প্রায় দশটা বাজে।
ভয়াল-ছয় বাহিনীর দুজন সদস্যকে দেখা গেল খোকনদের বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। দুজন বেশ চিন্তিত। একজনের নাম শাহজাহান। সে বেশ বেঁটে। তার বন্ধুদের ধারণা, যতই দিন যাচ্ছে ততই সে বেঁটে হচ্ছে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় সে নাকি এতটা বেঁটে ছিল না। ক্লাসের ছেলেরা তাকে শাহজাহান ডাকে না, ডাকে বল্টু। বেটে ছেলেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সাধারণত খুব লম্বা হয়। কিন্তু শাহজাহানের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম আছে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদও সাইজে শাহজাহানের মতোই। সাজ্জাদ পড়াশোনা ও মারামারি দুটোতেই সমান দক্ষ বলে তার অন্য কোনো নাম নেই। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় টুনু তাকে দুয়েকবার মুরগি ডাকার চেষ্টা করেছে। সাজ্জাদ টিফিন টাইমে টুনুর নাকে গদাম করে একটা ঘুসি মেরে বলেছিল, আর মুরগি ডাকবি? টুন দুহাতে নাক চেপে বলল, না।
বল, কোনোদিন ডাকব না।
কোনোদিন ডাকব না।
টুনু মুরগি নাম দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেনি। উল্টো তাকেই সবাই চীনা-মুরগি ডাকতে শুরু করল। চীনা-মুরগিও ভয়াল-ছয় বাহিনীর একজন সদস্য। তারও খোকনদের বাসায় আসার কথা ছিল। আসতে পারেনি, কারণ তার ছোটভাই আজ সকালেই সাইকেলের নিচে পড়ে হাত ছিলে ফেলেছে। টুনুকে তার ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। সাড়ে নটার মধ্যে টুনুর চলে আসার কথা। কিন্তু আসছে না। এদিকে খোকনও বেরুচ্ছে না বাড়ি থেকে। সাজ্জাদ বলল, কী করবি পন্টু? গেট দিয়ে ঢুকবি খোকনদের বাড়ি।
নাহ।
নাহ কেন? খেয়ে তো ফেলবে না। দারোয়ানকে গিয়ে বলব, আমরা খোকনের বন্ধু।
তুই গিয়ে বল।
সাজ্জাদ সাহস করে গেট পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও ফিরে এল। খোকনদের বাড়ির দারোয়ানটির চাউনি খুব আন্তরিক মনে হলো না তার কাছে। তার উপর একটি কুকুর আছে। গেটের কাছে যাওয়া মাত্রই সে এমন একটি ডাক ছাড়ল যাকে কুকুরের ডাক বলে মনে হয় না। বল্টু বলল, কিরে ভীতুর ডিম, গেলি না ভিতরে?
বড়লোকের বাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছা করে না।
বল্টু কিছু বলল না। কারণ এটি তারও মনের কথা। যে-বাড়ির ছেলেদের পাঁচ জোড়া জুতা থাকে সে-বাড়িতে ঢুকতে ভালো লাগে না। সাজ্জাদ বলল, ঢিল মারলে কেমন হয়? খোকনের ঘরের জানালায় চল ঢিল মারি।
কোনটা ওর জানালা।
সাজ্জাদ চুপ করে গেল। খোকনের ঘর কোনটি তা তার জানা নেই। একদিন মাত্র সে এসেছিল এ বাড়িতে। তাও ভেতরে ঢোকেনি। বল্টু বলল, চল দারোয়ানকে গিয়ে বলি ভিতরে খবর দিতে। খোকনকে গিয়ে বলবে, দুজন বন্ধু এসেছে খুব জরুরি দরকার।
যদি না যায়?
যাবে না মানে? একশবার যাবে।
তাহলে তুই গিয়ে বল।
আমি একা বলব কেন? আমার কী দায় পড়ল।
দুজনের কাউকেই যেতে হলো না। দেখা গেল দারোয়ান নিজেই আসছে। গেটের ভেতরে তাকে যেরকম ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল এখন আর সেরকম মনে হচ্ছে না।
আপনাদের ডাকে।
কে ডাকে?
বড়সাহেব। আসেন আমার সাথে।
বল্টু এবং সাজ্জাদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বড় সাহেব মানে খোকনের বড়চাচা। তিনি তাদের ডাকবেন কেন শুধু শুধু! এই সময় টুনুকে আসতে দেখা গেল। সে বোধহয় কিছু একটা আঁচ করেছে। সাজ্জাদ দেখল–টুনু দাঁড়িয়ে পড়েছে। পরমুহূর্তেই টুনুকে লম্বা লম্বা পা ফেলে পাশের গলিতে ঢুকে পড়তে দেখা গেল। এরকম ভীতুর ডিমকে ভয়াল-ছয়-এ ঢোকানো খুব ভুল হয়েছে।
.
বড়চাচা ইজিচেয়ারে শুয়ে ছিলেন। ওদের দেখে উঠে বসলেন।
খোকনের সঙ্গে মনে হয় তোমাদের খুব জরুরি প্রয়োজন। অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি ঘুরঘুর করছ।
ওরা জবাব দিল না। বড়চাচা বললেন, তোমরা দুজনেই কি ভয়াল-ছয়-এ আছ?
সাজ্জাদ ও বল্টু মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এর মানে কী? ভয়াল-ছয়ের কথা তো তার জানার কথা নয়।
বড়চাচা শান্তস্বরে বললেন, তোমরা কি বোকনের বন্ধু।
উত্তর দিল সাজ্জাদ, জি।
আফ্রিকার গহীন অরণ্যে যাচ্ছ কবে?
প্রশ্ন করা হলো বল্টুকে। বল্টুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল।
খুব শিগগিরই রওনা হচ্ছ নাকি?
জি।
পায়ে হেঁটেই যাবে?
জি।
প্রথমেই একেবারে আফ্রিকার গহীন অরণ্যে? এই দেশটা একবার দেখে নিলে হতো না?
বল্টু বলল, এই দেশ আমরা পরে দেখব।
আমার মনে হয় প্রথমে নিজের দেশটাই দেখা উচিত। আমি হলে তা-ই করতাম। বসো, তোমরা ওই চেয়ারে বসো।
ওরা বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্লেটে করে সন্দেশ চলে এল। বড়চাচা বললেন, খোকনের সঙ্গে তো আজ দেখা হবে না। ও আজ সারা দিন ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। সাজ্জাদ ও বল্টু দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। বড়চাচা বললেন, জিজ্ঞেস করো কেন খোকন আসবে না? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। বড়চাচা বললেন, ও কাল রাত নটার পর বাড়ি ফিরেছে, সেজন্যে শাস্তি। বুঝতে পারছ?
জি পারছি।
তোমরা ছাড়া আর কে কে যাচ্ছে। সব মিলে ছজন না?
জি-না, পাঁচজন। টগর আজ সকালে বলেছে সে যাবে না।
যাবে না কেন?
ওর নাকি ভয় লাগছে।
তাহলে তোমরা এখন ভয়াল-পাঁচ?
জি।
আমার তো মনে হয় আরও কমবে। শেষমুহূর্তে অনেকেই পিছিয়ে পড়বে। শেষমুহূর্তে অনেকের সাহস থাকে না। খাও, সন্দেশ খাও।
সাজ্জাদ সন্দেশ খেতে খেতে চারদিকে তাকাল। সিনেমায় বড়লোকদের বাড়ি যেরকম সাজানো থাকে সেরকম সাজানো। লাল টুকটুক কার্পেট। ময়লা জুতা পরে কেউ নিশ্চয়ই এ কার্পেটে পা দেয় না। কার্পেট থেকেই লালাভ একটি আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ঘরের দেয়াল ঘেঁসে উঁচু উঁচু চেয়ার। চেয়ারের গদিগুলিও লাল রঙের। মাঝখানের মস্ত টেবিলটি কি পাথরের তৈরি? খোকনকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
সন্দেশ খাচ্ছ না কেন? যে কটি খেতে পারো খাও।
গবগব করে পাঁচ-ছটা সন্দেশ শেষ করে দেওয়াটা অভদ্রতা হবে ভেবেই বল্টু ইতস্তত করছিল। বড়চাচা বললেন, খেতে ইচ্ছে হলে খাবে। না খাওয়ার মধ্যে কোনো ভদ্রতা নেই।
সাজ্জাদ একসঙ্গে দুটো সন্দেশ মুখে পুরে দিল। মিষ্টির ভেতরও যে এমন সুন্দর গন্ধ থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না। এ মিষ্টিগুলি কি বাড়িতেই তৈরি হয়। সাজ্জাদের হঠাৎ করে বড়লোক হওয়ার ইচ্ছে হলো। খোকনদের মতো বড়লোক। বড়চাচা বললেন, আচ্ছা, তাহলে তোমরা যাও। খোদা হাফেজ।
বল্টুর ইচ্ছে হলো এগিয়ে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলে। মুরুব্বিদের সঙ্গে হাঠাৎ দেখা হলে যেরকম করা হয়। কিন্তু সাহসে কুলাল না। যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন বড়চাচা আবার ডাকলেন, তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তোমরা কি মিছিলে যাও? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, ভয়াল-ছয়ের সদস্যরা মিছিলে যায়?
সাজ্জাদ ইতস্তত করে বলল, ওরা যায় না, আমি যাই।
কেন যাও?
সাজ্জাদ জবাব দিতে পারল না।
এসব মিছিল-টিছিল কেন হচ্ছে জানো?
জানি।
কেন?
সাজ্জাদ জবাব দিতে পারল না। বড়চাচা গম্ভীর মুখে বললেন, না, তুমি জানো না। মিছি-টিছিল করা এখন আমাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় কথায় মিছিল, সভা, শোভাযাত্রা। এসব কী? রাতদিন রাস্তায় চেঁচামেচি করলে মানুষ কাজ করবে কখন?
সাজ্জাদ কিছু বলল না। বড়চাচা হঠাৎ করে কেন রেগে যাচ্ছেন সে বুঝতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ ইলেকশনে জিতেছে, ভালো কথা। কিন্তু এমন করছে যেন তারা যা বলবে তাই। আরে বাবা, পাকিস্তানের কথাও তো শুনতে হবে। হবে কি না বলো?
সাজ্জাদ না বুঝেই মাথা নাড়ল।
শেখ সাহেবের যে পরিকল্পনা তাতে তো দেশটাই ছারখার হবে। পাকিস্তান আনার জন্যে আমরা কম কষ্ট করেছি। এখন পাকিস্তানের কথা বলে না, সবাই শুধু বাঙালি বাঙালি করে। বাঙালি ছাড়াও তো লোক আছে। পাঞ্জাবি আছে, সিন্ধী আছে, এরা মানুষ না। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকা যায় না।
জি যায়।
বড়চাচা গলা উচিয়ে বললেন, মিছিল-টিছিলে কখনো যাবে না। এখন পড়াশোনায় সময়। পড়াশোনা করবে। ব্যস। কথায় কথায় মিছিল–এসব কী? যাও বাড়ি যাও।