০২. বসার ঘরের কলিংবেল

বসার ঘরের কলিংবেল টিপতেই অপরিচিত একজন মাঝবয়েসী মহিলা বের হয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, কারে চান?

করিম সাহেবের মেয়েরা কেউ আছে?

কোন মেয়েরে চান?

বড় মেয়ে কিংবা অন্য কেউ।

আপনে কে?

আমি তিনতলায় থাকি। ইনাদের ভাড়াটে। আমার নাম আহসান।

আচ্ছা। বুঝেছি। বসেন।

আহসান বসতে-বসতে বলল, করিম সাহেবের খবর নিতে এসেছি। উনার খবর কি? কেমন আছেন এখন?

ভালো না। অবস্থা খুবই খারাপ। আপনে বসেন, বেগমেরে ডাক দেই। ও বেগম, বেগম।

এই যুগে মেয়েদের নাম কেউ বেগম রাখে? কি অদ্ভুত নাম এ-বাড়ির মেয়েদের বেগম, শাহাজাদী, মহল। মহল হচ্ছে তিন নম্বর মেয়েটি। এই মেয়েটি বড় দুবোনের মতোনয়। একটু অন্যরকম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে দেখা হয়ে গেলে বড় দুববানের মতো শক্ত হয়ে যায় না। বরং হাসি-হাসি মুখে তাকায়। মাঝে-মধ্যে দু- একটা কথা-কথাও হয়। যেমন, আহসান যদি বলে, কি ভালো? সে লাজুক স্বরে বলে, দ্ধি।

যাওয়া হচ্ছে কোথায়? ছাদে?

জ্বি। আচার শুকাতে।

ভালো। বেশি করে আচার শুকাও। আচার ভালো জিনিস।

সন্ধ্যাবেলা ওদের কাজের মেয়ে বাটি ভর্তি আচার নিয়ে উপস্থিত। আহসান চমকে উঠে বলেছে, আচার কী জন্যে?

মহল আপা পাঠাইছে।

আমি তো আচার খাই না।

ও আল্লা, মহল আপা কইছে আপনে চাইছেন।

আরে না। খাই না যে জিনিস সেটা শুধু-শুধু চাইব কেন?

কাজের মেয়েটি বাটি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আহসান খানিকটা বিরক্তই হল। মহল মেয়েটির বুদ্ধি-শুদ্ধি সেরকম নেই। বুদ্ধি যে কম তার আরেকটি প্রমাণ আছে। একবার নিউমার্কেটে দেখা। সে তার অন্য দুই বোনের সঙ্গে গিয়েছে। বোরা নেই। তিন বোন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। দৃশ্যটি অদ্ভুত। এত বড় বড় তিনটি মেয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটবে কেন? আহসানকে দেখে তিনজন ভূত দেখার মত চমকে উঠল। এটিও অস্বাভাবিক। মহল নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, আমরা শাড়ি কিনতে এসেছি।

বেশ।

তিনজন একরকম শাড়ি কিনব।

ভালো।

আপনি একটু আসবেন আমাদের সঙ্গে?

কেন? আমাকে দরকার কেন?

আপনি যেটা বলবেন সেটা কিনব।

তোমরা তোমাদের পছন্দ মতো কিনবে। আমি বলব কেন?

আপনি আসলে বেগম আপা কিছু বলবে না।

আরে না তোমরা তোমাদের মার্কেটিং কর। আমি অন্য কাজে এসেছি।

মহল ফিরে গিয়ে আবার দুবোনের হাত ধরল।

এদের তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ওদের মধ্যে মিলের অংশটুকু। তিনজন দেখতে একরকম। একই রকম লম্বা। গলার স্বরও একধরনের। যতবার একসঙ্গে বাইরে যায় হাত ধরাধরি করে হাঁটে। মাঝখানে মহল দু পাশে দু বোন।

বাবা মারা গেলে এরা বোধ হয় একই রকম ভঙ্গিতে জড়াজড়ি করে কাঁদবে। এই চিন্তা মাথায় আসায় আহসানের একটু খারাপ লাগছে। একটি পরিবারের এত বড় দুঃসময়ে এমন কথা কী করে সে ভাবল?

আহসানকে বেশ খানিকক্ষণ বসতে হল। আগের সেই মহিলা এক পেয়ালা চা এবং পিরিচ করে দুধেভর্তি এক পিরিচ সেমাই দিয়ে গেলেন। সেমাইয়ের পিরিচে চামচ নেই। খেতে হলে বিড়ালের মত চুক-চুক করে খেতে হবে।

একটু বসেন। বেগম আসছে।

ঠিক আছে বসছি।

আমি বেগমের দূর সম্পর্কের ফুপু। বেগমের আরা আমার মামাতো ভাই।

ও আচ্ছা।

ভদ্রমহিলা বসলেন সামনের সোফায়। কৌতূহলী চোখে তাকে দেখতে লাগলেন। আহসান অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। রেবা মেয়েটিকে এরা কি যেতে দেখেছে? দেখাই স্বাভাবিক।

আপনের কথা মহলের কাছে শুনেছি।

কি শুনেছেন?

আপনের স্ত্রী মারা গেছে।

ঠিকই শুনেছেন।

একটা ছেলে আছে আপনের?

হ্যাঁ আছে।

কার সাথে থাকে?

ওর মামার বাড়িতে থাকে। ধানমণ্ডি।

মহল বলছে আপনি কোনোদিন ছেলেকে এই বাড়িতে আনেন নাই।

ছোট ছেলে। মাত্র চার বছর বয়স।

চার বছর ছোট হবে কেন? চার বছরের বাচ্চাতো অনেক বড়। তার নাম কি?

মারুফ।

সেমাইটা খান। সেমাই ভালো হইছে।

সেমাই খেতে ইচ্ছে করছে না।

আপনে খাওয়া-দাওয়া হোটেলে করেন?

একবেলা হোটেলে করি। একবেলা এখানে খাই।

মহল বলেছে আমাকে।

মহল দেখি অনেক খবর রাখে।

এই কথাটিতে ভদ্রমহিলা খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। আহসান বলল, আমার একটু বাইরে যেতে হবে। আমি পরে এসে খোঁজ নেব। ডাক্তাররা কী বলেছেন?

আর ডাক্তার। ডাক্তারের হাতে এখন নাই। এখন আল্লাহর হাতে।

বেগম এসে ঢুকল। তার দেরির কারণ বোঝা যাচ্ছে। সে গোসল করেছে। রাত জাগার ক্লান্তি তাতে দূর হয় নি। চোখ লাল হয়ে আছে। বেগমের হাতে একটি চামচ। চামচ নিয়েই সে নিশ্চয়ই আসে নি। পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রথমে দেখে গিয়ে চামচ নিয়ে এসেছে।

বেগম বসল না।

আহসান বলল, করিম সাহেবের অবস্থা এখন কেমন?

আগের চেয়ে ভালো। শেষরাতে জ্ঞান হয়েছে। কথাটথা বলেছেন।

তাই নাকি।

জ্বি।

আহসান বড়ই অবাক হল। ভদ্রমহিলার কথার সঙ্গে এই মেয়ের কথার কোনো মিল নেই।

তোমার অন্য বোনেরা কি হাসপাতালে?

জ্বি। আমি গেলে ওরা আসবে। ভাত খাওয়ার জন্যে আসবে।

তোমার মা? উনি কোথায়?

উনি হাসপাতালে।

আচ্ছা আমি তাহলে উঠি এখন।

সেমাইটা খান।

সেমাই খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

একটু খান। ঘরে আর কিছু নাই।

আহসান বিস্মিত হয়ে তাকাল। মেয়েটির মধ্যে আগের সেই লজ্জা, সংকোচ, কিছুই নেই। অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে। বাবার অনুপস্থিতি নিশ্চয়ই এর একমাত্র কারণ নয়।

আহসান উঠতে-উঠতে বলল, আমি যাব একবার করিম সাহেবকে দেখতে।

আপনি গেলে বাবা খুব খুশি হবেন।

আহসান অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?

জ্বি খুব খুশি হবেন। বাবা আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।

আমার কথা কী জিজ্ঞেস করলেন?

জিজ্ঞেস করছিলেন আপনি এ্যাকসিডেন্টের খবর পেয়েছেন কি-না। মহলকে জিজ্ঞেস করছিলেন।

আচ্ছা।

আব্বা আপনাকে খুব ভালেমানুষ জানেন।

আহসানের দৃষ্টি তীক্ষ হল। মেয়েটি কি কিছু বোঝাতে চাচ্ছে? বলতে চাচ্ছেভালোমানুষ হিসেবে জানলেও আপনি ভালোমানুষ নন। আপনার ঘর থেকে সুন্দর মতো, রোগা ফর্সা একটি মেয়ে বের হয়েছে। সে রাত কাটিয়েছে আপনার সঙ্গে।

বেগমও তার দিকে তাকিয়ে আছে। সরল ও ক্লান্ত চোখ। না এই মেয়ে কিছু দেখে নি। দেখলে চোখে তার ছায়া পড়ত। আহসান বলল, আমি যাব একবার।

আজ যাবেন?

হ্যাঁ আজই। বিকেলে। ভিজিটিং আওয়ার্সে।

আহসান চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। বেগম ঠাণ্ডা গলায় বলল, আৰ্ব কোথায় আছেন তা তো আপনি জানেন না।

আহসানকে থমকে দাঁড়াতে হল।

এই কাগজে ঠিকানাটা লেখা আছে।

বেগমের হাতে এক টুকরো কাগজ। সে তৈরি হয়েই এসেছে। মেয়েটি বুদ্ধিমতি। করিম সাহেব কি এই তথ্যটি জানেন? বোধ হয় জানেন না। আহসান হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল। মেয়েটি এতক্ষণ কাগজটি লুকিয়ে রেখেছিল। হয়ত ভেবেছে আহসান নিজেই চাইবে।

আচ্ছা এখন যাই?

বেগম জবাব দিল না।

বাড়ির সামনে ট্রাক দাঁড়িয়ে। জলিল মিয়া বারান্দায় বসে আছে। তার হেল্লার বালতি-বালতি পানি এনে ট্রাকের চাকায় ঢালছে। এই হেল্পারটিকেই বোধ হয় কুকুর কামড়েছে। বাঁ পায়ে পট্রি বাঁধা। সে কিছুক্ষণ পর-পর থুথু ফেলছে। আগেও ফেলত-নাকি কুকুর কামড়ানোর পর ফেলছে কে জানে। জলিল বলল, স্লামালিকুম প্ৰবেসর সাহেব।

ওয়ালাইকুম সালাম।

ঝামেলা দেখেন না, এই বিপদের মধ্যে ট্রিপে যাওয়া লাগবে। বগুড়া। পার্টির সাথে কথাবার্তা বলা। না গেলে হবে না।

ও।

হেল্পার হারামজাদার শরীরটাও ভালো না। ইনজেকশন দেওয়া লাগবে। আপনি যান কোথায়?

নিউমার্কেটের দিকে যাব।

একটু বসেন ট্রাক নিয়া বার হব। নামায়ে দিব আপনারে।

না লাগবে না।

আমাদের দেরি হইত না।

কোনো দরকার নেই। শ্যামলীতে আমার একটা কাজ আছে।

ও আচ্ছা। যান তাহলে। স্লামালিকুম।

আহসানরাস্তায় নেমে পড়ল। রাস্তায় প্যাচপেচেকাদা। ইট বিছানোরাস্তা। জায়গায়জায়গায় ইট উঠে গিয়ে গর্ত হয়েছে। পানি জমে আছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি মানোযোগ দিয়ে সে রাস্তা দেখছে। মনে-মনে সে কিছু একটা খুজছে। যা খুঁজছে তা সে পেয়ে গেল।

রাস্তার একপাশে ঘাসের ওপর এক পাটি স্যান্ডেল। রেবা কিংবা পারুল নামের মেয়েটির স্যান্ডেল। যাবার সময় বোধ হয় বোরির চোখে পড়ে নি। লাল ফিতার নতুন স্যান্ডেল, হয়ত অল্প কিছুদিন হল কিনেছে। আহসান লক্ষ করল তার মন খারাপ লাগছে। অথচ মন খারাপ হবার মতো কিছুই হয় নি। এই মেয়েটিকে এক রাতের জন্যে সে আশ্রয় দিয়েছিল। রাত কেটে গেছে সে চলে গেছে, ব্যস ফুরিয়ে গেল কিন্তু এখন এমন লাগছে কেন? শুধু যে এখন এমন লাগছে তাই না, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যখন দেখেছে মেয়েটি চলে গিয়েছে তখনি বুকে আচমকা একটা ধাক্কা লেগেছিল।

যা সে প্ৰাণপণে অস্বীকার করেছে। কিন্তু কেন? এরকম হচ্ছে কেন? আহসান একটি সিগারেট ধরাল। কার্যকারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই হয় না। সে কি কার্যকারণ ছাড়াই একটি স্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে? নিশ্চয়ই না। কারণ একটি আছে যা স্বীকার করতে তার ইচ্ছে করছে না। রেবা বা পারুল নামের মেয়েটির সঙ্গে তারিনের চেহারার খুব মিল। প্রথম দিকে চোখে পড়ে নি কিন্তু মেয়েটি যখন তারিনের শাড়ি পরে বেরুল তখন আহসানের গা কাঁপছিল। কী অদ্ভুত মিল। কী অসম্ভব ব্যাপার? তখন তা সে স্বীকার করে নি। রূঢ় ব্যবহারই করেছে মেয়েটির সঙ্গে। খেতে বলেছে অবশ্যি। সেই বলায় মমতা বা করুণা ছিল না। কিংবা থাকলেও তার প্ৰকাশ হয় নি। প্রকাশ হলে ক্ষতি ছিল না কিছু।

কড়া রোদ উঠেছে। আহসান হাঁটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। তার তেমন কোনো। পরিকল্পনা নেই। কোন একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে হবে। এই পর্যন্ত। বিকেলের জন্যে আরেকটা ঝামেলা বেধে রয়েছে। হাসপাতালে যেতে হবে।

শ্যামলী থেকে সে একটা বাসে উঠল। প্রায় ফাঁকা বাস। বাসে চড়লেই তার কেমন ঝিমুনির মতো আসে। আজ আসছে না। এত খালি সিট থাকতেও নোংরা এক বুড়ো এসে বসল তার পাশে। বুডোর হাতে পলিথিনের ব্যাগে কিছু ছোট মাছ। বিকট গন্ধ আসছে সেখান থেকে। হঠাৎ করেই আহসানের মনে হল পলিথিনের একটা ব্যাগ থাকলে স্যান্ডেলটা নিয়ে আসা যেত। কোনোদিন এ-মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলে ফিরিয়ে দেওয়া যেত। সে নিশ্চয়ই অন্য পাটিটি যত্ন করে রেখেছে।

বুডোর পলিথিনের ব্যাগ থেকে টপটপ করে মাছের রস পড়ছে। এক ফোঁটা পড়ল আহসানের প্যান্টে উঠে অন্য কোথাও বসা উচিত কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না।

দরজা খুলে জেরিন বিরক্ত গলায় বলল, দুলাভাই আপনি সবসময় অড আওয়ারে আসেন কেন? ছুটির দিনে আড়াইটার সময় কেউ আসে?

আহসান হাসল।

আসুন ভেতরে আসুন। কাঁচাঘুম ভাঙিয়েছেন ভীষণ রাগ লাগছে।

সরি। বাসায় আর কেউ নেই?

বাবা আছেন। ঘুমুচ্ছেন। মা আপনার পুত্রকে নিয়ে মেজোপার বাসায়। আপনি খেয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই?

হুঁ।

জেরিন হাই তুলে বলল, চোখটা শুধু লেগে এসেছে এমন সময় কলিং বেল টিপলেন। এরকম অসময়ে ফকির-মিসকিনরা এসে কলিং বেল টিপে ভিক্ষা চায়। বুঝলেন সাহেব?

বুঝলাম।

কাঁচাঘুম ভাঙলে কি যে খারাপ লাগে।

দুপুরে ঘুমের অভ্যাসটা বাদ দাও। হু-হু করে মোটা হয়ে যাবে। পাত্র জুটবে না।

চা খাবেন? চা করতে হবে?

না হবে না। ফ্ৰিজে ঠাণ্ডা কিছু আছে?

পানি আছে। পানি দিতে পারি।

তা-ই দাও।

জেরিন পানি আনল সঙ্গে একগ্লাস সরবত। দুটি হিমশীতল সন্দেশ এবং একটুকরো কেক।

ফ্রিজে যা পেয়েছি নিয়ে এসেছি। কেকটা বাসি। ওটা খাবেন না।

বাসি তো আনলে কেন?

প্লেটের শোভা বাড়াবার জন্যে। দুলাভাই, সরবত-টাবত খেয়ে রেস্ট নিন। আমি ঘুমুতে চললাম। সন্ধ্যাবেলা দেখা হবে।

সত্যি-সত্যি যাচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ সত্যি-সত্যি যাচ্ছি। আপনার ওপর দুটি দায়িত্ব কেউ কলিং বেল টিপলে দরজা খুলবেন। টেলিফোন এলে ধরবেন এবং বলবেনবাসায় কেউ নেই, সন্ধ্যার পর ফোন করুন।

আচ্ছা ঠিক আছে—তুমি যাও।

রেস্ট নিতে চাইলে রেস্ট নিতে পারেনবিছানা দেখিয়ে দিচ্ছি। আর যদি জেগে থাকতে চান কিছু ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন দিতে পরি। omni বলে একটা চমৎকার ম্যাগাজিন আছে। সায়েন্স ফিকশান ম্যাগাজিন।

কিছু লাগবে না।

বসে-বসে ধ্যান করবেন?

ঝিমুব। ঝিমুতে ইচ্ছে করছে। তুমি যাও, তোমাকে বসে থাকতে হবে না।

জেরিন গেল না। কোলের ওপর দুহাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। জেরিনের সঙ্গে তারিনের কোনো মিল নেই। দুজন সম্পূর্ণ দু রকম। তবুও এরা দুজন যে বোন তা যে-কেউ ধরতে পারবে। অতি সূক্ষ্ম সাদৃশ্য। তা-ও বা কী করে হয়, সূক্ষ্ম সাদৃশ্য হলে চট করে এরা যে দু বোন তা বলা যায় কি করে? জেরিনের মধ্যে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। সে খানিকটা অহংকারী। অহংকার তার চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। চার ভাইবোনের মধ্যে জেরিন সবচেয়ে মেধাবী। মেট্রিক থেকে শুরু করে অনার্স পর্যন্ত চোখ-ধাঁধানো রেজাল্ট করেছে। অনার্স প্রথম নিয়েছিল জিওগ্রাফিতে। সেটা বদলে নিয়েছে স্ট্যাটিসটিক্স। তা-ও নাকি কার ওপর রাগ করে। শুধুমাত্র দেখানোর জন্যে অঙ্কে মেয়েদের মাথা পুরুষদের চেয়ে খারাপ নয়। তা সে দেখিয়েছে।

কি ব্যাপার জেরিন ঘুমুতে যাচ্ছ না যে?

যাব খানিকটা ভদ্রতা করে নিই। আফটার অল বড় বোনের হাসব্যান্ড, অভদ্রতা করি কিভাবে? এ-বাড়ির জামাই।

জেরিন অল্প-অল্প পা দুলাচ্ছে। কাঠিন্য ও স্নিগ্ধতা মেশানো একটা মুখ দেখতে ভালো লাগে। আহসান বলল,

মারুফ আছে কেমন?

ভালো আছে বলেই তো মনে হয়। অবশ্যি আমি ঠিক বলতে পারব না। মা বলতে পারবেন। ওর দেখাশোনা মা করেন। আমার এত সময় নেই।

পড়াশোনা?

হুঁ। তাছাড়া আপনার পুত্র আমাকে দেখতে পারে না। ঐদিন ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমার কাছে এনে শুইয়েছি। মাঝরাতে একা-একা বালিশ নিয়ে উঠে চলে গেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমিও ছড়বার পাত্র না। আমি আবার তুলে নিয়ে এলাম। আবার ঘুম ভেঙে একা-একা চলে গেল।

তুমি কি করলে? আবার নিয়ে এলে?

ঠিক ধরেছেন। অন্য কেউ হলে এটা করত না, হাল ছেড়ে দিত। আমি এত সহজে হাল ছাড়ি না।

খুব ভালো গুণ।

ভালো মন্দ জানি না। আমি যেরকম সেরকম। সব মানুষই আলাদা। আপা ছিল আপার মতো। আমি হয়েছি আমার মতো।

ফিলসফি করছ?

ফিলসফি-টফি না। আমি এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আজকাল ভাবি।

প্রেমেট্রেমে পড়লে মেয়েরা এইসব ভাবে। ঘটেছে সেরকম কিছু?

না। সবাই কি আর আপা?

আহসান কাল তীক্ষ চোখে। জেরিন তার আপার প্রেমের প্রসঙ্গটি অত্যন্ত কঠিনভাবে মাঝেমধ্যে আনে। মনে হয় কোনো বিচিত্র কারণে এই বিষয়টি নিয়েই তারিনের ওপর তার চাপা রাগ আছে। যে-মেয়েটি বেঁচে নেই তার ওপর এতটা রাগ এখনো থাকা খুব অন্যায়।

দুলাভাই।

বল।

আমার মাঝে-মাঝে জানতে ইচ্ছে করে আপনাকে আপা এতটা পছন্দ করেছিল কেন? ভালো লাগার মতো সত্যি কি কিছু আছে আপনার মধ্যে?

না নেই।

আসলেই কিন্তু নেই। প্রাইভেট কলেজে মাস্টারি করেন। হেনতেন করে একটা সেকেন্ড ক্লাস পেলেই প্রাইভেট কলেজের মাস্টারি যোগাড় করা যায়। যায় না?

হ্যাঁ যায়।

আপনার চেহারা ভালো না। গান জানেন না, খেলাধুলা জানেন না। দরিদ্র পরিবারের ছেলে। ভুল বলছি?

না।

কি দিয়ে আপাকে ভুলিয়েছিলেন? কাইন্ডলি একটু বলুন শুনি। আমি প্রায়ই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব। জিজ্ঞেস করা হয় না। মনে থাকে না।

আহসান সিগারেট ধরাল। এক টুকরো সন্দেশ ভেঙে মুখে দিল। জেরিন নিচু গলায় বলতে লাগল, বড় আপা এবং আমি এক খাটে ঘুমুতাম। বুঝলেন দুলাভাই, আপনি সেই সময় বড় বড় চিঠি লিখতেন আপাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়তেই আপা অসংখ্যবার পড়া চিঠি আবার পড়তে বসত।

বুঝতে কী করে? তুমি তো ঘুমে।

না ঘুমে না। ঘুমের ভান। আপা সেই সব আজেবাজে চিঠি পড়ে খুব কাঁদত। এমন রাগ লাগত আমার।

আজেবাজে বলছ কেন?

আজেবাজে বলছি কারণ ঐসব চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি। নিতান্তই হালকা কথাবার্তা। বানানো সব ব্যাপার। আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম বিয়ের পর-পর আপা একটা। শক খাবে। দেখবে এইসব প্রেমট্রেমের ব্যাপারগুলো সত্যি না।

তোমার কি মনে হয় শক খেয়েছিল?

না বিয়ের পর আপা আরো অন্যরকম হয়ে গেল। যেন পৃথিবীতে আপনি ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই। আমি ভীষণ আহত হয়েছিলাম।

পাস্ট টেন্সে কথা বলছ, তার মানে কী এই যে এখন আহত হচ্ছ না?

এখনো হচ্ছি। হচ্ছি বলেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কি দিয়ে তাকে ভুলিয়েছিলেন?

কিছু দিয়েই তাকে ভুলাই নি। সে ভুলেছে নিজ গুণে।

আমারও তাই মনে হয়। আপা আপনাকে বিয়ে না করে যদি অন্য কাউকে বিয়ে হলেও একই অবস্থাই হত। তার চিন্তা-চেতনা জুড়ে থাকত ঐ লোকটি।

সেটা কি খুব খারাপ?

হ্যাঁ খারাপ। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব আইডেনটিটি থাকবে। মেয়ে মানেই কি লতানো গাছ? যে অন্য কাউকে না জড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না?

পারবে না কেন, নিশ্চয়ই পারবে। তুমি যে অন্তত পারবে এই সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।

ঠাট্টা করছেন?

না ঠাট্টা করছি না। তুমি খুবই স্পিরিটেড মেয়ে। তোমার এই স্পিরিট দেখতে ভালো লাগে।

আর আপার কোন জিনিসটা দেখতে ভালো লাগত?

আহসান উত্তর দিল না। জেরিন বলল, বলুন না শুনি। আচ্ছা ঠিক আছে উল্টোটা বলুন আপার কোন জিনিসটা আপনার খারাপ লাগত?

ঐ প্রসঙ্গ থাক। অন্য কিছ নিয়ে আলাপ করি শোন। তোমার ঘমের কি হল?

জেরিন জবাব দিল না। কি যেন সে ভাবছে। তার কপাল কুঁচকানো, মুখের ভাব চিন্তাক্লিষ্ট। গরমে নাক ঘেমেছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। তারিনেরও নাক ঘামত।

দুলাভাই।

বল।

আপনার সঙ্গে আমার একটি অত্যন্ত জরুরি কথা আছে।

এতক্ষণ যা বললে সেগুলো জরুরি নয়?

না নয়।

বেশ, বল শুনি।

বলছি–কিন্তু আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার জরুরি কথাটা বলা শেষ হবার পরেও আগে যেভাবে আসতেন এ-বাড়িতে ঠিক এইভাবেই আসবেন।

আহসান হাসিমুখে বলল, বেশ নাটকীয় ওপেনিং ব্যাপার কী বলত?

আপনার বাবা, আমার বাবাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠি পড়ে বাসার সবাই খুব মন খারাপ করেছে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করেছি আমি। আপনি বোধ। হয় জানেন না আমি কোনোদিন কাঁদি না, কিন্তু সেই চিঠি পড়ে খুব কেঁদেছি। কেঁদেছি কারণ আমার ধারণা ঐ চিঠি আপনি আপনার বাবাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। আপনার বাবা, সরি আমার বোধ হয় ভালই সাহেব বলা উচিত—নিজ থেকে এরকম একটা চিঠি লিখতে পারেন না।

চিঠিটা দেখি।

জেরিন ড়ুয়ার থেকে চিঠি বের করল, আহসানের হাতে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে। গেল। আহসানের অনেক সময় লাগল চিঠি শেষ করতে। তার বাবা কুতুবপুর এম. ই. হাই স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার জনাব নেছারউদ্দিন অত্যন্ত প্যাঁচল অক্ষরে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন—

॥ ইয়া রব ।।

প্রিয় বেয়াই সাহেব,

আসোলামু আলায়কুম। পর সমাচার এই যে, দীর্ঘদিন আপনার সঙ্গে পত্ৰ মারফত কোনো যোগাযোগ নাই। গত রমজানে আপনাকে একটি পত্ৰ দিয়াছিলাম সম্ভবত আপনার হস্তগত হয় নাই।

যাই হোক, একটি বিশেষ আবদার নিয়া আপনার নিকট এই পত্র প্রেরণ করিতেছি। আবদারটি আপনার তৃতীয় কন্যা জেরিন প্রসঙ্গে। এই অত্যন্ত সুলক্ষণা, বিদ্যাবতী ও গুণবতী কন্যাটির সঙ্গে আহসানের বিবাহ কি হইতে পারে না? যদি হয় তাহা হইলে মারুফ সম্পর্কে আমাদের সকলের সকল আশংকা দূর হয়। সৎ মার গৃহে শিশুদের কী অবস্থা হয় তা তো আপনার অজানা নাই। আমি নিজেও ভুক্তভোগী। মা জেরিনের সঙ্গে আহসানের বিবাহ দিতে পারিলে সব দিক নিশ্চিত হওয়া যায়। পত্র মারফত এইসব বিষয় আলোচনা করা সম্ভব না। বাধ্য হইয়া করিলাম। কারণ আমি বর্তমানে বাতব্যাধিতে শয্যাশায়ী। হাঁটাচলার সামর্থ্য নাই।

আপনি এই পত্রটি বেয়ান সাহেবকে দেখাইবেন। এবং তাঁহার সহিতও পরামর্শ করিবেন।

এই হচ্ছে চিঠি শুরুর প্রস্তাবনা। এরপরও নানান প্রসঙ্গ আছে। তাঁর অসুখের পূর্ণ বিবরণ আছে। কুতুবপুর এম. ই. স্কুল নিয়ে বর্তমানে যে পলিটিক্স চলছে এবং এই পলিটিক্সের ফলে যে স্কুলের অস্তিত্বই বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার বিশদ বিবরণ আছে। এই অবস্থায় কি করা উচিত বলে বেয়াই সাহেব মনে করেন?—এইসবও আছে।

আহসান চিঠিটি খামে ভরে টেবিলের ওপর রাখল। জেরিন চা নিয়ে ঢুকছে। শান্ত ভঙ্গিতে টি-পট থেকে চা ঢালছে।

দুলাভাই, মা ফিরেছে। আমাকে বলেছে আপনাকে যেন চলে যেতে না দিই। মা নামাজ পড়েই আসবে। চায়ে চিনি হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

এখন আপনাকে আরেক কাপ চা খেতে হবে বাবার সঙ্গে। তিনি চা-নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

তাহলে আর এখানে চা দিলে কেন?

আপনি সিগারেট ছাড়া চা খেতে পারেন না এই জন্যে।

জেরিন হাসল। হাসতে-হাসতে বলল, আজ রাতে তো আপনি থাকবেন এখানে তাই না?

তেমন কোনো কথা ছিল কি?

না ছিল না। কিন্তু আমি জানতাম আজ আপনি আসবেন এবং রাতে থেকে যাবেন। আমি মাকে সকালবেলাতেই বলে রেখেছি ভালোমতো বাজার করতে।

আজ কি কোন বিশেষ দিন?

জেরিন তীব্র গলায় বলল, কেন প্রিটেন্ড করছেন? আপনি ভালোই জানেন আজ কোন দিন। জানেন বলেই এসেছেন। গত দু মাসে কি একবারও এসেছেন এ-বাড়িতে?

আহসানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আজ এগারই শ্রাবণ। এই দিনে পাঁচ বছর আগে তারিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। বাসর হয়েছিল এ-বাড়িতেই। খুব ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিল বলে বর-কনেকে যেতে দেওয়া হয় নি।

জেরিন ঠাণ্ডা গলায় বলল, যান বাবা বসে আছে। দেখা করে আসুন।

আহসানের শ্বশুর ইমতিয়াজ সাহেব ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। কোন কিছুতেই উত্তেজিত না হওয়ার অসাধারণ গুণটি তিনি আয়ত্ত করেছেন। সারাজীবন জজিয়তি করে-করে কথা না বলে শুধু শুনে যাওয়ার বিষয়টিও তাঁর মজ্জাগত হয়েছে। অসম্ভব ভদ্রলোক। নিজের জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ও খুব লক্ষ রাখেন যেন কোথাও সৌজন্য এবং শিষ্টতা ক্ষুণ্ণ না হয়।

আহসানকে তিনি কখনো সহজভাবে নিতে পারেন নি। অবশ্যি তা বুঝতেও দেন নি; তবে এইসব ব্যাপারগুলি বোঝা যায়। আহসানের বুঝতে অসুবিধা হয় নি। নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে একবার সে তারিনকে বলেও ফেলল, তোমার বাবা আমাকে সহ্য করতে পারে না কেন বল তো?

তারিন খুবই স্বাভাবিকভাবে বলল, সবাই কি আর সবাইকে সহ্য করতে পারে? এমন যে মহাত্মা গান্ধী তাঁকেও তো অনেকে সহ্য করতে পারত না।

মহাত্মা গান্ধী অনেক বড় ব্যাপার। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁর কিছু যায় আসে না। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি আমার খারাপ লাগে।

আমারো লাগে কিন্তু কী আর করা।

না, করার কিছুই নেই। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি পথ আছে? আহসান মেনে নিয়েছিল। এ-বাড়িতে পা দিলে সে নিয়ম মাফিক কিছু সময় কাটাত ইমতিয়াজ সাহেবের সঙ্গে। ইমতিয়াজ সাহেব ন্যাশনাল জিওগ্রাফির পাতা বন্ধ করে অতি ভদ্ৰ স্বরে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে এক সময় ইতি টানতেন। সেই ইতি টানার ব্যাপারটিও রুচি সম্মত।

যাও তোমাকে আর আটকে রাখতে চাচ্ছি না। বড়ো মানুষদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো ভালো নয়—এতে মনের মধ্যে বুড়ো-বুড়ো ভাব ঢুকে যায়। যা মোটেই ডিজায়ারেবল নয়।

আহসান পাশের কামরায় ঢুকল। শ্বশুরের সঙ্গে তার কথাবার্তা হল মামুলি ধরনের। সে এদিকে তেমন আসে না কেন? ছেলেটি এখানে আছে সে কারণেও তো আসা উচিত। এবং ছেলেটিকে নিজের কাছে মাঝেমধ্যে রাখা উচিত।

কি বল আহসান, উচিত না?

একটু বড় হোক। তারপর মাঝেমধ্যে নিয়ে রাখব। এখন নিলে কাঁদবে।

কাঁদবে কেন? বাবার কাছে কি ছেলে কাঁদে? মোটেই কাঁদে না।

মোটই কাঁদে না কথাটা ঠিক না। আহসানের শাশুড়ি মারুফকে কোলে নিয়ে বারান্দায় আসতেই মারুফ তার বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সে এখানে আসবে না।

তোমাকে না দেখে দেখে এরকম হয়েছে।

আহসান কিছু বলল না। তার শাশুড়ি ছেলেকে তার কোলে দিতে চেষ্টা করতে লাগলেন। ছেলে কিছুতেই আসবে না। হাত-পা ছুঁড়ছে।

আহসান খানিকটা অপ্ৰস্তুত বোধ করছে। সে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে ভালো?

মারুফ পাথরের মতো মুখ করে রইল। আহসানের শাশুড়ি বললেন, খোকন তোমার পেঙ্গুইনের খেলনাটা বাপিকে দেখাবে না?

না।

দেখতে চাচ্ছে যে। আহসান তুমি পেঙ্গুইনের খেলনা দেখতে চাও। তাই না?

হ্যাঁ চাই।

খেলনাটা দেখার জন্য তোমার খুব লোভ হচ্ছে তাই না?

হ্যাঁ হচ্ছে।

এই জাতীয় কথাবার্তা দীর্ঘ সময় চালিয়ে যাওয়া খুবই বিরক্তির ব্যাপার। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে আহসান চালিয়ে যায়। মারুফের মুখের কাঠিন্য তাতে বিন্দুমাত্র কমে না। এতে আহসানের শাশুড়ি বেশ আনন্দ পান। আহসানের ধারণা ছেলে যদি কোন দিন তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে মনের কষ্টে তার শাশুড়ির হার্ট অ্যাটাক হবে।

আহসান বলল, এখন উঠব, আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে হবে, একজনকে দেখতে যাওয়ার কথা।

তার শাশুড়ি অবাক হয়ে বললেন, তা কী করে হয়? আজ রাতে তো তুমি এখানে থাকবে। জেরিন তোমার জন্যে সকাল বেলা বাজার করিয়েছে। রান্নাবান্না হচ্ছে।

আমাকে যেতেই হবে। আমার চেনা একজন মানুষ এ্যাকসিডেন্ট করেছে। হয়ত মারা যাবে।

আহসানের কথাগুলো খুব বিশ্বাসযোগ্য হল না। মনে হল সে বানিয়ে-বানিয়ে একটা অজুহাত তৈরি করছে। তাও খুব জোরাল অজুহাত নয়।

তার শ্বশুর গম্ভীর গলায় বললেন, ঠিক আছে তুমি হাসপাতালে যাও ভদ্রলোককে দেখে চলে আস। সেখানে নিশ্চয়ই তোমাকে সারারাত থাকতে হবে না।

না তা হবে না।

ভদ্রলোক কে?

আমার বাড়িওয়াল করিম সাহেব।

অসুখটা কি?

টেম্পোর সঙ্গে এ্যাকসিডেন্ট করেছেন।

ও আচ্ছা, যাও। চা খেয়ে যাও। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।

ভদ্রলোক একটা চুরুট ধরিয়ে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, তোমার বাবার শরীর কেমন? চিঠিপত্র পাও?

পাই। শরীর ভালোই সম্ভবত।

আমি অবশ্যি রিসেন্টলি একটি চিঠি পেয়েছি তাতে বাতে কষ্ট পাচ্ছেন বলে লিখেছেন। স্কুলেও কি সব ঝামেলা হচ্ছে।

আহসান অপেক্ষা করতে লাগল কখন জেরিনের প্রসঙ্গটি আসে। মনে হচ্ছে আসবে। না এলে চিঠির প্রসঙ্গ উনি আনতেন না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার প্রসঙ্গ উঠল না। উনি বৰ্ষার কথা নিয়ে এলেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে উনি জেরিনের প্রসঙ্গটি এনে ব্যাপারটা এখানেই মিটিয়ে দিতে চান। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় আনতে পারছেন না। আহসান বলল, আপনার সঙ্গে আমি একটি ব্যাপারে আলাপ করতে চাচ্ছিলাম।

কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি?

না তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।

তোমার শাশুড়িকেও ডাকি। ও বোধ হয় মারুফকে দুধ খাওয়াতে গেছে।

না ওনাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। করিম সাহেবের কথা বলছিলাম না আপনাকে আমার বাড়িওয়ালা।

হ্যাঁ বলছিলে।

ভদ্রলোকের খুব ইচ্ছা তাঁর মেয়েকে আমি বিয়ে করি। আমিও ভাবছিলাম–

গুড ভেরি গুড। মেয়ে তোমার পছন্দ হলে অফকোর্স করবে। তোমার সারা জীবন তো সামনেই পড়ে আছে। ইয়াংম্যান —

আহসানের মনে হল তাঁর শ্বশুরের বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। তিনি খুব হালকা বোধ করছেন। চট করে চমৎকার একটি মিথ্যা মাথায় আসায় ভালোই হয়েছে। ঐ চিঠির প্রসঙ্গ তিনি আর তুলবেন না।

আমি এখন উঠি?

ঘন্টা খানিকের মধ্যে চলে আসবে কিন্তু। খাবে এখানে।

ঠিক আছে।

এক কাজ কর না কেন? গাড়ি নিয়ে যাও। ড্রাইভার আছে।

না গাড়ি লাগবে না। মেডিক্যাল কলেজে যাব। কতক্ষণ থাকব কিছু ঠিক নেই।

আহসান উঠে দাঁড়াল।

বেশি দেরি করবেনা। এদিকে রেগুলার ছিনতাই-টিনতাই হচ্ছে। দেশে বাস করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

না দেরি করব না।

আহসানের শ্বশুর তাঁর সঙ্গে গেট পর্যন্ত এলেন। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না করিম সাহেবের মেয়েটি কি পড়ে দেখতে কেমন? এই অসম্ভব ভদ্র, সংস্কৃতিবান পরিবারটির কেউই তার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় না। একজন। একজন তারিন। আহসান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় ভিজিটারদের সংখ্যা অনেক বেশি। গিজগিজ করছে চারদিকে। ফিনাইলের কড়া গন্ধ, ওষুধের গন্ধ এবং রোগ গন্ধ। কিছুক্ষণ থাকলেই মাথা ভার-ভার হয়ে যায়। বমি-বমি লাগে তবু যদি কেউ বেশিক্ষণ থাকে তাহলে যেতে চায় না। এইসব গন্ধের কোনো একটিতে সম্ভবত এ্যাডিকসনের কিছু আছে। যা মানুষকে আটকে ফেলে। ভাবতে-ভাবতে আহসান এলোমলোভাবে খানিকক্ষণ করিডোর দিয়ে হাঁটল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে করিডোর পরিচ্ছন্ন। এত মানুষজন যাওয়া আসার মধ্যেও করিডোর পরিচ্ছন্ন আছে কী ভাবে তাও একটা রহস্য। বুডোমতো একজন হাতে এক ডজন কলা নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে এ-মাথা ও-মাথা করছে। সে আহসানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ডাক্তার সাব, চই নম্বর কোনখানে?

হাসপাতালের কাউকে জিজ্ঞেস করুন। আমিও একজনকে খুঁজছি।

বুড়ো আসতে লাগল তার সঙ্গে-সঙ্গে। ডাক্তারদের চেহারা কি অন্যদের থেকে আলাদা? তারিন হাসপাতালে থাকার সময়ও কয়েকবার অপরিচিত লোজন তাকে ডাক্তার ভেবেছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা অসম্ভব গম্ভীর থাকেন। অস্বাভাবিক একটি কাঠিন্য তাঁদের চোখে-মুখে মাখানো থাকে, তারও কি তাই?

বড়ো লোকটি গভীর আগ্রহে তাকে লক্ষ করছে। তার কলার কাঁদি থেকে একটি কলা ছিঁড়ে পড়ে গেছে। সেই কলাটি সে অন্য হাতে ধরে আছে। সে ভেবে পাচ্ছে না ডাক্তারের মতো এই লোকটি একবার সিঁড়ির এই মাথায় যাচ্ছে একবার অন্য মাথায় যাচ্ছে কেন? সে ভয়ে-ভয়ে ডাকল, ডাক্তার সাব।

আমি ডাক্তার না। আপনাকে তো আগে একবার বলেছি। আর শুনুন, আপনি আমার পিছনে পিছনে হাঁটছেন কেন?

বুড়ো লোকটির কলার কাঁদি থেকে আরো একটি কলা ছিঁড়ে পড়ে গেল। সে কলাটি কুড়িয়ে ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে দূরে সরে গেল। বড় মায়া লাগল আহসানের। মায়া ব্যাপারটি বেশ অদ্ভুত। হঠাৎ তেমন কোনো কারণ ছাড়াই কঠিন হৃদয় মানুষের মধ্যে এটা জেগে ওঠে তাকে অভিভূত করে দেয়। রিনের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ও ঐ মায়া নামক ব্যাপারটি কাজ করেছে।

সেই বিকেলে তার কিছু করার ছিল না। কিছু করার না থাকলে শুধু হাঁটতে ইচ্ছে করে। সে প্রায় সারা বিকেল হেঁটে ক্লান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দিকে এল। ভ্যাপসা গরম। গায়ে ঘাম চটচট করছে। অসম্ভব তৃষ্ণা পেয়েছে। বার-বার মনে হচ্ছে শহরের জায়গায়-জায়গায় হাইড্রেন্ট থাকলে বেশ হত। তৃষ্ণার্ত ক্লান্ত পথচারী হাইড্রেন্ট খুলে চোখে-মুখে পানি দিত, আঁজলা ভর্তি পানি পান করত।

বাংলা একাডেমীতে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। রবীন্দ্র বা নজরুল এই দুজনের কোনো জয়ন্তী-টয়ন্তী হবে। হয়ত এই গরমে অনুষ্ঠান ঠিক জমছে না। যত লোক যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে আসছে। আইসক্রিমওয়ালারা ঘন্টা বাজিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কামড়ে-কামড়ে আইসক্রিম খাবার মতো বাজে জিনিস আর কিছুই নেই। তবু আহসান একটি আইসক্রিম কিনল আর ঠিক তখন ছ-সাত বছরের টোকাই শ্রেণীর একটি বালিকা তার ভাইকে কোলে নিয়ে আহসানের পাশে এসে দাঁড়াল। কড়া একটা ধমক দিতে গিয়েও ধমক দেওয়া গেল না। বালিকার চোখ দুটি অসম্ভব কোমল। আহসান আইসক্রিমওয়ালাকে বলল, এদের দুজনকে দুটি আইসক্রিম দাও।

কত দামের?

আমারটা যেমন সেরকম। আমারটার দাম কত?

আট টাকা।

আট টাকা। বল কি? আইসক্রিমের এত দাম নাকি?

চকবারের দাম বেশি।

দাও ওদের তাই দাও।

আইসক্রিমওয়ালা গম্ভীর মুখে দুটি আইসক্রিম বের করল। তখন গুটি-গুটি আর একটি বালক এসে উপস্থিত। কোমল চোখের মেয়েটি বলল, এ আমার ভাই।

দাও এর ভাইকেও একটা দাও।

আইসক্রিমওয়ালা বিরক্ত গলায় বলল, অত দিয়ে পার পাইতেন না—দুনিয়ার ফকির আইয়া বেড় দিব।

বাচ্চা তিনটি গভীর আগ্রহে আইসক্রিম খাচ্ছে। ঘোট ঘোট টুকরো ভেঙে মুখে দিচ্ছে। আহসান বলল, কি রে তোদর নাম কি? বড় মেয়েটি হেসে ফেলল। যেন অদ্ভুত কথা এই জন্মে শোনে নি। তাকে হাসতে দেখে অন্য দুজনও হাসতে লাগল।

হাসছিস কেন রে শুধু-শুধু?

এতে তাদের হাসি আরো বেড়ে গেল। আহসান লক্ষ করল শুধু এরাই হাসছে না। হাসিমুখে আর একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে। লম্বা, রোগা একটি মেয়ে। বালিকাদের মতো নিগ্ধ মুখ। অনেকদিনের চেনা মেয়ের মতো সে বলল, এদের সঙ্গে আপনার দেখি খুব ভাব হয়ে গেছে।

আহসান কি বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আপনি কি প্রায়ই এরকম করেন?

না।

আমার নাম তারিন, আমার বান্ধবীর আজ এখানে গান গাওয়ার কথা। সে আসে নি। কি কাণ্ড দেখুন না। অথচ আমি তার জন্যেই এসেছি।

কত সহজ কত স্পষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলছে মেয়েটি। কোনো রকম জড়তা নেই, দ্বিধা নেই।

আহসান খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনি কি আমাদের সঙ্গে একটা আইসক্রিম খাবেন? মেয়েটি হাসতে-হাসতে বলল, জ্বি না। আমার টনসিলের সমস্যা আছে ঠাণ্ডা লাগলেই কথা বন্ধ হয়ে যায়।

পরবর্তী সময়ে আহসান যখন জিজ্ঞেস করেছে—একজন সম্পূর্ণ অচেনা একটি ছেলের সঙ্গে এতগুলো কথা তুমি ঐদিন কিভাবে বললে? তারিন ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেছে—জানি না। কিভাবে বললাম। আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তাই বলেছি। তুমি এত আন্তরিকভাবে ঐ বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলছিলে দেখে আমার খুব মায়া লাগল। তোমার ওপর মায়া পড়ে গেল।

এখন এই বড়ো লোকটির ওপর মায়া পড়ে গেছে। কলা হাতে নিয়ে কেমন। জবুথবু দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। সে বোঘ হয় পুরো ঠিকানা নিয়ে আসে নি। আহসান এগিয়ে গেল।

আসুন, আপনার রুগী কোথায় বের করে দিচ্ছি। রুগীর নাম কি?

মোহাম্মদ ওসমান আলি।

কী হয় আপনার?

আমার আপন ভাইস্তা। আদমজী মিলে কাম করে।

কি কলা কিনেছেন সব তো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। দিন আমার কাছে কয়েকটা দিন।

বুড়ো, এই মানুষটির ভদ্রতায় অভিভূত হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *