ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি
অনেক নামকরা দার্শনিক, অনেক রকম যুক্তি-তর্ক দিয়ে ভাববাদকে অপ্ৰমাণ করতে চেয়েছেন। তবু ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি। বরং একে খণ্ডন করবার জন্য বুদ্ধির জৌলুশে দীপ্ত যে-সব দার্শনিক প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, শেষপৰ্যন্ত র্তারা ভাববাদের স্নিগ্ধচ্ছায়াতেই ক্লান্ত দার্শনিক চেতনা এলিয়ে দিলেন। যেন ভাববাদই একমাত্র আর অনিবাৰ্য দার্শনিক মতবাদ, যেন মানুষের বুদ্ধি এই চূড়ান্ত অসম্ভবের পায়ে যুগ যুগ ধরে মাথা কুটেছে, তবু মুক্তি পায়নি। তার দাসত্ব থেকে।
আসলে, একদিক থেকে বাস্তবিকই তাই। শুধু বুদ্ধি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না-যে-দর্শন বুদ্ধির দাবিকে, বিশুদ্ধ চেতনার দাবিকে চরম দাবি বলে দেখতে চায়, সে-দর্শন শেষ-পৰ্যন্ত ভাববাদেই পরিসমাপ্তি পেতে বাধ্য। তাই শুধু তর্ক-বলে ভাববাদকে অস্বীকার করতে গেলে শেষ-পর্যন্ত তর্কের খাতিরেই ভাববাদকে স্বীকার করতে হয়। একথা নৈয়ায়িকভাবে অনিবাৰ্য, এবং এর সামাজিক কারণটুকুও স্পষ্ট।
নৈয়ায়িকভাবে কেন যে অনিবাৰ্য, প্রথমে তা-ই আলোচনা করা যাক। সামাজিক ভিত্তির কথা প্ৰথমেই তোলা উচিত; তবুও পরে তোলাই ভালো। কেননা পণ্ডিতমহলের এতদিনকার একটানা প্রচারের ফলে দর্শনের সাধারণ ছাত্রের পক্ষে দার্শনিক বিচারে নিছক নৈয়ায়িক সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া আজ প্ৰায় অভ্যাসে পরিণত। তাই শুরুতেই সামাজিক উৎসের কথা প্ৰতিবন্ধ হয়ে দাড়াতে পারে। আমাদের প্রাচীনেরা বলতেন। “শাখা চন্দ্র-স্যায়”-চাদ যদি গাছের আড়ালে থাকে, তাহলে প্ৰথম চেষ্টাতেই সে চাদ কাউকে দেখানো হয়তো কঠিন; তাই গাছের সেই শাখার দিকেই প্ৰথমে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। দার্শনিক আলোচনাতেও তাঁরা এইভাবে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিয়েছেন। যে-কথা শুনতে শ্রোতার অভ্যাস আছে, সেই কথাতেই আলোচনার সূত্রপাত হওয়া উচিত, পরে যে-কথায় তিনি অনভ্যস্ত, সেই কথার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া ভালো। কেবল মনে রাখতে হবে, লোকায়তিক দৃষ্টিতে নিছক নৈয়ায়িক আলোচনা অর্থহীন ও অবাস্তর; মূর্ত সামাজিক পরিপ্রেক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, লৌকিক জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োগ থেকে বিচুত হলে, দার্শনিক আলোচনা-তা সে যতই যুক্তিকণ্টকিত ও আপাতপাণ্ডিত্যপূর্ণ হোক না কেন-কাকদন্ত পরীক্ষার মতো বৃথা হতে বাধ্য। কেননা দর্শন শুধু শৌখিন মানুষের অবসর বিনোদন নয়, শ্রেণীসংগ্রামের অস্ত্ৰও। এতদিন পর্যন্ত পরোক্ষভাবে তাই হয়ে এসেছে, আজকে প্ৰত্যক্ষভাবে হবার দিন এসেছে। কিন্তু শুরুতেই এসব কথা প্ৰতিবন্ধ সৃষ্টি করবে। আপাতত শাখাকে চন্দ্ৰ মনে করেই অগ্রসর হওয়া যাক, আলোচনা করা যাক, তর্ক-বলে কেন যে ভাববাদকে খণ্ডন করা সম্ভব নয়, তার নৈয়ায়িক অনিবাৰ্যতা নিয়ে।
তর্ক বলে, শুধু বুদ্ধি দিয়ে, ভাববাদকে খণ্ডন করা অসম্ভব; এ প্রচেষ্টা স্ববিরোধী, অতএব আত্মঘাতী। বুদ্ধি দিয়ে খণ্ডন করতে গেলে মেনে নিতে হবে বুদ্ধির দাবি-তর্কের দাবি, চেতনার দাবি-চরম দাবি; মানতে হবে, এ দাবি মেটাতে পারে না বলেই আলোচ্য মতবাদ সমর্থনের অযোগ্য। তর্কমূলক খণ্ডনের আর কী মানে হওয়া সম্ভব? কিন্তু ওটুকুকে স্বীকার করা মানেই ভাববাদকে স্বীকার করা। কেননা, ভাববাদের মূল কথাও ওই একই; চেতনার দাবিই চরম দাবি; চেতনাই প্ৰাথমিক ও পরম সত্য। এ-কথাকে। নানানভাবে প্ৰকাশ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতা বা চেতনা বা বুদ্ধি বা মন,- বা অমাজিত মানুষের কাছে খটকা লাগে, এই ভয়ে যার নাম দেওয়া হয়েছে ভগবান-যে-কোন শব্দ দিয়েই একে বর্ণনা করা যাক না কেন, তাকেই পরমসত্তা বলে মানতে হবে, তার দাবিই চরম দাবি, তার উপর নির্ভর করে। বলেই বাস্তব হলো বাস্তব, তার উপর যা নির্ভর করে না তার নাম অলীক। তাই মানা চলবে না চেতনা-নিরপেক্ষ কোনো জড়পদার্থকে, বলতে হবে বস্তুর ধারণা নেহাতই নামমাত্র সত্য (বার্কলির নামমাত্রবাদ)।
দর্শনের মূল প্রশ্ন হলো : বুদ্ধির কাছে যে দাবি প্রাথমিক ও মৌলিক, পরমসত্তা কি সেই দাবি মেটাতে বাধ্য? ভাববাদী বলবেন : নিশ্চয়ই; সেটুকুই তো আমাদের দর্শনের সচেতন ভিত্তি; এবং শুধু আমার দর্শনের কেন, যারা আমার কথা মানেনও না, তারাও এই ভিত্তিটুকুকে অচেতনভাবে স্বীকার করে নেন। তাই ভাববাদকে খণ্ডন করতে গিয়ে যদি কেউ ভাববাদের এই মূল কথাটুকুই মেনে নেন, যদি আশা করেন তর্কবলে ভাববাদকে খণ্ডন করা সম্ভব হবে, — অর্থাৎ, দেখানো যাবে, তর্কের দাধি মেটাতে পারে না বলেই ভাববাদ ভ্ৰান্ত-তাহলে ভাববাদীর পক্ষে এতটুকুও বিচলিত বোধ করবার কারণ নেই। ভাববাদী জানেন, যে-পূর্বপক্ষ বুদ্ধির দাবিকে চরম দাবি বলে মেনে নিয়েছে, সে-পূর্বপক্ষ সাপও নয়, সাপিনীও নয়, শুধু ফোঁস-ফোঁস; নেহাতই পোষা সাপ, যে-সাপ কখনো ছোবল দেবে না।
তর্কের উপর বিরূপ হয়েছেন অনেক দার্শনিক, বুদ্ধি সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ হয়েছেন অনেকে। তাঁরা কেউবা ধরেছেন নিবুদ্ধির পথ, কেউবা অতিবুদ্ধির। এঁদের কথা আলোচনা করলে দেখা যাবে, শ্রেণীর দাবি আর যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে বুদ্ধির যেটুকু আসল অবদান, সেটুকুকেই এরা কেমনভাবে অস্বীকার করেন, আর কেমনভাবে মেনে নেন, শুদ্ধবুদ্ধির যেটা আসল গ্লানি, তাকেই। আপাতত দেখা, যাক কোনো কোনো দার্শনিক কী রকম স্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবে অনুভব করেছেন, শুধু তর্কবলে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না। দৃষ্টান্ত হিসেবে ফরাসী দার্শনিক দিদারো এবং ইংরেজ দার্শনিক রাসেল-এর উল্লেখ করা যায় {
রাসেল বলছেন (মনে রাখতে হবে, রাসেল হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের একজন প্রধান, আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে একজন প্ৰধান বর্ণচোরা ভাববাদী) : “একদিক থেকে মানতেই হয় যে, আমরা নিছক নিজেদের সত্তা এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর সত্তা প্ৰমাণ করতে পারি না। পৃথিবীতে শুধু আমরা এবং আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও ইন্দ্ৰিয়বেদনা ছাড়া আর যে কিছুই সত্য নয়, বাকি সবই যে আমাদের কল্পনামাত্ৰ, এই অর্থপত্তি থেকে কোনো নৈয়ায়িক অসম্ভাবনা হয়তো ঘনায় না। –সমস্ত জীবনটাই যে একটা স্বপ্ন, সে স্বপ্নে আমাদের সামনে যা কিছু ঘটছে তা আমাদেরই সৃষ্টি, এ কথা ভাবার মধ্যে কোনো নৈয়ায়িক অসম্ভাবনা নেই। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের দিক থেকে যদিও এ কথা অসম্ভব নয়, তবুও একে সত্যি বলে মানবার কোনো রকম কারণ নেই।”
যদিও নৈয়ায়িকভাবে অসম্ভব নয়, তবুও একে মানবার কোনো তাগিদ। নেই-কথাটা একদিক থেকে ঠিক। অধিবিদ্যার বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা না গেলেও ভাববাদকে মানবার কোনো তাগিদ বাস্তবিকই নেই, কেননা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভাববাদের অন্তঃসারশূন্যতা একেবারে প্রকট হয়ে পড়ে। কিন্তু রাসেল তো আর সে-দিকে এগোননি। বরং তিনি আগে থাকতে উলটো সুর গেয়ে উলটোভাবে গোড়া বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, আগে থাকতে তিনি বলে রেখেছেন-দার্শনিক হবার বাসনা থাকলে আজগুবিকে ভয় করলে চলবে না (দার্শনিক হবার বাসনা, না ভাববাদী হবার বাসনা?)। তাই আমাদের দেশের ন্যায়-সূত্রকার রাসেল-এর মুখে এমনতর কথা শুনলে নিশ্চয়ই উৎসাহিত হয়ে উঠতেন। কেননা, তিনি যে অনুপপত্তির নাম দিয়েছেন ‘বিরুদ্ধ, তার দৃষ্টান্ত অপেক্ষাকৃত বিরল, এবং রাসেল-এর এই উক্তি সেই অনুপপত্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সিদ্ধান্তমত্যুপেত্য তৎবিরোধী বিরুদ্ধ : রাসেল-এর অজস্র অস্থিরমতিত্ব সত্ত্বেও সমস্ত দর্শন ধরে তিনি শুদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের দাবিকে, প্রয়োগ-জীবনের সঙ্গে লেশ সম্পর্কহীন বিশ্লেষণের দাবিকে চরম দাবি বলে ঘোষণা করেছেন; আর তা সত্ত্বেও কিনা হঠাৎ বলে বসেছেন, ভাববাদ খণ্ডন এ দাবিকে মেটাতে না পারলেও অস্বীকাৰ্য নয়!
তর্কবলে ভাববাদকে যে অপ্ৰমাণ করা যায় না, এ কথায় রাসেল-এর অবশ্য তেমন কোনো বিক্ষোভ নেই, হাজার হোক রাসেল হলেন ম্যাক-আভেনেরিয়সের দার্শনিক বংশধর, প্ৰচ্ছন্ন ভাববাদীই। কিন্তু ফরাসী দার্শনিক দিদারো-র পক্ষে অত সহজে এই কথা স্বীকার করা কঠিন। তিনি মনেপ্ৰাণে বস্তুবাদী, ভাববাদের কবল থেকে তাঁর মুক্তি-প্ৰয়াসের মধ্যে ফাকি নেই। তাই, তর্কবলে ভাববাদের অসম্ভাবনাকে অপ্ৰমাণ করা যাচ্ছে না দেখে তার যে আক্ষেপ ও অসহিষ্ণুতা, সেটা লক্ষ করবার মতো :
“যে-সব দার্শনিকেরা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব এবং নিজেদের মনের মধ্যে ইন্দ্ৰিয়-পরম্পরার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বাকি সমস্ত কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তঁদেরই নাম ভাববাদী! এ হলো এক রকমের দার্শনিক নবাবিয়ানা, আমার তো মনে হয় শুধুমাত্র অন্ধ মানুষ এরকম দর্শনের জন্ম দিতে পারে; তবুও মানুষের বুদ্ধির আর দর্শনের গলায় দড়ি, এ মতবাদ সবচেয়ে আজগুবি হলেও একে খণ্ডন করা সবচেয়ে দুরূহ।”
দিদারো-র এই উক্তি উদ্ধৃত করে লেনিন বলছেন, দিদারোই সাম্প্রতিক বস্তুবাদের খুব বেশি কাছ ঘোষতে পারেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, শুধু তর্ক বা শুধু যুক্তি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না, কেননা এখানে আসল কথা তর্কাতর্কির কথাই নয়।
নিছক তর্কবলে ভাববাদকে যে খণ্ডন করা যায় না, এ কথা প্ৰমাণ করবার জন্যে শুধু দুচারজন দার্শনিকের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করবার দরকার নেই। সাম্প্রতিক দর্শনে বুদ্ধিমূলক ভাববাদ খণ্ডনের চরম দৃষ্টান্তকে বিশ্লেষণ করা যাক; দেখা যাবে, বিপক্ষের অনেক বাকময় শরের শয্যায় শুয়েও ভাববাদ কী-রকম অক্ষত দেহে কী অক্ষুন্ন আয়াস উপভোগ করতে পারে। স্থানাভাবের দরুন এখানে মাত্র একটি দৃষ্টান্ত তুলব।–সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের ভাববাদ খণ্ডন। সাম্প্রতিক দর্শনে সেইটিই প্ৰধান দৃষ্টান্ত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের প্ৰাচীনেরা বলেছেন, ‘প্রধান-মল্প-নিবৰ্হিণ ন্যায়’। মল্পক্ষেত্রে বিপক্ষ হিসেবে প্ৰধান মল্লকে যদি পরাভূত করা যায়, তাহলে ছোটখাট মল্পের সঙ্গে আর আলাদাভাবে লড়বার দরকার পড়ে না। দার্শনিক দ্বন্দ্বের বেলাতেও সেই রকম।
সাম্প্রতিক দর্শনে বস্তুম্বাতন্ত্র্যবাদীর ভাববাদ খণ্ডন নিয়েই শোরগোল সবচেয়ে বেশি। এবং বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে প্ৰধান হলেন শ্ৰীযুক্ত মূর–ভাববাদের বিরুদ্ধে তিনি যে সুর শুরু করেছেন, বাকি সব বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী মোটামুটি তারই ধুয়ো ধরেন,–যদিও নানান ভাবে, নানান ভঙ্গিমায়। তাই মুর-এর যুক্তিটাই প্ৰথমে ধরা যাক। মূর বলেন, ভাববাদ–তা সে যে-জাতেরই হোক না কেন, –প্রেরণা পেয়েছে বার্কলির সেই সরল উক্তি থেকে–সত্তার সার-পরিচয় তার অভিজ্ঞতায়। কিংবা, যা একই কথা, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ কোনো বস্তুর সত্তা অভাবনীয়।
মূর বলেন, অতি সরল এক অনুপপত্তির উপর এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা। যে-কোনো অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করলে দুটি স্বতন্ত্র উপাদান পাওয়া যাবে। – এক হলো চেতনা, যার সঙ্গে সমস্ত ইন্দ্ৰিয়বেদনার সম্পর্ক; আর এক হলো চেতনার বিষয়, যার দরুন। এক অভিজ্ঞতা অন্য অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন। ‘লালরঙ” সম্বন্ধে জ্ঞান এবং “নীল-রঙ” সম্বন্ধে জ্ঞান,-এ দুয়ের মধ্যে প্ৰভেদ স্পষ্ট, এবং এ প্ৰভেদের কারণ বিষয়ের বিভিন্নতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আবার জ্ঞান হিসেবে দুটির মধ্যে সাদৃশ্য, সে সাদৃশ্যের কারণ উভয়ের মধ্যে চেতনার বিদ্যমানতা। তাই, চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা, এ দুয়ের মধ্যে তফাত করতেই হবে; অথচ সেই প্ৰভেদকে অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের আসল ভিত্তি। চেতনার বিষয় ও বিষয়ের চেতনা-এ দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক, তারই নাম “জ্ঞান” বা “সচেতন হওয়া”। এ সম্পর্ক আদি ও অপূর্ব, এর জুড়ি আর কোথাও মিলবে না। তাই, নীল রঙ সম্বন্ধে যখন জ্ঞান হচ্ছে, তখন এ কথা বলা চলবে না যে, আমাদের চেতনায় নীল-রঙ-এর প্রতিবিম্ব পড়ছে, কেননা এখানে আসলে জ্ঞান হচ্ছে নীল-রঙ-এর জ্ঞান সম্বন্ধেই।
মূর এর ছোট প্ৰবন্ধ “ভাববাদ খণ্ডন”, তাতে যুক্তির জৌলুশকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু কথা হলো, সে-যুক্তির গভীরতা কতটুকু? সে-যুক্তি কি সত্যিই ভাববাদের যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারে? ভাববাদীর যুক্তি অত্যন্ত সরল ও অত্যন্ত স্পষ্ট; চেতনার বা জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে পড়ছে না। এমনতর। কোনো বস্তু বা বিষয়কে আমরা কি জেনেছি? এ প্রশ্নের রকম থেকেই উত্তরটুকু সহজ হয়ে পড়ে – জানা মানেই চেতনার বা জ্ঞানের গণ্ডীভূত হওয়া; তাই যা চেতনার গণ্ডীভূত নয়, তাকে জানিবার কথাই ওঠে না। ভাববাদী বলবেন, যা কিছু আমরা জানি, তা সমস্তই চেতনার উপর নির্ভরশীল, কেননা তা অনিবাৰ্যভাবেই চেতনার গণ্ডীভূত, চেতনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য-সম্বন্ধযুক্ত। চেতনার উপর নির্ভরশীল হওয়া মানেই মানসিক”। অর্থাৎ, আমরা যা কিছু জানি, তা সমস্তই মানসিক। এবং দর্শনে এমন কোনো কিছুকে নিশ্চয়ই বাস্তব বলে মানা চলবে না, যার সম্বন্ধে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। এ কথাও তো অত্যন্ত সহজ কথা; যাকে জানা যায়নি, তাকে সত্যি বলে স্বীকার করবার অধিকার দার্শনিকেরও থাকতে পারে না। তাই, দার্শনিক বিচারে শুধু চেতনানির্ভর বস্তুকে, শুধু মানসিক সত্তাকে একমাত্র সত্য বলে মানতে হবে। অর্থাৎ পরমসত্তা মানসিক, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ নয়।
ভাববাদীর মূল যুক্তিকে উপরোক্তভাবে বর্ণনা করায় হয়তো অতি-সারল্যের অপবাদ জুটবে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে, আসল যুক্তিটা এ ছাড়া কিছুই নয়। উদাহরণ হিসেবে বার্কলি এবং বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধর কথা ধরা যায়; এঁদের যুক্তিই ভাববাদের প্রাঞ্জলতম নিদর্শন।
বার্কলি বলছেন : “মানব-জ্ঞানের বিষয়াবলীকে যিনিই প্ৰেক্ষণ করেছেন, তাঁর কাছেই এ কথা স্পষ্ট যে, সেগুলি হয় ইন্দ্ৰিয়ের উপর বাস্তব ধারণার ছাপ, না-হয় নিজেদের মনের বাসনা ও ক্রিয়া সম্বন্ধে অনুভূতি, আর না-হয় স্মৃতি ও কল্পনাশক্তির দ্বারা গড়া ধারণামাত্র–“সকলেই মানবেন, আমাদের মনের চিন্তা, বাসনা বা কাল্পনিক ধারণার কোনোটাই মানস-নিরপেক্ষ হতে পারে। না। এবং সে-কথার চেয়ে আমার কাছে এ-কথা একটুও অস্পষ্ট নয় যে, আমাদের বিভিন্ন অনুভূতি ও ইন্দ্ৰিয়ের উপর ছাপা ধারণাগুলিকে যেমনভাবেই একসঙ্গে মিশেল করা হোক না কেন (অর্থাৎ, সেগুলি দিয়ে যে-কোন রকম বিষয়ই গড়া যাক না কেন), এগুলি অভিজ্ঞতাকারী-মন-নিরপেক্ষ হতেই পারে না।” বার্কলির যুক্তি আধুনিক পাঠকের কাছে অতি প্ৰসিদ্ধ, তাই এর দীর্ঘতর উদ্ধৃতি অবাস্তর হবে।
বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলছেন, জ্ঞান ও বিষয়ের মধ্যে সহোপলম্ভ নিয়ম বর্তমান, অর্থাৎ একটিকে ছাড়া অপরটিকে পাবার কোনো উপায় নেই। জ্ঞান ব্যতীত একেবল বিষয়, বা বিষয় ব্যতীত কেবল জ্ঞান কেউ কখনও অনুভব করতে পারে না। এই সহোপলম্ভ নিয়ম থেকেই জ্ঞান ও বিষয়ের মধ্যে অভেদ সিদ্ধ হতে বাধ্য, এবং এই অভেদকে মানা মানেই বাহাবস্তুকে অস্বীকার করা-জান এবং জ্ঞানের বিষয় যদি একই হয়, তাহলে বাহুবিস্তুর স্থান আর কোথায়? এই অভেদভাবের প্রতিবন্ধক বা বিরুদ্ধ প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না, এমন দৃষ্টান্ত অসম্ভব যেখানে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে জ্ঞান-নিরপেক্ষ বাহবিস্তু রর্তমান। বরং বাহবিস্তুকে যারা স্বীকার করেন, যারা বলেন বাহবিস্তু না থাকলে জ্ঞানের বিষয়ই থাকে না, অতএব জ্ঞানই সম্ভব হয় না, তাদের কথার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত মোটেই দুর্লভ নয়। অর্থাৎ, এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেখানে বাহবিস্তু সত্যিই নেই, অথচ তদাকার জ্ঞান হচ্ছে। যেমন স্বপ্নদর্শন, মায়াদর্শন, মরুমরীচিকায় জলদর্শন, আকাশে গন্ধৰ্বনগর দর্শন, এইরকম কতই তো দৃষ্টান্ত! এখানে জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়, জ্ঞানই পূর্বক্ষণে বাহাবস্তুর আকার ধারণ করে এবং দ্বিতীয়ক্ষণে বিষয়ের গ্রাহকাকার ধারণ করে। অতএব, জ্ঞানের পক্ষে বিষয় ও বিষয়জান উভয়ের আকার ধারণ করা। এমন কিছু অসম্ভব কথা নয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলছেন,-বাহপদার্থকে যদি মানা যায়, তাহলে বিভিন্ন জ্ঞান কেমন করে পরস্পরের থেকে ভিন্ন হতে পাৱে? কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব এমন কিছু কঠিন নয়; বাহবিস্তু বলে জ্ঞানের কোনো বিষয় না। থাকলেও, জ্ঞান বা ধারণাই জ্ঞানের বিষয় হলেও, বিভিন্ন ধারণার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই; সেই পার্থক্যর দরুনই বিভিন্ন জ্ঞান পরস্পর থেকে পৃথক। এবং বিভিন্ন ধারণার মধ্যে যে বৈচিত্ৰ্য, তার ব্যাখ্যা করবার জন্যে বাহবিস্তু ও বাহবিস্তুর বৈচিত্ৰ্যকে মানবার কোনো প্রয়োজন পড়ে না; বাসনা-বৈচিত্র্য দিয়েই তার যথেষ্ট ব্যাখ্যা হয়, এবং এই বাসনা জিনিসটা বাহ পদাৰ্থ নয়, মানসপদার্থই। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বাসনা-বৈচিত্ৰ্য দিয়ে জ্ঞান-বৈচিত্ৰ্যকে ব্যাখ্যা করবার যে প্ৰচেষ্টা করেছেন, তা আমাদের প্রাচীন কালে অনেকটা দার্শনিক সহজ বুদ্ধির মতোই ছিলো, এবং অন্তত স্বপ্নাদির বেলায় এ-কথা যে অসম্ভব নয়, তার সপক্ষে নিশ্চয়ই আধুনিক মনস্তত্ত্বের দোহাই দেওয়া যায়।
বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধের বাকি যুক্তিগুলির কথা। আপাতত অপ্রাসঙ্গিক হবে। তাছাড়া উপরোক্ত যুক্তিই তার প্রধান যুক্তি, এবং বার্কলি প্ৰমুখ সমস্ত ভাববাদীর যুক্তির সারমর্ম এই একই কথা। এই যুক্তিকে খণ্ডন করতে হলে মাত্র দুটো পথে এগোনো সম্ভব। হয়। প্ৰমাণ করতে হবে যে, জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যেই জ্ঞাননিরপেক্ষ বস্তুর সত্তাকে প্ৰমাণ করা যায়, আর না-হয় তো বলতে হবে, চেতনানিরপেক্ষ বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞানের স্বাক্ষর না থাকলেও অন্য স্বাক্ষর আছে এবং সে স্বাক্ষর অবিসংবাদিত। প্ৰথম পথে এগোনো অসম্ভব, কেননা-এ পথ আত্মবিরোধের পথ। দ্বিতীয় পথে এগোতে গেলে বিশুদ্ধ তর্কের দাবি বা বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে চরম বলে মানা যায় না, প্রয়োগের কথা তুলতে হয়। মূর প্রমুখ সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের পক্ষে সে-কথা তোলা কেন সম্ভবপর নয়, এ আলোচনা স্বতন্ত্র। মোটের উপর কথা হলো, তারা সে পথে এগোতে চাননি। চেতনার গণ্ডির মধ্যে থেকে, তর্কের দাবি দেখিয়ে, তঁরা ভাববাদকে খণ্ডন করতে চান।
মুর বলছেন, জ্ঞানের বিষয় এবং বিষয়ের জ্ঞান, এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের প্রকৃত ভিত, অথচ এই তফাতকে স্বীকার না করে উপায়ও নেই। চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা যদি বিভিন্ন না হতো, তাহলে বিভিন্ন জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য সম্ভবপর হতো না। ‘লাল-রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং “নীল রঙ” সম্বন্ধে জ্ঞান, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কীসের? নিছক চেতনা হিসেবে উভয় জ্ঞানই অভিন্ন, ফলে ভেদ নিশ্চয়ই জ্ঞানের বিষয়ে।
ভাববাদী বলবেন, এই যুক্তি ছাড়া মুর-এর ভাববাদ খণ্ডনের বাকি সবটুকুই নিছক ঘোষণামাত্র, প্ৰমাণ নয়। এবং এই যুক্তি দিয়ে, শুধু এই যুক্তি দিয়ে, ভাববাদকে নিশ্চয়ই খণ্ডন করা যায় না। প্রথমত, চেতনার বিষয়কে বিষয়ের চেতনা থেকে স্বতন্ত্র করা হচ্ছে নেহাত অৰ্থপত্তি হিসাবে, এবং অর্থপত্তির মূল্য বড় জোর সম্ভাবনামূলক। অর্থাৎ, এই যুক্তি বড় জোর বস্তুর বা বিষয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের সম্ভাবনা প্ৰমাণ করছে, অস্তিত্ব নয়। তাছাড়া, আসল প্রশ্ন হলো, সম্ভাবনা হিসেবে যে-বিষয়কে প্ৰমাণ করা গেল, তার প্রকৃত স্বরূপ কী রকম? ভাববাদী নিশ্চয়ই এমন কথা বলবেন না যে, জ্ঞানের বিষয় বলে সত্যিই কিছু নেই; মূর যেন ভাববাদীর ঘাড়ে এই কথা অধ্যস্থ করে। তারপর এই কথাকে খণ্ডন করেছেন। ভাববাদী বলবেন, চেতনার বিষয় নিশ্চয়ই আছে, এবং সেই বিষয়ের দািকনই এক চেতনা অপর চেতনা থেকে ভিন্ন; কিন্তু এই বিষয় জড়বস্তু নয়, অন্তর্বস্তু মাত্র। এ বিষয় যে অন্তর্বস্তু, বহির্বস্তু নয়, তার প্রমাণ হিসেবে ভাববাদী বলবেন, নিছক বহির্বস্তুরূপে, চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিরহিত অবস্থায়, তাকে কখনও জানা যায়নি। অথচ নিছক অন্তর্বস্তুর বিভিন্নতার দরুন জ্ঞানের বিভিন্নতা যে সম্ভবপর, তার উদাহরণ হিসেবে প্ৰাচীন দার্শনিকদের গন্ধৰ্বনগর দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদের ব্যাধিত অপচ্ছায়ার উল্লেখ করা যায়। তাই মূর-এর যুক্তি ভাববাদকে সত্যিই খণ্ডন করতে পারে না।
নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের ভাববাদ খণ্ডনের বেলাতেও একই কথা। তঁদের যুক্তির জৌলুশ অনেক কম, কিন্তু মেজাজ অনেক বেশি চড়া। ভাববাদের মূলে অন্তত সাত-সাতটা অনুপপত্তি তারা আবিষ্কার করেছেন। তার মধ্যে তিনটি –অতিসারল্য, দার্শনিক দুরাশা এবং বেহিসেৰী ভাষা ব্যবহারের অপবাদকোন কোন বিশেষ ভাববাদীর বিরুদ্ধে নিয়োগযোগ্য হলেও ভাববাদ মাত্রের বিরুদ্ধেই এইগুলি যে প্ৰযোজ্য হবে, তার কোনো মানে নেই। জড়বাদী, অজ্ঞানবাদী, এমন-কী বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী কোনো দার্শনিকের ব্যক্তিগত দুর্বলতা যদি থাকে, তাহলে এইসব অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই প্ৰযোজ্য। অর্থাৎ এগুলি কোনো বিশেষ দার্শনিক মতবাদের অনুপপত্তি নয়, কোনো কোনো দার্শনিক বিশেষের ব্যক্তিগত দুর্বলতামাত্র। তাই এগুলিকে বাদ দিতে হবে। নিছক দার্শনিক মতবাদ হিসেবে ভাববাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চারটি; এবং মজার কথা এই যে, সে চারটি অভিযোগের নামরূপে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, সবগুলির মূলেই বক্তব্য এক।
(১) এ পর্যন্ত মানুষ যা জেনেছে, তা সমস্তই জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল বলে সমস্ত বস্তুই যে জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই; (২) জ্ঞানের সময় চেতনার সঙ্গে বিষয়ের সম্পর্ক আছে বলে সে সম্পর্ক যে ত্ৰৈকালিক হতে বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই,-যে লোক আজ রিপাবলিকান রাজনীতি করছে, আগামীকাল সে যে ডিমোক্রাটুদের ডেরায় ভিড়বে না, এমন কথা কি কেউ জোর করে বলতে পারে? (৩) বিষয়ের প্ৰাথমিক পরিচয়ে চেতনা-নির্ভরতা থাকলে এই পরিচয় যে তার চিরন্তন পরিচয় হবে, এমন কোনো কথা নেই,–“আগল” “পাগল” “ছাগল” শব্দে “গ” অক্ষর দ্বিতীয় অক্ষর বলে “গ” যে সর্বদাই শব্দের দ্বিতীয় অক্ষর হবে একথা দাবি করা যায় কি? (৪) বিষয়ের পক্ষে জ্ঞাত হওয়া গৌণ লক্ষণ মাত্র, তাকে মুখ্য লক্ষণ মনে করলে চলবে না, – প্রেমিকের সত্তা প্রেমের উপর নির্ভর করে নিশ্চয়ই।
রাজনীতি থেকে শুরু করে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার পর্যন্ত রকমারি দৃষ্টান্ত! একের পর এক অকাট্য যুক্তি। একের পিঠে শূন্য বসালেও দশ হয়, দশের পিঠে শূন্য বসালেও একশো হয়—একটি যুক্তির উপর আর একটি যুক্তি চাপিয়ে খণ্ডন করলে খণ্ডনের গুরুত্ব এইরকম হুড়হুড় করে বেড়ে যেতে পারে, অনুবতী যুক্তি যতই দুর্বল হোক না কেন। কিন্তু শূন্যের পিঠে যাই বসানো যাক, ফল শুধুই শূন্যই, গুরুত্ব এতটুকুও বাড়ে না। নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর প্রথম বা একটি যুক্তির মূল্যও যদি শূন্যর চেয়ে বেশি হতো, তাহলে সত্যিইভাবনা থাকত না, ভাববাদকে যুক্তি দিয়ে ভেঙেচুরে মিসমার করে দেওয়া যেত। কিন্তু ভাববাদের খণ্ডন হিসেবে কোনো একটি যুক্তিও শূন্যর চেয়ে বেশি সারবান নয়। তাই সাত-সাতটা যুক্তির পরেও ফল দাঁড়িয়েছে শুধু শূন্য দিয়ে শূন্যকে গুণ করার মতো।
ভাববাদী বলবেন, শুধুমাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্তে জ্ঞানের উপর বিষয়কে নির্ভরশীল হতে দেখে আমি যদি বলতুম, জ্ঞানের উপর বিষয় একান্তভাবে নির্ভর করে, তাহলে আমার কথাকে খণ্ডন করবার জন্যে নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর পক্ষে অত বড় অনুপপত্তির ফর্দ দরকার পড়ত না। কিন্তু আসল কথা মোটেই তা নয়। আসল কথা হলো-এমন কোনো বিষয়ের সন্ধানও মানুষ এখন পায়নি, যার সত্তা চেতনানিরপেক্ষ। অতীতের সমস্ত মানুষ এবং বর্তমানের সমস্ত মানুষ দাড়কাককে কালো বলে চিনেছে বলেই দাঁড়কাকমাত্ৰকেই কি কালো বলে মানার তাগিদ নেই? অবশ্য, শুধু এ জাতীয় যুক্তি-স্বদেশী ন্যায়শাস্ত্রে যাকে বলে অন্বয় – সুনিশ্চিত নিগমন স্থাপন করতে পারে না, শুধু অবাধিত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে যে নিগমন পাওয়া যায়, তা সম্ভাবনামূলক মাত্র। কেননা, এখানে বিপরীত অভিজ্ঞতার কথা অন্তত কল্পনা তো করা যায়-বিপরীত অভিজ্ঞতা এতদিন পর্যন্ত অবাস্তব হলেও অসম্ভব। মোটেই নয়। কিন্তু ভাববাদী বলবেন, আমার দর্শনের ভিত্তি এত কঁাচা নয়, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়কে এতদিন যে অভিজ্ঞতার মধ্যে পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, তাকে পাবার কথা ভাবাই যায় না, এমন-কী কল্পনাতেও নয়। কেননা, নিছক বিষয় বা বিষয়মাত্রকে পাবার কথা কল্পনা করতে গেলে অন্তত কল্পনার সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বীকার করতে হবে; এবং কল্পনা যে-হেতু মানসক্রিয়ার প্রকারমাত্র, সেইহেতু উক্ত বিষয়কে মানসক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত, অতএব মানসক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, মনে না করে উপায় নেই। তাই মানস-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথা সোনার পাথরবাটির মতো। সোনার পাহাড় সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না হলেও তার অস্তিত্ব কল্পনায় স্ববিরোধ নেই, কিন্তু সোনার পাথরবার্টির শুধু অভিজ্ঞতা অসম্ভব নয়, তার অস্তিত্ব-কল্পনায় স্ববিরোধ। অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথাও ওইরকমই স্ববিরোধী–কেননা, বিষয় মানেই অভিজ্ঞতার বিষয়, তা সে বাস্তব অভিজ্ঞতাই হোক, আর কাল্পনিক বা সম্ভব অভিজ্ঞতাই হোক।
মূর একদা বলেছিলেন, ভাববাদীর মতে যে-হেতু অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বস্তুর সত্তা থাকতে পারে না, সেইহেতু মানতে হবে, ট্রেন একবার প্লাটফর্ম ছাড়বার পরই তার চাকা উবে যায়, কেননা চলন্ত ট্রেনে বসে ট্রেনের চাকা তো চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এই বিদ্রুপের ভাববাদী জবাব অতি সরল; চলন্ত ট্রেনের চাকাকে অযথার্থ মনে করা ভুল হবে, কেননা তা অভিজ্ঞতারই বিষয়; কেবল এই অভিজ্ঞতা বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়, “সম্ভব”। অভিজ্ঞতা মাত্র। “যে টেবিলের উপর আমি এখন লিখছি”, বার্কলি বলেছিলেন, “সে টেবিলের অস্তিত্ব আছে; অর্থাৎ আমি একে দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি; এবং আমি যদি পড়ার ঘরের বাইরে যৌতুম, তাহলেও আমি বলতুম, এর অস্তিত্ব আছে; অর্থাৎ পড়ার ঘরে থাকলে আমি তাকে অনুভব করতে পারতুম; কিংবা অন্য কোন আত্মা বাস্তবিকই তাকে অনুভব করছে।”
সাম্প্রতিক বস্তম্বাতন্ত্র্যবাদীর ভাববাদ খণ্ডন যে কীরকম পঙ্গু ও অথর্ব, আর একটি দৃষ্টান্ত দেখিয়ে এ আলোচনা শেষ করব। আলেকজাণ্ডার হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের আর একজন দিকপাল দার্শনিক। বিশ্বের সমস্ত সত্তাকে তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন, মন আর বহির্বস্তু। এক ভাগের একটির সঙ্গে অপর ভাগের আর একটির সংযোগ ঘটলে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। ভেবে দেখতে হবে, এই সংযোগঠিক কোন জাতের। আলেকজাণ্ডার বলেন, এই সংযোগ-বিচারে ভাববাদীর দল মনকে অযথা প্ৰাধান্য দিয়ে বসে, মনে করে, এই সংযোগের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় নির্ভর করে জ্ঞানের উপর। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়, এ সংযোগ অতি সাধারণ একত্র-সমাবেশ মাত্র, যে রকম একত্ৰসমাবেশ ডিশের সঙ্গে টেবিলের ৭ ডিশের উপর টেবিলের সত্তা নির্ভর করে। না, টেবিলের উপর ডিশের সত্তাও নয়। মনের উপর বিষয়ের সত্তা নির্ভর করবে। কেন? কিন্তু শুধু এই কথা বলে থেমে যাওয়া যায় না, জ্ঞান নামক একত্র-সমাবেশের অন্তত একটা কোনো বৈশিষ্ট্য তো মানতেই হয়, কেননা যে-কোনো একত্ৰ-সমাবেশের বেলায় তো জ্ঞান হয় না! আলোকজাণ্ডার বলছেন, এ বৈশিষ্ট্য সমাবেশের বৈশিষ্ট্য নয়, সমাধিত এক উপাদানের বৈশিষ্টা মাত্র। অর্থাৎ অন্যান্য সমাবেশের বেলায় উভয় উপাদানই বহির্বস্তু, জ্ঞানের বেলায় একটি উপাদান হলো মন বা জ্ঞাতা। এই কথা শুনে ভাববাদী নিশ্চয়ই বিক্রম করে বলতে পারেন–অর্থাৎ আলেকজাণ্ডারের মতে “জ্ঞান” হলো এমন এক একত্ৰ-সমাবেশ, যার একটি উপাদানের মধ্যে “জ্ঞান” বর্তমান; এবং ন্যায়শাস্ত্রের অতি সাধারণ ছাত্রও জানে, এই জাতীয় সংজ্ঞা petitio principii নামের এক সরল অনুপপত্তি।