০২. বাড়ির নাম নীলা হাউস

বাড়ির নাম নীলা হাউস।

বিনয় করে নাম রাখা হয়েছে হাউস। প্যালেস হলে মানাত। না, প্যালেস মানাত না। প্যালেসে প্রকাশ্য ব্যাপার থাকে। প্যালেস মানে দর্শনীয় কিছু। লোকজন দেখবে, অভিভূত হবে। এ বাড়ি বাইরে থেকে দেখা যায় না। তের ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে বাড়ি ঘেরা। পাঁচিলের উপর আরো দুই ফুট ঘন করে কাটাতারের বেড়া। বাড়ির গেট লোহার। সাধারণত গেটের ফোঁকর দিয়ে বাড়ির খানিকটা দেখা যায়। এ বাড়ি গেটটি নিশ্চিদ্র লোহার। লখিন্দরের সূতা-সাপের ঢোকার ব্যবস্থাও নেই।

গেট পেরিয়ে কোনক্রমে ঢুকতে পারলে–কি সুন্দর বলে একটা চিৎকার দিতেই হবে। কারণ দোতলা বাড়ির ঠিক সামনেই নকল ঝিল করা হয়েছে। ঝিলে বাড়ির ছায়া পড়ে। আকাশের ছায়া পড়ে। বাড়িটাকে তখন মনে হয় আকাশ-মহল।

পারুল প্রথম দিনে বাড়ি দেখে চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল–কারণ তার চোখে পড়ল তিনটা কুকুর। লাইন বেঁধে বসার মত এরা বসে আছে। গানের কালো পশম চিকচিক করে জ্বলছে। কুকুরের চোখ সাধারণত অন্ধকারে জ্বলে–এদের দিনেও জ্বলছে। তাহের বলল–কোন ভয় নেই।

পারুল প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ভয় নেই কেন? এরা কি অতি ভদ্র কুকুর?

এরা মোটেই ভদ্ৰ না। ভয়ংকর কুকুর গ্রে হাউন্ড। নিমিষের মধ্যে তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

করছে না কেন?

বিচার-বিবেচনা করছে।

তাহের স্ত্রীর কাঁধে সান্ত্বনার হাত রেখে ডাকল, কামরুল, এই কামরুল।

বাড়ির পেছন থেকে লুঙ্গি পরা খালি গায়ের একটা লোক বের হয়ে এল। তার নাম কামরুল। কুকুর তিনটার দেখাশোনার দায়িত্ব তার। পারুল বিস্মিত হয়ে দেখল কামরুল নামের এই লোকটাও কুকুরগুলির মতই ছিপছিপে। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটার চোখও কুকুরের চোখের মতই জ্বল জ্বল করছে। পারুলের মনে হল–এই মানুষটা যদি হামাগুড়ি দিয়ে মার্টিতে হাঁটে, তাকে গ্রে হাউন্ডদের মতই দেখাবে।

তাহের হড়বড় করে বলল, শোন কামরুল, এ হল পারুল, আমার স্ত্রী, ও কয়েকদিন আমার সঙ্গে থাকবে। কুকুরগুলির সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দাও।

কামরুল নামের লোকটা হুম করে শব্দ করতেই একসঙ্গে তিনটা কুকুর জুটে এল। পারুল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটি কুকুরই তার গা শুকছে। তাদের গরম নিঃশ্বাস এসে গায়ে লাগছে। অস্বস্তিকর অবস্থা। পারুলের শরীর শিরশির করছে।

তাহের হাসিমুখে কলল, এরা তোমার গায়ের গন্ধ জেনে গেল। তোমাকে এরা আর কখনোই কিছু বলবে না।

ভুলে যদি কিছু বলে ফেলে? মানুষেরই ভুল হয় আর কুকুবের হবে না?

কুকুরের কখনো ভুল হবে না। ভয়ে শক্ত হয়ে যাবার কোন দরকার নেই। গায়ে হাত দাও–কিছু বলবে না।

পারুল তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই শয়তানগুলির গায়ে হাত দেবার আমার কোন ইচ্ছা নেই। এরা যে গা শোঁকাশুঁকি করছে তাও আমার অসহ্য লাগছে। লোকটাকে বল কুকুর সরিয়ে নিয়ে যাক।

গন্ধ নেয়া হয়ে গেলে এরা আপনাতেই চলে যাবে এদের কিছু বলতে হবে না।

তাহেরের কথা শেষ হবার আগেই কুকুররা সরে গেল। ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে মূর্তির মত বসে রইল। পারুল বলল, মরে গেলেও কুকুরগুলির সঙ্গে এই বাড়িতে আমি থাকতে পারব না।

তোমার কোন ভয় নেই। এরা হাইলি ট্রেইন্ড কুকুর। কখনো বাড়িতে ঢুকবে না। দরজা খোলা থাকলেও ঢুকবে না। এদের দায়িত্ব হচ্ছে বাড়ির চারপাশে ঘোরা। বাড়িতে ঢোকা নয়।

কই, এখন তো ঘুরছে না।

রাত নটার পর থেকে ঘোরা শুরু করে। খুব ইন্টারেস্টিং।

পারুল ব্যাপারটায় ইন্টারেস্টিং কিছু দেখল না। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে কুকুর খুবই ভয় পায়। ছেলেবেলায় তাকে কুকুর কামড়ে ছিল। চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়েছে নাভিতে। ইনজেকশনের পর নাভি ফুলে গেল। সেই ফোলা এখনো আছে। এখনকার মেয়েরা কত কায়দা করে নাভির নিচে শাড়ি পরে। সে তার ফোলা নাভির জন্যে পরতে পারে না। কুকুরের কামড় খাবার পর থেকে তার কুকুর-ভীতি তাও একটা কুকুর হলে কথা ছিল–তিন তিনটা কুকুর। লোকটাও প্রায় কুকুরের মতই। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। শুধু তাহের যখন বলেছে–আমার স্ত্রীকে কুকুরগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও–তখন ঘেউ জাতীয় একটা শব্দ করেছে–যে শব্দ শুনে কুকুর তার গা শোঁকার জন্যে ছুটে এসেছে। লোকটা নিশ্চই কুকুরদের ভাষাতেই কথা বলেছে নয়ত কুকুরগুলি বুঝল কি করে?

পারুল নীলা হাউসে ঢুকল মন খারাপ করে। যত সুন্দর বাড়িই হোক, পরের বাড়ি। পরের বাড়ি পাহারা দেবার মধ্যে অনিন্দজনক কিছু নেই। পারুল লক্ষ্য করল–তাহের আনন্দিত। বাড়ির খুঁটিনাটি বলে সে খুব আরাম পায়।

পারুল, দেখো–পুরো বাড়ি মার্বেলের। ইটালীয়ান মার্কেল, তাজমহল ইন্ডিয়ান মার্বেলের তৈরি। ইন্ডিয়ান মার্বেলের চেয়ে ইটালীয়ান মার্বেল দশগুণ দামী।

তোমার ধারণা–নীলা হাউস তাজমহলের চেয়েও দশগুণ দামী?

তা বলছি না। মার্বেলের কথা বলছি। এ বাড়ির মাস্টার বেডরুমে যে বাথরুম ফিটিংস আছে সব আঠারো ক্যারেট গোল্ডের।

আমরা তাহলে আঠারো ক্যারেট গোলেডর কমোডে বসে বাথরুম করতে পারব?

না–তা পারবে না। সব তালা দেয়া। বাড়িটা কেমন বল।

আছে মন্দ না।

তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, মন্দ না বলছ কেন? তোমার বাড়ি পছন্দ হয়নি?

পছন্দ হলে কি করবে? কিনে দেবে?

তাহের বিরক্ত হয়ে বলল, এটা কি রকম কথা? পছন্দ হলেই কি কিনে দিতে হবে? আমাদের কত কিছুই তো পছন্দ হয়। পছন্দ হলেই কি আমরা কিনে ফেলি?

তাহের অতক্ষণ বিরক্ত থাকে ততক্ষণই তাহেরের কপালের চামড়া কুঁচকে থাকে। চোখ জাপানিদের মত ছোট ছোট হয়ে যায়। এরকম মুখ বেশিক্ষণ দেখতে ভাল লাগে না। কাজেই পারুল তাহেরকে খুশি করার চেষ্টা করল। অকারণ উচ্ছ্বাসের বন্যা বইয়ে দিল। বারান্দায় টবের সারির দিকে তাকিয়ে বলল, ও আল্লা, বারান্দায় এত ফুলের গাছ? মনে হচ্ছে কয়েক লক্ষ গাছ।

তাহের হৃষ্ট গলায় বলল, কয়েক লক্ষ না, মোট দুশি তেতত্রিশটা চারা গাছ আছে।

তুমি বসে বসে নেছ না কি?

এটাই তো আমার কাজ।

গাছ গোনা তোমার কাজ?

গাছে পানি দেয়া। স্যার বাইরে যথন যান তখন আমাকে রেখে যান গাছে পানি দেয়ার জন্যে।

কেন, কামরুল যে সে পানি দিতে পারে না?

এক এক জনের এক এক কাজ। কামরুলের কাজ হচ্ছে করে দেখা–সব কাজ তো আর সবকে দিয়ে হয় না?

পারুল হাসি মুখে বলল, গাছে পানি দেয়ার মত জটিল কাজে বুঝি তোমার মত জ্ঞানী মানুষ দরকার?

তাহের আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। অর্থাৎ সে রাগ করেছে। পারুলকে বলতে হল–সে ঠাট্টা করছে। বলার পর তাহের স্বাভাবিক হল। তার মুখে কোমল ভাব ফিরে এল। পারুলের ধারণা, এই পথিবীর শ্রেষ্ঠ দশজন মানুষের মধ্যে তাহের একজন। তাহেরের সমস্যা একটাই–সে ঠাট্টা বুঝতে পারে না। রাগ করলে এখনও শিশুদের মত খাওয়া বন্ধ করে দেয়।

 

প্রথম দিন এ বাড়িতে এসে পারুলকে কোন রান্নাবান্না করতে হয়নি। তাহের প্যাকেটে করে খাবার নিয়েয়ে এসেছিল। শিক কাবাব—তন্দুর রুটি। শিক কাবাব কতদিনের বাসি কে জানে–শুকিয়ে চিমসা হয়ে গেছে। টক টক স্বাদ। পারুল বলল, মাংসটা মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। টক লাগছে।

তাহে বলল, মোটেও নষ্ট হয়নি। এরা কাবাবের উপর লেবুর রস চিপে দেয়, এজন্য টক টক লাগে। আরাম করে খাও তে।

পারুল খেতে পারেনি, তবে তাহের মহানন্দে বাসি মাংস চিবিয়েছে। আনন্দে এক একবার তার চোখ বুজে যাচ্ছে। তাহের বলল–এত বড় বাড়িটার বলতে গেলে আমরাই এখন মালিক, তাই না? দারুণ লাগছে না? পারুলের মোটেই দারুণ লাগছে না। তবু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

তাহের বলল, মেয়েরা এবং শিশুরা হল বাড়ির শোভা। একটা বাড়িতে যদি কোন মহিলা বা কোন শিশু না থাকে তাহলে সেটা আর বাড়ি থাকে না–হোটেল হয়ে যায়। তুমি আসার আগ পর্যন্ত এই বাড়ি হোটেল ছিল–এখন বাড়ি হয়েছে।

পারুল অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আরও সাত মাস এ বাড়িতে থাকতে পারলে শিশুও চলে আসবে। তখন এটা হবে পুরোপুরি বাড়ি–তাই না?

তাহের তাকাচ্ছে, কিছু বলছে না–পারুল ঠাট্টা করছে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। পারুল কখন ঠাট্টা করে, কখন করে না সে বুঝতে পারে না বলে পারুল কিছু বললেই সে কিছু সময়ের জন্যে হলেও অস্বস্তির মধ্যে থাকে।

পারুল বলল, এ বাড়ির যিনি মালিক তিনি কি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকেন?

না। এটা বাগানবাড়ি।

পারুল কৌতূহলী গলায় বলল, তার বান্ধবীদের নিয়ে মজা করতে আসেন? এজন্যই এতো নিরিবিলিতে বাড়ি?

তাহের বিরক্ত মুখে বলল, মানুষকে এত ছোট ভেবো না তো। সুখী মানুষ বলতে যা বোঝায় করিম সাহেব তাই। এ বাড়িতে একটা নামাজ-ঘর আছে, সেটা জান?

তিনি এখানে তাহলে নামাজ পড়বার জন্য আসেন?

বিশ্রাম করার জন্যে আসেন। একনাগাড়ে কয়েকদিন থেকে চলে যান। একা আসেন, একা চলে যান।

একা আসেন কেন? স্ত্রীকে আনতে অসুবিধা কি?

তার স্ত্রীর প্যারালাইসিস। আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারেন না। নার্সিং হোমে আছেন গত ছয় বছর ধরে।

এদের বাচ্চাকাচ্চা কি?

কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই।

পারল বিস্মিত গলায় বলল, কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই, তাহলে টাকাপয়সা কে উড়াবে? ধনী বাবার সম্পদ নষ্ট করার জন্যে পুত্র-কন্যা দরকার।

একবার একটা ছেলেকে পালক নিয়েছিলেন। বার তের বছর বয়স হবার পর ঘাড় ধরে সেই ছেলেক বের করে দিলেন।

কেন?

জানি না কেন। পছন্দ হয়নি আর কি। যতই হোক পরের ছেলে–পরের ছেলের উপর কি আর মায়া হয়?

হবে না কেন? তুমি তো পরের ছেলে, তোমার উপর আমার মায়া হচ্ছে না?

সব সময় কেন ঠাট্টা কর?

ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি।

সত্যি কথা বলা দরকার নেই।

পারুল হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঐ ভদ্রলোক পালক ছেলে হিসেবে তোমাকে নিয়ে নিলে খুব ভাল করতেন। এক সঙ্গে ছেলে, ছেলের বউ দুটাই পেয়ে যেতেন। কিছুদিন পরই নাতি বা নাতনী। এক ঢিলে তিন পাখি।

তাহের বিরক্ত মুখে বলল, তুমি সব সময় বাঁকা বাঁকা কথা বল তার কি মানে সেটাই বুঝি না।

পারুল গম্ভীর গলায় বলল, তুমি একটা কাজ করো না, ভদ্রলোক এলে তাঁর কাছে পালকপুত্র হবার জন্যে একটা দরখাস্ত দাও। দরখাস্তের শেষে বায়োডাটা।

পারুল। একটু আগে কি বললাম? আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবে না। আমার অসহ্য বোধ হয়।

আমি তো কখনো ঠাট্টা করি না। সিরিয়াস কথাগুলি হালকাভাবে বলি বলে ঠাট্টা মনে হয়।

হালকাভাবে কথা তাহলে বলো না।

আচ্ছা যাও, এখন থেকে খুব ভারি ভারি কথা বলব। হে স্বামী, রাত্রি গাভীর হইয়াছে–আপনি কি এখন শয্যা গ্রহণ করিবেন, না গল্প করিয়া কালক্ষেপণ করিবেন?

পারুল হেসে গড়িয়ে পড়ছে। তাহের রাগ করে উঠে গেল। মনে হচ্ছে এই রাগ অনেকক্ষণ থাকবে। রাগ ভাঙানোর জন্যে সাধ্যসাধনা করতে হবে। রাগ ভাঙানোর সাধ্যসাধনা করতে পারুলের খারাপ লাগে না, ভালই লাগে। তবে এই মুহূর্তে রাগ ভাঙানোর দরকার নেই। থাকুক মুখ ভোতা করে। রাতে রাগ ভাঙ্গানো যাবে। পারুল একা একা বাড়ি দেখে বেড়াতে লাগল। এত বড় বাড়ি, মনে হচ্ছে সারাদিন হাঁটলেও দেখা হবে না। তবে বেশির ভাগ ঘরই তালাবন্ধ। চাবি থাকলে ঘরগুলি দেখা যেত।

 

রাতে ঘুমূবার সময় তাহের অন্যদিকে পাশ ফিরে শুয়ে রইল। রাগ দেখানো হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কপট ঘুমের ভানও করা হবে। পারুল বলল, এই, ঘুমিয়ে পড়েছ না কি?

তাহের জবাব দিল না। জবাব দেবে না জানা কথা। পারুলকে কথাবার্তা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেন নিজের অজান্তেই তাহের অংশ গ্রহণ করে ফেলে। পারুল বলল, কি শক্ত খটখটে বিছানা। মনে হচ্ছে ইটের উপর শুয়ে আছি। এদের শোবার ঘরের বিছানাও কি এমন না কি?

তাহের বলল–কি পাগলের মত কথা! এদের শোবার ঘরের বিছানা এরকম হবে কেন? ওয়াটার বেড।

সেটা কি রকম?

তোষকের ভেতর তুলার বদলে পানি ভরা।

সে কি?

বিছানায় শোয়ামাত্র চোখে ঘুম চলে আসবে। মনে হবে পানির উপর ভাসছ।

পারুল উঠে বসে আগ্রহের সঙ্গে বলল–চল ঐখানে শুয়ে থাকি। করাত ধরেই আমার ঘুম আসছে না। ঐ ঘরে আরাম করে ঘুমাই।

বললাম না ঐ ঘর তালাবন্ধ। তাছাড়া তালা না থাকলেও এখানে শোব কেন?

বাড়িটাই যখন আমাদের, সব কিছুই আমাদের।

বাড়িটা আমাদের তোমাকে বলল কে?

তুমি তো বললে। তুমি বললে না ওদের অনুপস্থিতিতে আমরাই বাড়ির মালিক।

কখন বললাম এরকম কথা?

বলেছ, এখন ভুলে গেছ। চল যাই।

তুমি কি যে বিরক্ত কর!

আচ্ছা যাও। শুধু ঘরটা দেখে চলে আসি। ঘরটা দেখব আর সোনার বাখরুমে গোসল করব। আমার গা কুটকুট করছে।

সোনার বাথরুম তো না। বাথরুমের ফিটিংসগুলি সোনার। আঠারো ক্যারেট।

পারুল অন্ধকারেই হাসল। তাহেরের রাগ জলে ভেসে গেছে। সে মনের কথা আনন্দে বলে যাচ্ছে। তাহেরকে আবারো রাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। এমন কিছু বলতে ইচ্ছা করছে যাতে তাহের রেগে আগুন হয়ে যায়–। রেগে যাবে, সে আবার রাগ ভাঙাবে।

পারুল নিচু গলায় বলল, এই, একটা কথা শোন।

শুনছি তো।

কাছে এসে শোন। গোপন কথা। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়।

কি কাজ? চল আমরা বাথরুমের ফিটিংসগুলি খুলে নিয়ে পালিয়ে যাই। সব জড় করলে দুই-তিন সে সোনা তো নিশ্চয়ই হবে। হবে না? সোনার ভরি এখন ছ হাজার টাকা। তিন সের সোনা বিক্রি করলে আমরা পাব–আচ্ছা, কত ভরিতে এক সের হয় তুমি জান?

তাহের গম্ভীর গলায় বলল–শোন পারুল, এক কথা কতবার বলব? আজেবাজে। তুমি একেবারেই পছন্দ করি না।

ঠাট্টা করছি না তো। সোনার বাথরুম এই খবরটা জানার পর থেকে আমার মাথার মধ্যে ব্যাপারটা ঘুরছে। আমরা কি করব শোন…

কিচ্ছু শুনব না। আর একটা কথা না। ঘুমাও।

তোমার বাথরুম পাচ্ছে না? বড়টা?

তাহের রাগী গলায় বলল–বাথরুম পাবে কেন?

পচা গোসতের কাবাব কপ কপ করে সবটা খেয়ে ফেললে এই জন্যে। স্ট্রং ডাইরিয়া তো ইতিমধ্যে শুরু হবার কথা…।

পারুল খিলখিল করে হসিছে। তাহেরের রাগ করা উচিত। রাগ করতে পারছে না। মায়া লাগছে। হাসি শুনতে ভাল লাগছে। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে। হাসি শুনলে মনে হয় এই মেয়ের জীবনে কোন দুঃখ কষ্ট নেই। শুধুই সুখ। অথচ তাহে জানে পারুল কত দুঃখী মেয়ে। মাত্র সাত মাস পর তার কোলে শিশু আসবে–অথচ কোন আয়োজন নেই। পারুলকে ক্লিনিকে ভর্তি করাবার টাকাও নেই। ক্লিনিক তো দূরের ব্যাপার–এখন পর্যন্ত সে তাকে ডাক্তারের কাছেও নিতে পারেনি।

গর্ভবতী মেয়েদের ভাল ভাল খাবার খেতে হয়। দুধ, ডিম, ফল-মূল কত কি! কিছুই করা যাচ্ছে না। তাহের অবশ্যি পকেটে করে প্রায়ই পেয়ারা, কলা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দোকান থেকে কলা কেনাও অস্বস্তির ব্যাপার। মানুষ কলা কেনে ডজন হিসেবে, সে কেনে একটা। একটামাত্র কলা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে ফিরলে পারুলও খুব হাসাহাসি করে। উল্টা-পাল্টা কথা বলে।

আচ্ছা শোন, এই যে এত কলা খাচ্ছি সমস্যা হবে না তো?

কি সমস্যা?

বাচ্চা হলে দেখা যাবে বাচ্চার আধ হাত লম্বা লেজ। অতিরিক্ত কলা খাওয়ায় পেটের বাচ্চা বানর হয়ে গেছে।

উদ্ভট কথা তুমি কেন যে বল!

তুমি উদ্ভট কাজ কর এই জন্যে আমি উদ্ভট কথা বলি।।

উদ্ভট কাজ কি করলাম?

এই যে পকেটে একটা করে কলা নিয়ে আস। প্লীজ আর কখনো আনবে না। এক সঙ্গে বেশি করে নিয়ে এসো। রোজ একটা করে খাব।

এক সঙ্গে বেশি করে আনবে কোত্থেকে? মাঝে মধ্যে একটা দুটা আনছে তাই অনেক বেশি। তাহেরকে বিয়ে করে পারুল যে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে পড়েছে তার জন্যে তাহের নিজেকে অপরাধী মনে করছে না। কারণ এই বিপদ পারুল নিজে ডেকে এনেছে। তাহের তাকে কখনো বলেনি আমাকে বিয়ে কর। বিয়ের চিন্তাই তার মাথায় ছিল না। নিজে খেতে পায় না–তার আবার বিয়ে কি? পারুলের বিয়ে যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল তখন সে বরং হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যাক, দুঃশ্চিন্তা দূর হল। খুব ভাল সম্বন্ধ। মেয়েটা সুখে থাকবে। মাঝে মধ্যে সে পারুলের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে টা-টা খেয়ে আসবে। সেটাও তো কম না। সম্বন্ধও খুব ভাল। ছেলের বাবা ডাক্তার। মুগদাপাড়ায়। চারতলা বাড়ি। তিনি নিজে একতলা দুতলা নিয়ে থাকেন। দুই ছেলের জন্যে ওপরের তিনতলা আর চারতলা।

তাহের নিজেই একদিন বাড়িঘর দেখে এল। সে মুগ্ধ। বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা। সেখানে বাগান করা হয়েছে। বাড়ির পেছনে অনেক জায়গা। আম গাছ, কাঠাল গাছ। ছেলের সঙ্গে কথা বলেও সে খুশি। ছেলে বিজনেস করছে। শাড়ির দোকান আছে, চায়নীজ রেস্টুরেন্টে শেয়ার আছে। পারুলকে সে উৎসাহের সঙ্গেই খবরাখবর দিল। পারুল বিরক্ত হয়ে বলল, আশ্চর্য কাণ্ড! তুমি ঐ বাড়িতে কি পরিচয় দিয়ে উঠলে?

বললাম, আমি পারুলের দূর সম্পর্কের মামা।

মামা? মামা বললে কেন?

প্রথমে ভেবেছিলাম দূর সম্পর্কের ভাই বলব–এতে সন্দেহ করতে পারে। কি দরকার, এরচে মামাই ভাল।

তোমাকে খুব খাতির-যত্ন করেছে?

হ্যাঁ, করেছে। ছেলের বাবা বাড়িঘর ঘুরে ঘুরে দেখালেন। তাদের একটা গাছে এবার ছিয়াত্তরটা নারকেল হয়েছে।

তুমি গাছে উঠে নাকেল গুনলে?

না, উনিই বললেন। নিতাই ভদ্রলোক। ছেলের সঙ্গেও কথা হয়েছে। বেশিক্ষণ কথা হয়নি। অল্প কিছুক্ষণ কথা হয়েছে, তার আবার একটা চায়নীজ রেস্টুরেন্টে। শেয়ার আছে–সন্ধ্যাবেলা খানিক বসতে হয়।

তুমি তাহলে আমার শ্বশুরবাড়ি দেখে মুগ্ধ?

মুগ হব না কেন?

চা-নাসতা খেলে?

হু। পাপড় ভাজা, সেমাই, নিমকপাড়া…

থাক, মেনু শুনতে চাচ্ছি না। যথেষ্ট শুনেছি।

তোমার শ্বশুরের একটা গাড়ি আছে। ওল্ড মডেলের টয়োটা, নতুন একটা কিনবেন। বাজেটের জন্যে অপেক্ষা করছেন। বাজেটে গাড়ির দাম কমার কথা।

সব দেখেশুনে তোমার কি মনে হচ্ছে আমার বিয়ে করে ফেলা উচিত?

অবশ্যই।

তুমি যখন বলছ, করে ফেলব।

আজকাল ভাল ছেলে পাওয়া আসমানের চাঁদ পাওয়ার মত। একজন যখন পাওয়া গেছে।

পারুল শীতল গলায় বলল, তার উপর ওদের চায়নীজ রেস্টুরেন্ট আছে। এটা একটা  প্লাস পয়েন্ট। যখন-তখন চাননীজ খাওয়া যাবে। ধর, তুমি বিকেলে বেড়াতে এলে, ঘরে কোন খাবার নেই, একটা স্লীপ লিখে তোমাকে চাইনীজ রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে দিলাম। আচ্ছা, এদের রেস্টুরেন্টের নাম কি?

নিউ সিচুয়ান। খুব চলি রেস্টুকেন্ট।

চল, ওদের রেস্টুরেন্ট থেকে একটু স্যুপ খেয়ে আসি।

তাহের হকচকিয়ে গেল। পারুলের কথাবার্তার ঠিক-ঠিকানা নেই। কাজকর্মেরও ঠিক-ঠিকানা নেই। হয়তো সত্যি সত্যি স্যুপ খেতে চাচ্ছে।

পারুল বলল, তোমার কাছে কি এক বাটি স্যুপ কেনার টাকা আছে? এক বাটি স্যুপের দাম একশ টাকার বেশি হবে না। একশ টাকা সুপ, পাঁচ টাকা টিপস। যেতে আসতে রিকশাভাড়া পনের–একশ কুড়ি টাকা হলেই আমাদের চলে। আছে তোমার কাছে, একশ কুড়ি টাকা?

তাহেরের কাছে তেত্রিশ টাকা ছিল। একশ কুড়ি টাকা থাকলেও যে সে পারুলকে নিয়ে যেত তা না। অকারণে টাকা নষ্ট করার কোন মানে হয় না। তাছাড়া যে মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে সেই মেয়েকে নিয়ে চায়নীজ রেস্টুরেন্টে ঘোরাঘুরি করা যায় না। কখন কে দেখে ফেলবে!

কি, কথা বলছ না কেন? আছে এক কুড়ি টাকা?

না, তেত্রিশ টাকা আছে।

তাহলে তো বিরাট সমস্যা হয়ে গেল। চল না বাকিতে খেয়ে আসি। খাওয়া দাওয়ার পর তুমি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে বলবে–এই যে মেয়েটি খাওয়া-দাওয়া করল তার সঙ্গেই আপনাদের মালিকের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। এখন বিবেচনা করুন, তার কাছ থেকে কি স্যুপের দাম রাখা ঠিক হবে?

তাহের বিরক্ত মুখে বলল, তোমার ব্রেইনে কোন সমস্যা আছে। তুমি সবসময়। আজেবাজে কথা বল। একজন স্বাভাবিক মানুষ তো আর সারাক্ষণ ঠাট্টা করে না। তোমাকে বোঝা খুবই মুসকিল।

পারুল উদাস গলায় বলল, মেয়েদের বোঝা এত সহজ না। তুমি যদি আমাকে বুঝতে তাহলে চিন্তায় তোমার ব্রহ্মতালু শুকিয়ে যেত।

কেন?

কারণ আমি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। এবং বিয়েটা হবে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে।

সত্যি সত্যি দুশ্চিন্তায় তাহেরের গলা-টলা শুকিয়ে গেল। বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। তার নিজের রাতে শোবার জায়গা নেই। জসিমের মেসে এতদিন থাকত। খাটে ডাবলিং করত। গত সপ্তাহেই জসিম বলেছে, অন্য কোথাও একটু থাকার ব্যবস্থা কর দোস্ত। গরমের মধ্যে এক খাটে দুজন–চাপাচাপি হয়–। তারপরও তাহের জসিমের সঙ্গেই আছে, যাবে কোথায়?

বিয়ে করে সে বউকে কোথায় নিয়ে তুলবে? জসিমের মেসে?

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাদের বিয়ে হবে গেল। কাজী অফিসে নাম সই করতে গিয়ে তাহেরের হাত কাঁপতে লাগল। অথচ পারুল কি স্বাভাবিক–যেন কিছুই হয়নি। সে রুমালে মুখ মুছে বলল, খুব গরম এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। কোথায় পাওয়া যায় বল তো?

এই প্রশ্নের জবাবে তাহের বলল–এখন তোমাকে নিয়ে আমি কী করব? কোথায় যাব?

পারুল বলল, আমাকে নিয়ে তোমাকে কিছু করতে হবে না, কোথাও যেতে হবে। তুমি যেমন আছি তেমন খাক। চাকরির চেষ্টা করতে থাক।

চাকরি পাব কোথায়?

এখন হয়ত পাবে। স্ত্রী-ভাগ্যে কিছু নিশ্চয়ই জুটে যাবে।

তোমার কোন টেনশন হচ্ছে না, পারল?

বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত হচ্ছিল–এখন হচ্ছে না।

চাকরি-বাকরি কিছুই যদি না পাই তখন কি হবে?

পাবে। অবশ্যই পাবে। আমি খুব ভাগ্যবতী মেয়ে।

তুমি ভাগ্যবতী মেয়ে?

অবশ্যই–যাকে বিয়ে করতে চেয়েছি তাকে বিয়ে করতে পেরেছি। কটা মেয়ের এরকম সৌভাগ্য হয়? টাকাপয়সার ভাগ্য হল ছোট ধরনের ভাগ্য। ভালবাসার ভাগ্য অনেক বড়। অনেক দিন ধরেই আমি রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না। আজ রাতে আমার খুব ভাল ঘুম হবে।

সেই রাতে তাহেরের একেবারেই ঘুম হয়নি। কি যন্ত্রণায় পড়া গেল। গোদের উপর মানুষের হয় বিষ ফোড়া, তার হয়েছে ক্যানসার। বিয়ে করা বৌ থাকে এক জায়গায়, সে থাকে আরেক জায়গায়। বন্ধুর খাটের অর্ধেকটা শেয়ার করে। পারুলকে নিয়ে কোনদিন সংসার করা যাবে তা মনে হয় না।

বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর পারুলকে তার বড় চাচা বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। মধুর গলায় বললেন–যাও, স্বামীর সঙ্গে সুখে ঘর-সংসার কর। ভুলেও এদিকে আসবে না। যদি কোনদিন তোমাকে কিংবা তোমার গুণবান স্বামীকে এ বাড়িতে দখি তাহলে স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে পিটাব। আল্লাহর কসম।

স্যান্ডেলের পিটা খাবার জন্যে না–চাচীর সঙ্গে তার কিছু গয়না ছিল, গয়নাগুলির জন্যে পারুল একাই একদিন গিয়েছিল। তার মায়ের গয়না–চাচীর কাছে গচ্ছিত। মেয়ের বিয়ের সময় যেন দেয়া হয় এরকম কথা। পারুলের চাচী বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বললেন, গয়না! কিসের গয়না?

পারুল বাল, মার মায়া চাচী।

তোমার মা তো রাজরাণী ছিলেন, গাদা গাদা গয়না বানিয়ে মেয়ের জন্যে রেখে গেছেন!

গাদা গাদা গয়না না চাচী–গলার একটা চন্দ্রহার।

ওরে বাপরে, হারের নামও জান–চন্দ্রহার?

মার একটা স্মৃতিচিহ্ন। দিয়ে দিন না চাচী।

তুমি কি বলতে চাচ্ছি–তোমার মায়ের গয়না আমরা চুরি করেছি? আমরা চোর? এতদিন খাইয়ে পরিয়ে এই জুটল কপালে! চোর বানালে আমাদের? তুমি যেও না বস, তোমার চাচা আসুক অফিস থেকে। তারপর ফয়সালা হবে।

পারুল বসেনি, চাচার জন্য অপেক্ষা করে লাভ হত না। মার স্মৃতি রক্ষার জন্যে পারুল যে খুব ব্যস্ত ছিল তাও না। গয়নাটা পেলে তার লাভ হত–চার ভরি ওজনের হার। খাদ কেটেও সাড়ে তিন ভরির দাম পাওয়া যেত… টাকাটা কাজে লাগত।

তাহের বৌকে দিয়ে তার মার এক দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের বাসায় গেল। তিনি দীর্ঘ সময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেন। এক সময় চোখ স্বাভাবিক করে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারলাম না। তাহের তার নাম, তার মায়ের নাম, গ্রামের নাম সব বলল। ভদ্রলোক বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা। বলার ভঙ্গি থেকে মনে হল এখনো চিনতে পারেননি।

তাহের বিড় বিড় করে বলল, মামা, কয়েকটা দিন আমি আপনার বাড়িতে। থাকব। বিপদে পড়ে গেছি–হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেলক…

কয়েকটা দিন মানে কতদিন?

ধরেন দশ-পনেরো দিন। এর মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলব।

ভদ্রলোক বললেন—ও।

এই ও-র মানে কি? থাকতে দিচ্ছেন, না দিচ্ছেন না তাহের ধরতে পারল না। তাহের রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পলি দুটি স্যটকেস আর একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে রিকশায় চুপচাপ বসে আছে। তাকে অবশ্যি তেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তাহের বলল–মামা, আমি এমন বিপদে পড়েছি ..

ভদ্রলোক বললেন, বিপদে যে পড়েছ তা তো বুঝতেই পারছি। চিনি না জানি না, সম্পর্ক ধরে উপস্থিত হয়েছ..।

মামা, পারুলকে কি রিকশা থেকে নামতে বলব?

পারুলটা কে?

আমার স্ত্রী। রিকশা থেকে নামতে বলব?

বল।

তাহেরের সেই দূর সম্পর্কের মামার নাম সিরাজউদ্দিন। প্যারালিসিস হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। ঢাকায় নিজের বাড়িতে থাকেন। ঢাকা শহরের সবচে নোংরা বাড়িটা তাঁর। বাড়ি নোংরা, আসবাবপত্র নোংরা, সবই নোংরা। বাড়ি প্রথম তৈরির সময় যে চুনকাম হয়েছিল, তারপর সম্ভবত আর চুনকাম হয়নি। দোতলা বাড়ির দোতলা এবং একতলার অর্ধেকটা ভাড়া দেয়। ভাড়ার টাকাতেই সম্ভবত সংসার চলে।

সিরাজউদ্দিন সাহেব তাহেরকে চিনতে না পারলেও তার থাকার জন্যে একটা কামরা ছেড়ে দিলেন। কামরার সামনে এক চিলতে বারান্দা আছে।বারান্দার টবে বকমভিলিয়া গাছে লাল লাল পাতা। বারান্দা আলো হয়ে আছে। এটাচড্‌ বাথরুম। বাড়ি নোংরা হলেও বাথরুমটা পরিচ্ছন্ন। সিরাজউদ্দিন সাহেব তার স্ত্রীকে ডেকে বলেছিলেন–আমার খালাতো বোনের ছেলে, নতুন বৌ নিয়ে এসেছে, দেখবে কোন অযত্ন যেন না হয় …।

তাদের বাসর হল সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাসায়। এতটুকু একটা খাট, তার ওপর ময়লা খয়েরি রঙের একটা চাদর। দুটি বালিশ আছে। একটায় ওয়ার নেই। পারুল বলল, মাগো! এত ছোট বিছানা হয়। একজনও তো আরাম করে শুতে পারবে না।

তাহের বলল, তুমি বিছানায় ঘুমাও। আমি মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে থাকব। আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমার অভ্যাস আছে।

পারল বলল, আজি আমাদের বাসর রাত। আমরা দুজন বুঝি দু জায়গায় শুয়ে থাকব? তুমি যাও তো, কয়েকটা জিনিস কিনে আন। একটা সুন্দর চাদর, দুটা বালিশের কভার, আর কয়েকটা গোলাপ ফুল। যদি পাও সাত আটটা বেলী ফুলের মালা।

তাহের ইতঃস্তত করছে। পারুল বলল, কিছু টাকা অকারণে রাত হলে। হোক না।

সামান্য জিনিস দিয়ে পারুল কি সুন্দর করেই না ঘরটা সাজাল। তাহেরের চোখ প্রায় ভিজে এল। পারুল বলল, আজ রাতে আমরা খুব আনন্দ করব। কষ্টে কষ্টে আমার জীবন কেটেছে তোমারও তাই। আজ রাতে যেন আমাদের মনে কোন কষ্ট না থাকে। বলতে বলতে পারুল চোখ মুছল। চোখ মুছতেই থাকল। কিছুতেই সে কান্না থামাতে পারছে না। তাহের তাকিয়ে আছে বিষণ্ণ চোখে। সে যে স্ত্রীকে সান্তনা দেবে সে সাহস তার হচ্ছে না। তার শুধুই মনে হচ্ছে, এত কাছে বসে থাকা মেয়েটি আসলে এ্ত কাছের না–অনেক দূরের কেউ। ধরা-ছোঁয়ার বাইরের একজন।

দিন সাতেক থাকার কথা বলে তাহের এ বাড়িতে উঠেছিল। ছ মাস পার করে দিল। সিরাজউদ্দিন এই ছ মাসে একবারও বলেননি–আর কত? এবার বিদেয় হও।

ভাল মানুষ পৃথিবীতে আছে। সিরাজউদ্দিন নামের রাগী-রাগী চেহারার এই মানুষটা না থাকলে কি ভয়াবহ অবস্থাই হত তাদের। লোকটা পুরোপুরি আবেগশূন্য। যখন তাহের তাদের বাড়িতে থাকতে গেল তখন তিনি যন্ত্রের মত মুখ করেছিলেন। দিন চলে আসে সেদিনও তেমন।

তাহের বলল, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না।

ভদ্রলোক বললেন, ও আচ্ছা।

আপনাকে আমরা অনেক যন্ত্রণা করেছি .দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।

আচ্ছা।

ভদ্রলোক জানতেও চাননি তাহেররা কোথায় যাচ্ছে। যে মানুষের কোন কৌতূহল নেই সেও জিজ্ঞেস করবে–তোমরা যাচ্ছ কোথায়? ভদ্রতা করে হলেও করবে। তিনি তাও করলেন না। হাই তুললেন। তাহের নিজ থেকে বলল–মামা, আমরা যাচ্ছি নীলা হাউসে–শহরের বাইরে এক ভদ্রলোক একটা বাড়ি বানিয়েছেন–ঐ বাড়ির দেখাশোনা…

আচ্ছা আচ্ছা।

ভদ্রলোক আবেগশূন্য হলেও তাহেরের চোখ ভিজে আসছে। সে ধরা গলায় বলল, যদি কোনদিন আপনার কোন কাজে আসতে পারি, বলবেন।

আচ্ছা আচ্ছা।

মাঝে মাঝে এসে আপনাকে দেখে যাব।

আচ্ছা আচ্ছা।

তাহের কদমবুসি করার জন্যে নিচু হতেই তিনি বললেন, পায়ে হাত দিও না। পায়ে হাত দিলে ব্যথা লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *