২
রাত দশটা।
বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মিসির আলি বাড়ির যে অংশে থাকেন তার বারান্দায় টিনের চালা। বৃষ্টির শব্দ সেই কারণেই স্পষ্ট। বাড়ির সঙ্গে কোনো বড় গাছ থাকলে গাছের পাতায় বৃষ্টি হতো। গাছের পাতায় পড়া বৃষ্টির শব্দও অদ্ভুত হয়। কিছুক্ষণ শুনলে নেশা ধরে যায়।
বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস হচ্ছে। বেশ ভালো বাতাস। বাতাসের জন্য বৃষ্টি পড়ার একটানা শব্দে হেরফের হচ্ছে। কখনো বাড়ছে, কখনো হঠাৎ করে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কনসার্ট শুনছেন।
দু’বার ইলেকট্রিসিটি যাই যাই করেও যায় নি। এখন তৃতীয় বারের মতো যাই যাই করছে। ভোল্টেজ নেমে গেছে। একশ পাওয়ারের বাল্ব থেকে দশ পাওয়ারের মতো আলো আসছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন বাল্বের দিকে। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির শব্দ যেমন ওঠা-নামা করছে, বাল্বের আলোও ওঠা-নামা করছে। বাল্বের কাছেই পেটমোটা একটা টিকটিকি। সে শিকার ধরার চেষ্টা করছে। বাল্বের আলোর ওঠা-নামার কারণে তার মনে হয় বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সে ঠিকমতো নিশানা করতে পারছে না। শিকার আটকাতে পারছে না। নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গরা ঘ্রাণনির্ভর জীবনযাপন করে। আলোর ওঠা-নামায় টিকটিকির অসুবিধা হবে কেন? সে ভরসা করবে তার ঘ্রাণশক্তির উপর।
মিসির আলি বাল্ব থেকে তার দৃষ্টি পুরোপুরি টিকটিকিটার উপর নিয়ে এলেন। বেশ উত্তেজনাময় দৃশ্য। টিকটিকিটা পোকা নিয়ে খেলছে না পোকা টিকটিকি নিয়ে খেলছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পোকাটা উড়তে পারে। তার উচিত উড়ে গিয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় গিয়ে বসা। সে তা করছে না। আলোর পাশেই ওড়াউড়ি করছে। সে কি জানে আলোর প্রতি এই তীব্র আকর্ষণের কারণেই তার মৃত্যু হবে! মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আলোর মায়া সে ত্যাগ করতে পারছে না।
মানুষ কীটপতঙ্গ নয় বলেই তার চিন্তাভাবনা অন্য রকম। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে অন্ধকারের মায়া ত্যাগ করতে পারে না। মানুষ কি ভালবাসে অন্ধকার! কীটপতঙ্গ আলো ভালবাসে।
মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হল। তাঁর হঠাৎ করে কেন যেন মনে হল মানুষ অন্ধকার ভালবাসে। মানুষ আলোর সন্তান। সে সব সময় আলো ভালবেসেছে। অন্ধকার ভালবেসেছে এমন মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য।
বাল্বের পাশে পোকাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। খাদক জয়লাভ করেছে খাদ্য পরাজিত। মিসির আলি চিন্তিত বোধ করছেন। এরকম বৃষ্টি আরো ঘণ্টাখানেক হলে ঘরে পানি ঢুকে যাবে। নর্দমার দুর্গন্ধ পানি একসময় নেমে যাবে কিন্তু গন্ধ থেকে যাবে। দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি ‘কে?’ বলে চিৎকার দিলেন না। কারণ দরজা কে খটখট করছে তিনি জানেন। বাড়িওয়ালা। এই ভদ্রলোক কড়া নাড়েন না—কড়া ধরে হ্যাঁচকা টান দেন। কড়া খুলে আনতে চান। হ্যাঁচকা টান দিয়ে কড়া নাড়তে তিনি আগে কাউকে দেখেন নি।
মিসির আলি দরজা খুলে বিস্মিত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
আজমল সাহেব মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, আপনার টেলিফোন। খুব নাকি জরুরি। আসুন তো।
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। বাড়িওয়ালার টেলিফোন নাম্বার তিনি কাউকে দেন নি। তিনি নিজেই জানেন না, কাজেই নাম্বার অন্যকে দেয়ার প্রশ্ন আসে না। জরুরি টেলিফোন মানে অসুখবিসুখ। মিসির আলির পরিচিত এমন কেউ নেই যার অসুখে জরুরি ভিত্তিতে তাঁর খোঁজ পড়বে।
আজমল সাহেব বললেন, দেরি করছেন কেন, চলুন।
মিসির আলি বললেন, টেলিফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। তাদের বলুন আমি শুয়ে পড়েছি। মিথ্যা বলা হবে না। কারণ, আমি শুয়ে ছিলাম।
খুবই জরুরি কল। জরুরি না হলে ঝড়বৃষ্টির রাতে কেউ কল করে?
মিসির আলি অনিচ্ছার সঙ্গে পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। তখনই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। পাঞ্জাবি উল্টা হয়েছে। পকেট ভেতরের দিকে চলে গেছে। পাঞ্জাবি ঠিক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আজমল সাহেব সাবধানী মানুষ ইলেকট্রিসিটি থাকা সত্ত্বেও তিন ব্যাটারির একটা টর্চ সাথে নিয়ে এসেছেন। টর্চটা এখন কাজে আসছে।
আজমল সাহেব বললেন, দরজায় তালা না দিয়েই রওনা হচ্ছেন। তালা দিন।
এখন তালা খুঁজে পাব না।
টর্চটা নিয়ে খুঁজে বের করুন। ঘর খোলা রেখে যাবেন নাকি?
অসুবিধা নেই।
অবশ্যই অসুবিধা আছে। আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি দরজায় তালা না দিয়ে আপনি বাইরে যান। এটা ঠিক না। পাঞ্জাবিও দেখি উল্টা পরেছেন। পাঞ্জাবি ঠিক করে পরুন। মেয়েরা উল্টা শাড়ি পরলে নতুন শাড়ি পায়। ছেলেরা উল্টা কাপড় পরলে অসুখে পড়ে। এটা পরীক্ষিত সত্য।
আজমল সাহেবের বসার ঘরে টেলিফোন। সেখানেই বাড়ির মেয়েরা ভিসিআরে ছবি দেখছে। ইলেকট্রিসিটি নেই। এদের জেনারেটরও নেই। তারপরেও টিভি- ভিসিআর চলছে কী করে! দর্শকরা মিসির আলির দিকে তাকাল। তিনি সংকুচিত বোধ করলেন। অকারণে এতগুলো মানুষের বিরক্তি তৈরি করা। টেলিফোন না ধরলেই হতো। টেলিফোন নিয়ে যে দূরে চলে যাবেন সে উপায় নেই। কথাবার্তা ভিসিআরের দর্শকদের সামনেই বলতে হবে।
হ্যালো।
মিসির আলি সাহেব কথা বলছেন?
জি।
আমাকে চিনতে পারছেন?
জি না।
গলার স্বরটা কি চেনা মনে হচ্ছে না?
আমি টেলিফোনে গলার স্বর চিনতে পারি না।
আপনাদের দিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে।
ক্যাটস অ্যান্ড ডগস, মুষলধারে?
হ্যাঁ, মুষলধারে।
আপনাদের ওদিকে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে না আছে?
মিসির আলি জবাব দিলেন না। টেলিফোনে একজন পুরুষ কথা বলছে। সে তার গলার স্বর বদলানোর চেষ্টা করছে। গলা ভারী করে কথা বলছে। এটা কোনো জরুরি কল না। ন্যুইসেন্স কল। মানুষকে বিরক্ত করে আনন্দ পাওয়ার জন্য এ ধরনের টেলিফোন করা হয়। টেলিফোনের এক পর্যায়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা থাকে।
মিসির আলি সাহেব?
জি।
আমি আপনার খুবই পরিচিত একজন।
ভালো।
আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন?
বিরক্ত হচ্ছি। আপনি অকারণে কথা বলে যাচ্ছেন। মূল কথাটা বলুন।
মূল কথা অবশ্যই বলব। কথাটা ভয়াবহ বলে সামান্য সময় নিচ্ছি। আচ্ছা আপনি কি অপরিচিত মানুষের কথা বিশ্বাস করেন?
কী বলতে চাচ্ছেন বলুন। আমি টেলিফোন রেখে দেব।
আমি টেলিফোন করেছি আপনাকে সাবধান করার জন্য। আপনি একটা ভয়ঙ্কর বাড়িতে বাস করছেন।
ও আচ্ছা।
রেবু নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে না? অল্পবয়সী মেয়ে তার মামার বাসায় থাকতে এসেছে। এই মেয়ে একটা ভয়ঙ্কর মেয়ে।
কোন অর্থে?
সর্বঅর্থে। মেয়েটা খুনি।
ও।
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?
মিসির আলি বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
প্রায় শেষ। মেয়েটা তার স্বামীকে আর তিন মাস বয়সী মেয়েকে খুন করেছে। পুলিশি মামলা হয়। অবশ্য মেয়েটা ছাড়া পায়। মেয়েটা তার মাকেও খুন করেছে। এখন যে বাড়িতে আছে সে বাড়ির কেউ না কেউ অবশ্যই খুন হবে। কিন্তু কেউ কিছু ধরতে পারবে না। আপনি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন। আপনাকে এই কারণেই জানালাম।
আচ্ছা।
মেয়েটি যে তার স্বামী-সন্তানকে খুন করেছে সেটি নিয়ে কাগজে নিউজ হয়েছিল তার কাটিং আমি পোস্ট করে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। দুএকদিনের মধ্যে পাবেন। স্যার, আমার কথা কি আপনার কাছে মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে?
মানুষের কথা আমি চট করে বিশ্বাস করি না। আবার অবিশ্বাসও করি না।
স্যার, আপনি কি আমাকে এখনো চিনতে পারেন নি?
চিনতে পেরেছি। তুমি মনসুর।
জি। কে খুন হবে বলব স্যার?
মিসির আলি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ভিসিআর দর্শকদের মধ্যে রেবু বসে আছে। সে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। মিসির আলির চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ফিরিয়ে নিল। মেয়েটি তাকে চিনতে না পারার ভঙ্গি করছে। কিংবা এও হতে পারে খুব ভালো কোনো ছবি চলছে। মেয়েটা ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছে না। তার সমস্ত মনোযোগ টিভি পর্দায়। মানুষ একসঙ্গে দু’জায়গায় মনোযোগ দিতে পারে না। মেয়েটিকে ভয়াবহ খুনি বলে মনে হচ্ছে না। সহজ-সরল মুখ। যে ভঙ্গিতে বসে আছে তার মধ্যেও আরামদায়ক আলস্য আছে।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব বললেন, চা খেয়ে যান। চা দিতে বলেছি। রাতের খানা কি হয়েছে?
জি হয়েছে।
নিজেই রেঁধেছেন?
জি।
আপনার জন্য একটা কাজের মেয়ে আনতে বলেছি। ময়মনসিংহের দিকে আমার কর্মচারীরা যায়। ওদের বলেছি একজন আনতে। ময়মনসিংহের কাজের মেয়ে ভালো হয়।
তাই নাকি?
জি একেকটার জন্য একেক জায়গা। মাটিকাটা লেবারের জন্য ভালো ফরিদপুর। অফিসের পিয়ন-দারোয়ানের জন্য রংপুর। আর কাজের মেয়ের জন্য ময়মনসিংহ।
আমি এইভাবে কখনো বিবেচনা করি না।
টেলিফোনে কোনো দুঃসংবাদ পেয়েছেন নাকি?
জি না।
যেভাবে আপনাকে চেয়েছিল, ভাবলাম দুঃসংবাদ।
মিসির আলি চা খেলেন। পান খেলেন। পানে প্রচুর জর্দা ছিল বলে মাথা ঘুরতে লাগল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই সাহেব আজ যাই।
আজমল সাহেব বললেন, যাই-যাই করছেন কেন? ইলেকট্রিসিটি আসুক তারপর যাবেন। বসেন ছবি দেখেন। নতুন ইউপিএস লাগিয়েছি। কারেন্ট চলে গেলে দুই- তিন ঘণ্টা টিভি চলে, ফ্যান ঘোরে। সায়েন্স ধাঁই-ধাঁই করে কোথায় যে চলে যাচ্ছে! পয়সা খরচ করে ইউপিএস লাগিয়ে ভালো করেছি না?
জি, ভালো।
পয়সা থাকলে সবই করা যায়। আমার এক বন্ধু গাজীপুর জঙ্গলে বাড়ি বানিয়েছে। সেখানেও সে সোলার এনার্জির ব্যবস্থা করেছে। সূর্যের আলো থেকে সোলার প্যানেল দিয়ে ইলেকট্রিসিটি।
তাই নাকি?
আপনাকে একদিন নিয়ে যাব, অবশ্য আপনাকে কোথাও যেতে দেখি না। যখনই দেখি—হাতে বই। এত পড়লে চোখের তো বারোটা বেজে যাবে। চোখের ক্ষতি যখন হয়েছে, আরেকটু হোক। আসুন ছবি দেখি।
মাঝখান থেকে দেখলে কি ভালো লাগবে?
হিন্দি ছবি যে কোনো জায়গা থেকে দেখা যায়। হিন্দি ছবির আগা-মাথা বলে কিছু নেই।
মিসির আলিকে ছবি দেখতে হল। মনে হচ্ছে ভ্রাতৃপ্রেম বিষয়ক কাহিনী। দুই ভাইয়ের একজন পুলিশ অফিসার, অন্যজন দুর্ধর্ষ খুনি। তবে খুনি হলেও সে সমাজসেবক। দুষ্ট লোকের যম। পুলিশ ভাই ধরতে চেষ্টা করছে দুর্ধর্ষ ভাইকে। এদিকে আবার একই মেয়ে দুই ভাইকে ভালবাসে। কাউকে বেশি বা কাউকে কম না। দু’জনকেই সমান সমান। দু’জনকেই সে বিয়ে করতে চায়।
আজমল সাহেব বললেন, গল্পটা কোনো সমস্যাই না। দুই ভাইয়ের একজন মারা যাবে। যে বেঁচে থাকবে মেয়েটার বিয়ে হবে তার সঙ্গে। সবই ফর্মুলা।
মিসির আলি এখন আগ্রহ নিয়েই ছবি দেখছেন—ফর্মুলা ব্যাপারটা সত্যি কি না জানতে চান। ‘সবই ফর্মুলা’ এই বাক্যটি তাঁর পছন্দ হয়েছে। আসলে তো সবই ফর্মুলা। পৃথিবী ফর্মুলা মতো তার উপর ঘুরছে। ফর্মুলা মতোই আসছে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত। তরুণ-তরুণী বিয়ে করছে। ফর্মুলা মতো তাদের ঘরে সন্তান আসছে। সবই ফর্মুলা।
মিসির আলি সাহেব!
জি।
আপনার ঘরে তো টিভি-ভিসিআর কিছুই নাই। ছবি যখন দেখতে ইচ্ছা করবে
চলে আসবেন।
জি আচ্ছা।
আপনাকে আমি পরিবারের একজন বলে মনে করি। আপনি একা একা থাকেন, খুবই মায়া লাগে।
মিসির আলি ছবির দিকে মন দিতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তবে এ বাড়ির অন্যদের তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। তারা আজমল সাহেবের ধারাবাহিক কথা বলার মধ্যেও ছবি দেখতে অভ্যস্ত।
মিসির আলি সাহেব!
জি।
বিয়ে-শাদির কথা কি কিছু ভাবছেন? পুরুষ মানুষ যে কোনো বয়সে বিবাহ করতে পারে। হাসান-হোসেনকে মারল যে ইয়াজিদ তার পিতা আশি বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। বিষাদসিন্ধুতে পড়েছি। মারাত্মক বই। বিষাদসিন্ধু পড়েছেন?
জি।
কত বার পড়েছেন?
একবারই পড়েছি।
আমি সময় পেলেই পড়ি। প্রথম পড়েছিলাম অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকার সময়, শেষ পড়েছি গত রমজানে। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো বই। ঠিক কি না বলুন তো?
মিসির আলি কিছু বলার আগেই রেবু বলল, মামা চুপ করো তো। তোমার কথার যন্ত্রণায় উনি ছবিটা ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। মানুষ এত কথা বলতে পারে, উফ!
ভাগ্নির কথায় আজমল সাহেব রাগ করলেন না। বরং খুশি খুশি গলায় বললেন, রেবু, ইয়াজিদের বাবার নাম তোর মনে আছে? তুই তো বিষাদসিন্ধু পড়েছিস।
ইয়াজিদের বাবার নাম মোয়াবিয়া।
ও আচ্ছা মোয়াবিয়া, এখন মনে পড়েছে।
মামা চুপ করে থাক। ছবি এখন শেষের দিকে চলে এসেছে। হাই টেনশন।
আজমল সাহেব চুপ করলেন। মিসির আলি গভীর মনোযোগে ছবি দেখছেন। আজমল সাহেবের কথাই সত্যি হয়েছে। খুনি-ভাই পুলিশ-ভাইয়ের হাতে মারা গিয়েছে। শেষ দৃশ্যে পুলিশ-ভাইয়ের সঙ্গে মেয়েটির বিবাহ। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী খুনি-ভাইয়ের বিশাল একটা অয়েল পেইনটিংয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। দু’জনের চোখেই পানি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে অয়েল পেইনটিংয়ের চোখেও অশ্রু টলমল করছে।
দর্শকদের মধ্যে রেবুর চোখেও পানি। শুধু আজমল সাহেবের মুখভর্তি হাসি। তিনি মিসির আলির দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, বলেছিলাম না ফর্মুলা মতো কাহিনী শেষ হবে!
মিসির আলি বললেন, তাই দেখলাম। আজ উঠি।
ছাতা নিয়ে যান। বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
মিসির আলি ছাতা হাতে নিলেন। আজমল সাহেব বললেন, কাজের ছেলেটাকে পাঠাচ্ছি। তার হাতে ছাতাটা দিয়ে দেবেন। আপনি যে মানুষ, দেখা যাবে ঘরের বাইরে ছাতা রেখে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভালো কথা, আগামী বিষ্যুদবার রাতটা ফ্রি রাখবেন। আমার পীর ভাই আসবেন। হালকা জিকির হবে। দোয়া করা হবে। পীর ভাই কোরানে হাফেজ। তাঁর ক্ষমতা মারাত্মক।
কী ক্ষমতা?
বাতেনি ক্ষমতা। এইসব আপনারা বুঝবেন না। সায়েন্স দিয়ে এই জিনিস বোঝা যায় না। পীর ভাইকে আমি আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব। ঠিক আছে?
.
মিসির আলি নিজের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনটা ঘটনা ঘটল।। বৃষ্টি থেমে গেল, ইলেকট্রিসিটি চলে এল এবং মিসির আলির ভয় করতে লাগল। তাঁর মনে হল, কেউ একজন বাড়িতে হাঁটাহাঁটি করছে। এরকম মনে করার কোনোই কারণ নেই। যদি ঘর অন্ধকার থাকত তা হলে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেত। ঘরে আলো আছে। মিসির আলি যে দুর্বল মনের মানুষ তাও না। অশরীরী কোনো কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস নেই। তা হলে ভয়টা তিনি পাচ্ছেন কেন?
রান্নাঘরে খুটখাট খুটখাট শব্দ হচ্ছে। কেউ কি আছে রান্নাঘরে? রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে না। অশরীরী কেউ অন্ধকারে রান্নাবান্না করছে নাকি? মিসির আলি রান্নাঘরে ঢুকলেন। বাতি জ্বালালেন। কেউ নেই। তিনি বাতি জ্বালিয়ে রেখেই শোবার ঘরে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে আজ রাতে ঘুম আসবে না। ঘুম যখন আসবেই না শুধু শুধু বিছানায় গড়াগড়ি করার কোনো অর্থ হয় না। তার চেয়ে বিছানায় পা তুলে বসে জটিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যায়।
চিন্তা করার মতো জটিল বিষয় এই মুহূর্তে তাঁর কাছে আছে। একটু আগে যে ছবিটা দেখেছেন সেই ছবির একটা বিষয়ে বড় ধরনের খটকা তাঁর মনে তৈরি হয়েছে। ছবির গুণ্ডা-ভাইটা যখন গুলি খেল তখন তিনি দেখেছেন গুণ্ডাটার হাওয়াই শার্টের তিন নম্বর বোতামটা নেই। অথচ গুণ্ডাটা যখন তার প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে মারা যাচ্ছে তখন দেখা গেল তিন নাম্বার বোতামটা ঠিকই আছে। এটা কী করে সম্ভব? গুলি খাওয়া গুণ্ডাটার সেবা না করে প্রেমিকা মেয়েটি কি শার্টের বোতাম লাগিয়েছে? খুবই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে যদি এমন কোনো লোকজ বিশ্বাস থাকে যে মৃত্যুপথযাত্রীর শার্টের বোতাম না থাকা অলক্ষণ, তা হলে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করা যায়। মেয়েটা অলক্ষণের কথা বিবেচনা করে কোনো এক ফাঁকে শার্টে বোতাম লাগিয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রীদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার কাজ করে। যেমন মৃত্যুপথযাত্রীর ঘরে কোনো পাখি ঢুকে পড়া বিরাট অলক্ষণ। গ্লাস থেকে পানি পড়ে যাওয়া অলক্ষণ। জুতা বা স্যান্ডেল উল্টে যাওয়া অলক্ষণ। শার্টের বোতাম না থাকাও হয়তো অলক্ষণ।
মিসির আলি গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন।