বিকেলের দিকে বৃষ্টি বেশ জোরে এল। ঠিক পাঁচটার পর। এর নাম অফিস-ভাঙা বৃষ্টি। মধ্য কলকাতার বড়ো বড়ো বাড়িগুলো থেকে পিলপিল করে বেরোচ্ছে মানুষ, এই সময় উঁচু থেকে দেখলে মনে হবে ঠিক যেন একটা পিঁপড়ে-নগরী। ঝমঝম বৃষ্টির জন্য কেউ পথে নামতে পারছে না, গাড়ি-বারান্দার তলাগুলো জমজমাট। একটু পরে অন্ধকার নামবে, সিনেমাগুলো ভাঙবে, তখন ট্রাম-বাসে মানবসভ্যতা কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে থাকবে।
নিশানাথ প্রতিদিন হেঁটেই বাড়ি ফেরেন। শুধু ট্রাম-বাসের পয়সা বাঁচানোর জন্যই নয়। তাঁর হাঁটার নেশা। বছরে পাঁচ-শো মাইল হাঁটলে নাকি মানুষের হৃদরোগ হয় না। নিশানাথ তার তিনগুণ পথ হেঁটে পাড়ি দেন। এবং তাঁর হৃৎপিন্ডে এখনও যা শক্তি, তাতে একসঙ্গে বোধ হয় তিন চারজন মানুষকে চালাতে পারে।
নিশানাথের বিশাল দেহ, বড়ো বড়ো পা ফেলে তিনি হাঁটছেন। জল-কাদার জন্য ধুতিটা একটু তুলে ধরতে হয়েছে, এজন্য তিনি একটু বিরক্ত। ভুরু দুটো কুঁচকে আছে। নিশানাথের পছন্দ-অপছন্দ অত্যন্ত জোরালো। বিকেল বেলার বৃষ্টি তাঁর পছন্দ হয়নি, সেই জন্যই যেন তাঁর অধিকার আছে আকাশের ওপর রাগ করার। দুপুরে যেমন তিনি রেগে গিয়েছিলেন সমগ্র উকিল জাতির ওপর।
দুপুরে তাঁকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে যেতে হয়েছিল। মাঝেমাঝেই যেতে হচ্ছে। বাড়িওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য মামলা করেছে। উকিলদের কাজই হল তারিখ ফেলা। ভাবগতিক দেখে মনে হয়, আদালতে কোনোদিন কোনো মামলার নিষ্পত্তি হয় না। নিশানাথ চান হাকিমের সামনে নিজে দাঁড়িয়ে স্পষ্টগলায় বলবেন, যেকোনো নতুন বাড়ি নিতে গেলেই অন্তত তিনগুণ ভাড়া বাড়বে। সেই টাকা তিনি পাবেন কোথায়? তাঁর কী তিনগুণ আয় বেড়েছে? কিন্তু উকিলরা তাঁকে কিছুতেই এই সোজাকথাটা বলতে দেবে না।
বাড়িওয়ালা যদি আগেকার দিনের মতন কয়েকজন লাঠিয়াল পাঠাতো, তাহলে নিশানাথ তাদের সঙ্গে লড়ে গিয়ে নিজের দখল বজায় রাখতে পারতেন। সেটাই তাঁর পক্ষে সুবিধেজনক। তার বদলে এই আইন-আদালত তাঁর ধাতে সয় না। তবু এই কাজও তাঁকেই করতে হবে। ছেলেদের দ্বারা তো কিছু হয় না।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে প্রায় হাঁটুসমান জল। আটকে গেছে কয়েকটা গাড়ি। ইজের পরা কালো কালো ছেলেরা লাফাচ্ছে, সেই গাড়িগুলোকে ঘিরে। তিনটি কলেজের ছাত্রী শাড়ি ভিজিয়ে হাঁটছে ছপছপ করে। তারা বিরক্ত নয়, এই জলেও খুশি। তাদের পেছনে পেছনে তিনজন যুবক। তারা মুগ্ধ হয়ে দেখছে ভিজে শাড়িতে নিতম্বদেশের ছন্দ।
একটা বাচ্চাছেলে দৌড়ে যেতেই খানিকটা জল লাগল নিশানাথের গায়ে। নিশানাথ ধমকে উঠলেন, এই!
যেন বাঘ ডাকল। ছেলেটা কেঁপে উঠল একেবারে। নিশানাথ ক্রুদ্ধভাবে ছেলেটার ঘাড় ধরলেন। মনে হল, টুঁটি চেপে মেরেই ফেলবেন। কিন্তু কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন শুধু, তারপর ঠাণ্ডাভাবে বললেন, ওরকম করিস না, যা!
হঠাৎ হঠাৎ রাগে মাথায় রক্ত উঠে আসে। বয়েস হয়েছে প্রায় চুয়ান্ন, এখন এতটা রাগ করা উচিত নয়। নিশানাথ সবসময় নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া শহরে এতবেশি রাগ করার জিনিস আছে!
বউবাজার পেরোবার সময় একটা ট্যাক্সি জলে ঢেউ তুলে নিশানাথের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একজন ডাকল, নিশি!
অদূরে গিয়ে ট্যাক্সিটা থামল। নিশানাথ কাছে এগিয়ে এলেন। ট্যাক্সিতে বসে আছে দেবেন। অনেকদিন পর দেখা।
দেবেন বললেন, শ্যামবাজারের দিকে যাবি? উঠে পড়।
নিশানাথ বললেন, না, আমি কাছেই যাব। তুই যা।
দেবেন বললেন, আমি এয়ারপোর্টে যাচ্ছি, তুই উঠে আয়, কথা বলা যাবে একটু।
দেবেনের পাশে দুটি স্ত্রীলোক বসে আছে। নিশানাথ সে-দিকে একবার আড়চোখে তাকালেন। তারপর গাড়িটা ঘুরে এলেন সামনে ড্রাইভারের পাশে বসবার জন্য।
কিন্তু গাড়িটা আর স্টার্ট নিল না। ড্রাইভার বিরক্তিসূচক কী যেন বলল। জলের মধ্যে গাড়ি থামানোর সত্যি ঝুঁকি আছে। দেবেন অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললেন, সে কী, গাড়ি চলছে না? আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিট—তারপর প্লেন ছেড়ে যাবে।
নিশানাথ হেসে ফেললেন। এতক্ষণে তাঁর বিরক্তি কেটে গেছে। মানুষের এই ধরনের অস্থিরতা দেখতে তাঁর ভালো লাগে। তিনি লঘুভাবে বললেন, আমাকে ডাকতে গেলি কেন? সেইজন্যই তো এ-রকম হল।
দেবেন বললেন, যতবার তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে, ততবারই একটা-না-একটা বিপদ হয়েছে আমার।
সে-কথা মনে থাকে না কেন?
নিশানাথ এক হাত দিয়ে গাড়িটা ঠেলতে লাগলেন। গাড়ি সেইভাবেই চলতে লাগল, স্টার্ট নেওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। নিশানাথ ঠেলেই চললেন, যেন তিনি ঠেলতে ঠেলতেই গাড়িটাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবেন।
একটু জল কমার পর ড্রাইভার নেমে এসে গাড়ির হুড খুলল। তারপর খবরের কাগজ জ্বেলে সেঁক দিতে লাগল কারবুরেটারে।
নিশানাথ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস?
অসমে। জরুরি কাজ আছে।
তোর তো সবসময়ই জরুরি কাজ থাকে।
তা থাকে। তোর মতন শান্তিতে থাকতে পারলাম কোথায়? নিশানাথ স্ত্রীলোক দু-টির দিকে আবার তাকালেন। উগ্র সাজপোশাক। তাঁর একটু সন্দেহ হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি বিয়ে করেছিস শেষপর্যন্ত?
দেবেন বিরক্তভাবে বললেন, কেন, বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে? তোদের মতন ছেলেপুলে, নাতিপুতি নিয়ে একটা নেটিপেটি জীবন কী আমার সহ্য হবে?
দেবেন সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতে নিশানাথ হাত নেড়ে বললেন, না। তিনি যে সিগারেট খান না, সে-কথা দেবেনের মনে নেই। কতদিন দেবেনের সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসে কথা হয় না। শুধু রাস্তায়-ঘাটে দেখা। অথচ একসময়, মনে হয় যেন কয়েক যুগ আগে, নিশানাথ আর দেবেন একখাটে শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন।
মণীশের খবর পেয়েছিস?
আমি তার খবর রাখতেও চাই না।
দেবেন একটু হেসে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পুরোনো বন্ধুর বাহু ছুঁয়ে বললেন, তোর মতন গোঁয়ারগোবিন্দ লোকরা পৃথিবীতে চিরকালই কষ্ট পায়।
নিশানাথ বললেন, আমি কষ্ট পাচ্ছি বুঝি? তুই তো সুখে আছিস?
নিশ্চয়ই!
তাহলেই হল!
তুই যদি তখন আমার কথা শুনতিস।
চলি!
গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে মনে হচ্ছে। তুই উঠবি না?
না।
আর কিছু না বলে নিশানাথ চলে গেলেন ফুটপাথের দিকে। কুলটা স্ত্রীলোকদের সঙ্গে তিনি এক গাড়িতে বসেন না। কিন্তু দু-জন কেন? সমবয়সি দু-টি মেয়েকে একসঙ্গে নিয়ে দেবেন
কী করছে?
ট্যাক্সিটা চলে যাওয়ার পরও নিশানাথ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের জীবনের সঙ্গে দেবেনের জীবনের একটু তুলনা না করে পারলেন না। তাঁর মনে হল, দেবেন একটা অর্থহীন জীবন কাটাচ্ছে। এ-রকম মানুষের বেঁচে থাকা, না-থাকা সমান কথা। তবু নিশানাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দেবেনের জন্য না নিজের জন্য ঠিক বোঝা গেল না।