছিল, তবে ন্যায়ের অনুরোধে যুগপৎভাবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, তাঁর নবী-জীবনটি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, বাইবেলের বর্ণনানুসারে এই কর্তব্য পালনের বহুআগেই ক্রুশে তাঁর মৃত্যু হয়। এ অবস্থায় হয় স্বীকার করতে হবে, ক্রুশে যীশুর প্রাণদানের কথা মিথ্যে, না হয় স্বীকার করতে হবে বনি-ইস্রায়ীলের হারানো গোত্রগুলোর উদ্ধারের জন্য তাঁর আগমন হয়নি।
ক্রুশ কাহিনীর গোপন-রহস্য:
যীশুর ইহুদীদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে বা ব্যক্তিগতভাবে কোন ঝগড়া ছিল না, যে-জন্য তাকে তারা হত্যা করতে চাইত; বরং বায়েত গ্রহণকারী, দীক্ষাদাতা যোহন (John The Baptist) বা ইয়াহইয়া নবী (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর মূলে যীশুর মিথ্যেবাদী হওয়া সম্বন্ধে ইহুদীদের এমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যীশুর অনুসারীদের নিকট তা প্রমাণ করতে এবং তাকে মানার দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাওরাতের শাস্তি (দ্বিতীয় বিবরণ, ২১ : ২৩) অনুযায়ী তাকে তারা ক্রুশে বধ করে মিথ্যেবাদী ও লাঞ্ছিত প্রমাণ করতে চেয়েছিল।
আর এ জন্য তারা যুগপৎভাবে যীশু-বিরোধী আন্দোলন চালানোর পর আঞ্চলিক শাসনকর্তা পীলাতের বরাবরে এই অভিযোগ পেশ করতে থাকল যে, যীশু রাজদ্রোহী নিজেকে তিনি ইহুদীদের রাজা বলে ঘোষণা করেন; লোকদের রাজকর দিতে নিষেধ করেন; ইহুদীদের পবিত্র ধর্মমন্দির সম্বন্ধে অবৈধ আক্রমণ করতে এবং নিজেকে খোদার পুত্র বলে ঘোষণা করতেও কুণ্ঠিত হন না, প্রভৃতি। এসব অপরাধের জন্য তাঁকে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে নিহত করা হোক। এই ছিল ইহুদীদের দাবী। কিন্তু, প্রচলিত বাইবেলের বর্ণনানুসারে রাজদরবারের বিচারে ইহুদীদের দাবী সত্য বলে সাব্যস্ত হলে প্রমাণিত হবে যে যীশুকে ক্রুশে দিয়ে নিহত করা হয়েছিল, অন্যথায় প্রমাণিত হবে যে তাঁকে ক্রুশে দিয়ে নিহত করা হয়নি।
জোয়েল কারমাইকেল (Joel Carmichael) বলেছেন, ‘যীশু মন্দির আক্রমণ করেছিলেন’ কথাটি ঠিক নয়, বরং বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক। কারণ, ইহুদীদের ধর্মজীবন নিয়ে বোম কখনও মাথা ঘামায়নি, কিন্তু এ কথা প্রমাণিত যে, তা কোন গণউত্থান কিম্বা গণবিদ্রোহ অথবা রোমের বিরুদ্ধে বিপ্লবের কোন ঘটনা নয়। তা যদি হত তবে তাদের ইতিহাসে সে কথা ফলাও করে লেখা থাকত। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে মারাত্মক কিছু ছিল না। তবে, এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, শিষ্যবর্গসমেত যীশুকে হঠাৎ গা ঢাকা দিতে হয়েছিল। কিন্তু কারণ?
‘উপদেশাবলী’ বলে, যীশু জানতেন, তাঁর জীবন বিপন্ন; তাই তিনি সশিষ্য পালিয়ে গিয়েছিলেন জেরুজালেমের উপকণ্ঠে কামরান উপত্যকার পূর্বে ত্রিশৃঙ্গ জয়তুন পর্বতে। তারপর নতুন নিয়মের সেই নাটকীয় বিবরণ সবারই জানা। যীশুকে হস্ত চুম্বন করে শত্রুদের নিকট ধরিয়ে দিয়েছিল তারই এক শিষ্য ঈস্কারিয়োতীয় যীহূদা।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কি কারণে যিহূদা ইস্কারিয়োত যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল? যীশু তো ছিলেন শান্তশিষ্ট ভদ্র, সবাই তো তাকে ভালবাসতো। লোকের মঙ্গল বৈ মন্দ কখনও তিনি চাননি। তিনি যা করেছেন, খোলাখুলিভাবে সবার চোখের সামনেই তা করেছেন। সাধারণ মানুষ, সমাজপতি, ধর্মগুরু, দখলদার রোম-সেনা, সবাই তাকে ভালো করেই চিনতো, জানতো। শাসককুল তাঁকে গ্রেফতার করতে পারতো যে কোনদিন, ডেকে আনতে পারতো জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। তবে এমন সর্বজনপরিচিত মানুষটিকে হাতে চুম্বন করে যীহূদা ইস্কারিয়োত-এর সনাক্ত করার দরকার হল কেন? ‘উপদেশাবলী’ বলে, পুরোহিত এবং সমাজপতিদের নাকি যীহুদা ইস্কারিয়োত বলেছিল, ‘যাকে আমি চুম্বন করব, জানবে সেই যীশু’। এইভাবে চিনিয়ে দেয়া থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যীশু ছদ্মবেশে ছিলেন। তাছাড়া, সুসমাচারের বিবরণ থেকে এটাও প্রমাণিত যে, পিতর ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ ভ্রাতৃসঙ্ঘের সদস্যবৃন্দ সম্পূর্ণ সশস্ত্র অবস্থায় ছিল, যেমন, ‘পিতরের নিকট তখন তরবারী থাকাতে তিনি তা খুলে মহাযাজকের দাসকে আঘাত করে তার ডান কান কেটে ফেললেন। সে দাসের নাম মল্ক (যোহন, ১৮ : ১০)। কিন্তু যীশু বুঝতে পেরেছিলেন, সেখানে বাধাদানের চেষ্টা বৃথা, তাই তিনি বললেন, ‘তরবারী কোষবদ্ধ কর’। অতএব, যীশুকে তারা ধরে নিয়ে গেল। আর তাঁর শিষ্যরা ডামাডোলের মধ্যে অন্ধকারে ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে গা-ঢাকা দিল।
‘যীশুকে দণ্ড দেয়া হয়েছিল অকারণে’ এই বিষয়ে সুসমাচারে লেখকগণ একমত। বিচারসভা এবং মহাযাজকেরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দাঁড় করেছে, বিরুদ্ধ সাক্ষ্য অন্বেষণ করেছে, কিন্তু যীশুকে দোষীসাব্যস্ত করতে পারেনি। তবে, জানা যায়নি কি অপরাধের সংবাদ বিশ্বাসঘাতক যিহূদা ইস্কারিয়োত তাদেরকে দিয়েছিল। বিচারকালের কোন প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি, শুনানীর সময়ও কখনো তাঁকে দেখা যায়নি।
একটি কথা অবশ্য জানা যায়, প্রধান পুরোহিতগণ তাঁকে ত্রিশটি রৌপ্যমুদ্রা দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন দিয়েছিলেন? দিয়েছিলেন, যেন মানুষটিকে সারা নগরের লোক চেনে, তাঁকেই সনাক্ত করতে। কিন্তু সনাক্তকরণ চুম্বন ব্যতীত যদি তার বিরুদ্ধে অভিযোগের নিশ্চিদ্র কোন প্রমাণ সে দিতে পারত তবে কি কর্তারা অমন অসহায়বোধ করতেন। তাই তখন থেকেই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া, মাত্র ত্রিশটি রৌপ্যমুদ্রার জন্য যিহূদা অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বস্তুতঃ কারণ নিশ্চয় অন্য কিছু ছিল, যা যিহূদার আত্মহত্যার কারণে কোনদিন আর প্রকাশ পায়নি।
যাহোক, ইহুদিদের দাবি ছিল, তাদের এক ব্যবস্থা আছে, সে ব্যবস্থানুসারে যীশুর প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত। কেননা, সে নিজেকে খোদার পুত্র করে তুলেছে। কিন্তু এসবকথা নিয়ে রোমানরা মাথা ঘামাবে কেন? ধর্মীয় ঝগড়ায় তাদের উৎসাহ ছিল না। তবুও, যোহন বলছেন :
“পীলাত যখন একথা শুনলেন, তিনি আরও ভীত হলেন’ (১৯ : ৮)।
কিসের ভয়? তার হাতে তো পুলিশ ছিল, তাছাড়া, সৈন্য-সামন্ত এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা। নীরব যীশুকে তিনি বলছেন :
‘তুমি কি জান যে, তোমাকে ক্রুশে দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে এবং তোমাকে ছেড়ে দেয়ার ক্ষমতাও আমার আছে’ (১৯ : ১০)। তাহলে পীলাতের ভয়টা কিসের? শাসক হিসেবে পীলাত এমনই অত্যাচারী এবং ইহুদী-বিদ্বেষী ছিল যে রোম তাঁকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। যাহোক, শেষপর্যন্ত যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। রাজনৈতিক কারণ একটি নিশ্চয় ছিল, আর এ তো অজানা কথা নয় যে, রাজনৈতিক কারণের উল্লেখ নথিপত্রে বড় একটা থাকে না।