মতিন সাহেবের বাসা বনানীতে।
নিজের বাড়ি নয়–ভাড়া করা। পুরানো ধরনের বাড়ি। অনেকগুলি ঘর। সামনে ফাঁকা জায়গায় দেশী ফুলের গাছ। চাপা গাছ, কেয়া গাছ, হাসনাহেনা। জংলা জংলা ভাব আছে। বাড়ির দক্ষিণে দুটা ঝাকড়া কাঁঠাল গাছ। একটা কাঁঠাল গাছের তলা বাঁধানো। ছুটির দিনের দুপুরে মিতু এইখানে বসে একা একা সাপলুডু খেলে। কাঁঠাল তলার আরেকটা নাম আছে–কান্নাতলা। মন খারাপ হলে মিতু এখানে বসে কাঁদে।
এত বড় বাড়িতে মানুষের সংখ্যা অল্প।
মতিন সাহেবের স্ত্রী–সুরমা। তিনি মতিঝিল জনতা ব্যাংকের মহিলা শাখার ম্যানেজার। সারাদিন অফিসেই থাকেন। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে প্রথমেই সবাইকে খানিকক্ষণ বকা ঝকা করেন, তারপর উঠে যান দোতলায়। রোজ সন্ধ্যায় তাঁর মাথা ধরে। দোতলায় তাঁর ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘণ্টা দুএক চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। তারপর একতলায় নেমে এসে আবার সবাইকে খানিকক্ষণ বকা ঝকা করেন। ঝড় ঝাপ্টা বেশীর ভাগ যায় তাঁর বড় ছেলে সাবেরের উপর দিয়ে। সাবের এই পরিবারে বড় ধরনের সমস্যা তৈরী করেছে। সবাইকে অশান্তিতে ফেলেছে।
সাবের দোতলায় থাকে। একেবারে কোনার দুটি ঘর তার। একটি স্টাডি রুম, অন্যটি শোবার ঘর। সাবের তিন বছর আগে ডাক্তারী পাস করেছে। পাস করবার পরপরই ঘােষণা করেছে ডাক্তারী কিছুই সে শিখতে পারেনি। সে চিকিৎসার ক, খও জানে না। কাজেই ডাক্তারী করবে না। মতিন সাহেব সাবেরকে ডেকে বলেছিলেন, শুনলাম তুমি চাকরি-বাকরি নিতে চাও না–সত্যি?
সাবের শান্ত গলায় বলেছে, সত্যি। প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে চাই না।
কেন চাও না?
আমি ডাক্তারী কিছুই শিখতে পারিনি।
পরীক্ষায় তো খুব ভাল রেজাল্ট করেছ।
তা করেছি, কিন্তু আমার কিছুই মনে নেই।
কিছুই মনে নেই বলতে কি মিন করছ?
যেমন ধর ডিপথেরিয়া। কিছুক্ষণ আগে ডিপথেরিয়া নিয়ে চিন্তা করছিলাম। ডিপথেরিয়াতে এন্টিটক্সিন দিতে হয় এবং এন্টিবায়োটিক দিতে হয়। এন্টিটক্সিনের ডোজ কিছুই মনে নেই। ডিপথেরিয়াতে কার্ডিয়াক ফেইলিউর হয়–কেন হয় তাও মনে নেই।
সব কিছু মনে থাকতে হবে?
অফ কোর্স মনে থাকতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে কথা।
তুমি তাহলে কি করবে?
আমি নিজে নিজে পড়ব। যেদিন বুঝব যা জানার সব জেনেছি সেদিন চিকিৎসা শুরু করব।
মতিন সাহেব বললেন, তুমি যা করছ তা যে এক ধরনের পাগলামি ত কি বুঝতে পারছ?
না বুঝতে পারছি না।
আমি কিছুই বলব না। এইসব পাগলামি তুমি তোমার মার কাছ থেকে পেয়েছ। তোমার মাকে আমি যেমন কিছু বলি না–তোমাকেও বলব না। তবে আশা করব যে, দ্রুত পাগলামি কাটিয়ে উঠবে।
সাবের মাথা নিচু করে রাখল। কিছু বলল না। মতিন সাহেব বললেন, বুঝতে পারছ কি বলছি?
পারছি।
পাগলামি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।
জি আচ্ছা।
পাগলামি কাটিয়ে ওঠার কোন রকম লক্ষণ সাবেরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার স্টাডি রুমে চিকিৎসা শাস্ত্রের রাজ্যের বই। সারাদিন সে বই পড়ে। যে সময়টা বই পড়ে না–বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে। এমাথা ওমাথায় যায়–ওমাথা থেকে এমাথায় আসে। যা পড়েছে তা মনে করার চেষ্টা করে।
দোতলায় মার ঘরের পাশের ঘরে থাকে মিতু এবং এষা। মেজো মেয়ে এষা ইংরেজী সাহিত্যে সেকেন্ড ইয়ার অনার্স পড়ছে। রূপবতী না হলেও স্নিগ্ধ চেহারা, অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তার বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। ছেলেটির নাম জুবায়ের। লেদার টেকনোলজিতে জার্মানী থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসেছে। নিজেই ছোটখাটো ইণ্ডাস্ট্রির মত শুরু করেছে। শুরুটা করেছে চমৎকার। জুবায়ের প্রায়ই এ বাড়িতে। আসে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করে।
মতিন সাহেবের বড় মেয়ের নাম নিশা। মাত্র কিছুদিন হল তার বিয়ে হয়েছে। এই মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী। রূপবতীদের সাধারণ ত্রুটি–অহংকার তার মধ্যে পুরোপুরি আছে। নিশার স্বামী ফজলুর রহমান গোবেচারা ধরনের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিক্সের এসোসিয়েট প্রফেসর। নিশা এই বিয়েতে সুখী হয়নি বলে মনে হয়। বাবার বাড়িতে সে যখন আসে–স্বামী এবং শশুর বাড়ির বদনাম করতে আসে। মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও করে।
মতিন সাহেব থাকেন এক তলায়। বলা চলে একা একাই থাকেন। এমনও দিন যায়–স্ত্রীর সঙ্গে তার কথাই হয় না। এই নিয়ে তাঁর মনে কোন ক্ষোভ আছে বলে মনে হয় না। মতিন সাহেবের পাশের ঘরে থাকে মিতুর ছোট মামা মন্টু। জগন্নাথ কলেজ থেকে দুবার বি.এ.পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে সে। তৃতীয়বারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মন্টুর ঘরের দরজায় বড় বড় করে লেখা–
মনোয়ার আহমেদ মন্টু
তার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা–বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। মন্টুর ঘর দিন-রাতই খোলা। যার ইচ্ছা সে ঘরে ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে। মতিন সাহেবের পরিবারের এই হচ্ছে মোটামুটি পরিচয়। এরা ছাড়াও দুজন কাজের লোক, একজন বাবুর্চি, একজন মালী, একজন দারোয়ান, একজন ড্রাইভার এ বাড়িতেই থাকে। এদের থাকার জায়গা বাড়ির পেছনের টিন শেডে। এইসব মানুষের সঙ্গে তিনদিন আগে আরেকজন মানুষ যুক্ত হয়েছে যার কোন নাম নেই এবং যে পুরানো কোন কথা মনে করতে পারছে না।
এক তলায় একটা ঘর তাকে দেয়া হয়েছে। নির্বিকার ভঙ্গিতেই সে সেই ঘরে আছে। খাওয়া-দাওয়া করছে, ঘুমুচ্ছে। যেন এটা তার নিজেরই ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইতেও শোনা যাচ্ছে। একটিই গান–
সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
কহে কানে কানে শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।
মতিন সাহেব লোকটির খোঁজ বের করার ভালই চেষ্টা করেছেন। থানায় ডায়েরী করিয়েছেন। দুটি দৈনিক পত্রিকায় সন্ধান চাই বিজ্ঞাপন ছবিসহ ছাপা হয়েছে। এ্যাকসিডেন্ট যেখানে হয়েছিল সেখানেও লোক পাঠিয়েছিলেন। কেউ কোনরকম সন্ধান দিতে পারেনি। মতিন সাহেব বুঝতে পারছেন না, তার কি করণীয় আছে। তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন আরো তিন-চারদিন দেখে লোকটাকে যেখান থেকে তুলেছেন সেখানে রেখে আসবেন। কাজটা অমানবিক হলেও কিছু করার নেই। সঙ্গে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিলেই হবে। লোকটি স্মৃতিশক্তি তার কারণেই হারিয়েছে তাতো নাও হতে পারে। হয়ত আগে থেকেই স্মৃতিশক্তি ছিল না।
বুধবার সন্ধ্যা।
মতিন সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। এষা ট্রেতে করে চা, এক পিস কেক এবং কলা এনে সামনে রাখল। মতিন সাহেব বললেন, কেমন আছ মা?
এষা হাসি মুখে বলল, ভাল আছি। তুমি কেমন আছো বাবা?
আমি মন্দ আছি।
পিতা এবং কন্যা দুজনই একসঙ্গে হেসে উঠল। এষা কথা বলা শেখার পর থেকে এই জাতীয় বাক্যালাপ দুজনের মধ্যে চলছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধরনটা একটু পাল্টাচ্ছে। এষার পাঁচ বছর বয়সে কথাবার্তা হত এ রকম :
মতিন সাহেব উঁচু গলায় বলতেন, কেমন আছ মা-মণি।
এষা প্রায় চিৎকার করে বলতো, তুমি কেমন আছো বাবা-মণি।
আমি মন্দ আছি।
আমিও মন্দ আছি।
হি হি হি।
আজ দুজনেরই বয়স বেড়েছে কিন্তু এই একটা জায়গায় যেন বয়স আটকে আছে। এষা বাবার সামনে চা রাখল। কোমল গলায় বলল, কলার খোসা ছাড়িয়ে দেব বাবা? মতিন সাহেব বললেন, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কলার খোসা ছড়ানো দারুণ কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটা করে তুই আমাকে সাহায্য করতে চাস। কিছু করতে হবে না–তুই আমার সামনে বোস। বসতে বলার দরকার ছিল না–এষা নিজ থেকেই বসত। সন্ধ্যাবেলা বেশ কিছুটা সময় সে বাবার সঙ্গে বসে। মতিন সাহেব মেয়ের কাছ থেকে বাড়ির সারাদিনের খবরাখবর নেন। এষাকে এ বাড়ির গেজেট বলা চলে। কিছুই তার চোখ এড়ায় না। বলেও খুব গুছিয়ে।
মতিন সাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ তোর মা আছে কেমন?
জানি না। ইউনিভার্সিটিতে যাবার আগে উঁকি দিয়েছিলাম। মা খ্যাক করে উঠেছেন–কেন ডিসটার্ব করছ?
বেচারী খেটেখুটে বাসায় আসে। ডিসটার্ব না করলেই হয়।
ডিসটার্ব আবার কি? আমি মার সঙ্গে কথাও বলব না?
যখন মন টন ভাল থাকবে তখন কথা বলবি?
তার মন কখনোই ভাল থাকে না।
তাও ঠিক।
আরেকটা খবর আছে বাবা।
বলে ফেল।
হরিপ্রসন্ন স্যার এসেছেন।
মতিন সাহব বিরক্ত মুখে বললেন, কেন?
কিছু বলেন নি। দেখে মনে হল খুব অসুস্থ। তুমি কি তার সঙ্গে কথা বলবে? ডাকব?
না এখন কথা বলব না। মনটা ভাল না।
মন ভাল না কেন?
তিনি উত্তর দিলেন না। সিগারেট ধরালেন। তিনি এখন পুরোদমে সিগারেট খাচ্ছেন। দিনে এক প্যাকেটের বেশী লাগে।
এষা একটু চিন্তিত বোধ করল। বাবার সিগারেট শুরু করা মানে তার ওষুধের কারখানায় বড় ধরনের কোন সমস্যা। যে সমস্যা নিয়ে তিনি কখনো কারো সঙ্গে কথা বলেন না।
সাবেরের খবর কি রে?
দাদা ভালই আছে। একটা নর কংকাল কিনে এনেছে। অস্থিবিদ্যা যা শিখেছিল সব ভুলে গেছে। আবার নতুন করে নাকি শিখতে হবে।
মতিন সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এষা বলল, মার সঙ্গে দাদাকেও নিয়ে। যাও। তাকেও কোন একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। আরেক কাপ চা দেব বাবা?
না।
তুমি আবার সিগারেট ধরিয়েছ। তোমার কারখানায় কি কোন সমস্যা হচ্ছে? মতিন সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। মনে হল তিনি শুনতে পাননি। এষা বলল, তুমি তো ঐ লোকটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে না।
কোন লোকটা?
ঐ যে যাকে নিয়ে এসেছ। এ্যামনেশিয়া হয়েছে।
ওর কোন খবর আছে নাকি?
না। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়িতে সে সুখে আছে।
কারো সঙ্গে কথাটথা বলে না?
নিজ থেকে বলে না। কেউ কিছু বললে খুশী হয়ে জবাব দেয়। আজ দুপুরে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি সে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে মিতুর সঙ্গে লুডু খেলছে।
তুই কি কথা বলেছিস?
না। কথা বলতাম। কিন্তু লোকটাকে আমার কেন জানি পাগল মনে হয়। চোখের দৃষ্টি যেন কেমন।
আরে দূর–চোখের দৃষ্টি ঠিকই আছে। লোকটা কিছু মনে করতে পারছে এই জন্যে তুই ভয় পাচ্ছিস। তোর কাছে মনে হচ্ছে লোকটা পাগল। তুই বরং লোকটার সঙ্গে কথা বল।
কেন?
কথা বললে বুঝতে পারবি–তার ব্যাকগ্রাউণ্ড কি? কি ধরনের ফ্যামিলি থেকে এসেছে। পড়াশোনা কি। এতে লোকটাকে ট্রেস করতে সুবিধা হবে।
তুমি তো অনেক কথা বলেছ–তোমার কি মনে হয়?
মতিন সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমি খানিকটা কনফিউজড।
সে কি?
মতিন সাহেব আরো একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে লক্ষ্য করলেন, লোকটা হেঁটে হেঁটে কাঁঠাল গাছগুলির দিকে যাচ্ছে। মতিন সাহেব বললেন, লোকটার একটা নাম দরকার। এমিতে ডাকার জন্য একটা নাম। যতদিন আসল নাম পাওয়া না গেছে ততদিন এই নামে ডাকব।
নাম তো বাবা দেয়া হয়েছে।
কি নাম?
নাম হচ্ছে জুলাই।
জুলাই?
হ্যাঁ, জুলাই। মিতু নাম রেখেছে। এখন জুলাই মাস, কাজেই তার নাম জুলাই। যখন আগস্ট মাস আসবে তখন তার নাম হয়ে যাবে আগস্ট। মিতুর খুব ইচ্ছা–লোকটা যেন সারাজীবন এই বাড়িতে থাকে, যাতে সে প্রতিমাসে একবার করে নাম বদলাতে পারে।
এষা খিল খিল করে হেসে উঠল। মতিন সাহেব বললেন, আরেক কাপ চা আন তো মা।
আরেক কাপ চা এনে দিচ্ছি–কিন্তু বাবা তুমি তোমার সিগারেটের প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে দাও। এরপর তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলে–আমার কাছে চাইবে।
মতিন সাহেব সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে দিলেন।
এষা চা বানিয়ে এনে দেখে, তার বাবা ঘুমুচ্ছেন। তন্দ্রা নয়–বেশ ভাল ঘুম। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত একজন মানুষের ঘুম। এষার তাকে জাগাতে ইচ্ছা করল না। সে চায়ের কাপ নিয়ে বাগানে নেমে গেল। জুলাই নামের লোকটাকে দিয়ে আসা যাক। তার সঙ্গে কথাও হয়নি। কিছুক্ষণ কথা বলা যেতে পারে। তবে নিজের হাতে চা নিয়ে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। লোকটা লাই পেয়ে যেতে পারে; বরং সে নিজেই নিয়ে এসে চা খাবে। চা খেতে খেতে দুএকটা কথা বলবে।
বাগানের এই দিকটা অন্ধকার। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বা ফিউজ হয়েছে, নতুন বাল্ব লাগানো হয়নি। তবে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো খানিকটা এসেছে এদিকে। সেই আলোয় অস্পষ্ট করে হলেও সবকিছু চোখে পড়ে। লোকটিকে কাঁঠাল গাছের নীচে পা তুলে বসে থাকতে দেখা গেল।
বসে থাকার ভঙ্গিটি মজার। পা তুলে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসা। শিরদাঁড়া সোজা করা। ধ্যান-ট্যান করছে না-কি? লোকটা বসেছে উল্টোদিকে। এষা এগুচ্ছে পেছন দিক থেকে। লোকটার মুখ দেখতে পারছে না। পেছন দিক থেকে একটা মানুষের কাছে যেতে ভাল লাগে না।
কেমন আছেন?
লোকটা চমকে উঠল। উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এষা বলল, আমি মিতুর বড় বোন। লোকটা নীচু গলায় বলল–জ্বি, আমি জানি। মিতু বলেছে।
আপনি বসুন, দাড়িয়ে আছেন কেন?
লোকটি বলল, আপনিও বসুন।
কথাগুলি এত সহজ এবং এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা হল যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন মানুষ কথা বলছে। এষা বসল। বসতে বসতে বলল, বাবা আপনার খোঁজ বের করার খুব চেষ্টা করছেন। আপনার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। আপনি কি দেখেছেন?
দেখেছি।
থানায় খবর দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে আপনাকে তুলে এনেছেন সেখানেও লোক পাঠানো হয়েছে।
আমি জানি। আপনার বাবা আমাকে বলেছেন।
আপনি কি কিছুই মনে করতে পারেন না?
জি না।
এর জন্যে আপনার মন খারাপ লাগছে না?
না।
আশ্চর্য! আপনার আত্মীয়-স্বজন কারা, তারা কোথায় আছেন–এই ভেবে মন খারাপ হচ্ছে না?
লোকটি চুপ করে রইল।
এষা বলল, আপনার আত্মীয়-স্বজনরা নিশ্চয়ই খুব দুঃশ্চিন্তায় আছেন। ছোটাছুটি করছেন।
লোকটি চুপ করেই রইল। যেন এই প্রসঙ্গে সে কোন কথা বলতে আগ্রহী নয়। এষা বলল, আপনার পড়াশোনা কতদূর?
জানি না।
আচ্ছা আমি একটা ইংরেজী কবিতা বলি আপনি এর বাংলা কি, বলুন তো
Remember me when I am gone away.
Gone far away into the silent land.
আমি অর্থ বলতে পারছি না।
আপনি কি ইংরেজী জানেন না?
ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয় জানি না।
ও আচ্ছা। আমার মনে হচ্ছিল, আপনি ইংরেজী জানেন।
আমি জানি না।
এষা উঠে দাঁড়াল। লোকটি বলল, চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, আপনিও ঘরে চলে যান। বৃষ্টি নামবে। দেখুন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
লোকটি জবাব দিল না।
রাত নটার দিকে বৃষ্টি নামল। এষা নিজের ঘরে পড়ছিল। মালী এসে বলল, আপা লোকটা কঁঠাল গাছের নীচে বইয়া বৃষ্টিতে ভিজতাছে।
কেন?
জানি না। ঘরে যাইতে বললাম, যায় না।
না গেলে না যাবে। ভিজুক।
পাগল-ছাগল মানুষ বাড়িতে রাখা ঠিক না আপা।
তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না। তুমি তোমার নিজের কাজ কর।
মালী চলে গেল। এষা জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। লোকটা বসে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। তার মধ্যে কোন রকম বিকার নেই। যেন একটা পাথরের মূর্তি। লোকটা কি পাগল? কথাবার্তায় অবশ্যি মনে হয়নি। ইংরেজী জানে না–তার মানে মূর্খ ধরনের মানুষ।
কাজের মেয়েটি এসে বলল, আপা আপনার টেলিফোন।
কার টেলিফোন?।
কাজের মেয়েটি মুখ টিপে হাসল। যার মানে এই টেলিফোন জুবায়ের করেছে। জুবায়ের টেলিফোন করলেই এ বাড়িতে এক ধরনের চাপা হাসি হাসা হয়। এর কোন মানে আছে?
এষা টেলিফোন ধরল।
কে এষা?
হ্যাঁ।
তোমাদের এদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হ্যাঁ। হচ্ছে।
অল্প-স্বল্প না ক্যাটস এণ্ড ডগস?
ভালই হচ্ছে।
বৃষ্টিতে ভিজবে এষা?
না।
না কেন?
আগে একবার তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি, তারপর তুমি যে কাণ্ড করেছো তারপর আমার আর সাহসে কুলায় না।
আজ আমি সন্ন্যাসীর মত আচরণ করব। তোমার কাছ থেকে সবসময় চার হাত দূরে থাকব। ওয়ার্ড অব অনার। চলে আসব?
আস।
ভাল কথা, ঐ লোকটার কোন খোঁজ পাওয়া গেছে? মিঃ জুলাই?
না।
লোকটার সম্পর্কে আমার কি ধারণা শুনতে চাও? আমার ধারণা ব্যাটা একটা ফ্রড। বিরাট ফ্রড। স্মৃতিশক্তি হারানোর ভান করে তোমাদের এখানে মজায় আছে।
আমাদের এখানে মজার কি আছে।
ফুড এণ্ড শেলটার আছে। এই শহরে কটা লোকের ফুড এণ্ড শেলটার আছে জান? এবাউট ফটি পারসেন্ট লোকের নেই। তোমরা এক কাজ কর। ঘাড় ধরে ঐ লোকটাকে বের করে দাও।
লোকটার উপর তোমার এত রাগ কেন?
ফ্রড লোকজন আমি সহ্য করতে পারি না। লোকটার গালে পঞ্চাশ কেজি ওজনের দুটো চড় দিলেই দেখবে হারানো স্মৃতি ফিরে এসেছে। ফড় ফড় করে কথা বলছে।
কে দেবে চড়?
কেউ দিতে রাজি না থাকে আমি দেব।
আচ্ছা চলে এস। এসে চড় দিয়ে যাও।
এষা টেলিফোন রেখে জানালার পাশে চলে গেল–লোকটা এখনো বৃষ্টিতে ভিজছে। এই কাণ্ড সে কি ইচ্ছা করে করছে? দেখাতে চাচ্ছে–তার মাথা ঠিক নেই?
সাবের বারান্দায় হাঁটছিল।
হাঁটতে হাঁটতে সারা দুপুর যা পড়েছে তা মনে করার চেষ্টা চলছে। বেশীর ভাগই মনে পড়ছে না। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার ধারণা, ব্রেইন পুরোপুরি গেছে। আধঘন্টা আগের পড়া জিনিসও কিছুই মনে নেই।
কিছুক্ষণ আগে সে ডায়েট সম্পর্কে পড়ছিল। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কি কি মিনারেল লাগে, কতটুকু লাগে। সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। মনে করার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না।
ক্যালসিয়াম ও দৈনিক ১ গ্রাম। WHO বলছে তারচে কম হলেও চলে ০.৪ থেকে ০.৭।
আয়রণ : ১৫ মিলিগ্রাম আয়োডিন : ০১ মিলিগ্রাম। ফসফরাস ও ১ গ্রাম।
আসল জিনিসটাই মনে আসছে না সোডিয়াম কতটুকু দরকার। অনেকখানি। দৈনিক খাবার লবণ শরীরে যাচ্ছে–দরকার কতটুকু? এই লবণের সঙ্গে আবার ব্লাড প্রেসার জড়িত। ফ্লোরিনও তো দরকার। কতটুকু? একটু আগে পড়া অথচ কিছুই মনে পড়ছে না। সাবেরের প্রায় কান্না পাচ্ছে।
মিতু একতলা থেকে দোতলায় উঠে এল। বারান্দায় সাবেরকে হাঁটাহাঁটি করার দৃশ্য সে খানিকক্ষণ দেখে–সহজ স্বরে বলল, ভাইয়া তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ
সাবের তার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। তার চোখে-মুখে সুস্পষ্ট বিরক্তি। সোডিয়াম ইনটেকের পরিমাণ মনে করতে হবে। যেভাবেই হোক মনে করতে হবে। মিতু আবার বলল, ভাইয়া, তুমি বৃষ্টিতে ভিজে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গেছে।
বিরক্ত করিস নাতো।
তোমাকে কি রকম যেন পাগলের মত লাগছে।
তাই নাকি?
হুঁ।
সাবের এই প্রথম লক্ষ্য করল বৃষ্টির ছাটে সে সত্যি সত্যি অনেকখানি ভিজেছে। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। ঠাণ্ডা লাগলে অনেক রকম কমপ্লিকেশন। শরীরের ডিফেন্স সিসটেম দুর্বল হয়ে যাবে। ভাইরাস জেঁকে ধরবে। ইনফ্লুয়েনজা,
আচ্ছা ইনফ্লুয়েনজা ভাইরাসের নাম কি যেন।
মিতু।
কি?
আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
হ্যাঁ। অল্প একটু বাকি। পুরোপুরি পাগল হলে তুমি কি করবে?
জানি না।
মিস্টার জুলাই-র মত বৃষ্টিতে বসে বসে ভিজবে?
মিস্টার জুলাইটা কে?
ঐ দেখ কাঁঠাল গাছের নীচে বসে ভিজছে।
লোকটা কে?
কেউ জানে না কে। আমরা যখন ময়মনসিংহ থেকে আসছিলাম তখন গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে ফেলে দেই। প্রথম ভাবলাম মরে গেছে। কিন্তু মরে নাই। বাসায় নিয়ে এসেছি। এই লোকটাও তোমার মত কিছু মনে রাখতে পারে লো।
কতদিন হল আছে?
চারদিন হয়ে গেল।
আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।
তোমাকে বলে কি হবে?
সাবের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাও ঠিক। আমি নিজের যন্ত্রণাতেই অস্থির। অন্যের যন্ত্রণা নিয়ে চিন্তার সময় আমার কোথায়। সাবের বলল, মিতু তুই আমাকে চা খাওয়াতে পারবি?
না।
কাজের মেয়েটাকে বলে আসতে পারবি তো? নাকি তা-ও পারবি না।
তা-ও পারব না। আমি দোতলা থেকে মিস্টার জুলাইকে দেখব।
একটা মানুষ বৃষ্টিতে ভিজছে তার মধ্যে দেখার কি আছে?
লোকটা পাথরের মত বসে আছে। একটুও নড়ছে না। কখন নড়ে সেটা দেখব। বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দাও তো ভাইয়া লোকটার গায়ে আলো পড়ুক।
সাবের বাতি জ্বালিয়ে দিতেই লোকটার উপর আলো পড়ল। সাবের বিরক্ত হয়ে বলল, তুই না বললি লোকটা পাথরের মত বসে আছে, নড়ছে না। ঐ তো নড়ছে। সত্যিই তাই। লোকটা মাথার পানি ডান হাতে মুছছে। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সাবেরের দিকে তাকাল।
মিতু, ভদ্রলোকের নাম কি বললি?
মিস্টার জুলাই। আর তিনদিন পর উনার নাম হবে মিস্টার আগস্ট।
আমি বোধহয় পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছি, তোর কথাবার্তা কিছুই বুঝছি না। আর তিনদিন পর তার নাম মিস্টার আগস্ট হবে কেন?
ভাইয়া, তোমার সঙ্গে আমি এত কথা বলতে পারব না। তুমি কোন কিছু বুঝিয়ে বললেও বোঝ না।
মিতু বারান্দার এক কোণায় চলে গেল। এখান থেকে লোকটাকে ভাল দেখা যায়। সাবের নীচে গেল। সে নীচে নামল কাজের মেয়েটিকে চায়ের কথা বলার উদ্দেশ্যে। নীচে নেমে তা মনে রইল না। বাগানে নেমে গেল। মিস্টার জুলাই-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা করছে। তিনদিন পর তার নাম মিঃ আগস্ট কেন হচ্ছে তা জানা দরকার। জেনে ফেলার একটা বিপদও আছে–মস্তিষ্কের মেমোরী সেলে ইনফরমেশনটা থেকে যাবে। অপ্রয়োজনীয় ইনফরমেশন। প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন রাখার জায়গা টান পড়ে যাবে।
বৃষ্টি এখন আর আগের মত পড়ছে না। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। লোকটা বসেই। আছে। সাবের তার কাছাকাছি এগিয়ে গেল। বিস্ময়মাখা গলায় বলল, ভাই আপনি কে?
লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে পরিচিত ভঙ্গিতে তাকাল। যেন এই হাসির মধ্যেই তার পরিচয় লুকানো। সাবের বলল, আপনার নাম কি মিস্টার জুলাই?
জ্বি।
আপনাকে একটা জরুরী কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম এখন মনে করতে পারছি না–।
লোকটি হাসি মুখে বলল, আপনি জিজ্ঞেস করতে এসেছিলেন তিনদিন পর আমার নাম মিস্টার আগস্ট কেন হবে।
হ্যাঁ তাই–তাই। আপনি বুঝলেন কি করে? আপনি কি থট রিডিং জানেন? :
না। আপনি দোতলার বারান্দায় মিতুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি শুনতে পেলাম। উপর থেকে কথা বললে অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়।
আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন কি জন্যে?
ভিজতে ভাল লাগছে এই জন্যে ভিজছি।
ঠাণ্ডা লাগবে তো। একবার ঠাণ্ডা লেগে গেলে বিরাট সমস্যায় পড়বেন। কোড ভাইরাস আক্রমণ করবে। ইনফ্লুয়েনজা। সেখান থেকে রেসপিরেটরী ট্র্যাক্ট ইনফেকশন। আমি একজন ডাক্তার।
জানি, মিতু বলেছে।
অবশ্যি আমি ডাক্তারী প্র্যাকটিস করছি না। কিছুই মনে রাখতে পারি না। ভুলে যাই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সোডিয়াম ইনটেক কতটুকু প্রয়োজন অনেকক্ষণ ধরে মনে করার চেষ্টা করছি, পারছি না।
মনে রাখার চেষ্টা খুব বেশী করছেন বলে এই সমস্যা হচ্ছে। আপনি এক কাজ করুন, ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। এতে ফল হতে পারে।
সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, ভুলে যাবার চেষ্টা কিভাবে করব?
মনে রাখার চেষ্টা যেভাবে করেন তার উল্টোভাবে করবেন।
মনে রাখার চেষ্টা আমি কিভাবে করি?
লোকটি এর উত্তরে হেসে ফেলল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাবেরের মনে পড়ল একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্যে দৈনিক ১ থেকে ২ গ্রাম খাবার লবণই যথেষ্ট অথচ সে বোজ ১০ থেকে ১২ গ্রাম খাবার লবণ খায়।
সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, মনে পড়েছে।
লোকটি বলল, জানতাম মনে পড়বে।
সাবের বলল, আপনাকে ইন্টারেস্টিং মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
আপনাকেও ইন্টারেস্টিং মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনি আমাকে একটা ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন? ইংরেজী কবিতার দুটা লাইনের সুন্দর বাংলা করে দেবেন–
Remember me when I am gone away,
Gone far away into the silent land.
সাবের তৎক্ষণাৎ বলল,
মনে রেখ যখন চলিয়া যাব দূরে
নৈঃশব্দের দূর নগরীতে।
লোকটি বলল, বাহ সুন্দর তো। সাবের খানিকটা হকচকিয়ে গেল। চট করে তার মাথায় এমন সুন্দর দুটা লাইন কি করে এল, সে বুঝতে পারছে না। লাইন দুটা মাথা থেকে চলে যাচ্ছে না–ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনা আপনি অন্য রকম করে সাজানো হচ্ছে–
যখন চলিয়া যাব দূরে
বহু দূরে। নৈঃশব্দের দূর নগরীতে–
তিনবার দূর শব্দটা ব্যবহার করায় মনে হচ্ছে অনেক অনেক দূরের কোন জায়গার কথা বলা হচ্ছে। মানুষের চিন্তা এবং কল্পনার বাইরের কোন নগরী, যে নগরী অস্পষ্ট এবং রহস্যময়।
সাবের বলল, আপনার পাশে বসি খানিকক্ষণ?
বসুন। বৃষ্টিতে ভিজে আবার অসুখ করবে না তো? ভাইরাস যদি ধরে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, রেসপিরেটরী ট্র্যাক্ট ইনফেকশন।
ধরুক। কদিন আর বাঁচব। মরতে তো হবেই তাই না? যেতে হবে অনেক দূরের দেশে। দূরে, বহু দূরে, নৈঃশব্দের দূর নগরীতে।
সাবের বসল তার পাশে। দুজনই বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। মিতু জানালা থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখছে। সে মনে মনে বলল, পাগলে পাগলে খুব মিল। হয়েছে। মিতুর খুব হাসি পাচ্ছে। সে হেসে ফেলল। খিল খিল হাসি। মিস্টার জুলাই হাসির শব্দ শুনে তাকাল মিতুর দিকে। মিতুর আরো বেশী বেশী হাসি। আসছে।
জুবায়ের আসতে আসতে রাত দশটা বাজিয়ে ফেলল।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দুএকটা তারাও উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
জুবায়ের এষার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, সরি। সময়মতই রওনা হচ্ছিলাম। গাড়িতে উঠতে যাব–এক গেস্ট এসে উপস্থিত। এমন গেস্ট যে বলা যায় না–ভাই এখন যান জরুরী কাজে যাচ্ছি।
এষা বলল, এত সাফাই গাচ্ছ কেন? জরুরী কাজ তো কিছু না।
জুবায়ের বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বলল, দুজন এক সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব এটা জরুরী না? কি বলছ তুমি? স্নান করব নীপ বনে, ছায়াবীথি তলে–এটা যদি জরুরী না হয় তাহলে …..
তুমি কি খেয়ে এসেছ?
না।
ভাল করেছ। এক সঙ্গে খাব। তুমি কি এখনি খাবে? খাবার গরম করতে বলব?
বল। এই ফাঁকে আমি চট করে তোমার মাতৃদেবীর সঙ্গে দেখা করে আসি।
প্লীজ এখন মাকে বিরক্ত করো না। মার মাথা ধরেছে। মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। এখন গেলেই মা রাগ করবেন।
পৃথিবীর কেউ আমার উপর রাগ করতে পারে না।
মা পারে। এখন তুমি মার ঘরে ঢুকলে মা তোমাকে ধমক দিয়ে বের করে দেবে–এটা ভাল হবে? তারচে, চল খাওয়া-দাওয়া করা যাক।
রাতের খাবার শেষ করে জুবায়ের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, চল ছাদে যাই। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে আসি। আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।
এষা বলল, পাগল এখন ছাদে যাব কি? বৃষ্টিতে ছাদ পিছল হয়ে আছে।
জুবায়ের খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল।
এষা বলল, পান খাবে? পান এনে দেব?
না।
কি ব্যাপার তুমি হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?
জুবায়ের বলল, তোমার ব্যাপারে আমার একটা অবজারভেশন আছে। তুমি কোন নির্জন জায়গায় আমার সঙ্গে থাকতে চাও না। এক ধরনের অস্বস্তি বোধ কর। এর কারণ কি বল তো? একজন মৌলানার সামনে তিনবার কবুল বলিনি–এই কি কারণ?
এষা বলল, কি বলছ এসব? হয়েছে কি তোমার? ছাদে যেতে চাচ্ছি না। কারণ ছাদ পিছল হয়ে আছে। তারপরেও তুমি যদি যেতে চাও–খুব ভাল কথা। চল যাই–পা পিছলে কোমর ভাঙ্গলে কিন্তু আমাকে দোষ দেবে না।
জুবায়ের বলল, যেদিন ছাদ শুকনো থাকে সেদিনও কিন্তু যেতে চাও না। গত সপ্তাহের কথা কি তোমার মনে আছে? তোমাকে বললাম, চল ছাদে যাই। তুমি বললে–তুমি যাও আমি আসছি। আমি অপেক্ষা করছি। তুমি এলে ঠিকই, মিতুকে সঙ্গে নিয়ে এলে।
এষা বিরক্ত গলায় বলল, মিতু আমার সঙ্গে আসতে চাচ্ছিল। আমি কি করব? মিতুকে বলব–না তুমি যেতে পারবে না। আমাকে এক-একা যেতে হবে যাতে অন্ধকারে ঐ লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। লোকটাকে এই সুযোগ দিতে হবে কারণ দুদিন পর সে আমাকে বিয়ে করছে।
তুমি রেগে যাচ্ছ এষা।
সরি।
আশ্চর্য! তুমি এত চট করে রেগে যাও। দেখি একটা পান দাও তো খাই।
এষা পান এনে দিল।
জুবায়ের দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আচ্ছা ঐ লোকের খবর কি? তার বাড়িঘরের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?
না।
সারাদিন সে করে কি?
কিছুই করে না। আজ সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টিতে ভিজেছে পুরো চারঘণ্টা।
খুবই সন্দেহজনক।
সন্দেহজনক কেন?
সে যে একটা অদ্ভুত কিছু এইটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে বিরাট ফ্রড। তোমাদের সাবধান থাকা উচিত।
আমার মনে হয় না সে ফুড। বরং আমার মনে হয় একটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।
ইয়ং লেডি ফর ইওর ইনফরমেশন–পৃথিবীতে ফ্রড মাত্রই ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার হয়। বিরক্তিকর কোন মানুষ ফ্রড হতে পারে না। আমি লোকটার সঙ্গে আলাপ করে আসি। আশা করি জেগে আছে। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? এষা নাসূচক মাথা নাড়ল। জুবায়ের একাই রওনা হল।
মিস্টার জুলাই জেগে ছিল। বিছানায় বসে গভীর মনোযোগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফী পত্রিকার পাতার দিকে তাকিয়ে আছে।
জুবায়ের ঘরে ঢুকেই বলল, কেমন আছেন?
জি ভাল।
আমার নাম মোহম্মদ জুবায়ের। আপনার নাম কি জানতে পারি।
আমার নাম জুলাই। তিনদিন পর নাম বদল হবার সম্ভাবনা আছে। বসুন।
বসব না–দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।
জিজ্ঞেস করুন। তবে আমার মনে হয় আপনার বেশীর ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারব না।
জবাব দিতে পারবেন না এমন কোন প্রশ্ন আমি আপনাকে করব না। তবে ইচ্ছা করে জবাব না দিলে তো কিছুই করার নেই।
আমি যা জানি আপনাকে বলব। অবশ্যই বলব।
পাগল সাজার চেষ্টা করছেন কেন?
কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
শুনলাম চারঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজেছেন। আপনার এই কাজের পেছনে পাগল সাজার সূক্ষ্ম চেষ্টা লক্ষ্য করছি। কারণটা জানতে চাচ্ছি।
মিস্টার জুলাই শান্ত গলায় বলল, আপনি বোধ হয় একটা জিনিস জানেন না–পাগলরা কখনো বৃষ্টিতে ভিজে না। পানি আর আগুন–এই দুটা জিনিসকে পাগলরা ভয় পায়। এই দুটা জিনিস থেকে এরা অনেক দূরে থাকে। কখনো শুনবেন না কোন পাগল পানিতে ডুবে মারা গেছে বা আগুনে ঝাপিয়ে পড়েছে। জুবায়ের প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, আপনি কি সিগারেট খান?
না।
একটা খান আমার সঙ্গে। খেয়ে দেখুন কেমন লাগে।
লোকটা সিগারেট নিল। আগুন ধরিয়ে টানতে লাগল।
জুবায়ের বলল, আপনার কয়েকটা জিনিস আমি মিলাতে পারছি না। দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে না। আপনি বলছেন আপনার আগের কথা কিছুই মনে নেই। স্মৃতি-বিলুপ্তি ঘটেছে। অথচ পাগল পানি এবং আগুন ভয় পায় এটা মনে আছে। একটা মনে থাকবে, একটা থাকবে না তা কেমন করে হয়।
লোকটা জবাব দিল না। নিজের মনে সিগারেট টানতে লাগল।
জুবায়ের চলে যাবার আগে এষাকে বলে গেল–সাবধান থাকবে। খুব সাবধান। খুবই সন্দেহজনক ক্যারেকটার। তোমার বাবাকে বলবে–অতি দ্রুত তিনি যেন লোকটাকে ডিসপোজ করার ব্যবস্থা করেন। লোকটার কোন একটা বদ মতলব আছে।
এষা হাসতে হাসতে বলল, তোমার কি ধারণা–কি করবে সে? গভীর রাতে আমাদের খুন করে পালিয়ে যাবে?
বিচিত্র কিছু না। করতেও তো পারে।
লোকটাকে দেখে খুনী খুনী মনে হয় না। ফর ইওর ইনফরমেশন ইয়াং লেডি–খুনীদের আলাদা কোন চেহারা হয়
ফর ইওর ইনফরমেশন ইয়াং ম্যান–রাত পৌনে বারটা বাজে–তোমার এখন চলে যাওয়া উচিত।
আমি যাচ্ছি–কিন্তু আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি–বি কেয়ারফুল, নেভার ট্রাস্ট এ স্ট্রেঞ্জার।
সুরমা খেতে বসেছেন। খাবার ঘরে শুধু তিনি এবং মতিন সাহেব। সুরমা খাবার সময় কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। কেউ কথা বললে, এমনভাবে তাকান যেন বিরক্ত হচ্ছেন। মতিন সাহেব বললেন, মাথাব্যথা কমেছে?
সুরমা তাঁর দিকে না তাকিয়েই বললেন, না।
রোজ রোজ মাথা ধরে এটা তো ভাল কথা না। একজন ডাক্তার দেখাও। সাধারণত চোখের কোন প্রবলেম হলে মাথা ধরে। তোমার কি চোখের কোন সমস্যা আছে।
জানি না, থাকতে পারে।
কাল আমার সঙ্গে চল–আমার চেনা একজন চোখের ডাক্তার আছেন।
কাল আসুক তখন দেখা যাবে।
সুরমা উঠে পড়লেন। প্লেটে খাবার পড়ে আছে। অল্প কিছু মুখে দিয়েছেন। তাঁর বমি বমি আসছে। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন, তোমার ঐ লোকের কোন গতি করতে পারলে?
না।
সে কি স্থায়ীভাবে এই বাড়িতেই থাকবে?
না–তা কেন। কয়েকটা দিন দেখে–বিদেয় করে দেব।
মিতু ওর সঙ্গে মাখামখি করে, আমার এটা পছন্দ না।
মিতুকে নিষেধ করে দিও।
তোমার ছেলেমেয়েরা কেউ আমার কথা শুনে না–ওদের কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। হরিপ্রসন্ন বাবু এসেছেন, জান?
এষা বলেছে।
কি জন্যে এসেছেন তা জান?
না।
সুরমা কঠিন মুখে বললেন, কোথাও থাকার জায়গা নেই বলে এসেছেন। তাঁর ধারণা তিনি অল্প কিছুদিন বাঁচবেন। সেই অল্প কিছুদিন–এই বাড়িতে থাকতে চান।
তুমি না করে দিয়েছ তো?
আমি না করব কেন? অপ্রিয় কাজগুলি তুমি সব সময় আমাকে দিয়ে করাতে চাও। এটা ঠিক না। তোমার যদি কিছু বলার থাকে তুমি বলবে।