বাউলকবি রাধারমণ – ভূমিকা
২. ভূমিকা
প্রায় দশম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে লুইপাদ বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে তান্ত্রিকতার প্রবর্তন করেন। তারই আশ্রয়ে রচিত হয় চর্যাপদ ও অন্যান্য দোঁহাবলী। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বৌদ্ধধর্মশ্রিত পালরাজাদের শাসনশক্তি অবসিত হতে থাকে এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মবৃত দক্ষিণাত্যের সেন রাজারা বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করতে থাকেন। সেন রাজাদের আমলের বৌদ্ধদের ওপর প্রচুর উৎপীড়ন হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভক্ত ও সাধকেরা প্রত্যন্ত বাংলার পাহাড়ে কন্দরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। নূতন অত্যাচার শুরু হয় ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই-তুকী আক্রমণ। অত্যাচারিত বৌদ্ধারা অনেকেই নেপাল তিব্বতে আশ্রয় নেন। আর যে সব বৌদ্ধারা থেকে যান। তারা হয় ধর্মান্তরিত হন, নাহয় শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। মাৎস্যন্যায়ের কিছু দিন পরই আবির্ভূত হন। শ্ৰীচৈতন্য এবং তাঁর কুলপ্লাবিনী বৈষ্ণব ধর্মের ধারায় প্রভাবিত হয়। সারা বাংলাদেশ ও সন্নিকট অঞ্চল। ওদিকে বৌদ্ধ, শাক্ত ও শৈব ধর্মের বুড়ি ছুয়ে টুয়ে বৈষ্ণব দেহবাদী সহজিয়া ধর্ম ক্রমশ প্রকট হয়।
সাধারণে স্বীকৃত আছে যে সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের আদি পুরুষদের মধ্যে রয়েছেনবিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, রঘুনাথ গোস্বামী, কৃষ্ণদাস গোস্বামী, গোপাল ক্ষত্রিয়, বিষ্ণু দাস, রাধাকৃষ্ণ চক্রবতী, গোবিন্দ অধিকারী ও সিদ্ধ মুকুন্দদেব প্রমুখ। চৈতন্য সমকালীন স্বরূপ দামোদর ও রায় রামানন্দ চৈতন্য প্রবর্তিত রাগাত্মিক ভক্তি ধর্মের সাধ্য সাধনতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। রঘুনাথ গোস্বামী অতিমমী’ রসের আধার স্বরূপ দামোদরের সাক্ষাৎশিষ্য ছিলেন এবং রঘুনাথের সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন প্রথিতযশাচৈতন্যচরিতামৃতকার কবিরাজকৃষ্ণদাস গোস্বামী। আর কৃষ্ণদাস কবিরাজের পাঁচ জন প্রধান শিষ্যের মধ্যে সিদ্ধ মুকুন্দ দেব ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ও সর্বাধিক প্রিয়। মহাপ্রভুর তিরোধানের পর শাক্ত আচার, বৈষ্ণব ও সহজিয়া বৌদ্ধ প্রভাবিত তত্ত্বের সমাহারে আনুষ্ঠানিক মিলনের মাধ্যমে সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটে। বলা হয়, পূর্বোক্ত মুকুন্দ দেব গোস্বামী ছিলেন সেই বিশিষ্ট ধর্মমতের শ্রেষ্ঠ প্ৰবক্তা। তাঁর সংস্কৃত ভাষায় রচিত মুক্তাবলীতে অমৃত রত্নাবলী, রাগ রত্নাবলী, অমৃত রসাবলী, প্রেম রত্নাবলী, ভৃঙ্গ রত্নাবলী ও লবঙ্গ চরিত্র গ্রন্থে তৎকথিত সহজ ধর্মের বিশ্লেষণ গ্রস্থিত হয়েছিল! আশ্চর্য কোনো কারণে এই সব মুক্তাবলবী কোনো উদ্দেশ পাওয়া যায় না। বদলে এই গ্ৰন্থরাজির তত্ত্ব অবলম্বনে রচিত যে পুথিসমূহ পাওয়া গেছে যা বাংলা ভাষায় রচিত বা অনুদিত সেগুলো হল আগম সার, আনন্দ ভৈরব, অমৃত রত্নাবলী, অমৃত রসাবলী ইত্যাদি। এই পুথিসমূহ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন ডাঃ পরিতোষ দাস তাঁর চৈতনোত্তর চারিটি সহজিয়া পুথি’ গ্রন্থে। শ্ৰীহট্টেও এই রকম একটি গ্রন্থের খবর পাওয়া যায় আমাদের গীতিকার রাধারমণ দত্তের গুরুর (রঘুনাথ ভট্টাচাৰ্য) গুরু তিলকচাঁদ গুপ্তের লেখা সহজ চরিত্র” নামীয় গ্রন্থে। সহজ চরিত্রও দুস্তপ্রাপ্য গ্রন্থ, কেননা শ্ৰীহট্ট সাহিত্য পরিষদের পুথি তালিকায় গ্রন্থটি নিবন্ধিত হলেও (ক্ৰমিক সংখ্যা ৩৭৫, শ্ৰীযন্তীন্দ্রমোহন ভট্টাচাৰ্য কৃত তালিকা দ্রষ্টব্য) বর্তমানে অযত্বরক্ষিত শ্ৰীহট্ট সাহিত্য পরিষদের অমূল্য পুঁথি ভাণ্ডারে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আমরা সহজিয়া তত্ত্বের বিশদ বিশ্লেষণে যাব না। অল্প কথায়, কেবল সাধারণ পরিচিতির জন্য সেই রসসম্পদের কিছু সন্ধান নেব মনস্বী পণ্ডিতদের সূক্তি ব্যবহার করে।
এক। বাংলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায় পূর্ববতী বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের যুগোচিত বিবর্তন। বৌদ্ধ সহজিয়ার মতো বৈষ্ণব সহজিয়াগণও বলিয়াছেন যে প্রত্যেক নরনারীর দৈহিক রূপের মধ্যেই তাঁহাদের স্বরূপ লুক্কায়িত আছে। নররূপে নর, স্বরূপে কৃষ্ণ, তেমনি নারী রূপে নারী, স্বরূপে রাধা। রূপ ছাড়িয়া স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে।
—ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত, (ভারতকোষ)
দুই। সহজ মানুষ হইবার সাধনা দুরূহ। সামান্য মানুষ সর্বত্রই আছে। কিন্তু সহজ মানুষ চৌদভুবনের কোথাও নাই, তাহাকে গড়িয়া নিতে হয়। গড়িতে হয় কি ভাবে? তাহা হয় রাগনুগা ভজনে। এই ভজনের একটি ক্রম বর্তমান। এই ক্রমের প্রথমটি প্রবর্ত অবস্থা। প্রবর্ত অবস্থায় প্রথমে নামকে আশ্রয় করিয়া সাধনা চলে। তখন গুরুর আজ্ঞা পালন এবং অকৈতবা কৃষ্ণ প্রেম, সাধুসঙ্গ করিয়া চলিতে হয়, দ্বিতীয় অবস্থা সাধক অবস্থা। এ সময় আশ্রয় ভাব। তৃতীয় অবস্থা সিদ্ধ অবস্থা। ইহার দুইটি আশ্রয়, একটি প্রেম, অপরটি রস। প্রবর্ত অবস্থায় ইন্দ্ৰিয় সংযম ও শৌচাদি আচরণ পূর্বক গুরুর নিকট হইতে নাম প্রাপ্ত হইয়া নাম এবং নামীয় অভেদ জ্ঞানপূর্বক তাহা অনুক্ষণ জপ করিতে করিতে অন্তর ও দেহের কলুষ নিবারিত হয় ও সাত্তিক বিকারাদির উদয় হইয়া থাকে। …সাধক অবস্থায় ভাবই আশ্রয়। এই অবস্থায় কামজয় একান্ত আবশ্যক। যখন কাম নিজের বশীভূত তখন নিজের ভাব অনুসারে নায়িকা গ্রহণ করিতে হয়। সাধক অবস্থায় নিজেকে প্রকৃতি মনে করিতে হয়। কিন্তু সিদ্ধাবস্থায় নিজের প্রকৃতি ভাব সম্পন্ন হইয়া যায়, যাহার ফলে প্ৰেম সাধনায় অগ্রসর হইবার পথ খুলিয়া যায়।
— গোপীনাথ কবিরাজ
ভুমিকা, চৈতন্যোত্তর চারিটি সহজিয়া পুথি
—পরিতোষ দাস
রাধারমণের গীতসংগ্রহে এই সহজ ভাবেরই রসমূর্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকার ঘটে।
২.১ রাধারমণ জীবনকথা
(১২৪০—১৩২২ বঙ্গাব্দ, ১৮৩৪—১৯১৬ খ্রি.)
রাজবৈদ্য চক্ৰপাণি দত্তের অধস্তন পুরুষেরা শ্ৰীহট্টের প্রাচীন সম্রান্ত বংশ। এই বংশের জনৈক প্রভাকর দত্ত ও কেশব দত্তের নামে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার অন্তৰ্গত দুটি গ্রাম নামাঙ্কিত আছে। প্রভাকর দত্তের থেকে দ্বাদশ পুরুষেরাধারমণের জন্ম,সুনামগঞ্জ মহকুমার জগন্নাথপুর থানার অধীন আতুয়াজন পরগনার কেশবপুর গ্রামের রাধামাধব দত্তের ঘরে, ১২৪০ বঙ্গাব্দে। মাতা সুবৰ্ণ দেবী। পিতৃদেব রাধামাধব পরম পণ্ডিত ও অশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে জয়দেবের গীতগোবিন্দেরস-ছন্দটীকা, ভারত সাবিত্রী ও ভ্রমর গীতা। বাংলা রচনার মধ্যে কৃষ্ণলীলা কাব্য, পদ্মপুরাণ, সূর্যব্রতের গীত, গোবিন্দ ভোগের গানইত্যাদি উল্লেখ্য। বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের প্রতিও তার অনুরাগ ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। রাধারমণের কৈশোরেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়।
প্রথম জীবন থেকেই রাধারমণ তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। এই কৌতুহলের বশবতী হয়েই তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি নানা মতের চর্চাচৰ্যা করেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তার সন্তোষ বিধান হয়নি।
১২৭৫ বঙ্গাব্দে শ্ৰীহট্টের মৌলবীবাজার মহকুমার সদর থানার আদপাশা গ্রামে তিনি মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দের বংশে নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীর পাণিগ্রহণ করেন। রাধারমণের চার পুত্রের তিনজনের এবং স্ত্রী গুণময়ী দেবীর অকাল প্ৰয়াণে রাধারমণ সংসারে বিবিত্ত হয়ে পড়েন এবং এরি কাছাকাছি সময়ে তঁর পঞ্চাশ বছর বয়সে মৌলবীবাজারের সন্নিকট ঢেউপাশা গ্রামের সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্য গোস্বামীর অলৌকিক কার্যকলাপ ও সাধনার খবর পেয়ে তাঁর কাছে এসে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে তার সহজ সাধনার শুরু এবং তখনই গৃহত্যাগী হয়ে বাড়ির কাছেই নলুয়ার হাওরে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সরে যান। তাঁর গানেও এর সমর্থন মেলে,
‘অরণ্য জঙ্গলার মাঝে বাধিয়াছি ঘর
ভাই নাই বান্ধব নাই কে লইব খবর’
সেই আশ্রম তখন ভক্তবৃন্দে ভরে যায় এবং ভক্তবৃন্দ সহ রাধারমণ অহোরাত্র সংকীর্তনানন্দে মেতে থাকেন। ধ্যান মগ্ন সেইসব পরিবেশেই তাঁর গীতসমূহ রচিত হতে থাকে। শোনা যায় নিজে বড় গান লেখেননি স্বহস্তে, তিনি গীতসমূহ রচনা করে করেই গেয়ে যেতেন এবং ভক্তবৃন্দ তা মুখস্থ করে বা স্মৃতিতে ধরে বা লিখে রাখতেন। তার গীতসমূহের সংখ্যা সহস্রাধিক’ বলে জীবনীকাররা উল্লেখ করেছেন। আমাদের ধারণা আরো অনেক অনেক বেশি গান তিনি রচনা করে গেছেন। যদিও রাধারমণের স্বগৃহে আমরা খুব বেশি সংখ্যক গান পাইনি, তবু কেশবপুর গ্রামেই এখনো প্রচুর অসংগৃহীত গান ছড়িয়ে আছে, নানা কারণে আমরা তার অংশমাত্র সংগ্রহ করতে পেরেছি। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অন্যত্রও হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, দেশ বিভাজনের পর তঁর ভক্তরা অনেকেই আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে ও অন্যত্র সরে এসেছেন। তাদের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা নানা কারণে কৃষ্টকর হয়ে পড়ায় আমাদের সংগ্ৰহ সংখ্যা আশানুরূপ হতে পারেনি, অথচ ঢাকার অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফ সাহেবের মাধ্যমে জানা গেছে যে সুনামগঞ্জের জামাইপাড়ার জনৈক শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়ের সংগ্রহেই একসময় সহস্রাধিক গানের সংগ্রহ ছিল। এও জানা যায় শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায় কাছাড়ের শিলচরে এসে কিছুকাল বসবাসের পরই লোকান্তরিত হন এবং তঁর আত্মীয় স্বজনেরা কেউ সেই সংগৃহীত গীতরাশির কোনো হদিশ দিতে পারেন নি।
শ্ৰীহট্ট বা তার সন্নিহিত অঞ্চলে বাংলা তথা ভারতীয় বৈষ্ণব সাহিত্যের পদাবলী কিছু কিছু গীত হলেও হাটে, ঘাটে, মাঠে এবং ভজনালয়সমূহে সর্বত্রই রাধারমণের গীতসমূহের বিশেষ প্রচলন। এছাড়া এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলমান সাধারণ মানুষের মধ্যে ওই গান সমান জনপ্রিয়। তাঁর গানের ক্ষুদ্র-বৃহৎ যে তিনটি সংকলন এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে সেই সংকলন সবকটিরই সম্পাদনা গুণগ্ৰাহী মুসলমানদের হাতে। প্রথমটি, রাধারমণ সংগীত, সম্পাদক, মোহাম্মদ আসরাফ হোসেন, সাহিত্যরত্ন, ভানুগাছ, শ্ৰীহট্ট, (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), দ্বিতীয়টি “ভাইবে রাধারমণ বলে’ (১৯৭৭) সম্পাদনা–হাসন পছন্দ মুহম্মদ আবদুল হাই, সুনামগঞ্জ শ্ৰীহট্ট এবং তৃতীয় গ্রন্থ রাধারমণ সংগীত (১৯৮১) সংগ্ৰহঃ চৌধুরী গোলাম আকবর, সাহিত্য ভূষণ, প্রকাশক মদনমোহন কলেজ প্রকাশন সংস্থা, শ্ৰীহট্ট। শ্ৰীহট্টের অপর উল্লেখ্য রবীন্দ্রসমাদৃত লোককবি হাসন রাজাও (গ্রন্থ হাসন উদাস) রাধারমণের সমসাময়িক। কথিত আছে তারা দুজনেই দুজনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, হাসন রাজার একটি গানে নাকি রাধারমণ প্রসঙ্গ রয়েছে, “রাধারমণ কেমন আছইন হাসন রাজা জানতে চায়’ কিন্তু রাধারমণের কোনো গানে আমরা এযাবৎ হাসন রাজা প্রসঙ্গ পাইনি।
রাধারমণের গুরু রঘুনাথের সম্বন্ধে নানা অলৌকিক কাহিনী শ্ৰীহট্টের জনশ্রুতিতে রয়েছে, রাধারমণ সম্বন্ধেও কিছু কিছু কিংবদন্তি রয়েছে, রাধারমণের পৌত্র শ্ৰীযুক্ত রাধারঞ্জন দত্ত পুরকায়ন্থের মৌলবীবাজার সন্নিকট ভুজবল গ্রামের বাড়িতে সাক্ষাৎ আলাপে যা আমাদের গোচর হয়েছিল।
১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬শে কার্তিক শুক্রবার শুক্লা ষষ্ঠী। তিথিতে এই কবিসাধকের দেহান্ত হয়। কেশবপুর গ্রামে তাঁর সমাধিতে এখনো প্রতি সন্ধ্যায় প্ৰদীপ জ্বলিয়ে কীর্তন করে তাঁর ভক্ত সাধকেরা গুরু রাধারমণের স্মৃতি রক্ষা করে চলেছেন এবং সেই গ্রামেই সম্প্রতি একটি স্মৃতিরক্ষা কমিটি করে স্থানীয় জনসাধারণ দ্বারা কবির রচনাবলীর উপর গবেষণা কাৰ্য চালাবার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাধারমণের আত্মীয় স্বজন কেউ কেউ এখনো কেশবপুরে রয়েছেন। কবিপুত্ৰ বিপিনবিহারীর দ্বিতীয় পুত্ৰ শ্ৰীরাধারঞ্জন দত্ত পুরকায়স্থ, আগেই উল্লিখিত হয়েছে, বর্তমানে মৌলবীবাজার সন্নিকট ভুজবল গ্রামে বসবাস করছেন। বিপিনবিহারী পিতৃহীন হলে মাতুল গৃহে বসবাসের জন্য ভুজবল আসেন, সেই থেকেই ভুজবলে তঁদের বসবাস। বিপিনবিহারীর জ্যেষ্ঠপুত্র নিকুঞ্জবিহারীর পুত্ররা কেউ কেউ মৌলবীবাজার শহরেই বসবাস করছেন। এদের সকলের সম্বন্ধে বিস্তৃততর তথ্য পরিশিষ্টের বংশতালিকায় দেয়া গেল।
২.২ গীতসংগ্ৰহ কথা
সহাধ্যায়ী বন্ধু শ্ৰীপূর্ণেন্দু গোস্বামী (পিতা, সদ্যপ্রয়াত বিশ্রুত অধ্যক্ষ প্রমোদ গোস্বামী) যাদের বাড়ি ছিল শ্ৰীহট্ট জগন্নাথপুরের সােচায়ানি গ্রামে (রাধারমণের কেশবপুর গ্রামের সন্নিকট) বর্তমানে কর্মরত অরুণাচল প্রদেশে, একবার ১৯৭৬ সালে এসেছিলেন আগরতলায় বেড়াতে। গুণী বন্ধু, হার্দ্য আলাপচারী গানও গাইতেন নানা রকম, সেবার এক গানের আসরে নানা রকম গানের শেষে ধরলেন রাধারমণের গান। কয়েকটি রাধারমণের গান শোনায় আমাদের কৌতুহল বাড়ে, এবং বলা যায়। সেই থেকে এই বাউল কবির গীতি সংগ্রহের আগ্রহের সূত্রপাত।
কাজটা হাতে নিয়েই প্ৰায় হাতের খছেই পেয়ে গেলাম শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত সংগৃহীত ও ডঃ নির্মলেন্দু ভৌমিক সম্পাদিত শ্ৰীহট্টের লোকগীতি। এতে অনেকগুলো গান এক সঙ্গেই পাওয়া গেল। সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের প্রতিভাজন অধ্যাপক, বর্তমানে অধ্যক্ষ, আবুল বসরা, সংগ্ৰহ-উদ্যোগের খবর পেয়ে, পাঠালেন সেই কলেজের ১৯৬৪ খৃষ্টাব্দের একটি মুখপত্র, এতে পেলাম শ্ৰদ্ধেয় অধ্যাপক সুধীরচন্দ্ৰ পালের একটি রাধারমণ বিষয়ক প্রবন্ধ, তাতে দশ বারোটির মতো পদও পাওয়া গেল মূল্যবান জীবনী সহ।
ভিসা যোগাড় করে সিলেট গেলাম একাধিকবার, সেখানেই মুসলিম সাহিত্য সংসদের শ্রদ্ধেয় গ্রন্থাগারিক নূরুল হকের সঙ্গে দেখার পর জানা গেল মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, সাহিত্যরত্ন, কাব্যবিনোদের সর্বপ্রথম সংগ্ৰহ ‘রাধারমণ সংগীত’-এর কথা। গ্রন্থাগারে গিয়ে নূতন কিছু গান পাওয়া গেল, যার ভাষা তুলনামূলকভাবে মূলানুগ। কলকাতার যাদবপুরে আছেন বাংলা পাণ্ডুলিপির তালিকাসমন্বয় মহাগ্রন্থের লেখক, গুরু স্থানীয় শ্ৰদ্ধেয় অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচাৰ্য, ডি. লিট, ওঁর কাছে প্রসঙ্গটা তুলতেই জানা গেল উনি দীর্ঘকাল ধরে এই গানের সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত আছেন এবং তঁর সংগ্রহেও প্রচুর গান রয়েছে। পরে তিনিই স্নেহভরে আমাকে প্রস্তাব দিলেন কাজটা যুগ্মভাবে সম্পাদনার, আজ এই গ্রন্থে সেই আকাঙক্ষাই ফলিত রূপ পাচ্ছে।
ঘুরেছি নানা স্থানে–কৈলাসহর, ধর্মনগর (ত্রিপুরা), করিমগঞ্জ, রামকৃষ্ণনগর, বড়বাড়ি (কাছাড়), শিলং (মেঘালয়), শিলেট, গহরপুর, ভুজবল, জগন্নাথপুর, কেশবপুর, মৌলবীবাজার, ঢেউপাশা, সমশের নগর, শ্ৰীমঙ্গল, দুর্গাপুর (শ্ৰীহট্ট, বাংলাদেশ) ও অন্যান্য স্থানে। স্নেহশীল ও দরদী ভ্ৰমণ সঙ্গী ছিলেন। কখনো, মাতুল নলিনীকান্ত দত্ত, বন্ধু ডঃ সুখোন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়, ভ্রাতা আশুতোষ দত্ত, হীরক চৌধুরী, ভগ্নী মুক্তা চৌধুরী, শ্ৰীযুক্ত সুভাষ রায়, প্রতিভাজন অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাস, বন্ধু পূর্ণেন্দু গোস্বামী, কখনো নাম না জানা কিংবা কখনো নাম ভুলে যাওয়া কোনো সহৃদয় ব্যক্তি কখনো বা সম্পূর্ণ একা। কখনো রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যায়, কখনো বা কোথাও গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে গৃহপ্ৰত্যাগমনে বাধ্য হয়েছি। নানা ধরনের সাধারণ মানুষের, গৃহস্থ্যা-মাতা-ঘরানীর, হিন্দু মুসলমান ভাইবন্ধুর, শ্ৰদ্ধেয় বৃদ্ধবৃদ্ধার সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটেছে, সর্বত্রই পেয়েছি সানুরাগ অভ্যর্থনা, রাধারমণের প্রতি সকলেই অনুরক্ত, কখনো বা পথপাশ্বেই অনুরাগিজন পেয়েছি, কেউ কেউ আংশিক বা পুরো পদটাই গেয়ে শুনিয়েছেন, যাদের ঘরে গেছি। কেউ দিয়েছেন খ্যাতন্ত্র খুলে পদাবলী টুকে নেবার সুযোগ, কেউবা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে গানটি গেয়েছেন আর আমরা কথাংশ টুকে গেছি, কেউ কেউ বা দুয়েক দিনের জন্য খাতাখানা ধার দিয়ে ও উৎসাহ যুগিয়ে গীতভাণ্ডার সমৃদ্ধির সহায়তা করেছেন। পত্ৰাদি মারফতও প্রচুর গীতি সংগৃহীত হয়েছে। র্তাদের মধ্যে প্রধান শ্রদ্ধেয় কবিপৌত্র রাধারঞ্জন দত্ত পুরকায়স্থ, কবি ও সহাধ্যায়ী করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য, ডঃ সুখোন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাস ও অন্যান্যরা। এরা সকলেই আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রতিভাজন, এদের কাছে এবং আরো অজস্র মরমী মানুষের প্রতি-সংগ্ৰাহকেরা ঋণী। কেউ কেউ গানের যোগান না দিতে পারলেও উপদেশ পরামর্শ দিয়ে কিংবা মূল্যবান তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন।
আমাদের সংগ্রহের সবচেয়ে অবিকৃত উপকরণ ছিল কবিপৌত্র রাধারঞ্জন দত্ত প্রেরিত তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্বগীয় নিকুঞ্জবিহারী দত্তের অনুলিখিত (১৯২৯) একটি পুথি। এর ভাব-ভাষা ছন্দ অনেকটাই রয়েছে অবিকৃত এবং প্রচল-দুষ্ট থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এর হস্তাক্ষরের চিত্ররূপ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।
বর্তমান সংকলনের প্রায় নয়শত গানের বাইরে আরো অনেক অনেক গান অসংগৃহীত পড়ে আছে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সুযোগ ও সময়ের অভাবের জন্য অনেক জায়গা থেকে বর্তমান সংগ্রাহকদের অনেক পদ সংগ্ৰহ না করেই ফিরে আসতে হয়। কিংবা প্রাপ্ত গানের খাতা থেকে সময় সময় আংশিক অনুলেখনের পরেই খাতা ফেরত দিয়ে দিতে হয়, তাই আমাদের ধারণা, সিলেটের অভ্যন্তরে গ্রাম শহরে ত্রিপুরা কাছাড়েব ও শ্ৰীহট্ট সংলগ্ন গ্রামের থেকে এখনো অনেক গান সংগৃহীত হতে পারে। এ বিষয়ে স্থানীয় উৎসাহীরা তৎপর হলে অনায়াসে আরো সুফল পেতে পারেন।
২.৩ গানের ভাষা
শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের ভাষাতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যের ওপর একাধিক গবেষণামূলক আলোচনা হয়ে যাওয়ার পর এই অঞ্চলের ভাষাতত্ত্বের পৃথক আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা কমে গেছে। কিন্তু বর্তমান গ্রন্থের পূর্ণতার জন্য ভাষাটির কথঞ্চিৎ পরিচায়ন দরকার। রাধারমণের গানে আঞ্চলিক ও সর্ববঙ্গীয় উভয় রূপই দেখা যায়, কোথাও বা কিছু কিছু আঞ্চলিক শব্দের মিশ্রণ থাকলেও তা সহজ গ্রাহ্য। আঞ্চলিক রূপভেদসমূহ নীচে কিছুটা আভাষিত হল :
(১) স্বরধ্বনির পরিবর্তন :
(ক) আপনিহিতি–সারি > সাইর, জানিয়া > জাইনা > জাইনে,
ভাবিয়া > ভাইবা > ভাইবে।
(খ) বিপ্রকর্ষ–আগুন > আগুইন, আন্ধার > আন্ধাইর,
উল্টা > উলুটা, জাগিলে > জগুইলে, মার > মাইর,
লহর > লওহর।
(গ) স্বরসংকোচ/স্বরলোপ–ডুবিলে > ডুবলে, তনু > তন্,
থুইয়া > থইয়া, পর্য> ধৰ্য, ধুইয়া > ধইয়া, ননদ > নন্দে
নিরালা > নিরাল, বিশাখা > বিশখা, মাস্তুল > মস্তুল
যুবতী > যৌবত, শুইয়া > শইয়া।
(ঘ) স্বরবৃদ্ধি–অনল > আনল, ঝাম্প > ঝাম্পু, দেহ > দেহা,
পর > পরা।
(ঙ) স্বরসংগতি—নিভিয়াছিল > নিবিছিল, সুকনা > শুকুনা।
(চ) স্বরবিপর্যাস–সমুদ্ৰ> সমদুর
(ছ) স্বরবিকার–অ > উ-মনুষ্য> মুনিষ্য, বিন্দরে > বিদুরে,
অ > এ—কেন > কেনে,
উ> আ—শুধু > সুধা > হুদা,
উ> ই-ভাবুক > ভাবিক,
উ> ও-কেউ > কেও, তুমি > তোমি, ভুলিয়াছ>
ঋ> অ-দৃঢ় > দড়,
ঋ > ই-কৃষ্ণ>কিষ্ণ, গৃহ > গির,
ঋ > রু (ই> উ)-ঋষি> রুষি,
ঋ > রে (ই-> এ)-বৃথা > ব্ৰেথা,
এ > অ–আসবে > আইসবে > আইসব, নিতে > নিত,
এ > আয়–ফেলে > ফালায়, নাড়ে > নাড়ায়
এ > ঐ–জিজ্ঞাসেন > জিজ্ঞাসাইন
পাইয়াছেন > পাইছইন,
ও > অ–ও নিতাই> অনিতাই,
ও > আয়–ওরে > অয়ারে
ও > উ–চোর > চুর, তোমার > তুমার
ও > এ—ওগো > এগো
ও > এও –ভোরা > ভেওরা
ঔ > ঐ – যৌবন > যৈবন
(২) ব্যঞ্জন ধ্বনির রূপান্তর :
(ক) সমীভবন > দুর্লভ > দুল্লভ, দুশ্চারিণী > দুর্বাচ্চারিণী, ভবাৰ্ণবে > ভবান্নবে,
(খ) বিপর্যাস —অনৰ্পিত > অনপূত
(গ) নাসিকগীভবন —আঁখি > আঙ্খি, ধোঁয়া > ধুমা,
(ঘ) স্বতে নাসিকগীভবন–কক্ষের > কাংখের, দিব > দিমু, বাত > মাত, বানায় > মানায়
(ঙ) হকারীভবন–প্ৰেমময়ী > প্ৰেমমহী > সামাইল > হামাইল
(চ) অল্প প্রাণের মহাপ্ৰাণতা –অপরাধে > অফরাধে, গাগরি > গাগুরি > ঘাঘুরি,
(ছ) মহাপ্ৰাণের অল্পপ্ৰাণতা–অর্ঘে> অৰ্গে, খোটাখান > খোটাকান, ভাইবে > বাইবে, মূঢ় > মুড়, সাথে > সাতে,
(জ) অঘোষের ঘোবিত্ত–নিষ্কপটে > নিষ্কবটে
(ঝ) বর্ণদ্বিত্ব–অনাথ > অন্নাথ, ত্রিনাথ > তিন্নাথ,
(ঞ) বৰ্ণাগম-(র-আগম) উজ্জ্বল > উর্জল, কালিন্দী > কালিন্দ্রী, জন্ম > জার্ম, সাহায্য > সাহার্য,
(ট) বৰ্ণলোপ—কোথায় > কুআই> কই, জয়ন্ত্রী > জত্রী, বাজায় > বায়, মহাজন > মাজন
(ঠ) বর্ণবিকার–দন্ত্য > অন্তঃস্থ-ননী > লিনী, নাগাল > লাগাল, অস্থঃস্থ>
অন্তঃস্থ—র > ল–কাঁটারি > কাটালি, ল> রি—মুরলী > মুররী
অন্তঃস্থ > তালব্য–র > ড়–চরায় > চড়ায়, নাগর > নাগড়
তালব্য > অন্তঃস্থ–ড় > র-গোড়া > গুরা
কণ্ঠ্য > অন্তঃস্থ—হ > য়— সোহাগী > সূয়াগী
কণ্ঠ্য > উন্মঃ > ষ–দুঃখিনী > দুস্কিনী
দন্ত্য > তালব্য–ত > চ—রাংতা > রাংচা,
দন্ত্য > মূর্ধন্য–ত >ট –সঙ্কেত > সঙ্কেট দ > ড দংশে > ডংশে
তালব্য > কণ্ঠ্য–জ > গ জিজ্ঞাসা > জিঙ্গাসা
মূর্ধন্য > অন্তঃস্থ —ট > র ঝুটি > ঝুরি
ওষ্ঠ্য > কণ্ঠ্য–প > গা উপাড়িয়া > উগাড়িয়া
ওষ্ঠ্য > অন্তঃস্থ-ব > লি বাউল > লাউল
(৩) (ক) শব্দরূপগত পরিবর্তনসমূহ নিম্নসারণীতে শ্রেণীবদ্ধ হল :
বিভক্তি | একবচন | বহুবচন |
প্রথমা | ০, এ, য় | রা, হকল গুইন |
দ্বিতীয়া | ০, রে, কে | রারে, হাকলরে, গুইনরে |
তৃতীয়া | দিয়া, রেদিয়া | রারে দিয়া…ইত্যাদি |
চতুর্থ | দ্বিতীয়ার অনুরূপ | দ্বিতীয়ার অনুরূপ |
পঞ্চমী | তনে (থান) থন থাকি | রারথন…ইত্যাদি। |
ষষ্ঠী | র রার ইত্যাদি | |
সপ্তমী | অ, ও, ত | হকলত, গুইনতু |
(খ) সর্বনাম পদের বিশিষ্টতাও উল্লিখিত হল :
কর্তৃকারকে–আমি, মুই, আমরা; তুমি, তুই, তুইন; তুমরা, তরা, তুরা, তুমিতাইন, তুইতইন; আপনে, আপনি; আপনেরা আপনাইন, আপনারা; সে, হে, তাই (স্ত্রী তুচ্ছার্থে), তাইন (সম্মানার্থে); তারা, হেরা, তাইনিতাইন (সম্মানার্থে বহুবচন)।
কর্মসম্প্রদানে-মোরে, মরে, আমারে, আমরারে;তরে (তুচ্ছার্থে), তুমারে, তরারে, তুমিরারে; আপনারে আপনেরে, আপনাইনরে, আপনারারে; তারে, হেরে, তাইরে (তুচ্ছ, স্ত্রী লিঙ্গ), তাইনরে (সাম্মানিক), তাইনেরে,
করণে-কর্মকরকের রূপ -এর সঙ্গে ‘দিয়া’ যোগে অপাদানে সম্বন্ধ পদের সঙ্গে থান, তন, থানে, তনে, থাকি সহযোগে।
ষষ্ঠী–মর, মোর, আমার, আমরার; তোর, তার তুর; আপনার, আপনের, আপনারার : তার, হের, তাইর, তারার, হেরার।
সপ্তমী – সম্বন্ধ পদের সঙ্গে ‘মাঝে’, ‘মাঝ’, ‘মধ্যে’, ‘মইধ্যে’ সহযোগে।
অন্যান্য সর্বনাম : নির্দেশক – ও, আউ, আটা, হাঁটা , অনির্দেশক –
কেউ, কেও, কিছু, কুনু, কিছু; প্রশ্নবাচক – কে, কেনে, কুন, কারা, কুবাই, কিয়ানো, কেম্নে।
ক্রিয়াবিশেষণ–যেখানো, যেমনে, যেমন ইত্যাদি।
(৪) ক্রিয়াপদের বিশিষ্টতাসমূহ কর আদি গণের দ্বারা নিম্ন সারণীতে বিন্যস্ত হল :
কাল | প্ৰথম, সামান্য | প্রথম ও মধ্যমগুরু | মধ্যম সামান্য | মধ্যম তুচ্ছ | উত্তম |
বর্তমান নিত্যবৃত্ত | এ | ইন | অ | অছ্ | ই |
ঐ ঘটমান | এব | রা, অবা | রায় | বে | রাম |
ঐ পুরাঘটিত | ছে | ছইন | অছ | ছছ | ছি |
ঐ অনুজ্ঞা | উক | উকা | অ, অনি | X, গি | ০ |
অতীত সাধারণ | ল | লা | লায় | লে | লাম |
ঐ নিত্যবৃত্ত | ত | তা | তায় | তে | তাম |
ঐ ঘটমান | তাছিল | তাছিলা | তাছিলায় | তাছিলে | তাছিলাম |
ঐ পুরাঘটিত | ছিল | ছিল, ছালা | ছিলায় | ছিলে | ছ্লেছিলাম, ছলাম |
ভবিষ্যত সাধারণ | ব | বা | বায় | বে | মু |
ঐ অনুজ্ঞা | ব | বা | ইও | ইছ | ০ |
কৃৎ – তে, ইয়া, লো, বার, আ।
× বিভক্তি শেষ হয় না, ০ রূপ নেই
(৫) অন্যান্য আঞ্চলিক বাংলা ভাষার মতোই শ্ৰীহট্টের ভাষায়ও প্রচুর তৎসমম তদভব এবং দেশি ও বিদেশি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামীণ লোককবি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রচনায় কিছু কিছু বিদেশি শব্দ অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে। বিদেশি শব্দসমূহ
প্রধান বিভাগে নীচে বিন্যস্ত হল :
আরবি-ফারসি মিশ্র সহ —
আইন, আদালত, আল্লা, ইমান, এজলাস, কমিন্দর, কাছারি, কাজী, খৎ খালাস, গুনাহ, গ্রেফতারি, চৌকিদারি, জিঞ্জির, তমসুক, তহবিল, দম, দরদী, দরবার, দারমা, দস্তখত দু’দিলা, দুস্তি, দেওয়ানা, নাজারত , নালিশ, বাজার, বাদশাহী, বেগার, বেগেনা, মহকুমা, মোহর, রংমহল, লোকসান, সেইনসার (শাহেনশাহ?), সাজা, সোওয়ারি, হাজির হিসাব।
ইংরাজি-পর্তুগীজ মিশ্র সহ —
ইন্সপেক্টর, এসিস্টেন্ট, গভর্নর, গিলটি, চীফ কমিশন, জেলখানা, টাইম, টিকেট মাস্টার, ডিগ্রিজারী, মাজেস্টর, মাস্তুল, মেনেজারি, স্টেশন মাস্টার, সাবডিভিশন, হাইকুট।
২.৪ গীতি-ছন্দ
সংগৃহীত গীতিসমূহের সবগুলোর ভাষা ও ছন্দ সবসময় অবিকৃত থাকেনি, বিশেষত আমাদের মৌলিক সংগ্রহ যখন অনুলিখিত বা তস্য অনুলিখিত খাতা কিংবা পরম্পরাধূত লোককণ্ঠ থেকে আহৃত। তবু লেখকের ছন্দের প্রতি মনোযোগ যথারীতি নিবিষ্ট ছিল তা খুব সহজেই উপলব্ধ হয়, কেননা আমরা যেসব গীতি পরম্পরাগত সূত্র থেকে পেয়েছি তাতেও ছন্দ পরিকল্পনার আঁচ স্পষ্ট। পয়ার ত্রিপদী চৌপদী বিভিন্ন ছাঁদের ছন্দে গীতিসমূহ গ্রথিত হলেও তা মূলত বাংলা লোকগীতির ছন্দোবদ্ধ স্বরবৃত্ত কখনো বা অক্ষর মাত্রিকতায় নিম্পন্ন। এছাড়া গীতিসমূহ যেহেতু গানের জন্যেই শুধু রচিত, কবিতার মতো পাঠ্য আদলে নয়, সেহেতু তাতে স্থানে স্থানে অপূর্ণ বা কথঞ্চিৎ দীর্ঘ মাঞার পটে রচিত হলেও তা মূল উদ্দেশ্যের কোনো অপহ’ব ঘটায় না। বিবিধ ধরনের ছন্দ ব্যবহারের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নীচে বিন্যস্ত হল।
(ক) একাবলী, ৬।৫ মাত্রার
শুন ওরে মন।বলিরে তোরে
হরি হরি বল। বদন ভরে
মনরো আপনা।বলিছ যারে
দেখিনি আপনা। এ সংসারে
গী/১১৫, (৫৯)
(খ) চোদমাত্রার পয়ার, ৮।৬
সব নবী প্রিয়া সনে । সুখে করে কেলি
মুই নারী প্রিয়া বিনে । তাপিত কেবলি
প্রিয়া পন্থ নিরখিয়া । তনু হৈল ক্ষীণ
বেহুশ হুতাশে যাপি । রাত্ৰি কিবা দিন।
–গী/৭১১ (৩৩৯)
(গ) কুড়ি মাত্রার লঘুত্রিপদী, ৬। ৬। ৮
পহিলহি রাগ । নয়নের কোণে
কালা সে নয়ান তারা।
নয়নে নয়নে । বাণ বরিষনে
হয়েছি পিরিতে মরা।
— গী/৪৩৩, (২১১)
(ঘ) আঠারো মাত্রার দীর্ঘ পয়ার, ৮।৮।১০
চৈতন্য থাকিতে মন । একবার ভাবে সে জনায়
সাকারেতে বিরাজিত । আঁধারে আলোক দেখা যায়।
–গী/১২৯, (৬৬)
(ছ) ছবিবশ মাত্রার দীর্ঘ ত্রিপদী, ৮ ৷ ৮ ৷ ১০
বিরহ বেদন তনু । হাতেতে মোহন বেণু
ললিত ত্রিভঙ্গ শ্যামরায়….
কেউ পরে রত্নহার । কেউ পরে অলঙ্কার
কেউর শোভে চরণে নেপুর।।
–গী/৩৫৯, (১৭৬)
(চ) বত্ৰিশ মাত্রার চৌপদী, ৮ । ৮ । ৮ । ৮
দিবসে আন্দাবী হল
মন প্ৰাণ হইল চঞ্চল
কেমনে ভরিব জল
মনে মনে ভাবি তায়।
(ঐ) বুঝিগো প্ৰাণ বিশখা
বংশী বটে যায় (তারে) দেখা
কাল ত্রিভঙ্গ বাঁকা
শ্ৰী রাধারমণ গায়।।
–গী/৪৮০, (২৩৪)
(ছ) চৌত্ৰিশ মাত্রার চতুষ্পদী, ৮ ৷৷ ৮ ৷৷ ৮ ৷৷ ১০
যে অধরে বংশী ধরে
যত্ন করি রাখতেম ভৈরে
রসরাজকে হিয়ার মাঝে।।
–গী/৪৮৩, (২৩৫)
(জ) স্বরবৃত্ত, ৪/৪/৪/৪ ষোলো মাত্রার চতুষ্পদী,
ইলশা মাছ কি। বিলে থাকে কাঁ
কাঠাল কি কি-। লাইলে পাকে
মধু কি হয়। বলার চাকে
মধু থাকে। মধুর চাকে।।
–গী/১৬,৮
(ঝ) স্বরবৃত্ত, ৪৪৪১/৪৪৪১, ২৬ মাত্রার চতুষ্পদী
বংশী বাজায় । কেরে সখী
বংশী বাজায় । কে
মাথার বেণী । বদল দিব
তারে আনিয়া দে।।
–গী/৪৪১ পাঠান্তর, (২১৫)
(ঞ) স্বরবৃত্ত, ৪৪৪২/৪৪:৪২, ২৮ মাত্রার চতুষ্পদী
সাপ হইয়া দংশ গুরু
উঝা হইয়া। ঝাড়ো
পুরুষো হ–। ইয়া তুমি
রমণীর মন। হারো।।
–গী/৩২, (১৭)
(চ) স্বরবৃত্ত, ৪৪৪৩/৪৪৪৩ ৩০ মাত্রার চতুষ্পদী
ভাইবে রাধা। রমণ বলে
আলসে দিন। যাপোনা
জমিদারের। খাজনার কড়ি
সময় থাকতে। খুঁজো না।।
–গী/১০০, (৫২)
(ঠ) স্বরবৃত্ত, ৪৪/৪৪/৪৪/৪২, ৩০ মাত্রা পৃথক ছাঁদের চতুষ্পদী
রাধা নামে । বাদাম দিয়া
কৃষ্ণ নামের । সারি গাইয়া
চলছে বাইয়া । রসিক নাইয়া
রমণ বলি । য়াছে।।
— গী/১৪৪ পাঠ (৭৪)
(ড) স্বরবৃত্ত, ৪৪/৪৪/৪৪২/৪৪/৪৪ ৪২ মাত্ৰা পঞ্চপদী
জন্ম দিলে। মার উদরে
আমারে ব । লিয়া গেলে
তোমায় ভুলে। আর কত দিন। থাকি।
তোমার ভাবে। তুমি থাকো
আমার ভাবে। আমি থাকি।
–গী/২৩৮, (১১৯)
(ঢ) স্বরবৃত্ত ৪৪/৪২/৪৪/৪২/৪৪/৪২ ৪২ মাত্রার ষট্পদী
মহাজনের। নৌকাখানি
মহাজনের। মাল।
মহাজনে। লইব হিসাব
ঠেকবায় পর। কাল।
(ওরে) রাধারমণ। মূলধন হারা
সংকট নি। কটে।
–গী/১১২, (৫৮)
স্তবক রচনা ক্ষেত্ৰেও নানা বৈচিত্ৰ্য কখনো চার চরণের, কখনো পাচ চরণের, কখনো ছয় চরণের, এসব গানে অনায়াসে লক্ষ করা যায়।
২.৫ গানের বিষয় ভাগ
রাধারমণের বর্তমান পদ সংগ্রহে সংগৃহীত সহস্রাধিক (পাঠান্তর সহ) পদের বিষয় ভাগ নানা কারণে কিছুটা দুরূহ। এক ভাবের গানে আরেক প্রকার ভাবের মিশ্রণ প্রায়শ চোখে পড়ে। বিশেষত সকল গানের মধ্যেই সহজিয়া ভাবের একটা অবলেপ মোটেই দুর্নিরীক্ষ্য নয়। তাই মুখ্য ভাবের আধারে এবং প্রচলিত রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক গানকে বৈষ্ণব পদাবলীর অনুসরণে গােষ্ঠ, পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান, অভিসার, বিরহ, মিলন ইত্যাদির নিরিখেই ভাগ করা হয়েছে। গুরুপদ, নাম মাহাত্ম্য, প্রার্থনা বিষয় পদকে একত্র প্রার্থনার শীর্ষকেই গ্রন্থন করা হয়েছে। দেহতত্ত্ব, বাউল ও সহজিয়া গীতসমূহ একত্র সহজিয়া শীর্ষকে সন্নিবেশিত হয়েছে। গৌররূপ, গৌরনাগরিকী গৌরবন্দনা, গৌরলীলা, সপার্ষদ গৌরচন্দ্র, গৌরপূর্বরাগ, গৌরবিচ্ছেদ ইত্যাদি বিচিত্রধারার পদকে গৌরপদের পৃথক গুচ্ছে নেয়া হল। এ ছাড়া মাতৃসঙ্গীত শাক্ত গীতিমালাকে মালসী পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘বিবিধ’ শীর্ষকের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ত্ৰিনাথ বন্দনা, বিবাহ সংগীত, সমসাময়িক ঘটনা ইত্যাদি বিষয়ক পদ।
২.৬ আঞ্চলিক প্রসঙ্গ
শ্ৰীহট্টের সুনামগঞ্জ মহকুমা অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমি-অধিকতর শস্যশ্যামলা। এর শস্যক্ষেত্র অধিকাংশ সময়ই জলা জায়গায় বা হাওরে (সাগর) ভরা, জল জমে থাকে। আবার এই জল থেকেই অন্যতর ফসল উঠে আসে, মাছ। এখানকার গো সম্পদও লক্ষণীয়ভাবে স্বাস্থ্যোজুল ও দুগ্ধদ। এখানকার মানুষের সাধারণ স্বাস্থ্যে ও চেহারায় এক চিঙ্কণ আভা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় বলে এখানকার অধিবাসীদের সহজেই চেনা যায়। দু’পায়ের চেয়ে নৌকেই বেশি চলে এখানে তাই জল, নদী, নালা, নৌকো, হাল, বাদাম, পাল ইত্যাদির ছড়াছড়ি রাধারমণের গানে। একদিকে আদিগন্ত জল ছল ছল বর্ষার বিশাল গেরুয়া প্রকৃতি অন্যদিকে শস্য ভরা আউসের খেতে অপাের শ্যামলতা—এই দুই পরাক্রান্ত প্রকৃতি এখানকার মানুষকে একদিকে যেমন করেছে নিবিড় জীবনাগ্রহী অন্যদিকে তাকে অসীম ঔদাস্যে নৈষ্কর্ম্যে করেছে সংসার বিবিজ্ঞ। রাধারমণের গানে এই দুয়ের যেন সম্মিলন ঘটেছে।
স্থানিক জলস্থলী নদীনালা হাওয়া গাছগাছালি ফুল লতা বায়ু পাখি আলো হাওয়া আকাশ সার্বিক নিসর্গ যেমন তাঁর গানে উপস্থিত তেমনি স্থানীয় বন্ধু সখী পার্ষদ গুরুদেব শিষ্যশিষ্যা এমনকী কবিপুত্রের উল্লেখ বিভিন্ন গানে ছড়িয়ে আছে।
স্থান নামে শ্ৰীহট্টের নানাস্থানের নাম যেমন পাই তেমনি নানা তীর্থস্থানের নাম তথা বাংলাদেশের অনেক উল্লেখ্য শহরের নামও অন্তর্ভুক্ত হতে দেখি।
গ্রামের কবি হলেও সমকালীন বিস্ময়বস্তু এরোপ্লেন, তার কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়া রেলগাড়ি, টেলিগ্রাফ, স্টেশনমাস্টার, টিকেট চেকার, লালপাগড়ি পুলিশ, কাবুলি, শুড়িখানা ইত্যাদি নাগরিক জীবন প্রসঙ্গ গানের বর্ণনা কিংবা উপমা-রূপকে ছড়ানো।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধেও যেমন সজাগ স্বদেশচেতনায় উল্লেখ রয়েছেবিলাতের কর্তা জিনি হাইবি স্বাধীন” (পদ সংখ্যা ৯৫) তেমনি দেশের অর্থনৈতিক ও নৈতিক অধঃপতনও তার নজর এড়ায় না-দেখলাম দেশের এই দুৰ্দশা, ঘরে ঘরে চুরের বাসা’ (পদ সংখ্যা–১৫)।
২.৭ কাব্যমূল্য
কবির পরিবারিক ঐতিহ্যে যেহেতু নিরক্ষরতা ছিল না এবং কবি যেহেতু বৈষ্ণব দার্শনিক ও আলঙ্কারিক পরিমণ্ডল সম্বন্ধে অনবহিত ছিলেন না, ফলে একটা বিস্তীর্ণ এলাকার পল্লীবাসী জনসাধারণের কবি হয়েও তিনি কিন্তু বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞানুসারিক লোককবি নন। তাই তার রচনার একটা দ্বৈত লক্ষণ সব সময় দেখা যায়, একাধারে তিনি লৌকিক ও সর্বজনীন, স্থানিক ও সর্ববঙ্গীয়।
আমাদের হাতে কবির নিজস্ব হস্তাক্ষরে লিখিত গানের কোনো পুথি বা উপকরণ নেই, শুধুপারিবারিক ঘরানায় রক্ষিত কবির মৃত্যুর তেরো বছর পরোকার কবিপৌত্র অনুলিখিত কথঞ্চিৎ পুরোনো (১৯২৯) একটি পুথি পাওয়া গেছে। এই পুথির গীতাবলীর ভাষা ও ছন্দ অনেকটা অক্ষুগ্ধ আছে, ধরে নিলেও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত গানের ভাষা ও কথাংশ সর্বত্র যদরচিত তদারক্ষিত থাকেনি, গানের অজস্র প্রচলিত পাঠান্তরে এর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য রয়েছে। লোকসংগীত লক্ষণােক্রান্ত গানের এই রূপান্তর প্রবণতা অবশ্যই স্বাভাবিক। তৎসত্ত্বেও এই সব গানের কাব্যমূল্য নির্ধারণের আনুষঙ্গিক প্রয়োজন থেকে যায়।
ভাগবত ঐশ্বর্যের দিকে যা আমাদের প্রথমত আকর্ষণ করে তাহল গানের মানবিক সুখ দুঃখ বিরহ মিলন লীলার প্রিয় প্রসঙ্গ। যদিও স্বীকৃত যে গানের জনপ্রিয়ক্ত বিশ্লেষণে গানের বক্তব্যটাই শুধু আমাদের কাছে আকর্ষক ঠেকে না, আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কারণ হয়তো তার মর্মস্পশী সহজ গ্রামীণ সুর, দ্বিতীয়ত সুরের হৃদয়গ্ৰাহিতা ও সরলতা ছিল এতই প্রবল যাতে এই সুর সহজেই কণ্ঠে তুলে নেবার পক্ষেও ছিল অনুকুল। তবু একথা স্মর্তব্য ভাব ও কথাংশের প্রকৃত আকর্ষণের জোরেই বিগত শতাব্দীকাল থেকে এই গীতিমালা গোষ্ঠীধর্মানুগত থেকেও উত্তর-পূর্ব বাংলা তথা ভারতের পল্লীর হিন্দু মুসলমান সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে।
অপর পক্ষে গীতসমূহের আকর্ষণকেও সমমূল্য দিতে হয় কারণ রাধারমণ নিজে সাধক এবং এই গানগুলো বেশির ভাগই ছিল তার সাধনার অঙ্গ এবং সাধনকালেই কীর্তনরত অবস্থায় রচিত বলে কথিত। বৈষ্ণব পদাবলী অনুসারী পদ ভাগেই বৈষ্ণব তত্ত্বনুসরণ লক্ষ করা গেছে। এছাড়া, শ্ৰীগৌরাঙ্গ প্রসঙ্গ,বৈষ্ণব পঞ্চারসের,মহাভাবের, তথা অৈিকতব কৃষ্ণপ্রেমের ও নামমাহাক্সোর গীতিবদ্ধ রূপের সঙ্গেও আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে; তদুপরি বৈষ্ণব সহজিয়া ধারার সাধন পথের বিস্তৃত ও লোকায়ত রূপ ফুটে ওঠে তার গীতাবলীতে।
বলা বাহুল্য বৈষ্ণব সাধক হলেও কোনো সন্ধীর্ণতা আচ্ছন্ন করে না কবির দৃষ্টিকোণ, আমরা আগেই দেখেছি তার কিছু সংখ্যক মাতৃসংগীত বা মালসী গানকে অনায়াসেই বৈষ্ণব সাধকের বিপরীত কোটির শাক্তপদাবলীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তদুপরি কিছু গান মহাদেব বা ত্রিনাথ বন্দনার পদগুলোও একশ্রেণীর শৈব সাধকদের প্রিয় হতে পারে।
রাধারমণের গীতিভাণ্ডার বিপুল ও বৈচিত্ৰ্যময় যেমন বিষয়ভেদে যেমন গভীর ভাবৈশ্বর্যে —জীবন জিজ্ঞাসায় কিংবা তত্ত্বানুসন্ধানে—তেমনি প্রকরণগত সিদ্ধিতে শব্দচয়ন-সন্ধাননির্মাণ কিংবা বাকপ্রতিমা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও সৃজন বৈভবের দ্বারা তিনি তাঁর পাঠকশ্রোতাকে বিস্মিত ও আবিষ্ট করে রাখেন। নীচের স্বতঃপ্রকাশ দৃষ্টােস্ত থেকে আমাদের এই অভিমত পরীক্ষিত হতে পারে :
ক) গুরু গুরু আমি তোমার আদম ভক্ত
লোহা হতে অধিক শক্ত
গুরু আমার মন তো গলে না ।। গী-১২
খ) আহা, চুরের ঘাটেও নাও লাগাইয়া ভাবিছ কিরে মন…
আর দেখলাম দেশের এই দুর্দশা ঘরে ঘরে চুরের বাসা
এগো সে চুরায় কি যাদু জানে
ঘুমের মানুষ করছে অচেতন। গী-১৫
গ) ইলশা মাছ কি বিলে থাকে
কাঁঠাল কি কিলাইলে পাকে? গী-১৫
ঘ) ভালো মানুষের আত ধোওয়াইলে
একদিন কাম আয় নিদানকালে
এগো কমিন্দর লগে দুস্তি কইলে
মুখপোড়া যায় বিনাগুইনে। গী-২২
(ঙ) অরণ্য জঙ্গলার মাঝে বানাইয়াছি ঘর
ভাই নাই, বান্দব নাই—কে লইব খবর
অকুল সমুদ্র মাঝে ভাসিয়া ফিরে পেনা
কতদিনে দয়াল গুরু লওয়াইবায় কিনারা। গী-২৯
(চ) সাপ হইয়া দংশ গুরু, উঝ হইয়া ঝাড়ো। গী-৩২
(ছ) খেওয়ার কড়ি নাই মোর সঙ্গে জামিন দিতাম কারে। গী-৪১
(জ) আমার দেহ হউক কদমতলা, অশ্রুধারা হউক যমুনা। গী-৬০
(ঝ) কাঁচা মাটিয়ে রঙ ধরে না, পোড়া দিলে হয় সোনা। গী-৬২
(ঞ) বেভুল হয়ে তোমায় দেখি মনে খুশি হইয়া
বেভুলে হাত দিয়া ধরি, হুশে দেখি খালি। গী-৯৬
(ট) কোন বিধি নির্মিল তারে নিরলে বসিয়া
সোনার অঙ্গে চাঁদের কিরণ কে দিল মিশাইয়া। গী-১৫২
(ঠ) আমি গৌররূপ সাগরের মাঝে মীনের মতো ডুবে থাকি। গী-১৫৭
(ড) ভাইবে রাধারমণ বলে গৌর কেমন জনা
আন্ধাইর ঘরে জ্বলছে বাতি, গৌর কাঞ্চা সোনা। গী-২০৭
(ঢ) শুড়ির মদ খায় না মাতাল আপন মদ আপনি বানায়
মন ভাটিতে প্রেমগুড়েতে নয়নজলে মদ চুয়ায়। গী-২৩৩
(ণ) কালায় মরে করিয়াছে ডাকাতি
দেহের মাঝে সিদ কাটিয়া জ্বালায় প্রেমের বাতি। গী-৩৬২
(ত) জল ভরিয়া গৃহে আইলাম শূন্য দেহ লইয়া
আমার প্রাণটি বান্ধা থইয়া।। গী-৩৭৮
(থ) শ্যামের দিকে চাইয়া আটতে উষ্টা লাগি পাও
গাগরী ভাঙ্গিয়া গেল, শাশুড়ীর গালি খাও। গী-৩৭৯
(দ) আরে যেই না বাড়ের বাশিগুলি
ও তোর ঝাড়ের লাগাল পাই–
এগো জড়ে পেড়ে উগাড়িয়া
সাগরে ভাসাই। গী-৩৮৭
(ধ) ভাইবে রাধারমণ বলে প্রেমের বিষম যন্ত্রণা
ছপাই কাপড়ে দাগ লাগলে ধাইলে তো দাগ ছাড়ে না। গী-৪২৪
(ন) সাপের বিষ কারিতে লামে প্রেমের বিষ উজান বায়
নাড়ি ধরি বলছে উবা এ বিষ তো সাপের ন্যায়। গী-৪৬৪
(প) রব শুনা যায় রূপ দেখি না বংশীধবনি যায় গো শোনা
মেঘবটে কি শ্যাম জানি না মেঘে বংশী বাজায়। গী-৪৮০
(ফ) শ্যামের রূপ হেরিয়ে যুবতীর প্রাণ ভ্ৰমরা উড়িয়ে গেল
বিজলী চটকের মতো যমুনার কুল আলো হইল।। গী-৪৮৪
(ব) আয় ললিতে, আয় বিশখে শ্যাম হেরিতে যাই
যায় যাবে কুল, ক্ষেতি নাই, শ্যামকে যদি পাই
নয়নচাঁদে ফাঁদ পাতিয়ে ধরিব কুরঙ্গ।। গী-৪৮৯
(ভ) বাশি কতই ছন্দি করি
বাশির গুণ কি শ্যামের গুণ কে বইলাবে আমারে
বাশির স্বরে প্রাণ হরিয়া নেয়
ধরা টলমল করে।। গী-৪৯০
(ম) নিজের বেদন সবাই বুঝে পরের বেদন না।
গকুলে সুহৃদ পাই না যার ঠাঁই করি ‘আ’
‘আ’ করিনা আউয়ার ডরে কি আনে কি কইব
একেতে আর পরচারি কলঙ্ক রটাইব। গী-৪৯২
২.৮ কথা শেষ
গ্রন্থটি বিদ্বজ্জনের সমীপে নিবেদিত হল, নিবেদিত হল আবহমান বাংলার সাধারণ পাঠক ও গীতরসিকদের উদ্দেশ্যে। পণ্ডিতিআনা প্রদর্শনের কোনো অভিমান এর সঙ্গে কোনো স্তরেই যুক্ত ছিল না, ছিল অকাতর ভালোবাসা। এ শ্রমের তাই গবেষকদের পরীক্ষণ তৌলে বিচারের খুব একটা অবকাশ ও সুযোগ নেই, ভালোবাসায় ভালোমন্দ সহ গৃহীত হলেই তার চরিতার্থতা।
গ্রন্থটির প্রকাশনাপর্বে নানা জটিলতা, কালক্ষয় ও প্রতিকূলর্ত ঘটেছে আমাদের ঐতিহ্যগত পারিপার্শ্বিক কারণে, এখানে সে বিষয়ে বিশদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবু একটি স্বীকারোক্তি। সময়ের কোনো এক সন্ধিতে আমাদের মৌল সমস্যার নির্যাকরণ ত্বরান্বিত হয় শ্ৰীযুক্ত দেবব্রত চৌধুরীর আবির্ভাবে ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। তার যোগ্য ও অকুণ্ঠ সহায়তা না পেলে আমাদের প্রিয় কবি রাধারমণের কথঞ্চিৎ পূর্ণায়ত উপস্থাপনা কে জানে আরো কত দিন আপেক্ষিত থাকতে পারত। সাধু সারস্বত প্রয়াসের ক্ষেত্রে তাঁর এই অখণ্ড অধিকার অব্যাহত থাকুক।
বিনীত
বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী
১৫-৮-১৯৮৭
বীর বিক্রম সান্ধ্য মহাবিদ্যালয়,
আগরতলা, ত্রিপুরা
রাধারমনের গীতের পিডিএফ ফাইল পাওয়া যাবে?
ইবুক সাইটে আপলোড করে দেয়া হয়েছে – https://www.ebanglaebook.com