০৬.
মানুষের বুকের ভেতর কত কি যে লুকোনো থাকে, মানুষের হৃদয় হল সমুদ্রতল! শুধু জল নয়, সেখানে জীবনও থাকে। রঘুনাথ ভালোবাসা ছাড়া কোনো শব্দেরই অর্থ উদ্ধার করতে পারল না, সে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, ছবিটা খাট থেকে তুলে নিল হাতে। তারপর নতুন কিছু দেখার মতো সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ছবিটাকে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জড়তা ভেঙে গিয়ে ডিম ফোঁটা মুরগির বাচ্চার মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল বিষয়টা, সূর্যাক্ষ মুখোমুখি চেয়ার টেনে বলল, মেয়েটাকে চিনলি না তো? ওর নাম দ্বীপী। নিমতলার ধারে ওদের ঘর। আমি রোজ একবার করে ওদের বাড়িতে যাই। গিয়ে গিয়ে নেশার মতো হয়ে গিয়েছে। না গেলে কষ্ট হয়, বুকটা টনটনিয়ে ওঠে, মনে হয় সারাদিনের কোনো একটা কাজ করতে ভুলে গিয়েচি। রঘুনাথ আশ্চর্য হল না, মেয়েটার সাথে বুঝি তুর লটঘট চলছে? তা ভালো। তবে এসব ধ্যাসটুমু করতে গিয়ে পড়াশোনার যেন দফারফা না হয়ে যায়। পীরিত করা বড়ো ঝামেলার জিনিস রে। আমার বুড়াদাদু বলে ভাব-ভালোবাসা হল গিয়ে বুড়িগাঙের বানের জল, এই আচে ওই নেই, তাই ভালোবাসা বুকে বয়ে বেড়িয়ে শরীল খারাপ করার কুনো মানে হয় না।
দ্বীপীর কথা ভাবলে আমার শরীর খারাপ করে না। ও আমার শ্বাস-প্রশ্বাস। জোর গলায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল সূর্যাক্ষ, ওর মুখটা একবার না দেখলে বইয়ের সব পড়া কেমন গুলিয়ে যায়। দ্বীপী আমার সবটা জুড়ে বসে আছে। ও আমার সমুদ্র। কিন্তু ও আমাকে কি ভাবে কি চোখে দেখে তা আমার আজও জানা হয়নি।
আবেগের ধারা বিবরণী চলে ক্রমাগত। রাত্রির বয়স বাড়ার সংকেত বুঝতে পারে না কেউ। নীচের ঘরগুলো থেকে নীরবতা ছাড়া কোনো শব্দ ওঠে না। কপোতাক্ষ ঘরে একা আসেন নি, সঙ্গে করে দু-জন অতিথিকে এনেছেন। ওরা রাতে খাবেন। মীনাক্ষী কপালের ফুটে ওঠা বিরক্তির রেখাগুলোকে যথাসম্ভব লুকিয়ে ফেলে আবার ভাতের জল চড়িয়েছেন উনুনে। কপোতাক্ষর এই স্বভাব বহু পুরনো ব্যাধির মতো, শতবার নিষেধ করেও মীনাক্ষী এর কোনো সুফল পান নি। মানুষটার এই জনহিত করার প্রবণতা বুঝি কোনোদিন অবলুপ্ত হবে না। মীনাক্ষীর বড়ো আশ্চর্য লাগে। কপোতাক্ষকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত রাত করে এলে যে?
রাত হয়ে গেল মীনু। আসলে কী জান, পার্টির কাজ মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেয়েও ঝামেলার। ঘড়ি ধরে এসব কাজ হয় না। কপোতাক্ষ বোঝাবার চেষ্টা করলেন, দেখি কাল থেকে যাতে আর দেরি না হয় সেই চেষ্টাই করব।
এরা কি খাবেন? সংশয় দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন মীনাক্ষী। খুব হালকা মেজাজে হেসে উঠলেন কপোতাক্ষ, জানি এত রাতে তোমার খুব অসুবিধা হবে তবু তুমি আছো বলেই আমি ভদ্রলোকদের সঙ্গে আনতে সাহস পেলাম। তাছাড়া এত রাতে ওরা গোয়াড়ী ফিরে যেতে পারবে না। বাস নেই। কাল সকালে ওঁরা চলে যাবেন।
-খাবেই যখন তখন একটা খবর পাঠাতে পারতে। মীনাক্ষীর গলা থেকে চুঁইয়ে নামল বিরক্তি।
–বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে।
–এই ভুল তোমার মজ্জাগত। এই ভুল তুমি বারবার করো। কপোতাক্ষ কোনো প্রতিবাদ করলেন না, তিনি জানেন অনেক সময় নীরবতাই সান্ত্বনার মলম।
মীনাক্ষী চলে যাচ্ছিলেন, কী মনে করে ফিরে এলেন, শোন, সূর্যর বন্ধু এসেছে। পারলে রাতেই একবার ছেলেটার সঙ্গে দেখা করে নিও। বড়ো ভালো ছেলে। হলদেপোঁতা ধাওড়ায় থাকে। খাওয়ার সময় ওর মায়ের কথা মনে পড়ছিল বলে ঠিক মতো খেতেই পারল না।
-কী নাম বল তো? কপোতাক্ষ উৎসাহিত হলেন।
–রঘুনাথ রাজোয়ার।
– হ্যাঁ-হ্যাঁ বুঝেছি। ছেলেটার মুখ দেখলে নিশ্চয়ই চিনব। তবে আমি ওর বাবা আর দাদুকে চিনি। ওরা বড্ড গরীব তবে সৎ। কপোতাক্ষ আনমনা হয়ে গেলেন, ওদের নিয়ে তো আমার সংগ্রাম। জানি না এই অসম লড়াই আমি কতদুর টেনে নিয়ে যেতে পারব। তবে আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। আমার এই লড়াইয়ে আমি তোমাকেও পাশে পেতে চাই।
আমি পাশে না থাকলে তোমাকে না খেয়ে শুকাতে হোত। মীনাক্ষী সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসলেন, হাসতে-হাসতে একসময় গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি, মানুষের জন্য কাজ করো এতে আমি তোমাকে কোনোদিন বাধা দেব না। তবে তোমার কাছে আমার একটাই নিবেদন–পর-উপকার করতে গিয়ে নিজের শরীরটাকে যেন ভেঙে ফেল না। মনে রেখো-শরীরও নদীর পাড়ের মতো, একবার ভেঙে গেলে, ধস নামলে আর মেরামত করা যায় না।
– হ্যাঁ-হ্যাঁ, এতো লাখ কথার এক কথা। কপোতাক্ষ মাথা নাড়লেন।
মীনাক্ষীর মনের মেঘ কেটে গিয়েছে, আমি যাই। তুমি একটু ওদের সঙ্গে গল্প করো। রান্না হয়ে গেলে ডাকব।
মীনাক্ষী চলে যাবার পরও একা অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন কপোতাক্ষ। সূর্যাক্ষর সঙ্গে কাল রাতেও তার দেখা হয়নি। তিনি যখন ফেরেন তখন সূর্যাক্ষ ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনি ওর। সূর্যাক্ষর অভ্যাস রাত বারোটার মধ্যে শুয়ে পড়া। রাত বারোটাতে শুলেও ও সকাল পাঁচটার মধ্যে উঠবেই। পেছনের বাঁশবাগানটাতে পাখির মেলা বসে যায় তখন, বিশেষ করে এক দল কাক বাঁশগাছে বসে দলবদ্ধভাবে ডাকতে থাকে, ওরা বুঝি সকালের আলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে পৃথিবীতে। আর আশ্চর্য, সকালবেলায় কাকের কা-কা ডাকও শুনতে মন্দ লাগে না সূর্যাক্ষর। পাখিগুলো বুঝি তার ঘুম ভাঙানোর জন্য প্রতিদিন প্রস্তুত হয়ে থাকে। কাক ছাড়াও বাঁশবাগানের ডোবাটায় এক জোড়া ডাহুক আসে প্রতিদিন সকালে। ওদের ডাকটা বড়ো অদ্ভুত। সব সময় ওদের যেন কেউ তাড়া করছে এমন উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ওদের ক ক ক ক ডাকে স্পষ্ট। সূর্যাক্ষ বুঝতে পারে ডাহুক হল সব চাইতে ভীতু পাখি। সুন্দর পাখি। একমাত্র ডাহুকই গলায় সাদা মোতির মালা পরে ঘুরে বেড়ায়, ওদের পালকের বিন্যাস, সজ্জা কোনো শিল্পীর দক্ষ হাতের অঙ্কন নয়, স্বয়ং প্রকৃতির, সৃষ্টিকর্তা বহু যত্ন নিয়ে ওদের পালকে রঙ ভরেছেন, তিল তিল করে ওদের তিলোত্তমা করে তুলেছেন।
কী মনে করে কপোতাক্ষ দোতলার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন, কান পেতে কথা শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, সূর্যাক্ষর গলা পাওয়া যাচ্ছে। গল্প আর বন্ধু পেলে ছেলেটার চোখের ঘুম পেয়াদাদের মতো উধাও হয়ে যায়। কপোতাক্ষর তবু সংশয় ছিল যাবে কি যাব না বলে। কিন্তু বাইরে ঠিকরে পড়া হ্যারিকেনের আলো তার সংকোচকে দূরে সরিয়ে দিল। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে তিনি উঠে এলেন দোতলার বারান্দায়। ঘরে না ঢুকেই তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, সূর্য, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি?
সূর্য সাড়া দিল, না বাবা, জেগেই আছি।
রঘুর হাত থেকে দ্বীপীর ফটোটা কেড়ে নিয়ে সে চকিতে বিছানার তলায় লুকিয়ে ফেলল, তারপর রঘুনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা আসছে।
রঘুনাথও নিমেষে শরীরটাকে টানটান করে উঠে দাঁড়াল। সূর্যাক্ষর বাবার সঙ্গে তার আলাপ নেই। আলাপ করার প্রয়োজনও হয়নি। তবে কপোতাক্ষ রোজ শেরপুরের বাঁধ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কালীগঞ্জের বাজারে যান, ওখানেই তাঁর আসল আড্ডা। প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরেন। এ অঞ্চলের ডাকাত-চোর-বদমাশ-লুটেরা-ধান্দাবাজ সব তার চেনা জানা। ফলে রাত করে বাড়ি ফিরলেও কেউ তাঁর পথ আগলে দাঁড়ায় না, বরং চোখাচোখি হলে মুখ নামিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই সম্মানটুকু আছে বলেই এখনও কপোতাক্ষ সারাদিন লড়াই করার শক্তি পান।
ঘরে ঢুকেই সবার আগে কপোতাক্ষ রঘুর দিকে তাকালেন, তোমাকে আমি দেখেছি, কিন্তু কথা হয়নি। তোমার বাবার নাম কি গুয়ারাম?
রঘুনাথ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেই মাজা নীচু করে হাত বাড়িয়ে দিল কপোতাক্ষর পায়ের দিকে। পা ছোঁয়ার আগেই কপোতাক্ষ রঘুনাথের হাত দুটো ধরে ফেললেন, না-না থাক। প্রণাম করার দরকার নেই। তুমি মনে মনে আমাকে শ্রদ্ধা করলেই প্রণাম করার চেয়েও হাজার গুণ বেশি শ্রদ্ধা জানানো হয়। আর একটা কথা। চট করে লোকের পায়ে হাত দিতে যাবে কেন? মাথা নত করার স্বভাবটা বন্ধ করতে হবে আমাদের। বাবা-মা আর তোমার শিক্ষক ছাড়া কারোর কাছে মাথা নত করবে না।
কপোতাক্ষর কথায় যেন চাপা আগুন উসকে উঠল। একটা তেজ তার কথার মধ্যে ঠিকরে বেরচ্ছিল।
-ঠিক আছে। তোমরা বসো। রাত হল। কাল সকালে আবার কথা হবে। তিনি সূর্যাক্ষর দিকে তাকালেন, মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমাবি। বাঁশ বাগানের মশারা কিন্তু দৈত্য হয়। আমি আসি।
কপোতাক্ষ চলে গেলেন। সূর্যাক্ষ সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, আমার বাবাকে কেমন দেখলি। রঘু?
–তুর বাবা বেশ ভালো মানুষ। অমন মানুষ আজকালকার দিনে পাওয়া ভার। রঘুনাথের কথায় খুশি হল সূর্যাক্ষ, প্রসঙ্গ বদল করল সে, কাল তোকে দ্বীপীদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।
–আমার লাজ লাগবে, আমি যাব না।
-যাবি না মানে? তোকে যেতেই হবে। জেদ ফুটে উঠল সূর্যাক্ষর গলায়। রঘু বলল, আগে সকাল হতে দে, তারপর দেখা হবেখন।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল রঘুর, জানালা টপকানো রোদ এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। চোখ ডলে নিয়ে সে দেখল চারিদিকে ফুটফুটে আলো হাসির নমনীয় রঙ মেখে নিজেকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। সূর্যাক্ষ কখন উঠেছে তা সে সঠিক জানে না। তবে সূর্যাক্ষ ঘরের এক কোণে হ্যারিকেন নিয়ে মনযোগ সহকারে পড়ছিল। ওর ভোরে ওঠা অভ্যাস, যত রাতে ঘুমাক না কেন তোর ভোর ঘুম ভাঙবেই। এই অভ্যাসটা মীনাক্ষীই তাকে পাইয়ে দিয়েছেন, ভোর ভোর না উঠলে দিনটা বড়ো ছোট হয়ে আসে। মীনাক্ষী প্রায় দিনই আবৃত্তি করার মতো করে বলেন, আরলি টু রাইজ এন্ড আরলি টু বেড মেকস আ ম্যান হেলদি অ্যান্ড ওয়াইস। বুঝলি-অনুগত ঘাড় নাড়ে সূর্যাক্ষ। কপোতাক্ষ ঘুমের ব্যাপারে আপোষহীন। দেরি করে ঘুমালে দেরিতে ওঠা তার স্বভাব। বিশেষ দরকারেও সে বিছানা ছেড়ে উঠবে না। আর যদি কোন কারণে উঠতে হয় তাহলে বিরক্ত হয় প্রচণ্ড, দিলে তা ঘুমটা ভাঙিয়ে, ঘুমে কত দাম জানো?
–আমার আর জেনে দরকার নেই। তুমি আগে বাজারে যাও তো। ঘরে কিছু নেই। ছেলেটা কী খেয়ে ইস্কুলে যাবে? মীনাক্ষীর কণ্ঠস্বরে বাতাস-খেদানো ঢেউয়ের ব্যস্ততা।
কপোতাক্ষ মীনাক্ষীর মুখের উপর কোনো কথা বলতে পারেন না। অস্বস্তি হয়। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন গোয়াড়ী শহরে মীনাক্ষীদের বাস চলে। আর একটা বাস কৃষ্ণনগর-করিমপুর রুটে। দুটো বাস ছাড়াও ওদের আছে কাপড়ের দোকান। ভাব-ভালোবাসার বিয়ে নাহলে কি মীনাক্ষী কোনোদিন এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বসবাস করত। বিবাহ শব্দটা তাই ভাগ্যঘেঁষা।
পিতৃদেব ক্ষীরমোহনের মৃত্যুর ছ মাসের মধ্যেই নীলাক্ষ জমিজমা, বাস্তুভিটে, পুকুর বিল এমনকী বাসনপত্র সব চোখ উলটে ভাগ করে নিলেন। এমনকী ভাগ হয়ে গেল গোয়ালের গোরু-মোষ। নীলাক্ষ যাওয়ার আগে গায়ে চিমটি কাটার মতো কথা বলল, তোর সাথে ইচ্ছে থাকলেও আর থাকা যাবে না। গাঁয়ের মানুষ খেপিয়ে তুই যে কারবার শুরু করেছিস–তা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়। ভাবছিস সস্তা রাজনীতি করে চারদিক মাত করে দিবি–তা কিন্তু হবার নয়। মানুষ ফাঁকিটা ধরতে পারে। আর যেদিন ফাঁকিটা ধরতে পারবে তোদের কিন্তু গাঙের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সময় আসলে আমার কথাটা মিলিয়ে নিস।
–তা বলে তুই ঘর ছেড়ে চলে যাবি? ভ্রূ তুলে জিজ্ঞাসা করল কপোতাক্ষ।
-না গিয়ে উপায় নেই। আমি চোরের সাথে ঘর করব তবু তোর সাথে নয়। মুখ বেঁকে উঠল নীলাক্ষর, তোর সাথে থেকে আমার নিন্দে হচ্ছে। ফলে ঘরের খেয়ে আমি বনের মোষ তাড়াতে পারব না। তাছাড়া তোর ছায়ায় নিজেকে ঢাকলে হাসাহাসি করবে লোকে।
–আর একবার শেষ বারের মতো ভেবে দেখ। কপোতাক্ষ বোঝাতে চাইল, দশের লাঠি একের বোঝা। কথাটা মানিস তো?
নীলাক্ষ চলে যাওয়ার পর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল কপোতাক্ষর। সে এখনও বুঝতে পারেনি কী তার অপরাধ? কেন দাদা তার সাহচর্য ছেড়ে গেল। তবে নতুন জায়গায় নতুন বাড়িতে নীলাক্ষ বেশ সুখে আছে। জমিদারের মতো মেজাজ সে এখনো ধরে রেখেছে নিজের ভেতর।
মীনাক্ষী এসে সকালের চা দিয়ে গেলেন। প্রতিটি সকাল তার কাছে নতুন মাত্রা নিয়ে ধরা দেয়। একটা ভয় পেঁচিয়ে ওঠে বুকের ভেতর। রামনগর সুগার মিলের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কপোতাক্ষ। মিল-কোম্পানীর সঙ্গে তার পটল না। শ্রমিক আর চাষিদের দাবী নিয়ে যত অশান্তি। অগ্রভাগে কপোতাক্ষ ঝান্ডা হাতে–জবাব চাই, জবাব দাও। সমস্যা একটা নয়। সাহেবমাঠের আখ বিক্রির সমস্যা ছিল বহু দিনের, সেই সঙ্গে যুক্ত হল পেয়াদাদের সমস্যা। ওরা নূন্যতম বেতনে কাজ করতে আগ্রহী নয়। বেতন বৃদ্ধির জন্য অসন্তোষ দানা বাঁধছিল ওদের ভেতর। মনে অশান্তি নিয়ে মাঠ পাহারার কাজ হয় না। এ কাজে বিপদ সব সময় মাথার উপর খাড়ার মতো ঝোলে। মিলের কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মিল প্রশাসন উদাসীন। ওদের চিকিৎসার ব্যবস্থার আশাপ্রদ নয়, তাছাড়া যাতায়াতের পথঘাট খানাখন্দে ভরা। এসব সমস্যার কথা ভেবে কপোতাক্ষর রাতে ভালো ঘুম হয় না। বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার আগে ঘর সামলে নেবার বড়ো প্রয়োজন। শ্রমিকরা এবার পুজোর বোনাসের জন্য সংঘবদ্ধ হবে। ওদের নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ কোথায়? কপোতাক্ষই চাকরির ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেলেন। আলোচনার মধ্য দিয়ে মীমাংসাসূত্র বেরিয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু বাস্তবে তা হল না একপক্ষের অনড় মনোভাবের জন্য। কপোতাক্ষর উপর রুষ্ট হলেন কর্তৃপক্ষ। তাকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দিলেন ওরা। কিন্তু কপোতাক্ষর মন আতাগাছের ডালের মতো ভঙ্গুর নয়, তিনি পাকা বাঁশের কঞ্চি, মচকাবেন তবু ভাঙবেন না। ফলে একদিন ছাঁটাইয়ের চিঠিটা ধরিয়ে দিলেন অফিসের বড়বাবু। এরকম কোনো অঘটন ঘটবে আগে থেকে আঁচ পেয়েছিলেন কপোতাক্ষ। মীনাক্ষী সব শুনে নিরাপত্তাহীনতায় ডুকরে উঠলেন, এ কী শোনালে গো, এখন আমাদের কী ভাবে চলবে?
-তুমি ভয় পেও না। তিনটে পেট ঠিক চলে যাবে। আমি ক্ষীরমোহন চক্রবর্তীর ছেলে। আশা রাখি আমার মাথার উপর যতদিন দাদা আছে আমার খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা হবে না। কপোতাক্ষর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা এবং সহনশীলতার সহাবস্থান, একটা কথা মনে রেখো মীনা, জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। ভগবানে আমার কোনো আস্থা নেই। আমার দেবতার নাম মানুষ-দেবতা।
-তুমি কি পাগল হলে? দাদা কেন তোমার সংসার টানতে যাবেন? মীনাক্ষীর চোখ জোড়ায় অশান্তি চিকুর কাটে, তোমার দাদা দেখো কোনদিন আবার পৃথক না হয়ে যান।
যায় যদি তো যাবে, তাতে আমার কি? কপোতাক্ষর কণ্ঠস্বরে হালকা সুর, এ পৃথিবীতে কেউ কারোর অনুগত নয়। যে যার কর্মের দ্বারা খায়। আসলে প্রতিটি দানায় যে খাবে তার নাম লেখা থাকে। তাছাড়া আমার চাকরি আমার দোষের জন্য যায়নি। বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে আমি ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করেছি।
মীনাক্ষী সংসারের দাবীর কথা কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারেন না। উল্টে কপোতাক্ষ বোঝান, আমার যদি ডাল ভাত জোটে তোমারও জুটবে। আর তা যদি না জোটাতে পারি তোমাকে কৃষ্ণনগরে রেখে আসব। তুমি খোড়ে নদীর উন্মুক্ত হাওয়া খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা রেখো। যদি সম্ভব হয় ভবিষ্যৎ-এর বিপ্লবের জন্য নিজেকে তৈরি রেখো।
-কী পাগলের মতো বকছো! সূর্যর ভবিষ্যৎ-এর কথা ভাববে না? মীনাক্ষী রাগ জ্বালা লুকিয়ে রাখতে পারল না? হতাশায় ডুবে গেল তার সুন্দর মুখশ্রী।
সকালের চা-টা সুন্দর বানিয়েছিলেন মীনাক্ষী। কপোতাক্ষ তার সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে বসেছেন বাইরের বারান্দায়। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে আলোচনা চলছে পূর্ণমাত্রায়। তাদের কথা শোনার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না সূর্যাক্ষ। সে মীনাক্ষীর মুখোমুখি দাঁড়াল, মা, আমি রঘুকে এগিয়ে দিয়ে আসি। আজ আমার স্কুল আছে। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পর টিউশানি সেরে ফিরব।
রঘুনাথ বিদায়বেলায় কেমন করুণ মুখ করে তাকিয়ে ছিল মীনাক্ষীর দিকে। সূর্যাক্ষর মা যেন কুমোরপাড়ায় গড়া মা দুর্গা। যেমন ব্যবহার, তেমন কথা-বার্তা, আন্তরিকতা। রঘুনাথের মন ভরে গিয়েছে। মানুষের প্রতি তার ভুল ধারণা অনেকটাই পাল্টে গেছে। ঘরে ফিরে সব কিছু গুছিয়ে বলতে হবে দুর্গামণিকে, যদিও এসব কথা সে আদৌ বিশ্বাস করবে না। রঘুনাথ তক্তাপোষে ঘুমিয়েছে সূর্যাক্ষের পাশে একই বিছানায়। একথা গ্রাম- সমাজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার পরিবেশ এখন ডিমের ভেতর ভ্রুণের মতো লুকিয়ে আছে। বিশ্বাস না করলেও সে দুর্গামণিকে গল্প বলবে সব। এ গল্প শুনে চুনারামের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা মনে মনে সব যেন দেখতে পাচ্ছিল রঘুনাথ।
মীনাক্ষী স্নেহের চোখে রঘুনাথের দিকে তাকালেন, আবার এসো বাবা। সংকোচ করো না, এ বাড়ি তো তোমার। যখন মন চায় চলে আসবে।
রঘুনাথের ঠোঁট কেঁপে উঠল, থরথরিয়ে উঠল দৃষ্টি। সে বুঝতে পারল আর একটা শব্দও যদি মীনাক্ষী উচ্চারণ করেন তার প্রতি তাহলে সে উগত কান্নার বেগকে সামাল দিতে পারবে না, বাঁধ ভেঙে গিয়ে আবেগের বন্যা আসবে শরীরের নদীতে।
সকালবেলায় নিমতলা ঝাট দেয় খোঁড়া হারু। ওর ভুষিমালের দোকান মাত্র বিশ হাত দূরে। শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও হারু একাজটা নিজের হাতে করতে পছন্দ করে। হারু শুধু খোঁড়া নয়, তার উচ্চতা মাত্র তিন ফুট দুই ইঞ্চি। সে তার যৌবনে সার্কাস দলে নাম লিখিয়েছিল, সেখানে সে জোকার সাজত, মুখে রঙচঙ মেখে হাসি-আনন্দ বিলোত দর্শকদের। সার্কাসের জীবন হারুর পছন্দ হয়নি কোনোকালে। সে ম্যানেজারের ক্যাশ ভেঙে পালিয়ে এল তিন বছর পরে। গাঁয়ে এসে ভয়ে ভয়ে সময় কাটাত সে। ছ’মাস পরেও যখন সার্কাসের লোক এল না তার খোঁজে তখন সে সাহস করে নিমতলায় ভূষিমালের দোকান খুলল। হারুর দোকান এ তল্লাটে বিখ্যাত, গাঁ বলে সে দাম গলা কেটে নেয় না, সামান্য লাভ রেখেই সে ব্যবসা করতে পছন্দ করে। এখন কাঁচা টাকার মুখ দেখেছে হারু। সে এখন গরিব দুঃখীদের মহাজন, সুদে টাকা ধার দেয়, গোপনে বন্ধকের কারবার করে।
কপোতাক্ষ হারুকে বারকতক সতর্ক করেছেন, সুদের টাকা থাকে না হারু। তোমার তো অভাব নেই তবু তুমি কেন সুদের কারবার করবে? মানুষের অভিশাপ কুড়িয়ে জীবন কোনোদিন সুখের মুখ দেখে না। তাই বলছিলাম কী হারু, তুমি এসব ছেড়ে দাও। শুধু ভুষিমালের দোকানটা চালাও। ওতেই তোমার মঙ্গল।
হারু সুখী না হলেও ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। সে জানে কপোতাক্ষর রাগের বাহার। মানুষটা ভালোর ভালো কিন্তু রেগে গেলে মাথায় খুন চড়ে যায়, তখন সাত বুঝিয়েও তাকে সামলানো যায় না।
নীলাক্ষর কাছে হারু খোঁড়া কাঁচুমাচু হয়ে অভিযোগ করেছে কপোতাক্ষর বিরুদ্ধে। সব শুনে দৃঢ় অথচ চাপা কণ্ঠে নীলাক্ষ আউড়েছেন, কপোতের কথা আমার কাছে বলো না। বাবার মৃত্যুর পর আমরা ভিনো হয়ে গিয়েছি। আমাদের হাঁড়ি আলাদা, ঘর আলাদা। এমনকী চিন্তা-ভাবনাগুলোও আলাদা। ওই অমানুষটাকে আমি কিছু বোঝালে বুঝবে না। ও নিজেকে কমরেড মনে করে।
হারু খোঁড়া একথা শোনার পরে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সাহস পায়নি। আপোষের ঢোঁক গিলে সে মন দিয়েছে নিজের কাজে।
এ সময় নিমগাছের ছায়া বড়ো মধুর হয়। নিম হাওয়ায় রোগ-জ্বালা ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। সূর্যাঙ্ক জ্ঞান বাড়ার পর থেকে এই গাছটাকে দেখছে। এর বুঝি বয়স বাড়ে না, গতর বৃদ্ধি হয় না, এ যেন জরা নিরোধক ছাল পড়ে কালের প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সূর্যাক্ষ রঘুনাথের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ চোখে তাকাল, কি রে যাবি নাকি দ্বীপীদের ঘরে? মন চাইলে বল এখুনি নিয়ে যাবো তোকে।
রঘুনাথ সংকোচ আড়ষ্টতায় ভুগছিল, না, আজ থাক। পরে কুনোদিন আসবখন।
পরের কথা পরে হবে, এখুনি যাই। সূর্যাক্ষ কাতর হয়ে উঠল, জানিস কাল রাতে দ্বীপীর স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন দেখতে-দেখতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই থেকে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। চল মাইরি। সূর্যাক্ষ রঘুনাথের হাত ধরে টানল।
.
০৭.
দ্বীপীদের বাড়িখানা পোড়ো বাড়ির মতোন, কতদিন যে চুনকাম হয়নি সময়ই তা জানে। বাড়ির সামনে দু’পাল্লা কাঠের দরজা, তাতে আলকারীর রঙ বর্ণ হারিয়ে সাদা জামা ঝুলকালিতে বোঝাই হয়ে যাওয়ার মতো দেখাচ্ছে। ঘরের সীমানার পাচিলটাও নোনা ধরা, বয়স্ক। ফ্যাকাসে লাল রঙের ইটগুলো দাঁত বের করে হাসছে। সূর্যাক্ষ দ্বিধাহীন হাতে বার কতক শেকলের বাড়ি দরজায় মারতেই কে যেন দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল। সূর্যাক্ষর মন প্রজাপতি হয়ে উড়তে লাগল দ্বীপীকে দেখতে পেয়ে। কিছু বলার আগেই দ্বীপী কেমন নরম চোখে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে উঠল, কাল যে এলি না বড়ো, জানিস আমি কি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম তোর সাথে কথা বলব না, রাগ করে থাকব।
সূর্যাক্ষর চোখ দুটো পোষা বেড়ালের চেয়েও অনুগত দেখাল, রাগ করিস না। দেখ আজ আমি কাকে সঙ্গে করে এনেছি।
দ্বীপী ভীতু চোখে লজ্জা মিশিয়ে তাকাল। রঘুনাথের চোখে সে চোখ ফেলতে পারল না। চোখ নিমেষে নামিয়ে নিয়ে ঠাকুর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
সূর্যাক্ষ কৌতুক হেসে বলল, ওকে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ওর নাম রঘু, রঘুনাথ। ভীষণ ভালো ফুটবল খেলে। বাঁশি বাজায়। সময়-সুযোগ হলে তোকে একদিন বাঁশি বাজিয়ে শুনিয়ে যাবে। কি রে রঘু, বাজাবি তো?
রঘুও নিরুত্তর, দম না দেওয়া ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো স্থির হয়ে আছে। নট নড়ন চড়ন। সূর্যাক্ষ ওর পিঠে থাবড়া মারল, কি রে কথা বলছিস না কেন? বোবা হয়ে গেলি বুঝি?
বিরক্তির সঙ্গে তাকাল রঘুনাথ, কথা থাকলে তো বলব? আমার কুনো কথা নাই। সব কথা মুখে এটকে গেছে।
–কেন রে?
–সামনে যে দাঁড়িয়ে আচে তার জন্য। রঘুনাথ এবার সংযমের বেড়া ভেঙে হেসে উঠল।
দ্বীপী বলল, তোর বন্ধু তো বেশ রগড় জানে। কোথায় বাড়ি রে ওর?
সূর্যাক্ষ কিছু বলার আগেই রঘুনাথ বলল, বাঁধের ধারে বুনোপাড়ায়। হলদিপোঁতা ধাওড়ার নাম শুনেচ?
ঘাড় নাড়ল দ্বীপী, আমরা তো রোজ ওই বাঁধ ধরে ইস্কুলে যাই! স্কুলে যাবার সময়টা আনন্দের চামর বুলিয়ে দেয় দ্বীপীর চোখে-মুখে। বিরক্তি নয় বেশ মজা হয় তার। মজার পাশাপাশি এক বিমল আনন্দ ছুঁয়ে থাকে তাদের। গ্রাম থেকে ওরা এক সাথে বেরয়। বাঁধের গোড়ায় এসে সূর্যাক্ষ বলবে, দ্বীপী, এবার তুই ক্যারিয়ারের পেছনে ঝপাৎ করে বসে পড়। কত আর হাঁটবি।
প্রথম প্রথম দ্বীপীর লজ্জা লাগত, এখন সেই লজ্জা শরত শিউলির মতো ঝরে গেছে। সাইকেল গড়ালে শুরু হয় ওদের কথামালা। দ্বীপী মুখ তুলে শুধোবে, হ্যাঁরে সূর্য, তোর কষ্ট হয় না আমাকে নিতে?
-ধ্যুৎ তোকে নিতে আমার কষ্ট কি। তুই যা রোগা। বোঝাই যায় না বসে আছিস।
-হ্যাঁরে, আমি কি এতই রোগা? বল তো আমি কার মতো রোগা? দ্বীপীর চকচকে চোখে দুঃশ্চিন্তা, আমি কি ডমরু ক্ষ্যাপার চেয়েও রোগা নাকি?
ডমরু বিয়ে পাগলা, রোগা খিটখিটে ওর চেহারা, মেয়ে দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে যেন ঠাকুর দেখছে। ওর নামে পাড়ায় পাড়ায় একটা ছড়া ঘোরে।
ডমরু ক্ষ্যাপা, বউয়ের বাবা,/বউ আনতে কবে যাবা।/ বউ গিয়েছে বাপের ঘর। এঁড়ে গোরুর লেজ তুলে ধর।
ডমরুর চেহারাটা মনে পড়তেই হেসে ফেলল সূর্যাক্ষ। দ্বীপীর স্ফুরিত অধরোষ্ঠ কেঁপে উঠল, হাসছিস যে! একদম হাসবি নে। তুই হাসলে আমার একদম ভালো লাগে না।
হাসব না কি কাঁদব? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সূর্যাক্ষ।
দ্বীপী সাইকেল থেকে ঝপ করে নেমে পড়ে, ধুলো ছিটিয়ে হাঁটতে থাকে রাগের ঘোরে। সূর্যাক্ষ তার সামনে গিয়ে মুখ ভেংচে বেল বাজায়। এভাবেই পাঁচ পাঁচটা বছর কেটে গেছে ওদের স্কুল যাওয়া আসায়। পাড়াপড়শিরা ভাবে ওরা দুটিতে যেন ভাই-বোন। ভাই-বোন না হলে কি তুই-তুকারি সম্পর্ক হয়।
দ্বীপী একদিন জামা ছাড়ছিল ঘরের ভেতর, সূর্যাক্ষ পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে একেবারে অবাক। দ্বীপীর ছড়ানো পিঠটা একেবারে টকটকে ফর্সা, হালকা লালচে আভা ফুটে উঠেছে ত্বকের উপর। চোখ বটআঠায় আটকে যাওয়া বনি পাখির চেয়েও অসহায়। গলা খেঁকারি দিয়ে কেশে উঠতে পারেনি সে, যদি স্বপ্নটা শেষ হয়ে যায়-ভয় একটাই। দ্বীপী টের পেয়ে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল সূর্যাক্ষকে। লজ্জায় আরক্ত তার চোখ-মুখ, কী অসভ্য রে তুই?
-কেন কী হলো? সূর্যাও কম অবাক নয়।
দ্বীপী নাকের ছিদ্র বিস্ফারিত করে বলেছিল, মেয়েরা পোশাক বদলালে সেখানে কি ছেলেদের থাকা উচিত হয়?
-মা তো শাড়ি বদলায়। আমি তো দেখি।
–মা তো কিছু বলে না।
-তখন তুই ছোট ছিলিস। ছোটদের চোখে পাপ থাকে না। শিশুদের চোখ তো ফুলের চেয়েও পবিত্র। তুই বইতে পড়িস নি? দ্বীপী কুলকুল করে হেসে উঠল, খবরদার আর কোনোদিন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবি না। তুই বড়ো হয়েছিস। আমিও বড়ো হয়েছি। এখন এসব ভালো দেখায় না। দ্বীপী হাই ইস্কুলের দিদিমণির মতো বলল কথাগুলো।
-তাহলে তুই যে আমার সাইকেলে বসে যাস, তখন! তখন যদি লোকে কিছু কথা বলে। দ্বীপীর মুখের গোলাপী আভা চিন্তায় মিলিয়ে গেল, লোকে বলতেই পারে। লোক কিছু বললে আমাদের সমঝে চলতে হবে। লোক যা বলবে তা আমাদের মানা উচিত।
আমি লোকের কথা মানি না। আমি শুধু তোর কথা মানব। বল দ্বীপী, আমার জন্য তোর মন খারাপ করে কি না?
দ্বীপীর কানের লতি লজ্জায় জবাফুলের মতো লাল হয়ে উঠল, তার মুখে কোনো ভাষা নেই, তার বুকের ভেতর শুশনিপাতার ঢেউ উঠল, কলজেটা গুড়ল পাখির মতো ডেকে উঠল গুড়গুড়িয়ে, সাবুদানা ঘাম বিজবিজিয়ে উঠল কপাল জুড়ে, কেঁপে কেঁপে উঠল চোখের তারা, ওর সিল্কি মুখে পিছলে যেতে লাগল জীবনের প্রথম রোদ্দুর, কোনোমতে ঠোঁটের কোণটা কামড়ে সে উদাস হয়ে গেল।
সূর্যাক্ষ খপ করে তার হাতটা ধরে মুচড়ে দিল জোর করে, তুই মিথ্যুক, ভীষণ স্বার্থপর। নিউটনের সূত্র বলছে–প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। তাই যদি হয় তাহলে তোর জন্য আমার মন খারাপ করলে তোরও আমার জন্য মন খারাপ করবে। আরে, এ তো এ প্লাস বি হোলস স্কোয়ারের ফরমূলার চাইতেও সোজা। তুই এটাকে ভুল প্রমাণ করবি কি করে?
–আমার হাতটা ছেড়ে দে সূর্য, লাগছে।
–লাগুক। লাগার জন্য তো ধরেছি।
–মেয়েদের হাত আর মন নরম হয় জানিস না বুঝি?
-কথা ঘোরাস না, সোজা কথার সোজা জবাব দে। সূর্যাক্ষ রীতিমতন উত্তেজিত, তুই যদি আমাকে কোনো জবাব না দিস তাহলে আমি আর কোনোদিন তোর বাড়িতে আসব না।
-না এসে থাকতে পারবি তো? আহ্লাদী গলায় প্রশ্ন করল দ্বীপী।
–আমাকে রাগাস না, আমি সব পারি।
–আমিও সব পারি।
–পাক্কা?
-পাক্কা। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে দ্বীপী হাসছিল। ওর রক্তবর্ণ পঞ্চদশী ঠোঁট পাকা তেলাকচুর মতো আহ্বান করছিল সূর্যাক্ষকে। সূর্যাক্ষ সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে ডানে বাঁয়ে তাকাল, তারপর দ্বীপীকে পাগলের মতো নিজের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, তুই আমার সঙ্গে না মিশলে আমি মরে যাবো দ্বীপী, আমি আর একটা লাইনও পড়তে পারব না। তুই আমার পড়া, তুই আমার খেলা, তুই আমার ঘুম সব। আমাকে ভুলে যাস না দ্বীপী। তুই ভুলে গেলে দেখবি আমি ডমরু পাগলার মতো মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
-কী ভাবছিস? দ্বীপীর ডাকে হুঁস ফিরে এল সূর্যাক্ষর। এমন ছেলেমানুষী তার ভেতরে মাঝে মাঝে ভর করে। সত্যি দ্বীপী এখন তার জীবনে প্রদীপের আলোর মতো। দ্বীপীকে সে কখনো খারাপ ভাবতে পারে না। দ্বীপীও তাকে নিকট বন্ধুর মতো দেখে সব সময়।
-তোর বন্ধু এল, ওকে ঘরে নিয়ে যাবি না বুঝি? দ্বীপী হাসতে হাসতে বলল, চল, ঘরে গিয়ে বসি। আজ নারকেল মুড়ি খাওয়াব। জানিস ভোরবেলায় গাছ থেকে একটা ঝানু নারকেল পড়েছে। বাবা মন্দিরে যাওয়ার আগে ছাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে ওটা। ভালোই হল নারকেলটা তোদের খাওয়াতে পারব।
দ্বীপী ওদের ঘরে বসিয়ে চলে গেল।
চন্দ্রিকা দ্বীপীর মা। কাঁসার জামবাটি ভরে মুড়ি আর নারকেল নিয়ে এলেন তিনি। রঘুনাথকে দেখে তিনি স্মিত হাসলেন, একটা জামবাটি তিনি রঘুনাথের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও বাবা, মুড়িগুলো খেয়ে নাও। আমি দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি দ্বীপীকে দিয়ে। দুধ মুড়ি খেলে পেটে কিছুক্ষণ থাকবে।
চন্দ্রিকা চলে গেলেন। দ্বীপী এল দুধভর্তি কাচের গ্লাস হাতে। রঘুনাথের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে সে বলল, আমাদের পোষা গোরুর দুধ। সব মিলিয়ে তিনটে আছে। তিনটেই পালা করে দুধ দেয়।
রঘুনাথ কাচের গ্লাসটা ধরে নিয়ে দ্বীপীর দিকে তাকাল। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে তার ধারণা ছিল না। দ্বীপীর মুখের গড়ন অনেকটা বাঁশ পাতার মতন, কথা বললে, হাসলে সুন্দর টোল পড়ে গালে। ঈদের চাঁদের মতো ওর চেহারাটা মেদহীন, পিঠ ছাপানো চুলগুলো ঢেউ খেলানো, অনেকটা কালো দিঘির জলের মতো ধারাবাহিকভাবে সাজানো। কখনোই দ্বীপী রোগা নয় বরং সে সাজানো-গোছানো সোনালি বালির চর।
দ্বীপী ঘরে এসে একটা কাঠের টুল টেনে নিয়ে ওদের মুখোমুখি বসল। খাওয়া থামিয়ে রঘুনাথ বলল, একদিন আমাদের ঘরে এসোখন। আমার মার সাথে তুমার আলাপ করিয়ে দেবখন। তুমারে দেখলে মা ভেষণ খুশি হবে। মা তুমার মতন সোন্দর মেয়েছেলে কুনোদিন দেকেনি।
সুতলি দড়ি দিয়ে টাঙানো ছিল দ্বীপীর ঘরের তিনটে জানলার পর্দা। ছাপা শাড়ি কেটে বানানো পর্দাগুলোর রঙ জ্বলে গেছে রোদ-হাওয়ায়, তবু বাতাস এলে ওগুলোই ফড়ফড়িয়ে ওড়ে, ঝলকে-ঝলকে আলো ঢুকে আসে বিনা বাধায়, মন্দ লাগে না দেখতে।
শিবমন্দিরের একমাত্র পুরোহিত হিসাবে বেশ নাম ডাক আছে দেবোত্তরের। তার নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা এবং ব্যক্তিত্ব সবার নজর কাড়ে। তবে পয়সার দিক থেকে মানুষটা একেবারে নুয়ে আছেন। পরপর তিন মেয়ে তাঁর জীবনে হতাশার সৃষ্টি করেছে, সে হতাশার কথা মাঝে মাঝে চন্দ্রিকার কাছে প্রকাশ করে তিনি ধমক খান। চন্দ্রিকা ঠোঁট কামড়ে বিরক্ত হয়ে বলেন, এ যুগে ছেলে-মেয়ের ফারাক দেখতে যেও না। এখন ছেলে-মেয়ে সব সমান, দু-চোখের তারার মতো।
মেয়েগুলোকে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলেন দেবোত্তর, কিন্তু শুধু দ্বীপী ছাড়া আর দুটি মেয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হতে দিল না। বড় মেয়ে লহরী স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে টেনে-টুনে। সে আর প্রি-ইউনিভার্সিটি পড়তে চাইল না নিজের ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে। একটা পাশ করেই সে স্থিতু হয়ে বসে আছে ঘরে, গ্রাম ছেড়ে বাইরে বেরতে তার তীব্র অনীহা, মাঝেমধ্যে সে দেবোত্তর সঙ্গে শিবমন্দিরে গিয়ে বিড়বিড় করে আপনমনে। দেখতে শুনতে সে মন্দ নয়, চোখ নাক মুখ আকর্ষণীয়, তাই দু-চারটে সম্বন্ধ আসছে এদিক-সেদিক থেকে। পাত্রপক্ষের মেয়ে পছন্দ হলেও বিয়ে হচ্ছে না দেনা-পাওনার জন্য।
ঊর্মি একটু কম কথা বলে, সে পড়াশোনায় ভালো ছিল কিন্তু অসুখ ওর পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটায়। প্রায় দিন সে শারীরিক কারণে স্কুলে যেতে পারত না, স্কুলে গেলেও বাড়িতে এসে তার পড়ার শক্তি থাকত না। ফলে সে বাধ্য হয় লেখাপড়ায় ইতি টানতে। দ্বীপী তিন বোনের মধ্যে সব চাইতে পড়াশোনায় ভালো, ওর স্মৃতিশক্তি প্রখর–একবার পড়লে সব মনে থেকে যায়। সে এবার সায়েন্স নিয়ে ক্লাস টেনে উঠেছে, সূর্যাক্ষ তার সহপাঠী। ওরা এক সঙ্গে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি আর বায়োলজি পড়ে। দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা এক সঙ্গে অঙ্ক করে। পড়াশোনায় ওদের অমনোযোগ লক্ষ্য করেনি কেউ। দ্বীপীর খুব ইচ্ছে সে বড়ো হয়ে রিসার্চ করবে কেমিস্ট্রি নিয়ে, তা যদি না হয় তাহলে সে ব্যাঙ্কে চাকরি করতে চায়, কেন না তার মামা প্রায় বলেন, ব্যাঙ্কের মাইনে অন্যান্য সরকারি সংস্থার চাইতে ঢের বেশি। বাবার দুঃখ দূর করতে হলে দ্বীপীর অনেক টাকা দরকার। ইদানীং তার পড়ার চাপ বেড়েছে প্রচণ্ড, সে সময় পায় না তাই ভোরবেলায় উঠে মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসে। দেবোত্তর ছোট মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
দ্বীপী লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হলে দুঃখ ঘুচবে দেবোত্তরের। চন্দ্রিকাও দ্বীপীর দিকে তাকিয়ে আছেন। ছোট মেয়েকে নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। আর যাই হোক দ্বীপী তাদের মনে দুঃখ দেবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিকে সে সহজভাবে মানিয়ে নেবে। সেই ক্ষমতা তার আছে।
দ্বীপীদের বাড়ি থেকে বেরতে ন’টা বেজে গেল। গাঙধারের আখ খেত থেকে হাঁক ভেসে এল পেয়াদার। এখন খটখট করছে আকাশ, কোথাও এক চিলতে মেঘের দেখা নেই। বাতাস জড়িয়ে ধুলো উড়ছে সর্বত্র। আর কতদিন প্রকৃতিতে ধুলো খেলা চলবে বুঝতে পারল না সূর্যাক্ষ। রোদ বাড়লে স্কুলে যেতে কষ্ট হয়। ছাতা নেওয়া তার পোষায় না। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ক্যারিয়ারে দ্বীপী, এই তিনের সমন্বয়ে খেলাটা বড়ো কঠিন হয়ে যায়, একটু অমনোযোগ হলে দুর্ঘটনা ঘটতে বেশি সময় লাগবে না।
দ্বীপী তার সঙ্গে থাকলে বুকে বল পায় সূর্যাক্ষ। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেলে তারা মোকামপাড়ার রাস্তাটা ধরে ফিরতে ভালোবাসে। নির্জন রাস্তা দ্বীপীর খুব পছন্দ। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ও কুটকুট করে কথা বলে। পণ্ডিত বিলের জলে গড়িয়ে যায় তার মাধুর্য-ভরা কণ্ঠস্বর। সূর্যাক্ষ তাকে তাতিয়ে দেবার জন্য বলে, জানিস তো, বিলের বালিহাঁসগুলো তোর চাইতে দেখতে সুন্দর। আমার ওদের ভালোবাসতে ভীষণ ইচ্ছে করে। দ্বীপী রাগে না, শুধু মসৃণ কাঁধটা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট ওলটায়, জানিস তো তোর চাইতে আমবাগানের হনুমানগুলো আরও সুন্দর। ওদের পোড়ামুখ ঠিক তোর মতন। তবে ওদের ঝকঝকে দাঁতগুলো তোর মতন হলুদ আর ছাতা ধরা নয়। ওরা তোর চেয়েও ভদ্র।
–তুই এসব আমার নামে বলতে পারলি?
-কেন বলব না, তুই থুতু ছিটালে আমি কি তোকে ফুল ছিটাবো? দ্বীপী গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, আমি গান্ধীনীতিতে জীবন কাটাতে পছন্দ করি না। আমার আদর্শ সুভাষচন্দ্র। কেউ যদি আমাকে চড় মারে, আমি তাকে অবশ্যই ঘুষি মারব।
-কী মেয়েরে বাব্বা! সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল সূর্যা।
দ্বীপী তোয়াক্কাহীনভাবে বলল, মেয়ে বলে ভাবিস না চিরটাকাল তোদের কথা শুনব। তুই ঠিকই বলেছিস আমি হলাম বালিহাঁস! কেন জানিস? বালিহাঁস ভীষণ চালাক। অনেক সময় জাল ফেলেও ওদের ধরা যায় না।
বিলের জল সোজা কোমর দুলিয়ে নাচের মুদ্রায় চলে গিয়েছে জগৎখালি বাঁধ বরাবর। একটা সুইচ-গেট আছে জল এদিক-ওদিক যাবার জন্য। বর্ষায় বিল ভরে গেলে বাঁধের পাহারাদার চাবি ঘুরিয়ে গেট খুলে দেয়। জল তখন ছুটতে থাকে কমলাবেড়িয়ার দিকে। এখন রোদ গায়ে মেখে জলো শ্যাওলা বুকে নিয়ে জল চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আকাশমুখো। নাকছাবির চেয়েও সুন্দর ঘেসো ফুল জড়িয়ে ধরেছে জলের কোমর। কনে সাজানোর মতো যেন সেজে উঠেছে পুরো পণ্ডিত বিল। একবার দেখলে তার দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
বেশির ভাগ দিন এ পথ দিয়ে গেলে সাইকেলে বসতে চায় না দ্বীপী। সূর্যাক্ষ কিছু বললে ভ্রূ তুলে তাকায়, এত জল এ তল্লাটে এ সময় আর কোথাও নেই। জলের পাশে হাঁটতে আমার ভালো লাগে, যদিও মা বলে আমার নাকি জলে ফাড়া।
সূর্যাক্ষ সকৌতুক হাসে, তুই এসব বিশ্বেস করিস? অমলকান্তি স্যার বলছিলেন গ্রামে বিজ্ঞান সচেতনতার উপর ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠান করবেন। আমি বললাম হলদিপোঁতায় করলে কেমন হয়? স্যার ভেবে দেখছেন।
–অমলকান্তি স্যার মনে হয় খুব রাগী। দ্বীপী মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করল, স্যার বলছিলেন আমাদের ভারতবর্ষের অনেক মানুষই নাকি এখনও পেট পুরে খেতে পায় না।
তোর কোনো সন্দেহ আছে? সূর্যাক্ষ দ্বীপীর চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। বাঁধের কাছে এসে সূর্যাক্ষ মন খারাপ করে বলল, এবার আমাকে ঘরে ফিরতে হবে রঘু, তুই এবার একা চলে যা। যদি সময় পাই বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করব। আর হ্যাঁ, শোন কোনো দরকার হলে তুই আমাকে অবশ্যই বলবি। সবসময় ভাববি আমি তোর পাশে আছি।
রঘুনাথ ঘাড় নাড়তেই সূর্যাক্ষ ফিরে যাচ্ছিল সাইকেল নিয়ে। সেই সময় হঠাৎ মাঠ থেকে ধুতি পরা অবস্থায় উঠে এলেন নীলাক্ষ। রঘুনাথের দিকে তর্জনী উঠিয়ে বললেন, ওই বুনোদের ছেলেটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছো? জানো কি ওর স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়। কাল আমার মুখে মুখে তর্ক করছিল পুকুরপাড়ে। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, পেটে কালির আঁচড় নেই, কত আর ভদ্র হবে। সূর্যাক্ষ কি জবাব দেবে ভাবছিল। নীলাক্ষ তড়িঘড়ি করে বললেন, ওর সাথে মিশবে না। ওদের সঙ্গে যদি সম্পর্ক রাখতে হয় তাহলে দূর থেকে রাখবে। উপর উপর হ্যাঁ-হুঁ বলে ছেড়ে দেবে। তোমার বাবার মতো আবার গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ো না।
সূর্যাক্ষ বিরক্তি হজম করে তাকাল। কপোতাক্ষর অপমান তার গায়ে ফোসকা ফেলে। অমলকান্তি স্যার তার বাবাকে দেবতার চোখে দেখেন। অথচ তার নিজের দাদা ছোটভাইকে হেয় করছে। এদের যে কী বিচার সঠিক বুঝতে পারে না সূর্যাক্ষ। সে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততা তৈরি করল, জেঠু, আমি এখন যাই। আমাকে আবার স্কুল যেতে হবে। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল সূর্যাক্ষ, আর তখনই নীলাক্ষর গলা ফাঁকা জায়গায় গমগমিয়ে উঠল, শোন তোমার এবার কোন ক্লাস হলো?
ঘাড় ঘুরিয়ে পাংশু মুখে সূর্যাক্ষ জবাব দিল, ক্লাস টেন।
–বেশ, বেশ। মাথা দোলালেন নীলাক্ষ, কপালে অবাঞ্ছিত ভাঁজ, শোন, যে কথা বলার জন্য তোমাকে আটকে দিলাম। ওই যে শিব মন্দিরের পুরোহিতটা, কী যেন নাম, ওঃ মনে পড়েছে দেবোত্তর ঠাকুর, ওর মেয়েটার সাথে বেশি মিশবে না। আমি শুনেছি তোমার নাকি ওদের বাড়িতে যাতায়াত বেড়েছে। এটা ভালো কথা নয়। গ্রামে থাকি। সব কথা আমার কানে আসে। তুমি আমাদের বংশের ছেলে। আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়।
খুব অসহায়ভাবে সূর্যাক্ষ বলল, দ্বীপী আমার সঙ্গে পড়ে। ও তো সায়েন্স নিয়েছে। আমার চাইতে পড়াশোনায় ভালো। আমরা দুজনে একসঙ্গে অঙ্ক করি।
-কেন তোমার বাবা কি তোমাকে মাস্টার দিতে পারেনি? ঝাঁঝালো গলায় অবজ্ঞা মিশল নীলাক্ষর।
সূর্যাক্ষ পরিস্থিতিকে সামাল দেবার জন্য বলল, না তা নয়। বাবা টিউশনি দিতে চেয়েছিল আমারই সময় হয় না। এতদূর থেকে কালীগঞ্জে গিয়ে টিউশানি পড়া পোষায় না। যাওয়া-আসায় অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়।
-তা ঠিক তবে পড়াশোনার প্রতি আরও যত্নশীল হও। তোমার দাদা রুদ্র সেন্ট পল’এ ভর্তি হয়েছে একথা কি তুমি জানো? সন্তান গর্বে নীলাক্ষর চোখ-মুখ ঝকঝকিয়ে উঠল, রুদ্রের মতো ছেলে এ গ্রামে আর একটিও নেই। তুমি চেষ্টা করো দাদাকে ছাপিয়ে যাওয়ার।
–আমার স্মৃতিশক্তি কম।
-বেশি ঘোরাঘুরি না করলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। মনটাকে নিজের ভেতর আত্মস্থ করো। দেখবে তাহলে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। নীলাক্ষ জ্ঞান দেবার ভঙ্গিতে বললেন কথাগুলো। অসহিষ্ণু সূর্যাক্ষ অস্থির হয়ে বলল, জেঠু, এবার আমি যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
যাও, তবে ওই পুরোহিতের মেয়েটাকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যাবে না। মনে রাখবে তুমি ওর সহপাঠী, ওর চাকর নও।
মুখটায় হঠাৎ কেউ বুঝি ছিটিয়ে দিল দোয়াত ভর্তি কালি, সূর্যাক্ষ কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল নিজের কালিমায় ভরা মুখের কথা চিন্তা করে।
নীলাক্ষর আরও কিছু বলার ছিল। তিনি এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন সূর্যাক্ষের কাছে। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, তিতির বেলডাঙা কলেজে পড়তে যায়। ওর কলেজ যেতে খুব আগ্রহ। আমি শুনেছি কালীগঞ্জের একটা ছেলে ওর পেছনে লেগেছে। ও তোমার দিদি হয়। একটু খেয়াল রেখো। কোনো খবর থাকলে আমার কাছে গোপন করবে না। থানার ও.সি. আমার বন্ধু। আমি ভাবছি বেণীমাধবকে দিয়ে ছেলেটাকে একটু টাইট দিতে হবে। ঘি আর আগুনের কারবার। বলা যায় না তো কখন বিপদ ঘটে যায়!
নীলাক্ষ চলে যাওয়ার পরও হাঁটতে পারছিল না সূর্যাক্ষ। এলোমেলো কথাগুলো বিষাক্ত পোকার মতো দংশন করছে মাথার ভেতর। এত বয়স হল তবু মানুষটার কোনো রুচিবোধ জন্মাল না। একটা সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব তার ভেতরে ঘোলা জলের মতো বিরাজমান। কপোতাক্ষর সঙ্গে এই প্রবীণ মানুষটির কত অমিল। চিন্তাভাবনায়, মন মানসিকতায় দু’জন দুই মেরুর বাসিন্দা। কপাল টিপে দূরের বাঁধের দিকে তাকাল সূর্যাক্ষ। রঘুনাথকে আর এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। রোদের মধ্যে একলা হেঁটে যাচ্ছে রঘুনাথ। সূর্যাক্ষ ভাবল-কপোতাক্ষ কি ওদের মাথায় ছাতা হতে পারবেন?
.
০৮.
অশ্বত্থতলায় ভিড় লেগে থাকে সবসময়। পাড়ায় বউ-ঝিরা এসময় জল আনতে যায় বুড়িগাঙে। কেউ কেউ প্রাতঃকৃত্য সেরে গা ধুয়ে ঘরে ফেরে। এই বুড়িগাঙ আছে বলে অনেকের ভরসা। স্রোত থেমে গেছে, তবু তো গাঙ। বর্ষায় এর দাপট দেখলে ভয় হয়, পিলে চমকে যাবার উপক্রম। দুর্গামণি একবার ভরা বর্ষায় ভেসে যাচ্ছিল স্রোতের তোড়ে। দুলাল ডিঙা নিয়ে গিয়ে তাকে বাঁচায়। তা যদি না হত তাহলে একেবারে মানিকডিহির গাঙে গিয়ে পড়ত দুর্গামণি। ওখানে জলের স্রেত মুখে গাঁজরা নিয়ে ছোটে। বড়ো বড়ো নৌকা পারাপার হয় সব সময়। কেননা নতুনগ্রাম যেতে হলে এ জল পেরতে হবে সবসময়।
রঘুনাথ পাকুড়তলায় এসে দাঁড়াল। একটা ঘোরের মধ্যে কতগুলো ঘন্টা তার কেটে গেল। সেই আচ্ছন্নতা এখনও হেমন্তের শিশিরের মতো তাকে লেপটে আছে। ঘটনাগুলো ভিড় করে একের পর এক মনে আসছে, আর অমনি তার মনের ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন, বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। এসব অনুভব সে তার মাকেও বলে বোঝাতে পারবে না। দুর্গামণির এত বোঝার ক্ষমতা কোথায়? তার সরল সাদাসিধে মন তো পাকা আতার মতো, একটু চাপ দিলে ভেঙে যায়।
রঘুনাথ দুলালকে দেখতে পেয়ে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেল, কাকা, তুমার সাথে দাদুর কি দেকা হয়েছে? দাদু তুমাকে পাগলের মতোন খুঁজছিলো।
-আমি খপর পেয়েছি ভাইপো, কিন্তু এখুনো তার সাথে আমার দেখা হয়নি। মেয়েটাকে লিয়ে আমার এখুন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলদশা। বিয়ের এত বছর পরে জামাই আবার সাইকিল চাইচে। কুথায় পাবো ভাইপো, তুই তো আমার অবস্থা লিজের চোক্ষে দেকচিস!
রঘুনাথ সমব্যথীর চোখে তাকাল। সহসা তার মনে পড়ে গেল কপোতাক্ষর কথা। ওই মানুষটা পারেন এই বিপদ থেকে দুলালকে উদ্ধার করতে। কিন্তু কী ভেবে রঘুনাথ কোনো কথা বলার উৎসাহবোধ করল না। সে অস্ফুটে প্রশ্ন করল, কাকা, বাবা কেমুন আচে? তার খপর সব ভালো তো?
গুয়ারামের জন্য রঘুনাথের মনটা মাঝে মাঝে উতলা হয়ে ওঠে, ঝড়ে নুইয়ে যাওয়া ধানচারার মতো অবস্থা তখন। দুর্গামণি চুনারামের সামনে গুয়ারামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না, মনটা কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকে, সংকোচ হয়। একসময় তার মনে হয় মানুষটার সঙ্গে গেলে বুঝি ভালো হত। তাহলে এত চিন্তা মনটাকে খুবলে খেত না। কদিন থেকে গুয়ারামের স্বপ্ন দেখছে দুর্গামণি। না জানি কেমন আছে সে। দুলালের সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। দুলালের আসার সংবাদ সে পেয়েছে কিন্তু তার দর্শন সে এখনও পায়নি। দুলালকে খবর পাঠিয়েছে চুনারাম। সময় বের করে সে নিশ্চয়ই আসবে, কথাবার্তা হবে। গুয়ারাম চুনারামের একমাত্র লাঠি যা শেষ বয়েসে হাত ধরে তাকে অনেকটা পথ নিয়ে যাবে।
দুলাল একটা বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দিল বাতাসে, তোর বাপের খপর ভালোই তবে সে মাঝখানে জ্বরজ্বালায় ভুগল। ওদিককার হাওয়া-বাতাস ভালো নয়রে। গায়ে সয়ে যেতে টেইম লাগবে। তাছাড়া জল বদলের সাথে সাথে মানুষের মনও বদল হয়। জলবদল মানিয়ে নিলেও মনবদল মানিয়ে নিতে সময় লাগে।
-এখুন কেমুন আচে সে? রঘুনাথের চোখে উৎকণ্ঠা গড়িয়ে পড়ল।
-বললাম তো ভালো আচে। চিন্তার কুনো কারণ নেই। দুলাল এত জোর দিয়ে কথাগুলো বলল যেন সে এই প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত।
-তুমি কবে যাবে গো, কাকা?
–দেকি কবে ও দেশের মাটি টানে! ফ্যাকাসে হাসি দুলালের ঠোঁটে ঝুলে রইল, মাটি না টানলে কিছু হবার নয়। মানুষের কি সাধ্যি মাটিকে এড়িয়ে চলে।
দুলাল হঠাৎ-ই যেন দার্শনিক হয়ে গেল।
রঘুনাথ বলল, কাকা, একবার সময় হলে ঘরের দিকে এসো। মা’র সাথে দেকা করে যেও। দাদুও খুব চিন্তায় আচে।
দুলাল রঘুনাথের কথাকে পাত্তা দিল না, পোড়া বিড়িটা ধুলোর ওপর ছুঁড়ে দিয়ে সে বেজার মুখে বলল, আমারও মনটা ভালো নেই ভাইপো। মেয়েটার জন্যি ভারী চিন্তা হচ্চে। জামাই বাছাধনকে আমার বিশ্বেস নেই। কখন মেয়েটার কী ক্ষতি করে ফেলে! যা যুগ পড়েচে, এখুন কুনো ক্ষতি হয়ে গেলে পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই।
কাজ কামাই করে ঘর আগলে পড়ে আছে দুলাল। ইন্দুবালারও মন সায় দিচ্ছে না কাজে যাওয়ার। বিন্দু তাদের একমাত্র সন্তান। ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বসলে সারা জীবন পথে বসে কাঁদতে হবে। তখন চোখের জল মুছিয়ে দিতে কেউ আসবে না। জামাই শ্রীকান্ত বিন্দুকে বড়ো জ্বালায়, খোঁটা দেয় গরীবিয়ানার। বিন্দু এসব সহ্য করতে পারে না, সে অঝোর নয়নে কাঁদে। শ্বশুরঘরে তার চোখের জল মুছিয়ে দেবার কেউ নেই। বিন্দুর এই বিবশতার সুযোগ নিতে চায় শ্রীকান্ত। সে ধাওড়াপাড়া ছেড়ে পালিয়ে যায় শহরে। ওখানে নাকি ওর বন্ধু থাকে। শ্রীকান্তর কথাবার্তা সন্দেহজনক। চালচলনও ভালো লাগছে না বিন্দুর। মানুষটা নিশ্চয়ই খারাপ মানুষের খপ্পরে পড়েছে নাহলে থানা থেকে পুলিশ কেন আসবে তার খোঁজে? পুলিশ আসার পর থেকে শ্রীকান্ত পলাতক। তার নাকি এখন প্রচুর টাকার দরকার। টাকা হলে কেস সব মিটে যাবে, সে আবার মাথা উঁচু করে গ্রামে ফিরতে পারবে, পুলিশও তার পিছু ছেড়ে দেবে।
এত টাকা কোথা থেকে আসবে দুলাল ভেবে পেল না। তার ভাগ্যটাই ছোট থেকে পোকায় কাটা। ভূষণী তার জন্মদাত্রী মা কিন্তু এই মাকে সে কি কোনোদিন ক্ষমা করতে পেরেছে? নাকি ক্ষমা করা যায়?
ধাওড়াপাড়ার সবাই জানে দুলালের বাপ দয়াল কেমন মাটির মানুষ ছিল। তার ভালোমানুষীর পুরস্কার সে পেয়ে গিয়েছে। ভূষণীকে মন দেওয়ার পর থেকে সে পাগল হয়ে গিয়েছিল ড্যাং-ডেঙে বাস্তুতলার মেয়েটার জন্য। ভাদু পরবে ভূষণী নজর কেড়েছিল তার, ডুরে শাড়ি পরে ঝকঝকে আলোয় ভূষণী যেন বিয়ে বাড়ির ঝাড়বাতি। ভাদু পরবের মেলায় ওদের আলাপ হল, সেই আলাপ গড়িয়ে গেল পুতুলনাচের আসর অবধি। লায়লা-মজুনর পালা দেখে মজনুর জন্য চোখের জল ফেলেছিল ভূষণী, তার কাঁচা মনের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, আমারে লিয়ে পেলিয়ে চলো, তুমারে ছাড়া আমি আর থাকতে পারচি নে। এর চেয়ে বেশি ব্যথা দিলে মরে যাবো গো। ভাদুপরবে আলাপ, তার দু-মাস পরে ভূষণীর হাত ধরে গাঁয়ে ঢুকেছিল দয়াল। মেয়েমানুষের রূপ দেখে সেদিন হাঁ হয়ে গিয়েছিল গাঁয়ের মানুষ, কেউ কোনো বিরুদ্ধ রা কাড়ার সাহস দেখাল না। সবাই আড়ালে আবডালে বলল, দয়ালটার বউভাগ্য চকচকে তবে দেখো কতদিন এই সোনা গরিবের ঘরে চকচকায়। মেয়েমানুষ বুড়িগাঙের জলের মতোন, আজ এখানে কাল সিখানে। এরা কোকিলা পাখির মতোন স্থিতু হতে জানে না, শুধু এ-ডালে সে-ডালে উড়ে বেড়ায়। বিয়ের হলুদ ফিকে হতেই দয়াল সকাল হলেই ছুটে যেত জনমজুর খাটার জন্য। না খাটলে পয়সা দেবে কে? মুখ দেখে তো কামাই হয় না। এভাবেই অভাবের সংসার চলছিল গড়িয়ে গড়িয়ে। তিন বছর পেরিয়ে গেল বিয়ের তবু ভূষণীর গতর ভারী হল না। পাড়ার বউরা তাকে পাকুড়তলায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বোঝাল, কিরে ভূষণী, এক বেছানায় নিদ যাস তো? তোর বরটা কেমুন রে, এখনও কুনো ফল দিল না। ফুল হবে না, ফল হবে না শুধু শুখাগাছ নিয়ে কী লাভ?
সেই থেকে চিন্তাটা মাথায় ফুট কাটছিল ভূষণীর। কত রাত যে ভোর হল তবু সেই রাতের ফসল শরীরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করল না। তাহলে কি তার শরীরটা খরার মাটি, দানা ছড়ালেও ফসল ফলে না? কপালে চিন্তার ভাঁজ, ভূষণী রাতে ঘুমাতে পারে না। নাগরা বাজিয়ে দয়াল ফেরে অনেক রাতে, ফিরেই সে ভূষণীর উষ্ণতা চায়। ভূষণী মুখ ঝামটায়, যাও গান-বাজনা নিয়ে মেতে থাকো গে, আমাকে দেখার তুমার সময় কুথায়। ভাবছি-কাল থিকে আমি তুমার সাথে কাজে যাব। ঘরে আমার মন ধরে না। সময় শিল-নোড়ার মতো বুকের উপর চেপে বসে।
সাহেব মাঠে তখন কাজ চলছে, আখ ঝোরার কাজ। আখ কেটে আলসে সাফসুতরো করে আঁটি বাঁধা। মিল কোম্পানীর ট্রাক্টর এসে নিয়ে যাবে। মিলবাবু নীলকণ্ঠ কাজ দেখাশোনা করে মন দিয়ে। মুনিষ যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় সেইজন্য তিনি আলের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কালীগঞ্জ বাজারে তার কোঠাদালান, ঘরে রূপসী বউ সুবর্ণা। বউ রূপসী বলে সংসারে খিটিমিটি লেগে আছে। নীলকণ্ঠবাবুকে সুবর্ণা পাত্তা দিতে চান না, জুতোর শুকতলা বানিয়ে রাখতে চান। নীলকণ্ঠবাবু মেনে নিতে পারেন না এই অত্যাচার। সুবর্ণাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বলেন, তোমার মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। যাও না কদিন বাবার কাছ থেকে ঘুরে আসো।
সুবর্ণা ভ্রূ-কুঁচকে তাকাল, আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো? যদি যাই তাহলে আর আসব না। পায়ে ধরে ডাকলেও আসব না। আমার বাবা-দাদার সাধ্য আছে আমাকে বসে খাওয়ানোর।
সুবর্ণা মনের জ্বালা মেটাতে চলে গেলেন। বড়ো একা হয়ে গেলেন নীলকণ্ঠ। ঘরে মদ খেতেন গলা পর্যন্ত। সুবর্ণার অনুপস্থিতি রুক্ষ করে তুলত তার মেজাজ। যত দিন গেল শরীরের ক্ষিদেটা পদ্মানদীর জলের মতো ফুঁসতে লাগল। সুবর্ণাকে চিঠি লিখলেন তিনি, ফিরে এসো। যা হবার হয়েছে। আমি আর পারছি না।
সুবর্ণা এলেন না, জেদ ধবে থাকলেন শহরের মাটিতে।
মিল কোম্পানীর কাজে কামাই করা পছন্দ করেন না নীলকণ্ঠবাবু। রোজ সাইকেল নিয়ে তিনি মাঠে যাবেনই যাবেন। সেদিন কাজ হচ্ছিল পশ্চিমধারের আখক্ষেতে। দয়াল আসেনি, কোন গাঁয়ে তার কীর্তন আছে, সেখানে তাকে ঝাল করতাল বাজাতে হবে। খোলওয়ালা না এলে গলায় ঝুলিয়ে নিতে হবে পোড়ামাটির খোল। সব বাদ্যযন্ত্র দয়ালের হাতে পড়লে পোষা বেড়াল। দয়ালও বাজায় খুব নিষ্ঠা সহকারে। শরীর নিংড়ে সুর বের করে।
ভূষণী আখের ভূঁইয়ে কাজ করছিল। আলের উপর দাঁড়িয়ে ভূষণীর যৌবন দেখছিল নীলকণ্ঠ। একটু আগে সে নেশা করেছে, ফলে ঘোর ঘোর দৃষ্টি। ভূষণীর শরীরের বাঁধন গঙ্গামাটির মতন ঢিলেঢালা নয়, বরং ওর শরীরের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে পুরুষের নোঙর করা মন। সুবর্ণার এত অহঙ্কার কিসের? ওর গায়ের চামড়া ফর্সা বলেই কি? যতই ফর্সা হোক সুবর্ণা, ভূষণীর কাছে সেই রঙ চুনকাম করা দেওয়াল ছাড়া আর কিছু নয়। ভূষণীর মাজা রঙে লালিত্য মাগুরমাছের ত্বককেও হারিয়ে দিচ্ছে। ও হাসলে বাবলাগাছে ঝুমা ঝুমা ফুল ফুটে ওঠে অজস্র। আর সেই হলুদফুল বাড়িয়ে দিচ্ছে রোদের নম্রতা। নীলকণ্ঠ ভূষণীর দিকে কাঁপা চোখে তাকিয়ে ধরা পড়ে গেল। ভূষণী হাসতে হাসতে বলল, বাবু, তুমার লিখা হয়েছে গো। যাও, ঝটপট ঘর চলি যাও। ঘর গিয়ে মাথায় ঠাণ্ডা তেল জেবড়ে আরামে নিদ যাও। আর রোদে রোদে ঘুরোনি।
-ঘর গেলে কি নিদ আসে রে? মন তো মাঠে পড়ে থাকবে। নীলকণ্ঠর কথা জড়িয়ে গেল, সে টলে পড়ল ভূষণীর উপর, আমাকে ধর। ঠেকা দে।
-ঘর যাও বাবু।
–কার জন্য ঘর যাবো বল? সেখানে কে আছে আমার?
–কেনে তুমার বউ!
–তার মুখে লাথি মারি। সে আমার মুখে লাথি মেরে চলে গিয়েছে। চুল চেপে ধরে ডুকরে উঠল নীলকণ্ঠ।
ভূষণী মাতাল মানুষটাকে সামলাতে গিয়ে নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ল। নীলকণ্ঠ তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল ঘাসের বিছানায়। ভূষণীর বুকের উপর চড়ে বসেছে সে, আমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিস নে ভূষণী। তুই ফিরিয়ে দিলে আমি মরব। কেউ আমাকে ভালোবাসা দেয়নি, অন্তত তুই আমাকে একটু হলেও ভালোবাসার স্বাদ দে। আমি তোকে ঠকাব না রে, তুই চাইলে আমি সব ফেলে তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব।
আখের খেতে আলো আঁধারী আলো, কিছু দূরে দিঘিতে ঢেউ উঠেছে জলের, ছোট ছোট আবেগ ভরা ঢেউগুলো সিঁদিয়ে যাচ্ছে জলের শরীরে আলোড়ন তুলে। ভূষণী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, সে ঢেউ হল, জল হল, তারপর ভ্রমরবসা শাপলা ফুলের মতো হেসে উঠল খিলখিলিয়ে, কিছু হয়ে গেলে তার দায় তুমি নেবে তো বাবু? ধোঁকা দিবেনি তো?
-বললাম তো চল পালিয়ে যাই এদেশ ছেড়ে। নীলকণ্ঠ বাধাহীনভাবে ঠোঁট ঘষে ভূষণীর লালচে ঠোঁটে।
ভূষণী দু-হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে পুরুষশরীর। তার আধফোঁটা চোখ, মলাটহীন দেহাতি শরীর তিরতির করে কাঁপে, যাব নি গো বাবু যাবনি। এ মাটি ছেড়ে আমি কুথাও যাবনি। ইখানেই বাঁচব, ইখানেই মরব। এত সুখ এই দেশছাড়া আর কুথায় পাবো।
দয়ালের পুরুষক্ষমতা ছিল না যদিও সে সুপুরুষ তবু সে ফসল ফলানোর চাষি নয়। মাত্র তিন মাসেই ভূষণী টের পেয়ে গেল সে মা হতে চলেছে। নীলকণ্ঠ দয়ালকে আগোলদারের কাজ পাইয়ে দিয়েছে সাহেবমাঠে। রাতে সে ঘরে থাকে না। পাঁচ হাত লাঠি বাগিয়ে চলে যায় খেত আগলাতে। তার গলার স্বরে বাতাস কাঁপে, ভুই কাঁপে। মাঠ জেগে ওঠে সেই অসুর শব্দে। ঘরে বসে ভুষণী সব শুনতে পায়, নীলকণ্ঠর অপেক্ষায় তার দু-চোখের পাতা এক হয় না, শরীরের নেশাটা গুড়মদের মতো চাগান দেয়, নীলকণ্ঠ এসে তার নেশাকে চূর্ণ করে মোকামপাড়ার বিলপথে ফিরে যায়।
একদিন দয়ালের চোখে ধরা পড়ে গেল ওরা। সেদিন নেশার ঘোরে মারাত্মক বাড়াবাড়ি করে ফেলল দয়াল। পুরো পাড়া জাগিয়ে দয়াল ঠুকরে উঠল, পালা আমার ঘর থিকে পালা। নাহলে চুলের মুঠি ধরে তুরে আমি ঘর থিকে ছুঁড়ে বুড়িগাঙের জলে ভেসিয়ে দেব। কাক-শকুনে খাক তুর যৌবন। তুর এত রূপের গরব। মরবি। মরবি। মরবি।
নীলকণ্ঠ চুপচাপ চলে গেলেও তার ভেতরে অপমানের তুষআগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। সেই আগুন সময়ের প্রশ্রয়ে বেড়ে দাবানলের সৃষ্টি করল। এক মাসের মধ্যে দয়ালের লাশ পড়ে থাকল খেতের আলে। সাত মাসের পেট নিয়ে ভূষণী কাঁদল অঝোর ধারায়। সে চায়নি দয়াল ঝরে যাক তেঁতুলফুলের মতো।
এসব খবর সুবর্ণার কানে পৌঁছে গিয়েছিল লোক মারফত। তাছাড়া এই মুখরোচক সংবাদ নিয়ে চোত-গাজনে বোলান বাঁধল বারোয়ারি পাড়ার দল। তাতে নীলকণ্ঠ আর ভূষণীর প্রেমকাহিনি পেয়েছিল প্রাধান্য। দয়ালের অস্বাভাবিক মৃত্যুটাকে গ্রামের মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। ঈর্ষায় কালো হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার ফর্সা মুখ। প্রায় মাসের উপর তিনি ঘরের বাইরে বেরতে পারেননি লজ্জায়। নীলকণ্ঠ তাকে এভাবে হারিয়ে দেবে, তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। ভূষণী কি তাহলে তার চাইতেও সুন্দরী? হতে পারে। তাকে একবার চোখে দেখা দরকার। শত্রুকে অত সহজে ছেড়ে দেওয়া নয়। লোকে দুধ-কলা দিয়ে বিষধর সাপ পোষে। আবার সেই সাপের ছোবলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। হিসাব চুকিয়ে না দিলেই সুদে-আসলে বাড়বে। শহরের জলবায়ু সুবর্ণাকে এত বড়ো করেছে। তিনি হেরে যাবেন ওই অশিক্ষিত ভূষণীর কাছে? হতে পারে না, কখনো হতে পারে না। বদলা তিনি নেবেনই, যে করেই হোক। নীলকণ্ঠকে তিনি ছেড়ে দেবেন না। কত ধানে কত চাল হয় এই হিসাব তিনি বুঝিয়ে ছাড়বেন।
সুবর্ণার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন তিনি তিন দিনের ছুটি নিয়ে। মাঠের কাজে দায়িত্ব অনেক, ছুটিছাটা পাওয়া যায় না। অথচ তার ছুটি হয়ে গেল। মাসের পর মাস পেরিয়ে গেল তবু নীলকণ্ঠর দেখা নেই। ভূষণীর প্রতিক্ষারত চোখ পথ দেখতে দেখতে আমড়ার আঁটির চেয়েও কঠিন হয়ে গেল। তবু নীলকণ্ঠ শহর থেকে ফিরলেন না। গ্রামের মানুষ বলতে লাগল মানুষটাকে ওর শালারা গুন্ডা লাগিয়ে মেরে ফেলেছে। তারপর খড়ে নদীর চরে পুঁতে ফেলেছে।
কথাটার সত্যতা ভূষণী এখনও পায়নি। নীলকণ্ঠ মারা গিয়েছে কিনা সে জানে না। নীলকণ্ঠ বেঁচে আছেন এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। তার বেঁচে থাকার প্রমাণ দুলালের মধ্যে জলছবির মতো ফুটে উঠছে। দুলাল তাই ধাওড়াপাড়ার কারোর মতো দেখতে নয়। তার খাটো চেহারায় আভিজাত্য হ্যাজাকের আলোর মতো তাপ ছড়ায়। ভূষণীর দুচোখ জড়িয়ে যায় কান্নায়। ওই মানুষটা তাকে সত্যি সত্যি সুখ দিয়েছিল, কোনোদিনও সে অস্বীকার করেনি এই সম্পর্ককে। সবসময় ভূষণীকে বুকে জড়িয়ে বলেছে, তুই আর কারোর নোস। তুই আমার। শুধু আমার।
নীলকণ্ঠ নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে সুবর্ণা আর কালীগঞ্জে থাকলেন না। কিসের মোহে এখানে পড়ে থাকবেন তিনি? পুরুষের টান সরে গেলে নারী তো ভাটার নদী। এই সত্য ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন সুবর্ণা। যত দিন গেল; তত তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। একদিন জমিজমা পুকুর এমনকী দোতলা বাড়িটা বিক্রি করে কৃষ্ণনগরে চলে গেলেন।
ভূষণীর দিন চলছিল কষ্টে। মাঠের কাজে গতর খাটাতে না গেলে তার দিন চলে না। দুলালকে জমির আলে শুইয়ে দিয়ে সে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। ছেলেটা কাঁদে। সেই কান্নার মধ্যে সে শুনতে পায় নীলকণ্ঠের খিলখিলানো দরাজ হাসি। তখন পরিশ্রমকে আর পরিশ্রম বলে মনে হয় না। মনে হয় সব শ্রমই পুজোর ফুল।
দুলাল বড়ো হয়ে হরিনাথপুরের ধাওড়াপাড়ায় বিয়ে করেছে। ইন্দুর স্বভাব, সাংসারিক টান মন্দ নয়, বরের উপর তার ভালোবাসা অটুট আছে। নিজে না খেয়েও সে দুলালকে খাওয়ায়, সব কাজে সে আগে থাকে, তার বিশ্বাস, প্রথম ঝড়টা যেন আমার গায়ে লাগুক। আমি থাকতে তুমার যেন কুনো ক্ষতি না হয়। মা শীতলাবুড়ির কাছে সে সবসময় এটাই কামনা করে।
দুলাল যখন বছর দশেকের তখন গাঁয়ে-গঞ্জে জোর গুজব, লাখুরিয়া কালীগঞ্জের মানুষ ফিসফিসিয়ে বলছে, এবার খেল জমবে। বড়ো ঘরের পাগলী বউটা ফিরে এসেছে। সে তো খালি হাতে যাবে না। শুনছি সে নাকি বুনোপাড়ার দুলালকে সাথে করে নিয়ে যাবে। দুলাল তার বরের শেষ চিহ্ন। ভূষণী তাকে পেটে ধরলেও তার দাবীর চাইতে সুবর্ণার দাবী কম নয়। কেসটা যদি কেসনগরের কোর্টে ওঠে তাহলে খেল জমবে।
এক টানটান উত্তেজনায় ভূষণী ঘুমোতে পারেনি পরপর সাতদিন। গাঁওবুড়া তাকে বলল, হাওয়া খারাপ দেখচি। ছেলেটারে লিয়ে যেদিকে দু-চোক যায় পেলিয়ে যা। ওই বড়োলোকের বিটির সাথে তুই কি কেস লড়ে পারবি? সে তুর কলজের ধনকে লিতে এয়েচে। এ ছেলের উপর তুর যেমুন টান, তারও তো তেমন থাকবে।
ভূষণী শেকড় ছড়ানো গাছের মতো অনড় অবিচল, কেনে পেলিয়ে যাব? আমি কি চোর না ডাকাত? পেটে ধরা ছেলেটা তো আমার, তুমরা সব সাক্ষী আচো। ওঃ, অতো মাগনা নাকি, চাইলেই মোওয়ার মতো হাতে তুলে দিয়ে দিতে হবে। এদেশে কি বেচার নেই? হলেওবা বড়ো ঘরের বিটি, ওর খেয়াল-খুশিতে কি চাঁদ-সূর্য উঠবে নাকি?
ভূষণী পালাল না, মাটি কামড়ে পড়ে রইল গাঁয়ে। পালালে বছর আটেক আগেই সে পালিয়ে যেত যখন তার যৌবন খুবলানোর জন্য চার খেতে আসা মাছের মতো হামলে পড়েছিল শরীরচাটা মাছ। সেই সময় তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি ভূষণী, লোভের ফাঁদে ডাকপাখির মতো ধরা দেয়নি। নীলকণ্ঠর স্মৃতি আঁকড়ে সে বাঁচতে চেয়েছে বছরের পর বছর। এখন চোখ মুদলে নীলকণ্ঠর গায়ের নিঃশ্বাস তার উদোম বুকে আছড়ে পড়ে, নীলকণ্ঠ তার সরু থুতনি নিয়ে গিয়ে আলতোভাবে ঠুসে ধরেছে বুকের ঢালু জলাশয়ে। এই স্মৃতি, এই অনুভব রক্তে পানকৌড়ি পাখি হয়ে সাঁতার কাটে। মানুষটা রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে তার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। স্বপ্নে এসে কথা বলে। হাসে, শিস দেয়। খুনসুটিতে জাগিয়ে তোলে ভূষণীর ক্ষুধিত শরীর।
ঝুমুরগানের দিন সুবর্ণা রিকশা নিয়ে সোজা চলে এসেছিল হলদিপোঁতা ধাওড়ায়। তার হাতে একটা নতুন কাপড়, মিষ্টি। দুলালের জন্য জামা-প্যান্ট-খেলনা। অশ্বত্থতলায় রিকশা দাঁড় করিয়ে সুবর্ণা চলে গিয়েছিল ভূষণীর ঘরের দাওয়ায়। ভূষণীকে বলেছিল, আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি বোন। ভয় পেও না, আমি রাক্ষুসী বা ডাইন নই যে তোমার ছেলেটাকে কেড়ে নিয়ে পালাব। তাই যদি আমার মনের ইচ্ছে হত তাহলে আমাকে এখানে আসতে হত না। টাকা ছড়ালে কাক-শকুনের অভাব হয় না। এখন গাঁ-ঘরে শ’টাকায় লেঠেল পাওয়া যায় কিনতে। তোমার ছেলেকে ছলে-বলে কেড়ে নিয়ে যেতে আমার বেশি সময় লাগত না। কিন্তু আমি তা করব না। সেটা আমার ধর্মও নয়। আমি শুধু এসেছি মানুষটার শেষচিহ্ন দেখতে। তোমার ওই ছেলের মধ্যে সে আজও বেঁচে আছে। সুবর্ণা কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ভূষণীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে বসতে বলবে না? ঠিক আছে আমি দাঁড়িয়েই কথা বলছি। ছেলেটাকে একটু নিয়ে এসো। ওকে আমি চোখের দেখা দেখে চলে যাব। তোমার কোনো ভয় নেই। দিনের বেলায় আমি চুরি করতে আসিনি। ওই দেখো আমার রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমি শহরে ফিরব।
ঝুমুর গানের আসর ভেঙে ছুটে এসেছে মানুষ। সবাই মজা দেখার জন্য উদগ্রীব। এত মানুষের ভিড় ঠেলে সুবর্ণা দুলালকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। ভূষণী মনের জোর ফিরে পেল। দুলালকে নিয়ে এল। সুবর্ণার কোলে তুলে দিয়ে বলল, এই ছেলেই আমাকে মাঠবাবুর কথা ভুলতে দেয় না। কি করে ভুলি? মানুষটা তো রসের জাহাজ। আমাকে সেই জাহাজে চেপিয়ে কুথায় কুথায় নিয়ে গেল। আমার ঘরের মানুষটা চার বছরে আমাকে যা দেয়নি, বাবু আমাকে চারমাসে তা দিয়েছে। আগে আমি শেয়ালকাঁটা গাছের মতো খড়খড়ে ছিলাম, বাবু আমাকে জলোপাতার মতুন নরম আর সোন্দর করেছে।
-এমনিতেই তুমি খুব সুন্দরী। সুবর্ণা মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন কথাটা, তোমার বাবুর নজর ছিল মানতে হবে। সত্যি বলতে কি–তুমি আমাকে সব দিক দিয়ে হারিয়ে দিয়েছ। আমি হেরে গেছি ভূষণী। ওকে আমি দুলাল দিতে পারিনি। শুধু ঘৃণা আর অবহেলা দিয়েছি। আজ বুঝতে পারছি আমার তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা ওকে আজ এপথে নিয়ে এসেছে। আমি যদি ওর প্রতি মনোযোগী হতাম, ওকে যদি সামান্য ভালোবাসা দিতাম তাহলে ও খাঁচা ভেঙে পালাত না। আমি যা দিতে পারিনি, তুমি ওকে তাই দিয়েছ ভূষণী। আমার পালিশ করা রূপের চাইতে তোমার আকাড়া চালের লালআউস ভাত ও অনেক তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। আমি হেরে গিয়েছি ভূষণী।
সুবর্ণা গোপালের মুখে চুমু খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এখনই ছেলেটার মুখের আদলে ছাপ পড়ে গিয়েছে বাবার, জলছবির মতো নীলকণ্ঠ স্পষ্ট হয়ে উঠবে সময়ের সাথে সাথে। ধাওড়াপাড়ার ধুলোমাটি মেখে সে নীলকণ্ঠ হয়ে ঘুরে বেড়াবে। সুবর্ণা অনেক ভেবে নিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দিলেন, তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। নীলকণ্ঠর সম্পত্তিতে তোমারও ভাগ আছে আমি মনে করি। তুমি চাইলে এর অর্ধেক আমি তোমার নামে লিখে দেব।
-টাকা-পয়সা, ধনদৌলত আমার দরকার নেই। ভূষণী ঘাড় দোলাল তীব্র অনীহায়। সুবর্ণা বললেন, ঠিক আছে। তোমার কথা আমার মনে থাকবে। এ পৃথিবীটা গোল, এবং যথেষ্ট ছোট। যদি বেঁচে থাকি তাহলে তোমার সঙ্গে আমার আবার ঠিক দেখা হবে। ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করো। ও তো শুধু তোমার একার ছেলে নয়, ও ছেলে আমারও। সময় পেলে আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো। যদিও কালীগঞ্জের বসবাস আমি উঠিয়ে দিয়েছি। পচা সুতোয় কোনো সম্পর্ক বাঁধা যায় না, বাঁধতে গেলে শক্ত ডোর দরকার, নাহলে ছিঁড়ে যায় ভূষণী।
সুবর্ণা চলে গেলে ভূষণী বুক হালকা করে শ্বাস ছাড়ল কিন্তু তার মনের খচখচানিটা কমল না। মাঠবাবু কিসের জন্য তার ছায়া চেয়েছিলেন, যার ঘরে সব সম্পদ গোছানো আছে সে কেন ভিখারি হতে গেল তার মতো দেহাতির কাছে। তাহলে কি ভালোবাসা যুগে যুগে মানুষকে ভিখারি করে দেয়, সময় সেই ধারাকে বয়ে নিয়ে যায় অনন্তকাল।
.
পাকুড়তলা থেকে রঘুনাথ যখন ঘরে ফিরে এল তখন রোদ টং-টং করছে আকাশে। দুর্গামণি মুখ ভার করে বলল, তুর এখন আসার সময় হলো? বাপের স্বভাব নিয়ে গা ঘুরলে কি দিন চলে যাবে? অত বড়ো ছেলে গতর না খাটালে চলবে কি করে?
দুর্গামণি যে বেজায় রেগে আছে এটা বুঝতে পেরে মুখে কুলুপ আঁটল রঘুনাথ। বুকের ভেতর জমে থাকা গল্পগুলো সে এখন আর হালকা করতে চাইল না। ওগুলো তার সুখের স্মৃতি, যদি হারিয়ে যায় অবহেলায় তাহলে সে ভীষণ কষ্ট পাবে। যে জগৎ তার জানা ছিল না, সেই জগৎ-এ সে পা রেখেছে। সেই অনাস্বাদিত বিশ্বকে সে এবার নিজের মতো করে ভালোবাসতে শুরু করবে। সে থমকে দাঁড়াবে না, আরও অনেকে পথ হাঁটতে হবে তাকে। এই প্রস্তুতিতে রঘুনাথ যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠল।
ঘরের কাজ করতে করতে দুর্গামণি বলল, তোর কাকা তুকে ডেকেচে। সে ঘরে আচে। তুকে দেকা করতে বলচে। নূপুর এসেছিল। খপর দিয়ে গেল। বলল–ভেষণ দরকার। যা, একবার তার ঘর থিকে ঘুরে আয়।
লুলারামের মাটির দোতলা ঘরখানায় অনেক রহস্য দানা বেঁধে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এ পাড়ার মানুষ গুজব ভালোবাসে, গুজব ছড়াতে পারলে কদমফুলের মতো তাদের মনটা খুশিতে উপচে ওঠে। লুলারাম বরাবরই নিজেকে রহস্যের মোড়কে ঢেকে রাখতে ভালোবাসে, এতে সে এক ধরনের তৃপ্তি পায় যা তাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
কঞ্চির বেড়াটা পেরিয়ে এলেই শুরু হয় লুলারামের ঘরের সীমানা। ওর বাবা মুনিরাম গাছের ছায়ায় বসে আছে খাটিয়া পেতে। বসে থাকা ছাড়া ওই বুড়োমানুষটার বুঝি আর কোনো কাজ নেই। বয়স হলে এমনিতেই মানুষ কমজোরী হয়ে পড়ে। তার উপরে যদি শরীরে কোনো অসুখ স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে তাহলে তো আর ভোগান্তির শেষ নেই। কুষ্ঠরোগটা যদিও কোনো রোগ নয় তবুও এর মন ফালাফালা করার প্রভাব অস্বীকার করতে পারে না মুনিরাম। রোগটা ধরা পড়ার পর এই লুলারামই তাকে মোকামপাড়ার বিলের ধারে রেখে আসতে চেয়েছিল। সে যাত্রায় হাতে-পায়ে ধরে কোনোমতে বেঁচে যায় মুনিরাম। বিপদ কাটলেও বিভিন্ন রকমের ফাঁড়া খাঁড়ার মতো তার কপালে ঝুলছে। প্রায়ই থানা থেকে পুলিশের জিপ আসে পাড়ায়। অশ্বত্থতলায় তারা জিপ দাঁড় করিয়ে ভারী বুটের মচমচ শব্দ তুলে ঢুকে আসে গাঁয়ে। লুলারামের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে খিস্তি উগরে দেয় তারা। তখন দরজা খুলতে দেরি হলে আর রক্ষে নেই। দুমদুম লাথি পড়বে কাঠের দরজায়, সেই লাথিতে কেঁপে উঠবে পুরো পাড়া। লুলারাম চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে আসার আগেই থানার মেজবাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, যাক আজও বেঁচে গেলি! যেদিন ধরতে পারব সেদিন মারের চোটে তোর অন্নপ্রাশনের ভাত বের করে ছেড়ে দেব। এই এলাকায় চুরি-ডাকাতি একদম আমি বরদাস্ত করব না।
মুনিরাম হাতজোড় করে কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে দেবেন মেজবাবু, চুপ কর হে, তোমাকে আর আদা ছাড়াতে হবে না। বেশি ওকালতি করতে এলে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলের ভাত খাইয়ে দেব।
জেল কী জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে মুনিরাম। তাই এখন জেলের কথা শুনলেই তার শরীরটা সিঁটিয়ে যায়। ঢিলি তার স্বামীর কী দোষ বুঝতে পারে না। নূপুর, নোলকের অবস্থাও তথৈবচ। তারা ঘুমচোখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। এসব তাদের আর ভালো লাগে না। গাঁয়ের মানুষগুলো দিনেরবেলায় তাদের কত কথা শোনায়। সে সব কথা গায়ে ফোসকা ফেলে মনটাকে ঘা করে দেয়। ঢিলি তাদের বোঝায়, মন খারাপ করবি নে। পাপ বাপকে ছাড়ে না। তুর বাপও পার পাবে না।
মুনিরাম গাছের ছায়ায় খাটিয়া পেতে আরাম করছিল চুপচাপ। এখন ওর শরীরটা রোগ আর বয়সে গুটিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছে। বসে থাকলে তাকে এক দলা মাংসের মতো দেখায়। মুনিরামকে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলে মুখ তুলে তাকায় সে, কে, কে যায় রে?
আমি গো কচিয়া দাদু! রঘুনাথ দাঁড়াল।
মুনিরামকে সে কচিয়া দাদু বলে ডাকে। এই সম্বোধন দুর্গামণি তাকে শিখিয়েছে ছোটবেলা থেকে।
-কুথায় যেচিস রে দাদুভাই? মুনিরামের প্রশ্নে রঘুনাথ বলল, কাকা আমাকে ডেকেচে!
-ওঃ। ঠিক আচে যা। সময় পেলে টুকে আসিস। গল্প করব। মুনিরামের কথায় বেদনা ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ার সবাই এই মানুষটাকে এড়িয়ে চলতে পারলে খুশি হয়। সবাই জেনে গিয়েছে এই মানুষের দ্বারা কারোর কোনো উপকার হবে না। বুড়ো ঘোড়ার কদর কোনোকালেই ছিল না। এটা ঘোড়ারই দুর্ভাগ্য। রঘুনাথ ওখান থেকে সরে এলেও তার মনে একটা প্রশ্ন দানা বাঁধল। বয়স কি মানুষের সব কেড়ে নেয়? কেন নেয়? পাকা তেঁতুল, পুরনো চাল, এমনকী পুরনো ঘিয়ের কদর এখনো কমেনি। তাহলে মানুষের কেন এ হাল হবে? লুলারাম নিজের বাবাকে কোনো গুরুত্ব দেয় না। সে যে একজন বয়স্ক মানুষ, এ সংসারের মাথা এই বোধ তাকে এখন আর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না। সে ভাবে–মুনিরাম পৃথিবী ছেড়ে বিদেয় নিলে তার বুঝি রক্ষে। ঝারির সঙ্গে লটরপটর তাহলে জমবে ভালো। ঢিলিকে সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, একটা পাগলীকে এত গুরুত্ব দেবার কোনো অর্থ হয় না। শুধু পথের কাঁটা মুনিরাম সরে গেলেই লুলারাম স্বাধীন, আজাদ পাখি।
নূপুরের সাথে দেখা হল দাওয়ায়। রঘুনাথ কিছু বলার আগেই নূপুর আগ বাড়িয়ে বলল, কুথায় থাকিস রে দাদা? বাবা কত খুঁজল তোকে।
–আমি মানিকডিহি গিয়েচিলাম।
-কেন রে? বাবুদের সাথে বুঝি তুর ভাব জমচে? নূপুর না বুঝেই খোঁচা দিল রঘুনাথকে। রঘুনাথ ম্লান হেসে তাকাল, সূর্যকে চিনিস? ও আমার বন্ধু হয়েছে।
নূপুর অবাক হল না, ভালো কথা। তবে বড়ো মানুষ বড়ো ধড়িবাজ। ওরা যখুন তখুন চোখের পাতা উল্টায়।
–সূর্য অমন নয় রে! রঘুনাথ জোরের সঙ্গে বলল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নূপুর বলল, ভালো কথা। ভালো হলে দেখতে ভালো লাগে। ঠকতে না হলে আরও ভালো। লুলারামের মাটির ঘরখানা অন্ধকারের আখড়া। এই আঁধারে রহস্য শুয়ে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে। এ গাঁয়ের সবাই জানে লুলারামের মাটির ঘরে মা লক্ষ্মীর আনাগোনা আর সেই লক্ষ্মীকে কিভাবে খুশি করতে হয়, পূজা দিতে হয় লুলারামের চাইতে এ গাঁয়ের কেউ বেশি জানে না। এককালে লুলারাম ললাটবাবুর লেঠেল ছিল। ললাটবাবুর অঙ্গুলি হেলনে সে উঠত-বসত। তার নির্দেশে লুলারাম কত নিরীহ মানুষের মাথা ফাটিয়েছে, মেরে অথর্ব করে দিয়েছে তার কোনো গোণা গুণতি নেই। টাকার বিনিময়ে সে পারে না এমন কাজ তার দৃষ্টির মধ্যে নেই। ফলে এখন ও গাঁয়ের মানুষ লুলারামের সামনে বেশি তেড়িবেড়ি করে না। সমঝে চলে। কার মনে কী আছে তা জানতে লুলারাম এখন আগ্রহী নয়। তবে নিজের নামটার উপর তার বড়ো ঘেন্না। প্রায় মুনিরামকে বলে, আর নাম পেলে না খুঁজে! আমি কি লুলা নাকি যার জন্যি আমার নাম লুলা রাখলে?
মুনিরাম কোনো উত্তর দিতে পারে না, ভীতু চোখে তাকায়। যা মেজাজ, বিশ্বাস নেই এই পাষণ্ড ছেলে কখন কি করে ফেলে।
কাঁথ দেওয়ালের পাশ দিয়ে হাত পাঁচেকের চওড়া দাওয়া। সেই দাওয়া মাথায় খড়ের ছাউনি নিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়েছে আরও বিশ-বাইশ হাত। দাওয়া যেখানে শেষ হচ্ছে–সেখান থেকে শুরু হচ্ছে আঁধার ঘরে যাওয়ার সরু পথ। বেশি দূর যেতে হল না, সামান্য গিয়েই রঘুনাথ টের পেল একটা অন্ধকার পুরী তাকে হাঁ করে যেন গিলতে আসছে। আলো থাকলে ভালো হত, আলো না এনে ভুল করেছে সে। একবার ভাবল ফিরে গিয়ে নূপুরের কাছ থেকে লম্ফো চেয়ে আনবে। কিন্তু ফস করে দেশলাই জ্বলে উঠতেই সে অবাক চোখে তাকাল। সেই স্বল্প আলোয় রঘুনাথ দেখল লুলারামের হলদে হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো বিকশিত হয়ে পরিতৃপ্তির একটা হাসি উগরে দিচ্ছে। বড়ো জান্তব আর পৈশাচিক হাসি।
রঘুনাথ ভাবছিল এই অন্ধকার কুঠুরীতে লুলারাম কি করছে একা একা। তীব্র গরমে আশপাশ যখন আইঢাই করছে তখন এই গুমোট দমবন্ধ করা পরিবেশে একটা মানুষ একা একা কি করতে পারে ওখানে? চোরাকুঠুরীর গল্প এর আগেও শুনেছে রঘুনাথ কিন্তু কোনোদিনও সাহস করে ওখানে ঢোকার তার স্পর্ধা হয়নি। মুনিরাম, দুর্গামণি মানা করত তাকে। মুনিরাম বলত, দাদুভাই, বিচুটি বনে ঢুকলে যে কুনো সময় ওর জ্বলুনীপাতা গা-গতরে ঘষে যেতে পারে। তখুন চুলকে চুলকে চাকড়া-চাকড়া দাগ হবে সারা গায়ে। সেটা কি ভালো দেখায় দাদুরে! বিচুটি বনের ধারে-কাচে যাস নে। আলো বাতাসে হাত-পা ছড়িয়ে খেল। আন্ধারঘরে মন আন্ধার হয়ে আসে।
গুয়ারামও খুশি হত না রঘুনাথ লুলারামের উঠোনে পা রাখলে। সে বেজার হয়ে বলত, খেলতে মন চায় পাকুড়তলায় চলে যা। কারোর দোরে লাফ-ঝাঁপ খেলা ভালো নয়। সব ঘরেই সব সময় কিছু না কিছু খেলা হয়। সে খেলা ছোটছেলেদের দেকা বারণ।
–কি খেলা বাপ?
–বড়ো হ। বুঝবি? গুয়ারাম এড়িয়ে যেত প্রশ্ন।
এখন রঘুনাথ বড়ো হয়েছে কিনা জানে না তবে চোরাকুঠুরীর অনেক রহস্য গল্প তার কানে এসেছে। ললাটবাবুর সৌজন্যে লুলারাম চোরাকুঠুরীটাকে দিনে দিনে বানিয়ে ফেলেছে গুমঘর। প্রতিশোধ নেওয়ার এমন মনোরম জায়গা আর কোথাও নেই এই গ্রামে। গুমঘরে ধরে এনে কারোর গলা দাবিয়ে দিলে কেউ টের পাবে না। খুন করলেও রক্তের ছিটে নজর এড়িয়ে যাবে। এমনকী আর্ত-চিৎকার হারিয়ে যাবে মাটির দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়ে। লুলারামের বধ্যভূমি এই চোরাকুঠুরীর গল্পকথা কোনোদিনও শেষ হবার নয়।
রঘুনাথ সত্যি-মিথ্যা জানে না। তবে সে জানে যা রটে তা কিছু না কিছু বটে। চোরাকুঠুরীর মেঝেয় পা রেখে তার শরীরে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। কপালের ঘাম মুছে সে বড়ো বড়ো চোখ মেলে দেখতে চাইল লুলারামকে। দেখতে না পেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় সে ডাকল, কাকা, তুমি কুথায়?
-কেন রে, তুর বুঝি ডর লাগে? অন্ধকার থেকে উড়ে এল লুলারামের কণ্ঠস্বর। ভয় জিনিসটা এই বয়সে অপমান। রঘুনাথ নিজেকে সামলে নিল, ভয় পাবো কেনে? আমি তুমার কাছে যেতে চাই। রঘুনাথ নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাবার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পরে আবার একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে লুলারাম সামনে এল। তার দু’হাতে রক্ত দেখে চমকে উঠল রঘুনাথ। লুলারাম সেই রক্তমাখা তর্জনী নিজের মোটা ঠোঁটে চেপে ধরে বলল, চুপ। হল্লা করিস নে। জানাজানি হলে হুজ্জোত বাড়বে!
অতো অক্ত? কী হয়েছে গো কাকা? রঘুনাথ হাঁপাচ্ছিল। সে কিছুটা উত্তেজিত। লুলারাম তাকে শান্ত হতে বলল, ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নাই। এট্টা কালোখাসি ধরে এনেচি মুকামপাড়া থিকে। পণ্ডিত বিলের বেড়ার ধারে চরছিল। দেকে আর লুভ সামলাতে পারলাম না। মনটা টেনে নিয়ে গেল হুড়হুড়িয়ে। ভাবলাম কত্তো দিন মানসো খাইনি। আর খাবো কি করে? খাসিমানসের যা দাম বেড়েচে। লুলারাম কথা থামাল।
রঘুনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলল, তার মানে চুরি করে এনেচো?
–ও কথা বলতে নেই ভাইপো। লুলারাম দাঁত বের করে হাসল, না বলে আনলে শাস্ত্রে বলছে চুরি করা হয়। তবে শাস্ত্রে এ-ও বলচে-চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা। তা আমাকে ধরার মতো কুনো মামু নেই এ-গাঁয়ে। চাইলে যখুন দেবে না তখুন না বলে নিয়ে এলাম। না বলে নিয়ে এলে কুনো দোষ হয় না। বরং মাসের সুয়াদ বাড়ে।
রঘুনাথের মুখে কথা আটকে গেল। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। কাকাকে এ চেহারায় সে কোনোদিন দেখেনি। না দেখলেই বুঝি ভালো হত। লুলারাম বলল, এই ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তুর অতো না ভাবলেও চলবে। শুন, আমি তুকে কিজন্য ডেকেচি। মন দিয়ে শুন। ঢোঁক গিলে লুলারাম তার রক্ত জড়ানো হাতটা রঘুনাথের কাঁধের উপর রাখল, তুর কুনো ভাই নাই, দাদা নাই। মেয়ে দুটা আর তুই হলি আমার সম্বল। তুকে আমি কিছু গুপ্তবিদ্যে দিয়ে যেতে চাই। বংশের অক্ত ছাড়া তো এসব কাউকে দেওয়া যায় না। ওস্তাদের বারণ আচে। বুঝলি?
রঘুনাথ অন্ধকারে ঘাড় নাড়ল।
লুলারাম উৎসাহ পেয়ে বলল, তুর কচিয়াদাদু চোর ছিল জানিস তো? সে এখুন আর রাত-বেরাতে বেরুতে পারে না। সে আগে ছিল বাঘ, এখুন হয়েছে বুড়াবাঘ। তুই জানিস তো বুড়াবাঘ শিকার ধরতে পারে না। এখুন আমি তাকে শিকার ধরে এনে দিই। তা খেয়ে সে বেঁচে থাকে। আমি না থাকলে বুড়াটা মরে ভূত হয়ে যেত। এ সনসারে কেউ কাউরে দেখবে না। যে যার, তার তার। কপাল চাপড়েও কুনো লাভ নেই। কপাল আমবাতের মতো ফুলবে। তাতে কার লাভ? কারোর নয়। তাই বলছিলাম কি, তুই আমার পথে চলে আয়। আমি তুকে হাতে করে সব শিখিয়ে যাই। এতে আমার স্বার্থ আছে। আমি বুড়া হলে তুই আমাকে শিকার ধরে দিবি। কি রে দিবি তো?
রঘুনাথ হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারল না চট করে। অন্ধকারে তার চোখ কুঁকড়ে যাচ্ছিল। শুধু লুলারামের কথাগুলো ছাড়া আর কিছু যেন ঘরের মধ্যে পড়ে নেই। এই অন্ধকার হাতড়ে কি পেতে পারে সে? অন্ধকার শুধু ভয়ের জন্মদাতা। চোরাকুঠুরীতে নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া চামচিকির ডানা ঝাড়ার ব্যস্ত আওয়াজ প্রকটিত হল। লুলারাম অধৈর্য হয়ে বলল, তুর বাপরে আমি পথে আনতে পারলাম না। সে যেটা বুঝবে–সেটাই শেষ কথা। গরিব মানুষের এত গোঁ ভালো দেখায় না। তারে আমি বলেছিলাম আমার সাথে কাজে লেগে পড়তে। সে আমার কতা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। তাতে কার ক্ষতি হয়েছে? গাঁ-ছেড়ে তাকে তো চলে যেতে হল দূর গাঁয়ে খাটতে। এতে কী লাভ হল বলদিনি বেটা।
লাভ-ক্ষতির কথা নয়, গুয়ারাম মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে। একথা ঠিক তার দুবেলা ভাতের জোগাড় হয় না, দুর্গামণিকে ঝোড়-জঙ্গলের শাক-লতা পাতা খুঁজে আনতে হয়, তবু তারা সম্মানের সঙ্গে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়, পুলিশ এসে তাদের দরজায় লাথি মারে না, ধমকায় না। রঘুনাথ কাকার মুখের উপর একটা কথাও বলতে পারে না, তার আড়ষ্টতাবোধ হয়, সে পাথরচোখে গিলতে থাকে গুমোটবাধা অন্ধকার।
বিরক্ত লুলারাম উত্তেজিত হল না, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ঠিক আছে, তুই যা ভালো বুঝিস কর। মন চাইলে আসবি না হলি পরে চলি যাবি। সব তুর উপর ছেড়ে দেলাম। লুলারাম আর একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাল, বিব্রত রঘুনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, খাসিটা মেরেচি, মানসো লিয়ে ঘর যা। এই বয়সে একা খেতে পারি নে, দিয়ে খেলে কলজের দম বাড়ে।
প্রায় সের দুয়েক মাংস লুলারাম পাতায় মুড়িয়ে ধরিয়ে দিল রঘুনাথের হাতে, তার সতর্ক চোখ-মুখ, গলা নামিয়ে বলল, তুরে যা বললাম-দু কান যেন না হয়। পেটের কথা বাইরে গেলে বেপদ বাঁধে। কলিকালের মানুষরা ভালো হয় না, ওরা কেউ-কারোর সুখ দেখতে পারে না। তুর-আমার কতা আলাদা, অক্তের সম্পর্ক তো!
রঘুনাথ গুমঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘাম মুছল কপালের। চোরাকুঠুরীর ভেতর কুয়া খুঁড়ে রেখেছে লুলারাম। ললাটবাবুর লেঠেল হওয়ার সুবাদে সেই কুয়ায় খুঁজলে এখন হাড়গোড়ও পাওয়া যাবে। এই কুয়োর খবর গ্রামের অনেক মানুষই জানে না। তবে দুর্গামণির সব নখদর্পণে। সে একদিন কথায় কথায় ঢিলিকে সতর্ক করে বলেছিল, বেঘোরে জানটা কেনে দেবে বুন, চোখ মুদে থাকো, না হলে মানিয়ে নাও। এদের বংশ খুনেবংশ। মদ-মেয়েছেলে নিয়ে ওদের সময় কাটত। আমার শাশুড়ির মুখে গল্প শুনেচি-তার শ্বশুর নাকি মদ খেয়েই চক্ষু মুদল। তোমার বর লুলারে কুনো বিশ্বাস নেই। ও পারে না হেন কাজও নেই। ঝারির জন্যি ও তুমাকে ঝোড়কাটার মতো কেটে চোরাকুঠুরীর কুয়ায় ফেলে দিবে। থানা-পুলিশ পাড়াপড়শি কেউ টের পাবে নি।
দুর্গামণির সতর্কবাণী রঘুনাথের হুড়হুড় করে মনে পড়ে গেল। প্রথমে সে ভেবে ছিল এগুলো হয়ত গল্পকথা, কথার কথা। কিন্তু আজ সে যা নিজের চোখে দেখল বাইরে এসে ভাবতে গেলে হিম হয়ে যাবে গা-হাত-পা। রঘুনাথ একবার ভাবল–সে থানায় গিয়ে সব বলে দেবে; পরমুহূর্তে সে বোঝাল নিজেকে। না, ভালো হবে না। কাকাকে ধরিয়ে দিয়ে তার ক্ষতি বইতে লাভ হবে না। হাজার হোক কাকা, দায়ে-আদায়ে পাশে দাঁড়ায়। কাঁধ দেওয়ারও তো লোক দরকার। তাছাড়া নূপুর, নোলক ওদেরকে সে ভুলবে কি করে? ওরা তো কোনো দোষ করেনি। ওরা ফুলের মতো নরম, দিঘির জলের মতো মৃদুভাষী। বাবার পাপে মেয়েরা কেন ভুগবে?
রঘুনাথ মাংস নিয়ে আপনমনে হাঁটছিল। ঢুলিরামের গল্প সে দাদুর মুখে শুনেছে। বাবার মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে চোখে জল চলে আসত চুনারামের। মানুষ অতীতের কাছে দাস হয়ে থাকতে ভালোবাসে না। চুনারাম ঢেঁকুর তুলে বলত, আর কুনোদিনও মদ খাবো না। মদ মন খায়, শরীল খায়। আয়ু খায় চিবিয়ে-চিবিয়ে।
ঢুলিরাম নেশায় চুর হয়ে থাকত সব সময়। নেশা করলে তার পা টলত, মাথা টলত, মুখ দিয়ে আজেবাজে কথার চাইতে বেরিয়ে আসত টুসুগান। বেশ রগড়ের লোক ছিল সে। গঙ্গামণি প্রায়ই কেঁদে-কেটে বলত, ছেড়ে দাও গো এই সব্বোনাশী নেশা। নিজের শরীলটাকে দেখবা না? কী হয়েছে তুমার চেহারা! একেবারে ঢিংঢিঙা। মনে হয় ফুঃ দিলে উড়ি যাবা।
এই চেহারায় সাহেবমাঠে কাজ করত সে। হাতে লাঠি, হাঁটুর উপর খাটো ধুতি। ধাবড়া নাক, সরু মুখের কপালে জোঁকের মতো শুয়ে থাকত চিন্তার দাগ। ওগুলো দু-মুখো সাপের মতো টনটন করত প্রায়সময়। বর্ষার সময় দিন পনের জ্বরে পড়েছিল সে। জ্বর ভালো হতেই মাঠে গিয়ে দেখল তার জায়গায় অন্য মুনিষ কাজে লেগেছে। বেকার হয়ে গেল ঢুলিরাম। হাতে পয়সা নেই অথচ নেশা করার শখ আছে। নেশা না করলে তার প্রাকৃতিক কর্ম হত না। কাজ না করলে সংসার চলবে কি করে? চুনারাম আর মুনিরাম বেকার। ঘরে চাল নেই, তেল নেই। মাঠে কাজ নেই। গঙ্গামণি কোনমতে টানছিল সংসার। কোনোদিন কাজ পায়, কোনোদিন আবার কাজ পায় না। একদিন ঢুলিরামই দু-হাত সম্বল করে বেরিয়ে পড়ল ভিক্ষায়। বাঁচতে তো হবে? এই আকাল কবে যে কাটবে শীতলাবুড়ি জানে। ভিক্ষা করা সহজ কাজ নয়। মাত্র পনের দিনেই বুঝে গেল ঢুলিরাম। বামুনপাড়ার মানুষরা বলল, তোমাকে ভিক্ষে দিয়ে কী হবে। চাল বেচে তো তুমি চোলাই খাবে। তার চেয়ে বউরে পাঠাও, তার হাতে আমরা দুমুঠি চাউল তুলে দেব।
গঙ্গামণির সেই সুযোগ আর এল না। একদিন ভিখ মাঙতে গিয়ে গায়ে গরম বাতাস লাগিয়ে বাঁধের ধার থেকে কটরাব্যাঙের মতো ঠিকরে পড়ল ঢুলিরাম। মরেই যেত, শুধু ভাগ্যের জোরে চোখের পাতা তুলে তাকাল। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে গেল না সে, কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে বলল, বাপ রে ওখানে গেলি পরে মরে যাবো। কড়া কড়া বড়ি আর ইনজিসিন এ গতর লিতে পারবে নি। তার চেয়ে দেহাতি দাওয়াই ভালো।
বাড়ি ফিরে এসে বার দুয়েক বাহ্যি গেল ঢুলিরাম। বাঁধের গোড়া থেকে তার ফিরে আসার কোনো ক্ষমতা ছিল না। শেষ পর্যন্ত গঙ্গামণি তাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এল। এভাবে সাত দিন কাটল তবু অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। খেজুরপাতার তালাই এ লেপটে গিয়েছে ঢুলিরামের দেহ। চোখের কোল বসা। গাল ঢুকে গিয়েছে শুকনো আমের মতো। ইংরেজি দাবাইয়ের উপর তার কোনো আস্থা নেই, হাসপাতালের কথা উঠলেই সে চিঁ-চিঁ করে বলে, মরি তো এই হলদেপোঁতায় মরব। তুদের হাতে-পায়ে ধরি রে, আমারে আর হাসাপাতালে নিয়ে যাস নে।
ঘরের মানুষটার কাতরতা দেখে গঙ্গামণি পাড়া জাগিয়ে কাঁদে, হা আমার কি হল গো, মানুষটা যে আর বেছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না গো! মা শীতলাবুড়ি, মা গো মা, তুমি আর অতো লিঠুর হয়ো না। মুখ তুলে চাও মা। মুখ তুলে চাও। ঘরের মানুষটারে ভালো করে দাও মা। বুকের অক্ত দিয়ে তুমার ধার শোধ করব। দয়া করো মা, দয়া করো।
-মা’র দয়া হবে নি রে; আমার সময় হয়ে এয়েচে। ঢুলিরামের মাথাটা যেন খেতের তরমুজ, আমার কতা শুন। আমার জন্যি চোলাই কিনে আন ভাটিখানা থিকে। নেশায় আমার মন টনটন করচে।
–বাহ্যি দিয়ে অক্ত ঝরচে, এ সময় কেউ নেশা করে গো? গঙ্গামণির দৃষ্টিতে কাতর প্রশ্ন।
নেতানো ঢোঁক গিলে ঢুলিরাম বলল, আমার শেষইচ্ছেটা পূরণ করি দে বউ। তুর কাছে এ জীবনে আর কিছু চাইব না।
-আমি বউ মানুষ, কী করে চুল্লু ভাঁটিতে যাই বলো? এতদিন গেল, কুনোদিনও যাইনি। আচ আমার বাঁধো ঠেকচে। গঙ্গামণি তার অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিল।
ঢুলিরাম জোর গলায় বলল, তুই যা। আমার হাতে সময় কম।
—যাব যে পয়সা কুথায়?
ঢুলিরাম ফাপড়ে পড়া চোখ মেলে তাকাল, আমার শেষ ইচ্চেটা আর পূরণ হল না। বলেই সে গঙ্গামণির হাতটা ধরল। অমনি সরু লিকলিকে রূপার চুড়ি দুটো সরে গেল কনুইয়ের দিকে, আশায় চকচকিয়ে উঠল মন, এই তো পয়সা পেয়ে গিয়েচি। যা বউ, চুড়ি বেচে আমারে মদ এনে দে। আমি তো সোনাদানা চাইচি নে, সামান্য মদ।
গঙ্গামণি রুপোর চুড়ি বেচে দিল সাকরা দোকানে। টাকা নিয়ে সে দৌড়ে গেল ভাটিখানায়। ব্যস্ত হয়ে বলল, দাদা গো, ঘরে বড়ো বিপদ। ওর জন্যি মদ দাও।
-সাত দিন ধরে অসুক। এখন মদ খাবে? কেমন মানুষ গো তুমার বর। ভাটিখানা মালিকের কপাল কুঁচকে গেল, সব জেনে-শুনে এ পাপ আমি করতে পারবোনি। তুমি ঘুরোন যাও।
–আমি খালি হাতে ঘুরে গেলে সে আর বাঁচবে নি। গঙ্গামণি আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠল, দাদা গো, মানুষটারে বাঁচাও। মদ ছাড়া যে মানুষটার একদিনও চলে নি, সে যে সাতদিন ধরে কী ভাবে আচে একবার তার কথাটা ভেবে দেখো।
বাটিতে মদ ঢালতে-ঢালতে ভাটিখানার মালিক বলল, এট্টা কতা ছিল যদি রাখো। মদ আমি দিচ্ছি ঠিকই কিন্তুক মন আমার সায় দিচ্চে নি। শুনেচি-নেশার জিনিস না দিলে পাপ হয়। সে আমার পাপ হোক। তুমি ওরে এক ঝিনুক মেপে মদ দিও। এর বেশি দিও না, আমার মাথার দিব্যি।
গঙ্গামণি সাবু ফোটান দিতে চেয়েছিল ঢুলিরামকে। সে হাত দিয়ে বাটি সরিয়ে দিল অনীহায়, আগে মদ দে বউ। মদের ঘেরাণ শুঁকে মাথা ধরা সারাই।
গঙ্গামণি বাটিটা ধরিয়ে দিলে চুমুক লাগাতে যায় ঢুলিরাম, আঃ, কতদিন পর চেনা ঘেরান পেলাম! পরানটি একেবারে জুড়িয়ে জল হয়ে গেল রে!
দাঁড়াও ঝিনুক নিয়ে আসি। গঙ্গামণি পা বাড়াল।
পানসে হেসে ঢুলিরাম বিষাদভরা চোখে তাকাল, কেনে রে, আমি কি কোলের খোকা নাকি? নেশার সময় বাধা দিস নে, চটকে যাবে।
দু’ ঢোঁক খেয়েই ঢুলিরামের হাত আলগা হয়ে বাটিটা পড়ে গেল বিছানার উপর। দু’বার হেঁচকি উঠেই ঢেঁকির কাঠের মতো স্থির হয়ে গেল ঢুলিরাম।
চোখ বুজলেই রঘুনাথ যেন গঙ্গামণির কান্না-দৃশ্য দেখতে পায়। মনটা ঘোলা জলের চুনো মাছের মতো ছটফটায়। বেড়ার কাছে এসে সে দেখে দুর্গামণি বসে আছে তালপাতার আসনে, তার সম্মুখে ঠাকুর হয়ে বসে আছে দুলাল। কী ভেবে রঘুনাথ তাদের সামনে দিয়ে গেল না। অবেলায় মাংস দেখে দুলালের মনে সন্দেহ হবে। হাজারটা প্রশ্ন করবে তাকে। তার সব প্রশ্নের উত্তর কি দিতে পারবে রঘুনাথ। সেই কারণে বুক কেঁপে উঠল। পিছন দিক দিয়ে ঘরে ঢুকে রঘুনাথ শুনল, দুর্গামণি বলছে, ইবার যখুন খাটতে যাবে আমারে সাথে করে লিয়ে যেও। রঘুর বাপ যাওয়ার পর থিকে মনটা আমার ভালো নেই। কুনো মতে বেঁচে আছি গো। বারবার মনে হয়-খাটতে না গিয়ে আমি বুঝি অপরাধ করে ফেলেছি।
-সে তুমি যেও। তবে ইখানকার রাঁধাবাড়ি কে করবে? দুলাল আরও কিছু শোনার জন্য হাঁ-করে তাকাল। একটু ভেবে নিয়ে দুর্গামণি বলল, আমার ঘরের রঘুটা সব পারে। দুটা মানুষের ভাত সে কি ফুটিয়ে নিতে পারবে না?
–বেশ পারবে! তাহলে তৈরি থেকো। দুলাল উঠে দাঁড়াল।
কঞ্চির আগাড় সরিয়ে দুলাল চলে যেতেই দুর্গামণি বিড়বিড়িয়ে বলল, মা শীতলাবুড়ি, তুমি আমার মনোকামনা পূরণ করো। ঘরের মানুষটাকে আমি গিয়ে যেন ভালো দেখতে পাই। ওরে ভালো রেখো মা।
.
০৯.
ভালো-মন্দ, থাকা না থাকা সব শীতলাবুড়ির ইচ্ছে। ক’ দিনের গরমে দুমদুম বাষ্প হয়ে যাচ্ছে বুড়িগাঙের জল। পাল খেদিয়ে এখন আর সুখ নেই কারোর। পাঁচ বছর আগে যা সুখ ছিল এখন তা ছিবড়ে। গোরু-মোষ পিছু মুড়ি আর জিরেন-কাট রসের পাটালি দিত মনিব। এখনও দেয় কিন্তু দায়সারা দশা। মন ভরলেও পেট ভরে না। রঘুনাথ হাঁপিয়ে উঠেছে গোরুর পাল খেদাতে গিয়ে। দুর্গামণি তার মনের ছটফটানি লক্ষ্য করে বলল, মাথা গরম করে কুনো লাভ হবে নি। এক কাঠা করে মুড়িই বা কে দেয় এই বাজারে।
সবাই দেবে। ঝাঁঝিয়ে উঠল রঘুনাথ, ভাবছো মুফতে দেয়, তা তো নয়। গোরু চরাতেও মেহনতের দরকার হয়। পাল খেদানো মুখের কতা নয়। এট্টু চোখ সরে গেলে কপালে চরম কষ্ট আচে। গোরু এদিক-ওদিক কেটে পড়লে জান ঢিলা হয়ে যাবে। তখুন বদনামের আর শেষ থাকবেনি।
-কুন কাজটা আরামের বল তো? দুর্গামণি অসন্তুষ্ট চোখে তাকাল।
রঘুনাথ মুখ ভার করে বলল, একাজ বড়ো এক ঘেয়েমীর কাজ। আমি হেঁপসে উঠেচি মা। পাল নিয়ে যেতে হলে তুমরা যাও, আমি আর যাবো না। ওসব আমার ভাল লাগে না।
–তুর কি হয়েছে বল তো? দুর্গামণির গলায় সন্দেহ প্রকট হল, ওই বামুনপাড়ার ছেলেটাই তুর মাথা খেল। বড়গাছে ভাঁড় বাঁধলে চলবে? নাকি তা শোভা দেয়? রঘুনাথ কপাল টিপে ধরল রাগে, তুমার আর বিদেশে খাটতে গিয়ে লাভ নেই।
-তুর বাপ যে গিয়েছে।
–যাক।
–আমি না গেলে ভালো দেকায়? দুর্গামণি কেমন সহজ হয়ে এল, ইবারটা যাই, আর যাবো না। বয়স হচ্চে।
-আমি এট্টা কাজ পেয়ে গেলে আর তুমারে খাটতে দিতাম না।
–ছেলের কথা শুনে হেসে উঠল দুর্গামণি, তুর মনটা বড়ো সাফসুতরো। তুর উপর রাগ করে থাকতি পারি নে।
শেষ পর্যন্ত পরদেশে আর খাটতে গেল না দুর্গামণি।
সাঁঝবেলায় কীর্তন দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চুনারামের। সে ঘাড় উঁচু করে আকাশ দেখছিল তন্ময় হয়ে। খোল করতালের শব্দ তার কানে যেতেই হুঁশ ফিরে এল। দুপুরবেলা সে কালো সুড়সুড়ি পিঁপড়েদের দল বেঁধে যেতে দেখেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। পিঁপড়েগুলোর হাঁটা-চলায় অস্বাভাবিকতা পুরো মাত্রায় লক্ষ্য করেছে সে। সুড়সুড়ি পিঁপড়ে সাধারণত চোখে পড়ে না। কারণ ছাড়া ওই জাতের পিঁপড়েগুলো মানুষের চোখের আড়ালে থাকতেই ভালোবাসে। সামান্য হলেও চুনারামের বয়স্ক-মন বৃষ্টি হতে পারে এই আশায় পুলকিত হয়ে উঠেছিল। যদি বৃষ্টি হয়–শুধু মানুষ নয়–গাছপালা প্রকৃতি–সাহেবমাঠ-বুড়িগাঙ সব যেন দম ছেড়ে বাঁচবে।
কীর্তন দলটি নাচের মুদ্রায় হেলে দুলে বাঁধের উপর উঠে যাচ্ছে। বেশ কদিন থেকে ওদের আর প্রার্থনার অন্ত নেই। গরম হাওয়ার দাপটে মাঠেঘাটের কাজকর্ম এখন বন্ধ হবার মুখে। এত চড়া রোদে মুনিষগুলোও আর পারছে না। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে এ ও জ্ঞান হারিয়ে পড়ছে ঢেলা খেতে।
সন্ধ্যা গাঢ় হয়নি, মেঘ করে এল আকাশ জুড়ে। পাকুড়তলায় জল আনতে গিয়েছিল দুর্গামণি। সে ফিরে এল হড়বড়িয়ে। বাইরে অনেক কিছুই পড়ে আছে। মেঘের যা তর্জন-গর্জন। যে কোনোসময় ঢাললেও ঢালতে পারে। দুর্গামণি ঝুম কালো আকাশের দিকে তাকাল। চিকচিকিয়ে উঠল তার চোখের তারা। এক ফোঁটা বৃষ্টির দানা তার চোখের নীচটাতে পড়ল অশ্রুদানার মতো।
–মা শীতলাবুড়ি মুখ রেখো। আচ মন ভরে ঢালো। ঢেলে ঢেলে সব ভেসিয়ে দাও। জোর পায়ে দুর্গামণি আগড় সরিয়ে ঢুকে এল দাওয়ায়। দু’চারবার চাঁটি মারার মতো বাতাস এসে ফোঁসফোঁস করল কলাগাছের ঝাড়ে, নতুন বেরনো পাতাগুলো কাঁপতে লাগল হাওয়ার শাসনে, সজনেগাছের হলুদপাতাগুলো চুনোমাছের মতো সাঁতরে বেড়াল বাতাসের নদীতে। মাঝ আকাশে বাজ পড়ল কড়কড়াত। বিদ্যুৎ-এর চিকুর ফাটিয়ে দিল আকাশের সিঁথি। অনুরাগ পর্ব শেষ হলে শুরু হল তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দলবদ্ধ ভাবে নেমে এল পৃথিবীর ধুলোয়। সৃষ্টির আদিম খেলায় মেতে উঠল চরাচর।
রঘুনাথ কালীগঞ্জ বাজারে এসেছিল ঢিলিকে খুঁজতে। হাট করতে এসে গাঁয়ের একজন ঢিলিকে দেখেছে পুরাতন বাজারে ঘোরাঘুরি করতে। নূপুর এসে বলল, দাদা, যা না রে, মাকে ধরে লিয়ে আয়। এখুন গেলে তার সাথে তুর দেকা হয়ে যাবে। তুকে দেখলে সে পেলিয়ে যেতে পারবে না। তুর কথা শুনবে। যা দাদা।
নুপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পেয়েছিল রঘুনাথ। ওদের খাওয়া-পরার কোনো অভাব নেই, অভাব শুধু সুখের। সুখ জিনিসটা দূর দেশের পাখির মতো উড়ে গেছে সংসারে ছেড়ে। শান্তি খুন হয়েছে চোরাকুঠুরীর অন্ধকারে।
ঠিক আচে। যেচ্চি। দেকি কতদূর কী করা যায়। রঘুনাথের কণ্ঠস্বরে ছিল সান্ত্বনা। নূপুর ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, তুই যা। তুই না গেলে মা বাস ধরে দেবগ্রাম-পলাশী পেলিয়ে যাবে। ওখান থেকে টেরেন ছাড়ে। টেরেন চেপে পেলিয়ে গেলে তার হদিস আর পাওয়া যাবে না। নুপুরের ছলছলানো চোখ মন খারাপ করে দিল রঘুনাথের।
কালীগঞ্জে এসে আটকা পড়ে গেল রঘুনাথ। এ বৃষ্টি যে চট করে থামবে না সে হাড়ে-হাড়ে টের পেল। অসুবিধা হলেও এই অসুবিধা মানিয়ে নেওয়া যায়। কদমগাছের ফুলগুলোর জন্য তার কষ্ট হত। ফি-বছর এ সময় ফুল ফোটে, গাছটা আকাশের ঝকমকে তারার মতো সুন্দর হয়ে ওঠে। এ বছর সেই সময় কবে পেরিয়ে গেল। কুঁড়ি ধরেছিল কিন্তু শুকিয়ে তা বেশিরভাগই ঝরে গেল। বুড়িগাছের শুকনো মুখের দিকে আর তাকানো যেত না, যেন বড়ো ঘরের বিটি হঠাৎ রোগে-শোকে ধূসর মলিন শুকনো। ওর মুখে জলের ছিটে দেবার আর কেউ নেই।
চা-দোকানের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল রঘুনাথ তবু ত্যাড়াবেড়া জলের ছাঁট ভিজিয়ে দিল তাকে। জলের মোহনী শক্তি প্রবল, রোমাঞ্চিত হল রঘুনাথ। রাস্তায় জল জমে যেতেই বৃষ্টি এবার দম নিল। তবু গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিকণা ঝিরঝির করে ঝরছিল। মাত্র ক’ ঘণ্টার বৃষ্টিতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ধরিত্রী এমনভাবে সে শ্বাস ছাড়ল। উৎকট খরার সেই ভয়াবহতা এখন আর নেই, চারদিক থেকে ছুটে আসছে ঠাণ্ডা আমেজ। শুধু আমেজ নয়, সুখের গন্ধ পেল রঘুনাথ।
যার জন্য এতদূর আসা, সেই ঢিলিকাকিকে দেখতে পেল না রঘুনাথ। নূপুর আর নোলককে সে কি বলবে? কাকিকে খুঁজে পেলাম না এই কথাটা বলতেই তার বাবো-বাধো ঠেকবে। ওরা কাঁদবে না, কিন্তু মন খারাপ করে কষ্ট পাবে। এই মুহূর্তে লুলারামকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারল না। আজ ঢিলিকাকির এই অবস্থার জন্য লুলারামকাকাই দায়ী। ঝারির সঙ্গে কাকার সম্পর্কটা ডালপালা ছড়িয়েছে। লুকিয়ে লুলারাম গিয়ে মাংস দিয়ে এসেছে ঝারিকে। ভিকনাথ সব জানত, সে লোভে পড়ে কোনো নিষেধ করে নি। অভাব মানুষের সব খায়। ভিকনাথকে তার অভাব পুরোপুরি গিলে নিয়েছে। ফলে ঝারির মুখের উপর সে কোন কথা বলার সাহস রাখে না।
পুরাতন বাজারটা ঘুরে রঘুনাথ চলে গেল বাস-স্ট্যাণ্ডের দিকটায়। ওদিকটা এখন এই দিকটার মতো জমজমাট নয়। দু-একটা মিষ্টি দোকান, সোনা দোকান, কাপড়ের দোকান, সাইকেল দোকান ছাড়া আর কিছু নেই। বাস-স্ট্যাণ্ডের চা-দোকানটায় তখনও বেশ ভিড় দেখতে পেল রঘুনাথ। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। সেই উত্তেজনাকে ঘিরে রয়েছে আশঙ্কা আর সংশয়।
দুল কাহারকে এ গাঁয়ের কে-না চেনে। ওর মতো দরাজ মনের মানুষ খুবই কম হয়।
দুলু কাহারের বাপের নাম কুলু কাহার। সে আগে পাল-কোম্পানির টালিকারখানায় কুড়ুল নিয়ে কাঠ ফাড়ত। শুধু কাঠফাড়া নয়, যখন যা কাজ পেত সে কাজ মন লাগিয়ে করত। গায়ে তাগদ থাকলে মানুষের মনে কর্মভীতি জমতে পারে না। টালি কারখানার কাজ মরশুমি কাজ। বর্ষা-বাদলের দিনে তা হবার নয়। ভেজা কাঠ শুকোবার জন্য রোদ দরকার। কাঁচা কাঠে পোড় জ্বলে না, শুধু ধোঁয়া উগরায়। কুলু তাই বর্ষা-বাদলের দিনে কুড়ুল ফেলে মোট বইত, মুনিষ খাটত। বিশেষ করে কালীগঞ্জ বাস-স্ট্যাণ্ডে তার সময় কেটে যেত বেশি করে। এখানে টুকটাক কাজ লেগেই থাকে। বাসের মাথার মাল-লোড করা, লরিতে পাট চড়ানো..আরও কত কী কাজ। দিনভর খাটলে ভাত-কাপড়ের অভাব হত না কুলুর। তার তিন বেগমের দু-জন এখন দেশ ছাড়া। শুধু ছোটবিবি তাকে জড়িয়ে আছে সুন্দরী শুয়োফলের মত। দুলু হল বড়ো বেগমের সন্তান। সে বড়ো বাপ ন্যাওটা। কুলুরও ছেলেটার উপর টান কম নয়। ওই ছেলেই তো তাকে খাওয়াবে, পরাবে। ওই ছেলেই তো তার বুড়ো বয়সের লাঠি, সাহারা। ছেলেকে তাই চোখে চোখে রাখত সে।
বয়স বাড়লে শুধু চামড়া নয়, ঢিলেঢালা হয়ে যায় মানুষের মনও। ভেঙে যাওয়া কলসী-হাঁড়ির খোলামকুচির মতো স্বপ্নটাও অর্থহীন, গুরুত্বহীন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছড়িয়ে যাওয়া স্বপ্নকে নতুন করে মালা গাঁথার মতো আর একত্রিত করা যায় না। কুলু কাহারের ইচ্ছা ছিল সে ছেলেটাকে অন্তত লাখুরিয়া হাই ইস্কুল অবধি পাঠাবে, কিন্তু দুলুর জেদ, গোঁ আর পালিয়ে বেড়ানো স্বভাব তাকে পণ্ডিত বিলের জলের মতো স্থিতু হতে দিল না। ফলে অ-আ ক-খ শিখেই দুলুর পড়া শেষ। গায়ে গতরে বাড়তেই সে-ও কুড়ুল তুলে নিল কাঁধের উপর। একদিন কুলু কাহারের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল কারখানায় কাজ করবে বলে। কাঠ-চেরাইয়ের কাজ মন্দ নয়। এ কাজ করে অনেকেই তো সংসার টানছে।
কুলু কাহারের এখন বয়স হয়েছে, সে আর নিয়ম করে খাটতে যেতে পারে না। তবু সে নিয়ম করে একবার স্ট্যাণ্ডের চা-দোকানটায় আসবেই আসবে। এতদিনের অভ্যাস, বাজারে না এলে তার ভাত হজম হবে না। দুলু হাজার নিষেধ করলেও সে শুনতে চায় না, গোসা করে বলবে, বুড়া হয়েচি মানচি–তবু এখুনও তো মাজা পড়েনি, লাঠি ছাড়া চলাফেরা করতে পারি। এখুনও মাল আমি তুলে দিতে পারব বাসের মাথায়।
মনে যত জোর থাক কুলু কাহারকে মোট বওয়াতে মানুষ এখন ভয় পায়। বুড়ো মেরে কেউ পাপের ভাগীদার হতে চায় না।
সংসার চলছিল দুলুর ঘাম ঝরানো মেহনতে। ফুঁকফুঁক করে প্রায়ই সে বিড়ি টানত বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে। কাঠ-চেরাইয়ের কাজে মেহনত যেমন আছে–তেমন আছে পয়সা। শক্তি জল হয়ে ঢল নামাত পা-বরাবর। যেমন খাটত তেমন খাদ্য পেত না দুলু। তার যুবক চেহারা ঝাঁপিতে আটকে রাখা জাতসাপের মতো ফুঁসছিল। একদিন বদলা নিল সে-ও। কাশি-কফের সঙ্গে কাঁচা রক্ত উঠে এল সেই প্রথম। কালীগঞ্জের ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বলল, তোমার টি-বি হয়েছে দুলু। তোমার এখন আরামের প্রয়োজন। দুধ-ঘি, ভালো-মন্দ নিয়মিত খেতে হবে তোমাকে। যদি নিয়ম করে ওষুধ খাও আর আমার কথা শুনে চলো তাহলে তোমার এই অসুখ মাস তিনেকের মধ্যে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে।
দুলুর বুকের রোগ ভালো হয়ে গেল, সে এখন সুস্থ মানুষ। তবু ডাক্তারবাবু মানা করেছেন তাকে কাঠ-চেরাইয়ের কাজে যেতে। গাঁয়েঘরে বিকল্প কাজ কোথায়? হালকা কাজ ছাড়া দুলুর চলবে না। শেষপর্যন্ত সে একটা কাজ পেল পালেদের আটা চাকিতে গম-পেষানোর। মাস গেলে মাইনে দেবে পালবুড়ো। এছাড়া জলখাবার, এটা-সেটা।
দুলু আটা চাকির কাজটা মন দিয়ে করছিল। এ কাজে সে বেশ স্ফূর্তিও পেত। হঠাৎ অমনোযোগে তার ডান হাতটা জড়িয়ে গেল ঘূর্ণায়মান বেল্টের সঙ্গে। মেসিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে অক্ষম হল দুলু। মেসিন তার ডান হাতটা বল প্রয়োগে বিচ্ছিন্ন করে দিল শরীর থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে কাটা হাত আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলা দুলুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল পালবুড়ো।
ডাক্তারবাবু জবাব দিলেন, এখনই একে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যান। আমি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। যা ব্লিডিং হয়েছে, ইমিডিয়েট ওর ব্লাডের দরকার।
পালবুড়োর চেষ্টায় দুলু প্রাণে বাঁচলেও তার ডান হাতটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল। অথর্ব হয়ে গেল দুলু। চোখ ফাটিয়ে কান্না এল তার। কুলু কাহার তার কোঁকড়ানো চুলে স্নেহের হাত রেখে বলল, চোখ মুছ। যা হবার তা তো খোদা করে দেখাল। খোদার উপর আমার কুনো রাগ নেই বেটা। তুর এট্টা হাত নেই তো কি আছে? তুর দুটা পা আচে। যার পা আচে সে তো ভবঘুরে। ইবার থিকে তুই চরে খা। আমি খোদাতালার কাছে তুর লাগি দোয়া মাঙচি।
দুলু সেই থেকে না ভিখারি, না বাউল, না ফকির। তবে তার গলায় চড়া সুরে খেলে বেড়ায় লালন ফকির। গাঁয়ে গঞ্জে, হাটে-বাজারে এমনকী রেলগাড়ির কামরায় সে ভিখ মেঙ্গে বেড়ায় সকাল থেকে সন্ধে। গান শোনানোর পরে বা হাতটা বাড়িয়ে দেয় হাতের তালু চওড়া করে। কেউ দেয়, কেউ আবার দেয় না। তবু সারাদিনে কুড়িয়ে বাড়িয়ে সে যা পায় তাতে তার দিব্যি চলে যায়। এখন মনে কোনো খেদ নেই দুলুর। কুলু কাহার তাকে বিয়ের কথা বললে দুলু হাসে, আর আমারে বাঁধতে চেও না বাপ। মন আমার বারমুখী হয়েছে। এ ঘর যে কবে পর হয়ে যাবে-সে কতা আমি হলফ করে বলতে পারচি নে। যে কদিন আমি সংসারের লতায় জড়িয়ে আছি, সে কদিন তুমাদের কুনো অসুবিধে হতে দিব না। জান দিয়ে হলেও তুমাদের আমি সেবা করে যাবো।
সন্ধে সাড়ে সাতটায় বাস থেকে নামল দুলু কাহার। তার গায়ে গেরুয়া আলখাল্লা, মাথার কোঁকড়া চুল ঘাড় ছাপিয়ে কাঁধ ছুঁয়েছে, কপালে খড়ি দিয়ে আঁকা রসকলি, চোখে মুখে ক্লান্তির পাশে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা। জমা জলে পা দিয়ে সে কিছুটা বিব্রত। পায়ের চপ্পলটা আর একটু হলে তাকে বেকায়দায় ফেলে দিত, নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে সে আশেপাশে আবেশী চোখে তাকাল। তার ঢুলু ঢুলু উদাসী চোখ হঠাৎই রঘুনাথকে দেখতে পেয়ে প্রফুল্লবোধ করল, কি রে, তুই ইখানে কি করচিলি? ফিরবি নে?
ঢিলিকাকিকে খুঁজতে বেরিয়েচি। রঘুনাথ এগিয়ে এল সামনে, তুমি তো দেবগ্রাম থিকে ফিরলে, সিখানে কি তার সাথে দিখা হলো তুমার? বাউল-কায়দায় ঘাড় নাচাল দুলু কাহার, তার কাটা হাতের ল্যাকপ্যাক করা জামার কাপড়টা সেই ছন্দে দুলে উঠল, তুর কাকারে বল–একবার বরমপুর বা কেসনগরে লিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে। শুনেচি ওর তো পয়সার কুনো অভাব নেই। অভাব নেই যখন তখন ওর অতো হাড়কিপটেমী কেন? টাকা-পয়সা কি সঙ্গে যাবার ধন রে! ওসব হল অলিত্য। নদীর ঢেউ। আজ আচে, কাল নেই।
রঘুনাথ চুপচাপ শুনছিল। সে সব জেনে-বুঝেও এখন কিছু বলতে পারে না। ঘরের কথা বাইরে বলা শোভা দেয় না। লোক হাসবে। নিন্দে করবে। মুখে কুলুপ এঁটে রঘুনাথ দুলু কাহারের দিকে তাকাল, চলো দুলুকাকা। ঘরে গিয়ে আবার খপরটা দিতে হবে।
-খপর দিয়ে কি হবে? তারে তো আমি পেরাই লালগুলা টেরেনে দেখি। দুল ঠোঁট কুঁচকে আধ্যাত্মিক-মুদ্রায় ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিছুক্ষণ পরে সে নিজের অবস্থায় ফিরে বলল, চল চা খাই। আজ রাতে ঘুম ভালো হবে বুঝতে পারছি। সারাদিন ভেষণ কষ্ট যায়। গান গেয়ে-গেয়ে গলাটা ঘড়ঘড় করে ব্যথায়।
-একটু আরাম করলেই তো পারো।
–তা যায়। কিন্তু সনসার? সনসার যে আরামের কতা বলে না।
বাঁশের বাতা চিরে বানানো হয়েছে বেঞ্চি। লোক বসে-বসে চকচক করছে সেই বাতা। টুকরো ছিটকাপড় দিয়ে বানানো ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বাঁ-হাত দিয়ে কাঁধটা রগড়ে নিল দুলু কাহার, তারপর গর্দান নাড়িয়ে মেয়েলী স্বরে বলল, দুটো চা।
দুলু পেশার সঙ্গে নিজেকে পাল্টে নিয়েছে পুরো মাত্রায়। চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে সে এখন ভিন্নমানুষ। যারা তাকে বছর পাঁচেক আগেও দেখেছে তারা এখন অবাক হয় দুলুর এই পরিবর্তনে। কুলু কাহার ছেলের এই পরিবর্তনে মাথার চুল চেপে আক্ষেপ করে, হায় খুদা, এ কী করলে গো তুমি? সব দিয়ে কেড়ে নিলে কেনে? আমার দুষটা কুথায়?
বাপের এই হাহাকারকে কোনো গুরুত্ব দেয় না দুলু। সে জানে দু-দিনের এই শরীর জলে ভাসবে, দাঁড়কাকে ঠুকরে খাবে। পচা দেহকে এত ভালোবেসে কি হবে? ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাড়ে চুমুক দিয়ে দুলু কাহার বলল, সামনে বড়ো খারাপ দিন আসচে রে! এমন এট্টা খারাপ দিন আসচে যখন মানুষ মানুষকে চিনবে না। এই দাদা, ভাই, কাকাখুড়োর সম্পর্কগুলো সব রেললাইনের খোয়ার চেয়েও নিরেট হয়ে যাবে। মানুষের মন থিকে দয়া-মায়া সব মুচে যাবে। কপালে ভাঁজ ফেলে অন্যমনস্ক হয়ে গেল দুলু কাহার।
রঘুনাথ আয়েশ করে চা-খেয়ে ঠোঁট মুছে বলল, কাকা, এট্টা কতা বলি তুমারে। রাগ করো না।
-রাগ করবো কেনে? বল, বল।
-তুমি টেরেনে গান গাও, গান শোনাও। কই গাঁয়ের মানুষকে তো গান শোনাও না? রঘুনাথের প্রশ্নে সামান্য হলেও বিচলিতবোধ করল দুলু কাহার, গাঁয়ের মানুষের আগের সেই মন নাই। এখুন হাড়সার খাওয়া ফসল খেয়ে ওদের মন হাড়ের চেয়েও শক্ত হয়ে গিয়েছে। ওদের মনে দয়া-মায়া বস্তুটাই নাই। তাছাড়া ভিখ দেওয়ার সময় ওরা মুষ্ঠি ভরা চালটাও দিতে চায় না। ভিখ না পেলে আমার তো চলবেনি। তাই হররোজ গাঁ ছেড়ে পালাই! কাজ-কম্মো সেরে আবার গাঁয়ে ফিরি। আমার যে টিকি বাঁধা আচে এই গাঁয়ে!
রাতে জাউভাত রেঁধেছে দুর্গামণি। বৃষ্টির পরে তার মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে। রঘুনাথকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে, সে জিজ্ঞাসা করল, নিদ লাগচে বুঝি? ভোক লাগলে বল-ভাত বেড়ে দিই।
রঘুনাথ ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, দাদু মনে হয় শুয়ে পড়েচে।
–শুতে দে। দিনভর আরাম পায় না মানুষটা। দুর্গামণির গলা নরম হয়ে এল, দুলাল কাল চলে যাবে। এদিকে আবার ইন্দুমণির জ্বর এয়েচে। দেখ দেকি কেমুন বেপদ! আর ভালো লাগে না।
-কাকা কেনে মুনিষ খাটতে চায় না? রঘুনাথের হঠাৎ প্রশ্নে ঠোঁট ওল্টাল দুর্গামণি, বুক ভরানো শ্বাস ছেড়ে ছেলের মুখের দিকে তাকাল, সবার ভাগ্য সমান হয় না বাপ। কারো কারোর ভাগ্য ভুষো ছাই দিয়ে ওপরওয়ালা লিখে দেয়।
-কাকা কেনে খাটতে যায় না আমি জানি।
–কী জানিস? দুর্গামণির চোখ শক্ত হয়ে উঠল।
রঘুনাথ অকপটে বলল, কাকার স্বভাব ভালো নয়। গাঁয়ের মানুষ কাকাকে লিয়ে অনেক কথা বলে। কাকা চোর। আমার কচিয়াদাদুও চোর।
-চুপ। যা বলেচিস, আর বলবি নে। দুর্গামণি জ্বলে উঠল, ওরা তুর গুরুজন। ওদের লিয়ে কু-ভাবতে নেই।
-কু’ কাজ করলে কু-ভাবব না?
–না। তুই ছোট, ছোটর মতুন থাক।
-আমিও তো একদিন বড়ো হবো। তখুন?
–তখুন কি? চুলায় শুকনো তুষ ছড়িয়ে দিয়ে দুর্গামণি অঙ্গার চোখে রঘুনাথকে দেখল।
রঘুনাথ মায়ের চোখে চোখ ফেলে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, কাকা আর কচিয়াদাদুর মতন আমিও রেতেরবেলায় মুনিষ খাটতে যাবো। রাতেরমুনিষ হলে আমাকে আর বাবার মতন গাঁ-ছাড়া হতে হবেনি।
দুর্গামণির সারা শরীর কেঁপে উঠল রঘুনাথের কথা শুনে, ওসব কথা মনে আনাও পাপ। যা নাক-কান মুল। এই আমার মাথায় হাত রেখে বল–আর কুনোদিন এসব কথা মনে আনবি নে। তুই যদি এসব কথা ভাবিস-তাহলি আমার মরণ হবে বলে দিলাম। কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না।
রাতভর ঘুমাতে পারল না রঘুনাথ, ঘুরে-ফিরে মায়ের কথাই ভাবছিল সে। তাদের সংসারে অভাব আছে কিন্তু সেই অভাবের কাছে এখনও মাথা বিক্রি করে দেয়নি দুর্গামণি। সে বিপথগামী হবে না, এটাই তার শপথ।
রঘুনাথের মনে পড়ল অনেকদিন আগের একটা ঘটনা। দাদুর সঙ্গে ছাতু তুলতে গিয়েছিল সে বামুনবাড়ির জঙ্গলে। এই এলাকার বালি ছাতু বেশ বিখ্যাত। বর্ষার শুরুতেই শুরু হয়ে যায় ছাতু ফোটা। ছোট ছোট ছাতুগুলো বর্ষার জল পেয়ে বনফুলের মতো মেলে ধরে নিজেদের। অসংখ্য ছাতু যেন ঘাস ফুলের মতো জাহির করে নিজেদের। বামুনবাড়ির কর্তা নীলাক্ষবাবু এইগুলোকে নজরে রাখেন, কাউকে হাত লাগাতে দেন না। চাইলেও একটা ছাতু কাউকে তিনি দেবেন না। নিজের সম্পত্তির উপর তার টান বরাবরের। চুনারাম এসব তথ্য জানত। রঘুনাথকে নিয়ে সে তাই বেরিয়ে গিয়েছিল ভোর-ভোর। আলো ফুটলে মানুষজনের সমাগম বাড়বে। ছাতু তুলতে দেখলে সেই খবর পৌঁছে যাবে বাবুর কানে। বাবু রাগারাগি এবং গালমন্দ করবেন। সেরকম হলে পাকমোড়া দিয়ে কেড়ে নেবেন বেতপালি। তখন সব শ্রমই পণ্ডশ্রম।
প্রাণভরে ছাতু তুলে ঘরে ফিরে এসেছিল চুনারাম। ছাতু তোলার গল্প গর্বভরে শুনিয়ে দিল দুর্গামণিকে। রঘুনাথ ভেবেছিল দাদুর কথা শুনে খুশি হবে দুর্গামণি। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। সব শোনার পরে রাগে ঝাঁ-ঝাঁ করছিল দুর্গামণির মাথা, ছিঃ, একাজ তো মানুষের কাজ হয়নি। পরের বেড় থেকে ছাতু তুলে আনায় কুনো বাহাদুরী নেই। বাবু যদি দেখতি পেত তাহলি লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যেত।
রঘুনাথ অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে বলেছিল, বাবু দেখবে কি করে? আমরা যে আলো না ফুটতেই ঘর থিকে বেরিয়ে গিয়েচি।
-কাজটা ভালো করিস নি বাপ। দুর্গামণির কণ্ঠস্বরে হতাশা ঝনঝনিয়ে উঠল, পরের জিনিস না বলে নিলে চুরি করা হয়।
–তাহলে আমরা চোর?
-হ্যাঁ, চোরই তো। দুর্গামণির গলা কঠিন হয়ে উঠল। এরপরে রঘুনাথের আর কথা বলার সাহস হয়ে উঠল না। বউমার রকমসকম দেখে চুনারাম আর কথা বাড়ায়নি। সুড়সুড় করে চলে গিয়েছিল তক্তাপোষের কাছে। দাওয়ার একধারে তক্তাপোষটা সব সময় পড়ে থাকে। চুনারামের ওটাই বিশ্রাম করার জায়গা। বসে পা দোলাচ্ছিল সে। দুর্গামনির কথা ভাবছিল সে। গরিবঘরের মেয়েটার সাহস আছে। অভাবে সে ভেঙে পড়ে না। অন্যায়ের কাছে নিজেকে সে বিকিয়ে দিতে শেখেনি। ধাওড়াপাড়ায় এমন বউ কটা ঘরে আছে? চুনারাম বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া উড়িয়ে দিল বাতাসে। বউমার জন্য গর্ব হল তার। এ মেয়েই পারবে গুয়ারামকে পথে আনতে। এর হাতে সংসারের রাশ থাকলে সে সংসার খাদে তলিয়ে যাবে না।
দুর্গামণির মুখটাই ঘুমাতে দিচ্ছিল না রঘুনাথকে। সে উঠে গিয়ে চুনারামের বিছানার পাশ থেকে বিড়ির ডিবা আর দেশলাই নিয়ে এল। বিড়ি খেলে ধোঁয়ায় যদি মনটা খোলা হয়। সাবধানে বিড়ি ধরিয়ে ফুঁসফুঁস করে টানল রঘুনাথ। তবু মন থেকে তার ভয় গেল না। এ পাড়ার সব ছেলেরাই গুরুজনদের সামনে বিড়ি ফোঁকে। এটাই রেওয়াজ। দুর্গামণি রঘুনাথকে সেই সহজ পথে চলতে দেয়নি। চোখ রাঙিয়ে বারবার শাসন করেছে সে, খবরদার কুনোদিন ওসব ছুঁয়ে দেখবি না। যদি কুনোদিন তোকে নেশা করতে দেখেছি সেদিন চ্যালাকাঠ দিয়ে মেরে তুর মাথা ফেটিয়ে দেব।
-রতন, ড্যাবরা যে খায়?
–ওরা গু খায় বলে তুই-ও খাবি? দুর্গামণির জবাবের কাছে মাথা ঝুঁকে গেল রঘুনাথের। সেই থেকে একটা ভয় এবং শ্রদ্ধা তার মনের ভেতর বাসা বাঁধল। মাকে সে কোনো কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারে না। দুর্গামণি প্রায়ই তাকে বলে, শুধু ঘাড়ে-গর্দানে বড়ো হলে মানুষ বড়ো হয় না। মানুষকে বড়ো হতে গেলে বড়ো কাজ করে দেখাতে হয়।
বড়ো কাজ মানে দশের কাজ, সমাজের কাজ। রঘুনাথ ভাবে। এসব কাজে হিম্মত দরকার। চড়াইপাখির মতো বুক নিয়ে এসব কাজ হয় না।
বিড়িটা নিভিয়ে উঠোনে ফেলে দিল রঘুনাথ। পুরো মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছে। গলাটা শুকোচ্ছে বারবার। মনটা ছটফট করছে কী জন্য সে ঠিক বুঝতে পারে না। সন্ধের পর থেকে জোর বৃষ্টি হয়েছে। পথের ধুলো এখন কাদা। মাটি থেকে অদ্ভুত একটা সুগন্ধ উঠে আসছে বাতাসে। খরার বাতাস আজ বড়ো অহঙ্কারী। এই শান্ত পরিবেশটা ভালো লাগছিল রঘুনাথের। শীত-শীত আমেজ ছড়িয়ে রয়েছে সাবধানে। বৃষ্টির সময় বুড়িগাঙের জলে খৈ-ফোটার মতো চড়বড় চড়বড় শব্দ হয়। জলের বিন্দুগুলো ভেঙে কাচের মতোন ছড়িয়ে যায় জলের উপর। সামান্য ঢেউ দিলে সেই দৃশ্য অপার্থিব।
রঘুনাথ ভাবল কাকার সঙ্গে তার একবার দেখা করার দরকার। লুলারামের প্রস্তাবটা মনে ধরার মতো। রাতের কাজটা ঠিকঠাক শিখে নিতে পারলে তখন শুধু টাকাই টাকা। গুয়ারাম রগড় করে বলে, টাকা নয় তো যেন চাঁদির জুতা। চাঁদির জুতায় কাঠেরপুতুল হাঁ-করে। বুবায় কতা বলে। মরা মানুষ পিটপিটিয়ে তাকায়।
রঘুনাথের টাকার ভীষণ দরকার। গুয়ারামের ঘর ছেড়ে যাওয়াটা তার মনোপূতঃ হয়নি। পেটের দায়ে মানুষ কেন জন্মভিটা ছাড়বে? মাটি ছেড়ে গেলে মানুষের আর থাকে কি?
লুলারামের বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে কী ভেবে আগড় থেকে হাত সরিয়ে নিল রঘুনাথ। তার মন বলল, যাসনে রঘু, উখানে যাস নে। পাপের পুকায় কেমড়লে তার বিষজ্বালা বড়ো ভয়ঙ্কর। তুই সইতে পারবি নে, জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাবি। তারচে ঘুরোন যা, ঘর যা। লুভের পথ, পাপের পথ তুর নয়।
কী ভেবে অন্ধকার বেড়ার ধার থেকে মাথা নিচু করে এল ফিরে রঘুনাথ। বাঁধের উপর উঠে এসে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। রাতেরবেলায় বাঁধের ধার শান্ত, একেবারে শুনশান। এসময় আকাশ থেকে দেবতারা নেমে এসে বুঝি হাওয়া খায়। বুড়িগাঙের জলে গা ধুয়ে আবার চলে যায় স্বর্গে।
এখন কদমগাছের পাতা নড়ছিল জলে হাওয়ায়। মুখ থ্যাবড়া পেঁচাটার মনে সুখ নেই। ইঁদুরগুলো আজ সব কোথায় পালাল? বসে বসে ঘাড় ঘুরাল পেঁচাটা। যেন ঘাড় নয়–পুরো শরীরটা তার ঘুরে গেল। এ সময় বুড়িগাঙের জলে কপাত করে ঘাই দিয়ে উঠল মাছ। দূরে কোথাও ক্র্যাও-ক্র্যাও শব্দে ডেকে উঠল রাতপাখির দল। এক-যোগে প্রহর ঘোষণা করে ভেসে এল শেয়ালের চিৎকার।
.
১০.
রঘুনাথ আকাশের দিকে তাকাল। ফিকে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে নামছে পৃথিবীতে। অমাবস্যা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। হয়ত ভোরের দিকে আরও ঝকঝকে দেখাবে চারপাশ। কী ভেবে বাঁধের ঢালু পথ বেয়ে মাঠের দিকে একা একা নেবে গেল রঘুনাথ। তার হাতে লাঠি বা কোনো আলো নেই। সাহেবমাঠের আল সব সময় বিপজ্জনক। ওখানে শামুকভাঙা খরিস সাপের বসবাস। ওরা মাঠেই শঙ্খ লাগে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়। ঘাস কাটতে গিয়ে দুপুরবেলায় রঘুনাথ অনেকগুলো খরিসের ছাকে দেখেছিল চরতে। ভয় যে লাগেনি তা নয়। তবে ওদের সে মারেনি। দুর্গামণি খরিসের ছাগুলোকে ড্যাকা বলে। ড্যাকা ওদের চলতি নাম। হাঁটতে হাঁটতে রঘুনাথের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি চলকে উঠল। এই মাঠে কমলার সঙ্গে তার কতবার দেখা হয়েছে। যতবারই চোখাচোখি হয়েছে ততবারই চোখ নামিয়ে ভীতু খরগোসের মতো দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছে কমলা। ওর নরম চোখের তারায় ধরা পড়ে যাওয়ার কাঁপুনি। এই কাঁপুনিটা রঘুনাথের বুকের ভেতরে পুরুষমথের মতো ফড়ফড় করে। এই ফড়ফড়ানীর অন্য নাম কষ্ট। সূর্যাক্ষ বলে, কষ্ট নয়রে, ভালোবাসা।
ভালোবাসা কি রঘুনাথ এখনও জানে না। তবে কমলার সঙ্গে তার যেদিন দেখা হবে সে রাতে সে স্বপ্ন দেখবেই দেখবে। ঘুম ভেঙে গেলে সারারাত তার আর ঘুম আসে না। আখখেতের আলের কচি-কচি ঘাস মাড়িয়ে কমলার দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা তার মনের ভেতর বায়োস্কোপের ছবির মতো দুলতে থাকে। চোখ বুজে ভাবলে কী আনন্দ, মনটা কদমফুলের মতো ফুটে ওঠে, মৃদু চাপা একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয় বিছানায়।
আজ সেসব কোনো অনুভব রঘুনাথকে ভাবায় না। সে ভাবছে একটাই কথা। সে কোন দিকে যাবে? চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। ধরা পড়লে? মার, অপমান, থানা-পুলিশ কিংবা জেল-হাজত। সে ধরা পড়বে কেন? গুরুবিদ্যা কোনোদিন কি বিফলে যায়? কাকার কাছে কাজ শিখবে সে। কাকা-ই হবে তার ওস্তাদ, গুরু। রঘুনাথ ভেতরে-ভেতরে তাতছিল। দুর্গামণির মুখটা মনে পড়তেই তার উথলে ওঠা আবেগে কে যেন ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে দিল। আলের উপর পা থেবড়ে বসে পড়ল সে। আবার দোলাচালের দোলনার মতো দুলতে লাগল মনটার। বাঁধের উপর দৌড়ঝাঁপ খেলা পাড়ার কুকুরগুলোর চিৎকার ভেসে এল, রোজ ওরা এসময় পাগল হয়ে যায় কেন? এটা কি কুকুরের স্বভাব? এভাবে চিৎকারে পাড়া মাথায় তোলার কোনো কি কারণ আছে, নাকি এই প্রহর পেরনো সময়ে তারা কী বিশেষ কাউকে দেখতে পায়? রঘুনাথ নিশ্চিত হল যে রাতের সময়টুকু সবার জন্য ভাগ-বাটোয়ারা করা থাকে। চোর কোন সময়টাকে পছন্দ করে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করার জন্য? লুলারামকে একথা অবশ্যই সে জিজ্ঞাসা করবে। সব কাজেরই একটা নিয়ম-নীতি-নিষ্ঠা থাকার প্রয়োজন। এসব যখন রঘুনাথ ভাবছিল তখন বাঁধের উপর দিয়ে চলন্ত একটা আলোক উৎসকে দূর থেকে দেখতে পেল। আলোটা কিসের সেটা অনুমান করার জন্য সে ঘাড় সোজা করে বাঁধের দিকে তাকাল। তখনই তার কানে এল শেষযাত্রার ধ্বনি। বল হরি হরি বোল। কাদের আবার শূন্য হল সংসার? কার আবার পুড়ল কপাল? শ্মশানঘাটে যাওয়ার রাস্তাটা বাঁধ ধরে গিয়ে মানিকডিহির গাঁয়ে ঢোকার ঢালুপথ পেরিয়ে আরও অনেকটা। হ্যাজাকের আলো পায়ের গতির সঙ্গে দুলছে। সরে সরে যাচ্ছে জমকালো আলো। রঘুনাথ অনুমান করল হ্যাজাক নিয়ে শ্মশানে যাওয়ার মানে মৃতর বাড়ির অবস্থা মন্দ নয়। আলোটা বেশ কিছুক্ষণ পরে দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই একরাশ বিষাদ-দুঃখ এসে গ্রাস করল রঘুনাথকে। অথচ সে বুঝতে পারল না তার এত কিসের দুঃখ।
রাত বয়স্ক হতে থাকে, মাথার উপর উড়ন্ত রাতপাখির ডাকে রঘুনাথের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়। ঘরে ফেরার তাগিদটা এবার তাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। এত বড়ো একটা রাত দু-চোখের পাতা এক না করে ফুরিয়ে যাবে ভাবা যায় না। দুর্গামণি বলে, রাত উজগারা ভালো নয়। রাত শুধু ঘুম খায় না, খুনও খায়।
দু-হাতে ভর দিয়ে রঘুনাথ উঠে দাঁড়াতে চাইলে একটা ফিসফিস কথা তার কানের গহ্বরে সিঁধিয়ে যায়। এত রাতে কে কথা বলছে অমন চাপা গলায়? কণ্ঠস্বরটা চেনা মনে হচ্ছে, তবু সঠিক যেন চিনতে পারছে না সে। আগ্রহ আর বিস্ময়বোধে রঘুনাথ টানটান হয়ে বসে থাকল ঘাসের আসনে।
ঘন আখগাছের ভেতরে সম্ভবত দুজন মানুষ কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। এরা কি কথা বলার জন্য আর জায়গা খুঁজে পেল না। আশ্চর্য! রঘুনাথ শুনল একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর উদ্বিগ্ন গলায় বলছে, এ হতে পারে না লুলাভাই। সব বিদ্যার চর্চা দরকার। চর্চা না থাকলে জং ধরবে। আর জং ধরলে কমে যাবে বিদ্যার ধার। তখন এই বয়সে ভেলকি হারিয়ে চোখ হবে সাধারণ হাটুরের মতোন। আমি চাই-হপ্তায় অন্তত দুটা করে কাণ্ড হোক।
সে তো হবে কিন্তু–। লুলারাম কী বলতে গিয়ে থামল, রোজ রাতে পুলিশ আসে আমার ঘরে। পাকুড়তলায় থানার গাড়িটা থামিয়ে তারা আমার কপাটে লাথ মারে। খিস্তি দেয়। এসব শুনে আমার মেয়েদুটো ভয়ে কাঁপে। তারা কান্নাকাটি করে। আমার আর ভালো লাগে না।
–ভালো না লাগলে চলবে? হাবুলচোর ঝুঁকে পড়ল, বসে খেলে সাগরও শুকিয়ে যায়। মানো তো কথাটা? নাকি মানো না? যাই হোক আমি বলছিলাম কি পুলিশও থাকবে, আবার চোরও থাকবে। এটা সংসারের নিয়ম। হাবুলচোর বড়ো করে শ্বাস টেনে নিল বুকের ভেতর, সেই শ্বাস শরীরে চালান করে লুলারামের মুখের দিকে সংশয় ভরা চোখে তাকাল, মরা পোড়ানো কি একা হয় গো, এরজন্য দল দরকার। বিদেশ-বিভূঁয়ে চুরির কাজে গেলে মানুষের খুব দরকার হয়। হাতে হাত না মিলিয়ে কাজ করলে খুব বিপদ। ধরা পড়ে গেলে ছাল ছাড়িয়ে ডুগডুগি বাজাবে। তবে তুমি থাকলে আমার কুনো চিন্তা থাকে না। তখন রাতকে ধমকাতে মন চায়।
অনেকক্ষণ চুপ করে গেল লুলারাম, একটা বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে, কাজ করতে তো মন চায় হাবুলদা কিন্তু পেরে উঠি না। ছাতিটা আর আগের মতোন দঢ়ো নেই। বয়স হচ্চে তো
-এ তুমার ভুল ধারণা লুলাভাই।
–ভুল নয় গো, সত্যিকথা। মনে ভয় ঢুকেচে। ভয় হল গিয়ে উইপুকা। কখুন কুরে কুরে খেয়ে লিবে তুমাকে–টেরও পাবে না। লুলারাম ঘাড়-গর্দান টানটান করল। সামনে সরে এসে হাবুলচোর খপ করে হাত দুটো জড়িয়ে ধরল লুলারামের, ভাই, যে কতা বলছিলাম। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্রপক্ষের দাবি-দাওয়া আচে। টাকার তো দরকার। কাজে না গেলে টাকা আসবে কুথা থেকে। টাকা তো আকাশ থিকে বৃষ্টির মতোন ঝরবেনি।
-তাহলে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেচো? তা কি নাম যেন তুমার মেয়ের?
–পারুল। হাবুলচোর কাশল, কন্যাদায় মহা দায়।
–বুঝলাম। তাহলে কী করতে চাও এখন? লুলারামের কথায় যেন প্রাণ ফিরে এল হাবুলচোরের, আমি ভাবছিলাম গাঙ পেরিয়ে নয়াগ্রামের দিকে গেলে কেমুন হয়? ওদিকটায় কারোর হাত লাগেনি। আমি খোঁজখবর লিয়ে দেকেছি–মন্মথ মাস্টারের বাড়িটা সব দিক দিয়ে ভালো। ভালো মালকড়িও পাওয়া যাবে। মা শীতলাবুড়ির কেপা হলে বড়পুজা অব্দি আরামে চলে যাবে।
-সে তো বুঝলাম। কিন্তুক অত লৌকো কুথায় পাবে?
–সে সব আমি ঠিক করে রেখেচি।
কপালে ভাঁজ ফেলে লুলারাম বলল, আরও ভালো করে খোঁজখপর নাও। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। সামনের মাসের অমাবস্যায় কাজ হয়ে যাবে।
-মাঝে কি তুমার ঘরে একবার আসব?
-আসতে পারো, তবে দিনের বেলায় ভুল করেও এসো না। গাঁয়ের সব মানুষ তুমাকে চেনে, তুমি কি করো সব জানে। লুলারাম সাবধান করার গলায় বলল।
হাবুলচোর কথা মিটে যাওয়ার পর তার কাপড়ের ঝোলা থেকে বের করে আনল দেশি মদের বোতল, কাচের গ্লাস, আর ডালমুট, লুলাভাই, তুমার জন্য এনেচি। লোকাল ভাটির মাল নয়, খাস বেথুয়ার জিনিস।
দুটো গ্লাসে মদ ঢালল হাবুলচোর, একটা গ্লাস লুলারামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এখন আর দেশী খেয়ে জুত পাই না। সব ভেজাল। কী খাবো বল তো? গাঁ-গঞ্জে জুচ্চোর ভরে গিয়েছে।
লুলারাম খোলা পানীয়ে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, মদ খাওয়ার সময় অতো কতা বলো না। নেশা জমতেও ধ্যানের দরকার।
হাবুলচোর মুখ দিয়ে দোষ-স্বীকার করার শব্দ করল, তা যা বলেচো। লাখ কথার এক কথা।
ওদের নেশা জমে উঠতেই রঘুনাথ আর দাঁড়াল না। হাবুলচোরকে সে যে এর আগে দেখেনি তা নয়। একবার পণ্ডিত বিলে টানাজাল ফেলে মাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল সে। সেবার তাকে জামগাছে বেঁধে বেদম মারে গ্রামের লোক। পরে থানা থেকে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রায় মাসের উপর লেগেছিল তার সুস্থ হতে। এত মার খেয়েও সে লুলারামের নাম ফাঁস করেনি। রঘুনাথ দেখেছে সেদিন বিলের রাস্তায় লুলারাম ঘোরাঘুরি করছিল বেশ ডাঁটের মাথায়। তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল হাবুল চোরের চোখের উপর। দৃষ্টি দিয়ে দূর থেকে হাবুলচোরকে শাসন করছিল লুলারাম।
গুপ্তবিদ্যায় শাসন না থাকলে লাগামছাড়া হয়ে যায় ভাবনাচিন্তা। বাঁধের উপর এসে রঘুনাথ ভাবছিল –হাবুলচোরের মেয়ে পারুলের কথা। মেয়েটাকে সে দেখেছে। বেশ স্বাস্থ্যবতী, শ্যামলা। তবে ওর চোখ দুটো বেশ সুন্দর, কাজলটানা, পদ্মর পাপড়ির মতো। পারুলের চেহারায় একটা মাতৃমুখ ভেসে ওঠে। ওকে দেখে কোনো খারাপ চিন্তা মনে আসে না।
পারুলের ভাবনা যেন কমলার কথা মনে করিয়ে দেয় রঘুনাথকে। হপ্তাখানিক পেরিয়ে গেছে তবু ওর সাথে দেখা হয় নি। রঘুনাথ খবর নিয়ে জেনেছে-কমলা তার মামার বাড়ি গিয়েছিল। কুলবেড়িয়া হাঁটাপথ। ভ্যানরিকশার ঝামেলা নেই। কমলা যে ফিরেছে–এ খবর সে জানে। নোলকের সঙ্গে তার পাকুড়তলায় দেখা হয়েছিল। কী কথায় যেন নোলক বলে ফেলেছে কথাটা।
রঘুনাথ আর বাড়ির দিকে গেল না। কে যেন তাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল কমলাদের ঘরের দিকে। আজ রাতে তার আর ঘুম আসবে না, আজকের রাত তার ঘুরে বেড়ানোর রাত।
চেনা পথ তবু আঁধারে হাঁটতে রঘুনাথের কেমন ভয় ভয় করে। ভয় তার সুফল ওঝার ছেলে কাশীনাথের জন্য। ছেলেটার বড্ড মাথা গরম। বারদুয়েক স্কুল ফাইনাল দিয়েও সে বেড়া ডিঙাতে পারল না। এখন ঘরে বসে টিউশন পড়ায়। বাপের ওঝা- গিরির ওপর তার আস্থা একেবারে নেই বললেই চলে। সুফল ওঝা বলছিল, এই মাদুলি শরীলে ছুঁয়ে থাকলে সব পড়া তোর হড়হড়িয়ে মনে পড়ে যাবে। এই মাদুলির নাম–বিদ্যাদেবী সরস্বতী মাদুলি। বৃহস্পতিবারে তুই এটাকে ধারণ করবি। ধারণের দিন নিরামিষ খাবি।
নিষ্ঠাসহকারে ডান হাতের বাহুতে মাদুলিটা ধারণ করেছিল কাশীনাথ, কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয়নি। পড়া মনে পড়া তো দূরের কথা, মুখস্থ পড়াও মনে পড়ছিল না ঠিকঠাক। ঘরে ফিরে এসে সুফল ওঝাকে রাগের মাথায় ধরিয়ে দিয়েছিল মাদুলি, এই নাও তোমার যন্ত্র। মগজে কিছু না থাকলে শুধু মাদুলি পরে কিছু হয় না। তোমার জন্য আমি স্কুল ফাইন্যাল পাশ করতে পারলাম না। তোমার এই মাদুলি আমার পড়ার ইচ্ছেটাকে নষ্ট করে দেয়। আমি যে মন নিয়ে পড়ছিলাম, সেই মনটাকে নষ্ট করে দিল তোমার এই মাদুলির চিন্তা। আমাকে দিয়ে তুমি যা করার করলে, খবরদার তুমি এ মাদুলি আর কাউকে দেবে না। আমার মতো আর কারোর সর্বনাশ হোক এ আমি চাইনে।
মুখ শুকিয়ে চুন ফুটেছিল সুফল ওঝার, দৃষ্টি নিষ্প্রভ। গলা কাঁপছিল উদ্বেগ দুঃশ্চিন্তায়। তবু ছেলের সামনে সে তার পেশাকে ছোট করতে পারে না। এতদিন ধরে লালন করা গর্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া কি সহজ? যে কোনো খেলায় জয়-পরাজয় থাকতেই পারে। তা বলে আত্মসমর্পণ কখনো উচিত নয়।
কাশীনাথ বদরাগী ছেলে। সে রঘুনাথের চাইতে বয়সে বড়ো হবে। সরাসরি কুস্তি লড়ে রঘুনাথ হয়তো তার সঙ্গে পারবে না। না পারলে পিছিয়ে সে আসবে না। কমলাকে সে মন দিয়েছে। একথা মিথ্যে নয়। মন দেওয়ার অর্থ নিজেকে অন্যের কাছে বন্ধক রাখা। মন এক জায়গায়, দেহ এক জায়গায়–এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। রঘুনাথ কঞ্চির আগোল সরিয়ে নিকোনো উঠোনে পা দিল। অমনি দাওয়ার শুয়ে থাকা কালো রঙের কুকুরটা ডাকতে ডাকতে ছুটে এল তার সামনে। রঘুনাথ ভয় পেল না। শরীর টানটান করে দাঁড়াল। চেনা মানুষ দেখে ডাক থেমে গেছে কুকুরের। পায়ের কাছে এসে সে লেজ নাড়ছিল আদর খাওয়ার জন্য। রঘুনাথ উবু হয়ে কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বেশ বোঝা গেল রাতচরা গোরুর মতো তার এই জায়গায় যাতায়াত আছে। ইঙ্গিতপূর্ণ তিন টোকায় দরজা খুলে পাটখেতের বুনো হাওয়ার মতো বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কমলা, যেন সে জানত রঘুনাথ আসবে, সে না এসে থাকতে পারে না। তবু অভিমানে কমলার ঠোঁট নড়ে উঠল, এত দেরি হল যে! যাও, ভালো লাগে না। তোমার জন্যি পথ দেখে-দেখে চোখ আমার শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে গেল।
নিজেকে সামলে নিয়ে চাপা গলায় রঘুনাথ শুধোল, কাশীদা কুথায়?
-সে তার ঘরে শুয়েচে। ঠোঁট উল্টাল কমলা। তারপর রঘুনাথকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে সে খিল লাগিয়ে দিল সতর্কভাবে।
তক্তাপোষের উপর এলোমেলো হয়ে আছে বিছানা। সেই বিছানা যেন রঘুনাথকে আকর্ষণ করছিল। কমলা গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে রঘুনাথের দিকে তাকাতেই ওরা দুজনে দু-জনের উপর ভেঙে পড়ল।
একটা বালিশে দুটো মাথা একে অন্যের দিকে মুখ করে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। কমলার বুকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে রঘুনাথ ফিসফিসিয়ে বলল, মামার ঘরে এতদিন থাকতে পারলে? আমার জন্যি তুমার বুঝি মন কেমুন করে না?
-কে বলল? কমলা রঘুর খোলা বুকে ঠুসে ধরল ঠোঁট, তোমার চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার যে কি হল আমি তা নিজেই জানি না। এভাবে চললে তোমার কাকির মতো পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে। এত কষ্ট বুকে নিয়ে কি বাঁচা যায় গো…
-তুমার এত কিসের কষ্ট?
-ও তুমি বুঝবে না। ছেলেদের প্রাণ সুপুরির চেয়েও শক্ত হয়। কমলার হাত রঘুনাথের বুকের উপর কিলবিল করে নড়ছে। একটা টান উত্তেজনা রঘুনাথের পায়ের বুড়ো আঙুলের কাছে এসে থেমে যাচ্ছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে রঘুনাথের। ভয়ে কাঠ- ব্যাঙের মতো ক্রমাগত লাফাচ্ছে তার বুকটা।
বুকে মুখ গুঁজে কমলা কাতর চোখে তাকাল, এ ভাবে আর পারা যাচ্ছে না, চলো কোথাও পালিয়ে যাই।
রঘুনাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, কুথায় যাবো বলদিনি?
-যেদিকে দু-চোখ যায়। কমলা সাহসী হয়ে উঠল।
-তুমার বাপ আমাকে বাণ চালিয়ে মেরে ফেলবে। তার মন্ত্রের বহু জোর। গাঁয়ের অনেক মানুষ তুমার বাপকে ভয় পায়। গলা কেঁপে গেল রঘুনাথের।
-তোমার ভেতর থেকে ভয় আর কোনোদিন গেল না। কমলা আশ্চর্য চোখে তাকাল, সেই প্রথম দিনের কথা তোমার মনে আছে। সেদিনও কাঁটা বের করতে গিয়ে তুমি ভয়ে কাঁপছিলে। তোমার এত ভয় কেন বলো তো?
রঘুনাথ কি জবাব দেবে খুঁজে পেল না। সে কমলার জ্যোৎস্নানরম মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল সে আকাশের চাঁদকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে উঠছে তার শরীর।
সাঁঝবেলায় হাট থেকে ফেরার সময় কাঁটা ঢুকে গিয়েছিল কমলার পায়ে। হাঁটতে হাঁটতে ঝপ করে সে বসে পড়েছিল ধুলোয়। তার অস্ফুট আওয়াজে রঘুনাথ এগিয়ে গিয়েছিল সামনে, কী হয়েছে গো?
সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে কমলা বলেছিল, পায়ে কাঁটা ঢুকে গিয়েছে। কাঁটাটা ভেঙে গিয়েছে। আর বেরুচ্ছে না। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।
-আমি কাঁটা বের করতে পারি। কথাগুলো বলে বোকার মতো তাকিয়ে ছিল রঘুনাথ, যদি বলো তো চেষ্টা করে দেখতে পারি।
সংশয়াচ্ছন্ন চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল কমলা, দেরি করো না। খুব ব্যথা হচ্ছে। যা করার তাড়াতাড়ি করো। আমাকে আবার অতটা পথ যেতে হবে।
রঘুনাথ অনুমতি পেয়ে বাজারের থলিটা নামিয়ে রেখেছিল রাস্তার একপাশে।
তারপর হন্তদন্ত হয়ে ভেঙে এনেছিল খেজুরগাছের কাঁটা। মুখের থুতু দিয়ে সে কমলার পায়ের তালু পরিষ্কার করে কাঁটা দিয়ে বের করে দিল কাঁটা। বেশ বড় ধরনের বাবলাকাঁটা। ভাঙা কাঁটাটা কমলার হাতে তুলে দিয়ে বলল, নড়ো না। আর এট্টু বসো। আমি হাড়মটমটির রস হাতে পিষে লাগিয়ে দিচ্ছি। অক্ত আর বেরবে না, বিদনাও কমে যাবে।
কমলা অবাক হয়ে সেদিন রঘুনাথকে দেখেছিল। খুব বেশি বয়সের ফারাক হবে না ওদের। বলা যেতে পারে প্রায়ই সমবয়েসী। এই বয়সের ছেলেরা মেয়েদের ছুঁতে ভয় পায়। কমলা সেদিনই টের পেয়েছিল রঘুনাথের শরীরের কাঁপুনি। সেই কাঁপুনিটা রঘুনাথ এখনও বুকের ভেতর বয়ে বেড়ায়। অথচ কমলা সেই কাঁপুনিটাকে থামিয়ে দিতে উদগ্রীব। রঘুনাথের হাতটা বুকে চেপে সে বলে, দেখো, আমি কেমন ঘামছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো তো। আমার ঘামগুলো তুমি শুষে নাও। এই গরম আমি আর সহ্য করতে পারছি নে…। ণ
রঘুনাথের বুকের উপর ভেঙে পড়ল কমলা, কাজলাদিঘির জলের মতো ছড়িয়ে গেল তার কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো মাথার চুল। কমলা উশখুশিয়ে উঠল। ওর সারা শরীর জুড়ে ঢেউ উঠছে, হঠাৎ আসা বন্যায় সে বুঝি ভেসে যাবে, হারিয়ে যাবে। তার ডাকে সাড়া দিতে পারে না রঘুনাথ, একটা অলঙ্ঘনীয় ভয় তার রক্তে পানকৌড়ি পাখির মতো ডুবসাঁতার কাটে, হারিয়ে যায় আবার ভেসে ওঠে, সাঁতরে অবলীলায় চলে যায় শরীরের একপাড় থেকে অন্যপাড়ে। কমলা ফুঁপিয়ে ওঠার আগে হকচকিয়ে তাকাল, কী হলো, ঠাকুর দেখার মতো কি দেখছো আমাকে! তোমার কি কোনো কথা নেই, ভাষা নেই।
রঘুনাথ গাছের মতো স্তব্ধ চোখে তাকাল, ইবার আমাকে ফিরতে হবেখন। রাত ফুরিয়ে আসছে। মনে হয় পোকরাতারা ফুটে উঠেচে আকাশে।
কমলা বিরক্তিতে ভ্রূ-কুঁচকে বলল, এত কষ্ট করে তোমার আসার কি দরকার ছিল বুঝি না। ঝুঁকি যখন নিয়েছে তখন আর একটু ঝুঁকি নিলেই পারতে।
রঘুনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি চাইনে আমার ভুলের জন্য তুমি জীবনভর কাঁদো। তুমাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই।
এবার ফুঁসে উঠল কমলা, ঢং করো না। তোমার কি আছে–তুমি কি তা জানো? কোনো মানুষই জানে না তার আসল শক্তির কথা।
রঘুনাথ ঘাড় নাড়ল, আমি জানি-তুমার ভেতরে কী শক্তি আছে। মেয়েমানুষের ভেতরে নদী থাকে, বন থাকে। তারা মাঠের ঘাস। রাগ নেই, দুঃখ নেই।
একথা শুনে কমলার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল। ছাড়া চুল খোঁপা করে নিয়ে সে সবিস্ময়ে নিজের দিকে তাকাল, আমার অনেক ভাগ্য যে তোমার মতো ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সবাই যেরকম হয়–তুমি সেরকম নও। তুমি আলাদা।
রঘুনাথ প্রতিক্রিয়াহীন। সে শুধু মুচকি হেসে বলল, আমার মা বলে সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। নাহলে সম্পর্ক পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছাড়ে। তুমার আমার মেলামেশাটা পচা সুতোর বাঁধন নয় যে হুট করে তা ছিঁড়ে যাবে।
তোমার কি আমার কাছে কিছু চাওয়ার নেই? কমলার সকৌতুক প্রশ্ন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে রঘুনাথ বলল, চাওয়ার কি আছে? না চাইতে তুমি আমাকে সব দিয়েছো। আমার এখন শুধু একটাই চাওয়া। সারাজীবন আমি যেন তুমার মুখের হাসিটুকু দেখতে পাই।
কমলা ফোটা পদ্মের মতো অপেক্ষায় ছিল ভ্রমরের গুঞ্জন শোনার জন্য। রঘুনাথ সমর্পণের গলায় বলল, ডুবে যাওয়া সহজ কিন্তু ভেসে থাকা কঠিন। আমি সদা সর্বদা তুমার মনে ভেসে থাকতে চাই।
রঘুনাথ জানে কমলার সঙ্গে তার এই সম্পর্ক এ সমাজ কোনোদিনও মেনে নেবে না। এই সম্পর্ক পরিণতির দিকে এগোলে ঝড় উঠবে। এলোমেলো হয়ে যাবে তাদের সংসার। মাটি হারা হয়ে বাঁচতে হবে তাদের। পালিয়ে বাঁচার মধ্যে সুখ কোথায়? তাছাড়া কমলার যদি মোহভঙ্গ হয় তখন? কাঁচা বয়সের ভালোবাসার রঙ পাকা হলেও সেই রঙের স্থায়ীত্ব কলার কষের মতো গাঢ় বা দীর্ঘস্থায়ী নয়। রঘুনাথের বুকের ভেতর তাই ভয়ের উইটিপিটা একটু একটু করে বাড়ছে।
বারোয়ারিতলার রামযাত্রার আসরে কমলাকে পাপড় কিনে দিয়েছিল রঘুনাথ। কাশীনাথ এটাকে ভালো নজরে দেখেনি। রঘুনাথকে বাঁধের ধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধমকেছে, বামুন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে যাস নে। হাত ভেঙে দেব।
-কী যা তা বলচো! রঘুনাথের গলায় ফ্যাসফেসে শব্দ উঠল।
–যা তা নয়, ঠিক বলছি। বাবার কানে কথাটা তুলে দিলে তুই কি ধাওড়াপাড়ায় টিকতে পারবি? কাশীনাথের তিক্তস্বরে বিষ ঝরে পড়ল। এখনও সময় আছে, সাবধান হয়ে যা। বেশি বাড়লে ব্যাঙের ছাতার মতো ফুটুরডুম হয়ে যাবি।
সেদিন কাশীনাথের চোখে জ্বলন্ত আঁচ দেখেছিল রঘুনাথ। সামান্য হলেও ভয় পেয়েছিল সে। সে জানে কাশীনাথের একটা দল আছে গ্রামের মধ্যে। সে দলের সব সদস্যই তার বয়সী। ওদের মাথা গরম, টেম্পার বেশি। ছোট-বড় জ্ঞান ওদের খুব কম। রঘুনাথ ইচ্ছে করেই আর কথা বাড়ায়নি। সে জানত এখানে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হবে না। সমাজের স্তরগুলো একদিনে ভাঙবে না। ওগুলো ভাঙার জন্য কপোতাক্ষর মতো বেশ কিছু মানুষের দরকার। সূর্যাক্ষর মতো উদার মন না হলে বুড়িগাঙের জলও একদিন সমাজ-সংস্কারের ধুয়োয় কালো হয়ে যাবে।
রামযাত্রার শেষে কমলা রঘুনাথকে খুঁজছিল। কাশীনাথ তার চঞ্চল চোখের তারাকে এক জায়গায় থামিয়ে দিল কথার বাণে, তুই যাকে খুঁজছিস তাকে আমি লাথি মেরে ভাগিয়ে দিয়েছি। ছিঃ কমলা, তোর এতটা নীচে নামা উচিত হয়নি। মনে রাখিস–তুই সুফল ওঝার মেয়ে। তোর বাবার সুনাম দশ গাঁয়ে। তুই যদি ঝোঁকের মাথায় কিছু করে বসিস তাহলে আমাদের আর মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না।
–তুই অকারণে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে ভাবছিস দাদা। কমলার টলটলে চোখে পাপের কোনো স্পর্শ ছিল না, রঘু আমাদের গাঁয়ের ছেলে। ও আমাকে একটা পাঁপড় কিনে দিয়েছে-এতে দোষ কোথায়? ওর সরলতাকে কু-নজরে দেখা উচিত নয়।
-তুই বড়ো হয়েছিস–একথাটা মাথায় রাখিস। কাশীনাথ ভেঙে পড়ল না, রুখে দাঁড়াল, লোক যাতে আঙুল তুলে কিছু না বলতে পারে সেইজন্য তোকে আগে-ভাগে নিষেধ করলাম। মানুষ যখন ভুল করে, সেই ভুলটা সে নিজে ধরতে পারে না। অন্যকে ধরিয়ে দিতে হয়।
-রঘুনাথের উপর তোর কি আগে থেকে কোনো রাগ ছিল?
কাশীনাথ শরীর ঝাঁকিয়ে কুলকুল করে হেসে উঠল, রাগ? ওর উপর রাগ করার আমার সময় কোথায়? ওর সাথে তুই আমাকে গুলিয়ে ফেলেছিস কেন? ও কোথায়, আর আমি কোথায়!
ঠোঁট কামড়ে অবজ্ঞার হাসি হেসে উঠল কমলা, কে যে কোথায় তা যদি সে নিজে বুঝতে পারত তাহলে তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
-একটা বুনোপাড়ার ছেলের জন্য ওকালতি করে তুই আমাকে ছোট করছিস?
ছোট তুই অনেক আগেই হয়ে গেছিস। রঘুনাথকে শাসিয়েছিস-সেটা খুব বড়ো মাপের বাহাদুরির কাজ নয়। কমলার স্ফুরিত ঠোঁট ঘৃণায় বেঁকেচুরে গেল। কাশীনাথ সেই রক্তবর্ণ চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। কমলা এত শক্তি পেল কোথা থেকে? সে শুনেছে প্রেমে পড়লে মানুষ বড়ো একরোখা হয়ে যায়। তখন বর্ষার নদীকে তার মনে হয় মামুলি ডোবা। জলোচ্ছ্বাসকে মনে হয় জলের ছিটে। তাহলে কি কমলা ইতিমধ্যে মন দিয়ে ফেলেছে বুনোপাড়ার রঘুনাথকে। ব্যাপারটা বেশ জটিল এবং উদ্বেগপূর্ণ। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। কমলার ঘোরাফেরা, হাবভাব মেলামেশার উপর নজর রাখা দরকার। সুফল ওঝা ঘরে থাকে না। প্রায়ই এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে দৌড়াতে হয় তাকে। তার অবর্তমানে ছেলে হিসাবে কাশীনাথের দায়িত্ব কম নেই। দায়িত্ব এড়িয়ে থাকা যে ভীষণ কঠিন।