দ্বিতীয় অধ্যায় – বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা (১৭৮৬-১৮৫৪)
১. ভারতে রাজ্য বিস্তার
হেস্টিংসের পরবর্তী বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিস ১৭৮৬ হইতে ১৭৯৩ সন পর্যন্ত ভারত শাসন করেন।
মহীশূরের সুলতান অথবা মহীশূর রাজ্যের উপর কর্ণওয়ালিসের ভাল ধারণা ছিল না। একবার তিনি টিপু সুলতানকে উন্মত্ত বর্বর বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। নিজামের নিকট কর্ণওয়ালিস যে-সমস্ত পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতেও তাঁহার মহীশূর-বিদ্বেষ ফুটিয়া উঠিয়াছিল। এই সমস্ত জানিতে পারিয়াই টিপু ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর তারিখে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের প্রান্তভাগ আক্রমণ করিলেন। ত্রিবাঙ্কুররাজ ইংরেজের মিত্র ছিলেন। তাই কর্ণওয়ালিস টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন, এবং তাঁহাকে পরাজিত করিবার জন্য নিজাম ও মারাঠাদের সহিত সখ্যসূত্রে আবদ্ধ হইলেন। তিনি নিজেই সেনাপতিরূপে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া বাঙ্গালোর অধিকার করিলেন এবং টিপুর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তন অবরুদ্ধ করিলে টিপু সন্ধি করিতে বাধ্য হইলেন (১৭৯২ খ্র.)। শ্রীরঙ্গপত্তনের সন্ধি অনুসারে টিপুকে তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং তাঁহার অর্ধেক রাজ্য ছাড়িয়া দিতে হইল। সন্ধি-শর্তের জামিনস্বরূপ টিপুর দুই পুত্রকে লর্ড কর্ণওয়ালিস কলিকাতায় আনিয়া রাখিলেন। টিপুর প্রদত্ত রাজ্য ইংরেজ, নিজাম ও মারাঠারা সমান অংশে ভাগ করিয়া নিল। মালাবার, কুর্গ, দিন্দিগাল ও বড়মহল ইংরেজদের অধীনে আসিল। নিজাম ও মারাঠাগণ তাঁহাদের নিজ নিজ রাজ্যের সংলগ্ন নানা ভূমিখণ্ড অধিকার করিলেন।
১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে কর্ণওয়ালিস চলিয়া গেলে সার জন শোর তাঁহার স্থানে বড়লাট হইলেন। ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দে অযোধ্যার নবাব আসফউদ্দৌল্লার মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্র উজির আলি অযোধ্যার নবাব হন। তিনি দাসীর গর্ভজাত সন্তান বলিয়া শোর তাঁহাকে নবাবী পদ হইতে সরাইয়া সাদৎ আলি খাকে অযোধ্যার সিংহাসনে বসাইলেন। সাদৎ আলি খাঁর সহিত নূতন সন্ধির শর্ত অনুসারে এলাহাবাদ ইংরেজদের হস্তগত হইল। সার জন্য শোর শান্তিপ্রিয় ও উদ্যমবিহীন ছিলেন। এজন্য তাঁহার শাসননীতিকে ‘উদাসীন নীতি’ বা ‘নিরপেক্ষতামূলক নীতি’ (Policy of Non-Interference) বলা হয়।
লর্ড ওয়েলসলী বড়লাট (১৭৯৮-১৮০৫ খ্রী.) হইয়া আসিয়া শোরের ‘নিরপেক্ষতামূলক নীতি’ একেবারেই পরিত্যাগ করিলেন। তিনি ভারতীয় শক্তিসমূহকে বৃটিশের অধীনতাপাশে বদ্ধ করিবার জন্য যে-নীতির প্রবর্তন করিলেন, তাহাকে ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ (Subsidiary Alliance) বলা যাইতে পারে। এই নীতি অনুসারে ভারতের রাজগণকে স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়া বৃটিশের আশ্রয় গ্রহণ করিতে আহ্বান করা হইত। তৎপরিবর্তে বৃটিশ গভর্নমেন্ট তাহাদের রাজ্যসীমা অক্ষুণ্ণ রাখিতে এবং বৈদেশিক আক্রমণ হইতে তাঁহাদিগকে রক্ষা করিতে প্রতিশ্রুতি দিত। ভারতীয় রাজগণের মধ্যে যিনি এই অধীনতামূলক মিত্রতা গ্রহণ করিতেন, তাঁহাকে নিজের রাজ্যে নিজের খরচে একদল বৃটিশসৈন্য পোষণ করিতে হইত, অথবা উহাদের পোষণের জন্য বৃটিশ গভর্নমেন্টকে খরচ যোগাইতে হইত। বৃটিশের সম্মতি ভিন্ন অপর কোন শক্তির সহিত কোনপ্রকার রাজনীতিক সম্বন্ধ রক্ষা করা তাঁহার পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল।
মারাঠাদের সহিত এক ভীষণ যুদ্ধে নিজাম ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে গুরুতররূপে পরাজিত হইয়া একরকম মারাঠাদের অধীন হইয়া গিয়াছিলেন। তিনি দুঃখ দুর্দশায় অস্থির হইয়া ফরাসি সেনাপতিদের সহায়তায় ইউরোপীয় পদ্ধতিতে তাঁহার সৈন্য সুশিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। ওয়েলসলী তাঁহাকে অনেক বুঝাইয়া ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ গ্রহণ করিতে স্বীকার করাইলেন। তাঁহার সৈন্যদল ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইল, এবং নিজামের স্বাধীনতা লুপ্ত হইয়া গেল।
এইবার টিপু সুলতানের পালা আসিল। তিনি কিন্তু বৃটিশের ক্রীতদাস হইতে অস্বীকার করিলেন, এবং ফরাসিদের সহিত মিলিত হইয়া নিজের বলবৃদ্ধির চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সুতরাং তাহার বিরুদ্ধে ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষিত হইল। ইংরেজসৈন্য বোম্বাই ও মাদ্রাজ হইতে একযোগে মহীশূর আক্রমণ করিল এবং ৪ঠা মে তারিখে রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তন অধিকার করিল। দুর্গের এক সিংহদ্বারে অসিহস্তে যুদ্ধ করিতে করিতে করিতে টিপু প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
হায়দর আলি যে হিন্দু রাজবংশের হস্ত হইতে মহীশূর রাজ্য কাড়িয়া লইয়াছিলেন, টিপুর পরাজয় ও মৃত্যুর পর মহীশূর রাজ্যের মধ্যভাগ সেই রাজবংশকেই ফিরাইয়া দেওয়া হইল। প্রকৃত প্রস্তাবে ইহা বৃটিশের এক অধীন রাজ্যে পরিণত হইল। অবশিষ্টাংশ ইংরেজ ও নিজাম ভাগ করিয়া লইলেন। নিজামের অংশ কিন্তু শীঘ্রই নিজাম কর্তৃক রক্ষিত বৃটিশসৈন্যদলের ব্যয়নির্বাহাৰ্থ ইংরেজের হস্তে ফিরিয়া আসির। মহীশূরের নূতন হিন্দুরাজা অল্পবয়স্ক ছিলেন বলিয়া তাঁহার রাজ্য কিছুকালের জন্য ইংরেজের অধীনে রহিল।
ওয়েলী তাঞ্জোরের রাজা এবং সুরাটের নবাবকে বৃত্তি দিয়া তাঁহাদের রাজ্য বৃটিশ রাজ্যভুক্ত করিলেন (১৭৯৯ খ্র.)। কর্নাটের নবাবের বিরুদ্ধে টিপুর সহিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উপস্থিত হওয়ায় কর্নাট রাজ্যও বৃটিশশাসনের অধীনে (১৮০১ খ্রী.) আনা হইল। কিন্তু ওয়েলসূলী সর্বাপেক্ষা অধিক জবরদস্তি করিয়াছিলেন অযোধ্যা রাজ্যের উপর। কুশাসনের অজুহাতে তিনি হতভাগ্য নবাবকে বেশীসংখ্যায় ইংরেজসৈন্য নিযুক্ত করিতে এবং ইহার ব্যয় নির্বাহের জন্য তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত দোয়াবের এক অংশ, গোরখপুর এবং রোহিখণ্ড বৃটিশের হস্তে সর্মপণ করিতে বাধ্য করিলেন।
সালবাই-এর সন্ধির পরে মারাঠা রাজ্যসমূহের শক্তি ও সম্ভ্রম বৃদ্ধি পাইতেছিল। এই সময়কার মারাঠা-নায়কগণের মধ্যে মাহাদজি সিন্ধিয়া এবং নানা ফারবিশ শক্তিশালী ও সুদক্ষ ছিলেন। উত্তরভারতে মাহাদজি সিন্ধিয়ার বিস্তৃত রাজ্য ছিল, এবং এম. ডি. বয়েন নামক একজন ইউরোপীয় সেনাপতি কর্তৃক ইউরোপীয় প্রথায় সুশিক্ষিত তাহার সৈন্যগণ ইংরেজসৈন্যের সমকক্ষ ছিল। ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে মাহাদজি সিন্ধিয়ার মৃত্যু হইলে তাঁহার ত্রয়োদশ বত্সর বয়স্ক ভ্রাতুস্পৌত্র দৌলতরাও সিন্ধিয়া তাঁহার উত্তরাধিকারী হন। ইহার এক বৎসর পরে হোল্কার বংশের বিখ্যাত রানী অহল্যাবাঈর মৃত্যু হয়। এই মহীয়সী মহিলা অত্যন্ত যোগ্যতার সহিত প্রায় ত্রিশ বৎসর কাল ধরিয়া ইন্দোর রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করিয়াছিলেন।
মারাঠাশক্তির কেন্দ্রস্থল পুণাতে নানা ফারুনবিশ শিশু পেশোয়া মাধব রাও নারায়ণের নামে নিজেই মারাঠা রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। লর্ড কর্ণওয়ালিসের সহিত টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ফলে টিপুর নিকট হইতে গৃহীত রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ লাভ করিয়া তিনি মারাঠা রাজ্যের সীমানা তুঙ্গভদ্রা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করিয়াছিলেন। তাঁহার পরামর্শে সিন্ধিয়া, হোল্কার ও অন্যান্য প্রধান প্রধান মারাঠাশক্তি মিলিত হইয়া নিজামকে ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে খর্দা নামক স্থানে গুরুতররূপে পরাজিত এবং মারাঠাদের বশীভূত করে। কিন্তু নিজামের বিরুদ্ধে এই বিজয়ই মারাঠাদের শেষ বিজয়। ফারুনবিশের কঠোর শাসন অসহ্য মনে করিয়া বালক পেশোয়া মাধব রাও নারায়ণ আত্মহত্যা করিলেন। অমনি মারাঠা রাজ্য ষড়যন্ত্রে ছাইয়া গেল এবং নানা ফারূনবিশ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন। অবশেষে রঘুনাথের পুত্র দ্বিতীয় বাজী রাও ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দে পেশোয়া বলিয়া স্বীকৃত হইলেন। কিন্তু ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে নানা ফারুনবিশ যখন পরলোকগমন করিলেন, তখন হইতেই মারাঠা রাজ্যের প্রভাব ও প্রতিপত্তি যেন বিলুপ্ত হইল। নূতন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজী রাওর মতো অযোগ্য ও অধম নরপতি খুব কমই দেখা যায়। দৌলত রাও সিন্ধিয়া তখন অল্পবয়স্ক ও অনভিজ্ঞ ছিলেন। যশোবন্ত রাও হোল্কারের বীরত্বের অভাব ছিল না, কিন্তু তিনি মোটেই রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন না।
এই সময়ে রাজ্যের মধ্যে অরাজকতা, নায়কদের ষড়যন্ত্র ও অন্তর্বিদ্রোহ প্রজা সাধারণের জীবন দুঃখ-দুর্দশায় দুঃসহ করিয়া তুলিয়াছিল। অবশেষে ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর তারিখে রাজধানী পুণার নিকট এক খণ্ডযুদ্ধে পেশোয়া ও সিন্ধিয়ার মিলিত সৈন্যদলকে যশোবন্ত রাও হোলকার সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন। পেশোয়া পলাইয়া গিয়া ইংরেজদের আশ্রয় লইলেন। ওয়েলস্লী তাঁহাকে সানন্দে অভ্যর্থনা করিয়া ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ গ্রহণ করিতে স্বীকার করাইলেন। তদনুসারে ১৭০২ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পরাক্রান্ত মারাঠা জাতির নায়ক বেসিনের সন্ধিদ্বারা বৃটিশের অধীনতা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইলেন। বৃটিশসৈন্যের সহায়তায় বাজী রাও পুনরায় সিংহাসন পাইলেন। কিন্তু অন্যান্য মারাঠা-নায়কগণ বেসিনের সন্ধিপত্র গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলেন। কিছুদিন পরে পেশোয়া নিজেও তাঁহার হঠকারিতার জন্য অনুতপ্ত হইয়া উঠিলেন, এবং বৃটিশের অধীনতাপাশ ছিন্ন করিবার সুযোগ খুঁজিতে লাগিলেন। অথচা মারাঠা নায়কগণ একত্রে মিলিত হইয়া একযোগে কিছুই করিতে পারিলেন না। সিন্ধিয়া ও ভোঁসলার সহিত মিলিত হইতে অস্বীকার করিয়া হোকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে মালবে চলিয়া গেলেন। এদিকে সিন্ধিয়া ও ভেলা একত্রে মিলিয়াও কিছু করিয়া উঠিতে পারিলেন না। ওয়েলসূলী তাঁহাদের সহিত সন্ধি করিতে চাহিলেন, কিন্তু কোন ফল হইল না। অবশেষে ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দের অগস্ট মাসে তিনি তাঁহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন।
দাক্ষিণাত্যে ও উত্তরাপথে একসঙ্গেই যুদ্ধ বাধিল। দাক্ষিণাত্যে ইংরেজসেনাগণের নায়ক ছিলেন বড়লাটের ভাই সার আর্থার ওয়েলী। ইনি পরে ডিউক অব ওয়েলিংটন নামে বিখ্যাত হইয়াছিলেন। আসাইর যুদ্ধক্ষেত্রে (সেপ্টেম্বর, ১৮০৩ খ্র.) সিন্ধিয়া এবং আরগাঁওর যুদ্ধক্ষেত্রে (নভেম্বর, ১৮০৩ খ্রী.) ভোসলা সম্পূর্ণ পরাজিত হইলেন। উত্তরভারতে সেনাপতি লে দিল্লী ও আগ্রা অধিকার করিয়া লাসোয়ারীর যুদ্ধক্ষেত্রে সিন্ধিয়ার সেনাগণকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন (অক্টোবর, ১৮০৩ খ্রী.)। এইরূপে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলার পরাজয় ঘটিলে সুরজী অর্জুনগাঁও এবং দেবগাঁওর সন্ধিদ্বারা উভয়েই ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ গ্রহণ করিলেন (১৮০৩ খ্রী.)। সিন্ধিয়া রাজপুতানায় চম্বল নদীর উত্তরস্থ ভূখণ্ড, পশ্চিম ভারতের কয়েকটি স্থান ও দোয়ার প্রদেশ, এবং ভেলা উড়িষ্যার কটক ও বালেশ্বর প্রদেশ এবং মধ্যভারতের একটি রাজ্যাংশ ইংরেজদিগকে ছাড়িয়া দিলেন। আহম্মদনগর ও বেরার নিজামের ভাগে পড়িল।
নির্বোধ হোলকার এই সঙ্কটের কালে নিরপেক্ষ থাকিয়া এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন। যুদ্ধের প্রারম্ভেই তিনি কর্নেল মসনের অধীন একদল বৃটিশসেনাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন; কিন্তু অনতিকাল পরেই ডীগের যুদ্ধে (নভেম্বর, ১৮০৪ খ্র.) পরাজিত হইয়া তিনি পঞ্জাব অভিমুখে পলায়ন করিলেন। অতঃপর বৃটিশ সেনাপতি লে ভরতপুরের দুর্গ অবরোধ করিলেন, কারণ ভরতপুরের রাজা হোলকারের সহিত যোগ দিয়াছিলেন। কিন্তু লে ভরতপুর অধিকার করিতে পারিলেন না, বরং তাঁহাকে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া ফিরিতে হইল। অবশেষে ভরতপুরের সহিত সন্ধি স্থাপিত হইল।
এই সমুদয় জয়লাভ সত্ত্বেও ওয়েলেসূলী কোম্পানির ইংলণ্ডস্থ কর্তৃপক্ষের নিকট সমাদর লাভ করিতে পারেন নাই। হোকার কর্তৃক মসনের পরাজয়ের সংবাদ ইংলণ্ডে পৌঁছিবামাত্র কোম্পানির কর্তৃপক্ষগণ ওয়েলেস্লীকে ইংলণ্ডে ফিরিয়া যাইতে আদেশ দিলেন। মহীশূর, নিজাম ও মারাঠাদের শক্তি বিনষ্ট করিয়া ওয়েলেসূলী ভারতে বৃটিশশক্তিকে প্রবলতম ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন করিয়া তুলিয়াছিলেন। বহুদিনব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও তিনি সময় করিয়া নবাগত ইউরোপীয় কর্মচারীদের শিক্ষার জন্য ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপন করিয়াছিলেন (১৮০০ খ্র.)। তাঁহারই অনুসৃত নীতি অনুসারে ভারতশাসনার্থ নির্বাচিত কর্মচারীদিগকে শিক্ষা দিবার জন্য বিলাতে হেলিবেরি নামক স্থানে ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কলেজ স্থাপিত হইয়াছিল।
ওয়েলেস্লীর পর লর্ড কর্ণওয়ালিস্ দ্বিতীয়বার বড়লাট হইয়া শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে ভারতে আসিলেন (১৮০৫ খ্রী.)। তিনি আসিয়াই বিগত যুদ্ধে যে সমুদয় অধিকার লাভ হইয়াছিল, তাহার অনেকগুলি পুনরায় বিপক্ষকে ছাড়িয়া দিলেন। বৃদ্ধ ও জরাগ্রস্ত কর্ণওয়ালিস্ ভারতে আসিয়া তিন মাসের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন।
কর্ণওয়ালিসের মৃত্যুর পর শাসন-পরিষদের প্রাচীনতম সভ্য সার জর্জ বালো বড়লাটের কাজ চালাইতে লাগিলেন (১৮০৫-১৮০৭ খ্রী.)। এই সময়ে লর্ড লেক হোলকারকে পরাজিত করিয়া বিপাশা নদীর তীর পর্যন্ত তাড়াইয়া লইয়া যান। কিন্তু বার্লো তাঁহার সহিত সন্ধি করিলেন। বার্লোর সময় ভেলোরে অবস্থিত সিপাহীগণের বিদ্রোহ হয়। এ বিদ্রোহ সহজেই দমিত হয়। ভেলোরে টিপু সুলতানের আত্মীয়গণ বাস করিতেছিলেন। এই বিদ্রোহের সহিত তাঁহাদের যোগ আছে সন্দেহ করিয়া তাহাদিগকে কলিকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়।
পরবর্তী বড়লাট লর্ড মিন্টো (১৮০৭-১৮১৩ খ্রী.) একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ্ ছিলেন। তাঁহার সময়ে ইংরেজগণ ভারতীয় কোন রাজার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় নাই। তখন ইউরোপে ফ্রান্সের বিখ্যাত সম্রাট নেপোলিয়নের সহিত ইংলণ্ডের যুদ্ধ চলিতেছিল। ভারত মহাসাগর হইতে ফরাসিদের প্রভাব লুপ্ত করিবার উদ্দেশ্যে মিন্টো ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে মরীসা ও বুরবন্ দ্বীপ অধিকার করেন। ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসিদের অনুগত ওলন্দাজগণের অধিকৃত যবদ্বীপও ইংরেজদের অধিকারে আসিয়াছিল।
লর্ড মিন্টোর পরে লর্ড ময়রা গভর্নর জেনারেল হইয়া আসিলেন (১৮১৩ ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ)। পরবর্তীকালে তিনি মারকুইস অব হেস্টিংস উপাধি প্রাপ্ত হন। ইতিহাসে তিনি লর্ড হেস্টিংস নামেই বিশেষ পরিচিত।
১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে নেপালের অন্তর্গত গুখা নামক স্থানের পার্বত্য জাতি নেপাল উপত্যকা অধিকার করিয়াছিল। পঞ্জাব হইতে ভুটান পর্যন্ত হিমালয়ের দক্ষিণাংশ জুড়িয়া তাহাদের রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল। খাগণ প্রায়ই বৃটিশরাজ্যে ঢুকিয়া লুটপাট করিত। সুতরাং ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড হেস্টিংস নেপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। এই যুদ্ধের প্রথমভাগে বড়লাট নিজেই সেনাপতি হইলেন। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে অধস্তন সেনানায়কদের যুদ্ধ-পরিচালনায় অযোগ্যতার জন্য প্রথম প্রথম ইংরেজসৈন্যেরই পরাজয় ঘটিল। গুর্খাদের বিজয় কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হইল না। ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে সেনাপতি অক্টারলোনি সদর্পে গুর্খাদের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হইয়া গেলেন। গুখারা তখন বাধ্য হইয়া সন্ধি করিতে সম্মত হইল। সগৌলির সন্ধির (১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে) শর্ত অনুসারে নেপালের গুখা-দরবার গাঢ়ওয়াল, কুমায়ুন এবং নেপাল তরাই-এর অধিকাংশ স্থান বৃটিশের হস্তে ছাড়িয়া দিল, সিকিমের উপর অধিকার পরিত্যাগ করিল এবং রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে একজন বৃটিশ রাজপ্রতিনিধি গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হইল। সেই সময় হইতে এখন পর্যন্ত নেপালের সহিত ভারতের শান্তি ও সদ্ভাব অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে।
মধ্যভারতে এই সময় ভয়ঙ্কর অরাজকতা ও গোলযোগ চলিতেছিল। দলবদ্ধ দস্যুগণ নির্ভয়ে দেশলুণ্ঠন, নরহত্যা ও অকথ্য নৃশংসতার অনুষ্ঠান করিত। এই দস্যগণের মধ্যে পিণ্ডারিগণই ছিল সর্বপ্রধান। এই পিণ্ডারিদলে সকল জাতি ও সকল ধর্মের লোকই ছিল। সময় সময় পাঠান ও মারাঠাগণও দলবদ্ধ হইয়া ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে চুরি-ডাকাতি করিত। ক্রমে ক্রমে সাহস বৃদ্ধি পাওয়ায় পিণ্ডারিগণ। বৃটিশরাজ্যেও লুটপাট আরম্ভ করিল। তাহাদের নানাপ্রকার নিষ্ঠুরতার বিবরণ শুনিয়া অবশেষে বৃটিশ গভর্নমেন্ট তাহাদিগকে দমন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইল। সকলেই জানিত যে, মারাঠা-নায়কগণ এই পিণ্ডারিগণের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন। সুতরাং লর্ড হেষ্টিংস নাগপুরের ভোসলা রাজার সহিত সন্ধি করিলেন। ভূপাল, উদয়পুর, যোধপুর এবং কোটার রাজার সহিতও মিত্রতা স্থাপিত হইল। অতঃপর লর্ড হেস্টিংস প্রকাণ্ড একদল সৈন্য লইয়া পিণ্ডারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন এবং পিণ্ডারিগণ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হইল (১৮১৮ খ্রী.)। পিণ্ডারিগণের প্রধান তিনজন নায়কের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করিল, চিতু নামে আর-একজন বনের মধ্যদিয়া পলায়নকালে ব্যাঘের মুখে প্রাণ দিল এবং তৃতীয় করিম খাঁকে বস্তি জেলায় বাসস্থান দেওয়া হইল। পিণ্ডারিদের প্রধান পাঠান নায়ক আমির খাঁকে রাজপুতানার অন্তর্গত টঙ্ক নামক স্থানের আধিপত্য দেওয়া হইল। এইরূপে ভারতবর্ষ এক বিষম উৎপাতের হস্ত হইতে রক্ষা পাইল।
মারাঠাগণের সহিতও লর্ড হেস্টিংসের শীঘ্রই যুদ্ধ বাধিয়া গেল। বৃটিশের অধীন হইয়া জীবনযাপন করায় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজী রাওর মনে বিষম অসন্তোষের সৃষ্টি হইয়াছিল। তারপর ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে এক নূতন সন্ধি করিয়া লর্ড হেস্টিংস পেশোয়ার নিকট হইতে কোঙ্কন প্রদেশ এবং কয়েকটি দুর্গ কাড়িয়া লইলেন। দুর্দশার ভরা এবার পূর্ণ হইল। আর সহ্য করতে না পারিয়া ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ছাব্বিশ হাজার সৈন্য লইয়া পেশোয়া পুণার নিকটবর্তী বৃটিশ প্রতিনিধিকে (Resident) আক্রমণ করিলেন। কিরকীতে বৃটিশসৈন্যের সংখ্যা তিন হাজারের বেশী ছিল না। কিন্তু তথাপি পেশোয়া গুরুতররূপে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইলেন। ইহার পর নূতন সৈন্য আসিয়া বৃটিশসৈন্যের দলবৃদ্ধি করিবামাত্র তাহারা পুণা অধিকার করিল। পেশোয়ার সৈন্য আবার আষ্টি নামক যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হইল (ফেব্রুআরি, ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে)।
আন্না সাহেব ভোঁসলাও পেশোয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়াছিলেন, কিন্তু ফল একই হইল। বৃটিশসৈন্য বিপুল মারাঠাবাহিনীকে সীতাবদি ও নাগপুরে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিল (নভেম্বর-ডিসেম্বর, ১৮১৭ খ্রী.)। হোল্কারের সহিতও যুদ্ধ হইল। মাহিদপুরের যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া হোকার ইংরেজের বশ্যতা স্বীকার করিলেন (ডিসেম্বর, ১৮১৭ খ্র.)।
পেশোয়া দ্বিতীয় বাজী রাও, আপ্পা সাহেব ভোঁসলা, ও হোলকার সকলেই বৃটিশের হস্তে আত্মসমর্পণ করিলেন। আপ্পা সাহেব সিংহাসনচ্যুত হইলেন, এবং তাঁহার রাজ্যের যে-অংশ নর্মদা নদীর উত্তরে অবস্থিত ছিল, তাহা বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। এক নূতন রাজা বৃটিশের অধীনতা স্বীকার করিয়া রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ শাসন করিতে লাগিলেন। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজী রাও রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া কানপুরের নিকটস্থ বিরে যাইয়া আবাস স্থাপন করিলেন। তাঁহার জন্য বার্ষিক আট লক্ষ টাকার বৃত্তি নির্দিষ্ট হইল। পেশোয়ার পদ উঠাইয়া দেওয়া হইল ও তাঁহার রাজ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। শিবাজীর এক বংশধর বৃটিশের অধীনে থাকিয়া ক্ষুদ্র সাতারা রাজ্যের রাজা হইলেন। হোকার বিভিন্ন রাজপুত রাজ্যের উপর সমস্ত অধিকার ও দাবি ছাড়িয়া দিলেন। নর্মদা নদীর দক্ষিণে যে সমুদয় স্থান তাঁহার রাজ্যভুক্ত ছিল তাহা ইংরেজকে সমর্পণ করিলেন এবং ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ গ্রহণ করিলেন।
এই সময় প্রধান প্রধান রাজপুত রাজ্য-উদয়পুর, জয়পুর, কোটা, বুন্দী, বিকানীর, কিষণগঞ্জ, জয়সলমীর, সিরোহী প্রভৃতি-ইংরেজের সহিত অধীনতামূলক মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হইল। এইরূপে কোন কোন দেশের সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া এবং কোন কোন দেশের সহিত বিনাযুদ্ধেই সন্ধি স্থাপন করিয়া লর্ড হেস্টিংস প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ বৃটিশের শাসনাধীনে আনিয়া ফেলিলেন। লর্ড ওয়েলেসূলীর আরব্ধ কর্ম এতদিনে সম্পূর্ণ হইল। ভারতে ইংরেজগণ অপ্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিল। পঞ্জাব ও নেপাল ব্যতীত এই সময়ে ভারতে এমন একটিও দেশীয় রাজ্য ছিল না, যাহা সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করিতে পারিত। লর্ড হেস্টিংসের শাসনকালে বৃটিশের সিঙ্গাপুর অধিকার আর-একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই সিঙ্গাপুর পরে বৃটিশ নৌবহরের একটি প্রধান আশ্রয়স্থান হইয়া উঠিয়াছিল।
ওয়ারেন হেস্টিংস এবং ওয়েলেস্লীর ন্যায় লর্ড হেস্টিংসকেও অপদস্থ হইয়া ভারতবর্ষ ত্যাগ করিতে হয়। পামার এণ্ড কোং নামক বিখ্যাত ব্যাঙ্কের নিন্দনীয় কার্যাবলী আলোচনা করিয়া ইংলণ্ডস্থ কর্তৃপক্ষগণ লর্ড হেস্টিংসের বিরুদ্ধে এক ভর্ৎসনামূলক মন্তব্য প্রকাশ করেন। তাহাতেই তিনি পদত্যাগ করিয়া ভারত ছাড়িয়া যান।
২. পূর্বাঞ্চলে সাম্রাজ্য বিস্তার
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ন্যায় পূর্বাঞ্চলেও ইংরেজগণ রাজ্য অধিকার করিয়া সীমান্ত সুদৃঢ় করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিল। ভারত মহাসাগরে প্রভাব-প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া সমুদ্রপথে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার অভিপ্রায়ে ইংরেজগণ সিংহল, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং সিঙ্গাপুর ও মালয় উপদ্বীপ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিল। এই সমুদ্রপথে বিস্তৃত চীনদেশ ও প্রাচ্য দ্বীপপুঞ্জের (East Indies) সহিত অবাধ বাণিজ্য করা তাহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
সার স্ট্যামফোর্ড র্যাফেলস নামক কোম্পানির একজন বিশিষ্ট কর্মচারী ভারতের পূর্ব-দ্বীপাঞ্চল পর্যবেক্ষণ করিয়া মালয় উপদ্বীপের প্রান্তসীমায় অবস্থিত তরুগুল্মে আচ্ছাদিত বিস্তৃত জলাভূমি সিঙ্গাপুর দ্বীপে একটি ঘাঁটি স্থাপন করিতে পরামর্শ দেন। লর্ড ময়রা তাঁহার উদ্দেশ্যের গুরুত্ব বুঝিয়া ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে সিঙ্গাপুরে বৃটিশপ্রাধান্য স্থাপন করেন। যখন সিঙ্গাপুর তাহাদের অধিকারে আসে, তখন ইহাকে এক বিরাট নৌ-ঘাঁটিতে পরিবর্তিত করা হয়, এবং ইহা পূর্ব সমুদ্ৰাঞ্চলের একটি প্রধান সামরিক ও বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। ইহার ফলে একদিকে ভারতের সমুদ্রোপকূলবর্তী পূর্বাঞ্চল সুরক্ষিত হয়, অপরদিকে চীনদেশ ও পূর্ব দ্বীপাঞ্চলে অবাধ বাণিজ্য চলিতে থাকে।
পরবর্তী বড়লাট লর্ড আমহাষ্ট্রের শাসনকালে (১৮২৩-২৮ খ্রী.) ব্ৰহ্মদেশের সহিত যুদ্ধ হয়। পলাশীর যুদ্ধের অনতিপূর্বে আলোমর অধীনে ব্রহ্মদেশে একটি শক্তিশালী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় (১৭৫০ খ্রী.)। তাঁহার পরবর্তী রাজা বোড়পায়া (১৭৭৯-১৮১৯ খ্রী.) আরাকান (১৭৮৪ খ্রী.) ও মণিপুর রাজ্য (১৮১৩ খ্র.) জয় করেন। ইহার পূর্বেই টেনাসেরিম প্রদেশ ব্রহ্মরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় (১৭৬৬ খ্রী.)। এইরূপে ভারতে ইংরেজরাজত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব-সীমান্তে একটি শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব হওয়ায় উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হইয়া উঠিল। ব্রহ্মরাজ কর্তৃক বিজিত রাজ্যের অধিবাসীরা দলে দলে ইংরেজরাজ্যে পলাইয়া আসে এবং মাঝে মাঝে ব্ৰহ্মরাজ্যের সীমান্ত পার হইয়া উপদ্রব করে। ব্রহ্মরাজ ইহাদিগকে তাহার হস্তে অৰ্পণ করিবার জন্য ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ করেন এবং ইংরেজ সরকার ইহাতে সম্মত না-হওয়ায় বিষম ক্রুদ্ধ হন। ফলে ইংরেজ যখন পিণ্ডারি যুদ্ধে ব্যস্ত তখন ব্রহ্মরাজ লর্ড হেস্টিংসের নিকট এক পত্রে দাবি করেন যে যেহেতু মধ্যযুগে চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং কাশিমবাজার প্রভৃতি অঞ্চল আরাকান রাজ্যকে কর দিত, অতএব ঐ সমুদয় অঞ্চল ব্রহ্মরাজকে ফিরাইয়া দেওয়া হউক। বড়লাট এই পত্র ফেরত দিয়া লিখিলেন যে ইহা সম্ভবতঃ কেহ জাল করিয়াছে। কিন্তু ইহার তিন-চারি বৎসর পরেই ব্রহ্মরাজ আসাম জয় করিলেন (১৮২১-২২ খ্র.) এবং চট্টগ্রামের অনতিদূরে শাহপুরী নামে ইংরেজ অধিকৃত একটি দ্বীপ দখল করিয়া বঙ্গদেশ আক্রমণের উদ্যোগ করিলেন। ইহার ফলে ১৮২৪ সনের ২৪ ফেব্রুআরি তারিখে আমহার্ট ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ইংরেজসৈন্য আসাম হইতে বর্মীদিগকে বিতাড়িত করিল, কিন্তু আরাকানে বর্মী সেনাপতি বালার হস্তে পরাজিত হইল। আমহার্ট সমুদ্রপথে স্টিমারে একদল সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। তাহারা রেঙ্গুন দখল করিল, কিন্তু ব্রহ্মদেশ সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞতা না-থাকায় এবং সুবন্দোবস্তের অভাবে বহু সৈন্যের মৃত্যু হইল। এই সৈন্যের গতিরোধ করার জন্য আরাকান হইতে বর্মীসৈন্য আসিল। প্রথম প্রথম তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল এবং ভারতীয় সৈন্য নিম্ন ব্রহ্মদেশের রাজধানী প্রোম নগরী দখল করিল। ১৮২৫ সনের শেষভাগে এই সৈন্যদল ব্রহ্মদেশের রাজধানী আভা শহরের ৬০ মাইলের মধ্যে পৌঁছিলে ব্রহ্মরাজ ইংরেজের সহিত সন্ধি করিলেন। ১৮২৬ সনে ইয়ান্দাবো নামক স্থানে এই সন্ধি স্বাক্ষরিত হইল। ইহার শর্ত অনুসারে ব্রহ্মরাজ আসাম, আরাকান, তেনাসেরিমের উপকূল ও মার্তাবানের এক অংশ ইংরেজকে দিলেন এবং এক কোটি টাকা দিতে এবং একজন ইংরেজ প্রতিনিধি তাঁহার রাজধানীতে রাখিতে সম্মত হইলেন।
এইরূপে ভারতের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত আসামে ইংরেজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইল। ব্রহ্মযুদ্ধের সময় আসামবাসীদের সাহায্য ও সহানুভূতি লাভের আশায় ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল যে, বর্মীরা বিতাড়িত হইলেই আসাম পুনরায় তাহার স্বাধীনতা ফিরিয়া পাইবে। ব্রহ্মযুদ্ধ শেষ হইবামাত্র ইংরেজ আসামের কিয়দংশ স্বীয় রাজ্যভুক্ত করিল এবং অবশিষ্ট অংশে কয়েকটি সামন্তরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিল। কিন্তু ১৮৩৪ সনে কাছাড়ের মধ্যভাগ, ১৮৩৫ সনে জয়ন্তিয়া, ১৮৩৫ সনে আসামের বাকী অংশ এবং ১৮৫৪ সনে কাছাড়ের বাকী অংশ নানা অজুহাতে বৃটিশের রাজ্যভুক্ত করা হইল।
৩. আফঘান যুদ্ধ
এইরূপে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করিয়া ইংরেজ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। ভারতে ইংরেজরাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে পঞ্জাব প্রদেশে শক্তিশালী শিখরাজ্য এবং তাহারও পশ্চিমে পর্বতসঙ্কুল আফগান রাজ্য অবস্থিত ছিল। এই উভয়ের সহিতই ইংরেজের সংঘর্ষ বাধিল। আফগানিস্থানে ও পারস্যে রাশিয়ার ক্ষমতার দ্রুত প্রসার দেখিয়া বৃটিশ মন্ত্রিসভা হইতে ভারতের বড়লাট লর্ড অ্যাণ্ডের (১৮৩৬-১৮৪২ খ্রী.) উপরে আদেশ আসিল, আফগানিস্থানে রাশিয়ার প্রভাবের প্রসার নিবারণ করিতে হইবে। তৎকালে আহম্মদ শাহ্ দুরানীর পৌত্র কাবুলরাজ শাহ্ সুজা ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার রাজ্য হইতে বিতাড়িত হইয়া লুধিয়ানায় বাস করিতেছিলেন। ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে দোস্তৃ মুহম্মদ খাঁ নামক এক ব্যক্তি কাবুল ও গজনী অধিকার করিলে শাহ্ সুজা তাঁহার রাজ্য পুনরুদ্ধার করিতে চেষ্টা করিয়াও ব্যর্থ হন। এই সময়ে লর্ড অকল্যাণ্ড শাহ্ সুজাকে আবার কাবুলের সিংহাসনে বসাইয়া সেখানে বৃটিশের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার সংকল্প করিলেন। শাহ্ সুজার সহিত একদল বৃটিশসৈন্য আফগানিস্থানে গিয়া ধীরে ধীরে কান্দাহার, গজনী ও কাবুল অধিকার করিল। দোস্ত মুহম্মদ পলাইয়া গেলেন এবং শাহ্ সুজাকে কাবুলের সিংহাসনে স্থাপিত করা হইল (১৮৩৯ খ্র.)। কিছুদিন পরে দোস্থ মুহম্মদ আত্মসমর্পণ করিলে তাহাকে বন্দী অবস্থায় কলিকাতায় লইয়া আসা হইল (১৮৪০ খ্র.)।
অকল্যাণ্ড দশ হাজার সৈন্য ও তাহাদের অসংখ্য অনুচরদিগকে আফগানিস্থানে রাখিয়া বাকী সৈন্য ভারতবর্ষে সরাইয়া আনিলেন। এদিকে শাহ্ সুজা আফগান জনসাধারণের বিরাগভাজন হওয়ায় চারিদিকে বিদ্রোহ আরম্ভ হইল। ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে দোস্থ মুহম্মদের পুত্র আকবর খাঁ কাবুলে তিনজন ইংরেজ কর্মচারী নিহত করিলেও ইহার কোন প্রতিশোধ না লইয়াই কাবুলের ইংরেজ প্রতিনিধি ম্যানটেন আকবর খাঁর সহিত সন্ধি করিলেন (১১ই ডিসেম্বর, ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দ)। এই সন্ধির শর্ত হইল, ইংরেজসৈন্য কাবুল ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে এবং দোস্ত মুহম্মদ পুনরায় কাবুলের সিংহাসনে বসিয়া আফগানিস্থানে রাজত্ব করিবেন। এই সন্ধি স্বাক্ষরিত হইবার বারো দিন পরেই আকবর খাঁর সহিত সাক্ষাতের কালে ম্যানটেন ও তাঁহার একজন সঙ্গী নিহত হইলেন, এবং অপর দুইজন ইংরেজ বন্দী হইল। এই হত্যারও কোন প্রতিশোধ না লইয়াই বৃটিশসৈন্য বন্দুক, কামান ও গোলাগুলি প্রভৃতি আফগানদের হস্তে সমৰ্পণ করিল এবং ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জানুআরি তারিখে সাড়ে চারি হাজার সৈন্য ও তাহাদের বারো হাজার অনুচর কাবুল ছাড়িয়া ভারত অভিমুখে যাত্রা করিল। কিন্তু আফগানগণ তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া তাহাদিগকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। কেবল একজন মাত্র ইংরেজ জালালাবাদে পৌঁছিল, বাকী সমস্ত সৈন্য ও অনুচর পথেই নিহত অথবা বন্দী হইল।
এই দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরেই অকল্যাণ্ড ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া গেলেন, এবং তাঁহার স্থানে লর্ড এলেনবরা (১৮৪২-১৮৪৪ খ্রী.) বড়লাট নিযুক্ত হইয়া আসিলেন। জালালাবাদ আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইল বটে, কিন্তু গজনীস্থিত বৃটিশসৈন্য আত্মসমর্পণ করিল এবং শাহ্ সুজা আফগানদের হাতে নিহত হইলেন। এইবার জালালাবাদ হইতে একদল এবং কান্দাহার হইতে আর একদল বৃটিশসৈন্য কাবুলের দিকে যাত্রা করিল। কাবুল অধিকার করিয়া তাহারা কাবুলের বিস্তৃত বাজার তোপে উড়াইয়া দিল এবং বৃটিশ বন্দীদিগকে উদ্ধার করিয়া পেশোয়ারে ফিরিয়া আসিল। গজনী নগরী ও দুর্গও ধ্বংস করা হইল। ইহার পর এলেনবরা আফগানিস্থানের আভ্যন্তরিক ব্যাপারে আর হস্তক্ষেপ করা সঙ্গত বোধ করিলেন না, এবং দোস্ত মুহম্মদকে বিনাশর্তে কাবুলের সিংহাসন ফিরাইয়া দিলেন (১৮৪২ খ্র.)। দোস্ত মুহম্মদ ইংরেজদের সহিত মিত্রতা রক্ষা করিয়া চলিতেন।
৪. সিন্ধুদেশ ও পঞ্জাব
প্রথম আফগানযুদ্ধের পরই ইংরেজ সিন্ধুদেশ অধিকার করিল। আমির নামে পরিচিত বেলুচি নায়কগণ সিন্ধুদেশ শাসন করিতেন। ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড মিন্টো এই আমিরগণের সহিত মিত্ৰতামূলক এক স্থায়ী সন্ধি করেন। ১৮২০ ও ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে এই সন্ধি আবার নূতন করিয়া করা হয়। কিন্তু ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড অ্যাণ্ডের সময়ে আফগানিস্থানের সহিত যখন ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধ আরম্ভ হইল, তখন ইংরেজ সরকার সমুদয় সন্ধির শর্ত অগ্রাহ্য করিয়া সিন্ধুদেশের মধ্যদিয়া সৈন্যবাহিনী পাঠাইল এবং সিন্ধুদেশের কয়েকটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিল। আফগানযুদ্ধের সময় সিন্ধুদেশের উপর অধিকার রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করিয়া লর্ড অকল্যাণ্ড ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে আমিরগণকে ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ গ্রহণ করিতে বাধ্য করিলেন। ইহার ফলে তাহাদের স্বাধীনতা বিনষ্ট হইল। কিন্তু ইহাতেও তৃপ্ত না হইয়া সিন্ধুদেশ সম্পূর্ণরূপে জয় করিবার উদ্দেশ্যে লর্ড এলেনবরা সার চার্লস্ নেপিয়ার নামক একজন কর্মচারীকে প্রতিনিধিরূপে সিন্ধুদেশে প্রেরণ করিলেন। তিনি আমিরদের বিরুদ্ধে কতকগুলি মিথ্যা অভিযোগ আনিয়া ঘোষণা করিলেন যে, তিনি অবিলম্বে সিন্ধুদেশের কতকগুলি জায়গা দখল করিবেন। একদল বেলুচি নেপিয়ারের দুর্ব্যবহারে উত্ত্যক্ত হইয়া কর্নেল আউটরামের আবাস ভবন আক্রমণ করিল। অমনি আমিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হইলে, আমিরগণ মিয়ানি ও দাবো নামক দুই স্থানে যুদ্ধে পরাজিত হইলেন (১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দ)। সিন্ধুদেশ ইংরেজ-রাজ্যভুক্ত করা হইল, এবং আমিরগণ নির্বাসিত হইলেন। এই সিন্ধুদেশ অধিকার সম্পর্কিত সমস্ত ব্যাপারেই ইংরেজগণ নানা ছলচাতুরীর সাহায্য লয় এবং সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করিয়া এই উদ্দেশ্য সাধন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রণজিৎ সিংহের (১৭৮০-১৮৩৯ খ্র.) নেতৃত্বে পঞ্জাবে শিখজাতি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হইয়া উঠিয়াছিল। রণজিতের জন্মের সাত বৎসর আগেই শিখরা পূর্বে শাহারানপুর হইতে পশ্চিমে আটক ও দক্ষিণে মুলতান হইতে উত্তরে কাংড়া এবং জম্মু পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগে আধিপত্য স্থাপন করে। যদিও শিখরা অমৃতসরে মিলিত হইয়া শিখ সম্প্রদায়ের নামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও মুদ্রা প্রচার করে, তবু তাহারা তখন বারোটি মিসূল অর্থাৎ ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিল। এই বিচ্ছিন্ন দলগুলিকে একতাবদ্ধ করিয়া একটি শক্তিশালী শিখরাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই রণজিৎ সিংহের সর্বপ্রধান কীর্তি। রণজিৎ সিংহের পিতা মহাসিংহ একটি শিখ মিসূলের নায়ক ছিলেন। তিনি অপরাপর কয়েকটি শিখ মিসূলের উপর আধিপত্য স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার অকালমৃত্যু ঘটে। তখন রণজিতের বয়স মাত্র দশ বৎসর। ১৭৯৩ হইতে ১৭৯৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে আফগানিস্থানের আমির জমান শাহ্ পঞ্জাব আক্রমণ করিয়া ইহার কতকাংশ অধিকার করেন। বালক রণজিৎ নানাভাবে তাঁহাকে সাহায্য করায় জমান শাহ্ তাঁহাকে ১৭৯৮ খ্রীষ্টাব্দে লাহোরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন, এবং পরে ‘রাজা’ উপাধি দেন। ইহার কিছুকাল পরেই রণজিৎ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং ক্রমে ক্রমে শতদ্রু নদীর পশ্চিমে অবস্থিত সমুদয় শিখ মিল তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। ইউরোপীয় সামরিক কর্মচারী দ্বারা সুশিক্ষিত তাঁহার বিখ্যাত খালসা সেনাবাহিনী শৌর্যবীর্য ও রণকৌশলে অদ্বিতীয় হইয়া উঠিয়াছিল।
শতদ্রু নদীর পূর্বদিকের অধিবাসী শিখ-নায়করা সর্বদা পরস্পরের মধ্যে বিবাদ করিতেন। তাঁহাদের একজনের অনুরোধে রণজিৎ শতদ্রু অতিক্রম করিয়া লুধিয়ানা অধিকার করিলেন (১৮০৬ খ্রী.)। কিন্তু ঐ শিখ-নায়কগণের কেহ কেহ রণজিতের বিরুদ্ধে বড়লাট লর্ড মিন্টোর (১৮০৭-১৮১৩ খ্রী.) নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিলে মিন্টো মেটকাফকে রণজিতের সভায় দূতরূপে প্রেরণ করিলেন, তখন অমৃতসরের সন্ধি দ্বারা রণজিতের সহিত বৃটিশ সরকারের স্থায়ী বন্ধুত্ব স্থাপিত হইল (১৮০৯ খ্রী.)। রণজিৎ শতদ্রর পূর্বদিকস্থ শিখ-নায়কগণের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবেন না বলিয়া অঙ্গীকার করিলেন, ফলে ঐসকল শিখ-নায়ক বৃটিশের অধীন হইয়া গেল। এইরূপে বিনা যুদ্ধে ও বিনা রক্তপাতে বৃটিশরাজ্যের সীমানা শতদ্রু পর্যন্ত বিস্তৃত হইল।
লর্ড মিন্টোর সহিত সন্ধি করিবার পর রণজিৎ সিংহ পূর্বদিকে রাজ্য বিস্তার করিতে না পারিয়া অন্যান্য অঞ্চল জয় করেন। ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে আফগানিস্থানের রাজা শাহ্ সুজা রাজ্য হইতে বিতাড়িত হইয়া লাহোরে আশ্রয় গ্রহণ করিলে রণজিৎ তাঁহার নিকট হইতে জগদ্বিখ্যাত কোহিনুর হীরকখণ্ড আদায় করেন। ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে রণজিৎ সিংহের মৃত্যুকালে শিখরাজ্য সিন্ধু হইতে শতদ্রু পর্যন্ত সমগ্র পঞ্জাব প্রদেশ এবং পেশোয়ার, কাংড়া ও কাশ্মীর জুড়িয়া বিস্তৃত ছিল।
রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন লইয়া বিবাদ বাধিল। এই সময়ে কাশ্মীরের হিন্দু ডোগরা জাতীয় কয়েকজন নায়ক পঞ্জাবরাজ্যে খুব শক্তিশালী ছিলেন এবং তাহাদের ও কয়েকজন শিখসর্দারের ষড়যন্ত্রে রাজ্যের শাসন ব্যাপারে ভয়ানক বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। রণজিতের পুত্র ও উত্তরাধিকারী খরক সিংহ অতিশয় অপদার্থ ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার বিধবা রাণীর সহিত রণজিতের অপর পুত্র শের সিংহের বিবাদ বাধিল। শের সিংহ রাজ্য অধিকার করিলেন কিন্তু এই সমুদয় আভ্যন্তরিক বিপ্লবের ফলে রণজিতের প্রবল প্রতাপশালী খালসা সৈন্যই দেশের সর্বেসর্বা হইয়া উঠিল। শের সিংহের মৃত্যুর পর তাহারা রণজিতের ছয় বৎসরের শিশুপুত্র দলীপ সিংকে সিংহাসনে বসাইল (১৮৪৩ খ্রী.)। তাঁহার মাতা ঝিন একজন নর্তকী ছিলেন। বিস্তৃত শিখরাজ্যের শাসন তখন প্রকৃতপক্ষে রাণী ঝিন্দন ও তাঁহার দুই মন্ত্রী লাল সিংহ ও তেজ সিংহের উপর ন্যস্ত হইয়াছিল। ইঁহাদের কেহই খালসা সৈন্যের বিশ্বাসভাজন ছিলেন না। লাল সিংহ ও তেজ সিংহ গোপনে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতেন এবং সম্ভবতঃ রাণী ঝিনও ইহা জানিতেন। শিখরাজ্যের আভ্যন্তরিক গোলযোগ ও প্রধান নায়কদের সহিত ষড়যন্ত্রের সুযোগ লইয়া বৃটিশ গভর্নমেন্ট শিখরাজ্য আক্রমণের জন্য ইহার প্রান্তদেশে বহু সৈন্য সমাবেশ করিল ও শতদ্রু নদী পার হইবার জন্য নৌকার সেতু প্রস্তুত করারও ব্যবস্থা করিল। ইহা প্রতিরোধ করিবার জন্য শিখসৈন্যও প্রস্তুত হইল এবং একদল শিখসৈন্য শতদ্রু নদী পার হইয়া অপরপারে শিখরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এক স্থানে সমবেত হইল (১৮৪৫ ডিসেম্বর)। অমনি বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-শিখসৈন্য বৃটিশরাজ্য আক্রমণ করিয়াছে এই অজুহাতে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন।
পর পর মুদকী, ফিরোজশা এবং আলিওয়াল–এই তিনটি যুদ্ধে শিখসৈন্য ইংরেজসৈন্য কর্তৃক পরাজিত হইল এবং শিখরা শতদ্রু নদীর পশ্চিমতীরে সরিয়া আসিতে বাধ্য হইল। শেষ যুদ্ধ হইল সোব্রাও নামক স্থানে। এই সমুদয় যুদ্ধে শিখসৈন্যগণ অসীম বীরত্ব ও ধৈর্যের সহিত যুদ্ধ করিলেও অধিকাংশ সেনানায়কগণের অদূরদর্শিতায় এবং লাল সিংহ, তেজ সিংহ ও ডোগরা গোলাব সিংহের বিশ্বাসঘাতকতায় তাহারা সম্পূর্ণ পরাজিত হইল (১৮৪৫-১৮৪৬ খ্রী.)। কিন্তু তাহাদের সাহস ও রণকৌশল শত্রু-মিত্র সকলকেই চমৎকৃত করিয়াছিল, এবং ইংরেজের পক্ষে দারুণ সৈন্যক্ষয় হইয়াছিল। যুদ্ধের পরেই ৯ই মার্চ লাহোরের সন্ধি দ্বারা শান্তি স্থাপিত হইল। এই সন্ধির শর্ত ঐ বত্সর ১৬ই ডিসেম্বর আর-একটি সন্ধি দ্বারা কতক পরিবর্তিত হইল। মোটের উপর শিখদিগকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং কাশ্মীর প্রদেশ, হাজরা জেলা, বিপাশা ও শতদ্রু নদীর মধ্যস্থিত জালন্ধর দোয়াব ও শতদ্রর দক্ষিণদিকস্থ সমস্ত ভূভাগ ইংরেজদিগকে ছাড়িয়া দিতে হইল। বালক দলীপ সিংহ নামেমাত্র রাজা রহিলেন, এবং আটজন শিখসর্দার লইয়া গঠিত এক দরবারের উপর পঞ্জাবের শাসনভার অর্পিত হইল। কিন্তু পঞ্জাবের শাসনকার্য প্রকৃতপক্ষে বৃটিশ রাজপ্রতিনিধি সাব্লু হেনরী লরেন্সের হস্তেই ন্যস্ত হইল। একদল বৃটিশসৈন্য লাহোরে স্থাপিত হইল এবং শিখসৈন্যের সংখ্যা কমাইয়া দেওয়া হইল। ইংরেজগণ কাশ্মীর ও জম্মু রাজ্য পঞ্চাশ লক্ষ টাকা মুল্যে লাহোর দরবারের ডোগরা সর্দার গোলাব সিংহের নিকট বিক্রয় করিল।
শিখদের সহিত সন্ধি বেশিদিন স্থায়ী হইল না। ইংরেজ প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিবার অভিযোগে রাণী ঝিন্দনকে লাহোর হইতে দেশান্তরে প্রেরণ করাতে তাহারা ভীষণ ক্রুদ্ধ হইল। অবশেষে মুলতানের শাসনকর্তা দেওয়ান মুলরাজকে লইয়া গোলযোগ বাধিল। লাহোরের দরবার আর্থিক সমস্যায় বিপন্ন মুলরাজের নিকট পঁচাত্তর লক্ষ টাকা দাবি করায় তিনি পদত্যাগ করেন এবং নানা কারণে বিদ্রোহী হন। ক্রমে অন্যান্য শিখ-নায়কগণ মুলরাজের সহিত যোগ দেন। এই বিদ্রোহের ফলে ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে বড়লাট লর্ড ডালহৌসী (১৮৪৮-১৮৫৬ খ্রী.) শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ঝিলাম নদীর তীরে চিলিয়াওয়ালা প্রান্তরে ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই জানুআরি শিখ ও ইংরেজ সৈন্যের ভীষণ যুদ্ধ হইল। যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের কোন চূড়ান্ত মীমাংসা হইল না, কিন্তু ইংরেজপক্ষে গুরুতর লোকক্ষয় হইল। কিছুদিন পরেই বৃটিশসৈন্য মুলতান অধিকার করিল। ইহার পর চিনাবের তীরে গুজরাট নামক স্থানে শিখসৈন্যদল সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল (২১শে ফেব্রুআরি ১৮৪৯ খ্রী.)। লর্ড ডালহৌসী পঞ্জাব ইংরেজরাজ্যের অন্ত র্ভুক্ত করিয়া ফেলিলেন।
৫. ডালহৌসীর আমলে সাম্রাজ্য বিস্তৃতি
বড়লাট লর্ড ডালহৌসীর শাসনকালে আরও অনেক দেশ ইংরেজরাজ্যভুক্ত হয়। প্রথম ব্রহ্মযুদ্ধের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অনেক ইংরেজ বণিক প্রথম ব্ৰহ্মযুদ্ধের পর ব্রহ্মদেশের দক্ষিণ উপকূলে বাস স্থাপন করিয়াছিল। তাহারা ভারতের বড়লাটের নিকট অভিযোগ করিল যে, রেঙ্গুনের শাসনকর্তা তাহাদের উপর অত্যাচার করিতেছেন। বড়লাট লর্ড ডালহৌসী এই অত্যাচারের ক্ষতিপূরণ এবং রেঙ্গুনের শাসনকর্তাকে সরাইবার দাবি জানাইয়া একজন নৌ-সৈন্যাধ্যক্ষকে যুদ্ধজাহাজসহ ব্ৰহ্মরাজের নিকট পাঠাইলেন। ব্রহ্মরাজ তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা করিয়া রেঙ্গুনের শাসনকর্তাকে পদচ্যুত করিলেন, এবং সন্ধির কথাবার্তার জন্য অন্য একদল লোক নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু ইংরেজ-দূত একটি তুচ্ছ কারণে নিজেকে অপমানিত জ্ঞান করিয়া রেঙ্গুন বন্দর অবরোধ এবং ব্রহ্মরাজের একখানি জাহাজ আটক করিলেন। ইহাতে উভয়পক্ষ হইতেই গুলিগোলা বর্ষিত হইল। তখন ডালহৌসী এই কার্যের জন্য দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করিলেন, এবং ব্রহ্মরাজ ইহা নির্ধারিত দিবসের পূর্বে না-দেওয়ায় ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। ইংরেজসৈন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মার্তাবান, রেঙ্গুন, বেসিন, প্রেম ও পেণ্ড অধিকার করিল। ডালহৌসী ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এক ঘোষণাপত্র দ্বারা পেগু অথবা নিম্ন-ব্রহ্মপ্রদেশ ইংরেজরাজ্যভুক্ত করিলেন। ব্রহ্মদেশের অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের সমস্ত উপকূলভাগই ইংরেজের অধীন হইল।
বিনাযুদ্ধে ডালহৌসী ভারতের অনেক রাজ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এগুলির মধ্যে অযোধ্যার রাজ্যটি আত্মসাৎ করা ডালহৌসীর শাসনের একটি গুরুতর কলঙ্ক। অযোধ্যার সহিত মিত্রতার সুযোগ লইয়া ওয়ারেন হেস্টিংস, সার জন্ শোর ও ওয়েলস্লী কিরূপে ধীরে ধীরে অযোধ্যা রাজ্যে ইংরেজপ্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া ইংরেজ সরকার সমস্ত অযোধ্যা রাজ্যটি গ্রাস করিবার সংকল্প করিলেন। অযোধ্যার নবাবকে স্পষ্টভাবে বলা হইল যে, তাঁহার রাজ্যের শাসনব্যবস্থা খুবই খারাপ–এই ব্যবস্থাকে উন্নত করিয়া না তুলিলে, তাঁহার রাজ্য ইংরেজরাই অধিকার করিবে। অযোধ্যার রাজ্যে যে অত্যাচার ও কুশাসন চলিতেছিল, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই অব্যবস্থার জন্য প্রধানত ইংরেজরাই দায়ী ছিল। কারণ বৃটিশ সরকার অয্যেধ্যায় ইংরেজসৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া উহার খরচ বাবদ ও অন্যান্য অজুহাতে বহু অর্থ শোষণ করিতেন; ইহা ছাড়া সরকারের নিয়োজিত অনেক ইংরেজ কর্মচারী অযোধ্যায় যথেচ্ছ অত্যাচার করিত। দেশের সৈন্যবল ইংরেজের হাতে থাকায় নবাব কোন কার্যেই তাহাদিগকে বাধা দিতে বা প্রতিবাদ করিতে পারিতেন না। এক নবাবের মৃত্যু হইলে ইংরেজ সরকার নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিকে নবাবী পদ দিয়া তাহার সহিত নূতন সন্ধি করিতেন, এবং অনেক নূতন নূতন অধিকার তাঁহাদের হস্তগত হইত।
বড়লাট লর্ড ডালহৌসীর প্রধান নীতি ছিল, যে-কোন নূতন রাজ্য অধিকারের সুযোগসুবিধা উপস্থিত হইলে তিনি কিছুতেই তাহা ছাড়িবেন না। পেশু ও পঞ্জাব অধিকার এই নীতিরই নিদর্শন। অযোধ্যার ব্যাপারেও ডালহৌসী এই নীতিরই অনুসরণ করিলেন। তাহার পূর্ববর্তী বড়লাটগণ অযোধ্যার কুশাসন বিষয়ে নবাবকে সাবধান করিয়াছিলেন। ডালহৌসীও এই সুযোগই গ্রহণ করিলেন। তিনি অযোধ্যার ইংরেজ প্রতিনিধিকে আদেশ দিলেন তিনি যেন সরজমিনে তদন্ত করিয়া সমগ্র অযোধ্যা প্রদেশের অবস্থা সম্বন্ধে একটি বিবৃতি বা রিপোর্ট লিখিয়া পাঠান। যথাসময়ে এই রিপোর্ট দাখিল হইল, এবং ইহাতে অযোধ্যার শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক বিরুদ্ধ মন্তব্য ছিল। ইহাতে স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছিল-রাজ্যের প্রজাবর্গ নানাপ্রকার অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতেছে; তালুকদারদের উৎপীড়নের কোন সীমা নাই; দেশে চুরি-ডাকাতি, খুনখারাপি লাগিয়াই আছে; লোকের ধন প্রাণ মোটেই নিরাপদ নহে; নবাব বিলাসিতায় মত্ত, রাজকার্যের দিকে দৃষ্টিই দেন না, তাঁহার সভাসদ ও কর্মচারীরা লোকের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার লুটতরাজ করে ইত্যাদি।-এই রিপোর্টের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। রিপোর্টের উপসংহারে লেখা ছিল,-অযোধ্যার সকল শ্রেণীর প্রজাবর্গেরই একান্ত ইচ্ছা যে, নবাবকে পদচ্যুত করিয়া এখানে ইংরেজশাসন প্রবর্তিত হউক। একথাটি যে সত্য নহে, তাহার প্রমাণস্বরূপ বলা যায় যে, অযোধ্যার নবাবকে যখন সত্যসত্যই পদচ্যুত করা হইল, তখন ঐ রাজ্যের সর্বশ্রেণীর লোকই খুব অসন্তুষ্ট হয়, এবং অনেকে মনে করেন যে, সিপাহী বিদ্রোহের সময় অযোধ্যায় যে ইংরেজদের দুর্দশা হইয়াছিল, প্রজাবর্গের অসন্তোষই ইহার প্রধান কারণ। অথচ ডালহৌসী এই রিপোর্টের উপর নির্ভর করিয়াই অযোধ্যা ইংরেজরাজ্যভুক্ত করিবার ব্যবস্থা করিলেন।
নবাবকে বলা হইল, তিনি যদি সন্ধিপত্র দ্বারা বৃটিশের হস্তে রাজ্য সমর্পণ করেন, তবে তাঁহাকে বাৎসরিক পনের লক্ষ টাকা বৃত্তি দেওয়া হইবে এবং তাঁহার নবাব উপাধিও বজায় থাকিবে। নবাব এই প্রস্তাবে স্বীকৃত না-হওয়ায়, এক ঘোষণাপত্র দ্বারা তাঁহার রাজ্য অধিকার করা হইল (১৮৫৬ খ্র.)। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্ কলিকাতায় নির্বাসিত হইলেন। তাঁহার জন্য বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা বৃত্তি নির্ধারিত হইল।
ইংরেজদের সহিত সন্ধির শর্ত অনুসারে হায়দরাবাদের নিজাম নিজের ব্যয়ে একদল ইংরেজসৈন্য পোষণ করিতেন। ক্রমে ক্রমে এই সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল, এবং ইহার ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ টাকা বাকি পড়িল। ডালহৌসী নিজামকে স্পষ্টভাবে জানাইলেন যে, বহু টাকা বাকি থাকায় অসুবিধা ও অসন্তোষের সৃষ্টি হইতেছে; সুতরাং সৈন্যের ব্যয় বহন করিবার জন্য তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত বেরার প্রদেশটি ইংরেজের হাতে ছাড়িয়া দিলে ভাল হইবে। নিজাম তখন বলিলেন যে, আমার দেশে কোন যুদ্ধবিগ্রহ নাই, ইংরেজসৈন্যেরও তেমন কোন প্রয়োজন নাই। সুতরাং সন্ধির শর্তানুযায়ী যে সৈন্যসংখ্যা আমার পোষণ করিবার কথা, তাহার অতিরিক্ত ইংরেজসৈন্য এখান হইতে ফিরাইয়া নেওয়া হউক। ইহার জবাবে ডালহৌসী বলিলেন, আচ্ছা, ধীরে ধীরে আমাদের সৈন্যসংখ্যা কমানো যাইবে, কিন্তু যতদিন তাহা না হয়, ততদিন পর্যন্ত সমস্ত ইংরেজসৈন্যের ব্যয় নির্বাহের জন্য বেরার প্রদেশটি ছাড়িয়া দিতেই হইবে। বড়লাটের এই দাবির ফলে নিজামকে বাধ্য হইয়া ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে এক নূতন সন্ধি করিতে হইল। এই সন্ধির শর্ত অনুসারে বেরার প্রদেশ, রাইচুর, দোয়াব এবং আরও কয়েকটি গ্রামাঞ্চলের শাসনভার ইংরেজসরকারের হস্তে ন্যস্ত করা হইল। নিজাম নামেমাত্র ইহার স্বত্বাধিকারী রহিলেন।
পশ্চিমে নেপাল, পূর্বে ভুটান, উত্তরে তিব্বত এবং দক্ষিণে দার্জিলিং জিলার মধ্যে ক্ষুদ্র পার্বত্য সিকিম রাজ্য অবস্থিত। ইহার বর্তমান আয়তন মাত্র ২৮১৮ বর্গমাইল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নেপাল ইহার অধিকাংশ দখল করিয়াছিল। ইংরেজের সহিত নেপালের যুদ্ধ শেষ হইলে ভারত-সরকার নেপালের অধিকৃত অংশ সিকিমকে ফিরাইয়া দিয়া এক সন্ধি করে (১৮১৭ খ্র.)। সিকিমরাজ দার্জিলিং অঞ্চল ভারত-সরকারকে দান করেন (১৮৩৫ খ্রী.)। ইহার জন্য ভারত সরকার সিকিমকে প্রথমে (১৮৪১ খ্রী.) তিন হাজার টাকা ও পরে (১৮৪৬ খ্রী.) ছয় হাজার টাকা বার্ষিক দেয়।
দার্জিলিংয়ের প্রথম সুপারইনটেনডেন্ট আর্চিবল্ড ক্যাম্পবেল (Dr. Archibald Campbel) ও সিকিমের রাজার মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয়। ক্যাম্পবেল অভিযোগ করেন যে সিকিমের রাজা দার্জিলিং হইতে লোক ধরিয়া নিয়া তাহাদিগকে ক্রীতদাস করেন। সিকিমের রাজা বলেন যে, তাঁহার ক্রীতদাস দার্জিলিং পলাইয়া যায় কিন্তু ক্যাম্পবেল তাহাদিগকে ফিরাইয়া দেন না।
১৮৪৯ সনে প্রসিদ্ধ উদ্ভিদবিদ্যাবিশারদ হুঁকার (Dr. Hooker) বৃটিশ গভর্নমেন্টের নির্দেশ অনুসারে হিমালয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য ক্যাম্পবেলের সঙ্গে সিকিম যান। সিকিমের রাজা তাঁহাদিগকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, তাহারা সিকিম রাজ্যের বাহিরে তিব্বত বা ভুটানে যাইতে পারিবে না। কিন্তু তাঁহারা ইহা সত্ত্বেও তিব্বতের সীমানা পার হন এবং ইহার ফলে সিকিমের সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। অতঃপর সিকিমরাজ হুঁকার ও ক্যাম্পবেল উভয়কেই গ্রেপ্তার করেন ও ক্যাম্পবেলকে কারারুদ্ধ করেন। হুঁকার স্বেচ্ছায় কারাগারে ক্যাম্পবেলের সঙ্গী হন।
সিকিমরাজ সমস্ত বৃত্তান্ত জানাইয়া গভর্নর জেনারেলকে চিঠি লেখেন এবং ইহাতে ক্যাম্পবেলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেন। এই সমুদয় অভিযোগ যে অনেকাংশে সত্য এখন তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু লর্ড ডালহৌসী এই সকল অভিযোগের সম্বন্ধে কোন বিচার না করিয়া বলপূর্বক সিকিমের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অধিকার করিলেন।
ইহা ছাড়া অন্যান্য কয়েকটি রাজ্য ডালহৌসীর শাসনকালে ইংরেজরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। পোষ্যপুত্রের স্বত্বলোপ-নীতির (Doctrine of Lapse) ফলেই প্রধানত এই সকল রাজ্য অধিকার করা হইত, অর্থাৎ বৃটিশের প্রতিষ্ঠিত ও অধীন কোন দেশীয় রাজ্যের অপুত্রক রাজা মরিয়া গেলে, তাঁহার দত্তক বা পোষ্যপুত্রকে ডালহৌসী উত্তরাধিকারী বলিয়া স্বীকার করিতেন না, এবং ঐ রাজ্য বৃটিশরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হইত। এই নীতি কুড়ি বৎসর পূর্বে প্রথম সূচিত হয় এবং বিলাতের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু ডালহৌসীই প্রথম এই নীতি অনুসারে কাজ করেন। ইহার ফলে সাতারা, ঝালী ও নাগপুর রাজ্য, বুন্দেলখণ্ডের অন্তর্গত জৈৎপুর এবং সম্বলপুর প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য বৃটিশরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বৃত্তিভোগী পেশোয়া বাজী রাওর মৃত্যু হইলে তাহার দত্তকপুত্র ধুন্দুপন্থ বা নানাসাহেবকে ডালহৌসী বাজী রাওর বৃত্তি দিতে অস্বীকার করিলেন। কর্ণাটের নবাবের মৃত্যু হইলে ডালহৌসী নবাবী পদ উঠাইয়া দিলেন। তাঞ্জোর রাজ্য সম্বন্ধেও ঐরূপ ব্যবস্থা হইল।
অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস যে ডালহৌসীর এই রাজ্য-অধিকার নীতি ভারতীয়গণের মধ্যে ঘোর অসন্তোষ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করিয়াছিল। দত্তকপুত্র গ্রহণ ভারতবর্ষের চিরাচরিত প্রথা এবং ভারতে চিরদিনই দত্তকপুত্র দত্তকগ্রহণকারীর আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারীরূপে গণ্য হইয়া থাকে। ভারতের এই চিরন্তন প্রথা বৃটিশ-কর্তৃপক্ষ প্রত্যাখ্যান করায় জনগণ বিশেষভাবে বিক্ষুব্ধ হইয়াছিল। এই প্রধূমিত অসন্তোষ বহ্নিই ভারতীয় বিদ্রোহে পরিণত হইয়াছিল বলিয়া অনেকে মনে করেন।
৬. শাসনব্যবস্থা
(ক) লর্ড কর্ণওয়ালিসের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
কৃষিপ্রধান দেশে ভূমির রাজস্বই গভর্নমেন্টের প্রধান আয়। হেস্টিংসের আমলে ভূমির রাজস্ব নিলামে দেওয়া হইত, এবং যিনি সর্বোচ্চ হারে ডাকিতেন, তাঁহাকে প্রথমে পাঁচ বৎসরের জন্য এবং পরে এক বৎসরের জন্য জমি বিলি করা ইত। ইহার ফলে ভূমির অস্থায়ী মালিকেরা প্রজাদের উপর অত্যাচার করিয়া ঐ অল্পকালের মধ্যেই যতদূর সম্ভব টাকা আদায়ের চেষ্টা করিত, জমির উন্নতির জন্য কোন যত্ন করিত না। এই সমস্ত বিবেচনা করিয়াই কর্ণওয়ালিস জমিদারদের সহিত ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিলেন। এই ব্যবস্থায় জমিদারদিগকে জমির স্থায়ী মালিক বলিয়া স্বীকার করা হইল। তাহারা শুধু গভর্নমেন্টকে বাৎসরিক খাজনা দিতে বাধ্য রহিলেন, এবং সেই খাজনার অঙ্কও চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট হইয়া গেল। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গ ও বিহার এবং তাহার দুই বৎসর পার বারাণসী প্রদেশে প্রবর্তিত হইল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কেবলমাত্র আংশিকরূপে সফল হইয়াছিল। ইহা বিশৃঙ্খলার স্থানে শৃঙ্খলা আনয়ন করিয়াছিল এবং সরকারের রাজস্ব নির্দিষ্ট করিয়াছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থায় ভূমিতে প্রজাদের অথবা মধ্যস্বত্ববানদের স্বত্ব গভর্নমেন্ট একেবারেই অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন। এজন্য তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে জমিদারের দয়ার উপর নির্ভর করিতে হইত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি নিয়ম ছিল যে, কোন ভূস্বামী নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে খাজনা দিতে না পারিলে তাহার জমি নিলামে বিক্রয় হইবে। ইহার ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ জমিদারই সর্বস্বান্ত হইয়া ঘোর দুর্দশায় গড়িয়াছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। ভূমির মূল্য ধীরে ধীরে বহুগুণে বাড়িলেও গভর্নমেন্ট জমিদারদের যে রাজস্ব নিদিষ্ট করিয়া দিয়াছিল, তাহার বেশি আর একটি পয়সাও দাবি করিতে পারিত না। এইজন্যই পরে জনগণের উপর নানারূপ ট্যাক্স বসাইতে হইয়াছিল, এবং তাহাদের দুঃখকষ্টও বাড়িয়াছিল। পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ক্রটি-সংশোধক আইনের প্রবর্তনে জমিদার ও প্রজাদের অবস্থার অনেকটা উন্নতি হইয়াছিল। বর্তমান স্বাধীন ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রহিত এবং জমিদারী প্রথা উৎখাত করা হইয়াছে।
(খ) শাসনব্যবস্থা
কর্ণওয়ালিসের সময় সমস্ত দেশ কতকগুলি জেলাতে বিভক্ত হইয়া জেলাগুলিই দেশের শাসনকার্যের কেন্দ্রস্বরূপ গঠিত হইল। প্রথমে জেলার সংখ্যা ছিল ৩৫, কিন্তু ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ইহার সংখ্যা কমাইয়া ২৩ করা হয়। প্রত্যেক জেলায় এবং তিনটি শহরে ইংরেজ বিচারকের অধীনে এক-একটি দেওয়ানী আদালত এবং কলিকাতা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনা এই চারটি বড় বড় কেন্দ্রে চারটি আপীল আদালত প্রতিষ্ঠিত হইল। কলিকাতা সদর দেওয়ানী আদালত সর্বোচ্চ আপীল আদালতে পরিণত হইল। ফৌজদারী মোকদ্দমার বিচারের জন্য চারটি সেসন আদালত স্থাপিত হইল। প্রত্যেক আদালতে দুইজন করিয়া ইংরেজ বিচারক থাকিতেন এবং তাঁহারা রাজ্যের সর্বত্র ঘুরিয়া বিচার করিতেন। এইজন্য ইহাদিগকে ‘কোর্ট অব সার্কিট বা ভ্রাম্যমাণ আদালত বলিত। সদর নিজামত আদালত ও সপারিষদ্ বড়লাটের অধীন হইল। কালেক্টরগণের হাত হইতে দেওয়ানী বিচারের ক্ষমতা সরাইয়া লওয়া হইল। দেওয়ানী আদালতের ইংরেজ জজগণ ম্যাজিষ্ট্রেটের কার্য করিতেন এবং পুলিশও তাঁহাদের অধীন ছিল। প্রত্যেক জেলা আবার অনেকগুলি থানাতে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেক থানা একজন দারোগার অধীন করা হইল।
লর্ড কর্ণওয়ালিসের পূর্বে দেশের শাসনকার্য নির্বাহের জন্য ভারতের সুযোগ্য অধিবাসীরাই দায়িত্বপূর্ণ উচ্চপদে নিযুক্ত হইত। কিন্তু কোন ভারতীয়কে উচ্চকার্যে নিযুক্ত না-করাই ছিল কর্ণওয়ালিসের মূল নীতি। ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টর, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতের বিচারক, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মচারী এবং অন্যান্য সমস্ত দায়িত্বপূর্ণ পদে তিনি ইউরোপীয়দিগকে নিযুক্ত করিতেন; অথচ, এদেশের লোকের প্রকৃতি, রীতি-নীতি, আচার-পদ্ধতি প্রভৃতি নানা বিষয়ে ঐসকল বিদেশীয় কর্মচারীদের অনেকেরই বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা থাকিত না। ইহার ফলে এবং অন্যান্য কারণে কর্ণওয়ালিসের সংস্কারগুলি বিশেষ ফলদায়ক হইল না।
বড়লাট বেন্টিঙ্ক ভারতীয়গণকে বিচার ও শাসন বিভাগে উচ্চপদে নিযুক্ত করিবার রীতি প্রবর্তন করেন। পূর্বে রেজিষ্ট্রার (Registrar) নামে প্রতি জিলায় একজন অধস্তন ইংরেজ বিচারক ছিলেন-ইনি ২০০ টাকা পর্যন্ত দাবির মামলা বিচার করিতে পারিতেন। নিম্নপদস্থ ভারতীয় কর্মচারীরা ৫০ টাকা পর্যন্ত দাবির মামলা করিতে পারিতেন। বেন্টিঙ্ক রেজিষ্ট্রারের পদ ও কর্ণওয়ালিস প্রবর্তিত চারিটি কেন্দ্রের আপীল আদালতগুলি উঠাইয়া দিলেন। ভারতীয় বিচারকদের ক্ষমতা বাড়ান হইল। মুনসিফ, সদর আমিন ও প্রধান সদর আমিন যথাক্রমে ৩০০, ১০০০ ও ৫০০০ টাকা পর্যন্ত দাবির মামলা করিতে পারিতেন। জিলা আদালতের ইংরেজ জজ যে-কোন দাবির মামলা করিতে পারিতেন এবং তাঁহার রায়ের বিরুদ্ধে সদর দেওয়ানী আদালতে আপীল করা যাইত। জজেরা মুনসিফ ও সদর আমিনের কার্য পরীক্ষা করিতেন। পূর্বে মুনসিফরা কোন বেতন পাইত না-মোকদ্দমার ফী মাত্র পাইত–গড়ে ইহা মাসিক বিশ-ত্রিশ টাকার বেশী হইত না। বেন্টিঙ্ক তাহাদের বেতন ও অফিসের অন্যান্য খরচ বাবদ মাসিক একশত টাকা ধার্য করিলেন। সদর আমিন ও প্রধান সদর আমিন তাহাদের বেতন ও অফিসের খরচ বাবদ মাসিক যথাক্রমে ২৫০ ও ৫০০ টাকা পাইতেন।
পুলিশ, রাজস্বআদায়, শুল্ক, লবণ ও আফিং বিভাগে এবং আদালতে নিযুক্ত নিম্নপদস্থ ভারতীয় কর্মচারিগণ অত্যন্ত কম বেতন পাইত। দারোগা, লবণ বিভাগের অধ্যক্ষ দেওয়ান, মোহরের ও পিওন যথাক্রমে মাসিক ৩০, ৫০, ৫, ও আড়াই টাকা বেতন পাইত। সুতরাং সর্বত্রই ঘুষ দেওয়ার প্রথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
কর্ণওয়ালিসের সময় প্রতি জিলার দুইজন প্রধান রাজকর্মচারী ছিলেন একজন কালেক্টর, তিনি কলিকাতা বোর্ড অফ্ রেভিনিউর অধীনে কেবলমাত্র রাজস্ব-সংগ্রহকার্যে নিযুক্ত থাকিতেন। আর একজন জজ ও ম্যাজিষ্ট্রেট এই উভয় পদের কার্য করিতেন এবং পুলিশও তাহাদের অধীন ছিল। পরে কালেক্টরও কতকটা বিচারের ভার পাইয়াছিলেন। ১৮০৮ সনে কলিকাতা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ বিভাগের জন্য একজন করিয়া পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হইয়াছিলেন। বেন্টিঙ্কের সময়ে (১৮২৯ সনে) এই পদগুলি উঠাইয়া দেওয়া হইল। কয়েকটি জিলা লইয়া একটি বিভাগের (Division) সৃষ্টি হইল এবং জিলার কালেক্টরগণ বিভাগীয় অধ্যক্ষ কমিশনার অফ রেভিনিউ ও সারকিট-এর (Commissioner of Revenue and Circuit) অধীনস্থ হইলেন। অপরদিকে জিলাগুলিও সাব ডিভিশানে ভাগ হইল। বিভাগীর কমিশনার পুলিশ বিভাগেরও কর্তা হইলেন। আপীল আদালত চারিটি উঠাইয়া দেওয়া হইল এবং উক্ত কমিশনার ভ্রাম্যমাণ সেসন আদালতের জজের কার্য করিতেন। কিন্তু ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে কমিশনারদের হাত হইতে সেসন জজের কাজ উঠাইয়া নিয়া জিলা জজের হাতে ন্যস্ত হইল, এবং জজদের হাত হইতে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাজ তুলিয়া নিয়া কালেক্টরের হাতে দেওয়া হইল। ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টরের পদ পৃথক করা হইল, কিন্তু ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে আবার এই দুই পদে একজন নিযুক্ত হইলেন। এই ব্যবস্থায় অনেকে। আপত্তি করিয়াছিল, কিন্তু ইহার আর পরিবর্তন হয় নাই। বেন্টিঙ্কের সময় (১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে) ডেপুটি কালেক্টরের ও নয়-দশ বৎসর পরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ সৃষ্টি হয়–এই দুই পদে ভারতবাসী নিযুক্ত হইতে পারিত। বেন্টিঙ্ক জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করেন-ইহারা পরে সাব-ডিভিশনাল অফিসার নিযুক্ত হইতেন।
১৮৩১ সনে রাজস্বসংক্রান্ত মামলার বিচারের ভারও কালেক্টরের হাতে অর্পিত হয়। এইরূপে ম্যাজিষ্ট্রেট-কালেক্টরই জিলার প্রধান কর্মচারী হন। জিলা জজের কার্যভার লাঘবের জন্য অতিরিক্ত জজ, এবং ভারতীয়দের জন্য সদর আমিন, মুনসফি, ও আরও কয়েকটি অল্প-বেতনের পদের সৃষ্টি হয়। তাহাদের বিচারের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় জিলা জজের নিকট এবং কোন কোন স্থলে সদর দেওয়ানী আদালতে আপীল করা যাইত। জিলা জজের নিষ্পত্তির বিরুদ্ধেও সদর দেওয়ানী আদালতে আপীল করা যাইত।
১৮০১ সনে সদর দেওয়ানী আদালতের সদস্যের অনেক পরিবর্তন হয়। সপারিষদ গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে তিনজন উচ্চপদস্থ ইউরোপীয় কর্মচারী ইহার সদস্য নিযুক্ত হন। ১৮১১ সনে একজন প্রধান জজ (Chief-Judge) পদের সৃষ্টি হয় এবং জজের সংখ্যা প্রয়োজনমত বাড়াইবার ব্যবস্থা হয়। ক্রমে ক্রমে সদর দেওয়ানী আদালত কেবল আপীল আদালতে পর্যবসিত হয় এবং ইহার নিস্পত্তির বিরুদ্ধে বিলাতে প্রিভি কাউন্সিলে আপীলের ব্যবস্থা করা হয়।
বেন্টিঙ্ক ভারতীয়গণকে বিচার ও শাসন বিভাগে উচ্চপদে নিযুক্ত করিবার রীতি প্রবর্তন করেন। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রদত্ত ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সনদের কুড়ি বৎসরের মেয়াদ শেষ হইলে বেন্টিঙ্কের শাসনকালে ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে আবার কুড়ি বৎসরের জন্য এক নূতন সনদ দেওয়া হয়। এই নূতন সনদে বিশেষ জোর দিয়া ঘোষণা করা হইল যে, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে যোগ্য ভারতবাসীকে শাসনকার্যের সমস্ত বিভাগেই নিযুক্ত করা যাইতে পারিবে। এই সনদে শাসনকার্যেরও নানা পরিবর্তন করা হইল। বাংলার লাট এখন হইতে বাংলা ছাড়াও সমগ্র ভারতের গভর্নর জেনারেল বা বড়লাট হইলেন। এতদিন ভারতের সর্বোচ্চ শাসন কর্তৃপক্ষের নাম ছিল ‘সপারিষদ বাংলার বড়লাট’, এখন তাহার নাম হইল ‘সপারিষদ ভারতের বড়লাট’ (Governor-General of India in Council) এবং বড়লাট ও পূর্বোক্ত তিনজন সদস্য ছাড়া ভারতের সেনাপতিও ইহার একজন অতিরিক্ত সদস্য ছিলেন। এই পরিষদই এখন প্রকৃত প্রস্তাবে সমগ্র ভারতের শাসনকর্তা হইল।
১৮৫৩ সনে যে নূতন সনদ দেওয়া হইল তাহাতে বাংলার জন্য লেফটেনান্ট গভর্নরের পদ সৃষ্টি হইল এবং বড়লাট আর বাংলা দেশের গভর্নর রহিলেন না; এখন তাঁহার পদবী হইল কেবলমাত্র গভর্নর জেনারেল অফ ইণ্ডিয়া। ১৮৩৩ সনের পূর্ব পর্যন্ত সপারিষদ গভর্নর জেনারেল এবং বম্বে ও মাদ্রাজ সরকারের আইনপ্রণয়নের অধিকার ছিল। ১৮৩৮ সনের নূতন সনদে বম্বে ও মাদ্রাজের আইনপ্রণয়নের অধিকার রহিত হয়, এবং গভর্নর-জেনারেলের পরিষদে কোম্পানির কর্মচারী নহেন এমন একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তি চতুর্থ-সদস্যরূপে নিযুক্ত হন। তিনি পরিষদের সকল সভায়ই উপস্থিত থাকিতে পারিতেন, কিন্তু কেবলমাত্র আইনপ্রণয়ন ব্যাপারে ইহার সদস্যরূপে বিবেচিত হইতেন। সুপ্রসিদ্ধ লর্ড মেকলে সর্বপ্রথম এইরূপ আইনসদস্য নিযুক্ত হন। ইহার পূর্বেকার আইনগুলিকে বলা হইত রেগুলেশন (Regulation), নূতন নিয়ম অনুসারে প্রণীত আইনের নাম হইল অ্যাক্ট (Act)। আর এই আইন সুপ্রীম কোর্ট ও বৃটিশ ভারতের সকল আদালতে বলবৎ হইল।
১৮৫৩ সনের আইন দ্বারা এই ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়। আইনসদস্য অন্য তিনজন সদস্যের ন্যায় গভর্নর-জেনারেলের পরিষদের পুরাপুরি সদস্য হইলেন। আরও স্থির হইল যে উক্ত পরিষদ যখন নূতন আইনপ্রণয়ন সম্বন্ধে আলোচনা করিবেন তখন গভর্নর জেনারেল ও উক্ত চারিজন সদস্য ছাড়া ভারতের সেনাপতি, বাংলার চীফ জাষ্টিস্, অন্য একজন জজ এবং বম্বে, মাদ্রাজ, বাংলা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ সরকারের একজন করিয়া প্রতিনিধিমোট এই বারোজন লইয়া পরিষদ গঠিত হইবে। এই পরিষদে কোন বেসরকারী ইংরেজ বা ভারতীয় সদস্য ছিল না এবং বড়লাট ইচ্ছা করিলে এই পরিষদের সিদ্ধান্ত নাকচ করিতে পারিতেন।
এই সময়ে উত্তরভারতে ইংরেজ-অধিকৃত সমস্ত প্রদেশই–অর্থাৎ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, বারাণসী ও ইহার সংলগ্ন অযোধ্যার নিকট হইতে প্রাপ্ত দোয়াব, রোহিলখণ্ড প্রভৃতি, এবং ব্রহ্মযুদ্ধের পর আসাম, আরাকান, টেনাসেরিম, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এজেন্সি (North-Eastern Frontier Agency) বাংলা প্রেসিডেন্সীর অন্তর্গত ছিল। ১৮৩৬ সনে বারাণসী ও ইহার পশ্চিমস্থ ভূভাগ একটি পৃথক প্রদেশে পরিণত হইল। প্রথমে ইহার নাম ছিল আগ্রা প্রদেশ এবং পরে ইহার নাম হইল উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ। ইহা বাংলা প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত হইলেও একজন পৃথক লেটেনান্ট গভর্নর (Lieutenant Governor) ইহা শাসন করিতেন। গভর্নর জেনারেলই বাংলা প্রেসিডেন্সীর গভর্নরের কার্যও করিতেন। ১৮৩৩ সনের পরে তাঁহার অনুপস্থিতিতে তাহার শাসন-পরিষদের একজন সদস্য ডেপুটি-গভর্নররূপে বাংলা প্রেসিডেন্সী শাসন করিতেন। ১৮৪৩ সন হইতে বাংলা দেশ শাসনের জন্য একটি পৃথক সেক্রেটারিয়েট (Secretariat) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একজন সেক্রেটারি ও দুইজন আণ্ডার-সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। কিন্তু এ সমুদয় সত্ত্বেও একই ব্যক্তির পক্ষে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও বাংলার গভর্নর, এই দুইটি দায়িত্বপূর্ণ পদের কার্যনির্বাহ করা ক্রমশ অসম্ভব হইয়া ওঠে। এইজন্য ১৮৫৩ সনের ১২ই অক্টোবর বিলাতের কর্তৃপক্ষ-কোর্ট অব ডিরেকটরস-বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের শাসনের জন্য একজন লেফটেনান্ট গভর্নর নিযুক্ত করার অনুমতি দিলেন। তদনুসারে ১৮৫৪ সনের ২৮শে এপ্রিল সার ফ্রেডারিক জেমস হ্যাঁলিডে সাহেব (F. J. Halliday) এই পদে নিযুক্ত হইলেন (১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দ)।
ইহা ছাড়াও লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৬-১৮৫৬ খ্র.) ভারতের আভ্যন্তরিক শাসনপদ্ধতির অনেক সংস্কার ও উন্নতি সাধন করিয়াছিলেন।
এই সময়েই পূর্ত-বিভাগের (Public Works Department বা P. W. D.) সৃষ্টি হইল, এবং বড় বড় খাল ও রাস্তার কাজ আরম্ভ হইল। রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ ও এক আনা মাশুলে ভারতের সর্বত্র পত্রপ্রেরণের ব্যবস্থা ডালহৌসীর আমলেই প্রবর্তিত হয়। ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে বিখ্যাত ‘এডুকেশন ডেস্প্যাচ’ বা ‘শিক্ষানীতিসম্বন্ধীয় আদেশপত্র’ এদেশে পৌঁছিল এবং ডালহৌসী উহা পাইবামাত্র এই নীতি অনুসারে কার্য আরম্ভ করিয়া দিলেন। তিনি পৃথক একটি শিক্ষা-বিভাগের (Education Department) সৃষ্টি করিলেন এবং নানা স্থানে স্কুল ও কলেজ স্থাপনের ব্যবস্থা করিলেন। ইহা ছাড়া তাঁহার ব্যবস্থার ফলেই ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ডালহৌসী স্ত্রী-শিক্ষার আবশ্যকতাও সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন।