বিজ্ঞানী
4. একজন বিজ্ঞানী এবং তার গবেষণা প্রক্রিয়া
1885 সালের জুলাই মাসের চার তারিখ ফ্রান্সের একটি ছোট শহরে জোসেফ মাইস্টার নামের নয় বছরের একটা বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিশাল এক কুকুর এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাচ্চাটিকে কুকুরটা সম্ভবত মেরেই ফেলতো, কাছাকাছি একজন মানুষ দেখতে পেয়ে কোনোমতে একটা লোহার রড দিয়ে কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চাটার প্রাণ রক্ষা করল। আপাতত বাচ্চাটির প্রাণ রক্ষা হলো সত্যি কিন্তু বাচ্চাটির জন্যে যে ভয়ংকর একটা দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। এই পাগল কুকুরটা ভয়ংকর র্যাবিজ বা জলাতঙ্কে ভুগছে, বাচ্চাটাকে যেভাবে আচড়ে কামড়ে কামড়ে ছিন্ন ভিন্ন করেছে তাতে বাচ্চাটিও যে এই রোগে মারা যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 1885 সালে জলাতঙ্কের চিকিৎসা ছিল না, এটি যে একটা ভাইরাস বাহিত রোগ সেটাও কেউ জানত না। এখনকার মানুষ যেমন জানে, তখনকার মানুষও জানত র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক রোগের মুত্যু থেকে ভয়ংকর কোনো মৃত্যু হতে পারে না। জ্বর দিয়ে শুরু হয়, অস্বাভাবিক এক ধরনের বিষণ্ণতা ভর করে সেটা পাল্টে যায় অনিয়ন্ত্রিত এক ধরনের উত্তেজনায়। গলার মাংসপেশীতে এক ধরনের খিচুনি শুরু হয়, মুখ থেকে ফেনা বের হতে শুরু করে। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে চায় কিন্তু এক বিন্দু পানি খেলেই খিচুনি শুরু হয়ে যায়। শেষের দিকে পানি খেতে হয় না, পানি দেখলেই উন্মত্ত এক ধরনের খিঁচুনি ভর করে। চার-পাঁচ দিন পর যখন জলাতঙ্ক রোগীর মৃত্যু হয় সেটাকে সবাই তখন আশীর্বাদ হিসেবেই নেয়।
জোসেফ মাইস্টারের মা তার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে বললেন, তার কিছু করার নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে বাচ্চাটাকে প্যারিসে লুই পাস্তুরের কাছে নেয়া যেতে পারে। সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই মানুষটিই যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে বাচ্চাটার জীবন রক্ষা করতে পারেন, শুধু তাহলেই বাচ্চাটি বাঁচতে পারে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র সেটি হচ্ছে লুই পাস্তুর কোনো ডাক্তার নন, তিনি একজন রসায়নবিদ। তার বয়স তখন তেষট্টি, স্ট্রোকে শরীরের অর্ধেক অবশ। জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছে গেছেন কিন্তু তখনও সারা দেশের মানুষের তার ক্ষমতার উপর অগাধ বিশ্বাস!
লুই পাস্তুর খুব বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বলা যায়, তাকে দিয়ে মাইক্রোবায়োলজি বা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের শুরু হয়েছে। জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব তার চাইতে ভালো করে কেউ জানে না কিন্তু তিনি এখন ভাইরাস নামের একটি অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে এসেছেন যেটা তখনো কেউ চোখে দেখে নি। বসন্ত রোগ বা জলাতঙ্ক রোগের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরেছেন কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়েও সেটাকে দেখতে পাওয়া যায় নি।
1880 সালে যখন লুই পাস্তুর তার অর্ধেক অবশ শরীর নিয়ে র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক রোগের উপর গবেষণা শুরু করেছেন, তখন এটি সম্পর্কে মাত্র তিনটি বিষয় জানা ছিল, এক : র্যাবিজ আক্রান্ত পশুর লালায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে, দুই : পশুর কামড়ে ক্ষতস্থান তৈরি হলে এই রোগের সংক্রমণ হয় এবং তিন : সংক্রমণের পর কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পরে এই রোগের উপসর্গগুলো দেখা যায়। এর বাইরে পুরোটাই একটা রহস্য।
লুই পাস্তুর খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমেই চেষ্টা করলেন জলাতঙ্কের কারণটি আলাদা করতে। একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে হলে তার রোগীর প্রয়োজন তাই লুই পাস্তুরের প্রথম কাজ হলো নিয়ন্ত্রিতভারে পশুদের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ করানো। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে র্যাবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে দেখা গেল এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তা ছাড়া, সেটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। একটা পশুর মাঝে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত আক্রান্ত করার একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।
লুই পাস্তুর চিন্তা করতে লাগলেন, রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয় এটি স্নায়ুর রোগ, মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ আছে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা না নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেশান দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। তাহলে কী হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং সুই পাস্তুর আবিষ্কার করলেন তার ধারণা সত্যি। সরাসরি পশুর মস্তিস্কে ইনজেকশান দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্যভাবে দ্রুত তিনি পশুকে র্যাবিজ রোগে আক্রান্ত করিয়ে দিতে পারছেন। এখন তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দিতে পারেন, রোগের কারণটিকে আলাদা করে বের করা।
এখানে এসে তিনি যেন এক শক্ত পাথরের দেয়ালের মাঝে ধাক্কা খেলেন। কিছুতেই এই অদৃশ্য কারণকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একটা ব্যাক্টরিয়াকে কৃত্রিম পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, বংশবৃদ্ধি বা কালচার করা যায় কিন্তু এই অদৃশ্য পরজীবী প্রাণটিকে কোনোভাবেই ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। লুই পাস্তুর আবার খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো ভাবলেন যদি তাকে কৃত্রিম অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা না-ই যায় তাকে তাহলে জীবন্ত কোথাও বাঁচিয়ে রাখা হোক। সেই জীবন্ত অংশটুকু হলো খরগোশের মস্তিষ্ক। আবার লুই পাস্তুরের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো, খরগোশের মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য জীবাণু শুধু বেঁচে থাকে না আরও ভয়ংকর আরও সর্বনাশী হয়ে উঠে, ছয়দিনের মাঝে এই রোগ তার সর্বগ্রাসী উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয়।
লুই পাস্তুর এখন গবেষণার শেষ ধাপে এসে পৌঁচেছেন, এমন একটা প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যেটা দিয়ে এই রোগের প্রতিষেধক বের করা যায়। একদিন ল্যাবরেটরিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দেখলেন তার একজন সহকারী জলাতঙ্ক আক্রান্ত একটা খরগোশের স্পাইনাল কর্ড কাচের ফ্লাস্কে ঝুলিয়ে রেখেছেন, কতদিন এই ভয়ঙ্কর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে সেটাই হচ্ছে পরীক্ষার উদ্দেশ্য। লুই পাস্তুর কাচের ফ্লাস্কের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন, কিছুদনি আগেই মোরগের কলেরা রোগের ব্যাক্টেরিয়াকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করে ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখানেও সেটি কি করা যায় না? যে অদৃশ্য জীবাণুকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু যার অস্তিত্ত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ নেই সেটাকে কী দুর্বল করে এর প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।
পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবহারিক বিজ্ঞানী তখন কাজে লেগে গেলেন। খরগোশের স্পাইনাল কর্ডে বেঁচে থাকা জীবাণুকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করতে লাগলেন। প্রতিদিন সেখান থেকে একটা অংশ নিয়ে সেটাকে গুড়ো করে সুস্থ খরগোশের মাথার ইনজেকশন দিতে শুরু করলেন। যতই দিন যেতে লাগল এই ভয়ংকর জীবাণু ততই দুর্বল হতে শুরু করল, বারোদিন পর জীবাণু এত দুর্বল হয়ে গেল যে, সেটা সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণ করতেই পারল না!
এখন আসল পরীক্ষাটি বাকী, এই প্রক্রিয়ায় সত্যিই কি জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব? লুই পাস্তুর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। একটা কুকুরের মস্তিষ্কে প্রথমে বারো দিনের দুর্বল জীবাণু প্রবেশ করানো হলো। তারপর দিন এগারো দিনের জীবাণু তারপর দিন দশ দিনের জীবাণু। এভাবে প্রত্যেক দিনই আগের থেকে একটু বেশি ভয়ংকর জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। বারো দিনের দিন একেবারে খাঁটি টগবগে জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেয়া হলো। কিন্তু এতদিনে কুকুরটির দেহে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর জীবাণু নিয়েও সেটি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল। লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন তবে মানুষের জন্যে নয় পশুর জন্যে।
ঠিক এ-রকম সময়ে নয় বছরের জোসেফ মাইস্টারকে নিয়ে তার মা এলেন লুই পাস্তুরের কাছে, আকূল হয়ে লুই পাস্তুরকে বললেন তার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। লুই পাস্তুর খুব চিন্তার মাঝে পড়ে গেলেন, নয় বছরের এই বাচ্চাটির শরীরে নিশ্চিতভাবেই জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু ঢুকে গেছে, একজনের শরীরে জীবাণু ঢোকার পর তার শরীরে কী প্রতিষেধক তৈরি করা যাবে? যে প্রক্রিয়া কখনো কোনো মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয় নি সেটি কি একটা শিশুর শরীরে পরীক্ষা করা যায়? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি পরীক্ষাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে দুই সপ্তাহ পরানো জীবাণু তারপর তেরো দিনের তারপর বারো দিনের। এভাবে যতই দিন যেতে লাগল ততই আগ্রাসী জীবাণু বাচ্চাটির শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। একেবারে শেষ দিন তার শরীরে জলাতঙ্ক। রোগের যে জীবাণু ঢোকানো হলো সেটি অন্য যে কোনো পশু বা মানুষকে এক সপ্তাহের মাঝে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে! সেই সময়টা সম্ভবত ছিল লুই পাস্তুরের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় তিনি খেতে পারেন না, ঘুমাতে পারেন না। লুই পাস্তুরের মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছেলেটি কি বাঁচবে না মারা যাবে?
ছেলেটি মারা যায় নি। লুই পাস্তুরের চিকিৎসায় পৃথিবীর প্রথম জলাতঙ্ক রোগীটি বেঁচে উঠল। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লুই পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় অবদানটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে!
জোসেফ মাইস্টার তার প্রাণ বাঁচানোর কারণে সারা জীবন লুই পাস্তুরের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। সে বড় হয়ে লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরির দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব নিয়েছিল। নাৎসি জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন নাৎসি বাহিনী লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরি দখল করতে আসে। জোসেফ মাইস্টার গেটের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে ল্যাবরেটরি রক্ষা করার চেষ্টা করে।
জার্মান সেনাবাহিনীর গুলিতে জোসেফ মাইস্টারের মৃত্যু হওয়ার আগে সে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেয় নি।
.
5. একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা
1992 সালের 31 অক্টোবর, পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। সবাই নিশ্চয়ই এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইবে গ্যালিলিও একজন বিজ্ঞানী মানুষ, তিনি কী এমন অপরাধ করেছিলেন যে ক্যাথলিক চার্চের তাকে শাস্তি দিতে হয়েছিল? আর শাস্তি যদি দিয়েই থাকে তা হলে তাকে ক্ষমা করার প্রয়োজনটাই কী? আর ক্ষমা যদি করতেই হয় তাহলে তার জন্যে সাড়ে তিনশত বৎসর অপেক্ষা করতে হলো কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরগুলোও প্রশ্নের মতোই চমকপ্রদ। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বলেছিলেন পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যকে ঘিরে ঘুরে। ক্যাথলিক চার্চের মনে হয়েছিল সেটা বাইবেল বিরোধী বক্তব্য এবং সেজন্যে তারা গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়েছিল!
এখন আমরা খুব সহজেই স্বীকার করে নিই যে পৃথিবীটা চ্যাপ্টা নয়, পৃথিবীটা গোল। যদিও দেখে মনে হয় চাঁদ সূর্য গ্রহ তারা পূর্বদিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যায় আসলে সে-রকম কিছু ঘটে না, পৃথিবীটা নিজ অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে আমাদের সে-রকম মনে হয়। শুধু তাই নয় যদিও আমরা দেখছি পৃথিবীটা স্থির সূর্যটাই উঠছে এবং নামছে আসলে সেটা সত্যি নয়। বিশাল সূর্যটাকে ঘিরেই ছোট পৃথিবীটা ঘুরছে। কিন্তু একসময় সেটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করাও একটা ভয়ংকর রকমের অপরাধ ছিল।
আসলে ঝামেলেটি পাকিয়ে রেখেছিলেন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতো দার্শনিক আর গণিতবিদরা। তারা বিশ্বাস করতেন পৃথিবীটাই সবকিছুর কেন্দ্র এবং সবকিছুই পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। তারা সেই সময় এত মহাজ্ঞানী ছিলেন যে, কেউ তাদের মতবাদকে অবিশ্বাস করেন নি। মোটামুটি সেই সময়েই অ্যারিস্টকাস নামে একজন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন যে, পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে কিন্তু কেউ তার কথাটাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয় নি।
অ্যারিস্টটল আর টলেমির ভুল ধারণা পৃথিবীর মানুষ প্রায় আঠারোশত বৎসর পর্যন্ত বিশ্বাস করে বসেছিল। টলেমির ব্যাখ্যাটি ছিল জটিল, যারা আকাশ-গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন তাদের কাছে গ্রহগুলোর গতিবিধি ব্যাখ্যা করাটি ছিল সবচেয়ে কষ্টকর। এই ভুল ধারণাটি প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন কোপার্নিকাস। তিনি দেখালেন যদি পৃথিবীর বদলে সূর্যকে কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে দেয়া যায় তাহলে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি ব্যাখ্যা করা হয়ে যায় একেবারে পানির মতো সহজ। সবকিছু ব্যাখ্যা করে কোপার্নিকাস তার বইটি লিখেছিলেন 1530 সালে কিন্তু সেই বইটি প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। অনেক ভয়ে ভয়ে বইটি ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয় 1543 সালে। কথিত আছে বইটি যখন কোপার্নিকাসের কাছে আনা হয় তখন তিনি সংজ্ঞাহীন এবং মৃত্যুশয্যায়।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বইটি প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, বইটির প্রকাশক কোপার্নিকাসের অনুমতি নিয়েই বইয়ের ভূমিকায় লিখে দিয়েছেন যে এই বইয়ে যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্যি নয়। গণনার সুবিধার জন্যে এটি একটি বিকল্প পদ্ধতি, এর সাথে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই! ধর্মযাজক এবং চার্চকে ভয় পেয়েই এই কাজটি করা হয়েছিল সেটি বলাই বাহুল্য। কোপার্নিকাসের এই জগদ্বিখ্যাত আবিষ্কারটি কিন্তু সবার চোখের অগোচরেই রয়ে গিয়েছিল দুটি কারণে প্রথমত, বিষয়বস্তুটি এত অবিশ্বাস্য যে, সেটা কেউই বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোপার্নিকাস বইটি লিখেছিলেন ল্যাটিন ভাষায় এবং ল্যাটিন তখন জানত খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। গ্যলিলিওর কারণে কোপার্নিকাসের মৃত্যুর 73 বছর পরে তার বইটির দিকে প্রথমে সবার নজর পড়ে এবং ক্যাথলিক চার্চ সাথে সাথে 1616 সালে বইটাকে নিষিদ্ধ করে দেয়। এই যুগে আমরা রাজনৈতিক কারণে বা অশ্লীলতার কারণে বইকে নিষিদ্ধ হতে দেখেছি কিন্তু প্রচলিত বিশ্বাসকে আঘাত করেছে বলে বই নিষিদ্ধ করার বিষয়টি তখন এমন কিছু বিস্ময়কর ছিল না।
গ্যালিলিওর জন্ম হয় 1558 সালে এবং মৃত্যু হয় 1642 সালে–যে বৎসর নিউটনের জন্ম হয়। আধুনিক বিজ্ঞানকে যারা গড়ে তুলেছিলেন তাদের মাঝে গ্যালিলিও ছিলেন অন্যতম। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের সাথে সাথে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানেও খুব আগ্রহ ছিল। তখন টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু এর গুরুত্বটি কেউ ধরতে পারে নি, দূরের জিনিসকে কাছে দেখার একটা মজার খেলনা ছাড়া এর আর কোনো গুরুত্ব ছিল না। গ্যালিলিও যখন জানতে পারলেন টেলিস্কোপ বলে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে যেটা দিয়ে দূরের জিনিস কাছে দেখা যায় তখনই তিনি বুঝে গেলেন ওটার সত্যিকার ব্যবহার কী হতে পারে। অনেক খাটাখাটুনি করে তিনি একটা টেলিস্কোপ তৈরি করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখা শুরু করলেন। তিনি চাঁদের খানাখন্দ দেখলেন, বৃহস্পতির চাঁদ দেখলেন, শুক্রের কলা দেখলেন, এমনকি সূর্যের কলঙ্কও দেখলেন। (গ্যালিলিও তখন জানতেন না সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো যায় না, সূর্যের আলোতে খালি চোখে দেখা যায় না সে রকম অতিবেগুনী রশ্মি থাকে। তাই সূর্য পর্যবেক্ষণের কারণে জীবনের শেষভাবে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।) টেলিস্কোপকে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তিনি যে সব জিনিস দেখেছেন সেগুলো নিয়ে তিনি 1610 সালে একটা বই লিখলেন। এই বইটিতে আসলে কোপার্নিকাসের মতবাদকে সমর্থন করা হয়েছিল এবং এতদিন যে কোপার্নিকাসের কথা কেউ জানত না, গ্যালিলিওর কারণে সেটি সবাই জানতে পারল। যার পরিণাম হলো ভয়াবহ। কোপার্নিকাসের বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং গ্যালিলিওকে বলা হলো তিনি যেন এইসব মতবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।
সেই যুগে ওরকম একটা বই লেখা ছিল খুব সাহসের কাজ। তিনি যখন তার বইটি প্রকাশ করেছেন তার মাত্র দশ বৎসর আগে জিওদানো ব্রুনো নামে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ব্রুনোর অপরাধ তিনি কোপার্নিকাসের মতবাদ বিশ্বাস করতেন। ব্রুনোকে তার বিশ্বাসের জন্যে প্রথমে আট বৎসর জেলে আটকে রাখা হয়েছিল এবং পুড়িয়ে মারার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ব্রুনোকে চাপ দেয়া হয়েছিল তিনি যেন কোপার্নিকাসের মতবাদকে ত্যাগ করে বাইবেলের মতবাদে ফিরে আসেন। ব্রুনো রাজি হন নি। শুধু যে রাজি হন নি তা-ই নয় বিচারকদের দিকে তাকিয়ে শ্লেষভরে বলেছিলেন, “বিচারক মহোদয়রা আমাকে শাস্তি দেয়ায় আমি যেটুকু ভয় পাচ্ছি আপনারা মনে হয় তার থেকে অনেক বেশি ভয় পাচ্ছেন!” (গ্যালেলিওকে ক্ষমা করলেও ব্রুনোকে কিন্তু ক্যাথলিক চার্চ এখনও ক্ষমা করে নি!)
এ-রকম একটা পরিবেশে কোপার্নিসাকের মতবাদ প্রচার করা খুব সাহসের ব্যাপার। তবে চার্চ নিষেধ করে দেয়ার কারণে গ্যালিলিও কয়েক বছর একটু চুপচাপ থাকলেন। তখন তার এক পুরানো বন্ধু পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন, গ্যালিলিও ভাবলেন এটাই তার সুযোগ। তিনি তখন আরেকটা বই লিখলেন, বইটি তিনজন মানুষের কথোপকথন হিসেবে লেখা, একজন টলেমির মতবাদ বিশ্বাস করে (পৃথিবী হচ্ছে সৌরজগতের কেন্দ্র), আরেকজন কোপার্নিকাসের মতবাদ বিশ্বাস করে (সূর্য হচ্ছে সৌর জগতের কেন্দ্র) এবং তৃতীয় জন একজন নিরপেক্ষ মানুষ। (আমাদের সৌভাগ্য আজকাল বিজ্ঞানের বই এভাবে আলাপচারিতা হিসেবে লিখতে হয় না। যেটা সত্যি সেটা কাটখোট্টা ভাষায় লিখলেও জার্নালগুলো ছাপিয়ে দেয়।) গ্যালিলিওর এই বইটি লেখা হয় ইতালীয় ভাষায়, বইয়ে কোপার্নিকাসের সমর্থকের তুখোড় যুক্তির কাছে টলেমির সমর্থক বারবার অপদস্ত হয় এবং এই বইটির কারণে গ্যালিলিও ধর্মযাজকদের বিষ নজরে পড়লেন।
1633 সালে ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে ধর্মোদ্রোহিতার অভিযোগ দিয়ে ডেকে পাঠাল। গ্যালিলিও তখন বৃদ্ধ, প্রায় অন্ধ। এই বৃদ্ধ জ্ঞান তাপসকে তিনদিন একটি টর্চার সেলে অত্যাচার করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত হাঁটু ভেঙে জোড় হাতে মাথা নিচু করে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। পোপ এবং ধর্মযাজকদের সামনে তিনি যে লিখিত বক্তব্য পড়েন সেটি ছিল এরকম:
“আমি ফ্লোরেন্সবাসী স্বাৰ্গীয় ভিন্সেজিও গ্যালিলিওর পুত্র সত্তর বৎসর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলি, সশরীরে বিচারের জন্যে এসেছি এবং বিখ্যাত ও সম্মানিত ধর্মযাজক এবং ধর্মবিরুদ্ধ আচরণের অপরাধে অপরাধী। হয়ে বিচারকদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ। করে শপথ করেছি যে, রোমের পবিত্র ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম সংস্থার দ্বারা যা কিছু শিক্ষাদান এবং প্রচার করা হয়েছে আমি তা বিশ্বাস করি, আগেও করেছি, ভবিষ্যতেও করব।
আমাকে বলা হয়েছিল সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রস্থল এই মতবাদটি মিথ্যা এবং ধর্মগ্রন্থ বিরোধী, আমাকে এই মতবাদ সমর্থন এবং প্রচার থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছিল।
তারপরেও আমি এই মতবাদকে সমর্থন করে একটি বই লিখেছিলাম এবং সঙ্গত কারণেই সাধারণের মনে সন্দেহ হতে পারে আমি খ্রিস্টধর্ম বিরোধী। সকলের মন থেকে সন্দেহ দূর করার জন্যে আমি শপথ করে বলছি যে এই ভুল, মিথ্যা এবং ধর্মবিরুদ্ধ মত ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করছি। আমি আরও শপথ করে বলছি যে, এ ধরনের বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যতে কিছু বলব না। শপথ নিয়ে আরও প্রতিজ্ঞা করছি আমাকে প্রায়শ্চিত্যের জন্যে যে নির্দেশ দেয়া হবে আমি সেটা হুবহু পালন করব। আমি যদি এই শপথ আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি তাহলে আমার জন্যে যে সব নির্যাতন এবং শাস্তির ব্যবস্থা আছে আমি তা মাথা পেতে গ্রহণ করব।”
পৃথিবীর ইতিহাসে একজন বিজ্ঞানী এবং তার বিজ্ঞানচর্চার উপর ধর্মীয় মৌলবাদের এর চাইতে বড় নির্যাতনের আর কোনো উদাহরণ আছে বলে জানা নেই। ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। তবে তার বয়স, স্বাস্থ্য এসবের কথা বিবেচনা করে আমৃত্যু নিজের ঘরে আটকে রাখা হয়। তার বইটিও নিষিদ্ধ ঘোষণার করা হয় এবং 1835 সালের আগে সেই বইটি আর নূতন করে ছাপা হয় নি। শুধু তাই নয় গ্যালিলিওর মৃত্যুর পর তাকে মর্যাদার সাথে সমাহিত না করে খুব সাদাসিধেভাবে কবর দেয়া হয়।
মহামতি গ্যালিলিও গ্যালিলির প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল সেটি বুঝতে ক্যাথলিক চার্চের সময় লেগেছিল মাত্র সাড়ে তিনশত বৎসর। পৃথিবীর কত বড় বড় মনীষীর হাঁটুর সমান মেধা নিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের লেবাস পরে তাদের উপর নিপীড়ন করার উদাহরণ শুধু যে ক্যাথলিক চার্চে ছিল তা নয় অন্য ধর্মেও ছিল। শুধু যে অতীতে ছিল তাই নয় এখনও আছে।
পছন্দের একটি সাইট..বার বার এখানে ফিরে আসি.. ভালো লাগে আপনাদের নতুন ও পুরনো বই এর সংগ্রহ..
বইটি এখানে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।