বাবা জাহিদ চৌধুরী মনে করে, সালমা উর্বর জমির মতো। ভালো করে না চষলেও আশ্চর্য ফসল ফলে। মা মনে করে, সালমা মোহনার মতো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার পলিমাটিতে ভর্তি হয়ে যায়। নইলে সারাক্ষণ এমন আজগুবি উদ্ভট চিন্তা ওকে পাগল করে রাখে কেন? নিয়মের ব্যতিক্রমটা ও বেশি ভালোবাসে। ওতেই আনন্দ পায়।
বাবা এবং মেয়ে। মা এবং মেয়ে। ভাই এবং বোন। সম্পর্কের এ নির্ধারিত বেড়াজাল সালমার ভালো লাগে না। সম্পর্কের সূত্র ধরেই মানুষ মানুষের ওপর অধিকার খাটায়। প্রভুত্ব করার সাধ হয়। বাবা-মা ওকে কত ভালোবাসে। অন্য আরো দশজন বাবা-মার চাইতেও বেশি। আর বেশিটাই সালমার মনে হয় বাড়াবাড়ি। মনে হয়, তারা তাদের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করছে।
সালমার মনে হয়, মানুষ যখন এত কিছু স্বীকার করে একটি অন্ধ অবস্থানের মধ্যে বসবাস করে তখন সেটা তার জন্য এক চরম লজ্জাকর। অসুস্থতা। নইলে সম্পর্কের এ বেড়ি কেউ ভাঙে না কেন? কেন নিজের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে না? বাবা-মা তাদের সম্পর্কের গণ্ডিতে নিশ্চিত। সাকিবেরও একই অবস্থা। নির্ভাবনাময় জগতে ঘুমিয়ে আছে যেন। পরিবেশ এবং অবস্থানকে প্রশ্ন না করার অর্থ আপন সত্তাকে উপেক্ষা করা। সালমার বুকটা আবার ধড়ফড় করে। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তার বুনট ঘন হয়ে জমতে থাকে। আসলে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অভিরুচি দিয়ে আপন স্বভাব গড়ে তোলা দরকার। উত্তরাধিকারসূত্রে সমাজের কাছ থেকে পাওয়া সংস্কারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে এমন শর্ত তো কেউ দেয়নি। তবে এত সহজে সবকিছু গ্রহণ করে নির্বিবাদ হয়ে যাওয়ার কী মানে থাকতে পারে। সংসার সমাজ পৃথিবী মানুষের হাতে কিছু পৌঁছে দেয় না। সকালবেলা উঠে কেউ দেখে না দরজায় তার জন্য সোনার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে–সব পেয়েছির দেশে তাকে নিয়ে যাবে। আসলে আপন পরিকল্পনা এবং কাজ দিয়ে সবাইকে ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়। সারা জীবনের পরিশ্রমে সে জমিতে ফসল ফলে। মানুষের এই একক সত্তায় যখন অন্যের প্রতিফলন নেই, তখন সম্পর্কের বাঁধন এত শক্ত করার দরকার কী?
আমি চাই নিজের কাছ থেকেও মুক্ত থাকব। সালমা ভাবল। আমি চাই প্রতি মহর্তে নিজেকে অতিক্রম করে চলতে। আমার এই মানবীর চাই প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অতিক্রম করে চ চৈতন্যের জগৎই আসল। এছাড়া আর কোনো জগৎ নেই। সালমার নসিয়া তীব্র হয়ে ওঠে। কৌটা খুলে এলাচদানা মুখে দেয়। ফুল স্পিডে ফ্যান ছাড়ে। ভীষণ গরম লাগছে। দরজা বন্ধ করে গায়ের কাপড় খুলে ফেলে। সারা গায়ে গরম স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন। হাঁসফাঁস করে সালমা। কী যন্ত্রণা! বাইরে কাকটা বিশ্রী শব্দে ডাকছে। ওটার গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে। এমন কর্কশ কণ্ঠ? সুখ-দুঃখের কথা মনে হয় সালমার। ওরা কী করছে? ওরাও কি সালমার মতো গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে? ধুৎ, বাজে ভাবনা! সালমা ঠাণ্ডা মেঝের ওপর বালিশটা বুকে চেপে শুয়ে থাকে। বাবার কথা মনে হয়।
বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দর্শনের অধ্যাপক। সালমাও ওই একই বিষয়ে পড়ে। বাবা যা পড়ায় সালমা তা বোঝে না। বাবার লেকচার মনে হয় ষাঁড়ের চিৎকারের মতো। সালমার একদম ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে বাবা কিছু জানে না। জানে না বলেই গর্জনটা বেশি। সালমা ভেরে পায় না যে বাইরের লোকেরা বাবাকে পণ্ডিত বলে কেন? তিনটে-চারটে ডিগ্রি আছে বলে। শুধু ডিগ্রি থাকলেই একজন লোক শিক্ষকতার অধিকার অর্জন করে। সালমা হিসাব করে দেখল যে বাবার নিজের জীবন অসংখ্য গলদ এবং ত্রুটিতে ভরা। তার কথা এবং কাজে কোনো সামঞ্জস্য নেই। বাবা খ্যাতির মোহে পাগল। টাকার মোহে পাগল। এর বাইরে বাবা ভালো কিছু চিন্তা করতে পারে না। একটি লোক এত ত্রুটি নিয়ে অন্যকে কী শেখাবে? শিক্ষকতা করার তার কোনো অধিকার নেই। নিজের সঙ্গে আপস করে যে নিজের চরিত্রকে নোংরা করেছে তার কাছ থেকে অন্যে কী শিখবে? বাবার কী অধিকার আছে শিক্ষকতা করার? জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি অন্য কিছু করতে পারেন। শিক্ষকতা নয়। সালমার বুকটা ধক করে ওঠে। আসলে বাবা চরিত্রহীন। এই শব্দটা বাবার চরিত্রের মেজাজের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এসব কথা ভাবতে গেলে ঠাণ্ডা মেঝেয় শরীর শীতল হয়ে আসে।
অথচ বাবা-মা নাসিমাকে দিন-রাত চরিত্রহীন বলে গাল দেয়। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর নাসিমা বিয়ে ছাড়াই আরেকজনের সঙ্গে বসবাস করে। এটা তার অপরাধ। অনেকের মতে নাসিমা অ্যাবনরমাল। একদিন সালমা এ প্রসঙ্গ উঠিয়েছিল।
নাসিমা’পা, কেউ কেউ বলে তুমি নাকি অ্যাবনরমাল?
রেগে গিয়েছিল নাসিমা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিল, যে প্রতি পদে পদে নিজের সঙ্গে আপস করে তোরা তাকে বলিস নর্মাল। সেই তো সবচেয়ে বড় অ্যাবনরমাল। কেননা সে নিজের মতো করে বাঁচতে জানে না। তার নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে জানি বলেই আমি অ্যাবনরমাল, তাই আমাকে নিয়ে এ সমাজের মাথাব্যথা।
নাসিমার কথাগুলো নিয়ে সালমা অনেক ভেবেছে। ভেবে কুলোতে পারেনি। তার বাব-মার অযাচিত মন্তব্যও সালমার ভালো লাগে না। কারো সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে নিজের চরিত্রটা অন্তত একবার যাচাই করে দেখা উচিত। মানসিকতার কোন অ্যাঙ্গেল থেকে কথা বলবে সেটা যদি মাপা না থাকে তবে ব্যক্তি হিসেবে তার কিসের মহত্ত্ব? বাবা নিজেকে অতিক্রম করতে পারেনি। আপন সীমিত গণ্ডির মধ্যে ঘুরে মরে। যত অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তিই হোক নিজেকে যে অতিক্রম করতে পারে না তার কোনো মহত্ত্ব থাকে না। সালমা হাঁপিয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতে সব গুলিয়ে যায়।
দিন-রাতের ভাবনা নিয়ে ক্লাসে যায়, লেকচার শোনার চেষ্টা করে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট কোনোরকমে ক্লাসে কাটিয়ে বেরিয়ে আসে। করিডরে গিজগিজ করে ছেলেমেয়ে। রকিবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে ও। তখন হয়তো পরের পিরিয়ডের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। রকিব প্রথম দিকে অবাক হতো। এখন হয় না। জানে সালমা এখন ক্লাস করবে না এবং সঙ্গে সঙ্গে রকিবেরও ক্লাস করা হয় না। দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটে, চারুকলা কলেজের সামনে দিয়ে রেসকোর্সে ঢোকে। নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে। কারণে-অকারণে সালমা হেসে গড়িয়ে পড়ে।
দেখ সালমা অমন করে হাসিস না। তোর হাসি দেখলে রাগ হয়।
নতুন কথা শোনালি। ছেলেরা নাকি মেয়েদের হাসি শুনলে খুশি হয়?
সে তোর মতো মেয়ে না।
তাহলে কার মতো?
ওই যে ঝরনা, মহুয়া ওদের মতো। ওরা মিটমিটিয়ে হাসে, লঘুছন্দে চলে, চকিতে চায়। দেখিস না আমার বন্ধুরা ওদের নিয়ে কবিতা লেখে।
উফ ওদের ভাবভঙ্গি দেখলে আমার কী মনে হয় জানিস?
কী?
মনে হয় বিড়াল মাছ চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছে।
হেসে ওঠে রকিব। সালমা এমনি স্বচ্ছ। অনাবিল স্রোতের মতো। বাতাস কেটে সোজাসুজি চলে। আড়চোখে আশপাশে চায় না। মুখে এক, মনে আর এক নয়। আর এজন্যেই সালমার সঙ্গে রকিবের সখিভাব।
জানিস রকিব, মা মাঝে মাঝে বলে আমি নাকি উচ্ছন্নে যাব। তুই বল নিজের মতো করে কিছু করাকে কি উচ্ছন্নে যাওয়া বলে?
কী জানি। জানি না।
জানিস রকিব, ওই মহুয়াদের মতো চিরকালের মেয়ে হতে আমার ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে অন্যরকম হতে।
তুই তো অন্যরকমই।
কই আর!
সালমা চুপ করে যায়।
রকিবের মনে হয়, সালমার ভেতরে একটা টেপ রেকর্ডার আছে। ও অনবরত ওখানে শব্দ ধরে রাখে আর বাজায়। ওর মনের মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা কাজ করে। বাবার বিরুদ্ধে বিরাট অভিযোগ পুষে রাখে বুকের মাঝে। বুড়োদের দুচোখে দেখতে পারেনা। বুড়ো বয়সটাকে ভয় পায়। মাঝে মাঝে বলে, জানিস আশি-নব্বই বছরের কথা চিন্তা করলে আমি শিউরে উঠি।
আমার বেশ ভালো লাগে।
যাঃ!
সত্যি বলছি। আমার মনে হয় তখনই তোর সঙ্গে আমার ভালোবাসা গাঢ় হবে।
মিথ্যে কথা! আচ্ছা রকিব, তখন তুই আমাকে চুমু খাবি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়। একশোবার। আরো বেশি করে খাব।
হরিবল!
সালমা ঠোঁট বাঁকায়। দুহাতে মুখ ঢাকে।
ওই বয়সের আগেই আমাকে মরতে হবে।
সালমা কেমন বিষণ্ণ সুরে বলে। ওর মন খারাপ হয়ে যায়। রকিবও আর কথা বাড়ায় না। মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে থেকেও কোথায় যেন উধাও হয়ে যায় সালমা। তখন রকিবের খারাপ লাগে। অন্য সময় ও খুব সপ্রতিভ। ক্লাসের কাউকে পরোয়া করে না। কাছাকাছি বন্ধুদের তুই ছাড়া কথা বলে না। হাসিতে ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখে। কেউ কেউ অপছন্দ করলেও বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে ওকে পছন্দ করে। সালমার বেপরোয়া চলা, অকারণ উচ্ছ্বাস, দমকা হাওয়ার মতো আচরণ ইত্যাকার গুণাবলি ওকে বেশ জনপ্রিয় করেছে। বন্ধুরা বলে, সালমা যখন যেমন খুশি তখন তেমন। যখন তখন হুঁস করে ইঞ্জিনের গা ছেড়ে বেরিয়ে আসা ধোয়ার মতো নিমেষে ভেসে যায়। সেখানে থৈ পাওয়া দুঃসাধ্য।
সেই গরমের দুপুরে বাবার বিরুদ্ধে ভাবতে ভাবতে চিন্তায় বাবাকেই আঁকড়ে ধরে সালমা। বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখে আসছে সালমার প্রতি তার কী টান! সাকিবের জন্য বাবা এমন করে না। অথচ সালমা ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। সালমা হবার পর বাবার নাকি চাকরিতে উন্নতি হয়েছিল। প্রচণ্ডভাবে ভাগ্যে বিশ্বাসী বাবাকে গণক বলেছিল, এ মেয়ে আপনার জন্য ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে। ও যেদিন ঘর ছাড়বে তারপরই আপনার একটা অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
বাবা কি ভাবে, সালমার ভাগ্যটা বাবার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা, এজন্যেই ওকে বাবার প্রয়োজন? বুকটা কেমন করে। না ভাবলেই ভালো। সুখের স্মৃতি কিছু ভাবতে চাইল ও। সেই পনেরো বছর বয়সে যখন একবার পোলিও হয়েছিল তখন বাবা একমুহূর্ত ওকে ছেড়ে কোথাও যেত না। কোলে করে এঘর-ওঘর করত। মাঝে মাঝে সালমা ব্যথায় কাঁদত। মনে হতো সালমার যন্ত্রণাটা বুঝি তার নিজের শরীরেই ছেয়ে গেছে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত অবশ হয়ে গিয়েছিল। সালমার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসকরত। কথা বেরোতে চাইত না। কোনোদিকে নড়াচড়া করতে পারত না সালমা। বাবা উৎসুক চোখে ওর। দিকে চেয়ে থাকত। রাতে কাছে নিয়ে ঘুমোত। সালমা কোনোকিছুই ভাবতে পারত না। ভাবতে গেলে মৃত্যুর কথা মনে হতো। আর তখনই কান্না পেত।
তিনদিন বাড়িতে থাকার পর ডাক্তারের পরামর্শে বাবা ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাসপাতাল। দোতলা ঘরে কোণের দিকে ছিল ওর বিছানা। জানালা দিয়ে নিচের জারুল ফুলের গাছ দেখা যেত। সাদা আর বেগুনি থােকা ফুলে ছেয়ে থাকত গাছটা। সালমার ভীষণ ভালো লাগত। ওই গাছ আর মিনু বউদি এখনো হাসপাতালের স্মৃতি হয়ে আছে। বউদি ওকে খুব আদর করত। একজন নার্সের কাছে রোগী হিসেবে যেটুকু সেবা প্রাপ্য ছিল তার বেশি পেত মিনু বউদির কাছে। যেজন্যে হাসপাতাল ওর খারাপ লাগেনি। ওষুধের গন্ধ, ইনজেকশন, স্যালাইন, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি বাজে ব্যাপারগুলো মিনু বউদি ওকে একদম সহজ করে দিয়েছিল। সে কারণে ওষুধ খেতে সালমা কখনো আপত্তি করেনি। সে যত তেতো ওষুধই হোক।
সেটা ছিল জুলাই মাস। যখন তখন ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি আসত। জারুল ফুল গাছটাকে মনে হতো যেন গা পেতে দিয়ে নরম সোহাগ নিচ্ছে। একটা-দুটো পাপড়ি ঝরে যেত। সালমা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকত। বাগানজুড়ে কত ফুলগাছ ছিল। কোনো গাছ এমন করে ওকে টানেনি।
মিনু বউদি ঠাট্টা করত, তুই কি কবি হবি নাকি লিমা? দিনরাত অমন হাঁ করে দেখিস কী বল তো?
কী আবার? গাছ দেখি।
সালমা বেশি কথা বলতে পারত না।
উঁহু, লক্ষণ ভালো না। বাবা এলে বলব, এবার লিমার জন্য একটা টুকটুকে বর দেখতে।
ভালো হবে না বউদি। মিনু বউদি জোরে জোরে হাসত।
তোমার হাতে আমি কিন্তু আর একটুও ওষুধ খাব না। সত্যি বলছি, খাব না। তিন সত্যি করব?
না লক্ষ্মী, না।
বউদি তখন হাসি থামাত। অসুখের জন্য সালমার চুলগুলো বব করে দেওয়া হয়েছিল। সালমা ফোলা ফোলা ফাপা চুল নিয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে থাকত।
সালমার বেডের চার-পাঁচ বেড পরে থাকত একটি ছোট ছেলে। মা ছিল ওর সঙ্গে। ওরা ছিল সাঁওতাল। কালো-কুচকুচে গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে ছিল পেটানো শরীর। ওই মাকে দেখতে বেশ লাগত সালমার। সারাদিন তিন বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকত। একটুও ক্লান্ত হতো না। ছেলেটার নেফ্রাইটিস হয়েছিল। হাত-পা চোখ-মুখ সব ফুলো ফুলো। জাপানিদের মতো লাগত। ওই ছেলের আগে আরো সাতটা ছেলেমেয়ে মারা গেছে ওদের। চার বছরের ওপরে কোনোটা বাঁচেনি। সাঁওতাল-মা যখন পাশের রোগীর সঙ্গে গল্প করত সালমা শুনত। মনে মনে বলত, তুমি কেঁদো না সাঁওতাল-মা, তোমার ছেলে ঠিক ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সালমার এমন প্রার্থনা সত্ত্বেও ভালো হয়নি সাঁওতাল ছেলে। দশ দিনের মাথায় ও মরে যায়।
দেয়ালে মেঝেতে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদছিল সাঁওতাল-মা। সালমা কেঁদেছিল। ইচ্ছে করছিল সাঁওতাল মাকে জড়িয়ে ধরতে। সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু নিজেই তো নড়তে পারে না। কেমন করে যাবে! সালমা তখন হাতে-পায়ে একটু একটু করে শক্তি ফিরে পাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়তে পারে কেবল। তারপর থেকে কিছুতেই ঘুম আসত না সালমার। আচমকা ঘুম ভেঙে যেত। মনে হতো দেয়ালে কে যেন মাথা ঠুকছে। ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। সালমা চোখ মেলে তাকাতে পারত না। ভয়ে বালিশে মুখ গুজে থাকত। সে মৃত্যুর কথা আজো ভোলেনি ও। স্পষ্ট সব ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কালো কুচকুচে পেটানো শরীরের একজন সাঁওতাল-মা নিজের শরীরকে তুচ্ছ করে বাচ্চার জন্য কাঁদছিল। সে কী কান্না! কেউ থামাতে পারেনি। এখনো মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে সালমা শুনতে পায় সে ঠকঠক শব্দ।
হাসপাতালের দিনগুলোতে বাবা রোজ যেত। ওকে হাত ধরে হাঁটাবার চেষ্টা করত। ডাক্তার বলেছিল, হাত-পা অনবরত নাড়াচাড়া করতে। সালমা পারত না। দাঁড় করিয়ে দিলে ধুপ করে পড়ে যেত। বাবা কোলে করে উঠিয়ে দিত। আবার দাঁড় করাত।
পাটা সোজা করে ফেল মা। এই তো হয়েছে। বাঃ, লক্ষ্মী মেয়ে। কে বলেছে লিমা পারবে না। আর এক মাসের মধ্যে লিমা পুরোপুরি হাঁটতে পারবে।
বাবা ওকে অনেক সাহস দিলেও ভালোভাবে হাঁটতে এক বছর সময় লেগেছিল সালমার। বার্ম অংশটা অনেকদিন কমজোরি ছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হতো ওকে। সেইসব দিনে সালমার মনে হতো নতুন করে জীবন ফিরে পাচ্ছে ও। ও এক বছর বয়সে যেমন করে হাঁটত তেমনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখছে। হাঁটতে গিয়ে যখন ধপাধপ পড়ে যেত, সেই সাঁওতাল-মার কথা মনে হতো সালমার। মনে মনে বলত, তুমি কেঁদো না সাঁওতাল-মা, আমি নতুন জন্ম নিয়ে তোমার কোলেই ফিরে এসেছি। তুমি কেবল আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। সাঁওতাল-মা তুমি কেঁদো না। অমন করে মাথা খুঁড়ো না।
বাবা অবাক হতো।
কার সঙ্গে কথা বলছে লিমা?
কই? কী যে বলো!
সালমা লজ্জায় চুপ করে যেত।
মাঝে মাঝে বাবা গাড়ি করে ওকে দূরে নিয়ে যেত। হাত ধরে হাঁটত। সাকিব দুষ্টুমি করত। কখনো রাস্তা ধরে সোজা দৌড় দিত, গাছে উঠত। মাঠে নেমে আখ ভাঙত। বাবা ওর দিকে তাকিয়ে হাসত।
কদিন পর তুমি ঠিক অমনি হয়ে যাবে লিমা।
সালমা কথা বলত না। বাবার সান্ত্বনা ওকে তেমন স্পর্শ করত না। মনে হতো, এ জীবনও মন্দ নয়। সব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ও একদম নতুন হয়ে উঠছে। এমন অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়। বাবা ভাবে, সালমা বুঝি মনমরা হয়ে গেছে। বোকা, বাবাটা একদম বোকা। হাসপাতালের দিনগুলো ওর কত যে ভালো লেগেছে ও কি কাউকে তা বোঝাতে পারবে? এই যে নিরিবিলি রাস্তায় চুপচাপ হাঁটা, এই বা মন্দ কী? মাথার ওপর বড় বড় গাছের ছায়া। আম, জারুল, জাম, শিরীষ আরো কত কী গাছ। দু-একটা গাড়ি চলে যায় শব্দ করে। তারপর সব নীরব। বাবা কথা বলে না। সালমা হাঁটতে না পারলে গাছতলায় বসে। বাবা বোতল খুলে পানি দেয়। এক ঢোক পানি, গাছের ছায়া, দূরের মাঠ, ইলেকট্রিক তারে ঝক ঝক শালিক–সব সালমার অন্যরকম লাগে। বাবা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত।
তোমার এখন কেমন লাগছে লিমা?
ভালো।
কী ভাবছ?
একজন সাঁওতাল-মার কথা।
কেন?
জানি না। কেবলই মনে পড়ে। ওর সব বাচ্চা মরে যায় কেন? আল্লাহর এমন ইচ্ছে হয় কেন?
ছিঃ, অমন কথা বলতে নেই।
আমি মরে গেলে কেমন হতো?
দেখো দেখো লিমা, কী সুন্দর পাখি।
বাবা আমি মরে গেলে কেমন হতো?
দেখো লিমা, পাখিটার সারা গা নীল। এ রংটাকে বলে ব্রাইট বু। তুমি না ওইদিন জিজ্ঞেস করেছিলে ব্রাইট বু কোনটা?
বলো না বাবা, আমি মরে গেলে কেমন হতো?
আঃ লিমা!
তুমি কাঁদতে?
আঃ লিমা, এসব কথা মনে করতে নেই।
তুমি কি সাঁওতাল-মার মতো দেয়ালে মাথা ঠুকতে?
তুমি এমন করলে আমি এখান থেকে উঠে একদিকে চলে যাব।
ঠিক আছে, আর কথা বলব না।
দুজনে আবার হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে ফিরে আসত। সাকিবের দুষ্টুমি তখনো শেষ হয় না। সালমা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাকিবকে দেখতে ভালো লাগত সালমার। ওর প্রাণশক্তি নিজের মধ্যে অনুভব করত। আর তা করলেই ভেতরটা কেঁপে যেত। মনে হতো, ও বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন ভালোর দিকে এগোচ্ছে। না এগিয়ে উপায় কী? বাবা যে ওকে নিয়ে সাধনায় নেমেছে। ভালো করে তুলবার প্রচণ্ড সাধনা। সালমা এসবের কোনো অর্থ খুঁজে পেত না। কেন বাবা এমন করে? না করলেই বা কী?
আস্তে আস্তে ভালো হয়ে গেল সালমা। আর বাবাকে কেন্দ্র করে সেই দিনগুলো সালমার জীবনে স্মৃতি হয়ে রইল। গরমের ভীষণ দুপুরে ওই স্মৃতিটুকু ছাড়া বাবাকে কেন্দ্র করে আর কোনো অনুভূতি কাজ করে না। মনে মনে বিড়বিড় করে, তুমি অধ্যাপক জাহিদ চৌধুরীই থাকো। আমার বাবা হতে এসো না।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। সালমার বিরক্তি লাগে। দুপুরটা বেশ জমে উঠেছিল। এ সময়ে আবার কে এলো?
দিদিভাই? অ দিদিভাই?
কী?
রকিব ভাই এসেছে।
আসছি।
রকিব এসেছে। মন্দ না। সময়টা কাটবে। রকিব প্রায়ই আসে। এ বাড়িতে ওর অবাধ যাতায়াত। কেউ কিছু মনে করে না। ভয়ে ভয়ে মা কখনো আপত্তি করে, ছেলেদের সঙ্গে বেশি ঘোরাঘুরি ঠিক নয় লিমা।
বেশি কই দেখলে? তাছাড়া ছেলেদের নয়। রকিব ছাড়া কারো সঙ্গে ঘুরি না। আর ঘুরলেই বা কী, নিজের কাছে যে সৎ থাকে সেই সবচাইতে চরিত্রবান ব্যক্তি।
দেখো মেয়ের কাণ্ড। একটা কথা বললাম, অমনি উনি বক্তৃতা শুরু করলেন।
মা বেগতিক দেখে অন্য প্রসঙ্গে যায়। সালমা গজগজ করে।
তোমরা বড্ড সেকেলে। এজন্যেই তো তোমাদের সঙ্গে আমার মেলে না। দৃষ্টিটা একটু ছড়িয়ে দাও না। যা শিখেছ সেটাই চিরকাল আঁকড়ে থাকবে, নিজে কিছু নতুন করে ভাববে না মা?
তোর মতো একালের মেয়ে আর হতে পারলাম কই?
মা কাজে চলে যায়।
ভাবতে ভাবতে দ্রুত কাপড় পরে নেয় সালমা। চুল আঁচড়ায়। পাউডারের পাফ বুলোয় মুখে। ড্রয়িংরুমে রকিব বসে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়। সালমার লঘু পায়ের শব্দ ওর খুব পরিচিত।
কিরে কী করছিলি?
শুয়েছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলি?
না।
চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি।
চল।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে আসে। এ জায়গাটা ওদের খুব প্রিয়। প্রায়ই আসে ওরা। বিছিয়ে রাখা গালিচার মতো সবুজ ঘাস। কয়েক হাত দূরে ঝাঁকড়া মাথা গাছ। সামনে লেকের কাঁপুনি জল। দূরে মিরপুর রোড। সালমার মনে হয় এই সেই নির্জন দ্বীপ। কিন্তু কখনো মিরপুর রোড দিয়ে চলে যাওয়া ডবল ডেকার বাস সব এলোমেলো করে দেয়। ভাবনা তলিয়ে যায়। ভালো করে কিছু ভেবে আর বুঝে উঠতে পারে না। বিকেলের নীলাভ ছায়া লেকের জলে উথালপাতাল। সেদিকে তাকিয়ে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সালমা।
কিরে দাঁড়িয়ে যে, চল কোথাও গিয়ে বসি।
দাঁড়া একটু। আচ্ছা রকিব, পাস করে তুই কী করবি?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
বল না।
পাস করে চাকরি নেব।
তারপর?
তারপর চাকরি করতে থাকব।
ধুৎ। তুই সেই রাজপুত্রের কাছে গল্প বলা রাখাল ছেলের মতো বলছিস। কেবলই ফুড়ৎ।
আর কী করব বল? এমনি করেই তো জীবন শেষ হয়ে যাবে।
শুধু একটা কিছু নয়, আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে।
ওতে নাকি জীবনে স্থিতি আসে না। শান্তি হয় না।
কে চায় স্থিতি! কে চায় শান্তি! জীবনটাকে অনবরত ঘোলা করে তুলব।
সালমা?
বল।
এমন করে কী লাভ?
লাভ-লোকসান বুঝি না। চল, ওই গাছটার নিচে বসি।
সালমা পা ছড়িয়ে গাছের তলে বসে। পঁড়িতে হেলান দেয়। চোখ বুজে থাকতে ইচ্ছে করে। রকিব ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়েছে।
সালমা কিছু বলে না। মনে মনে হাসে, রকিবের কি এখন আবাল খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে। রকিব ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়েছে।
রকিব অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। একটা কিছু আঁচ করে। দুষ্টুমির ঝলক সালমার সারা মুখে।
কিরে, কী ভাবছিস?
তোর কী এখন আবাল খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে!
যাঃ। কী যে বলিস!
মন্দ কী! এই খোলা মাঠ গাছের নিচ। মনে হবে আমরা দুজন আদম আর ইভ। চারদিকে কেবল অনন্তকালের নীরব প্রকৃতি।
একদম বখে গেছিস তুই।
সালমা জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। হাঁটুর ওপর মুখটা রেখে চুপচাপ বসে থাকে। ফিকে হলুদ রঙের শাড়ি বিকেলের রোদের মতো। সালমার গায়ের হলুদ রঙের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। হঠাৎ বলে, আচ্ছা, রকিব এখন যদি গাছের ওপর থেকে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী কথা বলে ওঠে?
কী কথা?
যদি জিজ্ঞেস করে আমরা কোনো জাদুর কাঠি চাই কি না? তাহলে কেমন হয়?
মন্দ না।
জাদুর কাঠির কাছে তুই কী চাইবি?
আমি চাইব–আমি চাইব–এই দেখ কিছু ভেবে উঠতে পারছি। তুই কী চাইবি?
আমি-আমি–সত্যি তো আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। কী চাইবার আছে?
দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে।
রোদ একদম নেই। বিকেল শেষ, সন্ধ্যাও পুরোপুরি ঘনায়নি। এমনি একটা মাঝামাঝি সময় ওরা উঠে আবার হাঁটতে থাকে। বাড়ি ফেরা দরকার। কেউ কোনো কথা বলে না। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় আসে। নিরিবিলি রাস্তা। লোক চলাচল কম। আশপাশের বড় বড় বাড়িগুলোর জানালা দিয়ে আলো আসছে। ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। সে ফুলের নাম জানে না কেউ।
গেটের সামনে এসে রকিব থমকে দাঁড়ায়।
ভেতরে যাবি না?
না, কাজ আছে। কাল ইউনিভার্সিটি যাচ্ছিস তো?
দেখি চিন্তা করে।
এমন করলে তুই পাস করতে পারবি না সালমা।
পাস যে করতে হবে এমন কথা কাউকে দিয়েছি নাকি?
সালমা হাসে। রকিব চলে যায়। দোতলার বারান্দায় রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে নাসিমা দাঁড়িয়ে আছে। সালমাকে দেখে হেসে হাত নাড়ে। সালমাও হাসে। কথা বলতে পারে না। বাবা-মা দুজনে বাড়িতে। নাসিমা অনুচ্চ গলায় বলে, কাল সময় পেলে আসিস একবার।
সালমা মাথা নাড়ে। বারান্দায় সাকিব বসে। অবশ্যই বাবা-মার মতো মারমুখী নয়। নাসিমাকে ওর ভালো লাগে। সালমাকে দেখেই সাকিব ডাকে।
শোন দিদিভাই, খবর আছে।
কী? সালমা চেয়ার টেনে ওর কাছে বসে।
বাবা বোধহয় তোর একটা বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করছে। বিকেলে চায়ের টেবিলে সেরকম আলাপ-আলোচনা শুনলাম।
কিসের বন্দোবস্ত? সালমা ভুরু কোঁচকায়।
বুঝতে পারছিস না, বিয়ে—
বিয়ে? আমাকে বলতে এলে দেখাবা
সালমা উঠে পড়ে। ঘুরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। কাপড় ছাড়ে। বাথরুমে যায়, হাতমুখে পানি দেয়। শব্দটা খচখচিয়ে ওঠে মনে। বিয়ে? বিয়ে? অসম্ভব। কখনো মধুর আমেজের মতো লাগে। আবার বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে। না, একঘেয়ে ক্লান্তিকর। জীবনটাকে নিঃশেষ করে দেয়। রুবা ভাবির কথা মনে পড়ে। অনেকদিন রুবা ভাবির ওখানে যাওয়া হয়নি। কতদিন হলো? প্রায় মাসতিনেক। রুবা ভাবি ঠিক রাগ করবে। কাল-পরশু একবার যেতে হবে।