০২. বারান্দার তোলা উনুনে ভাপা পিঠা

বারান্দার তোলা উনুনে ভাপা পিঠা বানাতে বসেছেন। এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা এই কারণে যে এ বাড়িতে গত ছয় বছরে ভাপা পিঠা হয়নি। এই পিঠা টুনুর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। শীতকাল এলেই টুনু রোজ ঘ্যান ঘ্যান করবে মা পিঠা কর—ভাপা পিঠা। খুব যখন ছোট ছিল তখন সে পিঠা হাতে নিয়ে বারান্দায় রোদে বসে থাকতো। গরম পিঠা–গা থেকে ভাপ উঠছে। টুনু একটু পরপর সেই পিঠা নাকের কাছে নিয়ে খেজুর গুড়ের গন্ধ নিচ্ছে এটা ছিল শীতকালের সাধারণ দৃশোর একটা।

সুপ্তি চুলার পাশে এসে বসল। আগুনের উপর হাত মেলতে মেলতে বলল, ভাপা পিঠা বানাচ্ছ তাই না-মা? নারিকেল দাওনি কেন?

সুরমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। কী আশ্চর্য এই মেয়ে চোখে কিছু দেখছে অথচ এমনভাবে কথা বলছে যেন সব দেখছে। পিঠায় নারিকেল দেয়া হয়নি এটাও ধরতে পারছে।

হঠাৎ করে ভাপা পিঠা কেন মা?

সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তাতে অসুবিধা কী হয়েছে। ঘরে চালের গুড়া ছিল, খেজুর গুড় ছিল।

সুপ্তি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ভাপা পিঠা কর না তো, আজ হঠাৎ করলে।

বাড়িতে একজন মেহমান এসেছে। পিঠা চিড়া করব না?

মেহমান কে? কার কথা বলছ?

বাবলু।

সুপ্তি বিস্মিত হয়ে বলল, বাবলু? বাবলু কে?

সুরমা একটু যেন লজ্জা পেলেন। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার তিনি নতুন নাম দিয়েছেন—বাবলু। তাকে টুনু নামে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। এম্নিতেই টুনুর সঙ্গে ছেলেটার খুব মিল। তার উপর যদি নামও হয় টুনু তাহলে অনেক সমস্যা।

আজ ফজরের সময় নামাজের অজু করতে উঠে দেখেন— টুনু সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে জবুথুবু হয়ে বসে আছে। সুরমা বললেন, “তুই এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছিস কেন?” বলেই মনে হল—কী সর্বনাশ! কাকে কী বলছেন? এতো টুনু না। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা। ছিঃ ছিঃ কী হল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বাবা তুমি কিছু মনে করো না। আমি আসলে—

ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা বলল, আমি কিছু মনে করি নি। আমার সঙ্গে আপনার বড় ছেলের চেহারার মিল আছে এটা আমি বুঝতে পারছি। এই জন্যেই আপনি ভুলটা করেছেন।

তোমার নাম কি আসলেই টুনু?

জ্বি।

এই নামটা বদলে তোমাকে যদি অন্য কোন নামে ডাকি তুমি কি রাগ করবে?

জ্বি-না। আপনার যে নামে ডাকতে ইচ্ছা করে আপনি ডাকবেন।

বাবলু ডাকি?

জ্বি অবশ্যই। বাবলু নামটাও সুন্দর।

ফজরের ওয়াক্ত পার হয়ে যাচ্ছে—সুরমা কলঘরে অজু করতে গেলেন। বাবলু পিছনে পিছনে আসছে। কল টিপে দিতেই আসছে নিশ্চয়ই। টুনুও তাই করত—কোন ব্যাপারেই মা’র কোন সাহায্যে সে এগিয়ে আসবে না—শুধু কলঘরে মা’কে যেতে দেখলে সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসবে। চাপকলে পানি তুলতে তার কোন আপত্তি নেই।

বাবলু চাপকলে পানি তুলছে তিনি অজু করছেন। অজুর সময় আল্লাহ ছাড়া কারো কথাই মনে করতে নেই তার একী হল শুধু টুনুর কথা মনে আসছে এবং চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। মুখে অজুর পানি দেয়া বলে চোখের পানি আলাদা করা যাচ্ছে না।

মজার ব্যাপার হল, বাবলু নামটাও আসলে টুনুরই নাম। সবাই টুনুকে টুনু ডাকলেও তিনি ডাকতেন বাবলু। বাবু থেকে বাবলু। শেষ পর্যন্ত টুনু নামটাই টিকে গেল। ভর দেয়া নাম টিকল না।

সুপ্তি বলল, কথা বলছ না কেন মা? বাবলু কে?

ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার নাম দিয়েছি বাবলু। টুনুর নামে তাকে ডাকতে ইচ্ছা করে না।

খুব বেশিতো আর তাকে ডাকাডাকি করতে হবে না। আমার ধারণা নাশতা খেয়ে উনি চলে যাবেন।

চলে গেলে চলে যাবে–যা-তো বাবলুকে নাশতা দিয়ে আয়। নিয়ে যেতে পারবি তো?

কী বল তুমি পারব না কেন?

সুপ্তি নাশতার প্লেট এবং পানির গ্লাস নিয়ে যাচ্ছে। কী স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই যাচ্ছে। বারান্দায় মাঝামাঝি জলচৌকি রাখা ছিল—তার কাছাকাছি গিয়ে সে জলচৌকিটা এড়িয়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। দিক ভুল হচ্ছে না। তিনি নিজে কতবার দরজায় হোঁচট খেয়েছেন—এই মেয়ে কখনো খায়নি। তবে এই মফস্বল শহরে অন্ধদের জন্যে আলাদা স্কুল নেই—মেয়েকে তিনি সাধারণ স্কুলেই ভর্তি করেছেন। সে পড়াশোনা করছে। ভালই করছে। তার হাতের লেখা ভাল না–এলোমেলো কিন্তু তা পড়া যায়। স্কুলের আপারা কষ্ট করে হলেও সেই লেখা পড়েন। সে পাস করে নতুন ক্লাসে ওঠে। এইবার মেয়ে ক্লাস এইটে উঠেছে। হয়ত একদিন এস.এস.সি’ও পাস করবে। তারপর কী হবে? কে এই মেয়েকে বিয়ে করবে?

সুরমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখে আঁচল চেপে বসে রইলেন।

ম্যাজিশিয়ান বসার ঘরের বিছানায় বসে আছে। সুপ্তি নাশতার পিরিচ নামাতে নামাতে বলল, আপনার ঘুম ভাল হয়েছে। ম্যাজিশিয়ান জবাব দিল না। তবে সুন্দর করে হাসল। যে হাসির অর্থ—”হ্যাঁ। খুব ভাল ঘুম হয়েছে। খুকী তুমি ভাল আছ?”

আপনি কি ভাপা পিঠা পছন্দ করেন? মা আপনার জন্যে ভাপা পিঠা বানিয়েছেন।

ভাপা পিঠা আমি খুব পছন্দ করি।

আপনি কি জানেন যে মা আপনাকে একটা নতুন নাম দিয়েছেন। সেই নামটা হল বাবলু। এখন আর আপনাকে আসল নামে ডাকা যাবে না। ভাল হয়েছে না?

হুঁ।

আপনাকে আসল নামে কেন ডাকা যাবে না সেটা জানেন?

ম্যাজিশিয়ান জবাব দিল না। সুপ্তি হাসতে হাসতে বলল, আমার একজন ভাই ছিল। তার নামও ছিল টুনু। আপনাকে টুনু বলে ডাকলে মা’র তার ছেলের কথা মনে পড়বে এবং খুব মন খারাপ হয়ে যাবে। এই জন্যে আপনাকে টুনু নামে ডাকা যাবে না।

ও আচ্ছা।

মা’র ধারণা আপনি দেখতেও অনেকটা আমার ভাইয়ার মতো।

তবে ভাইয়ার সঙ্গে আপনার সবচে বড় অমিল কী জানেন? সবচে বড় অমিল হচ্ছে ভাইয়া সারাক্ষণ কথা বলত। সে এক সেকেণ্ডও চুপ করে বসে থাকতে পারত না। এবং আমার মার ধারণা সে ঘুমের মধ্যেও কথা বলত। পিঠা খেতে কেমন হয়েছে?

খুব ভাল হয়েছে। তুমিও খাও।

সুপ্তি খাটের পাশে চেয়ারে বসল। তার খুব মজা লাগছে। আজ স্কুলে ম্যাজিশিয়ানের গল্প করতে হবে। এত কাছ থেকে সে এর আগে কোন ম্যাজিশিয়ান দেখেনি। উনি কয়েকদিন বাসায় থেকে গেলে ভাল হত। তার কাছ থেকে কয়েকটা সহজ ম্যাজিক সে শিখে রাখত। স্কুলের বন্ধুদের দেখিয়ে অবাক করে দিতে পারত। তবে মেয়েরা ম্যাজিক শেখে কি-না কে জানে। সে কোনদিন কোন মেয়ে ম্যাজিশিয়ানকে দেখেনি।

আচ্ছা আপনি কি আমার নাম জানেন?

জানি। তোমার নাম সুপ্তি।

আমি যে চোখে দেখতে পাই না সেটা কি জানেন?

হুঁ।

আপনার কি এই জন্যে খারাপ লাগছে?

ম্যাজিশিয়ান কিছু বলল না। সুপ্তি হাসতে হাসতে বলল—এত সুন্দর একটা মেয়ে চোখে দেখতে পায় না, এই ভেবে আপনার খারাপ লাগছে না?

লাগছে।

আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না। আমার নিজের কিন্তু খারাপ লাগে না। কোনদিনও তো চোখে দেখিনি কাজেই চোখে দেখতে না পাওয়ার কষ্টটা আমি জানি না। অন্যরা যখন আমাকে দেখে আহা উহু করে তখন আমার খুব খারাপ লাগে। আপনি দয়া করে আহা উহু করবেন না।

আচ্ছা করব না।

আপনি কি আজ চলে যাবেন?

হ্যাঁ।

আপনার ম্যাজিক তো দেখা হল না?

তুমি তো চোখে দেখতে পাও না। ম্যাজিক কীভাবে দেখবে?

আমি কল্পনা করে করে দেখি। আপনি কী দেখাচ্ছেন সেটা বললেই আমি বাকিটা কল্পনা করে নেবো। নাশতা খেতে খেতে একটা ম্যাজিক দেখান না। ভাপা পিঠাটা খেয়ে ফেলবেন কিছুক্ষণ পর কান দিয়ে কিংবা নাক দিয়ে সেই পিঠা বের করবেন। হি হি।

ম্যাজিশিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখটাও হাসি হাসি। সুপ্তি বলল, এই যে আমি হি হি করে হাসছি আপনি রাগ করছেন না তো?

না।

ক্লাসেও আমি সারাক্ষণ হি হি করে হাসি। এই জন্যে ক্লাসে আমার নাম হিহি রাণী। নামটা সুন্দর না?

হ্যাঁ।

ক্লাসের মেয়েরা কী বলে জানেন? তারা বলে আমার যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে হা হা করে হাসবে। এবং তার নাম হবে হাহা রাজা। হাহা রাজার বউ হিহি রাণী। বক বক করেই যাচ্ছি আপনি রাগ করছেন না তো?

না।

এখন একটা ম্যাজিক দেখান। কারণ ক্লাসের মেয়েদের কাছে আমাকে গল্প করতে হবে। সুন্দর একটা ম্যাজিক দেখান।

ম্যাজিশিয়ান বলল, আচ্ছা দেখাচ্ছি। এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবো।

সুপ্তি ভাবল—তিন। কারণ তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। ভাইয়া বেঁচে থাকলে সে ভাবত চার। ভাইয়া যেহেতু বেঁচে নেই— কাজেই তিন।

ভেবেছ?

হুঁ।

ম্যাজিশিয়ান বলল, চার বিয়োগ এক। হয়েছে?

হুঁ হয়েছে। কিন্তু আপনি সরাসরি তিন না বলে চার বিয়োগ এক বললেন কেন?

এম্নি।

আচ্ছা আমি মনে মনে একটা ফুলের কথা ভাবছি। বলুন তো কী ফুল?

ম্যাজিশিয়ান হাসল কিছু বলল না। সুপ্তি বলল, পারছেন না, তাই না?

ম্যাজিশিয়ান তারও জবাব দিল না। সুপ্তির মন একটু খারাপ হল। তার ধারণা ম্যাজিশিয়ান বলতে পারবে। সে খুব সহজ ফুল ভেবেছিল—বেলীফুল। সুপ্তি বলল, আপনার ম্যাজিক কিন্তু খুব ভাল না। মোটামুটি।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ তাই। মনে মনে একটা সংখ্যা ভাবা সেই সংখ্যা বলে দেয়া অনেকেই পারে।

ও আচ্ছা।

একবার আমাদের স্কুলে একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছিল সে অনেক ভাল ভাল ম্যাজিক দেখিয়েছে। একটা ম্যাজিক ছিল খুবই অদ্ভুত। কেরোসিনের একটা চুলায় সে কড়াই দিল। কড়াই এ তেল ঢেলে দিল। তেল যখন ফুটে উঠল তখন সে একটা ডিম ভেঙ্গে কড়াই এ ছেড়ে দিল। তারপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিল। এক সময় ঢাকনা তুলতেই ঢাকনার ভেতর দেখে একটা কবুতর বের হয়ে উড়ে চলে গেল। অদ্ভুত না?

হ্যাঁ অদ্ভুত।

আপনি এ রকম ম্যাজিক দেখাতে পারেন না?

না।

টুনু ভাইয়া একবার কোখেকে একটা ম্যাজিক শিখে এসেছিল। দড়ি কাটার ম্যাজিক। একটা দড়ি কাঁচি দিয়ে কাটা হয় ) দড়িটা আপনা আপনি জোড়া লেগে যায়। আমাকে সে ম্যাজিকটা শিখিয়ে দিয়েছিল। আসলে মূল দড়িটা কাটা হয় না। আলাদা একটা ছোট্ট টুকরা কাটা হয়। সেই টুকরাটা লুকিয়ে ফেলা হয়। আপনি কি এই ম্যাজিকটা জানেন?

না।

আচ্ছা আমি স্কুল থেকে এসে আপনাকে শিখিয়ে দেব। আপনি থাকবেন

এখনো জানি না।

আমার মনে হয়–মা আপনাকে যেতে দেবে না।

ম্যাজিশিয়ান বলল, আমারও তাই ধারণা।

আমি স্কুল থেকে ফিরে এসে আপনাকে দড়ির ম্যাজিক শিখিয়ে দেব।

আচ্ছা।

সুপ্তির ম্যাজিশিয়ানের সামনে থেকে উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। বেচারা ম্যাজিক না পারলেও তার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। আজ স্কুলে না গেলে কেমন হয়? এমন কোন ক্ষতি অবশ্যই হবে না তবে রেবর্তী আপা খুব ক্যাট ক্যাট করবে। সুপ্তি উঠে পড়ল। তাদের মর্নিং শিফ্ট। সকাল আটটায় ক্লাস শুরু হয়ে যায়। একটা রিকশা ঠিক করা আছে তাকে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে বাবা সঙ্গে যান। আজ মনে হয় বাবা সঙ্গে যাবেন না।

.

মবিন উদ্দিন রান্নাঘরে স্ত্রীর পাশে বসে আছেন। আগুনের পাশে বসে থাকতে তার ভাল লাগছে। মবিন উদ্দিন বললেন, ছেলেটাকে নাশতা দিয়েছ?

সুরমা বললেন, হ্যাঁ। চারটা পিঠা দিয়েছিলাম। চেটেপুটে খেয়েছে। মনে হয়। ভাপা পিঠা খুব পছন্দ করে।

মবিন উদ্দিন স্ত্রীর দিকে তাকালেন কিছু বললেন না। এই বাড়ির আরো একজন ভাপা পিঠা খুব পছন্দ করতো। সেই স্মৃতি মনে করার চেয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করা ভাল। সুরমা বললেন, ছেলেটা কি আজ চলে যাবে? মবিন উদ্দিন বললেন, হ্যাঁ।

কখন যাবে?

এখনই চলে যাক। রাতটা থাকার দরকার ছিল, থেকেছে।

এখনই যাবার দরকার কী? ভালমত একবেলা ভাতও তো খায়নি। রাতে ঠাণ্ডা কী সব খেয়েছে। পোলাওয়ের চাল এনো তো দুপুরে খিচুড়ি করব।

দুপুরে না করে রাতে কর। হাসের মাংস আর খিচুড়ি। শীতকালের হাঁস ভাল।

সুরমা বললেন, ছেলেটা যদি চলে যেতে চায় তাকে বলে আজকের দিনটা রেখে দাও। কাল যাবে।

বলে দেখি। থাকবে কি-না কে জানে।

ম্যাজিশিয়ান একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেল। মবিন উদ্দিন বললেন, তুমি কাল রাতে ঠাণ্ডা বাসি খাবার খেয়েছ এই জন্যেই সুপ্তির মা ভালমতো একবেলা খাওয়াতে চায়। একটা দিন থেকে যেতে তোমার অসুবিধা হবে না-তো?

ম্যাজিশিয়ান নরম গলায় বলল, জ্বি-না।

আমি দোকানে যাব। তুমি যাবে না-কী আমার সঙ্গে?

জ্বি চলুন।

আগে একজন কর্মচারী ছিল, সেই দোকান খুলতে তাকে বিদায় করে দিয়েছি। টাকা-পয়সা সরাতে! ঘরে পাঁচটা বাংলা ডিকশনারী ছিল—সংসদ অভিধান। একদিন গিয়ে দেখি একটাও নাই। আমি বললাম, ডিকশনারীগুলি কোথায়? সে হাবার মতো মুখ করে বলল, কিসের ডিকশনারী। বিদায় করে দিয়েছি। বিশ্বাসী কাউকে পাচ্ছি না রাখাও হচ্ছে না। অবশ্যি ব্যবসার অবস্থাও ভাল না। একজন কর্মচারী রাখার সামর্থ আমার নাই। সুপ্তির মা তোমাকে ভাল মন্দ খাওয়াতে চায়—চাইবেই। সামান্য চাওয়াটাও আমার জন্যে কষ্টদায়ক হয়। যাই হোক চল যাই। দোকানটা দেখবে।

মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানকে নিয়ে সারাদিন ঘুরলেন। পোলায়ের চাল কিনলেন, হাঁস কিনলেন। বাড়ি ফেরার পথে চায়ের দোকান দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন–ম্যাজিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, চা খাবে।

জ্বি খাব।

চল চা খাই।

তিনি খুব আরাম করে চা খেলেন। চা খেতে গিয়ে তার একবারও মনে পড়ল না গত ছ’ বছর তিনি চা খাননি। ছ’ বছর পর চা খাচ্ছেন। এত বড় একটা ঘটনা তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি মহা আনন্দে গল্প করে যাচ্ছেন।

এই বছর কেমন শীত পড়েছে দেখলে?

জ্বি।

যে বছর শীত বেশি পড়ে সেই বছর কলা খুব মিষ্টি হয়।

তাই না-কি?

হুঁ। যে বছর গরম বেশি পড়ে সেই বছর আম হয় মিষ্টি। প্রকৃতির নিয়ম-কানুন বড়ই অদ্ভুত।

জ্বি।

চা আরেক কাপ খাবে?

জ্বি খাব।

মালাই চা খেয়ে দেখ। হাফ দুধ, হাফ চা। খুবই টেস্ট।

দু’জন দু’কাপ মালাই চা নিলেন। আর ঠিক তখন মবিন উদ্দিন চমকে উঠলেন। তিনি চা খাচ্ছেন। এই তার দ্বিতীয় কাপ চা। মবিন উদ্দিন খুব লজ্জিত বোধ করছেন। যেন মস্তবড় একটা অপরাধ করছেন। সাধারণ চা খেলেও একটা কথা ছিল–তিনি খাচ্ছেন মালাই চা। টুনুর অতি প্রিয় চা। এই দোকানেই তো টুনুকে নিয়ে তিনি কতবার এসেছেন।

.

সুরমা রান্না নিয়ে খুব ব্যস্ত। হাঁস রান্না খুবই যন্ত্রণার ব্যাপার। পাখা ছাড়াতে হয়। বড় পাখাগুলি সহজে উঠে আসে কিন্তু ছোটগুলি আসতেই চায় না। আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছোট পাখা দূর করতে হয়। সুপ্তি যে তাকে সাহায্য করবে তা না। সে সন্ধ্যা থেকে ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার সঙ্গে গল্প করছে। তিনি কিছু বলছেন না, গল্প করছে করুক। বেচারী একা একা থাকে গল্প করার মানুষ নেই। টুনু যখন বেঁচে ছিল দুই ভাই-বোনের গল্পের যন্ত্রণায় তিনি অস্থির হছেন। দুজনই কথা বলছে। কেউ কারো কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না।

সুপ্তি রান্নাঘরে ঢুকল। আনন্দিত গলায় বলল, মা তোমার কোন সাহায্য লাগবে?

সুরমা বললেন, না।

পরে কিন্তু ডাকাডাকি করতে পারবে না।

তুই করছিস কী? গল্প?

উহুঁ। আমি উনাকে ম্যাজিক শেখাচ্ছি মা। দড়ি কাটার ম্যাজিক!

কী বলছিস তুই। ম্যাজিশিয়ান ছেলে তাকে তুই কী ম্যাজিক শিখাবি?

উনি ম্যাজিক-টেজিক তেমন জানে না মা।

তাহলে যা। ম্যাজিক শিখিয়ে দে।

.

সেই রাতে সুপ্তি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল। যেন সে হাঁটতে হাঁটতে গভীর বনে ঢুকে গেছে। সেই বনের গাছগুলি অদ্ভুত। ডালের মাথা প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। গাছ ভর্তি ফুল। ছোট ছোট সাদা ফুল। আশ্চর্য কাণ্ড ফুলগুলি দেখতে বেলী ফুলের মতো। বেলী ফুলের তো এত বড় গাছ হয় না। বেলী ফুলগাছ লতানো ধরনের হয়। এত বড় গাছে বেলী ফুল ফুটেছে তার মানে কী! ফুলগুলির কী সুন্দর গন্ধ। স্বপ্নের মধ্যেই সুপ্তি গন্ধ পেল। এবং সে এতই অবাক হল যে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার ঘুম ভাঙ্গার পরেও স্বপ্নের গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার সারা বিছানায় কেউ যেন বেলী ফুল বিছিয়ে রেখেছে। এটা কেমন স্বপ্ন যে স্বপ্ন ভাঙ্গার পরেও স্বপ্নের ছায়া থেকে যায়। এই স্বপ্নের সঙ্গে কি ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার কোন সম্পর্ক আছে? না, তা কী-করে থাকবে। সুপ্তি ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন তার আর স্বপ্নের কথা মনে রইল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *