নুরুল ইসলাম টেবিলে বল পয়েন্ট কলমটা অন্যমনস্কভাবে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, ঈশিতা।
বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা ঈশিতা বলল, বলেন।
বিকেলটা ফ্রি রেখো।
কেন?
তোমাকে এনডেভারের অফিসে যেতে হবে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
কেন?
নুরুল ইসলাম দেশের জনপ্রিয় একটা পত্রিকার সম্পাদক, পত্রিকা কীভাবে চালাতে হয়, সেটা খুব ভালো জানেন কি না, সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারে কিন্তু ব্যবসা জানেন কি না, সেটা নিয়ে কেউ সন্দেহ করে না। টেলিফোন কোম্পানির ওপর কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হওয়ার পর থেকে কোম্পানিগুলো তার পত্রিকায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়। কৃতজ্ঞতাবশত, নুরুল ইসলামও তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বন্ধ রেখেছেন। এ মুহূর্তে তাঁর পত্রিকায় ব্যাংকগুলো নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হচ্ছে। তিনি ব্যাংকের জিএমদের কাছ থেকে ফোন পেতে শুরু করেছেন, মনে হচ্ছে তাদের থেকেও নিয়মিত বিজ্ঞাপন আসতে থাকবে। নুরুল ইসলাম ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, এনডেভারের সিইওর একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে।
ঈশিতা বলল, সেটা বুঝেছি, কিন্তু আমি কেন? আরও সিনিয়র রিপোর্টাররা আছেন।
তিনটা কারণ। প্রথম কারণ হচ্ছে, তুমি ভালো ইংরেজি জান। শুদ্ধ বিদেশি অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলতে পার। বিদেশিদের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য এ রকম রিপোর্টার দরকার। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এনডেভার একটা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি। তাদের কী প্রশ্ন করতে হয়, সেগুলো সিনিয়র সাংবাদিকেরা জানে না, তোমরা জান। তৃতীয় কারণটা বলা যাবে না। যদি বলি, তাহলে নারীবাদী সংগঠনগুলো আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
ঈশিতা হেসে ফেলল, তার মানে তিনটা কারণের মধ্যে তৃতীয় কারণটাই ইম্পরট্যান্ট! অন্যগুলো এমনি এমনি বলেছেন। তাই না?
সবগুলোই ইম্পরট্যান্ট। নুরুল ইসলাম হাসার ভঙ্গি করে বললেন, এনডেভার দেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। পৃথিবীর একটা জায়ান্ট কম্পিউটার কোম্পানি। কাজেই যত্ন করে ওদের ইন্টারভিউ নেবে।
যত্ন করে?
হ্যাঁ। মানে বুঝেছ তো? ঘটাবে না। এরা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশের বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। একটা সময় ছিল, যখন এসব কোম্পানিকে গালাগাল করা ছিল ফ্যাশন। এখন হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ। এখন এদের তোষামোদ করা হচ্ছে ফ্যাশন!
তার মানে এদের তোষামোদ করে আসব?
না। আমি সেটা বলছি না। তোষামোদ করবে না, কিন্তু কথা বলবে একটা পজিটিভ ভঙ্গিতে। এদের ঘটাবে না, বিরক্ত করবে না। ওদের সঙ্গে পজিটিভ ভাবে কী বলা যায়, জেনে আসবে।।
যদি পজিটিভ কিছু না পাই, তবুও–
নুরুল ইসলাম আবার হাসির ভঙ্গি করলেন। বললেন, আগে থেকে কেন সেটা ধরে নিচ্ছ, গিয়ে দেখো।
ঈশিতা যখন নুরুল ইসলামের অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন তাকে বললেন, আর শোনো, বিদেশিরা সময় নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে। পাঁচটায় সময় দিয়েছে, তুমি ঠিক পাঁচটার সময় হাজির হবে, এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও না। বুঝেছ?
বুঝেছি।
যারা পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে পারে, তারা এই দেশের একটা পত্রিকাকে অনেক টাকার বিজ্ঞাপন দিতে পারে!
ঈশিতা নুরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। খবরের কাগজ আসলে খবরের জন্য নয়, খবরের কাগজ এখন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সেটা নিয়ে একসময় তর্কবিতর্ক করা যেত, ইদানীং সেটাও করা যায় না।
নুরুল ইসলামের কথামতো কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় ঈশিতা এনডেভারের অফিসে এসে হাজির হয়েছে। কাজটা খুব সহজ হয়নি, ট্রাফিক জ্যামের কারণে কেউ আজকাল ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় যেতে পারে না। ঈশিতা মোটরসাইকেল চালিয়ে যায় বলে সে মোটামুটি ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতে পারে, তার পরও আজ সে ঝুঁকি নেয়নি। অনেক আগে রওনা দিয়ে অনেক আগে পৌঁছে গেছে। বাড়তি সময়টা কাটাতে তার রীতিমতো কষ্ট হয়েছে। মোটরসাইকেলে ঘোরাফেরা করা শার্টপ্যান্ট পরে থাকা মেয়েদের নিয়ে সবারই এক ধরনের কৌতূহল।জামি ক্যামেরাটা থাকায় একটু সুবিধে, সাংবাদিক হিসেবে মেনে নেয়। প্রয়োজন না থাকলেও সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে খ্যাচ-খ্যাচ করে ছবি তুলে নেয়, লোকজন তখন তাকে একটু সমীহ করে। ডিজিটাল ক্যামেরা, আজকাল ছবি তুলতে এক পয়সাও খরচ হয় না।
ঈশিতা অবশ্যি তার এত দামি ক্যামেরাটা নিয়ে ভেতরে যেতে পারল না, গেটের সিকিউরিটির মানুষটি একটা টোকেন দিয়ে ক্যামেরাটা রেখে দিল, যাওয়ার সময় ফেরত দেবে। ঈশিতাকে বলল, এনডেভারের অফিসের ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। ক্যামেরাটা প্রায় জোর করে রেখে দেওয়ার সময়ই ঈশিতার মেজাজটা একটু খিচে ছিল, ভেতরে গিয়ে ওয়েটিং রুমে যখন টানা কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করতে হলো, তখন তার মেজাজ আরও একটু খারাপ হলো। শেষ পর্যন্ত যখন তার অফিসের ভেতর ডাক পড়েছে, তখন সে ভেতরে ভেতরে তেতে আছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সে অবশ্যি বেশ অবাক হয়ে যায়—অফিস বলতেই যে রকম চোখের সামনে বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদি আঁটা চেয়ার, ফাইল কেবিনেট, কম্পিউটারের ছবি ভেসে ওঠে, এখানে সে রকম কিছু নেই। চৌদ্দতলায় এক পাশে ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত কাচের দেয়াল দিয়ে বহুঁ দূর দেখা যায়। ঈশিতা একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, যদিও এলাকাটি শহরের মোটামুটি দরিদ্র এলাকা কিন্তু এত ওপর থেকে দেখলে সেটি বোঝা যায় না। এই দেশে অনেক গাছ, মনে হয় গভীর মমতায় সেই গাছগুলো দারিদ্রকে ঢেকে রাখে। ঘরের অন্যপাশে দেয়ালে সারি সারি ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি। এক ঘরে এতগুলো টিভি কেন, কে জানে। প্রত্যেকটা টিভিতেই নিঃশব্দে কিছু একটা চলছে। মেঝেটিতে ধবধবে সাদা টাইল এবং কুচকুচে কালো কিছু ফার্নিচার। যে ইন্টেরিওর ডেকোরেটর ঘরটিকে সাজিয়েছে, তার রুচিবোেধ আধুনিক এবং তীব্র।
কাচের দেয়ালের সামনে একজন বিদেশি মানুষ দাঁড়িয়েছিল, ঈশিতার পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাল এবং এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ঈশিটা?
ঈশিতা ইংরেজিতে বলল, আসলে ঈশিতা। কিন্তু তুমি যেহেতু ত এবং ট আলাদাভাবে শুনতে পাও না বা উচ্চারণ করতে পার না, এতেই চলে যাবে।
মানুষটা কেমন যেন অবাক হলো, শুধু অবাক নয়, মনে হলো কেমন যেন একটু ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। কেউ তার ভুল ধরিয়ে দেবে, সে মনে হয় এই। ব্যাপারটায় অভ্যস্ত নয়। বলল, তুমি বলতে চাইছ ট উচ্চারণটি দুই রকম? কী আশ্চর্য! আমি এত দিন এই দেশে আছি, কেউ আমাকে এটা বলেনি!
ঈশিতা বলল, প্রয়োজন হয়নি। কিংবা তোমার মুখে এই উচ্চারণটিই হয়তো সবাই পছন্দ করে।
মানুষটা ঈশিতাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসায়। চেয়ারের সামনে একটি টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে আরেকটি চেয়ারে বসে বলল, বলো, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?
ঈশিতা বলল, বব লাস্কি, আমাকে পাঠানো হয়েছে, তোমার একটি ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য। তোমরা এই দেশে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে যাচ্ছ। কাজেই আমরা তোমাদের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই।
বব লাস্কি চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমরা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার। সাদা ভাষায় তোমরা কম্পিউটার বলতে যা বোঝাও, সেই কম্পিউটার না। আমরা বিশেষ কাজ মাথায় রেখে কম্পিউটার তৈরি করি। এক ধরনের সুপার কম্পিউটার। আর্কিটেকচার সম্পূর্ণ আলাদা, নিউরাল নেটওয়ার্ক–
ঈশিতা ইতস্তত করে বব লাস্কিকে থামিয়ে বলল, আমি গত বিশ মিনিট তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডেস্কে রাখা কাগজপত্র থেকে এগুলো জেনে গেছি। আমি আসলে তোমার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু জানতে চাই।
বব লাস্কির মুখ কঠিন হয়ে উঠল, ঈশিতা মোটামুটি স্পষ্ট ভাষায় তাকে জানিয়ে দিয়েছে, তুমি আমাকে বাইরে বিশ মিনিট অপেক্ষা করিয়েছ। এই মানুষটি এটিও পছন্দ করেনি, স্বাভাবিক ভদ্রতা দাবি করে এখন সে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। বব লাস্কি দুঃখ প্রকাশ করল না। বলল, তুমি আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কী জানতে চাও?
বাংলাদেশে কেন?
বব লাস্কি সরু চোখে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। নিউরাল নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার ব্যবহার করে বিশেষ ধরনের কাজ করার উপযোগী সুপার কম্পিউটার তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ যে সঠিক দেশ নয়, সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি চালাক-চতুর হতে হয় না। কাজেই ঈশিতার প্রশ্নটা এমন কোনো দুর্বোধ্য প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু বব লাস্কি ভান করল, প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি। বলল, আমি তোমার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারিনি।
ট্রপিক্যাল ডিজিজ গবেষণার জন্য বাংলাদেশ চমৎকার একটি দেশ হতে পারে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও এটা চমৎকার জায়গা। জাহাজশিল্প কিংবা ফুড প্রসেসিংও হতে পারে। কিন্তু সুপার কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারিং? বাংলাদেশে? কেন? কীভাবে?
বব লাস্কি এবার খুব হিসাব করে কথার উত্তর দিল। বলল, তোমার দেশে এক শ পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ, সারা পৃথিবীর সব মানুষের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। মানুষের বুদ্ধিমত্তা পৃথিবীতে সমানভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কাজেই তোমাদের দেশে অসংখ্য মেধাবী ছেলেমেয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া এই ছেলেমেয়েগুলোকে আমরা ব্যবহার করতে চাই। তাদের নিয়ে নিউরাল নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচারের বিশ্বমানের গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে চাই।
ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, আমিও ঠিক এটা ভেবেছিলাম। কিন্তু—
কিন্তু?
তোমরা এখানে আছ এক বছর থেকে বেশি সময়, রেকর্ড টাইমে চৌদ্দতলা এই বিশাল বিল্ডিং তৈরি করেছ, কিন্তু এখন পর্যন্ত এই দেশের কোনো ছেলে বা মেয়েকে নিয়োগ দাওনি।
বব লাস্কির মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে যায়, শীতল গলায় বলে, নিয়োগ দেওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি।
সম্ভবত। ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, আমার আরেকটা প্রশ্ন। তোমাদের এই বিশাল বিল্ডিংটা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারের ল্যাবরেটরির মতো না। এটা অনেকটা হাসপাতালের মতো। কারণ কী?
তুমি কেমন করে জান? সিকিউরিটির কারণে বাইরের কেউ এখানে ঢুকতে পারে না। তোমাকেও নিশ্চয়ই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একটা বিল্ডিংকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার কথা নয়, এটা হাসপাতাল, না ক্যাসিনো! তোমার কেন ধারণা হলো, এটা হাসপাতালের মতো?
ঈশিতা বলল, আমাকে যখন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়, তখন সেখানে যাওয়ার আগে আমি খুব ভালো করে হোমওয়ার্ক করে আসার চেষ্টা করি। এবার সময় বেশি পাইনি, তাই হোমওয়ার্কটা শেষ করতে পারিনি, যেটুকু পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে—
বব লাস্কি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার হোমওয়ার্ক ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে।
অসম্পূর্ণ বলতে পার, কিন্তু ভুল বলাটা ঠিক হবে না। আমি কীভাবে হোমওয়ার্কটা করার চেষ্টা করেছি, শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে।
কীভাবে করেছ?
যে কন্ট্রাক্টর তোমার বিল্ডিংটা তৈরি করেছে, তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই বিল্ডিংয়ের একটা ফিচার হচ্ছে অক্সিজেনের লাইন। শুধু হাসপাতালে ঘরে ঘরে অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে হয়! সে জন্য অনুমান করেছি–
তোমার অনুমান ভুল। বব লাস্কি অনেক চেষ্টা করেও তার গলার স্বরে ক্রোধটাকে লুকিয়ে রাখতে পারল না, হিংস্র গলায় বলল, কন্ট্রাক্টরের এসব কথা বলা হচ্ছে সম্পূর্ণ অনুচিত এবং বেআইনি। আমাদের দেশ হলে সে। পুরোপুরি ফেঁসে যেত।
ঈশিতা বব লাস্কির মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা পুরোপুরি উপভোগ করতে শুরু করে। মুখের হাসিটা আরও একটু বিস্তৃত করে বলল, শুধু কন্ট্রাক্টর নয়, কাস্টমসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তোমাদের এই বিল্ডিংয়ে কনটেইনার বোঝাই মেডিকেল ইকুইপমেন্ট আসছে। দামি দামি ইকুইপমেন্ট। এই দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালও যে ইকুইপমেন্ট আনার কথা চিন্তাও করতে পারে না, তোমরা সেই ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসেছ। কেন?
বব লাস্কি অনেকক্ষণ শীতল চোখে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে বাধ্য নই। তুমি আমার কাছে যে বিষয়গুলো জানতে চাইছ, সেই জিনিসগুলো তোমার জিজ্ঞাসা করার কথা নয়। পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশ হলে—
ঈশিতার মাথায় রক্ত উঠে গেল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, সভ্যতার কথা থাক। আমি তোমার সঙ্গে সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমি কখনোই একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিক্রেতার কাছে যাব না। অন্য কোথাও যাব।
ঈশিতা বুঝে গেল, এটি হচ্ছে বেল্টের নিচে আঘাত। এই আঘাতের পর ইন্টারভিউ চলার কথা নয়; এবং সত্যি সত্যি আর চলল না। বব লাস্কি উঠে দাঁড়াল। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, তুমি এখন বিদায় হও।
ঈশিতাও উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে কাগজগুলো তুলতে তুলতে বলল, বাংলাদেশে গত কিছুদিনে অসাধারণ দুটি ব্যাপার ঘটেছে, একটা হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন। এই দেশে এখন সরকার যেকোনো তথ্য দিতে বাধ্য। আমাদের মতো সাংবাদিকদের ভারি মজা এখন পুলিশ বলো, কাস্টমস বলো, সবার কাছ থেকে খবর বের করতে পারি। দ্বিতীয়টা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। না বুঝে এই দেশের মানুষ এখন ভয়ংকর ভয়ংকর খবর ইন্টারনেটে দিয়ে রাখে!
বব লাস্কি কিছু বলল না। ঈশিতা হেঁটে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার কেন ডিভোর্স হয়েছে, সেটাও–
বব লাস্কি চিৎকার করে বলল, তুমি কেমন করে জান?
জানতাম না। এখন জানলাম। ঈশিতা মিষ্টি করে হাসে, সাংবাদিকেরা অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য জানে। শুধু শুধু!
মোটরসাইকেলটা চালিয়ে ঈশিতা যখন তার অফিসে ফিরে আসছে, তখন সে বুঝতে পারল, কাজটা ভালো হলো না। সম্পাদক নুরুল ইসলাম বারবার করে বলে দিয়েছেন, এদের ঘাটাবে না, বিরক্ত করবে না। দরকার হলে তোষামোদ করবে। অথচ সে ঠিক উল্টো কাজটা করে এসেছে। বব লাস্কিকে ঘটিয়েছে, বিরক্ত করেছে, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করেছে, ভয় দেখিয়েছে, অপমান করেছে। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে টিটকারি মেরেছে। সে এইটুকুন পুচকে একটা মেয়ে, কেন তার মাথায় এ রকম দুর্বুদ্ধি হলো? চাকরিটা মনে হয় গেল।
রাত এগারোটার সময় ঈশিতা নুরুল ইসলামের টেলিফোন পেল। তিনি হিমশীতল গলায় বললেন, ঈশিতা, তুমি কোথায়?
ঈশিতা মেয়েদের একটা হোস্টেলে থাকে। সে বলল, হোস্টেলে।
হোস্টেলটা কোথায়?
মণিপুরী পাড়ায়।
তোমার একটু অফিসে আসতে হবে।
ঈশিতা একটু অবাক হয়ে বলল, এখন?
কেন? সমস্যা আছে?
না, নেই। গাড়ি পাঠাব?
ঈশিতা বলল, না, গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি আসছি। পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাব।
আমার ব ঈশিতা টেলিফোন রেখে দিচ্ছিল। তখন নুরুল ইসলাম বললেন, আর শোনো–
বলুন।
আজকের অ্যাসাইনমেন্টের কাজ কোথায় করছ?
আমার ল্যাপটপে।
ল্যাপটপটা নিয়ে এসো। যদি কোনো কাগজে নোট নিয়ে থাক, তাহলে কাগজগুলোও নিয়ে এসো। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
রাত এগারোটায় রাস্তাঘাট ফাঁকা, ঈশিতা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোটরসাইকেলে খবরের কাগজের অফিসে পৌঁছে গেল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যেত, কয়েক মিনিট দেরি হলো। সে মেয়েদের যে হোস্টেলে থাকে, তার কিছু নিয়মকানুন আছে। এত রাতে কেন বের হচ্ছে, সেগুলো দারোয়ান আর সুপারকে বোঝাতে তার কিছু বাড়তি সময় লেগেছে।–খবরের কাগজের অফিস ভোরবেলা ঢিলেঢালাভাবে শুরু হয়, রাতের দিকে সেটা রীতিমতো জমজমাট থাকে। রাত গভীর হওয়ার পর সেটা আবার ফাঁকা হতে শুরু করে। ঈশিতা যখন অফিসে পৌঁছেছে, তখন সেটা ফাঁকা হতে শুরু করেছে। নুরুল ইসলামের অফিস তিনতলায়, লিফটে করে উঠে করিডর ধরে তার অফিসে যেতে যেতে সে দেখতে পেল, তার অফিসে দুজন মানুষ বসে আছে।
দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে ঈশিতা বলল, আসব?
এসো। নুরুল ইসলাম একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসো।
ঈশিতা ল্যাপটপটা টেবিলে রেখে চেয়ারটায় বসে। সাধারণ সামাজিক নিয়মে এখন নুরুল ইসলামের এই দুজন লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন না, চুপচাপ বসে রইলেন। মানুষ দুজন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন মধ্যবয়স্ক, অন্যজনের বয়স একটু কম। দুজনেই হাস্যকর এক ধরনের সাফারি কোট পরে আছে। এই পোশাকটি কে আবিষ্কার করেছে, আর বাংলাদেশের মানুষ কেন এটি পরে, বিষয়টি ঈশিতা কখনোই ভালো করে বুঝতে পারেনি। মানুষ দুজনের চুল ছোট করে ছাঁটা, পেটা শরীর, মুখে এক ধরনের কাঠিন্য।
ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নুরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে ডেকেছেন!
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, আসলে আমরা ডাকিয়েছি।
ঈশিতা এবার ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল। মানুষটি বলল, বাংলাদেশে কত দিন থেকে ক্রসফায়ারে মানুষ মারা হচ্ছে, আপনি জানেন?
ঈশিতা প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠল। ইতস্তত করে বলল, সব মিলিয়ে বছর দশেক হবে।
কত মানুষকে মারা হয়েছে?
কয়েক হাজার।
আমাদের সংবিধান কি এই মার্ডারকে অ্যালাও করে?
না।
এটা নিয়ে কি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে? হিউম্যান রাইটস গ্রুপ কি চেঁচামেচি করেছে?
হ্যাঁ, করেছে।
কোনো লাভ হয়েছে?
ঈশিতা বলল, না, হয়নি।
তার মানে কি আপনি জানেন?
ঈশিতা দুর্বল গলায় বলল, না, জানি না।
তার মানে হচ্ছে, পৃথিবীর সব দেশে দেশের আইন মানার প্রয়োজন হয়, সে রকম একটা বাহিনী থাকে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য তারা দ্রুত ডিসিশন নিতে পারে। দ্রুত সেই ডিসিশন কার্যকর করতে পারে।
মানে মানুষ মার্ডার করতে পারে?
আরও অনেক কিছু করতে পারে।
ঈশিতা জিব দিয়ে তার শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে বলল, আপনারা গভীর রাতে ডেকে এনে আমাকে এসব বলছেন কেন? আপনারা কারা?
মানুষটা এবার ঈশিতার দিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করল এবং ঈশিতা তখন বুঝতে পারল, এই মানুষটি আসলে ভয়ংকর একটি মানুষ। মানুষটি তার কালচে জিবটা বের করে ওপরের ঠোঁটটা চেটে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, শোনো মেয়ে, এখন আসল কথায় চলে আসি। মানুষটি এতক্ষণ আপনি করে কথা বলছিল, এখন তুমিতে নেমে এসেছে—আমাদের কেউ প্রশ্ন করে না, দরকার হলে আমরা প্রশ্ন করি। বুঝেছ?
ঈশিতা কথা না বলে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটি বলল, কাজেই আমি কে, কী করি, কেন এসেছি, জানতে চেয়ো না। ঠিক আছে?
ঈশিতা মাথা নাড়ল, না, ঠিক নেই।
মানুষটা এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, বিষয়টা ঠিক আছে কি নেই, সেটা তুমি খুব সহজে পরীক্ষা করে দেখতে পার। তুমি যদি চাও, আমরা তোমাকে এখন তুলে নেব, ভোর রাতে মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে ফেলে যাব। একটু সুস্থ হয়ে তুমি পুলিশে কেস করার চেষ্টা করবে। তুমি দেখবে যে পুলিশ তোমার কেস নিচ্ছে না। খুব বেশি হলে পত্রপত্রিকায় একটু লেখালেখি করাতে পারবে কিন্তু দেখবে তার পরও কিছুই করতে পারবে না। চ্যালেঞ্জটা নিতে চাও?
ঈশিতা মাথা নেড়ে জানাল, সে নিতে চায় না। মানুষটা বলল, গুড। টেবিলে ল্যাপটপটা দেখিলে বলল, এটা তোমার?
হ্যাঁ।
এনডেভারের ওপর যে রিপোর্টটা লিখছ, সেটা এখানে আছে?
হ্যাঁ।
হ্যাঁ।
কাগজগুলো?
এই ব্যাগটাতেই আছে।
গুড। মানুষটি ব্যাগসহ ল্যাপটপটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, আমি এটা নিতে এসেছি।
ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, নিতে এসেছেন? আমার ল্যাপটপ?
হ্যাঁ। তোমার এডিটর সাহেবকে বলব দরকার হলে তোমাকে আরেকটা ল্যাপটপ কিনে দিতে।
মানুষ দুজন উঠে দাঁড়াল, দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে মধ্যবয়স্ক মানুষটি দাঁড়িয়ে যায়। ঘুরে নুরুল ইসলাম আর ঈশিতা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, আরও একটা কথা। এনডেভার নিয়ে যদি তোমরা বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখাও, তাহলে—কথা শেষ না করে সে হাত দিয়ে গলায় পোচ দেওয়ার ভঙ্গি করল।
মানুষ দুজন ভারী জুতোর শব্দ তুলে করিডর ধরে হেঁটে চলে গেল। লোকগুলো চোখের আড়াল হওয়ার পর ঈশিতা হতবাক হয়ে বলল, মগের মুল্লুক? আমার ল্যাপটপটা নিয়ে চলে গেল?
নুরুল ইসলাম নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ল্যাপটপ! শোনো ঈশিতা, খুব অল্পের ওপর দিয়ে গিয়েছে।
অল্পের ওপর দিয়ে?
হ্যাঁ।
এরা কারা?
নুরুল ইসলাম ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, জিজ্ঞেস কোরো না।
এনডেভারের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক।
এনডেভারের নাম মুখেও আনবে না।
ঈশিতা ইতস্তত করে বলল, আজকে এনডেভারের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে, আপনি শুনতে চান?
নুরুল ইসলামের মুখে আতঙ্ক এসে ভর করল, না, শুনতে চাই না। এনভেডার নিয়ে কী লিখতে হবে, তার একটা রিপোর্ট দিয়ে গেছে।
সেটা কোথায়?
নুরুল ইসলাম টেবিলের ওপর থেকে একটি কাগজ হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলেন। ঈশিতা কয়েক লাইন পড়ে নুরুল ইসলামের কাছে ফিরিয়ে দিল। বিশ্বের সেরা কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণদের সমন্বয়ে কীভাবে ভবিষ্যতের নিউরাল কম্পিউটার গড়ে তুলবে, তার আকর্ষণীয় একটি বর্ণনা আছে। একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের কী ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে এবং সেই দায়বদ্ধতার কারণে তারা এই দেশের দুস্থ শিশুদের স্বাস্থ্যশিক্ষা আর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কী কী কাজ করেছে, তার একটি বিশাল বর্ণনা আছে। ঠিক কী কারণ, জানা নেই। ঈশিতা তার একটি কথাও বিশ্বাস করল না।
গভীর রাতে ঈশিতা যখন অফিস থেকে বের হয়ে নিজের মোটরসাইকেলে উঠেছে, সে টের পেল দূরে একটি গাড়ির হেড লাইট জ্বলে উঠেছে। যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন দেখতে পেল, গাড়িটি একটি দূরত্ব রেখে তার পেছনে পেছনে আসছে।
গাড়িটা কিছুই করল না। শুধু তার পেছনে পেছনে হোস্টেল পর্যন্ত এল, যখন সে ভেতরে ঢুকে গেল, গাড়িটা কিছুক্ষণ বাসার সামনে অপেক্ষা করে চলে গেল।
এরা কারা, ঈশিতা জানে না। কিন্তু এদের কাজকর্মে কোনো গোপনীয়তা নেই, কোনো লুকোছাপা নেই। এরা কাউকে ভয় পায় না। এই দেশে তাদের জন্য কোনো আইন নেই।