দুই
ইরাকের কাফেলার পরিচালকের সঙ্গে ১৭ই নভেম্বর আমি মক্কা ত্যাগ করি। তিনি নিজ ব্যয়ে বাগদাদ পর্যন্ত আমার জন্য একটি উটের পিঠের আসনের অর্ধাংশ ভাড়া করে দেন এবং পথে নিজে আমার দেখাশুনা করেন। বিদায়ের সময় কা’বা তাওয়াফ (দক্ষিণ) করার পরে আমরা মা’র এসে পৌঁছলাম। আমাদের সঙ্গে ইরাক, খোরাসান, ফারস ও অন্যান্য প্রাচ্যদেশের এত বিপুল সংখ্যক হাজী ছিলেন যে দেখে মনে হচ্ছিল যেন জমিনের উপর দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ উঠেছে এমনি কালো মেঘের মত তারা ছুটে চলেছিলেন। লোকের ভিড় এতই বেশী ছিল যে এক মুহূর্তের জন্য কেউ তার কাফেলা ছেড়ে কোন দিকে সরে গেলে পুনরায় তার জায়গা চিনে নিবে এমন কোন উপায় ছিল না। এ-কাফেলার সঙ্গে দন্দ্ৰি হাজীদের মধ্যে বিতরণের জন্য উটের পিঠে পানি বোঝাই ছিল। তাছাড়া খয়রাতী খাদ্য ও রোগাক্রান্ত হাজীদের জন্য ঔষধপথ্যবাহী উটও সঙ্গে ছিল। কাফেলা যেখানে গিয়ে থেমেছে সেখানেই বড় বড় পিতলের কড়াইতে রান্না করা হয়েছে। দরিদ্র হাজীদের এবং যাদের সঙ্গে খাদ্যবস্তু ছিল না তাদের খাদ্য এখান থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক অতিরিক্ত উটও আমাদের সঙ্গে ছিল। যারা চলতে অক্ষম তারা এসব উটে চড়ে অগ্রসর হচ্ছিল। ইরাকের সুলতান আবু সাঈদের বদানের জন্যই এসব ব্যবস্থা সম্ভবপর হয়েছিল। এ ছাড়া কাফেলার সঙ্গে কর্মব্যস্ত বাজারও ছিল। অনেক রকম দ্রব্যসম্ভার, খাদ্য, ফলমূল প্রভৃতি সবকিছুই সেখানে পাওয়া যেত। মশাল জ্বেলে দোকানদাররা কাফেলার সঙ্গে রাত্রে চলতে থাকে। তাদের মশালের আলোকে রাতের অন্ধকারও দিনের মত আলোময় হয়ে উঠে।
আমরা খুলায় ও বদর হয়ে মদিনায় ফিরে এলাম এবং পুনরায় হজরতের (সাঃ) রওজা মোবারক জেয়ারতের সৌভাগ্য লাভ করলাম। মদিনায় ছয়দিন কাটিয়ে তিন রাত্রি চলার উপযোগী পানি নিয়ে আমরা যাত্রী করলাম এবং ওয়াদিল-আরুসে পৌঁছে পুনরায় পানি সংগ্রহ করে নিলাম। এখানে মাটী খুঁড়ে পানের উপযোগী পানি পাওয়া। যায়। ওয়াদিল-আরুস ছেড়ে আমরা নাজদ-এর দেশে প্রবেশ করলাম। যতদূর দৃষ্টি যায়, এটি একটানা একটি সমতলভূমি। এখানকার নির্মল সুগন্ধি বাতাসে নিঃশ্বাস গ্রহণ করে আমরা তৃপ্ত হলাম। চার মঞ্জিল পথ চলবার পরে আমরা উসায়লা নামক একটি জায়গায় এসে থামলাম। এখানে পানি পাওয়া যায়। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে এলাম। আন-নাকিরা। এখানেও পানি পাওয়া যায়। বিরাটাকার চৌবাচ্চার মত এখানে কয়েকটি পুকুরের চিহ্ন রয়েছে। তরপরে আমরা পৌঁছলাম আল্-ফারুরা। এখানে বৃষ্টির পানিতে
অতি পুকুর আছে। জাফরের কন্যা জুবায়দা যে সব পুকুর খনন করান এগুলি তারই। কয়েকটি। মক্কা থেকে বাগদাদ অবধি দীর্ঘ পথের প্রতিটি পুকুর, চৌবাচ্চা ও কুপ সেই মহিলার পূণ্যস্মৃতির স্তম্ভস্বরূপ। খোদা তাঁকে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন। এ স্থানটি নজদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। স্থানটি বেশ প্রশস্ত, আবহাওয়া ও মাটি উত্তম। সারা বছরই এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। আল-ফারুরা থেকে আমরা আল হাজির পৌঁছলাম। এখানে পুকুর আছে কিন্তু শুকিয়ে গেছে। কাজেই পানির জন্য অস্থায়ী পুকুর খনন ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সেখান থেকে আমরা সামিরা এসে হাজির হলাম। সামিরা সমতল ভূমিতে অবস্থিত একটি নীচু স্থান। স্থানটি সুরক্ষিত ও পরিবেষ্টিত বলে লোকালয়পূর্ণ। এখানকার কুপে প্রচুর পানি আছে কিন্তু সে পানি লবণাক্ত। সে জলার বেদুঈনরা মেষ, মাখন ও দুধ নিয়ে সেখানে আসে হাজীদের কাছে বিক্রি করার জন্য। এসব জিনিসের পরিবর্তে একমাত্র মোটা সূতীবস্ত্র ছাড়া টাকা পয়সা বা অন্য কোন জিনিস গ্রহণ করতে কিছুতেই তারা রাজী হয় না। আমরা পুনরায় যাত্রা করে গর্তওয়ালা পাহাড়ে’ (Hill with the Hole) পৌঁছলাম। মরুভূমি অঞ্চলের এ পাহাড়টির শিরোদেশে একটি ছিদ্র আছে। সেখানে বাতাস প্রবেশ করলে একপ্রকার শব্দ শুনা যায়।
অতঃপর আমরা ওয়াদিল-কুরুশে পৌঁছলাম। এখানে পানি পাবার কোন ব্যবস্থা নেই। সেখান থেকে সারারাত্রি চলার পরে আমরা ভোরে ফায়েদ ১ দূর্গে হাজির হলাম।
সমতলভূমিতে অবস্থিত ফায়েদ একটি পরিবেষ্টিত সুরক্ষিত স্থান। এ স্থানটির উপকন্ঠে ব্যবসায়ী শ্রেণীর আরবদের বাস। তারা হাজীদের সঙ্গে ব্যবসা করে জীবিকার্জন করে। মক্কা যাবার পথে হজযাত্রীরা তাদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর কিছু অংশ এখানে রেখে যায় এবং ফেরবার সময় তা সংগ্রহ করে নেয় ২। মক্কা ও বাগদাদের অর্ধপথে ফায়েদ অবস্থিত। সর্বত্র পানি পাওয়া যায় এমনি একটি সহজ পথে এখান থেকে রওয়ানা হয়ে কুফা যেতে বার দিন লাগে। আরব দস্যুদের ভয়ে হাজীরা এখানে সশস্ত্র অবস্থায় এসে ঢোকে। কারণ, লোভী আরব দস্যুরা এখানে একত্র হয়ে অনেক সময় কাফেলা আক্রমণের চক্রান্ত করে। এখানে এসে আমরা দেখা পেলাম আমীর মোহাম্মদ বিন ইসার দুই পুত্র আমীর ফাইয়াদ ও আমীর হাইয়ার। তাদের সঙ্গে বহুসংখ্যক অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য। হজযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে লক্ষ্য করলাম। আরবরা বিক্রির জন্য অনেক উট ও মেষ এনেছিল। হাজীদের ভেতর যার যা দরকার কিনে নিতে লাগল।
আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল আল-আজফার, জারুদ এবং আরও কয়েকটি বিশ্রাম-স্থানের মধ্য দিয়ে। আমরা শয়তানের পথ’ নামক গিরিপথে এসে পৌঁছলাম। রাত্রির জন্য সেখানে আস্তানা ফেলে পরের দিন আবার যাত্রা শুরু হল। সমস্ত পথের মধ্যে এ অংশটাই সবচেয়ে বন্ধুর এবং চলা কষ্টসাধ্য।
আমাদের পরবর্তী বিশ্রাম-স্থানের নাম ওয়াকিসা। এখানে একটি দূর্গ আছে, পানির পুকুরও আছে। তাছাড়া এখানে আরবদের বসতি রয়েছে। এ পথের এটিই শেষ জায়গা যেখানে পানি পাওয়া যায়। ইউফ্রেটিস্ থেকে বেরিয়ে আসা নহর ছাড়া এখান থেকে কুফা পর্যন্ত পানি পাবার উল্লেখযোগ্য কোন জায়গা নেই। কুফার অনেক লোক ওয়াকিসা অবধি এগিয়ে আসে হাজীদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। সঙ্গে করে আনে ময়দা, কুটী, খেজুর এবং অন্যান্য ফলমূল। এখানে এসে তারা হাজীদের সঙ্গে প্রীতি বিনিময় করে পরস্পর কোলাকোলি করে।
এখান থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা পৌঁছলাম লাওজা। এখানে প্রকাও একটি পুকুর রয়েছে। সেখান থেকে এলাম আল-মাসাজিদ (মসজিদ শব্দের বহুবচন)। এখানে পুকুর আছে তিনটি। তারপর গেলাম মানারাত আল-কারুন (Minarat of the Hons)। নামক একটি মিনারের কাছে। মরু অঞ্চলে অবস্থিত এ মিনারটি যথেষ্ট উঁচু বলে বহুদূর থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। মিনারের শীর্ষদেশ হরিণের শিং দ্বারা সজ্জিত। কিন্তু মিনারটির আশেপাশে কোন লোকালয় নেই।
অতঃপর আমরা আল-উধায়ের নামে একটি উর্বর উপত্যকায় এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আল-কাদিসিয়ার প্রসিদ্ধ যুদ্ধের ময়দানে। এখানেই পার্শীদের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধে আত্মাহ্ ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করেন। এখানে কয়েকটি খেজুর বাগান আছে এবং ইউফ্রেটিস্ ৩ থেকে একটি নহরও এ অবধি এসেছে।
সেখান থেকে যাত্রা করে আমরা নজফের মাশহাদ আলী শহর গিয়ে পৌঁছলাম। ইরাকের একটি চমৎকার শহর এটি। প্রস্তরময় একটি প্রশস্ত সমতল ভূমিতে অবস্থিত এ শহরটি যেমন সুগঠিত তেমনি জনবহুল। শহরের বাজারগুলি সুন্দর এবং পরিষ্কার। পরিচ্ছন্ন।
আমরা (বাইরের) বাব-আল্ হারা দিয়ে বাজারে প্রবেশ করে প্রথমেই পেলাম। তরিতরকারীর দোকান, বাবুর্চিদের এবং কশাইদের দোকান। তারপরে ফলের বাজার দরজির দোকান, আতরের দোকান। তারপরে হাজির হলাম (ভিতরের) বাব-আল্ হারায়। এখানে একটি কবর আছে যাকে সবাই আলীর কবর বলে। বাব-আল হারা দিয়া কেউ ভিতরে ঢুকলেই প্রথমেই পাবে একটি বৃহৎ মুসাফেরখানা, তার ভিতর দিয়া দরগায় প্রবেশের পথ। প্রবেশ পথে কর্মচারী, হাজিরা বই-রক্ষক ও খোঁজা প্রহরীরা আছে। কোন দর্শনার্থী কবরের দিকে অগ্রসর হলেই প্রহরীদের একজন বা দর্শনার্থীর পদমর্যাদানুযায়ী সবাই উঠে দাঁড়ায় এবং তার সঙ্গে দরজায় গিয়ে আপেক্ষা করে। সেখান থেকে তারা দর্শনার্থীর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে বলে উঠে, “হে আমীর উল-মোমনিন, আমি খাকসার আপনার পবিত্র বিশ্রাম স্থলে প্রবেশের অনুমতি চাইছি।” অতঃপর তাকে দরজায় চুম্বন করতে বলে। দরজা-চৌকাঠ রৌপ্য নির্মিত। পরে সে দরগায় প্রবেশ করে। দরগার মেঝে রেশমী কার্পেটে মোড়া। দরগার ভিতরে ছোটবড় অনেকগুলি স্বর্ণ ও রৌপ্যের দীপাধার আছে। মধ্যস্থলে মানুষ সমান উঁচু একটি চতুষ্কোণ বেদী রয়েছে। কাঠের বেদীটি সম্পূর্ণভাবে সোনার পাত দিয়ে রূপার পেরেকে আঁটা। এখানে তিনটি কবর রয়েছে। এখানকার লোকদের মতে করবগুলি হজরত আদম, হজরত নূহ ও হজরত আলীর। কবরগুলির মধ্যস্থলে স্বর্ণ ও রৌপ্যের থালা রাখা আছে। থালায় রয়েছে গোলাব, কস্তরী এবং অন্যান্য আতর। আগন্তুক হাতের অঙ্গুলি দ্বারা আতর নাকে মুখে লাগায় এবং দোয়া প্রার্থনা করে। দরগায় আরও একটি দরজা আছে। তার চৌকাটি রৌপ্য নির্মিত এবং রঙীন রেশমের ঝালরওয়ালা। দরজার পরেই একটি মসজিদ। এ শহরের সমস্ত অধিবাসীই শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। এ সমাধিসৌধে অনেক। অলৌকিক ঘটনা ঘটে বলে তারা এ সমাধিকে হজরত আলীর সমাধি বলে দাবী করে। এ সব অলৌকিক ঘটনার একটি ঘটে ২৭শে রজব ৫ তারিখের শেষে। সেদিন ইরাকের উভয়াংশ, খোরাসান, পার্শিয়া ও আনাটোলিয়া থেকে প্রায় ত্রিশ, চল্লিশ জন খোঁড়াকে এখানে এনে পবিত্র সমাধিসৌধে রাখা হয়। উপস্থিত লোকেরা তখন মোনাজাত, দোয়া দরুদ অথবা কোরআন পাঠ করে রাত্রিযাপন করে এবং ঐ সকল খোঁড়ারা কখন ভাল হয়ে উঠবে তার অপেক্ষা করতে থাকে। যখন রাত্রির আধাআধি হয় অথবা তিনভাগ গিয়ে একভাগ থাকে তখন তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বলে উঠে, “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদর রসুলল্লাহ ওয়া আলিউন হাবিবুল্লাহ।” এ ঘটনা এখানকার লোকদের কাছে বিশেষ বিদিত। আমি বিশ্বাসী লোকের কাছে একথা শুনেছি কিন্তু নিজে কখনও তেমন কোন রাত্রে উপস্থিত থাকিনি। আমি মেহমান কলেজে (Guest’ College) চারজন বিকলাঙ্গ লোকের দেখা পেয়েছিলাম এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। তারা বলল যে, সে রাত্রে তারা হাজির হতে পারেনি বলে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষা করছে।
এ শহরের লোকেরা কোন খাজনা বা কর দেয় না, শাসনকর্তাও নেই কিন্তু এ শহর এককভাবে নকিব-আল-আশরাফ (Keeper of the Register of the descendants of the Prophet)-এর অধীনে। এখানকার লোকদের সবাই উদ্যমশীল ব্যবসায়ী। তারা সাহসী, দয়ালু ও সফরের সঙ্গী হিসাবেও উত্তম কিন্তু হজরত আলী সম্বন্ধে অত্যন্ত গোঁড়া। যদি এখনকার লোকেদের ভেতর কেউ মাথায়, হাতে, পায়ে অথবা শরীরের অপর কোন অঙ্গে রোগাক্রান্ত হয় তবে সোনা বা রূপা দিয়ে সে অঙ্গের একটি প্রতিকৃতি তৈরী করে এ স্মৃতিস্তয়ে নিয়ে আসে। এ সমাধিসৌধের খাজাঞ্চিখানা অনেক ধনরতে সমৃদ্ধ। দরবারে নকিব-আল-আশরাফ উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী। যখন তিনি ভ্রমণে বের হন তখন ঠিক প্রধান সেনানায়কের সমমর্যাদায় তাঁর। অনুগমন করে পতাকাবাহী ও দামামা বাদকগণ। প্রত্যহ ভোরে ও সন্ধ্যায় তাঁর প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে রণবাদ্য বাজান হয়। বর্তমানে যিনি এ পদে আছেন তার আগে একত্রে একাধিক ব্যক্তি এ পদ দখল করছিলেন। পালাক্রমে তারা শাসনকতার কর্তব্য পালন। করতেন।
এ সব খ্যাতনামা ব্যক্তিদের একজন ছিলেন শরিফ আবু ঘুরা। তরুণ বয়সে তিনি ধর্মকর্ম ও বিদ্যাশিক্ষায় কাটান কিন্তু নকিব-আল-আশরাফ পদে অধিষ্ঠিত হবার পর ইনি দুনিয়াদারিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন, ধর্ম স্বভাব ত্যাগ করেন এবং অসদুপায়ে তাঁর অর্থে ব্যবহার করতে থাকেন। বিষয়টি সুলতানের গোচরীভূত করা হলে আবু ঘুরা তা জানতে পেরে খোরাসান যান এবং সেখান থেকে রওয়ানা হন সোজা ভারতের পথে। সিন্ধুনদ পার হয়েই তিনি সঙ্গীদের হুকুম করলেন জয়ঢাক আর রণভেরী বাজাতে। ভেরী বেজে উঠতেই গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে গেল, মনে করল হয়ত বা তাতার দস্যুরাই দেশে হামলা করেছে। গ্রাম ছেড়ে তারা পালিয়ে গেল উজা (উ) শহরে। সেখানকার শাসনকর্তাকে খবর দিল যা-কিছু তারা শুনেছে। খবর পেয়েই তিনি যুদ্ধের আয়োজন করে একদল সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু যে সন্ধানী সৈন্যদলকে তিনি আগে পাঠিয়েছিলেন তারা দেখল, মোটেই জন-দশেক অশ্বারোহী, তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক পদাতিক, পেছনে রয়েছে সওদাগরেরা, দামামা ও পতাকাবাহীর দল। তাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলে, তারা বলল, ইরাকের নকিব শরিফ এসেছেন ভারতের সুলতানের কাছে। এ সংবাদ নিয়ে সন্ধানী সৈন্যরা ফিরে এল শাসনকর্তার কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, শরিফের বুদ্ধি বিবেচনা কম, নয়তো নিজের দেশের বাইরে এসে তিনি নিশান উড়িয়ে দামামা বাজাতে শুরু করতেন না। শরিফ কিছুদিন উজ্ব শহরেই অবস্থান করলেন। তখনও প্রতিদিন সকালে-বিকালে তার বাড়ির বাইরে তিনি নিশান উড়িয়ে ও জয়ঢাক বাজিয়ে তৃপ্তিবোধ করতেন। শুনা যায়, ইরাকে থাকতে তার উপস্থিতিতে যখন ঢাক বাজানো হতো তখন বাজনা থামলেই তিনি বলে উঠতেন, “আরেকবার হোক, ঢাকী।” তারপর এ শব্দ কটাই হয় ব্যঙ্গচ্ছলে তার ডাকনাম।
উজার শাসনকর্তা শরিফের সংবাদ লিখে পাঠালেন সুলতানের কাছে। তার আগমনের সময়ে এবং আসার পর অবধি বাসগৃহের দরজায় সকালে-বিকালে জয়ঢাক। বাজানো এবং নিশান উড়ানোর সংবাদ দিতেও তিনি ভুললেন না। ভারতে তখন প্রচলিত নিয়ম ছিল; সুলতানের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ ঢাক বাজাতে বা নিশান উড়াতে পারবেন না। কেউ অনুমতি পেলেও শুধু সফরের পথে বাজনা বাজাতে পারতেন। তাছাড়া বাজনা বাজার রীতি ছিল শুধু সুলতানের প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে। পক্ষান্তরে মিশর, সিরিয়া ও ইরাকে বাজনা বাজানো হয় সেনানায়কের গৃহের দ্বারে। কাজেই শরিফের ব্যবহারের কথা শুনে সুলতান বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হলেন। শরিফ তখন যথারীতি জয়ঢাক বাজাতে-বাজাতে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, এ-দিকে সুলতানও যাচ্ছিলেন সিন্ধুর আমীরের সঙ্গে দেখা করতে। পথে দেখা হতেই শরিফ এগিয়ে এসে সুলতানকে অভ্যর্থনা জানালেন। সুলতান কুশল প্রশ্নাদির পর তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন এবং তার জবাব শুনে আমীরের কাছে চলে গেলেন। ফিরবার পথেও শরিফের আসার বা অন্য কোন রকম ব্যবস্থা না করেই রাজধানীতে ফিরে এলেন। তিনি তখন দৌলতাবাদে যাত্রার জন্য তৈরী হয়েছিলেন। যাত্রার পূর্বে শরিফকে পাঁচশ দিনার (মরক্কোর ১২৫ দিনার) দূত মারফত পাঠিয়ে বলে দিলেন, “তাকে বলবে, তিনি যদি ফিরে যেতে চান তাহলে এ টাকা তার পথ খরচের জন্য, যদি তিনি আমাদের সঙ্গে আসতে চান তবে এ টাকা সফরে ব্যয় করবেন, আর যদি থাকতে চান তবে আমাদের ফিরে না-আসা পর্যন্ত তার খাওয়ার খরচ এ টাকা দিয়ে হবে।” শরিফ খুশী হতে পারলেন না। তিনি ভেবে রেখেছিলেন, সুলতান অপরকে যেমন
বখশিশ দেন তেমনি দরাজ হস্তে তাঁকেও বড় রকম কিছু দেবেন। অবশেষে তিনি সুলতানের সঙ্গে যাওয়াই স্থির করলেন এবং উজিরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা করতে লাগলেন। উজিরও তাকে যথেষ্ট স্নেহের চোখে দেখতে লাগলেন এবং সুলতানের উপর নিজের প্রভাবের বলে দৌলতাবাদ জেলার দুটি গ্রাম তার জন্য জায়গীর স্বরূপ আদায় করে দিলেন। প্রায় আট বছর কাল শরিফ সেখানে বাস করে দুটি গ্রামের প্রজাদের কাছে কর আদায় করে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করেন। অতঃপর তিনি ভারত ত্যাগ করতে চান কিন্তু তাতে সক্ষম হন না। কারণ, যারা সুলতানের অধীনে চাকুরী করেন তারা। সুলতানের বিনানুমতিতে কোথাও যেতে পারেন না। বিদেশীদের সঙ্গে তার সংস্রব বেশী বলে তাদের তিনি কদাচিৎ অনুমতি দিয়ে থাকেন। শরিফ প্রথমে চেষ্টা করেন সমুদ্রোপকুলের পথে পালাতে কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাঁকে রাজধানীতে ফিরে আসতে হয়। তখন পুনরায় উজিরের চেষ্টায় তিনি ভারত ত্যাগের অনুমতি লাভ করেন। শুধু। অনুমতিই নয়, সুলতান তাকে দশ হাজার দিনারও দান করেন।
এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল একটা বস্তায় ভর্তি করে। অর্থ শরিফের অত্যন্ত প্রিয়বস্তু বলে এবং পাছে কেউ তাতে ভাগ বসায় এ ভয়ে তিনি টাকার বস্তার উপর বয়েই ঘুমাতেন। তার ফলে স্বদেশ যাত্রার প্রাক্কালে তাঁর পাশে ব্যথা হয়ে। গেল। সে ব্যথাই তার কাল হল, টাকার বস্তা পাবার বিশ দিন পর তিনি এন্তেকাল। করলেন। টাকা তিনি রেখে গেলেন শরিফ হাসান-আল্-জারানীর কাছে। তিনিও সমস্ত টাকা খয়রাত করে দিলেন দিল্লীর শিয়াদের ভেতর। ভারতীয়রা উত্তরাধিকারের দায়িত্ব অমান্য করে না এবং বিদেশীদের টাকা পয়সায় হস্তক্ষেপ করে না, এমন কি তার। পরিমাণ যত বেশীই হোক সে সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করে না। অনুরূপ ভাবে, কাফ্রীরাও শ্বেতচর্ম লোকদের অর্থের প্রতি লোভ করে না, সত্যিকার ওয়ারিস না পাওয়া। পর্যন্ত সে টাকা লোকটির দলপতির কাছেই থাকে।
খলিফা হজরত আলীর কবর জেয়ারতের পর আমাদের কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেল বাগদাদের পথে। আমি সে দেশবাসী এক দল আরবের সঙ্গে বসরার পথ ধরলাম। তারা ছিল অত্যন্ত সাহসী। তাদের সঙ্গ ছাড়া এ রকম দেশে সফর করাই সম্ভব হত না। ইউফ্রেটিস নদীর পারে আল-ইহার নামক একটা স্থানের মধ্যে দিয়ে ছিল আমাদের পথ। একদল লুণ্ঠনকারী আরব অধ্যুসিত আল-ইহার নল-খাগড়ার জঙ্গলময় জলাভূমি। এখানকার আরবরা রাহাজানি করে এবং নিজেদের শিয়া বলে পরিচয় দেয়। আমাদের। পশ্চাদ্বর্তী একদল দরবেশকে আক্রমণ করে এরা তাদের পায়ের জুতা থেকে কাঠের তৈরী খাদ্যপাত্র অবধি লুঠ করে নেয়। তারা এ জঙ্গলে নিজেদের সুরক্ষিত করে নিয়েছে এবং সর্বপ্রকার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতেও তারা সক্ষম। ইহার মধ্যে দিয়ে তিনদিন পথ চলবার পর আমরা ওয়াসিত শহরে পৌঁছলাম ইরাকের বাসিন্দাদের ভেতর যাদের সজ্জন বলা যায়, ওয়াসিতের বাসিন্দারা তাদের অন্তর্গত। তারা শুধুই সজ্জন নয়, সর্বপ্রকারে সজ্জন। ইরাকীদের ভেতর যারা ভালভাবে কোরআন আবৃত্তি করতে চায় তারা সবাই আসে এখানে। এ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে এমন একদল ছাত্র আমাদের কাফেলায়ও ছিল। আমাদের কাফেলা তিন দিন অবস্থান করায় আমি এখান থেকে এক দিনের পথ উন্মে উবায়দা নামক গ্রামে আর-রিফাইর কবর জেয়ারতের সুযোগ পেলাম। যাত্রার পরদিন দুপুর বেলা আমি এখানে গিয়ে পৌঁছলাম। বিরাট এ দরগায় হাজার হাজার দরবেশের বাস।৬ আসরের নামাজের পর জয়ঢাক ও দামামার বাজনা শুরু হল এবং সঙ্গে-সঙ্গে হাজার-হাজার দরবেশ নৃত্য শুরু করলেন। অতঃপর মাগরেবের নামাজ আদায় করে তারা আহারে বসলেন। আহার্য ছিল চাউলের রুটি, মাছ, দুধ ও খেজুর। এশার নামাজের পরে তারা নিজেদের দরুদ পড়তে লাগলেন। অনেক জ্বালানী কাঠ সেখানে জড়ো করে অগ্নিকুণ্ড তৈরী করা হয়েছিল। দরবেশরা নৃত্য করতে করতে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে গিয়ে পড়লেন। কেউ-কেউ আগুনের ভেতর গড়াগড়ি করতে লাগলেন। কেউ-কেউ বা আঙ্গার নিভে না যাওয়া পর্যন্ত মুখের ভেতর রাখলেন। আহমদী দরবেশদের এ সব আজব রীতি। তাদের ভেতর কেউ-কেউ বড়-বড় সাপ এনে দাঁত দিয়ে সাপের মাথায় কামড়ে এপিঠ-ওপিঠ বিদ্ধ করে দেয়।
আর-রিফাইর কবর জেয়ারতের পর আমি ওয়াসিতে ফিরে এসে দেখলাম আমাদের কাফেলা আগেই রওয়ানা হয়ে গেছে। আমি পথে গিয়ে তাদের নাগাল পেলাম এবং তাদের সঙ্গে বসরা অবধি গেলাম। শহরের দিকে অগ্রসর হতে-হতে দু’মাইল দূরে নজরে পড়ল দূর্গের মত দেখতে সুউচ্চ একটি অট্টালিকা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এটি হজরত আলীর মসজিদ। এক সময়ে বসরা এত বিরাট একটি শহর ছিল যে এ মসজিদটি ছিল তার কেন্দ্রস্থলে। আর এখন কিনা মসজিদটি পড়েছে গিয়ে দু’মাইল দূরে। এখান থেকেও দু’মাইল দূরে শহরের পুরাতন প্রাচীর। কাজেই বর্তমান শহরও পুরাতন প্রাচীরের মধ্যস্থলে এ-মসজিদটি। ইরাকের প্রসিদ্ধ নগরগুলির ভেতর বসরা একটি। এখানকার মত খেজুর বাগান পৃথিবীর আর কোথাও নেই। চৌদ্দ পাটও খেজুরের চলতি দাম ইরাকী এক দিরহাম অর্থাৎ এক নুকরার ৮ তিন ভাগের এক ভাগ। এখানকার কাজী আমাকে এমন প্রকাণ্ড এক ঝুড়ি খেজুর দিলেন যা একজনে অতি কষ্টে বয়ে আনতে পারে। সেগুলি বিক্রি করে আমি মোটে নয় দিরহাম পেলাম, তার তিন দিরহাম দিতে হল কুলীকে সেই ঝুড়ি বাড়ি থেকে বাজার অবধি বয়ে নেবার মজুরী বাবদ। বসরার বাসিন্দারা একাধিক সদ্গুণের অধিকারী। বিদেশীদের প্রতি তাদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। তারা এভাবে বিদেশীদের হক আদায় করে যে তাদের ভেতর কেউ নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করে না। শুক্রবার তারা জুমার নামাজ পড়ে পূর্ববর্ণিত হজরত আলীর মসৃজিদে কিন্তু অন্যান্য দিন মসজিদটির দ্বার বন্ধ থাকে। একদিন শুক্রবারের জামা’তে আমি উপস্থিত ছিলাম। এমাম খোত্র পাঠ করতে উঠে কতকগুলি মারাত্মক ব্যাকরণ (৯) ভুল করলেন। আমি বিস্মিত হয়ে কাজীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, “ব্যাকরণ শাস্ত্র জানেন এমন একজন লোকও আর এ শহরে নেই।” সমস্ত কিছুর পরিবর্তন সাধন যিনি করেন তাঁর মহত্ব বৃদ্ধি হউক। চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এটি একটি শিক্ষনীয় বিষয়, ব্যাকরণ শাস্ত্রে বসরার বাসিন্দাদের জ্ঞান এক সময়ে উচ্চ শিখরে উঠেছিল। যেখানকার মাটিতে এর কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে, যে দেশের অধিবাসীদের এ বিদ্যায় প্রাধান্য ছিল অবিসম্বাদিত, সেই দেশের এমাম আজ ব্যাকরণের নিয়মাবলী ভঙ্গ না করে খোত্বা পাঠ করতে পারেন না।
বসরা থেকে উবুল্লা১০ যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি সামবাক নামক এক প্রকারের হোট একটি নৌকায় আরোহণ করলাম। বসরা থেকে উবু দশ দিনের পথ। এ পথের দু’পারে পথিক দেখতে পায় একটানা ভাবে ফল ও তালের বাগিচা। গাছের ছায়ায়। সওদাগরেরা বসে বিক্রি করছে রুটি,মাছ, খেজুর,দুধ ও ফলমূল। উবুন্না এক সময়ে খুব বড় শহর ছিল। ভারত ও ফারসের সওদাগরেরা নিয়মিত এখানে যাতায়াত করত। কিন্তু সে শহর ধ্বংস হয়ে আজ একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। সূর্যাস্তের পরে এখান থেকে আমরা একটি ছোট জাহাজে আরোহণ করে পরদিন ভোরে গিয়ে আবাদান পৌঁছলাম। উবুঝার একটি লোক জাহাজটির মালিক। কৃষিবিহীন সমতল অঞ্চলে অবস্থিত আবাদান একটি গ্রাম। শুনেছিলাম আবাদানে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন একজন তাপস বাস করেন। তিনি বাস করেন সম্পূর্ন নির্জনে। মাসে একবার তিনি নদীর পারে এসে এক মাসের খাদ্যোপযোগী মাছ শিকার করে আবার প্রস্থান করেন। আমি তাকে খুঁজে বের করতে মনস্থ করলাম এবং তাঁকে নামাজরত অবস্থায় খুঁজে পেলাম একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদে। নামাজের শেষে তিনি আমার হাত ধরে বললেন, “আল্লাহ তোমার ইহকালের ও পরকালের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। আলহামদোলিল্লাহ-খোদার সমস্ত প্রশংসা যে তিনি সত্যই আমার ইহকালের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন। সে মনোবা দেশ ভ্রমণের ছাড়া আর কিছুই নয়। সে বাসনা তিনি এভাবে পূর্ণ করেছেন যে আমার জ্ঞাত মতে আর। কাউকে তা করেননি। পরকাল এখনও আমার সামনে রয়েছে কিন্তু সে বিষয়ে খোদার। অশেষ দয়া ও ক্ষমতার উপর আমার অসীম আস্থা আছে। আমার সঙ্গীরা পরে পূর্বোক্ত তাপসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল কিন্তু তারা তার কোন সন্ধান পায়নি। আমরা যে মুসাফেরখানায় বাস করছিলাম সেখানকার একজন দরবেশ সেদিন সন্ধ্যায় তাপসের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। তিনি দরবেশের হাতে একটি তাজা মাছ দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন, “আজ যে মেহমান আমার কাছে এসেছিল তাকে নিয়ে দাও।” দরবেশ ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আজ তোমাদের ভেতর কে শেখের সঙ্গে দেখা করেছো?” আমি বল্লাম, “আমি দেখা করেছি।” তখন তিনি আমাকে বললেন, “তিনি বলেছেন, এইটি তোমার মেহমানের উপহার।” আমি এজন্য খোদাকে ধন্যবাদ জানালাম। পরে দরবেশ মাহটি রান্না করলে আমরা সবাই তা খেলাম। এর চেয়ে ভাল মাছ আমি কখনও খাইনি। মুহূর্তের জন্য আমার মনে হ’ল বাকী জীবন আমি এ শেখের খেদমতেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার মনের একাগ্রতা সে সঙ্কল্প থেকে আমাকে নিবৃত্ত করল।
সেখান থেকে আমরা জাহাজে মাজুল রওয়ানা হলাম। আমার অভ্যাস ছিল, যে। পথে একবার গিয়েছি সে পথে যতটা সম্ভব আর কখনও ফিরে না আসা। বাগদাদ যাওয়ার সঙ্কল্প ছিল আমার কিন্তু বসরার এক ব্যক্তি আমাকে পরামর্শ দিল সুর যেতে, সেখান থেকে ইরাক-আল-আজম, পরে ইরাক-আল-আরব। আমি তার পরামর্শই গ্রহণ করলাম। চারদিন পর আমরা মাজুল১৯ পৌঁছলাম। পারস্য উপসাগরের কূলে মাজুল একটি ছোট জায়গা। সেখানকার এক শস্যব্যবসায়ীর একটি ঘোড়া ভাড়া করে রামিজ (রাম-হারমুজ) রওয়ানা হলাম। মুক্ত প্রান্তরের মধ্য দিয়ে পথ। সেখানে যাযাবর কুদীসের বাস।ফলের গাছ ও নদী সম্বলিত রামিজ সুন্দর একটি শহর। সেখানে এক রাত্রি বাস করে পুনরায় কুর্দী অধ্যুষিত একটি সমতল ভূমির উপর দিয়ে তিন রাত্রি পথ চললাম। প্রতি মঞ্জিলের শেষেই একটি করে মুসফেরখানা। মুসাফেরখানায় প্রত্যেক মুসাফেরকে রুটি, মাংস ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অতঃপর আমরা তুন্তর (সুত্তার) শহরে এসে পৌঁছলাম। শহরটি একটি সমতল ভূমির প্রান্তদেশে অবস্থিত। সেখান থেকে পর্বতের গুরু। সেখানে শেখ শরাফউদ্দিন মুসার মাদ্রাসায় আমি মোল দিন কাটালাম। মুসা একজন অত্যন্ত সৎ প্রকৃতির লোক। প্রতি শুক্রবার জুমার জামাতের পর তিনি ‘ওয়াজ করেন। একদিন তার ওয়াজ শুনে মনে হল তার তুলনায় মিসরে, হেজাজে, সিরিয়ার যত ওয়াজ এতদিন শুনেছি সবই ম্রিয়মান। একদিন নদীর পাড়ের এক ফলের বাগানে দরবেশ, ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ ও খ্যাতনামা লোকদের এক সমাবেশে তার সঙ্গে আসবার সুযোগ আমার হয়েছিল। উপস্থিত সবাইকে আহার্য দিয়ে তিনি বিশেষ মর্যাদা ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে ওয়াজ (খোত্বা পাঠ) করলেন। তিনি হোত পাঠ শেষ। করতেই চারদিক থেকে-ছোট ছোট কাগজের টুকরা তার উপর নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। পারস্যের লোকদের মধ্যে রীতি আছে, কাগজের টুকরায় প্রশ্ন লিখে তা ওয়াজখানের দিকে নিক্ষেপ করে। ওয়াজখান পর-পর সেগুলির জবাব দিয়ে যান। এক্ষেত্রেও শেখ সমস্ত কাগজের টুকরা সগ্রহ করে পর-পর অতি সুন্দরভাবে জবাব দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করলেন।
তুস্তার থেকে রওয়ানা হয়ে উচ্চ পার্বত্য পথে আমরা তিন রাত্রি পথ চলবার পর ইহাজ শহরে হাজির হলাম। ইহাজ মাল-আল-আমীর নামেও পরিচিত। মাল-আল আমীর সুলতান আতা বেগের রাজধানী। সেখানকার সকল শাসনকর্তার উপাধিই আবেগ ১২। আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা করেছিলাম কিন্তু তা সম্ভব হল না; কারণ তিনি মদ্যাসক্ত এবং কেবলমাত্র শুক্রবার বাইরে আসেন। কয়েকদিন পরে সুলতান নিজেই আমাকে আমন্ত্রণ পাঠান তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। পত্র বাহকের সঙ্গে আমি সাইপ্রাস দ্বার নামে পরিচিত একটি প্রবেশদ্বারে গিয়ে হাজির হলাম। সেখান থেকে একটি উচ্চ সিঁড়ি গিয়ে উঠেছে একটি কোঠায়। সুলতানের পুত্রের জন্য তারা শোকাতুর বলে সে কোঠাটি সজ্জিত করা হয়নি। সুলতান একটি গদি আঁটা আসনে বসেছিলেন। তার সামনে দুটি আবৃত পানপাত্র। তার একটি সোনার অপরটি রূপার। তার আসনের কাছেই আমার জন্য একটি সবুজ কম্বল বিছানো হয়েছিলো। আমি তার উপর আসন গ্রহণ করলাম। সে কামরায় তখন তার একজন সভাসদ ও একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। সুলতান আমার নিজের সম্বন্ধে, দেশ সম্বন্ধে এবং মিসরের ও হেজাজের সুলতান সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আমি তার সমস্ত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলাম। ঠিক তখন বিশিষ্ট একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তি সেই কামরায় ঢুকলেন। সুলতান লোকটির প্রশংসা করতে লাগলেন। আমি তখন লক্ষ্য করলাম, সুলতান মদ্য পান করেছেন। কিছুক্ষণ পরে বিশুদ্ধ আরবীতে তিনি আমাকে বলেন, “কথা বলুন।” আমি তাকে বললাম, “যদি আপনি শুনতে রাজী হন তবে বলতে পারি। আপনার পিতা ছিলেন দানধ্যান ও সততার জন্য বিখ্যাত একজন সুলতান। শাসক। হিসাবে আপনার বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ নেই ঐ একটি বস্তু ছাড়া।” বলেই আমি পানপাত্র দুটি দেখিয়ে দিলাম। আমার কথায় তিনি বিস্ময়াবিষ্টের মত চুপ করে রইলেন। আমি তখন চলে আসতে চাইলাম, কিন্তু তিনি আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন, “আপনার মত লোকের সঙ্গে দয়ার শামিল। দেখলাম তিনি যেন ঘুরে পড়ে যাচ্ছেন এবং প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাজেই আমি চলে এলাম। আমি আমার পাদুকা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু যে আইনজ্ঞ লোকটির কথা উল্লেখ করেছি তিনি ঘরের ভেতর খুঁজে পাদুকা জোড়া এনে দিলেন। তার এ দয়ার জন্য লজ্জিত হয়ে আমি ক্রটি স্বীকার। করলাম। কিন্তু তাতে তিনি আমার পাদুকা চুম্বন করে মাথার উপর তুলে বললেন। “আল্লাহ যেন আপনার মঙ্গল করেন। আজ সুলতানকে আপনি যা বলেছেন আপনি ছাড়া কেউ তা পারতেন না। আশাকরি আপনার কথা তার মনের উপর গাদ কাটবে।”
কয়েকদিন পরেই আমি ইহাজ ছেড়ে আসি। সুলতান আমাকে এবং আমার সঙ্গীদের কিছু দিনার পাঠান বিদায়ের উপহার স্বরূপ। এ সুলতানের এলাকায় আমরা সু উচ্চ পর্বত-সঙ্কুল পথে ১০ দিন অবধি সফর করি। প্রতি রাত্রেই আমরা কোন মাদ্রাসায় পৌঁছে বিশ্রাম করেছি। সেখানে প্রত্যেক সফরকারী ও তার বাহনের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। কোন-কোন মাদ্রাসা জনবিরল স্থানে অবস্থিত। কিন্তু মাদ্রাসার প্রয়োজনীয় সব কিছুই তাতে আছে। ঐ রাজ্যের আয়ের এক তৃতীয়াংশ এসব মুসাফেরখানা ও মাদ্রাসার ব্যয়নির্বাহের জন্য রাখা হয়। ইসফাহান প্রদেশের একটি সমতল অঞ্চলে উস্ তারকা ও ফিরুজান শহর হয়ে আমরা পথ চলতে লাগলাম। ফিরুজানে পৌঁছে শহরের অধিবাসীদের সঙ্গে শহরের বাইরেই দেখা হল। তখন তারা একটি শবযাত্রায় চলেছে। শবের খাটের সামনে ও পেছনে মশাল চলছে। তারা বাঁশী বাজাতে-বাজাতে শবের অনুগমন করছে গায়করা চলেছে আনন্দসূচক গান গাইতে-গাইতে। তাদের এ কাণ্ড দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। পরের দিন যে পথ দিয়ে আমরা অগ্রসর হলাম তার আশে পাশে ফলের বাগান আছে, খালও আছে, আর আছে কবুতরের বাসার উপযোগী বহু সংখ্যক মিনার। বিকেল বেলা আমরা ইরাক-আল-আজমের অন্তগর্ত ইসফাহান বা ইসপাহান এসে পৌঁছলাম। ইসপাহান শহরটি যেমন বড় তেমনি সুদৃশ্য। কিন্তু শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের বিবাদের ফলে আজ এ শহরের বহুলাংশ ধ্বংসের কবলে পড়েছে। সে বিবাদ সেখানে এখনও চলছে। ফলের জন্য স্থানটি বিখ্যাত। এখানকার খুবানী অতুলনীয়, তার ভেতরে আছে সুস্বাদু বাদাম। ইসপাহানের ন্যাসপাতি স্বাদে ও আকারে সর্বোৎকৃষ্ট। এখানে আর পাওয়া যায় চমৎকার আঙুর ও তরমুজ। ইসপাহানের বাসিন্দারা সুদর্শন। তাদের গাত্রবর্ণ রক্তাভ সাদা। তারা সাহসী ও সদাশয় এবং সর্বদাই। ভাল ব্যয়বহুল খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এ ব্যাপারে তাদের সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে। এখানে প্রত্যেক শ্রেণীর ব্যবসায়ীদেরই একটি সমিতি আছে। ব্যবসায়ে লিপ্ত না হলেও নেতৃস্থানীয় লোকদের অনেক সমিতি আছে। তাছাড়া আছে অবিবাহিত যুবকদের সমিতি। এসব সমিতি অপর সমিতির সভ্যদের দাওয়াত করে এবং সাধ্যমত জাকজমক সহকারে ভোজ দেবার প্রতিযোগিতা করে। শুনেছি, একবার এক সমিতি অপর সমিতির সভ্যদের দাওয়াত করে রান্না করেছিল মোমবাতি জ্বালিয়ে। পরে এ মেহমানরা পালটা দাওয়াত করে রান্না করেছিল রেশম জ্বালিয়ে।
অতঃপর আমরা ইসপাহান থেকে রওয়ানা হই সিরাজে শেখ মাজদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে। সিরাজ সেখান থেকে দশ দিনের পথ। ছয় দিন পথ চলার পর আমরা পৌঁছলাম ইয়াজদিখস্তে। শহরের বাইরে একটি ধর্মশালায় মুসাফেরদের থাকবার ব্যবস্থা। আছে। শহরটি সুরক্ষিত এবং প্রবেশদ্বারটি লৌহ নির্মিত। ভিতরে রয়েছে কতকগুলি দোকান। মুসাফেররা প্রয়োজনীয় সব জিনিস এখানে কিনতে পারে। এখানে যে পনির তৈরী হয় তা ইয়াজদিখাস্তি নামে পরিচিত। উৎকর্ষতায় সে পনির অতুলনীয়। প্রতিটি পনিরের টুকরার ওজন দু’ থেকে চার আউন্স। সেখান থেকে তুর্কী অধ্যুষিত একটি অঞ্চল পার হয়ে সিরাজ গিয়ে পৌঁছলাম। জনবহুল সিরাজ শহরটি সুপরিকল্পিত ও সুগঠিত। প্রত্যেক রকম কারবারের জন্যই এখানে রয়েছে স্বতন্ত্র বাজার। এখানকার অধিবাসীরাও সুদর্শন এবং সুবেশধারী। সমগ্র প্রাচ্যে একমাত্র দামেস্ক ছাড়া বাজারের সৌন্দর্যে, ফলেফুলের বাগানে, নদীনালায় ও অধিবাসীদের সুশ্রীতায় সিরাজের তুলনা হয় না। চারদিক ফলের বাগানে বেষ্টিত একটি সমতল ভূমিতে সিরাজ অবস্থিত। মধ্যে মধ্যে রয়েছে নদী। তারই একটি নাম রুকনাবাদ১৩। এ নদীর সুমিষ্ট পানি গ্রীষ্মে অতি শীতল এবং শীতের সময় গরম। সিরাজের বাসিন্দারা ধর্ম প্রাণ ও সৎ, বিশেষ করে সেখানকার নারী সমাজ। তাদের মধ্যে চমৎকার একটি রীতি প্রচলিত আছে। প্রতি সোম, বৃহস্পতি ও শুক্রবার শহরের প্রধান মসজিদে এক দু’ হাজার নারী পাখা হাতে গিয়ে জমায়েত হয় এবং ধর্ম সম্বন্ধে বক্তার বক্তৃতা শোনে। অত্যাধিক গরম বলে তারা তখন নিজের-নিজের পাখা ব্যবহার করে। আমি আর কোনো দেশেই মহিলাদের এত বড় জমাত দেখি নি।
সিরাজ নগরে প্রবেশ করে আমার অন্তরে জাগরূক ছিল একটি মাত্র বাসনা। সে বাসনা হ’ল যুগের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় খ্যাতনামা শেখ মাজদ্দিন ইসমাইলকে খুঁজে বের করা। আমি যখন তার গৃহে গিয়ে পৌঁছলাম তিনি তখন আসরের নামাজের জন্য বাইরে। যাচ্ছিলেন। আমি তাকে ছালাম করলাম। তিনি আমার সঙ্গে কোলাকোলি করে আমার হাত ধরে জায়নামাজ অবধি এগিয়ে গেলেন এবং তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে ইঙ্গিত দিলেন। অতঃপর শহরের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা এলেন তাঁকে ছালাম করতে। ভোরে ও সন্ধ্যায় এই তাদের রীতি। এরপর তিনি আমার সফর এবং যে সব দেশ সফর করেছি সে সব-সম্বন্ধে আলাপ করলেন। আলাপের পর তার মাদ্রাসায় আমার থাকার ব্যবস্থা করতে হুকুম দিলেন। ইরাকের সুলতান শেখ মাজদ্দিনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তার এ শ্রদ্ধার কারণ নিমোত কাহিনীটিতে বুঝা যায়।
ইরাকের ভূতপূর্ব সুলতান মুহাম্মদ খোদাবান্দার ১৪ ইসলাম গ্রহণের আগেই তার সহচর ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী একজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি। পরে তাদের সহ তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন তখন এ ব্যক্তিকে তিনি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতে লাগলেন। এ সুযোগে তিনিও সুলতানকে পীড়াপীড়ি করে রাজী করালেন তার রাজ্যের সর্বত্র শিয়া মত প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু বাগদাদ, সিরাজ ও ইস্পাহানের লোকেরা এ মত প্রচারে বাধা দিল। সুলতান তাতে ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি ঐ তিন জায়গায় কাজীদের সমন দিয়ে হাজির। করতে হুকুম দিলেন। সুলতানের হুকুম মোতাবেক প্রথম যাকে দরবারে আনা হল তিনিই সিরাজের কাজী শেখ মাজদ্দিন। সুলতান তখন ছিলেন তাঁর গ্রীবাস কারাবাগ ১৫ নামক একটি স্থানে। কাজীকে তার কাছে হাজির করা হলে তিনি হুকুম দিলেন তাকে কুকুরের সামনে নিক্ষেপ করতে। গলায় শিকল বাঁধা প্রকাও এ কুকুরগুলিকে নরমাংস খেতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। যখন কাউকে কুকুরের সামনে দেবার জন্য আনা হয়। তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় প্রকাণ্ড একটি ময়দানে। তারপর কুকুরগুলিকে লেলিয়ে দেওয়া হয় তার উপর। লোকটি তখন স্বভাবতই পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পালাবার পথ পায় না। কুকুরগুলি অনায়াসে তাকে ধরে ছিন্ন-ভিন্ন করে তার মাংস খেতে থাকে। কিন্তু কাজী মাজদিনকে যখন কুকুরের সম্মুখে ছেড়ে দেওয়া হল তখন একটি কুকুরও তাকে আক্রমণ করল না। বরং কুকুরগুলি অত্যন্ত বন্ধুভাবে তাঁর কাছে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। এ খবর শোনার পর হতেই সুলতান কাজীকে অশেষ শ্রদ্ধা দেখাতে লাগলেন এবং শিয়া মত পরিত্যাগ করলেন। শুধু তাই নয়, সিরাজের প্রসিদ্ধ এলাকা জামানের একটি গ্রাম সহ অনেক কিছু কাজীকে দান করলেন। ভারত থেকে। ফিরবার পথে ১৩৪৭ খ্রীস্টাব্দে পুনরায় আমি কাজীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি তখন এত দুর্বল যে চলাফেরা করতে পারেন না। তবু তিনি আমাকে দেখেই চিনলেন এবং উঠে কোলাকোলি করলেন। একদিন আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম সিরাজের সুলতান নিজের কান ধরে তার সামনে বসে আছেন। কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে সম্মান দেখাবার এই রীতি সেখানে। সুলতানের সামনে হাজির হয়ে সেখানে সবাই তাই করে।
আমার সিরাজ সফরকালে সিরাজের সুলতান ছিলেন আবু ইসহাক ১৬। তিনি ছিলেন উত্তম সুলতানদেরই একজন। তিনি সুদর্শন, সদাচারী, বিনয়ী, দয়ালু প্রকৃতির একজন শক্তিশালী সুলতান ছিলেন। বিশাল একটি রাজ্য তিনি শাসন করতেন। তাঁর তুর্কী ও পার্শী সৈন্য সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তিনি সিরাজের অধিবাসীদের বিশ্বাস করতেন না। তিনি তাদের কখনো চাকুরীতে বহাল করতেন না। এবং কাউকে কোন রকম অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতেন না। কারণ তারা ছিল যেমন সাহসী, তেমনি ছিল পটু শাসনকর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। ১৩৩৫ খ্রীস্টাব্দে সুলতান। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর প্রত্যেক আমীর নিজের কাছে যা ছিল তাই হস্তগত করেন। কিন্তু সুলতান আবু ইসহাক নিজের বলে সিরাজ, ফারস ও ইসপাহানে আয়ান কিসরার ১৭ মত একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং সিরাজের অধিবাসীদের আদেশ করেন প্রস্তাবিত প্রাসাদের ভিত্তি খননের। তখন এক সমিতির লোকেরা অপর সমিতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এ কাজ আরম্ভ করল। কর্মীদের প্রতিযোগিতা এতদুর গিয়ে পৌঁছল যে অনেকে মাটি বইবার ঝুড়ি চামড়া দিয়ে তৈরী করে তা আবার কারুকার্য করা রেশমী কাপড়ে মুড়ে দিল। গাধার পিঠে যে ঝুড়ি ঝুলানো থাকত তাও এভাবে মুড়তে বাকি রইল না। কেউ-কেউ কাজের যন্ত্রপাতি তৈরী করল রূপা দিয়ে। কেউ কেউ অসংখ্য মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। যখন তারা মাটি খনন করতে যেত তখন। সবচেয়ে ভাল পোশাকটি পরে নিত। সুলতান একটি অলিন্দে বসে তাদের এসব লক্ষ্য করতেন। ভিত্তি খননের কাজ শেষ হলে তাদের বিদায় দিয়ে বেতন ভুক কারিগর নিয়োগ করা হল। নিয়োজিত কারিগরের সংখ্যা ছিল কয়েক সহস্র। আমি শহরের শাসনকর্তার কাছে শুনেছি, যে কর সেখানে আদায় হত তার বেশীর ভাগই ব্যয় হয়েছিল। এ কাজের জন্য। দান ধ্যানের জন্য আৰু ইসহাক নিজের তুলনা করতে যাইতেন ভারতের সুলতানের সঙ্গে। কিন্তু মাটির ঢিল থেকে সপ্তর্ষীমণ্ডল’ কত দূরে”। আবু ইসহাকের সবচেয়ে বড় দানের কথা আমি যা শুনেছি, তাতে জিরাতের রাজার এক দূতকে তিনি দিয়েছিলেন সত্তর হাজার দিনার। কিন্তু ভারতের সুলতান তার চেয়ে অনেক বেশী করে দিয়ে থাকেন অসংখ্য লোককে। দানের একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
আমীর বখত একবার ভারতের সুলতানের রাজধানীতে দেখা করতে এসে নিজেকে অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। সুলতান তার কাছে যেতেই তিনি উঠবার চেষ্টা করলেন কিন্তু সুলতান তাকে বিছানা ছেড়ে নামতে বারণ করলেন। একটি আসন আনা হলে সুলতান সেখানে বসলেন। তারপর হুকুম করলেন দাঁড়িপাল্লা ও সোনা আনতে। সে সব এলে তিনি রুগ্ন ব্যক্তিকে একটি পাল্লায় উঠে বসতে বললেন। আমীর তখন বলে। উঠলেন, জাহাঁপনা আগে যদি বুঝতাম আপনি এই করবেন তাহলে সমস্ত জামা-কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিতাম। সুলতান বললেন, ‘এখন পরে নিন আপনার যত জামা-কাপড় আছে। কাজেই তুলা দিয়ে তৈরী শীতের সমস্ত জামা-কাপড় পরে তিনি একটি পাল্লায় উঠে বসলেন। আরেক পাল্লায় চাপানো হলো সম-ওজনের সোনার তাল। সুলতান তখন বললেন, “এগুলি নিয়ে আপনার রোগমুক্তির জন্য দানখয়রাত করে দিন।” এই বলে তিনি চলে গেলেন।
সিরাজে এমন অনেকগুলি পবিত্র স্থান আছে যার প্রতি বাসিন্দাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। তারা এসব স্থান জেয়ারত করতে আসে। এ-সবের ভেতর ইমাম আবদুল্লাহ ইব্নে খাফিফের কবরস্থান একটি। সেখানে শেখ বললেই এ ইমামকে ছাড়া আর কাউকে বুঝায় না। মুসলিম তাপসদের মধ্যে তার স্থান ছিল অতি উচ্চ। তার সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। একবার ত্রিশজন দরবেশকে সঙ্গী হিসাবে নিয়ে তিনি সিংহলের সরণ দ্বীপে (Adam’s peak) যান। পথে এক জনমানবহীন স্থানে পৌঁছে ক্ষুধায় তারা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। সিংহলে অনেক হাতী পাওয়া যায়। সিংহল থেকে ভারতে অনেক হাতী চালান হয়ে আসে। ক্ষুধার যন্ত্রণা যখন অসহ্য হয়ে উঠে তখন দরবেশরা একটি ছোট হাতী মেরে খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কিন্তু শেষ তাদের বারণ করেন। অবশেষে ক্ষুধায় অস্থির হয়ে তারা শেখকে অমান্য করেই একটি হাতীর বাচ্চা মেরে ক্ষুধা নিবারণ করেন। অবশ্য শেখ হাতীর গোশত ভক্ষণে রাজী হন না। অতঃপর রাত্রে তাদের নিদ্রিত অবস্থায় চারদিক থেকে অনেক হাতী এসে সেখানে হাজির হয় এবং তাদের প্রত্যেকের ঘ্রাণ নিয়ে একে-একে সবাইকে হত্যা করে। নিদ্রিত শেখেরও ঘ্রাণ নেয় কিন্তু তার কোন অনিষ্ট করে সহসা একটি হাতী গুড় দিয়ে তাকে নিজের পিঠে তুলে নেয় এবং একটি লোকালয়ে গিয়ে হাজির হয়। গ্রামবাসীরা শেখকে হাতীর পিঠে এ অবস্থায় দেখে বিস্মিত হয়। হাতিটি তখন তাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে প্রস্থান করে।
এ সিংহল দ্বীপেও আমি সফর করেছি। এখানকার লোকেরা এখনও পৌত্তলিক (বৌদ্ধ) রয়েছে। কিন্তু তা হলেও মুসলমান দরবেশদের এরা সম্মান করে, নিজেদের গৃহে আশ্রয় দেয় এবং আহার করতে দেয়। নিজেদের গৃহে এর স্ত্রীপুত্র নিয়ে বসবাস করে। ভারতের যে সব পৌত্তলিক (ব্রাহ্মণ ও হিন্দু) বাস করে তাদের রীতিনীতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা কখনও মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না এবং কখনও নিজেদের পাত্রে পানাহার করতে দেয় না। অথচ কথায় বা কাজে তারা মুসলমানদের প্রতি আপত্তিকর কিছু করে না। এখানে আমরা একবার তাদের হাতে রান্না করা গোশত খেতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাদের নিজেদের পাত্রেই আমাদের খাদ্য পরিবেশন করা হল, তারা বসে রইল কিছু দূরে। তারা কলাপাতায় করে আমাদের ভাতও খেতে দিত। ভাত তাদের প্রধান খাদ্য। ভাত দিয়ে তারা চলে যেত। আমাদের খাওয়ার যা কিছু পড়ে থাকত তা কুকুর ও পাখী এসে খেয়ে ফেলত। যদি কোন অবোধ শিশু কখনো এসব। খেত তবে তাকে প্রহার করে কিছু গোবর খাইয়ে দেওয়া হত। তারা বলে, এই করে। তাকে পবিত্র করা হয়।
সিরাজ নগরের বাইরে যে সব পবিত্র কবর আছে তার মধ্যে ধর্ম প্রাণ শেখ সাদীর১৮ কবর একটি। ফারসী ভাষায় তিনি তাঁর সময়কার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তিনি তাঁর রচনায় অনেক সময় আরবী কবিতা ব্যবহার করেছেন। কবির দ্বারা নির্মিত চমৎকার একটি মুসাফেরখানা এখানে আছে। মুসাফেরখানার ভেতরে সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান। নিকটেই রয়েছে রুকনাবাদ নামক প্রসিদ্ধ নদীর উৎপত্তিস্থল। শেখ সাদী কাপড় ধোয়ার জন্য মার্বেল পাথরের কতগুলি চৌব্বাচ্চা তৈরী করে গেছেন। সিরাজের বাসিন্দারা কবর জেয়ারত করতে এসে এখানেই খেতে পায় এবং নদীতে নিজেদের কাপড় ধুয়ে নেয়। আমিও তাই করলাম–আল্লাহ্ তার আত্মার মঙ্গল করুন।
সিরাজ থেকে দু’মাইল পশ্চিমে কাজান। সিরাজ থেকে কাজারুন রওয়ানা হলাম শেখ আবু ইসহাক আল-কাজারুনীর কবর জেয়ারত করতে। ভারত ও চীনের বাসিন্দারা শেখ আবু ইসহাককে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। চীন সমুদ্রে ভ্রমণকালে বাতাস যদি বিপরীত দিকে বইতে থাকে এবং জলদস্যুর আক্রমণের ভয় থাকে তবে ভ্রমণকারীরা শেখ আবু-ইসহাকের নামে মানত করে এবং যে যা মানত করল তা কাগজে লিখে রাখে। অতঃপর তারা নিরাপদ স্থানে পৌঁছলে ঐ ধর্ম স্থানের লোকেরা জাহাজে গিয়ে তালিকা দেখে মানতের টাকা পয়সা আদায় করে আনে। ভারত ও চীন থেকে এমন কোন জাহাজ এখানে আসে না যাতে মানতের হাজার হাজার দিনার আদায় না হয়। শেখের নাম করে কোন ফকির এখানে এসে ভিক্ষা চাইলে তাকে শেখের নামের মোহরাঙ্কিত একটি হুকুমনামা দেওয়া হয়। তাতে লেখা থাকেঃ যদি কেউ শেখ আবু ইসহাকের নামে মানত করে থাকো তবে অমুককে এত টাকা মানতের টাকা থেকে দিয়ে দাও।” অতঃপর হাজার, শ’ বা কমবেশী টাকার কথা উল্লেখ করে দেয়। ফকির কোন মানত কারীর দেখা পেলে তাকে হুকুমনামা দেখিয়ে টাকা আদায় করে অপর পিঠে রশিদ লিখে দেয়।
কাজারুণ থেকে জায়দানের পথে আমরা এলাম হুবায়জা। সেখান থেকে পানিবিহীন মরুভূমির ভেতর দিয়ে পাঁচদিন পথ চলে কুফায়১৯ হাজির হলাম। এক সময়ে কুফা ছিল আস্হাবদের, পণ্ডিতব্যক্তিদের ও ধর্মশাস্ত্রজ্ঞদের বাসস্থান এবং আমির উল-মমামেনিন হজরত আলীর রাজধানী। কিন্তু এখন সে কুফা পার্শ্ববর্তী যাযাবর আরবদের আক্রমনের ফলে ধ্বংসের কবলে এসে পড়েছে। শহরটির চারদিকে কোন প্রাচীর নেই। এখানকার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মসজিদটির সাতটি গুম্বজ সুউচ্চ স্তরে উপর স্থাপিত। কারুকার্যখচিত স্তম্ভগুলির একটি অংশ অপরটির উপর পর-পর বসিয়ে জোড়া দেওয়া হয়েছে গলানো সীসার সাহায্যে। এখান থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা বীর মাল্লাহা (Salt well) নামক সুন্দর একটি শহরে এসে রাত কাটালাম। সুন্দর এ শহরটির চারদিক তাল বাগানে বেষ্টিত। আমি শহরে প্রবেশ না করে বাইরেই তাবু খাটালাম। কারণ, এ শহরের বাসিন্দারা গোড়া শিয়া মতাবলম্বী।
পরের দিন ভোরে যাত্রা শুরু করে আমরা হিল্লা শহরে এলাম। ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত হিল্লা বেশ বড় একটি শহর। শহরের বাজারগুলিতে ফসলাদি ছাড়াও স্থানীয় অনেক শিল্পদ্রব্য কিনতে পাওয়া যায়। এখানে নদীর এপার থেকে ওপার অবধি নৌকার পর নৌকা সার বেঁধে সাজিয়ে সুন্দর একটি সেতু তৈরী করা হয়েছে। নৌকাগুলির ‘আগা’ ও পাছায় লোহার শিকল লাগিয়ে উভয় তীরে বাঁধা হয়েছে কাঠের শক্ত খুঁটীর সঙ্গে। হিল্লার বাসিন্দারা সবাই ‘Twelver’ দলভূক্ত শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। কিন্তু তাদের ভেতর আবার রয়েছে দুটি উপদল। এক দলের লোকেরা কুর্দ বলে পরিচিত অপর দলকে বলা হয় দুই মসজিদের দল। দু দলের ভেতর সর্বক্ষণ ঝগড়া বিবাদ লেগেই আছে। শহরের প্রধান বাজারের সন্নিকটে একটি মসজিদ আছে। এ মসজিদটির দরজা রেশমী পর্দায় ঢাকা থাকে। তারা এ মসজিদকে বলে জামানার ইমাম (বা Master of the Age)–এর দরগা। এখানকার প্রচলিত নিয়মানুসারে প্রতিদিন সূর্যাস্তের পূর্বে প্রায় শতেক লোক মুক্ত তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্রাদি হাতে নিয়ে নগরের শাসনকর্তার কাছে হাজির হয়। তিনি তাদের জাজিম ও লাগাম লাগানো একটি ঘোড়া বা গাধা দেন। সেই ঘোড়া বা গাধাটি নিয়ে তখন তারা ঢাক ঢোল বাশীসহ মিছিল করে পঞ্চাশ জন ঘোড়ার আগে এবং পঞ্চাশ জন পিছনে, ডাইনে বামে অনেক লোক সহ জামানার ইমামের দরগায় গিয়ে হাজির হয়। দরজার সামনে গিয়ে বলতে থাকে, “বিছমিল্লাহু, হে জামানার ইমাম, বিছমিল্লাহ্ চলে আসুন, দুর্নীতি শুরু হয়েছে, অবিচার চলছে। এখনই আপনার আগমনের সময়, যাতে আপনার দ্বারা আল্লাহ্ সত্য ও মিথ্যার যাচাই করতে পারেন।” মাগরেবের নামাজের সময় অবধি তারা ঢাক, ঢোল ও বাঁশী বাজিয়ে এমনি করে ডাকতে থাকে। তাদের বিশ্বাস, আল হাসান আল্-আসকারির পুত্র মোহাম্মদ এই মসজিদে ঢুকে লোকচক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য হয়েছেন এবং একদিন আবার এখান থেকেই হবে তার আবির্ভাব। কারণ তাদের মতে, ইনিই হবেন সেই প্রত্যাশিত ইমাম।
সেখান থেকে চলে এলাম আমরা কারবালা-হযরত আলীর পুত্র হোসেনের দরগাহ্। এ কবরটির পারিপার্শ্বিকতা ও জেয়ারতের রীতিনীতি নাজাফে হযরত আলীর কবরের অনুরূপ। এ শহরের বাসিন্দারা সবাই শিয়া মতাবলম্বী এবং তারাও দুটি দলে বিভক্ত। যদিও তারা একই বংশ থেকে উদ্ভূত তবু সর্বক্ষণ পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে। তার ফলে শহরটি ধ্বংসপ্রায় হয়ে গেছে।
তারপর সেখান থেকে এলাম বাগদাদ-শান্তির আগার, ইসলামের রাজধানী ২২। হিল্লার সেতুর মত এখানে দুটি সেতু আছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সে সেতুর উপর দিয়ে রাত-দিন নদীর এপার ওপার লোক চলাচল করে। বাগদাদে মোট এগারটি প্রধান (Cathedral) মসজিদ আছে, তার আটটি নদীর দক্ষিণ তীরে, বাকী তিনটি বাম তীরে। এ ছাড়াও বাগদাদে আরো মসজিদ ও মাদ্রাসা আছে কিন্তু মাদ্রাসাগুলির সবই ভগ্নদশা প্রাপ্ত। বাগদাদে হামাম বা গোসলখানার সংখ্যা প্রচুর এবং সেগুলি সুন্দর ভাবে গঠিত। অধিকাংশ হামামের দেওয়াল পিচ দিয়ে রং করা হয়েছে বলে কাল মার্বেল পাথরের মত দেখায়। কুফা ও বসরার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি ঝরণা থেকে এ পি সগ্রহ করা হয়। সেখানে ক্রমাগত পিচের ধারা বয়ে এসে ঝরণার দু’পাশে কাদার মত জমা হয়। শাবলের সাহায্যে তাই তুলে আনা হয় বাগদাদে। প্রতি বেসরকারী গৃহ বা। প্রতিষ্ঠানের গোসলখানা রয়েছে। গোলসখানার এক কোণে আছে পানির গামলা (Basin) তার সঙ্গে যুক্ত ঠাণ্ডা ও গরম পানির দু’টি কল। প্রত্যেক মানার্থীর জন্য তিনখানা করে তোয়ালের ব্যবস্থা আছে। একখানা থাকে গোলসখানায় ঢুকবার আগে পরবার জন্য, অপরখানা পরে বাইরে আসবার জন্য এবং তৃতীয়খানা শরীর মুছে। শুকাবার জন্য। একমাত্র বাগদাদ ছাড়া অপর কোন শহরে আমি এ ধরনের বিস্তৃত ব্যবস্থা দেখি নাই, যদিও কোন-কোন শহরে এর কাছাকাছি সুব্যবস্থা আছে২৩। বাগদাদ শহরের পশ্চিমাংশ নির্মিত হয়েছে আগে যদিও তার বহুলাংশ এখন ধ্বংসের কবলে। তা সত্ত্বেও এখানে এখনও তেরটি মহল্লা আছে এবং তার প্রতিটিই একটি শহরের মত এবং প্রতিটি মহল্লায় দু’ তিনটি করে গোসলখানা আছে। হাসপাতালটি মনে হয় একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ, যার চিহ্ন মাত্র এখন বর্তমান। শহরের পূর্বাংশে রয়েছে অনেকগুলি বাজার। সবচেয়ে বড় বাজারটিকে বলা হয় মঙ্গলবারের বাজার। শহরের এ অংশে কোন ফলের গাছ নেই বলে এখানে ফল আনা হয় পশ্চিমের অংশ থেকে। সেখানে ফলের বাগানাদি আছে।
আমার বাগদাদ আগমনের সম সময়ে সেখানে আসেন উভয় ইরাক ও খোরাসানের সুলতান আবু সাঈদ বাহাদুর খান ২৪। ইনি সুলতান মোহাম্মদ খোদাবান্দার পুত্র। সুলতান খোদাবান্দার ইসলাম গ্রহণের উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। বর্তমান সুলতান একজন দয়ালু ব্যক্তি। তিনি যখন পিতার মসনদ দখল করেন তখনও বয়সে তিনি। বালক মাত্র। তাঁকে নামে মাত্র সুলতান রেখে সমস্ত ক্ষমতা দখল করেছিল প্রধান আমীর জুবান। এভাবেই কিছুকাল চলবার পর একদিন ভূতপূর্ব সুলতানের বেগমগণ জুবানের পুত্র দামাস্ক খাজার ঔদ্ধত্য সম্বন্ধে নালিশ করেন বর্তমান সুলতানের কাছে। সুলতান। জুবানের পুত্রকে গ্রেপ্তার করিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তার সৈন্যদলের সঙ্গে জুবান তখন ছিলেন খোরাসানে। তাতার সৈন্যদল জুবানের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অগ্রসর হয়। কিন্তু উভয় পক্ষের সৈন্যরা যখন সামনাসামনি হয় তখন তাতার সৈন্যরাও জুবানকে ত্যাগ করে সুলতানের সঙ্গে যোগদান করে। জুবান অগত্যা সিজিস্তানে (সিস্তান) পলায়ন করতে বাধ্য হয় এবং পরে হিরাতের সুলতানের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিছুদিন পরেই হিরাতের সুলতান তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ও তার কনিষ্ঠ পুত্রকে হত্যা করে তাদের মাথা সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দেন। অতঃপর আবু সাইদ যখন সর্বেসর্বা তখন তিনি জুবানের কন্যাকে বিবাহ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জুবানের কন্যাকে বলা হত বাগদাদ খাতুন। তিনি পরমাসুন্দরী ছিলেন এবং শেখ হাসানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। আবু সাইদের মৃত্যুর পরে শেখ হাসানই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। শেখ হাসান ছিলেন আবু সাঈদের ফুপাত ভাই। আবু সাঈদের হুকুমে হাসান তার স্ত্রীকে তালাক দেন এবং বাগদাদ খাতুন শীঘ্রই আবু সাঈদের প্রিয়তমা পত্মী হয়ে উঠেন। তুর্কী ও তাতারদের মধ্যে মহিলাদের স্থান অতি উচ্চে। তারা যখন কোন হুকুম দেন তখন বলেন, “সুলতান ও মহিলাদের আদেশানুসারে।” প্রত্যেক মহিলাই বিরাট আয়ের কয়েকটি শহর ও জেলার মালিক। সুলতানের সঙ্গে যখন তারা সফরে বের হন তখন তাদের জন্য পৃথক তাবুর বন্দোবস্ত থাকে।
উপরে বর্ণিত অবস্থায় কিছুদিন চলবার পরে সুলতান দিলশাদ নাম্নী এক নারীকে বিবাহ করেন এবং অচিরেই তার অনুরক্ত হয়ে উঠেন।২৫ তখন বাগদাদ খাতুনকে। অবহেলা করার ফলে সে হিংসার বশে একখানা রুমালের সাহায্যে সুলতানকে বিষ প্রয়োগ করে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশ লোপ হয়ে গেল। তখন আমীররা নিজ নিজ প্রদেশের মালিক হয়ে বসলেন। পরে যখন তারা জানতে পারলেন যে, বাগদাদ খাতুনই সুলতানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে তখন তাঁরাও বাগদাদ খাতুনকে হত্যা করবেন বলে স্থির করেন। খাজা সুলু নামে একজন গ্রীক ক্রীতদাস ছিলেন প্রধান আমীরদের একজন। বাগদাদ খাতুন যখন স্নানাগারে ছিলেন তখন সেখানে প্রবেশ করে সুলু লাঠির প্রহারে বাগদাদ খাতুনকে হত্যা করেন। এক টুকরা চট দিয়ে ঢাকা অবস্থায় তার মৃতদেহ কয়েকদিনের জন্য সেখানেই পড়েছিল।
অতঃপর আমি সুলতান আবু সাঈদের মহল্লার’২৬ সহগামী হয়ে বাগদাদ ত্যাগ করি। সুলতান কোন্ পথে যান তাই দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে দশদিন চলার পরে আমি একজন আমীরের সঙ্গে তাব্রিজ ২৭ শহরে রওয়ানা হই। দশদিন সফরের পরে আমরা তাব্রিজ শহরের বাইরে আস্-শাম নামক একটি জায়গায় হাজির হয়ে তাবু খাটালাম। এখানে সুন্দর একটি মুসাফেরখানা আছে। এখানে মুসাফেরদের রুটি, গোশত, ঘৃতপক্ক ভাত ও মিষ্টান্ন দেওয়া হয়। পর দিন ভোরে শহরে প্রবেশ করে গাঁজান বাজার নামে প্রকাণ্ড একটি বাজারে হাজির হলাম। দুনিয়ার যত সুন্দর-সুন্দর বাজার আমি দেখেছি তার একটি গাঁজান বাজার। প্রত্যেক পণ্য-দ্রব্যের জন্যই এখানে নির্দিষ্ট পৃথক স্থান আছে। স্বর্ণকারদের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে নানা রঙের মণিমুক্তা দেখে আমার চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হল। রেশমী কোমরব সহ মূল্যবান পোশাকে সজ্জিত সুশ্রী ক্রীতদাসদের সাহায্যে এসব রকমারী মণিমুক্তা দেখানো হয়। তারা মহাজনের সামনে দাঁড়িয়ে তুর্কী বেগমদের এসব দেখায়, বেগমরা তখন এসে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রচুর পরিমাণে কিনতে থাকে। এসব দেখে একটি দাঙ্গা দেখছি বলে মনে হল।-আল্লাহ্ এসব থেকে আমাদের রক্ষা করুন। তারপর গেলাম কস্তুরী ও অন্যান্য গন্ধদ্রব্যের বাজারে। সেখানেও অনুরূপ বা তার চেয়েও খারাপ দাঙ্গা দেখে এলাম।
তাব্রিজে আমরা মাত্র এক রাত্রি কাটালাম। পরের দিন সুলতান আমীরকে ফিরে যাবার নির্দেশ পাঠালেন। কাজেই এখানকার কোন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হবার আগেই ফিরে আসতে হল। ফিরে আসবার পরে আমীর আমার বিষয়ে সুলতানকে বললেন এবং আমাকে চাক্ষুষ পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুলতান আমায় দেশ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা করে একটি পোশাক ও ঘোড়া আমাকে উপহার দিলেন। আমীর তখন সুলতানকে বললেন যে আমি হেজাজ যেতে চাইছি। তার ফলে তিনি আমাকে রসদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ দিতে হুকুম করলেন। আমীর-উল-হজের সঙ্গে আমার সফরের ব্যবস্থা হল এবং তিনি বাগদাদের শাসনকর্তাকে সে কথা পত্র লিখে জানিয়ে দিলেন। বাগদাদে ফিরে এসে সুলতানের ব্যবস্থা মত সবকিছুই আমি পেলাম। হজযাত্রীর কাফেলা রওয়ানা হতে তখনও দু’মাসের বেশী সময় বাকি ছিল। কাজেই এ সুযোগে মাসুল ও দিয়ার বাকর জেলা দুটি সফর করে আসা আমার উত্তম বলে মনে হল।
বাগদাদ ত্যাগ করে আমরা দুজাল খালের পাড়ে একটি সরাইখানায় এলাম। তাইগ্রীস নদী থেকে বেরিয়ে এসে অনেকগুলি নদীতে পানি সরবরাহ করছে এ খালটি। দুদিন পর আমরা এলাম হারবা নামক বড় একটি গ্রামে সেখান থেকে তাইগ্রীস নদীর তীরস্থ আল-মাগুক নামক একটি দূর্গের নিকটে। এর উল্টা দিকে পূর্ব তীরে সুররা মানরা বা সামারা শহর। এ শহরটির শুধুমাত্র ধ্বংসাবশেষ এখন বর্তমান। এখানকার আবহাওয়া সুষম প্রকৃতির এবং স্থানটি ধ্বংসাব শেষে পূর্ণ হলেও অত্যন্ত মনোরম ২৮। আরও একদিনের পথ এগিয়ে গিয়ে আমরা তাকরিট পৌঁছলাম। তাকরিট শহরটি বেশ বড় এবং এখানে সুন্দর-সুন্দর বাজার এবং অনেকগুলি মসজিদ আছে। এ শহরের বাসিন্দারা তাদের বিবিধ সদৃগুণের জন্য প্রসিদ্ধ। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আরও দু’মঞ্জিল পথ চলে আমরা এলাম আল্-আকর নামে আরেকটি গ্রামে। এখান থেকে একটানা কতগুলি গ্রাম ও আবাদী জমি পার হয়ে মসুল। সেখান থেকে আমরা যেখানে এলাম সেখানকার জমি কাল। বসরা ও কুফার মধ্যকার স্থানের ঝরণার মত এখানকার কুপে পি পাওয়া যায়। এখান থেকে আরও দু’মঞ্জিল গিয়ে আমরা আল-মাউসিল (মসুল) পৌঁছলাম।
মসুল একটি পুরাতন বর্ধিষ্ণু শহর। এখানকার সুদৃঢ় দূর্গটি আল-হাদরা (The Humpback) নামে পরিচিত। দূর্গের পরেই সুলতানের প্রাসাদরাজি। শহর থেকে প্রাসাদগুলিকে পৃথক করে রেখেছে বেশ চওড়া একটি দীর্ঘ রাস্তা। রাস্তাটি শহরের শুরু থেকে শেষ অবধি প্রসারিত। শহর বেষ্ট করে আছে ঘন-ঘন সন্নিবিষ্ট মিনারওয়ালা। দু’টি সুদৃঢ় প্রাচীর। প্রাচীরগুলি এতটা পুরু যে পর-পর অনেকগুলি কোঠা তৈরী করা হয়েছে। প্রাচীরের ভিতরে দিল্লী ছাড়া আর কোথাও আমি এমন নগর প্রাচীর দেখি নাই। শহরের বাইরেই বিস্তৃত শহরগুলি। সেখানে মজিদ, গোসলখানা, বাজার, মুসাফেরখানা প্রভৃতি সবই আছে। এখানে তাই গ্রীসের তীরে রয়েছে প্রসিদ্ধ একটি মজিদ। মসজিদের চারদিকে লোহার জাফরি-কাটা জানালা। আর আগে এর সংলগ্ন নদীর দিকে প্রসারিত সুদৃশ্য ও সুগঠিত বেদী। মসজিদের সামনেই একটি হাসপাতাল। এ ছাড়া আরও দুটি প্রসিদ্ধ মজিদ আছে শহরের ভিতরে। মসুলের কায়সারিয়া লোহার দরজাওয়ালা সুন্দর একটি অট্টালিকা।২৯
মসুল থেকে আমরা গেলাম জাজিরাত ইব্নে ওমর নামক বৃহৎ একটি শহরে। শহরটি নদী দ্বারা বেষ্টিত বলেই নাম হয়েছে জাজিরা (দ্বীপ)। শহরের বহুলাংশ আজ ধ্বংসের কবলে। জাজিরার বাসিন্দারা সচ্চরিত্র ও বিদেশীদের প্রতি সদাশয়। এখানে যেদিন ছিলাম সেদিন আমাদের জুদি পর্বত দেখবার সুযোগ হয়। এই জুদি পর্বতে এসে হজরত নূহ-এর কিশতি নোঙর করেছিল বলে কোরআন শরীফে উল্লেখ আছে। জাজিরাত-ইব্নে ওমর থেকে দু’মঞ্জিল এগিয়ে আমরা পৌঁছলাম নাসিবিন শহরে। মাঝারী আকারের একটি প্রাচীন শহর নাসিবিন। বিস্তীর্ণ একটি উর্বর সমতটে অবস্থিত। এ শহরেরও অনেকাংশ ভগ্নদশায় উপনীত। এ শহরে যে গোলাব পানি তৈরী হয় সুগন্ধের জন্য তা অতুলনীয়। নিকটবর্তী একটি পাহাড় থেকে উৎপন্ন নদী শহরটিকে ঘিরে আছে। নদীর একটি শাখা শহরে প্রবেশ করে রাস্তা, বাড়ীঘর, প্রধান মজিদের চত্বর পার হয়ে দুটি চৌবাচ্চায় গিয়ে নিঃশেষ হয়েছে। এ শহরে একটি হাসপাতাল ও দু’টি মাদ্রাসা আছে।
অতঃপর আমরা হাজির পর্বতের পাদদেশে স্থাপিত সিজার ৩০ নামক শহরে। শহরের অধিবাসীরা সাহসী ও দয়ালু প্রকৃতির কুর। সিজার থেকে এলাম দারা। দারা নামক এ বৃহৎ পুরাতন শহরে মনোরম একটি দূর্গ ৩১ আছে। এ শহরটিও ধ্বংসপ্রায় এবং একেবারেই জনবিরল। শহরের বাইরের জনপদে গিয়ে আমরা থাকবার ব্যবস্থা করলাম। সেখান থেকে যাত্রা করে পাহাড়ের পাদদেশে মিরিদিন শহরে গেলাম। মুসলমান দেশগুলিতে যে সব সুন্দর সুগঠিত শহর আছে তার মধ্যে মিরিদিন একটি। এখানে যে উলের সূতা তৈরী হয় তা এ নামেই সর্বত্র পরিচিত। পাহাড়ের শীর্ষদেশে অবস্থিত এখানে সুউচ্চ একটি দূর্গ আছে। আমি যখন সেখানে যাই তখন মিরিদিনের সুলতান ছিলেন আল্ মালীক আস্-সালি৩২। ইরাক, সিরিয়া বা মিসরে দানে তার মত মুক্তহস্ত ব্যক্তি আর নাই। কবি ও দরবেশরা আসেন তার সঙ্গে দেখা করে তার দান গ্রহণের জন্য।
এখান থেকে বাগদাদ ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করতে হল। মসুলে পৌঁছে দেখলাম সেখানকার হজযাত্রী দল বাগদাদের দিকে যাত্রা করে শহর ছেড়ে বাইরে এসেছে। আমিও তাদের শামিল হয়ে গেলাম। বাগদাদে পৌঁছে দেখতে পেলাম, সেখানকার হজযাত্রীরাও যাত্রার আয়োজন করছে। কাজেই আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করে আমার প্রাপ্যের কথা উল্লেখ করলাম। একটি উটের পিঠের অর্ধাংশ তিনি আমার জন্য বরাদ্দ। করে দিলেন আর দিলেন খাদ্য ও চারজনের উপযোগী পানি। এবং তদনুযায়ী একটি হুকুমনামা লিখে দিয়ে আমীর-উল-হজের কাছে আমাকে হাওলা করে দিলেন। তার সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু পরে আমাদের পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তার তত্ত্বাবধানে আমাকে রেখে তিনি যথেষ্ট যত্ন ও দয়া প্রদর্শন করেন এবং আমার ন্যায্য প্রাপ্যের চেয়ে তিনি অনেক বেশী দেন। কুফা ত্যাগ করার পর আমি। পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হই। সেজন্য আমাকে প্রত্যহ বহুবারের জন্য উটের পিঠ থেকে ওঠানামা করতে হয়। আমীর-উল-হজ সর্বদা আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতেন এবং আমাকে দেখাশুনা করতে অপর সবাইকে আদেশ দিতেন। আব্বার দরগাহ্ মক্কা পৌঁছা পর্যন্ত আমি অসুস্থই ছিলাম। সেখানে পৌঁছে যথারীতি পবিত্র কাবা তওয়াফ করলাম এবং আর সব করণীয় বসা অবস্থায় সমাধা করতে হল। সাফা ও মারোয়া গেলাম আমীরের ঘোড়ায় চড়ে।৩৩ মিনায় এসে আমি অনেকটা ভাল বোধ করতে লাগলাম ও সুস্থ হয়ে উঠলাম। হজের শেষে একটি বছর আমি পুরোপুরিভাবে ধর্মকর্ম উদ্যাপনে কাটালাম।
পরের বছর হজ (১৩২৮) সমাপন করে পর-পর আরও দু’বছর আমার সেখানে কাটল।
টিকা
পরিচ্ছেদ ২
১। বাগদাদ এবং নজ থেকে যে পথ মদিনায় গিয়েছে সেটা খলিফা হারুন-উর-রশিদের বেগমের নামানুসারে দার যোবেদা বলে পরিচিত। তিনি এ পথের সব জায়গায় পানির চৌব্বাচ্চা নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং তাঁর সম্পত্তির আয় থেকে সে সব রক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সে পথে বিগত বারো শ বছরের ক্কচিৎ কোন পরিবর্তন ঘটেছে। হামদানীর বর্ণনানুসারে মদিনা থেকে ফয়েদ পর্যন্ত যে সব স্টেশন ছিল তা হচ্ছেঃ তারাফ (২৪ আরবীয় মাইল) বতন নাখ (২০ মাইল), উসেলা (২৮ মাইল), মাদিন্ আন-নাকিরা (২৬ মাইল), তুজ (২৫ মাইল), ফয়েদ (২৪ মাইল) : মোট ১৯৬ আরবীয় মাইল কিম্বা ২৩৪ ইংলিশ মাইল। ইব্নে বতুতা স্পষ্টরূপে মধ্যবর্তী দুরত্ব ভ্রমণ করে ছ’ দিনে উসেলায় পৌঁছেন (আমি। তার ওয়াদিল অরুস দেখতে পাচ্ছি না), তারপর মাদিন আন-নাকিরার পরিবর্তে অন্য পথ গ্রহণ করেন নাকিরার ভিতর দিয়ে; কারুরাতে এসে ধরেন প্রধান রাস্তা (মাদিনা আন্-নাকিরা এবং আল্-হাজিরের মাঝখানে, এবং পরবর্তীটি থেকে ১২ মাইল), এবং সেখান থেকে গতি পরিবর্তন না করে চলতে থাকেন। ঝাঁঝরা পাহাড়-আ-মারুকা দেখানো হয়েছে মিউজিলের ১.১,০০০,০০০ ম্যাপে ফয়েদের ২৭ ইংলিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, ২৬.৫০ উত্তরে, ৪১.৩৬ পূর্বে, এবং ফয়েদ ২৭.০৮ উত্তরে ৪১.৫৩ পূর্বে।
২। ইয়াকুত বলেন, খাদ্যদ্রব্য এবং ভারী মালপত্রের একটা অংশ পারিশ্রমিক হিসাবে তাদের দেওয়া হয় যাদের জিম্মায় এ সব রাখা হয়।
৩। ফয়েদ এবং কুফার মাঝখানের মোট ২৭৭ আরবী মাইল কি ৩৩০ ইংরেজী মাইল ভ্রমণের বিভিন্ন স্তরের বিস্তৃত বিবরণ এখানে দেওয়া অনাবশ্যক। শয়তানের গিরিপথ” সম্ভবতঃ মিউজিলের ম্যাপে চিহ্নিত “আসোয়েবৃ” ৩০.১১ উত্তরে, ৪৩.৪২ পূর্বে অবস্থিত। ওয়াকিমাকে দেখানো হয়েছে ৩০.৩৮ উত্তরে, ৪৩.৫১ পূর্বে, লাওজা অবস্থিত ১৬ ইংলিশ মাইল উত্তরে, ওয়াকিসার পূর্বে অ-মাসাজি কিম্বা আল্-মসজিড় হচ্ছে নাজাফের পশ্চিমে ৫৬ মাইল দক্ষিণে, মুনারাত আকুরুন মনে হয় উম্মু করুন একটি মন্দির নাজফের ৩০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। কাদ্দাসিয়া নাজাফের ১৫ মাইল দক্ষিণে। যে যুদ্ধের কথা ইব্নে বতুতা উল্লেখ করেছেন সেটা ঘটেছিল ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে, হজরত মোহম্মদের (দঃ) ইন্তেকালের পাঁচ বছর পরে। এর ফলে পার্শিয়ান বাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটে এবং আরবগণ ইরাক অধিকার করেন।
৪। পয়গম্বরের জামাতা এবং চুতর্থ খলিফা, ৬৬১ খ্রীষ্টাব্দে নিহত হন। কারবালায় হোসেনের সহ তার কবর শিয়াগণের কাছে একপ্রকার অদ্ভুত ভক্তি পেয়ে থেকে। (১পরিচ্ছেদ,২২টীকা দ্রষ্টব্য)। ক্যাসারিয়া শব্দের অর্থ দেখুন নিচে ২৯ টীকায়।
৫। ২৭ শে রজবের পূর্বরাত্রি লাইলাতেল মিরাজ নামে পরিচিত, কিম্বা পয়গম্বরের স্বর্গারোহন রাত্রি। পরিচ্ছেদ ১, টীকা ৩০ দেখুন।
৬। আহমদ-আর রিফাই, মৃত্যু ১১৮২ খ্রীষ্টাব্দে, সমাহিত হন উম্উবেদায়, আবদুল কাদির আল্-জিলানীর ভ্রাতপুত্র এবং রিফাইয়া সম্প্রদায়ের দরবেশদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, এরা কারিয়া সম্প্রদায়ের একটি উপ-শাখা, বর্তমানে মিশরের একটি প্রধান সম্প্রদায়। যে। সম্প্রদায়কে ইব্নে বতুতা আহমদী দরবেশ নাম দিয়েছেন, বর্তমানে সেটা শেখৃ আহমদ আল– বাওয়াই প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়কে দেওয়া হয়। ইনি ছিলেন উৰ্ত্তবেদা আশ্রমের শিষ্য মিশরের টানটায়। তার মৃত্যু হয় ১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে।
৭। বসরার সংকোচন সম্পূর্ণভাবে তার ক্ষয়প্রাপ্তির জন্য ঘটে না বরঞ্চ নগরের ক্রমশঃ পূর্ব দিকে সরে যাওয়ার জন্য।
৮। নূত্রা হচ্ছে মিশরীয় রৌপ্যমুদ্রা, মূল্য প্রায় পাঁচ পেনি। পরিচ্ছেদ ১২, টীকা ১৮ দ্রষ্টব্য।
৯। ইব্নে বতুতার শ্রোতাগণ অবশ্য ওয়াকিবহাল আছেন যে আরবী ব্যাকরণের নিয়ম কানুন শৃংখলাবদ্ধ করা হয় হজরত মোহাম্মদের ওফাতের দুই শতাব্দী পরে বরাতে। নিচে যে। ‘অগ্রবর্তীর উল্লেখ করা হয়েছে তিনি সিবাওয়ে প্রথম বৃহৎ নিয়মবদ্ধ আরবী ব্যাকরণের রচয়িতা।
১০। উবুল্লা বর্তমান বসরা টাউনের ভূমিখণ্ডে অবস্থিত-শাতিল আরবের পশ্চিমে একটি খালের উপরে অবস্থিত ছিল মধ্য যুগের বরা–এবং আধুনিক শহর জুবেয়ারের এক অথবা দু মাইল পূর্বে।
১১। এখন বন্দর মাসুর, খরমুসার তীরে। খরমুসা হচ্ছে ব-দ্বীপের পূর্বে একটি খাড়ি।
১২। ক্ষুদ্র হাজারাসৃপিদ রাজত্ব লিউরিস্তান পর্বতমালার উপর বারো শতাব্দীতে এবং সমস্ত মংগল যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দুজেইল নদীর তীরে এদের রাজধানী আইধাজ এখন মালামির নামে পরিচিত। আতাবেস (রাজ-প্রতিনিধি) উপাধি ছিল সে সমস্ত ক্ষুদ্র রাজত্বের যারা বারো শতাব্দীতে সালজুক সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল।
১৩। রোন্নাবাদের সৌন্দর্যকে অমরতা দান করেছিলেন শিরাজের প্রসিদ্ধ কবি হাফিজ। তিনি ছিলেন আমাদের পর্যটকের তরুণ সমসাময়িক।
১৪। উলজেতু নামে সুপরিচিত (১৩০৫-১৩১৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন) পারস্যের মোগল ইলখান বংশ ধারার অষ্টম ব্যক্তি (তাঁর সমসাময়িক চীনের মোগল ম্রাট কুবলাই খানের (১২৯৪-১৩০৭) পৌত্র উজায়েতুর সঙ্গে তাকে জড়িয়ে নেওয়া ঠিক হবে না)। শৈশব কালে উজায়েতু ক্রিফান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
১৫। কারাবাগ অবস্থিত ছিল আরাস্ নদীর ওপারে তাবরিজের উত্তরে পার্বত্য জেলার মধ্যে (ক্লাভিজোর এই গ্রন্থমালার দ্বিতীয়ম্যাপ)। গ্রীষ্মকালে উচ্চভূমিতে গমন করার যাযাবর আভাস মংগল সুলতানগণ রক্ষা করে চলতেন।
১৬। ইব্নে বতুতা দেখা যাচ্ছে ১৩৪৭ খ্রীষ্টাব্দে তার প্রত্যাবর্তন কালে শিরাজ ভ্রমণের সঙ্গে প্রথম ভ্রমণকে জড়িত করে ফেলেছেন। নিচের উক্তি সমূহ অনুসারে ইনজু পরিবারের শেখ আবু ইসাক ১৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দের পরবর্তী কাল পর্যন্ত শিরাজ অধিকার করেন নি-যখন তার আত্মীয় এবং পূর্ববর্তী শারাফ উদ্দীন শাহ মাহমুদ ইনজু মংগলদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৩৪৭-তে তিনি তার ক্ষমতার উচ্চস্তরে ছিলেন এবং ১৩৫৬ কি ১৩৫৭ খ্রীষ্টাব্দে তার প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবার মুজাফাবিদগণ তাকে গ্রেফতার করেন এবং মেরে ফেলেন।
১৭। পারশ্যের সেসিষ্ণুনে সাসানিদ নরপতিগণের ইসলাম পূর্ব যুগের বিরাট প্রাসাদ-এর ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখা যায় বোগদাদের কয়েক মাইল নিম্নে।
১৮। প্রসিদ্ধ গোলাপকুঞ্জের (গুলিস্তান) এবং অন্যান্য কবিতা গ্রন্থের রচয়িতা–মৃত্যু ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দে।
১৯। জেডানকে বিকৃত করা হয়েছে একটি গ্রাম রূপে। আরাজান (এখন বিহুবিহান) এবং দায়রাকের (এখন ফালাহিয়া) মাঝখানে অবস্থিত। পরবর্তী স্থান থেকে এক দিনের পথ এবং আরাজান থেকে তিন দিনের কম (শওয়ার্জের ‘ইরাণ” গ্রন্থ ৪’ ৩৮৪)। হয়েজা হচ্ছে আধুনিক হইজা, মুহামারা থেকে ৭০ মাইল উত্তরে অবস্থিত।
কুফা (নজফ থেকে কয়েক মাইল উত্তরে) ছিল বসরার সঙ্গে অন্যতম দূর্গ বেষ্টিত নগর, ৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে আরবগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তাদের ইরাক বিজয়ের সময়। হযরত আলীর স্বল্পকালীন রাজত্ব কালে (টীকা ৪ দ্রষ্টব্য) এটা ছিল খলিফার বাসস্থান।
২০। এই উপাধির এবং পরবর্তী অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যার জন্য উপক্রমণিকা দ্রষ্টব্য।
২১। পরিচ্ছেদ ১, টীকা ২২ দেখুন।
২২। প্রকৃত পক্ষে এ সময়ে (১৯১৮ পর্যন্ত) বোগদাদ একটি প্রাদেশিক শহর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এর উচ্চ পদবী আহরিত হয়েছিল ৭৫৭-১২৫৮ পর্যন্ত খেলাফতের কেন্দ্র রূপে-অতঃপর এ নগর মংগলদের হাতে বিপুলভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
২৩। দামাস কাসের হাম্মামখানায় গোসলকারীগণ ছয় থেকে দশখানা তোয়ালে পর্যায়ক্রমে পেয়ে থাকে।
২৪। পারস্যের মগেল কি তাতার ইল খানগণের বংশের শেষ ব্যক্তি।
২৫। দিলশাদ ছিলেন জুবানের (চুবান) পুত্র দিমাশক বাজার মেয়ে–একে আবু সাইদ মেরে ফেলেছিলেন।
২৬। মাহাব্বা হচ্ছে চলন্ত শিবির-এতে থাকতো রাজকীয় পার্শ্বরী এবং সৈন্য। এরা সুলতানের সঙ্গে অভিযানে যেতো।
২৭। তারিজ-মার্কোপলো এবং অন্য সব পশ্চিমী লেখকদের তাওরিজ ছিল পাশ্যে মংগলদের রাজধানী। এ সময়ে এটা পশ্চিম এশিয়ার প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র রূপে বোগদাদের স্থান দখল করেছিল এবং এখানে আসতেন বহু সংখ্যক ইউরোপীয় সওদাগর।
২৮। ৮৩৬ এবং ৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের মাঝখানে সামারা ছিল খলিফাদের অধিস্থান এবং তাদের সময়ে শোভিত হয়েছিল বহু জমকালো এবং সাধারণের অট্টালিকা রাজী দিয়ে, সে সবের। চিহ্ন এখনো রয়েছে। মাতকের দূর্গ সম্ভবতঃ সেই এক নামের প্রাসাদের স্থান দখল করে আছে (আল্ মাশুক, অর্থ প্রিয়তম)-তৈরি করেছিলেন খলিফা মুতামিদ (৮৭০-৮৯২ খ্রীষ্টাব্দ রাজত্বকাল)।
২৯। ক্যারিয়া শব্দটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, “একটি সাধারণ স্থান যেখানে বাজার বসে “ কিম্বা একটি চৌকোণ অট্টালিকা যাতে কামরা রয়েছে, মালগুদাম রয়েছে, এবং পর্যটকদের জন্য হোটো ছোটো দোকান রয়েছে।” নামটি দেওয়া হয়েছে ল্যাটিন কিম্বা গ্রীক থেকে এবং মূলতঃ সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার আরবগণ একে ব্যবহার করতেন, এর উৎপত্তি অজানা। এর উপর যে সব মত প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে এটাই সব যে এর অর্থ হচ্ছে শাসক কর্তৃক অনুমোদিত বা প্রদত্ত বাজারের দালান (মূলতঃ এসব দেশে সিজার কর্তৃক অনুমোদিত)। একটা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এটাতে থাককে দেওয়া হয় কিন্তু এর সমতুল্য কোনো শব্দ বাইজেন্টাইন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বর্তমানে এটা শহরের প্রধান বাজারের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়। উত্তর আফ্রিকায় আমি শুনেছি এটা ব্যবহৃত হয় (টেলেমসেন) বিপণী। শ্ৰেণী শোভিত রাস্তার ব্যাপারে। বাজারের গেটের জন্য ব্যবস্থা এখনো আগের মতো সাধারণ। (ডজি, এস, ভি; লা ট্রে, পূর্ব খেলাফতের দেশ, পৃঃ ৮৯)।
৩০। সিজার স্পষ্টতঃ ভুল স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। সম্ভবতঃ মেরিডিন থেকে মণ্ডলের পথে এ স্থান ভ্রমণ করা হয়েছিল।
৩১। দারা হচ্ছে রোমান সাম্রাজ্যের দূর্গ” পারশ্য সীমান্তের বিপরীতে একটি কেল্লা রূপে তৈরী করেছিলেন জাষ্টিনিয়ান।
৩২। বাগদাদের সালাজুক শাসক মেরিডিন দূর্গ হস্তান্তর করেছিলেন দ্বিতীয় গাজীর নিকট ১১০৮ খ্রীষ্টাব্দে-ইনি ছিলেন ক্রুসেডারগণের বিরুদ্ধে অন্যতম দুঃসাহসী মুসলিম যোদ্ধা। (লেপুল)। এর বংশধরগণ মেরিডিনের অরতুকি বলে পরিচিত-তৈমুরঙের মৃত্যুর পর পর্যন্ত শহর এবং তার পরিপার্শ্বের অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। এর দ্বাদশ বংশধরগণ আল্ মালিক আস্-সলিহ্ ১৩১২ থেকে ১৩৬৩ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ৩৩। এ-অনুষ্ঠানটি হচ্ছে সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে আগে পিছে দৌড়ানো-এটা করা হয় হাজেরার স্মৃতি উপলক্ষে। হাজেরা তার পুত্র ইসমাইলের জন্য পানির তালাসে এই দুই পাহাড়ের মাঝখানে ছুটাছুটি করেছিলেন। এটা সাধারণতঃ পায়ে হেঁটে পালন করা হলেও অনেক সময় গাধা কিম্বা উটের পিঠে সোয়ার হয়ে করা হয়। নজদের বর্তমান শাসক। সুলতান আবদুল আজিজ আল্-সাউদ এটা সম্পন্ন করেন মোটর গাড়ীতে চড়ে।