০২. বায়রনীয় অ-সুখ

২. বায়রনীয় অ-সুখ

বিশ্বের ইতিহাসে পূর্বেও যেমন ছিল, বর্তমানেও সবার ধারণা এই যে, আমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী, তারা প্রাচীন যুগের সব উৎসাহ-উদ্যমের পরিচয় পেয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন যে বেঁচে থাকার জন্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যারা এই মতো ধারণ করেন, তারা যথার্থই অসুখী, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা গর্বিত। কারণ তারা বিশ্বের এই প্রকৃতিকে অতৃপ্তির হেতুরূপে প্রচার করেন এবং মনে। করেন যে, আলোকিত মানুষের পক্ষে অতৃপ্তিই হচ্ছে একমাত্র যৌক্তিক মনোভাব। তারা তাদের অতৃপ্তির জন্যে অহংকার বোধ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দুর্দশাকে উপভোগ করেন, তিনি নিজে দুর্দশাগ্রস্ত নন। এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত সরল। এ বিষয়ে দ্বিধা নেই যে উচ্চমন্যতাবোধ এবং অন্তদৃষ্টি দুঃখভোগ জনিত কিছু ক্ষতি পূরণ করে। কিন্তু সহজ আনন্দ উপভোগের অভাব তা পূরণ করতে পারে না। আমি মনে করি না যে অসুখী হওয়ার মধ্যে কোনও উচ্চমার্গের বিচারবোধ আছে। জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অবস্থায় যতটা সম্ভব ততটাই সুখী হবেন এবং যদি তিনি অনুভব করেন যে পৃথিবীর ব্যাপারে ভাবনা একটা বিশেষ সীমার পর বেদনাদায়ক, তখন তিনি তার পরিবর্তে অন্য কিছু ভাববেন। এই অধ্যায়ে এই কথাটাই আমি প্রমান করতে চাই। পাঠককে বোঝাতে চাই যে নানারকম বিতর্ক থাকলেও যুক্তি কখনো সুখের ওপরে নিষেধবিধি আরোপ করেনি। আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি যারা তাদের দুঃখের কারণকে আন্তরিকভাবে তাদের পৃথিবী সম্পর্কিত ভাবনার জন্য দায়ী করেন, তারা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেন। মূল কথা হচ্ছে, তারা কেন অসুখী তা-ই তারা জানেন না। আর এই অতৃপ্তি তাদের অভ্যস্ত পারিপার্শ্বিক বিশ্বের কম পছন্দের বৈশিষ্ট্যসমূহের দিকেই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখে।

আধুনিক আমেরিকানদের জন্যে আমি যে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীটি তুলে ধরতে চাই তা মিস্টার জোসেফ উড ক্রাচ’ তার ‘দ্য মডার্ন টেম্পার’ নামে যে পুস্তক তাতে তুলে ধরেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্যে এটি করেছেন কবি বায়রন।(১) সর্বকালের জন্যে করেছেন ‘একলিজিয়াস্টেস’-এর লেখক। মিস্টার ক্রাচ বলেছেন: আমরা পরাহত এবং জগতে আমাদের স্থান নেই, কিন্তু তাই আমরা আমাদের মানবজন্মের জন্যে দুঃখিত নই।

আমরা বরং মানবরূপে ধ্বংস হব। তবুও পশুরূপে বেঁচে থাকতে চাইব না । কবি বায়রন বলেন :

‘যে আনন্দ নিয়ে যায় কাল, কভু নাহি দেয় তাহা ফিরে।
যৌবনের ভারের গরিমা ডুবে যায় কাল সিন্ধু নীরে।‘(২)

‘একলিজিয়াস্টেস’-এর লেখক বলেন :

‘এই কারণে, যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের চেয়ে মৃত, অর্থাৎ যারা আগেই মরে গেছেন, তাদের আমি বেশি সাধুবাদ দিয়েছি।

সত্যিই এই দুই প্রকারের মানুষের চেয়ে সেই বেশি ভাল যিনি এখনও জন্মগ্রহণ করেননি, যিনি এখনো সূর্যের নিচে ঘটে যাওয়া পাপাচার দেখেননি।

এই তিনজন নৈরাশ্যবাদী জীবনের সকল উপভোগের বিষয়কে দেখেই এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন যার মধ্যে কোনও আনন্দের কণা নেই। মিস্টার ক্রাচ নিউইয়র্কের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের সমাজে বাস করেছেন। বায়রন পৌরাণিক যুগের নায়কদের মতো হেলেসপন্টে সাঁতার কেটেছেন এবং চুটিয়ে প্রেম করেছেন। একলিজিয়াস্টেসের লেখক প্রমোদের বৈচিত্রে বায়রনকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি মদে ডুবেছেন, সঙ্গীতে আত্মহারা হয়েছেন এবং আনুষঙ্গিক সব কিছুতেই নিজেকে জড়িত করেছেন। তিনি জলাশয় তৈরী করেছিলেন। তাঁর অনেক সেবাদাস ও সেবাদাসী, অনেকে তাঁর বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিল। এমন অবস্থাতেও তিনি বুদ্ধিভ্রষ্ট হননি। কিন্তু তবুও তিনি দেখেছেন সব কিছু অর্থহীন। এমনকি জ্ঞানও তার কাছে অর্থহীন।

“আমি অন্তর দিয়ে জানতে চেয়েছি জ্ঞানকে, জানতে চেয়েছি উন্মাদনা ও মুখতাকে। আমি দেখেছি আত্মা এতেও পীড়িত হয়, কারণ যত জ্ঞান তত অনুতাপ। যে মানুষ জ্ঞানকে বাড়াবেন তিনি দুঃখকেই বাড়াবেন।”

তাঁর জ্ঞান তাঁকে বেদনাহত করেছিল, মনে হয়। তিনি এ থেকে মুক্তির ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

“অন্তর থেকে আমি বলেছিলাম এবার এসো, আনন্দ দিয়ে যাচাই করি তোমাকে।

অতএব প্রমোদে ভেসে যাও। কিন্তু দেখলাম তাও অর্থহীন।”

কিন্তু তার জ্ঞান তার সঙ্গ ছাড়েনি,

“আমি তখন নীরবে বললাম, যেমন বুদ্ধিহীনের বেলায় ঘটে, তেমনি আমার বেলাতেও ঘটে। তা হলে আমি বেশি জ্ঞানী হলাম কেন? তখন আবার আমি মনে মনে বললাম, এও অর্থহীন।

সুতরাং আমি জীবনকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। কারণ যা কিছু এই বিশ্বে হয়ে যাচ্ছে তা আমার কাছে বেদনাদায়ক। কারণ সবকিছুই অর্থহীন এবং মানস সত্তার পক্ষে বিরক্তিকর।”

এটা লেখকদের পক্ষে সৌভাগ্যের কথা যে, লোকে অনেক আগেকার দিনের লেখা আর পড়েন না। কিন্তু যদি পড়তেন; তাহলে তারা এই সিদ্ধান্তে আসতেন যে জলাধার সম্পর্কে যাই বলা হোক, নতুন বই লেখা নিশ্চিতভাবেই অর্থহীন। আমরা যদি দেখাতে পারি জ্ঞানী লোকের পক্ষে একমাত্র একলিজিয়াস্টেসের মতবাদই উন্মুক্ত, সেকথা ঠিক নয়। তা হলে ঐ একই মেজাজের পরবর্তী অন্যসব লেখা নিয়ে আমাদের আর ভাববার কিছু নেই। এই ধরণের আলোচনায় আমাদের উচিত, লেখার মনন এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ– এই দুইয়ের পার্থক্যটা মনে রাখা। লেখার মননের সাথে কোনও তর্ক নেই, কোনও অনুকূল ঘটনায় তার পরিবর্তন হতে পারে অথবা আমাদের শারীরিক কোনও পরিবর্তনে তার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু তর্ক দ্বারা কখনো নয়। আমি নিজে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যখন মনে হয়েছে সব কিছু অর্থহীন, এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি কোনও দার্শনিক চিন্তা দিয়ে নয়। পেয়েছি কোনও অবশ্য করণীয় কাজের চাপে পড়ে। আপনার শিশুসন্তান অসুস্থ হলে আপনি অসুখী হতে পারেন। কিন্তু কখনো আপনার মনে হবে না যে এসব অর্থহীন। আপনার মনে হবে যে সন্তানকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। এ প্রশ্ন আপনার মনে উঠবেই না যে জীবনের কোনও চরম মূল্য রয়েছে কিনা। ধনী লোক মনে করতে পারেন এবং সচরাচর মনে করেও থাকেন সবকিছু অর্থহীন। কিন্তু যদি কোনও কারণে তার অর্থনাশ হয়, তবু তার মনে হবে না যে পরবর্তী আহারের ব্যাপারটাও অর্থহীন। প্রকৃতিলব্ধ অভাবের সহজ পূরণ থেকেই এই অনুভূতি জাগ্রত হয়। মানবজাতি অন্যসব প্রাণীর মতো এক বিশেষ ধরণের জীবনযুদ্ধের উপযোগী হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। প্রচুর অর্থের সাহায্যে মানুষ বিনা শ্রমে তার সব খেয়াল চরিতার্থ করতে পারে। অবস্থা যদি এমনি হয় পরিশ্রমের অভাবই সুখের একটি প্রধান উপকরণ তার জীবন থেকে চলে যাবে। যেসব জিনিসের প্রতি মানুষের কামনা প্রবল নয়, সেসব যদি সে সহজে লাভ করে, তা হলে সে মনে করবে কামনা পূরণে সুখলাভ হয় না। তার অন্তর যদি কিছু দার্শনিক ভাবনায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তা হলে তার মনে হবে মূলত মানবজীবন দুঃখময়। তা হলে যে মানুষ যা চায়, তাই যদি পেয়ে যায়, সে আরও অসুখী। সে ভুলে যায় যে কিছু অভাব থাকা সুখের একটি অপরিহার্য উপাদান।

এই হল মেজাজ বা মননের কথা, যা এখানে শেষ করতে হয়। অবশ্য একলিজিয়াস্টেসে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনাও রয়েছে।

“নদী সাগরে গিয়ে পড়ছে, তবু সাগর অপূর্ণ।
সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই।
পূর্ব-স্মৃতি বলে কিছুই নেই।
এই পৃথিবীতে সুর্যের নিচে যে শ্রম আমি করেছি,
আমি ঘৃণা করেছি তাকে, কারণ আমার পরে যে জন্মাবে
তাকে দিয়ে যেতে হবে অর্জিত সম্পদ।”

এই আলোচনা আধুনিক দার্শনিকের ভাষায় সাজিয়ে নিলে তা অনেকটা এইরকম দাঁড়াবে : মানুষ নিরন্তর পরিশ্রম করছে, বস্তু অবিরাম গতিশীল, তবু কিছুই অবিনশ্বর নয়। যদিও পরিবর্তনের নিয়মে যা করে আসছে তার সাথে পূর্বের কোন পার্থক্য নেই। কোনও মানুষ মারা গেলে তার উত্তরপুরুষ তার শ্রমের ফল ভোগ করে। নদী পড়ছে সাগরে গিয়ে। কিন্তু তার জলরাশি সেখানে থাকছে না। বারবার সীমাহীন, উদ্দেশ্যহীন চক্রে মানুষ এবং সব জাগতিক বস্তুর উদ্ভব এবং বিনাশ হচ্ছে। কোনও উন্নতি নেই, স্থায়ী কোনও ফল নেই। এমনি চলছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। নদীদের যদি বুদ্ধি থাকত, তা হলে তারা চলত না, স্তব্ধ হয়ে থাকত। সলোমন(৩) যদি বুদ্ধিমান হতেন, তাহলে তিনি উত্তরপুরুষের ভোগের জন্যে ফলের গাছ পুঁততেন না।

কিন্তু অন্য মেজাজে দেখলে সব কিছুর চেহারা বদলে যাবে। সূর্যের নিচে নতুন কিছুই আর নেই। কেন, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, আকাশ-যান, আর রাজনীতিবিদদের বেতার ভাষণের কথা ভাবুন? সলোমন(৪) এসবের কিছু জানতেন কি? যদি রাজ্যের অভ্যন্তর থেকে ফিরে এসে তিনি শেবার রাণির প্রজাদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত বেতার ভাষণ শুনতে পেতেন, তাহলে তাতে কী তিনি তাঁর তুচ্ছ গাছপালা আর জলাশয়ের মাঝখানে সান্ত্বনা পেতেন না? যদি তার অধীনে কোনও তথ্য দপ্তর থাকত এবং সংবাদপত্রে তার হারেমের আরাম সম্বন্ধে কী বলছে, এবং তার সাথে তর্করত বিরোধী জ্ঞানীদের কী দুর্দশা ঘটছে, তা যদি সেই দপ্তর সংবাদপত্রের কাটিং পাঠিয়ে তাঁকে জানাতে পারত, তাহলেও কী তিনি বলতেন সূর্যের নিচে নতুন কিছুই নেই? হয়তো এসব তাঁর নৈরাশ্যকে সম্পূর্ণ দূর করতে পারত না। কিন্তু এসব কিছুকে তিনি নতুনভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন। বস্তুত আমাদের সময় সম্পর্কে মিস্টার ক্রাচের একটি অভিযোগ এই যে, সুর্যের নিচে নতুন জিনিস একটু বেশিই আছে। নতুনত্বের অভাব অথবা উপস্থিত–দুই-ই যদি সমান বিরক্তিকর হয় তাহলে তার কোনটি নৈরাশ্যের সত্যি কারণ হতে পারে তা মনে হয় না। তার ওপর এই কথাটি বিবেচনা করে দেখুন : “সব নদী সাগরে গিয়ে লীন হচ্ছে, তবু সাগর পূর্ণ হচ্ছে না। যেখান থেকে নদীসমূহ আসছে, সেখানেই আবার ফিরে যাচ্ছে।” নৈরাশ্যের কারণরূপে বিবেচনা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ভ্রমণ নিরানন্দময়। লোকে গ্রীষ্মকালে স্বাস্থ্যকর স্থানে যায়, আবার ফিরে আসে। এতে প্রমাণ হয় না যে গরমের দিনে স্বাস্থ্যনিবাসে যাওয়া অর্থহীন। জলের যদি অনুভূতি থাকত, তা হলে তা হয়তো শেলির(৫) ‘ক্লাউড’ (মেঘ)-এ বর্নিত রীতিতে নিজের সাহসে ভরা ভ্রমণচক্রটা উপভোগ করত। উত্তরাধিকারীর জন্যে সব রেখে যাওয়ার বেদনাবোধ থেকে বলা যায় যে বিষয়টি দুদিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। উত্তরাধিকারীর দিক থেকে দেখতে গেলে এটি স্পষ্টতই কম দুর্দশামূলক। সব কিছুই পরিণতিতে দূরে চলে যায়। শুধু সেই কারণে তার জন্যে হতাশ হওয়া উচিত নয়। যদি তাদের পরিবর্তে খারাপ জিনিস আসে তাহলে তাকে আশাব্যঞ্জক হওয়ার একটি কারণ মনে করা যেতে পারে। সলোমন যেমন মনে করেন, যদি তেমন কিছু ফিরে আসে? তা হলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাই তো নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্যই যায় না, যদি না আবর্তনের প্রতিটি স্তর আলাদাভাবে বেদনাদায়ক না হয়। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তা কী বয়ে আনবে, তার মধ্যে বর্তমানের সমস্ত অর্থ নিহিত, এইভাবে দেখার ধারণাটাই অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমানের নিজেরই একটি মূল্য আছে। তার অংশবিশেষের কোনও মূল্য না থাকলে সমগ্রেরও কোনও মূল্য থাকে না। জীবন আর যাই হোক মিলনান্তক নাটক নয়। অবিশ্বাস্য রকমের বহু দুর্ভোগের ভিতর দিয়ে গিয়ে নায়ক-নায়িকার আনন্দঘন মিলন ঘটে যে নাটকে, বাস্তব জীবনকে তার অনুরূপ ভাবা উচিত নয়। আমি আমার সময়ে বেঁচে আছি এবং সেই সময়কে যথারীতি উপভোগ করছি, আমার পুত্র পরে আসবে এবং সেও তার সময়ের সম্পদ ভোগ করবে। তারপর তার পুত্র আসবে। এরইমধ্যে বিয়োগান্তক কী রয়েছে? বরং আমি যদি চিরজীবী হতাম, তা হলে শেষ জীবনে সব আনন্দ বিস্বাদে পরিণত হত। জীবন দুর্বিসহ বোঝা হয়ে উঠত। যেভাবে জীবন চলছে তাতে তা চিরসজীব রয়েছে,

“জীবনের আঁচে তপ্ত করেছি দুহাতে ভাই
আগুন নিভেছে, এবার আমিও বিদায় চাই।”(৬)

মৃত্যুতে যন্ত্রণা পাওয়া যতটা যুক্তিসঙ্গত, এই মনোভাবও ততটাই যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং যুক্তি দিয়েই যদি মেজাজ গড়তে হয়, তা হলে হতাশ হওয়ার পক্ষে যতটুকু যুক্তি আছে, খুশী হওয়ার পক্ষেও ততটুকু যুক্তি রয়েছে।

‘একলিজিয়াস্টেস’ বিষাদময়। মিস্টার ক্রাচের মডার্ন টেম্পার’ হৃদয়বিদারক । মিস্টার ক্রাচ অন্তরের অন্তস্থলে বিষণ্ণ, কারণ মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ছে। পরবর্তী অসুখী যুগের অনেক মূল্যবোধ আর শাশ্বত মনে হয় না। তিনি বলেছেন, “আধুনিক নিরানন্দ কালটা হচ্ছে মৃত দুনিয়ার প্রেত-অধ্যুষিত কাল, এবং এখনও সেকাল স্থিতিশীল হয়ে ওঠেনি। যে কিশোর পৌরণিক ধর্মীয় ভাবধারায় বড় হয়েছে, সে যেমন স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে দিগভ্রান্ত, এর সঙ্কট অনেকটা সেই রকম।” একটি বিশেষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সম্পর্কে এটা সম্পূর্ণ সত্য। এঁরা সাহিত্যের শিক্ষালাভ করেছেন, তাই আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না। এঁরা প্রথম জীবনের বিশ্বাসকে আবেগের ভিত্তির ওপর স্থাপন করার শিক্ষা পেয়েছেন। তাই যা আধুনিক জগতের জ্ঞান দ্বারা পূরণ করা যায় তাতে তাদের আস্থা নেই। অন্যান্য আরো সাহিত্য-কর্মীর মতো। মিস্টার ক্রাচ এই ধারণায় নির্ভর করে বলছেন যে, বিজ্ঞান তার প্রতিজ্ঞা পালন করেনি। এই প্রতিজ্ঞা কিসের তা অবশ্য তিনি বলেননি। কিন্তু তিনি মনে হয় ভাবেন ষাট বছর আগে ডারউইন। ও হাক্সলি বিজ্ঞান থেকে এমন কিছু আশা করেছিলেন, যা বিজ্ঞান দিতে পারে নি। আমার মনে হয় এর সবটুকুই ভুল এবং এই ভুল পোষণ করে এসেছেন সেই সব।

লেখক এবং যাজক, যারা চান না তাদের বিশেষ জ্ঞানকে কেউ তুচ্ছ মনে। করুক। এ কথা সত্যি যে বর্তমানের জগতে অনেক নৈরাশ্যবাদী রয়েছে। যখনই অনেক লোকের আয় কমে যায় তখনি নৈরাশ্যবাদের প্রকোপ দেখা যায়। একথা ঠিক যে মিস্টার ক্রাচ একজন আমেরিকান এবং মোট কথা আমেরিকানদের আয় যুদ্ধের কারণেই অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সমগ্র ইউরোপ মহাদেশে বুদ্ধিজীবীরা খুবই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তা ছাড়া যুদ্ধ প্রত্যেকের মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তার ভাব জাগিয়ে তুলেছে। একটা যুগের মানসিক গঠনে বিশ্বের গতি প্রকৃতি বিষয়ক মতবাদের তুলনায় এইসব সামাজিক কারণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ত্রয়োদশ শতক সবচেয়ে নৈরাশ্রময় যুগ। যে বিশ্বাসের অভাব নিয়ে মিঃ ক্রাচ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তা এয়োদশ শতকের নৈরাশ্যভরা সময়ে তৎকালীন সম্রাট এবং কয়েকজন ইতালিয়ান অভিজাত ব্যক্তি ছাড়া অন্য সবার মনে গেঁথে ছিল। মিঃ ক্রাচ বলেছেন কিছু মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যেই আধুনিক কালের মানুষের এই দুর্দশা, তা কিন্তু সঠিক নয়। রজার বেকন(৭) বলেছেন, “যে কোনও অতীত যুগের তুলনায় বর্তমান পাপ বেশি মাত্রায় রাজত্ব করছে এবং পাপ ও জ্ঞান বিপরীতধর্মী। যদি বিশ্বের সমগ্র অবস্থা দেখি এবং সব জায়গায় তার রূপ কী দাঁড়িয়েছে তা বিবেচনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাব দুর্নীতি সর্বকালের সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং তা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে শীর্ষমহলে। … লাম্পট্য রাজ দরবারকে কলুষিত করেছে এবং ঔদারিকতা সবার মনিব সেজে বসেছে…। সমাজের শীর্ষস্তরে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে নিচের দিকের অবস্থা কী? গীর্জার প্রভুদের দেখুন, কীভাবে তারা আত্মাকে উদ্ধার করার চেয়ে অর্থের পিছনে ছুটছেন। …তারপর ধর্মীয় গোষ্ঠীদের দেখা যাক, যা বলতে যাচ্ছি তা থেকে কেউ বাদ যাবে না। দেখুন তাদের কী পরিমাণ অধঃপতন হয়েছে কেউ এ থেকে বাদ নেই, নতুন গোষ্ঠী (ফ্রায়ারগণ) নিজেদের উচ্চ মর্যাদাবোধ থেকে ভয়ানকভাবে নিচে নেমে গেছে। যাজকশ্রেণী এখন অহংকার, লাম্পট্য এবং লালসাগ্রস্ত। এবং যেখানেই যাজক-সহকারীরা একসাথে ছুটেছে, প্যারিসে হোক বা অক্সফোর্ডে, সেখানেই তারা কলহ, মারামারি এবং আরো সব কুকর্ম দ্বারা জনগণকে কলংকিত করেছে। …প্রত্যেকে যদি লালসা চরিতার্থ করতে পারে, তবে কী হচ্ছে, কেমন করে হচ্ছে, কোন্ কৌশলে হচ্ছে, কিছুই আসে যায় না। প্রাচীন যুগের পৌত্তলিক পণ্ডিতদের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, তাঁদের জীবন আমাদের চেয়ে এত বেশি ভাল ছিল যে, দুয়ের মধ্যে কোনও তুলনা চলে না। যেমন ভাল ছিল শালীনতায় এবং বিশ্বকে নিন্দা করার ব্যাপারে, তার সব আনন্দ, ঐশ্বৰ্য্য এবং মর্যাদা নিয়ে। এসব জানা যাবে অ্যারিস্টটল,সেনেকা, টুলি, অভিসেনা, আলফারারিয়াস, প্লেটো, সক্রেটিস এবং অন্যান্যদের লেখা থেকে। এইভাবে তারা জ্ঞানের রহস্যে পৌঁছেছিলেন এবং তার রহস্য ভেদ করেছিলেন।”(৮) রাজার বেকনের অভিমত হচ্ছে, তাঁর সমকালীন সাহিত্যসেবীদের কেউ তাঁর মতো নিজের যুগকে পছন্দ করেননি। এসবের মুলে কোনও দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে আমি তা মূহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করি না। বাস্তব অর্থে এর মূলে আছে যুদ্ধ, দারিদ্র এবং সন্ত্রাস।

মিঃ ক্রাচের রচনার করুণতম অধ্যায় হচ্ছে প্রেম বিষয়ে আলোচনা। ভিকটোরিয়ান যুগের লোকদের প্রেম বিষয়ে ধারণা খুব উচ্চস্তরের ছিল। কিন্তু আমরা আমাদের আধুনিক বাস্তববোধ দিয়েই প্রেমকে দেখি। “ভিকটোরিয়ানদের মধ্যে যারা অতিরিক্ত সন্দেহবাদী, তাদের কাছে প্রেম ঈশ্বরের কিছু উদ্দেশ্যসাধন করত যা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের কাছে প্রেম ছিল ঈশ্বরের প্রতিরূপ। এই সঙ্কটের মুখে অনেক শক্তলোকও সাময়িকভাবে অতীন্দ্রিয়বাদী হয়ে পড়তো। তারা নিজেদের দেখেছেন এমন এক রহস্যময় শক্তির মুখোমুখি, যা তাদের মনে একপ্রকার ভক্তির ভাব জাগিয়ে তোলে, যা অন্য কিছুতে জাগায় না। তা এমন কিছু, যার প্রতি তাদের প্রশ্নহীন আনুগত্য সমর্পন করা উচিত। এ কথা তারা মর্মমূল থেকে অনুভব করেন। তাদের কাছে, প্রেম ঈশ্বরের মতোই সবরকম আনুগত্য দাবি করে। ঈশ্বরের মতোই জীবনের এক অর্থময় রূপবৈচিত্র্যে বিশ্বাসীদের ভূষিত করে। যাকে এখন পর্যন্ত যে কোনও ভাবে বিশ্লেষণ করে বাতিল করা যায়নি। তাদের চেয়ে আমরা ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে বেশি অভ্যস্ত, কিন্তু এখনও এমন পৃথিবীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি, যেখানে প্রেম নেই। প্রেমহীন, ঈশ্বরহীন পৃথিবী যখন হবে, তখনি নিরীশ্বরতার সঠিক অর্থ কী তা বুঝতে পারব।” এটি খুবই কৌতুকের ব্যাপার যে আমাদের কালের তরুণদের চোখে ভিকটোরিয়ান যুগ যত প্রেমময় মনে হচ্ছে, সে যুগের লোকদের কাছে তা ততটা প্রেমময় ছিল না। আমার দুজন মহিলার কথা মনে পড়ে, দুজনেই সে যুগের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করতেন। আমার প্রথম জীবনে দুজনেই খুব পরিচিত ছিলেন। এঁদের একজন ছিলেন নীতবাদী এবং অন্যজন ছিলেন ভলটেয়ারপন্থী, অর্থাৎ ধর্ম মানতেন না। প্রথম মহিলা এই বলে দুঃখ করতেন যে, সব কবিতা যেন শুধু প্রেম নিয়ে লেখা এবং তার মতে বিষয়টা স্বাদহীন। পরের মহিলা বলতেন–“আমার বিরুদ্ধে কারো কিছু বলবার নেই। কিন্তু আমার মতে বাইবেলের দশ-আদেশের ষষ্ঠটি অগ্রাহ্য করা যত খারাপ, সপ্তমটি তত নয়। কেন না আর যাই হোক এতে অন্যপক্ষের সম্মতি চাই।” এই দুটি মতের কোনওটাই, যাকে মিঃ ক্রাচ বিশেষভাবে ভিকটোরিয়ানরূপে চিহ্নিত করেছেন তা নয়। কারণ এই দু’জন মহিলা প্রেমে শ্রদ্ধাশীল নন তা খুব ভাল করে বোঝা যায়। মিঃ ক্রাচ লেখকজীবনে এমন কয়েকজন লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যারা আপন পরিবেশেই মানিয়ে নিতে পারেননি নিজেদের। এর একটা বড় উদাহরণ আমার মনে হয় রবার্ট ব্রাউনিং(৯)। কিন্তু প্রেম নিয়ে কবি রবার্ট ব্রাউনিং-এর ধারণা আমার কাছে কিছুটা শ্বাসরোধী মনে হয়। তার প্রেমের দর্শন হচ্ছে :

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তাঁর সৃষ্ট হীনতম জীবও
গর্বিত হয় দ্বৈত আত্মায়, তাঁদের একটি পৃথিবীর দিকে
তাকাবার জন্যে।
অন্যটি দয়িতার দিকে ফেরাবার জন্যে।”

এর থেকে বুঝতে পারা যায়, সার্বিকভাবে এই জগতে প্রতিযোগিতার ভাবই একমাত্র সম্ভাব্য পথ। কেন? কারণ ব্রাউনিং বলবেন পৃথিবী নিষ্ঠুর। তা হলে আমাদের বলতে হয়, পৃথিবী আপনাকে আপনার মূল্যে মেনে নেবে না। ব্রাউনিং দম্পতির অনুকরণে দুজনে পরস্পর প্রশংসাকারী সমিতি গঠন করতে পারেন। ভাল-মন্দ বিচার না করে কাজের সর্বদা প্রশংসা পাওয়া নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। ব্রাউনিং এমন অবিমিশ্র প্রশংসাই চেয়েছিলেন সাথীর কাছে, ব্রাউনিং অরোরা লি’ কে প্রশংসা না করার সাহসিকতার জন্য ফিটজেরাল্ড(১০)-কে মাত্রাহীন নিন্দা করেছিলেন। এভাবে তিনি নিজেকে উঁচু স্তরের বীরপুরুষ ভেবেছিলেন। সুতরাং এদের দুপক্ষেরই সমালোচনাশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়াকে আমি সত্যি প্রশংসামূলক। বলতে পারি না। এর মূলে রয়েছে ভীতি এবং নিরপেক্ষ সমালোচনার ঠাণ্ডা ঝাপ্টা থেকে নিরাপদে থাকার কামনা। অনেক বয়স্ক চিরকুমার নিজেদের ঘরে আরামের আগুনের পাশে বসে একই তৃপ্তি লাভ করেন। আমি নিজে ভিকটোরিয়ান যুগে অনেক দিন কাটিয়েছি। মিঃ ক্রাচের আদর্শে আমি আধুনিক নই। কোনও ভাবেই আমি প্রেমে বিশ্বাস হারাইনি। কিন্তু ভিকটোরিয়ানরা যে প্রেমের প্রশংসা করেন আমি তাতে বিশ্বাসী নই। এ প্রেমে দুঃসাহসিকতা আছে। জাগ্রত এর দৃষ্টি, এ যেমন শুভবোধের জন্ম দেয় তেমনি অশুভ দিককে ভুলিয়ে দেয় না। আমার প্রেম যে পাপমুক্ত অথবা পবিত্র এরকম ভনিতা করে না। প্রেমে এইসব গুণাবলী আরোপ করা, যে প্রশংসার যোগ্য, যৌন নিষেধাজ্ঞার পাপপূণ্য বোধ থেকে এসেছে। ভিকটোরিয়ানদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে অধিকাংশ যৌনতাই অশুভ এবং যে যৌনতার অনুমোদন দেওয়া হত তার সাথে জুড়ে দেওয়া হত নানাধরণের পবিত্রতার বিশেষ সব বিশেষণ। বর্তমান যুগের তুলনায় অতীত যুগে যৌন-ক্ষুধা অনেক বেশি ছিল। এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে ঠিক এই কারণে অতীতের লোকেরা যৌনতার গুরত্ব খুব বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন সাধুরা সবসময় করে থাকেন। বর্তমান কালে আমরা এক সংশয়-পূর্ণ যুগের ভিতর দিয়ে চলেছি। এই সময় আমরা অনেকেই পুরানো আদর্শ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি কিন্তু নতুন কিছুই পাইনি। এতে তাদের অসুবিধা বেড়েছে যারা এখনও পুরানো আদর্শে বিশ্বাস করেন। এতে তাদের মনোজগতে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা, নৈরাশ্য, অনুশোচনা এবং বিশ্বনিন্দুকতা। আমার বিশ্বাস এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু এ যুগে তাদেরই প্রাধান্য বেশি। আমার বিশ্বাস কেউ যদি এই যুগের সাধারণ অবস্থাপন্ন যুবকদের সাথে ভিকটোরিয়ান যুগের যুবকদের তুলনা করেন, তা হলে দেখবেন প্রেম সম্পর্কে বর্তমান সময়েই তৃপ্তিলাভ বেড়েছে এবং ষাট বছর আগের চেয়ে প্রেমের মূল্য নিয়ে আন্তরিকতা এখন অনেক বেড়ে গেছে। তবুও যে কিছু বিশ্বনিন্দুক সবকিছুই খারাপ দেখে, তার কারণ খুঁজতে হবে তাদের অবচেতন মনের ওপর অতীত আদর্শের অত্যাচারের মধ্যে, আর খুঁজতে হবে আধুনিক সময়ের লোকের আচরণ-নিয়ন্ত্রক যৌক্তিক নৈতিক আদর্শের মধ্যে। অনুতাপের মধ্যে এর প্রতিকার নেই। অতীতের প্রতি মমত্ববোধের মধ্যেও নেই, রয়েছে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীকে সাহসের সাথে স্বীকার করার মধ্যে। আর রয়েছে কিছুমাত্রায় বাতিল কুসংস্কারকে তাদের সব রহস্যময় গুপ্তস্থান থেকে নির্মূল করার মধ্যে।

প্রেমের মূল্য দেওয়া কেন তা সংক্ষেপে বলা খুব কঠিন। তবু আমি চেষ্টা করব। প্রেমের মূল্য দেওয়া উচিত কারণ প্রেম নিজেই আনন্দের উৎস। এটি প্রেমের উচ্চতম মূল্য না হলেও, এর প্রত্যেকটি স্তরে এই আনন্দই অনিবার্যভাবে অবস্থান করছে।

“হে প্রেম! তারা তোমাকে খুব ভুল করে
বলে তোমার মধুরতা তিক্ত
কিন্তু তোমার রসাল ফল এমন যে
তার চেয়ে মধুরতর আর কিছু নেই।”

এই কয়েকটি পংক্তির অজ্ঞাতনামা লেখক নিরীশ্বরবাদের কোনও মীমাংসা খুঁজছেন না, বিশ্বরহস্যের চাবিও নয়। তিনি নিজের মধ্যেই আনন্দকে উপভোগ করছেন। প্রেম যে শুধু আনন্দের উৎস তাই নয়, এর অভাবও বেদনার উৎস। দ্বিতীয়ত প্রেমকে এজন্যে মূল্যবান মনে করতে হবে, কারণ তা জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। যেমন সঙ্গীত, পর্বতে সূর্যোদয় এবং পূর্ণিমার সুষমায় প্লাবিত সমুদ্র। যে মানুষ তার প্রেমিকার সাথে মিলে সুন্দর জিনিস উপভোগ করেনি সে প্রেমের যে যাদু-ক্ষমতা আছে তার সন্ধান পায়নি। প্রেম অহংবোধের আবরণটা ভেঙে ফেলতে পারে। কারণ এটি জৈব-সহযোগিতারই একটি রূপ, যাতে একের প্রকৃতিজাত উদ্দেশ্য মেটাতে অপরের আবেগের প্রয়োজন হয়। বিশ্বে নানা যুগে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের কোনওটা মহৎ কোনওটা নয়। স্টোইক এবং প্রথমযুগের খ্ৰীষ্টানরা বিশ্বাস করতেন মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ মঙ্গল পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র নিজের স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা, অন্ততপক্ষে অন্য মানুষের সাহায্য ছাড়া। অন্যেরা ক্ষমতাকেই মনে করেছেন জীবনের চরম লক্ষ্য। কেউ কেউ মনে করেছেন ব্যক্তিগত আমোদ-প্রমোদকে। এসবই বিশেষ নির্জন দর্শনের পর্যায়ে পড়ে। কেন না এতে অনুমান করা হয়েছে। যে, মঙ্গল এমন একটা বস্তু যা শুধু ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সমাজে নয়, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে আলাদাভাবে রূপায়িত হওয়া সম্ভব। আমার বিবেচনায় এ সকল মতবাদ মিথ্যা এবং তা শুধু নৈতিক মতবাদ হিসাবে নয়, আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির উৎকৃষ্ট অংশের প্রকাশরূপেও। মানুষ সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এবং কিছু ত্রুটিপূর্ণ হলেও প্রকৃতি তার ভিতর এমন সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে যাতে সহযোগিতার জন্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ অন্তর প্রয়োজন তা সেই সহযোগিতা প্রেরণা যোগায়, যাদের কিছুমাত্র প্রেমের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা তাদের প্রিয়জনের চরম মঙ্গলের সাথে সম্পর্কহীন এমন কোনও দর্শনে তৃপ্ত হবে না। সন্তানম্নেহের অনুভূতি আরও বেশি ক্ষমতাশালী। কিন্তু তার শ্রেণী প্রকাশ ঘটে পিতা-মাতার পরস্পরের প্রেমের ফলে। আমি এমন দাবি করি না যে মহৎ প্রেম খুব একটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এ কথা বলি যে মহৎ প্রেম এমন কিছু মূল্যবোধ তুলে ধরে, যা অন্যভাবে অজানা থেকে যেত। প্রেমের নিজেরই ভিতর এমন একটা ঐশ্বর্য আছে, যাকে অবিশ্বাস দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। মহৎ প্রেম সব সংশয়বাদীর নাগালের বাইরে। যারা তাদের অক্ষমতার জন্যে যদিও সংশয়বাদকেই দায়ী করে।

“সত্য প্রেম দীর্ঘজীবী অনল
যা মনে জ্বলছে অনন্তকাল
কখনো রুগ্ন হয় না, মরে না, শীতল হয় না,
কখনো স্থানচ্যুত হয় না।”

এর পর মিঃ ক্রাচ ট্র্যাজেডি নিয়ে কী বলেছেন তা দেখব। তিনি এ প্রসঙ্গে যা বলেন, আমি তার সাথে সহমত পোষণ করি। ইবসেনের(১১) ‘গোস্টস’, শেক্সপীয়ারের(১২) ‘কিং লিয়র’ থেকে নিম্নমানের। প্রকাশের ক্ষমতা বৃদ্ধি, উন্নত শব্দরাজি উপহার, কোনও কিছুই ইবসেনকে শেক্সপীয়ারে রূপান্তরিত করতে পারত না। যে উপাদান থেকে শেক্সপীয়ার তার নাটক সৃষ্টি করেছেন, মানবিক মর্যাদাবোধ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির ওপর গুরুত্ববোধ এবং জীবনের বিস্তার-সম্পর্কিত কল্পনার আশ্রয়, ইবসেনের কল্পনায় এসবের কোনও গুরুত্ব নেই, এবং তার সমসাময়িকদের কাছেও তার কোনও গুরুত্ব থাকতে পারে না, ছিলও না। মধ্যবর্তী শতক সমূহের মধ্যে ঈশ্বর, মানুষ এবং প্রকৃতি সব কিছু কেন জানি মূল্য হারিয়ে ফেলেছে যার অর্থ এই নয় যে, আধুনিক শিল্পের বাস্তবতা আমাদের মানুষের হীনতার সন্ধানে লিপ্ত করেছে। এইভাবে মানুষের জীবনের হীনতা বাস্তববাদী চিত্রকলা পদ্ধতি যেন কোনওভাবে আমাদের ওপর চাপানো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সেই ব্যাপার যে, প্রাচীন ধাচের ট্র্যাজেডি যেখানে রাজকুমারদের দুঃখের কথা থাকত তা বর্তমান কালের উপযোগী নয়। আমরা যখন অখ্যাত কোনও ব্যক্তির দুঃখের কথা একই রীতিতে আলোচনা করি, তখন তার প্রতিক্রিয়া এক হয় না। এর কারণ অবশ্য এটা নয় যে জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অবনতি হয়েছে। বরঞ্চ এর বিপরীতটাই সত্যি। কারণ, এখন আমরা বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তিকে আর বিশ্বের মহৎ মানুষ বলে মনে করতে পারি না। একমাত্র তাদেরই বিয়োগান্ত নাটকে আবেগের অধিকার থাকবে, আর অন্যেরা কিছু লোকের মহিমা বাড়াবার জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করবে, এমন কথা আমরা মেনে নিতে পারি না। শেক্সপীয়ার বলেছেন :

“ভিক্ষুকরা মারা গেলে আকাশে ধূমকেতুর উদয় হয় না।
কিন্তু রাজকুমাররা মারা গেলে তাদের মৃত্যুতে
আকাশ ঝলসে ওঠে।”

শেক্সপীয়ারের কালে এই আবেগ সামগ্রিকভাবে কেউ বিশ্বাস না করলেও এতে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ রয়েছে যা বাস্তবতা বিশ্বজনীন এবং শেক্সপীয়ার নিজে তা মেনে নিয়েছিলেন। শেক্সপীয়ার তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারেন নি। এরই ফলে নাটকের চরিত্র কবি সিনার মৃত্যু কৌতুকময়। কিন্তু সিজার, ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসের মৃত্যু শোকাবহ। কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্যে যে পার্থিব গুরুত্ব, পূর্ণতা পেয়েছে সেই মূল্যবোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি কেন না আমরা এখন গণতন্ত্রী, শুধু বাইরের রূপেই নয় অন্তরের উপলব্ধিতেও। তাই অতি বিয়োগান্ত নাটককে এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিকের চেয়ে সমাজকেন্দ্রিক হতে হয় বেশি। আমি যা বলতে চাই তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি; এর্নস্ট টোলার রচিত গ্রন্থ ‘মাসেমেনশ’(১৩)-এর সাহায্যে। আমার মনে হয় না, এই গ্রন্থ অতীতে শ্রেষ্ঠ সব যুগে যে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে তার কোনওটার সমতুল্য। কিন্তু সেসব গ্রন্থের সাথে এর যে যথার্থ তুলনা চলে, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থ উন্নত করে অন্তরকে, এখানে গভীরতা এবং বাস্তবতাবোধ থেকে বীরোচিত কর্মকাণ্ড চিত্রিত হয়েছে। অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন তেমনি এই গ্রন্থে ‘করুণা ও ভীতি জাগিয়ে পাঠকমনকে কলুষমুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই রকম আধুনিক বিয়োগান্ত নাটক কমই রচিত হয়েছে। কারণ এখন শিল্পিত সাধারণ বিষয় দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে না, অথচ প্রাচীন আঙ্গিক এবং ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করতে হবে। এই কাজ কঠিন। ট্র্যাজেডি রচনা করলে নাট্যকারকে ট্র্যাজেডি অনুভব করতে হবে। সেই অনুভবের জন্যে যে বিশ্বে তিনি বাস করেন তার জন্যে সচেতন থাকতে হবে। শুধু অন্তরে নয়, প্রতি রক্তকণায় এবং স্নায়ুতে। মিঃ ক্রাচ তার বইয়ে প্রথম থেকে শেষাবধি মাঝে মাঝে নৈরাশ্যের কথা বলে গেছেন। তিনি যে বীরোচিতভাবে আনন্দহীন বিশ্বকে স্বীকার করে গেছেন তা হৃদয়কে স্পর্শ করে। কিন্তু এই আনন্দহীনতার কারণ হচ্ছে তিনি এবং অধিকাংশ সাহিত্যসেবী এখন পর্যন্ত পুরানো আবেগসমূহকে নতুন যুগের প্রেরণায় সজীবিত করতে শেখেন নি। প্রেরণার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সাহিত্যিকদের নিজস্ব গোষ্ঠীতে তা নেই। যে সব সাহিত্যিক গোষ্ঠী রয়েছেন, সমাজের জীবনের সাথে তাদের প্রাণের কোনও সংযোগ নেই। এই সংযোগ খুব জরুরী, যদি মানুষের অনুভূতির আন্তরিকতা এবং গভীরতা দিয়ে আসল দুঃখ এবং বেদনাকে পরিমাপ করতে হয়। যেসব প্রতিভাদীপ্ত যুবক জগতে তাদের কিছুই করার নেই মনে করে, ঘুরে বেড়ায়, তাদের আমি বলি : লেখার চেষ্টা ত্যাগ কর, তার পরিবর্তে না লেখার চেষ্টা কর। বিশাল বিশ্বে বেরিয়ে পড়, জলদস্যু হও। বোর্নিওতে গিয়ে রাজা হও, সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে শ্রমিক হও, এমন জীবনকে গ্রহণ কর, যাতে তোমার প্রাথমিক জাগতিক চাহিদা মেটাতে তোমার প্রায় সকল ক্ষমতা দখল করে রাখবে। আমি প্রত্যেকের জন্যে এই পরামর্শ দান করছি না। শুধু তাদের জন্যে করছি যারা মিঃ ক্রাচ আবিস্কৃত ‘অসুখ’ নামের রোগে সংক্রামিত হয়েছে। আমার বিশ্বাস এরকম জীবন-যাপন করার কয়েক বছর পরে সাবেক-বুদ্ধিজীবী দেখতে পাবেন, চেষ্টা করেও তিনি আর না লিখে পারছেন না, এবং এমন অবস্থা আসবে তখন নিজের কাছে আর তার লেখা তুচ্ছ মনে হচ্ছে না। লেখার আকৃতি থেকে লিখেই তিনি অপার আনন্দ লাভ করবেন।

——-

১. বায়রন, Lord Byron (১৭৮৮-১৮২৪)। Lord Gordon নামেও মায়ের পদবীতে পরিচিত। রোমান্টিক যুগের কবি।

২. অনুবাদ মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬)। তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের “Conquest of Happiness”-এর ভাব অবলম্বনে “সুখ” গ্রন্থটি রচনা করেন। 

৩. সলোমন, solomon, খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকের হিব্রু রাজা। খ্রিস্ট সমাজে তার চিন্তাধারাপুত ‘Legos Theology’ গৃহীত।

৪. Eccleiasten সলোমনের রচনা নয়। কিন্তু তাঁর নামের সাথেই এই গ্রন্থ সংযুক্ত।–রাসেল

৫. শেলি, P.B Shelley (১৭৯২-১৮২২), রোমান্টিক যুগের কবি। স্বল্পায়ু। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘Ode to the West Wind’, ‘The Cloud’, ‘the Skylark’ এবং ‘Song of Prosperive’

৬. মোতাহার হোসেন চৌধুরীর অনুবাদ।

৭. বেকন, Roger Bacon (১২১৪-১২৯২), ইউরোপের মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক।

৮. Coulton(কূলটন)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ “From St. Francis to Dante” হ’তে গৃহীত।–রাসেল।

৯. ব্রাউনিং, Robert Browning (১৮১২-১৮৮৯), বিখ্যাত ইংরেজ কবি। তাঁর কবিতায় নিস্পৃহতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তোলেন অনেক সমালোচক।

১০. ফিটজেরাল্ড (১৮০৯-৮৩), ইংরেজ কবি, পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের রুবাইত’-এর ইংরেজি অনুবাদক রূপে বিখ্যাত।

১১. ইবসেন, Henrik (Johan) Ibsen (১৮২৪-১৯০৬)। নরওয়ের কবি ও নাট্যকার। আধুনিক নাট্যকলার প্রবাদপুরুষ।

১২. শেক্সপীয়ার, William Shakespeare (১৫৬৪-১৬১৬)। ইংরেজী সাহিত্যের মহাকবি, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার।

১৩. Vera Meynell ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ‘Masses and Man’ নামে।-–রাসেল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *