০২. বিজ্ঞান ভবন থেকে বেরিয়ে

বিজ্ঞান ভবন থেকে বেরিয়ে জনপথ ধরে দক্ষিণের দিকে একটু এগুলেই এক নম্বর ইয়র্ক প্লেস। নতুন নাম মতিলাল নেহরু প্লেস। ওদিকে গেলেই আধুনিক ভারতবর্ষের ফতেপুর সিক্রীর সামনে না দাঁড়িয়ে পারি না।

কোথাও কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই, নেই বিশেষ কোন মানুষের আনাগোনা। ইয়র্ক প্লেসকে ঘুরে জনপথের উপর দিয়ে দিনরাত কত গাড়ি-ঘোড়া মানুষজনের ছোটাছুটি, কিন্তু না, তারাও কেউ মুহূর্তের জন্য এই ফতেপুর সিক্রীর সামনে দাঁড়ান না। সবাই ব্যস্ত? কারুরই সময় নেই? নাকি প্রয়োজন নেই?

একদিন এই এক নম্বর ইয়র্ক প্লেসই ফতেপুর সিক্রীর মত ভারত ভাগ্য-বিধাতার আস্তানা ছিল। তখন কত সান্ত্রী চারপাশে ঘোরাঘুরি করত, ত্বরিত পদক্ষেপে আসা-যাওয়া করতেন আসমুদ্রহিমাচলের রথী মহারথীরা। সরকারী আমলাদের কাছে তখন এ বাড়ি মক্কা-মদিনা, ক্ষমতালোভী স্বার্থপর রাজনীতিবিদদের কাছে এই ফতেপুর সিক্রীই ছিল কৈলাস-মানস সরোবর।

আজ? ফতেপুর সিক্রীর মত এক নম্বর ইয়র্ক প্লেসও অতীত ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়। আর লালবাহাদুর শাস্ত্রী? কাব্যে উপেক্ষিতা ঊর্মিলার মত আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বজন উপেক্ষিত মহানায়ক।

অতীতের এক নম্বর ইয়র্ক প্লেস ও আজকের এক নম্বর মতিলাল নেহরু প্লেসে পা দিতেই কত কথা মনে পড়ছে। প্রথম দিনের আলাপেই চমকে গিয়েছিলাম।

.

দু-এক মাস আগেই দিল্লী এসেছি। দু-চারদিন পর পরই নেহরু সন্দর্শনে তিনমুর্তি ভবনে যাই। মাঝে মাঝে শাস্ত্রীজিকে দেখি কিন্তু কথা হয় না। তারপর হঠাৎ একদিন আমাকে দেখিয়ে উনি নেহরুকে বললেন, পণ্ডিতজী, এই ছেলেটার বিরুদ্ধে আমার একটা নালিশ আছে।

আমি চমকে উঠলাম।

শাস্ত্রীজি হাসতে হাসতে বললেন, হি কামস টু ইউ এভরি নাউ এ্যাণ্ড দেন কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করে না।

পণ্ডিতজী সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নটি বয়! তুমি রোজ লালবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করবে।

সত্যি এরপর থেকে বোজ শাস্ত্রীজির বাড়ি যেতাম। দিল্লীতে আছি অথচ ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, এমন দিনের কথা মনে পড়ে না। না গিয়ে পারতাম না। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর এই মানুষটি আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করতেন।

একবার আমি পণ্ডিতজীর তিনমূর্তির বাড়িতে কলকাতার এক যশস্বী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করলাম। পণ্ডিতজীর ব্যক্তিগত ড্রইংরুমে অনুষ্ঠিত এই ঘরোয়া আসরে আমন্ত্রিত ছিলেন গোবিন্দবল্লভ পন্থ, শাস্ত্রীজি, শ্ৰীমতী উমা নেহরু, লেডী রামা রাও, এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জী, শ্রীমতী সারদা মুখার্জী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তায়েবজী ও আরো কজন ছাড়া নেহরু পরিবারের কয়েকজন। আমি পণ্ডিতজী আর শাস্ত্রীজিকে গানের মোটামুটি অর্থ ইংরেজিতে বলে দিচ্ছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষে শাস্ত্রীজি আমাকে বললেন, আমি রবিবাবুর সব বই পড়েছি। গীতাঞ্জলি, চোখের বালি, গোরা আর রাশিয়ার চিঠি যে কতবার পড়েছি তার ঠিক ঠিকানা নেই, কিন্তু লজ্জার কথা, রবিবাবুর গান বিশেষ শুনিনি। তাই বলছিলাম, যদি একদিন আমার বাড়িতে গানের আয়োজন কর তাহলে খুব খুশি হতাম।

পরের দিনই শিল্পীর কলকাতায় ফেরার কথা। রেলের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল। শাস্ত্রীজি ওকে বললেন, আমি আবার রিজার্ভেশন করে দেব। কলকাতায় খবরও দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একদিন থেকে গেলে বাড়ির সবাইকে রবিবাবুর গান শোনাতে পারি।

এমন আন্তরিক খোলাখুলি কথা শুধু উনিই বলতে পারতেন।

.

পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ মারা যাবার পর শাস্ত্রীজি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। তখনকার দিনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বের সীমা ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা, আই-সি-এস আই-এ-এস / আই-পি-এস প্রভৃতি সমস্ত সর্ব ভারতীয় সার্ভিসেস, সমগ্র গোয়ন্দা বিভাগ, বিশেষ পুলিশ সংস্থা, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয়, হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও তাদের চাকরি-বাকরি সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়, সিবিআই, ভূতপূর্ব দেশীয় রাজ্যের রাজাদের রাজন্য ভাতা ও তাদের উত্তরাধিকারী, কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল, রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেওয়া, কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত কর্মচারীদের চাকরি-বাকরি সংক্রান্ত বিষয়, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা এবং আরো অনেক কিছু বিষয় ও বিভাগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে ছিল। এই গুরুদায়িত্ব বহন করতে শাস্ত্রীজিকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হত। সকালে সাড়ে আটটা-নটার আগে কাজ শুরু না করলেও প্রতি দিন রাত্রে দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত কাজ করতেন।

শাস্ত্রীজি সাধারণত রাত নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত অফিসে কাজ করতেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ ওঁকে বাড়ি ফিরে যেতে দেখেই একটু খটকা লাগল। মনে হল, বোধ হয় পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান আছে; কিন্তু না, পারিবারিক কারণে উনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেননি। পারিবারিক ভৃত্য-পুত্রের নিউমোনিয়া হয়েছে শুনেই উনি বাড়ি ফিরেছেন। সেদিন আর কোন কাজ নয়। ভৃত্য-পুত্রের চিকিৎসার বিধিব্যবস্থা ও সেবাযত্নের তদারকী করেই সারা রাত কাটিয়ে দিলেন।

.

উপরাষ্ট্রপতি ডক্টর জাকির হোসেন অসুস্থ হয়ে অল ইণ্ডিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীজি তাঁকে দেখতে গেলেন। সঙ্গে আমিও আছি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে সফদারজং রেলওয়ে লেভেল ক্রশিং বন্ধ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি থমকে দাঁড়াল। একটু দূরে একটা লোক আখের রস বিক্রী করছিল। ওকে দেখতে পেয়েই শাস্ত্রীজি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, পয়সা আছে?

প্রশ্ন শুনে একটু বিস্মিত হলেও বললাম, আছে।

এবার একটু হেসে বললেন, হাজার হোক উত্তর প্রদেশের মানুষ। আখের রস খেতে ইচ্ছা করছে। খাওয়াবে?

কিন্তু আপনি কী এই আখের রস খাবেন?

চিরকালই তো এই রকম রাস্তার ধারের দোকান থেকে আখের রস খেয়েছি। এখন খাব না কেন?

রাস্তার ধারের একজন অতি সাধারণ দেহাতী লোকের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রী আখের রস খাবেন শুনেই সঙ্গী নিরাপত্তা কর্মীরা চমকে উঠলেন। প্রধানমন্ত্রী হেসে বললেন, ভয় নেই। এর হাতের আখের রস খেয়ে আমি মরব না।

আজ এক নম্বর ইয়র্ক প্লেসের কথা বলতে গিয়ে আরো কত কথা মনে পড়ছে। শাস্ত্রীজির বড় ছেলে হরি এক বিখ্যাত বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর শিক্ষানবীশ থাকার পর ওদেরই ভারতীয় সংস্থায় চাকরি পেল। বাড়ি, গাড়ি ও হাজার টাকার ওপর মাইনে। হরি ভেবেছিল, বাবা খুব খুশি হবেন কিন্তু নিয়োগপত্র দেখে উনি কিছুই বললেন না। পরের দিনই শাস্ত্রীজি ঐ সংস্থার সর্বময় কর্তাকে লিখলেন, ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন জেনে খুশি হলাম কিন্তু বাড়ি-গাড়ি ছাড়াও অত টাকা মাইনে পাবার মত যোগ্যতা তো আমার ছেলের নেই। সুতরাং অন্য পাঁচজনের মত যদি ওকে সাধারণ মাইনে দেন, তাহলে সে চাকরি করবে, অন্যথায় নয়।

এ ধরনের চিঠি কী আর কারুর কাছে আশা করা যায়?

যাই হোক, এই চাকরির সূত্রে হরিকে প্রায়ই ভূপাল যেতে হত। শাস্ত্রীজি খবর পেলেন, রেল স্টেশনে ওঁর ছেলেকে অভ্যর্থনা করার জন্য কখনও মুখ্যমন্ত্রী, কখনও বা অন্য মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকেন। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই শাস্ত্রীজি মুখ্যমন্ত্রী শঙ্করদয়াল শর্মাকে ফোন করে বললেন, আমি প্রধানমন্ত্রী, আমার ছেলে প্রধানমন্ত্রী না। সুতরাং আমার ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কোন মন্ত্রীই যেন স্টেশনে না যান।

একবার শাস্ত্রীজি তাঁর এক অতি বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন ব্যক্তিগত কর্মচারীকে হঠাৎ নিজের দপ্তর থেকে সরিয়ে দেন। কেন? উনি জনৈক ব্যবসায়ীকে একটু সাহায্য করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক জয়েন্ট সেক্রেটরিকে টেলিফোন করেছিলেন। এই ভদ্রলোককে আর কোন দিন শাস্ত্রীজি বাড়িতে ঢুকতে দেননি।

আরো মজার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী একদিনের কলকাতা সফরে যাচ্ছেন। প্রথম বার কলকাতা দেখার জন্য ওঁর পরিবারের কয়েকজন সঙ্গে আছেন। এ ছাড়া তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী ও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্ৰী টি. এন. সিং, রেলমন্ত্রী শ্রী দাসাঞ্জা, আইনমন্ত্রী শ্রী অশোক সেন ছাড়াও জেসপ কোম্পানির চেয়ারম্যান শ্ৰী অশোক চন্দ ও আমিও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কলকাতা যাচ্ছি। কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কাৰ্যসূচী জেসপ কোম্পানির ১৫০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎসবে যোগদান। উৎসবটি এমন সময় হচ্ছিল যখন ভারতবর্ষের এক বিখ্যাত শিল্পপতি আস্তে আস্তে জেসপ কোম্পানির শেয়ার কিনে নিজের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছিলেন। অন্য দিকে সরকার ভাবছিলেন, যে কোম্পানিকে বহু সরকারী সাহায্য দেওয়া হয়েছে এবং যার প্রায় সমগ্র উৎপাদনই সরকার কিনে নেন, সে কোম্পানির মালিকানা পরিচালনা সরকারের হাতে আসাই ঠিক হবে কিনা। কংগ্রেস সিণ্ডিকেটের কিছু নেতা ঐ শিল্পপতিকে বুঝিয়েছিলেন, আমরাই শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী করেছি। সুতরাং আমরা বললে উনি নিশ্চয়ই জেসপ কোম্পানির সরকারী পরিচালনায় আনতে পারবেন না। পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত কংগ্রেস নেতাও ঐ শিল্পপতিকে খুব সাহায্য করছিলেন।

দিল্লীর পালাম বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমান টেক-অফ করার পাঁচ-দশ মিনিট পরেই শাস্ত্রীজি শ্ৰীচন্দকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠালেন। দশ-পনেরো মিনিট পর শ্রীচন্দ আমাদের কেবিনে ফিরে আসতেই প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি, ওঁর হাতে জেসপ কোম্পানির ১৫০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিক অনুষ্ঠানের নানা কাগজপত্র। মঞ্চে কে কোথায় বসবেন তার প্ল্যান আমাকে দেখিয়ে বললেন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট দিস জেন্টলম্যান (ঐ শিল্পপতি) টু বী সীটেড অন দ্য ডায়াস। ক্যান ইউ হেলপ মী?

আমি বললাম, নিশ্চয়ই পারব।

তাহলে যা হয় একটা ব্যবস্থা কর।

আমি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বসেই একটা সাদা কাগজ লিখলাম আর্জেন্ট মেসেজ ফর মিস্টার পি. কে. বাসু ডি আই জি / আই বি মিস্টার…সুড নট বি সিটেড অন দ্য ডায়াস। প্লিজ কনফার্ম। কাইণ্ডলি রিপ্লাই উইদিন্ ফিফটিন মিনিটস। ককপিটে গিয়ে মেসেজটি কমাণ্ডার অব দ্য এয়ারক্রাফটকে দিয়ে বললাম, এক্ষুণি এই মেসেজটি দমদম কন্টোলে পাঠান এবং উত্তর এলেই আমাকে জানাবেন।

পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই প্রসাদবাবু আমাকে জবাব দিলেন ব্যবস্থা করছি।

তারপর? না, ঐ শিল্পপতি অনেক তর্ক বিতর্ক করেও মঞ্চে বসার সুযোগ পাননি। সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা তাকে দর্শকদের একটি আসনেই বসিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই শিল্পপতির হাতে জেসপ কোম্পানিকে তুলে দেননি শাস্ত্রীজি। মজার কথা, এই মানুষটি সম্পর্কে একদল রাজনীতিবিদ প্রচার করতেন, আমাদের পরামর্শ ছাড়া ওঁর পক্ষে কোন কিছু করা অসম্ভব নয়।

কার্টুনিস্ট শংকর, কুট্টি, আর. কে. লক্ষ্মণ বা আমাদের চণ্ডী লাহিড়ী কংগ্রেস নেতাদের যে ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন, তা পুরোপুরি ঠিক না হলেও অনেকাংশে ঠিক। কংগ্রেসী নেতাদের মোটামুটি ঐ রূপ। মুখে কোন দুশ্চিন্তার ছাপ নেই, চেহারা দেখে মনে হয় না তিন পুরুষের মধ্যে কেউ কোন দিন কায়িক পরিশ্রম করেছেন। এরা চাকরি করেন না, ব্যবসা করেন না, কিন্তু তবু এদের সংসারে প্রাচুর্যের বন্যা। রেলগাড়ি চড়লে এদের কৌলীন্য যায়। মোটরগাড়ি ছেড়ে এক কিলোমিটার রাস্তা হাঁটলেই তা পদযাত্রার গৌরব লাভ করে খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়। আরো কত কি। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে এবং নিঃসন্দেহে লালবাহাদুর শাস্ত্রী তার সব চাইতে বড় নিদর্শন।

রাজনৈতিক দিক থেকে শাস্ত্রীজি নেহরুর একান্ত অনুরক্ত ছিলেন, এ কথা সর্বজনবিদিত, কিন্তু এ কথা বোধ হয় অনেকেই জানেন না, ইনি নেহরুজীর তিনমূর্তি ভবনের বিলাসবহুল বিধিব্যবস্থা মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনমূর্তি ভবনের সংসার চালাত সরকারী অতিথি সেবা বিভাগ ( গভর্ণমেন্ট হসপিটালিটি অরগানাইজেসান) এবং যত দূর মনে পড়ছে নেহরু তার ব্যক্তিগত খরচের জন্য দৈনিক মাত্র সাড়ে সাত টাকা সরকারী অতিথি সেবা বিভাগকে দিতেন। গৌরী সেনের টাকায় সংসার চলত বলে তিনমূর্তি ভবনে প্রাচুর্যের বন্যা বইত। বেয়ারা, চাপরাশী, কেরানী, স্টেনোগ্রাফার, নিরাপত্তা : কর্মী, প্রাইভেট সেক্রেটারি, অতিথি-অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়নের জন্য ঢালাও ব্যবস্থা ছিল। এর জন্য কত টাকা ব্যয় হত তা জানার উপায় নেই, কারণ সরকারী অতিথি সেবা বিভাগ রাষ্ট্রপতি ভবনের অধীনে ছিল এবং রাষ্ট্রপতির বাজেটের মধ্যেই এ সব খরচ ধরা হত। শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, মোটরগাড়িরও ঢালাও ব্যবস্থা ছিল; কারণ পণ্ডিতজীর নিজস্ব গাড়ি ছাড়া অন্য সব গাড়ি আসত রাষ্ট্রপতি ভবনের গ্যারেজ থেকে।

লালবাহাদুর কোন দিন মুখে কিছু বলেননি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি বুঝিয়ে দিলেন, না, গৌরী সেনের টাকায় সংসার চালাতে তিনি আগ্রহী নন। অতিথি সেবা বিভাগকে বলা হল, যাও, রাষ্ট্রপতি ভবনে ফিরে যাও। রাষ্ট্রপতি ভবনের গাড়িও চাই না, ও সব ব্যবহার হবে রাষ্ট্রপতি ও সরকারী অতিথিদের জন্য। বিশিষ্ট অতিথি আপ্যায়ন? নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু বাড়িতে কেন? তার জন্য তো রাষ্ট্রপতি ভবন, হায়দ্রাবাদ হাউস ও সরকারী ভাল ভাল হোটেল আছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যারা আসবেন, তাঁদের জন্য? টি বোর্ডকে বলে দাও, ওরা চা খাওয়াবে। বাড়ি-ঘরদোর সাজানো গোছানা? না, লাখ লাখ টাকার ফার্ণিচার আর কার্পেট দিয়ে বাড়ি সাজাতে হবে না। যা আছে, তাতেই চলবে। অফিসে? হ্যাঁ, ওখানে দুটো-একটা ঘর সুসজ্জিত থাকুক, কিন্তু আহা মরি করার কোন প্রয়োজন নেই। ঘরে ঘরে এয়ার কণ্ডিশনার? নো, নেভার। দরজায় মোটা সিল্কের পর্দা? লাখ টাকা খরচ করে পর্দা তৈরি করতে হবে না। অল্প খরচেও ভাল পর্দা হয়।

দেশী-বিদেশী রাজা-মহারাজা আর বিলেত ফেরত সাহেবসুবাদের ভজনা করতে করতে আমরা সৎ, ভদ্র ও আদর্শবাদী ভারতীয়দের শ্রদ্ধা করতে ভুলে গেছি। তাই তো এক দল লোক শাস্ত্রীজিকে নিয়ে জঘন্য বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি এবং এরা প্রচার করেন যে শাস্ত্রীজি কায়রোয় গিয়ে হোটলে নিজের শোবার ঘরে রান্নাবান্না করার জন্য লাখ টাকা খেসারত দিতে হয়। নেহরুর একটা মন্তব্যের জন্য অতীতের ভারত-ভক্ত নেপাল ভারত বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। শাখা সিঁদুর আর মাথায় ঘোমটা পরা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সহজ সরল অমায়িক ব্যবহার করেই শাস্ত্রীজি নেপালের পররাষ্ট্র নীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দেন। এই ছোট্টখাট্ট মানুষটিই আমেরিকা যাত্রার কদিন আগে প্রেসিডেন্ট জনসনের একটা মন্তব্যের প্রতিবাদে আমেরিকা সফর বাতিল করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর না করেই পাকিস্তানকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করার অনুমতি দেন।

আজকের আসাম আন্দোলনের পটভুমিকায় একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সে সময় মাঝে মাঝেই অভিযোগ শোনা যেত, আসামের কয়েকজন বিশিষ্ট ক্ষমতাশালী কংগ্রেস নেতার পৃষ্টপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু লোকজন বে-আইনী ভাবে আসামে অনুপ্রবেশ করছে। এ নিয়ে পার্লামেন্টে ও আসাম-পশ্চিম বাংলার বিধানসভায় তর্ক-বিতর্কও হত। কাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অনুপ্রবেশ হত, তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও সবাই জানতেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আসামের কিছু চা বাগানের মধ্যে দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে বেশ কিছু মানুষ বে-আইনী ভাবে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসামে চলে আসতেন।

একদিন পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে আসামের কয়েকজন এম. পির কাছে শুনলাম, সীমান্তবর্তী একটা বিরাট চা বাগান সাহেবরা এক মাড়োয়ারী কোম্পানির কাছে বিক্রী করছে এবং পরদিনই গৌহাটিতে এই লেনদেন চূড়ান্ত হবে। ওরা আশঙ্কা করছিলেন, ঐ চা বাগানটি মাড়োয়ারীদের হাতে গেলে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের চাপে এই বাগান দিয়ে বে-আইনী অনুপ্রবেশ আরো বেড়ে যাবে। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্ত্রীজির কাছে খবরটা পৌঁছে গেল অপরাহ্নের দিকে। বিকেলের দিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের সর্বাধিনায়ক ভোলানাথ মল্লিকের তলব পড়ল।

দিন দুই পরে ঐ সেন্ট্রাল হলের আড্ডাখানাতেই শুনলাম, সেদিন যে প্লেনে সাহেব ও মাড়োয়ারী কর্তাদের কলকাতা থেকে গৌহাটি যাবার কথা ছিল, সে প্লেনে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। ওরা বহুক্ষণ দমদম এয়ারপোর্টে বসে থাকার পর যখন দেখলেন গৌহাটির কোর্ট-কাছারি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদি বন্ধ হবার সময় হয়ে আসছে এবং সেদিন ঐ লেনদেন পাকাপাকি করায় সময় নেই, তখন ওরা ফিরে গেলেন। ওরা দমদম ছেড়ে চলে যাবার পর পরই প্লেনের যান্ত্রিক গোলযোগও ঠিক হয়ে গেল। আর ওরা যখন দমদমে বসে আছেন তখন কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুমে একদল সরকারী অফিসার ঐ চা বাগানের কিছু আইন বহির্ভূত কাজকর্মের জন্য ওর পরিচালনার দায়িত্ব সামরিক ভাবে নিয়ে নিলেন। কাকপক্ষী জানল না কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সফল হল। এই হল লালবাহাদুর শাস্ত্রী!

কেন কাশ্মীরে কী করলেন? হজরতবল মসজিদ থেকে হজরতের পবিত্র কেশ চুরি হওয়ায় চারদিকে দারুণ হৈ-চৈ শুরু হল। গোয়েন্দাদের তৎপরতায় কেশ উদ্ধার হল কিন্তু কাশ্মীরের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতারাই বললেন, না, ও কেশ, সে কেশ নয়। কাশ্মীরে তখন এমন উত্তপ্ত আবহাওয়া যে, যে কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে লালবাহাদুর চলে গেলেন কাশ্মীর। একই সময়ে সব ধর্মীয় নেতাদের ডাকলেন সরকারী অতিথিশালায় কিন্তু প্রত্যেককে আলাদা আলাদা গাড়িতে আনা হল এবং আলাদা আলাদা ঘরে বসানো হল। অর্থাৎ সবাই ভাবলেন, শান্ধীজি শুধু তাঁর সঙ্গেই আলোচনা করতে চান এবং এ খবর আর কেউ জানেন না। এবার শাস্ত্রীজি নিজে প্রথম ঘরে গিয়ে একজন নেতার সঙ্গে আলাদা ভাবে আলোচনা করলেন এবং তিনি স্বীকার করলেন, এটাই পয়গম্বরের কেশ, কিন্তু অন্যেরা স্বীকার করছে না। শাস্ত্রীজি ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দ্বিতীয় ঘরে এসে দ্বিতীয় নেতার সঙ্গে কথা বললেন। উনি বললেন, আমি তো জানি এটা পয়গম্বরের কেশ কিন্তু অন্যেরা স্বীকার করছে না। এভাবে শাস্ত্রীজি প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে একই কথা শুনলেন। এবার সবাইকে বাইরে ডাকা হল। নেতারা একে অন্যকে দেখে অবাক! মাইক্রোফোন প্রস্তুত। দল পাকিয়ে গণ্ডগোল করার কোন অবকাশ নেই। শাস্ত্রীজির আমন্ত্রণে একে একে প্রত্যেক নেতা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, হ্যাঁ, এই সেই পয়গম্বরের পবিত্র কেশ। ধর্মীয় নেতাদের এই ভাষণ রেকর্ড করে সঙ্গে সঙ্গে প্রচারিত হল কাশ্মীর রেডিওতে।

যে সমস্যা নিয়ে সারা কাশ্মীর উপত্যকায় প্রায় আগুন জ্বলে উঠেছিল, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে সমস্যার সমাধান করে লালবাহাদুর ফিরে এলেন দিল্লী।

. গ্রামের ছেলে লালবাহাদুর। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ বা ইটন-হ্যারোতে নয়, গ্রামের পাঠশালা আর কাশী বিদ্যাপীঠে লেখাপড়া করেছেন। পরতেন সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি, কিন্তু তাই বলে সৌজন্যবোধের অভাব ছিল না শাস্ত্রীজির।

লণ্ডনে কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভারে গেছি। মার্লবোরা হাউসে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস রিসেপসন। এই রিসেপসনেই দেশনায়কদের সঙ্গে সাংবাদিকদের মেলামেশা গল্পগুজব। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রত্যেক সাংবাদিককে ড্রিঙ্ক তুলে দেন প্রবেশ পথের মুখে। আমি ঢুকতে গিয়েই দেখি, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছে দাঁড়িয়ে শাস্ত্রীজি ঘানার নক্রুমার সঙ্গে কথা বলছেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ড্রিঙ্ক কিন্তু সামনে শাস্ত্রীজিকে দেখে আমি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছি। শাস্ত্রীজি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে চোখের ইসারায় আমাকে ইঙ্গিত করলেন, নিয়ে নাও। আমি হাসতে হাসতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ড্রিঙ্ক গ্রহণ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আয়ুবের কাছে এগিয়ে গেলাম।

শাস্ত্রীজির কথা লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে। ভাবপ্রবণ জহরলাল কখনও কখনও এমন এক একটি মন্তব্য করতেন যে তার ফলে অনেক সময় বহু সমস্যা জটিলতর হয়ে উঠত। যেমন ভারত নেপাল সম্পর্ক।

ভারত নেপালের সম্পর্ক নানা কারণে খুবই নিবিড়। তাইতো রাণাদের আধিপত্য শেষ করার জন্য ভারত নেপালের পাশে এসে দাঁড়ায়। মুখ্যত জয়প্রকাশ-লোহিয়ার মত কিছু সোসালিস্ট নেতার উদ্যোগে ভারতবর্ষের মানুষ নেপালবাসীদের সাহায্যে এগিয়ে এলেও ভারত সরকারও পিছিয়ে থাকেনি। নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেহরুর অবদান অনস্বীকার্য। নেপালের চরম দুর্দিনে রাজা ত্রিভুবনকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন ভারত সরকার। তারপর রাজা ত্রিভুবন নেপালে ফিরে গেলে কৈরালার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ভারত নেপালের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নেপালের রাজা ও নেপালের মানুষ এ সব কথা আজও ভোলেনি। যাই হোক, পরবর্তী কালে রাজা মহেন্দ্র রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে এমন সরকার গঠন করেন, যা গণতান্ত্রিক ভারতকে দুঃখ দেয়। পত্র পত্রিকায় ও নানা রাজনৈতিক দলের সভা-সমিতিতে রাজা মহেন্দ্রর সমালোচনাও করা হয়। নেপাল ভারতবর্ষের ব্যাপারে এত ওয়াকিবহাল যে এ সব সমালোচনায় খুশি না হলেও মেনে নিয়েছে কিন্তু যেদিন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহরু রাজা মহেন্দ্রর এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন, সেদিন নেপাল সরকার তা নীরবে মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীন সার্বভৌম নেপাল সরকার বিনা দ্বিধায় জানিয়ে দিল, আমাদের দেশে কি ধরনের সরকার হবে, তা আমাদের বিচার্য, ভারত সরকারের নয়। নেহরুর ঐ একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারত-নেপাল সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করল।

ইতিমধ্যে শুরু হল ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ। সংঘর্ষ। নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল রাতারাতি। ভারত-নেপাল সম্পর্কের অবনতি রোধই নয়, অবিলম্বে উন্নতির প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু কে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে? যে আই-সি-এস আই-এফ-এস কূলচূড়ামণিরা ভারতবর্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোকিত করে রাখেন তাদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া গেল না যিনি এ কাজ করতে পারেন। সর্দার স্বরণ সিং বহুবার পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিলেও তাঁকেও ঠিক উপযুক্ত মনে হল না। তবে কি নেহরু স্বয়ং? যাঁর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জল এত ঘোলা হয়েছে তার যাওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া নেহরু নিজে এগিয়ে গেলে ভারত সরকারের মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকবে না। তবে কি কৃষ্ণ মেনন? না, দেশরক্ষামন্ত্রী নেপাল গেলে নানা দেশে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং নেপালও অস্বস্তিবোধ করবে। তবে কে?

অনেক ভেবেচিন্তে নেহরু শাস্ত্রীজিকে বললেন, লালবাহাদুর, তুমি নেপাল যাও।

শাস্ত্রীজি অবাক হয়ে বললেন, আমি!

হ্যাঁ, তুমি।

শাস্ত্রীজি হেসে বললেন, আমি তো কোন দিন দেশের বাইরে যাইনি। তাছাড়া ফরেন এ্যাফেয়ার্সের ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞও না।

পণ্ডিতজী সরাসরি বললেন, তাতে কি হল? তুমি তো ক্যাবিনেটের পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স কমিটির মেম্বার। তোমার আবার কি অজানা?

কয়েকদিন পরেই সরকারীভাবে ঘোষণা করা হল, নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপার আমন্ত্রণে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী সন্ত্ৰীক নেপাল সফর করবেন।

নিত্যকার মত পরের দিন সকালে অফিস যাবার পথে শাস্ত্রীজির বাড়ি যেতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নেপাল গিয়েছ?

হ্যাঁ।

ওখানকার লোকজনের সঙ্গে পরিচয় আছে?

আমি হেসে বললাম, নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ তুলসী গিরির সঙ্গে আমার খুবই মধুর সম্পর্ক।

তাই নাকি?

হ্যা।

কিন্তু কি ভাবে?

অনেক কাল ধরেই পরিচয়। তাছাড়া বেলগ্রেডে নন-এ্যালাইণ্ড নেশনস্ কনফারেন্সের সময় আমি আর ডাঃ গিরি খুবই ঘনিষ্ঠ হই।

শুনে খুশি হলেন শাস্ত্রীজি। একটু হেসে বললেন, তাহলে আমি যখন নেপাল যাব, তুমি কি যেতে পারবে?

আমি বললাম, সম্পাদকের সঙ্গে আজই টেলিফোনে কথা বলব।

রাত্রে সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললাম। উনি মত দিলেন। দু-একদিনের মধ্যেই বিমানের টিকিট ও টাকা পাঠিয়ে দিলেন। শাস্ত্রীজি রওনা হবার একদিন আগেই আমি দিল্লী থেকে কাটমাণ্ডু রওনা হলাম।

কাটমাণ্ডু বিমানবন্দরে পৌঁছে দু-একজনের সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ দেখি প্রধানমন্ত্রী ডাঃ গিরির স্ত্রী এয়ারপোর্টে ঘুরছেন। সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার। মিসেস গিরির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যেতেই একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বাধা দিলেন। অনুরোধ করলাম, ওঁকে আমার কথা বলতে, কিন্তু অফিসারটি এমন বিরক্তি প্রকাশ করলেন যে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। সন্দেহ হল, বোধ হয় ভারতীয় সাংবাদিক বলেই আমাকে এমন করে উপেক্ষা করা হল। বুঝলাম, ভারত-নেপাল সম্পর্ক কোথায় এসে পৌঁছেছে।

দুপুরে আমাদের এম্বাসীতে গেলাম। দু-একজন পূর্বপরিচিত অফিসারের সঙ্গে দেখা করার পর গেলাম প্রেস এ্যাটাশে মিঃ জুগরানের কাছে। কাজ-পাগল প্রাণবন্ত মানুষ। প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, মিশতে পারেন মানুষের সঙ্গে। অনেক হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব হল। কফি খেলাম পর পর। সিগারেট পোড়ালাম অনেকগুলো। তারপর হঠাৎ জুগরান চেয়ার ছেড়ে উঠেই বলল, চলুন, আপনার সঙ্গে এ্যাম্বাসেডরের পরিচয় করিয়ে দিই।

আমি হেসে বললাম, ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

কবে পরিচয় হল? আজই।

না, এর আগেই পরিচয় হয়েছে।

জুগরান এগিয়ে এসে বলল, তা থাক। চলুন, দেখা করে আসবেন।

আমি বললাম, না, ওর সঙ্গে আমি দেখা করব না।

কেন?

আমি হেসে বললাম, শুনতে চাও?

জুগরান অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই শুনতে চাই।

.

কুইন এলিজাবেথ যখন ভারত-পাকিস্তান-নেপাল সফরে আসেন, তখন সাংবাদিক হিসেবে আমিও তার সঙ্গী হলাম। বহু অনুরোধ উপরোধ করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার কুইন্স প্রেস পার্টির ভারতীয় সদস্যদের ভিসা মঞ্জুর করলেন না। নেপালে যাবার জন্যে ভিসার প্রয়োজন নেই কিন্তু রাণীর সফর কভার করার জন্য নেপাল সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা অবশ্যই চাই। পর পর কয়েকটা চিঠি লিখেও নেপাল সরকারের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলাম না। ভারত নেপাল সম্পর্কের তৎকালীন পরিবেশের জন্যই ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতি নেপাল সরকার এই রকম ঔদাসীন্য দেখান। স্থির করলাম, নেপাল যাবই, তারপর যা হয় হবে। তবু সাবধানের মার নেই। কৃষ্ণ মেননকে সব কথা জানাতেই উনি নেপালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিঃ হরেশ্বর দয়ালকে একটা ব্যক্তিগত চিঠি লিখে আমাকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে বললেন।

কাটমাণ্ডু পৌঁছে দেখি, নেপাল সরকার আমাদের চিঠিপত্রের জবাব না দিলেও বৃটিশ সাংবাদিকদের মত আমাদের জন্যও সব ব্যবস্থা করেছেন। কুইন্স পার্টির অন্যান্যদের মত আমরাও রাজকীয় নেপাল সরকারের অতিথি হয়ে রয়্যাল হোটেলে রইলাম। রাষ্ট্রদূত হরেশ্বর দয়ালের কাছে কোন সাহায্য চাইবার প্রয়োজন হল না। তবে ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। উনি পরের দিন আমাকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানালেন।

বিরাট জায়গা নিয়ে কাটমাণ্ডুর ভারতীয় দূতাবাস। একদিকে চান্সেরী ও কিছু কোয়াটার্স। অন্য দিকে রাষ্ট্রদূতের নিবাস। পরের দিন যথা সময় আমি দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রদূতের নিবাসে পৌঁছলাম রাস্তা আর বিরাট লন পার হয়ে রাষ্ট্রদূতের ঘরের পাশ দিয়ে বারান্দার এক কোণায় পৌঁছতেই সশস্ত্র প্রহরী আমাকে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে বারান্দার অন্য কোথায় নিয়ে যেতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। সশস্ত্র প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম, বারান্দার এ পাশ থেকে ও পাশে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে আনলে কেন? সে জানাল, ডিপ্লোম্যাট ছাড়া অন্য কারুর এ্যাম্বাসেডর সাহেবের জানালার সামনে দিয়ে যাবার হুকুম নেই।

শুনে শুধু অবাক হলাম না, রাগে অপমানে সারা শরীর জ্বলে উঠল। এ্যাম্বাসেডরের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করলাম, এই কি আপনাদের নিয়ম।

সে সবিনয়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ স্যার।

প্রাইভেট সেক্রেটারির কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখলাম, ডিয়ার মিঃ এ্যাম্বাসেডর, আপনি ঘরে আছেন বলে আপনার জানালার সামনে দিয়ে হাঁটার অধিকার আমার নেই। ছোট্ট বারান্দার এ কোণ থেকে ও কোণ আসার জন্য আমাকে আপনার বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আসতে হল। এই ধরনের অপমান সহ্য করার অভ্যাস আমার নেই। তাই আপনার সঙ্গে আমার লাঞ্চ খাওয়া সম্ভব নয়। আপনার অসাধারণ সৌজন্যের কথা আমি মিঃ কৃষ্ণ মেননকে বলব।

আমার চিরকুট পড়ে প্রাইভেট সেক্রেটারির চোখ ছানাবড়া। সে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন?

আসি হেসে বললাম, হ্যাঁ।

লাঞ্চ খাবেন না?

আমি আবার হেসে বললাম, এত খাবার পরও কি লাঞ্চ খাবার দরকার আছে? আর বললাম, আমি আপনার এ্যাম্বাসেডরের জানালার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছি। যদি উনি অপমান বোধ করেন তাহলে যেন তার প্রতিবাদ করেন।

পরে হরেশ্বর দয়াল আমাকে টেলিফোন করে বললেন, আই এ্যাম সরি, বাট এটা অনেক দিনের নিয়ম।

আমি হেসে বললাম, নিয়মটা আপনার ভাল লাগে বলেই তো আপনি বদলাননি। আর বললাম, ভারতীয় সাংবাদিক হয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কাছে আমি যে অপমান সহ্য করেছি তাতেই বুঝতে পারছি নেপালীদের কপালে কি জোটে।

কথাটা নিছক রাগ করে বলিনি। বহুকাল ভারতীয় দূতাবাসের সমগ্র এলাকার মধ্যে কোন নেপালী ছাতি মাথায় দিতে পারতেন না। কারণ? দূতাবাসের এলাকায় নেপালীরা ছাতি মাথায় দিলে গণতান্ত্রিক ভারত সরকারের হিজ একসেলেন্সী এ্যাম্বাসেডরের অপমান করা হয়। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে শুধু হায়দ্রাবাদে এই নিয়ম ছিল। নিজাম রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কেউ ছাতি মাথায় দিতে পারতেন না। কেন? ছাতি মাথায় দিলে নিজামকে অপমান করা হবে।

সব কিছু বলার পর আমি জুগরানকে জিজ্ঞেস করলাম, এই সব শোনার পরও কি আপনি আমাকে মিঃ দয়ালের কাছে নিয়ে যেতে চান?

জুগরান সে কথার জবাব না দিয়ে হেসে বলল, নাউ উই মাস্ট হ্যাভ ড্রিঙ্কস!

আমি হেসে বললাম, দ্যাটস্ বেটার এ্যাণ্ড মোর অনারেবল।

শাস্ত্রীজির কাটমাণ্ডু পৌঁছতে একদিন দেরী হল। হঠাৎ রাজেন্দ্র প্রসাদ মারা যাওয়ায় শাস্ত্রীজি তাঁর শেষকৃত্যে যোগদান করে পরের দিন কাটমাণ্ডু পৌঁছলেন। প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ডাঃ তুলসী গিরি বিমানবন্দরে হাজির হয়ে সবাইকে বিস্মিত করলেন। নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপা তো ছিলেনই।

অনেক দিন পর ডাঃ গিরির সঙ্গে দেখা। মনে মনে ভয় ছিল হয়তো প্রধানমন্ত্রী হবার পর কিছু পরিবর্তন হয়েছে এবং আমাকে চিনতে পারবেন না। তাই শাস্ত্রীজির বিমান পৌঁছবার আগে ওকে দেখেও ওর কাছে যেতে দ্বিধা করছিলাম কিন্তু উনি নিজেই এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি কবে এলে?

পরশু।

আমাকে ফোন করনি কেন?

আমি হেসে বললাম, হাজার হোক আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনাকে বিরক্ত করা কি ঠিক?

ডাঃ গিরি হেসে বললেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছি বলে তোমাকে ভুলে যাব? যাই হোক, তুমি আমার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যেও না।

না না, নিশ্চয়ই দেখা করব।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপার সঙ্গে উনিই আমার আলাপ করিয়ে দিলেন। থাপাও সাদরে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ওর বাড়ি।

পরিচয় হল আরো অনেকের সঙ্গে। কথাবার্তাও হল। কথা বললাম না শুধু ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হরেশ্বর দয়ালের সঙ্গে। প্রেস এ্যাটাশে জুগরানের সঙ্গে দিল্লী থেকেই পরিচয় ছিল। এই দুদিনের আড্ডা-হাসিঠাট্টা আর বিশুদ্ধ স্কচের কৃপায় সে পরিচয় নিবিড় বন্ধুদ্ধে পরিণত হয়। তাই সে আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বলে, তুমি শালা আমার এ্যাম্বাসেডরকে আর কত অপমান করবে?

আমিও ফিস ফিস করে জবাব দিলাম, তোমার প্রাণের প্রিয় এ্যাম্বাসেডরকে টাইট দেবার লোক আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছচ্ছেন।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এয়ারপোর্টে দেখে শাস্ত্রীজি মুগ্ধ হলেন। সকৃতজ্ঞ চিত্তে বললেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনার কত কাজ। আমার মত একজনকে অভ্যর্থনা করার জন্য আপনি কেন এত কষ্ট করলেন?

ডাঃ গিরি বললেন, শাস্ত্রীজি, আপনাকে শুধু আপনার দেশের লোকই শ্রদ্ধা করে না, আমরাও করি!

.

এয়ারপোর্ট থেকে শীতল নিবাস। রাজকীয় অতিথিশালা। শাস্ত্রীজি ও শ্ৰীমতী ললিতা শাস্ত্রী ঘরদোর-বিছানা দেখে অবাক। শাস্ত্রীজি হাসতে হাসতে বিছানা দেখিয়ে নেপাল সরকারের চীফ অব প্রটোকল ঠাকুরসাহেবকে বললেন, এত মোটা গদীর ওপরে শোওয়া অভ্যাস নেই। আপনি বরং আমাদের জন্য সাধারণ বিছানার ব্যবস্থা করুন। ঠাকুরসাহেব প্রথমে আপত্তি করলেও পরমুহূর্তে বুঝলেন, এই সহজ সরল মানুষটি রাজনীতির স্বর্ণ শিখর প্রাঙ্গণের অন্যতম নায়ক হয়েও সত্যি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন এবং তিনি সত্যি সত্যি মোটা গদী সরিয়ে দেবার হুকুম দিলেন। পরে ঠাকুরসাহেব বলেছিলেন, এই শীতল নিবাসে আরো অনেক ভারতীয় নেতাই থেকেছেন। কিন্তু এই ধরনের অনুরোধ আর কেউ করেননি।

রাজা মহেন্দ্রর রাণী শ্রীমতী ললিতা শাস্ত্রীকে ভোজসভায় আমন্ত্রণ করতেই শাস্ত্রীজি সবিনয়ে বললেন, আমাদের সৌভাগ্য যে আপনি ওকে আমন্ত্রণ করছেন কিন্তু আমার স্ত্রী অত্যন্ত সাধারণ মহিলা। উনি ডাইনিং টেবিলেও খান না, ছুরি-কাটার ব্যবহারও জানেন না। শাস্ত্রীজির এই স্বীকৃতিতে ওর বা ওর স্ত্রীর মর্যাদা কমেনি, বরং বেড়েছিল। শ্রীমতী শাস্ত্রীর সম্মানে অয়োজিত সব ভোজসভাই সাধারণ ভারতীয়/নেপালী প্রথার মত হয়েছিল। সবাই মেঝেয় আসন পেতে বসে হাত দিয়েই খেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, শাস্ত্রীজি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে রাণীকে, শ্ৰীমতী গিরি ও অন্যান্য সবাইকে বলেছিলেন, আমার স্ত্রী ইংরেজি জানেন না, শুধু হিন্দী জানেন। শাস্ত্রীজির কথা শুনে ওরা সবাই বলেছিলেন, ইংরেজির চাইতে হিন্দীতে কথাবার্তা বলতেই আমরা বেশী অভ্যস্ত। কূটনৈতিক চালে নয়, বড় দেশের নেতা বলে দম্ভ দেখিয়েও নয়, এই সরলতা আর নিছক সাধারণ ভারতীয়ের স্বাভাবিক আচরণেই শাস্ত্রীজি নেপালের নেতা ও মানুষের মন জয় করলেন।

ওদিকে দুদিন ধরে শাস্ত্রীজির সঙ্গে রাজা, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা চলার পর ডাঃ গিরি আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। বললেন, শাস্ত্রীজির সঙ্গে ছায়ার মত মিঃ দয়াল সব জায়গায় উপস্থিত থাকছেন বলে আমরা ঠিক মন খুলে কথা বলতে পারছি না কিন্তু আমরা তো বলতে পারি না এ্যাম্বাসেডরকে নিয়ে আসবেন না।

আমি বলি, আমি কি শাস্ত্রীজিকে বলব আপনার সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলতে।

হ্যা বল। তবে আমরা আলাদা ভাবে কথা বলার খুব বেশী সময় পাব না। তাই তুমি ওকে কয়েকটা কথা বলবে।

শাস্ত্রীজিকে জানাবার জন্য প্রধানমন্ত্রী ডাঃ গিরি আমাকে অনেক কথা বললেন। কোন ভুল না হয়, সেজন্য আমি প্রতিটি পয়েন্ট নোট করে নিলাম। সেসব কথা প্রকাশ করা উচিত নয় বলেই করব না। তবে এ কথা নিশ্চয়ই সবার জানা প্রয়োজন যে ডাঃ গিরি সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এত নিবিড় যে তার তুলনা হয় না। অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত নেপালীই ভারতে পড়াশুনা করেছেন। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুয় ভারতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারে আমরা এত কাছাকাছি যে তা বলার নয়।

আমি বললাম, তা তো বটেই।

ডাঃ গিরি একটু হেসে বললেন, যে সব সভায় আমরা হিন্দীতে বক্তৃতা করি, সে সব সভাতেও তোমাদের এ্যাম্বাসেডর ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন।

কী আশ্চর্য।

আমি জানি ভারতবর্ষের সবাই হিন্দী বলতে পারে না কিন্তু মিঃ দয়ালের মাতৃভাষাই তো হিন্দী। উনি ইংরেজিতে বক্তৃতা দিলে কি নেপালের মানুষ ওকে বেশী শ্রদ্ধা করবে? নাকি ওকে আপন মনে করবে?

আমি কি বলব–চুপ করে থাকি।

চা খেতে খেতে কথা হয়। ডাঃ গিরি বললেন, মিঃ দয়াল সব সময় আমাদের সবার সঙ্গে এমন ভাবে কথাবার্তা বলেন যেন আমরা কেউ কিছুই বুঝি না এবং উনি আমাদের সবার চাইতে বেশী বুদ্ধিমান। এই ধরনের কোন রাষ্ট্রদূত কি কখনও অতিথি-দেশে জনপ্রিয় হতে পারেন?

শুনে আমি লজ্জিত বোধ করি, অপরাধী মনে করি। আমি মনে মনে ভাবি, এই সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের জন্যই ভারত এশিয়া আফ্রিকার বহু দেশে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।

যাই হোক, ডাঃ গিরি আরো অনেক কথা বলার পর আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। উনিও রাষ্ট্রদূত দয়ালের সম্পর্কে অনেক কথা বললেন। শাস্ত্রীজির নির্দেশ মত আমি একটা রিপোর্ট টাইপ করে গোপনে ওকে দিলাম। এর পর শাস্ত্রীজি নিজেই উদ্যোগী হয়ে রাষ্ট্রদূত দয়ালকে সঙ্গে না নিয়ে নেপালের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন।

মনে পড়ছে শাস্ত্রীজির সম্মানে রাষ্ট্রদূত দয়ালের পার্টির কথা। শাস্ত্রীজিকে নিয়ে রাষ্ট্রদূত দয়াল তাঁর বাড়িঘর, ফুলের বাগান, টেনিস কোর্ট ইত্যাদি দেখালেন। তারপর শাস্ত্রীজি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে অনেকের সামনেই রাষ্ট্রদূতকে বললেন, আপনাদের সবকিছু দেখে মনেই হয় না আপনারা ভারতবর্ষের প্রতিনিধি।

শাস্ত্রীজির এই সফরের পরই আবার নাটকীয় ভাবে ভারত-নেপাল সম্পর্ক মধুর ও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল।

শাস্ত্রীজি প্রধানমন্ত্রী হবার পর নেপালে কোন আই-সি-এস/আই এফএসকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠান না। তিনি নেপালে রাষ্ট্রদূত করে -পাঠিয়েছিলেন ধুতি পাঞ্জাবি পরা গান্ধীবাদী নেতা শ্ৰীমন নারায়ণকে।

ভারতীয় রাজনীতিতে শাস্ত্রীজির মত অমায়িক নেতা আর দেখিনি। সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৌজন্যেও তিনি ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম।

নেহরু মন্ত্রীসভা গঠনের সময় একটা সুন্দর চিঠি লিখে নির্বাচিত সহকর্মীদের মন্ত্রীসভায় যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানাতেন। সে সব চিঠি পৌঁছে দিত মিলিটারী মোটরসাইকেল রাইডাররা। মন্ত্রীসভা থেকে কাউকে বাদ দিলেও নেহরু ঠিক ঐ রকমই সুন্দর চিঠি লিখতেন। সে চিঠিও ভাগ্যহীনদের বাড়ি পৌঁছে দিত মিলিটারী মোটরসাইকেল রাইডাররা। মজার কথা, চিঠিগুলো পাঠানো হত একটু বেশী রাত্রে। মনে পড়ে কী উৎকণ্ঠা নিয়েই কিছু নেতা সন্ধ্যার পর থেকেই লনে পায়চারী করতেন! মোটরসাইকেলের আওয়াজ শুনলেই তারা চমকে উঠতেন অজানা বার্তার আশঙ্কায়। শাস্ত্রীজি চিঠি লিখে কাউকে মন্ত্রীসভায় যোগ দেবার অনুরোধ করেননি। তিনি নিজে প্রত্যেকের বাড়ি গিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে অনুরোধ করতেন মন্ত্রীসভায় যোগ দেবার জন্য। শুধু মন্ত্রী নয়, এমন কি পার্লামেন্টারী সেক্রেটারি ক্ষেত্রেও উনি এই নিয়ম মেনে চলতেন।

মনে পড়ছে ওয়েস্টার্ণ কোর্টের এক দিনের ঘটনা। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী হাজির হতেই সবাই অবাক। রিসেপসনিস্ট ছুটে এলেন। শাস্ত্রীজি তার কাছে ললিত সেনের ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে নিজেই সে ঘরের দরজায় হাজির। দরজায় তালা দেখেই ফিরে গেলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে আবার শাস্ত্রীজি এলেন ওয়েস্টার্ণ কোর্টে। না, এবারও ললিত সেনকে পেলেন না। চলে গেলেন। একটু পরেই ললিত সেন ফিরে এসে শুনলেন প্রধানমন্ত্রী দুবার এসে ঘুরে গেছেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি। ওকে দেখেই শাস্ত্রীজি বললেন, একটা অনুরোধ করার জন্য তোমার ওখানে গিয়েছিলাম।

ললিত সেন বললেন, আপনি আমাকে ডেকে পাঠালেন না কেন?

না ললিত, তা হয় না। আমার দরকারে তোমাকে কষ্ট দেব কেন?

তাতে কি হল? বলুন, কি দরকার।

আমার কাজে তোমাকে সাহায্য করতে হবে।

নিশ্চয়ই করব।

তোমায় আমার পার্লামেন্টারী সেক্রেটারি হতে হবে।

বঙ্গেশ্বর লক্ষ্মণ সেনের বংশধর ললিত সেন একটু হেসে বললেন, আপনি যদি আমাকে এ কাজের উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে আমার কি আপত্তি? তবে এ কথা বলার জন্য আপনি কেন কষ্ট করে দুবার ওয়েস্টার্ণ কোর্ট গিয়েছিলেন?

শাস্ত্রীজি বললেন, ললিত, আমিও ভোটে জিতে এম. পি. হয়েছি, তুমিও তাই। আজ তোমরা আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেছ বলে কি তোমাদের আমি উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করতে পারি?

জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি এই ছিল শাস্ত্রীজির মনোভাব। এম. পি-দের প্রতি এমন শ্রদ্ধার মনোভাব সত্যি দুর্লভ। শ্ৰীমতী গান্ধী মন্ত্রীসভার সদস্যদের চিঠি লেখেন না, নিজে অনুরোধও জানান না এভাবে। সাধারণত ওর প্রাইভেট সেক্রেটারি ধরনের কোন কর্মচারী সংশ্লিষ্টদের টেলিফোনে জানিয়ে দেন, আপনি রাষ্ট্রপতি ভবনে আসুন, শপথ নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের অনুরোধেই শ্ৰীমতী গান্ধী কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ডক্টর ত্রিগুণা সেনকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী করেন, কিন্তু ভক্টর সেন এ খবর পান প্রাইম মিনিস্টারের সেক্রেটারি যশপাল কাপুরের কাছ থেকে। যশপাল কাপুর ওকে বেনারসে টেলিফোন করে বলেন, ডক্টর সেন, আপনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। দিল্লী চলে আসুন। শপথ নিতে হবে। টেলিফোন পেয়ে ত্রিগুণাবাবু অবাক। ভাবেন, লোকটা বলে কি? একবার ভাবলেন, কেউ ঠাট্টা করছে না তো? এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই কাশীর লোকজন মালা নিয়ে হাজির। কী ব্যাপার? রেডিওতে বলল, আপনি সেণ্টল মিনিস্টার হয়েছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বারানসীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসে সেলাম করে বাড়ির দরজায় সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করলেন। ত্রিগুণাবাবু স্বীকৃতি না জানালেও মালা, অভিনন্দন আর রাইফেলধারীদের সেলামের ঠেলায় পরদিনই দিল্লী ছুটতে বাধ্য হলেন। শ্রীমতী গান্ধী এই ভাবেই মন্ত্রী নিয়োগ করেন।

ললিত সেন পার্লামেন্টারী সেক্রেটারি হলেও শাস্ত্রীজি ওকে যেমন বিশ্বাস করতেন তেমনি ভালবাসতেন। প্রধানমন্ত্রীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন রাজনৈতিক কাজের দায়িত্ব বহন করতে হত ললিত সেনকে। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা না লিখে পারছি না।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করা সত্বেও শাস্ত্রীজি কংগ্রেস সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সারা দেশের কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যুর পর শাস্ত্রীই একমাত্র শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন যার সঙ্গে কংগ্রেস কর্মীদের নিয়মিত ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। তাই দেশের নানা প্রান্তের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের ভিতরের খবর ও কর্মীদের মনোভাব শাস্ত্রীজি খুব ভাল করেই জানতেন। তাইতো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিভিন্ন প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলিকে কয়েকজন সুবেদারের নিজস্ব জমিদারীতে পরিণত করা হয়েছে এবং এই সব নেতাদের জমিদারী মনোবৃত্তি ও পরিচালনা পদ্ধতির জন্যই কংগ্রেস দিনে দিনে দুর্বল হয়ে উঠেছে।

নেহরু নিজেও এই সব প্রাদেশিক কংগ্রেসী সুবেদারদের দেখতে পারতেন না এবং নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে এই সব নেতাদের নিজের কাছে ঘেষতে দিতেন না। বেশ কয়েক বছর প্রতি দিন প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান তিনমূর্তি ভবনে গেছি কিন্তু মনে পড়ে না কামরাজ, বিজু পটনায়ক, বা অন্য দু-একজন ছাড়া অন্য কোন প্রাদেশিক নেতাকে নেহরুর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ বা ডিনার খেতে দেখেছি। নেহরুর বাড়িতে নানা ধরনের উৎসব হত কিন্তু সেসব উৎসবে পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ, লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও কৃষ্ণমেনন ছাড়া অন্য কোন কংগ্রেস নেতাকে আমন্ত্রিত হতে দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। কংগ্রেসের এই সব প্রাদেশিক সুবেদারদের নেহরু ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ না করলেও প্রাদেশিক কংগ্রেসের ওপর তাদের প্রভুত্ব ঠিকই বজায় ছিল। কারণ নেহরু এই সব নেতাদের থেকে এত ওপরের, এত জনপ্রিয় ও সর্বোপরি এত ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যে তিনি ওদের মত সুবেদারদের উপেক্ষা করেও স্বচ্ছন্দে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পেরেছেন। শাস্ত্রীজি প্রধানমন্ত্রী হবার অনেক আগেই বুঝেছিলেন, এই সব প্রাদেশিক সুবেদারদের হাতে না পারলে আপামর সাধারণকে কংগ্রেসের প্রতি আকৃষ্ট করা যাবে না। তাছাড়া এই সব সুবেদাররা নিজেদের গদী ঠিক রাখার জন্য বহু নিষ্ঠাবান কংগ্রেসীকে মণ্ডল বা জেলা কংগ্রেস কমিটির সভ্য হবার সুযোগ দেন না এবং নতুন সদস্য করার ব্যাপারে এই সব সুবেদাররা বহু রকমের দুর্নীতির প্রশ্রয় নেন। সর্বোপরি শাস্ত্রীজি জানতেন এই সব প্রাদেশিক নেতারা কংগ্রেসের নামে অর্থ সংগ্রহ করে নিজের ও নিজের গোষ্ঠীর জন্য ব্যয় করেন। আর? আর জানতেন এই সব নেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্পপতি ও ব্যবসাদারদের অর্থে বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য শাস্ত্রীজি উপযুক্ত সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হবার পর শাস্ত্রীজি মনে করলেন, সে সুযোগ ও সময় সমাগত।

আজ ভাবলে অবাক লাগে যে অজয় মুখার্জীর বিদ্রোহের বহু আগেই লালবাহাদুর শাস্ত্রী বুঝেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে এমন দুর্নীতি ঢুকেছে যে তার প্রতিকার না করলে কংগ্রেসকে বাঁচানো যাবে না। তাই তো তিনি ললিত সেনের মারফত অজয় মুখার্জীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও বিয়াল্লিশের আন্দোলনের অনন্য যোদ্ধা সতীশ সামন্ত এম. পি. কে খবর দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে বলবন্তরাও মেটার রিপোর্ট বহু কাল ধামাচাপা পড়ে আছে। প্রাদেশিক নেতাদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ আছে। আপনারা সে সব রিপোর্ট ও খবরের উল্লেখ করে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কাছে স্মারকলিপি পেশ করুন। দু-চারজন ও তাদের কিছু মোসাহেবদের স্বার্থরক্ষার জন্য হাজার হাজার নিষ্ঠাবান কংগ্রেসী কংগ্রেস থেকে দূরে চলে যাবেন, তা হতেই পারে না। অজয়বাবুর এক প্রতিনিধিকে শাস্ত্রীজি নিজেও বলে ছিলেন, আনফরচুনেটুলি পণ্ডিতজী টলারেটেড দ্য ম্যানেজিং এজেন্টস অব পি. সি. সিস এ্যাজ হি ওয়াজ টু গ্রেট টু বী এ্যাফেকটেড বাই দেম–কিন্তু আমার কাছে কয়েকজন মুষ্টিমেয় নেতার গদীরক্ষার চাইতে লক্ষ লক্ষ কংগ্রেস কর্মীর স্বার্থরক্ষাই বড় কাজ।

নেপথ্যে যখন কাজকর্ম শুরু হল তার পর পরই ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব শুরু হল এবং শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রীজি মারা গেলেন। সেদিনের এই নেপথ্য কাহিনীর খবর যারা রাখেন তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন শাস্ত্রীজি বেঁচে থাকলে কংগ্রেসের ও ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্য রকম হত। কংগ্রেসের এই প্রাদেশিক সুবেদারদের খতম করার জন্যই শ্ৰীমতী গান্ধী নতুন কংগ্রেস গড়ে তোলেন। কংগ্রেসকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য শ্রীমতী গান্ধীর বিরুদ্ধে অনেকের অনেক অভিযোগ। তাঁর কর্মধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হয়েও এ কথা মুক্ত কণ্ঠে বলা যায় যে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সুবেদারদের কৃপায় কংগ্রেস এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল যে সার্জিক্যাল অপারেশন না করে শ্রীমতী গান্ধীর উপায় ছিল না।

মিডমিডে পিদিম আর মিড়মিড়ে বউয়ের মত আদর্শহীন, ব্যক্তিত্বহীন মানুষ আমি কোন কালেই পছন্দ করি না। হৃদয় ঐশ্বর্য সবার থাকে না, থাকতে পারে না, কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্য কেন থাকবে না? যে দুহাত বাড়িয়ে মানুষকে বুকে টেনে নিতে পারে না, যে হাসতে পারে না, খেলতে পারে না, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারে না, দুচোখ ভরে আকাশ দেখতে পারে না, তাদের আমি কোন কালেই ভালবাসতে পারি না। শ্রদ্ধা করা তো দূরের কথা।

অল্প বয়সে খবরের কাগজের রিপোর্টার হই। তখন প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকেই কম-বেশি অসাধারণ মনে করতাম। অনভিজ্ঞ বলে শ্রদ্ধাও করতাম বহু জনকে। আস্তে আস্তে আমি উপলব্ধি করলাম, সব নেতাই বুদ্ধিমান না এবং নেতাদের মধ্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, হৃদয় ঐশ্বর্য প্রায় দুর্লভ। ছলে-বলে-কলে-কৌশলেই নেতৃত্বের আসন দখল করতে হয়।

বোধ হয় এটাই নিয়ম, কিন্তু ব্যতিক্রম হয় বৈকি। যেমন কৃষ্ণমেনন।

ছোটবেলায় বা কৈশোরে খবরের কাগজের পাতায় কোন দিন কৃষ্ণমেননের নাম দেখিনি। দেশ স্বাধীন হবার পর ব্রিটেনে প্রথম ভারতীয় হাই কমিশনার রূপে কৃষ্ণমেননের নাম কাগজের পাতায় ছাপা হয় এবং কয়েক বছরের মধ্যেই জীপ স্ক্যাণ্ডাল-এর সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে।

তখন মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত ছিল। নোট বই পেন্সিল নিয়ে হাজরা পার্ক, ওয়েলিংটন স্কোয়ার বা রাইটার্স–লালবাজার গিয়েই মনে করতাম সূর্যের চাইতে প্রদীপের আলো বেশি। তাই কৃষ্ণমেননের বিরুদ্ধে হঠাৎ এতগুলি মানুষ কেন সোচ্চার হয়ে উঠল বুঝতে পারিনি। অল্প বুদ্ধি ভয়ঙ্করী বলে মনে মনে ভেবে নিলাম, পশ্চিমবাংলার একদল অসৎ কংগ্রেসীর মত কৃষ্ণমেননও চোর, অসৎ।

পরে জেনেছি, বুঝেছি, যারা চোর চোর বলে চিৎকার করেছিল, তারা অনেকেই অসৎ, কৃষ্ণমেনন না। আজ মনে পড়ছে ১৯৬২ সালের সেই সর্বনাশা দিনের কথা। চীনের হাতে ভারত নিদারুণ ভাবে অপদস্থ। কংগ্রেসের সমস্ত দক্ষিণপন্থী নেতারা কৃষ্ণমেননকে চিরদিনের মত শেষ করে দেবার নেশায় মশগুল। দেশের মানুষও ক্ষেপে উঠেছে। নেহরু নিরুপায় হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে কৃষ্ণমেননের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করলেন। সমালোচকদের খুশি করার জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইস্তাহার বেরুল। ভারতবর্ষের সেই মহাদুর্দিনে দক্ষিণপন্থী নেতারা মেতে উঠলেন বিজয়োৎসবে।

মন খুবই খারাপ। সারাদিন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। ছোটাছুটিও করেছি অনেকবার পার্লামেন্ট হাউস আর সাউথ ব্লকের মধ্যে। খবরটবর পাঠিয়ে দেবার পর বাড়ি ফেরার পথে গেলাম কৃষ্ণমেননের ওখানে।

সামনের অফিস ঘরে এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারি মহাবীর কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত। আমি ওকে বললাম, খবর দাও, আমি এসেছি।

কৃষ্ণমেননের মানসিক অবস্থা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ছিল না। তাই মহাবীর টেলিফোনের বাজার বাজিয়ে তাঁকে আমার আসার কথা বলতে সাহস করল না। বলল, আজ আমাকে খবর দিতে বলবেন না। আপনি চলে যান।

জিজ্ঞেস করলাম, ঘরে আর কেউ আছে?

না, কেউ নেই। মহাবীর একটু হেসে বলল, আজ আর কে আসবে?

ভিতরের বারান্দায় মেননের কুক-কাম-ভ্যালেট-কাম-পার্সোন্যাল সেক্রেটারি-কাম পার্সোন্যাল ড্রাইভার রমজানকে বললাম, সাহেবকে বল, আমি এসেছি।

না, রমজানও সেদিন ভয়ে ওর ঘরে ঢুকতে সাহস করল না। কী করব? কোন খবর না দিয়েই আমি ওর ঘরে ঢুকলাম।

আমি বসলাম। মেনন একবার মুখ তুলে আমাকে দেখলেন কিন্তু কিছু বললেন না। দশ-পনেরো মিনিট পরে উনি জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াই হাভ ইউ কাম?

আমি বললাম, হোয়াই সুড আই নট কাম?

দুচার মিনিট চুপ করে থাকার পর উনি বললেন, উড ইউ ডু মী এ ফেভার?

আমি কৃষ্ণমেননকে ফেভার করব? অবাক হলেও বললাম, বলুন কি করতে হবে।

মেনন গম্ভীর হয়ে বললেন, বোম্বেতে একটা ট্রাংকল করব। ব্যাঙ্কে টাকা না থাকলে তুমি বিলটা পেমেন্ট করে দেবে?

আমি ওঁর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে বলি, নিশ্চয়ই দেব।

মেনন সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে মহাবীরকে বললেন, বম্বের কলটা বুক কর। যদি ব্যাঙ্কে টাকা না থাকে তাহলে ভট্টাচারিয়া পেমেন্ট করে দেবে।

সাতচল্লিশ থেকে বাষট্টি। দীর্ঘ পনেরো বছর। লণ্ডনে ভারতীয় হাইকমিশার, রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারতীয় দলের নেতা ও সব শেষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সেই লোকের ব্যাঙ্কে একটা ট্রাংকলের বিল দেবার টাকা আছে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ? তাছাড়া দু-এক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত আর্মি সিগন্যাসের লাইনে বিনা পয়সায় মুহূর্তের মধ্যে প্রায় সর্বত্র টেলিফোন করতে পারতেন এবং হয়তো তখনও করতে পারতেন, সেই মেনন সাধারণ নাগরিকের মত ট্রাংকল বুক করবেন?

এই সততা কজন নেতার আছে? মন্ত্রিত্ব চলে যায়, নেতৃত্ব চলে যায়, তবু তাদের সংসার চলে রাজসিক চালে। তবু তারা গাড়ি চড়েন, প্লেনে ওড়েন। কিন্তু এর জন্য তাদের চাকরি করতে হয় না, ব্যবসা করতে হয় না। মাঠে-ময়দানের বক্তৃতা শুনে মনে হয়, এর কোন শিল্পপতির দালালিও করেন না। তবে কী এরা ম্যাজিসিয়ান? তা না হলে এরা টাকা পান কোথায়? এককালে এই সব শা– রাই বলেছে কৃষ্ণমেনন চোর। চমৎকার!

সেদিন মেনন আমাকে যে দুটি কথা ছিলেন, তা আমি জীবনেও ভুলব না। উনি বলেছিলেন, ভট্টাচারিয়া, তুমি আমার জন্য কিছুই করলে না কিন্তু ইচ্ছা করলে কিছু করতে পারতে। তবু বলব, তোমাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি খুশি। তোমাকে আমি ভালবাসি।

আমি চুপ করে ওঁর কথা শুনি। এবার উনি বললেন, তোমাকে দুটো কথা বলছি। মনে রেখো।

বলুন।

মেনন একটু হেসে বললেন, রিমেমবার, নোবডি এভার কিকস এ ডেড ডগ! এ্যাণ্ড? এ গ্রেট মান ইজ নোন বাই দিনাম্বার অফ হিজ এনিমিজ।

এত বড় সত্যি কথা খুব কম লোকের মুখেই শুনেছি।

.

দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করলেও কোন একটা বিখ্যাত সংবাদপত্রে চাকরি করে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে খ্যাতি-যশ-অর্থ লাভ করার সুযোগ আমার হয়নি। সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার ব্যর্থতা, কিন্তু এই ব্যর্থতার জন্য আমার কোন দুঃখ নেই। কারণ নানা প্রদেশের নানা ভাষার নানা ধরণের পত্রিকায় কাজ করেও আমি এমন সৌভাগ্য লাভ করেছি, তা বহু বিখ্যাত পত্রিকার স্বনামখ্যাত সাংবাদিকদেরও স্বপ্নাতীত। এই সৌভাগ্যের একটা অংশ হল বহু যশস্বী ও অসামান্য ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ। এদেরই একজন হলেন বহু বিতর্কিত কৃষ্ণ মেনন।

কলকাতায় দশ বছর রিপোর্টারী করার পরও বহু রথী-মহারথী সাংবাদিককে তৈল মর্দন করা সত্বেও একশো পঁচিশ টাকার চাকরি জুটল না। এক হিন্দী পত্রিকার শেঠজী সম্পাদক নিজের খ্যাতি দিল্লীর দরবারে পৌঁছে দেবার লোভে একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করলেন। ওর ঐ হিন্দী দৈনিক আর ইংরেজি সাপ্তাহিকের একশো টাকা মাইনের বিশেষ সংবাদদাতা হয়েই পাড়ি দিলাম দিল্লী ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করার দুর্জয় সঙ্কল্প নিয়ে।

দিল্লীতে পৌঁছবার দুদিন পরেই শেঠজী সম্পাদক ফরমায়েস করলেন, তিনমূর্তি ভবন থেকে শুরু করে সব বিখ্যাত নেতাদের ফিচার ও ছবি চাই। এই ফরমায়েসের তাগিদেই ঐ ইংরেজি সাপ্তাহিকে ফিচার লিখলাম কৃষ্ণ মেননকে নিয়ে। ছাপা হবার পর দুকপি কাগজও পাঠিয়ে দিলাম।

এর দুএক মাস পরেই এ-আই-সিসির অধিবেশন হল সপ্রু হাউসে। লাউঞ্জে হঠাৎ কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, আর ইউ দ্যাট হোপ্লেস বেঙ্গলী জার্ণালিস্ট?

আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, হোয়াট ডু ইউ মীন?

তুমিই তো আমাকে নিয়ে সেই নোংরা লেখাটা লিখেছিলে?

আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললাম, হ্যাঁ।

উনি সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, এসো, চা খাই।

চা খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন, কে তোমাকে বলল আমি বুদ্ধিমতী সুন্দরী মেয়েদের সান্নিধ্য পছন্দ করি?

. আমি হাসতে হাসতে জবাব দিই, বুদ্ধিমতী সুন্দরীরাই বলেছেন।

আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই অবাক হয়ে ভাবি, এই মানুষটিরই ১৭ দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে যুদ্ধাবসান হয় রক্তাক্ত কোরিয়ায় এবং এই প্রস্তাবের জন্যই চীন প্রথম আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পায়। এই সেই কৃষ্ণমেনন, যার সম্পর্কে স্যার এ্যান্থনি ইডেন হাউস অব কমন্সে বলেছিলেন, আই সুড এ্যাড এ ট্রিবিউট টু ইণ্ডিয়া এ্যাণ্ড কৃষ্ণ মেনন ইন পার্টিকুলার ফর দ্য স্টেটসম্যান শিপ। এই সেই মানুষ যাকে ইউনাইটেড নেশন্সএর জেলারেল এ্যাসেমব্লীতে পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছিলেন আমেরিকান ডীন একিসন। আরো কত কথা মনে পড়ে।

. হঠাৎ কৃষ্ণ মেনন গম্ভীর হয়ে আমার কানে কানে বললেন, ডোন্ট ইউ থিংক মোস্ট ডেলিগেটস আর টকিং ননসেন্স?

ওর কথায় হাসি। অবাকও হই। বলি, আপনারাই তো ডেলিগেট ঠিক করেন।

না না, কখনই না। প্রদেশ কংগ্রেসের ক্ষুদে মোগল সম্রাটাই ওদের পাঠায়। মোস্ট অব দিজ ডেলিগেটস আর এ্যাজ ইডিয়টস এ্যাজ দেয়ার মাস্টার্স।

আমাকে কোন কথা বলতে দেবার সুযোগ না দিয়েই আবার বলেন, এই ডেলিগেটদের মধ্যে কজন পণ্ডিতজীর কথা বোঝে তা আঙুলে গুণে বলা যায়। এরা পণ্ডিতজীর বক্তৃতার পর হাততালি দেবে কিন্তু সুযোগ পেলেই পণ্ডিতজীর বিরুদ্ধে ভোট দেবে।

বোম্বের রমেশ সঙ্গভিকে এগিয়ে আসতে দেখেই কৃষ্ণ মেনন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

হঠাৎ কেন এত আপন ভেবে আমার সঙ্গে এত কথা বললেন, তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু মানুষটাকে ভাল না বেসে পারলাম না। এআইসিসি অধিবেশনের পর দুএক মাস কৃষ্ণমেননের সঙ্গে আমার দেখা হল না।

প্রতিদিনের মত সেদিনও সাত সকালে উঠে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি। খাবার জন্য তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরেই দেখি, সামনেই পুলিশের একটা বেতার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অনুমান করলাম, কোন কাজে আশেপাশের বাড়িতে এসেছে। সাইকেল রেখে ঘরে ঢুকতেই সুন্দরী বলল, ওয়ারলেস ভ্যানের ইন্সপেক্টর তোমাকে খুঁজছেন। আমাকে? শুনেই আমি অবাক। মনে মনে ভাবি, কী এমন গুরুতর অন্যায় করলাম যে পুলিশের বেতার গাড়ি নিয়ে পুলিশ আমার কাছে ছুটে এসেছে। এ সব কথা বেশীক্ষণ ভাবার অবকাশ পেলাম না। ইন্সপেক্টর আমার ঘরের সামনে হাজির হয়ে আমাকে একটা স্যালুট করে বললেন, স্যার, ডিফেন্স মিনিস্টার আপনার এখানে আসছেন বলে আমরা এসেছি।

ইন্সপেক্টরের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। বলি, কিন্তু আমি তো কে আসতে বলিনি।

ইন্সপেক্টর সবিনয়ে বললেন, স্যার তা তো আমি জানি না। তবে উনি আসছেন বলেই আমাদের এখানে থাকতে বলা হয়েছে।

উনি কখন আসবেন?

ঠিক কখন আসবেন, তা আমাদের জানানো হয়নি। বলা হয়েছে, উনি চলে না যাওয়া পর্যন্ত এখানে থাকতে।

তখনও আমার টেলিফোন আসেনি। কাছের পোস্ট অফিস থেকে দুআনা দিয়ে টেলিফোন করলাম ডিফেন্স মিনিস্টারের প্রাইভেট সেক্রেটারি রমেশ ভাণ্ডারীকে। (এই রমেশ ভাণ্ডারীই এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম সচিব।) পুলিশের বেতার গাড়ির কথা বলতেই উনি বললেন, হ্যাঁ, ডিএম. তোমার বাড়ি যাবেন।

কিন্তু আমি তো ওকে নেমন্তন্ন করিনি?

দ্যাট ইজ বিটুইন ইউ এ্যাণ্ড হিম। আমি শুধু বলতে পারি, মিঃ মেনন তোমার বাড়ি যাবেন।

কখন আসবেন?

পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত ওর অফিসে থাকতেই হবে। পাঁচটা-সওয়া পাঁচটার আগে উনি তোমার ওখানে পৌঁছতে পারবেন না।

অপ্রত্যাশিত অতিথি আপ্যায়ণের জন্য সামান্য কিছু ব্যবস্থা করতে না করতেই কৃষ্ণ মেননের গাড়ি এসে থামল আমার বাড়ির সামনে। উনি একা না, সঙ্গে এনেছেন আরো তিনজনকে–মতী রেণুকা রায়, এম. পি. শ্রীরামেশ্বর সাহু, এম. পি. ও বিখ্যাত চার্টার্ড, এ্যাকাউন্টটেন্ট শ্রীরামেশ্বর ঠাকুর।

(বিহার থেকে নির্বাচিত সাহু পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় উপমন্ত্রী হন। ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও জয়প্রকাশ নারায়ণ ঠাকুরকে খুবই স্নেহ করতেন। জয়প্রকাশের PRISON DIARYতে বার বার এর কথা লেখা আছে।) পাঁচ-দশ মিনিট নয়, প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাদের সবার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা গল্প-গুজব করে কৃষ্ণ মেনন বিদায় নিলেন। গাড়িতে ওঠার আগে আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বললেন, দেখতে এলাম তুমি একশো টাকায় কী করে সংসার চালাও।

আমি অবাক বিস্ময়ে ওঁর দিকে তাকাতেই উনি আবার বললেন, পণ্ডিতজীর কাছে শুনছিলাম তুমি নাকি একশো টাকা মাইনে পাও।

কৃষ্ণ মেনন গাড়িতে উঠতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। আমি নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কৃষ্ণ মেননকে শুধু আমার ভাল লাগল না, আমাকেও উনি ভালবাসলেন। গভীর ভাবে ভালবাসলেন। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ করে নিলেন আমাকে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন কূটনীতিবিদ ও নেহরুর পরম আস্থাভাজন ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী হঠাৎ আমার মত একজন সাধারণ সাংবাদিককে এত ঘনিষ্ঠ করে নেবার জন্য আমি শুধু মুগ্ধ না, বিস্মিতও হই। একদিন কথায় কথায় ফিরোজ গান্ধীকে বললাম। শুনে উনি হাসলেন। বললেন, হি ইজ এ ম্যান অব এক্সট্রিম লাইকস এ্যাণ্ড ডিসলাইকস এবং তাও প্রথম দর্শনে, প্রথম পরিচয়ে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। এ্যানি বেসান্ত, হ্যারল্ড ল্যাস্কি ও পণ্ডিতজীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই মেনন ওদের শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যাকে প্রথম পরিচয়ে ভাল লাগবে না, তার যত গুণই থাক, তাকে উনি সারা জীবনেও সহ্য করতে পারেন না।

আমি বলি, এই নীতি মেনে চলা কী কোন পলিটিসিয়ানের পক্ষে সম্ভব?

কে বলল মেনন পলিটিসিয়ান? হি ইজ এ ডিপ্লোম্যাট পার একসেলেন্স, এ ড্রিমার, এ ওয়ার্কার। সর্বোপরি মেনন একজন ইনটেলেকচুয়াল।

সত্যি মেনন সাধারণ অর্থে পলিটিসিয়ান ছিলেন না। পলিটিসিয়ান –বিশেষ করে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা দিবারাত্রি মিথ্যা কথা বলে মানুষকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করেন। কৃষ্ণ মেননকে কোন দিন এ কাজ করতে দেখিনি। কিছু মানুষকে বা কোন দেশকে নিছক খুশি করবার জন্য মেননকে কোন দিনই কোন কথা বলতে শুনিনি। বরং নিজের বক্তব্য পরিষ্কার করে বলার জন্য অপ্রিয় কথা বলতেও উনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না।

একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে।

কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে জেনেভা এয়ারপোর্টে নামতেই দেখি, সংবাদপত্র, রেডিও ও টি. ভি-র বহু সাংবাদিক ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রথমে দুটো-একটা টিকা-টিপ্পনী, হাসি-ঠাট্টা। শেষ পর্যন্ত শুরু হল সাংবাদিক সম্মেলন। বহু বিষয়ে বহু প্রশ্ন। মুহূর্তের মধ্যে জবাব। আমি সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করছি না কিন্তু মেননের পিছনে বসে সবকিছু উপভোগ করছি।

যে সময়ের কথা বলছি তখন শুধু কয়েকটি পাশ্চাত্য দেশ ও সোভিয়েট ইউনিয়নেরই আণবিক-পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। এশিয়ার একটা বিশেষ দেশের সাংবাদিক হঠাৎ মেননকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কী মনে করেন আণবিক বা পারমাণবিক অস্ত্র শুধু আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু দেশের একচেটিয়া অধিকার?

মেনন জানতেন ঐ সাংবাদিকটির দেশও আণবিক অস্ত্র তৈরির ব্যাপারে গোপনে গোপনে কাজ করছে এবং ভারত কোন কারণেই আণবিক অস্ত্র বানাবে না। তাই মেনন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, No, nover. Only American and European countries cant have monopoly over prostitution. There must be prostitutes from your country to break their monopoly.

হাসিতে ফেটে পড়লেন দুনিয়ার সাংবাদিকরা, মুখ চুন করে মাথা হেঁট করে বসে রইলেন ঐ সাংবাদিক।

কৃষ্ণ মেননের কথাবার্তার ধরণই ছিল এই রকম। যেমন বুদ্ধি, তেমনি পাণ্ডিত্য। সেই সঙ্গে বিতর্ক করার অসাধারণ ক্ষমতা। পেঙ্গুইনের অন্যতম প্রথম সম্পাদক, কোরিয়া ও ইন্দো-চায়না সমস্যা সমাধানের প্রধান ব্যক্তি, স্বাধীন সার্বভৌম সাইপ্রাসের স্রষ্টা কৃষ্ণ মেনন সত্যি অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। সাইপ্রাসের কথা বলতেই মনে পড়ে কত কি।

সাইপ্রাস তখন সারা দুনিয়ার সংবাদপত্রের শিরোনাম। বিশ্বের নানা রাজধানীতে সাইপ্রাসের ভবিষ্যত নিয়ে নিত্য আলোচনা। ইউনাইটেড নেশন-এ বিতর্ক হয় কিন্তু তুরস্ক ও গ্রীসের পারস্পরিক ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের জন্য সমস্যার সমাধান হয় না। গ্রীস বলে, যে দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রীক বংশোদ্ভুত, সে দেশে আমাদের অধিকার চাই। পাল্টা দাবী করে তুরস্ক–সাইপ্রাস তো আমাদেরই অটোম্যান সাম্রাজ্যের মধ্যে ছিল। সুতরাং সাইপ্রাসে আমাদেরই আধিপত্য থাকতে হবে। সমাধান? দেশকে দু টুকরো কর।

না, তা হতে পারে না। রাষ্ট্রপুঞ্জে গর্জে উঠলেন কৃষ্ণমেনন। আঞ্চলিক ভিত্তিতেই দেশ গড়ে ওঠে, সে দেশের মানুষ অতীতে কোন্ দেশের লোক ছিল, তা কোন বিবেচনার বিষয় নয়। পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে যেখানে অন্য দেশের মানুষ এসে দীর্ঘকাল ধরে বাস করে না? দশ দেশের মানুষ নিয়েই প্রতিটি দেশ গড়ে উঠেছে কিন্তু তাই বলে কোন দেশকেই দশ ভাগে ভাগ করা হয় না। গ্রীক বা তুরস্ক-যে দেশের মানুষই হোক, যারা সাইপ্রাসে বাস করে তারাই সাইপ্রাসের অধিবাসী। নাগরিক। সাইপ্রাস দ্বিখণ্ডিত হতে পারে না–হবে না। স্বাধীন সার্বভৌম সাইপ্রাসের জন্মই সব সমস্যার সমাধান করবে।

ভারতের প্রতিনিধি ও নেহরুর দূত কৃষ্ণমেননের এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই জন্ম নিল সাইপ্রাস। ভূমধ্যসাগরের কোলে অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই দেশ প্রতিষ্ঠিত হল বিপ্লবী ম্যাকারিয়সের নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম সাইপ্রাস সরকার। মনে পড়ছে প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিয়সের কথা। প্রথম গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলন কভার করার জন্য আমি চলেছি বেলগ্রেড। গভীর রাতে দিল্লী থেকে বেইরুট পৌঁছলাম বি-ও-এ-সি প্লেনে। এক দিন ওখানে কাটিয়ে ব্রিটিশ ইউরোপীয়ন এয়ারওয়েজের প্লেনে রওনা হলাম গ্রীসের রাজধানী এথেন্স। মাঝপথে বিমানটি অপ্রত্যাশিতভাবে নামল সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোশিয়ায়। আরো বেশি অবাক হলাম রাষ্ট্রপতি আর্চবিশপ ম্যাকারিয়াকে আমাদের প্লেনেরই যাত্রী হতে দেখে।

নিকোশিয়া থেকে প্লেন টেক অফ করার পরই প্রথমে এয়ার হোস্টেস, পরে ক্যাপ্টেনের মারফত প্রেসিডেণ্ডের সেক্রেটারির কাছে আমার ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে অনুরোধ জানালাম, রাষ্ট্রপতির দর্শন চাই। কয়েক মিনিট পরেই তদানীন্তন বিদেশ মন্ত্রী ও বর্তমানের রাষ্ট্রপতি কিপ্রিয়ানউ এসে জানালেন, হাতের কাজ শেষ হলেই প্রেসিডেন্ট আপনাকে ডেকে পাঠাবেন।

হ্যাঁ, কয়েক মিনিট পরেই খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজক ও বিপ্লবী বীরের দেখা পেলাম। পৃথিবীর বহু দেশের বহু নেতার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রপতি আর্চবিশপ মাকারিয়সের কাছে যে সম্মান, যে ভালবাসা, যে আন্তরিকতা পেয়েছি, তার তুলনা হয় না। কারণ? আমি ভারতীয়। আমি কৃষ্ণ মেনন ও নেহরুর দেশের মানুষ। ম্যাকারিয়স বারবার আমাকে বললেন, নেহরুর সদিচ্ছা আর রাষ্ট্রপুঞ্জে কৃষ্ণমেননের অবিস্মরণীয় বক্তৃতার জন্যই সাইপ্রাস আজ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের দেশের দীনতম দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষও জানে নেহরু আর কৃষ্ণ মেননের জন্যই সাইপ্রাস দু টুকরো হয়নি। তাইতো এই দুজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতার ছবি আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে পাওয়া যাবে।

বেলগ্রেডে গিয়ে ম্যাকারিয়স নেহরুকে আমার কথা বলেছিলেন। কী দারুণ খুশি হয়েছিলেন নেহরু। আর কৃষ্ণ মেননকে আমিই বলেছিলাম ম্যাকারিয়সের কথা। উনি স্বভাবসিদ্ধভাবে একটু হেসে আমার কানে ফিস ফিস করে বলেছিলেন, বাট আই কুড নট ডু এনিথিং টু স্টপ দ্য পাটিশান অব মাই ওন কান্ট্রি!

চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। এ কথা আজ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে লর্ড মাউন্টব্যাটনের চক্রান্তু, লেডি মাউন্টব্যাটনের রূপ ও মাধুর্য এবং সর্বোপরি জিন্নার কূটনৈতিক বুদ্ধির কাছে সমস্ত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আত্মসমর্পণ করেন বা করতে বাধ্য হন বলেই ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়। যে মানুষটি কোরিয়া-ইন্দোচীন-সাইপ্রাস ইত্যাদি জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের সূত্র আবিষ্কার করেছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল হ্যামারশিল্ডের ব্যর্থতার পরও যিনি চীনে বন্দী আমেরিকান বৈমানিকদের মুক্তিলাভের ব্যবস্থা করেন, তিনি কী জিন্না বা মাউন্টব্যাটনের কূটনৈতিক চালে হেরে যেতেন? বোধ হয় না। যিনি ভিসিনেক্সি-মলোটভ, ডালেস, চু-এন-লাই, ম্যাকমিলন, এ্যান্থনি ইডেন, নাসের, সোয়েকৰ্ণ, নক্রমা, উ নু প্রভৃতি বিশ্ববরেণ্য নেতাদের সঙ্গে সমান তালে আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে অনন্ত ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেছেন, তাঁকে কী পেট মোটা-মাথা মোটা কংগ্রেসীরা সহ্য করতে পারেন। না, কখনই না। তাইতো মেনন অধিকাংশ কংগ্রেস নেতাদের কাছে এত অপ্রিয় ছিলেন।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমরা অত্যন্ত রক্ষণশীল জাতি। রান্নাঘর থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত এই রক্ষণশীলতার ছাপ। আমাদের চরিত্রে এই রক্ষণশীলতার সঙ্গে মিশে আছে ভণ্ডামী আর লোকভয়। শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, পারিবারিক সামাজিক গণ্ডী পেরিয়ে রাজনৈতিক দুনিয়ায়ও এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে। কৃষ্ণমেনন ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে বার বার ঝড় উঠেছে।

সত্যি কথা বলতে কৃষ্ণ মেননই প্রকৃত অর্থে প্রথম দেশরক্ষা মন্ত্রী। সর্দার বলদেব সিং যখন দেশরক্ষা মন্ত্রী তখনই প্রথম কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হয় কিন্তু তখন দেশরক্ষার ব্যাপারে নেহরু ও প্যাটেল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। কৈলাসনাথ কাটজু কোন মতে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে ছিলেন। মহাবীর ত্যাগী সৈন্যবাহিনীতে হিন্দী চালু করেন। এ ছাড়া ইনি একটি মাত্র গুরুত্বপূর্ণ নতুন প্রকল্প ( HAL) গ্রহণ করেন। প্রকল্পটি খুবই জরুরী ছিল এবং পরবর্তী কালের যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে যথেষ্ট সাহায্য করে। মহাবীর ত্যাগীর অবদান এখানেই শেষ।

এলেন কৃষ্ণ মেনন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে সব কিছু বিচার বিবেচনা করে দেখলেন, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে যেসব অশস্ত্র আছে তা আধুনিক দেশগুলির যাদুঘরের উপকরণ। সর্বাধুনিক অস্ত্র চাই। কোথায়? পশ্চিমী দুনিয়ার গোটাকয়েক দেশের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়াতে হবে? না, কখনই না। আমরা কিনব নানা দেশ থেকে। আর? অবশ্য প্রয়োজনীয় সব কিছু আমরাই তৈরি করব। কৃষ্ণ মেননের এই সিদ্ধান্তে জ্বলে উঠল পশ্চিমী দুনিয়া, ঝড় উঠল স্বার্থবাদী ভারতীয় রাজনৈতিক মহলে। ক্ষেপে উঠলেন গান্ধীবাদী কৃপালনীর দল।

কারণ ছিল অনেক। পশ্চিমী দুনিয়ার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর গোপনতম খবরও বিনা ক্লেশে পৌঁছে যেত ওদের কাছে। সেখান থেকে ভারতবিরোধী দেশগুলিতে। তাছাড়া শত শত কোটি টাকার নিশ্চিত ব্যবসা হাতছাড়া হবার জন্যও পশ্চিমী দুনিয়া ক্ষেপে উঠল।

ভারতবর্ষে গান্ধীবাদীরা ক্ষেপে উঠলেন এই জন্য যে, গান্ধীর দেশ দেশরক্ষার জন্য কেন এত ব্যয় করবে? ভারত যখন কোন দেশকে আক্রমণ করতে চায় না। তখন এই গোলা-গুলি -ট্যাঙ্ক-যুদ্ধ বিমান তৈরির দরকার কী? মুখর হয়ে উঠলেন সৈন্যবাহিনীর কিছু প্রবীণ অফিসারও। স্যাণ্ডহার্স্টর এই সব ভূতপূর্ব ছাত্ররা সাহস করে বলতে পারলেন না, আমরা পশ্চিমের পূজারী। আমাদের জীবন দর্শনের সঙ্গে ওরা এমন মিলেমিশে আছে যে নিজের দেশ বা অন্য কোন দেশের অস্ত্র ব্যবহার করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ওরা বললেন, এতে ট্রেনিংয়ের অসুবিধা হবে। তাছাড়া পশ্চিমী দেশগুলির অস্ত্রশস্ত্রই সবচাইতে ভাল।

কৃষ্ণ মেনন বললেন, যুদ্ধের সময় পশ্চিমী দেশগুলি আমাদের সৈন্যবাহিনীর অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না দিলেই বিপদে পড়ব এবং সব সময় ওদের কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকলে ভারত স্বাধীনভাবে আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করতে পারবে না। গান্ধীবাদী সমালোচকদের মেনন বললেন, আমরা কোন দেশ আক্রমণ করতে চাই না ঠিকই, কিন্তু অন্য দেশ যে আমাদের কোন কালেই আক্রমণ করবে না, এ কথা কে বলতে পারে। তাই পৃথিবীর বহু শান্তিকামী দেশের মত ভারতেরও সৈন্যবাহিনী চাই এবং সে সৈন্যবাহিনী যাতে সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করতে পারে তার সব ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব।

ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয় অস্ত্রাদি কেনাকাটার ব্যাপারে কৃষ্ণ মেননের বিকেন্দ্রীকরণের নীতিকে দক্ষিণপন্থীরা ব্যাখা করলেন, মেনন রাশিয়ার কাছে ভারতকে বিক্রী করছে। একদল স্বার্থপর বুদ্ধিহীন দক্ষিণপন্থী ভুলে গেলেন যে কোরীয় সঙ্কটের সময় রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার প্রতিনিধি ভিসিনিস্কি যে ভাবে মেননকে তিরস্কার করে ছিলেন, তার তুলনা বিরল এবং মেনন তা কোন দিন ভুলতে পারেননি। মেনন দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার একচ্ছত্র অধিকার কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না এবং সেই জন্যই নেহরুর অনুপ্রেরণায় কৃষ্ণ মেননের অসাধারণ কূট নৈতিক বুদ্ধির ফলে জন্ম নেয় বিশ্বের তৃতীয় শক্তি–একদিকে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলন, অন্যদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জে এশিয়া-আফ্রিকা গোষ্ঠী। কোন বৃহৎ শক্তিই বা তাদের সাগরেদরা এটাকে খুব সুনজরে দেখতে পারেননি। তাই তো কৃষ্ণ মেননের প্রতিটি কাজে মুখর হয়ে উঠতেন একদল পেশাদারী সমালোচক। মেনন হাসতে হাসতে বলতেন, I dont create controversy. controversy always chases me.

কৃষ্ণ মেনন এমন এক সময় ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে নেহরুর মুখ্য পরামর্শদাতা এবং সে নীতির রূপকার ছিলেন যে তখন সাদা-কালোর মত পৃথিবী দ্বিধাবিভক্ত ছিল। তাইতো তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে বিতর্কের ঝড় উঠত। দক্ষিণপন্থীরা যেমন তাঁর সমালোচনা করতেন, কমিউনিষ্টরা তেমনি সোচ্চারে তাকে সমর্থন করতেন। মজার কথা এর কোনটাই কৃষ্ণ মেনন পছন্দ করতেন না।

কৃষ্ণ মেনন ডালেসের নীতিকে নিশ্চয়ই ঘৃণা করতেন কিন্তু তাই বলে তিনি ভারতবর্ষকে সোভিয়েট ইউনিয়নের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাননি। কৃষ্ণ মেনন সোভিয়েট ইউনিয়নকে এইজন্য পছন্দ করতেন যে কুশ্চেভ-বুলগানিনের সোভিয়েট ইউনিয়ন গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনকে সমর্থন করতে দ্বিধা করেনি এবং এই গোষ্ঠী নিরপেক্ষ আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল কৃষ্ণ মেননের স্বপ্ন ও সাধনা। দক্ষিণপন্থীরা মনে করতেন, গোষ্ঠী নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে কৃষ্ণ মেনন ভারতবর্ষকে কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। সোস্যালিস্টরা সে সময় কমিউনিষ্টদের অস্পৃশ্য মনে করতেন বলে মেননকেও সহ্য করতে পারতেন না। (এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে পঞ্চাশের দশকে যে কোন খ্যাতনামা সোস্যালিস্ট নেতার চিরকুট নিয়ে গেলেই Us I sএ চাকরি হত এবং হয়েছে।) ওদিকে কমিউনিষ্টরা মনে করতেন, কৃষ্ণ মেনন ও নেহরুকে সমর্থন করে যেটুকু কাজ এগুনো যায়, ততটুকুই ভাল। তাইতো শখের করাতের মত অবস্থা ছিল মেননের।

হ্যারল্ড ল্যাস্কির প্রিয় ছাত্র মেনন অর্থনৈতিক ব্যাপারেও সুস্পষ্ট মতামত পোষণ করতেন। তিনি চাইতেন, অর্থনৈতিক মূল কাঠামো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর চাইতেন প্রতিরক্ষার ব্যাপারে ব্যবসাদারদের দূরে রাখতে। কারণ তিনি মনে করতেন, দেশের সঙ্কটকালে ব্যবসাদাররা দেশরক্ষা সংক্রান্ত গোপন খবর অন্যত্র পাচার করতে পারেন এবং তাইতো তিনি দেশের নানা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে শুধু গুলি-গোলা না, অনেক সাধারণ জিনিসপত্রও তৈরি করতে শুরু করান। এজন্য ওঁকে কত ঠাট্টা-বিদ্রুপের জ্বালা সহ্য করতে হয়েছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। মনে পড়ে একদিন লোকসভায় সেনাবাহিনীর জুতো কেনার ব্যাপারে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে মেনন অনিচ্ছা প্রকাশ করায় একদল এম. পি গর্জে উঠলেন। এই ধরণের মামুলি প্রশ্নের জবাব না দেওয়ার জন্য মেনন সংসদকে উপেক্ষা করছেন বলে স্পীকারের কাছে অভিযোগ করা হল নানা দিক থেকে। মেনন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললেন, না, বলব না। আমাদের মোট সৈন্য সংখ্যা সবার জানা আছে কিন্তু জুতোর ব্যাপারে বিশদ হিসেব দিলেই অন্যান্য দেশের সমর-বিশারদরা বুঝতে পারবেন, কোথায় কত কী রকম সৈন্য আছে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে এই সাদাসিধে প্রশ্নের জবাব দিতে আমি অপারগ। মেনন বৃশ্চিক রাশি বা লগ্নের মানুষ ছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই তবে তার কথায় বৃশ্চিকের দংশন থাকতই। তাইতো তিনি সব শেষে বললেন, বাইরের কোন লোকের পরামর্শেই এই প্রশ্নটা করা হয়েছে বলে মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার হৈচৈ শুরু হয়ে গেল, কিন্তু মেনন গ্রাহ্য করলেন না। এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণ মেননের একটা রসিকতার কথা মনে পড়ছে। সেন্টলি হলের আড্ডাখানায় তিনি হাসতে হাসতে বলতেন, এ দেশে শুধু মারোয়াড়ী ব্যবসাদাররাই সোভিয়েট ইউনিয়নের যন্ত্রপাতি বিক্ৰী করার এজেন্সী পায়। (শিল্পোন্নয়নের সেই প্রথম পর্বে সোভিয়েট ইউনিয়নের যন্ত্রপাতি নির্ধারিত মূল্যের চাইতে বেশি দামে বিক্রী হত এবং এই অতিরিক্ত আয়ের টাকাটির এক অংশ কোন কোন রাজ নৈতিক নেতা বা দল পেতেন বলেও অনেকে মনে করতেন।) মারোয়াড়ী ব্যবসাদারদের মেনন সহ্য করতে পারতেন না। তাইতো ওদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রকে উনি Jute Press বলে উপহাস করতেন।

কিছু কিছু সংবাদপত্র সত্যি যেন তার রক্ত পান করার নেশায় মেতে উঠেছিল। মনে পড়ছে জেনারেল থিমায়ার পদত্যাগের কাহিনী।

দেশরক্ষা মন্ত্রী মেননকে না জানিয়ে জেনারেল থিমায়া একদিন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে দেখা করে জানালেন, সেনাবাহিনী সংক্রান্ত নানা প্রস্তাব অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে এমন আটকে পড়ছে যে তাতে ক্ষতি হচ্ছে। এই আলোচনার পর পরই নেহরু মেননকে সব কথা জানালেন। মেনন সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল থিমায়াকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, দেশরক্ষা মন্ত্রীকে ডিঙিয়ে দেশরক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অধিকার কোন সেনাপতির নেই। তাছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব কোন সেনাপতির নয়–দেশরক্ষা মন্ত্রীর। সর্বোপরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভাল-মন্দ সব রকম সিন্ধান্ত নেবার দায়িত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ও মন্ত্রীদের–সেনাপতিদের নয়।

বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ জেনারেল থিমায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝলেন ও স্বীকারও করলেন। তবে উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, মনে হচ্ছে আমি আপনার আস্থা হারিয়েছি, সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আমার পদত্যাগ করা উচিত।

মেনন বললেন, ভুল বোঝাবুঝি যখন মিটে গেছে তখন পদত্যাগ করার কোন কথাই ওঠে না।

থিমায়া খুশি মনে কৃষ্ণ মেননের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও দুপুরের দিকে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে তার পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিলেন। বিকেলের দিকে নেহরু জেনারেল থিমায়াকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ভুল বোঝাবুঝি যখন মিটে গেছে তখন পদত্যাগ করা তার উচিত হয়নি এবং আর কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে এখনই তাঁর পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। জেনারেল থিমায়া বিনা প্রতিবাদে তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে নিলেন।

সন্ধ্যার পর চাণক্যপুরীর এক দূতাবাসে ককটেল পার্টি বেশ জমে উঠেছে। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে জেনারেল থিমায়া ও তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আছেন। হঠাৎ জেনারেল থিমায়ার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টেটসম্যান পত্রিকার রাজনৈতিক সংবাদদাতাকে এক কোণায় ডেকে নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, জেনারেল পদত্যাগ করেছেন। এ্যাডমিরাল কাটারী ও এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জীও পদত্যাগ করেছেন। ঐ সংবাদদাতা হাতের গেলাসের বাকি হুইস্কীটুকু গলায় ঢেলে দিয়েই অফিস চলে গেলেন। পরের দিন কাগজে মহাসমারোহে তিন সেনাপতির পদত্যাগের খবর ছাপা হল।

খবর পড়ে নেহরু বিস্মিত। ঝড় উঠল রাজধানীর রঙ্গমঞ্চে। ঝড় উঠল পার্লামেন্টেও। হঠাৎ যেন অধিকাংশ এম. পি. থিমায়ার প্রতি অত্যন্ত সমবেদনশীল হয়ে উঠলেন। নেহরু দীর্ঘ বিবৃতিতে সবকিছু জানালেন এবং বললেন, যে খবর তিনি ক্যাবিনেটের কোন সদস্যকে পর্যন্ত জানাননি সে খবর ফাঁস হল কিভাবে তা ভেবে দেখা দরকার। নেহরু মেননের সমালোচকদের বললেন, কেউ যেন ভুলে না যান এ দেশে রাজনৈতিক ও বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং সেনাবাহিনী তাদেরই অধীন। সদস্যরা যখন উপলব্ধি করলেন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপেক্ষা করে সামরিক কর্তৃপক্ষকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে দেশের সর্বনাশের বীজ নিহিত থাকে, তখন তারা চুপ করে গেলেন।

আজ এত বছর পর এই ঘটনা লিখতে গিয়ে আরো কয়েকটা কথা না লিখে পারছি না। থিমায়া অত্যন্ত জনপ্রিয় সেনাপতি ছিলেন। কোরিয়ায় রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশনের সভাপতি হয়ে তার সম্মান আরো বেড়ে যায়। থিমায়ার সঙ্গে রাজনৈতিক দুনিয়ার বেশ কিছু লোকের যোগাযোগ ছিল, এ কথা সর্বজনবিদিত এবং মজার কথা এরা সবাই নেহরু ও মেননের সমালোচক ছিলেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে শ্রদ্ধার আসনে বসাবার উদ্দেশ্যেই যে থিমায়ার পদত্যাগের খবর ফাঁস ও ছাপানো হয়, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বৈদেশিক শক্তির চক্রান্তে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উচ্ছেদ করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। থিমায়ার ঘটনার পশ্চাতে যে এমনি কোন অশুভ চক্রান্ত ছিল না, তা হলপ করে বলা যায় না। ভাবলে অবাক লাগে যে ভারতের আর কোন সেনাপতি না, শুধু থিমায়ারই বিরাট জীবনী প্রকাশিত হয়েছে পাশ্চাত্যের এক দেশে এবং এই বইতে তাঁকে প্রায় সর্বজনপ্রিয় মহাপুরুষ করে তোলা হয়েছে।

কথায় কথা বাড়ে। এক কথা লিখতে গিয়ে আরো কথা মনে পড়ে। থিমায়ার পদত্যাগের খবর প্রকাশ করে স্টেটসম্যান একদিকে যেমন সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হেয় করতে চায়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুটি কাজই অত্যন্ত নিন্দনীয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও স্টেটসম্যান অনুরূপ নিন্দনীয় কাজ করে।

আজাদ কাশ্মীরের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলি ভারতীয় সৈন্যদের দখলে। স্বপ্নের শহর লাহোরের উপকণ্ঠেও ভারতীয় সৈন্য। পাকিস্তানের শক্তিশালী প্যাটন ট্যাঙ্কের সমাধি রচিত হয়েছে ভারত ভূমিতে। আরো কত কি। সব মিলিয়ে আয়ুব টলটলায়মান।

যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ-উপরোধ আবেদন-নিবেদন এলো নানা দেশ থেকে। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের অছি পরিষদের প্রস্তাব। নিশ্চিত সর্বনাশ বাঁচাবার জন্য আয়ুব সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব মেনে নিয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন। ভারত? ভারত কী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেবে? নাকি পাকিস্তানের বিষদাঁত চিরকালের জন্য ভেঙে দেবার জন্য এখনই যুদ্ধবিরতি করবে না?

প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী লোকসভার ঘোষণা করলেন, অছি পরিষদের প্রস্তাব আমরা বিবেচনা করে দেখছি। শাস্ত্রীজি লোকসভার কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজের অফিসে ঢুকতেই আমরা পাঁচ-ছজন সাংবাদিক ওঁর ঘরে ঢুকলাম। সবার মুখেই একই প্রশ্ন : আমরা কী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেব? শাস্ত্রীজি বললেন, হ্যাঁ, যুদ্ধবিরতি করব কিন্তু এখনই ঘোষণা করব না। আমাদের সেনাবাহিনী তাদের পজিশন কনসোলিডেট করে নেবার পরই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করব–তার আগে নয়।

শাস্ত্রীজি আমাদের বিশ্বাস করে এই আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ খবরটি দিলেও সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ করলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করে এই খবরটি ছাপাবেন না। সরকারী ভাবে লোকসভায় এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পরই খবরটি ছাপাবেন। না, আমরা কেউ এ খবর প্রকাশ করিনি। বিশ্বাস ভঙ্গ করলেন স্টেটসম্যান পত্রিকার রাজনৈতিক সংবাদদাতা ইন্দর মালহোত্রা। দুর্ভাগ্যের কথা এরাই বিখ্যাত সাংবাদিক, শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক।

.

কৃষ্ণ মেনন সম্পর্কে যে যাই বলুন, তিনি সে একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিলেতে থাকার সময় দু-একজন মহিলার সঙ্গে ভাব-ভালবাসা হলেও তার কোন বন্ধন ছিল না। এমন কাজ পাগল মানুষ খুব কম দেখা যায়। কাজ না করে উপায়ও ছিল না। ঘুমুতেন মাত্র দু-এক ঘণ্টা। চা বিস্কুটই ছিল প্রধান খাদ্য। সুতরাং খাওয়া-দাওয়াতেও সময় নষ্ট হত না। কাজের ব্যাপারে দিন-রাত্রির কোন পার্থক্য ছিল না ওঁর কাছে।

কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যার পর প্রায়ই আমি বাড়ি ফেরার পথে কৃষ্ণ মেননের বাংলোয় যেতাম। বিরাট বাংলোর এক কোণার এক ছোট্ট ঘরে উনি থাকতেন। ঐ ঘরখানিই ছিল ড্রইং রুম-কাম-বেড রুম-কাম ডাইনিং রুম-কাম-লাইব্রেরী। কোন দিন একলা পেতাম, কোন দিন আবার দু-একজনকে ওঁর সঙ্গে গল্প করতে দেখতাম। অন্য ছোট বড়-মাঝারি মন্ত্রিদের বাড়িতে সব সময় যেমন তাঁবেদার আর অনুগ্রহ প্রার্থীর ভীড় দেখা যায়, কৃষ্ণ মেননের বাড়িতে সে দৃশ্য কখনই দেখা যেত না। যাই হোক, কোন কোন দিন আড্ডা চলত বেশ রাত পর্যন্ত। আবার কোন দিন রাত দশটা-সাড়ে দশটার সময় উঠতে গিয়েও বাধা পেয়েছি।

কী ব্যাপার? উঠে দাঁড়ালে কেন?

আমি হেসে বলি, দশটা বেজে গেছে। এবার বাড়ি যাই।

ডোন্ট বী সিলি! সীট ডাউন।

কী করব? আমি আবার বসি। কৃষ্ণ মেনন সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের বাজার বাজিয়ে পার্সোন্যাল স্টাফকে বলেন, ভট্টাচারিয়ার বাড়িতে কানেকশান দাও। তারপর উনি টেলিফোনের কানেকশান পেতেই বলেন, তোমার অপদার্থ স্বামীকে আজ ছাড়ছি না। কাল ভোরেই বাড়ি ফিরবে। ঠিক আছে তো?

ওদিক থেকে সুন্দরী কী বলল শুনতে পাই না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারি।

মেনন টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখতেই আমি হেসে জিজ্ঞেস করি, আজ কী সারারাত গল্প করবেন?

কী করব তা বলব কেন?

এবার ডাক পড়ে রমজানের। সে ঘরে ঢুকতেই হুকুম দেন, বাঙালীবাবুকে কিছু খেতে দাও।

খাবার মানে ডাল-ভাত বা ইডলি-দোসা বা ভাত-সাম্বার না। রমজান খেতে দেয় খানকয়েক স্যাণ্ডউইচ আর কাজু। তার সঙ্গে কফি। কফি শেষ করতে না করতেই কৃষ্ণ মেনন ছড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, চল চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আমি উঠে পড়ি। ওর পিছন পিছন গাড়িতে উঠি। ফাঁকা রাস্তা। পালাম এয়ারপোর্টে পৌঁছতে কয়েক মিনিট লাগে। গাড়ি গিয়ে থামে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক বিশেষ বিমানের সামনে। বিমান কর্মীদের সঙ্গে করমর্দন করেই বিমানে ওঠেন। পিছন পিছন আমি। শুধু আমাদের দুজনকে নিয়ে বিমান আকাশের কোলে ভাসতে শুরু করে।

গল্পে গল্পে কখন যে ঘণ্টা দুয়েক সময় কেটে গেছে, তা টের পাইনি। হঠাৎ পাইলট এসে মেননকে বললেন, স্যার, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছব।

ব্যাঙ্গালোর! শুনে আমি তাজ্জব কিন্তু কোন কথা বলি না।

মেনন পাইলটকে বলেন, কন্ত্রোলকে জানান বিশেষ কারণে ল্যাণ্ড করব। আর ওরা যেন HALকে বলে একটা গাড়ি পাঠাতে, কিন্তু কেউ যেন জানে না, আমি এই প্লেনে আছি।

HAL-এর এরোড্রোমে প্লেন ল্যাণ্ড করল। কোন উচ্চপদস্থ কর্মচারী নয়, শুধু একজন ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কৃষ্ণ মেননকে দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া! সেলাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই আমরা উঠলাম। গাড়ি ছুটল HAL-এর দিকে। ফটকে সান্ত্রী গাড়ি আটকাতেই ড্রাইভার ফিস ফিস করে বলল, ডি, এম, (ডিফেন্স মিনিস্টার) গাড়িতে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে সান্ত্রী সেলাম দিয়েই ফটক খুলে দিল।  

তারপর নাইট শিফট-এ বিমান তৈরির কাজ দেখতে শুরু করলেন কৃষ্ণ মেনন। এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে গভীর রাত্রে দেশরক্ষা মন্ত্রীকে দেখে তদারকী অফিসার ও কর্মীরা সমান ভাবে বিস্মিত ও হতভম্ব। মেনন খুটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখেন ও প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের উৎসাহিত করেন, শুধু ইউরোপ-আমেরিকাই বড় বড় কাজ করতে পারে, সেটা ঠিক নয়। সুযোগ পেলে আমাদের দেশের মানুষও অনেক বড় বড় কাজ করতে পারে এবং করছে। HAL-এর মত প্রতিষ্ঠান এশিয়া-আফ্রিকায় খুব বেশী নেই। আপনারা একটু ভাল ভাবে কাজ করলে এর সুনাম দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

হঠাৎ HAL-এর কর্ণধার এয়ার ভাইস মার্শাল রঞ্জন দত্ত এসে হাজির। কৃষ্ণ মেনন পিছন ফিরে আমার দিকে হাসতে হাসতে বলেন, দেখেছ ভট্টাচারিয়া, তুমি বাঙালী বলে রঞ্জন দত্ত বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

কৃষ্ণ মেননের কথায় সবাই হাসেন। তারপর ঐ কারখানার ফ্লোরে দাঁড়িয়েই কাজকর্ম নিয়ে কনফারেন্স শুরু করেন মেনন। তারপর এক রাউণ্ড কফি।

প্লেনে ওঠার আগে কৃষ্ণ মেনন এ ভি এম দত্তর কানের কাছে মুখ নিয়ে একটু চাপা গলায় বলেন, ঘুম ভেঙে গেল কেন? রাত্রে কী ভাল ভাবে ড্রিঙ্ক করার সময় হয়নি?

এয়ার ভাইস মার্শাল হাসতে হাসতে জবাব দেন, স্যর, আপনি তো জানেন নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহল পেটে না পড়লে আমি কখনই বিছানায় যাব না।

গুড।

এয়ার ভাইস মার্শাল রঞ্জন দত্তকে কৃষ্ণ মেনন খুব ভালবাসতেন। প্লেনে উঠেই মেনন আমাকে বললেন, তোমরা বাঙালীরা বড় অদ্ভুত জাত। অধিকাংশ বাঙালীই কুঁড়ে, বেশি কথা বলে, ঝগড়া করে কিন্তু হঠাৎ এমন এক একটা বাঙালীর আবির্ভাব হয় যা ইতিহাসের বিস্ময়।

আমি চুপ করে মেননের কথা শুনি।

এ দেশে কত লক্ষ-কোটি সাধু জন্মেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই বাট ওয়ান বিবেকানন্দ ইজ এনাফ টু চেঞ্জ দ্য কোর্স অব হিস্ট্র। বলতে পারো শঙ্করাচার্য আর বিবেকানন্দ ছাড়া আর কে এভাবে এই অশিক্ষা-কুশিক্ষা-দরিদ্র জর্জরিত উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের চিন্তাধারায় বিপ্লব এনেছেন? মেনন এক নিশ্বাসে বলে যান, থিংক অব আচারিয়া পি. সি. রে। এই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালী অধ্যাপক প্ল্যানিং কমিশনের একশো বছরের কাজ এগিয়ে দিয়ে গেছেন। সমগ্র জাতির গর্ব করার জন্য একজন টেগোরই যথেষ্ট।

এবার কৃষ্ণ মেনন হঠাৎ একটু হেসে বলেন, নান বাট সুভাষবাবু, এগেন এ বেঙ্গলী, হাড দ্য কারেজ টু রিভোল্ট এগেনষ্ট গান্ধীজি।

এবার আমি হাসি।

হাসেন কৃষ্ণ মেননও। বলেন, এই এক একটা বাঙালী লক্ষ কোটি অপদার্থ বাঙালীর কলঙ্ক ঘুচিয়েছেন। হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে মেনন বলেন, টেক দ্য কেস অব আওয়ার এয়ারফোর্স। রঞ্জন দত্ত একটাই আছে। দত্ত না থাকলে HAL এত ভাল কাজ করতে পারত না।

আমরা পালামের মাটিতে যখন নামলাম তখন প্রায় পাঁচটা বাজে।

এইভাবে আরো কতবার কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর আর কানপুর গেছি।

বিচিত্র মানুষ ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। একদিন বিকেলের দিকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সেবানগর চেনো?

চিনি বৈকি।

হাতের কাজ সেরেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল, সেবানগর যাই।

নিঃশব্দে গাড়িতে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম, বোধ হয় কোন অনুষ্ঠান আছে, কিন্তু না, কোন অনুষ্ঠান নয়। ওঁর ড্রাইভার অসুস্থ। তাই তাকে দেখে এলেন।

কোথায় ডিফেন্স মিনিস্টার আর কোথায়, একজন সামান্য ড্রাইভার! কিন্তু কৃষ্ণ মেননের কাছে এই সামান্য ড্রাইভারও যে সহকর্মী ছিলেন। আশেপাশের সাধারণ মানুষের জন্য সমবেদনা ও ভালবাসা ছিল নেহরুর, রাজেন্দ্রপ্রসাদের, লালবাহাদুর ও জাকির হোসেনের। আর আছে চ্যবনের।

ফকরুদ্দীন আলি আমেদ যখন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী ছিলেন, তখন তার কাছে এক একটা ফাইল পড়ে থাকত তিন-চার মাস। মেনন ছিলেন ঠিক এর বিপরীত। ফাইল আসার আধ-ঘণ্টা-এক ঘন্টার মধ্যেই তা ফেরৎ চলে যেত। উনি আশা করতেন, সবাই এই ভাবে কাজ করবে।

একদিন মেননের অফিসে বসে আছি। পাঁচটা বাজার পাঁচ-সাত মিনিট আগে আর্মি হেড কোয়ার্টার্সের QMG লেঃ জেনারেল কোচার এলেন একটা ফাইল নিয়ে। সামান্য সময় আলোচনার পরই দেশরক্ষা মন্ত্রী ফাইলে সই করে বললেন, তাড়াতাড়ি অর্ডারটা ইস্যু করার ব্যবস্থা করুন।

লেঃ জেনারেল কোচার বললেন, হ্যাঁ স্যার, কাল সকালে অফিসে এসেই অর্ডারটা ইস্যু করে দেব।

কৃষ্ণ মেনন চট করে ঘড়ি দেখেই বললেন, হোয়াই টুমরো? এখান থেকে আপনার ঘরে যেতে লাগবে পনেরো সেকেণ্ড। চেয়ারে বসতে লাগবে আরো পনেরো সেকেণ্ড। সই করতে লাগবে পাঁচ সেকেণ্ড। এবার হেসে বললেন, এ সব করেও আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে দুএক মিনিট আগেই পৌঁছতে পারবেন।

লেঃ জেনারেল কোচার হাসতে হাসতে বললেন, স্যার, আই এ্যাম ইস্যুয়িং দ্য অর্ডার রাইট নাউ।

থ্যাঙ্ক ইউ!

কোচার এক পা পিছিয়ে স্যালুট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এই ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। ওঁর এই কাজের নেশা ও গতির জন্যও উনি বহুজনের কাছে অপ্রিয় ছিলেন।

নিত্য নতুন বই ও আধুনিক খেলনা মেনন নিয়মিত কিনতেন। সব সময় নিজে বইয়ের দোকানে গিয়ে বই দেখেই পছন্দ মত বই কিনতেন। অধিকাংশ বইই কিনতেন সান্তাক্রুজ এয়ারপোর্টের বইয়ের দোকানে। ঝড়ের বেগে দোকানে ঢুকে দু-এক মিনিটের মধ্যে দশ-পনেরোখানা বই শেলফ থেকে নামিয়ে নিয়েই দৌড়ে প্লেনে উঠতেন।

দাম? দাম দেবার সময় কোথায়? সঙ্গে যে পার্সোন্যাল স্টাফ থাকতেন তিনি প্লেন থেকে বইগুলি নামিয়েই নাম আর দাম লিখে রাখতেন এবং পরের দিনই চেক চলে যেত ঐ দোকানে।

কৃষ্ণ মেননের ঘর ভর্তি বই আর সুন্দর সুন্দর খেলনা ছিল। ঐসব খেলনা নিয়ে খেলা করেই মেনন তাঁর অবসর বিনোদন করতেন। বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের বাচ্চারা এলে শেলফ থেকে সব খেলনা নামিয়ে তাদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতেন। এবং নিজের রোজগারের সিকিভাগ বাচ্চাদের চকোলেট ও খেলনা কিনে দিতেই খরচ করতেন।

ছোটখাট ও মজার দু-একটি ঘটনা লিখেই কৃষ্ণ মেননের ওপর যবনিকা টানব।

কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে কলকাতা এসেছি। অন্যান্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে উনি আমার কাগজের অফিসেও যাবেন। সকালবেলার এক অনুষ্ঠানের শেষে অতিথিরা চা খাচ্ছেন। হঠাৎ একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার কৃষ্ণ মেননের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, আপনি কী বিকেলে পত্রিকার অফিসে যাবেন?

ইয়েস আই উইল গো দেয়ার।

কিন্তু স্যার, মনে হয় ওখানে না যাওয়াই ভাল।

দপ করে জ্বলে উঠলেন কৃষ্ণ মেনন, ডু ইউ থিংক ডিফেন্স মিনিস্টার অব ইণ্ডিয়া সুড এ্যাক্ট অন ইওর এ্যাডভাইস?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *