০২. ভাদ্রমাসের ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরগুলো

ভাদ্রমাসের ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরগুলো এম্নিতেই ছমছমে লাগে। আজ যেন আরো বেশি লাগছে। তরু বসার ঘর থেকে ভেতরের বারান্দায় এল, সেখান থেকে শোবার ঘরে ঢুকল। তরুর মা মেঝেতে একটা বালিশ পেতে ঘুমুচ্ছেন। তার মাথার উপর সা-সা করে ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসে তাঁর মাথার চুল উড়ছে। এই দৃশ্যটা তরু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েদাঁড়িয়ে দেখল। সেখান থেকে গেল পাশের ঘরে। এই ঘরটা তরু এবং মীর। মীরু, তরুর ছোটবোন-এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। সে এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি বলেই ঘর চমৎকার গোছানো। সে ফিরে এলে মুহূর্তের মধ্যে ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তার জন্যে মীরুকে কিছু বলা যাবে না। শেষ বয়সের মেয়ে বলে মীর মা, শাহানা, মেয়েকে কখনো কিছু বলেন না। কেউ একটা কড়া কথা বললে তিনি ব্যথিত গলায় বলেন, এইসব কী। ও ছোট না?

আদরে-আদরে মীরুর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে বলে তরুর ধারণা। মীরু অসম্ভব জেদী এবং রাগী হয়েছে। একবার রাগ করে দুদিন ভাত না খেয়ে ছিল। তারচেয়েও সমস্যার কথা ইদানীং তার বোধহয় কোনো একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হয়েছে। সেই ছেলের লেখা একটা কাঁচা প্রেমপত্র তরু উদ্ধার করেছিল। মাকে তা দেখাতেই তিনি বললেন, ওর দোষ কী বল? জোর করে দিয়ে দেয়। ছেলেগুলো হচ্ছে বদের হাড্ডি। তরু অবাক হয়ে বলল, তুমি মীরুকে কিছু বলবে না?

বলব ধীরেসুস্থে বলব। এত তাড়াহুড়ার কী? কিছু বলব তারপর দেখবি রাগ করে। ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেবে। আরেক যন্ত্রণা।

শাহানা কিছুই বলেন নি। মীরুর কোনো অপরাধ তাঁর চোখে পড়ে না। কোনোদিন হয়ত পড়বেও না। এবং একদিন দেখা যাবে মীরু একটা কাণ্ড করে বসেছে।

 

তরু নিজের ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিল। এই ঘরটা আপাতত ফাঁকা। দেশের বাড়ি থেকে কেউ এলে থাকে। এখন মতির মা শুয়ে আছে। এই ঘরেও ফ্যান আছে। ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পিডে তবু মতির মার হাতে একটা পাখা। ঘুমের মধ্যেই সে তালের পাখা নাড়ছে। তরু ডাকল, এই মতির মা। মতির মা।

মতির মা সঙ্গে-সঙ্গে বলল, কি আফা?

একটু দেখে আস তো চায়ের দোকানটায় জহির ভাই বসে আছেন কি না।

আচ্ছা আফা।

বলেই মতির মা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। মতির মাকে হাজার ডাকাডাকি করেও লাভ হবে না। সে ঠিকই সাড়া দেবে তারপর আড্ডা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়বে।

তরু বসার ঘরে চলে এল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জহির ভাই কি চলে গেল নাকি? হঠাৎ তরুর চোখে পানি এসে গেল। ব্যাপারটা এত হঠাৎ হল যে সে লজ্জায় অস্থির হয়ে পড়ল। জহির ভাইকে সে খুব পছন্দ করে তা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই না যে তার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে পানি আসতে হবে। ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার। ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলে নি।

জহিরকে সে প্রথম দেখে পাঁচ বছর আগে। সে তখন ক্লাস এইটে পড়ে। কী কারণে যেন দুই পিরিয়ড পরেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। সে বাসায় এসে গল্পের বই নিয়ে বসেছে, তার কিছুক্ষণ পরেই জহির এসে উপস্থিত। হাতে একটা চামড়ার সুটকেস, সঙ্গে সতরঞ্জির একটা বিছানা। তার গায়ে হলুদ রঙের শার্ট। গলায় কটকটে লাল রঙের মাফলার। তরু বলল, কাকে চান?

লোকটি একটু টেনে-টেনে বলল, এটা বরকত সাহেবের বাসা?

জ্বি।

উনাকে একটু ডেকে দেবেন? আমি শ্যামগঞ্জ থেকে আসছি।

আব্বা তো অফিসে।

অফিসে? কখন আসবেন?

পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার সময়।

আচ্ছা তাহলে যাই। স্লামালিকুম।

লোকটা তার মত একটা বাচ্চা মেয়েকে ম্লাস্লামালিকুম দিচ্ছে, কী আশ্চর্য। তরুর খুব মজা লাগল। সে বলল, আম্মা আছে, আম্মাকে ডেকে দেব?

না। উনি আমাকে চিনবেন না। আমি আসব সাড়ে পাঁচটার সময়। সুটকেসটা রেখে যাই?

 

ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় আবার এসে উপস্থিত। তরু বলল, বাবা এখনো আসেন নি।

মাঝে-মাঝে উনি তাস খেলতে যান তখন ফিরতে দেরি হয়।

কত দেরি হয়?

তার কোনো ঠিক নেই। কোনো কোনোদিন রাত আটটা নটাও বাজে।

আচ্ছা আমি তাহলে নয়টার সময় আসব।

বসুন না। এখানে বসে অপেক্ষা করুন। মাকে ডাকি?

উনি আমাকে চিনবেন না।

তরু হাসিমুখে বলল, আপনি আমাদের আত্মীয় হন?

হুঁ। সম্পর্কে তোমার ভাই হই।

তাই নাকি?

মামা, অর্থাৎ তোমার আব্ব চিনবেন। আমাদের আদিবাড়ি শ্যামগঞ্জের রসুলপুর। মিয়াবাড়ি। এক সময় খুব নামকরা বাড়ি ছিল। এখন অবশ্য গরীব অবস্থা।

গরীব অবস্থা যে তা অবশ্যি তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শীতের কাপড় বলতে গলার লাল রঙের মাফলার। জানুয়ারি মাসের প্রচণ্ড শীত মানুষটা একটা মাফলার দিয়ে সামাল দিচ্ছে কীভাবে কে জানে। তরুর খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে, আপনার শীত লাগছে না? লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। তরু বলল, বসুন না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?

জহির বসল তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বরকত সাহেব এসে পড়লেন। তাঁর বয়স তিপ্পান্ন, দেখাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। তিনি ইস্টার্ন প্যাকেজিং লিমিটেডের এ. জি. এম.। এই কোম্পানির অবস্থা বেশ ভালো তবে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে মালিকানা হাত-বদল হবে। নতুন মালিক কিছু লোকজন সবসময় ছাঁটাই করেন। বরকত সাহেবের ধারণা তিনি এই ছাঁটাইয়ে পড়বেন। এইসব কারণে কদিন ধরেই তাঁর মন ভাল নেই। রোজ মুখ অন্ধকার করে বাড়ি ফেরেন। জহিরকে দেখে অপ্রসন্ন গলায় বললেন, তুমি? তুমি কোত্থেকে?

জহির কদমবুসি করতে-করতে বলল, এই বৎসর বি. এ. পাস করেছি মামা। চাকরির সন্ধানে এসেছি। এই কথায় বরকত সাহেবের মুখ আরো অন্ধকার হয়ে গেল।

চাকরির কোনো খোঁজ পেয়ে এসেছ না এখন খুঁজবে?

জ্বি এখন খুজব। মফস্বলে থেকে কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।

বরকত সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি শুকনো গলায় বললেন, বস আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।

বি. এ-তে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি, মামা।

ভালো। খুব ভালো। চাকরির বাজারে অবশ্যি বি. এ, এম. এ. কোন কাজে লাগে। না, সব ধরাধরি। এসে ভুল করেছ।

বরকত সাহেব বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহানার সঙ্গে ছোটখাট একটা ঝগড়া বেঁধে গেল। শাহানা চাচ্ছেন যেন এই ছেলেকে এক্ষুনি বলা হয় এই বাড়িতে থেকে চাকরি খোঁজা সম্ভব না। প্রথমত থাকার জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত এই বাজারে একটা বাড়তি লোক পোর প্রশ্নই ওঠে না।

বরকত সাহেব এইসব কথা এক্ষুনি বলতে চাচ্ছেন না। তিনি বললেন, রাতটা থাকুক, সকালে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললেই হবে।

শাহানা বললেন, গ্রামের এইসব মূৰ্খ ছেলে, এদের সরাসরি না বললে কিছুই বুঝবে না। ভাত খাওয়াতে চাচ্ছ খাওয়াও তারপর বিশটা টাকা হাতে ধরিয়ে বিদেয় করে দাও।

এতরাতে যাবে কোথায়?

রাত এমন কিছু বেশি হয় নি। কত বড় গাধা, বি. এ. পাস করে ভাবছে লোকজন চাকরি নিয়ে তার জন্যে বসে আছে। এদের উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত। লতায়-পাতায় সম্পর্ক ধরে উঠে পড়ছে। এদের কি কাণ্ডজ্ঞানও নেই?

রাতটা থাকুক। সকালে বুঝিয়ে বলব। বিপদে পড়েই তো আসে। আত্মীয়তার দাবি নিয়ে এসেছে।

শাহানা অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণও ছিল। গত মাসেই একজন এসে দশ দিন থেকে গেছে। ফিরে যাবার ভাড়া পর্যন্ত ছিল না। পঞ্চাশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিয়ে করতে হয়েছে। তার আগের মাসে দুজন এসেছিল চিকিৎসার জন্যে। তারা থেকেছে এগার দিন। তাদের অসুখ সারে নি। চিঠি দিয়েছে—আবার আসবে।

বরকত সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন। আবেগহীন গলায় বললেন, কাপড়-চোপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া কর। সকালে কথা হবে।

জহির বলল, মামা আমি তো এখানে কিছু খাব না।

খাবে না কেন?

আমাদের শ্যামগঞ্জের একটা ছেলে থাকে নাজিমুদ্দিন রোডের একটা মেসে। তাকে বলে এসেছি তার সঙ্গে খাব। ও অপেক্ষা করবে।

ও আচ্ছা।

আমি তাহলে মামা এখন উঠি।

উঠবে মানে। তুমি কি ঐ মেসেই উঠবে নাকি?

জ্বি। আগে চিঠি দিয়ে রেখেছিলাম।

মেসে উঠতে চাও উঠবে। স্বাধীনভাবে থাকার একটা সুবিধা আছে। বাড়িতে সেই সুবিধা নেই। বাড়তি একটা লোক রাখার মতো অবস্থাও আমার নেই। তা না হলে…..।

বরকত সাহেব কথা শেষ করলেন না। কী বলবেন গুছিয়ে উঠতে পারলেন না। এখন খানিকটা লজ্জিতও বোধ করছেন।

জহির বলল, মামীকে একটু সালাম করে যাই। উনার সঙ্গে দেখা হয় নাই কখনো।

শাহানার মুখে অপ্ৰসন্ন ভাব এখন আর নেই। তিনি বেশ আন্তরিক সুরেই বললেন, এত রাতে না খেয়ে যাবে সেটা কেমন কথা। যা আছে খেয়ে যাও।

আরেকদিন এসে খাব। আমি আমার এই সুটকেসটা রেখে যাই, কিছু দরকারি। কাগজপত্র আছে। মেসে রাখা ঠিক না। বাচ্চাগুলোর জন্যে সামান্য মিষ্টি এনেছিলাম। পাসের মিষ্টি, বি. এ. পাস করেছি। সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি মামী।

বাহ্ ভালো তো। মিষ্টি আনার কোনো দরকার ছিল না।

কী যে বলেন, মামী। আত্মীয় বলে তো আপনারাই আছেন। আর তো কেউ নাই। বড় ভালো লাগল।

বরকত সাহেব বললেন, এই শীতে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে আছ। ঠাণ্ডা লাগছে না?

জহির লজ্জিত গলায় বলল, শার্টের নিচে সুয়েটার আছে মামা। একটু ঘেঁড়া, এই জন্যে ভেতরে পরেছি। তাছাড়া মামা ঢাকা শহরে শীত একেবারেই নাই।

রাতে খাবার টেবিলে বরকত সাহেব গম্ভীর হয়ে রইলেন। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে নিচু গলায় বললেন, বেচারা দেখা করতে এসেছিল আর কত কথাই না তুমি বললে। ছিঃ ছিঃ।  শাহানা কঠিন গলায় বললেন, কঠিন কথা আমি কী বললাম? যা, সত্যি তাই বলেছি। একেকজন আসে আর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে, তোমার মনে থাকে না?

সবাই তো একরকম না।

সবাই একরকম। তোমার জহিরও আলাদা কিছু না। দুদিন পরে টাকাপয়সা ফুরিয়ে যাবে; এসে তোমার ওপর ভর করবে।

নাও তো করতে পারে।

সুটকেস রেখে গেছে কী জন্যে তাও বোঝ না? রেখে গেছে যাতে সহজে আবার ঢুকতে পারে। সুটকেস রেখে যাবার তার দরকারটা কী? কোন কোহিনূর হীরা তার সুটকেসে আছে যে সুটকেস রেখে যেতে হবে?

তুমি সব কিছু বড় বেশি বোঝ।

বেশি বোঝাটা কি অন্যায়?

হ্যাঁ অন্যায়। যতটুকু বোঝার ততটুকুই বুঝতে হয়। তার বেশি না।

শাহানা কঠিন চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন। তরুর বড় বোন অরু তখন ক্লান্ত গলায় বলল, তোমরা কী শুরু করলে? রোজ ঝগড়া, বড় খারাপ লাগে।

শাহানা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, খারাপ লাগলে এই বাড়িতে পড়ে আছিস কেন, চলে যা। অরু বলল, তাই যাব মা। সত্যি-সত্যি যাব।

 

অরু তখন কলেজে পড়ে। লালমাটিয়া কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। সব সময় বিষণ্ণ হয়ে থাকে। এই বিষণ্ণতার কোনো কারণ কেউ জানে না। অরুর স্বভাব অসম্ভব চাপা। তার চরিত্রের মধ্যেও কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। গেট পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ ফিরে এল। শান্ত গলায় বলল, আজ কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে। না মা।

শাহানা চিন্তিত হয়ে বললেন, শরীর খারাপ নাকি?

না শরীর ঠিক আছে।

অরু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এই দরজা সারাদিনেও খোলা হল না। অরুর তখন নিজের একটা ঘর হয়েছে। স্টোর রুমটাকেই সে ঘর বানিয়ে নিয়েছে। পায়রার খুপরির মত একটা ঘর। ছোট্ট একটা জানালা। না আছে আলো, না আছে। বাতাস। তবু সে এই ঘরেই আছে। এইটাই তার ভালো লাগে।

শাহানা পৃথিবীর কাউকেই পরোয়া করেন না কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে বড় মেয়েকে সমীহ করেন, অনেকখানিই করেন। অরুর স্বভাবই হচ্ছে মা যে ব্যাপারটা পছন্দ করেন না, সে তাই করবে। শাহানা একদিন বললেন, রোজ শাড়ি পরে কলেজে যাস কেন, এখনো তো শাড়ি পরার বয়স হয় নি। যখন হয় তখন পরবি।

এখন পরলে অসুবিধা কি?

বড়-বড় দেখায়।

বড়-বড় দেখালে অসুবিধা কি?

তুই বড় যন্ত্ৰণা করিস অরু।

তুমিও বড় যন্ত্রণা কর মা।

অরু সেদিন থেকেই পুরোপুরি শাড়ি পরা শুরু করল। নতুন একটা কামিজ বানানো হয়েছে। একদিনমাত্র পরা হয়েছে; ঐটিও সে ছুঁয়ে দেখবে না।

শাহানা জহিরকে এ বাড়িতে রাখবেন না, শুধুমাত্র এই কারণে অরু উঠে-পড়ে লাগল যেন জহির এ বাড়িতে থাকে। শাহানা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ওর থাকার জায়গা আছে। বন্ধুর সঙ্গে উঠেছে, ওকে জোর করে এখানে আনতে হবে?

বন্ধুর সঙ্গে আছে বাধ্য হয়ে, আমরা ওর আত্মীয়। আমরা ওর সুবিধা-অসুবিধা দেখব না?

এ রকম লয়-পাতায় আত্মীয় দেখলে তো চলে না।

কেন চলবে না?

মেয়ে বড় হয়েছে, একটা পুরুষ মানুষ হুট-হুট করে ঘুরবে, তা কি সম্ভব?

পুরুষ মানুষ কি বাঘ নাকি যে বড় মেয়ে দেখলেই চিবিয়ে গিলে ফেলবে?

তুই কেন শুধু-শুধু ঝগড়া করিস? তোর সমস্যাটা কি?

আমার কোনো সমস্যা নেই, এর পরে যখন ছেলেটা আসবে তখন তাকে বলবে এ বাড়িতে থাকতে।

আচ্ছা বলব।

জহির থাকতে রাজি হল না। এই ব্যাপারটা শাহানাকে বিস্মিত করল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বলামাত্র সে বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে আসবে। শাহানা যখন আসতে বললেন, তখন সে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, খুব বিপদে পড়লে তো আসতেই হবে। না এসে যাব কোথায়। আত্মীয় বলতে তত এক আপনারাই আছেন।

শাহানা বললেন, বলা রইল, অসুবিধা মনে করলে আসবে।

জ্বি আচ্ছা। ছুটির দিন চলে আসবে। খাওয়াদাওয়া করবে।

জ্বি আচ্ছা।

চাকরিবারির কোন সুবিধা হল?

খোঁজ করছি। তবে দুটা টিউশানি জোগাড় করেছি।

বল কী। এর মধ্যে টিউশানিও জোগাড় করে ফেলেছ?

আমার বন্ধু জোগাড় করে দিয়েছে।

একদিন তোমার বন্ধুকে নিয়ে এস।

জ্বি আচ্ছা।

আরেকটা কথা বলে রাখি, ঐ দিকের ছোট ঘরটায় আমার বড় মেয়ে থাকে। ওর মেজাজ-টেজাজ খুব খারাপ, তুমি যেন আবার হুট করে ওর ঘরে ঢুকবে না।

জ্বি না, ঢুকব না। মেজাজ খারাপ কেন?

জানি না। মেজাজের যন্ত্রণায় আমরা অস্থির। আরেকটা কথা, ঐদিন শুনলাম মীরুর সঙ্গে তুমি তুই-তুই করে কথা বলেছ। গ্রামের ছেলেরা বাচ্চাদের সঙ্গে তুই-তুই করে কথা বলে, তা আমি জানি। তুমি এটা করবে না।

জ্বি আচ্ছা।

জহির প্রতি শুক্রবারে আসতে শুরু করল। খুব সকালে আসে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যাবেলা চলে যায়। ছুটির দিনে বাইরের একটা মানুষ যে এসে সারাদিন থাকে এটা বোঝাই যায় না। পুরোপুরি নিঃশব্দ একটা মানুষ। বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছে কিংবা বারান্দায় মোড়াতে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে উঠানের ঘাসে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবেজিজ্ঞেস না করলে মুখ তালাবন্ধ। একদিন দেখা গেল একটা খুরপি কিনে এনেছে। উঠানের ঘাস তুলে কী যেন করা হচ্ছে। শাহানা বলল করছ কী তুমি?

কিছু না মামী। মাটি কোপাচ্ছ কেন?

কয়েকটা গাছ লাগিয়ে দিচ্ছি। গাছপালা নেই, জায়গাটা কেমন ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগে।

পরের বাড়িতে গাছপালা লাগিয়ে লাভ নেই। তুমি এসব রাখ তো।

জ্বি আচ্ছা।

রেশন এনে দাও। পারবে তো আনতে?

জ্বি পারব।

ছুটির দিনে ছোটখাটো কাজের ভারগুলো আস্তে আস্তে তুলে রাখা হতে থাকে জহিরের জন্যে। এইসব কাজের ফাঁকে-ফাঁকে দেখা যায় একচিলতে উঠানের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো গাছ, গাছগুলোও জহিরের মতোই প্রায় অদৃশ্য। এরা যে আছে তাই বোঝা যায় না। তারপর একদিন বোগেনভেলিয়ার লতানো গাছ ছাদে উঠে গাঢ় কমলা রঙের পাতা ছেড়ে দিল। দক্ষিণের উঠানের কোনার দিকের গোলাপ গাছগুলো অবশ্যি আরো আগেই গোলাপ ফুটাতে শুরু করেছে।

দুবছরের মাথায় জহিরের একটা চাকরিও হয়ে গেল। বড় এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে একদিন এসে মামা-মামীকে সালাম করল। বরকত সাহেব বললেন, চাকরি জোগাড় করে ফেলেছ? ভালো। খুব ভালো। তুমি দেখি অসাধ্য সাধন করলে।

তেমন কিছু না। প্রাইভেট ফার্ম।

প্রাইভেট ফার্মই ভালো। সরকারি চাকরি আর কজন পায় বল? খুশি হয়েছি। আমি খুব খুশি হয়েছি। এইবার বাসা ভাড়া করে টাকাপয়সা জমাও। বিয়েটিয়ে কর। সারাজীবন কষ্ট করেছ। এখন সুখ পাও কি-না দেখা

জহিরের চোখে পানি এসে গেল। সে ধরা গলায় বলল, আপনার এখানে যে আদর পেয়েছি এই কথা আমি সারাজীবন ভুলব না মামা।

বরকত সাহেব খুবই অবাক হয়ে গেলেন, কী ধরনের আদর এই ছেলেকে করা হয়েছে তা বুঝতে পারলেন না। খানিকটা লজ্জিত বোধ করতে লাগলেন।

চাকরি পাওয়ার পর জহিরের এ বাড়িতে আসা-যাওয়ার পরিমাণ কিছু বাড়ল। ছুটির দিন ছাড়াও তাকে দেখা যেতে লাগল; হাতে নানান টুকিটাকি, যেমন একটা বেতের মোড়া, কারণ আগেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটা হাতুড়ি, কারণ এ বাড়িতে হাতুড়ি নেই। এক বাভিল দড়ি। একবার এক চুনকামওয়ালা মিস্ত্রি ধরে আনল বাড়ি চুনকাম করে দেবে। শাহানা বিরক্ত হয়ে বললেন, পরের বাড়ি আমি নিজের পয়সায় চুনকাম করব কেন?

জহির লাজুক গলায় বলল, টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না, মামী।

চিন্তা করব না মানে? টাকাপয়সা কে দেবে, তুমি?

জহির মাথা নিচু করে রইল। শাহানা তীব্র গলায় বললেন, তুমি টাকাপয়সা দেবে। কেন? কী অদ্ভুত কথা!

তাহলে মামী থাক। ওকে চলে যেতে বলি?।

হ্যাঁ বল।

শুধু অরুর ঘরটা চুনকাম করে দিক।

শাহানার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। জহির মৃদু স্বরে বলল, ও ঐদিন বলছিল তার ঘরের দেয়ালগুলো বড় নোংরা–তার নাকি ঘেন্না লাগে।

এই শুনেই তুমি চুনকামওয়ালা নিয়ে এসেছ? বল, ওকে চলে যেতে বল। এক্ষুনি যেতে বল।

জ্বি আচ্ছা।

শাহানার মনে অন্য একটা সন্দেহ দেখা দিল জহির যে এত ঘনঘন এখানে আসে তার মূল কারণ অরু নয় তো? কী সর্বনাশের কথা! বরকত সাহেবের সঙ্গে তিনি ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলেন। বরকত সাহেব হেসে উড়িয়ে দিলেন।

কী যে তুমি বল। কোনদিন কথাই বলতে দেখলাম না।

এইখানে হয়ত বলে না কিন্তু বাইরে….

বাইরে কথা বলাবলির সুযোগ কোথায়? বাজে ব্যাপার নিয়ে তুমি চিন্তা করবে না।

 

শাহানা খুব ভরসা পান না। বাইরে দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা পুরোপুরি বাদ দেওয়া যায় না। অরুবরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাকে বরিশালে আনা- নেয়ার দায়িত্ব পালন করে জহির। তখন কি তাদের কোনো কথাবার্তা হয় না? গ্রামের এইসব মিনমিনে ধরনের ছেলে ভেতরে খুব সজাগ। কী চাল চলছে কে জানে? তাছাড়া তিনি লক্ষ করেছেন, জহির শুধু যে মীরুর সঙ্গে তুই-তুই করে বলে তাই না, তরুর সঙ্গেও বলে। এইসব আলাপে গভীর অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া থাকে। এতে কিসের খাতির।

ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে একবার কায়দা করে বললেন, জহির, অরুকে বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। একজন ছেলেও মোটামুটি পছন্দ হয়েছে ডাক্তার ছেলে।

জহির ভাত খাচ্ছিল, মুখ না তুলেই বলল, তাহলে তো ভালোই হয় মামী।

শিগগিরই বিয়েটা দিয়ে দেব, তোমার অনেক খাটাখাটনি আছে।

জহির কিছু বলল না। যে ভাবে খাচ্ছিল সেই ভাবেই খেয়ে চলল। শাহানার এই লক্ষণ ভালো লাগল না। তাছাড়া তাঁর কাছে মনে হল কথা শুনে জহির একটু মনমরা হয়ে গেছে। খাওয়া শেষ করে সে সেদিন আর অপেক্ষা করল না। অন্যদিন বেশ কিছুক্ষণ থাকে। শাহানার বুক কাঁপতে লাগল। সেই রাতে তাঁর ঘুম ভালো হল না।

তাঁর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। এই ঘটনার পনের দিনের মাথায় অরু কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলল। তাদের লালমাটিয়া কলেজের ইতিহাসের একজন টিচারকে বিয়ে হল বরিশালে। অরু মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল থেকে চিঠি লিখে সব জানাল।

ইতিহাসের ঐ শিক্ষকের নাম আজহার হোসেন। ভদ্রলোক বিবাহিত, বয়স চল্লিশের ওপর। তাঁর বড় ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ভদ্রলোকের স্ত্রীর সুন্দর মিগ্ধ চেহারা। এই সুন্দর স্নিগ্ধ চেহারার মেয়েটি অরুদের বাসায় এসে কঠিন গলায় এমনসব কথা বলতে লাগলেন যে শাহানার ইচ্ছা করল নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা, কী লজ্জা!

অরু এখন ঢাকাতেই আছে। তার ডাক্তারী পড়া বন্ধ। সে একটা কিন্ডারগার্টেনে মাস্টারি করে এবং আজাহার হোসেনের সঙ্গে জীবনযাপন করে। সেই জীবন কেমন এ বাড়ির কেউ জানে না। অরুর সঙ্গে এদের কোনো যোগাযোগ নেই। এ বাড়িতে অরুর ব্যবহারী প্রতিটি জিনিস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শাহানাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, আপনার ছেলেমেয়ে কি? তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আমার দুই মেয়ে। এটা বলতে তাঁর কথা আটকে যায় না বা তিনি কোনোকষ্টবোধ করেন না। কিংবা কে জানে, হয়ত করেন, কাউকে বুঝতে দেন না। গত ঈদে অরু এসেছিল। শাহানা রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বলেছিলেন, তোর এত সাহস! তুই এ বাড়িতে আসতে পারলি? এক্ষুনি বের হ। এক্ষুনি। অরু চলে গিয়েছিল এবং আর কখনো আসে নি।

শাহানার ধারণা জহিরের সঙ্গে অরুর হয়ত কোনোযোগাযোগ আছে। এই বিষয়ে জহিরকে তিনি কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আজকাল মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে।

 

তরুর অস্থির ভাবটা আরো বাড়ল।

জহির ভাই এখনো বের হচ্ছেন না। কী করছেন তিনি? চা খাচ্ছেন? ককাপ চা? এই ঝাঁঝাঁ দুপুরে চা খাবার দরকারটা কি? তার ইচ্ছা করছে উঁকি দিয়ে দেখতে। ইচ্ছা করলেও যাওয়া যাবে না। সবাই ঘুমুচ্ছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করবে কে? তরু বসার ঘরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। তার তখনি চোখে পড়ল জহির ভাই বেরুচ্ছেন। আজ তাকে অন্যরকম লাগছে। কেন অন্যরকম লাগছে? গায়ে তো সেই পুরনো হলুদ শার্ট। এরকম বিশ্রী রঙের শার্ট কেউ পরে? কপয়সা আর লাগে ভালো একটা শার্ট কিনতে। কত সুন্দর-সুন্দর শার্ট আজকাল বের হয়েছে!

জহির কলিং বেলে হাত দেয়ার আগেই জানালার ওপাশ থেকে তরু বলল, জহির ভাই।

জহির জানালার পাশে এগিয়ে এসে বলল, তুমি কলেজে যাও নাই?

না। আপনি ঐ চায়ের দোকানে বসে কী করছিলেন?

দেখেছ নাকি?

হাঁ দেখেছি। আপনি ওখানে কী করছিলেন?

চা খাচ্ছিলাম, আবার কি?

এ বাড়িতে আমরা কি চা বানাতে পারি না যে দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়?

জহির কথা ঘুরাবার জন্যে বলল, দরজা খোল তরু, জানালা দিয়ে কথা বলব?

তরু দরজা খুলল, তার মুখ ভার-ভার, বিষণ্ণ।

জহির বলল, কেউ নেই নাকি? ঘর এমন চুপচাপ। তরু করুণ গলায় বলল, এ বাড়ি এখন তো চুপচাপই থাকে। এ বাড়িতে হৈচৈ-এর মানুষ কোথায়? বসুন জহির ভাই। কেন জানি আপনাকে দেখে আজ খুব ভালো লাগছে। জহির লজ্জিত মুখে বলল, মামা এখনো ফেরেন নি?

উহুঁ। আপনাকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন জহির ভাই? কেমন অচেনা-অচেনা লাগছে।

চুল কেটেছি।

আপনাদের পুরুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার, দুই দিন পরপর চুল কাটেন আর চেহারাটা বদলে যায়।

মানুষ তো আর বদলায় না।

কে জানে হয়ত বদলায়।

তোমার মনটা মনে হয় খারাপ। কিছু হয়েছে নাকি?

না, কি আর হবে।

মামী কোথায়?

ঘুমুচ্ছেন। ডাকব?

না, ডাকার দরকার নেই।

জহির খানিক ইতস্তত করে বলল, জিনিসটা কেমন দেখ তো তরু। এনগেজমেন্টের একটা আংটি কিনলাম। মানে মামা বললেন—তাই।

তরু হাত বাড়িয়ে আংটির বাক্সটি নিল। জহিরের অসময়ে আসার উদ্দেশ্য তার মনে পড়ল। আজ যোল তারিখ, মেয়ে দেখার দিন; তরুর মনেই ছিল না।

জহির নিচু গলায় বলল, তোমাকে নিয়ে কিনতে চেয়েছিলাম, ভাবলাম তোমাকে নিয়ে গেলে তুমি শুধু দামিগুলো কিনতে চাইবে। মানে আমার তো আবার

আংটিটা সুন্দর হয়েছে।

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ, সত্যি। খুব সুন্দর।

আঙুলে লাগবে কি-না কে জানে।

লাগবে। জহির ভাই আমি একটু পরে দেখব?

পর। দেখ আবার যেন দাগ না লাগে।

তরু একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ জহিরের দিকে তাকিয়ে আংটি পরল। জহির বলল, লেগেছে?

হ্যাঁ।

টাইট হয় নি তো?।

না।

অবশ্যি হলেও অসুবিধা হবে না। ওরা বলেছে ফেরত নিবে। আংটিটা এখন খুলে ফেল তরু, ঘষাটসা লাগলে দাগ পড়ে যাবে।

পড়বে না। সোনাতে অত সহজে দাগ পড়ে না। চা খাবেন জহির ভাই।

না।

ঠাণ্ডা কিছু দেব? শরবত করে দেই, লেবু আছে।

না না কিছু লাগবে না। তুমি বস তো।

তরু তার সামনে বসল। নিচু গলায় বলল, আংটিটা আমাকে একদম মানাচ্ছে না, তাই না জহির ভাই? গায়ের রঙ আরো ফর্সা হলে মানাতো। যার গায়ের রঙ সোনার মতো তাকেই সোনার গয়নায় মানায়। আমাদের কলেজে সায়েন্স গ্রুপে একটা মেয়ে পড়ে, তার গায়ের রঙ অবিকল কাঁচা সোনার মতো।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। একবার কয়েকগাছি চুড়ি পরে এসেছিল, চুড়িগুলো গায়ের রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেল যে কোনগুলো চুড়ি বোঝা যাচ্ছিল না।

বল কী।

তবে মেয়েটা দেখতে ভালোনা। মেয়েটার দিকে তাকালে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এতো সুন্দর গায়ের রঙ, এতো সুন্দর শরীর।

বলতে-বলতে তরু লজ্জা পেয়ে গেল। সুন্দর শরীর কথাটা বলা ঠিক হয় নি, জহির ভাই কী মনে করলেন কে জানে।

জহির ভাই।

বল।

সবারই তো একইরকম নাক-মুখচোখ, তবু কাউকে সুন্দর লাগে, কাউকে লাগে না কেন?

কি জানি কেন।

তরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি নিজে দেখতে তো ভালো না এইজন্যে এটা নিয়ে আমি খুব ভাবি।

তুমি দেখতে খারাপ কে বলল?

খারাপ না তবে সাধারণ। খুব সাধারণ।

সাধারণই ভালো।

ছেলেদের জন্যে ভালো। মেয়েদের জন্যে না। একটা মেয়ের কেমন বিয়ে হবে, কী রকম বর হবে তা নির্ভর করে মেয়েটা দেখতে কেমন। মেয়েটি বুদ্ধিমতী কি-না, পড়াশুনায় কেমন, তার মনটা কেমন এইসব দেখা হবে না।

জহির বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি কি বিয়ে নিয়ে খুব ভাব?

ভাবি। আপার এ কাণ্ডের পর ভাবি। নিজের চেহারাটা আরেকটু ভালো হলে তেমন ভাবতাম না।

তোমার চেহারা খারাপ না।

তা ঠিক। খারাপ না, তবে ভালো না।

তরু হাত থেকে আংটি খুলে বাক্সে ভরতে-ভরতে বলল, বাবা বলছিলেন আজকে যে মেয়েটিকে দেখতে যাবেন সে খুব সুন্দর তবে রোগা। জহির কিছু বলল না। তরু বলল, ওদের নাকি খুব আগ্রহ। আগের কয়েকটা বিয়ে লাগানী-ভাঙানীর জন্যে ভেঙে গেছে তাই…. তরু কথা শেষ না করে উঠে গেল।

জহির ঘড়ি দেখল। চারটা চল্লিশ; অথচ বাইরে এখনো কড়া রোদ। আকাশে মেঘের ছিটাফোঁটাও নেই। সে ভেতরের বারান্দায় এল। দুটো গোলাপ গাছে অসুখ ধরেছে। পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে। গাছের কষ্টটা দেখেই বোঝা যায়। গোলাপের এই অসুখটা খুব খারাপ। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কাল-পরশুর মধ্যে ওষুধ এনে দিতে হবে। জহির গাছগুলোর কাছে নেমে এল। অসুস্থ পাতাগুলো ফেলে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় কিছু ছাই দিতে পারলে হত। শহরে ছাই কোথায় পাওয়া যাবে।

তরু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে কিছু বলতে চায়। জহির বলল, কিছু বলবে তরু?

না।

তোমার মনটা খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে?

না মাথা ধরেছে।

চোখ বন্ধ করে ঘরটা অন্ধকার করে শুয়ে থাক।

আপনার এই হলুদ রঙের শার্টটা দেখলেই আমার মাথা ধরে যায়। একদিন আপনার বাসায় গিয়ে শার্টটা পুড়িয়ে দিয়ে আসব। হাসবেন না, সত্যি-সত্যি পুড়িয়ে দেব কিন্তু।  জহির দেখল তরু মুখ থেকে বিষণ্ণ ভাবটা চলে গেছে। সে হাসছে। হাসলে এই মেয়েটাকে সুন্দর দেখায়। হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায় কিন্তু এই মেয়েটিকে একটু বেশি সুন্দর লাগে।

এ বাড়ির মানুষেরা কথা কম বলে। শুধু শাহানা কিছু বেশি কথা বলেন। তরু, অরু এবং মীরু এই তিন বোন তো কথাই বলে না। বনেরা মিলে গল্প করার দৃশ্যও জহির খুব বেশি দেখে নি তবে এই তিন বোনর মধ্যে তরু খানিকটা সহজ। বাইরের লোকজন এলে সে এগিয়ে গিয়ে গল্প করে। তাও অবশ্যি অল্প কিছুক্ষণ। মনে হয়। কিছুক্ষণ গল্প করার পরই তার আগ্রহ নিভে যায়। তরু নরম গলায় বলল, জহির ভাই?

বল।

অসুন্দর মেয়ে হবার সবচে বড় সমস্যা কি জানেন?

না।

একটা অসুন্দর মেয়ে যদি কাউকে পছন্দ করে সে তা জানাবার সাহস পায় না। মনের মধ্যে চেপে রাখতে হয়।

এইসব আজেবাজে জিনিস নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়? যাও আমার জন্যে চা বানিয়ে আন।

 

শাহানার ঘুম ভাল।

ঘুম ভাঙলে প্রথম তিনি যে কাজটি করেন তা হচ্ছে মতির মাকে বকাঝকা। আজ বকাঝকা চূড়ান্ত রকমের হতে পারে। মতির মারও ঘুম ভেঙেছে। সে এই বকাঝকা মোটও গ্রাহ্য করল না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকে বলল, আফা দেহি আমারে একফোঁটা চা দেন।

জহিরের চা খাওয়া শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বরকত সাহেব ঢুকলেন। আজ কেন জানি তাঁকে ক্লান্ত ও বিরক্ত লাগছে। তিনি জহিরকে দেখে বললেন, এসে পড়েছ? মেয়ের এক বড় খালু আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পর যেতে। রাতে ঐ বাড়িতে খেতে বলেছে। খাওয়াটা কি ঠিক হবে? চা-মিষ্টি খাওয়া এক জিনিস আর ভাত খাওয়া অন্য জিনিস। আমি অবশ্যি হ্যাঁ-না কিছুই বলি নি। খাওয়াতে চাচ্ছে খাওয়াক। তুমি কী বল?

আপনি যা ভালো মনে করেন।

এরেঞ্জড্‌ ম্যারেজ এখন ভয়ঙ্কর সমস্যা। ছেলেগুলোর চরিত্রের ঠিক নাই, মেয়েগুলোও তেমন। বিরাট টেনশান। তরুর একটা বিয়ে কোনো মতে দিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিত হই।

এখনই তরুর বিয়ে?

হ্যাঁ, এখনই। তুমি জান না বখা ছেলেগুলো খুব যন্ত্রণা করছে। তরু তোমাকে কিছু বলে নি?

জহির বিস্মিত হয়ে বলল, না তো!

লজ্জায় বলে নি। বলার মতো জিনিস তো না। তুমি আবার নিজ থেকে জিজ্ঞেস করো না–লজ্জা পাবে।

না আমি কিছুই জিজ্ঞেস করব না।

জহিরের মন খারাপ হল। বেশ মন খারাপ। সে তরুকে পছন্দ করে। অনেকখানিই করে। এই মেয়েটা মনে কষ্ট নিয়ে ঘুরছে ভাবতেই খারাপ লাগে। কি করেছে। ছেলেগুলো? খারাপ কোন গালাগাল দিয়েছে? নাকি গায়ে হাত-টাত দিয়েছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *