বাসরঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাত দুটা বেজে গেল। এর মধ্যে কত সমস্যা যে হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বরযাত্রী একজনের মানিব্যাগ হারিয়ে গেল। ইরার এক বান্ধবীর কানের দুল খুলে পড়ে গেল। কলেজে পড়ে মেয়ে অথচ আকাশ ফাটিয়ে কান্না। এটা তার মার দুল। মা না-কি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলবে। আমার বড় মামার শুরু হল মাইগ্রেন পেইন। এই বিশেষ ধরনের মাথাব্যথা যে এমন পর্যায়ে যেতে পারে আমার ধারণা ছিল না।
বড় মামা মাথার যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করছেন, অন্তু প্ৰবল বেগে তাকে বাতাস করছে এই অবস্থায় আমি বাসর ঘরে ঢুকলাম। ইরার বান্ধবীরা খাট ভালমত সাজাতে পারে নি। কাগজের ফুল দিয়ে জবরজং কি বানিয়ে রেখেছে। মামা যে ভেলভেটের চাদর এনেছেন সেটা সাইজে ছোট হয়েছে। চারদিকে তোশক বের হয়ে আছে। চাদরে গোলাপ ফুল দিয়ে লিখেছে ভালবাসা। তাকালেই লজ্জা লাগে। খাটের পাশে একটা একটা বেতের চেয়ার। রাখলই যখন দুটা বেতের চেয়ার রাখলেই পারত। একটা কেন রেখেছে? সেই বেতের চেয়ারে সে বসে। আছে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে আবার নিজেই লজ্জা পেল। ধাপ করে বসে পড়ল। ইরার সব বান্ধবীরা জানালার পাশে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল। ওরা হেসে উঠল খিলখিল করে। আমি খাটের উপর বসলাম।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমি বসলাম সহজভাবেই। লজ্জায় অভিভূত হলাম না। তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও আমার লজ্জা লাগল না। আমি তাকলাম আগ্রহ নিয়ে। এই জীবন যার সঙ্গে কাটাব তাকে ভাল করে দেখতে ইচ্ছা করল। ইচ্ছাটা কি অন্যায়?
বিশেষত্বহীন চেহারার একজন মানুষ। মাথা খানিকটা নিচু করে বসে আছে। এরকম মানুষ পথে ঘাটে, ট্রেনে বাসে কত দেখি। আগ্রহ নিয়ে এদের দিকে কখনো কেউ তাকিয়ে থাকে না। যেহেতু কেউ তাকিয়ে থাকে না সেহেতু তারাও বেশ নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাটা তরমুজ কিনে সারামুখে রস মাখিয়ে খায়। রাস্তায় যেতে যেতে শব্দ করে নাক ঝাড়ে।
ঘরে আলো কম। ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় এরা একটা হারিকেন এবং একটা মোমবাতি দিয়ে গেছে। বাতাসে মোমবাতি যেভাবে কাঁপছে তাতে মনে হয় যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। সে আমাকে দেখছে না। তার হয়তো লজ্জা লাগছে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোমবাতির দিকে। এক সময় মোমবাতি নিভে গেল। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মোমবাতি জ্বালালো। যেন বাতি জ্বালিয়ে রাখাই তার প্রধান কাজ। ইরার বান্ধবীরা আবারও হাসছে খিলখিল করে। সে খুব লজ্জা পাচ্ছে। অসহায়ের মত তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি হোসে ফেললাম। কেন হাসলাম নিজেই জানি না। আমি হাসি শাড়ির আঁচলে লুকানোর চেষ্টা করলাম না। মনে হয় সহজভাবে হেসে আমি মানুষটাকে অভয় দিতে চেষ্টা করলাম। সে অন্যদিকে তাকিয়ে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল,
তোমার মামার মাথাব্যথা কি খুব বেশি?
আমার সঙ্গে এই তার প্রথম কথা। আমি বললাম, হ্যাঁ বেশি।
সে তৎক্ষণাৎ বলল, আমার এক বন্ধুর স্ত্রীরও মাইগ্রেন আছে। ওর নাম অহনা। অকুপাংচারে চিকিৎসা করিয়েছিল, এতে কমেছে।
মানুষটা কথা বলে সহজ হবার চেষ্টা করছে। আমি তাকে সুযোগ করে দেবার জন্যেই বললাম, অকুপাংচার কি? যদিও আমি খুব ভাল করেই জানি অকুপাংচার কি।
সে নড়েচড়ে বসল। খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল, অকুপাংচার হল এক ধরনের চায়নীজ চিকিৎসা। সুচ ফুটিয়ে দেয়।
ব্যথা লাগে না?
লাগে, খুব অল্প।
তার কথা ফুরিয়ে গেল। সে এখন আবার তাকিয়ে আছে মোমবাতির দিকে। বোধহয় মনে-প্ৰাণে চাচ্ছে মোমবাতিটা নিভে যাক, তাহলে সে একটা কাজ পাবে, ছুটে গিয়ে মোমবাতি জ্বালাতে পারবে।
আমার বলতে ইচ্ছা করছে—তুমি মোমবাতি নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি আমার দিকে তাকাও। আমাকে এত লজ্জা পাবার কিছু নেই। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
আসলেই মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। সে ইরার নায়ক শুভ্ৰ নয়। সে সাধারণ একজন মানুষ। অস্বস্তি, দ্বিধা এবং খানিকটা লজ্জা নিয়ে সে বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। কোন কথা পাচ্ছে না বলেই অকুপাংচার নিয়ে এসেছে। সেই বিষয়েও বেচারা বোধহয় কিছু জানে না। জানলে আরও কথা বলত।
সফিকেরও আমার সঙ্গে আসার কথা ছিল। সে হঠাৎ চলে গেল ব্যাঙ্কক।
সফিক কে?
যার কথা একটু আগে বললাম–অহনা। তার স্বামীর নাম সফিক। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমি ওর অফিসেই কাজ করি। আমার বস।
ও আচ্ছা।
আমার বস শুধু না প্রতিষ্ঠানের মালিকও তবে আমার সঙ্গে ব্যবহার বন্ধুর মত। বিরাট বড়লোক। তার বাড়ি দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। ছাদে সুইমিং পুল।
খুব সুন্দর?
খুবই সুন্দর। মাঝে মাঝে জোছনা রাতে সুইমিং পুলের পাশে সে পার্টি দেয়। অপূর্ব লাগে।
সে খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে। আমি লক্ষ্য করছি মানুষটার উপর আমার মায়া পড়ে যাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে, তার কথা শুনতে ভাল লাগছে। শুরুতে তার চেহারা যতটা সাধারণ মনে হচ্ছিল এখন ততটা সাধারণ মনে হচ্ছে না। তার চোখ দুটা খুব সুন্দর লাগছে। মাথা ঝুকিয়ে কথা বলার ভঙ্গিও সুন্দর।
কেন এত অল্প সময়ে লোকটির উপর আমার মায়া পড়ল? এই মায়ার উৎস কি? এই ব্যাপারটা কি সব মেয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে, না শুধু আমার বেলায় ঘটল? এই লোকটির সঙ্গে বিয়ে না হয়ে অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হলে তার উপরও কি এত দ্রুত মায়া পড়ে যেত। তার চোেখও কি সুন্দর লাগত?
মোমবাতি আবার নিভে গেছে। সে উৎসাহের সঙ্গে আবার ছুটে গেছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার মোমবাতি জ্বালানো দেখছি। দেয়াশলাইয়ের কাঠি বার বার নিভে যাচ্ছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের এখানে খুব বাতাস। তোমাদের বাড়িটা কি দক্ষিণমুখী?
না।
তোমাদের এদিকে বোধহয় খুব বৃষ্টি হয়।
হ্যাঁ খুব বৃষ্টি।
যে ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, শিওর বন্যা হবে।
দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। সে আমার দিকে তাকালো। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। কি আশ্চর্য! ছোটখালা। অতিথিপুর থেকে ছোটখালা চলে এসেছেন। তিনি খবরই পেলেন। কিভাবে, এলেনই বা কিভাবে? ছোটখালার হাতে ট্রে। ট্রেতে দুকাপ চা। ছোটখালা হাসি মুখে বললেন–চা দেয়ার অজুহাতে জোর করে ঢুকে পড়লাম। ও নবনী, তোর বরের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, উনি আমার ছোটখালা। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ।
সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
ছোটখালা বললেন, ও নবনী, তোর বর যে আমাকে সালাম করল— আমি খালি হাতে এসেছি। যাই হোক, দেখি সকালে ব্যবস্থা করা যায় কি-না। তোরা দু জন দু মাথায় বসে আছিস কেন? বাবা, তুমি নবনীর পাশে গিয়ে বস। ছোটাছুটি করে মোমবাতি জ্বালাতে তোমাকে কে বলেছে? চা খেয়ে মোমবাতি হারিকেন দুটাই নিভিয়ে প্রাণভরে গল্প কর। মেয়েরা সব জানালায় ভিড় করে আছে। বাতি নিভিয়ে দিলে কিছু দেখা যাবে না। ওরা ভিড় কমাবে। বুঝতে পারছি?
ছোটখালা ওকে হাত ধরে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে বললেন, নবনীর মত সুন্দর মেয়ে কি তুমি এর আগে কখনও দেখেছি? বল হ্যাঁ কিংবা না।
ও হাসল। ছোটখালা আমাদের চা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে রইলেন। যাবার সময় বাতি নিভিয়ে গেলেন। ও উঠে গিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ছিটিকিনি লাগল। খাটের দিকে আসতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমি উঠে এসে তাকে ধরলাম। ও লাজুক গলায় বলল, মোটেও ব্যথা পাই নি। তোমাকে ধরতে হবে না।
আমি হাত ধরে তাকে খাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। মনে মনে ভাবছি–ইরার উপন্যাসের সেই নায়ক শুভ্ৰকেও কি তার স্ত্রী ধরে ধরে খাটের দিকে নিয়ে যেত?
নবনী!
উঁ।
তুমি খুব বেশি সুন্দর। আরেকটু কম সুন্দর হলে ভাল হত।
কম সুন্দর হলে ভাল হত কেন?
এম্নি বললাম, কথার কথা। সফিক তার স্ত্রীকে সবসময় এই কথা বলে।
উনার স্ত্রী কি খুব সুন্দর?
হ্যাঁ খুব সুন্দর। কালো কিন্তু সুন্দর। তার নামটাও অদ্ভুত। অহনা। আর কোন মেয়ের এমন নাম শুনেছ?
না।
নবনী!
কি?
আমি এর আগে কখনও কোন মেয়ের হাত ধরি নি। এই যে তোমার হাত ধরেছি। কেমন যেন ভয়-ভয় লাগছে। এই দেখ, আমার শরীর কাঁপছে।
ওর কথা শুনে আমার কি যে ভাল লাগল! চোখে পানি এসে গেল। বাসররাতে সব মেয়েই বোধহয় কোন-না-কোন উপলক্ষে চোখের পানি ফেলে। আমি ফেললাম। আমার সেই চোখের পানিতে আনন্দ ছিল, সুখ ছিল। সেই সুখ ও আনন্দের তেমন কোন কারণ ছিল না। অকারণ সুখ অকারণ আনন্দও তো মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে আসে।
রাত এখন কত আমি জানি না। আমার হাতে ঘড়ি নেই। একটা ঘড়ি ছিল। ইরার বান্ধবীরা ঘড়ি খুলে নিয়েছে। বাসর ঘরে না-কি ঘড়ি নিয়ে ঢুকতে নেই। ঘড়ি নিয়ে ঢুকলেই কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করবে। বাসর রাতটা হবে এমন যেখানে সময় বলে কিছু থাকবে না। আমি ইরার বান্ধবীদের সঙ্গে কোন তর্ক করি নি। ওরা ঘড়ি খুলতে চেয়েছে। আমি খুলে দিয়েছি। ওরা যদি ভাবে ঘড়ি খুলে রাখলেই সময় বন্ধ হয়ে যাবে-ভাবুক।
ও বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমুচ্ছে। খাটের একেবারে শেষপ্রান্তে চলে গেছে। আমার কেবলই ভয় হচ্ছে এই বুঝি গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। ইচ্ছে করছে তাকে নিজের কাছে টেনে নেই। ইচ্ছে করলেও সম্ভব না। মানুষের সব ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়। তবে আমি বেতের চেয়ারটি খাটের পাশে এনে রেখেছি। গড়িয়ে পড়লেও মেঝেতে পারবে না। চেয়ারের উপর পারবে।
বৃষ্টি কিছু সময়ের জন্যে থেমেছিল। এখন আবার প্রবল বেগে শুরু হয়েছে। বাতাসও দিচ্ছে। শো শো শব্দ হচ্ছে। এ বাড়ির কেউই বোধহয় ঘুমায়নি। বারান্দায় তাদের হাঁটাহাটির শব্দ পাচ্ছি। হাসাহাসির শব্দও হচ্ছে। সবচে বেশি। হাসছে ইরা। খিলখিল খিলখিল। হাসছেতো হাসছেই। ইরা বোধহয় আজ হাসির বিশ্ব রেকর্ড করল। কি নিয়ে তাদের এত হাসাহাসি? কাদাখেলা কি শেষ হয় নি? না-কি আজ সারারাতাই চলবে?
আমার ঘুম আসছে না। আমি ভোর হবার জন্যে অপেক্ষা করছি। ভোরবেলা একা একা ছাদে খানিকক্ষণ হাটব। ও যদি জেগে থাকে–ওকেও সঙ্গে নেব। আমার ধারণা এই পৃথিবীতে অল্প যে কয়টি সুন্দর জায়গা আছে আমাদের বাসার ছাদটা তার একটা। উঁচু রেলিং দিয়ে ছাদটা ঘেরা। শ্যাওলা জমে রেলিং হয়েছে গাঢ় সবুজ। মনে হয় ইট পাথরের রেলিং নয়–সবুজ লতার রেলিং। বাড়ির পেছনের প্রকাণ্ড শিরীষ গাছটা বেঁকে এসে ছাতার মত ছায়া ফেলেছে ছাদের উপর। গাছ ভর্তি টিয়া পাখি। সকাল এবং সন্ধ্যায় বাক বেঁধে টিয়া পাখি উড়তে থাকে। তীক্ষ্ণ গলায় ডাকে ট্যা ট্যা। টিয়া পাখিগুলো খুব অদ্ভুত এরা মানুষের দেয়া খাবার কখনো খায় না। আমি কতবার ছাদে চাল ছড়িয়ে দিয়েছি–কাক এসে খেয়ে গেছে। টিয়ারা কাছে আসে নি।
ভোরবেলা যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আমি ইরাকে বলব আমাদের দুজনকে ছাদে চা দিতে। ইরা মনে মনে হাসবে। পরে হয়ত ঠাট্টাও করবে। করুক ঠাট্টা। এমন একটা সুন্দর জিনিস ওকে না দেখিয়ে নিয়ে যাব তা হয় না। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি–চা খেতে খেতে ভোরের প্রথম আলোয় ওকে বলব–আমার জীবনের ভয়াবহ সমস্যার কথা। ওকে সমস্যাটা বলে রাখা দরকার। সব শোনার পর সে যদি বলে—নবনী! তুমি এইখানেই থাক। তোমাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব না। তাহলে এখানেই থেকে যাব। বিশাল এই বৃক্ষের ছায়ায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে আমার খুব খারাপ লাগবে না। সেই মানসিক প্ৰস্তুতি আমার আছে।
ওকে আমি কি ভাবে কথাটা বলব? শুরু করাটাই সমস্যা। একবার শুরু করলে বাকিটা আমি তরতার করে বলে যেতে পারব। শুরু করব কি ভাবে? এই ভাবে কি শুরু করা যায়?
এই শোন, আমার এক সময় একজনের সঙ্গে খুব ভাব ছিল।
না এভাবে শুরু করা যায় না। পৃথিবীর কোন স্বামীই বিয়ের পরদিন এ ধরনের কোন কথা শুনতে চায় না। কোন স্বামীই গোপন সত্য শুনতে চায় না। তারা শুনতে চায় মধুর মিথ্যা।
একসময় একজনের সঙ্গে খুব ভাব ছিল এটা এমন ভয়াবহ কোন ব্যাপারও নয়। ভাবতো থাকতেই পারে। তবে খুব ভাব ছিল— সমস্যাটা এইখানেই। খুব বলে একটা ছোট্ট বিশেষণ আছে। আমি ইচ্ছা করে বসাই নি। নিজের অজান্তেই চলে এসেছে।
উনার নাম…।
থাক নামটা বাদ থাক। নামের দরকার নেই। উনি ছিলেন। আমাদের কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক। বয়স অল্প। পাস করে প্রথমেই এই কলেজে এসেছেন। এখানেই তার চাকরি জীবনের শুরু। তাকে দেখে আমাদের মেয়েদের মধ্যে খুব হাসা।হাসি পরে গেল। হাসাহাসির প্রধান কারণ তাঁর পরনে জোব্বা ধরনের পোশাক। গোড়ালী পর্যন্ত পায়জামা। থুতনীতে ছাগল দাড়ির মত ফিনফিনে এক গোছা দাড়ি। তিনি চোখে সুরমা দেন। ক্লাসে যখন পড়ান। তখন কখনো মেয়েদের দিকে তাকান না। মেঝের দিকে তাকিয়ে পড়ান। হঠাৎ কারো চোখে চোখ পড়ে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে যান। তবে পড়ান খুব সুন্দর। এরকম অল্প বয়স্ক একজন মৌলানাকে বেছে বেছে তারা মেয়েদের কলেজে কেন দিল কে জানে। কলেজের সব স্যারদের নাম থাকে। তাঁর নাম হল চেংড়া হুজুর।
আমরা নানাভাবে তাকে যন্ত্রণা করি। যেমন তিনি রেজিস্ট্রার খাতা হাতে যখন ক্লাসে ঢুকেন তখন আমরা সব কয়টি মেয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলিআসসালামু আলায়কুম। আমাদের এই সমবেত চিৎকারে কলেজ কেঁপে উঠে। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসহায় ভঙ্গিতে বলেনওয়ালাইকুম সালাম। তাঁকে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়। যেমন একদিন ক্লাসের পড়া শেষ করে বললেন, কারো কোন প্রশ্ন আছে। আমাদের ক্লাসের সবচে স্মার্ট মেয়ে মবকুলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জ্বি স্যার আছে।
বল।
আপনি এমন অদ্ভুত পোশাক পরে ক্লাসে আসেন কেন?
অদ্ভুত পোশাকতো না। আমাদের নবীজী এই পোশাক পরতেন।
নবীজীতো উটে চড়ে ঘোরাফেরা করতেন। আপনি উটে না চড়ে রিকশায় আসেন কেন?
উটের প্রচলন। এখানেই নেই। থাকলে হয়ত আসতাম।
হো হো করে আমরা হেসে উঠলাম। স্যার চোখ মুখ লাল করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে করুণ গলায় বললেন, আচ্ছা যাই আসসালামু আলায়কুম।
আমরা সমস্বরে হুংকার দিয়ে উঠলাম— ওয়ালাইকুম সালাম। আমাদের হুংকারে কলেজ বিল্ডিং কেঁপে উঠল।
একদিন বিকেলে ছাদে হাঁটছি, মা এসে বলল, বাইরে এক ভদ্রলোক এসেছেন। তোর বাবা চা চাচ্ছে। চা দিয়ে আয়। আমি দুকাপ চা নিয়ে ঢুকে অবাক হয়ে দেখি— আমাদের চেংড়া হুজুর। আজ তাঁর পোশাক আরো চমৎকার। মাথায় পাগড়ি পরেছেন। বিয়ের আসরে ছেলেরা পাগড়ি পরে বলে জানি কিন্তু কেউ যে পাগড়ি পরে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে আসতে পারে তা জানা ছিল না। ভদ্রলোক কি উন্মাদ? তিনি আমাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললেন। বাবা বললেন, নবনী উনি মহিলা কলেজের একজন শিক্ষক। আমাদের যে বাড়তি দুটা ঘর আছে। ঐ ঘর দুটা তিনি ভাড়া নেবেন।
আমি বললাম, বাবা আমি উনাকে চিনি। উনি আমাদের ইতিহাস পড়ান।
ইতিহাস পড়ান? বলিস কি। আমিতো ভেবেছি এরাবিকের টিচার।
স্যার মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল হিস্ট্রীতে এম. এ. করেছি।
বাবা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা। তাহলে তো ভালই হল। গুড। ভেরী গুড। একসেলেন্ট।
আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন আছেন স্যার? তিনি ঠিক আগের মতই মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাল। তুমি ভাল আছ নবনী?
স্যার যে আমার নাম জানেন তা জানতাম না। আমি চমকে উঠলাম।
চা নিন স্যার। চুমুক দিয়ে দেখুন চিনি হয়েছে কি-না।
স্যার আমার দিকে তাকালেন। কি আশ্চর্য এত সুন্দর চোখ! কি শান্ত! কি মায়াকাড়া! না-কি এসব আমার কল্পনা। স্যার চোখ নামিয়ে নিয়েছেন। আমার বলতে ইচ্ছা করছে, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে চা খানতো স্যার। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? মেঝেতে কি আছে দেখার?
টিয়া পাখির ট্যাঁ ট্যাঁ শোনা যাচ্ছে।
ভোর হয়ে গেছে। বৃষ্টি এখনো থামে নি। আমি দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি আমাদের বিদায়ের আয়োজন চলছে। ভোর বেলা ট্রেন। এক্ষুণি রওনা না হলে ট্রেন ধরা যাবে না। বড় মামা সবাইকে তাড়া দিচ্ছেন।
আমার সমস্যার গল্প আজ আর বলা হল না।